লেক ট্যাঙ্গানিকার তীরে – ১

ইব্রাহিম চাওসিকো একটা ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল অফিস-কাম-ড্রইংরুমে। ট্রেতে দুটো কফির মগ, দুই হাফপ্লেটে বাদাম।

ট্রেটা সামনের সোফায় রেখে চায়ের টেবিলটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর ট্রে থেকে একটা কফির মগ ও বাদামের হাফপ্লেট মেয়েটার সামনে টেবিলে নিয়ে রাখল। বলল, কফি খেয়ে নিন।

মেয়েটা চোখ তুলে তাকাল আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকোর দিকে। ইব্রাহিম চাওসিকোর চোখ দুটি নামানো।

মেয়েটা ধন্যবাদ দিতে গিয়েও পারল না। মেয়েটার জড়সড় অবস্থা যেন আরো বাড়ল।

আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো মেয়েটির সামনে থেকে ফিরে গিয়ে তার সোফায় বসল। টেনে নিল ট্রেটা। মেয়েটার দিকে পলকের জন্যে তাকিয়ে প্লেট থেকে বাদাম নিয়ে চিবোতে লাগল। মেয়েটিও কয়েকটা বাদাম হাতে নিয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়েছে।

আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগোলো ওয়াশ রুমের দিকে।

মেয়েটির চোখে পড়েছিল ইব্রাহিম চাওসিকোর ব্যাপারটা।

মেয়েটিও উঠে দাঁড়াল। বাধা দেয়ার ভংগিতে হাত তুলে বলল, আমি…।

কথা শেষ করতে পারল না মেয়েটি। তার কণ্ঠ জড়তা এসে জড়িয়ে ধরেছে।

আপনি বসুন। আমি আসছি। বলল ইব্রাহিম চাওসিকো।

চরম অস্বস্তি ও আতঙ্কের সাথে লজ্জাও এসে যোগ হলো মেয়েটির মধ্যে। ছেলেটির দ্র ব্যবহারে মেয়েটির মন কখনো আশ্বস্ত হতে চাইছে আবার কখনো তার মন বলছে তার কাপড় শুকাতে দেবে ছেলেটা, এত ভালো তো। ভালো নয়। খুব খারাপ মানুষরাও শুরুতে ভ্ৰদ্ৰতা ও তোষণের আশ্রয় নিতে, পারে। তোষণ ওদের একটা অস্ত্র। আতংক আরো বাড়ল মেয়েটার মধ্যে। মনের এই কাঁপুনি ধরা আতংক নিয়েই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে কফি পান করছে মেয়েটা।

তিন চার মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো ইব্রাহিম চাওসিকো। সোফায় বসে কফির কাপ তুলে নিল হাতে। বলল, খুব গরম কফি আমি খাই না তাই একটু সময় নিলাম। কথা অনেকটা স্বগোতোক্তির মতো।

মেয়েটা তাকিয়েছিল ইব্রাহিম চাওসিকোর দিকে। ইব্রাহিম চাওসিকো কথা বলছিল কফির দিকে তাকিয়ে।

মেয়েটা কিছু বলল না। তার মন চাইছে, ছেলেটা তার সাথে কথা বলার সুযোগ না পাক। ভয় তাতে বাড়বে বলে মনে করছে মেয়েটা।

দুজনে কফি খাচ্ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বাইরে ঝড়-বৃষ্টির ভীতিকর শব্দ। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভুগছে ইব্রাহিম চাওসিকোর মন। সারা রাত ঝড়-বৃষ্টি থামবে না- এই চিন্তা মনের অস্বস্তিকে ক্রমে বাড়িয়ে তুলছে। একটা বিষয় তার জন্যে সান্ত্বনার যে, মেয়েটার মধ্যে গায়েপড়া বাঁচাল ভাব সে। দেখছে না। আর তাদের একত্রবাস বাইরের কেউ দেখার নেই। খামারের ভেতরে কাজের লোকরা আছে কিন্তু তারা সেখানে তাদের নিয়ে ব্যস্ত।

কফি খাওয়া হয়ে গেল দুজনের। ইব্রাহিম চাওসিকো ট্রেতে করে সব নিয়ে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এলো কমিনিট পর।

অফিসের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে লক্ষ করে ইব্রাহিম চাওসিকো বলল, এখন সাতটা বাজে। ঝড়-বৃষ্টি ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আপনি রেস্ট নিন। এ পাশের কক্ষটি বেড রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওখানেই আপনি রেস্ট নিন। আমি ওদিকে আছি।

বেড রুমে রেস্ট নিতে বলা শুনে মেয়েটির চোখে-মুখে নতুন করে একটা ভীতির ভাব ছড়িয়ে পড়ল।

তাকাল মেয়েটি কক্ষের দিকে। মুখে কিছুই বলতে পারল না।

ইব্রাহিম চাওসিকো বেড রুমের পশ্চিম প্যাসেজ দিয়ে উত্তরের ওপাশে চলে গেল। ওদিকেই কিচেন, ডাইনিং ও স্টোর রুম।

মেয়েটি তার সোফায় বসেই রইল।

সময় কাটাবার মতো কিছু নেই তার কাছে। মোবাইলটা ভিজেঁ গেছে। তা আবার গাড়ির সিটে ভুল করে রেখে এসেছে। একবার বেড রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে তার মন চাচ্ছে। পরক্ষণেই মন বলছে, একজন বেড রুমে রেস্ট নিতে আহ্বান জানিয়েছে বলেই সে যাবে কেন? এটা এক ধরনের প্রশ্রয় হতে পারে।

বসে থাকল মেয়েটি।

মাঝে মাঝেই সে তাকাচ্ছে ছেলেটা যেদিকে চলে গেছে সেই পথের দিকে। এক সময় সোফায় হেলান দিল সে। বাইরে ঝড়ের একটানা শোঁ শো শব্দ, তার সাথে অবিরাম বৃষ্টির ঝমঝমে আওয়াজ।

সোফার হাতলে ছড়িয়ে রাখা ডানবাহুর উপর মাথা এলিয়ে শুয়েছে। মেয়েটা। নিজের অজান্তেই সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

হ্যালো, হ্যালো শুনছেন? গলার বড়সড় শব্দে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসল মেয়েটা। শব্দ অনুসরণে মেয়েটার চোখ গিয়ে পড়ল ইব্রাহিম চাওসিকোর উপর।

জড়সড় হয়ে বসা মেয়েটার চোখে-মুখে ভয়মিশ্রিত বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে। বলল মেয়েটা, স্যরি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

শোবার জায়গা ছিল, ভালো করে শুতে পারতেন।

একটু থামল ইব্রাহিম চাওসিকো। সংগে সংগেই আবার বলল, এখন রাত দশটা বাজে। ওয়েদার ফোরকাস্ট অনুসারে ঝড়-বৃষ্টি আরো বাড়বে। এই অবস্থায় আমার আপনার কারোই বাইরে যাবার সুযোগ নেই। বসে থাকার চেয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়াই ভালো।

মেয়েটার বুক হাতুড়ি পেটার মতো ধকধক করে উঠল। মেয়েটা মনে মনে বলল, আমি শুতে চাই না, যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।

ইব্রাহিম চাওসিকোই আবার কথা বলল, আপনি চাইলে মুখ-হাত ধুয়ে নিতে পারেন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

বলে ইব্রাহিম চাওসিকো আগের মতোই ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে সে বেড রুম থেকে আরেকটা চায়ের টেবিল এনে নিজের সোফার সামনে রাখল।

প্রায় সাত-আট মিনিট পর একটা বড় ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ফিরে এলো ইব্রাহিম চাওসিকো। ট্রেটা নিজের টেবিলে রাখল। দুইটা প্লেটে দুটো করে চারটা নানরুটি, দুটো হাফ প্লেটে দুটো করে ডিমের মামলেট, দুটো হাফ প্লেটে সালাদ এবং দুই বোতল মিনারেল ওয়াটার।

নিজের খাবার সে নিজের টেবিলে নামিয়ে রেখে বাকি খাবার মেয়েটার টেবিলে নামিয়ে দিয়ে বলল, ফ্রিজে রান্না করা কিছুই নেই। গোশত আছে কিন্তু রান্না করা নয়। দুপুরে আনা নানরুটি গরম করে এনেছি। এ দিয়েই রাত চালাতে হবে। আপনার টেস্ট সম্পর্কে কিছুই জানি না, এতে চলবে তো?

– মেয়েটা ইব্রাহিম চাওসিকোর কাজ-কর্ম দেখছিল। সে অবাক হলো, এত কিছুর মধ্যে একবারও সে তার মুখের উপর চোখ ফেলেনি। একটা জড়সড় ভাব থাকলেও খুবই স্বাভাবিকভাবে সে কাজ করছে। খাবার সম্পর্কে বলার সময়ও সে টেবিলের খাবারের দিকে চোখ রেখেছিল, তার মুখের দিকে নয়।

কিছু জড়তা কাটল মেয়েটার মনের। বলল, না, এই যথেষ্ট। খুব ভালো খাবার। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ পাবার মতো কিছু করিনি। যা ছিল তাই নিয়ে এসেছি। বলল ইব্রাহিম চাওসিকো।

ডিম ভেজেছেন, সালাদ তৈরি করেছেন। আমি এসব করতে পারতাম না।

আমিও পারব বলে ভাবিনি। মা, ভাবিদের করতে দেখেছি। এই দেখাটাই ছিল আমার সম্বল।

একটু থেমেই ইব্রাহিম চাওসিকো বলে উঠল, ঠিক আছে খেয়ে নিন। আমার খাবার ওদিকে আছে।

বলেই ইব্রাহিম চাওসিকো তার টেবিলের দিকে এগোলো।

এতগুলো কথার মধ্যে ছেলেটা একবারও তার চোখে চোখ ফেলেনি। চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ নামিয়ে নিয়েছে।

মেয়েটার মনের ভয় ও আতংকের বন্ধ দরজা অনেকটাই খুলে গেছে। সে

অনেকখানি সহজ হতে পেরেছে। তার মনে হয়েছে, সাদাটে-সোনালি বর্ণের এই সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলেটি খুবই লাজুক। এই পরিবেশে ছেলেদের এমন সংযত আচরণ তার কাছে কল্পনার বাইরে।

খাওয়া শেষ হয়ে গেল।

ইব্রাহিম চাওসিকো ট্রেতে করে সবকিছু নিয়ে ভেতরে রেখে এসে বলল, ঝড়-বৃষ্টি আরো বেড়েছে। আবহাওয়া আরো খারাপই হবে। রাত এখানে। কাটানোর বিকল্প নেই। আপনি বিশ্রাম নিন, আমি ওপাশে আছি।

চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েই থেমে গেল সে। মুখটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে বলল, কোনো অসুবিধা নেই বেডের সবকিছু পাল্টে দিয়েছি।

বলেই ইব্রাহিম চাওসিকো ওপাশের দিকে চলে গেল।

মেয়েটার মুখে নতুন করে বিব্রতভাব ফুটে উঠল। লজ্জাও পেল। মনে। মনে ভাবল, ছেলেটা তাহলে কি ভাবল যে, আমি বেডের কারণেই বেড রুমে যাচ্ছি না! কিন্তু আমার সমস্যা তো বেড় নয়, বেড়ে যাওয়াই তো আমার জন্যে ভাবনার বিষয়।

ইব্রাহিম চাওসিকো চলে গেলে কিছুটা সময় নিয়ে মেয়েটা সোফা থেকে উঠল। একটু এগিয়ে ইব্রাহিম চাওসিকো যে দিকে চলে গেল, সে দিকে একটু উঁকি দিল ওদিকে কি আছে দেখার জন্যে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। বেডরুমের পশ্চিম পাশ দিয়ে যে প্যাসেজটা উত্তর দিকে এগিয়ে গেছে, বেড় রুমের উত্তর পাশের দেয়াল বরাবর তার মাথায় একটা দরজা। দরজাটা বন্ধ।

ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা বেড রুমের দিকে এগোলো।

বাইরে ঝড়-বৃষ্টির প্রচণ্ড দাপাদাপি। মনে হচ্ছে যেন কাঁচের জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়বে। বিদ্যুৎচমক ও বজ্রপাতের কড় কড় আওয়াজ ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। নিশ্চয় এই ফার্ম হাউজে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা নেই, ভাবনা এলো মেয়েটার মনে। সেই সাথে মনে ভয়েরও সৃষ্টি হলো। তাড়াতাড়ি সে বেড রুমের দরজার পর্দা ফাঁক করে ভেতরটা দেখে ভিতরে ঢুকে গেল।। ঘরে একটা মাত্র বেড। ঘরের পুব প্রান্তে উত্তর দেয়ালের সাথে একটা টেবিল। আর দক্ষিণ দেয়ালে কাপড় রাখার জন্যে একটা হ্যাঁঙার। ঘরের পশ্চিম প্রান্তে উত্তর দেয়ালে একটা দরজা। ওই দরজাটা বোধ হয় বাড়ির ওদিকে যাবার পথ, যে দিকে ছেলেটি গেছে।

মেয়েটা বেডের দিকে এগোলো। বেড কভার একেবারে ভাঁজহীন, ফ্রেশ। বালিশের কভারও তাই।

হঠাৎ ফার্ম হাউজটির কোথাও যেন বজ্রপাত হলো।

মেয়েটা ভীষণ চমকে উঠে আছড়ে পড়ল বেডের উপর। দুহাতে আঁকড়ে ধরল বালিশটি।

ঝড়, বজ্র-বৃষ্টির ঘনঘটা যেন বেড়ে গেল।

শুয়ে পড়েছে মেয়েটি। দুহাতে শক্ত করে বালিশ ধরে আছে। এখন তার মনে হচ্ছে ছেলেটা তার চোখের সামনে কোথাও থাকলে ভালো হতো, সাহস পেত সে। ভাবতে গিয়ে আবার কেঁপে উঠল তার মন। ছেলেটাকে কাছে চাওয়ার মধ্যে আরো বড় বিপদ আছে।

শীত করছে মেয়েটার। পায়ের দিকে সুন্দর ভাঁজ করে রাখা একটা চাদর টেনে গায়ে দিল। চাদরটাও ফ্রেশ। একটা হালকা সুগন্ধ তার নাকে লাগল। ভালো লাগা এই সুগন্ধ সে বেডেও পেয়েছে। মন তার বলে উঠল, নতদৃষ্টি ছেলেটা যেন কিছুই দেখে না, কিন্তু সব দিকেই তার নজর আছে। তার রুচিবোধও প্রশংসনীয়। কে ছেলেটা? তার ভব্যতা, ভদ্রতার আড়ালে অন্যকিছু নেই তো! থাকারই কথা। এমন পরিবেশে কোনো ছেলে বা পুরুষই বিশ্বাস্য নয়। গায়ের চাদরকে দেহের সাথে আরো জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।

ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভাঙল মেয়েটার। চোখ খুলে চারদিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। প্রথমে চোখে মুখে একটা বিমূঢ় ভাব আসলেও পর মুহূর্তেই তা কেটে গেল এবং মনে পড়ল সব।

দরজার কাঠের প্যানেলে আঙুলের আঘাতে ঠক ঠক শব্দ হচ্ছিল। মেয়েটি উঠে বসতেই দরজার পর্দার ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো, কফি এনেছি নিয়ে নিন।

মেয়েটির ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো, যাক ছেলেটিই তাকে কফি নিতে ডাকছে।

অনেকটা যন্ত্র-চালিতের মতো মেয়েটি বেড থেকে নামল। দরজার পর্দা ফাঁক করে সামনে তাকাল। মনে হলো ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। একবার তাকিয়েই চোখ নিচু করেছে সে। ট্রেতে কফির কাপ এবং একটা হাফপ্লেটে কিছু বিস্কুট।

মেয়েটি ছেলেটার হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে পিছু হটে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

ট্রেটা রেখে আপনি একটু আসুন, প্লিজ দরজাটা লাগিয়ে দেবেন। বলল। ইব্রাহিম চাওসিকো।

চমকে উঠল মেয়েটা, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে সে কি বাইরে যাবে? বিস্ময়ের চেয়ে মেয়েটা কিছুটা ভীতই হয়ে পড়ল।

সে তাড়াতাড়ি কফির ট্রে টেবিলে রেখে দরজায় ছুটে গেল। বলল, আপনি কি এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাবেন?

না আমি বাইরের দরজার কথা বলছি না, ভেতরের একটা দরজার কথা বলছি। বলল ইব্রাহিম চাওসিকো শান্ত কণ্ঠে মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই।

কথা শেষ করেই আবার সে বলে উঠল, আসুন। বলে হাঁটতে শুরু করল ইব্রাহিম চাওসিকো। মেয়েটি তার পিছু নিল।

অফিস রুম থেকে বাড়ির উত্তর অংশে যাবার পথে প্যাসেজের মুখে একটা দরজা। ইব্রাহিম চাওসিকো দরজার ওপারে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে বলল, দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিন। আপনার শোবার ঘরের উত্তর দিকের দরজাতেও ছিটকিনি লাগিয়ে দেবেন।

মেয়েটি ব্যাপারটা বুঝতে পারল। এই মহাদুর্যোগের রাতে একাকিত্বের একটা ভয় মেয়েটাকে পেয়ে বসল। ছিটকিনি না লাগালে হয় না কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মেয়েটা। অন্যরকম একটা অস্বস্তি তার মনে উঁকি দিল।

দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘরে ফিরে এলো মেয়েটা। বসল চেয়ারে। সামনে টেবিলে কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে।

কফির কাপটি তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিল কফির কাপে। পর পর কয়েকটা চুমুক দিয়ে কফির কাপটা রাখল পিরিচের উপর। টেবিলের ওপাশে একটা বইয়ের দিকে চোখ গেল তার। বইটা হাতে তুলে নিল। চোখ বুলাল বইটার নামের উপর।

স্পেস-ন্যাচার বইটার নাম।

বইটা নিশ্চয় ছেলেটার? এত কঠিন বিষয়ের বই সে পড়ে! বিস্ময়ের ধাক্কা খেল মেয়েটি।

বইটির পাতা উল্টাল সে।

এত দেখছি আমাদের ভিক্টর ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির বই! ছেলেটি কি তাহলে আমাদের ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ছাত্র! বিস্ময়ের আরেকটা ধাক্কা খেল সে। ছেলেটা তাহলে আমাকে চিনল না কেন? ভিক্টর ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর এবং বুজুমবুরার নাম্বার ওয়ান ব্যক্তিত্ব ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ানের মেয়ে আনা আরিয়াকে চেনে না এমন খুব কম ছেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে।

বুকে এবার সাহস ফিরে পেল আনা আরিয়া মেয়েটি।

সেই সাথে ছেলেটি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসাও জাগল তার মনে। ছেলেটির নাম কি, কোন্ বিভাগে, কোন্ ইয়ারে পড়ে? কি ধরনের ছেলেরে বাবা তার নামও বলেনি, আমার নামও জিজ্ঞেস করেনি! কফি খাওয়া শেষ হলো তার।

কফির কাপটা সরিয়ে রেখে এবার বইয়ের দিকে মন দিল আনা আরিয়া। বইটি স্পেস সাইন্সের একটা মৌলিক বই। মহাশূন্যের গঠন, মহাকাশ-বস্তু, অর্থাৎ মহাশূন্যের বিভিন্ন কণার চরিত্র, কাজ, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ঘনত্ব ও ভারসাম্যের বিস্ময়কর ঐক্য ইত্যাদি সব জটিল, গাণিতিক আলোচনা বইটিতে আছে। বইটি বন্ধ করতে করতে আনা আরিয়া ভাবল, অবশ্যই ছেলেটি বিজ্ঞানের ছাত্র।

বইটি টেবিলের একপাশে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়া।

ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল বেডের দিকে।

নিখুঁতভাবে বেডটি পাতা। সাদা ধবধবে চাদর। ছেলেটির রুচি আছে মনে মনে বলল আনা আরিয়া। সাদা চাদর তারও পছন্দ।

বেডের দিকে এগোলো আনা আরিয়া। বেডে বসতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভরে গেল আনা আরিয়ার মন। সে এভাবে অন্যের বেডে কখনো শোয়নি। ছেলেদের বেডের তো কথাই নেই।

সংকোচ, অস্বস্তি নিয়েই সে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো উত্তর দিকের দরজার কথা, যা ছেলেটি বন্ধ রাখতে বলেছিল।

খাট থেকে নেমে দরজার দিকে এগোলো। দরজা খোলা, ছিটকিনি দেয়া নেই।

মনটা আঁৎকে উঠল আনা আরিয়ার। ছেলেটা বন্ধ করতে না বললে তো। দরজা খোলাই থাকত। শুয়ে পড়ল আনা আরিয়া।

একটা হালকা সুন্দর গন্ধে মনটা ভরে গেল তার। গন্ধটা একটু পরিচিত মনে হলো, কোথাও যেন পেয়েছে। মনে পড়ে গেল, ছেলেটা খাবার ও নাস্তা দেয়ার সময় কাছাকাছি এলে এই গন্ধই সে পেয়েছে।

গন্ধের কথা ভাবতে গিয়ে ছেলেটার চেহারাও তার মনে ভেসে উঠল। সুন্দর গন্ধটা তার চেহারার সাথে মানানসই। হঠাৎ ক্ষোভের সৃষ্টি হলো আনা আরিয়ার মনে। ছেলেটা নামও বলেনি, নাম জিজ্ঞেসও করেনি। এমনকি ভালো করে চোখও তোলেনি সে আনা আরিয়ার দিকে। আনা আরিয়া কি দেখার মতো নয়? সুন্দরী হিসেবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলের সৌজন্য বোধ পর্যন্ত থাকবে না? নামও বলবে না, জিজ্ঞাসাও করবে না আমার নাম? তাকিয়ে দেখার মতো স্বাভাবিক কাজটাও করবে না? এটা এক ধরনের অবজ্ঞাও হতে পারে। এটা অপমানকর, কষ্টদায়ক। সেই সাথে মন আবার বলল, সুন্দরী তুমি এটা ভাবতেই পার। যাকে অপমানকর ও কষ্টদায়ক বলছ, তা-ই তোমার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। ভেবে দেখ, প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে ঘেরা এই বাড়ি তোমার জন্যে একেবারেই অরক্ষিত। ছেলেটা যদি এর সুযোগ…।

বুঝতে পেরেছি। তুমি ঠিক বলেছ, কিন্তু তোমাকে মানতে হবে এটা আমার নারী-সত্তার পরাজয়ও। আকর্ষণের কথা বাদ দিলাম, আমি যেন তার মধ্যে সামান্য কৌতূহলও সৃষ্টি করতে পারিনি। বলল আনা আরিয়া।

ভেতর থেকে সেই মনটা চোখ রাঙিয়ে বলল, তোমার নারী-সত্তার পরাজয় হয়নি, সে সম্মান দিয়েছে তোমার সত্তাকে।

কোন উত্তর দিল না আনা আরিয়া। চোখ বুজল।

সুন্দর সুগন্ধের হালকা পরশ রাজ্যের ঘুম নিয়ে এলো তার দুচোখ জুড়ে, কোনো উদ্বেগ নয় প্রশান্তির ঘুম।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন ঘরের ভেতরটাও ফর্সা। বাইরে ঝড়-বৃষ্টির দাপট নেই। উঠল আনা আরিয়া।

ঘরের পুব জানালা দিয়ে দেখল, সুন্দর সোনালি সকাল। রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমে গেছে। সুর্য উঠেছে বেশ কিছু আগে। দেরি হয়ে গেছে, আরো আগে তার ওঠা দরকার ছিল। সে ছুটে গেল উত্তরের দরজায়।

দরজা খুলে দেখল, ছেলেটা ডাইনিং টেবিলে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

হ্যালো, মিস্টার। দরজায় দাঁড়িয়েই ডাকল আনা আরিয়া ছেলেটাকে। দুবার ডাকল আনা আরিয়া, সাড়া নেই।

দরজা থেকে সরে এসে তাড়াতাড়ি ঢুকল ওয়াশ রুমে। তার কাপড় চোপড় শুকায়নি, দেখল সে।

ভেজা কাপড় সে দলা পাকিয়ে নিল। বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। বাইরের দরজার লক-সিস্টেমটা ভালো। লক করে বেরিয়ে এসে দরজা টেনে দিলেই দরজা লক হয়ে যাবে।

দরজা লক করে বেরিয়ে এলো আনা আরিয়া।

মনে প্রবল একটা অস্বস্তি অনুভব করল সে। ছেলেটাকে বলা হলো না। কি মনে করবে সে! কৃতজ্ঞ সে ছেলেটার কাছে। শুধু আশ্রয় দিয়েছে বা খাবার দিয়েছে তা নয়। অবিশ্বাস্য এক নিরাপত্তা পেয়েছে সে তার কাছে। প্রথম দিকে সে নিজেও মনে করেছে, ঝড়-বৃষ্টি ঘেরা পরিবেশে নির্জন এই বাড়িতে তার কুমারী জীবনের আজকেই শেষ রাত। কিন্তু বিস্ময়কর পবিত্র এই ছেলেটা। সে চোখ তুলে আমাকে একবার দেখারও চেষ্টা করেনি। দুটি দরজা দিয়েই সে আমার কাছে আসতে পারতো, কিন্তু আমাকে দিয়েই আমার দিকে ঢোকার দুটি দরজাই সে বন্ধ করিয়ে নিয়েছে। দেবদূতরা এত ভালো কিনা জানি না, তবে কোনো পুরুষ এমন হতে পারে সে আগে দেখেনি। ছেলে বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ মনে হওয়া ছেলে বন্ধুদের চোখেও সে। লোভের ছোঁয়া দেখেছে। বিস্ময়কর এই ভালো ছেলেটা কোত্থেকে উদয় হলো!

যাবার সময় ছেলেটাকে ধন্যবাদ না দিতে পারায় মনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেল আনা আরিয়ার।

রাস্তায় উঠে এলো আনা আরিয়া। গাড়িটা রাস্তায়, বেশ দূরে। আনা আরিয়া দ্রুত হাঁটতে লাগল সেদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *