আলো-অন্ধকারে
কান্তিভাই ভুলাভাই এঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস্-এর কমার্শিয়াল ম্যানেজার পরমার্থ রায়ের বয়স পঞ্চাশের সামান্য ওপরে। কিন্তু প্রচুর চুল পেকেছে। ঘাড় অবধি ঝামর চুল। কাঁচা পাকা চুলের এই কেশর ভদ্রলোককে একটা খুব স্টাইলিশ চেহারা দিয়েছে। লম্বার চেয়ে ইনি চওড়ায় একটু বেশি। বেশ আঁট-সাঁট। র সিল্কের টি-শার্ট বা বুশ শার্ট পরা পছন্দ করেন। টাই পরেন না প্রায় কখনই। মোটাসোটা হওয়ার দরুন ক্ষিপ্রতা বা কর্মশক্তি কোনটাতেই কম পড়েনি। উৎসাহে সবসময় টগবগ করছেন। পরমার্থ রায় এই গুজরাতি ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর সব-কিছু প্রতিভা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। তাঁর কাজ-কর্ম, হাবভাব দেখলে মনে হয় কম্প্যানিটা কান্তিভাই ভুলাভাইদের নয়, তাঁরই। ম্যানেজিং ডিরেক্টর কান্তিভাই ফ্যাক্টরি অঞ্চলে আসেনই না বলতে গেলে। কলকাতার অফিসে বসে কিছুক্ষণ কান চুলকে বাড়ি চলে যান। পরিচালনার দায়িত্ব কার্যত পরমার্থরই। এবং সে দায়িত্ব খুব নিপুণভাবে পালন করে ভদ্রলোক মালিকপক্ষকে খুব খুশি এবং নিশ্চিন্ত রাখতে পেরেছেন। ভদ্রলোকের ত্রুটি কিছু কিছু থাকতে পারে যেমন বিলেত গেছেন কিছুতেই ভুলতে পারেন না। ঔরংজেবের মতো অপরের প্রতি কিছুটা ভরসাহীন। কিন্তু সকলের প্রতি আন্তরিক মঙ্গলেচ্ছায় এগুলো তাঁর প্রাণশক্তিতে টইটম্বুর চরিত্রে মানিয়ে গেছে। এবং ভালো হোক মন্দ হোক, স্বজাতি-প্রীতিটি তাঁর নিখাদ। বাঙালির উদ্যমহীনতার বিরুদ্ধে তিনি সুযোগ পেলেই বক্তৃতা দেন। স্বজাতির অন্যান্য দোষ এবং গুণ সম্পর্কেও তিনি বেশ সচেতন। আজ পরমার্থ রায়ের চলাফেরা ওঠাবসার একটা অতিরিক্ত উচ্ছলতা এসেছে। আশাতীত রকমের উজ্জ্বল কেরিয়ারের বাঙালি এঞ্জিনিয়ার পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগপত্র বার করে দিয়েছিলেন। খালি ভাবনা হচ্ছিল না আঁচালে বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ সকালে পূর্ব-ব্যবস্থামতো কম্প্যানির ট্রাক গিয়ে ভদ্রলোকের আসবাবপত্র নিয়ে এসেছে। ভদ্রলোক স্বয়ং এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন, সঙ্গে স্ত্রী। পরমার্থ রায়কে দেখলে মনে হচ্ছে তিনি হাতে সত্যি সত্যি চাঁদ পেয়েছেন। অর্থাৎ বড় বড় পোস্টে কাজ করেও পরমার্থ সেইসব পোস্ট-সুলভ নির্বেদ আয়ত্ত করতে পারেননি। তাঁকে দেখলে বেশির ভাগ সময়েই মনের ভাব বোঝা যায়। অর্থাৎ আদতে পরমার্থ রায় সরল স্বভাবের মানুষ। সজীবতা যাদের কোনও পোস্ট বা পোশাকের তলাতেই চাপা পড়ে যায় না তাদের সগোত্র।
প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম সারা হয়ে গেলে পরমার্থ নবনিযুক্ত এঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীর দিকে ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বললেন—‘সরি, মিসেস সেনগুপ্ত, আমার উচিত ছিল গোড়াতেই আপনাকে আমার মিসেসের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। এতোক্ষণে আলাপ-পরিচয়ও হয়ে যেত, আপনার সময়টাও এরকম বাজে কাটত না। কথাটা যে কেন মনে হয়নি!’
মিসেস সেনগুপ্তর বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে যে কোনও জায়গায়। চুল কাঁধ ছাড়িয়ে ধাপে ধাপে নেমেছে পিঠের মাঝখান পর্যন্ত। স্ন্যাক্স্ এবং চিত্র-বিচিত্র টপ পরনে। দামী হেয়ার-কনডিশনার এবং পারফিউমের গন্ধে বাতানুকূলিত ঘর অনেকক্ষণ থেকে দম বন্ধ করে আছে। মাথা ঈষৎ হেলিয়ে, প্রবাল রঙের ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটি বলল—‘ইটস্ অল রাইট, মিঃ রয়। আমার অসুবিধে তো হচ্ছিলই না, বরং ইনটারেস্টিং লাগছিল খুব।’
—‘ইনটারেস্টিং?’ পরমার্থ ঝুঁকে বসলেন, ‘আচ্ছা! কোনটা ইনটারেস্টিং লাগল?’
—‘কাজের অ্যাটমসফিয়ার আমার দারুণ লাগে। নানান রকমের কাজ আমায় অ্যাট্রাক্ট করে মিঃ রয়। চ্যালেঞ্জিং জব্স্। আমি যদি এখুনি একটা বিজনেস এগজিকিউটিভ হয়ে যেতে পারতাম তো লাইফটা ঠিকঠাক এনজয় করতাম; বিশ্বাস করুন! এইরকম একটা দুর্দান্ত ঘরে বসে ইনটারেস্টিং সব ফাইল নাড়াচাড়া!’
মাথা ঝাঁকিয়ে, শরীরটাকে চেয়ারের পিঠে ফেলে হো-হো করে হেসে উঠলেন পরমার্থ।
—‘ইনটারেস্টিং ফাইল? আপনি রিয়্যালি হাসালেন মিসেস সেনগুপ্ত। যেখানে যত প্ৰব্যাব্ল কাস্টমার্স আছে আপনার প্রোডাক্ট সব কমদামে কিনে ফেলতে চাইছে, বুঝলেন? সাঙ্ঘাতিক কমপিটিশন। এই ফাইলটার চিঠিপত্রের মধ্যে ওই একটা তথ্যই ঘাপটি মেরে রয়েছে।’
একটা ফাইল দেখিয়ে বললেন পরমার্থ। মিসেস সেনগুপ্ত ঘাবড়াবার পাত্রী নয়। চুলসুদ্ধ মাথা দুলিয়ে বলল—‘আই উড টেক ইট অ্যাজ আ. চ্যালেঞ্জ!’
—‘দাঁড়ান তাহলে। আমার নেক্সট্ ম্যান অরণ্য মুখার্জিকে বলছি আপনাকে ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিতে। এগজিকিউটিভ পোস্ট-এ ভেক্যান্সি হলেই আপনাকে পাকড়াও করছি। কি মিঃ সেনগুপ্ত, আপত্তি আছে?’
সেনগুপ্ত খুব চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ মনে হল। শুধু হাসলেন। মিসেস সেনগুপ্ত বলল—‘সত্যি!’
—‘না তো কি?’
তিনজনে উঠে দাঁড়ালেন।
—‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’ মিসেস সেনগুপ্ত জিজ্ঞেস করল। পরমার্থ বললেন—‘অবশ্যই আমার বাড়ি। একটু চা টা খাবেন। আমার গৃহিণীর সঙ্গে পরিচিত হবেন।’ সেনগুপ্তর দিকে ফিরে বললেন—‘মিসেসকে নিয়েই যখন এলেন তখন থেকে যেতে পারতেন। আপনাদের ফ্ল্যাট রেডি। ফার্নিচার-টার সব যথাস্থানে চলে গেছে; যদিও একটারও প্রয়োজন ছিল না। কম্প্যানি তো আপনাকে ফার্নিশ্ড্ কোয়ার্টার্স-ই দিত। তাই-ই প্রাপ্য। ছাড়বেন কেন?’
মিসেস সেনগুপ্ত সুবক্র ঠোঁটে হেসে বলল—‘তাহলে আমার নিজস্ব শখের ফার্নিচারগুলো বরাবরের জন্য কোনও গো-ডাউনে রেখে দিতে হয়, মিঃ রয়। এতদিন মিডল ইস্টে ব্যবহার করবার সুযোগ পাইনি। এখনও না পেলে·····।
সেনগুপ্ত বললেন—‘বারোয়ারি ফার্নিচার ব্যবহার করায় আমার স্ত্রীর আসলে একটু আপত্তি আছে মিঃ রায়। সেটা উনি সঙ্কোচে বলতে পারছেন না। যাই হোক,, একটা কুকিং রেঞ্জ আর ফ্রিজ পাবো তো?’
—‘নিশ্চয়ই।’
বেল টিপলেন পরমার্থ। ছোটখাটো চেহারার একটি পিওন এসে দাঁড়াল। রায় বললেন—‘অনাদি, এই সাহেব আর মেমসাহেবকে আমার বাড়ি নিয়ে যাও।’ সেনগুপ্তর দিকে চেয়ে বললেন—‘আপনারা এগোন, আমি এখুনি আসছি কয়েকটা কাজ সেরে। আমার স্ত্রী বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
দুজনে বেরিয়ে যেতে আপন মনেই হাসতে লাগলেন রায়। ফোনটা তুলে নিয়ে বাড়ির নম্বর ঘোরাতে লাগলেন—‘হ্যাল্লো জয়ন্তী। আমি তোমার পতিদেবতা বলছি। তোমার গ্রেগরি পেককে পাঠিয়ে দিলুম। ভালো করে রিসিভ করো।’
—‘কি বাজে বকছো কি? কে আবার আমার গ্রেগরি পেক?’ ফোনের মধ্যে বোঝা গেল গৃহিণী ভ্রূকুটি করেছেন।
—‘বাঃ! অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে ফটো দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়লে, একেই নিতে হবে বলে বায়না ধরলে আর এখন বলছ, কার গ্রেগরি পেক? শোনো, সঙ্গে মিসেসও আছেন। ইনি গ্রেগরি পেক তো উনি জিনা লোলো, তুমি আর পাত্তা পাচ্ছো না, ডিয়ার!’
—‘কি অসভ্যের মতো করে যাচ্ছো তখন থেকে? অচেনা গেস্ট পাঠিয়ে দিচ্ছো, শীগগির বাড়ি এসো বলছি!’
—‘আরে পঞ্চাশোর্ধেও যদি একটু অসভ্যতা না করব তো কবে করব গিন্নি? চান্স দাও একটু জেলাস-টেলাস হবার?’
ওদিক থেকে দুম করে ফোন রেখে দেবার শব্দ হল। মিটিমিটি হাসতে হাসতে পরমার্থ হাতে টুসকি দিয়ে কোনও অশ্রুত সুরের তালে তালে নাচতে লাগলেন। আড়াল থেকে কেউ দেখলে নির্ঘাত পাগল ভাবত।
জানলার ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ডগুলো নামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পরমার্থ। তালা লাগালেন নিজের হাতে। বাইরে গিয়ে দারোয়ানকে বাকি অফিস বন্ধ করতে বলে, পাশের ছাউনিতে গিয়ে স্কুটারে চড়ে বসলেন। ফ্যাক্টরি-এলাকার মধ্যে তিনি নিজের স্কুটারে ঘোরাফেরা করতেই ভালোবাসেন। সেনগুপ্ত-দম্পতি গেছে পদব্রজে। মেয়েরা হাঁটে আস্তে আস্তে। মিসেসের সঙ্গে তাল রাখতে সেনগুপ্তর শ্লথগতি হয়ে যাবে। তিনি ভটভটিয়ায় চড়ে নিমেষের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন খিড়কির দরজা দিয়ে। ওদের আগেই।
মিসেসকে বলা ছিল আজ একজন অতিথি আসার কথা। কে, কি বৃত্তান্ত কিছুতেই ভাঙেননি, এই মজাটুকু করবেন বলে। পেছনের প্যাসেজ দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই গৃহিণীর আয়োজনের গন্ধ পেলেন রায়। বাতাসে নাক তুলে শোঁ শোঁ করে শ্বাস নিতে নিতে ভেতরে ঢুকলেন—‘হুঁ, হুঁ। হাঁউ মাউ খাঁউ।’
জয়ন্তী রায় একটা ঝলমলে সিনথেটিক শাড়ি পরে তদারক করছিলেন। টেবিলের ওপর ওঁদের রাঁধুনি রামশরণ সাজিয়ে রাখছে প্লেটগুলো। মাথার ওপর চাপ চাপ কোঁকড়া চুল, যথাসম্ভব ছোট করে ছাঁটা। সাদা ঘাড়ের ওপর সোনার চেন চিকচিক করছে। জয়ন্তী রায় ভটভটিয়ার আওয়াজ পেয়েই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। ‘হাঁউ মাউ খাঁউ’ শুনে ভুরুটা একটু কুঁচকোলো, মাথাটা এমনভাবে ঝাঁকালেন যে কানের হীরে থেকে রেখার মতো একটা দ্যুতি এসে বিঁধে গেল পরমার্থর কাঁধের ওপর। চোখ ছোটছোট করে পরমার্থ সব লক্ষ করছিলেন। মনে মনে হাসলেন—রাগ করা হয়েছে! ব্যাটা রামশরণ ছায়ার মতো ঘুরঘুর না করলে রাগ ভাঙানোর একটা বিলি-ব্যবস্থা এক্ষুনি হয়ে যেত। তা ইডিয়টটা যেন আঠা দিয়ে মেমসাহেবের সঙ্গে সাঁটা। উনি রান্নাঘরে গেলেন তো ইনিও গেলেন। উনি এলেন তো ইনিও এলেন।
জয়ন্তী বললেন—‘চায়ের জলটা মিনিট পনের পরে চাপিও রামশরণ। দেখো বেশি ফুটে না যায়।’
বাইরে বেল বাজল। পরমার্থ দরজা খুলে দিতে এগোলেন।
মিসেস সেনগুপ্ত অবাক হয়ে বলল—‘বাঃ আপনি কি করে আমাদের আগে পৌঁছে গেলেন?’
—‘হুঁ হুঁ বাবা। স্লো বাট স্টেডি উইন্স্ দা রেস। আপনারা নিশ্চয়ই রাস্তার মাঝখানে ছায়াভরা গাছটাছ দেখে এক ঘুম ঘুমিয়ে নিয়েছেন সেই আলসে খরগোশটার মতো। এদিকে আমি ব্যাটা কচ্ছপ হলে হবে কি?’ নিজের ছোটখাটো আঁটসাঁট ভুঁড়িটির দিকে আঙুল দেখিয়ে পরমার্থ হাসলেন—‘ঠিক টুকটুক টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেছি। আসুন মিঃ সেনগুপ্ত।’
দু হাতে পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন জয়ন্তী।
পরমার্থ নিচু হয়ে আদাব জানাবার ভঙ্গিতে বললেন—‘আসুন আসুন, ইনি মিঃ সেনগুপ্ত, আমাদের চীফ এঞ্জিনিয়ার। আর ইনি জয়ন্তী রায়, আমার অশেষ গুণশালিনী বেটার হাফ। জয়ন্তী, মিট পারমিতা সেনগুপ্ত, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে সবরকম গুণে ইনি তোমাকে টেক্কা দেবার জন্যেই জন্মেছেন, পারমিতা সেনগুপ্ত মৃদু হেসে বলল—‘নো মিঃ রয়, আমার কোনও গুণ নেই। দেখে যদি গুণী-টুনী মনে হয় তো মনে রাখবেন অ্যাপিয়ারেন্সেজ আর ডিসেপটিভ।’
পরমার্থ বললেন—‘ক্রমশ সবই প্রকাশ্য হবে। তাড়া কি? জয়ন্তী তোমার কফি ক্লাবের মেম্বার একজন বাড়ল।’
চীফ এঞ্জিনিয়ার দেয়ালের বাহারি র্যাকে রবীন্দ্ররচনাবলীর সেটটার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন। হাসির বাষ্পও নেই সে মুখে। জয়ন্তী জনান্তিকে বললেন—‘তোমার ভাঁড়ামিটা একটু থামাবে? সকলে কি সব পছন্দ করে?’ তারপর সেনগুপ্তর দিকে চেয়ে বললেন—‘বসুন মিঃ সেনগুপ্ত, একেই ক্লান্ত তারপর আপনাদের ইনডিফ্যাটিগেব্ল ম্যানেজার সাহেবের বকবকানি নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে শুনতে হয়েছে।’
পারমিতা বলল—‘বারোটা নাগাদ বেরিয়েছি। নানারকম কাজ সারতে সারতে আসছি। মিঃ রয় কিন্তু খুব ইনটারেস্টিং লোক। আমার একটুও বোরিং লাগেনি।’
জয়ন্তী বললেন—‘আপনাদের প্রোগ্রাম কি? মানে কবে আসছেন? শুধু দুজনই···?’
পারমিতা বলল—‘আমাদের ছেলে পুরুলিয়া সৈনিকে পড়ে। ভেকেশনে আসবে। এমনিতে আমরা দুজনই।’
দরজার কাছে রামশরণ গলা খাঁকারি দিল। জয়ন্তী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—‘এসো রামশরণ!’ প্লেটগুলো অতিথিদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন—‘একটু জলযোগ করুন মিঃ সেনগুপ্ত। খেতে খেতেই কথা হোক···ওকি! হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? মুখই তুলছেন না যে! মিসেস সেনগুপ্ত আপনার স্বামী যত বড় টেকনোক্র্যাটই হোন না কেন, এ যুগের পক্ষে ভয়ানক লাজুক।’
পরমার্থ দেখলেন সেনগুপ্তর মুখ প্রথমে সাদা, তারপরে টকটকে লাল হয়ে গেল। দেশ-বিদেশ ঘোরা এঞ্জিনিয়ারসাব মেয়ে দেখলে ঘাবড়ে যান—এটা একটা সংবাদ বটে!
অবশ্য জয়ন্তী কোন অর্থেই সাধারণ মেয়ে নয়। একে সাঙ্ঘাতিক সুন্দরী। তার ওপর প্রচণ্ড স্মার্ট। কথাবার্তার ধারে, সাজপোশাকের বাহারে যে কোনও পুরুষের কান কাটতে পারে। পরমার্থ যখন প্রথম দেখে ছিলেন চোখ ঝলসে গিয়েছিল। কথাবার্তা শুনে চমকে গিয়েছিলেন। যে কোনও বিষয়ে পরিষ্কার মতামত দেবার মতো পড়াশোনা ভাবনা-চিন্তা আছে জয়ন্তীর। পরমার্থ নিজেও অত জানেন না। সেনগুপ্ত একটু চুপচাপ ধরনের। এরকম মুখচোরা পুরুষ জয়ন্তীর সান্নিধ্যে এলে ঘাবড়ে যাবেই। সবাই তো আর পরমার্থ রায় নয়। বিদ্যা-বুদ্ধি-সপ্রতিভতা যাই থাক না কেন, মেয়েরা শেষ পর্যন্ত মেয়েই, স্ত্রীও শেষ পর্যন্ত স্ত্রী-ই। এই তত্ত্বটা বোঝা হয়ে গেছে পরমার্থর। পিয়ানোর ঠিক কোন চাবিতে হাত পড়লে কি সুর বেরোবে পিয়ানোবাদক ঠিকই জানে। মাথার কাঁচাপাকা চুলের মধ্যে দিয়ে খুশিতে ডগোমগো হয়ে হাত চালালেন পরমার্থ। জয়ন্তীর তিনি একনিষ্ঠ ভক্ত। যে কোনও পরিস্থিতিতে ওকে ফেলে দাও, সে মাঝগঙ্গার মতো গভীর ব্যাপার হলেও ও ঠিক সাঁতরে পাড়ে উঠে আসবেই। সেনগুপ্তর স্ত্রী পারমিতা মেয়েটিও রূপসী। কিন্তু অপরিণত, এখনও। জয়ন্তীর মতো ক্ষুরধার হতে সময় লাগবে। আদৌ হবে কিনা বলা শক্ত; যতই স্ল্যাক্স পরে স্বামীর কর্মস্থলে প্রথম দিন আসুক।
পারমিতা বলল—‘করেছেন কি? এতো কেউ খেতে পারে?’
—‘ডায়েট যদি না করেন তাহলে তো ঘাবড়াবার কিছু নেই! অবশ্য করলেও কিছু এসে যায় না, আমি নিজেও যথাসম্ভব ফ্যাট-ফ্রি-জিনিস খাই। চপটা ভাপা চপ। রাশিয়ান সালাডের দই আর শশা ফ্যাট গলিয়ে দেবে। চিকেনটা অবশ্য ভেজেছি। কিন্তু রেড মীট তো আর নয়!
পারমিতা একটা চপ চামচে দিয়ে ভেঙে মুখে পুরল লিপস্টিক বাঁচিয়ে, স্বামীর দিকে চেয়ে বলল—‘তুমি কিছু নিচ্ছো না যে! কিছু হয়েছে?’ সেনগুপ্ত তাড়াতাড়ি এক টুকরো ভাজা মাংস কাঁটায় গেঁথে বললেন ‘ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমি ঠিক আছি।’
পরমার্থ বেশ তৃপ্তি করে মাংসর টুকরো চিবোতে চিবোতে বললেন—‘ছেলেকেও নিয়ে আসুন। আমাদের এখানে ফ্যাক্টরির বাস ছেলেদের স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে নিয়ে আসে। বর্ধমানে, চন্দননগরে ভালো স্কুল আছে। আমার দুই ছেলে-মেয়েও বর্ধমানে পড়ে।’
সেনগুপ্ত মৃদু গলায় বললেন—‘সেট্ল করে গেছে। ওকে ডিসটার্ব করে কোন লাভ নেই।’
পারমিতা বলল—‘পাবলিক স্কুল এডুকেশন যাতে পায় সে জন্যই আরও দেওয়া, খানিকটা স্যাক্রিফাইস তো করতেই হবে।’
জয়ন্তী তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলেন—‘পাবলিক স্কুল এডুকেশন! মানে ব্রিটিশ টাইপ? এখন? এই ভারতবর্ষে? স্বাধীনতার ঊনচল্লিশ বছর পরেও? কি মিঃ সেনগুপ্ত, আপনারও কি তাই মত নাকি?’
সেনগুপ্তকে খুব বিব্রত দেখাল। দু তিনবার গলা পরিষ্কার করে অস্ফুটে কি যে বলতে চাইলেন, বোঝা গেল না। পারমিতাকে দেখে মনে হল সে ভেতরে ভেতরে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে। ফলের চাটনিটা নিতে গিয়েও নিল না। ঘড়ি দেখল একবার। পরমার্থ এসব লক্ষণ নির্ভুল চেনেন, কথা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন—‘রামশরণকে চা-টা আনতে বলো জয়ন্তী’, সেনগুপ্তকে লক্ষ করে বললেন, ‘চাটা খেয়েই চলুন আপনাদের ফ্ল্যাটটা দেখে আসবেন।’
জয়ন্তীর কতকগুলো মেজাজ তিনি বোঝেন না। কোথায় কি বলতে হবে ওর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু ইচ্ছে করে দুমদাম ইঁট ফেলে মাঝে মাঝে। পরমার্থ স্বভাবতই সমর্থন করেন না। পরে চোখে আঙুল দিয়ে সামাজিকতার এই সব ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে নির্বিকার মুখে জয়ন্তী বলবে—‘এক একটা কথার ধাক্কায় মুখোশগুলো ভেঙেচুরে আসল চেহারাগুলো কেমন বেরিয়ে পড়ে, দেখতে ইচ্ছে করলে কি করবো? বেশ তো, তোমার অসুবিধে হলে আমায় নিয়ে যেও না।’—যেন ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব।
পরমার্থ আশা করেছিলেন তাঁর প্রথম দিনের এই অতিথি-সৎকার বেশ আদৃত হবে আগন্তুকদের কাছে। সেনগুপ্ত-দম্পতি জয়ন্তীর রন্ধন-কুশলতার ভূয়সী প্রশংসা করবে, লোকে সাধারণত তাই করে থাকে। সঙ্গত কারণেই। কিন্তু ওরা আলতো করে কয়েকটা টুকরো-টাকরা খেয়ে হাত গুটিয়ে বসল এমনভাবে যে, তিনি একেবারেই হতাশ হয়ে পড়লেন। ওঁর মুখের দিকে চাইলে এখন মনে হবে একটা বড় হলঘরে যেন বেশির ভাগ বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেনগুপ্তরা উঠে দাঁড়াতে জয়ন্তী বললেন—‘আপনাদের ফ্ল্যাটটা আমিই বেছেছি, মিঃ সেনগুপ্ত। পছন্দ না হলে বলবেন’, এমনভাবে বললেন যেন অতিথিদের ভাবান্তর আদৌ তাঁর নজরে পড়েনি।
পরমার্থ বললেন—‘এই সেদিনও বিল্ডিংটা একতলা ছিল। বাংলো। প্যাটার্নটা রেখেই দোতলা করিয়েছি। একেবারে নতুন ধরনের। হঠাৎ দেখলে লন্ডনের শহরতলির বাড়ি বলে মনে হবে, অথচ ভেতরটা একেবারে আধুনিক। বম্বে থেকে সেরামিক টাইলস আনিয়ে ফ্লোরটা করিয়েছি। আপনার পছন্দ না হলে আমিই নিয়ে নেব।—কি বলো?’ জয়ন্তীর দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন পরমার্থ।
জয়ন্তী সংক্ষেপে বললেন—‘ইটস মেন্ট এক্সক্লুসিভলি ফর দেম।’
পরামর্থ বললেন—‘আপনাদের ফার্নিচার কোথায় কি থাকবে সেসব প্রাথমিক ব্যবস্থা উনিই করেছেন। সারাটা সকাল কোমর বেঁধে ওখানেই কাটিয়েছেন। পরে অবশ্য আপনারা ইচ্ছেমতো উল্টে-পাল্টে নেবেন।
চারজনে যখন বেরোলেন, সন্ধ্যার ছায়া পড়ে গেছে চারদিকে। সোজা, সমান্তরাল রাস্তাগুলো। পিটে পিটে শক্ত, সমান করা হয়েছে। হঠাৎ দেখলে সুরকির বলে ভ্রম হয়। আসলে কিন্তু এ অঞ্চলের মাটিই এমনি লাল। দুধারে প্রচুর গাছপালা। দোতলার চেয়ে উঁচু কোনও বাড়ি নেই। আকাশরেখা তাই উদার। প্রত্যেকটা বাড়ির সঙ্গে বাগান। কেউ কেউ খুব সুন্দর বাগান করেছে। দোলনচাঁপার মৃদু গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায়।
পারমিতা বলল—‘জায়গাটা খুব সুন্দর তো! অনেকটা শান্তিনিকেতনের মতো, তাই না?’
সেনগুপ্তকে লক্ষ্য করে কথাটা বলা হলেও জবাব এলো না। রায় খুব খুশি হয়ে বললেন—‘কি যে কমপ্লিমেন্ট দিলেন আমায় নিজেই জানেন না মিসেস সেনগুপ্ত। এইভাবে বাগান-টাগান করা অ্যাকচুয়ালি আমার উৎসাহেই সম্ভব হয়েছে। আগে একেবারে ন্যাড়া-বোঁচা ছিল। প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ বাগানের জন্য একটা প্রাইজ ডিক্লেয়ার করি। গতবার পেয়েছিল একজন সাধারণ ওয়ার্কার। অপূর্ব চুবড়ির মতো চন্দ্রমল্লিকা করেছিল দশ রকম রঙের। নিজস্ব জমির বাগান ছাড়াও এখানে ফ্যাক্ট্রির বাগান আছে। নানারকম সবজি, ফল হয়। সবাই ভাগ পায়।
সুন্দর একটা হাওয়া দিচ্ছে মৃদু মৃদু। গাছের ফাঁকে ফাঁকে হ্যালোজেন জ্বলে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে চারজনে খুব বাহারি একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। টালি-ছাওয়া পর্চ। বেশ বড়, চৌকো।
পরমার্থ বললেন—‘নিচে থাকেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অরণ্য মুখার্জি। চমৎকার লোক। আলাপ হলেই বুঝবেন। স্বামী আর স্ত্রী।’
জয়ন্তী যোগ করলেন—‘ছেলেমেয়ে নেই। হয়নি। সেনগুপ্ত সাহেব আপনাদের অসুবিধে হবে না।’
পারমিতা আশ্চর্য হয়ে বলল—‘অসুবিধে কি? আমার ছেলেকে হস্টেলে রেখেছি বলে বলছেন? আসলে আমরা এখন কোথায় থাকবো ঠিক নেই বলেই···’
বাড়ির সামনে একটা ঝুপড়ি শিউলি ফুলের গাছ। তলায় ফুল বিছিয়ে অন্ধকারে একটা গোল সাদা বেদীর মতো দেখাচ্ছে জায়গাটা। একটু দূরে খুব সম্ভব বকুল। মুখার্জিদের ঢোকবার পথ সোজাসুজি। চওড়া পর্চ দিয়ে। দোতলায় যাবার ফটক ডান দিকে। খোলা দরজা দিয়ে নিচু ধাপের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। মেজানিন ফ্লোরের ঘরের দরজা খুলে জয়ন্তী বললেন—‘যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারেন এটাকে। স্টাডি হিসেবে, গেস্টরুম হিসেবে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্সের এখানে দরকার হয় না। ওয়ার্কারদের বউ ছেলে মেয়েরাই বেশির ভাগ কাজ করে দিয়ে যায়।’
সিঁড়িতে বাঁক নিয়ে মেহগনি রঙের দরজার সামনে বেশ নাটকীয়ভাবে দাঁড়ালেন রায়। পকেট থেকে চাবি বার করে মিসেস সেনগুপ্তর হাতে দিলেন—‘আপনার বাড়ি আপনিই খুলুন। হাতে খড়ি হয়ে যাক।’
কপাট দুটো দু হাতে সরিয়ে ভেতরে গিয়ে আলোর সুইচ টিপে দিলেন রায়। তিরিশ বাই কুড়ি মতন একটা লম্বা হল। দেয়ালে স্নিগ্ধ সবুজ আর হাতির দাঁতের রঙ। আলো পিছলে পড়ছে সাদা বড়দিনের কার্ডের মতো ছোট ছোট ফুলের কুঁড়ি আঁকা মেঝেতে। উল্টো দিকে মোটা কাচের পাল্লার ওধারে ব্যালকনি। বাঁদিকে জানলা। ডানদিকে অন্যান্য ঘরে যাবার এবং প্যাসেজে যাবার তিনটে দরজা।
জয়ন্তী বললেন—‘এ ঘরটাতে আপনাদের ডিনার-টেবল রাখবার দরকার হবে না। ওদিকে রান্নাঘরের লাগোয়া বেশ বড় ডাইনিং স্পেস আছে। আসুন।’
এক এক করে ঘরগুলো খুলে দেখাতে চলে গেলেন জয়ন্তী পারমিতাকে নিয়ে। হলের সোফায় গা ডুবিয়ে বসলেন পরমার্থ। সেনগুপ্তকে নিয়ে।
—‘আপনি একটু দেখে-টেখে আসুন।’
সেনগুপ্ত বললেন—‘অনেক আয়োজন করেছেন মিঃ রায়। একটু নিরিবিলি পরিবেশ ছাড়া আমার প্রয়োজন সামান্যই।’
—‘সেদিক থেকে কান্তিভাই ভুলাভাই’ আদর্শ জায়গা বলতে পারেন। ইচ্ছে হলে যে কোনও মানুষ এখানে নির্জনবাস করতে পারে।’
সামান্য একটু ভুরু তুললেন সেনগুপ্ত, কথা বললেন না।
প্যাসেজ দিয়ে স্টীল হীলের শব্দ তুলে পারমিতা এসে দাঁড়াল, পেছনে জয়ন্তী—‘কি পছন্দ হয়েছে তো?’
—‘চলবে’—পারমিতা সেনগুপ্ত বসে পড়ে বলল, ‘দু একটা ফার্নিচার একটু জাগা বদল করব, তাহলেই কোজি হয়ে যাবে। থ্যাংকিউ মিসেস রয়।’
জয়ন্তী মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
পরমার্থ বললেন—‘আপনার জয়েন করতে তো আর মোটে তিন দিন। আজ থেকেই সেটল করতে পারতেন। সুবিধে হত।’
সেনগুপ্ত বললেন—‘পরশুই একেবারে এসে যাবো। কয়েকটা জরুরি কাজ আছে, সারতে হবে।’
—‘অ্যাজ ইউ প্লীজ’—রান্নাঘর-টরগুলো ভালো করে দেখে নিয়েছেন তো মিসেস সেনগুপ্ত?’
—‘দেখেছি। চমৎকার! আয়্যাম গ্রেটফুল টু য়ু মিসেস রয়। রিয়্যালি!’
জয়ন্তী রায় আড়ষ্ট হেসে বললেন—‘ওহ, নীড্ন্ট মেনশন।’
নিচে নামতে নামতে সিঁড়ির মুখে ওদিককার দরজার তালা খোলবার শব্দে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন পরমার্থ।
—‘মুখার্জিরা এসে গেছে মনে হচ্ছে। ভালোই হল। দুদিনের ছুটি নিয়ে ওরা দীঘা ঘুরে এলো। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপটা সেরেই যান।’
জয়ন্তী দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন—‘থাক না। আলাপ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। একদিনের পক্ষে টু মাচ্ হয়ে যাবে না?’
—‘বাঃ মুখার্জিরা কি মনে করবে বলো তো?’
খোলা দরজা দিয়ে হই হই করতে করতে ঢুকে পড়লেন পরমার্থ। পেছন পেছন ঢুকতে ঢুকতে জয়ন্তী সেনগুপ্তকে লক্ষ করে বললেন—‘আপনাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগছে না। আমার কিন্তু দোষ নেই।’
—‘মুখার্জি কোথায় গেলে?’ গলা চড়ালেন পরমার্থ।
—‘কি ব্যাপার?’ লম্বা, চৌকো চেহারার অরণ্য মুখার্জি এগিয়ে এলেন। চাপা রঙ। মাথার চুলে ঢেউ, ডানদিকে সিঁথি। এখন চুল খুব সম্ভব লম্বা ভ্রমণের জন্যই এলোমেলো হয়ে আছে।
—‘এই যে মিঃ সেনগুপ্ত, আমার ডান হাত অরণ্য মুখার্জি। মুখার্জি, আমাদের নতুন চীফ এঞ্জিনিয়ার সাব আর তাঁর চীফ’—নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন পরমার্থ—চেঁচামেচি করে ডাকলেন ‘কই হে মিসেস মুখার্জি? মেড ফর ইচ্ আদার কমপিটিশনের একজোড়া ক্যানডিডেট দেখে যাও।’
অরণ্য মুখার্জির স্ত্রী জানলার দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। ওপরের মতোই বিশাল হলঘরের বাঁদিকে। অস্ফুট গলায় বলল—‘ঘর ভর্তি গুমোট। জানলাগুলো অন্তত খুলতে দেবেন তো পরমার্থদা।’ জয়ন্তী রায়—স্ট্যান্ডিং ল্যাম্পটার আলো জ্বেলে দিলেন। মৃদু সাদাটে আলো হঠাৎ চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল সবার মুখে। অরণ্য মুখার্জির স্ত্রী একাই খালি অন্ধকারে অস্পষ্ট, জানলার কাছে। পরমার্থ স্নেহভরা গলায় বললেন—‘চলো ব্রততী, মুখার্জি চলো, আমাদের বাড়ি চা যাবে। একগাদা খাবার-দাবার করেছে জয়ন্তী। কি বলেন সেনগুপ্ত? আরেক রাউন্ড চায়ে তো আপত্তি নেই?’
সেনগুপ্ত সম্মতি দিলেন কিনা বোঝা গেল না। অরণ্য মুখার্জির স্ত্রী হঠাৎ কোনও ভূমিকা না করেই ওদিকের শোবার ঘরে ঢুকে গেল, পেছন পেছন ব্যস্ত হয়ে জয়ন্তী রায়।
—‘কি হল কি?’ পরমার্থ হতভম্ব হয়ে বললেন।
জয়ন্তী ঘরের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে বললেন—‘তোমরা এগোও। ব্রততী বেচারার সেই বিশ্রী পেটের যন্ত্রণাটা আবার আরম্ভ হয়েছে। আমি ওকে একটু সুস্থ করে যাচ্ছি।’
অরণ্য মুখার্জি একটু অপ্রস্তুত, একটু চিন্তিত মুখে এগিয়ে এসে বলল —‘আপনারা একটু বসে যান। এখুনি সুস্থ হয়ে যাবে। কি যে হয় থেকে থেকে!’
পারমিতা বলল—‘মাঝে মাঝেই হয় নাকি?’
—‘বেশি পরিশ্রম হলেই হয়। অনেকটা বাস জার্নি তো! গরমটাও কমেনি তেমন।’
—‘আমি যাবো একবার?’ পারমিতা বলল।
সেনগুপ্ত তার কাঁধে হাত রাখলেন। পরমার্থ বললেন—‘ওসব জয়ন্তী জানে ঠিক। আপনি নতুন মানুষ—গিয়ে কি করবেন?’
ভেতরের ঘর থেকে চাপা গোঙানি এবং উদ্গত কিছু চাপবার শব্দ শোনা যেতে লাগল। সেই শব্দ ও তার কারণ মানুষটির ভেতরকার অসহ্য যন্ত্রণার সংবাদ উপস্থিত সব কটি মানুষকে বিবর্ণ করে দিল। পরমার্থ পরিবেশ হালকা করার বৃথা চেষ্টায় বললেন—‘চলুন, মিসেস সেনগুপ্ত, আমার বাড়ি গিয়ে একটু বসে যাবেন।’
অরণ্য মুখার্জির স্ত্রীর খুলে-যাওয়া জানলা পথে হাওয়া না হোক শেষ সন্ধ্যার ঠাণ্ডা ঢুকছিল ঘরে। স্ট্যান্ডিং ল্যাম্পটার ভৌতিক আলোয় ধবধবে ফর্সা সুমন্ত সেনগুপ্তকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল, বললেন—‘না···আমাদের অনেক দূর···পরে আবার···।’
পরমার্থ বললেন—‘তাহলে আমরা গেলাম মুখার্জি। রামশরণকে পাঠিয়ে দিচ্ছি বাড়ি গিয়ে, যদি কিছু দরকার হয়।’
কাঁচা পাকা চুলের মধ্যে দিয়ে চিন্তিতভাবে হাতটা চালাতে লাগালেন পরমার্থ রায়। পেছনে তাড়া করে আসছে রুদ্ধ গলার হাহাকার। দুঃসহ যন্ত্রণার।