সংযোজন – অগ্রন্থিত কবিতাবলি

অগ্রন্থিত কবিতাবলি ১

সূচি

প্রতিটি রাত্রির পর…, আজ রাতে, সংকেত-২, ধ্বংসের আগে…, কীভাবে তোমার কাছে কথা আসবে, যারা লিখতে বেরিয়েছি, প্রথম পাতার লেখা, ভয়, উন্মোচন, ভয়ের ছবি, হাতবদল, গ্রাম্য আমি, সেদিন কেন যে…, আর কোনওদিন যদি, একটি দুঃস্বপ্ন, এসো দীপ, অভিশাপ, দুঃসংবাদ, যাদের কিছুতে বোঝানো গেল না, নিভে-যাওয়া চাঁদ, ভাঙাগান, এবারকার চিঠি, আমরা বাড়ি, বসন্তের চারদিন আগে, জোকার, পাখিযন্ত্র, সম্পূর্ণ কাঠের কবিতা, আজান, অনন্যোপায় সন্ধে, রবি ঠাকুরের কাছে ঋণ, একটি মরুভূমিয় গল্প, মা , ২ জানুয়ারি: ফেরাপথে, দ্বিধায়, অন্ধজন-৪, যে মেয়েটিকে বলব না, রাত্রিকথা, ডাক, ১২ ডিসেম্বর: ব্যর্থতা, ছোটবেলায় শোনা একটি ছড়া, আমরা সাত ভাই, অন্ধজন-৩, বিলাসখানি, একদিন রাতে আমি…, জরুরি অবস্থা, একটি বিজ্ঞপ্তি, আর কিছুদিন সঙ্গে থাকলে, ১৯ নভেম্বর, সন্ধে, দাঁড়াও, ভাবো…, ফুলটি বলল, আগন্তুক, স্বপ্নে দেখি, সব কথা, এপিটাফের বদলে…, তোমাকে বলেছি, রাঁধুনী, অসুস্থ, বিজলি চমকি…, শেষকৃত্য, শনিবার, বনানীকে, ভুল, এসো, পশমের ক্লান্তি, বৈশাখ, পুরনো, পাতাঝরা গীতবিতান, আর কী হত, মুগ্ধ, এসো… , জাতিস্মর, তোমাকে রেখেছি, শর্তলিপি, দেবদূত, একশো বছর: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, পাবলো আর পোস্টম্যান, একটি গড়পড়তা লাভ-লেটার, ধর্ষণ-পরবর্তী লেখা, হ্যাল বেরি, জন্মাষ্টমী (রিমিক্স)

প্রতিটি রাত্রির পর…

আমি যদি তোর হয়ে তৃণশুল্ক দিতে যাই মাঠে,

ঘাসেরা মৃত্যুর মতো…আশ্চর্য সবুজভাবে ওরা

ওত পেতে থাকে শান্তি, স্নেহ ও জরার পাশাপাশি

নীল ও সমুদ্ররাশি, বালু ও পায়ের ছাপগুলি

অন্ধকার মনে হয়, মুহূর্তের শত্রু থেকে প্রিয়

প্রিয়ের আরাধ্য মৃত্যু বাঁধা হয় ও পায়ে ঘুঙুর

সাক্ষীতট ভাঙে, ওঠে, জাগরণ ইত্যাদি তোমার

মুখের অনেক দূর ভিতর পর্যন্ত চলে গিয়ে

ছায়াশাস্তি ত্যাগ করে ফিরে আসে অনায়াসভাবে

জিহ্বায় গ্রন্থির মতো ফুটে ওঠে আমার আঙুল

ঘুঙুর সত্বর বাজে অথচ যথেষ্ট প্রিয় নয়

যে তল হারায় ছবি রাত্রি তার চুল ধরে টেনে

মাটির উপরে তুলে ছুড়ে দেয় বৃহতের দিকে

সে তল ফেরে না, চারুমাত্রাহীন কল্প ও সমাধি

পাঠপ্রান্তে নতজানু বসে থাকে…অথচ মৃত্যুর

প্রতিটি ছায়ার বুকে লেগে আছে ঘাস, মেরে দেবে,

আমি যদি তোর হয়ে তৃণশুল্ক দিতে যাই মাঠে…

২৯/৬/৯৮

আজ রাতে

আজ রাতে যত পারি লিখে রাখব। পরবর্তী ভোর

কী জানি কী এনে দেয়-প্রতীক্ষা, কুয়াশা, সফলতা…

ইত্যাদি দূরেই ভাল। নিকটে কেবল রাতটুকু

অক্ষম আশ্লেষ বুক ঘন পামবীথির পরিধি

যেন পার হয়ে এসে ক্লান্ত কোনও টিলার বাহুতে

বসে পড়া, আজ রাতে যেন লিখে রাখতে পারি সব

ও সব, যা সব প্রিয়, মিথ্যা আর বৃষ্টি দিয়ে ঢাকা

যা সব অবর্ণনীয় মেলামেশা হিসেবে বর্ণিত

যেন পারি, নিদ্রামুখ অকাট্য অবাধ্য করে রেখে

টেবিলে বিষাদ ভরা হাতদুটি ছড়িয়ে দিয়ে এক

মাত্রার অতীত লেখা, রং, বর্ণ, গন্ধ, খুশিহীন

তরঙ্গে কেবল জানা বায়ুর সমান ঘটনাকে

যেন আসে, মনে পড়ে তরলবর্জিত ভালবাসা

আজ রাতে মৃত্যুমাখা চোখ, দেখি, আনত ও পায়ে

যা প্রেম, যা শেষ, সব একসঙ্গে লিখে দিতে চেয়ে…

৮/৭/৯৮

সংকেত-২

ছ’টা আগুনের পাল্লা খুলে গেলে, তোমার মাথায়

ভাঙা কলকব্জাসহ ঢুকে পড়বে অতিকায় মাছি…

সে তোমার ভাল চাইবে, খুলি শান্ত করে দেবে কুন্দনের মতো

খেয়া দেখবে ঘূর্ণিপথ, মাটি দেখবে পচা-গলা পোকার চলন

কলকব্জাহারা সেই অতিকায় মাছি তার রক্তগন্ধ দিয়ে

ধুয়ে মুছে দেবে সব ভুলভুলাইয়া শিরা-উপশিরা

মগজের খোপে-খোপে জ্বর, শুধু জ্বর আসবে কালচে-হলদেটে

হায় শব্দ! মেশিনের ধাতব শব্দের জোরে উড়ন্ত দ্বিধায়

যা কিছু প্রবৃত্তি সব উড়ে গিয়ে পড়বে মুখ পেতে

ধুলিধূসরিত জ্বালামুন্ডু হাতে মৃত্যুনাচ দেখাবেই মাছির কঙ্কাল…

তুমি দূর থেকে দ্যাখো।

তুমি শুধু পাল্লাগুলো খুলে যেতে দাও…

১৫/৪/৯৮

ধ্বংসের আগে…

মুছে যাচ্ছে আয়ুপার…

ওই দেখছ তোমাদের সূর্যমন্দিরের নড়াচড়া

পৃথিবীর সব নৌকো গিলে নিয়ে ঢেকুর তুলছে

ওঠো তাপ! ওঠো, এই জঙ্গলে জলায় ভরা অবস্থান থেকে

মুছে যাচ্ছে আয়ুপার…

আর ওই সূর্যমন্দিরের দরজা থেকে

কাঁকড়া-ভরা পথে শুধু পদচিহ্ন রাখতে-রাখতে শেষ দৌড় দিয়ে আসছে

রাশি-রাশি বালির মানুষ…

১৪/৪/৯৮

কীভাবে তোমার কাছে কথা আসবে

কীভাবে তোমার কাছে কথা আসবে

কীভাবে আবেগখানি মুছে নেবে চঞ্চল দিঘির দু’টি পার

সোনা গলানোর মন্ত্র

এই তো…

দুপুরে এই পোড়া রেশমের সূর্যটুকু

বেলে নিলে অতিকায় রুটির মতোই স্বাদু হবে

আর ওই সবুজ চামড়ার

সারা দেহে শুধু নখ প্রকাশিত লালাঝরা হিংস্র জীবটাও

পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বিষচিঠি বিলি করবে

অথচ আজকে এই অতিঘোর দুপুরবেলায়

চল্লিশ ডিগ্রির সোনা গলা দিয়ে নামছে না যে…

কীভাবে তোমার কাছে কথা আসবে, বলো!

১৪/৪/৯৮

যারা লিখতে বেরিয়েছি

বুঝতে-না-পারার কষ্ট কবিতার আশেপাশে সর্বদাই ঘোরে

তবু আমরা নেমে যাচ্ছি

অতল পাহাড় বেয়ে

পুরনো নদীর দিকে

খাদের কিনার

ধরে ধরে…

৮/৪/৯৮

প্রথম পাতার লেখা

আয় চন্দ্র, চাঁদ, আয়, তোর মাংসে রাতের খাবার

আয় পোস্টম্যান, তোর খটখটে দাঁতের হাসি এখনও উজ্জ্বল

আয় রে পেরেক তোরা মাঠে-মাঠে নিশিজাগা ফসলের মতো

আয় শামুকের পিঠ, বয়ে আন লম্বা-লম্বা টিনের দেয়াল

গুহাভস্ম আচ্ছাদিত উপত্যকা আয় উঁচু-উঁচু

দেউলিয়া আয়, আয় কণ্ঠনালি ভেদ করা লোহার গরল

আয় জং ধরা বুক, রাতারাতি উড়ন্ত দুর্গের

পাশাপাশি বেড়ে ওঠা অলীক বসতিগুলি আয়

দিনের তলানিটুকু চুমুক মারার মতো ঐচ্ছিকেরা আয়

আয় গর্ভতাপ থেকে মুক্তি পাওয়া রক্তের শ্রাবণ

আয় অজগর তোর বিষের ডগায় ধরা পরিশ্রম নিয়ে

আয় সব, আয় তোরা পৃথিবীর শেষ উড়োজাহাজ চালিয়ে

দ্যাখ-কেউ কোনওদিন বুঝবে না, এমন লেখা

ঘোরাফেরা করছে এই খরাকুটিরের আজুবাজু—

শুধু বুঝতে পেরে দ্রুত ওঠে-নামে দূর কোনও মাথার প্রকোষ্ঠে ভরা জল…

৫/৪/৯৮

ভয়

একধরনের ভয় থেকে আমি মায়ের ভেতরে লুকোতে চাইছি পুনরায়

একধরনের ভয় থেকে আমি বাবার মতন হতে পারব না কোনওদিন

একধরনের ভয় থেকে আমি জড়িয়ে ধরতে চাইছি তোমার ঘুমকোল

একধরনের ভয় থেকে সব বন্ধু এবং বান্ধবীদের বিচ্ছেদ

একধরনের ভয় থেকে যেন আঁধার দিয়েছি তোমাকেও,-ছায়াহিন্দোল,

একধরনের ভয় থেকে প্রিয় কবির সকাল নষ্ট করেছি কতবার

একধরনের ভয় থেকে চেনাঘর ছেড়ে এসে আবার ঘরের সন্ধান

একধরনের ভয় থেকে এই কালোমুখ ছিঁড়ে বার করে আনা আলোমুখ

একধরনের ভয় থেকে আজ প্রেম ছাড়া আর কোনও কথা ঠিক মনে নেই

একধরনের ভয় থেকে এই ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ জলডুব,

জলের মাথায় ভেসে আছে দ্যাখো, বিপদবার্তা, এখনও, আমার ডাকনাম…

২৪/৬/৯৮

উন্মোচন

যে-হাসি খুলেছে চক্ষু

সহস্র পাপড়ির মতো মেলেছে সোনায় ভরা সেতু

যে-শান্তি ছুঁয়েছে দীর্ঘ

চুলে ভরা সমুদ্রসৈকতের কোনও আলুথালু মাথা

যে-কল্প গাছের নীচে

চিরন্তন পেশিহারা আলিঙ্গনে সম্মতি দিয়েছে

সেই হাসি, শান্তি, কল্প

পর্দার আড়াল থেকে

হাজার বছর দূরে ঠেলে ওঠে ভাঙা কণ্ঠস্বর সঙ্গে করে…

মুখোশ তো বন্ধুর মুখ,

আস্তে-আস্তে খুলে যেতে থাকে…

১৪/৪/৯৮

ভয়ের ছবি

আমার মাথার কোনও তল খুঁজে পাচ্ছি না এখনও

সে কোন জলের নীচে, কত নিচু মাটিতে ঠেকেছে…

অথবা ঠেকেনি আজও, ভেসে-ভেসে চলছে কোনও জলে

জলের জঙ্গলে তার কত গাছ স্পর্শের বান্ধব

বেরং পর্ণের মুখে এঁকে দিচ্ছে প্রাণের উপমা

বুনো মেঘেদের দুধ জলে ভাসছে ফেনার মতোই

তার মধ্যে যুবকের ক্লান্ত মাথা ডুবে-ডুবে যায়

রহস্যকালীন চোখ জং-পড়া, কপালে ত্রিভুজ

চুলে কাঁটাতার আর মগজের অলিতে-গলিতে

লাভা নামছে ভারী-ভারী, মুণ্ডতাপ সূর্যের দ্বিগুণ

এই হল যুবকের ক্লান্ত মাথা শূন্যে যে চড়েছে

আর আমি জ্বর হওয়া বিছানায় শুয়ে দেখতে পাই

আমাকে অসুস্থ রেখে মাথা সব জলের ভেতরে

ডাক দিচ্ছে বন্ধুদের, যারা যারা মাথা ভাসিয়েছে…

২০/৩/৯৮

হাতবদল

আমাকে তোদের চোখে

মেলে দিতে-মেলে দিতে

কত নেমে গেল রোদ

তার মুখে দিল ছায়া

তবু ছোট হল দিন

আমাকে তোদের হাতে

তুলে দিতে—তুলে দিতে

চোখ মুছে নিল যারা

যারা ওই চলে গেল

ছোটমতো বাঁক ঘুরে

তাদের রোদের ডানা

দুই কাঁধে পরে নিয়ে

দাঁড়াব তোদের ছাদে

তোরা নিবি হাসাহাসি

তোরা দিবি ভুলোমন

আর ওই খুব রাতে

ছোটমতো বাঁক ঘুরে

একে একে নিভে যাবে

উঁচু-নিচু মোমবাতি…

২৬/২/৯৮

গ্রাম্য আমি

ভরসায় কাটাচ্ছি দিন, কেউ এসে তুলে নেবে-এই।

ততদিন স্বপ্নমোছা আলুথালু দু’চোখের দিকে

ছুটে আসছে গাছবন, ঘিরে রাখছে সমস্ত বিপদ

ততদিন ঢেউ-তৈরি-করা হাতে কথা বলছে জল

বলছে, আর ক্লান্ত মাথা নেমে আসছে মেয়েলি হাঁটুতে…

ফিরে চলে যাচ্ছি গ্রামে, ধুলো ঢাকছে ফেরাপথটুকু

সন্ধে-সন্ধে নামো হাওয়া, গল্প দাও পথের আড়াল

এই তো একবারই আসা। কেউ এসে তুলে নিয়ে যাবে—

তখনও বলব না কিছু-মন খারাপ করবে শুধু মাঠ

গাছ নেবে ফিরে পাতা, দাউ-দাউ জ্বলে উঠবে গ্রাম

দুটি সাঁকো বাধ্য হয়ে নদী ঢাকতে গিয়ে হবে ছাই…

আর তুই, তুই এত গল্পের মধ্যেও মনমরা—

একবারটি হেসে ওঠ, সোনা, তোর ঠোঁটের দোহাই,

গ্রাম্য আমি, তোর সুখী মুখের ওপরে আলো ফেলে

দেখাতে চাইছি গ্রাম, সমস্ত গ্রামের জেগে ওঠা…

১৯/২/৯৮

সেদিন কেন যে…

প্রেমিক, সেদিন কেন যে অতটা দূরে বসেছিলে!

মাথা নোয়াওনি গলে গিয়ে, তবু ভয় ছিল প্রাণে।

বুঝি তার কত হাত-ধরাধরি দেখেছে সবাই,

তোমার কতক চিঠি যেন গেছে উড়ে ওইদিকে…

গেছে যাক! আরও কত যাবে, তাতে ভাবার কী আছে?

আমি তো রয়েছি! আমরা তো আছি! ভয় কী তোমার?

তাছাড়া তোমার চিঠিতে যেমন ভাষার বাহার,

খোঁজ নিয়ে দ্যাখো-অনেকে তেমন পড়তে শেখেনি

১১/২/৯৮

আর কোনওদিন যদি

আর কোনওদিন যদি দেখি বন্ধু এরকম হতে

যদি আর দেখি বন্ধু হাতে ধরে আছ দয়াভোর

শিশিরে-শিশিরে মুখ জ্বলে যাচ্ছে তবু ধরে আছ

আশায়-আশায় ডানা বেঁকে চলছে তবু নড়ছ না,

আর ওই দয়া যাচ্ছে অবশ্য নদীতে মাঝি হয়ে

ডেকে নিতে যাচ্ছে নৌকো, ধরে নিতে যাচ্ছে বুঝি পাল

আর ওই ভোর নামছে হাপুস-হুপুস নদীতীরে

নদী তাই মুখ তুলে বলে দিচ্ছে কেন এত জল…

ইতিমধ্যে মাঝি এসে বুক তুলে ভোরের পাতায়

লিখে দিচ্ছে নামধাম, শরীর, ঠিকানাসহ মন

আর ঠিক তার পরে ভেসে চলে যাচ্ছে এরা সব

ভোরের ভেতর নদী, নদীতে মাঝি ও সোনাদয়া

ঘূর্ণিরূপে বাঁক নিচ্ছে, বাঁকের আদল নিচ্ছ তুমি…

যদি এরকম হতে দেখি বন্ধু আর কোনওদিন,

সত্যি বলছি! তুমি থেকো জেদ নিয়ে-ভেতরে ভেতরে

তুলকালাম হয়ে যাবে! আমি কিন্তু ছেড়ে চলে যাব।

১/২/৯৮

একটি দুঃস্বপ্ন

খাদের ধারে ঘোড়া তোমার মুখ

তাকিয়ে আছে গভীরতার দিকে

যেখানে রুপোজলের নীল ধারা

বয়ে চলেছে পাহাড় থেকে রাতে

রাত মানে তো সাহসী জোছনায়

বুক জাগানো পাহাড় দিকে-দিকে

পাহাড় থেকে পাহাড় তত দূরে

ডাকার কেউ, দেখার কেউ নেই

একলা তুমি, ঘোড়া তোমার মুখ

তাকিয়ে আছে রুপোজলের দিকে

এই তাকিয়ে থাকতে থাকতেই

জলের গায়ে নিজের মুখ দেখে

নিজের রূপ সামলাতে না পেরে

এই যে, এই ঝাঁপ লাগালে জলে…

২০/১/৯৮

এসো দীপ

এসো দীপ, এসো, জ্বলো, অন্ধকার টেনে

দূর থেকে এসো দীপ, এবার তোমার

ভূমিকা নেবার দিন, ছোটবেলা থেকে

ধারাবিবরণী শুনে বড় হতে-হতে

ঘাড়ে যে ক’খানা মাথা, তাও ভুলে গেছি

হাততালি দিতে-দিতে দু’হাতের তালু

ক্ষয়ে গিয়ে রক্ত আর হাড় দেখা যায়

এসো দীপ, এসো, আজ তোমার সহায়

আশা আর ভরসা তুমি। জ্বলো দেখি! জ্বলো!

বাতাসের সঙ্গে কিছু মিতালি পাতিয়ে

শহরে-শহরে ফের জ্বালো লোকগীতি

৯/১/৯৮

অভিশাপ

থাকলে ভাল।

এখনও মন আকাশপানে

থাকলে হয় ভাল।

এতদিনের

অনন্যতা, কে জানে, তার

কীভাবে চমকাল;

কীভাবে সেই

রাস্তাপথ, নামার বেলা

সে মনে রাখল না—

যেটুকু আজ

রক্তজল, না, প্রতিশোধ

তবুও বলব না;

পারিনি, জানি।

পারিনি আমি সেসব, যা-যা

অন্যলোক পারে…

শুধু আমার

না-পারাটুকু, তাকেও যেন

পাগল করে মারে!

৩/৮/৯৮

দুঃসংবাদ

অশ্বের পিঠে উপহার

চাপানো রয়েছে, বৈকাল,

খুলে নাও, আজ খুলে নাও

ঝুরি-মেঘ নামা সন্ধ্যায়

কত সন্দেহ, রক্ষী

পার হতে-হতে ক্লান্ত

হাঁটু ভেঙে গিয়ে প্রত্যয়

মৌমাছি ওড়ে, বৈকাল,

পিঠে যে দেখছ উপহার—

কী রয়েছে ওতে? কী আছে?

আশ্রয়? শিলা? মুদ্রা?

তেষ্টার জল? শৈবাল?

কিছু না। এসব কিছু না।

খুলে দ্যাখো, দ্যাখো বৈকাল

ওখানে বন্দি রয়েছে

কিছু হাড়, কিছু ভস্ম…

অশ্বটি তার মৃত্যু

স্পর্শ করেছে গতকাল!

২৫/৭/৯৮

যাদের কিছুতে বোঝানো গেল না

হঠাৎ করে ঝলসে ওঠার সুযোগখানি

হারাতে নেই, তাই তো বোধহয় ফিরল না মুখ

এপারপানে, ওপার থেকেই মিলিয়ে গেল

ফিরল কেবল হালকা, কোমল প্রতিধ্বনি

ভাসল জলে চাবুক, খিলান, অরুন্ধতী

আর ক’ফোঁটা হাওয়াবাতাস সহজ সরল

কিন্তু তাতে মীমাংসা নেই, চরমপথে

এক’পা-দু’পা দাঁড়াচ্ছে সব গাছগাছালি

জ্বলন্ত কাঠকয়লা আমার ভেতর-ভেতর

যখন-তখন বিস্ফোরণের আদল নেবে

তোরা বলবি; দু’এক মাত্রা এদিক-ওদিক…

তুমি বলবে: ও কিছু নয়। ছন্দোপতন…

তাই যদি হয়, জবাব দে না, উত্তর দে—

সকাল-সন্ধে, এপার-ওপার, আসতে-যেতে

এই যে জীবন পাত করে দিই,-কীসের জন্যে?

২৪/৭/৯৮

নিভে-যাওয়া চাঁদ

কে তোমার মুখে চাঁদ বয়ে আনে?

নাতিশীতোষ্ণ চিবুকের নীচে

কে বসায় রোজ কল্পনাতিল?

কে ধরে তোমায় বুকের ভেতর,

যখন বাড়ির জানলারা খোলা,

ঘন-ঘন লোক আসছে-যাচ্ছে

পৃথিবীর সব টেলিফোনগুলো

একবার বেজে হঠাৎ কেমন

চুপ হয়ে গেলে কে তোমায় দ্যাখে?

সে কি অনন্যসাধারণ কোনও

মৎস্যকন্যা? অথবা পারুল?

তুমি তো জানো না, তলায়-তলায়

আসলে সে এক নিভে-যাওয়া চাঁদ।

যতবার তাকে কুরে-কুরে খাও

সে তত তোমায় বুকের তলায়

আশ্রয় দেয় আর নিজে এক

কষ্টিপাথরে মুখ ঘষে-ঘষে

কোনওরকমের শান দিয়ে নেয়,

সে তো বুঝে গেছে আস্তে-আস্তে

তোমাকে বন্ধু বানাবার পর

পোহাতে চলেছে কতরকমের

ঝঞ্ঝাট!

২৬/৯/৯৮

ভাঙাগান

তোমার ওই কপালের টিপ, তাও

ছুড়ে ফেলে দিতে পারি গঙ্গায়

যদি আজ সত্যিই না জানাও

এতবার পেরনোর কী কারণ—

কী নতুন শিহরন এই জল

দিতে পারে, যা আমার জানা নেই?

জানি, শিষ ভেঙে যাওয়া পেনসিল,

তুমি আজ কপালের ভরসায়

পৃষ্ঠায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াবেই

তারপর কোনওদিন কবিতায়

পরিচিত নামতার এক, দুই…

সেই দীপ খননের কৌশল

সে কোথায়, কত নীচে ভাসমান…

সবই হবে। সবই। হবে সব্বাই।

শুধু এক মিনিটের জন্যেও

এই সুর যদি আজ ফসকায়

জেনে রেখো, তবে আর কোনওদিন

কোনও গান দাঁড়াবে না কণ্ঠে…

শুধু এই ভাঙাগান ভাসানোর

দৃশ্যটি চেয়ে নিল সাক্ষী

আর সব ঠেলে দিল সন্ধ্যায়

এই প্রতি ইঞ্চির বাবুঘাট

২৬/৯/৯৮

এবারকার চিঠি

আজ গাছেদের সঙ্গে কথা বলে কোনওমতে বসন্তের ব্যবস্থা করেছি।

প্রথম-প্রথম কেউ রাজি হচ্ছিল না, শেষে বলল চেষ্টা করে দেখতে পারে

আমার দোলনাবাড়ি ওরা জানে। পথে কিছু সাশ্রয়ের কথাও বলেছি

বলেছি যে কমে হলে ভাল হয় না হলে তো এ-বছর দেখাই হবে না—

আবার কাজের দিনে কুড়ুল চাপিয়ে কাঁধে বনে-বনে ঘোরার বেলায়

সব শোধ করে দেব। ওরা গাছ। বিশ্বাস করেছে। তবে একথাও ঠিক

তেমন তো সাধ্য নেই, না-হয় পরের বার দেখা না-ই হল, কিন্তু আজ

তাড়াতাড়ি চলে এসো, পুরনো পাতায় আমি বসে আছি, অন্যথা কোরো না…

২৩/৯/৯৮

আমরা বাড়ি

আমরা বাড়ি। আমাদের কাছাকাছি রয়ে একদিন

শতদল ছিন্ন হয়। বর্ষায় উহারা যায় পুষ্করিণী হইতে খুব দূর-দূর দিঘি…

বর্ষা এইরূপ করে। পশ্চাতে সকল দোষ আমাদের হয়।

আমরা জড়। বুদ্ধি নাই। আমাদের সকল প্রকার

দৃশ্যের অভ্যাস আছে। উড়াইলে উড়িয়া যাবে এমত জীবন পাই নাই।

পরিবর্তন বলিতে, বর্ষার কিঞ্চিৎ পরে

শীতের বাতাস পাইয়া দক্ষিণদিকের জানালার পুরাতন শার্সি ভাঙে—

পুনরায় বর্ষা হইলে কোনওমতে নূতন লাগাই…

১৪/৯/৯৮

বসন্তের চারদিন আগে

বসন্তের চারদিন আগে পেচ্ছাপের সঙ্গে দেখি

জলকমল টিয়ারগ্যাস অমনোনীত কবিতাগুলো আর

উপার্জন বেরিয়ে গেল হু-হু করে

তখন আমার কী অবস্থা কেমন ভাবে ঠিকরে পড়ে

ঠিক কেমন কচ্ছপের ভঙ্গিমায় বেরিয়ে যাব গলে

কোতল করো হাসিচেষ্টা পোড়া ঝাঁঝরা লাশের নীচে গোপন চিরকুট

চিরকুটের দু’অধ্যায়-তিনঅধ্যায় আরও তলায় চাপা

কে তুলেছিল কেউ না তারা নিজেই উঠে মধ্যরাতে গগন

কাঁপিয়ে তুলে বাজিয়েছিল বল্লমের বাঁশি

সেই সুরের ভেতর দিয়ে শয়তানের বুদ্ধি ঝরে কু-ঝিকঝিক-কু-ঝিকঝিক আরও

কোলবালিশ আঁকড়ে ধরো মাকে জানাও ভয়ে তোমার ঘুম আসবে না রাতে

ঘুম আসবে না কেন রে শালা

সারা দুপুর কাকুতি যায় এ-টেলিফোন ও-টেলিফোন সে-টেলিফোন বেয়ে

সেই বেলায় লজ্জা নেই এখন কোন মায়ের ব্যাটা বাঁচায়

প্যাঁচকলম মারাত্মক চপাত্‌ করে এফোঁড়-ওফোঁড় পেট

ঘুড়ির মতো কাটাকলের ধকল যদি না নিতে পারে না নিক

মাঠে শোয়ার পরে তো ঠিক জামাকাপড় খুলে রাখার পরে

অবস্থার ওপার থেকে দুলিয়ে নেবে স্বজনহীন দেহ

তখন কার বল্লমের বাঁশির সুরে বেরিয়ে যাবে পাপীর মুখটুকু

আর সকল প্রজন্মের জোনাকি এসে বাকিটা ঠিক কুড়িয়ে নিয়ে যাবে

পড়ে থাকবে কেবল সব জলকমল টিয়ারগ্যাস অমনোনীত কবিতাগুলো আর

দেহ…

১৯/৯/৯৮

জোকার

চোখ কুঁচকে হাসিতে ফেটে পড়ছি বলে আমার দিকে অমন করে

তাকিও না আমাকে মেঘ ভাবলে মেঘ মাটি ভাবলে মাটি

ভয় ভাবলে ভয় কিন্তু ওরকম ভাবে তাকিও না চোখ ঠেলে জল

আসছে হাসির চোটে তাড়া খেয়ে জামার ভিতর ঢুকে পড়েছে বাইশটা

জ্বলন্ত ভ্রমর আর তাদের প্রচণ্ড কাতুকুতুতে মরে যাচ্ছি হেসে আমার

দম ঠিকরে আসছে আমি হাসতে-হাসতে পেট চেপে মাটিতে শুয়ে

পড়ছি গড়িয়ে যাচ্ছি অবাক হচ্ছ ভাবছ মাথার ঠিক নেই কিন্তু

একটু পরেই পৃথিবীর সবক’টা স্বরবর্ণের উপর দিয়ে হু হু করে

ছুটে বেরিয়ে যেতে হবে….

না হাসলে আমি পারব কী করে?

১৩/৯/৯৮

পাখিযন্ত্র

পাখিযন্ত্রের মতো হয়ে গেছি। শাবকের চোখ

খুবলে বসাই গতজন্মের চোরালন্ঠন

খড়ের শিয়রে দাঁড়ানো রাতের ঘুমন্ত চাকা

ছুঁয়ে দেখি ঠিক নড়ে ওঠে কি না আর গুহা থেকে

সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত বেরোয়

সে রক্ত চাপা দিতে-না-দিতেই এত ভয়ানক

মনে পড়ে গেল বহুজন্মের আগের চেহারা

পাখি তো তখন। ভাষা পালকের। পেশা: রোদ্দুর।

দিয়াপথ। দিয়া কাননে-কাননে পছন্দপীড়া—

সেবা। ধানশিষ। ভাঙা জল। এই করতে-করতে

আমার ডানায় তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়ে, শেষে

সকাল-সকাল ঘুম থেকে তুলে জীবন যেদিন

ঠোঁটের ভেতর গুঁজে দিয়েছিল জ্বলন্ত কাঠ…

সেইদিন থেকে পাখিযন্ত্রের মতো হয়ে আছি।

দিনে কতবার ঠোক্কর মারি নিজের ডানায়—

হিসেব রাখি না। আর যদি আজ ভাবো খুব জোর

ব্যথায় রয়েছি, ছেঁড়া ডানা দেখে— মিথ্যে ভাববে।

বিশ্বাস করো আর না-ই করো, সত্যি বলছি,—

পাখিযন্ত্রের কোনওরকমের কষ্ট হয় না…

১২/৯/৯৮

সম্পূর্ণ কাঠের কবিতা

আবার কাঠের দিন আসে, অলি, টেবিলে-চেয়ারে

ঠোকাঠুকি লেগে কাদা উপচে পড়ে। ঘরময় কাদার ভিতর

আমি হাবুডুবু খাই, রাত্রিদিন কে জেতে-কে হারে

খেলা হয়। আজ সেই খেলা শেষে কোনওভাবে আমিও কি তোর

পিপাসা মোছাতে চাই? বলতে চাই কিছু? না বলি না?

শুধু খটাখট শব্দে ডাকে দুটো প্রজাপতি পায়ের পাতায়

বেঁধে আছে, জল নাকি? হাওয়া? আসলে তো শেকলই না

কাঠের আষাঢ় মাসে কাঠের বৃষ্টির ছাঁট কাঠের ছাতায়

কাঠ, কাঠ, কাঠ, কাঠ, কাঠ হয়ে উলটোদিকে ছোটে

এই মুহূর্ত থেকে সব দাঁত কাঠ, সামনে সব কাঠের খাবার—

নাভি ওড়ে ডানা মেলে, কেঠো-চুমো কাঠের দু’ঠোঁটে,

আবার কাঠের দিন ঝেঁপে আসছে, অলি, এই শরীরে, আবার…

৮/৯/৯৮

আজান

আজ একটা দিনের জন্যে তোমার কাজের বন্ধনী

খুলে রাখো। এই আমি এসেছি কতদিন দূর থেকে, কাঁধে ঝোলা,

আজ কী বার? মনে পড়ছে না। দ্যাখো, আমি একটা কাঠের

পুতুল, তোমার ভাল চাই না, বুঝি না, রক্ত এখন কাঠ হয়ে

ফুঁড়ে বেরচ্ছে শরীর থেকে, এই সন্ধে হল, জানি, এখন এক সপ্তাহের

মতো একটা চুমু খাব, প্রচণ্ড… তারপর, বিপদ ছাড়া আমার

মাথায় কিছু নেই, শুধু তুমি, শুধু একবার তোমার কাজের

বন্ধনী খুলে রেখে, চুলের মুঠি ধরে আমায় ঝাঁকিয়ে, মেঝেতে পেতে

ফেলে ডানদিকের চোখ গলা অবধি চুষে নাও

আমি বারণ করব না…

২৮/৮/৯৮

অনন্যোপায় সন্ধে

ভয় পাইনি রাত্রে জেগে

অন্যরকম কষ্ট এসেছিল।

কী জানি কী মাথার মধ্যে ‘বসন্ত-বসন্ত’ হল—

কেবল জানি শরীর খারাপ।

মনও।

কী করি, কী করি…

অনন্যোপায় সন্ধে জেনেও ইচ্ছে হয়েছিল

মায়ের বুকে মুখ গুঁজে খুব কাঁদি।

মা তো অনেক দূরে।

সবজান্তা সন্ধে নেমে এল।

গন্ধে আমার মাথাখারাপ, খারাপ মাথা নিয়ে

তোর কাছে পৌঁছলাম,

অল্প আলোর আন্দাজে এক অন্ধ যেমন চায়

আমার জাহাজ ডুবতে-ডুবতে বার্তা মুছে নিল

কথা বলার ইচ্ছেও হল না।

কাছে থাকব, জড়িয়ে শোবো, পারছি না কিছুতেই…

পারতে হবে। চতুর্দিকে হু-হু করছে

লোকজন। লোকজন।

লোকে আমার কষ্ট নিল, আমি লোকের দয়া

মাথার মধ্যে ‘বসন্ত বাতাস’

সেই মুহূর্তে আগুনটাকে চাদর চাপা দিতে

না, তোকে পোড়ানো ছাড়া

আমার কোনও রাস্তাই ছিল না!

২২/২/৯৯

রবি ঠাকুরের কাছে ঋণ

কখনও তোমার হাত ছিলাম না ছুঁয়ে নিতে, কোনওদিন ছোঁব ভাবিওনি

অথচ তোমারই পথ টেনেছিল যদি আমি হেরে গেছি— জীবন এমনই।

সফেদ-পাথর ঠেলে সারাদিন পর কত দরকার তোমার দরোজা—

বসন্ত তখন, বড় সুগন্ধ তখন, আর আমি সেই বিকেলের প্রজা

দু’ হাতে ফসল আর ফসলের বিষণ্ণতা, জানি, তুমি মাপ করে নাও

ছোট চুল, তবু খোলা, তবু তাতে কত রাত কেটে গেছে, কত উপমাও…

দিগন্তে পরের ভোর অপেক্ষায় বসে আছে, আর সেই ভোরেরও পতন

অতীত ফুটিয়ে তোলে। আমরা অতীতের হই। স্বাভাবিক। জীবনই এমন।

আকাশ নীলের ঘরে নীলের পোশাক, নীল সন্ধে ছেড়ে ওপারে হঠাৎ

দরজা খুলে গেল, রাত আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে, সামনে শুধু মাঠ আর মাঠ…

আলো কি প্রেমের শত্রু? বন্ধুতারও? তবে কেন নতজানু আলো-আঁধারিতে

তোমাকে সঙ্গিনী মনে হয়েছিল? বারবার দুঃখ গেছিলাম চিনে নিতে?

আমার হারানো চুলে হাত রেখেছিলে শেষে, চেনা চেনা দূরের আজান

মনে পড়ে, বারান্দায় ঠান্ডা হাওয়া দিয়েছিল, তুমি সেই গেয়েছিলে গান…

৮/২/৯৮

একটি মরুভূমিয় গল্প

উলটে পড়েছে সকল তারার নিভু নিভু আলো রাত্তিরবেলা তাকলামাকানে

ভাঙা উৎসবে গান গায় যারা তাদের সঙ্গে মাখামাখি করে রাত বাড়ে আর

অলস চাঁদোয়া

দোলা দেয় শুধু দোলা দেয় শুধু দোলা আর সব বাচ্চা নদীরা কিচমিচ ক’রে

ভোর করে ফ্যালে… ওলটানো তারা সোজা করে রাখে বুড়ো বাতিওয়ালা

চলে যায় কারা চলে যায় যারা চলে-চলে যায় কখনও কি আর ফেরত আসে না?

উত্তর দেবে ভাবতে-ভাবতে শাড়ি-জামা-সায়া-দুখিনী ব্লাউজ মেলে যে-গৃহিণী

সে তো কক্‌খনো তাকলামাকান দূরে থাক, কোনও মরুভূমিতেই যায়নি, কিন্তু

চুল সরানোর ফাঁকে-ফাঁকে তাকে নাড়া দেয় কোনও উষ্ণ তামাটে যুবা বেদুইন

অলস চাঁদোয়া দোলা দেয় আর দোলা দেয় শুধু তার চোখে ভাসে রোদের উপমা

হঠাৎ পাশের বারান্দা থেকে প্রতিবেশিনীর গলা ভেসে আসে ‘তুমি যে কী

করে ওড়না ছাড়াই…

ওনার তো ভাই সহ্য হয় না।’ একথা তখন কানেও ঢোকে না, সে মনোবিহীনা

কী করে বোঝাবে

ওড়না যে তার উড়ে চলে গেছে ছায়াপথ ছায়াসুদূর তন্দ্রা তাকলামাকানে

সে না হয় এই ঝাঁঝালো শহরে পড়েই থাকল সারাটা জীবন। তার সে ওড়না

দামাল হলুদ মরুভূমিতেও পছন্দমতো নবীনবরণ করে-করে ফেরে

আর সে রেলিঙে ভর দিয়ে দ্যাখে সন্ধেবেলায় সেই ওড়নাকে লাঠিতে জড়িয়ে

বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করছে যুবাবেদুইন, ওরফে এদেশি রাখালবালক…

১৭/১/৯৯

মা

তোমার ছেলের কণ্ঠে সামগান আসবে না কোনওদিন।

সে কষ্ট বোঝে না, আর স্পর্শ তো দূরের কথা,

সারাদিন একা-একা থেকে

সন্ধের শহরে সব চিল, বাজ ধুলোপাখি

কাঁধ থেকে আকাশে ওড়ায়।

তোমার ছেলের চোখে শতাধিক মণি

তারাও প্রত্যেকে একা, তারাও প্রত্যেকে কর্মহীন

যখন দু’হাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে, জানো,—

এই পুরো পৃথিবীটা তার কাছে খাদের কিনার?

পঁচিশ বছর আগে, স্বপ্নিল, পুষ্পিত দেহ থেকে

সেই ভোরে, নদীর মতো স্রোতকষ্ট বুকে নিয়ে,

কাকে জন্ম দিয়েছিলে, মা!

৯/১/৯৯

২ জানুয়ারি: ফেরাপথে

তোমার মুখ থেকে একেবারের জন্যে হলেও, ঝরে পড়তে

পারি না, না?

ঝুরোঝুরো কুয়াশার মতো গতিবেগ নিয়ে

কোথায় যাব তাহলে?

মাথায়, আজ মাথায় সাজিয়ে রাখছি প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক

শীতকাল, উল…

বলো? হ্যাঁ, জানি, আমার ধানখেত ছিল, ধানখেত

হয়েছিল কেউ একজন

আর তোমারও তো মাথায় হাত ছোঁয়াবার মানুষ ছিল

কিন্তু সেসব তো পাখিদেরও থাকে

পদ্মপাতার ঢাল গড়িয়ে নামতে নামতে

কাল সারারাত ভেবেছি এরকম লিখব

বলো? সকালরোদে ঝমঝম করে ক্রিকেট খেলার

মতো বাঁচবে না?

বলো? হ্যাঁ, জানি,

কিন্তু আমার মাথায় বুনে নেওয়া শীতকালে

ঝাপুর-ঝুপুর গুলমোহর গাছ থেকে ঝরে-ঝরে যাচ্ছে সোনা…

তোমার মুখ থেকে, একবারের জন্যে হলেও

ঝরে পড়তে পারি না?

৩/১/৯৯

দ্বিধায়

শুখা-শুখা কষ্ট হল। শুখা খেদ শ্বাস থেকে বাতাসে ভাসাই

রোদ্দুরে কাপড় মেলে একা যদি চলে যেতে পারতাম, ওদিকে…

বুক বন্ধ। হাওয়া-হাওয়া, বাতাস-বাতাস করছে দু’বুকের ঘর

এখন তো দিন, হয়তো সাতদিন ঘাস থেকে ফড়িং ওড়েনি

এও হতে পারে শীত আসতে-আসতে আরও প্রায় বছর সাতেক

এখন ফেনায়, সাদা সাবান ফেনায় ভরা কাঠের বাস্কেটে

হাত ডুবিয়ে মনে করছি ভাল আছি, মনে করছি দুঃখ পেতে নেই

বেলাবেলি চান করব, পরিষ্কার জামা পরব, ছিমছাম, অথচ

রোদ্দুরে কাপড় মেলে একা যদি চলে যেতে পারতাম, ওদিকে…

১/১/৯৮

অন্ধজন-৪

সেই তো মাছউঁকি আর পালটাউঁকি জালে-জালে অবাধ্য স্পৃহায়

হে মধু অসহ্য মধু যদি মুখ মনে পড়ে কোনও-কোনও দিন

অত চিন্তা যদি শেষ আর হয়তো প্রাণপথ জলের তলায়

সবুজ বুদবুদ ঘুরছে হলুদ বুদবুদ ঢুকছে আস্তে আস্তে ঘরে

সে হায় শ্যাওলা আর চরমের মাঝপথে বন পুড়ে-পুড়ে

তাকিয়ে রয়েছে সেই নিস্পন্দ বেগুনি চোখে হঠাৎ ভীষণ

তাপ ওঠে তাপ এসে কপাল পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি সব

হাওয়া ঘুরতে ঝড় ঘুরতে মন মানিয়ে নেয়, মন মানাতে হয় তো

চেলো বাজে, গম্ভীর ধূসর চেলো অতীতের আভিজাত্য ঢেলে

আঁধারে মিলায় তাও বাঁক নেওয়া পথে মুখ তেমনই হতাশ

খোলা দরজা দোলে মাছউঁকি পালটাউঁকি তার পাখা থেকে সরে

একবার দাঁড়ায় দৃষ্টি বিছিয়ে-বিছিয়ে বোঝে অন্ধতা কেমন

হতে পারে…

১/১/৯৯

যে মেয়েটিকে বলব না

জলে মেয়েটির ছায়া পড়েছিল, তাই দেখে,

আমরা সবাই শুয়ে থাকলাম সকালভর।

কিচ্ছু হল না। কোনও কাজ নয়। কেবল পথ

পড়ে থেকে-থেকে দেখল বিফল যাত্রাদিন—

অপেক্ষা করে মনখারাপের বাঁক নিল

আকাশ তখন পছন্দসই উচ্চতায়

শুভ আলপনা। মেয়েটি কেমন অতসী। সে

এত গল্পের কোনও অধ্যায় জানল না।

তাকালে দেখত— বাঁক নেওয়া পথে শুয়ে আছি—

জনা দশ-বারো লালকমল আর নীলকমল;

সবার জামায় ফুল ফুটে আছে। বোতাম-ফুল।

ভাবলাম তাকে দেব। ভাবলাম, কাছে ডেকে

বলি— ‘এসো ওই নন্দিতভালে ঠোঁট পেতে

স্মরণপাখার গুঞ্জনে মুখ মুছিয়ে দিই।’

মনে-মনে তাকে বললাম। শেষে মনে-মনেই

শুদ্ধ পাতায় সাজিয়ে দিলাম শরীর, আর

দু’হাত বাড়িয়ে মূর্ছা নিলাম সবান্ধব,

জলে মেয়েটির ছায়া পড়েছিল,— তাই দেখে।

২৮/১২/৯৮

রাত্রিকথা

রাত্রি ভাল লাগে না আর। অন্তত

পার হবার রাত্রি নয়। সেতুবিহীন

সংকেতের রাত্রি যদি দাও তো দাও—

না হয় এই গন্ধসীমা আড়াল হোক

ছোট হলেও, পৃথিবী হোক দিগন্তের

আমার বুকে ভুলে যাবার দায়িত্ব

হালকা হোক— সকল মনে রাখতে চাই

রাত্রি ছাড়া। সেও তো কত ভালবাসার

সঙ্গী ছিল, এখন শুধু নির্ধারক

হয় বোধহয় মাঝেমধ্যে আমারও তো

আমারও দুই অমনোযোগী চরণতল

সকাল চায়। আজ যেমন টালমাটাল

বুকের নীচে পুরো শরীর মেঘের ভার

স্বপ্ন ছিল সরাইখানা; —সারাজীবন।

এখন দূর অবধি কোনও পিদিমও নেই

এমনভাবে হিসেবহীন রজনীদল

ঝাপসা হয়ে কোনওরকমে হাঁটার পর

কখনও যদি ঘুমিয়ে পড়ি অনিচ্ছায়—

যন্ত্রণার সাক্ষ্য তুমি দেবে তো, পথ?

১৩/১২/৯৮

ডাক

আওয়াজ কখনও ফেরত আসে না। ডাক ফেরে।

উপত্যকার দেহে মুদ্রিত বনাঞ্চল

আটকায়, তাকে ছাড়তে চায় না। কিন্তু সে

আকাশ পঠিত। সবুজে-সবুজে ধাক্কা পায়

শেষে ঘুরে ঘুরে বিশ্রাম নেয়, বিশ্রামের

কারণ জুড়োলে নেমে আসে চাঁদ ভূ-পৃষ্ঠে

অদৃশ্য চাঁদ তখনও কেমন নান্দনিক

উপত্যকায় ক্লান্ত ডাকের অভিভাবক

সুপ্ত। প্রয়াস খুঁড়ে জল নিত যে-দর্শক

সে কোথায় নিজগৃহের ছোট্ট অঙ্গনে

ঘুমিয়ে পড়েছে। হাজার ধোঁয়ার সমান শ্বাস

সবুজে-সবুজে মাথা কুটে-কুটে মরতে চায়

মরে না। এমন প্রায়শই হয়। ঠিক তখন

মাটিতে, বাতাসে, তরঙ্গে আর কম্পনে

রেশমের মতো লজ্জিত হয়ে মেশার পর

ডাকতে-ডাকতে কণ্ঠ কীভাবে পালটে যায়,

তোমাকে শোনাব, প্রতিধ্বনির মরশুমে

১৩/১২/৯৮

১২ ডিসেম্বর: ব্যর্থতা

আজ রাতে তোমাকে চিঠি লেখার বদলে আমি

একটা গান গাইব।

সারাদিনের কাঁধ থেকে ঢেউনক্ষত্রের

নিশ্বাসভার নামিয়ে রেখে লেখার টেবিলের সামনে

আসব আর এক অক্ষরও না লিখে শুরু করব

এই গান।

তোমার অপেক্ষার গান।

আমার জন্যে সারাদিন, সারা জোনাকিজন্ম ধরে

প্রতিমুহূর্তে বাড়তে থাকা অপেক্ষার গতি আর

আমার পৌঁছতে না পারার মাঝখানের অংশের

এই গান

কখনও-না-কখনও পৌঁছে যাবে ধরিত্রীর গায়ে

যেখানে কেউ ভাষার রং শেখেনি, সকল জোনাকি

ধেয়ে যায় নীল, আর মাটি ভেদ করে সূর্যের দিকে

নিষ্পাপ তাকিয়ে আছে তোমার অর্ধেক পৃথিবীর

মতো স্তনের দুটো কুসুমশিখা

তুমি কেঁদেছ— তার গান।

আজ রাতে তোমাকে চিঠি লেখার বদলে আমি

এই গান গাইব।

১২/১২/৯৮

ছোটবেলায় শোনা একটি ছড়া

আমি আজ আনতে চলেছি যার জল, সে আমায় চেনে না।

এই পাথরের রাস্তা ভেঙে-ভেঙে সেইখানেই তো যত কারচুপি

পেছনে দুলছে সেবাব্রত পাইন গাছেদের ইতিহাস

সামনে টিলার পর টিলা আর শেষে জল

বোধহয়।

সাবধানি আমার চোখ, কান, কিন্তু মুখকে বিশ্বাস নেই

তার তো অনেক সহজলভ্য বার্তা জানা

এই একটার পর একটা ডিঙিনৌকো সে বলবেই

এই বিনীত খসখসে পাতার চিঠিও সে বলবে

আর হাতের পাত্র, কিংবা বসুন্ধরা

উড়ে গিয়ে পড়বে কাদায়।

মিশ্রণও এক ধরনের রহস্য আর মোটেই তা ভাল নয়

কোথায় থাকবে তখন পুরো উপত্যকার কর্তা সূর্য

কোথায়ই বা কুয়োতলার হলুদ বোতাম ফুল

কেবল পাহাড়চুড়ো থেকে নিঃস্ব দেখা যাবে নীচের

ধোবিনীদের টাঙানো রং বেরঙের জামাকাপড়… তাও শুকিয়ে যাওয়া অবধি

এতকিছুর পরেও একটাই যা ভরসা,—

আমি আজ আনতে চলেছি যার জল, সে আমায় চেনে না।

১১/১২/৯৮

আমরা সাত ভাই

বৃন্ত থেকে চ্যুত হলে ফুলকে

কী নামে ডাকো? অবৈধ সন্তান?

জামার নীচে অপরাধী উল্কি

লুকিয়ে তুমি দেখেছ শ্রাবস্তীর

ধানের খেতে বিঁধে আছে উল্কা

সেখানে সব ছাদভাঙা বস্তির

মানুষ দেয় পরবের শুল্ক

শামুকগাড়ি টানে অনুসন্ধান

ধরিত্রীর বিবাহের পণদান

করোও আর কান-মাথা-চুলকোও

শেষটা ছাড়ো কী বাক্য স্বস্তির

‘ধান তো নেই, অবৈধ ফুল খাক!’

এহেন দিনে পালছেঁড়া কশ্তির

সওয়ারি হওয়া খুব একটা ভুল কি?

আমি যে আজ সকালে আমনধান

গোলায় নিতে দেখেছি পারুলকে!

৯/১২/৯৮

অন্ধজন-৩

আমাকে বহুবার তুমি মার্জনাময় ফুলের বীথি দিয়ে

পার করে নিয়েছ। আমি টুঁ শব্দ করিনি। বরং গিয়ে

যার কাছে উঠেছি, সে তো তুমিই। তোমার অনন্ত দীর্ঘতা

জ্বালাচ্ছে পোড়াচ্ছে সফেদ শান্তির পতাকা। সকল শ্রোতা

সেই দেখে আকুল হল। এই দেখে সকলে আমার হাতে

শেকল পরাল। তুমি বারণও করলে না। কেবল রাতে

আড়ালে, চুপ করে, আমার কানে-কানে শেখালে বন্যতা—

ততক্ষণে অন্ধ আমি। ব্যস্ত ভীষণ, খঞ্জনি বাজাতে ।

৭/১২/৯৮

বিলাসখানি

দাঁড়িয়ে রয়েছি। তুমি তো আমাকে কুয়াশাতলায় দাঁড়াতে বলেছ—

সকাল হচ্ছে— লেপের ভেতরে ঘুম জড়াচ্ছে শান্তির দূত

এমন সকালে ছোট পত্রিকা নতুন কবির লেখা বার করে

সকাল হচ্ছে, একটু পরেই বিলাসখানিতে গান শুরু হবে—

হঠাৎই হাজার রাতজাগা চোখ মন্ত্র শুনতে প্রস্তুত হয়

আমি দাঁড়াচ্ছি, দু’ হাতে তখন ধ্রুবতারা আর প্রভাতী-চাদর

বিলাসখানিতে গান শুরু হল, প্রাচীন বটের শুশ্রূষা নিয়ে

লক্ষ-লক্ষ আলপিন সোজা নেমে এল চীরমহাকাশ থেকে

আমাকে বিঁধছে, লাগছে আমার কপালে মাথায় কুচো বিদ্যুৎ—

সা রে গা পা ধা সা রে গা ছুটে গেলে; নামার সময়ে নিখাদ লাগিয়ে

মধ্যমে যেই দাঁড়ালে, আমিও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি। বলি,—

ভগবান, ওকে মেয়ে করে দাও, মেয়ে করে দাও, আমি একবার

বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদি, প্রার্থনা করি, আশ্রয় চাই

আমি যে প্রহরী, আমি যে গাছের গতজন্মের শস্যবন্ধু

ফিরে আসব না? কবিতা লিখলে পড়ে শোনাব না?— বলতে-বলতে

সকাল ফুরল। কোনওমতে দেখি— বিলাসখানির শাখা নুয়ে পড়ে

কথা ঢেলে দেয় তানুপুরো থেকে পাঞ্জাবি হয়ে সুরমণ্ডলে

এমন সকালে নতুন কবির বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না,

শুধু ধ্রুবতারা, প্রভাতী চাদর, শান্তির দূত উড়ে চলে গেলে

গাছকে ঘিরবে শতশাখা, আর গাছ থেকে ঠিক একটু দূরেই—

দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি তো আমাকে কুয়াশাতলায় দাঁড়াতে বলেছ…

৩/১২/৯৮

একদিন রাতে আমি…

মাথায় রাত, পায়ের নীচে আরব মরুভূমি

বালির তাপ, পদচারণা, জুতোর মশমশ…

অদূরে গোটা পাঁচেক তাঁবু, প্রত্যেকের আগুন

আলাদা করা, দু’চারজন প্রহরী হাত সেঁকে

মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে মিহি ঘোড়ার ডাক

আর কখনও শনশনিয়ে হাড়-কাঁপানো হাওয়া—

এছাড়া আর কিছুই নেই, উৎকণ্ঠা আছে।

ভোর রাতের দিকে আমরা রওনা দিতে পারি

যেখানে বালি শেষ হচ্ছে— আবছা মতো আলো

আমরা সব ঝাঁপিয়ে পড়ে মিশিয়ে দেব। লুঠ!

হ্যাঁ, সকলেই ডাকাত। কেউ ভালমানুষ নই—

সবার হাতে দুটো জিনিস,— লাগাম তলোয়ার।

কাল ভোরেই বিরাট দাঁও, তৈয়ার সবাই

এখন শুধু কিছু প্রহর নিথর। বিশ্রাম।

আমার তাঁবু আলাদা, আমি এদের দলপতি

ঘুম আসছে না। চোখের পাতা বন্ধ করে আছি

খোয়াব নেই। পাশবালিশ পুরনো হয়ে গেছে।

মাথার নীচে যে রমণীর উল্কি আঁকা ঊরু,—

পূর্বে তাকে দেখিনি, আর কখনও দেখব না

মায়ের মুখ মনে পড়ে না। বাবার নাম নেই

জন্মে থেকে দেখেছি খুন, শিখেছি লুণ্ঠন

এখন খুব নির্দ্বিধায় এসব কাজ করি

করি, কারণ আটকাবার তেমন কেউ নেই

আছে কেবল শরাব, পোড়া মাংস আর রুটি

আর কপাল, যে-কোনওদিন মরে যাবার ভয়

মৃত্যু যদি আসত, যদি মৃত্যু এসে… আহ…

কে আছিস রে, তমাম আলো নিভিয়ে দিতে বল

আলো নিভল, বালির নীচে রাত্রি ঘন হল

সে কত ঘন বালিই জানে, রাত্রিও জানে না…

সকালে খুব ভয়ের পাশে ঘুম ভেঙেছে, আমি

চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট বিছানায়

ছড়িয়ে আছে রক্তমাখা সোনার আশরফি

দৌড়ে গেছি বাথরুমের ভেতরে, আয়নায়

আমার মুখ… কী অদ্ভুত! আমার মুখ নেই

তার বদলে ফুটে উঠছে চোখ ধাঁধানো রঙে

মাঝরাতের ঝলসে ওঠা শহর।—

বাগদাদ!

২২/১১/৯৮

জরুরি অবস্থা

ফিরিয়ে নিলাম সমস্ত জল,— হাতে রইল ঋণ

এবার থেকে সকল ছবিই আবক্ষ রঙিন

সকল ছবিই আমার, আমি জন্মাতে জন্মাতে

তাকিয়েছিলাম উপর দিকে, হাঘরে-হাভাতে

যেমন করে, তখন শীতল যে-চন্দ্রমল্লিকা

দুধ খাওয়াল, তার কপালে আজীবনের টিকা

পরিয়েছিলাম। এখন কপাল ঘুমন্ত আর নিচু

হাত? সে কোথায়? নিশ্চয়ই সেই ছবির পিছুপিছু

ছড়িয়ে দিচ্ছে আতর, সংজ্ঞা ছিটকে-ছিটকে এবার

ছিঁড়ছে আগুন, মেঘের তলায় ফুলকি গুঁজে দেবার

সময় হল, ফুটন্ত সেই অতৃপ্ত বাসনা

স্বস্তিতে ভাসিয়েছিলাম, এখন সে-জল নোনা—

ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এবার ঘুরে মরব, তবু

মায়ের কাছে, কষ্ট হলেও আর কোনওদিন

সাহায্য চাইব না!

২/১২/৯৮

একটি বিজ্ঞপ্তি

বলার কিছু নেই; বরং দূরভাষে গন্ধ থাক রাঙা চন্দনের

আর আমি জানি তুমি আজও সে-বনপথে বসেছ একা-একা প্রার্থনায়

নিজেকে অপরাধে ঝলসাব না বলে যেখানে নিমীলিত স্বার্থ নেই,

এখন সেখানেও পেতেছি সন্তাপ। মেলেছি দুটি হাত, বন্দনার—

শিকড়ে ভালবাসা প্রোথিত হয়ে গেলে দু’দিন দূরে থাকা মন্দ নয়

দাঁড়াও দশদিকে। বলো, কী শোনা যায়? নান্দীমুখ, নাকি আর্তনাদ?

ধুলায় মিশে যাবে তপ্ত মহাকাশ, ভাল না বেসে তবু পারতে না,—

কে জানে, কেন মুখ দেখতে পাচ্ছ না, অথচ একেবারে অন্ধ নও…

২০/১১/৯৮

আর কিছুদিন সঙ্গে থাকলে

[কোথায় দাঁড়াব, বলো, তুমি যদি না থাকো জীবনে?

—স্বীকারোক্তি : ঋজুরেখ চক্রবর্তী]

আর কিছুদিন সঙ্গে থাকলে সঙ্গিনী বানাতাম।

কিন্তু তা হবার ছিল না: মধ্যে একটা গাছ

হঠাৎই জন্মাল। এমন আচমকা জন্মাল—

সুতোর দু’দিক প্রমাণ করল দু’রকমের আলো

সাঁতার না জানলে কী হবে, গভীর জলের মাছ

তর্কের উপরেও বসায় গ্রহণযোগ্য পাতা—

এবার প্রহর ছিটকে যাচ্ছে। কী দিয়ে যে বাঁধি,

উৎসাহী অক্ষরের মালা ফেরাচ্ছি দু’হাতে

জানি। তোমায় নিচ্ছি না, আর তুমিও সঙ্গিনী

হওয়া-তে নেই। কিন্তু জেনো, মিথ্যে তো আসিনি,

জমাট-বাঁধা বরফ-সোহাগ উপড়ে তোলার রাতে

তোমার যদি সমাপ্তি হয়, আমারও সমাধি!

১৯/১১/ ৯৮

১৯ নভেম্বর, সন্ধে

তোমার সঙ্গে কথা বলাও রোমাঞ্চকর

ডায়ালে হাত দিলেই যেন চলকে ওঠে

যানবাহনের শব্দ, পাড়ার ক্লাবের টিভি,

ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে জ্বালায়, কিন্তু

আমি তখন ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী, আমার

তোমাকে চাই, তোমার কুশল, আওয়াজটা চাই।

আওয়াজ এল। আওয়াজ পেলাম। ভাঙা আওয়াজ।

কোথায়, কখন, কীভাবে ভেঙেছ, গভীর,

জলে-কাদায় তলিয়ে যাচ্ছ আস্তে-আস্তে

আমি তো অসহায়, আমি অনেক দূরে

এখান থেকে জড়িয়ে ধরাও যায় না সোনা,

কেবল কথা শোনানো যায়, কেবল কেবল…

হঠাৎ করে চতুর্দিকের শব্দকলুষ

ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে ছিনিয়ে নেয়—

ঝাপসা কালো পরাজয়ের সন্ধে নামে—

আমাকে চুপ হাঁটতে দ্যাখে সবাই, শুধু

ব্যর্থ, অঝোর চেষ্টাটুকুর সাক্ষী থাকে

বৃদ্ধ, নিঝুম, ঘুটঘুটে এই পাবলিক বুথ

১৯/১১/৯৮

দাঁড়াও, ভাবো…

আমার জন্যে মন্ত্র পড়ছ শুকনো থালায়, স্বচ্ছ জলে

আমার জন্যে খুঁজে আনছ নতুন-নতুন ভাষার পোশাক

চেষ্টা দেখে বিস্মিত হই, তলায়-তলায় দুঃখ চলে

যেন তোমার চেতনা নেই, উন্মাদনায় বিস্মৃতবাক

আর সে যখন অনেক দূরে গভীর তুলোয় হারিয়ে যাবে,

আর তুমি স্বাচ্ছন্দ্য থেকে আস্তে আস্তে মৃত্যুকামী—

তখন যদি একটিবারের জন্যে হলেও দাঁড়াও, ভাবো,

দেখবে তোমার চতুর্দিকে, আকাশে, পাতালে, আমিই….

১৯/১১/৯৮

ফুলটি বলল

যে বেঁচে রয়েছে এবার তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে মালি

পৃথিবীর সমস্ত কালো রং যদি হয় তার বাতাস তার একার ঘর

আস্তে আস্তে দুর্গ হয়ে উঠবে উঠবেই আমি একবার শাঁখের ভিতরদিকে

তার নাম বসিয়েছি সবুজ মিত্রালী কালোর পরিখা যখন দুলল আঁচে

আমার কাগজের তৈরি হলুদ পৌরুষ যখন মাটি চুষতে চুষতে হয়রান তখন

একবার সে এসে তুলে ধরেছিল পুরো খামার আর খামারের উপরিস্থ

রেশমের পৃথিবী সে একাই বিশদভাবে বাঁচিয়ে গেছিল আর আজ যখন

তিনকোণ থেকে তিনরকমের আয়ু মেরুদণ্ডে ঢুকে আসছে ধীর তখন

তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে মালি একদম ভিতরে যদি শ্বাস ফ্যালো

সে কোথাও-না-কোথাও জেগে উঠবেই উঠবেই তবে আমাদের চেষ্টার কাছে

কোনও গাছ না হয়, কোনও চাঁদ না কাঁপে মুখে, আর বসন্ত শেষবারের

মতো যখন এসেই গেছে, আমার জামা খুলে ফেলে আমি এই মুহূর্তে

একটা দীপরোদের গান বুনব, সে চেনে তার সুর, আমার তুরীয়

হালকা কেশর থেকে সে ঠোঁটে করে পরাগ তুলে নিতে আসবে।

আর পৃথিবীর জলরঙের ভাষা আপনার নয়, তোমার নয়, তোরও নয়

শুধু তার আমি ক্লিন্ন তীর ধরে ফুটি সে আসুক তুমি আর তুমি

শুধু ঠিকমতো জল দিয়ে যাও মালি…

১৭/১১/৯৮

আগন্তুক

বিরক্তি বা দুঃখপ্রকাশ অচেনা নয়, অচেনা এই মুখ

মুখের আলোয় আত্মকথা পড়তে বসে হঠাৎ আগন্তুক

তাকাল আকাশের দিকে, তাকাল আর চূর্ণ অসম্মতি

চিবুক ছুঁল, আছড়ে পড়ে মাটিতে সে অপূর্ব বিরতি

আর কী নিজের থাকল, তেমন-তেমন হলে বোঝানো সম্ভব

অন্ধকার সে সাধে তো নয়, বাঁচতে-বাঁচতে নিশ্বাসে নীরব

এখন আসল মূর্তি লুকোয়, ভাষা নকল, আলাপে পোশাকি

হাত পেতে আসন্ন আসে, একটুখানি পালটে যাওয়া বাকি—

পালটে যাবে, পালটে যাচ্ছে, পালটে গেলেও প্রত্যেকেরই চেনা

অনেকদিনের বিগ্রহ তো, এমনি-এমনি ভাসানো যাবে না।

২৯/ ১০/ ৯৮

স্বপ্নে দেখি

স্বপ্নে দেখি, তুমি বাস্তুঘুম ফেলে দাওয়ায় বসে আছ

দু’দিকে ধূ-ধূ করা প্রহর, বিশ্রাম, রাতের মহকুমা—

এ গ্রামে গতবার বন্যা এসেছিল, এবার কেউ নেই…

পাশের গ্রাম থেকে লন্ঠনের আলো যেটুকু পৌঁছয়

তাতেই নিহতের খাদ্য ফুটে থাকে গহন বারোমাস—

তুমিও যেন শেষবয়স ভুলে গিয়ে রয়েছ পাহারায়

ঘরের চারদিকে বাঁশের বেড়া থেকে পাঠানো সংকেত,

দু’হাতে গুঁড়ো করে ছড়ানো সন্ধান কোথায় হারিয়েছে…

না-আসা উত্তরে নিথর রাত গেঁথে ভস্ম হাওয়া চলে—

স্বপ্নে দেখি, তুমি হাজার রাত ধরে দাওয়ায় বসে আর

উঠোনে, চারদিকে তাকিয়ে পড়ে আছে পুরনো চাবিগুলো…

১৮/১০/৯৮

সব কথা

যদিও তোমাকেই সমর্পণ

তবুও সব কথা বলার নয়।

হলুদ পুষ্করে নামার দিন

যেমন কথা ছিল অন্ধকার

সিন্দুকের নীচে বন্দিপ্রায়

সকলে তারা এই দিগন্তের

অবশ, দুস্তর আপনজন…

থাক সেসব। তুমি প্রাণ দিলেও—

সরলবর্গীয় অরণ্যের

কুশল পথে-পথে যে-প্রস্তাব—

আমি সে-গল্পের নায়ক নই।

কে জানে, আমি কোন চরিত্র!

ভেসে এলাম তাই নির্দ্বিধায়

আজ আর কিছুতেই পারবে না—

আমাকে দেখে যদি বুঝতে চাও

কীভাবে এতদিন সাঁতরালাম…

১৭/১০/৯৮

এপিটাফের বদলে…

তোমাকে দরকার, তোমাকে দরকার এক্ষুনি

না, কোনও কথা নেই। তাকিয়ে থাকা যদি বাক্য হয়,

কপাল কাঁধে রেখে ঘুমোনো যদি হয় শব্দরূপ,

তা হলে তাই। আজ কিছুই পারছি না। অস্থি জল

শিশিরে নিচু হয় কীভাবে সব স্মৃতি, অবশেষে

জঠর মনে পড়ে। লতার প্যাঁচে ঘেরা সে-ভ্রূণও আজ

চিনতে পারে ত্বক। যে-ত্বক তুমি, এসো, কষ্ট পাও

আকাশে টুপটাপ ফুটেছে যন্ত্রণা-সেদিকে চোখ…

আমাকে সন্ন্যাস বোলো না। আমি জানি গৃহস্থের

দু’বাহু প্রতিদিন ছিন্ন হতে-হতে মিলিয়ে যায়…

পড়ে যা থাকে, তার স্পর্শ ধরে আছে তোমার কোল—

হয়তো আজ রাতই এখানে মৃত্যুর নিমন্ত্রণ

দু’চোখ জুড়ে থাক অন্ধকার।

মুখ দেখতে দাও…

১৬/১০/৯৮

তোমাকে বলেছি

যে-তুমি আলের নীচে শুয়ে আছ চারদিকে ধানখেত বলে,

যে-তুমি সারাটা রাত শিরায় বহন করো প্রত্যেকের জল,

যে-তুমি প্রণামপাতা, যে-তুমি খোদাই করা পলির হরফ

সে-তুমি দেখেছ আজ আকাশ ভরাট হয়ে নেমে এল কোলে

সারাদিন মেঘ ক’রে কে তোমায় ছেড়ে গেল, কার দ্রুত ছল

নামাল কুরুশ থেকে শীতের পশমধ্বনি, আসলে বরফ…

সে-বরফ আবারও কি বিরল নদীর নীচে ডুবে যেতে-যেতে

দ্যাখেনি তোমার চোখ একবারও? দেখেছে। সে দেখেছে বলেই

কোনও কথা না ছড়িয়ে, কোনও দূত না পাঠিয়ে ফসলের কাছে

নিজেই এসেছে ফিরে, দাঁড়িয়েছে রাতভর সেই ধানখেতে—

যেখানে দু’দিকে ধান, মাঝখানে আল ছাড়া আর কিছু নেই,

অবশেষে ভোর হলে পুরনো পাতার মতো ঘুমিয়েছে গাছে…

১০/১০/৯৮

রাঁধুনী

[‘একটা দুটো চুল রূপোলী, আমি তো তার মেয়ের বন্ধু,

তাই বলে কি বসন্তদিন মনে মনেও তার বন্ধু নই?’

—শুকনো পাতার ডালে : জয় গোস্বামী]

বান্ধবী, তোর বয়স আমার মনমতো নয়;

কেননা তোর জানলা খুললে কদম্ব গাছ

সারাটা দিন হেলতে-দুলতে বার্তা পাঠায়—

বার্তা তখন চায়ের চিনি, ডালের ফোড়ন

বার্তা তখন হাজার চোখের ফাই-ফরমাশ

শেষ অবধি তাও হারিয়ে যায় ধোঁয়ায়, জলে…

লোকাল ট্রেনের বাঁশি ছড়ায় পুরনোদিন—

লিখিস? তখন কী লিখতে চাস? কোথায়-কোথায়?

কোত্থাও নয়। কেবল যেদিন পূর্ণিমা হয়,

রান্নাঘরের মেঝেয় জোটে বরাদ্দ চাঁদ…

সেই জোছনায় আমিও তোর পাশেই থাকি,

সেই জোছনায় ডুবন্ত দুই ঝলসানো হাত

পূর্ণ করিস; ভাবনা কীসের? বান্ধবী, তোর

সঙ্গে আছেন দু’-এক কলি রবীন্দ্রনাথ

১২/১০/৯৮

অসুস্থ

যখন বিছানার দু’পাশে রাখা ছিল মৃত্যুদিন

যখন তর্কের মাথায় বসেছিল শক্তচাঁদ

যখন বুকে-পিঠে পেরেক দিয়ে গাঁথা তির-ধনুক—

অসুখ করেছিল। মাথায় সাদা-কালো সম্মোহন

শিরায় রক্তের বিন্দু নীল, শিষ ডুবন্ত…

তলার পাড় বেয়ে তখনও প্রাণপণ ধুলোর ঝড়

বিবশ পর্দার অন্যদিকে ভুল সেবার শেষ

শেষ তরফ, দিন, বিকল অস্ত্রের বর্ণনায়

অসুখ আগে এল। পেছনে সেবা রেখে অসুস্থ

এগিয়ে গেল, তার মৃণাল দ্রাক্ষায় জ্বলন্ত…

ঢেলেছে, ঢেলে দেবে, যতক্ষণ তার জীবন দেয়—

খারাপ লাগে, জানো, এরপরেও যদি হিসেব চাও…

১৬/১০/৯৮

বিজলি চমকি…

বিজলি চমকি আসে। পিয়াসী, তোমার ঘর কালো কেন আজ?

আমি তো এসেছি। আমি এসেছি কি? সত্যি-সত্যি এসেছি তোমাতে?

এতখানি পথ টেনে, সপ্তাহে ছ’দিন কেনা ক্রীতদাস হয়ে

ঘুরে ঘুরে মাথা ঘুরে ভারী আজ নতজানু কাজলবাতাস

নেবে না? দূরের সন্ধ্যা ঝিম হয়। তুমি আর তোমার চুলের

ঘন ঢল নেমে আসে, এই কালো থেকে আরও, আরও কালো হতে

কী কালো চোখের নীচে অভিমান, হা আমার অভিমান বলে দিতে হয়

নামে আরও কোনও সেই দীঘল পাখির-ডানা-ছোঁয়া অন্ধকার

পরিখাপ্রদীপ জ্বলে… এই ঘর তো চতুর্দশ শতাব্দীর আলেয়ামহল

বিজলি চমকি আসে। সে-আলোয় তুমি দেখি ভাস্কর্য নিথর

ছুঁয়ো না তা হলে? আর ছুঁতেও দিও না? আমি জলতেষ্টা নিয়ে ফিরে যাই?

মাথা নুয়ে আসে। কার গুমগুম শব্দ হয়… মেঘ হবে। মেঘ হতে পারে।

এইবার তাকাই-এসো, কবরের মধ্যে এই অশ্রুমাখা শাবল চালাও

মেরে ফ্যালো। মেরে ফ্যালো! টুকরো-টুকরো ক’রে দাও। কিন্তু আজ বলো

ওই যে ডিঙিনৌকো আর উথাল-পাথাল নদী চালাচালি করছে দেশ রাগে—

হাজার শতাব্দী ধরে নিখাদে দাঁড়িয়ে তুমি সা না ছুঁয়ে ফিরে আসতে পারো?

বলো? পারো? বলো? বলো? তোমাকে বলতেই হবে, নয়তো এই হাত

ছাড়ব না

কী হল, বলবে না?… কার হাওয়া দেয়… চুপচাপ… দুটো মাথা নিচু হয়ে আসে

ক্ষতস্থ বুকের গর্তে দু’ চোখ ঢুকিয়ে রেখে দেখি—

আলোছায়া পাশাপাশি ছাই হয়ে বসে আছে, পুড়ে গেছে হবে… আর তা-ও

যত মেঘ ছিল সব উমড় ঘুমড় আয়ে, বাদরিয়া ছায়ে চহুঁওর—

শনশন আওয়াজ আসে… সামনে কি সমুদ্র আছে? এটা কি দক্ষিণ?

বিজলি চমকি আসে। সমস্ত ঝরোখা খুলে বৃষ্টিছাঁট ঢুকতে থাকে ঘরে…

শেষকৃত্য

এখনও মনে আছে, কোমরে বাঁধা ছিল মন্ত্র পড়ে দেওয়া দূরবিন

যে-কোনও ছোটবেলা সূর্য ভালবাসে, যে-কোনও বড়বেলা প্রান্তর

দু’ হাত বাড়িয়েছি সবাই, কিছুতেই বুঝিনি পর্দার আড়ালে

সূর্যবন্দনা করতে করতেই কেটেছে ভুলভাল রাত্তির

কে যেন চোখে-চোখে অবাক চিঠি দিত, অচেনা হরকরা, বিদ্যুৎ

সহজে ধুলো থেকে আলোর কণাগুলো ছিটকে কাছে চলে আসত

বর্ণসংগ্রহে শরীর নীল ছিল, কাচের মতো ছিল ভিনদেশ

ধরো সে তুমি ছিলে, ধরো সে আমি… আর ধরো সে আগ্রহ সকলের

সুযোগ আলোছায়া, সুবিধা প্রতিবেশী, গুপ্ত হাতে-হাতে সন্ধান

ঝাঁঝালো গন্ধের পেছনে হেঁটে যেতে দ্বিধায় মরেছিল সুন্দর

হঠাৎ পাশ ফিরে তাকিয়ে দ্যাখে তার চিবুক ছুঁয়ে আছে অস্ত্র

যা হয় তারপর… নিজের আশ্রয় চোখের নিমেষেই ঝাঁঝরা

শব্দ শেষ হলে শুকনো পাতা ওড়ে, দৃশ্য শুধু কিছু মন্থর

আকাশে শুকতারা একলা। ঠিক যেন জীবনানন্দের বন্ধু

বাতাসে ভেসে আছে ফুলের পাগলামো, মাটিতে খোলামেলা শান্তি…

তবুও সারারাত কেটেছে অস্থির, স্বপ্নে জেগে থেকে দেখেছি—

প্রণাম ফাঁকি দিয়ে নীরব, স্মৃতিহীনা মা ভেসে আসছেন দীর্ঘ

রক্তে ধুপধুনো, দৃষ্টি অকাতর, অস্থি ঝরে ঝরে পড়ছে

আমরা বসে থাকি, তোমরা বসে থাকো, যে-কোনও নদীতীরে, ক্লান্ত

সে-লাশ পাওয়া যাবে আগামী ভোরবেলা গঙ্গা, সিন্ধু বা মেঘনায়…

শনিবার

অল্প আলোর পর্দা টানা, কল্প আলোর গল্প শোধ

ক্লান্ত পথিক কোলের ভেতর মুখ গুঁজেছে। আবার সেই

বন্ধ দুপুর ভাসছে ঘরে, বারান্দাটায় বড্ড রোদ…

চোখের পালক ওজন দরে বিক্রি করেও শান্তি নেই।

শান্তি কোথায়? শান্তি আদল পালটে যখন খবর দেয়

বার্তাবাহক ভদ্র হলেও, ছদ্মবেশী প্রবঞ্চক

দিন ডাকে। দিন ডাকছে আমায়। রাত ডাকে। রাত সফল ব্যয়

শুল্কবিহীন আকাশ থেকে মরতে এল অনর্থক

তর্ক, সুলভ তর্ক, আমায় একটু আদর করতে দাও

এক-দু’ বেলার জীবন জেনেও ক্রুদ্ধ চোখে তাকাচ্ছ?

দৃষ্টি ঘোরাও পথের দিকে, অন্য কারওর খবর নাও

ধুলোয়, দ্যাখো, শুকনো পাতা… পাতার ওপর চাকার ছোপ…

পাতার শরীর জাতিস্মরের, জঙ্গলে তার ঘুমের শেষ

বাঁচল নাকি? দুপুর রোদে একটা ছায়াই রইল নয়

কালকে আবার সকাল-বিকেল সাঙ্গ হবে আলোর রেশ

থাকবে শুধু পলকা স্মৃতির দুঃখবিলাস, বৃন্তক্ষয়

দুর্গদখল, লুঠতরাজেই কাটল সুদিন অন্ধকার

স্বপ্নখেতের চতুর্দিকে চিকিংফাঁক আর হাতেমতাই

আজকে এসো, ঝগড়া রেখে, সন্ধেবেলায়, আরেকবার

আমরা দু’জন ঘড়ির কাছে একটু সময় ভিক্ষা চাই

বনানীকে

আর দু’দিনের বাতাস তুমি পারবে না, বনানী?

আতিথ্যহীন পান্থশালা পেরিয়ে যেতে-যেতে

অন্ধকারে পাখির মতো ধৈর্য ধরে থাকো।

সকাল হলেই দেখবে, দূরে, নদীর ছোট বাঁকে

টলটলে জলভর্তি জীবন, অশ্বক্ষুরাকৃতি

কোথাও-না-কোথাও একটা নৌকো বাঁধা আছেই।

এখন তোমার রাতজাগা চোখ ঠান্ডা হাওয়ার কাছে

ঘুম চাইছে, অথচ রাত জাগিয়ে রাখছে স্মৃতি

এদিকে তার তরঙ্গমুখ ভোলাচ্ছে আমাকে

আর দুটো দিন। তারপরে ঠিক অন্যগ্রহের সাঁকো

দৈব আলোয় পা ডোবাবে পার্থিব ধানখেতে

তক্ষুনি সংসারী দু’জন জন্ম নেবে, জানি

আমার হৃদয় তোমার থেকে চার বছরের বড়

পোড় খাওয়া ডুবুরি আমি, সাতসমুদ্র বাজি

চোখ বুজে অপেক্ষা জমাও, সাহস চেপে ধরো—

বাঁচব, দেখো, কালকে, না হয় আজই!

ভুল

ছন্দ তাকে বলেছে ছাড়াছাড়ি, ঊর্ণা তাকে বলেছে সংসার

অন্ধ তাকে বলেছে আন্দাজ, বন্ধু তাকে বলেছে রাস্তা

গাছেরা তাকে বলেছে পাতাঝরা, অস্ত্র তাকে বলেছে ছারখার

দুপুর তাকে বলেছে বাড়ি যেতে, সন্ধে তাকে ডেকে নেয়।

হ্যাঁ, আমি তার ছায়ার অনুরাগী, স্বভাবে তাকে নকল করে থাকি।

অপার্থিব আমার ঘরে-ঘরে উদাসরঙা বেগে সে ধাবমান

এ কোণ থেকে ও কোণ ছুটে চলে উচ্ছসিত কণিকা আলোহারা

আকর্ষণে জলের কাছে গিয়ে যেমন কেউ মরার কথা ভাবে!

আমিই সেই হাজার ভুলেভরা ছায়ার পাশে নেহাত উপছায়া

জলের নীচে হঠাৎ জেগে উঠে ঘুমোই চিরমৌনপ্রিয়শ্যাম

চিকন ছবি প্রথম পাওয়া, তবু খেলায় তাকে হারতে দিতে হয়।

না হলে আমি, না হলে তার কাছে পারি না।

পেরেছি যেই, আকাশ মেনে নেয়। গরম কালো বাতাস এসে লাগে

ছেঁড়া দু’ পায়ে ছুটেছি আঁকাবাঁকা, ভাঙা দু’ পায়ে ছুটেছি তিরবেগে

সফর জোড়া মিঞা কি মল্হারে শরীর একা, মগ্ন সরোদিয়া

জমানো কথা দু’ ধারে ফুটেছিল, ভেবেছি পথে তোমার দেখা পাব।

তোমার দেখা। তোমাকে দেখা নয়। আমার দেখা? সে রোজই দেখা দেবে।

তবুও চোখে সহজ শুয়ে থাকে তোমার থেকে হাজার তোমাদের…

পায়ের নীচে পুরনো কাঁটা বিঁধে রক্ত পড়ে… রক্ত… চেনাশোনা…

বিকেল শুধু পাশে থাক।

প্রতিটা ঘরে, শহরে, মহাদেশে জাহাজডুবি হওয়ার পরদিন

আমাকে যারা বাঁচিয়ে রেখেছিল, তারা কি শুধু কবিতা ভালবাসে?

মাত্র কিছু সময় বাকি আছে। পৃথিবী তার হলুদ ছেঁড়া চিঠি

পাঠিয়ে দেবে। আমাকে ছেড়ে দাও। সঙ্গে করে এনেছি সেরা বিষ…

কফিনে রাখা শরীরও কথা বলে, যখন তাকে কবর দেওয়া হয়।

অথচ আজ কিছুতে মানছ না সহজসাদা বিদায় চুম্বন

হতেও পারে, আমারই ভুল ছিল। মানুষ তবে কীভাবে ভালবাসে

কে জানে!

এসো

এই রইল বন্ধখাম, এই রইল অন্য কারও কথা

প্রতিশ্রুতি দাও যে আর কখনও তুমি ওদিকে তাকাবে না

অভিমানের অস্ত্র ভাল, মিথ্যে ভাল, গুমোট বেশ লাগে

জন্ম থেকে অভ্যেসের বন্দি হয়ে আছ

কে জানে তাও, কীভাবে আসে ভবিষ্যৎ… উল্কি আঁকা মেঘে

দেহ বারুদ ঝলসে ওঠে! এদিকে দ্যাখো-চোখের নীচে আলো

দেখতে পাও? সোনারঙের জাতিস্মর এমনি পড়ে নেই

অন্ধকারে গল্প ভাল লাগে।

হৃদয় থেকে মগজ হয়ে আকাশ যেন সহজ কোনও পথ

জুড়েছি টানা পেনসিলের গন্ধ দিয়ে… এ যাত্রায় আমি

কোনওরকম জীবনবোধ বাদ দেব না। তোমার পাশে একা

রাত কাটাতে চাই

বর্ণমালা জ্বলুক, তাতে পুড়ুক যত ফালতু অভিধান

প্রথমবার মৃত্যু ছিল একলা থাকা। দ্বিতীয়বার প্রেম।

তৃতীয়বার মৃত্যু তুমি নিজেই। আমি বুঝেছি। ভয় নেই,

এসো—

পশমের ক্লান্তি

আর কী, সে মুছে গেলে পশমের ক্লান্তি মনে হবে

অনন্ত দীর্ঘতা সূর্য, আরও রাশিমুদ্রা থেকে অতি

দূরত্বের মতো তুমি, সে তুমি তোমার মতো সে-ও

আসে, এসেছিল, পায়ে ঋতুমতী শ্রমের বাতাস

যবন চশমা, হাতে ধুলোপদ্ম গ্রহণপ্রতীক

আর সে কী ঊর্ধ্বমুখে পান পিপাসার মতো ক’রে

তাকাবে… আমার ইচ্ছে আমাকেই আমি ও আমার

শেষের অধৈর্য ডাক, তবু সেও ইচ্ছে তো সকলই

যেন গ্রন্থে পড়ে থেকে বিদায়ের আগে অক্ষরেরা

প্রতিপাতা চিনে রাখছে, চুমু খাচ্ছে, বলছে ‘তবে চলি?’

এই তো। আমিও মাঠ পার করে ঝাপসা গাছ হয়ে

সকালে কুয়াশা কিনে মিশে যাব। যেহেতু একাই,

আরও আরও আরও একা… কেন একা… কী দেব জবাব

আমাকে বোঝার পরও যদি কিছু বাকি থাকে প্রেম

যে-গলায় বর্ষা ঋতু পার করে অধিকার আসে,

দেবো। আজ আর কিছু প্রতিজ্ঞা করার আগে ভাবো

আমাকে কতটা চেনো, কতটা চেনালে ছেড়ে যাবে…

ছেড়ে যাবে অন্ত্যমিল… আমি থাকব। থাকব। মরব না।

যদিও সে মুছে গেলে পশমের ক্লান্তি মনে হবে…

বৈশাখ

জ্বলো বৈশাখ, মধু বৈশাখ, খোলা প্রান্তর থেকে নিকিয়ে নিকিয়ে

রোদ্দুর তোলো ঝিলমিল, দ্যাখো পালকের মতো বাতাসে ভাসানো

ডাকঘর দোলে চুপচাপ… পাশে এস্রাজ আর প্রবাসী গিটার

ভাসছে… বুঝি জানা নেই, কত দুঃখের পর মানুষ মেশিনে

ভর দেয়… যত উৎসব যত আশ্রয় যত পূর্তি পেরিয়ে

কঙ্কাল ফেরে দরজায়… ধরো মন্থন থেকে কাতারে-কাতারে

মাশরুম জমে, শৈশব তার কাছে যায়, তার ছায়ায়-ছায়ায়

ঝলসায় কুচো নিশ্বাস… বিষে ভরপুর। মাগো! আমিও অমন

পারতাম? জানে ঈশ্বর। একা অন্ধ যেমন এদিকে-ওদিকে

হাতড়ায়, আর কুষ্ঠের রোগী… জিভ নেই তবু চুমুতে-চুমুতে

ছয়লাপ করে দিনরাত… শেষে সমাধান মানে বিছানাজনিত

সন্তান… মাটি ভাগ হও! আলো বৈশাখ, দ্যাখো দমকে-দমকে

মৈথুন করে শয়তান তবু স্বর্গের নীচে এখনও প্রেমের

প্রস্তাব জ্বলে রাতভর… লোকে মার খায় তবু তোমাতে-আমাতে

ভাব হয়, প্রেমে মন যায়, চলে বুক থেকে বুকে পাতাল রেলের

ছন্দ… সোজা বৈশাখ, দ্যাখো পৃথিবীর হাতে চরম ঋতুর

পর্যায়, পাখি দল নেয়, ডানা ঝাপটায়, তার ঝাপটে-ঝাপটে

আমরাও উড়ে চললাম… বলো শয়তান, আরও নতুন চমক

দরকার? এসো বৈশাখ, রাঙা অঙ্গার থেকে তিলক পরাও—

সব্বাই প্রিয় বন্দরজলে ঝাঁপ দিই, এসো জানলা টপকে

রাস্তায়… অভিনন্দনভরা রোদ্দুর মেখে শরীর বিছিয়ে

শরীর বিছিয়ে

শরীর বিছিয়ে

গান গাই!

পুরনো, পাতাঝরা গীতবিতান

যে-আমি ভ্রূণ হয়ে এসেছি কোনওমতে, যে ভ্রূণ ভালবাসে অন্ধকার,

তাকেও কোলে করে কুয়াশা নেমে এল, আবছা হল যত মুগ্ধদিন

অঝোর আয়ুসীমা পেরিয়ে যেতে-যেতে, সময় ছিঁড়ে যাওয়া অবস্থায়

কোথায়, কতটুকু দাঁড়িয়ে ছিল প্রাণ, আজ সে পরিচয় অর্থহীন।

আদরে মুড়ে রাখা কপাল পুড়ে যেত যদি না পাওয়া যেত অন্যপথ,

যে-পথে নিশিদিন দেখেছি বালিয়াড়ি, যে-পথে আমি একা আগন্তুক

অযথা রাত জেগে শুয়েছি ভোরবেলা, কান্না ধুয়ে গেছে পথের ধার—

অচেনা মহাকাশে সহসা দেখা দিল শ্রাবণমোহঘন পিতার মুখ

প্রথমে ভাল করে বুঝিনি চমকিত শরীরে কেন এল ভবিষ্যৎ,

আড়ালে দেখি প্রিয় অতীত মেঘে-মেঘে ঢেকেছে রক্তের ছদ্মনাম

আহত সমাধান মুছিয়ে দিতে এসে পাশেই থেকে গেলে আন্তরিক,

ধারণা পরিহিত জীবন ফুটে ওঠে, দু’দিকে ভাসমান মধ্যযাম…

কী লিখে গেছ তুমি? ওরা যে কথাহারা, সকলে দিশা খোঁজে অরণ্যের—

আমার পড়া নেই। অথবা ভ্রূণ হয়ে জঠরে শুয়ে আছি লুপ্তপ্রায়…

আসলে কী জানো তো, এখনও দুটি ভুরু সেতুর মতো চায় স্পর্শপথ,

অথচ তলে-তলে না জেনে ঝরে গেছি, পরাগ নিজে ছিল অন্তরায়।

আজ সে-পরাগের সমাধি বিছিয়েছি, পারলে হেঁটে যেও দু’-একদিন,

পাহাড় কেটে-কেটে রাস্তা বানাবার দৃশ্য ধরা থাক দৃষ্টিতেই

কে জানে, কবে থেকে মরমে বসে আছ নিভৃত আলোছায়া-সম্পাদক,

তোমাকে চিনি বলে মরতে পারছি না, তোমাকে জানি বলে জন্ম নেই…

যা আছে, শুধু কিছু সহজ কথা বলা, সহজ বুঝে নেওয়া নিরন্তর—

সফেদ বাতাসিয়া, কীভাবে পারো তুমি? কীভাবে পেরে ওঠে তোমার গান?

যে যায় ভেসে যায়, যে থাকে ডুবে থাকে, এমনই জলে ভরা নদীর চোখ

আমি সে-নদীতীরে হারিয়ে বসে আছি পুরনো, পাতাঝরা গীতবিতান…

আর কী হত

এই যদি লোভ হত, আর যদি না দিতে সাহস

আমার হাতের থেকে যদি ছুটে যেতে ওই দিকে

যেখানে কণিষ্কদল তোমার দু’ ঠোঁট থেকে রোজ

হাসি মুছে নিচ্ছে, আর তুমি দিচ্ছ ‘শাবাশ! শাবাশ!’

যেখানে মাটির লোক কেউ নেই, সব বাতাসের

মহাভক্ত সহচর, উড়ে উড়ে চলেছে সবাই

প্রতিবার প্রাণদণ্ড মাথা পেতে নেবার উল্লাসে

কঠোর নাচের শব্দে যেখানে প্রত্যেকে মাতোয়ারা,

সেই দিকে যেতে যদি, তবে এই বিপরীত দিকে

কবে ফোটাতাম মুখ-কে জানে! কখন কোন ঋতু

জড়তা কাটিয়ে দিত, ভালমতো জানা নেই তাও।

শুধু ওই অযোগ্যের কাঁপা-কাঁপা হাত থেকে তুলে

প্রবল পাখির ঝড় বুকে করে এতদূর এসে

দাঁড়িয়ে থাকতে হত রাতভর মাটির তলায়;

এছাড়া আর কী হত, কতটুকু, কতদূর হত—

এই যদি লোভ হত, আর যদি না দিতে সাহস…

মুগ্ধ, এসো…

মন দাও পদ্মপাতা, রোদ রাখো ধারালো চিবুক,

মাথায় আগুন ধরো, চোখ নাও ধরিত্রীপতন,

ঠোঁট ছোঁও বাহুধারা, হাত শেখো শব্দব্যবহার,

বুক আনো বজ্রপাত, পিঠ ধরো প্রকাশ্যে ঋজুতা

এবার আরম্ভ করো নদীতে-নদীতে বিষজল,

পাহাড়ে ক্রন্দনধাতু, গাছে-গাছে যুদ্ধের তিলক,

যেখানে-সেখানে জ্বালো নষ্ট সময়ের মোমবাতি

তারপর একে-একে গলাও প্রাণের মধ্যে প্রাণ

মন থেকে দেহ কাটো, দেহ থেকে নতুন শরীর

পোশাকে ঢুকিয়ে নাও, দাও, এই সুযোগ এখন

ছারখার মন্ত্র পড়ো, জ্বালা হোক অণু-পরমাণু,

নিজের আনন্দে পোড়ো, পোড়াও সমস্ত পরিচিতি—

এইভাবে কাজে লাগো। আর এই কাজের ভিতরে

ঘোরাতে-ঘোরাতে মন, ঘোরাতে-ঘোরাতে প্রাণপণে

মুগ্ধ, এসো, ভেসে যাও ঘনঘোর দুর্নিবার চোখে;

নিজের শরীর থেকে নতুন শরীরে যেতে-যেতে

তোমাকে ভাসিয়ে নিই সৃষ্টির ভিতরে একবার…

জাতিস্মর

কীরকম ঘনঘোর হলে তবে তুমি মেনে নেবে

আমাদের মেঘচোখ, কতখানি ওঠাপড়া পেলে

জীবনে বিশ্বাসী হবে, আর কত ধনুক দেখালে

বুঝে নেবে আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব শেষ,

কেন না তুমি তো জানো, পুরোপুরি ভোলাও যায় না;

বর্মের উপরে-নীচে এঁকে রাখা ফুলগুলি আর

ইনিয়ে-বিনিয়ে এত হালকা-চালের এই লেখা

দু’বাতাসে উড়ে যাবে। তবু এই দুর্গের ভিতরে

খবর জমতে থাকে আমাদের চোয়ালের হাড়ে…

যতই দু’হাত তুলে আমন্ত্রণ জানাও এখন,

আমরাও জাতিস্মর… পুরনো অনেক কথা জানি!

তোমাকে রেখেছি

তোমাকে রেখেছি কাঁধের দু’পাশে বাহবার মতো

তোমাকে রেখেছি পালকের মতো বায়ুপথ জুড়ে,

শুভরাত্রির তুলো ভরা এক নরম বালিশে

তোমাকে রেখেছি ঘুমপাড়ানির ঠিক মাঝখানে,

অতিরঞ্জিত শোকবাহী এক ঠান্ডা কাঁথায়

তোমাকে রেখেছি বরফ মাখানো কাহিনির মতো;

দুলে ওঠে মোহ প্রতিবার কোনও কুহকের চোখে

হেরে যেতে-যেতে পায়ের পাতায় জল জমে গেছে,

এই শুভদিনে প্রতিশোধ তবু নিতে পারছি না।

চলে যেতে পারো, দুর্দিনে তুমি আসবে, কারণ—

তোমাকে রেখেছি ঢাল-তলোয়ারে যুদ্ধের মতো,

হারব না বলে জিভের তলায় তোমাকে রেখেছি।

শর্তলিপি

যদি না দেখে রাখি পুরনো কৌশলে ফেরার পথ

যদি না মনে থাকে জলের নিচুদিকে ছুটির দিন

যদি না হাতে আসে তুলোর কথা ভরা সহজ গান

যদি না ভেবে নিই সুযোগসন্ধানী প্রেমের ছল

যদি না ছুঁয়ে দেখি গাছের বিদ্যুৎ, পায়ের ছাপ

যদি না ছেড়ে দিই বন্দি-রাজহাঁস, মুঠোর গম

যদি না চোখে পাই নিজের বাড়িঘর, তোমার গ্রাম…

তা হলে আমি আর মাটিকে মাটি বলে মানব না

দেবদূত

দেবদূত বলে ঘেন্না কোরো না। আমরাও

একদিনে এই ছন্দ শিখিনি। তবে আজ

ভালমতো জানি, তাই তো এসেছি তোমাদের

দুয়ারে দুয়ারে, যত চাই আজি উৎসব…

তাই তো এসেছি সামান্য দু’টো ভাঙচুর

করে দিয়ে যাব, (তেমনই থাকবে দিনকাল)

শুধু তোমাদের খাপছাড়া ফাঁকা দরজায়

ঘনিয়ে উঠবে উড়োঝড়, উড়োঝঞ্ঝায়

দিকদিগন্তে অন্ধেরা হবে উজ্জ্বল…

বিশ্বাস নেই? এখনও ঘেন্না? তবে যাঃ!

দেখে আয় সব ছোট দিন, সব বড়দিন

আর মনমরা খোকা-খুকুদের আঙিনায়

দাঁড়া দু’দণ্ড, সামনে তাকিয়ে দেখে নে—

সাইকেল করে মাঠে উড়ে যায় দেবদূত!

একশো বছর: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

একশো বছর পেরোলে মানুষ বই হয়ে যায়।

শোকেসে সাজিয়ে রাখার অনেক সুবিধে আছে তো,

ধুলো পড়ে তাতে, মাকড়সা এসে সংসার বোনে..

সেই সংসার বয়ে চলে আরও একশো বছর।

অথচ বইয়ের ভেতরে তখন পরম শান্তি

লেখারাও সব ঘুমিয়ে পড়েছে বহুদিন হল…

যারা জেগে আছে তারা ঘুমন্ত লেখাদের তুলে

ঘাড় ধরে আজ ঝাঁকিয়ে বলছে-‘সভা করি এসো’

একশো বছর পেরোলে মানুষ সভা হয়ে যায়।

সেখানে দারুণ ঘোরাফেরা করে তরুণের দল

দুঃখের কথা, কবিতার কোনও ‘মেড-ইজি’ হয় না।

কাব্যের ধুলো মাড়িয়ে-মাড়িয়ে, আমার শহরে

জীবন ছুটছে, সময় ছুটছে, আমিও ছুটছি।

যখন, যেখানে, যাদের দেখছি, সকলে ছুটছে।

দিশেহারা এই দৌড়ের মাঝে কবিতা কোথায়?

আজকে হঠাৎ সুধীন দত্ত পড়তে বসেছি

শতবার্ষিকী সংখ্যায় এই লেখা দেব বলে…

পাবলো আর পোস্টম্যান

(‘ইল পোস্তিনো’ ছবিটি দেখার পর)

তুমি যে-পোস্টম্যানের বন্ধু ছিলে,

সে এখন শুকনো পাতা কুড়চ্ছে আর

অচেনা গান ধরেছে আপন মনে…

আমি ভাত খুঁজছি আমার অন্ত্যমিলে

কিনেছি ঘুম, ভাঙা চাঁদ, বেতের চেয়ার

ভেবেছি শান্তি পাব কতক্ষণে

তুমি যে-ঝিলের ধারে ঘুরেছ, আজ

তার জল শুকিয়ে পাথর। আংটি করে

পরেছি ভাগ্য ফেরার ফালতু আশায়

সকালে রংমেলানো খুচরো তোয়াজ

বিকেলে একলা হাঁটা… আর কী করে

তোমাকে লিখব চিঠি আমার ভাষায়

শহরে সবুজ হাওয়া, বিষাক্ত গাছ

লেখাকে নাম দিয়েছি বদভ্যেসের

ভেঙেছি পুরনো কাচ নতুন ঢিলে

শুধু এক মুগ্ধ পাগল, অলস, রোগা

সারাদিন শুকনো পাতা কুড়চ্ছে সে—

তুমি যে-পোস্টম্যানের বন্ধু ছিলে…

একটি গড়পড়তা লাভ-লেটার

অ্যাদ্দিন পর তোমাকে চিঠি লিখতে বসে

কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ খেই হারাল

স্ট্যাম্পের দাম বাড়ছে আবার। রিফিলও শেষ…

তোমার-আমার টেলিপ্যাথিই জমবে ভাল

দশদিগন্ত ক্যাবলাকান্ত উলুধ্বনি

শাঁখের ফুটোয় গাঁজার পাতা। দম মারো দম—

বোকার মাথায় পোকায় কাটে সোনার খনি

টেবিলজুড়ে ন্যাংটোপুটো কাগজ কলম

কী লিখব? কী লিখব? আমায় কেউ বলে দে—

ইকির-মিকির-চামচিকিরের ফন্দি ফিকির

খাটছে না আর। বরং নতুন গল্প ফেঁদে

হাফপ্যান্টের বুকপকেটে জমাই সিকি

সবাই যে কী করে এত পয়সা কামায়,

ভাবতে-ভাবতে চিকন চুলে পাক ধরেছে…

খিস্তি কাঁচা। কিস্তিতে-কিস্তিতে আমায়

মাত করেছে মাতব্বরে, কাৎ করেছে

প্রাণ চলে যায়। কিন্তু বচন যাবে কোথায়

উঠতে-বসতে আগদুয়ারে-পিছদুয়ারে

মন্দমৃদু কানমলা খাই অবাধ্যতায়…

চাঁদ উঠে যায় অশ্রুনদীর সুদূরপারে

চোখ মুছি আর রুমাল-বেড়াল গুলিয়ে ফেলে

দিব্যি সাঁটাই ঠান্ডা, বাসি চপ-হালুয়া

চাকরি খুঁজি, বাকরি খুঁজি একলা ছেলে

বাতাস এসে পিঠ চাপড়ায়-‘আচ্ছা হুয়া!’

তোমার কথাও বলে বাতাস। বলে তোমার

নতুন কেনা সলওয়ারের রং কীরকম

আমার তখন কপালজোড়া অকথ্য মার—

হাত-পা থেকে গন্ধ বেরোয় জখম-জখম!

পাবলিক তো ফুসমন্তর দিয়েই হাওয়া।

বোঝেও না সে জীবন মানে সস্তা রিমেক

দিনেরবেলা হেঁ-হেঁ, রাতে ব্যাপক বাওয়াল

পাগল শুধু তা দিয়ে যায় ঘোড়ার ডিমে

আজ এটুকুই। ডাকছে মলিন রাতের খাবার

কী বোঝাব এই খিদেটা কী ডানপিটে

মাইরি বলছি, তোমায় চিঠি লিখব আবার

যেদিন আমার মুখ বেরবে ডাকটিকিটে…

ধর্ষণ-পরবর্তী লেখা

‘পুলিশ ভ্যানে ধর্ষিতা মূকবধির কিশোরী নিখোঁজ’

—আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ, ২০০২

পুলিশ তোকে ধর্ষণ করেছে, তুই চুপ।

কেন না তোর মূকবধির শরীরে কোনও ভাষা

ঢুকতেই পারেনি। কেবল চিৎকারে-চিৎকারে

আকাশ ফেটে নেমে এসেছে টিটকিরি, তামাশা…

বাড়িতে আছে ছোট্ট মেয়ে, অল্প ক্ষতিপূরণ

তবুও তুই পালিয়ে গিয়ে কোথায়, কী করছিস?

একদিন-দু’দিনে ক্ষত সারবে না। কাল তোর

দাঁতে আসবে ক্ষুরের ধার, থুতুর মধ্যে বিষ

তখন ওদের চুমু খাওয়াস। আদর দিতে-দিতে

সব শালার এলিয়ে থাকা পুরুষকার

কামড়ে ছিঁড়ে নিস!

ইহা ‘কবিতা’।

এরপর, এই কবিতা ছাপা হলে, বেশিরভাগ পাঠকই পড়ে বিস্মিত

হবেন, ভাববেন-‘দেখেছ, সমাজের নোংরামোগুলোর বিরুদ্ধে কবি

কেমন সোচ্চার? অথচ আমার তো কিছু যায় আসে না এসব ঘটনায়…

অবশ্য, তাই তো হবে। সবার থেকে আলাদা, সবার চেয়ে স্পর্শকাতর

বলেই তো তিনি কবি।’ এঁদের মধ্যে বেশিরভাগ পাঠকই স্ত্রীকে পড়াবেন

কবিতাটি। স্ত্রী দ্বিগুণ উৎফুল্ল হবেন, ভাববেন-‘দেখেছ, একজন পুরুষ

হয়েও মেয়েটির দুঃখে কেমন পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, এমন মানুষকেই তো

শ্রদ্ধা করা যায়।’ এইভাবে প্রচুর পাঠক, পাঠকের স্ত্রী, পাঠিকা ও

পাঠিকার স্বামী কবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ঘটনাটির প্রতি সহনশীল

হয়ে উঠবেন।

ইহা ‘কবিতা’-র উদ্দেশ্য।

হ্যাল বেরি

নিজেকে হ্যাল বেরির মতো লাগছে

তোমাকে ঠিক পিয়ার্স ব্রসনান

বিকিনি পরে অতল থেকে উঠছি—

রহস্যের রক্ত আনচান

ছোট চুলের জঙ্গলে কী শান্তি

সরু ঠোঁটের ভেতরে কত রস

নাভির কাছে পৃথিবী কত ছোট্ট

আর কিছুটা গেলেই প্রিয় ধস…

তোমাকে আজ চেনাব প্রতি ইঞ্চি

আমার কাছে, দেখব, কী কী চাও

কেন শুঁকছ, প্রেমিক, পোষা বুলডগ—

তথ্য খুঁজে পাবে না একটাও।

পাবে কেবল আগুনে সেঁকা চামড়া

ওষুধ খেয়ে ঘুমের নিচু দাগ

শিরদাঁড়া, না অপমানের খেলনা?

শিরার নীচে কান্না, চাপা রাগ…

রাতের মতো দেখতে বলে, বারবার

যত হ্যাল-এর পাত্র ফিরে যায়

আমার মুখে তাদের মুখ দেখবে

তাদের পাবে আমার জায়গায়

তোমার হাসি দারুণ সাদা। কিন্তু

আমারও কালো মগজ টানটান—

নিজেকে হ্যাল বেরির মতো খুলছি

সামলে থেকো, পিয়ার্স ব্রসনান!

জন্মাষ্টমী (রিমিক্স)

কয়েদখানায় জন্মেছিলাম বলে

প্রথম প্রথম কেউ নিল না কোলে।

পরে দেখল মাথায়

ইলাস্টিকে আটকানো নীল পালক

মুঠোর ভেতর কয়লাখনির আলো…

অশান্ত কলকাতায়।

তখনও আমি জলে ভেজাই ঘুড়ি

বিকেল হলে ইচ্ছেমতো উড়ি

আকাশ থেকে আকাশ…

হঠাৎ রাজা (পেছনে বাঁধা গদি)

বলল ‘চোখ উপড়ে নেব, যদি

আমার দিকে তাকাস!’

জন্ম থেকে আমার হাতে বাঁশি

রাজার ঠোঁটে হাড়কাঁপানো হাসি

চিৎকারে খানখান…

ভয়ে সবাই লুটচ্ছে তার পায়ে,

আমিও শালা ব্যর্থ বাপ-মায়ের

অষ্টম সন্তান।

আমায় যারা মারতে এসেছিল,

হিজড়ে আর পুরুষ আর স্ত্রীলোক,

আমি চাইলেই খতম।

তাও মরিনি। বাঁচুক ভেড়ার পালে।

যুদ্ধ হবে রাজাতে-রাখালে

শহর থতমত

সবাই সরে দাঁড়ায়। সবাই জানে

একটা কথার কোথায় ক’টা মানে

কতরকম ঢং

বাঁশির ডগায় লম্বা তুলি বাঁধা

কী আশ্চর্য, রাজার বর্ম সাদা

আমার অস্ত্র রং!

অ্যাদ্দিনে ঠিক জান এসেছে রঙে।

চাঁদের পাশে মেঘ জমেছে অনেক

স্বপ্নে রাজা দ্যাখে—

চাঁদ আসলে কয়লাখনির আলো।

আকাশ থেকে অজস্র নীল পালক

ঝরছে একে-একে…

পালক তো নয়! হাত-পা-মুখোশ-মাথা…

কোন কিশোরের পদ্য লেখার খাতায়

লুকিয়েছিল বোমা…!

ঘুম ভেঙে যায় রাজার। ভয়ের চোটে

কী করবে, না বুঝতে পেরে ছোটে

এ মাঠ থেকে ও মাঠ…

পায়ের চাপে গুঁড়িয়ে যায় প্যালেট

আকাশ তখন বিদ্যুতে রং খ্যালে।

খেলাও তো মেধাবী—

সাদা রঙের বর্ম ধুয়ে, ছেঁকে

সে দাঁড় করায় সমস্ত মিথ্যেকে

চাবুকই তার চাবি।

আর সে-রাতে বৃষ্টিতে সব উধাও

বৃষ্টি খেয়েই মিটিয়ে নেবে ক্ষুধা

নৌকোভাঙা নাবিক…

তার হাতেই তো মৃত্যু লেখা রাজার,

কারণ, আজও দোষের পরে সাজা

অবশ্যম্ভাব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *