লেক ট্যাঙ্গানিকার তীরে – ২

দারুস সালাম বিমানবন্দর। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা। কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল সে।

বিমানের প্রায় গোটা পথেই সে দুজন তরুণ-তরুণীর বিতর্ক শুনেছে।

ওরা খার্তুম থেকে বিমানে উঠেছে। আহমদ মুসা আসছে মদিনা থেকে।

ওদের মজার বিতর্কের কথাগুলোই কিলবিল করছিল আহমদ মুসার মাথায়।

আহমদ মুসা বুঝেছিল, তরুণীটি জাঞ্জিবারের আর তরুণটি তানজানিয়ার রাজধানী দোদুমার বাসিন্দা।

পোশাক দেখে তরুণীকে মুসলিম বলে মনে হয়েছে আহমদ মুসার কাছে। ছেলেটির গলায় ছিল একটা সোনার ক্রস।

খার্তুম বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসারের কথা নিয়েই ওদের বিতর্কের শুরু। তরুণটি বলছিল, অফিসারটির বাড়ি তোমাদের জাঞ্জিবারে নাকি, তোমাদের সোহাইলি ভাষায় কথা বলল?

তরুণীটিকে লক্ষ করে বলেছিল তরুণটি।

তরুণীটি ত্বরিত জবাবে বলেছিল, সোহাইলি ভাষা আমাদের বলছ, কেন তোমাদের নয়?

তোমাদের সোহাইলি ভাষা আমাদের নয়। আমাদের সোহাইলি ভাষা তোমাদের মতো অমন বিদঘুঁটে নয়। বলেছিল তরুণটি।

বিদঘুঁটে? আমাদের জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জের সোহাইলি ভাষাই স্ট্যান্ডার্ড সোহাইলি ভাষা। সোহাইলি ভাষাভাষি সব দেশেই এটা অনুসৃত হয়। তরুণীটি বলেছিল।

স্টান্ডার্ড হওয়াই সব কথা নয়। এই সোহাইলি ভাষায় আরবি শব্দের অতি আধিক্য অনেকেই পছন্দ করে না। বলেছিল তরুণটি।

শোন আলী মুইজী, সচেতনভাবে কথা বলা উচিত। পূর্ব আফ্রিকার খ্রিস্টান মিশনারী এবং তাদের মন্ত্র পাওয়া লোকরা ছাড়া হাজার বছর ধরে চলে আসা সর্বত্র প্রচলিত এই ভাষাকে সবাই ব্যবহার করে। তরুণীটি বলেছিল। তার কণ্ঠে ক্ষোভের প্রকাশ।

সংগে সংগে জবাব দেয়নি তরুণটি। তার চোখ-মুখে কিছু বিব্রতভাব। একটু সময় নিয়ে সে বলে, তুমি যখন এভাবে কথা বললে তখন আমিও বলি, খ্রিস্টানরা তানজানিয়া ও এই অঞ্চলে মেজরিটি। সুতরাং তারা ব্যাপারটা অপছন্দ করতেই পারে। গণতান্ত্রিক অধিকারকে তুমি আমি বাধা দেব কি করে?

খ্রিস্টানরা তানজানিয়া ও এই অঞ্চলে মেজরিটি এ কথা তুমি কোথায় পেলে? তরুণীটি বলেছিল।

সবাই তো বলে, খ্রিস্টানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬২ পারসেন্ট।

আর মুসলমান মাত্র ৩৫ পারসেন্ট। বলে তরুণটি।

যারা বলে দেখ গিয়ে তারা সবাই খ্রিস্টান অথবা ওগুলো খ্রিস্টান সোর্স থেকে আসা প্রচারণা। ১৯৬৭ সাল থেকে আমাদের তানজানিয়ার আদম শুমারিতে মানুষের ধর্ম পরিচয়ের উল্লেখ বন্ধ করা হয়েছে কেন জান? বলেছিল তরুণীটি।

কেন বন্ধ করা হয়েছে? অনেক দেশই তো এমনটা করেছে। তরুণটি বলে।

যে দেশই করুক, রাজনৈতিক কোনো স্বার্থসিদ্ধি থেকে করেছে। আমাদের দেশে করা হয়েছে মুসলমানদের সংখ্যা কম দেখানো এবং খ্রিস্টানদের সংখ্যা বেশি দেখানোর অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। বলে তরুণীটি।

দেখ, তোমার অভিযোগটা খুবই স্থূল। এটা এক ধরনের ব্লেম গেম। বলেছিল তরুণটি।

তোমার কথাটাই স্থূল। একেবারে বলার জন্যেই বলা। কে না জানে, আদম শুমারিতে ধর্মের পরিচয় উল্লেখ বন্ধ করার আগে তানজানিয়ার মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপর রাতারাতি মুসলমানরা ৩৫% শতাংশে নেমে এলো আর খ্রিস্টানরা উঠে গেল ৬২ শতাংশে। আর স্থানীয় ধর্ম অনুসারীদের সংখ্যা নাই হয়ে গেল। তুমি জান না মিরাকলটা কীভাবে ঘটেছে? তরুণীটি বলে।

তুমি কি বলবে আমি জানি। বলে তরুণটি। তার মুখে হাসি।

তুমি কি তা স্বীকার করো না? স্বীকার করো না যে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়, সাহায্যের তালিকা ও ভোটার লিস্ট করার সময় জোর করে অথবা না জানিয়ে মুসলমান ও স্থানীয় ধর্মাবলম্বীদেরকে পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে খ্রিস্টান নাম দেয়া হয়েছে এবং পরে এদের সবাইকে খ্রিস্টান জনসংখ্যার মধ্যে শামিল করা হয়েছে। তরুণীটি বলেছিল।

এসব অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের কথা বাদ দাও। তোমাদের জাঞ্জিবারে তো শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমান। ওখানে তাহলে এমনটা ঘটেনি কেন? বলে তরুণটি।

– ওখানে ওরা সুযোগ পায়নি, সাহস করেনি। বলেছিল তরুণীটি ত্বরিত। জবাবে।

জাঞ্জিবারে তোমরা যা পেরেছ, মেইনল্যান্ডের মুসলমান ও স্থানীয় ধর্মাবলম্বীরা তা পারেনি। দোষ তাহলে সবারই আছে। তরুণটি বলেছিল।

দোষ নয়, নানা কারণ থেকে উদ্ভূত, এটা এক অসহায়ত্ব। তোমার নিজের ব্যাপারটাই দেখ। তুমি রাজধানী শহরের সচেতন মুসলিম তরুণ। তুমি গলায় খ্রিস্টানদের ক্রস পরে আছ। কারণ তোমার আউট স্ট্যান্ডিং লিটারারি পারফরমেন্সের জন্যে ক্রস ঝুলানো সোনার চেইন তোমার গলায় পরিয়ে দেয়া হয়েছে স্বয়ং ভিসির পক্ষ থেকে। তুমি তা খুলতে পারনি। তোমাকে যে কেউ তানজানিয়ার খ্রিস্টান জনসংখ্যার মধ্যে শামিল করতে পারে, যদিও তুমি একজন সচেতন মুসলমান। বলে তরুণীটি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া কোট পিন, চেইন, রিং, বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিপার্টমেন্টাল মনোগ্রাম সবাই ব্যবহার করে। আমিও ব্যবহার করি। খুলে ফেলতে পারব না, তা নয়। থাক এসব কথা। দেখ, ক্যাবিনেটের কথা তো ধরছিই না, টপের কথাই ধর। তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি সবাই মুসলমান। আর কি চাও? বলে তরুণটি।

এটাই প্রমাণ করে তানজানিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তরুণীটি বলে।

তরুণটি হাসে। বলে, তাও তোমার অবস্থান থেকে তুমি সরে আসবে না। তোমাদের জাঞ্জিবার মফস্বল শহর বলেই মফস্বল-চরিত্র তুমি কাটিয়ে উঠতে পারছ না।

ভ্রুকুটি করে ওঠে মেয়েটি। বলে, আমাদের জাঞ্জিবারকে তুমি মফস্বল শহর বলছ। তুমি কি জান, আমাদের জাঞ্জিবার নগরী মুসলিম সালতানাতব স্টেট অব জাঞ্জিবারের রাজধানী ছিল। তখন তানজানিয়া ওরফে ট্যাঙ্গানিকা, মালাবী, বুরুন্ডি এবং মোজাম্বিক ও কংগোর একাংশ ছিল এই স্টেট অব জাঞ্জিবারের অধীন। আর আমাদের জাঞ্জিবার যখন ছিল আন্তর্জাতিক নগরী, তখন তোমার দোদুমা ছিল একটা আঞ্চলিক বাজার। জার্মানরা যখন তানজানিয়ায় রেলওয়ের নির্মাণ করছিল, সে সময় ১৯০৭ সালে দোদুমাকে শহর হিসেবে গড়ে তোলে। আজও আমাদের জাঞ্জিবার আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা রাখে।

আসলে মফস্বল কথাটা স্থানের সাথে নয়, মানসিকতার সাথে যুক্ত। বলে তরুণটি।

হেসে উঠে তরুণীটি। বলে, আত্মরক্ষার জন্যে কথা পাল্টাচ্ছ। কথা পাল্টালেই সত্য অসত্য হয়ে যাবে না।

তরুণটিও হাসে। বলে, আমার আত্মরক্ষার প্রয়োজন নেই। আমি যা তাতেই খুশি।

তুমি যা তার মধ্যে গলার ক্রসটিও কি আছে? তরুণীটি বলে। তারও মুখে ছিল হাসি।

তরুণটি সংগে সংগেই গলা থেকে ক্রস ঝুলানো সোনার চেইন খুলে ফেলে। বলে উঠে, আচ্ছা, এবার আর কি বলবে?

ধন্যবাদ। তরুণীটি বলে। তার মুখে উজ্জ্বল হাসি।

কিছু মনে করো না, তোমাদের দুজনকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। বলেছিল আহমদ মুসা তরুণ-তরুণী দুজনকে লক্ষ করে।

প্লেনের এক পাশে তিন সিটের সারিতে তরুণীটি বসেছে জানালার পাশে। মাঝখানে ছিল তরুণটি। তারপর ছিল আহমদ মুসা।

তরুণ-তরুণী দুজনে এক সাথে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। গভীর দৃষ্টি। এতক্ষণ যেন তারা আহমদ মুসাকে দেখেইনি। একটা বিব্রত ভাব তাদের চোখে-মুখে।

স্যরি, আপনাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি আমরা। দুএকটা কথা বলতে গিয়ে এমনটা হয়েছে। ধন্যবাদ দিয়ে আমাদের লজ্জা দিচ্ছেন। বলে তরুণীটি।

তরুণীটি একটু থেমেই আবার বলে উঠে, স্যার, আমার নাম সিতি সাবেরা, আর ওর নাম হোসেন আলী মুইজী।

ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা বলেছিল, সিতি, আলী মুইজী, আমি মোটেই বিরক্ত বা ডিস্টার্বড় হইনি। আমি তোমাদের মিষ্টি বিতর্ক আগ্রহের সাথে শুনছিলাম।

আগ্রহের কি পেলেন স্যার, আমরা তো তেমন কিছুই বলিনি। আলী মুইজী বলেছিল।

অনেক কিছু বলেছ। তোমরা আফ্রিকার বিশেষ করে মধ্য আফ্রিকার মুসলমানদের সমস্যায় হাত দিয়েছ। সিতি যে তথ্যগুলো দিয়েছে তার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। বলেছিল আহমদ মুসা।

আপনি সোহাইলি ভাষা ভালো বলতে পারেন। আপনি নিশ্চয় বাইরে থেকে আসছেন, মনে হচ্ছে মধ্য এশিয়া অঞ্চল থেকে। আপনি কীভাবে এত ভালো সোহাইলি ভাষা জানলেন? বলে তরুণী অর্থাৎ সিতি সাবেরা।

আফ্রিকার বান্টু গোত্রসমূহ, মুসলমান ও সোহাইলি ভাষার সম্পর্ক সম্পর্কে আমি জানতাম। মদিনায় জাঞ্জিবারের পেমবাদ্বীপের একজন লোকের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি মদিনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। সোহাইলি প্রাথমিকভাবে আমি তার কাছ থেকেই শিখি। তা ছাড়া মধ্য পশ্চিম অফ্রিকায় আমাকে বেশ কিছু দিন থাকতে হয়েছিল। তখন ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও কংগোতে বেশ ঘুরাঘুরি করতে হয়। দেশগুলোতে সোহাইলি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে চর্চা হয়। আর ক্যামেরুনে যাদের সাথে থাকতাম, তারা সোহাইলি বলতো। এভাবেই ভাষাটা কিছু শিখে ফেলেছি। বলেছিল আহমদ মুসা।

আপনি কি ট্যুরিস্ট হিসেবে গিয়েছিলেন সেখানে? জিজ্ঞাসা ছিল আলী মুইজীর।

আমি ট্যুরিস্ট নই, ট্যুরিস্ট হিসেবেও যাইনি। সোহাইলি ভাষা ও জনসংখ্যার ধর্মীয় পরিচয় তোমাদের যে সমস্যা, তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা ছিল সেখানকার মুসলমানদের। এ সমস্যা নিয়েই সেখানে গিয়েছিলাম। বলেছিল আহমদ মুসা।

তাদের সমস্যাটা কেমন ছিল? পত্র-পত্রিকায় আমরা কিছু পড়েছিলাম। তরুণী সিতি সাবেরা বলেছিল।

কি পড়েছিলে? বলেছিল আহমদ মুসা।

গোপন ও প্রকাশ্য কিছু আন্তর্জাতিক খ্রিস্টান সংস্থা মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের ভূমি দখল করছিল। বহু এলাকা মুসলিম জনশূন্য করে ফেলা হয়েছিল। এ ধরনের অনেক কথা। তরুণী সিতি সাবেরা বলেছিল।

বাস্তবেও কি এ রকম কিছু ঘটেছিল, না বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছিল? বলে আলী মুইজী।

সিতি যা পড়েছ সেটাই বললে, বাস্তবের ঘটনা ছিল আরো ভয়াবহ। মুসলমানরা শুধু ভূমি হারানো বা উচ্ছেদ হওয়াই নয়, শত শত মুসলমান গুম ও হত্যার শিকার হয়েছে। বলেছিল আহমদ মুসা।

মধ্য পশ্চিম আফ্রিকা তো আমাদের কাছেই, আমাদের ভাগ্যেও কি অমন কিছু অপেক্ষা করছে? সিতি সাবেরা বলেছিল।

খ্রিস্টান নামের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো যে ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিম আফ্রিকায়, তারা বা তাদের কেউ সাহস করবে না পূর্ব আফ্রিকায় নাক গলাতে। আহমদ মুসা বলেছিল।

আশার কথা শুনবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।

কথা শেষ করে একটু থেমেই সিতি সাবেরা বলেছিল, পশ্চিম আফ্রিকায় আপনার কাজ সম্পর্কে তো কিছু বললেন না। আপনার নামও তো আপনি বলেননি।

ওখানকার কাজ ছিল সামষ্টিক। আমার একার ভূমিকা সম্পর্কে বলার কিছু নেই। আহমদ মুসা বলেছিল।

আপনার নাম? প্রশ্ন ছিল আলী মুইজীর।

অনেক কথা বলেছি, এটুকু না বললেও চলে আলী মুইজী। বলেছিল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল সিতি সাবেরা। এই সময় প্লেন দারুস সালাম বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার ঘোষণা দিল।

মুখের সেই হাসি নিয়েই আহমদ মুসা বলে উঠে, আমাদের এখনকার গল্প শেষ। আবার দেখা হলে এখান থেকেই শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।

আবার দেখা হবে, সেটা কি বলা যায়? বলে সিতি সাবেরা।

পৃথিবী গোল। দেখা হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি জাঞ্জিবার সিটি, দারুস সালাম ও দোদুমায় আসতে পারি। আর তোমরা দুজনেই তো দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়। আহমদ মুসা বলেছিল।

জানলেন কি করে? আমরা তো বলিনি! বলেছিল আলী মুইজী।

সিটের পকেটে রাখা ম্যাগাজিনে তোমার পরিচয় লেখা দেখেছি। বলে আহমদ মুসা।

আপনি দোদুমা, দারুস সালাম ও জাঞ্জিবারে আসবেন বললেন, তাহলে এখন আপনি যাচ্ছেন কোথায়? সিতি সাবেরা বলে।

বুজুমবুরায় যাচ্ছি। বলেছিল আহমদ মুসা।

আপনার যাত্রা শুভ হোক। বুঝতে পারছি আপনি কাজের মানুষ। আরো বুঝতে পারছি এই কারণেই আপনার নামটা এখন বলতে চাইলেন না। বলে আবার সিতি সাবেরাই।

সিতি সাবেরা তোমাদের দুজনকে ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি হয়েছি, তোমরা সচেতন এবং নিজের জাতিকে তোমরা ভালোবাস। মনে রেখ, এই সচেতনতা ও জাতির প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে স্বাধীনতাও হারিয়ে। যাবে। আহমদ মুসা বলেছিল।

সিতি সাবেরা ও আলী মুইজী দুজনেই সোজা হয়ে বসল এবং সমস্ত মনোযোগ যেন চোখে এনে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দুজনেই কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। সাবেরার কণ্ঠই আগে কথা বলে উঠে, স্যার এইভাবে এমন কথা কেউ কোনদিন আমাদের বলেনি। আপনার পরিচয়। সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরো বাড়ল। এমন কথা আমাদের মতো অপরিচিতদের তিনিই বলতে পারেন, যিনি সবার স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেন। দুঃখ আমাদের থেকেই যাবে। এমন একজন মহৎ ব্যক্তির সাথে, জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়ার পরও তাঁর পরিচয় আমাদের জানা হলো না।

প্লেন ল্যান্ড করেছে। মাটির উপর দিয়ে প্লেন তখন গড়াচ্ছিল।

গড়ানোটা শেষও হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে যায় প্লেন। বিমানের দরজাও খুলে গিয়েছিল তখন।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেছিল, তোমার এই শেষ কথার

জবাবও আমি দিয়েছি।

সিতি ও আলী আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।

ধন্যবাদ স্যার। আশা অবশ্যই নিরাশার চেয়ে ভালো। বলেছিল সিতি সাবেরা।

প্লেনের দরজার দিকে এগিয়েছিল সবাই।

ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ানো আহমদ মুসার মাথায় সিতি ও আলী মুইজীর কথাই ঘুরে ফিরে আসছিল।

এক্সকিউজ মি স্যার।

পাশ থেকে বলা এই কথা শুনেই মুখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, বুকে ইমিগ্রেশনের আইডি ঝুলানো একজন লোক। ইমিগ্রেশন অফিসারই হবে। নাম দেখল এরিক দানিয়েল দুমা।

আহমদ মুসা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই অফিসারটি বলল, স্যার আপনার কাগজ-পত্র নিয়ে আমার সাথে ইমিগ্রেশন অফিসে একটু আসুন।

লাইনের চেকিং কাউন্টারেই তো সব কাগজপত্র দেখার ব্যবস্থা আছে, তাহলে আবার অফিসে যাওয়া কেন- ভাবল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আবার তার মনে হলো, হয়তো আরো কোনো বড় অফিসার দেখতে চান তার কাগজপত্রগুলো।

আহমদ মুসা কোনো কথা না বলে অফিসারটির পেছন পেছন চলল। ইমিগ্রেশন হলটা পেরিয়ে আরো দুএকটা কক্ষ পার হয়ে একটা কক্ষের সামনে অফিসারটি দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, আসুন স্যার এই কক্ষেই।

কক্ষের দরজা বন্ধ।

দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে দুজন। নিশ্চয় ইমিগ্রেশন সিকিউরিটির লোক হবে এরা।

অফিসার লোকটি নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। আহমদ মুসাও তার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকল।

ঘুরে ঢুকে আহমদ মুসা দেখল, বড় ঘরটির মাঝখানে একটা। সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলের ওপাশে একটা রিভলভিং চেয়ার। চেয়ারে কেউ নেই। চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন লোক। তাদের বামদিকে একটু দূরে আহমদ মুসাদের সামনে আরো দুজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের গায়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের ইউনিফরম, কিন্তু তাদের গলায় বা ইউনিফরমের সাথে ইমিগ্রেশন আইডি ঝুলানো দেখল না।

পেছন থেকে দরজা বন্ধের শব্দ এলো।

পায়ের শব্দে মনে হলো আহমদ মুসার, দরজার দুজন সিকিউরিটি ভেতরে প্রবেশ করেছে।

পরিস্থিতিটা আহমদ মুসার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। ঊধ্বর্তন, অফিসারের সাথে সাক্ষাৎকারের জন্যে নিয়ে এসেছে, অথচ সেই অফিসারের চেয়ারটাই খালি।

আহমদ মুসার চিন্তা কোনো পরিণতিতে পৌঁছতে পারল না।

অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই পেছন থেকে তার দুই হাত সমেত তাকে জাপটে ধরছে একজন। তার সাথে সাথেই আরেকজন এক হাতে আহমদ মুসার গলা পেঁচিয়ে ধরে অন্যহাতে ক্লোরোফরম ভেজানো রুমাল চেপে ধরেছে তার নাকে। আর সামনের পাঁচজনের হাতেই উঠে এসেছে রিভলভার। পাঁচটি রিভলভারের নল তাক করা আহমদ মুসার দিকে।

কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরেছে আহমদ মুসা। পরিস্থিতি পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ রাখেনি। অবশেষে একটাই করণীয় হিসেবে নিশ্বাস বন্ধ করেছে আহমদ মুসা। মিনিট খানেকের মধ্যেই আহমদ মুসার দেহ ঢলে পড়ল তাকে যে জাপটে ধরেছিল তার হাতের উপর। লোকটি চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, খেলা শেষ। বীরপুরুষের জ্ঞান হারিয়ে গেছে।

আহমদ মুসা মনে মনে বলল, এরা কি আমাকে চেনে, না এরা ভাড়াটে কেউ? কথাগুলো ভাড়াটেদের মতোই।

লোকটির কথা শেষ হতেই সামনে থেকে একজন চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, মাইকেল, তোমরা তাড়াতাড়ি একে কফিনের কাছে নিয়ে যাও। তার আগে এর হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে বেড়ি লাগাও। এটা উপরের নির্দেশ। আধাঘণ্টার মধ্যে একে কফিনে তুলে সব রেডি করে ডিপারচার লাউঞ্জের কার্গো কেবিনে নিয়ে যেতে হবে।

আহমদ মুসার হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে বেড়ি লাগানো হলো। তারপর তাকে কাপড়ে মুড়ে একটা কার্গো ট্রলিতে তুলে নিয়ে চলল।

আহমদ মুসা মনে মনে, অবাক হলো, সংজ্ঞাহীন করার পরও তাকে হ্যান্ডকাফ ও বেড়ি পরানো হলো। আর উপরের নির্দেশেই তারা এটা, করেছে। উপরের লোকরা, মানে মূল কিডন্যাপকারিরা কারা? তারা আহমদ মুসাকে ভালোভাবে চেনে বলেই এই পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছে। তাকে কফিনে তোলা হবে, এরপর তাকে ডিপারচার লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। কফিন হিসেবে তাকে কার্গো বিমানে উঠাবে। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া। হচ্ছে।

সময়ের হিসাব এবং তার কফিন নিয়ে কি হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব আহমদ মুসার কাছে নেই। সে অনুমান করছে ঘণ্টাখানেক ধরে এখান থেকে সেখানে টানা-হেঁচড়া করার পর তার কফিন উপরে উঠানো হলো এবং অনেকটা আছড়ে ফেলার মতো করে এক জায়গায় রাখল। কফিনের আঘাত তার দেহেও এসে লাগল।

কফিনটা স্থির হবার সাথে সাথেই একটা অব্যাহত কম্পন তার শরীর অনুভব করল এবং অব্যাহত একটা শব্দ তার কানে আসতে লাগল। আহমদ মুসা বুঝল তাকে প্লেনে তোলা হয়েছে।

আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, দারুস সালামের মতো একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার কফিনটা ইমিগ্রেশন থেকে কীভাবে প্লেনে তুলল এত কম সময়ে! সন্ত্রাসীরা যতই ব্যক্তিত্বশালী হোক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের যোগসাজস ছাড়া এটা হয়নি। কারা হতে পারে এই সন্ত্রাসী গ্রুপ! পূর্ব আফ্রিকায় এমন কোনো গ্রুপের সাথে তার কোনো জানাশোনা নেই। তাহলে তার আন্তর্জাতিক শত্রুদের কেউ হবে।

এই সব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই সে অনুভব করছে, প্লেনের কম্পন ও শব্দ বেড়ে গেছে। আরো কিছু পরে নড়ে উঠল বিমানটা। উপরে উঠছে বিমান। বিসমিল্লাহ বলে আহমদ মুসা যানবাহনে ওঠার দোয়াটা পড়ে নিল। রানওয়ের উপর দিয়ে তখন দৌড়াচ্ছে প্লেনটা।

আহমদ মুসা ইমিগ্রেশন কাউন্টারের যে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, তার পাশেই। স্থানীয় যাত্রীদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল সিতি সাবেরা ও আলী মুইজী। ইমিগ্রেশন অফিসার আহমদ মুসার কাছে আসা ও তার সাথে কথা বলা এবং অফিসারটির সাথে আহমদ মুসার যাওয়া সবটাই তাদের সামনে ঘটেছে। তারা মনে করেছিল, কাগজ-পত্র সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসার জন্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে আসবেন তিনি। এ জন্যেই ইমিগ্রেশনের কাজ তাদের শেষ হলেও কাউন্টারের পেছনে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ইমিগ্রেশনের সব যাত্রী কাজ শেষ করে চলে গেল অথচ আহমদ মুসা ফিরে এলো না।

আরো অপেক্ষা করল তারা। কিন্তু আহমদ মুসা এলো না। কিছু কি ঘটেছে তার? কি ঘটতে পারে? দুজনেই ভাবছিল।

কি চিন্তা করছি আমরা! খোঁজ নেয়ার একটা বড় সূত্র আছে। আমার বড় মামা মাসখানেক আগে ট্রান্সফার হয়ে এখানকার ইমিগ্রেশনে এসেছে। তিনিও একজন বড় অফিসার। আজকে তার ডিউটি আছে। চল। বলল সিতি সাবেরা। তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

চল, তার কাছ থেকে আসল খবর পাওয়া যাবে। আলী মুইজী বলল।

তেমন কিছু ঘটলে তার সাহায্যও পাওয়া যাবে। বলল সিতি সাবেরা।

দুজনেই হাঁটতে শুরু করল ইমিগ্রেশনের দিকে। সিতি সাবেরার বড় মামার নাম শরিফ হামাদ। সে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন ডেপুটি ডাইরেক্টর।

শরিফ হামাদের অফিস-কক্ষে প্রবেশ করল সিতি সাবেরা ও আলী মুইজী।

কক্ষ খালি।

সিতিরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চাইল। একজন অ্যাটেন্ড্যান্টকে দেখতে পেল কিছু দূরে একটা বেঞ্চিতে বসা। সিতি সাবেরা তার কাছে গিয়ে শরিফ হামাদ সাহেব কোথায় জিজ্ঞেস করল।

অ্যাটেন্ড্যান্ট বলল, একটা মিটিং এ গেছেন। এখনি এসে পড়বেন। মিটিংটা কোথায়? জিজ্ঞাসা সিতি সাবেরার।

এই তো এখানে। বড় স্যারের রুমে। বলল অ্যাটেন্ড্যান্ট।

কথা শেষ করেই অ্যাটেন্ড্যান্ট আবার জিজ্ঞাসা করল, দরকার কি স্যারের সাথেই? কি দরকার?

উনি আমার বড় মামা। একটু অন্য কাজ আছে। সিতি সাবেরা বলল।

অ্যাটেন্ড্যান্ট উঠে দাঁড়াল। প্রসন্ন মুখে বলল, তাহলে ভেতরে গিয়ে বসুন। আমি দেখছি ওদিকে গিয়ে।.

সিতি সাবেরা ও আলী মুইজী শরিফ হামাদের অফিস কক্ষে গিয়ে বসল। একটু পরেই এলো শরিফ হামাদ।

কক্ষে ঢুকেই বলল, সিতি মা, তুমি কতক্ষণ? স্টাডি ট্যুর থেকে তোমরা ফিরলে বুঝি?

জি বড় মামা। অন্যেরা আগেই এসে গেছে। আমরা খার্তুমে একটু নেমেছিলাম।

শরিফ হামাদ দরজার দিকে তাকিয়ে অ্যাটেন্ড্যান্টকে বলল, ফ্রান্সিস কারুমি, কফি দাও।

কফির অর্ডার দিয়েই সিতিদের দিকে ফিরে আলী মুইজীকে লক্ষ্য করে বলল, তোমার নাম আলী মুইজী না, তুমি যেন কার ছেলে?

আলী মুইজী কথা বলার আগে সিতিই বলে উঠল, ওর বাবা পার্লামেন্ট সদস্য আমানি আবেদ।

– হ্যাঁ, মনে পড়েছে। দোদুমায় একবার দেখা হয়েছিল। বলল শরিফ হামাদ।

চেয়ারে একটু ঠেস দিয়ে সিতির দিকে চেয়ে শরিফ হামাদ বলল, হ্যাঁ, সিতি মা বলল, শুধু মামার সাথে দেখা করতে এসেছ, না কিছু বলবে? তোমার মা গতকাল হাসপাতালে গিয়েছিল, জান?

জি মামা, জানি। আম্মার সমস্যাটার জন্য আরো আগে ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার ছিল। সিতি বলল।

তোমার বাবা তো রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত! দলের একজন শীর্ষ নেতা হওয়ায় এখন তো ব্যস্ততা আরো বেড়েছে। বলল সিতির বড় মামা শরিফ হামাদ।

বড় মামা, আমরা একটা খোঁজ নিতে এসেছি। সিতি বলল।

বল কি খোঁজ করছ? বলল শরিফ হামাদ।

ইমিগ্রেশনের ওখানে আমরা ডোমেস্টিক লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের পাশেই বিদেশিদের লাইনে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিচিত একজন। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার গিয়ে তাকে ইমিগ্রেশন অফিসে ডেকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সে আর লাইনে ফেরেনি। আমরা বহুক্ষণ অপেক্ষা করার

পর কি ঘটেছে, তার খোঁজ নিতেই এসেছি। সিতি সাবেরা বলল।

বিদেশি লোকটি এশিয়ান? জিজ্ঞাসা সিতির মামার।

হ্যাঁ, এশিয়ান।

হঠাৎ সিতির বড় মামা শরিফ হামাদের মুখের উপর দিয়ে ভয়ের একটা কালো ছায়া খেলে গেল। সে মুখ একটু নিচু করেছিল।

বিষয়টা সিতি ও আলী মুইজী কারোরই চোখ এড়াল না। এ সময় কফি এসে গেল।

এসো আমরা কফি খেয়ে নেই। আমার ডিউটি শেষ। আমরা এক সংগেই বেরুব।  

বড় মামা, আমাদের খোঁজ নেয়ার বিষয়টা? সিতি তার বড় মামাকে স্মরণ করিয়ে দিল।

তার বড় মামা শরীফ হামাদ ওদের দিকে চেয়ে তর্জনী ঠোঁটে ঠেকাল। তার চোখে-মুখে সেই ভয় ও আশংকার প্রকাশ।

সিতি ও আলী মুইজ দুজনেই বুঝল, এ বিষয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।

সিতি ও আলী মুইজীর মনে একটা আশংকা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হলো।

কফি খাওয়ার পর লাগেজ কর্নার থেকে লাগেজ নিয়ে সিতি ও আলী মুইজী সিতির বড় মামা শরিফ হামাদের সাথে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলো।

শরিফ হামাদ তার গাড়িতে উঠতে গিয়ে বলল, তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পরে যেও, এখন আমার বাসায় চল।

পথে আর কোনো কথা হলো না। শুধু একবার সিতির বড় মামা তাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, আজ ইমিগ্রেশনে সবার মুখে তালা লাগানো।

শরিফ হামাদের ড্রইংরুম। সবাই ফ্রেস হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছিল।

সিতি ও আলী মুইজী উদ্বেগ-আতংকে একদম সারা। কি ঘটেছে এমন যে ইমিগ্রেশন অফিসের সবার মুখে তালা। সবচেয়ে বড় কিছু যদি ঘটে থাকে তাহলে সেটা হবে লোকটি গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু এমন ঘটনা তো ইমিগ্রেশনে নতুন নয়। আর এতে সেখানকার সবার মুখে তালা লাগানোর প্রশ্ন তো ওঠে না।

সিতি ও তার বড় মামা এক সাথেই বাসার ভেতর থেকে এসে ড্রইং রুমে বসেছিল। বসেই সিতি বলল, কি ঘটেছে মামা এবার বলুন। আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন।

উদ্বিগ্ন হয়ে কি করবে মা লোকটি এখন প্লেনে লুসাকার পথে। বলল শরিফ হামাদ।

কিন্তু মামা তার তো ডেস্টিনেশন বুরুন্ডির বুজুমবুরা! সিতি বলল।

মা তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। তাকে সংজ্ঞাহীন করে কফিনে ভরে লুসাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বলল শরিফ হামাদ।

কিন্তু তাকে তো ইমিগ্রেশন অফিসার অফিসে ডেকে নিয়ে গেছে! কিডন্যাপ হলো কখন? সিতি বলল।

হাসল শরিফ হামাদ। শুকনো হাসি। বলল, কিডন্যাপারদের জন্যেই অফিসে তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তাহলে তো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এর সাথে জড়িত। বলল সিতি।

কে জড়িত, কে জড়িত নয়, বলা মুস্কিল। যারা কিডন্যাপ করেছে তারা এত বড়, এত প্রভাবশালী যে, অনেক সরকার পর্যন্ত তাদের কথায় ওঠে বসে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কথা না শুনে পারবে কি করে? শরিফ হামাদ বলল। তার মুখ শুকনো ও বিব্রত। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না।

এক সময় মুখ তুলল শরিফ হামাদ। বলল, কিডন্যাপ হওয়া লোকটা কে? কিডন্যাপাররা নাকি বলেছে, আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান। ব্যক্তিকে তারা জালে আটকেছে। তার মাথার মূল্য নাকি বিলিয়ন ডলার।

বলে একটু দম নিল শরিফ হামাদ। সিতিও আলী মুইজীর দিকে চেয়ে বলল, এত দামি লোক, কে সে? জানো নাকি তাকে? কীভাবে তোমাদের সাথে পরিচয়?

প্লেনে সাইডের তিন সিটের সারিতে আমরা দুজন এবং তিনি বসেছিলেন। পথে আমি ও আলী আলোচনা করছিলাম সোহাইলি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষ এবং তানজানিয়ায় খ্রিস্টান ও মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ে। আমি বলছিলাম, ১৯৬৭ সাল থেকে আদমশুমারীতে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের উল্লেখ বন্ধ করে দেশে খ্রিস্টানের সংখ্যা বাড়ানো এবং মুসলমানের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এসব নিয়ে নানা রকম আলোচনা করছিলাম। তার মনোযোগ যে আমাদের আলোচনার দিকে ছিল আমরা তা বুঝতে পারিনি। এক সময় তিনি আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে আমাদের আলোচনা থেকে তানজানিয়া সম্পর্কে নতুন কিছু জানলেন এই কথা বললেন। এভাবেই তার সাথে আলোচনা শুরু। তিনিই আমাদের জানালেন, পূর্ব আফ্রিকার চেয়ে মধ্য পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমানদের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। বলে তিনি সেখাকার মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে জানালেন। জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি জানালেন, মধ্য পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুনে এবং মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও কংগোর একটা অঞ্চলে কিছু ঘটনার কারণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আর…।

সিতির কথায় বাধা দিয়ে তার মামা শরিফ হামাদ বলে উঠল, ক্যামেরুনে খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের যে বিরাট ঘটনা কিছু দিন আগে ঘটল সেই ঘটনায় তিনি গিয়েছিলেন?

জি মামা, তিনি সেটাই বলেছেন। বলল সিতি।

লোকটি তার নাম কি বলেছিলেন? জিজ্ঞাসা মামার। নাম বলতে চাননি। সিতি বলল।

শরিফ হামাদের চোখে-মুখে ভাবান্তর স্পষ্ট হয়ে উঠল। বলল, ক্যামেরুনের সেটা ছিল আফ্রিকা অঞ্চলের একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। আমি পত্র-পত্রিকায় বিষয়টা বিস্তারিত পড়েছি। একজন আরবীয় কূটনীতিকের কাছে শুনেছি, গোটা ঘটনাটা আহমদ মুসা ঘটায়। তাঁর সম্পর্কে তিনি অনেক কথা বলেছিলেন। মজলুম মানুষদের তিনি বিরাট সম্পদ। ওআইসি, রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী, সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলো তার জন্যে গর্বিত। সেই আহমদ মুসাই ইনি নয়তো?

জানি না মামা, কিন্তু তাঁর কথাগুলো আহমদ মুসার মতো মানুষের মুখেই মানায়। জানো মামা, তিনি আমাদের বিদায় দেবার সময় কি বলেছেন? জাতির স্বকীয়তা সম্পর্কে আমাদের সচেতনতাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছেন, এই সচেতনতা ও জাতির প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে স্বাধীনতাও হারিয়ে যাবে। সিতি বলল।

ঠিক, এমন কথা আহমদ মুসার মুখেই মানায়। কিডন্যাপারদের বলা সেই দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি তাহলে আহমদ মুসাই। শুকনো ও বেদনাতাড়িত কণ্ঠস্বর শরিফ হামাদের।

তাহলে তিনিই আহমদ মুসা মামা? বলল সিতি। তার ও আলী দুজনের মুখেই অপার বিস্ময়।

আমাদের চোখের সামনে ঘটনা ঘটেছে। আমরা কি কিছু করতে পারি, তার আপনজন বা যারা জানলে তার উপকার হবে এমন কোনো কাউকে কিডন্যাপের কথা আমরা জানাবার চেষ্টা করতে পারি? আলী মুইজী বলল।

ভাবছিল শরিফ হামাদ। বলল, আমি সেটাই ভাবছি আলী।

বলেই একটু থামল। আবার বলে উঠল, একজনের কথা মনে পড়ছে। আমাদের দারুস সালামের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের প্রধান ইমাম মদিনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন সৌদি-মুবাল্লেগ। খতিব সাহেব মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। একটা ঘটনায় তাদের সাথে। আমাদের পরিচয় হয়। আমি তাদেরকে ঘটনাটা জানাতে পারি।

জি মামা, তাই করুন। ওঁরা ঠিক জায়গায় জানাতে পারবেন। বলল আলী মুইজী।

সিতি ও আলী মুইজী দুজনেরই মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিল শরিফ হামাদ।

ঘরে ঢুকল সিতির মামী। পরনে ওড়না-কামিজ। মাথায় রুমাল বাঁধা। তার উপর দিয়ে চাদর।

সিতিরা ও তার মামারা জাঞ্জিবারের পুরানো ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবার। তাদের পরিবার আরব, ইরানী ও আফ্রিকার বা গোত্রের মিশ্র পরিবার। উল্লেখ্য, তানজানিয়া (আগের ট্যাঙ্গানিকা) উপকূলের জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জ পূর্ব আফ্রিকার ইসলামী সমাজ, সভ্যতা ও রাজনীতির বড় এবং সবচেয়ে পুরানো একটা কেন্দ্র। পর্তুগীজ, বৃটিশ ও জার্মান উপনিবেশিক সময়েও জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জ স্বায়ত্বশাসন ও অর্পিত স্ব-শাসনের মাধ্যমে হলেও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে। ১৯৬৪ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ট্যাঙ্গানিকা (আজকের তানজানিয়ার মূল ভূখণ্ড) জাঞ্জিবার দখল করে গণহত্যা চালায়। সর্বনিম্ন হিসেবেও সেখানে বিশ হাজার লোক নিহত হয়। সিতি ও তার মামাদের পরিবার অন্যান্য অনেকের সাথে পালাতে পেরেছিল। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপের ফলে মুসলিম পরিবারগুলো আবার জাঞ্জিবারে ফিরে আসে। কিন্তু আলাদা স্বাধীন অস্তিত্ব। আর থাকে না। জাঞ্জিবার দ্বীপপুঞ্জ ও ট্যাঙ্গানিকা মিলে তানজানিয়া নামে নতুন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে।

সিতির মামী ঘরে ঢুকেই বলল, নাস্তা রেডি। তোমরা এসো। নাস্তার জন্যে সকলেই উঠে দাঁড়াল।

.

কফিনটা এবার অনেকটা আছড়েই পড়ল। আহমদ মুসার দেহ কফিনের ভেতর বড় রকমের আঘাত খেল। বিমান চলার সময় আহমদ মুসার চোখে তন্দ্রার ভাব এসেছিল। বিমান ল্যান্ড করার সময় সে তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়। বিমান ল্যান্ড করল তা বুঝেছিল আহমদ মুসা। তার আনুমানিক দশ মিনিট পরেই শুরু হয় কফিন নিয়ে টানাহেঁচড়া। এই শেষ বার আছড়ে পড়ার আগে কয়েক বার কফিনটি উঠানো নামানো হয়েছে।

শেষ বার কফিনটা কোনো মেঝেতে পড়েছে তা বুঝল আহমদ মুসা। এটাই কি তার ডেস্টিনেশন, জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার মনের।

মেঝেতে পড়ার অল্প কিছুক্ষণ পরেই কফিনের বাইরে মানুষের তৎপরতা টের পেল আহমদ মুসা। একাধিক লোকের পায়ের শব্দ ও কথা-বার্তা সে শুনতে পেল। কথা-বার্তার শব্দ একটু পরেই কাছাকাছি এলো। তাদের কথা এবার বুঝতে পারছে আহমদ মুসা। কে একজন ভারি কণ্ঠে বলল, কাঁচি, স্কু ড্রাইভার পেয়েছ? তাহলে দেরি হচ্ছে কেন কফিন খুলতে?

বড় কর্তা আসবেন বললেন সেই জন্যে অপেক্ষা করছি স্যার। বলল আরেকজন কেউ।

আচ্ছা, স্যার আসবেন? উনি তো কিছুক্ষণ আগে সাউথ আফ্রিকা থেকে এলেন। উনি আমাকে বললেন, তোমরা কফিন খুলে ঠিকঠাক করো। আমি পরে যাব। বলল আগের সেই ভারি গলার লোকটি।

কিন্তু টুলস বক্সটা আনতে গেলে এইমাত্র তিনি আমাকে বললেন, বন্দিটা এতই মূল্যবান যে, প্রথমেই দেখার লোভটা সামলাতে পারছি না। তোমরা তৈরি হও আমি আসছি। বলল দ্বিতীয় লোকটি।

বাইরে কিছুক্ষণ চুপচাপ নীরবতা। এক সময় প্রথম ভারি গলার লোকটি বলল, ঐ যে স্যার এসে গেছেন। কাজ শুরু করে দাওনি, বসে আছ কেন? বলল ভারি গলায় একজন।

স্যার আমরা আপনার অপেক্ষা করছি। বলল প্রথম ভারি গলার লোকটি।

ঠিক আছে, কাজ শুরু করে দাও। দ্বিতীয় ভারি গলার লোকটি বলল।

এই দ্বিতীয় ভারি গলার লোকটিই ইভানজেলিকস ফর পাওয়ার (FEP) ফেপ-এর চেয়ারম্যান অসওয়াল্ড আলফ্রেড। FEP আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের একটা গোপন খ্রিস্টান সংগঠন। খ্রিস্ট ধর্মের শান্তিপূর্ণ প্রচার, প্রসারে এদের কোনো ভূমিকা নেই। এরা পশ্চিম আফ্রিকার আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট আফ্রিকা-AOCOWA (ওকুয়া) ও কিংডোম অব ক্রাইস্ট-KOC (কোক) এর মতো অর্থ লিলু একটা গোপন সংগঠন। ওকুয়া ও কোক থেকে একটাই পার্থক্য সেটা হলো, FEP ওকুয়া ও কোক-এর মতো ভূমি দখল ও অখ্রিস্টানদের উচ্ছেদের মতো গর্হিত কাজ করে না। অর্থ সংগ্রহ এবং খ্রিস্টানদের রাজনৈতিক ভাবে প্রমোট করাই মূল কাজ এদের।

এরা খ্রিস্টান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অর্থবলে বা শক্তিবলে দমন করে। আরেকটা বড় পার্থক্য আছে, সেটা হলো ওকুয়া, কোক এবং ব্ল্যাকক্রস সব ক্রিশ্চিয়ানদের পক্ষে কাজ করে আর ইভানজেলিকসরা শুধুই ইভানজেলিসদের জন্যে কাজ করে।

প্রথম ভারি কণ্ঠের লোকটি এই ইভানজেলিকস ফর পাওয়ার-এর হেড অব অপারেশন এরিক আমাজন।

ইভানজেলিকস ফর পাওয়ার- সংক্ষেপে বলা হয় FEP (ফেপ)। এই ফেপ-এর দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলের হেড কোয়ার্টার জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায়।

কফিনের ভ্রু খোলা এবং লোহার পাতের বাঁধন কাটা হয়ে গেলে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঢাকনা কি খুলব স্যার?

হ্যাঁ, ঢাকনা সরিয়ে ফেল। বলল অসওয়াল্ড আলফ্রেড, FEP (ফেপ) এর চেয়ারম্যান।

ফেপ-এর হেড অব অপারেশন এরিক আমাজন দ্রুত পকেট থেকে রিভলভার বের করে তাক করল কফিনের দিকে।

এ সময়ের মধ্যে আহমদ মুসার সংজ্ঞা ফিরেছে বলে কী মনে করো এরিক আমাজন? অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।

ফিরতে পারে স্যার, আবার নাও ফিরতে পারে। যদিও জানি, ক্লোরোফরমটি নতুন ধরনের। সাধারণভাবে সাত আট ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফেরার কথা নয়। কিন্তু সবার স্ট্যামিনার মাত্রা এক রকম নয়। কেউ সময়ের আগে জ্ঞান ফিরে পেতে পারে। বলল এরিক আমাজন।

বন্দির হাত-পা খোলা অবস্থায় আছে? অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।

বেঁধে রাখার কথাই বলেছিলাম। বিমানে আনা হচ্ছে তো! হঠাৎ কোনোভাবে যদি জ্ঞান ফিরে পেয়ে যায়, তাহলে কোনো সুযোগ বুঝে কফিনের ভেতরে থেকেও শব্দ সৃষ্টি করে অনর্থ ঘটাতে পারে। বলল এরিক আমাজন।

ঠিক করেছ। বিমানটা তো আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। সুতরাং সাবধান থাকা ঠিক হয়েছে। অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।

একজন কফিনের ঢাকনা খুলে ফেলল। উপস্থিত তিনজনেরই চোখ গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।

মনে হচ্ছে এখনো সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে। বলল অসওয়াল্ড আলফ্রেড।

এরিক আমাজন উঠে গিয়ে আহমদ মুসার নাকে আঙুল দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করল এবং হ্যান্ডকাফ লাগানো দুই হাত কিছুটা উপরে তুলে ছেড়ে দিল। আছড়ে পড়ল হাত দুটি।

এরিক আমাজন অসওয়াল্ড আলফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বলল, এ এখনো সংজ্ঞাহীন স্যার। একজন নিদ্রিত ও চেতনাসম্পন্ন লোকের দেহ ও শ্বাস প্রশ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ যেমন হয়, এমন অবস্থা তার নয়।

ঠিক আছে, ওকে বন্দিখানায় ঢোকাও। বলল অসওয়াল্ড আলফ্রেড।

কিছুটা দূরে অ্যাটেনশন অবস্থায় স্টেনগান হাতে ডজনখানেক প্রহরী দাঁড়িয়েছিল। তাদের পরনে হালকা বাদামি রঙের ইউনিফরম। বুকে বড় ধরনের ক্রস আঁকা। ক্রসের নিচে ইভানজেলিস্ট শব্দ লেখা।

অসওয়াল্ড আলফ্রেড ডাকলে তাদের কয়েকজন ছুটে এলো এবং আহমদ মুসাকে কফিন থেকে বের করে সামনেই বন্দিখানায় ঢুকালো।

বন্দিখানা হলো সারিবদ্ধ কিছু ঘর।

ঘরগুলোর তিনদিকে দেয়াল। সামনেটা খোলা। কক্ষের খোলা মুখটা বন্ধ করা হয়েছে মোটা স্টিলের মজবুত গ্রিল দ্বারা। মাঝখানে গ্রিলেরই একটা দরজা। কক্ষে আরেকজন বন্দি ছিল। ঘুমিয়ে ছিল সে। শব্দ ও কথাবার্তা শুনে সে উঠে বসেছিল।

স্যার, এ তো মূল্যবান ও বিপজ্জনক বন্দি। এর একার জন্যে একটা ঘর হলে ভালো হতো না? বলল এরিক আমাজন।

জানো তো তুমি, কোনো ঘর খালি নেই। অসওয়াল্ড আলফ্রেড বলল।

মাকা ইয়াওকে অন্য ঘরে সরিয়ে নিলে হতো না? বলল এরিক আমাজন।

আহমদ মুসাকে রাখা বন্দিখানার দিকে একবার তাকিয়ে একটু নিচু গলায় এরিক আমাজনকে বলল, আহমদ মুসা খুবই মূল্যবান বন্দি, মাকা ইয়াও মূল্যহীন নয়। ওদের পরিবারের কোনো এক স্থানে গুপ্তধন আছে। যেখানে সোনা আছে কয়েক টন। আমরা ঐ গুপ্তধন চাই।

মাফ করবেন স্যার, আমরা আলেয়ার পেছনে ছুটছি না তো? জিজ্ঞাসাবাদে মাকা ইয়াও বার বার বলছে গুপ্তধন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। তার দাদাকেও সে দেখেছে। তার বাবা, দাদার কাছ থেকেও সে কিছুই শোনেনি। আর সে বলছে গুপ্তধন থাকার মতো পরিবারও তারা নয়। আর দশটা পরিবারের মতোই সাধারণ তাদের পরিবার। বলল এরিক আমাজন।

পরিবার সম্পর্কে এই কথা সে ঠিক বলেছে। তার পরিবারের মূল পরিচয় সে এবং তার পরিবার হারিয়ে ফেলেছে, আমরা সেটা জানি। আমরা এটা। জানতে পেরেছি গির্জার সংগৃহীত ও সংরক্ষিত পূর্ব আফ্রিকার পারিবারিক গোপন ইতিহাস থেকে। এটা নিশ্চিত যে, গুপ্তধনের মালিক পরিবারগুলো উত্তরাধিকারীদের জন্যে সংকেত বা ধাঁধা সংকেত রেখে যায় যা বংশানুক্রমে সংরক্ষিত থাকে। আমি নিশ্চিত, তারা সব পরিচয় হারিয়ে ফেললেও এই সংকেত তাদের কাছে আছে। গুপ্তধনের কথা তারা না জানতে পারে, পারিবারিক কোনো আমানতের কথা তারা নিশ্চয় জানে। সেই আমানতের মধ্যেই গুপ্তধনের সেই সংকেত পাওয়া যাবে। ইন্টোরোগেট করার সময় এ বিষয়টা সামনে রাখবে। তাকে পরিষ্কার বলে দেবে, হয় সে তাদের পরিবারের সেই আমানত আমাদের দেবে, নয় তো জীবন দেবে। আর সে জীবন দেয়া হবে খুব কষ্টের। তার কিছু নমুনা তাকে দেখাবে। সোজা আঙুলে কখনো ঘি উঠে না। থামল অসওয়াল্ড আলফ্রেড। এ এরিক আমাজন হাসল একটু। ক্রুর হাসি। হাসিতে শিকার ছিঁড়ে খাওয়ার আনন্দ। বলল, ইয়েস স্যার।

এরিক আমাজন তাকাল আহমদ মুসার কক্ষের দিকে। দৃষ্টি ফিরে এলো তার বস অসওয়াল্ড আলফ্রেডের দিকে। বলল, স্যার আহমদ মুসাকে কি জাগানোর চেষ্টা করব, সন্ধ্যা তো হয়ে আসছে?

না জাগানোর দরকার নেই। ঐ ক্লোরোফরমের অ্যাকশন রাত নয়টা, দশটার বেশি হবে না। আপনাতেই জাগুক। আমাদের তাড়া নেই। ওকুয়া, কোকরা এখনো তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা আমাদের জানায়নি।

একটু থেমেই অসওয়াল্ড আবার বলে উঠল, বন্দিকে কি সার্চ করেছ? না করা হয়নি। তবে ভালোভাবে সার্চ করেই তাকে কফিনে তোেলা হয়েছে। তবু সার্চ একবার করাই দরকার স্যার। এরিক আমাজন বলল।

হ্যাঁ, করো। আমাদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। বলল অসওয়াল্ড আলফ্রেড।

আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ ও বেড়ি কি পরানোই থাকবে স্যার? জিজ্ঞাসা এরিক আমাজনের।

আমার মনে হয়, দরকার নেই। কিন্তু যখন পরানো আছে, তখন পরানোই থাক। সাবধান থাকা ভালো। বলল অসওয়াল্ড আলফ্রেড।

তাই হবে স্যার। এরিক আমাজন বলল। উঠে দাঁড়াল অসওয়াল্ড আলফ্রেড। এরিক আমাজনও উঠল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু সে অন্ধকার বন্দীখানায় প্রবেশ করতে পারেনি।

আহমদ মুসার পা দরজার দিকে।

আগের বন্দি ছেলেটি মাকা ইয়াও, বসে আছে আহমদ মুসার মাথার পেছনে।

আহমদ মুসা চোখ খুলল।

ঘরে আলো নেই, বারান্দায় আলো। সেই আলো ঘরকেও আলোকিত করেছে। তবে সে আলোটা খুব উজ্জ্বল নয়, ঘরে থাকলে যেমনটা হতো। বরান্দার পরেই উঁচু দেয়াল, ব্লকের বাউন্ডারি ওয়াল হবে নিশ্চয়।

দরজায় কোনো প্রহরী নেই। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আহমদ মুসা। বারান্দা বা করিডোর দিয়ে প্রহরী বা কাউকে আসা-যাওয়া করতে দেখল না।

মাথা ঘুরিয়ে মাথার পেছন দিকে তাকাল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা ঘুরতেই মাকা ইয়াও সরে এলো আহমদ মুসার পাশে। বলল, ভালো হয়েছে, আপনার সংজ্ঞা ফিরেছে।

তুমি খুশি হয়েছ? বলল আহমদ মুসা।

খুশি হবো না স্যার, আপনিও আমার মতো বন্দি। মাকা ইয়াও বলল। বন্দি মাকা ইয়াও, কথা বলছিল সোহাইলি ভাষায়।

মাকা ইয়াও তুমি কত দিন থেকে বন্দি এখানে? বলল আহমদ মুসা।

পনেরো দিন হলো স্যার। মাকা ইয়াও বলল।

দরজায় তো প্রহরী দেখছি না? বলল আহমদ মুসা।

দরজায় প্রহরী নেই স্যার, এই ব্লকের একটা গেট আছে, সেই গেটে প্রহরী থাকে। মাকা ইয়াও বলল।

কয়জন থাকে?

না স্যার, কোনো নিয়ম নেই। প্রায়ই দুজন প্রহরী থাকে। মাকা ইয়াও বলল।

তোমার বয়স তো বিশ-বাইশ হবে, তুমি কি ছাত্র? বলল আহমদ মুসা।

ছাত্র ছিলাম দুবছর আগে। আমার বাবা ও বড় ভাই এক সাথেই মারা যায়। তারপর আমাকে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছে সংসার দেখাশোনার জন্যে। মাকা ইয়াও বলল।

তোমার সংসারের এখন অবস্থা কি? বলল আহমদ মুসা।

আমাদের কিছু জমিজমা আছে, ছোট-খাটো ব্যবসাও আছে। আমার বোন ও ভাবিরা ওসব দেখা-শোনা করছে নিশ্চয়। মাকা ইয়াও বলল। তার মুখটা বিষণ্ণ ও চোখ ভারী হয়ে উঠেছিল।

তোমার অপরাধ কি? তোমাকে এরা ধরে এনেছে কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

সংগে সংগে কথা বলল না মাকা ইয়াও। মুখ নিচু করল। একটু পর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, স্যার, এরা যা বলে আমি তা বুঝি না, আমি কিছু জানিও না।

কি বলে এরা? বলল আহমদ মুসা।

গুপ্তধনের সন্ধান চায়। আমাদের নাকি গুপ্তধন আছে। তারা জানতে চায় এটা কোথায় আছে। মাকা ইয়াও বলল।

তোমাদের কাছে গুপ্তধন আছে, এ কথা বলে কেন তারা? তোমাদের এলাকার অন্য কাউকে নিশ্চয় বলে না? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

না স্যার, অন্য কাউকে বলে না। মাকা ইয়াও বলল।

তোমাদেরকে বলার তাহলে কারণ কি? বলল আহমদ মুসা।

আমি জানি না স্যার। ওরা বলে, আমাদের পূর্ব-পুরুষের বিশাল ধন ভাণ্ডার নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি। মাকা ইয়াও বলল।

তোমার বাবা-মা, দাদা-দাদীদের কাছে কিছু শোননি? বলল আহমদ মুসা।

কারো কাছেই কিছু শুনিনি। আমার দাদী এখনো বেঁচে আছেন। একশ বছরের বেশি বয়স। তিনিও কখনো কিছু বলেননি। মাকা ইয়াও বলল।

তুমি কিছু জান না, কিছু শোনওনি এ কথা বললে এরা কি বলে? বলল আহমদ মুসা।

বিশ্বাস করে না স্যার। আমাকে এ নিয়ে অনেক নির্যাতন করেছে। অবশেষে তিন দিনের সময় দিয়ে বলেছে, মুখ না খুললে তিন দিনের শেষ দিনে হত্যা করবে আমাকে। তারপর আমার বাড়িতে গিয়ে কারো কাছে গুপ্তধনের সন্ধান না পেলে পরিবারের সবাইকে হত্যা করবে এবং বাড়ি-ঘর ভেঙে জমি খুঁড়ে তারা দেখবে।

মাকা ইয়াও একটু দম নিল। বলল আবার, স্যার, আজকের রাতই শেষ রাত আমার জন্যে। এরা স্যার ভয়ানক খুনি। এরা কাউকে ধরে আনলে সে আর বাঁচে না। আমাকেও মেরে ফেলবে আমি জানি। স্যার, আমার পরিবারকে এরা ধ্বংস করে ফেলবে- সেটাই আমি সহ্য করতে পারছি না। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মাকা ইয়াও।

ধৈর্য ধরো মাকা। যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাকে তাঁর উপর ভরসা করো।

কথা শেষ করেই একটু থেমে মাকাকে বলল, আচ্ছা, তোমাদের এমন কি কোনো পূর্বপুরুষ ছিলেন যিনি কোনো ধনভাণ্ডার রেখে যেতে পারেন? বলল আহমদ মুসা।

আমার জানা নেই স্যার। আমি এদের বলেছিলাম, গুপ্তধন আমরা কোত্থেকে পাব, কে রেখে যাবে আমাদের জন্যে গুপ্তধন? ওদের একজন আমার কথার জবাবে কি একটা নাম বলতে যাচ্ছিল। তার মুখ থেকে ম শব্দ বেরুতেই হেড যিনি তিনি ধমকে উঠে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, পর্বত প্রমাণ তথ্য ঘেঁটে যাকে দিনের আলোতে বের করে এনেছি, তার সাথে এদের আত্মীয়তা করে দেবার জন্যে নয়। এ পর্যন্তই স্যার।

চিন্তার ছায়া নামল আহমদ মুসার মুখে। বলল, তাহলে তো মাকা, কেউ একজন আছে।

একটু চিন্তা করল আহমদ মুসা। বলল, মাকা তোমার পুরো নাম, কি?

মাকা ইউহান্না বারনাবা ইয়াও। মাকা ইয়াও বলল।

মাকা তোমার নামতো সাধারণের নাম নয়। জাম্বিয়া, মোজাম্বিক, জিম্বাবুই, মালাবী, তানজানিয়া অঞ্চলের আফ্রিকীয় নাম, বিশেষ করে ইয়াও গোত্রের সাধারণ নাম এটা নয়। তুমি নিশ্চয় ইয়াও গোত্রের? তোমার নামের ইয়াও অংশ নিশ্চয় গোত্রীয় পরিচয়-জ্ঞাপক? বলল আহমদ মুসা।

হ্যাঁ স্যার, আমরা ইয়াও গোত্রের। আমার নাম আমার দাদা রেখেছেন। মাকা ইয়াও বলল।

তোমার বাবা, দাদাদের নাম কি এমন? কি নাম তোমার বাবার? বলল আহমদ মুসা।

মাকা অ্যাডোফো বাই বুরেহ। মাকা বলল।

আহমদ মুসার ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল। কিছুটা বিস্ময় চোখে-মুখে। বলল, তোমার দাদার নাম?

আমার দাদার নাম মাকা ডান ফোদিও ফাতি। মাকা বলল।

আহমদ মুসার চোখে এবার বিস্ময় নয় আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তোমরা কি মুসলমান?

মাকা বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, না স্যার, আমরা খ্রিস্টান।

কিন্তু তোমার, তোমার বাপ-দাদার নাম তো মুসলিম। বলল আহমদ মুসা।

মাকার চোখে বিস্ময় আরো গম্ভীর হলো। বলল, কেন, কীভাবে স্যার। আমাদের গোত্রের অধিকাংশের এ ধরনেরই নাম।

তোমার দাদার নামের শেষ শব্দ আরবি ফাতিহ শব্দের অপভ্রংশ। তোমার বাবার নামের শেষ দুই শব্দ বাই বুরেহ তোমাদের গোত্রের মূল ভাষা চিয়াও-এর কোনো শব্দ নয়। এটা অনেকটাই আরবি, ফারসি শব্দের কিছুটা বিকৃত রূপ। তোমার নামের ইউহান্না বারনাবা চিয়াও শব্দ নয়, এটা তানজানিয়া অঞ্চলের একজন মুসলিম ঐতিহাসিকের নামের অংশ। সেই ঐতিহাসিক ও লেখকের নাম ছিল ইউহান্না বারনাবা আব্দুল্লাহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তোমাদের প্রত্যেকের নামের প্রথম শব্দ মাকা তোমাদের ধর্মীয় ও বংশীয় পরিচয়ের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাকা শব্দটি মুসলমানদের কেবলা যেখানে, সেই মক্কা শহরের মক্কা নামের অপভ্রংশ। জাম্বিয়া, মোজাম্বিক, মালাবী অঞ্চলে মুসলমানদেরকে মাকা নামে ডাকা হতো, বা পরিচয় করানো হতো। থামল আহমদ মুসা।

বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে মাকার মুখ। বলল বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে, তাহলে আমার নামের মাকা আসলে মক্কা?

অবশ্যই মাকা। বলল আহমদ মুসা।

তার মানে আমি, আমার বাবা, দাদা সবাই মুসলমান? মাকা বলল।

সেটাই তো দেখা যাচ্ছে মাকা। বলল আহমদ মুসা।

রাজ্যের বিস্ময় এসে ঘিরে ধরল মাকাকে। সে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। বোবার মতো চেয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।

তুমি বিস্মিত হয়েছ মাকা, আমিও বিস্মিত হয়েছি এত দূরে তোমাকে এভাবে পেয়ে। আমি তো জানি, মালাবী, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, এমনকি জিম্বাবুই অঞ্চলের ইয়াও গোত্রের অনেকেই জানে, ইয়াও গোত্র মুসলমানদের বন্ধু ও মিত্র। তাদের পূর্বপুরুষ মুসলমান ছিল এটাও তারা জানে। অনেকে নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তোমরা দেখছি তোমাদের

অতীত সম্পর্কে কিছুই জানো না। বলল আহমদ মুসা।

আমি আমার বাপ-দাদাদের কাছ থেকে কিছুই শুনিনি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে স্যার। তখন আমি অনেক ছোট। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। আমাদের অঞ্চলের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লোয়াংগ নদীতে একটা নৌকা ডুবি হয়েছিল রাতের বেলায়। বেঁচে যাওয়া একটা পরিবার তীরে উঠেছিল। আমার বাবা দাদারা সেখানে গিয়েছিল। আশ-পাশের অনেক লোক জমা হয়েছিল। তাদের অনেকে বলেছিল, নদী যাদের গ্রাস করে, তাদের কেউ বেঁচে গেলে তারা হয় নদী পাড়ের মানুষের সম্পত্তি, এটাই এখানকার নিয়ম। আমার দাদা পরিবারটির সাথে কথা বলে তাদের পরিচয় জেনেছিল তারা মুসলমান। তখন দাদা সবাইকে বলেছিল, মুসলমানরা আমাদের ইয়াও গোত্রের মিত্র। তারা আমরা এক। এরা আমাদের মেহমান। এদেরকে নিজের ঠিকানায় পৌঁছানোও আমাদের দায়িত্ব। সবাই এটা মেনে নিয়েছিল। এই একটা ছোট স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই শুনিনি, জানিনি মুসলমানদের সম্পর্কে। অন্যদিকে স্কুল-কলেজে শুধু মাত্র ট্রাইবাল হিস্ট্রি পড়ানো হয়, সেখানে ধর্মীয় পরিচয় থাকে না। আর যে উন্নয়নের ইতিহাস পড়ানো হয়, তাতে পশ্চিমী খ্রিস্টান দেশগুলো এদেশে কি করেছে, খ্রিস্টান মিশনারীরা কোথায় কোন্ স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও সমাজসেবার কাজ করেছে, তার বিবরণ তুলে ধরা হয়। সুতরাং অতীতের সবকিছু সম্পর্কে জানার আমাদের সুযোগ নেই স্যার।

থামল মাকা ইয়াও। কিন্তু সুংগে সংগেই আবার বলে উঠল, স্যার আমাদের সাথে মাকা-এর ধর্মীয় সম্পর্কের কথা বললেন, কিন্তু মাকা-এর সাথে বংশীয় সম্পর্কের কথা বলেননি।

ধন্যবাদ মাকা ইয়াও। তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কতদূর পর্যন্ত পড়েছ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

ইলেভেন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি স্যার। তারপর আর পড়া হয়নি। মাকা বলল।

দুনিয়াকে বোঝা ও জীবন চালানোর মতো পড়া হয়ে গেছে তোমার। এখন লেখাপড়া নিজেই এগিয়ে নিতে পারবে।

আহমদ মুসা একটু থামল। আবার শুরু করল, তোমাদের পরিচয় যদি মুসলিম হয়, তাহলে মাকা শব্দের সাথে তোমাদের একটা বংশীয় সম্পর্ক আছে। আমার মনে হয়, তোমাদের এক পূর্বপুরুষ মাকাও নিয়াসাল্যান্ড অঞ্চলের একজন সুলতান বা রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান। মুসলমান। নিয়াসাল্যান্ডে তিনি একটি মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লেক নিয়াসা, লেক ট্যাঙ্গানিকা অঞ্চল ছাড়াও জাম্বেসি নদী-অববাহিকায় হাজার হাজার মক্তব-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সুলতান তার গোটা জীবনব্যাপী পশ্চিমী উপনিবেশ ও তাদের দাস ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সেই সুলতান মাকাও-এর নিশ্চয় তোমরা বংশধর। তোমাদের নামের আগে মাকা শব্দের ব্যবহার এ কারণেও হতে পারে। তোমরা সুলতান মাকাও-এর বংশধর বলেই হয়তো তোমাদের কাছে সুলতান মাকাও-এর গুপ্তধন থাকার কথা উঠেছে।

স্যার, সব কথাই আমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। মাকা বলল।

স্বপ্ন নয়, এটা বাস্তবতা। নৌকাডুবি ও তোমার দাদার যে কথা বললে সেটাও প্রমাণ করে তোমরা মুসলমান ছিলে। তোমাদের নামের আগে মাকা শব্দ এবং তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্বপুরুষের বিষয়টিও ইংগিত করে সুলতান মাকাও-এর বংশধর তোমরা। গুপ্তধন হাত করার জন্যে তোমাকে যারা ধরে এনেছে তারাও অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছে তোমরা সুলতান মাকাও-এর প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। বলল আহমদ মুসা।

কিন্তু গুপ্তধন কোথায় স্যার? আমরা তো কিছুই জানি না। মাকা বলল।

তোমাদের পরিচয় যেমন তোমরা হারিয়ে ফেলেছ, তেমনি সেই গুপ্তধনও অজানার অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।

যা হারিয়ে গেছে, যার অস্তিত্ব আমাদের অজানা, তার জন্যেই আজ আমাকে জীবন দিতে হচ্ছে, আমরা আজ ধ্বংসের মুখে। আমরা যে মুসলমান ছিলাম, আমরা মুসলিম ঐতিহ্য এখনো লালন করছি, এ কথাটা আমি জানলাম, কিন্তু আমার পরিবারের হয়তো আর জানা হলো না। মাকা বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে।

আহমদ মুসা উঠে বসল। হ্যান্ডকাফ লাগানো হাত তুলে মাকার কাঁধে রেখে সান্ত্বনার স্বরে বলল, আল্লাহর উপর ভরসা রাখ মাকা। তাঁর সিদ্ধান্ত ছাড়া কারো মৃত্যু হয় না। কেউ কাউকে ইচ্ছা করলেই মারতে পারে না।

একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে কখন আসে মাকা?

আটটায় ওরা খেতে দেয়। খেতে দেয়ার আগেই আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে এই কয়দিন।

সন্ধ্যার পর আধাঘণ্টা গেছে। তার মানে আটটা বাজতে এখনো দেড়ঘণ্টা। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো এই কথা বলে আহমদ মুসা তাকাল। মাকার দিকে। বলল, তুমি দরজার গ্রিল ঘেষে দাঁড়াও। প্রহরীর দিকে চোখ রাখ। এদিকে আসতে দেখলে একটা শব্দ করবে।

মাকা একটু বিস্মিত হলো। বলল, স্যার, এমন কি করবেন যে তার জন্যে গোপনীয়তা দরকার!

মাকা উঠে গেল গ্রিলের দরজায়।

ব্লকের দরজা যেখানে প্রহরীরা থাকে, সেদিকেসহ দরজার দুপাশেই সে চোখ রাখল। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে সে আহমদ মুসার দিকে। সে দেখল, আহমদ মুসা তার জুতার তলা থেকে কি যেন বের করল। সেটা দিয়ে হ্যান্ডকাফের লকে কি যেন করল। হ্যান্ডকাফের লক খুলে গেল। তারপর একইভাবে পায়ের শিকলের লকও খুলে ফেলল। ভয়ে বিস্ময়ে চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠল মাকার। প্রহরী এবং ওরা যদি জেনে ফেলে মহাকাণ্ড ঘটে যাবে।

আহমদ মুসা হাতের হ্যান্ডকাফ ও পায়ের বেড়ি খুলে ফেলে আবার পরে নিল, কিন্তু লক আর হলো না। তারপর মাকাকে সরে আসতে বলল।

মাকা সরে এসে বলল, স্যার, কি করে খুললেন, ওটা তো চাবি নয়? এখন ওরা দেখে ফেললে কি হবে? মাকার কণ্ঠে উদ্বেগ।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ভয় করো না মাকা। ভয় করলে ভয় বাড়বে। শোন, আমি এখন আগের মতো সংজ্ঞাহীন লোকের মতো শুয়ে পড়ছি। ওরা এসে বুঝবে আমার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। ওরা নিশ্চয় কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। তুমি গুপ্তধন সম্পর্কে আগে যা বলেছ, সেই কথাই বলবে। শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা।

স্যার, আমার জীবন যাবে আমার দুঃখ নেই। একটা বিষয় ভেবে আমার দুঃখ হচ্ছে। আপনার কাছ থেকে জানলাম, আমার পূর্বপুরুষরা মুসলমান ছিল। একজন মুসলিম সুলতানের আমরা বংশধর। আপনার কাছ থেকে

এটা জানতে পারলাম এমন সময়ে যখন আমার আর মুসলমান হওয়ার সুযোগ নেই। আর এটা আমার পরিবারকেও জানাতে পারলাম না স্যার। মাকা বলল। তার কণ্ঠ ভারি।

আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে থেকেই বলল, মাকা, তোমার পূর্বপুরুষের মুসলমান পরিচয়ে তুমি খুশি হয়েছ? মুসলমানদের তোমার কেমন লাগে?

খুশি হয়েছি স্যার। বাবা, দাদার সাথে একবার আমি জাঞ্জিবার গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর দেশ, মানুষদের ব্যবহারও ভালো। দেখেছিলাম ওখানকার মেয়েরা মাথা, গা ঢেকে রাখে। দাদা বলেছিলেন, জাঞ্জিবারের সব মানুষ মুসলমান। এদের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য করায় আরাম আছে। এরা সাধারণত মিথ্যা কথা বলে না। কয়েকটা প্রার্থনার ঘর দেখেছিলাম মুসলমানদের। সবাই মিলে এক সাথে প্রার্থনা করে। আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি আমাদের লুসাকাতেও মসজিদ দেখেছি, মুসলমানদেরও দেখেছি। অন্যদের চেয়ে ওরা একটু ভিন্ন। যেমন ওরা ভদ্র তেমনি স্পষ্টভাষী। লোকেরা বলে মুসলমানরা সৎ এবং যা বলে সেই অনুসারেই কাজ করে।

মাকা একটু থামল। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, স্যার, আপনি কি মুসলমান?

তোমার কি মনে হয়? বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।

মুসলমান মনে হয় স্যার। মাকা বলল।

কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

এদিকের মুসলমানদের সম্পর্কে এত কথা আপনি জানেন। তাছাড়া আপনার কথা-বার্তায় খুব দরদ আছে স্যার।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, হ্যাঁ আমি মুসলিম মাকা।

আপনাকে কেন ধরেছে স্যার? এইভাবে হাত-পায়ে বেড়ি লাগিয়ে কফিনে করে কেন এনেছে? মাকা বলল।

আমি ঠিক জানি না মাকা আমাকে কেন ধরেছে? ওদের সাথে এখনো কথা হয়নি আমার। বলল আহমদ মুসা।

কথা শেষ করেই আহমদ মুসা একটু থেমে আবার বলে উঠল, মাকা,

এখান থেকে বের হবার সুযোগ পেলে তুমি কি করবে?

সংগে সংগে কথা বলল না মাকা। একটু সময় নিয়ে বলল, বের হবার সুযোগ কি করে পাব স্যার। আর এরা যাদেরকে ধরে, তারা আর কখনো ফিরতে পারে না স্যার।

ধরো যদি সুযোগ পাও? বলল আহমদ মুসা।

বের হবো স্যার। কিন্তু বের হলেও ওরা বাঁচতে দেবে না, বাঁচতে কাউকে দেয় না। মাকা বলল শুকনো কণ্ঠে।

মাকা, ওদের সর্বশক্তিমান মনে করো না। সর্বশক্তিমান একমাত্র আল্লাহ। প্রতিটি মুসলমানকে এটা বিশ্বাস করতে হয়। বলল আহমদ মুসা।

মুসলমানিত্বের আমি কিছুই জানি না। আপনি বলেছেন আমি মুসলমান। আমি এখন এটা বিশ্বাস করেছি। মাকা বলল।

ধন্যবাদ মাকা। বিপদ-আপদে হতাশ হতে নেই। বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টা করতে হয়। যে চেষ্টা করে, তাকে আল্লাহ সাহায্য করেন। বলল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ স্যার, আপনার কথা শুনে আমি সাহস পাচ্ছি। আল্লাহর সাহায্য এভাবে আসে? মাকা বলল।

অবশ্যই। বলল আহমদ মুসা।

স্যার, আমার এই অবস্থায় বাঁচার জন্যে আমি কি চেষ্টা করতে পারি? মাকা বলল।

আল্লাহ সুযোগ করে দিতে পারেন। বলল আহমদ মুসা। মাকা কিছু বলতে যাচ্ছিল এই সময় করিডোরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। আহমদ মুসা দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে মাকাকে ইশারা করল কথা না বলতে। আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীনের মতো পূর্ব অবস্থানে ফিরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *