৬
বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে তার নির্দিষ্ট চেয়ার-টেবিলে এন্ড স্টোরি অব সিভিলাইজেশনস বইটি নিয়ে বসেছিল আনা আরিয়া। শুধুই পাতা উল্টাল বইটির, মন বসাতে পারল না বইতে। বিজ্ঞানমনস্ক আনা আরিয়ার হঠাৎ মনে পড়েছে জার্নাল অব অ্যাডভানসড ফিজিক্স-এর কথা। নিশ্চয় এ মাসের জার্নালটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেছে এই কয়দিনে। আনা আরিয়া আর বসে থাকতে পারল না। মনে হচ্ছে জার্নালটা তাকে ডাকছে।
বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়া। চলল সে লাইব্রেরির বিজ্ঞান বিভাগের দিকে। বিজ্ঞান বিভাগের জার্নাল সেকশন তার লক্ষ। জার্নাল সেকশনটি বিজ্ঞান বিভাগের এক প্রান্তে।
প্রবেশ করল আনা আরিয়া জার্নাল সেকশনে।
জার্নাল সেকশনের আবার কয়েকটি পার্ট। পার্টগুলো বিজ্ঞানের বেসিক সাবজেক্টের ভিত্তিতে বিভক্ত। যেমন ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, বায়োলজি ইত্যাদি।
আনা আরিয়া এগোলো ফিজিক্স সেকশনের দিকে। লাইব্রেরির পরিবেশ এমনিতেই নীরব। তবু বই বিভাগে টুকটাক শব্দ শোনা যায়। নিচু গলার দুএকটা কথাও তার কানে আসে। কিন্তু জার্নাল সেকশন একেবারে যাকে বলে পিনড্রপ সাইলেন্ট।
জার্নালের ফিজিক্স সেকশনে প্রবেশ করল আনা আরিয়া।
সামনে চোখ তুলতেই টেবিলগুলোর উপর দিয়ে তার চোখ গিয়ে পড়ল একদম শেষ টেবিলে বসা একটা ছেলের উপর। তার চোখের দৃষ্টিটা ছেলেটার উপর ভালো করে পড়তেই চমকে উঠল আনা আরিয়া। এতো সেদিনের সেই রাতের ছেলে! সেই রাতের সেই বিস্ময়কর ছেলেটির দেখা পেয়ে আনা আরিয়ার মনে একটা আনন্দের শিহরণ জেগে উঠল। ছেলেটির সে রাতের আচরণ, তার ভদ্রতা, পবিত্রতা, তার নৈতিক দৃঢ়তা ভুলতে পারেনি আনা আরিয়া। তার দেখা পৃথিবীতে এই চরিত্রের মানুষ সে দেখেনি, দেখবে বলেও মনে করে না। তাকে অবাক করা ও তার হৃদয়ের অকুণ্ঠ প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ছিনিয়ে নেয়া সেই ছেলেটি এখন তার সামনে! দাঁড়িয়ে পড়ল আনা আরিয়া। দেখল, ছেলেটির মনোযোগ ম্যাগাজিনের উপর। ম্যাগাজিনের পাশেই একটা নোট খাতা। খাতার উপর একটা বলপেন।
আনা আরিয়ার মনে প্রশ্ন, ছেলেটা চিনতে পারবে কি তাকে? মনে হয় না। দুএক ঝলক ছাড়া ছেলেটা সেদিন তার মুখের দিকে তাকায়নি। তার উপর রাতের দেখা এবং দিনের দেখার মধ্যে পার্থক্যও আছে।
এগোলো আনা আরিয়া ছেলেটার টেবিলের দিকে। আনা আরিয়া টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকাল ইব্রাহিম চাওসিলো।
ইব্রাহিম চাওসিকোর কাছে এক প্রবল ঝড়-বৃষ্টির রাতে আশ্রয় নিয়েছিল আনা আরিয়া।
ইব্রাহিম চাওসিকোর খামার বাড়ি ছিল সেদিন নির্জন। আশ্রয় নেয়া আনা আরিয়া এবং চাওসিকো ছাড়া আর কেউ ছিল না বাড়িতে।
আনা আরিয়ার উপর চোখ পড়তেই চাওসিকো উঠে দাঁড়াল। বলল, ওয়েলকাম, বসুন।
ছেলেটি আনা আরিয়াকে চিনতে পেরেছে ভেবে খুশি হলো সে। সামনের চেয়ারে বসল আনা আরিয়া। চাওসিকোও বসল।
আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার।
চোখ নিচু ছিল চাওসিকোর। সে একবারই পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আনা আরিয়ার দিকে। তারপরই চোখ নামিয়ে নেয়।
স্যরি, চিনতে পারিনি। আপনি নিশ্চয় বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী? বলল চাওসিকো।
না, আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নই। তবে আমার মন পড়ে থাকে বিজ্ঞান বিভাগে, কিন্তু আমি পড়ি ইতিহাস নিয়ে। এটা আমার বাবার কারণে হয়েছে। আমি ফরম নিয়েছিলাম বিজ্ঞান বিভাগের জন্য। বাবা চাপিয়ে দিয়েছেন ইতিহাস মানে সমাজবিজ্ঞান। সিভিলাইজেশন অব ম্যান আমার সাবজেক্ট। বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ আমার কাটেনি। দেখুন, আমি আমার পড়া ফেলে জার্নাল অব অ্যাডভানসড ফিজিক্স-এর এই মাসের সংখ্যার খোঁজে এসেছি। আমার বাবা আমার ক্ষতি করেছেন। আনা আরিয়া বলল।
আপনার বাবা লেখাপড়ার প্রতি সুবিচার করেছেন। আপনার ক্ষতি নয়, উপকার করেছেন তিনি। বলল চাওসিকো।
কীভাবে? আনা আরিয়া বলল।
তিনি আপনাকে জ্ঞানার্জন করাতে চান, লেখাপড়া শেখাতে চান, যা মানুষের উপকার করবে এবং ক্ষতি থেকে বাঁচাবে। সিভিলাইজেশন অব ম্যান-এ ধরনেরই একটা জ্ঞান যার আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ, শিক্ষাগ্রহণ মানবজাতির উপকার করবে এবং অতীতে মানবজাতির যে ক্ষতি হয়েছে, যে ক্ষতি সামনেও হতে পারে তা থেকে মানুষকে বাঁচাবে। আর বিজ্ঞান হলো আসলে অনুসন্ধানের কাজ। আমাদের মহাবিশ্ব-প্রকৃতিতে বা বস্তুতে সম্ভাবনাময় যে ধর্ম বা গুণ-বৈশিষ্ট্যগুলো আল্লাহ দিয়েছেন তার সন্ধান করা এবং কাজে লাগানোই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই কাজ যদি বন্ধ হয়,, তাহলে বস্তুগত বাড়তি সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাবে না কিন্তু মানুষ ও মানবতার কোনো ক্ষতি এতে হবে না। সুতরাং ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতির মতো মানবিক বিভাগের শিক্ষাই মানুষের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা। আপনার বাবা এটা জানেন। বলল চাওসিকো। কথা বলার গোটা সময়ই চাওসিকোর চোখ নিচু ছিল।
মুখ হা হয়ে গিয়েছিল আনা আরিয়ার। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে। শিক্ষার এমন ব্যাখ্যা সে শোনেনি তার ১৮ বছরের জীবনে, পড়েওনি সে কোথাও। কল্পনাতেও এমন কথা তার মাথায় আসেনি। কিন্তু ছেলেটার যুক্তি অকাট্য। তারও মনে হচ্ছে শিক্ষার ব্যাখ্যা এটাই হওয়া উচিত। প্রশ্ন একটা খুঁজে পেল সে। বলল, নিশ্চয় আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাহলে আপনি মানবিকে না পড়ে বিজ্ঞান পড়ছেন কেন?
জীবনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা হিসেবে আমি বিজ্ঞান পড়ছি না। বস্তুবিজ্ঞানের কয়েকটা বিষয়ের অনুসন্ধানের জন্যেই আমি বিজ্ঞান পড়ছি। এই সাথে প্রয়োজনীয় অন্য পড়াও আমি সাধ্যমতো পড়ি। বলল চাওসিকো।। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা দরকার। আমি আমার সাবজেক্ট নিয়ে আর দুঃখ করব না। আপনার কথা মানছি, বাবা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল আনা আরিয়া, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি কি?
আপনি তো এর আগেই প্রশ্ন করেছেন। আর আমি কেউকেটা নই যে। প্রশ্নের জন্যে অনুমতি চাইতে হবে। বলল চাওসিকো।
প্রশ্নগুলো একটু ভিন্ন রকমের। আনা আরিয়া বলল।
করা যায় না, এমন প্রশ্ন আপনি নিশ্চয় করবেন না। বলল চাওসিকো।
মনে করুন আমি আপনার আইকিউ টেস্ট করছি। বলুন তো, আমার চোখ গোল না লম্বা? আনা আরিয়া বলল।
প্রশ্ন শুনে হাসি ফুটে উঠল চাওসিকোর ঠোঁটে। বলল, এ বিষয়ে আইকিউ টেস্ট হবে জানলে ভালো করে দেখতাম। তবে আমার মনে হয় গোল নয়। 0;
দ্বিতীয় প্রশ্ন, বলুন তো আমার নাক তীক্ষ্ণ খাড়া না মধ্যম খাড়া? আনা আরিয়া বলল।
তীক্ষ্ম ও মধ্যম এই বিশেষণ দুটো না থাকলে উত্তর দিতে চেষ্টা করতাম। আগের উত্তরের মতো। স্যরি, পারছি না উত্তর দিতে। বলল চাওসিকো।
হাসি ফুটে উঠল আনা আরিয়ার ঠোঁটে। বলল, আপনার আইকিউ টেস্টের রেজাল্ট হলো, প্রথম প্রশ্নের উত্তর আপনার স্পেসিফিক নয়। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আপনি দেননি। খুবই সহজ দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনার ব্যর্থতার কারণ হলো, আমার মুখের উপর আপনার চোখ পড়েছে, কিন্তু আপনার চোখে। দৃষ্টি ছিল না, দেখেননি আপনি আমাকে। এর কারণ কি বলুন তো?
চাওসিকোর মুখ গম্ভীর হলো। বলল, আমি মুসলিম। মুসলিম ছেলেরা ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নিকট আত্মীয়া ছাড়া তান্য সব মেয়েদের ক্ষেত্রে নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে।
সব সময়? জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার।
একবার দেখার অনুমতি আছে। বলল চাওসিকো।
এতটা কড়াকড়ি কি স্বাভাবিক? না উচিত? জিজ্ঞাসা করল আনা আরিয়া।
এতটা কড়াকড়ির কারণ হলো, বর্তমান যুগসহ সর্বযুগে নারী-পুরুষের উন্মুক্ত সম্পর্ক অপরাধের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে কাজ করেছে। পরিবার ও সমাজের ভাঙন ও বিশৃঙ্খলার এটা বড় কারণ প্রমাণিত হয়েছে। বলল চাওসিকো।
মন্তব্যটা এক্সট্রিম হয়ে গেল না? আনা আরিয়া বলল।
আমার কথা সিম্পল একটা ন্যারেশন
সমাজবিজ্ঞানীরা আরো কঠোর মন্তব্য করেছেন এ সম্পর্কে। আপনি শুনতে চাইলে একটা উদাহরণ আমি দিতে পারি। আপনার সাবজেক্টের সাথেও এটা প্রাসঙ্গিক। বলল। চাওসিকো।
ধন্যবাদ। আমি শুনতে চাই। আনা আরিয়া বলল।
ধন্যবাদ। আমি সোস্যাল অ্যানথ্রোপলোজিস্ট জন ড্যানিয়েল আরউইন এর কথা বলব। তিনি পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ৮৬টি আদিম গোত্র এবং ছয়টি সভ্যতার উপর এক পর্যালোচনা করেন। পর্যালোচনা থেকে তিনি যা পান, তার উপর এক মন্তব্যে তিনি বলেন, কোনো সভ্যতার বিকাশ সেই সভ্যতার যৌন সংযমের সাথে সম্পর্কিত। সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রীক, রোমান, অ্যাংলো স্যাক্সনসহ প্রতিটি সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ঘটেছে এমন সময়ে যখন যৌন সংযম ও নৈতিকতাকে এসব সমাজে কঠোরভাবে মেনে চলা হতো। কিন্তু উন্নতির সাথে সাথে প্রতিটি সভ্যতায় শুরু হয় অবক্ষয়। সফলতা পাবার পর সভ্যতাগুলো হারানো শুরু করে নিজেদের নৈতিকতা। সাফল্যের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে তাদের মূল্যবোধ, প্রথা ও আচরণ। ক্রমেই শিথিল হতে শুরু করে যৌনতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি। বহুগামিতা, সমকামিতা, উভকামিতার মতো ব্যাপারগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয় সমাজ।…বিয়ে পূর্ববর্তী ও বিয়ে বহির্ভূত যৌনতা এবং অবাধ ও বিকৃত যৌনাচার যে সমাজে যত বেশি, সে সমাজের সামাজিক শক্তি তত কম। যৌনতার উপর যে সমাজ যত বেশি বাধা নিষেধ আরোপ করে, তার সামাজিক শক্তি তত বাড়ে এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সমাজ হলো যেখানে যৌনতা এক বিয়ে কেন্দ্রিক পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস জুড়ে প্রতিটি সমাজ ও সভ্যতার ক্ষেত্রে এ কথা সত্য।…যে কোনো সমাজকে সামাজিক শক্তি ও যৌনস্বাধীনতার মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। আর এর পক্ষে প্রমাণ হলো, কোনো সমাজ এক প্রজন্মের বেশি এ দুটো এক সাথে চালিয়ে যেতে পারে না। জন ড্যানিয়েল আরউইন-এর সংক্ষেপিত মন্তব্যের এখানেই শেষ। তিনি ক্রাইম এপিডেমিকের কথা বলেছেন যা সমাজ-সভ্যতার ধ্বংস-বিপর্যয় ঘটায়, তার শুরু কিন্তু হয় ব্যক্তি পর্যায়ের ছোটখাট বিচ্যুতি থেকে।
ধন্যবাদ। আপনি সত্য বলেছেন, তার পর্যালোচনা, মন্তব্য আমার সাবজেক্টের বড় বিষয় হতে পারে। তিনি যে ভয়াবহ কথা বলেছেন, তার। উপর মন্তব্য করতে হলে বিষয়টি আমাকে হজম করতে হবে এবং আরো ভাবতে হবে। কিন্তু তার সাথে আমি একমত। আপনার কথার সাথেও আমি একমত যে, ব্যক্তি পর্যায়ের বিকৃতি-বিচ্যুতি থেকেই সামাজিক অপরাধ মহামারীর মতো সৃষ্টি হয়। কিন্তু আপনি আমার মুখ দেখলেন না, আমি আপনার মুখ দেখলাম না, তাতেই কি সমস্যার সমাধান আমরা পাব? বলল আনা আরিয়া।
এতেই সমাধান হবে না। কিন্তু অপরাধের উৎসমুখ বন্ধে এটা একটা বিগিনিং। ছেলেমেয়েদের শালীন পোশাক, লাগামহীন মেলামেশা অপরাধ উৎস বন্ধে…।।
চাওসিকোর কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, এ বিষয়ে আজ আর নয়। হজম করতে পারব না। স্থগিত থাক এ প্রসংগ আরেকদিনের। জন্য। অন্য বিষয়ে আমার একটা প্রশ্ন, আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র। আপনার বিষয় হবে বিজ্ঞান। কিন্তু নারী-পুরুষ, সমাজ-সম্পর্ক বিষয়ে আপনার এতটা গভীরে যাওয়ার বিষয়টি অংর্কে মিলে না। এর কারণ কি?
প্রথমত আমি মানুষ। তাই মানুষকে নিয়ে ভাবা স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, নারী-পুরুষ সম্পর্ক এবং সমাজ-সভ্যতা নিয়ে ভাবতে আমার ধর্ম আমাকে শিখিয়েছে। বলল চাওসিকো।
শুরুতে বুঝতে পারিনি, আপনি বলার পর বুঝতে পেরেছি আপনি মুসলিম ধর্ম অনুসরণ করেন! আনা আরিয়া বলল।
হ্যাঁ, আমার ধর্ম ইসলাম। বলল চাওসিকো।
কিছু মনে করবেন না, মুসলমানদের বিরুদ্ধে এত বদনাম কেন বলুন তো? আনা আরিয়া বলল।
বদনামগুলো কি? জিজ্ঞাসা চাওসিকোর।
মুসলমানরা ধর্মান্ধ, হিংস্র, সংকীর্ণ, যুদ্ধবাদী- এ ধরনের আরো অভিযোগ মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বলল আনা আরিয়া। এ প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন, ধর্মান্ধ বলতে আপনি কি বুঝেন? চাওসিকোর প্রশ্ন।
তারা যুক্তি, বুদ্ধি থেকে চোখ বন্ধ করে রাখা এক ধর্মানুসারীর দল। শিক্ষা-সংস্কৃতি, সুনীতি, সদাচারের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। বলল আনা আরিয়া।
ধর্মান্ধদের পরিচয় সম্পর্কে আপনি যা বললেন সেটাই যদি হয়, তাহলে ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের পরিচয় এর উল্টো। ইসলাম যুক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্ক ধর্ম। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন, বার বার তার পাঠক-শ্রোতাকে চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণার দিকে আহ্বান করেছে। ইসলাম বলেছে, জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্ত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আপনাদের ইউরোপের লোকদের তো লেখাপড়া শিখিয়েছে স্পেনের মুসলমানরা। মুসলিম-স্পেনে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজগুলো ছাত্র-ছাত্রীর কলকাকলীতে যখন গম গম করছিল, তখন খ্রিস্টান ইউরোপে স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখনকার পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি ছিল মুসলমানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বাগদাদে। প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্যে বিদ্যা শিক্ষাকে ইসলামে অপরিহার্য করা হয়েছে। এমন ধর্মানুসারীরা ধর্মান্ধ হতে পারে না। তবে মুসলমানদেরকে ধর্মের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান হতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যা বলো, যা বিশ্বাস করো তা প্রতিপালন করো। খ্রিস্টানরা চার্চে গেলেও চলে, কিন্তু মুসলমানরা বৈধ কারণ ছাড়া দিনে পাঁচবার মসজিদে গেলে তার ঈমানের ক্ষতি হয়।
একটু থেমেই চাওসিকো আবার বলল, মুসলমানদের ধর্ম হিংস্রতা শিক্ষা দেয় না। না যুদ্ধক্ষেত্রে, না শান্তির সময় কোনো ক্ষেত্রেই মুসলমানরা হিংস্র নয়। জেরুজালেম যখন খ্রিস্টানরা দখল করে তখন তারা সত্তর হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। কিন্তু মুসলমানরা সেই জেরুজালেম যখন পুনর্দখল করে, তখন যুদ্ধোত্তর একটা হত্যাকাণ্ডও ঘটেনি। এমনকি যুদ্ধের মধ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধদের হত্যা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত যে সৈনিককে মারা হচ্ছে, তাকেও হিংসাত্মকভাবে হত্যার অনুমতি দেয়া হয়নি, তার মরদেহকে বিকৃত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সবগুলো যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। ইউরোপের খ্রিস্টানরা ও তাদের শাসকরা ৭টি ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধ মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, মুসলমানরা একটা ক্রুসেডও তাদের উপর চাপিয়ে দেয়নি। থামল চাওসিকো।
আনা আরিয়া চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল চাওসিকোর দিকে। বলল, আপনি যে কথাগুলো বললেন, তা আমার কাছে এতটাই বিস্ময়কর লাগছে যে, আপনি না বললে কথাগুলো আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমি এখন নিজের চেয়েও আপনাকে বেশি বিশ্বাস করা শুরু করেছি। আমি আপনার কথা সবটুকুই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, ইসলাম ও মুসলমান। সম্পর্কে একেবারে উল্টো কথাগুলো সমাজে চালু হয়ে গেল কি করে?
কারণ যারা প্রচার করছে, তাদের আছে একচেটিয়া সংবাদ মাধ্যম, অঢেল অর্থশক্তি এবং আছে রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্য।
আপনি ঠিকই বলেছেন। একটা মিথ্যাকে শতবার বললে তা সত্য হিসেবে চালানো যায়। হিটলারের গোয়েবলস যে তত্ত্ব দিয়ে গেছে তা এখন আরো শক্তিশালী হয়েছে। যাক এ প্রসংগ। আপনার অনেক সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু আমার উপকার হয়েছে অনেক। আমি উঠতে চাই। বলে উঠে দাঁড়াল সে।
একটু থেমে আবার বলল, আমি আনা আরিয়া।
উঠে দাঁড়িয়েছে চাওসিকোও। বলল, আমি চাওসিকো। আমি খুশি হয়েছি আপনার সাথে কথা বলে। : হাসল আনা আরিয়া। বলল, আপনার কথায় কিন্তু আমি আরো অনুপ্রাণিত হলাম আপনার সাথে কথা বলার জন্যে। একটা আলোচনা তো স্থগিত রেখেছি, সেটা তো শেষ করতে হবে। অতএব সময় নষ্ট আপনার আরো হবে।
আলোচনায় যে সময় যায়, তা নষ্ট হয় না। তাতে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। বলল চাওসিকো।
ধন্যবাদ, আসি।
বলে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল আনা আরিয়া। বলল চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে, সত্যি আমাকে চিনতে পারেননি?
চাওসিকো তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। বলল, আজকের আগে কি কোথাও দেখেছি আপনাকে? মনে তো…।
কথা শেষ না করেই থেমে গেল চাওসিকো। হঠাৎ তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল। হয়ে উঠল। বলল, সেই রাতে কি আপনিই…।
চাওসিকোকে কথা শেষ করতে না দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠল আনা আরিয়া। বলল, গড ব্লেস ইউ, অবশেষে চিনতে পারলেন তাহলে! সেদিন যদি আমাকে ভালো করে দেখতেন তাহলে এমনটি হতো না।
সত্যিই সেদিন রাতে আমি খুব ভীত হয়ে পড়েছিলাম। বলল চাওসিকো।
ভীত? কেন? আনা আরিয়া বলল।
শয়তানের মন্ত্রণা মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করে, মানুষ তা জানতে পারে না। যখন বুঝতে পারে, তখন আর ফেরার সময় থাকে না। বলল। চাওসিকো।
বুঝতে পেরেছি। আপনি ভালো লোক বলেই ভীত হয়ে ছিলেন, খারাপ লোক হলে এ রকম অবস্থায় আনন্দিত হতেন। আনা আরিয়া বলল।
সেই ভীতিকর রাতের কথা তাহলে আপনার মনে আছে? বলল চাওসিকো।
সেই রাতটা আমার জন্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার জীবনে সেই রাতে প্রথমবারের জন্যে একজন মানুষ দেখেছিলাম। আনা আরিয়া বলল।
বুঝলাম না, আপনার চারদিকেই তো মানুষ! বলল চাওসিকো।
এসব মানুষের সুদৃশ্য পোশাকের আড়ালে পশু দেখেছি, মানুষ দেখিনি। আনা রিয়া বলল।
আপনি খুব বড় কথা বলেছেন। এই কথা নিয়ে একটা মহাকাব্য রচিত হতে পারে। বলল চাওসিকো।
হওয়া উচিত। পোশাক ছিঁড়ে নগ্ন করে ফেলা উচিত ওদের। আনা। আরিয়া বলল।
বাইরে থেকে এ সময় হৈচৈ ও চিৎকার শোনা গেল।
আপনি বসুন, আমি দেখে আসছি। বলে আনা আরিয়া ছুটল বাইরের দিকে।
ঘটনা ফিজিক্সের লাইব্রেরি কক্ষে।
আনা আরিয়া দেখল, আফ্রো-এশিয়ান চেহারার একটা ছেলেকে চার পাঁচজন ব্যাটনধারী এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র টেনেহেঁচড়ে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের একজন চিৎকার করে কাছে, প্রভু যিশুর শত্রু, মা মেরীর শত্রু এই শয়তান আমাদের লাইব্রেরিতে পড়াশোনার সুযোগ করে নিয়েছে। এই সুযোগে সে আমাদের তথ্য পাচার করে, শত্রুর সাথে মিলে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। এই শয়তানকে আর কোনো অপকর্ম করতে আমরা দেব না। ছেলেটিকে ওরা টেনেহেঁচড়ে বের করে নিয়ে গেল।
আনা আরিয়াকে দেখে কয়েকজন ছাত্র ছুটে এলো। বলল, ম্যাডাম, ছেলেটা খুব ভালো। নাম আবিউলা আমাদি। সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাডভানসড লেভেল পরীক্ষায় সে প্রথম স্থান অধিকার করেছে রেকর্ড নাম্বার নিয়ে, যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। সে ভর্তি হয়েছে সরকারি স্টেট কলেজে। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমাদের ভিসি স্যারের লিখিত অনুমতি নিয়েই সে লাইব্রেরি ব্যবহার করেছে প্রতিদিন তিনঘণ্টা করে। ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ আজ এই কাণ্ড।
তোমরা ভিসি স্যারকে এখনি জানাও। আর দেখ, ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে গেল। বলল আনা আরিয়া।
আনা আরিয়া ফিরে গেল চাওসিকোর ওখানে। তাকে ঘটনাটা জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো লাইব্রেরি থেকে।
লাইব্রেরির সিঁড়িতেই আনা আরিয়াকে ঘিরে ধরল তার একদল বন্ধু বান্ধবী।
তার এক বান্ধবী মধ্য আফ্রিকা অঞ্চলের বিশপের মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নাম রিটা রেমন্ড। রিটা রেমন্ড আনা আরিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা সকলে তোকে ক্যাম্পাসে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। লাইব্রেরিতে ছিলি? তুই তো এ সময় লাইব্রেরিতে আসিস না! আনা আরিয়া মুখে হাসি টেনে বলল, কেন খুঁজছিস?
কেন মানে? ভুলে গেছিস সব? আজ ইউরোপ বিজয়ী জন জয়েস-এর কনসার্ট না। তোরই তো প্রোগ্রাম? বলল রিটা রেমন্ড।
সত্যিই ভুলে গেছি। কয়টায় কনসার্ট? আনা বলল।
কেন, সাড়ে চারটায়। তোরই তো বেশি জানার কথা। বলল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের মেয়ে ফ্লোরেন্স।
তোকে ধন্যবাদ। টিকিট কাটা হয়েছে? ভিআইপি টিকিট কিন্তু
তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। আনা আরিয়া বলল।
কি বলছিস তুই? তুই না টিকিট কাটার দায়িত্ব নিলি! বললি, ভিসি অফিসের পিএস মেয়েটাকে পাঠিয়ে টিকিট আনিয়ে নেব। বলল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের ছেলে টেড টেনিসন।
হেসে উঠল আনা আরিয়া। জ্যাকেটের পকেট থেকে ছয়টি টিকিট বের করে বলল, ভুলে গিয়েছিলাম।
সকলের মুখ হা হয়ে গিয়েছিল। বেশি; হা হয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির ছেলে হ্যারিসনের। তুমি অসুস্থ নও তো? বলে সে হাত বাড়াল আনা আরিয়ার কপালের দিকে।
আনা আরিয়া এক ঝটকায় মাথা সরিয়ে নিয়ে বলল, আমাকে অসুস্থ ভাবার কোনো কারণ ঘটেনি। পিএস মেয়েটি টিকিট হাতে দেবার সাথে। সাথে পকেটে রেখে দিয়েছি, দেখিওনি। আনা আরিয়ার কণ্ঠে ক্ষোভের সুর।
ঠিক আছে আনা আরিয়া। এমনটি ঘটতেই পারে। তবে তোমার ক্ষেত্রে ঘটা স্বাভাবিক নয়। তুমি খুবই সতর্ক, সচেতন! বলল হ্যারি। এই হ্যারি হ্যাঁমিল্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ছেলে।
হ্যারি, মানুষ সর্বশক্তিমান হতে পারে না, তেমনি মানুষ সর্বসতর্ক ও সর্বসচেতনও নয়। আনা আরিয়া বলল অংকের মতো নীরস কণ্ঠে।
আনা, তোর কিছু একটা তো ঘটেছে, হয় শরীরে নয়তো মনে। তুই তো বন্ধুদের আড্ডায় এমন ভারি তত্ত্বকথা বলিস না! আর তুই যেভাবে মাথাটা সরিয়ে নিলি, তাও একেবারে নতুন। বলল রিটা রেমন্ড।
হাসল আনা আরিয়া। বলল, কিছু ঘটার প্রয়োজন নেই। লাইব্রেরিতে দীর্ঘক্ষণ বসলে মনে হয় বইয়ের জগতটাই জগত, অর বাইরের সব অন্ধকার।
তাহলে তো লাইব্রেরি বিপজ্জনক। বলল হ্যারিসন।
সবার জন্যে নয়। আনা আরিয়া বলল।
এসব কথা তোরা রাখ। কনসার্টের সময় বেশি নেই। এখন বল, সবার গাড়ি এখানে রেখে এক গাড়িতে গেলে ভালো হয় না? বলল রিটা।
আমি গাড়ি নিয়ে যাব। গোটা সময় কনসার্টে আমি নাও থাকতে পারি। বলল আনা আরিয়া।
রিটা ও ফ্লোরেন্স বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। বিস্মিত দুজনের মনে একই প্রশ্ন, এ কি সেই আনা আরিয়া, যে কনসার্টের জন্যে পাগল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না তারা।
কনসার্টে যে যার গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ঠিক হলো।
ভিআইপিতে ৩৬টি সিট। মাখখান দিয়ে রাস্তার জন্যে লেন। লেনের দুইপাশে আঠারোটি করে সিট। এক রোতে ছয়টি সিট।
প্রথম রোর ছয়টি সিট আনা আরিয়াদের। একটি ছেলে একটি মেয়ে এভাবেই সিটগুলো রিজার্ভড করা ছিল।
আনা আরিয়া দেখল লেন প্রান্তের প্রথম সিটটি হ্যাঁমিল্টনের, তার পরের সিট তার বান্ধবী রিটা রেমন্ডের।
রিটা রেমন্ডকে তার সিটে বসতে বলে আনা আরিয়া হ্যাঁমিল্টনের সিটে বসে বলল, সিট রিঅ্যারেঞ্জ করলাম। আমি আগেই চলে যেতে পারি, তাই প্রান্তের সিট নিলাম। রিটা তার সিটেই থাকবে। রিটা, তোর কি কোনো অসুবিধা করলাম?
রিটা আনা আরিয়ার পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, তোর মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। ছোটখাট জিনিস নিয়ে এমন কিছু করার দরকার আছে? বন্ধু সিম্পলি বন্ধুই, তার বেশি তো কিছু নয়!
না রিটা আমার মাথা ভালোই আছে। বলে রিটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, প্রত্যেক ছোটখাটই বড়র শুরু। ছোটখাট ঘটনাই বড় ঘটনার জন্ম দিতে পারে। চারাগাছ-এর মধ্যে বড়গাছ-এর বাস্তবতা আমরা দেখি। কুঁড়িই ফুল হয়।
রিটা রেমন্ড মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। গম্ভীর তার মুখ। বাম হাতটা আনা আরিয়ার কাঁধে রেখে বলল, আনা, সত্যিই আজ তোকে আমি বুঝতে পারছি না।
হাসল আনা আরিয়া। বলল, আমি তো কোনো অস্পষ্ট কথা বলিনি রিটা। কনসার্ট শুরু হয়ে গেল। আনা ও রিটার কথা বন্ধ হয়ে গেল।
আনা আরিয়ার মন অস্থির নয়, প্রশান্ত। কিন্তু কনসার্টে মন বসাতে পারল সে। চাওসিকো এবং তার কথাগুলো বার বার তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। তার প্রতিটি কথাই যুক্তির মানদণ্ডে অকাট্য। কিন্তু তার মন তো এমন কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সেই রাতের চাওসিকোকে দেখার সাথে সাথেই তার হৃদয়টা যেন আনন্দে নেচে উঠেছিল। তার কথা শুরু হলে মনের দরজা শুধু খুলে যাওয়া নয়, স্বাগতও জানিয়েছিল তার কথাকে। তার ইচ্ছার বাঁধন তার মন মানেনি।
প্রায় আধাঘণ্টা বসে থাকার পর আনা আরিয়া বিটাকে বলল, আমি উঠছি। রিটা।
রিটা তার হাত চেপে ধরে বলল, না তুই যাবি না। তোর প্রস্তাবেই আমাদের এই কনসার্টে আসা। টিকিটও তুই কিনেছিস। এখন সৌজন্যের খাতিরে হলেও তোকে বসতে হবে আমাদের সাথে।
রিটার যুক্তি খণ্ডাতে পারেনি আনা আরিয়া। তাই তাকে জোর করেই দেখতে হয়েছে কনসার্ট।
.
ডিনার শেষে আনা বসেছিল তার স্টাডিতে। আনা আরিয়ার মা দুকাপ কফি হাতে নিয়ে আনার স্টাডিরুমে ঢুকল।
একটা কাপ আনাকে দিয়ে আরেকটা কাপ নিজে নিয়ে বসল আনার পাশে। আনা কাপটি তুলে নিয়ে মাকে ধন্যবাদ দিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল।
আনা, তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। খুব ঘোরাঘুরি করেছ নাকি? কনসার্টে না গেলেই পারতে। আনাকে বলল, আমার মা শীলা সাম্রা।
না মা, তেমন ঘুরিনি। লাইব্রেরিতেই ছিলাম অনেকক্ষণ। আনা আরিয়া বলল।
খুশি হলাম লাইব্রেরিতে বেশি সময় দিচ্ছিস জেনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা তো পড়াশোনার জন্যেই। বলল আনার মা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সে পরিবেশটা বোধ হয় নষ্ট হচ্ছে মা। মাথার শক্তির। স্থানটা মনে হয় পেশীশক্তি দখল করে নিচ্ছে। আনা আরিয়া বলল।
কেমন করে? জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার মায়ের।
আজ লাইব্রেরিতে একটা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। বলে আনা আরিয়া আজ লাইব্রেরিতে যে ঘটনা দেখেছিল তা তার মাকে বলল।
সবার সামনে এ ঘটনা ঘটেছে? বলল আনা আরিয়ার মা।
দিন-দুপুরে সবার সামনে ঘটেছে মা। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। যারা এটা ঘটাল, ব্যাটারী ঐ পাঁচটি ছেলেকে সবাই চেনে। তারা একটা বড় গ্যাং-এর সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। সবাই বলে ওদের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশীর্বাদ আছে। বলল আনা আরিয়া।
ছেলেটির নাম কি? কোন জাতের ছেলে? মুসলিম নয় তো? আনার মা বলল।
শুনলাম আবিউলা আমাদি নাম। আফ্রো-এশিয়ান। ধর্ম জানি না মা, তবে খ্রিস্টান নয়। খ্রিস্টান হলে এ দশা হতো না। বলল আনা আরিয়া।
আনা আরিয়ার মা হাসল। বলল, খ্রিস্টান ছাত্রের এ দশা হবে কেন? এটা তো খ্রিস্টান ইউনিভার্সিটি।
তাহলে অখ্রিস্টান ছাত্রদের এখানে ভর্তি করা হয় কেন? জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার।
ভর্তি করা হয় ঝামেলা এড়াবার জন্যে? আনা আরিয়ার মা বলল।
ঝামেলা এড়াবার জন্যে নাকি খ্রিস্টান বানাবার জন্যে? নাম পাল্টিয়ে তাকে খ্রিস্টান হিসেবেই তো পরিচয় করানো হয়। বলল আনা আরিয়া
আনা আরিয়ার মা হাসল। বলল, বিরোধী দলের মতো কথা বলছ আনা তুমি।
বিরোধী দলের মতো নয় ন্যায়ের পক্ষে কথা বলছি। আবিউলা আমাদি ছেলেটা গত সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাডভান্সড পরীক্ষায় দেশের মধ্যে প্রথম হয়। খুবই প্রতিভাবান ও ভালো ছেলে। স্টেট কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। সেখানকার লাইব্রেরি ছেলেটির জন্য যথেষ্ট হয়নি। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের ভিসির অফিসকে অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি তাকে ব্যবহার করার অনুমতি দেবার জন্যে। ভিসির অফিস তাকে অনুমতি দিয়েছে। সে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে ঢোকেনি। তাহলে তাকে মেরেধরে টেনে-হিঁচড়ে
বের করে নিয়ে যাওয়া হবে কেন? বলল আনা আরিয়া।
আবার হাসল আনা আরিয়ার মা। বলল আনার পিঠে হাত বুলিয়ে, খুব খেপেছ তুমি। খেপারই কথা। এসব কথা বল তোমার বাবাকে।
কি বলবে বাবাকে? মা-মেয়ে কি করছ এখানে?
বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করল ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা!
আনার মা আনার কাছ থেকে উঠে গেল তার বাবার বসার জায়গা করে দেবার জন্যে। বলল, মেয়ের পাশেই বস। মেয়েকে রাগিয়েছ তোমরা। এখন থামাও।
আনার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান মেয়ের পাশে বসতে বসতে বলল, কেন কি হয়েছে আমার মায়ের। রেগেছে কেন?
না বাবা রাগি নাই, একটা অভিযোগ করেছি মাত্র। বলল আনা আরিয়া।
অভিযোগ তো রাগের চেয়েও ভারি। মা, কি হয়েছে বল? আনার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
থাক, মেয়ের কথা আমিই বলছি। বলল আনা আরিয়ার মা।
আনা আরিয়ার মা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে লাইব্রেরি ব্যবহারকারী স্টেট কলেজের ছাত্র-আবিউলাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবার ঘটনা বিস্তারিত বলল। বলল যে, ঘটনাটা আনা আরিয়ার সামনেই ঘটেছে।
হো হো করে হাসল স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা। বলল, ও এই অভিযোগ। এই অভিযোগ আমার অফিস পেয়েছে মা। বিষয়টা আমার অফিস দেখবে। অফিস সূত্রে আমি দুটো জিনিস জানতে পেরেছি। ছেলেটি নাকি পবিত্র মাতা মেরীকে কি অশ্লীল কথা বলেছিল। সেটা থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। অন্যটি হলো, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা আমাদের প্রাক্তন ছাত্র। কারোই ইনরোলমেন্ট নেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু তারা তো বাবা প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র তাদের অবাধ গতি। বিভিন্ন কাজ ও প্রোগ্রামেও তারা অংশ নেয়। সবাই তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেই মনে করে। বলল আনা আরিয়া।
সবার পরিচিত প্রাক্তন ছাত্র তো। সে পরিচয়ের সুযোগ তারা নেয়। স্বেচ্ছাসেবক নেবার সুযোগ আমাদের সব প্রোগ্রামেই আছে। আর যারা কাজ করতে চায়, কাজের সুযোগ তারা পায় না। এটা কোনো বড় কথা নয়। আনা
আরিয়ার বাবা বলল।
পবিত্র মাতা মেরীকে সে যদি গালি দিয়েই থাকে, তাহলে প্রথমেই অভিযোগ আসা উচিত ছিল আপনাদের কাছে, কারণ আপনারাই তাকে লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন। বলল আনা আরিয়া।
সেটাই উচিত ছিল মা। কিন্তু তা করেনি। নিজেরা যা ভালো বুঝেছে সেটাই করেছে তারা। আনা আরিয়ার বাবা বলল।
ছেলেটাকে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়নি। কোথায় নিয়ে গেল, কি করল তাকে? বলল আনা আরিয়া।
এ বিষয়ে কোনো খবর আমাদের কাছে নেই মা। নিশ্চয় আমাদের অফিস
জানার চেষ্টা করবে। আনা আরিয়ার বাবা বলল।
ধর্মের নামে হিংসা, হানাহানি বন্ধ করা যায় না বাবা? বলল আনা আরিয়া।
এটা বিশ্বজোড়া সমস্যা। আমাদের ক্ষমতা কতটুকু? আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
বাবা শিক্ষা সবার জন্যে উন্মুক্ত, উন্মুক্তই থাকা উচিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সব ধর্মের ছাত্রের সমানাধিকার দেয়া যায় না? বলল আনা আরিয়া।
এখানে তো সবাই শিক্ষার সমান সুযোগ পায় মা। আনা আরিয়ার বাবা বলল।
বাবা, এখানে তো ট্রাইবাল ও অন্যধর্মের ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় তাদের নাম পরিবর্তন করতে হয়। এটা করা হয় আনঅফিসিয়াল সিদ্ধান্তে। বলল আনা আরিয়া।
সংগে সংগে কথা বলল না আমার বাবা।
একটু পর বলল ধীরে ধীরে, তুমি ধর্ম নিয়ে হানাহানির কথা বললে। আমাদের এই কাজটা ধর্মীয় হানাহানি দূর করারই একটা উদ্যোগ। বুরুন্ডি, তানজানিয়া এবং গোটা আফ্রিকায় খ্রিস্টীয়করণ যদি হয়ে যায়, তাহলে আফ্রিকায় ধর্মীয় হানাহানি থাকবে না।
কিন্তু বাবা অন্যধর্মের লোকরাও তো বসে থাকবে না। তারাও ছুটে আসবে মাঠ দখলের জন্যে। হানাহানি তাতে আরো প্রকট হবে। আমার মনে হয় বাবা, সব ধর্মেরই প্রচার ও প্রসারমূলক কাজের সমান অধিকার থাকা উচিত, তবে শর্ত থাকবে এক ধর্ম আরেক ধর্মের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক, বিরোধ সৃষ্টিকারী এবং গালাগাল দেয়ার মতো কোনো কাজ করতে পারবে না। যেকোনো ধর্ম পালন, যেকোনো ধর্ম গ্রহণ এবং ধর্ম পরিবর্তনের অবাধ অধিকার মানুষের থাকবে। ধর্মীয় হানাহানি বন্ধ হতে পারে আমি মনে করি কেবল এই পথেই। বলল আনা আরিয়া।
হাসল আনা আরিয়ার বাবা। বলল, মা তোমার বয়স কম। বাস্তবতার মুখোমুখি এখনো হওনি। তুমি যেটা বললে সেটা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমাদের ধর্মকে তার জন্মস্থান বেথেল হেমে গিয়ে আশ্রয় নিতে হতে পারে। তোমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। জাতীয় অস্তিত্ব, জাতীয় স্বার্থের কথা তোমাদের প্রথম ভাবতে হবে। বর্তমান বাস্তবতা হলো, সবার অধিকারের কথা যদি ভাবতে যাও, সবাইকে তার অধিকার যদি দিতে চাও, তাহলে তুমি ভোগ করছ এমন অনেক অধিকার তোমাকে ছাড়তে হবে। আর একবার ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত যদি নাও, তাহলে সব হারিয়ে তার মাশুল তোমাকেই দিতে হবে।
বাবা, তুমি যা বললে তার অর্থ ভয়াবহ। আমরা কি তাসের ঘর সাজিয়ে তার উপর বসে আছি যে, অন্যেরা তাদের অধিকার পেলে আমরা ধ্বসে পড়ব? যদি তাই হয় বাবা, তাহলে আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো উচিত। তারপর আমরা যা, তার উপর ভিত্তি করে আমাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। যদি তা না পারি, তাহলে তার পরিণতিটাকে আমাদের প্রাপ্য ব…।
আনা আরিয়ার কথার মাঝখানেই তার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, থাক মা, আমি যা বলেছি তার উপর তোমার মন্তব্য এত দ্রুত নয়, আরো ভেবে চিন্তে তোমাকে বলতে হবে।
আনা আরিয়ার বাবা কথাটা বলেই হাত রাখল আনা আরিয়ার মাথায়। বলল, গড ব্লেস ইউ মা। আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি আমার খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। তোমার এই বুদ্ধি, মেধা জাতির সম্পদ মা। ঈশ্বর তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা বাড়িয়ে দিন।
উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়ার বাবা।
আসি মা, তুমি গিয়ে রেস্ট নাও। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান।
আনা আরিয়ার মা আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।