লিখতে হলে ভদ্রভাবে লেখো
পরিবর্ধিত শোভন সংস্করণ: মে, ২০০৪
সপ্তর্ষি প্রকাশন। ৫১ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা ৯। মূল্য: ৪০ টাকা।
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২।
প্রচ্ছদ: স্বাতী রায়চৌধুরী
উৎসর্গ: বাংলার চিরন্তন ফুল, পাখি, চাঁদ আর তারাদের
.
সূচি
ঈশ্বর ও আপেল, স্বপ্ন, আমাদের বনলতা, বর্ষার চিঠি, বসন্তের চিঠি, জনৈক বাঙালির বক্তব্য, অলীক, যা হয়ে থাকে, এক ছড়া— দু’ছড়া, অপেক্ষা, আজ থেকে, বল্টুকিরণ, চোরপুলিশ, সোনালি আখরোট, ইদানীং, আমি আর অনির্বাণ, হাসি, ফেয়ারওয়েল, রিকশা, টুম্পাদের বাড়ি, পরিস্থিতি, দুর্ঘটনা, অস্বস্তি বিষয়ক, রজনী না হতে, কবিতা আজ গেরস্থালি/১, কবিতা আজ গেরস্থালি/২, দৃশ্যকল্প, কালো ওড়নার প্রতি, প্রতিযোগীদের বিবৃতি, দু’টুকরো, দয়া করো, অনুসরণকারীর ডায়রি, দুটি চিঠির খসড়া, শেষ দিন: ২০০১, আমরা যারা
.
পাবলিকই দেবতা, কিন্তু আমি তারও দু’গন্ধ উপরে
ঝুলন্ত পটল আলু এঁকে রাখছি, যাতে করে আজ
খিদের কী রং স্পষ্ট বোঝা যায়। কৈশোরের এঁটো ভালবাসা
ফিরাতে আসিল যারা, তাদের কী দুরন্ত সাহস!
তাদেরও ফেরার পথে বাপিডাকাতের দল লুঠ করবে জানি—
বিশ্বাস এমত। আচ্ছা মা ভবানী, এই সবের ঊর্ধ্বে উঠে যদি
কখনও উলঙ্গ হই, জাঙ্গিয়া বর্জন করি,
তবে কি নীচের লোকে খিদে ভুলবে, পটল, হ্যাঁ, আলু…
কী লিখছি তার কোনও মাথামুন্ডু নেই ভাইটি
খিদের ব্যথায় শেষে পাগলা হয়ে পড়েছি আমিও
আকাশে যদি বা দ্যাখো তারা ফুটছে, চাঁদ উঠছে,
নিজগুণে ক্ষমা করে নিও…
.
ঈশ্বর ও আপেল
ঈশ্বর আপেল দিয়ে ভাত খান, একথা সত্যিই।
আমরা যারা ভদ্রলোককে কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি
প্রতিদিন ভোরবেলা লুঙ্গি-ফতুয়ার ছদ্মবেশে
কিছু সবজি, কুচোমাছ, ইত্যাদি বাজার করে এনে
হাই পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে কাগজ পড়েন।
স্ত্রী আপিসে চলে যান, ছেলেমেয়ে হয়নি কোনও, তিনি
দুপুর, বিকেল, সন্ধে ঘুমিয়ে কাটান কোনওমতে।
ঘুমোন, কেন না প্রতি রাতে তাঁকে জেগে থাকতে হয়
ঘুপচি বাইরের ঘর, তেলচিটে আলো-অন্ধকার…
কাঁসার থালায় ভাত ঢাকা থাকে তেপায়া টেবিলে
ঈশ্বর বসেন, খান, কিন্তু শুধু ভাত নয়। পাতে
দু’-তিনটে আপেল এসে হঠাৎ উদয় হয়ে বসে।
সে এমন কিছু নয়, রোজ রাতেই হয়, জানা কথা
কিন্তু দেখতে-দেখতে পাতে আপেলের সংখ্যা বেড়ে যায়
পাতেও ধরে না শেষে, টেবিলে, মেঝেতে, সারা ঘরে
রাত যত বাড়তে থাকে, আপেলের স্তূপ হয়ে ওঠে।
বউ ঘুমোয়, ফ্রিজ ঘুমোয়, টিভিতে নীলাভ ছবি ভাসে…
তিনি বিচলিত হন না। একে-একে ধৈর্য ধরে খান
পুঁজ বার হয়ে আসা, গলাপচা আপেলের দল
ঈশ্বর একাই খান সারারাত জেগে বসে থেকে
যে-আপেল আমরা খাই না, কাজের মাসিকে দিয়ে দিই…
স্বপ্ন
বিকেলবেলা বাড়ি থাকাও পাপ
বাইরে হাওয়া, ঘরে নতুন টিউব
মাথায় বাজে একলা ডায়াল টোন
গ্যাসের দাম বাড়ছে, প্রেম নেই,
দুটো প্রাচীন টিউশানি হারালাম
তবু আমায় চিনছে এতজন…
একেকদিন বাড়ি ফেরার পথে
একেকদিন, সত্যি মনে হয়
আমি বোধহয়… আমি বোধহয় ক্লোন!
এখন আমার স্বপ্ন বলতে শুধু
পাড়ার ছোট ছেলেমেয়ের হাতে
নানা রঙের মুখোশ বিতরণ
আমাদের বনলতা
বনলতা সেন, তোমাকে আমরা চিনতে পারি না।
বাস থেকে নামা রুবি রায় হলে তাও চেনা যেত
কলেজ রাঙানো আর ডি-র সুর… কেবল ভেবেছি
শুনতে চাইলে নতুন মেয়েটি গান শোনাবে তো?
নতুন মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে উঁকি মেরে যায়
ট্রাম দেখলেই মনে হয় আমি জীবনানন্দ
কেউ-কেউ বেশ কবিতা লিখতে শুরু করেছিল,
একটাও তাকে পাঠানো গেল না, কপাল মন্দ
কপাল মন্দ সেই মেয়েটিরও, যে নাকি এখন
‘বনলতা সেন’ সাজিয়ে রেখেছে কাচের শো-কেসে
খুব উঁচু কোনও জানলায় তাকে দেখা যায় রোজ…
কোন সে শহরে কারা মরে গেল কাকে ভালবেসে
সে-গল্প থাক। সেসব কাহিনি ঠোঙা হয়ে গেছে
সে-ঠোঙায় মুড়ি মেখে দিলে আজ পাঁচ টাকা দাম
মুড়ির মধ্যে ফসিলের কুচি, হাড়ের টুকরো
খেতে-খেতে দাঁতে আটকালে ভেবো কঠিন বাদাম
বনলতা সেন, তোমাকে আমরা চিনতে চাই না।
কবিতায় পড়া সেই মুখে আজ ধুলো আর কাদা—
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছি যে-কোনও লাইনে
আমাদের কাছে দারু আর চিনি আলাদা-আলাদা!
বর্ষার চিঠি
সোনা, তোমায় সাহস করে লিখছি। জানি বকবে
প্রিপারেশন হয়নি কিচ্ছু। বসছি না পার্ট টুতে
মাথার মধ্যে হাজারখানেক লাইন ঘুরছে, লাইন
এক্ষুনি খুব ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে শুতে
চুল কেটে ফেলেছ? নাকি লম্বা বিনুনিটাই
এপাশ ওপাশ সময় জানায় পেন্ডুলামের মতো
দেখতে পাচ্ছি স্কুলের পথে রেলওয়ে ক্রসিং-এ
ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছ শান্ত, অবনত
এখানে ঝড় হয়ে গেল কাল। জানলার কাচ ভেঙে
ছড়িয়ে পড়েছিল সবার নোংরা বিছানায়
তুলতে গিয়ে হাত কেটেছে। আমার না, অঞ্জনের
একেকজনের রক্ত আসে একেক ঝাপটায়
সবাই বলছে আজও নাকি দেদার হাঙ্গামা
বাসে আগুন, টিয়ার গ্যাস, দোকান ভাঙচুর
কিন্তু আমি কোনও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না
বৃষ্টি এসে টিনের ছাদে বাজাচ্ছে সন্তুর…
ঝালা চলছে। ঘোড়া যেমন সমুদ্রে দৌড়য়
ভেতর-ভেতর পাগল, কিন্তু সংলাপে পোশাকি…
তুমিই উড়ান দিও, আমার ওড়ার গল্প শেষ
পালক বেচি, আমিও এখন এই শহরের পাখি
বসন্তের চিঠি
বসন্ত এসেছে। আমার শহর ভীষণ একলা এখন
দূর থেকে আজ কে বুঝবে তার চোখের কোণে জল না ধুলো
হাওয়ায় উড়ছে শুকনো পাতা, পায়ের ছাপও থাকছে না আর
আস্তে-আস্তে ঝাপসা হচ্ছে ভালবাসার রাস্তাগুলো
তবুও কথা জমছে। কথার নাম জানি না, মানে বুঝি না
টেলিগ্রাফের তারের ওপর শালিখ বসছে জোড়ায় জোড়ায়
দুপুর রোদ্দুরে মুখে মুখোশ এঁটে ঘুরে বেড়াই
রাতে বুকের মধ্যে কারা দাঙ্গা করে, টায়ার পোড়ায়…
সেই সঙ্গে ঘুম আসে আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন ঢোকে
স্বপ্নে আমি মাথা ঝাঁকাই স্বভাবসুলভ অবাধ্যতায়
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের মুখের আদল ভাসে তখন
ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়ি, মনখারাপের সময় কোথায়
অথচ এই খারাপ মনে বেঁচে থাকার ইচ্ছে দারুণ
কে জানে আজ চিঠি লিখছি কীসের টানে, কোন গরজে
বয়েস যেন পাহাড়ি পথ, খাদের নীচে পড়ার সময়
পলকা আমার শরীর শুধু শরীর, তুমুল শরীর খোঁজে
ওই ঠোঁটে ঠোঁট রাখব ভাবি। লাগবে কি এক শতাব্দীকাল?
তোর কপালে সিঁদুরে মেঘ, আমার হাতে কাপাস তুলো
শিগগির আয়। এই বসন্তে আমার শহর একলা ভীষণ
আস্তে আস্তে ঝাপসা হচ্ছে ভালবাসার রাস্তাগুলো
জনৈক বাঙালির বক্তব্য
আমার কান্ট্রির মতো কান্ট্রি নাই টোটাল ভুবনে।
তারও মধ্যে, দেখতে গেলে, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ দি বেস্ট।
কালচারই বলো আর আর্টই বলো, আনবিলিভেবল!
মিউজিক, অ্যাকটিং, পোয়েট্রি, ফিল্ম মেকিং, থিয়েটার, রোমান্স
আমাদের ব্লাডে আছে। আফটার অল, আমরা অন্য জাত।
হ্যাঁ, মানছি পভার্টি আছে, ডার্টি পলিটিকস আছে, তবু
ইংরেজিতে না চেঁচিয়ে, বুকে হাত দিয়ে বলো দেখি—
বেঙ্গলি ভাষার মতো সুইট ভাষা আছে, পৃথিবীতে?
অলীক
যে তুমি বনানীর ভেতরে শুয়ে আছ কাঠের বাংলোয়
সোনালি চুল যার বিছানা বেয়ে নেমে স্বপ্নে আলুথালু…
ফ্রকের ফ্রিলে এসে পৃথিবী ধরা দেয়—
তোমাকে দেখছি।
দেখছি তোমার ওই কাঠের বাড়ি থেকে কিছু দূরেই এক পাহাড়ি ঝর্না
বন্ধু ওকগাছ, পাইন, পপলার…
তুমি তো ঘুম থেকে উঠেই নিশ্চয়ই জলকে যাও আর
স্ট্রবেরি, চেরি, পিচ কুড়িয়ে নিয়ে ফেরো…
তখন চারদিকে বিকেল নামছে।
ফেরার পথে রোদ গুমরে পড়ে আছে, ক্লান্ত, চুপচাপ।
যে-ছেলে ওই পথে আপেল ফিরি করে তার তো ইতিহাস
থাকতে নেই কোনও,
কেবল সন্ধে,
সন্ধে হয়ে আসে।
কাঠের বাংলোয় হলুদ মোমবাতি আস্তে জ্বলে ওঠে
পুরনো আয়নায় একার ছায়া পড়ে
বয়েস… আলোছায়া…
নিজেকে ভাল লাগে
নেশায়, তারপর, আগুন ফেলে, সেই আস্ত মোমবাতি…
আসলে কোনওদিন, পারলে ভেবে দেখো,
আসলে কোনওদিন তোমার বাবা-মা’র
মিলন হয়নি!
যা হয়ে থাকে
অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে
আকাশ থেকে নতুন তারা খসা
কলকাতায় বিকেল শেষ হলে
কিছু লোকের কাজই শহর চষা
মন্দিরের আওয়াজ, পপগান
নতুন মেয়ে, ব্র্যাকেটে মদালসা
ল্যাম্পপোস্টে ডাক্তারের ছবি
যৌনরোগ সারিয়ে এত পসার…!
একার সন্ধে, একার পেটে খিদে
চারটে রুটি, একটা মাটন কষা।
মদ্যপান সপ্তাহে একদিন
কয়েকজন বন্ধু মিলে বসা—
রবিঠাকুর, চাকরি, রাজনীতি
পেঁয়াজকুচি, টমেটো আর শসা
ফেরার পথে খিস্তি, গুনগুন
প্রতিবাদের দেয়ালে পিঠ ঘষা
বাসের পর বাস চলে যায়…ভিড়…
শহুরে লোক, শহুরে দুর্দশা
ভালই হল। আমারও সব অসাড়
অসাড়, কিন্তু বুঝতেও পারছি
একটু করে হলেও, প্রতিদিন
অন্য কারও রক্ত খেয়ে এসে
আমার গায়ে হুল ফোটাচ্ছে মশা
একছড়া—দু’ছড়া
একছড়া-দু’ছড়ায় আমার পায়ের নীচে গড়ায়
পাঁচমিশেলি নোনতা চিনির দানা
একটু তাদের চাখি আবার একটু তুলেও রাখি
আশকারা পায় সাবধানি দস্তানা
ছোট্ট শীতের শহর, কুরুশ বুনছে উলের বহর
গল্পগুলো ঘুমোচ্ছে নোটবুকে
তুরুপ লাগে তাসে… যেমন সন্ধে নেমে আসে
চশমা আঁটা তরুণ কবির মুখে
তারপরও সে তাকায়, কী সব ভাবে, ভুরু বাঁকায়
আমার দিকে প্রশ্ন ছোড়ে হঠাৎ
‘কোথায় গেল ভায়া, তোমার দীর্ঘ বটের ছায়া?’
আকাশ তখন আক্ষেপে রংচটা
জবাব দিলাম ‘দাঁড়াও। এখন যেদিকে পা বাড়াও
মানুষ মানুষ মানুষ থরে থরে
শহর মফস্সলে তারা পথ বানিয়ে চলে
বটের ছায়া শুকোয় জাদুঘরে,
তখন সে-ও হাসে, কেমন ছিমছাম সন্ত্রাসে
আমার তোমার সবার কলম ঘেরাও
পিঠে দারুণ চাবুক কিন্তু গুটিয়ে নিলেন তাঁবু
এক-এক করে পূর্বপুরুষেরাও
আজ তাই মগজে হাওয়া অন্য কথা খোঁজে
মন ওঠে না একছড়া-দু’ছড়ায়
তরুণ কবির চোখে গরম কান্না এসে ঢোকে
পায়ের নীচে নোনতা চিনি গড়ায়…
অপেক্ষা
ভ্রু পল্লবে ডাক দিয়েছ, বেশ।
আমার কিন্তু পুরনো অভ্যেস
মিনিট দশেক দেরিতে পৌঁছনো
তোমার ঘড়ি একটু জোরেই ছোটে
আস্তে করে কামড় দিচ্ছ ঠোঁটে
ঠোঁটের নীচে থমকে আছে ব্রণ
কুড়ি মিনিট? বড্ড বাড়াবাড়ি!
দৌড়ে ধরছ ফিরতিপথের গাড়ি
আমারও সব বন্ধুরা গোলমেলে
বুঝিয়ে দেবে তোমায় কাছে পেলে
কেমন করে গল্প শুরু হয়!
খোলাচুলের সংজ্ঞা দিতে দিতে
সন্ধে নেমে আসবে বস্তিতে
ভাবছ তোমার অপেক্ষা সার্থক?
জানবেও না আমি ততক্ষণে
অন্ধকার চন্দনের বনে
ঘুরে মরছি, কলকাতার লোক…
আজ থেকে
যা হোক বলো, ভাল থাকার বাহানা দাও
কথার মধ্যে গন্ধ ছড়াও নেলপালিশের
পাহাড়প্রমাণ জমেছে রাত, এবার কাঁদাও
চোখের জলে দায়িত্ব নেই। ভাবনা কীসের
বসন্তে আজ সমস্তটাই মিথ্যে বলা
পাটভাঙা পাঞ্জাবির রঙে মনখারাপি
হাসির আওয়াজ ছিটকে ওঠে ন’দশ তলা
শান্ত আমি, তোমার পাড়ায় সন্ধে মাপি
চশমা থেকে বাদ পড়ে যায় অসংখ্য লোক
আর কিছুটা লুকিয়ে থাকে মুদ্রাদোষে
আজ থেকে সব মিথ্যেকথা তোমার হল,
যেমন আমার সব কবিতাই শঙ্খ ঘোষের
বল্টুকিরণ
বল্টুকিরণ মেঘান্তে এসে পড়ে
সূর্যের তুমি কী অবস্থাই করেছ অঘোরচাঁদ
পোর্ট্রেট ভেবে টাঙিয়ে রেখেছ ঘরে—
বল্টুকিরণ মেঘান্তে এসে পড়ে।
বল্টুকিরণ ধুলো খায় যেতে-যেতে
মাপা হাইওয়ে, বেগুনি-সবুজ রাস্তার ধারে ফাঁদ
কাকতাড়ুয়ার নয়ন লেগেছে খেত-এ…
বল্টুকিরণ ধুলো খায় যেতে-যেতে।
বল্টুকিরণ ভিটামিন ভালবাসে
চপলভাষার আত্মজীবনী কেটেকুটে যদি ঘুড়ি,
সে-ঘুড়ি তা হলে আকাশের গায়ে হাসে,
বল্টুকিরণ ভিটামিন ভালবাসে।
বল্টুকিরণ ওড়ে কম, হাঁটে বেশি
খাইবার থেকে সাইবার পথে দেহমন আজ কুড়ি
মাথার ভেতরে হলুদ মাংসপেশি…
বল্টুকিরণ ওড়ে কম, হাঁটে বেশি।
উল্কায় আঁকে আল্পনা আর দরজায় লেখে ছড়া—
যদিও তাদের মিনিং বোঝে না খোকা,
বল্টুকিরণ বেসিক্যালি খুব বোকা।
তবু রোজ তার পিতামাতা নড়েচড়ে
চাঁদি ফেটে যায়-রাতের আকাশে রোদ্দুর এত চড়া,
বছর-বছর ভাইবোন আসে ঘরে,
বল্টুকিরণ কী আর করবে,
নাইট কলেজে পড়ে…
চোরপুলিশ
এসো আজ খেলি তবে চোর চোর পুলিশ পুলিশ
চেকপোস্ট চেকপোস্ট পোঁ-গাড়ির চেজ সিকোয়েন্স
কে কাহাকে তাড়া করে সে-হিসাব কুত্তারও অজানা
খাকিপ্যান্ট খাকিজামা আহা ছদ্মবেশী তোলাবাজ
আমেরিকা হলে আজ গুলির আওয়াজ হত ‘ঢিচুঁ!’
বদলে ‘ঢিচক্যাঁও’ শব্দে পিলে মুষড়ে দেবার উপায়ে
এনেছ যে-নতুনত্ব সেও বাওয়া পুরনো টপিক
পতিতপাবন হেই ডিঙি মেরে সেলুট জানাও
জানাও চোরের মার কাকে বলে কার বড় গলা
সেই ফাঁকে হাফটাইম অন্ধকারে আততায়ী হাওয়া
কে কাহাকে তাড়া করে সে-হিসাব কুত্তারও অজানা
সে শুধু গ্রামোফোনের সামনে ব’সে ভোঁতামুখ ক’রে
প্রভুমার্কা গান গায় সনাতন দেশজ স্টাইলে
ট্রেনিঙে বলেছে তাকে ‘গন্ধ শুঁকো, শনাক্ত কোরো না।’
সোনালি আখরোট
আমি তোমার দেওয়া কাঁটাচামচ রক্ষা করেছিলাম
আমি তোমার দেওয়া দশটাকার নোট
আজও কোনও দোকানবাজারহাটে বিনিময় করিনি
শুধু স্বপ্নে ভাঙি সোনালি আখরোট
মনে পড়েছে খুব হাস্যকর কী সব অজুহাতে
এক আঙুলে ওই কপাল ছুঁয়ে দিতাম
তুমি ভালবাসতে আমার ছেলেমানুষি, আর গান
আমি তোমার মৃদু সুমন-বিরোধিতা
কোন পাড়ায় থাকি, কী কাজ করি, কার সঙ্গে মিশি
কোন গলিতে ছোট, নোংরা আশিয়ানা
তুমি না জেনেশুনে পা রেখেছিলে ঘোর দুপুরবেলা
মুখে আছড়েছিল প্রজাপতির ডানা
তাতে ক্ষতি হয়নি কিছু, বরং উলটে আমি পেলাম
টানা এপার থেকে ওপার ছোঁয়া সাঁকো
তাও বেড়াতে যাওয়া এড়াতে চাওয়া… শুনেছিলাম তুমি
সব শত্রুদের বন্ধু করে রাখো
কারা হোটেলঘরে সন্ধেবেলা দু’জন, তবু একা
কারা সামলেছিল ইন্দ্রিয়ের টান
ভাবো জানি না? কিছু বুঝি না? সব জেনেবুঝেও চুপ
শুধু জ্বরের ঘোরে ডেকেছি ‘বৌঠান!’
যদি প্রশ্ন করি কেন সেদিন ওভাবে হাসছিলে?
কেন ফোন করোনি ফিরে আসার পরে?
জানি জবাব নেই। ঘুমিয়ে আছ গভীর লেপ টেনে
আমি রাত জাগছি বিশ্রী জাদুঘরে
তবু বলছি, শোনো। এসব কথা গোপন করে কী লাভ?
যদি তোমার মন না নিতে চায়, না নিক
চোখে টানেল খুঁড়ে ঢুকে পড়ছে হৃদয়গামী যে-চোর,
তাকে শাস্তি কিছু শোনাও, মহারানি!
সে তো তোমার দেওয়া কাঁটাচামচ রক্ষা করেছিল
সে তো তোমার দেওয়া দশটাকার নোট
আজও কোনও দোকানবাজারহাটে বিনিময় করে না
শুধু স্বপ্নে ভাঙে সোনালি আখরোট…
ইদানীং
শীতের দুপুরে মাঝে মাঝে ভাবি, তোর চেয়ে
আমার বিছানা রোদ্দুর পেত অল্প
তবুও তো ছিল মুখ দেখাবার লজ্জা
তখনও জানি না আয়নার নাম দর্পণ
তখনও জানি না ক্লান্তির নাম কারশেড
মাথায় ঘুরত আলি আকবর, জগজিৎ
বুকে অনিচ্ছে, পরীক্ষা, শ্বাসকষ্ট…
চোখের সামনে মিলিয়ে যাচ্ছে সবদিক
কথায়-কথায় অনশন, পদযাত্রা
মিটিং, মিছিল, অবরোধ চেনা রাস্তায়
’৯২: মূর্তি ভাঙার শব্দ
পড়তে গেলাম, স্যার বললেন ‘আজ থাক।’
সেই থেকে আজও শিরায় ছুটছে দমকল
বুঝতে পারিনি কাদের আগুন, কার ছাই
পোড়া দেহ নিয়ে জলে ঝাঁপ দেয় ডুবুরি
বাড়ির বদলে একটা ঝিনুক ধার চায়
কিন্তু হাঙর তাড়া করে তাকে। আর সে
পাগলের মতো চোরাস্রোত কেটে সাঁতরায়….
আমারও দেখছি ইদানীং খুব হচ্ছে
লোকে যাকে বলে ‘অস্তিত্বের সংকট’
আমি আর অনির্বাণ
ক
হাওড়া ব্রিজের টং আমাদের প্রায়শই টানে
এক প্যাকেট তাস নিয়ে কালই আমরা পৌঁছব সেখানে
একটা ছুরি নিয়ে যাব, সারারাত শান দেব মগজে
ভোর হলে খেলা শুরু। হাওয়া আছে দুপুরের ভোজে
দুপুরেও তাস আর সন্ধে থেকে রাত অব্দি তাস-ই
যে যাই বলুক ভাই, আমরা স্রেফ খেলতে ভালবাসি…
মজা হবে, লোক জমবে, ভাববে আমরা ব্যতিক্রমী বোকা—
যেমন খুশি ভাবতে পারো, টেক্কা তো ওপরে আছে খোকা!
আমরাও ওপরে আছি। কবে নামব বলতে পারছি না
নীচে তো হল না কিছু, দেখি না, এখানে হয় কি না…
না-না, কোনও ভয় নেই। পড়ে গেলে মা গঙ্গা আছেন
আপাতত দান চালছি, বেজে যাচ্ছে ন’টার সাইরেন…
তোমরা যারা ভয়ে-ভয়ে ভরসা করে ঢুকবে কলকাতায়
দু’জন দেবতা, দেখবে, তাস খেলছে ব্রিজের মাথায়!
খ
জাদু মুরগি সেঁকা হচ্ছে… ওফ!
জাদুবলে বানানো ফার্নেস
পৃথিবীতে যত পচাজাদু
আমাদের টাটকা বিজনেস
আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে
আমরা খুলছি মিষ্টির দোকান
ভাল দেখে বন্দুক কিনুন—
যাঁরা-যাঁরা মিষ্টি খেতে চান
এছাড়াও ভাবছি আন্দামানে
আদিবাসীদের কাছে গিয়ে
মিনিস্কার্ট বেচব সের দরে
আর বেচব, যাকে বলে, ইয়ে…
ছোটখাটো প্রবলেমে যদিও
এই জাদু খুব একটা খাটে না
বেকার বেকার-ই থাকে, শুধু
বিশ্বব্যাঙ্কে বেড়ে চলে দেনা
অনবদ্য জাদুকর জুটি
কাতারে কাতারে লোক আসে
নিয়ে যায় প্রসাদি পাঁরুটি
মাঝেমধ্যে ম্যানড্রেকও এসে
আমাদের দরজায় দাঁড়ান
আমরা বলতে? ঠিক ধরেছেন
আমি আর সখা অনির্বাণ।
হাসি
হাসি আমার, হাসি নূতন পিঞ্জরে
আকাশ জানে কতটা লাঞ্ছনা
অথচ দ্যাখো, একশো-দুই-তিন জ্বরে
তুমি তো এর কিছুই জানছ না
জানছে শুধু মুচকি হাসি পক্ষীটি
তোমার দিকে দেখছে বারে বারে
জ্বরের ঘোরে তুমি কেমন লক্ষ্মীটি
ওড়ার কোনও ক্ষমতা নেই, বা রে!
উড়তে শালা চাইছে কোন উন্মাদে!
আমরা দুটো ওষুধ খেয়ে খুশি
বুঝতে পারি ধর্ষণ আর খুন বাদে
রঙ্গে ভরা জগৎটাও ভুসি।
অন্ধকারে কাঠি করছে লোকে…
কাঠি না হলে পাগলা তুই জ্বালবি কী?
মাথায় যদি একটা কথা ঢোকে
চোখ বন্ধ। বন্ধ করো নাক-কানও।
কান্না পেলে তবেই ঠোঁট খুলো
ঠোঁটের ধারে সেলাই-সুতো আটকানো
মানুষ হয়ে হাসছে ভোটগুলো।
হাসি আমার, হাসি নূতন পিঞ্জরে
আকাশ জানে কী নির্ভীক ক্ষতি
বৃক্ষ থেকে পাতার মতো দিন ঝরে,
তবু কেমনে হাসিছে বৃক্ষটি!
সবার গায়ে হাসিমুখর জার্সি, না?
পয়সা দিয়ে হাসছে প্রত্যেকে?
আমরা যারা লাফিং ক্লাবে যাচ্ছি না,
তাদের হাসি আসছে কোত্থেকে?
ফেয়ারওয়েল
আপনি তো স্যার বুকের মধ্যে জাগিয়েছিলেন রঙিন-রঙিন আশা
আপনি তো ডিম ভেজেছিলেন নামকরা কোন বেবি-অয়েল দিয়ে
অথচ আমাদের কপাল পুড়িয়ে খেলো গালভরা তামাশা
আমরা সবাই কনেযাত্রী, আসছে মাসে চম্পাকলি’র বিয়ে
বিয়ে তো নয়, শ্রাদ্ধবাসর। বাধ্য ছেলের দল গড়েছি মোরা
চোখ পিটপিট করব সবাই, মুখে থাকবে পেনাল্টিমেট হাসি
দুঃখী হাতে প্রেজেন্টেশন এগিয়ে দেব, সাবধানে, আনকোরা
তলপেটে চাপ টাকডুমাডুম, আমরা আঁটি চুষতে ভালবাসি
আপনি তো স্যার দুঃখ নিয়ে কীসব যেন থিয়োরি দিচ্ছিলেন
‘সাবঅলটার্ন কালচারে আজ এই সবই তো নরম্যাল ট্র্যাজেডি…’
ঘর মুছছে সুপার হিরো, কাদের বাড়ি বাসন মাজছে ভিলেন
কমেডিয়ান সর্বেসর্বা, পেরিয়ে এলাম টু থাউজ্যান্ড এ ডি
পেরিয়ে এলাম নগরজীবন, ইন্ডাস্ট্রির ধোঁয়ায় ঢাকা আঁখি
পেরিয়ে এলাম হার্ডল রেস, সত্যি হয়ে থাকল ফটোফিনিশ
মাচায় বসে রাত কাটালাম, খাঁচাসুদ্ধু পালাল প্রাণপাখি
একটু করে টেনে নিচ্ছে… গিলে নিচ্ছে… জীবন যে কী জিনিস!
আপনি তো স্যার জেমস ক্লিপে জীবন এঁটে বানিয়ে নিলেন সিভি
‘বয়সটা ভাল নয়’ আপনি আদেশ দিলেন বাবার সঙ্গে শুতে
দিনের বেলা বটতলা বই, রাতের বেলা নীলচে কেবল টিভি
কোথায় বেশি উত্তেজনা, ঝগড়া বাঁধে বন্ধুতে বন্ধুতে
ঝগড়া থেকে ফায়দা লুটে কায়দা মারে কোন সে মজন্তালী
কৌরব-পাণ্ডবের মাঝে যেমন থাকে ক্যালানে দ্রৌপদী
ধৃতরাষ্ট্র ব্লাইন্ড বলে লাভের গুড়ে পড়ল চোখের বালি
সব ছোটলোক চাটাই পাতে, আপনি তো স্যার আটকে আছেন গদি
তবুও যেদিন বিদায় নেবেন, দু’হাতে দুই অভিজ্ঞতার থলে
আমরা সেদিন বাতাসা আর চোখের জলে ফেয়ারওয়েল দেব
হাজার হাজার চম্পাকলি ভেট চড়াব ওই করকমলে
কিন্তু যদি সুযোগ আসে, আপনাকে স্যার, পারলে দেখে নেব!
রিকশা
রিকশায় ফুটেছে তারা, রিকশা যাবে দূরে—
চারপাশ আগলাচ্ছে হাওয়া। সুগন্ধী। ফুরফুরে।
আমরা সবাই অফিসযাত্রী। পুরাতন, সাবেকি
তাদের মধ্যে তুমি কেমন পথ করেছ দেখি!
পথে তোমার ওড়না ওড়ে, রেশম দিয়ে বোনা
বয়েস উড়ে যাচ্ছে তোমার-সামলাতে পারছ না…
আমরা সবাই কলেজযাত্রী। উনিশ থেকে কুড়ি—
চাঁদের রিকশা রাস্তা কাটে, চরকা কাটে বুড়ি
কীসের রাস্তা, কীসের চরকা, কীসের বৃন্দাবন—
মধ্যবিত্ত জীবন সবার, মধ্যবিত্ত মন
চোখ উঠিয়েই নামিয়ে নিচ্ছি, ঝাঁঝ আছে রোদ্দুরে
রিকশায় ফুটেছে তারা, রিকশা অনেক দূরে…
টুম্পাদের বাড়ি
টুম্পাদের বাড়িতে একটু আগে থাকতে ভোর হয়ে যায়
কেন না ওদের বাড়ি বেশ খানিকটা পুব ঘেঁষে স্থাপিত
পাড়ায় সবার আগে ওদের বাড়িতে সূর্য রোদ নিয়ে ঢোকে, দম নেয়,
সবার যখন রাত তখন ওদের বাড়ি ডবল ডিমের পোচ, ভেজ স্যান্ডউইচ আর
চা রান্না করা হয়
টুম্পার বাবার মুখে ময়াল সাপের মতো ঘুম লেগে থাকে
টুম্পার মায়ের মুখে রজনীগন্ধার মতো হাসি
এ তো কিছু নয়
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে টুম্পার থাইয়ের রং সাদা
এ সমস্ত কথা এই পাড়ার সমস্ত লোক জানে,
স্বীকার করতে ভয় পায়।
মজার ব্যাপার হল, টুম্পার কুকুর, জাতে অ্যালসেশিয়ান—
এসবের কিছুই বোঝে না।
পরিস্থিতি
তাড়িয়ে দিলেও ফিরে-ফিরে আসে, কী নির্লজ্জ বসন্তকাল
অথচ কখনও ঘুমের মধ্যে ফিরে আসবে না বাসে-দেখা-মুখ
ফিরে আসবে না পিছল দৃশ্য, পরীক্ষারোদ, কলেজের সিঁড়ি…
ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ে মরে…যেন কতদিন ইমেজ লিখি না
চুপচাপ থাকি, দুপুরে ঘুমোই, কারও সাতেপাঁচে নাক গলালেই
পাড়ার ছেলেরা বাড়ি বয়ে এসে বলে যায় ‘বস, বাওয়ালি হবে না।’
কী হবে তা হলে? টুপিজুতোমোজামাফলার আর জ্যাকেট চাপিয়ে
ক্রিসমাস ইভে উবু হয়ে বসে পার্ক স্ট্রিট থেকে পোস্টার কিনি।
কত লোক… কত লোক… কত লোক… কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছেও না
শুধু যাতায়াতে বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘বেঁচে আছি’… আমি যাতায়াত করি।
দেয়ালের গায়ে পেচ্ছাপ আর ঝাপসা প্রতীক… পড়া… গলাসাধা…
সন্ধে হলেই যার-যার বাড়ি সিএনএন খুলে যুদ্ধ দেখছে
আমাকে ডাকেনি ওরা কেউ, তবু মাথার ভেতরে একের পর এক
যুদ্ধ ঘোষণা, রি-ইউনিয়ন, লাল বিয়েবাড়ি, সন্ত্রাসবাদ…
রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যেন আমাকে বাঁচায় রানি মুখার্জি
দুঃখ ভোলানো ওর হাসি থেকে উড়ে এসে আমি বিছানায় পড়ে
বমি করি আর মৈথুন আর হাসি আর ভাবি আর লিখি আর
করি আর যাই আর নামি আর সরি আর আর আর আর আর
খবরে বলেছে: উপকূলে ঝড়, জেলেরা-মাঝিরা সাবধান। আমি
এত উঁচু এই পাহাড়চুড়োয় বসে ভয় পাই…
ভয় পাই…
ভয়…
দুর্ঘটনা
একবার-দু’বার হৃদয় টাল্লি খেতে পারে, পকেট ফাঁক হয়ে যায় ভর্তি মিনিবাসে
কেমন একটু বেঁটে বলে সব আশা ছেড়েছ, এখন চাকরি খোঁজো সার্কাসে-সার্কাসে
ফুটপাত বদল হচ্ছে ঝিন্চাক্-ঝিন্চাক্, পাগলা মা কি তোর একার এই মাঝরাতে?
ব্যর্থতা উদ্যাপন করছে সহস্র কিম্ভূত, তাদের গলায় জ্বালা, ঠুনকো বোতল হাতে
রবীন্দ্রসংগীত গাইছে নিজের দেওয়া সুরে… সবাই একটু-একটু স্বাধীন থাকে শোকে
মুক্তো ছাড়ো। ঝিনুকই মিলছে না, তুমি তেমন হলে জড়িয়ে ধোরো নির্মলা মিশ্রকে
কিন্তু বাড়ি ফিরেই পাবে শিরা কাটার গন্ধ, ভীষণ লোক জমেছে, একঝাঁক সান্ত্বনা…
তুমি মাতাল, তার ওপরে কবিতাদোষ আছে,
এসব নখরা তোমার বউ আগে জানত না?
অস্বস্তি বিষয়ক
ক
প্রথমে মাংসটাকে কুচি কুচি করে কেটে নিন
অল্প আঁচে পেঁয়াজ আর ক্যাপসিকাম ডিপ ফ্রাই করুন
এরপর মাংসের কিমা ছেড়ে দিয়ে সামান্য হলুদ
টমেটো, আদার কুচি, ধনেপাতা, আর অবশ্যই
একটু ভিনিগার নিয়ে মিশিয়ে ঢালুন, চাপা থাক
এবার আন্দাজমতো নুন দিয়ে নাড়িয়ে নামান
এটাই স্বাভাবিক যে মধ্যদুপুরের গৃহিণীরা
কুকারি শো-এর মধ্যে জীবনের স্বাদ খুঁজে পান
খ
দ্যাখো, ইলেকট্রিক তার চলে গেছে দিগন্ত ছাড়িয়ে
মনে তো হয় না দেখে এ-গ্রামে তোমার কেউ থাকে
দু’দিন বেড়াতে আসা, থাকা খাওয়া সামান্য টাকায়
হটশট ক্যামেরায় দীর্ঘ সানসেট, বুনোফুল…
কোমর দুলিয়ে আজ চাষিমেয়েদের ছোটনাচ
কাল প্রোমোটার এসে কিনে নেবে সব ধানখেত…
দু’দিন বেড়াতে আসা বিদ্যুৎচালিত এই গ্রামে
কাকতাড়ুয়াই শুধু ঠিকঠাক প্রলেতারিয়েত
পোড়ো কেঠো বাড়ি, মরা বেড়ালের গন্ধ চারপাশে
সাপ আর আদিবাসী মেয়ের মিলন চিৎকার
কানে গোঁজা তুলো রক্তে ভিজে যাচ্ছে থেকে-থেকে, আমি
দরজা দিয়ে একছুটে ভেতরে গেলাম, বড় ঘরে
প্যাঁচার পালক উড়ছে, বন্ধুদের গলা পাচ্ছি, আর
দেখছি লাশ গিঁথে আছে ছোটবড় ঘড়ির কাঁটায়
আমি যত কোলবালিশ আঁকড়ে ধরি ছাড়া পাব বলে,
আমার স্বপ্নের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়তে চায়
রজনী না হতে
বাঁশি বাজছে… বাঁশি বাজছে… এই তো আমার স্বভাব
আমি হচ্ছি কবি, আমার খাতা-পেনসিল আছে
কিন্তু বাঁশি বাজলে আমি পাগল হয়ে যাবই
গল্প লিখব ইচ্ছেমতো, গোরু তুলব গাছে
তারপর যা হবার, হবে ভীষণ তাড়াতাড়ি
প্রেমিকজন্ম লুটিয়ে পড়বে স্নো-পাউডার হাতে
কাকুতি মিনতি করবে, আম্মো লোভে প’ড়ে
ধরতে গিয়ে হোঁচট খাব খিলখোলা প্রভাতে
যেমন তেমন প্রভাত? বাবা! সবাই মিলে বলো—
‘পাপ এসেছেন! পাপ এসেছেন!…’ ও পাপ, আমার খ্যাপা,
কে আসতে বলল আপনাকে? বেশ তো ছিলাম ঘরে
এখন আপনি বাইরে নেবেন, কে সামলাবে হ্যাপা?
হ্যাপার কথা ঘর জানে আর ঘরকে জানে প্রেমই
প্রেম জানে মন, মনের কথা পাঁচুগোপাল জানে
কে ছিল রাই, কে ভাই মীরা, বয়েই গেছে আমার
তোমাকে আজ তাক করেছি পাড়ার অনুষ্ঠানে।
কে গো তুমি? কেন? বিবেক-বিবেক কে? বেপাড়ার?
সে যাই হোক গে, বাবুসোনার বিবেক বলে কথা
যত্নআত্তি করব’খনে, চান করিয়ে দেব,
কিন্তু আমার ওপর কেন খার খেলে অযথা?
চালিয়ে যাও না, ব্যাপক হচ্ছে। যদিও জানি রাতে
বৃষ্টি এসে সমস্তটাই পণ্ড করে দেবে,
তখন দেখব কার কত দম। ঠাকুর তো বলেছেন—
‘হাতি নাচছিস… ঘোড়া নাচছিস… কদমতলায় কে বে?’
কবিতা আজ গেরস্থালি/১
কবিতা আজ গেরস্থালি। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই আর
টাট্টুঘোড়া লাট্টু খেয়ে ভেদবমিতে ইহলোকের মায়া
ত্যাগ করেছে গতপরশু-শোকসভায় কবিতা পড়া হবে।
শুধু কী তাই, মৎস্যমুখে কবির দল শোনাবে কীর্তন
হরে কৃষ্ণ ঘরে কৃষ্ণ ধরে কৃষ্ণ রাধার পনিটেল
যুবতীরাও স্বপ্নে দ্যাখে লালকৃষ্ণ আদবানীর মুখ
পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে সুরদাসের চশমা ছিল কিনা,
অথবা খুব শক্ত হলে জোকারদের জননপ্রক্রিয়া…
ঘাবড়াবার কিচ্ছু নেই, কোর্সে আছে। তা ছাড়া ইদানীং
বাচ্চারাও কী গম্ভীর, বেশ একখানা লাদেন জেঠু ভাব
গাল টিপলে ঠেঙিয়ে দেবে, বাপমায়ের একমাত্র ব্যথা
কিন্তু ওই, কবিতা আজ গেরস্থালি। হাওয়ায় উড়ে-উড়ে
পৃথিবীটাকে উঠোন করে এনেছে প্রায়। কিন্তু সাবধান!
এই শহরে ছদ্মবেশে ডি কে লোধের শিষ্য ঘোরেফেরে
কবিতা বোঝে, মন্তব্যে যায় না, তবে টোটকা বলে দেয়
হতাশা প্রেম স্বপ্নদোষ চোঁয়াঢেকুর অর্শ গনোরিয়া
সব সারবে। ছবি ও সই দেখে নেবেন, মূল্য ধরে দিয়ে
বাড়ি কাটুন। রোজ দু’বেলা… না হলে আর বলছি কী গো, কাল
ঝড়ের মতো কবিতা এল! গায়ে না লাগে ছোট্ট ওঠাপড়া…
বারান্দায়, লিভিংরুমে, পাপপুণ্যে, নাটক-সিরিয়ালে
কবিতা আজ ঢুকে পড়েছে। মাইরি, এত আরাম লাগছে না,
ডায়রি শুধু ব্রত রাখুক, উপোসী থাক চিলেকোঠার কোণে…
আপনি দাদা এগিয়ে যান বৌদিসহ, মামাশ্বশুর—
দেওর-কাকু-ভাইঝি-মাসিমারা
কবিতা দিন, কবিতা নিন
বিবাহে আর নিত্য প্রয়োজনে!
কবিতা আজ গেরস্থালি/২
কবিতা আজ গেরস্থালি। যেন
দালানে সাদা পায়রা বসে আছে
একটা সাদা সৎকারের ভ্যানও
সেই কবিতার আনাচে-কানাচে
ঘুরে দেখছে কেউ মরল কিনা…
কোথায় মরণ। মোচ্ছবে-মোচ্ছবে
ঢেকে যাচ্ছে শুনশান আঙিনা
লেখা পড়ছে প্রতিভাবান গবেট
ক্রিসমাস, ঈদ, বসন্তপঞ্চমী
কিন্তু এবার পত্রিকা দপ্তরে
কবিতা নয়, পাঠাতে চাই বমি
দুর্গন্ধ ঝলসে উঠুক পাতায়
নাক চাপা দিক সুস্থ কবিতারা
ঐতিহ্যের তাপ্পিমারা কাঁথায়
গান ধরেছে ফুলপাখিচাঁদতারা
লোক জমেছে পাড়ার মোড়ে-মোড়ে
মুরগি-লড়াই কবিতা মারপ্যাঁচে
কলমগুলোর সাবধানী আঁচড়ে
উত্তেজনাও ঠান্ডা মেরে গেছে।
আর যারা সব শহরে-মফস্সলে
বন্ধুর মুখোশে মানুষখেকো,
তারাই আবার আমায় এসে বলে
‘লিখতে হলে ভদ্রভাবে লেখো।’
দৃশ্যকল্প
ক
আমরা তো দেখি মেনরোডে ভিড় ঠেলে
আস্তে চলেছে সাইকেলঅলা
পেছনে ঝুলছে মৃত পাঁঠাদের ছাল…
কিন্তু ভাবো তো, রাতের দাওয়ায় ঘুমোচ্ছে সেই সাইকেল
তার কেরিয়ারে লেগে তাজা রক্তের ছোপ…
আর কী দেখব
শীত এসে গেল সোয়েটারে-মাফলারে
শহরে ঢুকছে নতুন বায়োস্কোপ…
খ
খেলা দেখছ। হারবে, তবু দেখতে হচ্ছে
ব্যাটে আছড়ে পড়ছে পাকা লেগব্রেক
হাতে আর. সি. কাঁপছে, তুমি যুদ্ধ চাও না
কত বাচ্চা মরছে…
বলো, দেখবে?
গ
সব অমাত্য। শিল্পী কেউ না। হস্তশিল্প বিক্রি হচ্ছে
ঠান্ডা পড়ছে… ছোট্ট ছাউনি…তিনটে-চারটে লোক ঘুমোচ্ছে…
কালো ওড়নার প্রতি
কালো ওড়না, তুমি যাচ্ছ… ভেসে যাচ্ছ… কত রেশন দোকান
পার হও… কত ধানখেত… কত হাইরাইজ আর পাগল হাওয়ার
সন্ধে… তুমি দেখলে… নীচে আলপথ থেকে দু’ হাত নাড়ল
বন্ধু… চোখে চশমা… এত রোদ্দুর, ব্যথা শুকনো-শুকনো
লাগছে। কালো ওড়না, তুমি যাচ্ছ, জেনো অনেক ছেলের
যৌবন খাবে ধাক্কা…যারা অন্ধ, যারা কথায়-কথায়
চমকায়, যারা মিথ্যুক, যারা দরজার গায়ে লাগিয়ে রেখেছে
পোস্টার, যারা বর্ষার রাতে মৈথুন আর রবীন্দ্রনাথ
হাতড়ায়, দুটো টিউশান সেরে রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে
পৌঁছয়-তারা থাকবে। পথে থাকবে। তুমি ভাসতে-ভাসতে
কদ্দূর যাবে একলা? সারা বিশ্বেই আজ মফস্সলের
ঠান্ডা…। তুমি পারবে? বলো পারবে, আজ ওদের শিয়রে
নামতে? বাজে প্রশ্ন। যদি পারতেই, তবে কখনও হতে না
উড্ডীন। কালো ওড়না, তুমি যাচ্ছ, কত রঙিন আকাশ
পার হও… তবে এও ঠিক, তুমি রাত্তিরবেলা কখনও পাবে না
শান্তি। যত সুন্দর আর দুর্গম-ই হও, তোমাকে জ্বালিয়ে
মারবেই সাদা অক্ষর হয়ে উদ্ভট শত বেকার ছেলের
কাব্য…!
প্রতিযোগীদের বিবৃতি
আমাদের স্বাধীনতা মুছে গেলে তবে তুমি পাঠাবে পবনভরা পাল?
দুধভরা নদীবক্ষে লুটোপুটি খাচ্ছি আমরা কয়েকজন সীমান্তকিশোর
শরীরে সাঁতারজামা, হাতে বৈঠা, এ-ওর মুখের দিকে উদ্বেগে তাকিয়ে
চিন্তা করছি কখন যে শুরু হবে অভিযান… তুমি কিন্তু এখনও এলে না।
দু’দিকে খাড়াই টিলা, সাবান মাখানো তাতে, গন্ধ খুবই ভাল লাগছে আজ
ভাবা তো যেতেই পারে এই পৃথিবীটা আছে ইয়াব্বড়ো ডেকচির ভেতর
একটু পরে আস্তে-আস্তে সেদ্ধ হতে শুরু করবে, ঘোরার আগ্রহ কমে যাবে
আমরা কয়েকজন এই বিদেশি নদীতে কী যে করব কিছু ভেবেও পাচ্ছি না
সঙ্গী বলতে শুধু ফেনা, আছে বলতে গ্রীষ্মকালে কেটে রাখা কাঠের ক্যানোপি…
এই সমস্ত ভেঙেচুরে ভেসে গেলে তবে তুমি পাঠাবে পবনভরা পাল?
বলছ পাখি গান গায়। বলছ ফুল ফোটে। আচ্ছা, আমরা তাও বিশ্বাস করেছি।
কিন্তু আসলে তো খুব চিনি না এখানে কাউকে, অপেক্ষায় থেকে-থেকে আজ
উপচে পড়ছে নদীবক্ষ, সারা গায়ে ফেনাদুধ, শীতরোদে ফুটন্ত সকাল…
দু’ টুকরো
একরোখা
একরোখা মন, এবার তোমার ছাউনি তোলো
কী লাভ লড়ে? এই পরাজয় সবার চেনা
কাজ লেগেছে অন্তরে, আজ ক’দিন হল
সকালবেলার আকাশ আমায় বোর করে না
দুপুরবেলা সঙ্গে থাকি আমরা ক’জন
সামান্য কাজ, অল্পটিফিন, একটু সেলাম…
অবাক হয়ে দ্যাখো, আমার একরোখা মন—
হাসতে হাসতে আমিও কেমন অফিস গেলাম
লবণজল
না, কবিতায় ঋণের কথা লিখব না আর।
চোখের লবণ বিক্রি করে খাওয়াও তো পাপ
জলের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে পাতাবাহার—
কিন্তু আমার জলের ধারে যাওয়াও খারাপ
ভাল কেবল সুদূরে এই জলতরঙ্গে
সুদূর থেকেই দেখছি চোখের রঙ্গখানা,
কী লাভ এত লবণ উঠে ঢেউয়ের সঙ্গে—
যখন আমার জলের ধারে যাওয়াই মানা?
দয়া করো
গায়ের রং সন্ধেবেলার মতো
বসার ভঙ্গি যা ছিল তা-ই আছে
প্রথমে সব সত্যি ভেবেছিল
এখন যেন মিথ্যে হলে বাঁচে।
আপনমনে গাইতে-গাইতে সে
কপাল থেকে আলগোছে চুল সরায়
ঝাঁঝিয়ে ওঠে গরমকালের আকাশ…
গনগনে রোদ… ঠোঁট ফেটেছে খরায়
বর্ষা এবার অন্যরকমের।
মেঘের ডাকে বন্দুক না সরোদ…
মুখ নামিয়ে একলামতো মেয়ে
গাইছে ‘ওগো বৃষ্টি, দয়া করো—’
দয়ার রং সবুজ। সবাই ভাবে।
তার গায়েও ১০৩ জ্বর
তাও, সারারাত, বৃষ্টি আসবে ভেবেই
বাঘের মুখোশ বানায় কারিগর
সকাল হলে বিক্রি করে হাটে
শাস্তিও পায় নকল বাঘ সাজার
মানুষ ঘোরে বাজার থেকে বাজার
কাদার ওপর ক্লান্ত পায়ের ছাপ
খুঁজে বেড়ায় অলক্ষ্মী উন্মাদ
বোঝালে সে কক্ষনও বুঝবে না
স্বপ্নে দেখা বিজ্ঞাপনের স্বাদ
তার ধারণা হাজার বছরের
আর আমাদের বয়েস মোটে তিরিশ
ঘণ্টাতিনেক আচ্ছন্ন থেকে
গানের শেষে যে-যার বাড়ি ফিরি
ফেরার পথে ঠান্ডা ছিল হাওয়া
ভেবেছিলাম বন্ধুরা মিথ্যুক
উলটোদিকের বাতাসে আজ ওড়ে
ঘা খাওয়া সব সঙ্গীদের মুখ
শহর, তোমার জখম গুনে গুনে
সময় নিজের লাশ ফিরিয়ে দিক—
বুকের ভেতর আর নিতে পারছি না
সন্ধেবেলার মৌসুমী ভৌমিক…
অনুসরণকারীর ডায়রি
অনুসরণের পথ আলো পড়ে লঘু হয়ে আসে
আকণ্ঠ চিমনির ধোঁয়া পান করে টলতে-টলতে বাড়ি…
রাস্তায় বাতিল বাল্ব, এককালে জ্বলত, তার গায়ে
থুতু ছুড়ি, ধোঁয়া লাগে। কুকুরে-বেড়ালে কাড়াকাড়ি
কী নিয়ে কে জানে, ওরা গলির সাম্রাজ্য খুব বোঝে
রাত বারোটার পর শুরু করে হুল্লোড়, মহড়া
তখন জানলা থেকে, ইচ্ছে হয়, নীচে ফেলে দিই
যা কিছু আনন্দঘন, যাহা কিছু সেলোফেনে মোড়া
কখনও পাওয়া গেছিল কী জানি কী কঠিন সে-স্মৃতি
পিকচার টিউব ঠেলে কাহিনি বেরিয়ে আসে তাও
গলায় মাফলার বাঁধি। সে-বয়েস নেই, যে-বয়েসে
গোয়েন্দা দপ্তর থেকে চিঠি আসত: ‘রহস্য পাঠাও’
আর কী রহস্য দেব, নিজেই রহস্যে ঢুকে গিয়ে
দেখে মরছি সন্ধেবেলা রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব
প্রিটোরিয়া স্ট্রিট আর নিউমার্কেটের চোরাগলি…
এসব মারের মুখে বন্ধুদের চাকরিই জবাব।
আর নিঃস্ব লেপ আর শহরে শীতের দিন এলে
মেলা ভাঙে। কোনওমতে জায়গা করে নিই লাস্ট বাসে
চাপ, এত চাপ, তবু ধুমকি ওঠে, নেশা চমকায়
অনুসরণের পথ আলো পড়ে লঘু হয়ে আসে।
লঘু পথ ঘুরে যায়, সঙ্গে-সঙ্গে সকলেই ঘোরে
ডাস্টবিন উপচে পড়ে, নোংরামাখা থ্যাঁতলানো আখের
লেপটে যায়, তবু কাউকে ডাক দিইনি। আমি তো একাই
খুঁজেছি পায়ের ছাপ, মিছিমিছি, আততায়ীদের…
দুটি চিঠির খসড়া
১
আর কোনওদিন যদি এই দ্বীপে ফিরেও এসেছ
পুলিশের হাতে তুলে দেব।
আমাদের বন্দিদশা জানি তুমি ফোটাতে জানো না
শিকল আওয়াজ করলে ভাবো রবিশঙ্করের ঝালা
আর রাতে পাহারা কুকুরদের ডাক ভেসে যায়
বেতার বারতা হয়ে যেন কিছু সুসংবাদ ফিরে আসবে তরঙ্গে এবার
কিন্তু আমরা জেনেছি যে তোমার ওই অসহায় মুখ
স্মৃতি ছাড়া আর কোনও কাজেই লাগে না।
যদি আসো
ভালবাসতে চেষ্টা করো, চুমু খেতে চেষ্টা করো
মেরে ফেলে দেব!
২
মাঝে মধ্যে স্বপ্নে তোর গলা শুনি, স্বীকার করি না।
এবারও তো জুনমাস এসেছে আগের মতো,
বৃষ্টি আর ঘুম
আড্ডা আর সিনেমায় মিশে থাকা আমাদের অস্থিরতাগুলো
আরও বেশি ধরা পড়ে…
বহুদিন তোর চিঠি নেই।
আমিও লিখি না আর
এত ঝামেলার মধ্যে চিঠি-ফিঠি অহেতুক লাগে।
বরং বারের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে
হোর্ডিং-এর নেভা-জ্বলা দেখতে-দেখতে মনে হয় আমিও সার্কিট
শহরের রক্ত চলাচলে
আমারও দায়িত্ব আছে কিছু…
এটুকুই।
শেষ দিন: ২০০১
কোনওদিন তোকে বলাও হবে না জানি
আমি কোন-কোন সুড়ঙ্গে বেঁচে থাকি
কপ্টার থেকে ত্রাণের বদলে কারা
বিষ ছুড়েছিল…কলেজে-পালানো পাখি—
কোনওদিন তোকে বোঝানো যাবে না, কেন
কবিতায় আর বিশ্বাস থাকছে না
তার চে’ আমার নতুন চেহারা ভাল,
ফুটপাত থেকে দরদাম করে কেনা—
চাপিয়ে নিয়েছি। শহরের ধোঁয়াপথে
ভাঙা ভাঁড়ে লাথি মারতে-মারতে হাঁটি
চির অদৃশ্য গোলকিপারের দিকে
থুতু ছুড়ে দিই… ফিরে আসে…থুতু চাটি…
রোজ ভোরবেলা আয়নায় ক্রীতদাস
দাঁত মেজে যায়, বলতে পারি না কিছু
আমার শরীরে বসে থাকে সারাদিন
দুটো করে স্মৃতি খুলে দেয় মাথাপিছু
বিকেল হলেই মৃদু নার্সিংহোম…
ভাই আর্মিতে। যুদ্ধ লাগতে পারে।
নিয়তির কাছে গরিবের প্রার্থনা—
সব ক্ষত যেন বোরোলীন দিয়ে সারে
কোনওদিন তোকে দেখানো যাবে না তবু
চামড়ার নীচে রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটি
অথচ মগজে অতীতের ঠোঙাওয়ালা
বিজ্ঞাপনের পাতায় খুঁজছে চিঠি
শরীরে তখন ঈশ্বর ঢুকছেন—
শীতের সন্ধে। আটটা সতেরো বাজে।
কলকাতা ছেড়ে উড়ে গেছে তোর প্লেন…
আমরা যারা
নোংরা স্মৃতি, রাস্তা ধরে চার-পাঁচজন হাঁটছি
গন্তব্যে পৌঁছতে আরেকটু সময় লাগবে
ঘিঞ্জি গলি, স্ট্রিটল্যাম্পের ঝাপসা আলোয় ডাস্টবিন…
হঠাৎ-ই কার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল— ‘যাগ্গে!’
যাচ্ছে, গিয়েও যাচ্ছে না মগজে রঙিন ধান্দা
বেলুন আঁকা জামায় বেলুন উড়িয়ে দেবার স্বপ্ন
অন্ধদের সম্বল তো শব্দ আর আন্দাজ…
বাজার পেরোই। বুকপকেটে তাপ্পিমারা সব নোট
খরচ করে তবেই স্বস্তি। মাঝেমধ্যে জল খাই
এ-ওর দিকে তাকাই, কিন্তু হাসি না। খুব সাবধান।
ঘুম-না-আসা চোখের মধ্যে নোংরা স্মৃতি চলকায়
পরিস্থিতির কাছে যেমন বেঁচে থাকার আবদার…
এবার বোধহয় পৌঁছলাম। দিগন্তে আলোর উৎসব
আকাশে টহল দিচ্ছে পাখপাখালির কঙ্কাল
মাইল-মাইল মাঠ জুড়ে রাত, মৃত ঘাসের গুচ্ছ…
হাত ঘষছি যে-যার হাতে, বুকভরা আশঙ্কা…
দরজা খুলে বেরিয়ে এল চৌকিদার সুখরাম
খুনখুনে গলায় বলল-‘অন্দর আইয়ে সাবজি!’
বাইরে তখন খুব শোরগোল। ঠান্ডাঘরে ঢুকলাম