উদ্যত সঙ্গিন
আসাম থেকে ফিরে সাধারণত সৌম্য সোজা সন্তোষদের বাড়ি যায় না। নিজেদের পদ্মপুকুরের বাড়ি গিয়ে আগে বদ্ধ ঘর-টর খুলে ঝাড়পোঁছ করে এবং করায়। বাসযোগ্য হতে বাড়িটা দুতিন দিন সময় নেয়। বড় বাজার থেকে কারিগর ধরার ব্যাপার থাকে তাছাড়া। সৌম্যর ব্যবসা এখনও মাঝারি পর্যায়ে আছে। বাঁধা কারিগর রাখলে লোকসান হয়ে যায় খুব। কাজেই অর্ডার অনুযায়ী কারিগর ধরতে হয় ওকে। জিনিসটাতে ওর মানসিক সায় নেই। যত শিগগির সম্ভব একটা বাঁধা-ধরা ব্যবস্থা করে ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ও। কিন্তু আপাতত উপায় নেই। এই সমস্ত ঘোরাঘুরির কাজগুলো ও শীর্ষ আসবার আগেই সেরে ফেলতে চায়।
এবার কিন্তু ও সোজা সন্তোষদের ওখানে চলে গেল। হেমন্তের বিকেল। ঝট করে আলো চলে যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ধোঁয়াশা দল পাকাতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। সময়টা খুব বাজে। হাওয়া ভারি হয়ে গেছে অথচ শীতের দেখা নেই। শ্রী বাড়ি নেই। সন্তোষও না। শীর্ষই আগলাচ্ছিল ওদের ছেলেকে। কিংবা উল্টো করেও বলা যায়। নির্বাণই সামলাচ্ছিল শীর্ষকাকুকে। নির্বাণই দরজা খুলে দিল। ভালো বলতে হবে ছেলেটাকে। সারা বিকেল, সারা সন্ধে, বাইরে খেলাধুলোর লোভ সামলে একটা পঙ্গু মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছে, বাবা-মা বলে গেছে বলে। দরজাটা খুলে দিয়েই নির্বাণ দৌড়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। সৌম্যকে দেখে শীর্ষও কোনও কথা বলল না। চোখ তুলে তাকাল শুধু একবার। দাবা খেলছে দুজনে। খেলায় মগ্ন একেবারে। সুটকেসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে একটা চেয়ারে বসে চোখ বুজল সৌম্য। যমুনাদিদিও নেই মনে হচ্ছে। নইলে এই সময়ে এক কাপ চা পেলে ভালো হত।
মাঝে মাঝে চোখ খুলে ওদের খেলা দেখছিল সৌম্য। অতিরিক্ত মনোযোগের ফলে নির্বাণের ঠোঁটদুটো গোল পয়সার মতো হয়ে গেছে। চোখদুটো বোর্ডের ওপর থেকে সরছে না। শীর্ষর মুখ শান্ত, আত্মমগ্ন। দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই সৌম্য বুঝতে পারল নির্বাণের ব্যাপারটা। আসলে কিন্তু নির্বাণ কোনও আত্মত্যাগ করছে না। এই বয়সের ছেলেদের মধ্যে আত্মত্যাগটা আসা স্বাভাবিকও নয়। উপরন্তু এই বয়সের বালকদের কিছু কিছু হিরো থাকে বড়দের মধ্যে। নির্বাণ শীর্ষর সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কোনও কর্তব্যবোধে না, শীর্ষ ওর কাছে ফুটবল খেলার মাঠের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় বলে। নতুন করে হঠাৎ সৌম্য অনুভব করল শীর্ষর সেই চৌম্বক শক্তি। ছোট থেকেই ওর প্রচুর ভক্তমণ্ডলী ছিল, তারা ওর কথায় সব কিছু করতে প্রস্তুত থাকত। শীর্ষ নিজে যা করত, নির্ভুলভাবে সমস্ত মনোযোগ, সমস্ত আবেগ দিয়ে করত। কত দিকে, কত ভাবে যে নিজেকে প্রয়োগ করতে পারত ও। পারত কেন, এখনও পারে, পারছে। কালিদাস শেষ করে ফেলেছে। এখন ভাস ধরেছে পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে। অরিজিন্যাল ইলিয়াড ওডিসি পড়বে বলে গ্রীক শিখছে। এখানে আবার শ্রীর ছেলের সঙ্গে ওর একটা আলাদা জগত। শীর্ষ এখানে খুব সহজে ওর প্রাপ্তবয়স্কতা থেকে কয়েক ধাপ নেমে আসে, নিবার্ণও তার বালকত্ব থেকে উঠে যায় কয়েক ধাপ তার হিরোর সঙ্গে মিলতে। এই জিনিসটা যদি আর কিছুদিন চলতে থাকে তাহলে নির্বাণ খুব শ্লাঘ্য একটা কৈশোরে পৌঁছে যাবে তাড়াতাড়ি। সমবয়সীদের সঙ্গ ওর কাছে খুব অতৃপ্তিকর লাগবে। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে ও বড় কিছু খুঁজতে থাকবে। নিজেকে সমর্পণ করা যায় এমন কিছু।
শীর্ষ বলল, ‘তুই এবারও মাত্ হয়ে গেলি নির্বাণ। এরকম করলে আর গ্র্যান্ডমাস্টার হবি কি করে?’
নির্বাণ বলল— ‘হেরে গেছি, গেছি। তুমি কিন্তু খবর্দার ইচ্ছে করে আমায় জিতিয়ে দেবার চেষ্টা করবে না কালকের মতো।’
‘ঠিক আছে’ শীর্ষ বলল, ‘তবে, তোর দু চারটে চালের ভুল ধরিয়ে না দিলে শিখতে পারবি না।’
—‘তাহলে প্রথমে একটা ট্রায়াল গেম হবে। সেটাতে তুমি সব ভুলগুলো ধরিয়ে দেবে। তারপর আসল খেলা। তখন কিন্তু স্পিকটি নট।’
‘মায়ের কাছ থেকে পাস করিয়ে নিস এটা। স্কুলের টাস্কগুলো সব পড়ে থাকবে তো!’ —শীর্ষ হাসিমুখে বলল, তারপর সৌম্যর দিকে তাকাল ‘তুই যেন শিডিউল্ড টাইমের আগেই ফিরেছিস মনে হচ্ছে?’
‘প্লেনে এলুম’— সৌম্য ছোট্ট করে বলল। শ্ৰী আর সন্তোষের ফেরার শব্দ শোনবার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে ও। সেটা প্রকাশও করতে পারছে না।
যমুনাদি এসে গিয়েছিল। এসে বলল, ‘চায়ের সঙ্গে আর কি খাবেন সৌম্যদা!’
—‘কিছু না স্রেফ চা।’
দরজার আওয়াজ পাওয়া গেল এতক্ষণে। সৌম্য উঠে গেল। সন্তোষরা ফিরেছে। সৌম্য দরজা খুলে দিতে অবাক হয়ে গেল। সৌম্য বলল, ‘দরকারি কথা আছে।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি’ শ্ৰী বলল, ‘সিনেমা দেখে মাথা ধরে গেছে। চা খাওয়া পর্যন্ত কথাটা অপেক্ষা করতে পারবে?’
‘না। কারণ কথাটা দরজার ওদিকে অপেক্ষা করে রয়েছে। ওদিকে তাকাসনি শ্রী। সন্তোষ, আধখানা ভেতরে আধখানা বাইরে হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ভেতরে এসো। খিল তুলে দিই।’
‘ব্যাপারখানা কি বলো তো?’ সন্তোষ ফিসফিসে গলায় অবাক হয়ে বলল।
‘আমিও তাই জিজ্ঞেস করছি তখন থেকে। নিজেকে। এবার তোমাদের জিজ্ঞেস করব।’
শ্রী বলল, ‘রান্নাঘরে যমুনাদি, বসবার ঘরে শীর্ষরা রয়েছে। চলো শোবার ঘরে যাই।’
সন্তোষ বলল, ‘আগে শীর্ষকাকুকে দেখা দিয়ে আসি।’ গলা চড়িয়ে বলল, ‘কই হে শীর্ষকাকু! খেলার রেজাল্ট কি?’
তিনজনে ঘরে ঢুকে দেখল শীর্ষ তক্তাপোশের ওপর পিঠে তাকিয়া নিয়ে চোখ বুজে কাত হয়ে আছে। পাশে দাবা-বোর্ড মুড়ে রাখা। নির্বাণ শীর্ষর আঙুল টেনে দিচ্ছে।
সন্তোষ বলল, ‘অ্যাই, অত জোরে না।’
নির্বাণ বলল, ‘কি করবো? শীর্ষকাকুর আঙুলে যে শব্দই হয় না।’
‘তাই বলে ওরকম গায়ের জোরে টিপবি?’ শ্ৰী ধমকে উঠল।
চোখ বুজিয়ে বুজিয়েই শীর্ষ বলল, ‘আঃ। আমাদের বিরক্ত করছো কেন? খেলায় হারলে নির্বাণ আমার আঙুল মটকে দেবে কথা ছিল। তোমরা যে কনফারেন্সে যাচ্ছিলে যাও না, ছোড়দা অনেকক্ষণ ধরে টেনস্ড্ হয়ে আছে।’
ওরা তিনজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কি অদ্ভুত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এই ছেলেটির! একেও ফাঁদে পড়তে হয়!
শোবার ঘরে ঢুকে খাটের ওপর বসল সন্তোষ। সৌম্যকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে শ্রী বলল, ‘তাড়াতাড়ি বলল সৌম্যদা ব্যাপারটা কি। এখুনি যমুনাদি এসে পড়বে। ওর আবার সব তাতেই ভীষণ কৌতূহল।’
‘এখান থেকে আসাম এবং আসাম থেকে কলকাতা জিরো জিরো সেভ্ন্ আমার পেছন পেছন ঘুরেছে। অ্যাভয়েড করবার জন্য প্লেন ধরলুম, তা-ও দেখি ঠিক তোদের দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।’
শ্রী বলল, ‘তুমি আবার অ্যাভয়েড করবার জন্য প্লেন ধরতে গেলে কেন?’
—‘জাস্ট টু সি যে ব্যাটা খসে কিনা।’
শ্ৰী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সৌম্যদা, অনেক বুদ্ধিও ধরো, সাহসও আছে স্বীকার করছি। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারে বড্ড বোকামি করে ফ্যালো। এটা ঠিক করোনি। তোমার কি ট্রেনের রিটার্ন টিকিট করা ছিল?’
‘ছিল। তবে কনফার্মেশন পেতে বড্ড দেরি হচ্ছিল। জানিসই তো, কোথাও প্রয়োজনের বেশি সময় কাটাবার আমার জো নেই। ধর, ধৈর্য হারিয়েই যদি প্লেনে এসে থাকি!’
সন্তোষের মুখটা বদলে যাচ্ছিল। সে বাঘই, তবে মানুষ-খেকো নয়। নেহাত প্রয়োজন না হলে সংহার-মূর্তি ধরে না। চাপা গরগরে গলায় হাতের আস্তিন গুটোতে গুটোতে বলল, ‘দ্বিতীয়বার যদি ও তোমাদের ট্রাবল দেয়, সন্তোষ মিত্তির কিন্তু আর ছেড়ে দেবে না। লাশ পড়ে যাবে। ফাইন্যাল বলে দিলুম।’
উদ্বিগ্ন চোখে শ্ৰী ওর দিকে চাইল, ‘তুমি আবার সঙ্গে সঙ্গে আস্তিন গুটোতে লাগলে কেন? দোহাই তোমার, র্যাশ কথাবার্তা বলো না। আমার হয়েছে জ্বালা।’
সন্তোষ বলল, ‘ছেড়ে দেবে তাই বলে? কোথায় “মার মার শত্রু মার” বলে রুখে দাঁড়াবে’, এ যে দেখছি জুড়িয়ে একেবারে জল হয়ে গেছো?’
সৌম্য একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিল, সেটা টিপে ছাইদানে ফেলে দিতে দিতে বলল, ‘ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া না দেওয়ার নয় সন্তোষ! আমি ভাবছি কেন! কেনটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। আমাদের তো কোন কিছুর সঙ্গে সংশ্রব নেই! তবে কেন?’
সন্তোষ শক্ত মুখে বলল, ‘এই ‘কেন’র কোনও উত্তর থাকে না সৌম্যদা। একবার ওরা যাকে ধরে তার শেষ না দেখে ছাড়া বোধয় ওদের কোষ্ঠীতে লেখে না।’
‘শেষের আর বাকি কি আছে?’ অন্যমনস্ক হয়ে সৌম্য বলল।
নির্বাণ দরজার কাছে এসে দাঁড়াল, ‘মা, বাবা, সৌম্যদা, শীর্ষকাকু তোমাদের ডাকছে।’ মা-বাবার দেখাদেখি নির্বাণও সৌম্যকে সৌম্যদা বলে।
সন্তোষ বলল, ‘ঠিকই। ওকে আর সাসপেন্সে রাখা ঠিক হবে না।’
শ্রী তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোমরা যেন আবার ওকে কিছু বলতে যেও না।’ সন্তোষ সৌম্য দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘পাগল হয়েছো?’
বিকেল মরে গেছে অনেকক্ষণ। বাড়ি বাড়ি সন্ধের শাঁখ বাজা শেষ। ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে শ্রী বলল, ‘তোমরা যাও, আলোগুলো জ্বালতে জ্বালতে যাও। আমি একটু ধুনো দেখাই ঘরে ঘরে। বড্ড মশা হয়েছে।’ শ্ৰী আলনা থেকে আটপৌরে ছাপা শাড়ি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সন্তোষ উঠতে উঠতে বলল, ‘আজ আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই সৌম্যদা।’
‘কেন?’ সৌম্য বলল, ‘জিরো জিরো সেভেনের ভয়ে?’
‘তা নয়। এখন ক্লান্ত হয়ে এসে ঝাড়া পোঁছা, ঘরটর খুলে সে তো বিস্তর কাজ!’
‘ও আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আমি গিয়েই পেছনের গলি থেকে লাট্টুকে ডেকে আনি। তালা-টালা খুলে, জানলা টালনা খুলতে থাকি; ইতিমধ্যে ও ঝাড়পোঁছ করে নেয়। আজ গিয়ে সব ঘর খুলবো না তো! আজ না গেলে কাল সকালে অসুবিধে হবে। মাল এসে পড়বে শিগগিরই। অনেক কাজ ভাই।’
দালানের আলো জ্বেলে ওরা বৈঠকখানায় গেল। ঘর অন্ধকার। তক্তাপোশের ওপর শীর্ষর আধ-শোয়া চেহারার আদল দেখা যাচ্ছে। আলো জ্বালতে বারণ করল।
সন্তোষ বলল, ‘খোকন গেল কোথায়?’
—‘বন্ধুর বাড়ি থেকে কি বই আনতে গেল। এখুনি আসছে,’ শীর্ষ গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘ছোড়দা একজন পুরনো বন্ধু আমাদের জানলার উল্টোদিকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইমাত্র গাঢাকা দিল। অবশ্যই স্ববেশে আসেনি। দাড়ি গোঁফে মুখ প্রায় ঢাকা, আধময়লা জামাকাপড়। একটা চারমিনার ধরিয়ে ছিল। গন্ধটা আমাকে গাইড করল। চারমিনারের সঙ্গে এমন একটা অ্যাসোসিয়েশন গড়ে উঠেছে। আমি মুখ তুলে তাকাতে যেন সিগারেট ধরাবার জন্যে থেমেছিল, এমনি একটা ভাব করে ওদিকে চলে গেল। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দেওয়া ওর পক্ষে শক্ত।’
সৌম্য নিচু গলায় বলল, ‘তোকে নয়, ও শ্যাডো করছে আমাকে। সেই গৌহাটি থেকে। ঘাবড়াস না। এটা হয়ত রুটিন কাজের মধ্যেই পড়ে ওদের।’
শীর্ষ বলল, ‘না। ঘাবড়াবার আর কি আছে, খাঁড়ার ঘা’টা শুধু দেওয়া বাকি। তবে তুই যদি বলিস গৌহাটি থেকে ও তোকে শ্যাডো করতে করতে আসছে, সেটাকে রুটিন কাজ বলে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে শক্ত। তবে আমি ঘাবড়াচ্ছি না।’
সন্তোষ বলল, ‘আমি খোঁজখবর নিচ্ছি শীর্ষকাকু, তুই ভাবিস না।’
সন্তোষের গলায় কি ছিল, শীর্ষ ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল, তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আমি বোধহয় ওর ‘কেন’টা অনুমান করতে পারছি।’
‘পারছিস?’ সৌম্য আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার বল তো?’
শীর্ষ নরম সুরে বলল, ‘জানি। কিন্তু বলব না ছোড়দা। মানে এখনই না। তবে তোদের মাথা ঘামাতে হবে না। আমি ম্যানেজ করব ঠিক।’
‘তুই ম্যানেজ করবি,’ সন্তোষ অবাক হয়ে বলল।
শীর্ষ দৃঢ় গলায় জবাব দিল, ‘এখনও বেঁচে আছি সন্তোষদা। মরব মরব করেও মরে তো যাইনি। ম্যানেজ আমি করবই। ঘরের আলোটা জ্বেলেই দাও সন্তোষদা। তখন বাবলিদিকে বারণ করেছিলুম, রাস্তায় ওর গতিবিধি দেখব বলে। এখন যদি ধারেকাছে থাকেও, দেখুক। ওকে দেখতে দাও শীর্ষ চক্রবর্তী ভাবছে, এখনও ভাবতে পারে। তোমরা আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
সৌম্য বলল, ‘আমি বেশিক্ষণ আর দাঁড়াব না। বাড়ি গিয়ে গোছগাছ করে নিই। তোকে কাল বিকেলের দিকে নিয়ে যাব। কি, ঠিক আছে তো?’
শীর্ষ বলল, ‘নিশ্চয়ই।’
বাড়ির তালা খুলতে খুলতে সৌম্য তখনও কেনটা ভাবছিল। পাশে দাঁড়িয়ে লাট্টু। সমানে ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছে সেই মোড় থেকে।
‘আজ আমায় একটা আইসক্রিম খাওয়াবেন কাকু? খাওয়ান না! খাওয়াতেই হবে।’ সৌম্য নিজের ভাবনায় এতই মগ্ন ছিল যে প্রথমটা শুনতে পায়নি। কিছু একটা বলছে ছেলেটা এইটুকু শুধু বুঝতে পারছিল। কিন্তু কি যে, তা ওর মাথায় ঢুকছিল না। ও ভাবছিল মুনশিজীর কাঠগোলা থেকে ও প্রথম দেখতে পায় জিরো জিরো সেভেনকে। এমনিতেই লোকটার একটু পাহাড়ি পাহাড়ি চেহারা। অসমিয়াদের মধ্যে দিব্যি মিশে গিয়েছিল। দেখে ও এতো অবাক হয়ে গিয়েছিল যে চোখ সরিয়ে নিতে ভুলে গিয়েছিল। অন্যমনস্ক গলায় সৌম্য বলল, ‘খাওয়াবো রে খাওয়াবো! এই রাতে কেন? কাল সকালে কি বিকেলে খাস। এখন পাবিই বা কোথায়!’
দ্বিতীয়বার লোকটাকে ও দেখে স্ট্র্যান্ড রোডে। স্ট্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে যাচ্ছিল ও। পান খাচ্ছিল লোকটা দোকানে। আয়নায় ছায়া পড়েছিল।
লাট্টু বলল, ‘আইসক্রিমঅলা যাচ্ছে বলেই তো বলছি! এই আইসক্রিম! অ্যাই!’
সৌম্যর সম্মতির জন্য অপেক্ষা করল না লাটু। পকেট হাতড়ে পয়সা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই সবুজ একটা লাঠি নিয়ে ফিরল। টুপটুপ করে জল ঝরে পড়ছে। এই জিনিসের জন্যই এতক্ষণ ধরে বায়না নিয়েছে ছেলেটা? উচ্চাশা এতো কম? সৌম্য বলল, ‘কেন রে লাট্টু, খাবি যদি ভালো কিছু নিলি না কেন? কাপ-টাপ? তোর বরফের জল তো সব জামা আর রাস্তাতেই খেল দেখছি!’
ঘ্যানঘেনে গলায় লাট্টু বলল, ‘কি করব? ওই অলাটার কাছে যে আর কিচ্ছু ছিল না! খালি সবুজ লাঠি আর কমলালেবু লাঠি।’
হঠাৎ চমকে উঠল সৌম্য। —‘চাই আইসক্রিম— গাড়িটা ঠেলতে ঠেলতে চলে যাচ্ছে ফেরিঅলা। কানে ডাকটা খট করে লাগল। সন্ধের পর, রাত এখন প্রায় আটটা হল··· এরকম ভাবে ডাকতে ডাকতে ওরা যায় না। অন্তত এ পাড়ায়। ঘোর গ্রীষ্ম হলেও বা কথা ছিল। তাছাড়া এ পাড়ার আইসক্রিম অলাদের ডাকগুলোও চেনা হয়ে গেছে। কেমন বেসুর লাগছে সব। তেমন করে নূপুর বলছে না। আইসক্রিমঅলাটা একেবারে চোখের বাইরে চলে যাবার পর আশ্চর্য হয়ে ভাবল সৌম্য— ‘বাপ রে এত আয়োজন! একজন আসাম থেকে বেনেটোলা। আরেকজন এসে গেছে পদ্মপুকুর! বাড়ির কলঘরে আবার কেউ ফিট করা নেই তো!’
রোয়াক পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ সৌম্য ওর ‘কেন’র উত্তরটা পেয়ে গেল। একেবারে নিশ্চিত! এইজন্য! শীর্ষ অঙ্কটার সমাধান আগেই করতে পেরে গেছে। এই ব্যাপার? শূন্য ঘরে আপন মনে খুব খানিকটা হেসে নিল সৌম্য। লাট্টু ঘর ঝাঁট দিতে দিতে বলল, ‘ও কাকু, তুমি খালি খালি হাসছো কেন? বলো না! ও কাকু!’
সৌম্য বলল, ‘হাসির কথা মনে পড়লে হাসব না?’
—‘কি হাসির কথা? আমায় বলো না!’
—‘সে তুই বুঝবি না।’
লাট্টু আর কথা বাড়াল না। অভিমান হয়েছে। গোমড়া মুখে জল ভরল, বাসন ধুল, সদর দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। সৌম্য স্টোভে ভাত বসিয়ে, একটা আলু আর দুটো ডিম ফেলে দিল তাতে। তারপর চিঠি লিখতে বসল দিদিকে। দিদিটা নিশ্চয়ই ভীষণ ভাবছে, রাগও করেছে। অরণ্যদাও নিশ্চয়ই খুব আপসেট!