অগ্নিকোণ

অগ্নিকোণ

কোনও কোনও রাতে কারও কারও চোখে ঘুম নামতেই চায় না। আবার কারও কারও চোখ জুড়ে নিবিড়, নিতল, নিঃস্বপন ঘুম। দেয়াল ঘড়িতে একটার পর একটা ঘণ্টা কাটার শব্দ, একটানা ঝিঁঝির খত্তাল, ফাঁকা জায়গা পেয়ে উন্মত্ত চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। দোহারকি দিচ্ছে কি একটা রাতচরা পাখি কু-কু-কুক্‌ কু-কু-কুক্‌। জানলার ফাঁক দিয়ে দমকা হাওয়ার সঙ্গে হঠাৎ নাম-না-জানা গাছালির উৎকট উগ্র গন্ধ। জানোয়ারের গায়ের গ্‌ন্ধের মতো। সারারাত ছটফট করেছে ব্রততী। শেষ রাতে যেই পাতলা ঘুম নেমেছে অমনি শুরু হল ভয় দেখানো স্বপ্নদের আনাগোনা। মাঝবয়সী একজন আঁটসাঁট মোটা ভদ্রমহিলা, বড় বড় চোখ, কোঁকড়ানো পাকা চুল, এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছেন, হাতে সুদর্শন চক্রের মতো একটা অস্ত্র। কিরকির কিরকির করে ঘুরছে। মুখ দিয়ে চিৎকার বেরোচ্ছে না, পেছোতে পেছোতে একটা গরাদহীন খোলা জানলা দিয়ে ব্রততী পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে অনেক নিচে, মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে একটা আওয়াজ বেরোতে যাচ্ছিল, ঘুমটা চড়াৎ করে ভেঙে গেল। এইবার মনে হল স্বপ্নে-টপ্নে নয়। সত্যি-সত্যি বাইরে চোর এসেছে। কি রকম একটা অস্পষ্ট খড়খড় খড়খড় মতো আওয়াজ। কেউ যেন সন্তর্পণে গরাদ কাটছে। মেঝেতে কোনও কাগজের টুকরো পাখার হাওয়ায় ঘুরপাক খেলেও এ জাতীয় শব্দ হয়। ইঁদুর-টিঁদুরের জন্য বা পাখি টাখি…।

গতকাল শুতে বারোটা বেজে গিয়েছিল। সৌম্য এসেছে। শীর্ষ এসেছে। বহু সাধ্য-সাধনার পর। অরণ্য বলছিল—‘যেভাবে আমরা তোমাদের জন্য সাধনা করেছি সৌম্য, ঈশ্বরের জন্য করলে নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হত।’ সঙ্গে সঙ্গে সৌম্যর অবধারিত প্রশ্ন—‘আপনার এই ঈশ্বর অভ্যাসের ঈশ্বর না বিশ্বাসের ঈশ্বর, অরণ্যদা—’

তর্ক এড়াতে অরণ্য বলেছিল—‘ঈশ্বরটা ইয়ের বিকল্প সৌম্য, আর কিছু না।’ ব্রততী জানে অরণ্য গভীরভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী, এতো গভীর, যে অন্যের ঠাট্টা-তামাশায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু এসে যায় না ওর।

শীর্ষ এমনিতে বেরোতে চায় না। সাহায্য ছাড়া তো পারবেও না। অভ্যেস করলে হয়ত এতদিনে কিছুটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু অভ্যাস করবার ইচ্ছেটাই ওর মরে গেছে। জোর করতে মন চায় না। শীর্ষকে চোয়াল শক্ত করে কোনও নির্দেশ দেবার দিন তার বড়দের চলে গেছে। সৌম্যর চলাফেরাও তাই খুবই সীমাবদ্ধ। খোঁজ খবর নেবার প্রয়োজন হলে ব্রততীই যায়, কিম্বা অরণ্য। অরণ্যদাকে ওরা দুজনেই দারুণ ভালোবাসে। মতের মিল থাক না থাক। বুকের মধ্যে একটা কাঁটা সব সময়ে খচখচ করে। ওদের জন্য দিদি সত্যিকারের করার মতো কিছু কোনদিন করতে পারল না। ওরাই বরং নিজেদের দুঃসহ জীবনের পরিধি থেকে দিদিকে সন্তর্পণে পার করে দিয়েছে। পার করেছে অসীম মমতার সঙ্গে। শীর্ষর জন্য সৌম্যই সংসার করল না। বেতের ব্যবসা করে। আজকাল কাঠও ধরেছে। সেই সূত্রে কিছুটা ভ্রমণ ওকে করতেই হয়, নইলে সৌম্য বলতে গেলে শীর্ষর ছায়া। ছায়া যেমন অনেক সময়ে লম্বা বড়মাপের হয়ে পড়ে, শীর্ষর পাশে সৌম্যও তেমনি। সৌম্যর সঙ্গে যার বিয়ে হবার কথা ছিল সেই শ্রীময়ী অসম্ভব ধৈর্যশীল মেয়ে। অনেক, অনেকদিন ওর জন্য অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু সৌম্য ও ব্যাপারে নির্বিকার। ওর মধ্যে কোনও ভাবালুতা নেই, বড় বড় কথা নেই, কিচ্ছু না। কিন্তু যে কাজটা করবে বলে মনে করে, তা থেকে কেউ ওকে নড়াতে পারবে না। আজও। কাউকে আঘাত-টাঘাত না দিয়ে এটা যে ও কেমন করে পারে! শ্রীময়ীর সঙ্গে ওর আলাপ স্কুলের বয়স থেকে। অথচ শীর্ষর জন্য অমন মেয়েটাকে অনায়াসে চলে যেতে দিল। খুব সম্ভব ব্রততীকেও যেমন বুঝিয়েছিল, শ্রীময়ীকেও তেমনি বুঝিয়েছে। বিয়ে করাটা শ্রীর একান্ত দরকার, এবং ওর নিজের না করাটা! ব্রততী বোঝাবার চেষ্টা করেছিল—শ্রী তো খুব ভালো মেয়ে সোম, ওকি শীর্ষকে দেখবে না?’ সৌম্য বলেছিল—শ্ৰী খুব ভালো মেয়ে দিদি, আমিও খুব ভালো ছেলে। কিন্তু স্বার্থপরতা যদি একবার এসে ভর করে শীর্ষর কি হবে?’ ব্রততী বলেছিল—‘তোদের কারুর পক্ষেই স্বার্থপরতা সম্ভব বলে আমি মনে করি না।’ সৌম্য তখন আস্তে আস্তে বলেছিল—‘দিদি, তোর কি মনে নেই, শীর্ষ কি রকম ফুল ব্লাডেড ইয়ংম্যান ছিল!’ শীর্ষ অনাগ্রহী চোখে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। বলে না—‘ছোড়দা, তুই আমার জন্যে কেন…।’

আসল কথাটা বললে সেটা মোটেই সত্যি হত না। ন্যাকামি হত। একজন যদি কীটদষ্ট হয়ে অসম্ভব কষ্টে বাঁচে, তাহলে তার প্রিয়জনরা আর সবাই স্বাভাবিকভাবে, সুন্দরভাবে জীবনযাপন করবে, যেন কিছুই হয়নি, কোথাও অসমতল কিছু নেই—সেটাই অস্বাভাবিক, সেটাই মিথ্যে। সৌম্য আর শীর্ষর মধ্যে কোনও ভাবালুতা নেই, ন্যাকামি নেই। মিথ্যেও নেই। তাই শীর্ষ বলে না—‘ছোড়দা, তুই তোর নিজের মতো করে বাঁচ।’ ভাবাবেগে আমরা এরকম কথা প্রায়ই বলে থাকি, যদিও আসলে বলতে চাই না। অন্যরকম একটা দায়িত্ববোধ, খুব সূক্ষ্ম বিবেকের কীটদংশন কি সৌম্যর ভেতরেও চিরকাল কাজ করে যাবে না? জীবন দর্শনের ব্যাপারে শীর্ষ যে একদা ভীষণভাবে ছোড়দার ওপর নির্ভরশীল ছিল! তাই ওরা দুজন এক, একা।

একভাবে দেখতে গেলে ব্রততী, অরণ্যও একা। তিনজন হতে পারল না বলে। অরণ্য কিছু বলে না। ওর ভেতরে একটা মেনে নেওয়ার ব্যাপার আছে। ব্রততী যখন ডাক্তার-টাক্তার দেখানোর হাঙ্গামায় রাজি হল না, তখন সে কিছুই বলেনি। সহকর্মীদের পরামর্শেই খুব আলতোভাবে কথাটা তোলা। ব্রততী আমল না দিতে দ্বিতীয়বার আর বলেনি। নিজেকে দেখিয়ে নিয়ে চুপ করে থেকেছে। ব্রততী-অরণ্য দুজন ঠিকই। আবার দুজনে মিলেও সব সময়ে একজন হতে পারে না। কোথাও কোথাও একা। একেবারে একা। সেই একাকিত্ব বিদ্ধ করবার চেষ্টা নেই অরণ্যর। সেটা উদ্যমের অভাবের জন্য না। সৌম্য-শীৰ্ষর মতো নিভাঁজ বোঝাপড়া না থাকলেও ওদের মধ্যেও একটা নিরুক্ত বোঝাবুঝি আছে। ব্রততী একা হয়ে গেলে, কারণটা অনুমান করতে পারলেও অরণ্য আস্তে আস্তে গভীর ভাবে হারিয়ে যায়। ইচ্ছে করেই। একাকিত্বটা ব্রততীর ভীষণ প্রয়োজন বুঝে সেটাকে যেন সম্ভব করে দিতেই।

আড্ডাটা সত্যিকার জমেছিল আসলে কাল। রবিবার ছুটি বলেই শনিবার রাত্তিরের আড্ডা সবচেয়ে রমণীয়। ওরা শুক্রবার থেকে রয়েছে অথচ চারজনে মিলে একসঙ্গে খেতে বসা পর্যন্ত হয়নি কদিন। শনিবার রাতে প্রথম হল। অরণ্য বলছিল—‘তোমার হাত আজ খুব খুলেছে মনে হচ্ছে!’ কদিন আগেই, ওদের আসার ঠিকঠাক হতে ব্রততী বলেছিল—‘তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো?’

—‘অসুবিধে কিসের?’

—‘অন্য কিছু না। শীর্ষর জন্য কোনও জবাবদিহি… কারো ব্যঙ্গ… এটা তো ফ্যাক্‌টরি-কলোনিই… আমি এখানকার ব্যাপার-স্যাপার জানি বলেই বলছি।’

—‘দ্যাখো ব্রততী, এদেশে কিম্বা সারা পৃথিবীতে কত প্রতিবন্ধী আছে তার স্ট্যাটিসটিক্‌স্ জানো? কাজেই তার ‘কি কেন কবে কোথায়’ নিয়ে মাথা ঘামাবে কে? কার অত সময়?’

—‘তোমাদের মিল কলোনিতে সময় আছে গো। অনেকের।’

—‘এসব ব্যাপারে বেশি টাচি হয়ো না ব্রততী, দ্যাট্‌স্‌ অল।’

খুব জমেছিল কাল। যারা সবসময়ে একমত তাদের মধ্যেও আড্ডা জমে, কিন্তু একটু-আধটু রকমফের হলে জমে আরও। অরণ্য খুব ধীর, শান্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ। তলিয়ে বোঝবার আগে কখনও কিছু সিদ্ধান্ত নেবার পাত্র নয়। চওড়া কাঁধ, হাত-পাও কর্মী-মানুষের কিন্তু চোখের দৃষ্টি দেখলে বোঝা যায় গভীরতা মাপতে কিছু সময় প্রয়োজন। সৌম্যও একটা ধীরতা আয়ত্ত করেছে আজকাল। কিন্তু সেটা চেষ্টাকৃত। খুব ঠুনকো। শীর্ষ এখনও ছেলেমানুষ, খুব মেজাজি। ওর মেজাজের ঋতুবদল খুব দ্রুত হয়। মস্ত এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলছিল—‘নাইটমেয়ার্স অফ এমিনেন্ট পার্সন্‌স্‌’ পড়েছেন অরণ্যদা? পড়লে বুঝতে পারতেন সাহিত্যিক হিসেবেও মানে ফিকশন মেকার হিসেবেও রাসেল কি অসাধারণ ছিলেন!’

অরণ্য বলছিল—‘দ্যাখো শীর্ষ, রাসেলের গ্রেটনেস কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু সাহিত্যের ব্যাপারে শ এর সঙ্গে তুলনা চলে না।’

—‘এই দেখুন, আপনি রাসেলের কি পড়েছেন? ‘এবি সি অফ রিলেটিভিটি’ আর ‘কংকোয়েস্ট অফ হ্যাপিনেস’ এই তো? অ্যাভারেজ পাঠক তাই পড়ে। আর শ-এর?’

—উঃ অনেক। স-বই বোধহয়। কি অসাধারণ মণীষা! লেখার ধার কি! আমাদের সময় তখন কলকাতার আঁতেল সার্কলে এলিয়ট খুব চলছে আর বোদলেয়র। কিন্তু পজিটিভ কিছু দিতে না পারলে… আর রাসেলের ওই বারবার বিয়ে করাটা যাই বলো…’

উচ্চৈস্বরে হেসে উঠেছিল শীর্ষ এবং সৌম্যও।

ব্রততী ফোড়ন কেটেছিল—‘যতই হাসো, তোমাদের এই গ্রেটমেনরা সব অটোমেশন। হৃদয়হীন, যান্ত্রিক…’

—‘যান্ত্রিক? তাই-ই বোধহয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অ্যান্টি-ওয়ার মুভমেন্ট করলেন। সমস্ত জগৎ যখন কমিউনিজম আর বোলশেভিকদের বিরুদ্ধে তখন রাশিয়া ঘুরে এলেন।’

—‘এদের কি বলে জানিস? ঘর-জ্বালানে পর-ভোলানে।’—ব্রততী নির্লজ্জভাবে মেয়েলি মন্তব্য করল।

অম্বুরি তামাকের ধোঁয়ার মতো ঘুরপাক খেতে খেতে ওদের আড্ডা শেষ হয়েছিল সৌম্যর মন্তব্যে—‘তোমাদের গান্ধী মহারাজ অরণ্যদা দারুণ মজাদার লোক কিন্তু। মিডিইভ্যাল সেন্ট আর মর্ডান ম্যানের জগাখিচুড়ি। দুঃখের বিষয় যেখানে মর্ডান ম্যানের ভূমিকায় নামা উচিত ছিল সেখানে সাধুগিরি করে গেলেন। আর যেখানে সাধুসন্ত হয়ে চুপচাপ থাকা উচিত ছিল সেখানে গোলমেলে পলিটিক্‌সের একেবারে মাঝমধ্যিখানে নাকটি গলালেন’ বলতে বলতে সৌম্য মাথা অবধি মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ এ বিষয়ে ও আর কিছু শুনতেও চায় না, বলতেও চায় না। অরণ্য তা সত্ত্বেও বলেছিল—‘সেই জন্যেই কি সারা পৃথিবীতে আজ ভদ্রলোককে নিয়ে এতো হইচই?’

চাদরের তলা থেকে সৌম্যর ঠাট্টা — সে তো অ্যাটেনবরোর গ্যান্ডি!’ ঘড়িতে ঢং করে বেজেছিল বারোটা। —‘আর রাত করিসনি শীর্ষ, ঘুমিয়ে পড়।’ জড়ানো গলায় শীর্ষর উত্তর—‘আমি তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই ঘুমোচ্ছি!’ চারজনের ধুম হাসি। আসলে শীর্ষ রাজনৈতিক আলোচনার বাষ্পের মধ্যেও থাকতে চায় না। ও আজকাল সাহিত্য পড়ে, দর্শন পড়ে, সংস্কৃত শিখছে নাকি টুলো পণ্ডিত মশাই রেখে। অতঃপর ব্রততী-অরণ্যর মস্ত বড় বড় সমাপ্তিসূচক হাই।

ব্রততী জিজ্ঞেস করেছিল—‘শীর্ষ তোর আর বালিশ লাগবে? সঙ্কোচ করিসনি। আমার অনেকগুলো কুশন তোলা আছে।’

—‘থাকলে দে। অ্যাজ মেনি অ্যাজ পসিবল।’

শুতে শুতে অরণ্য আত্মগত বলছিল—‘আগে ভাবতুম এক্সট্রিমিজ্‌ম্‌টা বয়সের ধর্ম। ম্যাচিওরিটি এলে আপনা আপনিই অরুচি এসে যায়। এখন দেখছি ওটা ব্যক্তিগত চরিত্র আর মেজাজের ব্যাপার।’

ব্রততী হাই চাপা দিতে দিতে বলেছিল—‘রাত্তিরবেলার আড্ডাগুলো তোমরা একটু কম সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কোরো।’

—‘অর্থাৎ হিন্দি- সিনেমা এবং টিভি সিরিয়্যাল?’

অরণ্য শব্দ করে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলেছিল। দরজা খোলা, সৌম্যও শুনতে পেয়েছে, ও-ও হাসছিল, বলছিল—‘দিদি তোর মাথা গরম হয়ে গিয়ে থাকে একটু জল থাবড়ে শুয়ে পড়।’

কোথা থেকে আসছে শব্দটা! লিভিং রুমের পর্দা সরালো ব্রততী। সৌম্য মনে হল জেগে গেছে। শব্দ করে পাশ ফিরল। পাখাটা শনশন করে চলছে। ঝড় বইছে ঘরে। শীর্ষটা ঠাণ্ডায় একেবারে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে গেছে। এদিককার ভোরে এতোটা দরকার হয় না। গ্রীষ্মকালেও ভোরে চাদর লাগে এক এক সময়। ব্রততী বন্ধ করে দিল সুইচটা। বলল—‘শব্দটা শুনতে পাচ্ছিস?’

জড়ানো গলায় উত্তর এলো—‘পাখি-টাখি হবে, বাসা করছে বোধহয়… দিস ইজ দি স্প্রিং টাইম, দিস ইজ দা হ্যাপি রিং টাইম…।

—সেপ্টেম্বরে স্প্রিং টাইম?

—‘ওই হলো। ঘুমে সব গুলিয়ে দিচ্ছে রে দিদি। প্লীজ পালা।’

—‘চোর নয় তো?’

—‘চোর হলে আগে ওষুধ-ফষুধ স্প্রে করত। কষ্ট করে জাগাতো না এভাবে। যা এখন… ঘুমোতে দে।…’

সুরক্ষিত মিল এলাকা হলেও ঘরের মধ্যে ওষুধ স্প্রে করে জানলার গ্রিল উপড়ে চুরি বা ডাকাতির ঘটনা যে এখানে একেবারেই ঘটে না, তা বলা যায় না। গত বছরই সুপারভাইজার মহাপাত্রর বাড়ি হয়েছে। আসলে মিলের পেছনে সোয়া মাইল গেলেই রেলওয়ে সাইডিং। ওই দিক থেকেই আসে এরা। একতলা বলেই বেশি সাবধানতা। ব্রততী একবার চারদিক দেখে এলো। এখন যদি স্বপ্নের সেই মোটা ভদ্রমহিলাকে সামনে পেতো দেখে নিত একবার। স্বপ্নের কথা মনে করে ব্রততীর হাসি পেলো। রান্নাঘরে সিঙ্কের ওপর রাজ্যের এঁটো বাসনকোশন জড় করা রয়েছে। বিশ্রী গুমসোনি গন্ধ বেরোচ্ছে। কোথাও কিছু নেই। কিন্তু শব্দটা একই ছন্দে হয়েই যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে। খড়খড় খড়খড়। ধুত্তেরি। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। আরেকবার বিছানায় ঢুকল ব্রততী। রবিবার। তাড়া নেই। সারা দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কাটবে। বারবার চা চাইবে শুধু তিনটে ছেলে। উপছোনো অ্যাসট্রে পরিষ্কার করতে হবে বারবার। আর কোনও হাঙ্গামা নেই।

সকালে বাগানের দিকের দরজাটা খুলতে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝা গেল। দোতলার বারান্দার নল দিয়ে খুব সরু ধারায় জল পড়ে যাচ্ছে। সারারাত জলটা এইভাবে সমানে পড়ে গেছে। মাটির ওপর বিছোনো মোরামে পড়ে শব্দ হয়েছে ছড়ছড় ছড়ছড়। ব্রততী সেটাকে শুনেছে খড়খড় খড়খড়। সারা রাত শব্দটা উড়ো আপদের মতো ঘুমের শান্তি তছনছ করেছে। সৌম্যটাও জেগে গিয়েছিল। ওরও হয়ত। শব্দ-টব্দ হলে ব্রততী একদম ঘুমোতে পারে না। ছেঁড়া ঘুম দুঃস্বপ্নের দাঁড়ি কমা সেমিকোলন সমেত ঘোরাফেরা করেছে মাথায় যেন সাইক্লোনের মেঘ।

আসলে রান্নাঘর দুদিক থেকে বন্ধ। বাইরে প্যাসেজ। প্যাসেজ দিয়ে গিয়ে তবে পেছনের বারান্দা। তারও ওদিকে বাগানের মোরামের ওপর দোতলার বারান্দা থেকে জল পড়েছে। এদিক থেকে বোঝার উপায় ছিল না। তাই রাতে দু তিনটে ঘর খুলে তদন্ত করেও উৎসটা আবিষ্কার করা যায়নি।

দোতলায়, চীফ এঞ্জিনিয়ার সুমন্ত সেনগুপ্তদের বারান্দায় কলওয়ালা পেল্লাই জয়ঢাকের মতো জালা থাকে। হরিদ্বার-টারে যেমন পাওয়া যায়। খুব সম্ভব বিদঘুটে চেহারা আর বোম্বাই সাইজের জন্যই ওটার বাইরের বারান্দায় স্থান হয়েছে। তবে ওতে টিউবওয়েলের পানীয় জলই তোলা থাকে বোধহয়। এই জালাটা থেকেই নিশ্চয় জল পড়ছে। মাঝরাতে কোন সময়ে জল খেয়ে কলটা ভালো করে বন্ধ করতে ভুলে গেছেন সুমন্তবাবু। উনি নাকি আবার ফ্রিজের জল খান না। গলা ব্যথা করে। বলছিল একদিন ওঁর স্ত্রী পারমিতা। সব মানুষেরই কিছু কিছু বাতিক থাকে।

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বাইরের বাগানের দিকে বেরিয়ে ব্রততী মুখ উঁচু করে দেখবার চেষ্টা করছে তার অনুমান ঠিক কিনা, পেছন থেকে রামের মার সাড়া পেলো।

—‘কি দেখতেছ গো বউদিদি?’

ব্রততী বলল—‘তুমি এসে পড়েছ ভালোই হয়েছে, রামের মা। ওপরের বাবুকে গিয়ে বলো তো বারান্দার নালি দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে, জালার কলটা যেন আগে বন্ধ করেন। দেখো, দেয়ালময় কিরকম কাদার ছিটে উঠেছে!’

রামের মা ওপর নিচ দুতলাতেই কাজ করে। প্রথমে নিচের কাজ সারে, তারপর ওপরে যায়। ব্রততীর কথায় সে চলে গেল। কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলো আবার। —‘ধাক্কা মারতেছি, বেল বাজিয়ে মরতেছি, কেউ খোলেনি কেন গা?’

ব্রততী বলল—‘ওপরের বউদি তো শনি-রবিবার বাড়ি থাকেন না। তুমি ভুলে গেছো? বাবু একা আছেন তো! হয়ত আজ বেশি ঘুমিয়ে পড়েছেন, তুমি আর একটু ধাক্কা দাও!’

চায়ের কেটলির শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাপিয়ে রামের মার ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ বেশ ভালো করেই কানে এলো।

একবার করে তীব্র নিখাদে বেল বেজে ওঠে। তার জলতরঙ্গ বাজনা শুরু হয়, তারপরেই রামের মার খনখনে গলার আওয়াজ—“ও বাবু, সায়েব, সায়েব গো! দরোজাটা খোলবেনি?’

চোখ মুছতে মুছতে অরণ্য উঠে এলো।

—‘কি ব্যাপার? সাত সকালে রামের মা লাগিয়েছেটা কি? রোববারেও যে একটু আয়েস করে ঘুমোব। তার উপায় নেই। বারোমাস ছত্রিশ দিন…’

—‘তা তোমাদের সেনগুপ্ত সাহেব যদি কুম্ভকর্ণ হন, রামের মার আর দোষ কি বলো? —ব্রততী চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলল —‘তুমি এক কাজ করো তো। আমাদের শোবার ঘরের ওদিকটায় চলে যাও, বাগান দিয়ে, নিচে থেকে একটা হাঁক দাও। ওদিকের জানলা দিয়ে শুনতে পাবে এখন।’

অরণ্য চটি পায়ে বাগানের দিকে বেরিয়ে গেল।

ব্রততী রান্নাঘর থেকে দেখল সৌম্য লিভিংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে। দাড়ির মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলল— ‘শীর্ষ কাল সারারাত ছটফট করেছে, আজ ভাবছি চলেই যাবো। একটু বেশি করে ব্রেকফাস্ট দিস।’

ব্রততী স্থম্ভিত হয়ে বলল—‘সে কি রে? চলে যাবি কি? আজকের জন্যেই তো যত আয়োজন। জল্পনা-কল্পনা। ঠিক আছে। তোদের যা ইচ্ছে চিরকালই করে এসেছিস, এখনও কর।’

ব্রততী তৃতীয় কাপে চা ছাঁকতে লাগল। সৌম্য একটু ইতস্তত করে বলল—‘ব্যাপারটা ঠিক মান অভিমানের পর্যায়ে নেই রে। শীর্ষ একটু বেশিরকম আপসেট হয়ে পড়েছে। বুঝতেই পারছিস। সবকিছু তো আর আগে থেকে হাত গুনে বলা যায় না! ফিজিক্যাল হ্যানডিক্যাপ নিয়ে তবু যা হয় করে চালাচ্ছি, মানসিক বিপর্যয় কিছু ঘটে গেলে কি করব বলতে পারিস?’— শেষের দিকে সৌম্যর গলা নিচু, ভারি হয়ে এলো। অরণ্য ফিরে এসে বলল—‘ষাঁড়ের মতো চেঁচালুম, নাথিং ডুয়িং।’

রামের মাও ততক্ষণে আবার নিচে নেমে এসেছে।

—‘বাবুরে যে কালঘুমে ধরেছে গো। অসুকবিসুক নাকি?’

অরণ্য একটু চিন্তিত হয়ে বলল— ‘তোমার কাছে তো মিসেস সেনগুপ্ত ডুপ্লিকেট চাবিটা রাখে, সেটা দিয়ে খুলে দেখো না হয়। তুমি নিজেই একবার যাও, রামের মার সঙ্গে। অসুখ টসুখ কিছু করল কিনা কে জানে।’

ব্রততী বলল—‘আমি অতশত পারবো না। তুমি যাও না।’

অরণ্য বলল—‘এই দ্যাখো। আমি শেভিং ক্রিমটা মেখে ফেলেছি। নইলে যেতুম ঠিক। দুটো টান দিয়েই আমি যাচ্ছি। তুমি প্লীজ একবার দেখো। ওপরতলার প্রতিবেশী খারাপ দেখাবে না হলে।’

চাবিটা খুঁজে পেতে সামান্য দেরি হল ব্রততীর। একটা হুকে ও নিজের সমস্ত চাবি রাখে। আলাদা একটা হুকে সেনগুপ্তদের ফ্ল্যাটের চাবি। চাবিটা সেখানে ছিল না। ওর বারোয়ারি চাবির হুকেই কখন রেখেছে মনের ভুলে।

শীর্ষ গুঁড়িসুঁড়ি মেরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। খানছয়েক কুশন ওর বাঁকাচোরা শরীরের চারপাশে। সৌম্যর হাতে চায়ের কাপ এবং কাগজ। গালে সবে সেফটি রেজারের একটা দুটো টান দিয়েছে অরণ্য, এমন সময়ে এলো ব্রততীর চিৎকারটা। একটা লম্বা লং ক্লথের টুকরোকে যেন কেউ চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল। ব্রততীর তো নয়ই। কোনও মানুষের গলা বলেই মনে হয় না এতো গা ছমছমে আওয়াজ। তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে বিদ্যুৎগতিতে দৌড়ে গেল অরণ্য। চায়ের কাপটা ঠক করে নামিয়ে পেছন পেছন সৌম্যও। মাঝসিঁড়ি অবধি উঠেছে কি ওঠেনি, দেখল ব্রততী কেমন এলোমোলা পা ফেলে অন্ধের মতো টলতে টলতে নেমে আসছে। মুখটা রক্তহীন। অরণ্যকে দেখে পায়ের কাছে কেমন জড়সড় হয়ে বসে পড়ল। ধরে না ফেললে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যেত।

—‘কি হয়েছে? হয়েছেটা কি তোমার?’

সৌম্য পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ব্রততীকে ভালো করে ধরে বলল—‘রামের মার দিকে দেখো অরণ্যদা।’

হলঘরটার অপর প্রান্তে দেয়ালজোড়া একটা দেওদারের ফ্যাব্রিক পেন্টিং। সাদার ওপর গাঢ়, কালচে সবুজ। তার তলায় সটান শুয়ে পড়েছে রামের মা। খুব সম্ভব দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে এবং দেখতে অরণ্যর এক লহমার বেশি সময় লাগল না। ওরা ধরাধরি করে ব্রততীকে ঘরের মেঝেতে বসিয়ে দিল, তারপর শোবার ঘরের দিকে দৌড়ে গেল। হলের অপর প্রান্তে। ডান দিকে শোবার ঘরের দরজা খোলা। দরজাপথে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল অরণ্য। পুবের জানলা দিয়ে রোদ এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। সূর্যকে পেছনে নিয়ে বাইরের কমপাউন্ডের রেনট্রিটার ছায়ার ঝিলিমিলি আন্দোলিত হচ্ছে সুমন্ত সেনগুপ্তর বিয়েতে পাওয়া সাদা সানমাইকার খাটের ধবধবে চাদরে। ডানলোপিলোর গদি একেবারে টানটান। খালি পায়ে, খালি গায়ে খাটের মালিক স্বয়ং অনতিদূরে একটা স্টীলের চেয়ারে আসন পিঁড়ি হয়ে ধ্যানস্থ। তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কালো কালো সরু সরু সাপ।

প্রথম ধাক্কাটা সামলে অরণ্য আর একটু এগিয়ে গেল। সাপগুলো এসেছে সুইচবোর্ড থেকে। একটা সুইচের ঢাকনা খোলা। সেখান থেকে দুটো তার সোজা সুমন্তর পায়ের আঙুলে এসে পৌঁছেছে। মোক্ষম প্যাঁচ দিয়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে চলে গেছে গলা অবধি। কাগজের মতো শাদা একটি উপবিষ্ট বুদ্ধমুর্তি। বরাভয় মুদ্রাটি শুধু নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সৌম্যকে ধাক্কা দিয়ে সভয়ে পিছিয়ে এলো অরণ্য। টেলিফোনটার দিকে ছুটে গেল তারপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *