শায়িত বল্লম

শায়িত বল্লম

আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। বঙ্গোপসাগরের কোথাও নিম্ন চাপ। হঠাৎ আবহাওয়ায় একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন। নভেম্বরের উজ্জ্বল দিনে বাদলা শীতের কাঁপুনি। ছেঁড়া খোঁড়া মেঘ আকাশময় এলোমেলো ঘুরছে ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়ার টুকরোর মতো। লম্বা লম্বা গাছগুলো প্রবল দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। রিকশা-অলা বলল—‘হুডটা খুলে দিই বউদি। হাওয়ায় টানতে পারছি না নইলে।’

—‘বৃষ্টি এলে?’

—‘সে তখন দেখা যাবে। তার আগেই আপনাকে ঠিক পৌঁছে দেবো।’

ট্রেনে ওঠার পর বৃষ্টি এলো। কোনদিকে ছাট বোঝা যায় না। ঘুরন্‌ হাওয়ায় উত্তর-দক্ষিণ পুব-পশ্চিম সব দিক থেকে ধারালো বৃষ্টির কুচি ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনের জানলায় ঠোক্কর মারছে। সব বন্ধ। কাচের পেছনে খড়খড়িগুলোও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। একে আজ বাচ্চাদের স্কুল বাস ছাড়ে নি। বর্ধমান পর্যন্ত লিফ্‌টটা পাওয়া গেল না। তার ওপর হঠাৎ এরকম দুর্যোগ। মনে হচ্ছে আজ আর পৌঁছনো যাবে না। অথচ আজই একটা ক্লাস টেস্ট নেওয়ার কথা।

স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছতে কাক-ভিজে। বৃষ্টির ঝাপটায় ছাতা উল্টে গেছে। বাস থেকে নেমে স্কুলে আসতে ওইটুকু রাস্তাই ভিজিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। দেরি হয়ে গেছে। ক্লাসের বাচ্চাগুলো খুব হই-চই শুরু করে দিয়েছে। মিসকে ভিজে কাক দেখে ওদের চিৎকার বেড়ে গেল। আনন্দ হয়েছে খুব। ব্রততী হেসে ফেলল। তারপরই হাঁচি। চোখ নাক লাল করে স্টাফরুমে ঢুকতে বেলাদি বললেন—‘আমার কেজ-এ ভাগ্যিস শাড়ি-টাড়ি রাখা থাকে। তুমি চট করে পাল্টে নাও। নভেম্বরের বৃষ্টি। জ্বর হল বলে। বাড়ি গিয়েই একটা অ্যাকোনাইট থ্রি খেয়ে নেবে। দিনে তিনবার।’

ব্রততী বলল—‘কেন বেলাদি, রাস-টক্স নয়? আমরা তো বরাবর রাস-টক্সই খেয়ে এসেছি।’

—‘উঁহু। ওসব সাট্‌ল ডিফেরেন্স আছে ভাই। নর্থ উইন্ড আরম্ভ হয়ে গেলেই অ্যাকোনাইট।’

মাধুরীদি বললেন—‘ঠিক বলছ না বেলা। বৃষ্টি, সে যে সময়েরই হোক না কেন, রাস-টক্স।’

হোমিওপ্যাথি নিয়ে এই বাদ-প্রতিবাদের মধ্যেই ব্রততী জামা-কাপড় বদলে এলো। ক্লাসে গিয়ে সব প্রশ্নগুলো বোর্ডে লেখা শেষ করেছে, বেয়ারা এসে স্লিপ দিল— ’ ‘প্রিন্সিপ্যাল ডাকছেন।’

বাচ্চাগুলোকে লিখতে বসিয়ে ক্লাস ক্যাপটেনকে ওদের চুপ করিয়ে রাখার দায়িত্ব দিয়ে প্রিন্সিপ্যালের ঘরে গেল ব্রততী। সামনে বসে থাকা ভদ্রলোককে দেখিয়ে প্রিন্সিপ্যাল বললেন—‘এই দ্যাখো তোমার কাজিন আবার কি খারাপ খবর নিয়ে এলেন!’

ব্রততী দেখল ফোলা ফোলা চোখ, চ্যাপটা নাক, খাদির পাঞ্জাবি ট্রাউজার্সের ওপর। উড়ো চুল। চেনা। কিন্তু কস্মিনকালেও কাজিন নয়। ওদের নিজেদের মধ্যে লোকটির নাম ছিল জিরো জিরো সেভ্‌ন। সবচেয়ে ধূর্ত। করিৎকর্মা, বলতে গেলে অদ্ভূতকর্মা পুরুষ সি আই ডিদের মধ্যে। সে সময়ে অনেক অল্প বয়স ছিল, নিজের বয়সের ছেলেমেয়েদের ধরতে যে তৎপরতা দেখিয়েছিল—বিস্ময়কর। নিয়মিত মিটিং-এ আসত। কেউ কোনোদিন বুঝতে পারেনি। নাম—অতনু সরকার।

বলল—‘স্ট্রোকটা মা কোনমতে সামলেছেন, মনে হয় এই শেষ বিবি। আমি গাড়ি নিয়েই এসেছি, দিদিকেও তুলতে হবে।’

সন্ধানী চোখ রাখল বিবি ওর ফোলা ফোলা চোখে। ওর চোয়াল কঠিন হয়ে আবার আস্তে আস্তে নরম হয়ে এল, বলল—‘চলুন।’ প্রিন্সিপ্যালের দিকে তাকিয়ে বলল—‘আমি আর তাহলে সই করছি না। আজকের দিনটা সি এল নিয়ে নিলাম।’

প্রিন্সিপ্যাল বললেন—‘ওসব তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি যাও মাসিমাকে দেখে এসো।’

স্কুলের বাইরে বেরিয়ে অতনু সরকার বলল—‘ওদিকে গাড়িটা রেখেছি। রাস্তা পার হতে হবে। চলুন।’

—‘কোথায়, লালবাজার?’

—‘না মিসেস মুখার্জি, গাড়িতে যেতে যেতেই কয়েকটা জরুরি জিজ্ঞাসাবাদ সেরে ফেলব। কোনও ভয় নেই।’

ব্রততী হাসল। কঠিন, নিষ্প্রাণ হাসি। অতনু সরকার অভয় দিচ্ছে। তাকে।

মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল অতনু। গাড়ির দরজা খুলে বলল—‘সামনেই বসুন, নইলে কথা বলতে অসুবিধে হবে। কথাবার্তা হবে শুধু আপনার আর আমার মধ্যে, ড্রাইভার আনি নি তাই।’

ব্রততী গুছিয়ে উঠতে উঠতে বলল—‘টেপটা কি সামনের দিকেই ফিট করা?’

অতনু জবাব না দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে চৌরঙ্গিতে পড়ে গাড়ি রবীন্দ্রভবনের দিকে গেল। উল্টো দিকে হস্তশিল্পের মেলা হচ্ছে। রাস্তা ভিজে। বৃষ্টি থেমে গেছে। অতনু বলল—‘মেলায় যাবেন?’

—‘জিজ্ঞেস করছেন কেন? আদেশ করুন।’

—‘যা বলেন। তবে আপনাকে আদেশ করবার আগে একবার ভাবতে হয়।’

ব্রততী নেমে দাঁড়াল। অতনু টিকিট কেটে আনতে ভেতরে ঢুকল। মেলায় তেমন ভিড় নেই। একেবারে ফাঁকাও নয়। অতনু বলল—‘মেলার মধ্যে আমরা সত্যিকার নিরাপদ, মিসেস মুখার্জি। আপনার কথায় মনে হল গাড়িটা সত্যিই বাগড্‌ হতে পারে। পরীক্ষা করে দেখাটাও আমার পক্ষে বিপজ্জনক। আমার ওপর লক্ষ্য রাখবার জন্যে যাকে মোতায়েন করা হয়েছে, মেলার মধ্যে সে আমাদের কথা শুনতে পাবে না।’

ব্রততী বলল—‘কাদায় কাদা হয়ে আছে এ জায়গাটা। শুকনো জায়গায় চলুন।’ “আমরা” করে বলবেন না। যা বলার বলুন। ভনিতার প্রয়োজন নেই। কোনও গোপনীয়তার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।’

—‘স্কুলে তাহলে মাসতুত ভাই পরিচয়টা না দিলেও চলত বলছেন?’

—‘বলছি।’

—‘সি আই ডি তুলে নিয়ে গেছে জানলে চাকরিটা থাকত?’

—‘চাকরির দরকার নেই।’

—‘দরকার নেই জানি। এখন মা-ও আর নেই। বাপ্পাও দাঁড়িয়ে গেছে। মুখার্জি তো বেশ শাঁসালো লোক। কিন্তু বাচ্চাগুলোর মুখ দেখতে পাবেন না, কচিকচি গলার···’

কথা শেষ হল না। সপাটে একটা চড় এসে পড়ল অতনু সরকারের গালে। ব্রততীর থমথমে লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে অতনু বলল—‘করছেন কি মিসেস মুখার্জি? এখুনি লোক ছুটে আসবে যে! নেহাত মেঘলা দুপুর, বিশেষ কেউ লক্ষ করেনি···’

চার পাঁচটি মেয়ের একটা দল দুজনের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। ব্রততী বলল—‘আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আমি কিছুই গ্রাহ্য করি না আর। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।’

অতনু বলল—‘এভাবে রি-অ্যাক্‌ট্‌ করলে বলব কি করে? আপনাদের ওপর একটা চূড়ান্ত অন্যায় হয়ে গেছে বলেই আজ আমি একা এইভাবে আপনাকে মীট করতে এসেছি। ভুল করবেন না মিসেস মুখার্জি।···না আপনি ভালোই করেছেন। আমার ওপর যে লক্ষ রাখছে সে সম্ভবত এসে গেছে। আপনার চোখ মুখ এবং আচমকা চড় বলে দিয়েছে যে আপনার সঙ্গে আমার আঁতাত অসম্ভব।’

ব্রততী কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল, বলল—‘আপনি আমাকে থানায় নিয়ে চলুন। সেখানেই যা জিজ্ঞেস করার করবেন।’

অতনু পেছন পেছন যেতে যেতে বলল—‘পুলিস সুমন্ত সেনগুপ্তর হত্যার ব্যাপারে একটা নিজস্ব থিয়োরি খাড়া করেছে।’

—‘হত্যা?’ ব্রততী চোখে আতঙ্ক নিয়ে পুরো ঘুরে দাঁড়াল—‘কি বলছেন আপনি?’

—‘হত্যা নয়? বেশ তো যদি না-ই হয়, তাহলে দ্বিতীয় থিয়োরি তো একটা দরকার, নাকি? দুটো থিয়োরিই আমি আপনাকে কনফিডেনশ্যালি শুনিয়ে রাখছি। আপনার মঙ্গলের জন্য।’

‘বাহাত্তর সালের অক্টোবর মাসে শিমলিপালের জঙ্গলে এক পোচারদের গোপন আড্ডা থেকে সুমন্ত সেনগুপ্তকে যখন ধরা হয় বেঙ্গল পুলিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেও ফেলেনি। কারণ তারা ভাবেনি—শহুরে গেরিলাদের অন্যতম সেনানায়ক সেনগুপ্তর মুখ থেকে আদৌ কোন কথা বের করা যাবে। কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল ব্যাপারটা সোজা। দুদিন রাজার হালে রাখার পর তৃতীয় দিনে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করা হয়েছে কি হয়নি, সুমন্ত সেনগুপ্ত একেবারে কোল্যাপ্‌স্‌ করল। নকশাল গেরিলাদের যে যে ওর গ্রুপে ছিল সবার নাম ধাম এবং আর যা কিছু তথ্য গলগল করে বলে সুমন্ত সেনগুপ্ত অজ্ঞান হয়ে গেল। তার দেওয়া খবরের ওপর নির্ভর করেই প্রধানত বাদ বাকি নকশালদের রাউন্ড আপ করা হয়, যার মধ্যে ছিল শীর্ষ চক্রবর্তী, সৌম্য চক্রবর্তী এবং ছিলেন আপনি, বিবি।

‘আলিপুর সেন্ট্রাল থেকে সুমন্ত সেনগুপ্তকে কিভাবে স্মাগ্‌ল করে বাইরে একেবারে ইংলন্ডে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল, আজও আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, তবে ডি এস পি রণবীর বিশ্বাসের মেয়ের সঙ্গে সুমন্তর বিয়ে হয়েছে দেখে অনুমান করছি রণবীর সুমন্তর ধনী আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে অনেক টাকা খেয়েছিলেন। সেনগুপ্ত বিদেশেই থেকে যায়। বছর দেড়েক আগে তার কি যে দুর্মতি হল, ভাবল ছোটখাটো কোনও কনসার্নে কাজ করলে পূর্ব-পরিচিতদের কারো সঙ্গে দেখা হবে না। ‘কান্তিভাই ভুলাভাইয়ে’র বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লাই করল সে। ঠিক যেটা এড়াতে চেয়েছিল সেটাই ঘটল সুমন্তর কপালে। বিশ্বাসহন্তাদের এমনিই হয়ে থাকে। হবি তো হ? “কান্তিভাই ভুলাভাই”-এর ম্যানেজারের স্ত্রী জয়ন্তী রায় একদম প্রথম যুগের নকশাল। সম্ভবত মুন্নি বলে পরিচিত ছিলেন বিপ্লবী মহলে, অজ্ঞাত কারণে সেভেনটির মাঝামাঝি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এঁকে আইডেনটিফিাই করেছেন আমাদের ইনস্‌পেকটর ঘোষ দস্তিদার। উনিই বোধহয় একমাত্র মুন্নিকে চিনতেন গোড়ার দিকের বেশ কয়েকটা এনকাউন্টারে থাকায়। জয়ন্তী রায় এবং আপনারা সকলে সুমন্ত সেনগুপ্তর ওপর প্রতিশোধ নেবেন ঠিক করলেন। পরিকল্পনার মধ্যে ছিলেন জয়ন্তী রায় স্বয়ং, আপনি, মার্কেটিং ম্যানেজার ইন্দ্র চৌধুরী এবং সৌম্য ও শীর্ষ চক্রবর্তী। কি ঠিক বলছি?’

ব্রততী এতক্ষণ বজ্রাহত বৃক্ষের মতো সটান দাঁড়িয়েছিল। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল—‘আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, থানায় নিয়ে চলুন। এ প্রহসন আমার আর ভালো লাগছে না।’

অতনু বলল—‘মাইন্ড ইয়ু আমি কিন্তু প্রথম থিয়োরিটার কথাই বলছি এখনও’ আরেকটা থিয়োরিও আছে। আসুন, এই রেস্তোরাঁটাতে বসা যাক।’

একটা চেয়ার টেনে অতনু ব্রততীকে বসতে দিল। নিজে মুখোমুখি চেয়ারে বসে খাবারের অর্ডার দিল। বলল—‘সত্যি বলছি মিসেস মুখার্জি, আজকের দিনটা অতনু সরকারকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন না। হ্যাঁ, কি বলছিলাম? আপনি যাতে হাতের নাগালে পান তাই জয়ন্তী প্ল্যান করে আপনাদের দোতলায় কোয়ার্টার্স দেওয়ালেন সেনগুপ্তকে। সেনগুপ্ত-দম্পতি ভুলো স্বভাবের। আপনি আপনার স্বামীকে দিয়ে প্রস্তাব করালেন একটা ডুপ্লিকেট চাবি আপনাদের কাছে রাখার জন্য। কেমন? এরপর কয়েক মাস নিশ্চিন্ত। মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার-দাবার পাঠাতেন ওপরে, কাজেই সেনগুপ্ত নিশ্চিন্ত হয়ে গেল যে, আপনি আপোস করতে ইচ্ছুক। পারমিতা সেনগুপ্তর কাছ থেকে জানতে পারলাম আপনি মাঝেমাঝে সেনগুপ্তকে বাইরে মীট করতেন। আপোসের প্রস্তাব, ক্ষমা প্রার্থনা এগুলো নিশ্চয়ই ওই সময়েই হয়। মিসেস সেনগুপ্তর স্থির বিশ্বাস, আপনার সঙ্গে সুমন্তর এক্সট্রা-ম্যারাইট্যাল লাভ অ্যাফেয়ার চলছিল। উনি জানেন না সেনগুপ্ত আপনার অতীত। বর্তমান নয়।’

ব্রততী এবার উঠে দাঁড়াল, রুদ্ধ স্বরে বলল—‘মিঃ সরকার, আমি আর বসতে পারছি না। আপনাদের তৎপরতা, কল্পনাশক্তি, নির্বুদ্ধিতা, অহঙ্কারের সীমা নেই।’

অতনু বলল—‘বিবি, আপনি সাঙ্ঘাতিক ভুল করছেন। পুলিসের থিয়োরিটা আমি পুরোপুরি আপনার কাছে ফাঁস করে দিচ্ছি, এতেও কি আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি শুধু পুলিসই নই। মানুষও। এইবারে পুলিসি কল্পনার সবচেয়ে সঙ্কটময় বিন্দুতে আপনাকে নিয়ে আসছি। চুপ করে শুনুন। বসুন আগে।’

ব্রততী হতাশের মতো বসে পড়ল। অতনু বলল—‘এইবার মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল আপনার দুই ভাইয়ের। শনিবার মাঝরাত্তিরে আপনার কাছ থেকে সেনগুপ্তর ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে ওরা দুজন ওপরে গেল। ইন্দ্র চৌধুরী বাইনোকুলর নিয়ে সেনগুপ্তর ফ্ল্যাটে চোখ রেখেছিল। সে ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হল। খুব শক্তিশালী বাইনোকুলর পাওয়া গেছে ওর ফ্ল্যাটে। সুমন্ত তখন কিছু একটা লিখছিল। সম্ভবত আপনাকে চিঠি। পেছন থেকে সৌম্য গিয়ে ওকে গ্যাগ করল, শীর্ষর ভোজালির আগায় সুইসাইড নোট লিখল সুমন্ত। তারপর তাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে বাকি কাজগুলো সেরে ফেলল সৌম্য। মেন সুইচ অফ এবং অন করে ওদের নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিল হয় ইন্দ্র চৌধুরী নয় বিবি আপনি।’

ব্রততী বলল—‘সুমন্ত সেনগুপ্ত তাহলে একটা মাটির পুতুলের বেশি না! সৌম্য চক্রবর্তী যা করাল, করে গেল? ধ্বস্তাধ্বস্তি না, কিচ্ছু না।’

—‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন বিবি, সৌম্য চক্রবর্তী অসাধারণ বলশালী, খানিকটা ধ্বস্তাধ্বস্তি নিশ্চয়ই হয়েছে। সামলাবার জন্যে আপনি ছিলেন, না ইন্দ্র ছিলেন বলা শক্ত।’

—‘এই অসাধারণ থিয়োরি কোর্টে গিয়ে প্রোডিউস করুন’—ব্রততী উঠে দাঁড়াল। অতনু বলল—‘সৌম্য আর শীর্ষ চক্রবর্তীর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে সেনগুপ্তর বাড়ির হলঘরে। যদিও চেয়ারটায় বা সুইচ বোর্ডে পাওয়া যায়নি। নিশ্চয়ই হাতে দস্তানা-টস্তানা ব্যবহার করেছিল।’

—‘ও, হলঘরে দস্তানা পরল না। বেডরুমে ঢুকেই পরে নিল? চমৎকার। সামান্য একটু শকেই তো নির্বিঘ্নে কাজ সমাধা হত। এতো রিস্‌ক্‌ নিয়ে এভাবে এগোবার দরকার কি ছিল?’

—‘আপনার বুদ্ধি চিরকালই পরিষ্কার,’ অতনু অ্যাশট্রের ওপর সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল—‘ওইটেই পুলিসকে ভাবাচ্ছে। আরও একটা জিনিস। মনে হচ্ছে, সুমন্ত সেনগুপ্ত সেদিন সাঙ্ঘাতিক ডিসটার্বড্‌ ছিল। এতো সিগারেট খেয়েছে যে অ্যাশট্রে উপছে, মেঝেতে পড়ে কার্পেট ফুটো হয়ে গেছে। বেড সাইড-টেবিলেও স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে সিগারেটের টুকরো। সাইড-টেবিলের ওপর একটা লম্বাটে চৌকো দাগ। নোটবই কিম্বা ছোট লেটার প্যাড সাইজের। ঠিক কি বস্তু সেটা বোঝা যাচ্ছে না। জিনিসটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সুইসাইড নোটটার পেছনে বারবার বিবি বিবি লিখে কেটে দেওয়া দেখে অনুমান হয় ওটা আপনাকে লেখা কোনও চিঠি। পরের দিন মৃতদেহ আবিষ্কার তো আপনিই করেছেন, সরিয়ে নিয়েছেন জিনিসটা।’

ব্রততী উঠে দাঁড়াল। পেছন ফিরে চলতে চলতে বলল—‘কোর্টে এসট্যাবলিশ করবেন ব্যাপারটা। এবার আর আমরা ভিখারি নই। ভালো ব্যারিস্টার দিতে পারব।’

হতভম্ব ওয়েটারের হাতে কুড়ি টাকার একটা নোট ফেলে দিয়ে হন্তদন্ত অতনু সরকার ব্রততীর পেছন পেছন প্রায় দৌড়লো।

—‘দাঁড়ান, মিসেস মুখার্জি। বাপ্পা বাচ্চুর হাতের ছাপ তাহলে এলো কি করে সেনগুপ্তর ঘরে? ইনভেস্টিগেশনের সময়ে ওরা পালালো কেন?’

ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো ফিরে দাঁড়িয়ে ব্রততী এবার চাপা গলায় বলল ‘—ওই ঘটনার পর, শীর্ষ চক্রবর্তীর নার্ভের অবস্থা আপনারা যা করেছেন, তাতে করে তার আর ওখানে থাকা চলত না। সুমন্ত সেনগুপ্তকে বাচ্চু নিজের দাদার চেয়েও ভালোবাসত। যান। আমার পেছনে ঘুরঘুর না করে আপনাদের পুলিসি শাস্ত্রে যা যা বলে, করুন গিয়ে। কিন্তু খবর্দার। শীর্ষ চক্রবর্তীর গায়ে হাত ছোঁয়ালে আপনি আর রক্ষা পাবেন না।’

ব্রততী প্রায় দৌড়ে গেটের বাইরে চলে এলো। দাঁড়ানো ট্যাক্সিগুলোর একটা ধরে মুহূর্তে চোখের বাইরে চলে গেল।

‘হে সারথি,

রথ এইখানে থামাও।

আর আমার এই বিষাদকে

একটু ধরো।’—সুভাষ মুখোপাধ্যায়

অদ্ভুত টেলিফোনটা জয়ন্তী বাড়িতেই পেলেন। অপ্রত্যাশিত, তাই অদ্ভুত। রিসিভারটা রেখে দিয়ে অবাক হয়ে মুখ ফেরালেন। ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ওটা কার মুখ? জয়ন্তী রায়ের? যে জয়ন্তী রায় পরমার্থ রায়ের সাম্রাজ্য পরিচালনা করে? মুন্নির নয়? যে মুন্নি তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে স্বপ্ন দেখত? স্বপ্ন দেখার মতো প্রবল, রোমাঞ্চময় বিষাদাপন্ন মোহে ভালোবাসত! ভালোবাসার মতো বিপজ্জনকভাবে বাঁচতে চাইত! এই তুমুল তীব্র, আলোড়নময় আকাঙ্ক্ষা, যার নাম জীবন— কেন একলা একলা যাপন করা যায় না? তাহলে তাকে উল্টে-পাল্টে, ভেঙে-চুরে আবার গড়ে-পিটে নিজের মনের মতো করে নেওয়া যেত। কেন সরু সরু চুলের মতো আদ্যন্ত এর গায়ে জড়িয়ে যায় অন্য মানুষ, অনেক মানুষ, তাদের জীবন, ভালোবাসা, ভাগ্য, দুর্ভাগ্য!

ছেলে-মেয়ে স্কুলে। রামশরণ কাজ-কর্ম পরিপাটি করে সেরে বাড়ি গেছে। আড়াই হাজার স্কোয়্যার ফুটের বিশাল বাংলোবাড়িটায় জয়ন্তী একদম একা। ওরা জানে, একমাত্র জয়ন্তীকেই এ সময়ে বাড়িতে পাওয়া যাবে। অরণ্যদের হয়ত সরাসরি বলতেও চায়নি। ব্রততীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেও তো তাঁকেই বলল। পরমার্থ কয়েকদিনের জন্য দিল্লি গেছেন। খুব ভালো হয়েছে। অরণ্যকে অফিসে ফোন করে জানাতে এক মিনিট একদম চুপ করে রইল, তারপর ধীর গলায় বলল, ‘আমি আসছি।’ ইন্দ্রকে এর পর। ব্রততীর স্কুলে ফোন করে জানলেন, ও বেরিয়ে গেছে। ফোনগুলো সারতে সময় নিল। বিশেষ করে ব্রততীরটা। এমনিতেই পাওয়া যায় না। তার ওপর এরকম দুর্যোগ। অফিসে ফোন করে অনাদিকে বললেন রামশরণকে খবর দিতে। বাড়ি আগলাতে হবে, ছেলে-মেয়ে এলে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এই করতে করতেই বাইরে স্কুটারের আওয়াজ। মুখার্জি এসে গেছে। ইন্দ্র ওকেই ধরেছে দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে নামল।

দরজা খুলে দিতে মুখার্জি বলল, ‘এতোটা রাস্তা, ওয়েদারও ভালো না। জিপটাই আনি, কি বলেন?’

জয়ন্তী বললেন, ‘মুখার্জি, আপনি বসুন একটু। ইন্দ্র, তুমি গাড়িটা আনো। ড্রাইভার নিও।’

মুখার্জি বসতে পারছে না, পায়চারি করতে করতে বলল, ‘ব্রততীকে কানেক্ট করতে পারলেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। মানে, না। ও আগেই বেরিয়ে গেছে···’

জিপ নিয়ে ইন্দ্র এসে পৌঁছলে অরণ্য একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চৌধুরীও সঙ্গে যাচ্ছে, নাকি?’

‘নিশ্চয়ই!’ ইন্দ্র চৌধুরী জয়ন্তীকে উঠতে সাহায্য করল। ড্রাইভারকে বলল, ‘শর্ট-কাটটাই ধরো মদনলাল।’

মেঘভাঙা রোদ উঠেছে সামান্য কিছুক্ষণ হল। শেষ বেলাকার রোদ। লাল মাটি জল টেনে নিয়ে আরও পান করবার আগ্রহে মুখ ব্যাদান করে আছে। ক্ষয়া ক্ষয়া পথ। লাল। দুপাশে উঁচু পাড়ি। ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে মস্ত খোবলানো মাঠ। দূরে দূরে তাল, বট, নারকেল ত্রিভঙ্গ খেজুর। অকালবৃষ্টিতে আচমকা ধুয়ে গিয়ে সব উজ্জ্বল সবুজ। নিজের নিজের রাজ্যে ওরা স্বরাট। রোদের রঙ ক্রমে কমলালেবুর ঘন রসের মতো হয়ে আসছে। একটু পরেই সেই রঙে রসে জারিয়ে উঠবে দিগ্‌বিসারী খোলা মাঠ, গাছপালা, আকাশ। এই দিগন্তকে চুমো খেয়ে সূর্য চলে যাবে, অন্য দিগন্তের কাছে। রুক্ষ, একলা, মেঠো প্রকৃতির ওপর স্বর্ণগোধূলির এই কুহক কাউকে কাউকে আত্মবিস্মৃত করে। কেউ কেউ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সূর্যের চলে যাওয়ার এই বিপুল আয়োজন দেখতে। জীবন আস্তে আস্তে মিশছে গিয়ে মহাজীবনে।

পাহাড়ি পথে যেভাবে যায় সেভাবেই চলতে হল জিপকে। মেঠো রাস্তা পার হয়ে গেল। জল-চকচক জি. টি. রোড, দিল্লি রোড, দুধারে এখনও গাছপালায় বৃষ্টির জটিল কান্না। মাঠগুলো সজল চোখে চেয়ে আছে। জলা খাল বিল সব ভর্তি। একটু টুসকি দিলেই ডাগর পুকুরের কিনার বেয়ে জল ঝরে পড়বে। ড্রাইভারের পাশে চৌধুরী। অরণ্য বসেছে জয়ন্তী রায়ের পাশে। একবার চোখ পড়তে হঠাৎ জয়ন্তী বউদিকে চিনতে পারল না অরণ্য। একমাথা কোঁকড়া ছাঁটা চুল। বর্ণহীন শরীর। যেন নারী নয় এক সদ্য যুবক। কাঁধে গামছা, কপালে শোকের ভস্মতিলক, শ্মশানে চলেছে।

দরজা বন্ধ ছিল। শ্ৰী খুলে দিল। বাইরের রোয়াকে সৌম্য। পায়চারি করছে। সন্তোষ বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়িয়ে। চোখ লাল।

অরণ্য সৌম্যর দিকে এগিয়ে গেল— ‘কখন? কিভাবে?’

সৌম্য বলল, ‘রাত্তিরে শোবার সময়ে শিশি উপুড় করে খেয়েছে মনে হয়। পুরো মাসেরটা একসঙ্গে আনানো থাকত। সকালে অনেক বেলাতেও উঠল না দেখে···।’

লাঠিসুদ্ধু পর্দাটা দরজার পাশে নামিয়ে রাখল ইন্দ্র। ঘরের মধ্যে ব্রততী, ওর মাথা কোলে। বিনুনি থেকে চুলগুলো সব ছাড়া পেয়ে এলোমেলো হাওয়ায় ইচ্ছেমতন উড়ছে। পাশে চুপটি করে বসে আছে নির্বাণ। যেন অনেক বড় হয়ে গেছে হঠাৎ। জয়ন্তী গিয়ে পাশে দাঁড়াতে মৃদু, অভিযোগহীন স্বরে ব্রততী বলল, ‘দেখো জয়ন্তীদি, কি করলে!’

সৌম্য ঘরে ঢুকল, হাতে একটা কালো ডায়েরি। ভেতর থেকে একটা খোলা পাতা বার করে নিয়ে দুটোই ব্রততীর দিকে এগিয়ে দিল, বলল, ‘দিদি, অন্তুদার ডায়েরি, এটা শীর্ষর চিঠি, পুলিশের হাতে চলে যাবার আগে পড়ে নে।’

ব্রততী নড়ল না। হাত বাড়ানোর শক্তিটুকুও যেন ওর ফুরিয়ে গেছে। সৌম্য জিনিসগুলো জয়ন্তীর দিকে বাড়িয়ে ধরল। কাঁপা হাতে ডায়েরিটা খুললেন জয়ন্তী।

২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭

ভেবেছিলাম, কোনরকমে একটা সময়কে পেছনে ফেলে আসতে পারলেই তার ওপর যবনিকাপাত হয়। ভেবেছিলাম সময় যে ভাবেই তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখুক না কেন, যবনিকাকে সে সমীহ করে। একমাত্র বিশুদ্ধ দুঃখই বোধহয় তার দলিল পেশ করে বোঝাতে পারে এ ধারণা সর্বৈব ভুল। সময় তার অনন্ত প্রবহমানতার মধ্যে আমাদের সব সময়ে ভাসিয়ে রেখেছে। সব যবনিকাই তার চোখে স্বচ্ছ। কিন্তু সময় যখন ব্যক্তির রূপ ধরে আসে, তখন তার ধাক্কা বড় ভয়ানক! তখনই ঠিক বোঝা যায়? গতকাল আজ আর আগামী কালের মধ্যে কোনও মৌলিক তফাত নেই। রাঢ় বঙ্গের এক সূর্যাস্তকে পশ্চাৎপটে নিয়ে যখন চোদ্দবছর পর আবার আমাকে দেখা দিলে বিবি তখনই একমাত্র আমার সময়কে বোঝা সম্পূর্ণ হল। বিস্তীর্ণ, ফসলহীন, রুক্ষ মাঠে আমি কাতারে কাতারে মানুষকে ছিন্নভিন্ন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখলাম যেন কুরুক্ষেত্রের অন্তিম পর্বে, সেইসব পদাতিক, কে কার আস্তিনের তলায় কার জন্য হিংসা লুকিয়ে রেখেছে না বুঝে যারা অন্যর স্বপ্নের দাম চুকিয়ে দিয়ে গেছে। বিবি আমি মহাপাপী। নিজের লড়াই ভাইকে লড়তে দিয়ে আমি সীমান্ত অতিক্রম করে গেছি। কিন্তু অতি বড় পাপীরও আত্মপক্ষ থাকে। কতদিন শুধু সেই নিজের কথাটুকু বলবার সুযোগ চাইতে তোমার পেছন পেছন ঘুরেছি, বলতে না পেরে মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়িয়েছে কথাগুলো। যক্ষ্মারোগীর রক্তবমনের মতো মাঝে মাঝে উদ্দাম বেগে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। মাপ চাইতাম না। কিন্তু একটাও কথা বলবার সুযোগ পেলাম না কেন? জানি, প্রশ্ন শুনে আকাশ-বাতাসের সুদ্ধু ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে। এতো কিছুর পরেও, এই সমস্ত ধুলোমাটির ঠুলি-পরানো, বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসে আবিল ইতিবৃত্তের পরেও কেন প্রশ্ন থাকে?

···‘টেবিল-ঘড়িতে রাত আড়াইটে। এইমাত্র ওরা চলে গেল। বাপ্পা আর বাচ্চু। লিভিংরুমের সবুজ দেয়াল পেছনে নিয়ে বাচ্চু দাঁড়িয়েছিল। নিচু হয়ে, ক্রাচের ওপর শুকনো পাতার মতো শরীরটার ভর দিয়ে, জানলার গ্রিল ধরেছিল একহাতে। নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। থরথর করে কাঁপছিল শুধু দাঁড়িয়ে থাকার তীব্র যন্ত্রণায়। এই কি বাচ্চু? সেই বাচ্চু! আমার আদেশ পালন করতে যার একবারও হাত কাঁপেনি! বিপদ থেকে আরও বিপদের মুখে যে বিনা প্রশ্নে ছুটে গেছে, খালি আমি বলেছি বলে! বললাম— ‘বাচ্চু তুই বোস। বাপ্পা বসো।’ শান্ত চোখে চেয়ে বাপ্পা বলল, ‘বসতে তো আসিনি অন্তুদা। শুধু তোমাকে একবার দেখতে এলাম।’ আর একটা কথাও বলল না। পেছন ফিরে বাচ্চুকে কোলে তুলে নিল। নিচে নেমে গেল আস্তে আস্তে। বাচ্চুর হাতের ক্রাচদুটো জ্যামিতিক ছায়া ফেলতে ফেলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তার সেই অতিকায় ফ্রেমের মধ্যে আমি আমার সব ভুল, সব পাপ এবং সব প্রায়শ্চিত্ত পরিষ্কার দেখতে পেলাম।’

‘বাচ্চু, তুইও আমায় মাপ করিস না। আমরা ক্ষমা পাবো বলে কি ক্ষমা চাই? ওটা আসলে অপরাধ স্বীকারের, বেদনা প্রকাশের একটা ভঙ্গিমাত্র। কিন্তু তোর কাছে কিছু কথা জমা রেখে যাবো। কৈফিয়ত নয়। যে পৈশাচিক অত্যাচার তোরা সবাই সহ্য করেছিস, করে আজ এমনি জীবন্মৃত হয়ে তবু মানুষের অহঙ্কার নিয়ে বীরাদপি বীরপুরুষের মতো বেঁচে আছিস, আমি সে অত্যাচার কেন সইতে পারিনি? কেন? নিজেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাই না। প্রথম দুদিন চূড়ান্ত বিলাস, সম্মান, আদর, তারপর আচমকা প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দিতে পিতৃপ্রতিম মুখগুলো সব পিশাচের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে গেল। নাভির নিচে আমূল ফুটে গেল একটা পিন। পরবর্তী বীভৎস সম্ভাবনায় তখন আমি চিৎকার করে উঠেছি, নিজের ওপর আমার আর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছিটকে গিয়ে পড়লাম বিদেশে, ধনী আত্মীয়ের টাকায়। জানতাম না, বিবির কি করেছি, তোর কি করেছি। অথচ জানা উচিত ছিল। বাচ্চু, আমি কাপুরুষ, কিন্তু অমানুষ নই। তোর শরীরের প্রত্যেকটি আঘাত আমার ঋণ। যদি শোধ করে দিতে পারি, তাহলে বাচ্চু আবার আমায় তেমনি করে দাদা বলে ডাকিস।’

শীর্ষর চিঠিটা ওর ছোড়দাকে লেখা : ‘ছোড়দা, অতনু সরকার আমাদের পেছনে লেগেছে অন্তুদার জন্য, এ আমি ওর চ্যাপ্টা মুখখানা দেখবার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি। প্রথমে বুঝিনি এতো তৎপর ও হল কি করে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের গতিবিধির ওপর পাহারা আর কোনদিনই শিথিল হবে না। আইনের চোখে আমরা চিরটাকালই ডেঞ্জারাস কিলার্স থেকে যাবো। আমাদের অনুসরণ করেই ওরা অন্তুদার কাছে পৌঁছেছে। তুই ওর ডায়েরিটা তুলে এনেছিস, ভালোই করেছিস। আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিলি কেন? পৌত্তলিক বাচ্চু যদি তার আইডলকে মাপ করে দেয়, তাই···?

‘ছোড়দা, আমাদের সংগঠন দুর্বল ছিল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলে কিছু ছিল না, বিপ্লবের জমি তৈরি হয়ে গেছে ভেবে এবং শাসকদলের গণ সমর্থন নেই ভেবে আমরা ভুল করেছিলুম, যে দেশে দারিদ্র্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় অন্ধতা, ভাষা-সংস্কৃতি এবং জাত নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, সে দেশের পটভূমিকায় অবিমিশ্র মার্কস-লেনিনবাদের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু, এই সব পণ্ডিতি কূটতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু আমাদের আসল দুর্বলতা যার জন্য পুরো আন্দোলন একটা মর্মান্তিক ট্রাজেডিতে পরিণত হল সেটা কি জানিস? বিপ্লব ধরেই নিয়েছে পুরুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল বীরপুরুষ। বিপ্লবে সামিল সব মানুষের মধ্যেই সে অসীম সহিষ্ণুতাসম্পন্ন একজন অগ্নিমানুষকে প্রত্যাশা করে, দাবী করে এমন শক্তির যা অনায়াসে সব ভেঙে দিতে পারবে। অথচ সৃষ্টির মৌলিক এবং চূড়ান্ত শর্ত ভাঙা নয়, গড়া। গড়ার পিপাসা যাদের মধ্যে প্রবল তারা সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ। স্থূলতার ছোঁয়ায় কখন যে কিভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, নিজেরাই জানে না। নিজেকে রোখবার-আগেই যদি সংগ্রাম তাদের ডেকে নেয়, তাহলে বিপ্লবের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাদের পাশ করার আশা নেই। তোরা জানিস কিনা জানি না, মধ্য প্রাচ্যের ইনডাস্ট্রির গত দশ বছরের ইতিহাসে, সুমন্ত সেনগুপ্ত একটা বরণীয় নাম। এখানেও তাই-ই হতে পারত। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তটা আরও জরুরি হয়ে দাঁড়াল। কারণ, আমরা কেউই তো ওকে একটা কথা বলবারও সুযোগ দিইনি!

‘আর আমার কথা যদি বলিস? আমার কথা তো অনেক দিন আগেই ফুরিয়ে গেছে।

“দা সিকনেস, দা নশিয়া, দা পিটিলেস পেন

হ্যাভ সীজ্‌ড্‌ উইথ দা ফিভার, দ্যাট ম্যাডন্‌ড্‌ মাই ব্রেন

উইথ দা ফিভার, কল্‌ড ‘লিভিং’ দ্যাট বার্নড্‌ ইন মাই ব্রেন।···”

বাকি জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচিস। আর দিদিকে বলিস ও ক্ষমা চায়নি, তবু যেন দিদি ওকে ক্ষমা করে। ওর জন্যে নয়, নিজেরই জন্যে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *