কুয়াশা কঠিন বাসর

কুয়াশা কঠিন বাসর

দিনটা বুধবার। দুপুর গড়িয়েছে। ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ সেরে সবে নিজের অফিসে ফিরেছে অরণ্য। বেয়ারা এক কাপ কফি আর একটা টেলিফোন মেসেজ রেখে গেল। বসে বসে কাজ। কফি না হলে এই সময়টায় কেমন একটা ঢুল আসে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাঁ হাতে আলতো করে টেলিফোন মেসেজটা তুলে নিল অরণ্য। কে এক মিস বিশ্বাস হেড অফিসে এসেছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। ফোন করে জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার অর্থাৎ পরের দিন সাড়ে এগারটা নাগাদ আবার আসবেন।

দু চারবার উল্টেপাল্টে দেখল অরণ্য কাগজটা। কোনও কাস্টমারের লোক কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মেসেজে সেরকম কিছু লেখা নেই। সুদ্ধু মিস বিশ্বাস। মহিলা ব্যবসায়ী নাকি? কিছুদিন আগে এই রকম একজন উদ্যোক্তা মহিলা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ট্রেডিং করেন, ম্যানুফ্যাকচারিং-এ নামতে চান, নানান পরামর্শ চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নাম তো যদ্দুর মনে পড়ছে বিশ্বাস নয়। বিরক্ত বোধ করল অরণ্য। দ্বিতীয় কোনও মত প্রকাশের সুযোগ রাখেনি। একেবারে স্থান-কাল ঠিক করে ফোন করছে। যেন গরজটা অরণ্যরই। অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করল অরণ্য।

—‘ভদ্রমহিলা কোনও নম্বর-টম্বর দিয়েছেন?’

—‘না তো সার। তবে খুব আর্জেন্ট মনে হল। বললেন বিষ্যুৎবার তো উনি হেড অফিসে আসেনই, নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে না।’

মাসে একটা বৃহস্পতিবার অরণ্যকে হেড অফিসে যেতে হয়। সেটা জেনেই তা হলে ফোন করেছেন ভদ্রমহিলা। শুধু এটা জানেন না যে, এ মাসে তার হেড অফিসে হাজিরা দেওয়ার কাজটা সারা হয়ে গেছে।

গিয়েই দেখা যাক। হাতে যে সময়টা থাকবে তাতে সোমদের খবর নেওয়া চলবে। ব্রততীকে তুলে নিয়ে পদ্মপুকুর হয়ে ফেরা যেতে পারে। ইদানীং ব্রততীর চেহারা আর শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। কম্পানির গাড়ি বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছতে রোজ বর্ধমানে আসা-যাওয়া করে। সেই গাড়িতেই ও বর্ধমান পর্যন্ত যায়, তারপর ট্রেন ধরে। ফেরবার সময়েও মোটামুটি তাই। খুবই পরিশ্রম হয়। সম্প্রতি যেন মনে হচ্ছে পরিশ্রমটা ওর সইছে না। একটা দিনও যদি সোজা কলকাতা থেকে লিফট্‌ পায়···।

সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আগেই কথাটা ওকে বলল অরণ্য।

ব্রততী বলল—‘বেশি দেরি করবে না কিন্তু। ওই রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পোষাবে না।’

ড্রাইভার নিল না অরণ্য। সত্যি সত্যি যদি সোমদের দেখে আসতে হয়, তো দেরি হবে। কম্পানির ড্রাইভারকে অতক্ষণ ধরে রাখা ঠিক হবে না। সোমদের কাছে যাবার কথাটা অবশ্য ব্রততীকে বলা হয়নি।

মাসে দ্বিতীয়বার হেড-অফিসে যাচ্ছে শুনে ম্যানেজার রায় খুব খুশি। বেশ কয়েকটা কাজ গছিয়ে দিলেন। এটা ভদ্রলোকের একটা দুর্বলতা। কেউ হিসেবের অতিরিক্ত কাজ করছে জানলে আপাদমস্তক খুশি হয়ে যান। মার্কেটিং ম্যানেজার চৌধুরি এই দুর্বলতার সুযোগ প্রায়ই নেয়। ব্রততীর কাছে এসে হাসতে হাসতে বলে— ‘সাইকো এসেছে। বিভীষিকার ছবি আবার আমি একদম মিস করতে চাই না জানোই তো। বললাম সাহেবকে—কলকাতা যাচ্ছি পার্টির সঙ্গে দেখা করতে। ব্যস, সাহেব অমনি গাড়ি-ফাড়ি দিয়ে একেক্কার।’

ফ্যাক্টরি গেট দিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে একটা মেঠো রাস্তা আছে। শর্ট-কাট হয়। কিন্তু সেদিকে গেল না অরণ্য। কাঁচা রাস্তা, কোন কারণে যদি গাড়ি বিগড়োয়, কি গাড্ডায় পড়ে আর দেখতে হবে না। সোজাসুজি জি· টি· রোডে গিয়ে পড়ল। এদিকে ভিড় এখনও কম। শ্রীরামপুরের কাছাকাছি এসে বড্ড সরু হয়ে গেছে রাস্তাটা। বাস এবং ট্রাক চলাচলও খুব। বর্ধমান থেকে কলকাতা পৌঁছতে লাগে দু ঘণ্টার মতো। অরণ্য ডালহৌসী পৌঁছে গেল দু ঘণ্টায়। গাড়ি পার্ক করে ঢুকতে যাবে, আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এলো।

অরণ্য দেখল সবুজ ঝিলিক। কেমন একটা চেনা-চেনা সুগন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। আরে, পারমিতা সেনগুপ্ত না!

—‘কি ব্যাপার? আপনি এখানে?’

—‘আপনার সঙ্গে একটু দরকার আছে। জরুরি।’

—‘চলুন। ভেতরে চলুন।’

—‘ওখানে না।’

—‘ঠিক আছে। একটু বসবেন। একজনের আসবার কথা আছে, কাজটা সেরে নিই।’

—‘আমিই কাল আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি’, মুখ নামিয়ে বলল পারমিতা, গোলাপি নখগুলো চোখের সামনে এনে দেখতে মনোযোগী হয়ে পড়ল হঠাৎ।

অরণ্য আশ্চর্য হয়ে বলল—‘মিস বিশ্বাস?’

—‘হ্যাঁ। আমার বাবার পদবী। এমনিতে আমি বিশ্বাস সেনগুপ্ত লেখা পছন্দ করি। খুব সামান্য একটু মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। অপরাধ নেবেন না। জরুরি দরকার এবং প্রাইভেসির প্রয়োজন না হলে নিতাম না। কোনও একটা নিরালা রেস্তোরাঁয় চলুন, প্লীজ।’

—‘কোথায় যাবেন, বলুন!’

—‘পিপিং-এ চলুন না হয়, লাঞ্চের আগে খুব নিরিবিলি থাকে।’

গাড়ির দরজা খুলে ধরল অরণ্য।

—‘আমি পেছনে বসছি।’ পারমিতা বলল।

উত্তরোত্তর আশ্চর্য হচ্ছিল অরণ্য। মাসখানেক আগে বাবার সঙ্গে ও অফিসে গিয়েছিল। সুমন্তর পাওনাগণ্ডা যা ছিল চুকিয়ে নিয়ে গেল। ম্যানেজার বলছিলেন ভদ্রলোকের ধরনধারন একেবারে মিলিটারি। পারমিতার সানগ্লাস পরা চোখ। কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝবার জো ছিল না। তারও দিন কুড়ি আগে অরণ্য অনেক সাধ্য সাধনা করে ব্রততীকে এবং জয়ন্তী রায়কে নিয়ে ওদের পার্ক সার্কাসের বাড়ি যায়। পারমিতা বাড়ি ছিল না। ওর বাবাও না। বয়স্ক চাকরশ্রেণীর লোক ছিল একটি। প্রায় এক ঘণ্টা পনের মিনিট মতো বসে থেকে ওরা চলে এসেছিল। ফিরতি পথে রাগে ফেটে পড়েছিলেন জয়ন্তী রায় —‘কি দরকার ছিল আসবার? মুখার্জি, আপনার ভদ্রতার এই সব ভালোমানুষি ধরনধারন সবার জন্য নয়। বুঝলেন?’ ব্রততী শান্ত করবার চেষ্টা করেছিল ওঁকে— ‘আঃ জয়ন্তীদি, ওরা কি করে জানবে আমরা আজ আসবো? ইচ্ছে করে তো আর···’ জয়ন্তী রায় ফুঁসছিলেন— ‘ওর স্বামীর মৃত্যুর জন্য কি আমরা দায়ী নাকি? একটা কাপুরুষ। নিশ্চয় চরিত্রহীন। কাপুরুষ না হলে কেউ আত্মহত্যা করে না। চোরা লম্পট। ডুবে ডুবে জল খায়। আমি ঠিক লোক চিনতে পারি, ব্রততী। সবাই তোর মতো ভালোমানুষ নয়। আই ওন্ট টেক ইট লাইং ডাউন।’

অরণ্য বলেছিল—‘কি হচ্ছে বউদি? আফটার অল মানুষটা মারা গেছেন। তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আর এঁদের দোষ কি বলুন! আমরা কি জানান দিয়ে এসেছি?’

কিন্তু পিতাপুত্রী যেদিন অফিসে এলেন ওদের যাওয়ার প্রসঙ্গ একবারও তুললেন না। কাজের লোকটি যদি বলতে ভুলে গিয়ে থাকে তা হলে ভালো, নইলে জয়ন্তী রায়ের কথা মেনে নিয়ে বলতেই হয়, ওঁরা অস্বাভাবিক রকমের আত্মম্ভরি।

সেই পারমিতা সেনগুপ্ত এতো রকম ছলছুতো করে আজ ডেকে এনেছে অরণ্যকে। মিস বিশ্বাস? এটা একটা নাটক বটে!

পিপিং-এ ঢুকে অরণ্য বাঁ দিকের কোণের টেবিলগুলোর দিকে পা বাড়াচ্ছিল। পারমিতা কাউন্টারে বসা চীনে ভদ্রলোকটির দিকে সতর্ক চোখে চেয়ে বলল—‘মিঃ মুখার্জি, যদি মাইন্ড করেন তো কেবিনে যাওয়া যাক। আমার কথাগুলো খুব গোপনীয়।’

চেয়ার টেনে বসতে বসতে অরণ্য বলল—‘সোজাসুজি আপনাদের বাড়ি যেতে বললেই তো হত। এতো কষ্ট করবার কোনও দরকার ছিল না।’

পারমিতার চোখে সেই মস্ত গোল কালো সানগ্লাস। সেটাকে ও টেবিলে নামিয়ে রাখল। পারমিতার চোখের চারপাশ ঘিরে গাঢ় কালি। চোখ দুটো ঈষৎ বসে গেছে। লাল। ও চোখ নামিয়ে বলল— ‘বাবা প্রচণ্ড শক্‌ খেয়েছেন। আপনাদের “কান্তিভাই ভুলাভাইয়ের” ওপর একেবারে ক্ষিপ্ত। ওঁর সামনে কোনও কথা বলা যাবে না।’

অরণ্য বলল—‘ওঁর কি ধারণা, কর্মস্থলের সঙ্গে ব্যাপারটার কোনও যোগাযোগ আছে? ক্ষিপ্ত কেন?

‘তা বলতে পারব না’— পারমিতা বলল—‘তবে আমাদের বাড়িতে ওখানকার কারুর সঙ্গে নিভৃতে কথা বলবার সুযোগ নেই। বয়স হয়েছে বাবার। আনরীজনেবল হতেই পারেন! আমি বাবার একমাত্র সন্তান। মাতৃহীন। বাবা তো এ বিয়ে কিছুতেই দিতে চাননি! আমার জেদে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল।’

বেয়ারা ফ্রায়েড প্রন-এর দুটো প্লেট নিয়ে ঢুকল। পারমিতা বলল—‘প্লীজ নিন। না হলে বসব কি করে? বসতে হবে অনেকক্ষণ। জানেন বাইশে রাত থেকে আর ঘুমোতে পারছি না। হাই ডোজে ওষুধ খেলে কাজ হয়। কিন্তু তাতে সারাদিন বিশ্রী একটা হ্যাঙ্‌-ওভার চলতে থাকে। তাই যথাসম্ভব না খেয়েই থাকতে চেষ্টা করি। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। সুমন্তর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে নানা মহলে গবেষণা চলছে— ভিন্ন ভিন্ন সোর্স থেকে কথাগুলো আমার কানে আসছে।’

অরণ্য বলল—‘মিসেস সেনগুপ্ত। এসব ক্ষেত্রে এ রকম একটু-আধটু আলগা কথা হবেই। আপনি বুদ্ধিমতী মেয়ে, আপনি কেন সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাবেন?’

পারমিতা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল—‘বাড়িতে শুধু আমি আর বাবা। মা মারা গেছেন পাঁচ-ছ বছর। আই ওয়জ দেন জাস্ট আ স্লিপ অফ আ গার্ল। পরের বারে ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেবো। একটা গাড়িতে শুয়ে শুয়ে ও এলো। ড্রাইভার শম্ভুদা আর বাড়ির কম্বাইন্ড হ্যান্ড শ্রীপতিকাকু মিলে ওকে ধরে ধরে দোতলায় তুলল। তখন অনেক রাত। আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে এসেছিলাম তাই। বাবা বলেছিলেন—‘মিতু এ আমাদের দেশের ছেলে, খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে হস্টেলে, কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে ওকে, তুমি একটু দেখাশোনা করো। কদিন পরই ও বিদেশ চলে যাবে। সবাই ছিল, তবু আমি সে সময়ে ওর সেবা করেছি। তিন বছর পর ইংলন্ড থেকে যখন এলো, মিঃ মুখার্জি, আমিই ওকে পাগলের মতো প্রোপোজ করি। এই তিন বছর আমি অন্য কিছু ভাবিনি।···’

পারমিতার কথা আটকে গেল; একটু পরে সামলে নিয়ে ধরা ধরা গলায় বলল—‘বাবা কিছুতেই বিয়েটা দিতে চাননি। বয়সের ডিফারেন্স অনেক। এখন শুনতে পাই ওর দিদি প্রচুর দাবি-দাওয়া করেছিলেন, বাবাকে সে সব মেটাতে হয়···’

অরণ্যর অস্বস্তি হচ্ছিল, বলল—‘আমার কাছে মন খুলে আপনি যদি হালকা হতে চান, আলাদা কথা। কিন্তু এসব কথা আমাকে বলে কি লাভ? আমি তো আপনাদের সম্পর্কে কোনও গুজবকে প্রশ্রয় দিইনি, বিশ্বাস করা তো দূরের কথা।’

পারমিতা হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল, ওর লম্বা হারের লকেটে সুমন্তর ছবি, লুটোপুটি খাচ্ছে রুইতনের মতো লকেটটা টেবিলের ওপর। দম বন্ধ, কান্না আটকানো গলায় ও বলল— ‘আমি বারো বছর ওর সঙ্গে এক দেশ থেকে আরেক দেশ ঘুরে ঘুরে সংসার করেছি মিঃ মুখার্জি, এখন মনে হচ্ছে সমস্তটা খেলা, তামাশা। বিশ্বাস করুন, আমার কাছেই ব্যাপারটা সবচেয়ে রহস্যময়। আর কিছু না, আপনি যদি একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে পারেন এ ব্যবহারের তা হলেও সান্ত্বনা পাবো। কি পায়নি বলুন তো ও জীবনে? রূপকথার রাজপুত্রের মতো জীবন— বুদ্ধি, মেধা, রূপ···সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে চাকরি। যেখানে যায় সাকসেস্ আর হিরো ওয়রশিপ। আচ্ছা বলুন, আমিই কি স্ত্রী হিসেবে ওর খুব অযোগ্য ছিলাম!’

—‘এভাবে চিন্তা করছেন কেন?’

—‘স্ত্রীকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসলে কেউ এ রকম করে? যখন ছুটি-টুটিতে এখানে এসেছি, থেকেছি ওদের গ্রামে আমাদের সঙ্গে কালচ্যারাল অ্যাফিনিটি কোথাও নেই তবু ওই দিদির সঙ্গে সমান তালে কোমর বেঁধে গ্রামের পার্বণের খাটুনি খেটেছি। ও নিজে তো দেশে কখনও আসত না। আসতুম আমি আর ববি, আমার ছেলে। এতো কথা আপনাকে বলছি শুধু আপনাকে বোঝাতে যে আমার জন্য ওকে কখনও কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি, উত্তেজনায় থমথমে গলা পারমিতা বলল—‘আমি তো বলব সম্পূর্ণ বিবেকহীন ক্রিমিন্যাল ও। সমাজ-ব্যবস্থার চূড়ান্ত সুখ-সুবিধেগুলো সমস্ত ভোগ করেছে।

এমনিতে রেডিমেড কেরিয়ার। বিদেশে পাঠানো, সংসার পেতে দেওয়ার দায়িত্ব শ্বশুরের। সামাজিক মর্যাদারক্ষার দায় স্ত্রীর। ওই বিধবা দিদি, যিনি ওকে মানুষ করেছেন, তাঁর প্রতিও বিশেষ কোনও কর্তব্য পালন করতে ওকে হয়নি। লাখে কটা মেলে বলুন তো এইরকম লাইফ! তবু এরা চুপি চুপি অন্যের সুখ-শান্তির পুরো স্ট্রাকচারটার তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেয়। আমি জেদ করে সুখী হবার চেষ্টা করতে পারি কিন্তু এই স্মৃতি কি আমায় কোনদিন সুস্থ হতে দেবে? আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি। আমার জীবনে কি এই দুঃস্বপ্নের একান্তই প্রয়োজন ছিল?’ টপটপ করে চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল, পারমিতা একবারও মোছবার চেষ্টা করল না।

অরণ্য খুব কোমল গলায় বলল—‘আপনি এভাবে ভাববেন না। জানেন তো ডাক্তাররা বলে সুইসাইড এর পেছনে টেমপোর‍্যারি ইনস্যানিটি থাকে।’

হঠাৎ পারমিতা মুখ ফেরাল, ওর গালে একটা নীল শিরা দপ্‌দপ্‌ করছে। চোখের কোণ দিয়ে কেমন করে যেন অরণ্যর দিকে তাকাল, বলল—‘আপনি কি সত্যিই কিছু জানেন না, মিঃ মুখার্জি?’

—‘আমি?’

—‘হ্যাঁ, আপনি! আপনার স্ত্রীকে যে ও দারুণ অ্যাডমায়ার করত। কতটা করত, আগে এভাবে বুঝিনি।’

—‘ব্রততীকে? সেনগুপ্ত? কি বলছেন?’

অরণ্যর চোখে চোখ রেখে পারমিতা বলল—‘ও বলত মিসেস মুখার্জি রিমাইন্ড্‌স্ মি অফ ইটারনিটি। কথাটা ওকে একাধিকবার বলতে শুনেছি। খুব চাপা স্বভাবের বলে বোঝা যেত না, কিন্তু সুমন্ত বোধহয় খুব ইমোশন্যাল ছিল, দার্শনিক এবং প্রচ্ছন্ন কবি, আপনার কিন্তু ব্রততী মুখার্জির স্বামী হিসেবে ব্যাপারটা বোঝার কথা।’

অরণ্য স্তম্ভিত হয়ে পারমিতার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ও তখনও বলছে—‘মিসেস মুখার্জি কিছু রেঁধে পাঠালে মুখে দেবার অনেক আগেই ও বুঝতে পারত জিনিসটা কোথা থেকে এসেছে। খেতে খেতে চোখ মুখ জ্বলজ্বল করত যেন প্রসাদ-ট্রসাদ খাচ্ছে। এতো গভীর কমিউনিকেশন, আর আপনিই তার খোঁজ রাখেন না? আমি অত্যন্ত আনরোম্যান্টিক। কিন্তু এখন সব কিছু বারবার চিন্তা করে আমার এই ধারণা ক্রমে বদ্ধমূল হচ্ছে সুমন্ত দ্যাট পুওর ফেলো, ফেল হোপলেসলি ইন লাভ উইথ ইয়োর ওয়াইফ। ইন ডেড আর্নেস্ট। অ্যান্ড শী ফেড ইট। পারপাসলি।’

অরণ্য অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করে উঠে দাঁড়াল, বলল—‘আপনার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।’

পারমিতা সেই একই রকম চোখে চেয়ে বলল—‘উনি তাহলে ওকে বাইরে মীট করতেন না?’

—‘কি বলতে চান, আপনি?’

—‘দিনটা সুদ্ধু আমার মনে আছে। সতেরই আগস্ট। সুমন্তর ডবলিউ এম এফ থ্রি জিরো নাইন থ্রি আপনার স্ত্রীর স্কুলের কাছাকাছি পার্ক করা ছিল, জানেন? আমি গানের স্কুল ফেরৎ লোয়ার সার্কুলার রোডে মার্কেটিং করতে গিয়ে দেখতে পাই। ছুটে গিয়ে কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে টকটকে লাল মুখে বলল—অফিসের কাজে এসেছে। অফিসের কাজে এসে কেউ গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে চুপচাপ বসে থাকে?’

অরণ্য গম্ভীর গলায় বলল—‘আপনার স্বামী কেন ওই সময়ে ওই জায়গায় গিয়েছিলেন, আমি জানি না। জানতে চাইও না। ব্রততী এসব ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ জানে না বলে আমার বিশ্বাস। আজেবাজে সন্দেহের বশে নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দেবেন না। যান। বাড়ি যান।’

সুইং ডোর ঠেলে বাইরে এলো অরণ্য। চীনে খাবারের চাপ চাপ গন্ধ ঠেলে পার্ক স্ট্রীটের উন্মুক্ত হাওয়ায়। উঃ। মাথাটা গরম হয়ে গেছে। দেখতে শুনতে আধুনিকা। গান-বাজনা আর্ট এগজিবিশন করে, এখনও স্বজাতি-বিদ্বেষ আর ঈর্ষার সনাতন কালে পড়ে আছে?

ঘড়িতে মোটে দেড়টা। এখনও হাতে অনেক সময়। পরমার্থদার দেওয়া কাজ সারতে ডালহৌসি ফিরতে হবে। মাথার মধ্যে বিছে কামড়াচ্ছে। ডালহৌসি হয়ে, আবার ঘুরে বেন্টিংক স্ট্রীট, ধর্মতলা, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ক্যামাক, ল্যান্সডাউন হয়ে দেশপ্রিয় পার্ক। অনেকক্ষণ গাড়ি পার্ক করে বসে বসে জনতা দেখা। আবার ঘুরে রাসবিহারী, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড ধরে সোজা চলে এসে লোয়ার সার্কুলার রোড।

ব্রততী আসছে। আকাশনীল শাড়ি। সাদা সাদা ঘন বুটি। কালো ব্লাউজ। কপালে কুচো চুল। মাথা ঝাঁকিয়ে বিনুনিটা সামনে থেকে পেছনে পাঠিয়ে দিল। ঘড়ি দেখছে। মৃদু হাসি। স্বচ্ছ, নির্মল। রোগা হয়ে গেছে ইদানীং। কেমন ক্লান্ত দেখায়। পেছনে আরও তিনটি মহিলা। এগিয়ে এসে ব্রততী বলল— ‘মঞ্জু, শিবানীদি আর উত্তরা, ওদের এসপ্লানেডে নামিয়ে দিতে হবে।’

মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে নমস্কার সারল অরণ্য। গাড়ির দরজা খুলে ধরল। তিন মহিলা পেছনের সীটে বসে শালিখ পাখির মতো কিচিরমিচির করছেন। ব্রততী সামনের সীট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কষল অরণ্য। আরেকটু হলেই মিনিবাসটার সঙ্গে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হত। মুখ নিচে নামিয়ে বোধহয় চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছে ড্রাইভারটা। ভয়ার্ত গলায় পেছন থেকে মন্তব্য হল—‘আপনি কি সবসময়েই এরকম ড্রাইভ করেন মিঃ মুখার্জি? না আজ আমাদের ভাগ্যে বা দুর্ভাগ্যে করলেন!’

অরণ্যর জিভ শুকিয়ে গেছে। বলল—‘যা বলেন।’

পেছন থেকে আবার মন্তব্য হল—‘এতো কথা বলিস কেন? কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যায়।’

এসপ্লানেডে তিনজন নেমে গেলে ব্রততী বলল—‘কিছু হয়েছে?’

—‘কি হবে?’

—‘না, কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে?’

হঠাৎ আলটপকা মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, সংযম নষ্ট হয়ে গেছে, ভুরু কুঁচকে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে অরণ্য বলল—‘তুমি যখন-তখন অন্যমনস্ক উদাস হয়ে যেতে পারো, অ্যাক্‌টিং মিস্টিরিয়াস। আমার বেলাই যত দোষ।’

ব্রততী অবাক হয়ে বলল—‘ওমা, ছোট ছেলের মতো ঝগড়া করছ কেন? দোষ, আমি বলেছি? অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য গাড়ি ঘোড়ার রাস্তা বাছলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে না?’

অরণ্য আড়চোখে চেয়ে দেখল খুব স্নিগ্ধ মুখ। রোগা হয়ে গেছে বলেই কি একটু করুণও। বলল—‘শীর্ষদের দেখতে যাবে?’

ব্রততী খুব খুশি হয়ে বলল—‘সময় হবে? তবে চলো না। সোমকে বলব— ‘খিঁচুড়ি চাপাতে, আমাকে আর বাড়ি ফিরে রান্না-টান্না করতে হবে না।’

—‘সুদ্ধু রান্নার ভয়ে ভাইয়েদের কাছে এসেছো, জানলে কি ওরা খুশি হবে?’

—‘কারণ যাই হোক, ফলাফল যদি দিদি-অরণ্যদা, হয় খুশি হতে বাধ্য।’

—‘তাহলে ভালো মিষ্টির দোকান টোকান দেখলে বলো, কিছুমিছু নিয়ে যাওয়া যাবে।

ব্রততী হেসে ফেলল—‘কিছুমিছু কিনতে হলে তো সবজি-বাজারে যেতে হবে।’

অরণ্য স্টিয়ারিং-এ চোখ রেখে একই ছন্দে বলল—‘সুমন্ত সেনগুপ্তর গাড়িতে তুমি কতো দিন চড়েছ?’

দারুণ চমকে ব্রততী বলল—‘মানে? হঠাৎ?’

—‘বলোই না।’

‘কোনদিন না,’ ব্রততী শক্ত মুখে, জেদী গলায় বলল—‘যদিও তোমার এ প্রশ্নের কোন অর্থই বুঝতে পারছি না।’

—‘সত্যিই বুঝতে পারছো না? কেউ কেউ তোমাকে আর সুমন্ত সেনগুপ্ত গাড়িকে কাছাকাছি দেখেছে কিন্তু।’

—‘কে?’

—‘যে-ই হোক না কেন!’

—‘বললুম তো না। আমি মিথ্যে বলতে পারি না।’

—‘মিথ্যে বলতে হয়ত পারো না, কিন্তু সত্য গোপন করতে তো পারো?’

ব্রততী পাশে আস্তে আস্তে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অরণ্য বুঝতে পারল। ক্রোধে, বিস্ময়ে না ভয়ে কে জানে! তূণ থেকে একটার পর একটা বিষাক্ত তীর আপনা থেকে তার সম্মতি ছাড়াই কি করে নিক্ষিপ্ত হয়ে গেল সে জানে না। কিন্তু শরসন্ধান মনে হচ্ছে অব্যর্থ। পাশে নারী নির্ভুলভাবে বাণবিদ্ধ। সামনে শীতের মলিন বিকেল। যানজটের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ মনখারাপের পথ। সোম কি শীর্ষর মুখ আর দেখা যাচ্ছে না সঙ্কল্পের আয়নায়। গাড়ির মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে গেল। ব্রততী কোনও প্রশ্ন করল না। বিরাট একটা বাদুড়ের পাখার মতো শেষ নভেম্বরের অন্ধকার কবলিত করে ফেলছে হাইওয়ে। অন্যমনস্ক অ্যামবাসাডর ছুটে চলেছে। কিছু দেখছে না। কিছু শুনছে না। ভেতরে নিঃশব্দ আর্তনাদ। সম্পর্কের মধ্যে বিন্দু বিন্দু রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অ্যামবাসাডরের যুগল আসন থেকে আর্ত রক্তবিন্দু পারার দানার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছিটকে যাচ্ছে পথে। মাঠে, ডোবায়, জলায়, দোকানে। ধান ক্ষেত আর গাছ-গাছালির অভ্যন্তর থেকে ছুটে আসছে দলা দলা অন্ধকার।

ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামল ফ্যাকটরি গেটের কাছে। প্রায় আটটা। দারোয়ান গেট খুলে অরণ্যর হাতে একটা মেসেজ দিল। মেসেজেরই দিন আজ। পরমার্থদা অফিসে দেখা করতে বলেছেন একবার। বাড়ির সামনে ব্রততী নেমে গেল নিঃশব্দে। গাড়ি গ্যারাজে তুলে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ম্যানেজারের অফিস। পরমার্থ রায়ের সামনে অরণ্যর দিকে পেছন ফিরে কেউ একজন বসে। অরণ্যর দৃষ্টি সোজা রায়ের দিকে। উদ্বিগ্ন মুখে রায় বললেন—‘মিঃ মৈত্র তোমার জন্য অনেকক্ষণ বসে আছেন, মুখার্জি। কি সব জিজ্ঞাস্য আছে ওঁর।’ রায় উঠে দাঁড়ালেন, যদিও কেউ বলেনি, তবুও বাইরে চলে গেলেন। অরণ্য এতক্ষণে দেখল। ইউনিফর্ম পরে দ্বারিকা মৈত্র। রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে অরণ্যর মুখোমুখি হলেন মৈত্র—‘বসুন মিঃ মুখার্জি।’ হাতের একটা নোটবইয়ের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন—‘বিবি কার নাম?’

—‘জানি না।’

—‘জানেন, কিন্তু বলবেন না।’

বিরক্ত গলায় অরণ্য বলল—‘আর কিছু বলবেন?’

—‘কাজটা ঠিক করছেন না মিঃ মুখার্জি। জানবার অন্য সোর্স আছে আমাদের।’

—‘অন্য সোর্সের কাছে যাচ্ছেন না কেন? যা আমি জানি না তার জন্য আমাকে মিছিমিছি বিরক্ত করে কি লাভ?’

—‘আপনার স্ত্রীর নাম তাহলে বিবি নয়?’

নিস্পন্দ হয়ে গেল অরণ্য। একটু পরে বলল—‘আমার স্ত্রীকে আমি বরাবর ব্রততী বলেই জানি।’

হাসলেন দ্বারিকা মৈত্র—‘আপনার উত্তরটা কি উকিলের শিখিয়ে দেওয়া?’

তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন—‘অন্য কিছু না। “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়” চিরকুটটার পেছনে বারবার লিখে বারবার কাটা হয়েছে একটা নাম আমাদের এক্সপার্ট উদ্ধার করেছেন নামটা বিবি। বিশ্বস্তসূত্রে জানলাম আপনার স্ত্রীর ডাকনাম বিবি।’

—‘আমিও সেটা আজ, এখনই জানলাম।’

—‘কতদিন বিয়ে করেছেন?’

—‘বছর নয়েক।’

—‘কোথায় পড়াশোনা আপনার?’

—‘স্কুলজীবন কলকাতায়। তারপর কাশী।

—‘ওখানকারই বাসিন্দা নাকি?’

—‘হ্যাঁ। আর কিছু দরকার আছে?’

—‘নাঃ। কিচ্ছু না। বিশ্বস্তসূত্রে আরও জানলাম, ক্যালকাটা এবং বেঙ্গল পুলিশের খাতায় বিবি নামে একটি সাঙ্ঘাতিক নকশাল মেয়ের নাম, ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট অর্থাৎ পুরো একটা ডসিয়ারই রক্ষিত আছে। বিখ্যাত এক কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী এই মেয়েটির কাছে তার সহযোদ্ধারা তাদের যাবতীয় আর্মস অ্যান্ড অ্যামিউনিশন জমা রাখত। লালবাজারে মেয়েটির নিকনেম ছিল অগ্নিকন্যা।’

—কপালে অজস্র ভাঁজ পড়তে চাইছে। অরণ্য প্রাণপণে সেগুলোকে টেনে টেনে সমান করছে। হিমালয়ের তুষারগলা রাত। ভেসে আসছে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নির্বাক মহিলার কণ্ঠস্বর—‘বিবি, বিবি, বিবিরে।!’

সমগ্র যাত্রাপথে ওই একবারই মুখ খুলেছিলেন ভদ্রমহিলা। কাকে ডাকছেন, কেন ডাকছেন তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেনি কেউ। হাতজোড় করে নমস্কার করল দীঘল চেহারার মেয়েটি। লম্বা, কালো বিনুনি। সোজা ভুরু। চোখ দুটো কোমল, গভীর, গম্ভীর।

—‘আমার নাম ব্রততী চক্রবর্তী। কলকাতা থেকে আসছি।’

দ্বারিকা মৈত্র বললেন—‘আপনাকে কষ্ট দিলাম মিঃ মুখার্জি। কিন্তু আপনার শ্যালক সৌম্য আর শীর্ষ চক্রবর্তী যে দুর্ঘটনার রাতে উপস্থিত ছিল, আপনার বাড়িতে যে সুমন্ত সেনগুপ্তর ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকত, ইনভেস্টিগেশনের সময়ে যে আপনার শ্যালকদ্বয় চুপিচুপি পালিয়ে যায়, এসব কথা গোপন করে আপনি অযথা নিজেকে সন্দেহভাজন করে তুলেছেন।’

অরণ্য নিঃশ্বাস ফেলে বলল—‘আপনার আর কিছু বলবার আছে? থাকলে আমাকে স্বভাবতই উকিলের মাধ্যমে কথা বলতে হবে।’

—‘অতটা বোধহয় দরকার হবে না। তবে আরও কিছু বলবার ছিল। আপনার শ্যালকদ্বয়ের আঙুলের ছাপ সুমন্ত সেনগুপ্তর ফ্ল্যাটের নানান জায়গায় পাওয়া গেছে। এবং এরা দুজন সত্তর-বাহাত্তরের নোটোরিয়াস নকশাল। শীর্ষ চক্রবর্তী ওরফে বাচ্চু সি পি এম মিনিস্ট্রি না হলে ছাড়া পেতো না আজও। ডেনজারাস চ্যাপ। আপাতদৃষ্টিতে এখন কোনও অ্যাকটিভিটি নেই যদিও। আপনার কিছু জানা থাকলে যদি বলেন উপকৃত হবো।’

—‘আমার কিছু বলার নেই। তবে আমার স্ত্রী এবং কাজের লোকটি ডেডবডি আবিষ্কার করে যখন ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, আমি এবং সৌম্য চক্রবর্তী দুজনেই ছুটে ওপরে উঠে যাই। আমাদের দুজনেরই ফিঙ্গার প্রিন্ট ওই ফ্ল্যাটের নানান জায়গায় পাওয়া যেতেই পারে।’

দ্বারিকা মৈত্র মৃদু হেসে বললেন—‘অবশ্যই। কিন্তু শীর্ষ চক্রবর্তী। দ্যাট ডেঞ্জারাস ফেলো? সে-ও কি আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে ওপরে দৌড়েছিল?’

ঘৃণায় জবাব দিল না অরণ্য। দ্বারিকা মৈত্র বললেন—‘তার আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। মিসেস সেনগুপ্তর বাবা রিটায়ার্ড ডিএস পি আমাদের নিজেদের লোক। তিনি ইনভেস্টিগেশনের জন্য চাপ না দিলে আমরা হয়ত এতোটা করতাম না। রুটিন চেক করে সুইসাইড কেস বলে ছেড়ে দিতাম। যাক, ঘাবড়াবেন না মিঃ মুখার্জি, পুলিশ কাউকে শুধু শুধু ফ্রেম করবার জন্য তথ্য ম্যানুফ্যাকচার করে না। শুনলে আশ্চর্য হবেন সুমন্ত সেনগুপ্তও সত্তর বাহাত্তরের নামকরা নকশাল-লীডার ছিল। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বিরাট গ্রুপ ওর কথায় উঠত বসত। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে রিলেশন খুব ক্লোজ ছিল। আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন।’ সতর্ক চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন দ্বারিকা মৈত্র।

দুজনে দুপাশে। মাঝখানে রাত। নির্জন। নীল। ঘুম নেই। ঘুম আসে না। রাতের কোটরে ঢুকে পড়ছে আস্তে আস্তে। নিস্পন্দ, নির্বাক। শেষ রাতের অস্তগামী চাঁদ কপালে টর্চ ফেললে ব্রততী মৃদুস্বরে বলল—‘আমি তো তোমায় বলেইছিলুম আই অ্যাম এ উওম্যান উইথ এ পাস্ট। বলিনি?’

অরণ্য বলল—‘সে অতীতের প্রকৃতিটা যদি একটু বুঝতে দিতে।’

—‘আমার কথা বলা যে বড় কঠিন! সোমদের কথা তো সবই জানো। তাতেও বোঝনি?’

—‘না।’

ব্রততী বলল—‘অতীত যা-ই হোক আমার বর্তমানটা পুরোপুরিই তোমার হাতে, এ নিয়ে কোনও সংশয় রেখো না। জানি না, ভবিষ্যতটা হয়ত আমার একলার। অরণ্য বলল— ‘তুমি কি খুব ভয় পেয়ে গেছো?’ ব্রততী বলল— ‘আমার জীবন নিয়ে ভয় এমন ছিনিমিনি খেলা খেলেছে যে সজ্ঞানে আমি আর ভয় কাকে বলে জানি না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *