1 of 2

একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ

আজকাল চিঠি লেখালেখি খুব কমে এসেছে- চিঠি লিখে যে কথাটি জানাতে হবে টেলিফোন করে অনেক তাড়াতাড়ি সে কথাটি জানিয়ে দেয়া যায়। এস.এম.এস কিংবা ই-মেইল আছে, ফেসবুক আছে, তাই কে আর এতো সময় নিয়ে চিঠি পাঠাবে। আমার ধারণা আমি সম্ভবত এই দেশে অল্প কয়েকজন সৌভাগ্যবান মানুষের একজন, যে এখনও নিয়মিত চিঠি পাই! আমার চিঠিগুলো খুব মজার হয় কারণ তার বেশিরভাগই লেখে ছোটো ছোট ছেলেমেয়েরা।

প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ শুরু হবার পর চিঠিগুলোকে মোটামুটি দুই ভাবে ভাগ করা যায়। একভাগ লিখছে যারা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আসতে পারছে তারা, অন্যভাগে রয়েছে যারা আসতে পারছে না তারা। যারা আসতে পারছে না, তাদেরকেও আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়; একভাগে রয়েছে যারা ঢাকার বাইরে থাকে তারা- অন্যভাগে রয়েছে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ অংশটুকু। তারা ঢাকায় থাকে, ইচ্ছে করলেই তারা শাহবাগ আসতে পারে, কিন্তু তাদের মা-বাবা আত্মীয়স্বজন তাদের আসতে অনুমতি দিচ্ছে না! আমার কাছে তারা লম্বা চিঠি লিখে সেই দুঃখের কাহিনী জানায়।

বাচ্চাদের চিঠিগুলোতে নানা প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় তথ্য থাকে এবং নানা ধরনের গল্প থাকে। একজন লিখেছে, তার পরিচিত একজন রাজাকার টাইপের আত্মীয় আছে, সে শাহবাগে যাচ্ছে শুনে সেই রাজাকার টাইপ আত্মীয় মুখ কালো করে বলেছে- “দেশটাকে দুইভাগ করে এখন গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেয়ার ব্যবস্থা।” বাচ্চাটি তখন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে হাতে কিল দিয়ে বলেছে, “কী মজা! এইটাই তো চাই! মুক্তিযুদ্ধ করতে পারি নাই- এখন যুদ্ধ করবো!” তার কথা শুনে রাজাকার টাইপ আত্মীয়ের মুখের ভাব কেমন হয়েছে সেটাও সে অনেক মজা করে বর্ণনা করেছে।

সত্যি সত্যি এই দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আর এই দেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা দেশদ্রোহী রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেবে আমি মোটেও সেজন্যে অপেক্ষা করে নেই। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বড়ো হয়েছি তারা জানি- একটা যুদ্ধে যে রকম সাহস বীরত্ব আর অর্জন থাকে, তার পাশাপাশি থাকে ভয়াবহ নৃশংসতা, দুঃখ-কষ্ট আর হাহাকার। আমরা সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করি এই দেশের মাটিতে আর কখনও যেনো কাউকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে না হয়।
কিন্তু এই কথাটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, ছোটো ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস দেখে একটি বিষয় বোঝা যায়, তারা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্বের আদর্শকে সত্যিকারভাবে অনুভব করতে পেরেছে। এই দেশে প্রায় সত্তর ভাগ হচ্ছে তরুণ, এই তরুণ প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে ধারণ করতে পারে তাহলে এই দেশে যে পুণ্জিভূত শক্তি রয়েছে সেই শক্তিকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কার আছে? এই দেশকে নিয়ে আর যে-ই দুর্ভাবনা করুক আমি করি না।

তবে একটি সত্য কেউ অস্বীকার করবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামাত শিবির যে তান্ডব শুরু করেছে, এই দেশের নতুন প্রজন্ম কখনো সেই তান্ডব দেখেনি। তাদের অনেকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে একাত্তরের নৃশংসতা কেমন ছিলো। এটি হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দল যেটি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহ হয়ে এই দেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো। সে সময়ে তাদের নৃশংসতা কতো ভয়াবহ ছিলো এখন অনেকে সেটা আঁচ করা শুরু করেছে। আমরা কি কখনো কল্পনা করেচিলাম যে আমরা টেলিভিশনে দেখবো একজন পুলিশের মাথা থেঁতলে দেয়া হচ্ছে? গাড়ির ভেতরে মানুষকে রেখে সেই গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে? ককটেল মেরে স্কুলের শিশুকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে? একাত্তরের যে বিভীষিকাটি আবার নতুন করে আমাদের হতবাক করে দিচ্ছে সেটি হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির পুড়িয়ে দেয়া। আমরা কি কখনও কল্পনা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করার জন্য তারা দেশের এই জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করার পথ বেছে নেবে? একটি দিনও যায় না যখন আমরা দেখি না এই দেশের কোথাও না কোথাও একটি মন্দিরে আগুন দেয়া হচ্ছে না।

এই সবকিছুর পাশাপাশি আমরা দেখেছি ধর্মের অপব্যবহার। খবরের কাগজে কাবাঘরকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়, চাঁদে যুদ্ধাপরাধীর ছবি দেখা হয়, বিশাল গণ-আন্দোলনকে ভুল দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য নাস্তিক-আস্তিক প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়। একজন ধর্মভীরু মানুষ কখনোই ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করতে পারে না- কিন্তু একাত্তরে যেভাবে ধর্মের নাবে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা হয়েছিলো ঠিক একইভাবে এই দেশে সেই একই গোষ্ঠী এই নতুন প্রজন্মের বিরোধিতা করার জন্য তাদের সকল শক্তি নিয়ে পথে নেমেছে।

আমরা এই মিথ্যাচার, অন্যায়, অবিচার, নৃশংসতা, বিভীষিকা, সাম্প্রদায়িকতায় অভ্যস্ত নই। আমি জানি, এই দেশের মানুষ, নতুন প্রজন্ম কখনও কখনও আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে, কখনও কখনও হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম যে রকম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনুপ্রেরণা পায়া, তাদেরকে ঠিক একইভাবে এই দুঃসময়ে আবার একাত্তরের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, একাত্তর থেকে বড়ো দুঃসময় এ দেশে কখনও আসেনি, অপ্রস্তুত একটি জাতিকে যুদ্ধের মাঝে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান মিলিটারি গণহত্যা করে যাচ্ছে। রাজাকার, আল-বদর তাদের সাহায্য করছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, এক কোটি মানুষ পাশের দেশের শরণার্থী হয়ে গেছে, নারীদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, বাইরের পৃথিবী চুপচাপ দেখছে, চীন-আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে, মুসলিম দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে- কতো দীর্ঘদিন যুদ্ধ হচ্ছে কেউ জানে না, ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যৎ। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ও এ দেশের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়নি, জীবনের সবচেয়ে বড়ো ত্যাগ স্বীকার করে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের সেই শিক্ষাটি নিতে হবে, কিছুতেই হতাশ হওয়া যাবে না। দেশদ্রোহী ধর্মান্ধদের অপপ্রচারের বিভ্যান্ত হওয়া যাবে না। তাদেরকে নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে- একাত্তরের ভয়ঙ্কর দুঃসময়েও যদি এদেশের মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে রুখে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এই নতুন প্রজন্ম কেনো পারবে না?
নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমের প্রথম পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাস করেছে- আমাদের দেখিয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ের ভেতর লালন করে। অপপ্রচার, আতঙ্ক, সাম্প্রদাবিকতা, নৃশংসতা, বিভীষিকার কালো ছায়ার মাঝে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে আশাবাদী হয়ে থাকার দ্বিতীয় পরীক্ষাটিতেও তাদের পাশ করতে হবে।

এই দেশটি আমাদের। যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটির জন্ম হয়েছিলো, নতুন প্রজন্মকেই আমাদের সেই দেশ উপহার দিতে হবে।

৭ বৈশাখ, ১৪২০
২০ এপ্রিল, ২০১৩

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপত্র “গণজাগরণ” এর প্রথম সংখ্যা
মে ০৩, ২০১৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *