উড়ন্ত সব জোকার
ষষ্ঠ মুদ্রণ: এপ্রিল ২০১৩
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৯। পৃ. ৬৪, মূল্য: ৮০.০০
প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০০৩
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু চাকী
উৎসর্গ: ছিটকে এসে জামায় লাগুক/ একের পর এক বান্ধবীদের সিঁদুর
সূচি
পেন্ডুলাম, লড়াই, কবিতার কথা, প্রাইভেট টক, ধর্ম, বিয়ের আগের দিন, শিককাবাব, সংসারগীতিকা-১, হে মালিন্য, বাবা-মা আর আমি, দোহাই, মশকরা, ঘরে ফেরার গান, ব্যাটাচ্ছেলে, একটা বিজ্ঞাপন, পাবলিক, হিংটিংছট, প্রতিবন্ধী, ক্রাইসিস, এসো মন, মি. ইন্ডিয়া যা বলেছিল, বিদায়, পরিচিতা, বাতাসের প্রতি, মেটামরফসিস, ইশারা, জীবন, তোকে নিয়ে, ডিসেম্বর, রঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি, নিশি, যদি তারে না-ই চিনি, সংসারগীতিকা-২, ভয়, জুলাই, প্রেমপর্ব, উড়ন্ত সব জোকার, শকুন, পিশাচ, উড়ুক্কুমাছ, রসদ, ইমেজ, প্রেমপর্ব-২, এই শহর, এই সময়, ওপরচালাক, ল্যাঙটো, সংসারগীতিকা-৩, জাজমেন্ট ডে, রওনা, তুমি জানো
.
আড়াইশো গ্রাম লালনীল আহ্লাদ
(নুন আন্দাজমতো)
গরম-গরম পরিবেশন করি
সুস্বাদু আর মুচমুচে সব শরীর
টাটকা কিছু ক্ষত
খেলে আবার আসতে হবে ফিরে
রোজ বিকেলে চ্যাপ্টা নদীতীরে
দোকান খোলা আছে
এবার খেলা অন্যরকম হোক—
জলখাবারের গল্প শুনুক লোক
তেল-আগুনের কাছে!
.
পেন্ডুলাম
সাড়ে সতেরো সভ্য মানুষের
নবরত্ন পেন্ডুলাম দোলে
ভগবানের তিনটে ভাল কাজ
অমিতাভের মোটে একটা। শোলে।
পকেটভরা চিরহরিৎ টপিক
অন্ধকারে কাছে পেলেই পা ফাঁক…
নদের চাঁদ বিরহ খুঁটে খাবে
জাল কাগজে হালকা করে ছাপা
খদ্দেরের মাথায় ব’সে কাক
দড়ি কলসি পাহারা দেয় এখন
মহামান্য হাসাহাসির পর
তুমিও নেই। অথচ ভেবে দ্যাখো,
পেছনে বাঁশ, সামনে এইচেস,
ডাঁয়ে লেডিস, ফ্রন্টে বিধি বাম…
সাড়ে সভ্য রত্নমানুষের
নবসতেরো পেন্ডু দোলালাম!
লড়াই
আজ যে তোমার জন্মদিন, তা জানো?
পাড়ায়-পাড়ায় টহল দিচ্ছ একা,
কাজ তো কেবল ডুগডুগি বাজানো।
শুটিং শেষ। এখন সবার প্যাক-আপ…
নিভছে আলো লাল-নীল-বেগুনি
রাস্তায় গড়াচ্ছে লজেঞ্চুস
আকাশে কার ঝমঝমানো ঘুড়ি
জোর মাঞ্জায় ভোকাট্টা পৌরুষ!
হাতে রইল লাটাইয়ের প্যাঁচ…
ছায়ার সঙ্গে ফালতু লড়াই, থুড়ি,
নিজের সঙ্গে নিজের ডুয়েল ম্যাচ
মাথার মধ্যে ঘোড়ার পা দাপানো…
জন্মদিনের ঘুরঘুট্টি রাতে
শহরব্যাপী জোড়া পাঁঠার মানত,
কিন্তু সবার দুরন্ত বকবক
গরম-গরম সরষে ইলিশ-ভাতে
রাত বাড়লেই ঘুমন্ত সব ছক…
ডাবের খোলা মাথায়, ঝাঁটা হাতে
লড়াই কাকে দেখাচ্ছ, চম্পক?
কবিতার কথা
মনভাল-মনখারাপ
মনভাল’র থেকে যেসব কবিতা লেখা হয় তারা অনেকটা বাড়ির ছোট মেয়ের মতো। ফর্সা, চুল ছোট করে ছাঁটা, আদরের, গানের ক্লাসে যাওয়া ফুটফুটে একটা মেয়ে। মন খারাপের থেকে যে সমস্ত কবিতা উঠে আসে তারা বাড়ির বড় মেয়ের মতো। চাপা রং, চুলঠোঁটনখে অযত্ন, দু’বার পাত্রপক্ষ ফিরে যাওয়া, সেলাইফোঁড়াই জানা একটা মেয়ে। আমি শুধু চেয়েছিলাম এই দুই বোনের মধ্যে রোগা সোগা, একরোখা, বদমেজাজি একটা ছেলে, যে অনেক রাত অব্দি গান শোনে, আর যার বন্ধু নেই কোনও।
আমি আর সেই খরগোশ
একজন চতুর খরগোশকে আমি নিয়োগ করেছি কৌতুক খোঁজার কাজে।
এই কলকাতা শহরে সারাটাদিন সে নানা ছদ্মবেশে কৌতুক খুঁজে বেড়ায়।
কখনও ট্র্যাফিক পুলিশ, কখনও পাঁড়মাতাল, কখনও কাগজকুড়ুনি
আবার কখনও কন্ডাক্টর, এইরকম।
সন্ধেরাতে বাড়ি ফিরে সে আমার কাছে জমা করে
তার রিপোর্ট, ছবিসহ।
তাকে খেতে দিয়ে দেখি সবক’টা রিপোর্টই দুর্ঘটনার।
নয় বাসচাপা, নয় আত্মহত্যা, নয় গণধর্ষণ,
নয় আরও অনেক কিছু।
আমিও চুপচাপ খেয়ে নিই।
তারপর আমি আর সেই খরগোশ সারারাত আলোচনা করি
কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে…
প্রাইভেট টক
দিকে-দিকে মেয়ে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে কিন্তু আমার মা এই
তোমাকে বলে রাখলাম পরে আবার বোলো না যেন ওফ্ দেখতে
দেখতে কেমন ডাগরটি হয়ে উঠেছি খেয়ালই ছিল না বাইসেপে
কুঁড়ি ধরেছে সোনা শরীরে যাকে বলে একেবারে বসন্তের হাহাকার
আবার সেই বাপন হারামজাদার দেওয়া জামাটা পরেছ কদ্দিন না
বলেছি ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে দ্যাখো দ্যাখো নাইস চাঁদ উঠেছে ওফ্
এই কলকাতার রাস্তা তবে মিথ্যে বলব না তোমার আগেও দু’জন
সে বহুকাল হল দোকানে ঢুকে কাটলেট আর হাত ধরে সরোবরে
এর বেশি এই আজকের মতো ট্যাক্সি অব্দি গড়ায়নি কোনওটাই
কাছে বসো না মনা কী হল ওহো বাবা ট্যাক্সিঅলা হরেন দাও
হরেন দাও সামনে দ্যাকো এদিকে কী এই করেই অ্যাক্সিডেন্ট হয়
মিটার তো বেড়ে দাদু হয়ে গেল বাপ ওমা নতুন আংটি হেবি
হয়েছে আমার হাতেও সাতরতির ছিল একটা এখন মডগেজ তা
বলতে নেই বিরাট বংশের বাতি এই অধম স্বয়ং মশার ধূপের
আবিষ্কর্তা হেঁ-হেঁ আমাদের ফ্যামিলিতেই নামটা এখন খেয়াল
পড়ছে না আরেকজন সাইকেলে দুনিয়া ঘুরতে বেরিয়ে আর বাড়ি
ফেরেনি তা ভালই চলছিল বাবার মুখশুদ্ধির ব্যাবসাটা ঝুলে
গিয়ে তা-ও দেখছি এদিক-ওদিক তুমি রুটি করতে পারো তো
মানে আমাদের বাড়িতে রাতে আবার রুটিটাই এই বাঁয়ে রোক্কে
ঠিকাছে সোনা আজ আসি চলে যেতে পারবে তো ফোন করব
টাটা আর হ্যাঁ কাকুকে বোলো যদি একটা জায়গা ফাঁকা থাকে…
ধর্ম
এখনও
এখনও আসে নতুন লেখা, মগজ থেকে শব্দ নামে ঠোঁটে
এখনও মাথাখারাপ, ঘোড়া দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটে
বাচ্চাদের গান শেখাই, ছাত্রপিছু দেড়শো টাকা মোটে
শুঁকে বেড়াই ঘরদুয়ার, কোথাও যদি কিছু একটা জোটে
এখনও পাড়া সাজানো হয়। সবাই মিলে ছুটি কাটায় ভোটে
কোনও হাতের ছাপ পড়ে না গান্ধীজির হাসিতে ভরা নোটে
এখনও জমে ক্রিকেট ম্যাচ, উত্তেজিত মানুষ নখ খোঁটে
ঘাড়ে রদ্দা পড়লে কথা বেরিয়ে যায় ভেদবমির চোটে
এখনও লোকে হাঁপায় আর টিকটিকিরা দেয়ালে মাথা কোটে
এখনও প্রেম জনপ্রিয়। এখনও টবে গোলাপফুল ফোটে…
তোমার কথা ভাবলে আজও পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে
তিন সত্যি
কাঠের বরাত কেমন করে খোলে?
যখন তাকে গিটার বানায় নামহীন কারিগর আর
সে গায়কের বুকের কাছে দোলে
ফুলের বাহার কেমন করে শানায়?
যখন তাকে প্রশ্রয় দেয় আলগা কোনও খোঁপা, সবাই
ঈর্ষা করে, কিন্তু তারিফ জানায়
কবির কপাল কেমন করে পোড়ে?
যখন তাকে হাতছানি দেয় সহস্র মুগ্ধতা, সেও
উঠোনটাকে আকাশ ভেবে ওড়ে…
বিয়ের আগের দিন
সরু অনামিকায় আংটি আর চোখের কোণে রাংতা—
এই যাচ্ছেতাই অশান্তি আমি দু’হাত দিয়ে ভাঙতাম
যদি না করতে খুব সন্দেহ আর করতে কিছু সন্ধি
তবে তোমারও পছন্দের লোক খাঁচাতে বাঘবন্দি
হতে পারত। আজও বলছি। যদি সত্যি থাকে কলজে,
নীচে নামিয়ে রাখো কলসি। দ্যাখো, আমারও পা টলছে
চলো, অনেক অনেক দূর যাই। এই ঝলসানো প্রাচুর্যে
কিছু যায় আসে না। দুচ্ছাই! কাল নতুন কোনও সূর্যের
ভোর দেখলে তবেই শান্তি। ঠিক জোটাব নুনপান্তা,
যদি ফেলতে পারো আজই
সরু অনামিকার আংটি আর চোখের কোণের রাংতা
শিককাবাব
আমি তোমার আত্মহারা প্রেমিক। আমায় কাটো।
শিককাবাব বানিয়ে ছাড়ো, রাজি। তবুও তোমার
অতদিনের বন্ধ থাকা আঠাভর্তি ফাটল
জিভ টানছে বড্ড, তাই বারোমাসের কোমায়
ডুবে যাচ্ছি, কেঁদে ফেলছি, কে জানে কী কারণে
মায়ের কথা মনে পড়ছে। অন্ধকার নালায়
কী দুর্গন্ধ! বাইরে আসব…কিন্তু ততক্ষণে
আমার দাঁড় মুঠোয় ভরে কে যেন ক্ষুর চালায়
স্বপ্ন ভাঙে। কোথায় তুমি। তোমার সাদা আঠা
দু’ এক ফোঁটা ছড়িয়ে আছে মার্বেলের মেঝেয়
জিভ টানছে আবার। আমি চাটছি। কলকাতায়
সবার পেটে ঢুকে পড়ছি শিককাবাব সেজে…
সংসারগীতিকা-১
একমুঠো দু’মুঠো চালে তিনমুঠো চারমুঠো
ভাত রেঁধেছি। গরম। তুমি ঘুম থেকে না উঠো
তুমি ঘুম থেকে উঠো না। সূরয পশ্চিমে যাক ঢলে
মাথার ধারে জানলা খোলা, বৃষ্টি বেশি হলে
বেশি বৃষ্টি হলেই চুল ভিজবে। চুলখোলা চুলভেজা
শরীর বলে বাইরে যাব, মন বলে ঘরকে যা—
ঘরে বউ আছে ঘুমন্ত, তার শিয়রে মোমবাতি
আলগা, অলস হাত-পা, তবু স্বপ্ন দেখার বাতিক
তাকে সুন্দরী করেছে। আমি দূর থেকে তাই দেখি
ঠোঁটদুটো আধুনিক, আহা, চোখদুটো সাবেকি
আমার ঘুম আসে না। ঠান্ডা ভাতে কাব্য ঝরে পড়ে
বৃষ্টি ধরে আসছে। কীসের আগুন লাগে খড়ে…
ঘরে আগুন দিলেও মরব না আজ। আগলাব খড়কুটো
শুধু ঘুম থেকে উঠো না তুমি, ঘুম থেকে না উঠো
হে মালিন্য
ছাঁটতে গিয়ে অনেক কিছুই বাদ গেছে।
যেমন ধরো মুর্দাবাদ, জিন্দাবাদ…
কয়েকধাপেই হা মনুষ্যজন্ম শেষ—
এক: বসন্ত, দুই: অশান্তি, তিন: দাবা।
আমরা ঘোড়া আড়াই চালের। পাখনা নেই।
ঘাসের দিকে চোখ নামিয়ে থাকলে বেশ
কিন্তু যদি চোখ তুলেছি একবারও
রাস্তা নিজেই খাদের দিকে বাঁক নেবে।
খাদের নীচে নাচছে নদী খলবলে
আকাশ থেকে সূক্ষ্মক্ষতি, সূক্ষ্মলাভ
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে। ভিজব না।
আমরা জানি তোমার বুকের হুক খোলা
হে মালিন্য, হে চুলখোলা উর্বশী,
তোমার প্রেমে আটকে গেছি আক্ষরিক
ছিপছিপে দু’পায়ের ফাঁকে জায়গা দাও—
দু’হাতে ওই অঙ্গখানি ফাঁক করি
হাতপামাথামুখ ঢুকে শ্বাস বন্ধ হোক
সূক্ষ্ম শুধু লাভক্ষতি, আর লোক ভোঁতা
গরম রসে ডুবিয়ে মারো মুগ্ধদের
যেমন লাভা ছাই করে দেয় সভ্যতা…
পরজন্মে ফিরে আসব। চাকরি চাই।
হাতে ছন্দ, গলায় যেন সুর থাকে
আমরা যারা ঢিল মেরেছি সবসময়
মিলনকালে আটকে যাওয়া কুত্তাকে!
বাবা-মা আর আমি
ক
বাবা-মা’র সঙ্গে পুরী বেড়াতে যাওয়া হয়নি আমার।
সিমলা বা উটিও না।
এসব তো দূর, কখনও চিড়িয়াখানা কি বইমেলাই যাওয়া হয়নি
আমি শুধু বাড়ি ফিরে আলো জ্বেলে ঢুকে গেছি
নিজের ঘরে আর দেখেছি
কীভাবে রোজ, পরস্পর, একটু একটু করে দূরে সরে গিয়ে
বাবা আর মা আমার বেড়াবার জায়গা করে দিচ্ছে…
আমাদের পাড়ায় একেকদিন রাতের দিকে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না।
বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করলে রাস্তাতেই ভাসতে আরম্ভ করি, গা ঘেঁষে
কুকুর, বেড়াল, রিকশা, সব ভাসতে-ভাসতে বেরিয়ে যায়। কোনওমতে
দরজা খুলে বাড়ি ঢুকে দেখি ভাত-ডাল-মাছেরঝোল সব মেঝেয় ফেলে
বাসনকোসনগুলো দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে আর তাদের মাঝখানে বাবার কাঁধে
মাথা রেখে ভেসে আছে মা…কোনও বিরক্তি নেই, ঝগড়া নেই, চুলোচুলি
নেই…যেন আমিও আসিনি পৃথিবীতে…শুধু শান্তি আর আনন্দের গন্ধে
ম-ম করছে গোটা বাড়ি। আমিও খুশিতে, লজ্জায় ভেসে থাকি রান্নাঘরের
এককোণে, আস্তে-আস্তে ঘুমিয়ে পড়ি, যতক্ষণ না স্বাভাবিক হচ্ছে অবস্থা,
যতক্ষণ না ওই দু’জনের তুমুল ঝগড়ায় ঘুম ভাঙছে আমার…
গ
মা’র চাহিদা অনেক।
মা চায় আমি বড় কবি হই, চাকরি পাই,
ভাল দেখে বিয়ে করি একটা,
আরও টুকিটাকি প্রচুর…
বাবা আর কিছু চায় না।
দিনকেদিন শ্লথ আর কুঁজো হয়ে যাওয়া আমার বাবার
চাওয়া বলতে রোজ রাতে তিনটে দেশলাই কাঠি।
একটা বিড়ি ধরাবার জন্যে,
আর দুটো, যদি আমি আর মা হারিয়ে যাই, সেই ভয়ে।
ঘ
বাবা একসময় খুব বন্ধু ছিল আমার।
তারপর, এসব ক্ষেত্রে যা হয়,
বন্ধু আস্তে-আস্তে দূরের লোক হয়ে ওঠে
বন্ধুপত্নী আরও কাছের
এই যেমন বাবা আজকাল সারাদিন
সিঁড়ির ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে
আমি আর মা
গল্প করি, টিভি দেখি, ঘুমোই একসঙ্গে
ঙ
খবরকাগজের দরজা বন্ধ
টিভি চ্যানেলের দরজা বন্ধ
স্কুল-কলেজের দরজা বন্ধ
শুধু বাড়ির দরজা খোলা। বাড়িতেই ঢুকি।
একতলায় মা গান শেখাচ্ছে। সারাজীবনের গান।
নিজের ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকি।
যখন রাত অনেক, প্রায় ভোর হয়ে এসেছে, গুটিগুটি পায়ে
পাশের ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়া মায়ের ফর্সা গলায় দাঁত বসাই
গান নয়। গরম, টাটকা রক্ত।
আর দাঁত বসাতে অক্ষম, দশবছর আগে লকআউট হওয়া বাবা,
কিছুদূরে মেঝেয় কাপ হাতে চুপচাপ বসে থাকে। অপেক্ষায়।
বাবা-মা’র মধ্যে বেশ একটা বেড়াল-বেড়াল
ব্যাপার আছে। দিনের বেশিরভাগটাই চোখ টিপে
এককোনায় পড়ে আছে, ঘুম ভাঙলে মাছের ঝোল,
দুধের প্যাকেট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, পরস্পরের
দিকে ক্রমশ বেড়ে চলা চিৎকার ছুড়ছে,
থপাথপ থাবাও বসিয়ে দিচ্ছে এক-আধবার…
কতক্ষণ মেনে নেওয়া যায়? ভাবি যাই, একদিন
বাজার যাবার পথে দুটোর ঘাড় ধরে দূরে কোথাও
রেখে দিয়ে আসি, বুঝবে মজা। তারপর মনে হয়
সত্যি-সত্যি তো আর বেড়াল নয় দু’জনে,
এই এত বয়েসে রাস্তা চিনে হয়তো আর
বাড়ি ফিরে আসতে পারবে না
ছ
শুনেছি, মা’র প্রেমে পড়ে বাবা পুরী পালিয়েছিল।
প্রথম-প্রথম মা রিফিউস করেছিল, তাই।
পুরীতে, সমুদ্রের ধারে বসে
বাবা প্রচুর মদ আর মাছভাজা খাচ্ছিল
আর উঁচু করে খোঁপা বাঁধা, বড় চোখের আমার মা
কলেজ ফেরত ভাবছিল ‘ইশ, হ্যাঁ বললেই হত…’
এ বছর পুরীতে গিয়ে খুব ইচ্ছে করছিল
আমার ঝড়ঝাপটা বাবাটাকে খুঁজে বার করি,
কলকাতায় ফিরিয়ে এনে দাঁড় করাই
সদ্য পঁচিশ মা’র পাশে
কিন্তু স্থানীয় লোকজনকে জিগ্যেস করাতে বলল
সেসব এখন আর পাওয়া যায় না।
এই ৩০ বছরে সমুদ্র অনেকটা সরে গেছে।
জ
হয়তো একদিন আমি ঘুমোচ্ছিলাম, বাবা বাইরে গেছিল,
মা’র পুরনো প্রেমিক এসে আমায় দেখে বলেছে
—‘কোন ক্লাস হল ওর?’
হয়তো আরও একদিন আমি ঘুমোচ্ছিলাম, মা বাইরে গেছিল,
বাবার পুরনো প্রেমিকা এসে আমায় দেখে বলেছে
—‘একদম তোমার মতো।’
আজ এত বছর পর ঘুম ভেঙে
আমি আবার খুঁজছি সেই দু’জনকে।
দু’জনের মধ্যে কি দেখা হয়েছে কখনও?
প্রেম?
বিয়ে করে শহরের বাইরে আছে কোথাও?
এখন গিয়ে থাকা যায় না, তাদের সঙ্গে?
ঝ
আর এই এতসবের পরে, দু’কাঁধে বাবা-মাকে চাপিয়ে নিয়ে
একের পর এক বিয়েবাড়ি, ট্র্যাফিক সিগন্যাল, এসএসসি,
মৃত্যুসংবাদ পেরিয়ে চলেছি আমি। পা টলছে, নাক দিয়ে রক্ত
পড়ছে, কিন্তু জ্ঞান হারাচ্ছি না। আমার বাঁ কাঁধে বসে মা গান
গাইছে, রাগাশ্রয়ী বাংলা, ডান কাঁধে বসে বাবা টিভি দেখছে।
মারপিটের বই। আর এই দুই আত্মহারা বাবা-মা’র মাথায়
পা দিয়ে দাঁড়িয়েছি, হ্যাঁ, আমিই। যে চাকরি-বাকরির তোয়াক্কা
করে না, কবিখ্যাতিকে পাত্তা দেয় না, প্রেম-বিচ্ছেদ নিয়ে
মাথা ঘামায় না, শুধু এক্ষুনি পৃথিবীর শেষ দেখতে চায়!
দোহাই
শুকনো ঠোঁট চাটে তর্ক
স্বাস্থ্য নয়, সম্পর্কপান
আদর খোঁজে কাঁচামাংস
দরিয়াদিল আশমান সমান
জিভ ছড়ায় পোড়াগন্ধ
খাবার নয়, অপছন্দ খায়
ভেঙে যাবার সেই কিস্যা,
মানুষ তাকে কুর্নিশ জানায়।
ঠান্ডা বুকে চাপা হিংসে
সঙ্গী নয়, লাশ চিনছে রোজ
দূরপাল্লা যায় সূত্র
কোথায় গেছে কোন টুকরো, খোঁজ…
ভাঙা রিশ্তা মৃত্যুর সমান
দোহাই করো বিসমিল্লা,
শিখিয়ে দাও মুশকিল আসান।
মশকরা
আহা মশকরা মশকরা
আমার দিন আনা দিন খাওয়ার মধ্যে মিচকে বসুন্ধরা
ঘোরে ইচ্ছেমতো স্পিডে
তখন তাল পারি না রাখতে। মাথায় রঙিন রঙিন খিদে
যে যার হাত-পা ছুড়ে নাচে
আমি আজ যাকে খুব ঘেন্না করি, কাল তাকে চাই কাছে
নয়তো চুলের মুঠি ধরে
নিজেই নিজের শরীর ঘষটে বেড়াই কানকাটা শহরে
সেথায় হরেকরকম দালাল
তাদের মেইনস্ট্রিম দাঁতকপাটি, হাসিটি প্যারালাল
শখের চাঁদ লাগে হরমোনে
যত বোঝাই রাতে পাশ ফিরো না, কে কার কথা শোনে—
নিজের ছায়ার গালেই অগত্যা দিই ঠাস করে এক চুমু!
ছায়া মুষড়ে পড়ে ভারী।
আমার ছায়ার পাশে অন্য একটা ছায়া কি দরকারি?
যদি তাই হবে তো বেশ,
এই দিলাম তোমায় বাপ-মা হারা টকঝাল সন্দেশ
খেয়ে জানাও আমায় কেমন
যদি পারো তো আজ শান্ত করো ক্লান্ত মাথার ব্যামো।
ঘরে ফেরার গান
ভাঙছে ঠুনকো আড্ডা
সাতটা লাল চা, বিস্কুট
দাম মেটাচ্ছে খুচরো।
অল্প-অল্প বৃষ্টি
একলা হাঁটছি, আস্তে
সঙ্গী বলতে রাস্তা
স্বপ্ন বলতে চাকরি
অস্ত্র বলতে ধান্দা
সত্যিমিথ্যে বন্ধু
পেট গোলাচ্ছে, যাক গে
ফিরতে ফিরতে রাত্তির
ভাত সামান্য ঠান্ডা
খাচ্ছি, গিলছি, ভাবছি
ছোট্ট একটা জানলার
নীলচে শান্ত পর্দা
একটু-একটু দুলছে,
চুল গড়াচ্ছে বিছনায়,
পাতলা, স্বচ্ছ নাইটি…
‘ছিন্নপত্র’ পড়ছ
ব্যাটাচ্ছেলে
পাক ধরেছে কৃষ্ণকেশে, টিউশানি যাও কায়ক্লেশে
ও রাস্তা খুব সর্বনেশে, সহজে কেউ মাড়ায় না
চা-বিস্কুট সহজপাচ্য, খাচ্ছ-দাচ্ছ ঠ্যাং দোলাচ্ছ
কুকুর-বেড়াল পদবাচ্য, হুট করে তাই তাড়ায় না
ফেরার পথে ঘোরো বিশ্ব, ভগবানের ভাবশিষ্য
উপর-নীচ সমান নিঃস্ব…স্বপ্নে সীমা ছাড়ায় না
ঘুঁটের ওপর বুটের চিহ্ন…পরমপুরুষ অবতীর্ণ
কিন্তু তোমার পাড়া ভিন্ন অন্য কারও পাড়ায় না
তখন বাওয়া হেবি মস্তি…নিজের সঙ্গে জবরদস্তি
লোকের সামনে কী অস্বস্তি…কেউ এসে হাত বাড়ায় না
দিন কেটে যায় ক্যারাম খেলে, অকালপক্ক ব্যাটাচ্ছেলে
একটা বয়েস পেরিয়ে গেলে কোনওকিছুই দাঁড়ায় না!
একটা বিজ্ঞাপন
লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা
সকাল ৮টা: ব্রাশহাগুমুতুচান, কলম কামড়ানো, রোদ
লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা
বেলা ১১টা: সীমান্ত প্রহরীদের সাক্ষাৎকার, দুটো রাস্তা ওয়ান-ওয়ে, ন্যাকামো,
আরও রোদ, চ্যাপ্টা স্বীকারোক্তি, টাইয়ের গিঁট, থুতু
লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা
বিকেল ৪টে: জোকারদের বার্ষিক সম্মেলন, শিরদাঁড়া, জ্যাম, ধুশশালা
লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা
সন্ধে ৭টা: চ্যাঁৎ করে পার্কিং, হোঁটো সে ছুলো তুম, ঘনত্ব, তারল্য, হিক্কা
লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা—লারেলাপ্পা
রাত ১১টা: ভিখিরিদের যৌনতা, রাধেশ্যাম বলো, ল্যাম্প, চুকুচুকু,
টেপা, ধাক্কা, রক্ষিতা, সব শালা দালাল, ঘুম
এবং কাল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হবে ট্রা-লা-লা-লা, যা আপনার
সারাদিনের কাজগুলিকে আরও মসৃণ করে তুলবে।
পাবলিক
বঙ্গ হনুমান। তার রঙ্গ অনুমান করে আমি
প্রচুর খাতির করি, নিশিদিন চেয়ারে বসাই,
হাত-পা টিপি, মাঝেমধ্যে চুরি করি থালার প্রণামী…
চোরে-চোরে মাসতুতো। দোষ কার? যে মেসোমশাই
ত্রিতাল মিছরির স্বাদে ষোলোমাত্রা বোলে রে পাপিয়া—
পায়ে বেড়ি নাকে খত। নিয়তি না আগ্রহের ফের?
সন্দেহতত্ত্বের গান-‘ভোলামন পোস্টমডার্নিয়া…’
নতুন কনসেপ্ট। কিন্তু কণ্ঠ? হুঁ-হুঁ, বীরেন ভদ্রের
তাই বলো। মহালয়া। আমি ভাবলাম যুদ্ধ হবে।
ধকল অনেক, তবু বাঁচাব নকল বুঁদিগড়
দুই হস্তে বিগশপার, ফেরো সৈন্য অপার গৌরবে
ছবি-সই দেখে নিও। রাজা কে? দুলালচন্দ্র ভড়।
তবে তো কোটালপুত্র বিছুটি কাটায় দূরে দূরে
হলিডে-হোমাগ্নি জ্বলে, দুদিন-দুরাত গেঁয়োখালি
ফিরে সেই কলকাতা। পাগল, ভিকিরি, ভবঘুরে
মনিটর রামকৃষ্ণ, মাদার বোর্ড স্বয়ং মাকালী
অথচ সে পেন্টিয়াম পরমহংস চেনটি খুলে-ইশ!
দেয়াল ভিজিয়ে দিচ্ছে। কাস্তে-ফুল সব ভিজে ঢোল
দমকল তাকে চাইছে, সে চাইছে ইঁদুর-মারা বিষ…
বিধাতার পরিহাস…। কে হাসে রে? শ্রীভৃগু (আসল)
তুমিও তেমনই কিছু হেসে উঠো, কুটোটি না নেড়ে
এলিয়ে কাগজ পোড়ো-শহরে সার্কাস, খুনোখুনি
ব্যর্থ প্রেমে আত্মহত্যা…কে কার হৃদয়াবদ্ধ গেঁড়ে
মৃত্যু মিথ্যে। ঠান্ডা। নীল। আর জীবন? গরম বেগুনি।
এই অব্দি বোঝা গেল। তারপর ঢালাও মরুভূমি…
ওপারে পৌঁছতে গত মে মাসের চল্লিশ তারিখ।
তখনও কি কবিতায় ‘সত্য’ খুঁজবে? ‘নিহিতার্থ’? তুমি
আমাকে জড়িয়ে বাঁচো। আমি কী?
ব্রহ্মাণ্ড…
পাবলিক!
হিংটিংছট
খচাখাঁই বাজাচ্ছি সন্তুর
তেচাকায় আলস্য ভরপুর
বেচে খাই পড়ন্ত রোদ্দুর
দু’চোখের কাচ তোলা
তোয়ালে খুলেই সে কী নাচ!
চোয়ালে খচরমচর কাচ
পোহালে পূর্ণিমাতে আঁচ
কী দারুণ স্বাস্থ্যলাভ
কেনিজি’র ঠান্ডা হরির লুট
এলিজি’র জলভরা গামবুট
ফেলিচি ছয়ের ঘরে পুট
ঘুমে তার আবছা রেশ…
খুঁটিতে রইল বাঁধা মেষ।
ছুটিতে সমুদ্র না ক্রেশ?
আগুনের হাঁপ ছাড়ে
চাঁদে চাঁদ খসখসাচ্ছে গা
জাদেজা’র হিলতোলা রণ পা
কাঁদে ছাদ মাঝরাতে একলা
সাজানো ভূতবাড়ি…
প্রতিবার রজ্জু বনাম সাপ
অতি বাড় বাড়ন্ত সন্তাপ
প্রতিভা’র মরণবাঁচন ঝাঁপ
কোনও এক বুধবারে…!
প্রতিবন্ধী
বাবা আজকের দিনটা বাঁচিয়ে দিও আরও তো সিট ছিল
কেন মরতে জানলার লোভে ভিড় এড়ানোর লোভে বাবা আজকের
দিনটা শুরুতেই লোক জমে গেল এত এরপর তো ওফ্ এই এসে গেল
পদ্মশ্রী মদ্দামাদীর হুড়োহুড়ি বাবা অন্ধখোঁড়া যেন না ওঠে পোলিওকুষ্ঠ যেন
না ওঠে কেন মরতে জানলার লোভে ধ্যুৎ যাক ওঠেনি দেখো বাবা
আসছে স্টপেজগুলোয় তোমার ভক্তের মুখ রেখো
একদম দাঁড়াতে পারব না সকালে আবার লুজমোশান মতো
নতুন প্যান্ট আটশো টাকার বাবা কেচ্ছা হয়ে যাবে এইতো বাঘাযতীন
গোটাদশেক হামলাহামলি এগিয়ে আসছে এদিকে দিদিভাই কি অন্ধ নাকি
নাহ্ দাঁড়াবে ওফ্ হাওয়া গার্ড হাতকাটা ব্লাউজ মুখের সামনে এবড়োখেবড়ো
বগল তুলে তাও যদি মুখশ্রী ভাল হতো বাবা এত ঘামের এত ইত্যাদির
দুর্গন্ধ আর পারি না এই গড়িয়াহাট নেমেছে প্রচুর কিন্তু মিনিবাস সালা
খচ্চরের জাত বাড়ি গিয়ে প্যাসেঞ্জার নিয়ে আসবে যাচ্চলে কালো চশমা
পরা একটা মাল উঠল দেখি না অন্ধ না স্টাইল দেখো বাবা আর
চার-পাঁচটা স্টপেজ হলে কথা ছিল শেষ অব্দি যাব তাই এত জ্বালা জানলার
বাইরে কত বিউটি বেরিয়ে যাচ্ছে নজর দেব কী আলটপকা বোবাখোঁড়া কেউ
উঠে এলেই হল পাশের দাদু তো উঠবে না আমাকেই আচ্ছা বোবা কি
প্রতিবন্ধী যদি না হয় তো ভাল একটা কেস কমল আর এই টেনশন সহ্য
হয় না বাবা এই বি.পি. হাই আর ভাল লাগে না সামনের জন্মে
অন্ধ কি খোঁড়া যা হোক কিছু করে দিও
ক্রাইসিস
মাথার ভেতর পাক মেরে যায় বাজারদর
কোন বছরে কার নামে কী পুরস্কার
এখন শুধু অভিধানেই ‘ভ্যাকেন্সি’
পানের পিকে পাড়ার দেয়াল অজন্তা
ভিড়ে ধাক্কা। পেছন থেকে ‘বোকাচ্চো’—
নন্দনে শো, আমার ভুবন, মৃণাল সেন…
জীবন তো এর ভেতর দিয়েই রোনাল্ডো
ডজ-ড্রিবলিং-ট্যাকল্, কিন্তু নকল খুব
কেনার সময় সই দেখে নিন অবশ্যই
সঙ্গে ছবি-হাস্যমুখে প্রোপ্রাইটার
মন ভাল হয়। দিন যায় দিন কী মস্তি
চিকেন কষা, শোবার আগে ইসবগুল
রাত বাড়লেই কেব্ল্ চ্যানেল ‘এ’ মার্কা
ভোরের দিকে ভিজে একশা। কাপড় ধোও…
বছর-বছর নিত্যিনতুন অ্যাসেম্বলি
সেবার দিঘা ঘুরতে গেলাম ভোটের পর—
সেখানেই তো, সাহস ক’রে, প্রথমবার…
সেসব কষ্ট কাটিয়ে উঠে এখন ফ্রেশ।
হৃদয় বাঁচুক, ভাঙা প্রেমের পাছায় লাথ!
কিন্তু হৃদয় বাঁচলেও সেই সমস্যা
কোথায় গেল বাসন্তীরং কলেজদিন…
এখন খালি থাই দেখানো মিনিস্কার্ট
সফটি খাওয়া মেয়েগুলো সব অসহ্য!
হায় কবিতা, তুই ছাড়া আর কে বন্ধু…
সন্ধেবেলা সন্ধে নামে শহরময়
দরজাগুলোয় বাদুড়ঝোলা হাজার লোক
ঝমঝমিয়ে ট্রেন চলে যায় সোনারপুর
জীবন তো এর ভেতর দিয়েই লিটল ম্যাগ—
থার্ড প্রুফেও ছাপার ভুল অজস্র।
শুধরে দিয়েও লাভ নেই খুব। কী লাভ, হ্যাঁ?
অনেক হল। নতুন কিছুই বলার নেই।
নতুন শুধু ভাষার ভঙ্গি, দেখার চোখ
সেই চোখও আজ চশমা প’রে দেদার ঘুম…
স্বপ্নে আসে নাইটি পরা হেলেন হান্ট
কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে? যেই সকাল হয়?
কী শোনে সে? নতুন স্লোগান, নিপাত যাক?
কী দ্যাখে সে? ভোরের হাওয়া প্রাবন্ধিক?
নাকি হঠাৎ আয়না দেখে হোঁচট খায়,
প্রশ্ন করে-‘এই শহরে কী হচ্ছে?’
প্রশ্ন করে, কলার ঝাঁকায়, জবাব চায়—
তোমার কোনও আত্মীয় কি পকেটমার?
অথবা কোনও বন্ধু হলে টিকিট ব্ল্যাক…?
বা ধরো তুমি নিজেই কোনও ঝুঁকির কাজ…
না-ই যদি হয়, তা হলে আর কী জানলে
ঠোঁটের কষে লাল রঙের কেমন স্বাদ,
কিন্তু কোনও ক্রাইসিস নেই, এটাও তো
একধরনের ক্রাইসিসই, না? জীবনভর
কী টেনশনে কাটিয়ে দিলে, প্রিটেনশন,
ভাবনায় ভাবনায় ইদানীং আকুল হও—
শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি, এমন কেউ
তোমায় যদি প্রোপোজ করে, কী করবে…
এসো মন
এসো মন, খেলি জগঝম্পের খেলা
ন্যাড়াছাদ থেকে গণতান্ত্রিক ঝাঁপ
পেছনে ভাসছে মরা পুলিশের ভেলা—
হ্যান্ডস আপ! হ্যান্ডস আপ!
তারপর ছুট দিনরাত-রাতদিন
বড়রাস্তার রাজকীয় ভাব ছেড়ে
এ গলি-সে গলি চটপট শান্টিং…
গায়ে হাত তোলে কে রে?
সব দেখে নেব। মধুচন্দ্রিমা যাক,
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের ছাদে
বাসর বসাব ধিনতাক-ধিনতাক
মড়া তুলে নেব কাঁধে
আবার ছুটব দশসিঁড়ি-বিশসিঁড়ি
আবার দাঁড়াব রেলিঙে কোমর দিয়ে
ব্যালকনি থেকে দেখব কী বিচ্ছিরি
বান্ধবীদের বিয়ে
আপাতত এই স্বপ্নকে ঝেড়ে ফেলে
হৃদয়বিদারী গামছায় মুখ মুছি,
এসো মন, বসি গেলাসে-গেলাসে ঠান্ডা রক্ত ঢেলে—
ওপরে ছড়ানো সম্পর্কের কুচি…
মি. ইন্ডিয়া যা বলেছিল
কে বিপন্ন, অকর্মণ্য, ইহজন্মে জগন্নাথ
ঠুঁটো হস্তে করো নমস্তে, কাটো অল্প টাকার চেক
অটো চড়ছ? কী আশ্চর্য! বাসে বড্ড ধকল, না?
পাড়াপড়শি ত্রিকালদর্শী। যেতে আসতে তাকাচ্ছে।
হতভাগ্য, এ বৈরাগ্য ইহজন্মে অবশ থাক
চুলে তৈল অনেক হইল। এবে শ্যাম্পু (ফ্রিডম কেশ!)
কে বাপান্ত, অল্পে ক্লান্ত, চিঁড়েচ্যাপ্টা অবস্থা
পরমান্ন খুব সামান্য খেলে বুঝবে কী জম্পেশ
কে অপাত্র, গরিব ছাত্র, পরজন্মে জমিন্দার
কে অপেক্ষা, ট্রিপল টেক্কা, তবু ময়না তাকায় না
চাপাকান্না রাজেশ খান্না, কাঁপাহাস্য গোবিন্দা
কে ক্ষুধার্ত, প্রথম পার্থ, বেলা পড়লে চা খায় না
কে নমস্য, দুগ্ধপোষ্য, কে চালাচ্ছে অযোধ্যা।
কে উলঙ্গ, অঙ্গভঙ্গ, কে ডিভোর্সি, ঘুমন্ত
কে বসন্তে নন্টেফন্টে, কে গো বৃষ্টি অঝোরধার
আটপৌরে ইঁদুর দৌড়ে আশাভরসা ছুমন্তর
একরত্তি গরম সত্যি গেলে দিচ্ছে তাদের চোখ
কাটা ছন্দ, তুমিও অন্ধ। খুঁজে ফিরছ সবার দোষ
নীচেউচ্চে শকুন ঘুরছে…আর সামনে যা দেখছ,
তা নিমিত্ত। মধ্যবিত্ত। খেপে উঠলে অবাধ্য।
হে মোগাম্বো, এবার থামব। কাঁচাকাব্যে বুনোট কম
বাকি গল্প অল্পস্বল্প ব্যাবিলন বা হরপ্পার
সবই পণ্ড, তবু অখণ্ড খিদে-তেষ্টা-ভ্রূণোদ্গম…
ও শতাংশ, পাঁঠার মাংস খাওয়া হয়নি ক’ রোববার?
বিদায়, পরিচিতা
ক
গাড়িতে ওঠবার সময়ে তার কান্নার রং ছিল—
‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটো হি যায়…’
লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে।
ফুলের লম্বা লম্বা শেকল দিয়ে বাঁধা ভাড়া করা গাড়ি
এসব দিনে বোধহয় মেঘ-টেঘই করে আসে।
গলির একতলা-দোতলা সব বারান্দায় মুখ…
আমি দেখছিলাম তার মুখ।
না, আমার দিকে তাকায়নি।
ছুটে গিয়ে ভদ্রলোকের বুকে ‘বা পি-ই’ বলে আছড়ে পড়ে
আর দু’হাতের পাতায় চাল নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে
পেছনে ছুড়ে ফেলা…
কষ্ট হচ্ছিল না।
শুধু হিন্দি সিরিয়ালগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম।
খ
ভাল থাকার চেষ্টা করবে।
রোদ, কাচঘর, মাছ, ছাদ, চিরুনি, হাসি, দুপুর।
মেল-আইডিটা যেন কী?
লোকে যে কেরোসিন মুখে ভরে আগুন ছুড়ে দেয়,
সেটা তার রুজি। উত্তর নয়।
‘হানড্রেড ইয়ার্স’টা পেলাম না। এইটা এনেছি।
‘আমাকে মনে রেখো না’ আর ‘আমাকে ভুলে যেও’-র মধ্যে
তফাত কীসের বলো তো?
আভিজাত্যের।
বাতাসের প্রতি
এই জগৎ সিনেমাহল, আমরা দর্শক
চোখের সামনে হোক যতই মনকাড়া ঘটনা,
সাবধানবাণীতে এবার বিশ্বাস করেছি—
এখন থেকে কোনওকিছুর বর্ণনা দেব না।
দেব না বললে হয়? বাতাস, তোমার গায়ের জোরে
দিক-টিক গুলিয়ে যাচ্ছে, পথ হারানো মিছিল
শেষ অব্দি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে কে জানে…
আপাতত চাকরি নেই অসংখ্য দধিচীর।
অদ্ভুত কায়দায় তবু ফুটিয়ে রাখছ
হাজার ক্যাকটাসের মাঝে একটা ক্রিসেনথিমাম
সবার নজর ওদিকে। আর সেই সুযোগে দূরে
আস্তে-আস্তে তৈরি হচ্ছে নতুন বিপদসীমা
কখন এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, টুঁটি কামড়ে ধ’রে
নিজের নামে লিখিয়ে নেবে বাদবাকি সব জমি,
এসব আমরা জানি, কিন্তু বর্ণনা দেব না।
আমি আর আমার প্রেমিকা ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী।
তাও তো ক’দিন ওদের বাড়ি যেতে পারছি না।
ভুল বুঝলে বুঝুক, সাধের কাব্য রচয়িতা
টাল খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে রাস্তায়-রাস্তায়
বমি করছে ডজনখানেক না-লেখা কবিতা
জানি এখনও প্রচুর ব্যাপার হজম হওয়া বাকি।
ফ্ল্যাটবাড়ি আর রেস্তোরাঁ আর ফ্লাইওভার গিলে
ঢেকুর তুলব যেদিন, ধোঁয়ায় ভরে যাবে আকাশ
হাসতে-হাসতে শামিল হব কানকাটা মিছিলে
এখন পাখি, ধুলো, বেলুন, যুদ্ধবিমান উড়ছে
উড়ছে বিফল মানবজনম, মফস্সল, শহর…
সকল কিছু উড়িয়ে নিচ্ছ, লজ্জা পাব এবার
ধীরে বহো…ধীরে বহো…বাতাস, ধীরে বহো
মেটামরফসিস
মুশকিলটা হল এই যে, মদন আজ সকাল থেকে আর কথা
বলছে না। এক্কেবারে চুপ মেরে গেছে। পাড়ার রোয়াকে বসে
কুকুরদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছে, পাখি-ফাখি দেখছে, কিন্তু না।
কথা বলছে না। প্রথম-প্রথম কেউ কেয়ার করেনি। কিন্তু যখন
দেখা গেল, শর্টরান থেকে পোখরান, যে-কোনও ছোট ও বড়
বিষয়ে যে-মদন অক্লান্ত ও সুচিন্তিত মতামত পেশ করত,
সে বেলা গড়িয়ে যাবার পরেও মুখ খুলছে না, পাড়ায় তখন
কানাঘুষো শুরু হল। গুটি গুটি লোক জমতে শুরু করল
উদাস, ভাবহীন মদনের সামনে। কেউ বলল-‘প্রেমে শক্
পেয়েছে…’, কেউ বলল— ‘অতিরিক্ত চিন্তার ফল…’ এই সব।
কিন্তু অত লোককে সামনে দেখেও মদন যখন রা কাড়ল না,
সকলে মিলে তাকে কথা বলাবার বিভিন্ন প্রকার চেষ্টায় রত হল।
কেষ্টা বলল— ‘কী রে মদনা, চা চলবে নাকি?’ মদন চুপ।
দেবুদা বলল— ‘ওই দ্যাখ মিতালি আসছে—’ মদন
চুপ। নিধু একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে বলল— ‘এ-এ বাবা,
মদন বেজম্মা-আ—’ মদন চুপ। মদন চুপ, চুপ, চুপ
চুপ, চুপ। এরপর লোকজন খেপতে শুরু করল, প্রথমে
কাঁচা খিস্তি, তারপর জামাকাপড় ধরে টানাটানি, শেষে
থুতু ছোড়া…আর এখন, এই সন্ধের দিকে অবস্থা এমন
দাঁড়িয়েছে যে, প্রায় শ’খানেক বাচ্চা-বুড়ো মদনের পায়ের
কাছে বসে চুল ছিঁড়ছে, কাঁদছে, আছাড়ি-পিছাড়ি যাচ্ছে—
ওদিকে মদন শুধু কুকুরদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছে আর পাখি
গুনছে তো গুনছেই…
ইশারা
অকালপ্রয়াত কালু দাসের স্ত্রী একবার আমাকে ইশারা করেছিল,
আমি রাজি হইনি। তা সে গেল খেপে। তৎক্ষণাৎ নালিশ জানাতে ছুটল
পাড়ার দাদা লালটুকে। লালটু সব শুনেটুনে বলল— ‘কীরকম ইসারা
করেচিলি?’ কালু দাসের স্ত্রী ইশারা করে দেখাল, লালটু রাজি হয়ে গেল।
কালু দাসের স্ত্রী গেল বেদম চটে, লালটুকে তো সে চায়নি, চেয়েছে
আমাকে। দ্বিগুণ রাগ বুকে চেপে সে গেল এলাকাপ্রধানের বাড়ি।
সেখানে আরেক কেচ্ছা-কালু দাসের স্ত্রী কিছু বলার আগেই এলাকাপ্রধান
তাকে ইশারা করে বসল। এইবার কালু দাসের স্ত্রী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে
এলাকাপ্রধানকে চড় মেরে বেরিয়ে গেল। এলাকাপ্রধান লালটুকে ডেকে
বললেন এই ঘটনা। লালটু জিজ্ঞেস করল-‘কী ইসারা করেচিলেন
স্যার?’ এলাকাপ্রধান দেখালেন, লালটু সাবধান হয়ে ফিরে গেল।
কথায়-কথায় আমাকে একদিন বলল— ‘সোন, ওই সালা কালুর বউটা
বহৎ দেমাগি। ওকে যেন ইসারা-টিসারা দিসনি, কেলিয়ে দেবে। স্যার
এই রকম ইসারা করেচিলেন, স্যারকেও ছাড়েনি’ বলে স্যারের করা ইশারা
আমায় যত্ন সহকারে দেখাল। আমি এরপর একদিন কালু দাসের স্ত্রীকে
জিজ্ঞেস করলাম— ‘কী গো, এলাকাপ্রধান নাকি তোমাকে ইশারা
করেছেন?’ কালু দাসের স্ত্রী অবাক হবার ভান করে বলল-‘কীরকম
ইশারা বলুন তো?’ আমিও বোকার মতো ইশারা করে দেখালাম আর
কালু দাসের স্ত্রী রাজি হয়ে গেল।
জীবন, তোকে নিয়ে
ওজনে কম হল যৌবন
আঙুলে বড় হল আংটি
কোথাও তবু ভারসাম্য
বজায় রেখে চলে শান্তি
পা দিলে পড়ে যাব নির্ঘাত
শ্যাওলা পোষে কত কার্নিশ
প্রেমের দিকটায় যাই না।
রাতের বাসে লং জার্নি…
যেদিকে ঈশ্বর থাকে না
সেদিকে মুখ করে পেচ্ছাপ।
ফ্ল্যাটের ছোট-ছোট জানলায়
আদর, প্রবলেম, কেচ্ছা…
সময়-অসময় দুই ভাই।
দুয়েরই খুরে-খুরে পেন্নাম
মরে যাবার পর স্বর্গ…
মরে যাবার আগে ঘেন্না!
জীবন, তোকে নিয়ে সকলেই
লিখেছি তিন-চার ছত্র
সেসব নিয়ে আজ বই হোক—
‘সেলিম লংড়ে পে মত রো’
ডিসেম্বর
এসেছে শীত। ঢালাও করে ফুটপাতে বিক্রি হয়
কেক-পেস্ট্রি, উলের টুপি, কন্ডোম
জবর জ্যাম…পথিমধ্যে নাকেরুমাল পুলিশ
দুঃসময়ের নিশ্বাসে দুর্গন্ধ
চক্ষুভরা আলকাতরা। অথচ গতকাল
স্বপ্নে তুই হাড়ের মালা কিনলি
এগিয়ে দিতে যাব, দেখি সাইকেলে হাওয়া নেই
আকাশপথে ট্রেন ছুটেছে দিল্লি…
ঘুম ভাঙছে খিদের মধ্যে। পেট ফুলে ব্রহ্মাণ্ড
দশ লক্ষ বছর কিছু খাইনি
এখন আমার বিছানা চাই। তিন-চারদিন ছুটি,
সঙ্গে তোকে,
শ্যাম্পু করা ডাইনি!
রঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি
রঞ্জু সোনা,
তোমার ই-মেল পড়ি না আর। এই অসীমে
হপ্তা পিছু দশ টাকা যায় ট্যাঁক থেকে
ইংলিশ বাদ। বাংলা চালু। শহরে সব রাস্তা ঢালু
গড়াই, আবার ফিরেও আসি এক ঠেকে
আকাশ ভরা সূর্য তারা, হাওয়ায় তখন কী আশকারা
বুঝিনি, তাও এগিয়ে গেছি চোখ বুজে
ঠেকতে ঠেকতে এখন জানি, দুধ কা দুধ-পানি কা পানি
জীবনে সব স্টেপ নিতে হয় লোক বুঝে।
কে কোন চুলোয় ঘাপটি মেরে কার কফিনে ঠুকছে পেরেক
কে কার ঘাড়ে নল রেখেছে বন্দুকের…
তবু তো প্রেম সর্বনাশী, পুজোর চাঁদা তুলতে আসি
সাহস পেতে সঙ্গে রাখি বন্ধুকে
অসীম কালের যে-হিল্লোলে তোমার বাবা দরজা খোলে
দেখেই আমার প্রাণ উবে যায়, রঞ্জিনী
বিকেল করে ঘুরতে বেরোই, স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরোই
আমি…তুমি…দাশকেবিন আর মঞ্জিনিস
বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্তু তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই।
কান পেতেছি চোখ মেলেছি যা দেখেছি চমকে গেছি
থমকে গেছি পাড়ার মোড়ে রাতদুপুর
ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডানা পাখি পায় দৈনিক চারানা
কাপড় কিনলে হয় না মুখের ভাতটুকু
প্রাতঃকৃত্য করছি বসে, এই সময় কে জমিয়ে কষে
লাথ ঝেড়েছে কাজলকালো পশ্চাতে
একেই দু’দিন হয় না, শক্ত, তার ওপরে চোটের রক্ত—
খুব লেগেছে। কিন্তু আমি, বস, তাতে
রাগ করিনি। ক্ষমাই ধর্ম। শঙ্খ ঘোষের ‘কবির বর্ম’
গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরেছি কলকাতায়
ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছি…হাত-পা দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি…
বেঁচে ফিরছি, সেটাই তো আসল কথা
টাকা খুঁজছি নোংরা হাতে, ঠান্ডাঘরে, কারখানাতে
তুমি হতাশ, আমিও শালা বিরক্ত
দেয়াল দেখে খিস্তি করি…কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি…
কান্না আসে। এ কোনদেশি বীরত্ব?
বাড়ির লোকের উত্তেজনা— ‘কেন কিছু একটা করছ না?’
যেন আজও বেকার আছি শখ করে
তবু এমন দেশপ্রেম, যে এমপ্লয়মেন্ট-এক্সচেঞ্জে
নাম লিখেছি সোনাবরণ অক্ষরে
তুমি বরং সেটল করো-গঙ্গারামকে পাত্র ধরো
ফরেন কাটো। দুঃখ পাব, সামান্যই…
আমায় নিয়ে খেলছে সবাই, সুযোগ পেলেই মুরগি জবাই
তুমি তোমার। আমি তো আর আমার নই
ঢপের আকাশ, সূর্য, তারা…স্বপ্নগুলো বাস্তুহারা
এবার থেকে নৌকো বুঝে পাল তুলো
আজ এটুকুই। সামলে থেকো, আমায় ছাড়াই বাঁচতে শেখো
আদর নিও—
ইতি
তোমার
ফালতু লোক
নিশি
একেকদিন ভর দুপুরবেলা আমাদের পাড়ায় গরিব মহিলার ছদ্মবেশে
নিশি আসে। হয়তো তখন খেতে বসেছি, আর সে দরজায়-দরজায় ‘মাসিমা—
গো-ও, ও মাসিমা-আ, দুটি ভাত দাও-ও’ বলে আর্তনাদ শুরু করে।
যতই টিভি-র আওয়াজ বাড়াই, তার সেই বুকচেরা ‘মাসিমা’ ডাকের
হাত থেকে রেহাই নেই। একসময় সে ডাকতে-ডাকতে ক্ষান্ত হয়, বুঝতে
পারে এই অসময়ে কেউ তার ডাকে সাড়া দেবে না। তারপর সারা পাড়া জুড়ে
দাপিয়ে বেড়ায় আর বড়লোকরূপী মধ্যবিত্তদের যা নয় তাই অশ্রাব্য
গালিগালাজ করতে থাকে। একবার মনে হয় বেচারিকে ডেকে, শান্ত করে,
দুটো ভাত, দশটা টাকা দিয়ে দিই। পরক্ষণেই ভয় হয়। প্রচণ্ড ভয়।
ওর ডাকে যে সাড়া দেবে, হয়তো তার প্রাণ ভাতে বন্দি করে নিয়ে চলে যাবে
নিজেদের পাড়ায়, এক হপ্তা খেতে না দিয়ে ছেড়ে দেবে এরকমই গরম দুপুরে,
বাড়ি-বাড়ি ভাত ভিক্ষার জন্যে…
যদি তারে না-ই চিনি
সকালবেলা রিকশা চেপে লেপ পৌঁছে দিয়ে আসছি
প্রিয় কবির বাড়ি
সন্ধে থেকে গান-কবিতা-পান-জর্দা-ভদকা-রাম-তাড়ি
তিনদিনের মহাপৃথিবী।
ছোট আলাপ। দু’খানা বই দিতে পেরেছি প্রথম সাক্ষাতে
আমায় তুমি চেনো না ভাল। এই আমিই কলকাতায়
সাপের ছাল বিক্রি করি রাতে।
এই আমিই বিটনুনের গন্ধ থেকে নেশা বানাই
বারুদ ঘষে তৈরি করি আবির
বোকার মতো উঁচুতে ছুড়ে লুফে নেবার চেষ্টা করি চাবি
এই আমার বুক পকেটে সবাই বসে দিন গুনছে
কবে আমার কবে আমার হা হা
নেট দিইনি স্লেট দিইনি ভেট দিইনি কাউকে, তাই
নাচগানের আড়াল থেকে আস্তে করে ডুবে যাচ্ছে হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়া জাহাজ…আমি
মরণকূপে ঝাঁপাব! দেখি, সরো—
দোতলা বাড়ি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াই সারাশহর
দু’কাঁধে দুই হাওয়া বাতাস
পায়ের নীচে আকাশ জড়ভরত
গায়ের রং কালোসবুজ। লম্বা চেরা জিভ নাড়ালে
কবিতা নয়, হিসহিসানি বেরোয়!
বাইরে থেকে খুব লাজুক, চোয়ালে বিষ জমছে আমাদেরও…
রক্তমাখা দরখাস্ত দলা পাকিয়ে ঘুরে মরছে চপার দিয়ে কাটা হাতের চেটো—
কলকাতায় কখনও যদি, যদি কখনও দেখা হয়
তুমি আমায় চিনতে পারবে তো?
সংসারগীতিকা-২
আঃ মির্চি!
উঃ মির্চি!
দিনরাতভর
স্পুটনিক। চিল।
ছিমছাম ফ্ল্যাট
লোকজন নেই
এই অ্যাদ্দুর
ওর জন্যেই
টেনশান, ঝাড়
রাত বরবাদ
প্রেম ছারখার
দাঁতচুলবুক
স্তনলোমপিঠ…
সঙ্গম নেই
কন্ডোম। পিল।
আজ নয় কাল
প্যাক্সাম। ব্লেড।
বিষ হয়তো…
এক চামচে
নয় হস্টেল
লোকজন। কেস।
জিভ জ্বলছে…
চোখ জ্বলছে…
উঃ মির্চি!
আঃ মির্চি!
সব পথ শেষ
সব পথ শেষ
স্পুটনিক ছাই
বাঁক নিক চিল…
বাঁক নিচ্ছি।
ভয়
ভয় দেখাচ্ছ? ভয় দেখাচ্ছ? ভয় খাব না।
হাত থেকে হাত পাল্টি খেয়ে পয়সা গোনা
পয়সা নিজেও সেয়ানা খুব। হেড টেল-এ তার
ফয়সালা চাই। পয়সা নাচায় শেখ। ছেলেটা
শেখের ঘোড়া ফুসলে পালায়…শক্ত লাগাম
দিনরাতদিন মায়ের গলায় রক্ত না গান
বাবার হাড়ে ঘুণপোকা। ঘুণ স্বপ্নজুড়ে
কাজ জোগাড়ের কর্মশালায় সব মজুরের
মজুরি নাই। তাও দয়াময় উপরি দিলেন
টিউশানিতে, কাব্যপাঠে, প্রুফ রিডিঙে…
তিনজনের চলে না তাতে। একার চলে।
সব দেখেছি তোমার দিকে দেখার ছলে
ছল শেখাচ্ছ? ছল শেখাচ্ছ? ছল কাকে হে—
হালকা অনেক ভেলকি আছে পলকা দেহে
একসমুদ্র নুন জমেছে অশ্রুকালীন…
দ্যাখ না কী হয়। দ্যাখ কীভাবে
আজ ভরাপেট
কাল আধাপেট
পরশু খালি…!
জুলাই
চোখের আর দোষ কী তেমন
গরমে পাথরও ঝলসায়…
এ বছর জুলাই মাসে
সে নাকি আসছে কলকাতায়।
আমাকে ট্যাক্সি করে
সে নেবে ধর্মতলার মোড়,
যদি খুব ভুল করি তো
দু’গালে আদুরে থাপ্পড়
মুখে তার আগুন বেশি।
বরাবর জল কিছুটা কম,
বিকেলের সূর্য যখন
দু’টাকার সস্তা আলুরদম—
সে তখন দৌড়বে খুব।
কী খপাৎ ধরবে আমার হাত
আমিও ছুট লাগাব,
বেপাড়ার ফেল করা সম্রাট
আমাকেও দেখবে লোকে,
কোনওদিন ঠিক সাড়ে পাঁচটায়
ধুলোঝড় ঠেকাচ্ছি আর
সে আঁচল লুটোচ্ছে রাস্তায়…
কবে দিন আসবে এমন
সে নেবে মুখের কাছে মুখ—
তারপর? সবাই জানে।
আমিও ক্যালানে, উজবুক
টিকটিকি এমন টকটকায়,
কবে কোন জুলাই মাসে
সে নাকি আসবে কলকাতায়
প্রেমপর্ব
খ্যাপা উলটো স্রোতেই সাঁতরায়
তার দু’মাত্রা তিনমাত্রায়
কিছু যায় আসে না আজকাল
তবু রং লাগানো কাব্যে
লোকে যা খুশি তাই ভাববে
কথা হবেই হবে পাঁচকান
তুমি টের পাও না সবটা
তাই কাজ সেরে ফি হপ্তা
যাও ক্লান্ত পায়ে কাকদ্বীপ
ওই শ্যাওলাজমা চত্বর
আর দোমড়ানো বইপত্তর
খুব চাইছিল কেউ হাত দিক
তার হাতে তো নখ, বিশ্রী।
তুমি বলছ ‘কেটে দিচ্ছি।
কই, নেলকাটারটা দিন তো—’
তাই এমনি কাটা যায় না
বদলে তার সঙ্গে তোমার জীবন কাটে
বিরক্ত, নিশ্চিন্ত।
উড়ন্ত সব জোকার
আকাশ বড় কৃপাসিন্ধু। ঝাকাস রোদে উড়ন্ত সব জোকার
বেকার ছিলাম অ্যাদ্দিন, আজ কাজ পেয়েছি গায়ের গন্ধ শোঁকার
নতুন-নতুন ছেলেমেয়ের শরীর কেমন গোছানো, ফুরফুরে
পাক ধরেছে দাবার ছকে, ডাক পড়েছে যাবার, দূরে-দূরে
ট্রাম-বাসে খুব ঝক্কি। তাও লক্ষ্মীছেলের ভাব করে ভিড় ঠেলি
বাতাস বড় করুণাময়। সাতাশ বছর পাঁউরুটিতে জেলি
পার করে আজ হ্যামবার্গার। ঘ্যাম বেড়েছে শ্যামসোহাগি রাধার
ঘুম আসে না। বালিশ থেকে নালিশ জানায় রংবেরঙের ধাঁধা
জীবন তবু প্রেমদিওয়ানা। পাহাড়ি পথ…পিছু নিয়েছে পুলিশ…
এবং গাড়ি ধাক্কা খাবেই। স্বপ্ন ভাঙবে গম্ভীর আব্বুলিশ
উঠে দেখব ছাঁটাই হওয়া দেবদূতেরা জল মেশাচ্ছে বিষে
কিন্তু করার কিচ্ছুটি নেই। অ-এ অজগর ঘুমোচ্ছে কার্নিশে—
ঘুমোক। ওকে ডাকব না আর। রাখব না আর কারওর কোনও কথা
দরজাগুলো আটকাব আর ধাক্কাব আর পাক খাব অযথা
চলার পথে কলার খোসা। গলায় তবু কলার তোলা রোয়াব
রামছাগলের গামছা খোলায় ব্যস্ত থাকুক আমার যত খোয়াব
খেয়াল ঢাকুক ঠুমরি দিয়ে, দেয়াল ঢাকুক মিষ্টিপানের পিকে
কী ভাববে কে জানে, আমি কাব্যে নামাই বন্ধুর ছাত্রীকে
বেড়াল শুকোক ছাদের তারে। হাতের মুঠোয় ছুটে মরুক ইঁদুর
ছিটকে এসে জামায় লাগুক একের পর এক বান্ধবীদের সিঁদুর—
ভ্রুক্ষেপ করছি না। আমার প্রেমদিওয়ানা জীবন তো ঝকমকে,
উড়ন্ত সব জোকার, তাদের নোংরা পালক ছড়িয়ে আছে রকে…
আস্তে-আস্তে কুড়োই, কিন্তু ফুরোই না এই অসভ্যতার খেলায়
সিঁড়ির মুখে বিড়ি ধরাই, ছিরির লড়াই গুরুতে আর চ্যালায়
ধুশ্শালা-সব ফালতু। ওসব ধান্দাবাজির বান্দা আমি নই
মুখের ওপর দরজা বন্ধ, বুকের ওপর উলটে রাখা বই…
দিনের পরে দিন যে গেল একইরকম বৈশাখে-আশ্বিনে
আবার ভাবি মদ খাব না। আবার গড়াই ভদকা থেকে জিনে
মন্দেভালয় সন্ধে কাটে। সকাল থেকেই চলছে ঢুকুঢুকু
ব্যাঙ পালাল ছিপ হাতিয়ে, ঠ্যাঙ তুলেছে নিজের পোষা কুকুর
কিন্তু আমি খুব ঘুমোচ্ছি। দু’চোখ থেকে খসে পড়ছে তারা
ঘুমের ভেতর মুখ বাড়াচ্ছে গোটাদুয়েক খাপছাড়া চেহারা
‘জীবন কিন্তু প্রেমদিওয়ানা, সাবধানে তার গায়ের গন্ধ শুঁকো-,
বলছে আমায় উড়ন্ত দুই পাগলা জোকার— দেরিদা আর ফুকো।
শকুন, পিশাচ, উড়ুক্কুমাছ
স্বপ্নে দেখা শকুন, পিশাচ, উড়ুক্কু মাছ
কাচবসানো লেপের তলায় ঠান্ডা দু’মাস…
তারপরও তার মুখের গন্ধ, হাতের ছোঁয়া
হঠাৎ-হঠাৎ চুল ঝাঁকিয়ে ‘অসহ্য’ আর
‘বেশ করেছি’ মনে পড়ছে। স্বপ্ন দেখি—
শকুন, পিশাচ, উড়ুক্কু মাছ সব মজে ক্ষীর
ক্ষীরের ওপর কাজুবাদাম ছড়িয়ে আমি
কাচবসানো লেপের তলায় এক পিরামিড
মিথ্যে সাজাই। সত্যি নিয়ে ব্যাবসা করি
নানারঙের টালবাহানা, গম, আকরিক
বিক্রি করে পেট চলে। আর পেটের ভেতর
হাত নাড়াচ্ছে, পা নাড়াচ্ছে, বাড়ছে, সে তো
এক পিরামিড মিথ্যে ভেঙে জন্ম নিয়ে
অবাস্তবের মাথার ওপর বনবনিয়ে
ঘুরতে থাকবে…ঘুরতে থাকছে…ঘুরছে তো আজ!
শকুন, পিশাচ, উড়ুক্কুমাছ সরিয়ে খুঁজছে মুখের গন্ধ, হাতের ছোঁয়া…
রসদ
বিন্দুমাত্র ভয় নেই। ইন্দুমাত্র উঠেছে আকাশে
সিন্ধুমাত্র জল, তাতে দিনদুয়েক চান করা যাবে
তারপর রহস্য শেষ। রেশনের চাল মাসে-মাসে…
সুরায় ফুরাবে ইচ্ছা (সে নেহাত পাত্রের অভাবে)
তবু তো হোটেল খোলা, বন্ধুদের ডানায়-ডানায়
ঘুরে ফিরে খাওয়া চলবে, ট্যাক্সি চড়া, দেরি করে বাড়ি…
হা কবি! অধিক রাতে যে-পাঠিকা মুগ্ধতা জানায়
কোন মুখে জানাবে তাকে, নিজে কত আওয়ারা, আনাড়ি
তাও যদি নার্গিস জুটত। ‘হারগিস পা দিবি না ও পথে!
এখনও ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাচ পুরনো প্রেমের
নিজে বেঁচেবর্তে থাক, বাপ-মাকে শান্তি দে কোনওমতে’—
এই অব্দি স্বপ্নাদেশ। আধো ঘুমে আরও ঢের-ঢের
লজ্জা-মল-দ্বিধা-মূত্র-ভয়-কফ পরীক্ষার ত্রাসে
সে হঠাৎ উঠে বসে। নিজেকে সাহস দেয়। ভাবে,
বিন্দুমাত্র ভয় নেই। ইন্দুমাত্র উঠেছে আকাশে
সিন্ধুমাত্র জল, তাতে দিনদুয়েক চান করা যাবে…
ইমেজ
এক-আধদিন দুঃখ টুঃখ হয়, মদ টদ খাই, ভাবি বাড়ি আর ফিরব না।
কিন্তু বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ধরি। টিউশানির পয়সা…চাকরি মন দিয়ে খুঁজি না…
যদি পেয়ে যাই…! ঢেকুর উঠছে। কতরকমের দুঃখ মানুষের। এইসব নিয়ে লিখব
ভাবি। ট্যাক্সি সিগন্যালে দাঁড়ায়…ফুটপাতে তরুণ দোকানির সঙ্গে সস্তা ব্রা নিয়ে
দরদাম করছে মলিন বউ…সেও এক ইমেজ। কোনও বন্ধুর বাড়ি গিয়ে হুজ্জোত
করতে পারলে ভাল হত কিনা বুঝতে পারছি না। আবার ঢেকুর উঠছে। সিগন্যাল
ছাড়ল, একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব, কিন্তু জানলার কাচ নামিয়ে ফেলেছি। ভাবছি
বমি হবে, হচ্ছে না। ভাবছি এই বুঝি প্রেম হবে, হচ্ছে না। তা হলে বোধহয় স্মৃতি
হবে, হচ্ছে না। শুধু পেটের মধ্যে হাজার-হাজার কথা আর মদের জবরদস্ত
কামড়াকামড়ি…সেই বাড়িই ফিরছি। বাবা-মা বাইরে গেছে…গলির মোড়ে
টলছি…এগোচ্ছি…পাড়া চুপচাপ…আমাদের বাড়ির ফোনটা রিং হয়ে যাচ্ছে…
এও এক ইমেজ।
প্রেমপর্ব-২
যেহেতু গত কয়েকবছর ধরে আমার জীবনে সরাসরি কোনও প্রেম নেই,
এই ব্যাপারটার সুযোগ নিয়ে মাঝেমধ্যেই আমি একটা মজার খেলা
খেলি। প্রাচীন, সরলমনা এক বান্ধবীর বাড়িতে বছরে দু’-তিনদিন
হন্তদন্ত হয়ে হাজির হই আর গম্ভীর মুখে তার কাছে আমার প্রেমের
গল্প ফেঁদে বসি। কিন্তু সেই প্রেম কখনওই নিশ্চিন্ত নয়। কখনও মেয়েটি
আমার চাইতে বয়েসে বড়, কখনও ছোট কিন্তু মুসলিম, আবার কখনও
সমবয়সি কিন্তু বিবাহিতা…এইরকম সব ঝামেলা। এও বলি যে এইসব
ব্যাপার নিয়ে আমার ও মেয়েটির বাড়িতে প্রচণ্ড গণ্ডগোল, কারওরই কোনও
কাজে মন বসে না, কী যে হবে কে জানে, ইত্যাদি। আমার বান্ধবীটি
ঝামেলার গন্ধ পেয়ে আরও কৌতূহলী হয়ে ওঠে, আমার প্রেমিকার
কথা সবিস্তারে জানতে চায়, আমিও যখন যেমন পারি বর্ণনা দিই,
শুধু খেয়াল রাখি, আগের বারের গল্পের সঙ্গে যাতে মিলে না যায়।
শেষমেশ আমার বান্ধবীটি সহানুভূতি জানায়, বলে, সবরকমের
অসুবিধেয় সে সাধ্যমতো সাহায্য করবে…আর প্রতিবার তার বাড়ি
থেকে আমি আরও হালকা, ফুরফুরে হয়ে ফিরে আসি এই ভেবে, যে
আমার কাছে না হোক, কারও কাছে অন্তত আমার জলজ্যান্ত, আস্ত
একটা প্রেমের অস্তিত্ব আছে।
এই শহর, এই সময়
নিয়মমাফিক
কলকাতায় নিয়মমাফিক সন্ধে হলেই
পাথর নেমে আসবে বুকে, সন্দেহ নেই।
আবার সকাল। রেলিং ছুঁয়ে লাফ দেয় রোজ
খবরকাগজ…খবরকাগজ…খবরকাগজ…
খবর পড়ে ছিটকে ওঠে মুন্ডুমাথা
পানাপুকুরে খুঁজে বেড়ায় বেকারভাতা
পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, সে তার নিজের ব্যাপার।
কে আর অত হিসেব রাখে, ইচ্ছেখ্যাপার।
জন্ম কোথায়, মৃত্যু কোথায়, কোন তারিখে…
লাশকাটা ঘর উপচে পড়ে রাতের দিকে
কিন্তু সবই মানিয়ে নেওয়া এই শহরে
সেসব লাশই কাজে বেরোয় পরের ভোরে
এসব কথা সত্যি কিনা, মক্ষিরানি,
তোমার কাছে জানতে চাইলে, আমিও জানি,
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে তুমি আলতো স্বরে—
‘ওয়েল, সেটা তোমার ওপর ডিপেন্ড করে…’
আজকাল
তেমন কিছুই হচ্ছে না আজকাল
খবরকাগজের পাতায় বাঘ বেরোচ্ছে, মানুষ মারছে,
ফিরে যাচ্ছে অপাঠ্য জঙ্গলে…
গঙ্গাফড়িং দেখলে লোকে চিনতে পারছে গঙ্গাফড়িং বলে।
ও কলকাতা
প্রেম আসে না আজকাল। তাও বৃষ্টি এল
জানলায় ছাঁট, অল্প ভিজে লেখার খাতা…
সবাইকে খুব চমকে দিয়ে দিনদুপুরে
বৃষ্টি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে এল। ও কলকাতা,
তোমায় নিয়ে ভিজব চলো, চাই না আমার
জল থেকে যে আড়াল করে এমন ছাতা
এখন কোনও ঘটনা নেই খবর নেই সময় নেই
দৌড়। শুধু দৌড়ে মরা ব্যস্ততা
সুতোর টানে উঠছে আর নামছে আর উঠছে—
সাপ হয়ে জন্মালেও বুক ঘষটাত
দশতলা ফ্ল্যাট, লিভিংরুমে আবছা আলো অন্ধকার
অনেক উঁচু ছাই জমেছে অ্যাশট্রেতে…
আগন্তুক
এই শহরে প্রতি মিনিটে রক্তচাপ বাড়ে
অন্ধদের চোখ বিক্রি হয়
ভিড়ের কোনও চরিত্র নেই। চরিত্রের ভিড়ে
পিষে যাচ্ছে একদলা সময়
এই সবই তার শোনা কথা। ঘিঞ্জি বুথে ঢুকে
বন্ধুদের নাম খুঁজছে পুরনো সব ডিরেক্টরির পাতায়—
ট্যাক্সি তাকে নিয়ে যাচ্ছে অচেনা গলিতে, সে
এই প্রথম এসেছে কলকাতায়।
রাস্তা জ্যাম। বাসের লোক যে যার মতো কথা বলছে
তর্ক করছে নানারকম ছুতোয়
পথে নামছি। পকেটে হাত
মাথার মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছে, পাক খাচ্ছে, মরে যাচ্ছে
গুজব আর পালটা জনশ্রুতি
ইতিমধ্যে রাত নেমেছে। ফুসমন্তর পড়ে আমায়
নিয়ে যাচ্ছে ল্যাজঝোলা এক ভূতে—
পা ধুয়ে বিছানায় উঠছি…
ঘুম আসছে…
স্বপ্ন…
চটির নীচে লেগে রইল থুতু
ক্যুইজ
বাবা অচল। ক্লান্ত চোখে রুমাল বেঁধে মা আজ গান্ধারী
বেড়াতে যাওয়া দারুণ মজা। প্রতিনিয়ত খেলা চালাই
ধর্মতলা বনাম তালসারি
যেখানে যাও চাকামোটর কাটাশরীর দলামাংস
গরম রুটি, আলুর তরকারি
হঠাৎ সুর থামিয়ে দিয়ে অচেনা গলা জিগ্যেস করে—
‘বলো তো, কোন গানের সঞ্চারী?’
প্রশ্ন করবেন না আর। এই শহরে আমরা বড়জোর
পেচ্ছাপের গন্ধ শুঁকে বলতে পারি পুরুষ নাকি নারী…
ওপরচালাক
লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে দাঁড়িয়ে গেছে অভ্যেসে
নতুন কোনও শব্দই আর ভরসাযোগ্য হচ্ছে না
চশমা চোখে ওপরচালাক, কার কাছে আর ঠকবে সে
অনেকগুলো লোকের মধ্যে একটা-দুটো লোক চেনা
তারাও কেমন হাত মেলাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে স্রোত ঠেলে
একপারে যার চায়ের দোকান, অন্যপারে ফ্ল্যাটবাড়ি
সেই খোলাচুল…বৃষ্টি…দৌড়…না, মনখারাপ করতে নেই
ওসব সন্ধে নামতে পারে একজীবনে একবারই
এখন বরং খেলতে শেখা শয়তানিরং সাপলুডো
কেমন করে দেখাতে হয় থুতুর সঙ্গে রক্তপাত
ভেতর-ভেতর ড্রিলার চলছে, বাইরে তবু আপ্লুত
কলকাতার বুকের ওপরে উড়ালপুলের অক্টোপাস
ট্যাক্সি-অটো-ট্রাম-মিনিবাস যে যার মতো লাশ টানে
গড়িয়াহাটে, ধর্মতলায় উগরে ফ্যালে সান্ধ্য ভিড়
অবাক আমি দাঁড়িয়ে দেখি কোথাও যাবার রাস্তা নেই…
অনেকগুলো বাড়ির মধ্যে একটা বাড়ি বান্ধবীর
ল্যাঙটো
ভয় পেও না, ভালর জন্যে বলছে ওরা।
লজ্জা-শরম একধরনের আপদ, ঠিকই
এই নাও। এই জামা খুললাম, প্যান্ট খুললাম—
তোমার সামনে ল্যাঙটো হতে আপত্তি কী?
আজকাল তো সবার সামনে ল্যাঙটো হচ্ছি।
খুঁটিয়ে সবাই দেখছে ওটার চামড়া, ওজন
দাঁড়ালে ঠিক ক’ইঞ্চি হয়, মাটির সঙ্গে
ক’ডিগ্রি কোণ তৈরি করে…আমরাও জোর
মস্তি করব অস্বস্তিতে গা ভাসিয়ে
চলো, এবার লাগিয়ে সব ফাঁক করে দিই—
আপত্তি কী, আমার সামনে ল্যাঙটো হতে?
প্রমাণ খতম। বদলে সব সাক্ষ্য রেডি।
উদাস মুখে বলবে তারা ‘কিচ্ছু হয়নি।
এই মুহূর্তে, হ্যাঁ জজসাহেব, কেস তুলে নিন—’
আবার আমরা ঘরে ফিরব। আবার আমরা
সন্ধে হলেই ফ্রয়েডরাধা, কেষ্টলেনিন
লড়িয়ে দেব। বিপ্লবী আর দার্শনিকের
খুনসুটিতে রাত পোহাবে। দরজাতে ভোর…
কিন্তু আমরা জামাকাপড় পরব না আর
সারাজীবন ল্যাঙটো থেকে লজ্জা দেব!
সংসারগীতিকা-৩
মাঝরাতে এক চোরের প্রেমে পড়ে
ঘর ছেড়েছে রঙিন আমার বউ
বলতে হবে তালিম পাওয়া ঘোড়েল
ডালিম গাছে স্টক করেছে মউ
সেই ডালিমের ডাল বাঁধা ইমনে
মা কড়ি, তাই বাবা হলেন কানা
তিন ননদের ছায়ার দাম অনেক
চার দেওরের মগজ লাইনটানা
টানা না আটানা, বলা বারণ।
মোটকথা সে সংসারী ছিল বেশ
ভেতরে এক বেড়াল ছিল তারও
অ্যাদ্দিনে সে আস্ত মাছের লোভে
আকাশ জুড়ে চমকাল ফিনাইল—
দমকা লোকের শঙ্কা পেল নিজে
আয়না ভেঙে ছড়িয়ে গেল স্মাইল,
বায়নাগুলো আটকাল ডিপফ্রিজে
ফ্রিজের আলো ঠান্ডা, বেহুঁশ, সাদা
মাঝরাতে এই ফ্ল্যাটবাড়ি ছমছমে…
দুঃখে দু’পেগ, সঙ্গে জমবে বাদাম
ভয়ে যেমন ভূতের গল্প জমে।
গল্প না কল্পনা, বলা বারণ।
ব্যাস, এটুকুই টানটান খবর—
সব পৃথিবীর সব ফ্ল্যাটে সব আরও
বউ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে চোর…
জাজমেন্ট ডে
এসো আমরা তুর্কি নাচি
আজ রাতই ফাইনাল
সুযোগ পেলে জমিয়ে দিতাম কাল
এসো আমরা দুধ খেয়ে নি
স্টক থাকবে, কিন্তু অফার শেষ।
এই করেছ ভাল হে দরবেশ—
এসো আমরা বুদ্ধি বাড়াই
চোর পালালে সাজিয়ে বসি দাবা
তিন চালে রাত কাবার
কাল ভোরে ঝামেলা
দুঃসময় সৌরজগৎ কুড়মুড়িয়ে খাবে
(খাদ্যের অভাবে)
এসো আমরা ঘুমোই একটু
এই শেষবার জড়ামড়ির অসহ্য আহ্লাদ
পায়ের নীচে ফালতু মাটি,
মাথার ওপর টেম্পোরারি চাঁদ…
রওনা
কান খোঁচাচ্ছে ঝলসানো দুর্বুদ্ধি
কপাল ফেটে তৈরি হচ্ছে পুবদিক
চোখের জলের কাহিনি একগণ্ডূষ
পেছনে চোখ উপড়ে নেওয়া বন্ধু…
সামনে রাস্তা। জল আগুনের কেচ্ছা
অন্ধকে পথ বাতলে দিচ্ছে বেশ্যা
তারও পরে ছুরিকাঁচির জঙ্গল
অন্ধকার দোকান। নিঃসঙ্গ
কুপি জ্বলছে। রাত না হওয়া সন্ধে
কোন বস্তি…কোন শহর…কোন দেশ…
জানি না। নাম হয় না। শুধু সংখ্যা।
নখের ডগা শুকিয়ে এখন কঙ্কাল
জানলা হাঁ মুখ। দেয়াল ভর্তি সাপখোপ…
নতুন বাড়ি, নতুন করে থাকব।
তুমি জানো
আকাশে টাঙানো আছে দ্রুত পায়চারি
মেঝেয় ছড়ানো কারও শ্রান্ত বসে পড়া
একযুগ পিছিয়ে গিয়ে তুলে আনতে পারি
পঙ্ক্তির আড়াল থেকে লেখার মহড়া
হয়তো আমাকেও লিখতে দেখেছে অনেকে—
সকাল, দুপুর কিংবা রাতজাগা ভোর…
আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি এতদূর থেকে