ছোটদের চিড়িয়াখানা
দ্বিতীয় মুদ্রণ: জুলাই ২০১৩
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৯। পৃ. ৮০, মূল্য: ৮০.০০
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৫
প্রচ্ছদ: সৌরীশ মিত্র
উৎসর্গ: যারা এখনও পোষ মানেনি, তাদের জন্য
.
সূচি
সুযোগ, পাগলের গল্প, মাতাল লিখিত, গল্প, মিথ্যেকথা বলার খেলা, জেনে নেওয়া দরকার, বসন্তের কবিতা, ছেড়ে যাওয়া, খণ্ডহর, অসুখ, চন্দ্রকোষ, তিন দিয়ে গুণ, দুই দিয়ে ভাগ, ওরিজিনাল, অভাবের দিনে, কিছু প্রেম, কিছু বিচ্ছেদ, রাস্তা, বনভোজন, দ্বিতীয় আর অবাধ্য একজন, ঘা, বর্ষার কবিতা, যে, জোকা, পোর্শিয়াকে লেখা চিঠি, স্বভাব, এক বিকেলের কথা, যদি
বেড়াল, সিংহ, সাপ, মুরগি, ব্যাঙ, প্যাঁচা, বাদুড়, হায়না, বাঘ, পিরান্হা, পিঁপড়ে, কচ্ছপ, কুকুর, জেব্রা
হাওয়া, বোকার মতো, মরা মানুষ, উপায়, ধান্দা, সাধারণ লোক, যোদ্ধা, সমুদ্র স্নান, লাভামুখ, মত, পক্ষ, প্রতিহিংসা, ঠান্ডা তলোয়ার, ভিড়, বদলা, যারা আর কাঁদতে পারছে না, বন্ধুরা বিদেশে চলে গেলে, আমিও, ভিখু, আলতো পায়ে
কিছু প্রেম, কিছু বিচ্ছেদ
অনেক দেখা বাকি। তুমি আমায় সবে চিনছ
যার দিনেরবেলা ঝুট ঝামেলা, রাতেরবেলা নীলচোখ…
তবু দেড়হাজারি মাইনেয় আমি তোমার মন পাইনে
উলটে হেসে মাসের শেষে ধার নিয়েছি তিনশো
চিনবে, ধীরে সুস্থে।
তুমি চাইলে পারো পুষতে,
আমি ওপর-ওপর প্রভুভক্ত, ভেতর-ভেতর হিংস্র!
সুযোগ
যে হাঁটে ঘুমের ঘোরে
তাকে খুব আদর করে
ডেকেছ ‘সণ্টুমনা—’
আমি সেই ফেলনা গোসাপ
ইদানীং তোমার পোষা
তুলেছি ব্যর্থ ফণা
যদি প্রেম দাও এখুনি,
একা হই শক্তি-সুনীল
সারাদিন নেশার ঝোঁকে
দু’ কলম ছটফটানি…
বোকামির খেলায় জানি
হবে জিত আহাম্মকের।
সে তখন পাড়ার মোড়ে
দাঁড়াবে এককাপড়ে
তুমি তার রাতকাবারি,
বরাবর লাজুক ছেলে
তবে হ্যাঁ, সুযোগ পেলে
আমিও খেলতে পারি!
পাগলের গল্প
প্রেম নয়। মাছের কঙ্কাল।
দু’পাশের মাংস খুবলে নেওয়া
একধারে ছড়ানো আঁশ, ছাল…
পাগলের গল্প এই নিয়ে।
সবুরে ফলানো একটা মেওয়া
সে রেখেছে গলায় ঝুলিয়ে
শরীর নয়। পেপসির বোতল।
স্ট্র দেখছ যে— শিরদাঁড়া। বাঁকানো।
শুষে নিতে পারো রক্ত, ঝোল…
মাছের কঙ্কাল নয়। প্রেম।
মাথা থেকে ইট খুলে আনো,
দেখতে পাবে নীল মেমারি গেম
একের পর এক শব্দ, ছবি…
ভাসতে-ভাসতে তলাচ্ছে আবার
এক দুপুর… অন্যের বান্ধবী…
চোখ নয়। খিদের আড়ত।
কিন্তু সে খেতে পারে না আর।
অনেক বছর আগে, মাত্র একবার
চুমু খেয়ে পুড়ে গেছে ঠোঁট!
মাতাল লিখিত
বাংলা মদের গন্ধে ভরা তোমার শরীর
সন্ধেবেলা নেশার জন্যে আদর করি
নেশার জন্যে কী দুর্দান্ত নরকগামী
নরক নাকি আমার নেশার চেয়েও দামি?
হয় যদি হোক, আমার তাতে কী আসে যায়
নিজেকে লোক কতরকম গর্তে নামায়
সকাল বিকেল গর্তে ঘুমোয় আমার কেঁচো
সন্ধে হলেই ঘুরি নিজের পেছন-পেছন
কীসের জন্যে অসহ্য এই ছোঁকছোঁকানি
বাজার ঘেঁটে সস্তাদামের বোতল আনি
যাক ডুবে যাক গলা অব্দি ঘোর বিপদে
আমায় যদি ছাড়ো, আমি যে করে হোক
নিজের গায়েই গন্ধ পাব বাংলা মদের।
গল্প
শীতের সকাল, সবাই মিলে ছিটকে যাব পিকনিকে
জমাট মজা। বন্ধুরা সব কেনাকাটায় অংশ নেয়
‘মায়ের চাদর, বাবার চটি, আর ওর জন্যে টিকলি কেন—’
উপহারের সাক্ষী ছিল ডাকবাংলোর মোমবাতি
একরাত্তির নদীর ধারে, গির্জাঘড়ি ‘ঢং’ শোনায়
জ্ঞান ছিল না। মুখ ডুবিয়ে তাহার কোলের ওম… (বাতিক)
ভোরেই বিচার। শেষ ইচ্ছে কী? জল? অপূর্ণ শখ কোনও?
টিকলি কখন সাপ হয়েছে অন্য কারও দংশনে
আমরা এই গল্প থেকে কী জানলাম? কী শিখলাম?
নিজের প্রেমের গল্প কাউকে শোনাতে নেই কক্ষনও!
মিথ্যেকথা বলার খেলা
মিথ্যেকথা বলার খেলা খেলছে,
আর বলছে ‘তোমার কোনও দোষ নেই।’
তবু আমার সন্দেহের টুকরো
আটকে আছে দু’ একখানা প্রশ্নে
দু’ একখানা চিহ্ন দেখে তার চোখ
ওপর থেকে আমায় খুব চিনছে
এ জন্মের স্বপ্ন পোড়াগন্ধ…
গতজন্ম জড়িয়ে আছে জিন্সে—
অবাক। যেন নাম জানে না রাস্তার।
প্রেমিক চিরঅপেক্ষায় ধন্য
মিথ্যেকথা সহ্য করা কাজ তার
তবু সে রোজ তোমার কাছে বাধ্য
তোমারই হাতে গিলতে আসে মিথ্যে,
তাকে তো কিছু সময় দেবে নিশ্চই
মিথ্যেকথা বলার খেলা শিখতে…
জেনে নেওয়া দরকার
সমঝোতা, চাঁদের কুচি, নাকিসুরে রবীন্দ্রসংগীত
শীতে পুরী, গ্রীষ্মে দিঘা, অভিমান, পালটা অভিমান
ভিড় থাকলে প্রোটেকশন, ফাঁকায় জানলার ধারে সিট
রাতে তাড়াতাড়ি ফেরা, সকাল দশটার মধ্যে চান
ঘরে দস্যু, বাইরে গেলে একটা বেশ কবি-কবি ভাব
রাতে শ-দেড়েক চুমু, দিনে পঁচিশবার টেলিফোন
ইমেজ, উল্কার গল্প, জন্মদিনে তন্দুরি-কাবাব
ঘরদোর গুছিয়ে রাখা, রাত না জাগা, সোজাসাপটা মন
সিনেমার মতো দুঃখ, ভোরে ওঠা, মিষ্টিমিষ্টি কথা
বিয়েশ্রাদ্ধভোটপৈতেহাসিকান্নামাসতুতোমামাতো
নারীপুরুষের খেলা, টাকাপয়সা, খুচরো অমরতা…
এসব, আমার কাছে, বলো, তুমি আশা করবে না তো?
বসন্তের কবিতা
ফোটে পলাশ থোকা থোকা, সে যে কীসের বহিঃপ্রকাশ
যেন রাগ করে খামোকা তুমি মুখ ফিরিয়েছ
নাম সর্বনাশের আঁধার, জোটে বেয়াক্কেলে রাধা
আমি মধুসূদন দাদার সঙ্গে বদল করি চোখ
দেখি জীবন কত ছোট, নেশা জড়ায় ওতপ্রোত
ভাসাই রোমানভের বোতল… আগুন ঠান্ডা করুক পেট
যদি বসন্তে না বাঁচি, তবে কীসের জন্যে আছি
পেরোয় আকাশছোঁয়া পাঁচিল আমার উড়ন্ত কার্পেট
আমি রাতকলেজে পড়ি, তুমি বিলাসখানি তোড়ি
মাঝে হাজার ঘুমের বড়ি… আমার ঘুম আসে না তাও
চুমু বিষের চেয়েও তেতো… সবই সামলে নেওয়া যেত
যদি আমার মাথার ভেতর তোমার চোখদুটো নামাও।
দ্যাখো কেমন কানায়-কানায় ভাসছে নীল কচুরিপানা
শুধু তোমার হাতেই মানায় আমার নতুন লেখা বই
তুমি কাব্যে পেরোও শতক, আমি ক্লান্ত অনুঘটক
চিরজ্যামের মধ্যে অটো, তুমি দিগন্তে লাগসই
দুটো বাতিল ট্রেনের মতো, চলো, কারশেডে ঘুমোই…
ছেড়ে যাওয়া
ক।
ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কাকে বলে?
ওসব আমি বুঝি না, বুঝব না
মাটির ওপর ট্রামবাসস্কুলকলেজ
মাটির নীচে মেট্রো, শেকড়, সোনা…
এসব কিছু বাদ দিলে যা থাকে,
আজ সেটুকুই কুড়িয়ে নিচ্ছি থেমে
অভিযোগের টিপ পরাব কাকে—
সবই চলে যুদ্ধে আর প্রেমে।
আচার ভেবে চেখেছিলাম ক্ষত
তুমিও চুমু ভাতের সঙ্গে খেতে
এখন আমি কারিগরের মতো
ছাইয়ের ঘর বানাই অ্যাশট্রেতে
খ।
টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে আলো
একখানা কাচ ভেঙেছিলাম মোটে
মুকুট থেকে খসে পড়ছে পালক
বিষ মেশানো ঠান্ডা শরবতে…
শুকনো পাতা উড়ছে হাওয়ার চোটে…
আজ দেখছি, তোমার পায়ে-পায়ে
ছেড়ে যাওয়াও শিল্প হয়ে ওঠে
খণ্ডহর
তোমার হাসির গন্ধ নীলচে
আমায় আস্তেসুস্থে গিলছে
আমি রাস্তা খুঁজতে-খুঁজতে গেছি খাদের কিনারায়
দেখি ফেরার কোনও পথ নেই
কেন না অতি যত্নে
খোঁড়া জিতেন্দ্রকে আগলে আছে অন্ধ রিনা রায়।
তাতে ভোর ফুটেছে। আস্তে।
স্রেফ মুহব্বত কে ওয়াস্তে
তোমার হাসির ঝলক গায়ে মাখব? উরি ব্বাবা, না!
তুমি নামাও বরং রাত্তির
কমে কমুক প্রেমের কাটতি
তবু দূরেই থাকব আমরা, হব নাসির-শাবানা।
অসুখ
মিথ্যেকথার ভার
সন্ধেবেলা কাঁধের ওপর জাঁকিয়ে বসছে। আর
শ্বাস নেওয়া মুশকিল
উলটোপালটা চিন্তাগুলো দিগন্তে কিলবিল…
শুধু তোমার পাড়ায়
কেউ একজন থাকত, যে এসব অসুখ সারায়
চন্দ্রকোষ
তীক্ষ্ণ ফলায় গেঁথেছি চাঁদ
খেলা শুরু হলে তোমাকে বাদ
(তোমাকে বাদ! তোমাকে বাদ!)
গলিয়ে ফেলেছি পুরনো ঘুম
পথ হারানোর কী মরশুম
(কী মরশুম, কী মরশুম)
হারিয়েছি পথ তোর পাড়ায়
ইতিউতি কারা গলা বাড়ায়
(সাহস তো খুব, গলা বাড়ায়?)
গলা কেটে নাও। কাটা গলায়
ঝরে পড়ে সুর। আর ফলায়
(তোমার দোষ! তোমার দোষ!)
দোষে কেটে যায়, আহা, নিখাদ
খেলা শুরু হয়
খেলা শেষ হয়
আমি দিতে থাকি তোমাকে বাদ
তোমাকে বাদ
তোমাকে বাদ…
তিন দিয়ে গুণ, দুই দিয়ে ভাগ
হালকা তেলে ছলকা বেগুন
যন্ত্রণাকে তিন দিয়ে গুণ— ফল তো চেনা
বোকার মাথায় শুকোচ্ছে হিম
চাইছে চালাক— ‘যশোদেহি’, প্রেম দেবে না?
অষ্টমীরাত হাতের মুঠোয়
পাড়ার পথে আঁচল লুটোয়… খুব হুঁশিয়ার!
মেওয়া’র গাছে ফলছে সবুর
বাড়ছে বয়েস, ম্যায়নে তবু প্যেয়ার কিয়া
শিরায় জ্বলুক হাজার টুনি
পুজোর ভিড়ে আমার উনি খুব আলাদা
পায়ের পাতা ছোঁয় না মাটি
তাও কী রকম সঙ্গে হাঁটি— দেখুন দাদা
কেনার বেলায় পুজোসংখ্যা… এই তো জীবন
কান্না পুষি একলা ছাদে
আষ্টেপৃষ্ঠে হৃদয় বাঁধে রেশমি রিবন
সে বন্ধনের কী ঝকমকি!
এবার পুজোয় পারলে, সখি, অন্তরে আয়—
শরীর জুড়ে ফুটুক ছাতিম
আমরা দু’জন হাট্টিমাটিম ঝড়ের খেয়ায়
পারবি না এই রঙিন ধুলোয়
গোমড়ামুখো কষ্টগুলো উড়িয়ে দিতে?
খুশির দলেই থাকছি এবার
যন্ত্রণাকে দুই দিয়ে ভাগ, অষ্টমীতে!
ওরিজিনাল
আমাকে জেরক্স করে নিয়ে গেছে ফুটফুটে মেয়েরা।
গরমে, বর্ষায় আর দুধরং শীতের সকালে
জেরক্স দোকানের সামনে যুগে-যুগে ভিড় করে তারা
সায়েন্স, কমার্স, আর্টস— একইরকমের কলকলানি
প্রথমে ফিসফাস… পরমুহূর্তে হাসিতে ফেটে পড়া
সলওয়ার, সোয়েটার, টপ-স্কার্ট পরা সেই সমস্ত মেয়ে
যত ইচ্ছে ততগুলো ফোটোকপি করেছে আমার।
তারপর যার যার স্যার, ম্যামের হাতে ফেরত দিয়ে
বাড়ি চলে গেছে।
আমার কপির সঙ্গে সারারাত শুয়ে থেকে
হাজার-হাজার মেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে।
আর আমি হলুদ হতে-হতে
স্যারদের, ম্যামদের অন্ধকার ফাইলে পড়ে আছি
আবার জেরক্স হব বলে…
অভাবের দিনে
‘When we’re hungry, love will keep us alive’—Eagles.
তারই কাঁধে আজ মাথা
শান্ত একটা মেয়ের
যে-ছেলে উঠেছে পাহাড়চুড়োয় আগুনের দড়ি বেয়ে
তার কাছে জলভাত
সমস্ত পিছুটান
সে জানে সবাই এই দুনিয়ায় দু’দিনের মেহমান
তবু তার রোগা হাত
আঁখিপল্লবগ্রাহী
ভিকিরির মতো চালচুলো যার, হাবভাব বাদশাহি
শহরের পথেঘাটে
বন্ধু জোটে না আর
সে জানে সবারই একটা বন্ধু দরকার। দরকার।
তাই তারই কাঁধে মাথা
অভাবের দিনে দেখো ওরা যেন বেঁচে থাকে চুমু খেয়ে…
কিছু প্রেম, কিছু বিচ্ছেদ
ভেঙেছি কঠিন কাব্য
কেটেছে দু’এক ইঞ্চি
ঝলমলাচ্ছে কাপবোর্ড
সস্তায় হলে কিনছি
অথচ এখনও ঘর নেই
বয়েস মাত্র ঊনত্রিশ
জুটেছে বধির কর্ণে
হেডফোন আর কুন্তী
মাঝামাঝি কোনও সিন নেই।
জিন্দা অথবা মুর্দা
দুপুরেও দেখে চিনলে,
সন্ধে হলেই সুরদাস।
চুমু এঁটো। তবু খুব খায়
ওর স্বামী আর এর স্ত্রী
মাঝে মাঝে দোসা, থুকপা
অথবা নরম পেস্ট্রি
পচা সুখ, মরা হিংসে
বয়ে নিয়ে চলে গঙ্গা
লোকাল বলতে বনগাঁ
তারও পরে আছে কাব্য
সেখানে খাটে না টেকনিক
ভাবি তার পিঠে চাপব,
কোত্থেকে এসে পেত্নি
কে জানে কীসের ধান্দায়
আমাকে গিলিয়ে দিচ্ছে
ঝিনুকে, গরম-ঠান্ডা,
কিছু প্রেম, কিছু বিচ্ছেদ!
রাস্তা
ওদিকে খোঁড়া আছে। জলের কাজ।
এদিকে কালো ধোঁয়া। পিচের টিন।
চকিতে দেখেশুনে রাস্তাপার…
মুখ না। ম্যানহোল। ঢাকনাহীন।
হাত না। সরু ব্রিজ। চোখ না। ভ্যাট।
পাঁজর নয়। সব স্পিডব্রেকার।
নাভি না। হাইড্রেন। তার নীচে
পুরনো ভাঙা ক্রেন, অন্ধকার…
প্রেমের নিয়তিই অ্যাক্সিডেন্ট।
বাঁচার ঝুঁকি আর কে নিতে চায়…
যেভাবে অটো চলে কলকাতায়।
বনভোজন
কাবাবের গন্ধ আসুক
খোলো চুল পশ্চিমে
দু’চোখে চশমা কালো
দু’হাতে ঘষছি মেঘ
এসো আজ বদল করি
নিজেদের মন, দেহ
অকেজো বিকেল কেটে
স্বাভাবিক সন্ধে হোক।
এতদিন কী যাচ্ছেতাই
এতদিন তেলকালি…
তুমি সেই অন্ধকারে
জ্বেলেছ নেলপালিশ
আমিও সাধ্যমতো
এনেছি খড়কুটো
যদিও মেঝেয় ফাটল,
যদিও ঘর ফুটো,
তবু আজ চশমা ফেলে
তাকাবে অন্ধজন
গরিবের বনভোজন
কী থাকে, খাবার পরেও?
চোখ? নাক? হাত? না মুখ?
আদরের সন্ধে শেষে
স্বাভাবিক রাত নামুক।
দ্বিতীয় আর অবাধ্য একজন
সবসময় কথা শুনতে বোলো না।
মানছি আমি অলস, অপদার্থ
সে জন্যেই জীবনে কিছু হল না
হল বলতে আটানা আর চারানা
সকালে শুধু ঘুম ভাঙাই সার্থক
সারাদুপুর ভাঙা রেডিও সারালাম…
তাতে ফুটল হিন্দিগান, পপ, রক
জানি পারুল, সে হলে দিত চম্পা
সে হলে দিত বালির গায়ে অভ্র
আমার খোঁজ— মুড়ির নীচে চানাচুর
আমার ঘর— যেখানে লোক কম পায়
আমার ঘুম— চোখের কোণে ভাঙাচুল
কপালে, দ্যাখো, আটকে আছে তারারা
তাদের তুমি ঠোঁটের কাছে নামিও
তোমাকে খুঁড়ে নীচে নামব সারারাত…
তখনও তুমি মুখে আনবে তারই নাম?
তাকে ডাকবে? যা খুশি কোরো। আমিও
সবসময় কথা শুনতে পারি না।
ঘা
তোমার ঠোঁটে ক্রিমের গন্ধ
ভাতের কাঙাল আমার জিভ
না দিতে চাও না দাও পাত্তা—
মিথ্যে তোমায় ঘা মারছি।
বসলে বলছ শান্তশিষ্ট
খেললে বলছ অবাধ্য
ধুলোকাদায় অ্যাত্তো ঘেন্না,
রক্ত লাগলে ক’বার ধোও?
রক্ত কোথায়? কোথায় রক্ত?
ওই তো, ঘরে, বারান্দায়…
টাটকা লালের দারুণ জেল্লা
হয়তো তোমায় আরাম দেয়
বালিশচাদর জাপটাজাপটি
বিছানাময় রজঃস্রোত
‘মৃতের সংখ্যা অজস্র’
তোমার চুলে রঙিন যুদ্ধ
ঘুমের কাঙাল আমার চোখ
যাও খুঁজে নাও নিজের রাস্তা—
মিথ্যে আমায় ঘা মারছ।
বর্ষার কবিতা
এল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি
তোর বাদামরঙা লিপস্টিক
গলে তৈরি হল বর্ষা
যেন অসময়ের খরচা
জলে সারা শহর ছমছম
আজ আমারও দর কমসম
তুই চোখের পাতা তুললে
আমি ভিজব বিনামূল্যে
আর ভিজেই এল তৃষ্ণা
পেল জলের মতো তৃষ্ণা…
তুই বুঝতে পারছিস না?
যে
যে ভীষণ কান্না চাপে, বাঁধ মানে না হাসির সময়
যে ভীষণ স্পর্শকাতর, অস্ফুটে গান গাইছিল তাই
যে ভীষণ বদমেজাজি, কথায়-কথায় বিরক্ত হয়
যে ভীষণ শান্ত, কিন্তু সুযোগ পেলেই খরস্রোতা
যে জানে ঝগড়া হলে ছেড়ে যাওয়ার বিকল্প নেই
যেন এই রংমশালের দুনিয়া তার পছন্দসই
দুপুরে বুনুয়েলের রক্ত শোঁকে, সুমন শোনে
বিকেলে ফিরতে গেলেই— ‘এখন না, আরেকটু বোসো—’
যে অনেক বড় হবার পরেও কেমন ছোট্ট আছে
যার খুব গিটার শেখার শখ, কিন্তু আঙুল নরম
যে অনেক কষ্টে নিজের মুখ সেঁকেছে অল্প আঁচে
ফুটেছে কী ফুল… এখন বলছে ‘আমায় যত্ন করো—’
তাকে বেশ দেখাচ্ছে। আর দেখতে গিয়ে আমার চোখে
উঁহু, না, দূরবিন নয়। জাদুকরের রুমাল আঁটা
যা থেকে খরগোশ আর চাকরি বেরয়, স্বপ্ন ঢোকে
তাকে নিয়ে একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছি এ কলকাতা…
সে কলকাতা…
শেকল কাটা!
জোকা
যেখানে রয়েছি, কয়েকটা ফ্ল্যাট
কিছু ধানখেত, ক’জন রিকশা,
শাঁখের আওয়াজে সন্ধে…
অনেক দূরের কোনও এক ল্যাবে
তোমার হাতের ছোঁয়ায় পাতারা
কেঁপে-কেঁপে ওঠে, বন্ধু
মাঝে কলকাতা রাক্ষসী হয়ে
শুয়ে পড়ে আছে। হার মেনে আমি
কবিতা লেখায় মন দিই
পোর্শিয়াকে লেখা চিঠি
দক্ষিণাপণ, সন্ধে সাতটা, শুক্রবার।
কালো শাড়ি প’রে ফুচকা খাচ্ছ। সঙ্গে কে?
পেছনে তাকাও— এতদিনকার বন্ধুরা
পালিয়ে বেঁচেছে ছুরির মাথায় জং দেখে
আমাকে আস্তে হালাল করছে সেই ছুরি
তোমারও ইচ্ছে খুবলে নিচ্ছে, পোর্শিয়া,
সেবারের মতো বাধা দিতে যাও, হাসবে লোক।
হত্যা এখানে প্রেমের চেয়েও বর্ষীয়ান
দক্ষিণাপণ, সন্ধে সাতটা, শুক্রবার।
শর্ত রাখছে, যারা ঠিকঠাক দেখতে পায়
অন্ধের কথা বরাবরই খুব কম চলে।
অন্ধ বলেই ধরতে পারোনি ছদ্মবেশ
(তেঁতুলজল না, রক্ত আসলে।
লেবু চা কোথায়? আসলে রক্ত!)
পড়তে দাওনি, সামলে নিয়েছ তাই নখে
লাল ছিটে লেগে। খুঁজো না তোমার বন্ধুদের
তারাও এখন বন্ধু হয়েছে শাইলকের
আমিই নেহাত ভিকিরির মতো কলকাতায়
খাবারের পাশে তোমাকে পেয়েছি। তারপরও
নিজেই নিজের মাংস কাটছি। বিক্রি হোক—
হ্যাঁ, এসো, আমার শিরা তুলে নিয়ে হার পরো
কিন্তু আমিও এমন খেলায় হারছি না।
এতদিন পর তোমাকে আবার পড়ছি, আর
তোমারই রক্ত চুষছি নিজের বুক থেকে…
বুঝতে পারছ, পোর্শিয়া?
স্বভাব
গাফিলতির গন্ধে ভরা ঘর
মরা ইঁদুর, বাতিল ঈশ্বর
ভাঙা ধনুক, ফসকে যাওয়া তির
মেঝেয় রোদ, রোদে কপালফের
ঢের হয়েছে। ঢের হয়েছে। ঢের।
তোমার কোলে মুখ রেখেছে আজ
সবহারানো ক্লান্ত রংবাজ…
কোথাও কিছু পালটায় না। তাও
ঘুরতে থাকে পৃথিবী… তুমি যাও
পারলে তার স্বভাব পালটাও।
এক বিকেলের কথা
আজ অন্তত ঘড়ির দিকে তাকাস না,
টুকরো করে উড়িয়ে দে সব সমস্যা—
চিন্তা তোকে মানায় না। দ্যাখ, আকাশ লাল
আজ অন্তত ফিরিস না ভিড় মেট্রোতে
ট্রাম চড়ব, ঘুরবে চাকা ঝমরঝম…
দু’জনে খুব গন্ধ নেব রেড রোডের
আজ অন্তত চুল খুলে দে দিগ্বিদিক
ডাইনে-বাঁয়ে লোকগুলো সব মূর্ছা যাক
ইচ্ছে ক’রে মিথ্যে কথার দিব্যি দিই
আজ অন্তত রাস্তা পেরোই হাত ধ’রে
তুই একবার সাধলেই জোর ফুচকা খাই,
কান টেনে বল— ‘ইস, কী আমার বাধ্য রে—’
আজ অন্তত বলিস না সব গল্প শেষ
হয়তো শুরুই হয়নি কোনও রূপকথা…
ওই তো, একটা একলা চেয়ার। চল, ব’সে
আমার নতুন লেখা শোনাই খানতিনেক
বাকিজীবন অশান্তিতে ভুগব, তাও
আজ অন্তত,
আজ অন্তত,
আজ অন্তত আমার কাছে শান্তি নে—!
যদি
যদি শব্দ দিয়ে মারো
জেনো জন্মাব আবার
যদি দুঃখ দাও আরও
হব কপালে ছারখার
যদি সঙ্গে নিতে পারো
আমি সমগ্র তোমার
সারাদিন দু’পায়ে হেঁটেছি
সূর্য নিভে গেলে চারপেয়ে
চোয়ালে ঠোক্কর মারছে রাত
ঘুমোব তোমার মাংস খেয়ে
খিদে পেটে, দ্যাখো, জেগে আছি
তোমারই জান্তব ছেলেমেয়ে…!
বেড়াল
কার্নিশের কোনায় ব’সে গা চুলকোয় বেড়াল
অন্ধকারে গেরস্থালি জমে
স্বামী-স্ত্রী’র বাড়ি ফেরার সময় অনুযায়ী
সন্দেহের মাত্রা বাড়ে কমে।
সন্দেহের নৌকো দোলে সন্দেহের জলে
সন্দেহের তুফান লাগে তাতে
কার্নিশের কোনায় ব’সে গা চুলকোয় বেড়াল
মরা মাছের টুকরো পড়ে পাতে
মাছের নাম হাঙর। তার দাঁতের কিবা শোভা—
বালিশ ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয় তুলো
শরীর থেকে শরীর খুলে কী বিচ্ছিরি দু’জন
উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুল।
শুয়ে থাকল সারাটা রাত, সারা বছর, সারাজীবন
ধারণা দিয়ে দু’ভাগ করা খাটে,
কার্নিশের কোনায় ব’সে গা চুলকোয় বেড়াল
আপনমনে নিজের থাবা চাটে…
সিংহ
সারাদিন কোনও কাজ নেই
লোককে দেখাই ব্যস্ত
দুপুরেও কোনও কাজ নেই
বিকেলেও কোনও কাজ নেই
বেরোচ্ছি আর হাঁটছি
সন্ধেবেলাও ফালতু
এর তার বাড়ি আড্ডা
সারারাত কোনও কাজ নেই
ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে দেখছি
চাকরি পাবার স্বপ্ন
ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে দেখছি
যারা-যারা খুব বন্ধু
দূরে-দূরে আজ টিমটিম
সবচে’ কাছের তারাটাও
দু’কোটি আলোকবর্ষ
সৌরজগৎ বলে আর
গর্ব করার কিছু নেই
ন’খানা গ্রহের ব্যয়ভার
সূর্য একাই টানছে
আমারও মাথার মধ্যে
ঠান্ডা আগুন সংসার
হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে
ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কিন্তু
চাকরি পাবার সিন নেই
আমার ক্যালানে হাঁ মুখে
হরিণ ঢোকার সিন নেই
সবই ঠিক। সবই সত্যি।
কিন্তু এটাও মানবে
ঘুমন্ত, আমি ঘুমন্ত,
আমি ঘুমন্ত
তবু সিংহ!
সাপ
বছরের শেষ। ঘুমোও।
দারুণ ঠান্ডা। ঘুমোও।
তোমার পুরনো খোলস মাড়িয়ে ছুটে যাক টাটা সুমো
চড়ুইভাতির দল
ছেলেমেয়েদের দল
হাসি-হাততালি-আগুনের গানে ছটফটে, ঝলমল
এই পথ দিয়ে গেছে—
হই হুল্লোড় গেছে
কালো আওয়াজের ছোপ লেগে আছে তোমার ঘুমনো প্যাঁচে
শীত পালাচ্ছে সবে।
ওরা ফিরে গেছে কবে
কিছুদিন পর তুমিও ওদের পুরনো খোলস মাড়াতে-মাড়াতে
এঁকেবেঁকে এই হাইওয়ে পার হবে…
মুরগি
চলো এবার ঘুরতে বেরোই
ডিসেম্বরের একতিরিশে
দেখতে বেরোই সবাই কেমন
বিরাট কালো তাওয়ার ওপর
কলকাতাকে চাপিয়ে দিয়ে
ফুর্তি করছে (একটা তো রাত।)
ফ্লাইওভাররা আকাশগঙ্গা…
তারার মতো জ্বলছে নিভছে
সাবির, জিশান, রহমানিয়া
লোহার শিকে মাংস গাঁথা—
গরম, নরম, পরম মাংস
জিভ আর চোয়াল গল্প করছে
বন্ধুরা সব মস্তিতে চুর…
লোহার শিকে গাঁথা মাংস
গলে যাচ্ছে মুখের ভেতর
গলছি আমি, গলছ তুমি…
সে যাই হোক গে, আসল কথা
আমরা কিন্তু এই বাজারেও
সস্তা এবং দারুণ খেতে!
ব্যাঙ
দুটো বন্ধু
ছোট আড্ডা
নিচু লন্ঠন
(আলো বাদ দাও)
মুখে শ্রাদ্ধ
গোটা বিশ্বের
কথা ভিজছে
ভেজা আড্ডা
দুটো বন্ধু
লোকে বলছে
‘কূপমণ্ডুক’
প্যাঁচা
তুমি কোকের বোতল বাজাও
আমি চুপচাপ বসে দেখছি।
যদি রান্না করতে না যাও
খুব অভিমান হবে ডেকচির?
রোগা বডি ফেলে দিই সোফায়
যেন কোথাকার কোন বাদশা
জানো, আড়ালে-আড়ালে ফোঁপায়
খাঁ-খাঁ পেটের ভেতরে ভাতশাক
তবু টিভি-তে খবর শুনি:
রোজ সন্ধের মুখে ভিড় চায়
কিছু অফবিট খুনোখুনি,
একা প্রজাপতি ওড়ে গির্জায়
আর ওড়া জুড়ে-জুড়ে ঝঞ্ঝা
কাটা গলা ডুবে আছে তৃষায়
মাথা জমিয়ে রেখেছে জঞ্জাল
প্রেম ফুটে গেছে নীল টবে
বাঘ চিনেছে নতুন বাবলা
এই ঝকঝকে উৎসবে
কেন তোমাকে ক্লান্ত ভাবলাম
তুমি গান গাও, মারো, চ্যাঁচাও—
আমি চুপচাপ বসে ভাবব
কেন লক্ষ্মীর পাশে প্যাঁচা
আজও গিলতে পারেনি,
ফেলতে পারেনি পাপবোধ…
বাদুড়
বাদুড় কখনও ব্যাটম্যান হতে পারে না।
তার সঙ্গে তো শত্রুতা নেই জোকারের,
সার্কাস আসে ভিনদেশ থেকে, ফিরে যায়,
অনেক দূরের কোনও গাছে ঝুলে, রাতভর
সে শুনতে পায় জোকারের হাসি। বোঝে না।
তার গাড়ি নেই, নেই নীল মারণাস্ত্র
অথবা বিপদে রবিনের মতো বন্ধু
সে শুধু শব্দ ছুড়ে দেয় আর লুফে নেয়,
চুপচাপ থাকে। সে শুধু দোষের মধ্যে
জন্ম থেকেই উলটো দেখছে দুনিয়া
হায়না
ঘড়ির কাঁটা বাছতে গিয়ে হাতে সময় বিঁধছে
আঙুলে কেটে, না, রক্ত না, গরম-গরম ইচ্ছে
গড়িয়ে পড়ছে মেঝের ওপর। চাটতে এসে হায়না
আমার কাছে থাকতে চাইছে (ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না)
এখন আমার সঙ্গে ঘুমোয়, গল্প করে, খায়-দায়
আমরা আদান প্রদান করি বেঁচে থাকার কায়দা
যেমন আমি রক্ত চাটা শিখছি, তবে আস্তে
ওরও একটু সময় লাগবে ঘড়ির কাঁটা বাছতে…
বাঘ
একসময় এই গোটা অঞ্চল, আমি শুনেছি, ভরে থাকত
বাঘের গন্ধে। বাঘের গায়ের গন্ধ, মুখের গন্ধ, চালচলনের
গন্ধ, এইসব। তারপর একে-একে বসতি গড়ে উঠল, জঙ্গল
সাফ ক’রে বাড়িঘর তৈরি হল, আমরাও থাকতে এলাম।
আস্তে আস্তে বাঘের গন্ধের বদলে অন্যান্য গন্ধ জায়গা নিতে
শুরু করল। মুখে টুথপেস্টের গন্ধ, গায়ে সাবানের গন্ধ,
জামাকাপড়ে পারফিউমের গন্ধ, বগলে ডিওডোর্যান্টের গন্ধ,
আরও নানাবিধ গন্ধে ভ’রে উঠল আমাদের জীবন।
আর এইসব গন্ধ ব্যবহার করতে-করতে-করতে-করতে
একসময় খুব বিরক্ত হয়ে উঠলাম আমি। টুথপেস্ট, সাবান,
পারফিউম, ডিওডোর্যান্ট সব ছেড়ে দিলাম। এমনকী আস্তে-আস্তে
দাঁত মাজা, চান করা, শেষমেশ জামাকাপড় পরাও বন্ধ
করলাম। এখন, কী আশ্চর্য, আমার গায়ে, আমার মুখে,
আমার চলাফেরায়, অবিকল বাঘের গন্ধ।
পিরান্হা
ফেরার পথে ইচ্ছে ত্রুটি
বন্ধু তোমার বাসায় উঠি
কষা মাংস— গরম রুটি
জিভ বলছে— ‘কী রান্না! কী রান্না!’
আর সারারাত হাসির তোড়ে
আমায় ছিঁড়ে টুকরো ক’রে
হজম করছ পরের ভোরে
খেলা চলছে পিরান্হা-পিরান্হা…
পিঁপড়ে
অনেক পিঁপড়ে এপাশ থেকে খাবার নিয়ে যায়
একটা পিঁপড়ে ওপাশ থেকে খবর নিয়ে আসে
খাবার আর খবর তা হলে উলটোপথে চলে?
মাঝখানে পা ফাঁসে
নানারকম লতাপাতায় জড়িয়ে যায় পা
হাত-পা-মাথা ভাগ হয়ে যায় এক-দুই-তিন দলে
মগজ পচে থকথকে পাঁক। দাঁড়িয়ে থাকে ক্লীব
দুপাশ দিয়ে ভাবলেশহীন পিঁপড়ে শুধু
খাবার আর খবর আর খাবার বয়ে চলে…
কচ্ছপ
চামড়ায় ভাঁজ। বয়েস… হবে তিন-চারশো
চোখের নীচে কালির মতো পশ্চিম দিক
পিঠের ওপর খোদাই করা আশ্চর্য
অনেক যুদ্ধ পেরিয়ে এসে একদম চুপ।
শুনছি না আর বলছি না আর দেখছিও না।
আমরা শুধু জটলা ক’রে রোজ সন্ধেয়
অল্প-অল্প ভাগ ক’রে খাই সেই গল্প
বাক্য হাপিস, শব্দ ভাঙা, অক্ষর নেই
আমরা তবু ভাগ ক’রে খাই সেই গল্প—
হাজার-হাজার বছর আগে কোন দৌড়ে
একবার, হ্যাঁ, হারিয়েছিলাম খরগোশকে।
কুকুর
তর্জনীটি সমস্ত কাজ সারে
আংটি এসে বসেছে মধ্যমায়
ভুল পাবে না ঝকঝকে তর্জমায়।
যখন-তখন সব ফাটিয়ে ফেলার
ইচ্ছে নিয়ে ঘুরছে মানববোমা
বেশ, ধরা যাক পুতুল-পুতুল খেলা
মুন্ডু কেটে ভাসাচ্ছে নর্দমায়—
দূরে ডুবছে সেসব চেঁচামেচি
একটা শহর ঢুকে যাচ্ছে কোমায়…
আমিও কেমন কুকুর হয়ে গেছি
চাটার আগে শুঁকে দেখছি তোমায়
জেব্রা
সাদা-কালোয় কীভাবে ভাগ করেছে কে জানে
মুখ নামিয়ে যে যার রাস্তা পেরোচ্ছি সাবধানে
আজ ভেবে হাসি পায়, একদিন ছিল আস্থা
ছোট আগুন জ্বালাব ঠান্ডা দু’হাত কচলে
পরে হেঁটেও দেখেছি অনেকরকম রাস্তায়
কিছু হয় না তেমন, পান থেকে চুন খসলে
শুধু পালটাতে থাকে, যেসব কারণে হাসতাম,
চেনা বিরহের গানে যেরকম আশা ভোঁসলে…
হাওয়া
সামনে তখন ঘুরঘুট্টি টানেল
আঙুল জ্বেলে বানিয়েছিলাম চিরাগ
বাইরে এসে দেখি সবাই জানে
সময় যদি না কাটে তো শিরা…
শতাব্দীও পা দিচ্ছে একুশে
দুয়ের পিঠে ভারী লাগছে এক
রিকশা-অটো-ট্যাক্সি চুষে-চুষে
রাস্তাগুলোও নিম্ফোমেনিয়্যাক
শত্রু বলতে দম ফুরনো পুতুল,
তাদেরই হাত ভাঙছি আড়াই প্যাঁচে
ফেলতে গিয়েও গিলে নিচ্ছি থুতু
হাওয়া অনেক ঠান্ডা হয়ে গেছে।
বোকার মতো
হতেও পারে, অনেক আগেই নস্ত্রাদামু জানতেন
হাতের মুঠোয় ভেসে উঠবে প্রিয়জনের বার্তা—
দেখলে ভীষণ হিংসে হয়। দূর থেকে দূর প্রান্তে
আমিও যদি আমার কথা পৌঁছে দিতে পারতাম…
বলার মতো নেই কিছুই। সবাই এখন খদ্দের
সবার ভেতরেই ছুটছে পোষ না মানা জন্তু
সেসব বিকেল কোথায় গেল, যখন বুকের মধ্যে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ত শিবকুমারের সন্তুর
বৃষ্টিশেষে হঠাৎ কোন ঠান্ডা হাওয়ার দমকা
উড়িয়ে নিয়ে চলল তাদের, যারা আমায় চিনত—
আমিই একা বোকার মতো দুর্ঘটনায় চমকাই
ডলফিনের কান্না এখন তাদের কাছে রিংটোন…!
মরা মানুষ
ভাঙাবাড়ির রাঙাদেয়াল শুঁকে বেড়ায় ভেজা বাতাস
ভেতরে যায় ভেতরে সব পুরনো শোক ছোট আলো
ভেতরে সব মরা মানুষ হেঁটে বেড়ায় সারাটা দিন
সারাটা দিন মশারি আর চাদরে খায় পুরনো শোক
মেঝে পাগল বোবা সিলিং তবু কোথাও বেরনো নেই
ভাঙাবাড়ির ভেতরে সব মরা মানুষ বেঁচে আছে
আছে চায়ের পাতা পায়ের পাতা ফাটল ভেজা বাতাস
বড় শহর পাড়া প্রাচীন সারাটা রাত সারাটা দিন
পুরনো শোক মশারি আর ছোট আলোর মায়া ছেড়ে
যাবে কোথায় মরা মানুষ…
উপায়
চলতে-চলতে মেট্রো বন্ধ।
কমবয়েসি একটা মেয়ে
রেললাইনে ঝাঁপ দিয়েছে খাদের টানে
প্ল্যাটফর্মে সাজিয়ে রেখে…
(অভিমানে?)
ভিড় ঠেলে ওপরে উঠি
ফ্লাইওভারের ছায়ায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে
সব কিছু অসহ্য লাগে
সব কিছু জঘন্য লাগে
মাটির থেকে ঘেন্না ওঠে আকাশপানে
অন্ধ সেজে বন্ধু খুঁজি
বন্ধুরা সব সমাধানের সূত্র জানে
সাপের মতো ফিসফিসিয়ে
তারাই সবাই উপায় ঢোকায় আমার কানে
উপায়। উপায়।
উপায় মানে?
‘বাইরে কোথাও কাটিয়ে এসো হপ্তাখানেক।’
ধান্দা
প্রথমে ভাবতাম ভালই হয়।
বুঝেছি পরে, কত ভাল।
দেখেছি স্বপ্নের বাজারময়
ছড়ানো মুরগির পালক
আমারও ঝলমলে পোশাক তাই
আমারও রংচঙে টুপি
পেটের ধান্দায় পেট বাজাই—
নিজেকে ছুড়ি আর লুফি
তুমিও চলে এসো। না ভেবে আজ
দু’হাতে খুলে দাও খোঁপা
স্বীকার করে নাও, তোমারও কাজ
নিজেকে ছোড়া আর লোফা
বরফ জলই হয়। আগুন ছাই।
কী হবে খানাতল্লাশে?
নিজেকে এত বড় ভাবে সবাই—
পৃথিবী ছোট হয়ে আসে
সাধারণ লোক
সাধারণ লোক খবর পড়ে না কেউ।
তাই বোঝেও না বোনচারা-ভাইচারা
গাছে আসে ফুল। দুনিয়া দেখার খেল।
প্রথম প্রশ্ন: সাধারণ লোক কারা?
উত্তরে হাওয়া জানলা বন্ধ করে
দক্ষিণে মেঘ ঢেকে দেয় প্রিয় তারা
মধ্যে অসাড় বুক-পিঠ-চোখ-মুখ…
সাধারণ লোক। কুপিয়ে-কুপিয়ে মারা।
অসাধারণের আড্ডায় সব মুখ
জিভ দিয়ে চাটে খবরের আশকারা…
কাদের খবর, জিভ?
—সাধারণ লোক যারা।
যোদ্ধা
মরেছ যুদ্ধ করে, সঙ্গী তোমার মুখ ঢেকে দিক
বরফের পাহাড় কেটে বানাক সাদা শহিদবেদি—
আমি তার তলায় এসে দাঁড়াই, যেন ক্লান্ত ছেলে
এসেছে পেছনে সব বাজার-শহর-বাজার ফেলে
দেখা যাক, কোথায় ভাঙে এই কাহিনির ঠুনকো কলস
তুমি তার পরের কথা শোনাও। নতুন গল্প বলো—
কেন না ক্লান্ত আমি কয়েক কোটি যুদ্ধ জিতে,
এসেছি জ্যান্ত মানুষ, ভূতের ঘরে জন্ম নিতে!
সমুদ্র স্নান
সমুদ্রে নেমে, আজকাল কেউ আর
নতুন দ্বীপ, তলিয়ে যাওয়া জাহাজ
বা চিকচিকে রোদ্দুরের খোঁজ করে না।
এমনকী মৎস্যকন্যাদেরও খোঁজে না কেউ।
সকলেই ভাবে, কতক্ষণে হোটেলে ফিরবে।
তারপর… কতক্ষণে ঘরের চাবি ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে
উঠে পড়বে ট্রেন, বাস, গাড়িতে…
কিন্তু এইসমস্ত করার আগে, প্রত্যেকেই,
অন্তত একবার ভাল করে চান করার জন্যে সমুদ্রে নামে।
শুধু সমুদ্রই বোঝে, চান আসলে একটা অজুহাত।
চান করার নামে কেউ সমুদ্রের জলে নাক ঝাড়ে,
কেউ সবার অলক্ষ্যে থুতু ফ্যালে,
আবার কেউ গোপন আনন্দে পেচ্ছাপ করে দেয়।
সারা জীবনে যত অপমান তারা হজম করেছে,
কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেনি,
এক ঘণ্টার চানে সেই সমস্ত সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয় সমুদ্রকে
তারপর শহরে ফিরে আসে।
সমুদ্রও কোটি কোটি মানুষের ব্যর্থ প্রতিশোধের ভাষা নিয়ে
পড়ে থাকে বোবার মতো…
আর উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে আমরা দেখি
পৃথিবী আসলে বিষণ্ণ একটা গ্রহ
যার একভাগ স্থল,
বাকি তিন ভাগ নীলচে, তরল অপমান।
লাভামুখ
মানুষ কত নীচে নেমে যায়
পুরনো কাঠখড় পোড়াতে
সামনে সরুপথ, লন্ঠন…
পেছনে বালিয়াড়ি, ভাঙাচাঁদ…
মানুষ কত কিছু না পেরে
ঘরেই বসে থাকে চুপচাপ।
বাইরে দরদাম। বিক্রি।
দেবতা কিনে ফেরে শয়তান
মানুষ কত কিছু জানে না
রেডিয়ো শোনে আর ব্যথা পায়
চাউনি ঘোলাজল, বেরঙিন
মুঠোয় পাখিদের বচসা
তবু সে কোনওদিন ভোলে না
শহরে গুহা থেকে এসেছে
হয়তো গুহাতেই যেতে চায়
পুরনো কাঠখড় পোড়াতে
আমিও খুঁজে পেয়ে লাভামুখ
আকাশে হই হই উঠেছি
উঠেছি শুধু আজ মানুষের
খারাপলাগাগুলো ওড়াতে…!
মত
ম-য় মুন্ডু
ত-য় তলোয়ার
খেলা চলছে।
তুমি বলো, আর
কত হিংসে
কত যুদ্ধ
এসো চুমু খাই।
আগে মুখ ধোও—
মুখে গন্ধ
কাঁচা মাংসের
দাঁতে হাড়গোড়
জিভ পানসে…
লাল সংসার
নীল আর্মস্ট্রং
কেন বারবার
টেনে আনছ
জানা ইতিহাস
পড়া গল্প
যারা চাবকায়,
তারা ডরপোক।
তুমি আলাদা।
আমি কাল তাই
ফিরে এসেছি।
চলো পালটাই—
ম-য় মোৎসার্ট
ত-য় তানসেন
দ্যাখো ইতিহাস থেকে ইতিহাসে সুর টানছেন,
আজও টানছেন…
পক্ষ
এবার থেকে মনখারাপ করব না।
চুলোয় যাক অতীত আর বর্তমান।
খাঁড়ার কোপে ভবিষ্যৎ মুন্ডুহীন
মহাকাশের ঝিমরঙিন মার্কেটে
যেন আমার না থাকাটাই বিক্রি হয়।
শহরময় যেন আমার ফালতু মিথ
ভয়ের লেপ বিছিয়ে দেয় নিঃসাড়ে
যেন কোথাও আছি, এমন সন্দেহ
কাঁচি চালায় মানুষদের মিলমিশে…
আর আমি খুব সূক্ষ্মদেহ, প্রায় হাওয়া
কিন্তু ওই হাওয়া সেজেই রাত্তিরে
পিঁপড়েদের পাশ করাব মাধ্যমিক
শয়তানের পক্ষ নেব। ভোরবেলা
বিষ মাখাব দেবতাদের টুথব্রাশে…!
প্রতিহিংসা
প্রতিহিংসা শেষ চুড়োয় উঠেছে।
নীচে মানুষ, ঝগড়ামাখা পৃথিবী
খবর থেকে খবরে ছোটে সন্ধে—
তারা বাংলা, স্কাই-বি আর ই-টিভি
বস্তা থেকে বেরয় কাটামুন্ডু।
বডি কোথায়? মাঝেমধ্যে হদিশও
পালক দিয়ে ঢেকে রাখছে প্রতিশোধ
আমিও তোর পালক থেকে বেরিয়ে
বাড়ি ফিরছি। টিউশানির টাকা শেষ
শান্তি নেই। শান্তি নেই। শান্তি
চাঁদের মতো কাটামুন্ডু উঠেছে,
উঠেছে কালো আকাশে…
ঠান্ডা তলোয়ার
রইল তোমার খেলনা তলোয়ার।
গল্প ছেড়ে মৌমাছিরা পালাচ্ছে এবার
শেষ দুপুর। জানলা কিছু খোলা—
ফাঁকা হাওয়ায় তৈরি হচ্ছে চুপ থাকার কোলাজ
নরম হাতে দম দিয়েছ, হাঁটেনি একফোঁটাও
লোহার পুতুল— চার হাতপায় জং
মীমাংসা নেই?
মীমাংসা নেই।
মীমাংসা কোন ছার!
রইল তোমার ঠান্ডা তলোয়ার।
সন্ধেবেলা ব্যর্থ এসব আলোচনার রং
ক্লান্ত মুখে আলতো লেপে পাড়ায় পাড়ায় পয়সা তুলবে সং
ভিড়
বাওয়াল করবেন না দাদা, ঝামেলা করবেন না
এতই যদি প্রেম থাকে আর এতই যদি ঘেন্না
দশ-বারো পা পিছিয়ে যান, দশ-বারো পা সামনে
আপনার নাম থাকতে পারে, ভিড়ের কিন্তু নাম নেই।
ভিড়ের আছে চিৎকার আর উলটোপালটা ধাক্কা
এক মুহূর্তে মানুষগুলো কাগজ হয়ে পাক খায়
আপনি সেসব কুড়িয়ে নিয়ে চাট্টি লেখা লিখবেন,
ভাবলেও হাসি পায় মশাই, ওসব ক’দিন টিকবে?
টিকবে শুধু গিজগিজে ভিড়। নাকচোখমুখহাতপা
সামনে যাকে পাবে তাকেই ঘুরিয়ে দেবে সাতপাক
পাড়ায়-পাড়ায় নাগরদোলা। ডাগর আঁখিপদ্মে
অর্ধেক জল থমকায় আর ঠোঁট শুষে নেয় অর্ধেক
এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে ঠান্ডা রুটি-তড়কা
রোজই তো যাতায়াত করেন, দাঁড়ানোর কী দরকার?
অতই যদি প্রেম থাকে আর অতই যদি ঘেন্না,
দরজা দিয়ে শুয়ে থাকুন। ঝামেলা করবেন না।
বদলা
ভয়ের বদলা ভয়
যদি সেটা তোমার পছন্দ না হয়,
তা হলে এই দারুণ খেলা তোমার জন্যে নয়।
বিষের বদলা বিষ
থুতুর বদলা জঘন্য কুর্নিশ
তাড়িয়ে দেবার বদলা অন্য শিবিরে আশ্রয়
যদি সেটা তোমার পছন্দ না হয়,
তা হলে এই জটিল খেলা তোমার জন্যে নয়।
চুমুর বদলা চুমু
খিদের বদলা বয়স্ক এক উনুন
অফস্পিনের বদলা মাথার ওপর দিয়ে ছয়
যদি তোমার সেটা পছন্দ না হয়,
তা হলে এই মজার খেলা তোমার জন্যে নয়।
রঙের বদলা রং
লোহার বদলা দু’দিন পরেই জং
ঘুম না আসার বদলা ঘুমের ওষুধ, মেঝেময়…
যদি তোমার সেটা পছন্দ না হয়,
তা হলে এই জমাট খেলা তোমার জন্যে নয়।
তোমার তবে দৃশ্য দেখা
নরম আঁচে হাত-পা সেঁকা
কিন্তু এখন আঁচের বদলা আঁচ
দেখার বদলা চোখের পাতায় কাচ
আর কিছু-না-বলার বদলা ঠোঁটের কষে নোনতা অপচয়
যদি সেটাও তোমার পছন্দ না হয়,
তা হলে আর কোনও খেলাই, সত্যি বলছি,
তোমার জন্যে নয়।
যারা আর কাঁদতে পারছে না
যারা আর কাঁদতে পারছে না, তাদের নিয়ে বাকিরা হাসিঠাট্টা
শুরু করেছে। তাদের কোনও কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। বলছে—
‘সত্যিই যদি হবে, তা হলে চোখে জল নেই কেন?’ বলছে— ‘এঁকে
বুঝিয়ে দাও’, বলছে— ‘তমুকের সই নিয়ে এসো, তবে মানব।’
পৃথিবীর বিভিন্ন পাড়ায় ছোট ছোট ঘরের মধ্যে চোখের জল শুকিয়ে
যাওয়া এইসব লোকেরা বুঝতে পারছে, প্রমাণ কত জরুরি।
মনে হয় তারা বেরিয়ে পড়বে ঘর থেকে। কোথাও না কোথাও
একদিন দেখাও হবে তাদের, কোনও একটা জঙ্গলের মধ্যে এক
বিকেলে ভাঙা বোতল, পুরনো রেকর্ড আর চশমার ফ্রেমের খেলা
খেলবে তারা, যেখানে কান্নার কোনও দাম নেই।
বন্ধুরা বিদেশে চলে গেলে
বন্ধুরা বিদেশে চলে গেলে
মানুষ মাঝেমাঝে শত্রুদের খোঁজখবর নেয়।
প্রথমে ফোনে, পরে সন্ধের পার্টিগুলোয়
এক-আধবার মুখ দিয়ে বেরিয়েও যায়— ‘কী, ভাল তো?’
বন্ধুদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলে
মানুষ শত্রুদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে।
প্রথমে খালিহাতে, পরে তার ছেলেমেয়ের জন্যে চকলেট…
বাড়ি ফিরতে আগের মতোই রাত হয়।
এইরকমই এক রাতে, বিছানায় শুয়ে সে টের পায়
এটা আসলে একটা ভয়ানক খেলা।
এতদিন তুরুপের তাস করে আস্তিনে সে
লুকিয়ে রেখেছিল তার শত্রুদের
নিজেও লুকিয়ে ছিল তাদের আস্তিনে।
এখন সবাই সাজিয়ে বসেছে সেই তাস
কারণ তারই মতো, তার শত্রুদেরও
কোনও বন্ধু নেই আর।
আমিও
হেমন্ত শেষ। হাওয়ায় ভাসছে ভাঙা পুজোর গন্ধ
সামনে শীত। কবিতা, প্রেম, গানবাজনার মরশুম
বান্ধবীরা গাল টিপছে— ‘দুষ্টু!’ (অপোগণ্ড)
পেছন ফিরে ফুল লাগাচ্ছে খোঁপায়
আর যারা সব বিয়ের পরেই ছিটকে গেছে দূরদেশ
আমার যখন আজ চলছে, তখন যাদের পরশু
যাদের খোলা ব্যালকনি সব প্রশ্ন করার ঊর্ধ্বে
রেড-সি থেকেও গহন যাদের সোফা,
তারাও আমায় কুশল জানায়, বাংলা ভাষায় শান দেয়
ভালই লাগে রাতের দিকে খুটুর-খুটুর মেল-চেক
সেসব চিঠি দেখলে শরীর কুঁকড়ে আসে ঠান্ডায়—
হরফ কোথায়, বরফঢাকা ই-মেল
কিন্তু আমার মাথার ভেতর জঘন্য এক স্পিডবোট
নদী কাটছে, হ্রদ ভাঙছে, প্রপাত শুষে ফেলছে
সেই আমিও আস্তে-আস্তে ঠান্ডা হতে শিখব…
সূর্য উঠবে, ঝকঝকে, পশ্চিমে!
ভিখু
আমি দম রাখি ফুটো পাত্রে
আর পিঠে ব্যাগ নিয়ে আগুন পেরোই সাঁতরে
হাতে ব্যান্ডেজ, দু’পায়ে তরুণ চপ্পল
আহা, কী করুণ গপ্পো
আরও লেখো, আরও বলো
শুনে জনগণ শিহরি উঠুক, মিঠে আঁখি ছলোছলো
আমি বাসনা মেটাই কাব্যে
আর সারাদিন ভাবি পাঠক পড়ে কী ভাববে
দু’পায়ে তরুণ চপ্পল, হাতে ব্যান্ডেজ
ফ্যান দিন, দাদা ফ্যান দাও, দিদি ফ্যান দে
ফ্যানেরা আমায় পত্র পাঠাক যত্রতত্র আকছার—
‘গুলি মারি তোর কলম কতটা সাচ্চা!’
হাতঘড়ি থেকে সময় ঝরছে ঝনঝন
মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেছে নন্দিন আর রঞ্জন
রাজা লড়াই বাঁধায় শিক্ষকে আর ছাত্রে
আহা শালিখ চড়াই বাঁধায় লড়াই দিনরাত ফুটোপাত্রে
আমি দৌড়ই হাহা দৌড়ই আর
পিঠে গুলি খেয়ে মরবার আগে
সমস্ত লেখা মুখে ছুড়ে মারি
তোমাদের ভিখু মাত্রে!
আলতো পায়ে
সে ছিল খুব আন্তরিক
আমি একটু উদাসীনতাপ্রিয়
যাবার দিন বলেও ছিল
‘কাউকে তুমি পাবে না, দেখে নিও—’
পাইনি। তবে দেখেছি রোজ
ফুটপাতের সস্তা গ্যালিলিও
প্রত্যেকেই একরকম
প্রত্যেকেই অভ্যেসে স্বকীয়।
শত্রু শুধু অবিশ্বাস
বন্ধু শুধু বিকেলে ডাকপিয়ন
ভালমানুষ রক্তবমি
শয়তানের চেহারা স্বর্গীয়
পিঠ চাপড়ে বলছে কেউ ‘জিওঃ!’
আমি এসব থোড়াই মানি
আলতো পায়ে সমস্তটা মাড়িয়ে যেতে-যেতে
জীবন, হু হু স্রোতের মতো জীবন শুধু প্রাতঃস্মরণীয়