যখন আমি ক্লাশ থ্রীতে পড়ি তখন একদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি তার মাঝখানে আস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে একটা বিজ্ঞাপন। কাগজে বিশাল একটা বোতলের ছবি তার উপড়ে বড় বড় লেখা “কোকাকোলা”। বিজ্ঞাপনটা দেখে জিনিসটা কি ঠিক বোঝা গেল না কিন্তু কয়েকদিনের মাঝে বন্ধুদের থেকে খোঁজ পেলাম যে এটা একটা খাবার জিনিস। বোতলের মাঝে কালচে রংয়ের এক ধরণের তরল পদার্থ থাকে এবং সেটা খেলে নাকি খানিক্ষণ পর একটা ঢেকুর ওঠে এবং তখন নাকি নাক মুখ আর কান দিয়ে আগুনের হলকার মত ঝাঁঝ বের হয়ে আসে। নাক মুখ আর কান দিয়ে ঝাঁঝ বের করার জন্যে কেন মানুষ খামোখা কালচে একটা তরল পদার্থ খাবে আমরা সেটা বুঝতে পারলাম না।
আরো কয়েকদিন পর কোকাকোলা সম্পর্কে আরও খোজ খবর এল। জিনিসটা নাকি একধরনের পানীয় এবং এটা খেতে খারাপ নয়। এক দুজন বন্ধু সেটা খেয়ে এসেছে এবং আমাদের কাছে তারা কোকাককোলার স্বাদ গন্ধ বর্ণ এবং বিশেষ করে তার ঝাঁঝালো ঢেকুরের একটা রোমহর্ষক বর্ণনা দিল। আমাদের মাঝে আবার একজন ছিল নামাজী। সে আমাদের সম্পূর্ণ নূতন খবর এনে দিল। সে জানাল যে তার কাছে পাকা খবর রয়েছে যে কোকাকোলায় নেশার করার জন্যে মদ মিশিয়ে দেয়া হয়। কাজেই কেউ যদি কোকাকোলা খায় তাকে সোজাসুজি দোজখে যেতে হবে। তার পরিচিত একজন নাকি তিন বোতল কোকাকোলা খেয়ে পুরোপুরি মাতাল হয়ে গিয়েছিল, লোকজন দেখেছে প্যান্ট খুলে মাথায় বেঁধে সে চৌরাস্তায় হাঁটাহাটি করছে।
কথাটা সত্যি না মিথ্যা সেটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজনা। আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম, একদল কোকাকোলার পক্ষে আরেকদল কোকাকোলার বিপক্ষে। দিনরাত আমরা কোকাকোলা নিয়ে আলোচনা করি। শহরে বড় বড় কোকাকোলার গাড়ি এসেছে, সেটা দিয়ে দোকানে দোকানে কোকাকোলা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ঘুরে ঘুরে কোকাকোলার বোতল দেখে আসি। বোতল ক্যাপ দিয়ে সীল করা থাকে। বোতল খুলে সেগুলি ফেলে দেওয়া হয়। আমরা সেগুলি কুড়িয়ে এনে নানাকাজে ব্যবহার করি। একটা ক্যাপের সাথে রাবার ব্যান্ড, বোতাম আর গিট দেওয়া সুতো দিয়ে এক ধরনের যন্ত্র তৈরী করা যায়, সেটা টান দিলে ক্যাট ক্যাট করে শব্দ হয়। আমাদের সবার কাছে এরকম দুই চারটা যন্ত্র রয়েছে কর্কশ ক্যাট ক্যাট শব্দের কারণে কেউ আমাদের ধারে কাছে আসতে পারে না। এর মাঝে আমাদের আরেক বন্ধু খবর আনল যে কোকাকোলা যদি বরফের মত ঠান্ডা করে খাওয়া যায় তাহলে নাকি একটু পরে পরে ঢেকুর ঊঠতে থাকে এবং সেই ঢেকুরের ঝাঁঝ হয় অনেক বেশী এবং মনে হতে থাকে নাক মুখ দিয়ে আগুন বের হয়ে আসছে। শুধুমাত্র যাদের বুকের পাটা অনেক বেশী তারাই যেন বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা খাওয়ার চেষ্টা করে কারণ ব্যাপারটা নাকি সাক্ষাৎ মৃত্যুর আলামত। কোকাকোলা সম্পর্কে আরো খবরাখবর আসে, এটা নাকি এসিডের মত যেটাকে স্পর্শ করে সেটা গলিয়ে ফেলে। একজন মুখে কোকাককোলা নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সকালকে উঠে দেখে সব দাঁত গলে গিয়েছে মুখে শুধু মাড়ি।
স্কুলের বাইরেও চারিদিকে শুধু কোকাকোলার গল্প। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল সাইনবোর্ড, এরকম একটা জিনিস ছাড়া কিভাবে আমরা এতদিন বেঁচে ছিলাম আমরা এখন চিন্তাও করতে পারি না।
এরকম সময়ে আমাদের ক্লাশে একদিন পরীক্ষা। পড়াশোনার ব্যাপারটা তখন আমার কাছে সহজ, পরীক্ষায় অন্যদের অনেক আগেই আমার লেখালেখি শেষ হয়ে যায়। সেদিনও তাই হল। সময় শেষ হবার অনেক আগেই আমার লেখালেখি শেষ, চুপচাপ খাতা নিয়ে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে গেলাম। সময় কাটানোর জন্যে পরীক্ষার খাতার সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানে একটা বিশাল কোকাকোলার বোতলের ছবি আঁকলাম। বোতলে কোকাকোলা এবং তার মাঝে থেকে বুদবুদ বের হচ্ছে। অন্যপাশে একজন মানুষকে আঁকলাম, তার মুখে হাসি সে একটা কোকাকোলার বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে খাচ্ছে। দুইটা ছবির মাঝখানে বড় বড় করে লিখলা, “কোকাকোলা পান করুন”। দরদ দিয়ে আঁকা ছবি, ভারী চমৎকার হল দেখতে, আমার পাশে যে বসে ছিল সেও আমার শিল্প-কর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
কয়েকদিন পরে পরীক্ষার খাতা ফেরৎ দেওয়া হচ্ছে। স্যারের খাতা দেওয়ার একটা নিয়ম আছে। প্রথমে ফেরৎ দেন সবচেয়ে বেশী যে নম্বর পেয়েছে তার খাতাটা, তারপর যে তার থেকে একটু কম, তারপর যে তার থেকে আরেকটু কম। সাধারণতঃ প্রথম দুই দিন জনের মাঝেই আমার খাতাটা থাকে কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম ঘটল আমি প্রথম দু দিনজনের মাঝে খাতা ফেরৎ পেলাম না। পরীক্ষা যখন দিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল পরীক্ষাটা ভালই দিয়েছি কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল করে ফেলেছি। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রইলাম স্যার ভাল খাতা দেওয়া শেষ করে মাঝারী খাতা দেওয়া শুরু করলেন তারপর মাঝারী খাতা শেষ করে যারা ক্লাসে এসে উদাস মুখে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকে তাদের খাতা দেওয়া শুরু করলেন কিন্তু তবু আমার খাতার দেখা নেই। পরীক্ষায় ফেল করে ফেলেছি এরকম তো হতে পারে না। কিন্তু একটা বড় গোলমাল হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; তবে গোলমালটা কোথায় হয়েছে কিছুতেই ধরতে পারলাম না। হঠাৎ করে আমার পেটের ভিতরে পাক খেতে শুরু করল।
সব খাতা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে, স্যারের হাতে এখন একটি মাত্র খাতা এবং স্যার সেই খাতাটা ফেরৎ না দিয়ে হাতে ধরে আছেন। স্যার হঠাৎ টেবিলে থাবা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “এখন তোদেরকে একটা জিনিস দেখাব, সবাই দেখ”।
স্যারের গলা শুনে সবাই সামনে তাকাল। স্যার তখন আমাকে ডাকলেন। আমি স্যারের দিকে এগিয়ে গেলাম, কাছাকাছি পৌছাতেই খপ করে আমার কানটা ধরে ফেললেন, তারপর সেটা ধরে রেখেই স্যার পরীক্ষার খাতাটা খুলে সারা ক্লাশকে দেখালেন পরীক্ষার খাতার উপরে আমার বিশাল শিল্পকর্ম। কোকাকোলার বোতল এবং হাস্যমুখী একজন মানুষ এবং বড় বড় করে লেখা “কোকাকোলা পান করুন।” ছবিটি দেখে সারা ক্লাশে একটা বিষ্ময়ধ্বনী উঠল আর স্যার আমার কান ধরে একটা ঝাঁকুনী দিয়ে বললেন, “আমার সাথে মশকরা? কোকাকোলা পান করুন?”
ক্লাশের ছেলেরা এবারে খুব আনন্দ পেল, কেউ শাস্তি পেলে সাধারণতঃ আনন্দ হয় না কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, স্যার খুব রেগে যাওয়ার ভাণ করে আছেন কিন্তু আসলে যে বেশী রাগেন নি সেটা বুঝতে পারো বাকী নেই। ছেলেমেয়েরা হাত তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলা। স্যার আরেক বার কান টেনে হাতে খাতাটা দিয়ে বললেন, “নে, ভাগ”।
একজন জিজ্ঞেস করল, “কত পেয়েছে, স্যার?”
“পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু বেশী পেলেই কি মশকরা করবে নাকি? তাও পরীক্ষার খাতায়?”
এতদিন পর এখনো আমি বুঝতে পারি না যদি অন্য সব জায়গায় কোকাককোলার বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় তাহলে পরীক্ষার খাতায় তার একটা বিজ্ঞাপন দিলে ক্ষতি কি?
বই: আধ ডজন স্কুল
প্রকাশকাল: বই মেলা ১৯৯৬
প্রকাশ করেছে: শিখা প্রকাশনী