1 of 2

গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর

ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস। এই মাসে শীতের একটা আমেজ পাওয়া যায়, বাগানে বাগানে রঙিন মৌসুমি ফুল ফুটতে শুরু করে, বাজারে শীতের সবজি উঠতে শুরু করে, বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে তাদের আনন্দ শুরু হয়, বিদেশ থেকে আপনজনেরা দেশে বেড়াতে চলে আসে, নানা ধরনের দেশি-বিদেশি কনফারেন্স শুরু হয়-কিন্তু এর কোনোটাই ডিসেম্বর মাসটিকে আলাদা করে দেখার কারণ নয়! ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস, এর কারণ, এটি আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসে রাজাকাররা গর্তে ঢুকে থাকে-এই মাসে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদাভাবে স্মরণ করি। এই মাসে মন্ত্রী না হয়েও আমরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ফেলি। আমাদের মধ্যে যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি, তারা বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করে এখনো এক ধরনের শিহরণ অনুভব করি।
মনে হচ্ছে, এই ডিসেম্বর মাসে আরও একটা বিষয় যোগ হবে-এই মাসে বহু বছর পর আমরা পৃথিবীর একটা নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের বিচার শেষ করে গ্লানিমুক্ত হতে পারব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটা অনেক দিক থেকেই ছিল অবিশ্বাস্য। এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। খুব সংগত কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছে; কিন্তু সাহস পায়নি। অথচ বাংলাদেশের জন্মের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার তাঁকে হত্যা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল-এটি এখনো বিশ্বাস করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার উদাহরণ খুব কম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের লিংকন কেনেডি থেকে শুরু করে মিসরের আনোয়ার সাদাত, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো বা ভারতের ইন্দিরা গান্ধী-ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই আমরা এ রকম অনেক উদাহরণ পেয়ে যাব। কিন্তু শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে? নববিবাহিত বধূ কিংবা ১০ বছরের শিশুসন্তান? এই হত্যাকাণ্ডের সময় ঠিক কী ঘটেছিল বহুদিন সাধারণ মানুষ সেটি জানতে পারেনি। বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি আবার নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। আমার ধারণা, যাঁরা সেই বর্ণনাগুলো পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই ‘মানুষ’ প্রজাতির ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।
শুধু যে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল তা নয়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আত্মীয়তা থাকার কারণে শেখ মণি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তাকে সব মৃতদেহ সমাহিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁর লেখা তালিকাটি পড়লে এখনো শিউরে উঠতে হয়। সেই দীর্ঘ তালিকায় বঙ্গবন্ধু, শেখ নাসের, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সবার নামের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে একাধিক অজ্ঞাত পরিচয় ১০/১২ বছরের বালক কিংবা ‘১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা’-এর কথা। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে, তারা কারা!
১৫ আগস্টের হত্যার মাঝে ছিল এক ধরনের পাশবিক নৃশংসতা। এর পরের হত্যাকাণ্ড, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঠান্ডা মাথায় একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। নভেম্বরের ৩ তারিখ জেলখানায় বেছে বেছে সেই নেতাদের হত্যা করা হলো, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে বাংলাদেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। জেলখানায় বন্দীদের হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু সেটি করা হয়েছিল, কারণ, এই খুনিচক্র তো শুধু পাশবিক আনন্দের জন্য খুন করেনি, তারা খুন করেছিল বাংলাদেশকে তার আদর্শ থেকে চিরদিনের জন্য লক্ষ্যচ্যুত করতে।
বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার নৃশংস ঘটনার পর সবাই হয়তো ভেবেছিল বর্বরতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ শিউরে উঠে আবিষ্কার করল, সেই বর্বরতা শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তার ৪১ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম একটি দলিল প্রকাশ করলেন, যে দলিলে পরিষ্কার করে লেখা হলো, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূদের হত্যা করেছে, শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই দেশে কোনো মামলা করা যাবে না। পৃথিবীর নৃশংসতম খুনিরা শুধু খুনি নয়, তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ-এই দেশের কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হলো না, ১৯৭৯ সালে সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচন করে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয় আর ১৯৭৯ সালের এপ্রিলের ৯ তারিখ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনী নামে আমাদের সংবিধানে স্থান করে নিল! এটি আমাদের সেই সংবিধান, যে সংবিধানটি এই দেশের মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে অর্জন করেছিল। যে বঙ্গবন্ধু এই সংবিধানটি এই দেশকে উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ঘোষণা করা হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এই দেশের মাটিতে বিচার করা যাবে না। এর চেয়ে উত্কট নিষ্ঠুরতার উদাহরণ কি এই পৃথিবীতে আছে?
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন দেশ-বিদেশে সগৌরবে তাদের হত্যাকাণ্ডের কথা ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর এই দেশের মানুষ টেলিভিশনে সেটি দেখেছে, যারা দেখেনি তারা ইন্টারনেটের ইউটিউবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী (নধহমধনধহফযঁ শরষষবৎ) লিখে খোঁজ করলেই সেটা পেয়ে যাবে। সেই হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তাদের নিজের মুখে দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ শুনতে পারবে।
তার পর একদিন নয়, দুই দিন নয়, এক বছর নয়, দুই বছর নয়, ২১ বছর কেটে গেছে। জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার এবং খালেদার সরকার সেই খুনিদের টানা ২১ বছর বুক আগলে রক্ষা করেছে, দেশ-বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছে, তাদের পদোন্নতি হয়েছে, সগর্বে তারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই ইনডেমনিটি বিলটিকে আমাদের সংবিধান থেকে অপসারণ করে প্রথমবার খুনিদের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করেছে। খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর।
মামলা করা যায়নি একুশ বছর, মামলা করার পর বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর। এর মাঝে বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকে বিব্রত হয়েছেন এবং সেগুলো দেখে আমরা শুধু বিব্রত হইনি, ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ক্রুদ্ধ হয়েছি। তার পরেও দেশের মানুষ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। একটা ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে ঝটপট বিচার করে খুনিদের ঝুলিয়ে প্রতিশোধের তীব্র আনন্দটুকু সহজেই পাওয়া যেত; কিন্তু সেটি করা হয়নি। এটি আমাদের দেশের বিশাল একটি অর্জন। আমরা এখন মাথা তুলে বলতে পারি, এই দেশের মাটিতে আমরা খুনিদের বিচার করে দেশকে, দেশের মানুষকে গ্লানিমুক্ত করেছি।
আত্মস্বীকৃত খুনিদের দম্ভোক্তিগুলো আমরা অসংখ্যবার শুনেছি, নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আরও অনেক সহজে শুনতে পারে। বিচারকাজ চলার সময় আবিষ্কার করেছি, প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখন তারা সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তখন আমরা না চাইলেও আমাদের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। আমি চাই, যখন তাদের গলায় জল্লাদেরা ফাঁসির দড়িটি পরাবে, তখন অন্তত একবারও যেন তাদের সামনে শিশু রাসেল এবং ১০/১২ বছরের নাম না জানা সেই বালক বা ফুটফুটে বালিকাদের চেহারাটা ভেসে ওঠে।

২.
আমি আশা করছি, বর্তমান সরকার আত্মতুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৫ সালের সেই সময়টুকুর কথা একবার ভাববে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দুঃসাহস পেয়েছিল কারণ, তখন দেশটি ভালো চলছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনীতি বলে কিছু নেই, খাবার নেই, দুর্ভিক্ষ, বাকশাল, রক্ষী বাহিনী-সব মিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ছিল হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। এত দিন পর আমরা জানি এর অনেকটুকু ছিল দেশ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল, অনেকটুকুর ওপর কারও হাত ছিল না সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য-কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকার করতেই হবে, একটা বড় অংশ ছিল তাদের ভুলভ্রান্তি এবং অন্যায়-অবিচার। বঙ্গবন্ধুর দলের মানুষের অপকর্মের দায়ভারই নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে আর তাঁর পরিবারের মানুষকে। যদি সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক আর কর্মীরা দেশটাকে এ রকম নৈরাজ্যকর একটা জায়গায় ঠেলে না দিত, এই খুনিরা তাহলে এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস পেত না।
আওয়ামী লীগ আবার দেশ শাসনের দায়িত্বটুকু পেয়েছে, দেশের মানুষ অনেক বড় স্বপ্ন দেখে তাদের ক্ষমতায় এনেছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আমার দলের মানুষ কি এই দেশের সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছে? দলের মানুষ ছোট একটা লাভ করার জন্য কি পুরো দেশটাকে বিশাল একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে?
আমি পুরো দেশের খবর জানি না, খবরের কাগজে অত্যন্ত খণ্ডিত একটা ছবি দেখি সেটা থেকে অনুমান করার চেষ্টা করি। সব সময় অনুমান সঠিক হয় না। কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন বাউল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। কোনো একটা কারণে ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে হামলা করে স্টেজ ভেঙে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের সব খবরের কাগজে খবরটা ছবিসহ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। যে খবরটা ছাপা হয়নি সেটা হচ্ছে, তার পরেও সবাই মিলে অত্যন্ত চমত্কারভাবে দুই দিনের সেই বাউল সম্মেলন অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের বাইরের সবাই সেটি উপভোগ করেছে। কাজেই, খবরের কাগজ থেকে আমরা যে তথ্যগুলো পাই সেগুলো খণ্ডিত, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়।
কিন্তু যে বিষয়গুলো আমি নিজের চোখে দেখি, সেগুলো খণ্ডিত নয়, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ। কাজেই, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের চোখে দেখেছি, এখানে ছাত্রলীগের ছেলেরা নিজেদের ভেতর মারামারি করছে, একদল আরেক দলের ওপর হামলা করছে। সেই হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছে, ধর্মঘট ডেকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেরা নিজেদের কুপিয়ে আহত করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সবচেয়ে সুন্দর ল্যাবরেটরিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। আমি অন্তত এই একটা ঘটনার কথা বলতে পারি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর ডিজিটাল পরিবেশটি তারা অবলীলায় ধ্বংস করে দিয়েছে। (আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি সেটি কখনো দেখতে যাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের খরচে সেটি আবার ঠিক করে দিয়েছে।) শুধু যে দল বেঁধে এ রকম হাঙ্গামা হচ্ছে তা নয়, নীতিহীন নেতা তৈরি হচ্ছে, তারা মাস্তানি করছে, ছাত্রীদের অসম্মান করছে।
আমি জানি, আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এই পুরো ব্যাপারটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, সমগ্র দেশের বিশাল কর্মকান্ডের তুলনায় এটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিষয়! কিন্তু এই ছোট ছোট অসংখ্য ক্ষুদ্র বিষয় যখন একত্র হয়, তখন সেটি আর ক্ষুদ্র বিষয় থাকবে না। যখন দেশের মানুষ একদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘ধুর! এদেরকে দিয়ে কিছু হবে না। সবই আসলে এক মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ!’ তখন তাদের বুঝতে হবে, একটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। আমরা নিজের চোখে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দেখেছি। তাই আমরা কোনোভাবেই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ দেশবাসী দেখতে চাই না।
শুধু যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহিষ্ণু ছাত্রলীগ- যুবলীগের তাণ্ডব হচ্ছে তা নয়, আরও বড় বড় ব্যাপারও ঘটছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অত্যন্ত দক্ষ এবং কার্যকর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি সত্ এবং নীতিবান মানুষ ছিলেন কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করিয়েছে। আমি যতদূর জানি, পদত্যাগ পত্রে তিনি স্পষ্ট করে সেই কথা লিখে দিয়েছেন। শুধু যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে তা নয়, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই একই ঘটনা ঘটেছে, ভাইস চ্যান্সেলরকে সরে যেতে হয়েছে। আমি দেশের অন্য অনেক কিছু না বুঝতে পারি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয় আর কী না হয় সেই জিনিসটা বুঝতে পারি। তাই আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে কাজগুলো ঘটছে, সেগুলো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো যে শুধু অনৈতিক তা নয়, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক মানুষকে নিয়োগ না দিয়ে দলীয় অপদার্থ মানুষদের জোর করে ঢুকিয়ে দিলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আর কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অন্যরা শুনছে কী না জানি না, আমরা কিন্তু এই দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে, তাদের অনেক বড় কাজ করার সুযোগ আছে। কিন্তু অত্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় কিছু বিষয়ে নাক গলিয়ে তারা যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে না দেয়। এই অতি সাধারণ বিষয় বোঝার জন্য কি রকেটবিজ্ঞানী হতে হয়?

৩.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই বড় কিছু ঘটে, তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই আমাদের লাইব্রেরির সিঁড়িতে এসে জড়ো হয়েছি। একজন-দুজন কিছু বলে অন্যরা শোনে। ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছাত্র-শিক্ষকেরা সেখানে উপস্থিতি হয়েছে। ছাত্ররা কথা বলেছে, শিক্ষকেরা কথা বলেছে। বক্তব্যের বিষয়বস্তু মোটামুটি এক, আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি, একই ধারাবাহিকতায় জেলহত্যা মামলার বিচার করে দ্বিতীয়বার কলঙ্কমুক্ত হব। আমাকে যখন কথা বলতে দিয়েছে, আমি তখন আরও একটি কথা যুক্ত করেছি, বলেছি, আজ যেমন এখানে এসেছি, ঠিক সেরকম কিছুদিনের ভেতর আবার এখানে এসে আমরা ঘোষণা করতে চাই, ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে পুরো জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হলো।’
সরকার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে, আমরা সরকারের সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করেছি। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার জন্য। এটি ডিসেম্বর মাস, এটি বিজয়ের মাস। এই মাসে এই দেশের সবাই যেন নতুন করে ঘোষণা করে যে এই দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমরা করবই করব।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে আমরা প্রথমবার অনুভব করেছি গ্লানিমুক্তির অনুভূতিটি কী রকম। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে আমরা নতুন করে আবার সেই গ্লানি আর কলঙ্ক ধুয়ে-মুছে ফেলতে চাই।
নতুন প্রজন্মের চোখের দিকে তাকিয়ে তখন আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারব, বাঙালি বীরের জাতি-এই জাতির ইতিহাসে কোনো গ্লানি নেই, কোনো কলঙ্ক নেই।

1 Comment
Collapse Comments

lekha ta vlo hoyeche,,,,,,,

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *