লেক ট্যাঙ্গানিকার তীরে – ৫

অনেক অশ্রু মাড়িয়ে আহমদ মুসা মাকাদের বাড়ি থেকে বের হলো। বিদায় কেউ দেয়নি, বিদায় নিয়েছে আহমদ মুসা।

দাদীর চোখে ছিল নীরব অশ্রুর বন্যা। শেষ দিকে সে কথাই বলতে পারেনি। আর মাকার মা ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। বলেছিল, বাবা আমি তোমাকে আমার হারানো বড় ছেলে মনে করেছিলাম। বড় ছেলেরই কাজ তুমি করেছ। আমাদের রাজা বানিয়ে দিয়েছ। তোমাকে ছাড়ব কেমন করে বাবা।

মাকে সান্ত্বনা দিয়ে সাবেরা, সুরাইয়া বলেছিল, তবু তাকে ছাড়তে হবে মা। মাটির প্রদীপ কি সূর্যকে ধারণ করতে পারে? উনি আমাদের হবেন কি করে, উনি যে সবার।

বলতে গিয়ে সাবেরা সুরাইয়ার দুচোখেও অশ্রুর বান ডেকেছিল।

 শেষ মুহূর্তে অরুদ্ধ কণ্ঠে দাদী বলেছিল, তুমি কি চিরদিনের জন্যে আড়ালে চলে যাবে ভাই? এ মাটিতে তোমার পা আবার পড়বে এমন আশাও কি করতে পারব না?

আহমদ মুসার দুই চোখও ভিজে উঠেছিল। সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, দাদী, আমি, আপনি সবার মালিক আল্লাহ। আমাদের জীবন স্রোত তাঁরই একক নিয়ন্ত্রণে। তার ইচ্ছা ছাড়া আমাদের কোনো ইচ্ছা নেই। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই দাদী। ভবিষ্যৎ আল্লাহই শুধু জানেন।

ঘুরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা আবার পা চালিয়েছিল সামনে। বাড়ির বাইরের উঠানে দাঁড়িয়েছিল গাড়ি। গাড়ির পাশে আহমদ মুসার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাকা।

গাড়িটা আহমদ মুসাকে গিফট করেছে মাকা।

সুলতান মাকানজিলার ধনভাণ্ডার উদ্ধার হয়েছে ইয়াও পর্বত থেকে। কিন্তু আহমদ মুসা সে ধনভাণ্ডার থেকে কিছুই নিতে রাজি হয়নি। শেষে মাকা তাদের সংসারের টাকা দিয়ে গাড়িটা কিনে দিয়েছে। সবার অনুরোধে এই গাড়িটা নিতে রাজি হয় আহমদ মুসা।

তিন দিন আগে ইয়াও পর্বত থেকে ধনভাণ্ডার উদ্ধার করে আনা হয় এ বাড়িতে।

ধনভাণ্ডার উদ্ধারে বড় কোনো ঝামেলা হয়নি।

 গ্রানাইট পাথরের সংকেতের সবগুলোই ছিল আরবি ভাষায়। সুতরাং খুব সহজেই ধনভাণ্ডারে পৌঁছে যায় তারা। অতি বিশ্বস্ত কিছু লোককেই শামিল করা হয়েছিল ধনভাণ্ডার উদ্ধারে।

সুলতান মাকানজিলার ধনভাণ্ডারের সন্ধান লাভ সহজেই হয়েছিল। কিন্তু পরিবহন করা ছিল দীর্ঘ পথের কষ্টকর সফর।

একটা বড় সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল, পনেরোটি পিতলের সিন্দুকে রাখা ছিল সুলতান মাকানজিলার

  ধনরাশি। পিতলের সিন্দুকগুলো লোহার সিন্ধুকের তুলনায় অনেক হালকা। পরিবহনের জন্যে সুবিধাজনক ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল সিন্দুকে।

পরিবহনের জন্যে কাভার্ড ভ্যান সংগ্রহ করা হয়েছিল।

ইয়াও পর্বতে নেয়ার মতো কোনো রাস্তা না থাকায় ইয়াও পর্বতের গা ঘেঁষে প্রবাহিত লুগেন নদী পশ্চিমের যেখানে মালাংগা-মেলানদে আঞ্চলিক সড়ককে স্পর্শ করেছে তার আশেপাশে রাখা হয়েছিল কাভার্ড ভ্যানগুলোকে। ছোট ফোল্ডিং ক্রেন আনা হয়েছিল কাভার্ড ভ্যানে। বড় ইঞ্জিন বোট ব্যবহার করা হয়েছিল ইয়াও পর্বতে যাওয়ার জন্যে। লোহার জালে বেঁধে পনেরটি সিন্দুক পাহাড় থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল বোটে।

ধনভাণ্ডার নিয়ে বোটটি ভোর রাতের মধ্যেই পৌঁছেছিল মেলানদে শহরের কাছাকাছি আঞ্চলিক সড়কটিতে।

রাতের অন্ধকার কিছুটা থাকতেই পনেরোটি সিন্দুক তিনটি ভ্যানে। ভোলার কাজ শেষ হয়েছিল।

ফজরের নামাজ পড়ে আহমদ মুসারা কাভার্ড ভ্যান নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। তারা উত্তর মোজাম্বিক থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জাম্বিয়ার লোয়াংগো নদী তীরের চিসোমো গ্রামে পৌঁছেছিল। এই গোটা পথে তারা হাইওয়ে বা বড় সড়ক এড়িয়ে আঞ্চলিক সড়ক ব্যবহার করেছিল। এ কারণে তাদেরকে একশ মাইলের জায়গায় তিনশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। উত্তর মোজাম্বিক থেকে দক্ষিণ মালাবীর তিন সীমান্ত ঘুরে তারা জাম্বিয়ায় প্রবেশ করেছিল। তাদের কষ্ট হলেও পথ ছিল নিরাপদ। নিরাপদে তারা সমগ্র ধনভাণ্ডার বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছিল।

আফ্রিকার একটি ট্রাইবাল রাজ্যের শাসক হিসেবে সুলতান মাকানজিলার ধনভাণ্ডার অনেক বড় ছিল বলা যায়। পনেরোটি বড় সিন্দুকের দশটি সিন্দুক স্বর্ণমুদ্রায় ভরা ছিল। অবশিষ্ট পাঁচটি সিন্দুকে ছিল সোনা ও হীরা-জহরতের অলংকারে ঠাসা।

এই বিশাল ধনভাণ্ডার আহমদ মুসার অছিলাতেই মাকার পরিবার পেয়েছে, আল্লাহ আহমদ মুসার মাধ্যমেই এই ধনরাশি মাকার পরিবারকে দিয়েছেন- এই যুক্তি তুলে ধনরাশির একটা অংশ আহমদ মুসাকে নিতে তারা অনুরোধ করেছিল। উত্তরে আহমদ মুসা বলেছিল, এমন বড় অংকের টাকা-পয়সা রাখার জায়গা তার নেই, আর কোনো প্রয়োজনও নেই তার টাকার।

গাড়িতে ওঠার আগে আহমদ মুসা যখন মাকার হাত থেকে হ্যান্ডব্যাগটা নিল তখন কান্নারোধ করতে পারল না মাকা। ভেঙে পড়ল সে কান্নায়।

আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে বলল, মাকা তোমার অন্ততঃ এভাবে কান্না করা চলে না। তোমার অনেক দায়িত্ব, তোমাকে শক্ত হতে হবে। মনে রেখ, যে সম্পদ তুমি, তোমরা পেলে তা মহান আল্লাহর অশেষ রহমত। তুমি, তোমরা, আমরা সকলেই আল্লাহর জন্যে, এই সম্পদও আল্লাহর জন্যে। আল্লাহর কাছে এ সম্পদের হিসাব দিতে হবে। এই অনুভূতি সব সময় মনে জাগরুক রেখে এই সম্পদের ব্যবহার তোমাদেরকে করতে হবে। থামল আহমদ মুসা।

মা, দাদী, সুরাইয়া সবাই এসে দাঁড়িয়েছিল মাকার পাশে।

 স্যার, সম্পদের খরচ আপনি যেভাবে করতে বলেছেন, তার তিল পরিমাণ অন্যথা যেন আমরা না করি, এ তাওফিক আল্লাহ যেন আমাদের দেন, এই দোয়া সব সময় আপনি আল্লাহর কাছে দয়া করে করবেন। আর স্যার, এ কথা বলতে লোভ হচ্ছে যে, আপনি বুজুমবুরা, পবিত্র মক্কা-মদিনা, যেখানেই থাকুন জাম্বিয়া খুব বেশি দূরে নয়। আপনি কি একটু আমাদের খোঁজ-খবর নিতে পারবেন না? আহমদ মুসা থামতেই বলে উঠল সাবেরা সুরাইয়া।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, আল্লাহ যদি মঞ্জুর করেন।

কথা শেষ করেই সবার উদ্দেশ্যে আবার সালাম দিল আহমদ মুসা। গাড়িতে উঠে বসল সে।

গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।

মাকারা সবাই অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে ছিল গাড়ির দিকে। কান্নার মধ্যেই হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে তারা।

গাড়ির রিয়ার ভিউতে এটা দেখে পেছনে ফিরে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল আহমদ মুসা।

চোখ ফিরাল আহমদ মুসা সামনে। গাড়ি ছুটে চলল লুসাকা হাইওয়ের দিকে।

দশ মিনিটের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি উঠে এলো লুসাকা হাইওয়েতে। এটা একটা ট্রান্সন্যাশনাল হাইওয়ে। জিম্বাবুয়ে থেকে প্রবেশ করেছে জাম্বিয়ায়। আবার তা জাম্বিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে গেছে। তানজানিয়ায়। কিন্তু আহমদ মুসা এ হাইওয়ে ধরে তানজানিয়ায় যাচ্ছে না। আহমদ মুসা যাচ্ছে বুরুন্ডির বুজুমবুরায়। তাই আরো শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছে সে। সে লুসাকা ট্রান্সন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে যাবে এমবিকা পর্যন্ত। এমবিকা থেকে আঞ্চলিক সড়ক পথে কাসামা হয়ে এমবালার পর সীমান্ত অতিক্রম করে তানজানিয়ায় প্রবেশ করবে। তানজানিয়া সীমান্তের পর উত্তর দিকে লেক ট্যাঙ্গানিকার কাছাকাছি প্রথম বড় শহর সোমবাওয়াংগা। এ শহরটি কয়েকটা সড়কের গ্রন্থি। সোমবাওয়াংগা থেকে আহমদ মুসা যাবে বুরুন্ডি সীমান্তের কাছাকাছি কাসুলু পর্যন্ত। এ সড়কটি লেক ট্যাঙ্গানিকার সমান্তরালে উত্তরে এগিয়ে বুরুন্ডি সীমান্ত পার হয়ে যাবে বুজুমবুরা পর্যন্ত। কিন্তু আহমদ মুসা কাসুলু থেকে পশ্চিমে লেক ট্যাঙ্গানিকার তীরবর্তী এ অঞ্চলের বড় শহর কিগোমা যেতে চায়। কিগোমার একটু দক্ষিণে মুসলিম। স্মৃতি বিজড়িত ইউজিজি। এককালে পর্যটকদের পদভারে মুখরিত এবং প্রাচীন সড়ক পথের একটা গ্রন্থি ইউজিজি শহর। আহমদ মুসা সুযোগ হলে। এ শহরে দুএকদিন কাটাতে চায়। তার পরবর্তী পরিকল্পনা হলো কিগোমার কাছাকাছি বুরুন্ডি সীমান্ত অতিক্রম করে পাহাড়ি পথে গাড়ি চালিয়ে লেক ট্যাঙ্গানিকার তীরে বুরুন্ডির প্রথম শহর নিয়ানজায় পৌঁছানো। এখান থেকে লেক ট্যাঙ্গানিকার তীর বরাবর তীরের মতো সোজা পথ ধরে বুজুমবুরা পৌঁছানো যায়।

 আহমদ মুসা জাম্বিয়া সীমান্ত পার হয়েছে। চলছে তার গাড়ি তানজানিয়ার রোকোয়া অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে।

 পাহাড়ি উচ্চভূমি। মাঝে মাঝে সবুজ উপত্যকা। গাড়ি চলার মতো সুন্দর রাস্তা, কিন্তু খুব প্রশস্ত নয়।

মাঝারি গতিতে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।

কয়েক কিলোমিটার সামনে সোমবাওয়াংগা শহর। রাস্তার দুই পাশে ছোটখাট বনজ পাহাড় এবং সবুজ উপত্যকা। পাহাড় ও উপত্যক। উভয় জায়গাতেই জনবসতি দেখা যাচ্ছে।

 একটা প্রশস্ত উপত্যকা দিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। আহমদ মুসার দৃষ্টি ছিল সামনে। তার দুচোখ হঠাৎ আটকে গেল রাস্তার দুদিক থেকে ছুটে আসা দুদল মানুষের উপর। তারা তীর-ধনুক, বল্লম, বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে আসছে একদল আরেক দলের দিকে।

সড়কটাই যেন তাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে। দুই সংঘর্ষমুখী দলের সড়কে পৌঁছতে দেরি নেই!

আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দুই দলের মাঝখানের সড়কে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।

তখন তীর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

ঢালের প্রতিরক্ষা থাকলেও দুপক্ষেরই দুএকজন করে লোক আহত হয়েছে।

আহমদ মুসা তার জ্যাকেটের পকেটের মেশিন রিভলভার হাত দিয়ে একবার স্পর্শ করে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সড়কে দুই দিকে দুই হাত তুলে।

আহমদ মুসা জানে এই অঞ্চলে বান্টু জাতি-গোষ্ঠীর শাখা ফিপা গোত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরো দুতিনটা জাতি এ অঞ্চলে বাস করে, তাদের মধ্যে বান্টু জাতি-গোষ্ঠীরই আরেক শাখা নিয়ামওয়েজী গোত্র প্রধান।

আহমদ মুসা সোহাইলি ভাষায় চিৎকার করে বলল, তোমরা দুই দল থামো। একটু শুনতে দাও তোমাদের কথা।

এ অঞ্চলের কোনো জাতি-গোষ্ঠীরই মাতৃভাষা সোহাইলি নয় কিন্তু পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলের প্রায় সকলেই সোহাইলি ভাষা বুঝে। এক সময় গোটা পূর্ব আফ্রিকারই রাজভাষা ছিল সোহাইলি।

আহমদ মুসার কথা শুনে দুই পক্ষেরই তীর বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। অল্পক্ষণ পরে দুই পক্ষই আবার তীর বৃষ্টি শুরু করল। আহমদ মুসা বুঝল কোনো পক্ষই আগে থামতে চাচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তরের পক্ষই থামার পর নতুন করে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।

 আহমদ মুসা এবার বসে পড়ল এবং দুই পকেট থেকে মেশিন রিভলভার ও পিস্তল বের করে উপরের দিকে একপশলা গুলি বৃষ্টি করল।

দুইপক্ষ আবারও থামল।

তারা আরো ভালো করে আহমদ মুসাকে দেখল। দুইদলই তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল।

উত্তরের দলের ভিতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো। সে কিছুটা এগিয়ে এলো। বলল, আপনি কে, কেন আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছেন? আমরা একটা অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে বেরিয়েছি। আমাদের মাথায় বাড়ি দেয়া নিয়ামওয়েজীদেরকে আমরা ছাড়ব না। লোকটির ভাষা মিশ্র সোহাইলি।

আমি আপনাদের কাজে বাধা দিচ্ছি না। অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন এটাও ভালো কথা। অন্যায়ের প্রতিবিধান হোক, আমিও চাই। কিন্তু একটা রক্তক্ষয়ী সংঘাত কেন হতে যাচ্ছে? অন্যায়টা কি? আমি শুধু এটুকুই জানতে চাচ্ছি। আপনারা দুই পক্ষ থেকেই কয়েকজন করে আসুন। আমি দুই পক্ষের কথা শুনে প্রতিবিধান যদি কিছু করতে পারি, সেজন্যে দয়া করে একটা সুযোগ আমাকে দিন। বলল আহমদ মুসা।

এগিয়ে আসা লোকটি ফিরে গেল। ওদের মধ্যে আলোচনা চলল।

এগিয়ে এসে কথা বলা লোকটি আবার ফিরে এলো। বলল, আপনাকে বিদেশি বলে মনে হচ্ছে বলেই আমাদের সর্দার আপনার অনুরোধ মেনে নিয়েছেন। সরদারসহ আমাদের তিনজন আপনার কাছে যাচ্ছে। ওদের তিনজনকে ডাকুন।

 আহমদ মুসা দক্ষিণের পক্ষকে ডাকল। ওদের একজন এগিয়ে এলে আহমদ মুসা তাকে সব কথা বলল।

 সব শুনে লোকটি চলে গেল। ফিরে এলো অল্পক্ষণ পরে। বলল, আমাদের সরদারসহ তিনজন আসছে আপনার কাছে।

দুই পক্ষই এলো। দুই পক্ষের সরদারের সাথে আহমদ মুসার পরিচয় হলো

আহমদ মুসা তার গাড়িটা রাস্তা থেকে সরিয়ে রাস্তার পাশে নিল। পাজেরো টাইপের আটসিটের জার্মান গাড়ি আহমদ মুসার।

দুই গোত্রের প্রধান দুই সরদারকে গাড়ির দুই সিটে বসতে দিয়ে আহমদ মুসা অন্য চারজনকে নিয়ে সরদারদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

পরিচয় হলো, উত্তরের দলটি ওয়াফিপা গোত্র। সোমবাওয়াংগা অঞ্চলের এরাই জনসংখ্যার প্রায় আশি ভাগ। আর দক্ষিণের দলটি নিয়ামওয়েজী। এরা জনসংখ্যার পনেরো ভাগের বেশি নয়। তবে তানজানিয়ার অন্য অঞ্চলে এদের সংখ্যা প্রচুর। এরা তানজানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গোত্র। কিন্তু ওয়াফিপা বা ফিপারা মাত্র সোমবাওয়াংগা অঞ্চলেই বাস করে। এখানে ওয়াফিপা যেমন বড় গোত্র তেমনি তাদের শক্তি ও অহংকার দুই-ই বড়।

 ওয়াফিপা গোত্রের সরদার প্রথমে তার কথা বলল। সে শুরুই করল এভাবে: নিয়ামওয়েজীরা আমাদের সর্বনাশ করেছে ক্ষুদ্র চুনোপুঁটি হয়ে। তাদের সাথে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা তাদের ধ্বংস চাই, তাদের সমূলে বিনাশ করব আমরা।

আহমদ মুসা দুই সরদারের কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনল। কিছু কথা তাদের সাথের লোকরাও বলল। দুই পক্ষের কথার মূল বিষয় হলো, ফিপা গোত্রের সর্দার আশা আরুশার ভাতিজী জিজিকে নিয়ামওয়েজী গোত্রের সর্দার দিগো দাইশার ছেলে বেন চার্চে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। জিজি খ্রিস্টান নয়। তাকে খ্রিস্টান সাজিয়ে চার্চে নিয়ে বিয়ে করে ফিপা গোত্রের ধর্ম নষ্ট করেছে এবং তাদের কয়েকশ বছরের বিয়ের রীতি ধ্বংস করেছে। অন্যদিকে নিয়ামওয়েজী গোত্রের সর্দার এর প্রতিবাদ করে বলছে, তার ছেলে বেন খ্রিস্টান নয়, যদিও কলেজে ভর্তির সময় তাকে তার অজান্তেই খ্রিস্টান নাম দেয়া হয়েছে বেনহাম বরিস। যেমন জিজিকেও নাম দেয়া হয়েছে জিনা জুলিয়া। চার্চই ফুসলিয়ে ফাঁদে ফেলে এবং নানা রকম লোভ দেখিয়ে তাদেরকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। সুতরাং তার ছেলের এবং তাদের গোত্রের দোষ এতে নেই। চার্চের বিয়েকে আমরাও অস্বীকার করেছি। দুই পক্ষের কথা শোনার পর আহমদ মুসা বলে, নিয়ামওয়েজী গোত্রের ছেলে বেন যদিও ফিপা গোত্রের মেয়ে জিজিকে চার্চে নিয়ে গেছে, কিন্তু আসল দোষী হলো চার্চ। তারাই ফুসলিয়ে নানা রকম লোভ ও ভয় দেখিয়ে উভয়কে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। তারা চার্চ কলেজের ছাত্র বলে লেখাপড়ার স্বার্থে তারা অবাধ্য হতে সাহস পায়নি।

এই কথাগুলোর পর আহমদ মুসা ফিপা গোত্রের সরদারকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি যদি সত্যিকার প্রতিবিধান চান, তাহলে আপনাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি নয়, আগে চার্চকে ধরতে হবে। যেহেতু বর-কনে দুজনের কেউই খ্রিস্ট ধর্মের নয়, তাই খ্রিস্ট ধর্ম মতে তাদের বিয়ে হতে পারে না। চার্চকে দিয়ে তথাকথিত বিয়ের ডকুমেন্ট বাতিল করতে হবে।

আমরা বুঝতে পারছি, চার্চই আসল কালপ্রিট। আপনাকে ধন্যবাদ, এ কথাটা আমাদের বুঝিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু জনাব, চার্চ যে দোষী এটা চার্চকে বলবে কে? বললেই কি চার্চ এটা মানবে? তাদের অনেক প্রভাব, অনেক শক্তি। সরকারের চেয়ে ওরা বেশি শক্তিশালী। এমন ঘটনা আমাদের সাথে না ঘটলেও অনেকের সাথে ঘটেছে। কোনো প্রতিকার, বিচার কেউ পায়নি। বরং দেখা গেছে, অভিযোগ করতে গিয়ে আসামী সাজতে হয়েছে অনেককে। বলল ফিপা গোত্রের সরদার আশা আরুশা।

আপনারা চাইলে আমি আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি। আহমদ মুসা বলল।

আপনি যাবেন চার্চে? আমাদের সাহায্য করবেন আপনি? বলল আশা আরুশা।

আপনি মনে হচ্ছে বিদেশি। আমাদের সাহায্যের জন্যে গিয়ে আপনি যদি বিপদে পড়েন? নিয়ামওয়েজী গোত্রের সরদার দিগো দাইশা বলল।

 আপনাদের ধন্যবাদ, আমার প্রতি শুভেচ্ছার জন্যে। কিন্তু আমার কথা আপনাদের ভাবতে হবে না। সব সময় সব ব্যাপারে স্রষ্টা আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে। বলল আহমদ মুসা।

 আপনি কি মুসলিম? মুসলমানরা স্রষ্টা, পালনকর্তাকে আল্লাহ বলে। জিজ্ঞাসা ফিপা গোত্র প্রধান আশা আরুশার।

হা মুসলিম। বলল আহমদ মুসা।

জগতরক্ষক আপনার সহায় হোক। আমি খুব খুশি। আপনি চার্চের সাথে কথা বলতে পারবেন। একমাত্র মুসলমানদেরকেই তারা ভয় করে।

ভয় করে বলেই মুসলমানদেরকে ওরা এক নম্বর শত্রু ভাবে। ফিপা প্রধান আশা আরুশা বলল।

আমিও খুশি। মুসলমানরাই শুধু ওদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিকারে নামতে পারে। বলল নিয়ামওয়েজী গোত্রের দিগো দাইশা!

 চার্চে গিয়ে কিন্তু আপনারা আমার মুসলিম পরিচয় দেবেন না। আমি একজন মানুষ হিসেবে ওদের সাথে কথা বলব, মুসলিম পরিচয় নিয়ে নয়। আহমদ মুসা বলল।

দুই গোত্র প্রধানই এক সাথে বলে উঠল, ঠিক আছে আপনি যা চান তাই হবে। আমরা নিজেদের থেকে কিছুই বলব না।

চার্চের নাম কি? বলল আহমদ মুসা।

 আফ্রিকান ইনল্যান্ড চার্চ। সোমবাওয়াংগা শহরে এটাই সবচেয়ে বড় চার্চ। ফিপা সরদার আশা আরুশা বলল।

আমি যদি এখন সেখানে যেতে চাই, আপনারা রাজি আছেন যেতে? বলল আহমদ মুসা।

দুই গোত্রের লোকরা পরস্পরের দিকে তাকাল। বলল দুই সরদারই, যেতে রাজি আছি। কতজন যেতে হবে?

উভয় পক্ষ কয়জন করে নেবেন, আপনারা ঠিক করুন। তবে আমি মনে করি বেশি লোক যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বলল আহমদ মুসা।

তাহলে আমরা দুই পক্ষ চার পাঁচজন করে লোক নেই। দুই পক্ষের জন্য চারটি গাড়ি হলেই চলবে। নিয়ামওয়েজী সরদার দিগো দাইশা বলল।

 গাড়ির সমস্যা নেই। তবে চার পাঁচজনের ব্যাপারে আমিও একমত। বলল ফিপা সরদার আশা আরুশা।

সড়কের দুই পাশে দাঁড়ানো দুই পক্ষের পেছনেই তাদের গাড়ি ছিল। গাড়ি সামনে আনা হলো।

বিয়ের দুই পক্ষ অর্থাৎ বর কনেকেও সাথে নিতে হবে। তারা কি এখানে আছে? বলল আহমদ মুসা।

স্যার, বর কনে বলবেন না, তারা তো আসলে বর কনে নয়। ফিপা সরদার আশা আরুশা বলল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ঠিক আছে। বেন ও জিজি কি আমাদের সাথে যাচ্ছে?

নিশ্চয় যাবে, তারা হাজির আছে। বলল দুই সরদারই। যাত্রা শুরু হলো সোমবাওয়াংগা শহরের দিকে।

শহরের মধ্য অংশ থেকে একটু উত্তরে আফ্রিকান ইনল্যান্ড চার্চ। চার্চটির ক্যাম্পাস বিশাল বড়। প্রাচীর ঘেরা। সামনে সিংহ দরজার মতো বিরাট বড় গেট।

ফিপা গোত্রের সর্দারের পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত পথ ধরেই আফ্রিকান ইনল্যান্ড চার্চের সামনে পৌঁছল তারা সকলে।

 সুন্দর সোমবাওয়াংগা শহর। তবে চার্চের ছাড়াছাড়িটা তার চোখে, পড়ল। আফ্রিকান ইনল্যান্ড চার্চ পর্যন্ত পৌঁছতেই আটটি চার্চ কমপ্লেক্স সে। দেখতে পেল। দেখতে পেল মাত্র দুইটা মসজিদ, মসজিদি ইস্তিকামা এবং মসজিদি রুধা।

আহমদ মুসাদের ৫টি গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল আফ্রিকান ইনল্যান্ড চার্চের কার পার্কিং-এ।

গাড়ি থেকে নামল সবাই।

 আমার প্রস্তাব হলো, দুই গোত্রের মাননীয় দুই সর্দার এবং বেন ও জিজি আমার সাথে ভেতরে যাবে। অবশিষ্টরা বাইরে থাকবে।

আহমদ মুসার প্রস্তাব দুই পক্ষই মেনে নিল।

 ধন্যবাদ, আসুন আপনারা। বলে আহমদ মুসা সামনে এগোবার জন্যে তৈরি হলো।

বেন ও জিজি একেবারে জড়সড় হয়ে গেছে। তাদের চোখে ভীতি। আফ্রো-এশীয় মিশ্র চেহারা ওদের। আফ্রিকায় এ চেহারার ছেলেমেয়েদের বিশেষভাবে সুন্দর বলা হয়।

 আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকাল। বলল, ভয় পেয়ো না। আমরা আছি, তোমাদের কোনো ভয় নেই। তোমরা আমাকে একটা কথা বলো, তোমরা তো আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান হওনি, তাই কিনা?

দুজনেই নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্তের জন্যে মুখ তুলে বলল, স্যার, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক কোনোভাবেই আমরা খ্রিস্টান হইনি।

তাহলে খ্রিস্টান মতে তোমাদের বিয়ে হলো কেন? তোমরা আপত্তি করনি? বলল আহমদ মুসা।

জিজি তাকাল বেন-এর দিকে।

 বেন জিজির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, স্যার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে একবার নিউ কাপল ডে পালিত হয়। এই নিউ কাপল ডেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর- যিনি একজন খ্রিস্টান প্রিস্ট, তার নেতৃত্বে একটা গোপন কমিটি নিউ কাপলদের জোড় তৈরি করেন। এরপর সবাইকে চার্চে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নিউ কাপলদের জোড় ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, যিশুর ইচ্ছাতেই এ জোড় নির্ধারিত হয়েছে। যারা যিশুকে প্রত্যাখ্যান করবে না, তারা এ জোড় গ্রহণ করে নিউ খ্রিস্টান কাপলদের তালিকায় নিবন্ধিত হয়ে যাবে। প্রকাশ্যে যিশুকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস কেউ করতে পারে না, আমরাও পারিনি।

সকলকে বিয়ের পোশাক পরানো হয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

 জি, স্যার। চার্চে এলে প্রথমেই বিয়ের পোশাক পরানো হয়। জিজ্ঞাসা করলে বলে, এগুলো অনুষ্ঠানের পোশাক। বলল জিজি। নত মুখ তার।

আচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছেলেমেয়েকেই কি নিউ কাপল বানানো হয়? আবার জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

 জি না, সবাইকে বানানো হয় না। বাছাই করে বানানো হয়, সংখ্যা। পঁচিশ-তিরিশের বেশি নয়। উত্তরে জিজিই বলল।

কোনো হোয়াইট বা তোমরা যাদেরকে সত্যিই খ্রিস্টান বলে জানো, তাদেরকে কি নিউ কাপল-এর মধ্যে আনা হয়? বলল আহমদ মুসা।

এ রকম আমাদের চোখে পড়েনি। একটু চিন্তা করে উত্তর দিল বেন।

 ধন্যবাদ তোমাদের দুজনকে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছ তোমরা। বলল আহমদ মুসা

কথাটা শেষ করেই আবার সকলের উদ্দেশ্যে বলল, আসুন।

দুপাশের গেট বক্সে দুজন প্রহরী।

আহমদ মুসারা গেটের সামনে দাঁড়াতেই একজন প্রহরী বেরিয়ে এলো। স্যালুট দিয়ে বলল, আমি কি সাহায্য করতে পারি আপনাদের?

এখন চার্চের সাহেবদের কেউ কি উপস্থিত আছেন? বলল আহমদ মুসা।

চিফ বিশপ এবং প্যাস্টোররা সকলেই আছেন। প্রহরীটি বলল।

 বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা কে দেখেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। চিফ বিশপ স্যারই প্রধানত দেখেন। প্রহরীটি বলল।

 বিশপ স্যারের সাথেই দেখা করতে চাই, জরুরি। বলল আহমদ মুসা।

প্রহরী আহমদ মুসাদের দিকে ভালো করে তাকাল। বলল, প্লিজ, একটু দাঁড়ান। আমি খবর পৌঁছাচ্ছি।

বলে প্রহরীটি গেট বক্সে চলে গেল। মিনিট দুই পরে গেট খুলে গেল। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়েছিল প্রহরীটি। বলল সামনের একটা কক্ষের দিকে ইংগিত করে, স্যার, আপনারা রিসেপশনে যান। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে।

সব ব্যবস্থার পর বিশপের পাবলিক অফিসে বিশপের সাথে দেখা হলো আহমদ মুসাদের।

বিশপের পাবলিক অফিসের তিন গেটে ছিল অস্ত্রধারী তিন প্রহরী। আর বিশপের চেয়ারের পেছনে ছয় ফুটের মতো দূরে দাঁড়িয়েছিল বিশপের পি.এ।

 বিশপের-টেবিল-মঞ্চের ছয় ইঞ্চির মতো নিচুতে সামনে ও দুই পাশে রেলিংঘেরা কাঠের মঞ্চের উপর দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসারা। বিশপই প্রথম কথা বলল। বলল সে, যিশুর জয় হোক, যিশুর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক। বলুন। বৎসরা আপনাদের অভিপ্রায় কি?

 গুডমর্নিং বিশপ স্যার। বলে আহমদ মুসা বেন ও জিজিকে দেখিয়ে বলল, আপনি কি এ দুজনকে চেনেন?

বিশপ চোখ থেকে চশমা খুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল বেন ও জিজির দিকে। বলল, হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। এরা জিনা জুলিয়া ও বেনহাম বরিস, জগৎ পিতা প্রভু যিশুর নিউ কাপল।

তাদের এই নামগুলো কি চার্চ রেখেছে, না তাদের পিতা-মাতা রেখেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

বিশপের চোখে মুহূর্তের জন্যে একটা ভ্রুকুটির ভাব দেখা গেল। তার মুখের উপর দিয়েও অসন্তুষ্টির একটা ছায়া জেগে উঠেও আবার মিলিয়ে গেল। বলল, এ নামগুলো তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হয়েছে।

 আমি শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর একজন যোগ্য লোক, ভালো লোক। আপনি…।

আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বিশপ বলল হ্যাঁ খুব ভালো লোক, যোগ্য লোক। আমাদের একজন প্রিস্ট তিনি।

তিনি কি আপনাদের চার্চের সাথে আছেন? বলল আহমদ মুসা।

ও আপনি তাহলে জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরই একটি প্রতিষ্ঠান। ওখানকার লোকও আমাদের তৈরি।

তাহলে ওখানকার দায়ও তো আপনারদের উপরই বর্তায়? বলল আহমদ মুসা।

এসব প্রশ্ন কেন? আপনারা কি জানতে চান? কি জন্যে এসেছেন আপনারা? প্রধান বিশপ বলল।

আমরা জানতে চাচ্ছি, আপনি যাদেরকে যিশুর নিউ কাপল বলে অভিহিত করলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেই এখানে এনেছিল বিয়ের জন্যে। যাদের জোড় বাধা হয়েছিল, তারা এটা জানতো না এবং তাদেরকে বিয়ের জন্যে চার্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাও তারা জানতো না। এই কাজটা আপনার বিশ্ববিদ্যালয় এবং আপনারা কেন করলেন? যাদের জোড় বেঁধে কাপল বানানো হয়েছিল, তারা খ্রিস্টান ছিল না। বলল আহমদ মুসা।

তারা খ্রিস্টান হয়েছে। তারা যিশুর চয়েসকে আনন্দের সাথে মেনে নিয়েছে। আর এরকমটাই চলে আসছে বহুদিন থেকে। কখনো কোনো প্রশ্ন উঠেনি। বিশপ বলল।

অন্যায়ের প্রতিবাদ এতদিন হয়নি বলে প্রতিবাদ হবে না, এটা আইন ও বিচারের কথা নয়। বলল আহমদ মুসা।

আমি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। যারা যিশুর কাপল হয়েছে, তারা এটা মেনে নিয়েছে। অস্বীকার তো দূরে থাক, মৌখিক আপত্তিও কেউ করেনি। বিশপ বলল।

 আপনারা চার্চ ও বিশ্ববিদ্যালয় যোগসাজস করে ফাঁদে আটকে অসহায়। অবস্থায় তাদেরকে বাধ্য করেছেন খ্রিস্টান কাপল হতে। এইভাবেই আপনারা বছরের পর বছর ধরে লেখাপড়া করতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছেলেমেয়েদেরকে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করছেন। প্রথমে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নাম পাল্টাচ্ছেন, তারপর নানা কৌশলে তাদের খ্রিস্টান হতে বাধ্য করছেন। যিশুর কাপল বিষয়টি খ্রিস্টান বানানোর একটা বড় ফাঁদ। বলল আহমদ মুসা।

 এই সময় দুজন অস্ত্রধারী এসে আহমদ মুসার দুপাশে দাঁড়িয়ে অন্ত্র উঁচিয়ে বলল, আপনারা শান্তি ভঙ্গের চেষ্টা করছেন। চলুন এখান থেকে আপনারা। না গেলে মাথা ছাতু করে দেব। আমাদের কাজে বাধা দিয়ে কেউ এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেনি।

আহমদ মুসা দুপাশে দুজনের দিকে তাকাল। চোখের পলকে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দুজনের হাত থেকে মিনি স্টেনগান কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। তারা আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা আগের মতো তার দুই হাত দুই দিকে বজ্রের মতো ঠেলে দিল। কানের পাশে দুজন হাতুড়ির মতো ঘা খেয়ে দুদিকে ছিটকে পড়ল।

ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন প্রহরী ছুটে এসেছে। তাদের হাতেও স্টেনগান। তারা আহমদ মুসার কয়েক গজ পেছনে এসে জড়ো হয়েছিল।

জ্যাকেটের পকেট থেকে তার এম-১০ আগেই উঠে এসেছিল আহমদ মুসার হাতে। সেই সাথে সে ঘুরেও দাঁড়িয়েছিল।

 স্টেনগানধারীদের স্টেনগানের ব্যারেল উঠে আসছে কিন্তু আহমদ মুসা তখনও টার্গেট হয়নি। পেছন থেকে কে একজন ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছিল, কয়েকটা জঞ্জালকে শেষ করে দাও।

ওরা শেষ করে দেবার আগেই আহমদ মুসার এম-১০ এর ব্যারেল একবার বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে এলো ওদের উপর দিয়ে।

ওরা সবাই পায়ে গুলি খেয়ে আছড়ে পড়েছে কার্পেটের উপর। গুলি করেই আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়েছে বিশপের দিকে। বিশপ-এর চোখ দুটি বিস্ফোরিত।

সে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সরে যাবার চেষ্টা করছিল।

 বিশপ স্যার, আপনি বসে পড়ন। এক ইঞ্চিও সরার চেষ্টা করবেন না।

বলে, আহমদ মুসা পকেট থেকে মিনি রেকর্ডার বের করে বিশপকে দেখিয়ে বলল, আপনার সব কথা, আমাদের সব কথা, প্রহরীর হুমকি এবং পেছন থেকে আমাদেরকে শেষ করে দেয়ার আদেশ সবই রেকর্ড হয়েছে এই পাওয়ারফুল রেকর্ডারে। আমি এখনি পুলিশ কমিশনারকে ডাকব এবং তাঁকে এই রেকর্ড শোনার এবং তাকে জানাবো আমরা নিজেদেরকে রক্ষার জন্যে ওদের পায়ে গুলি করে ওদের নিরস্ত্র করেছি।

 কথা শেষ করে আহমদ মুসা তাকাল বেন-এর দিকে। বলল, বেন, তুমি পুলিশ কমিশনারের নাম্বার বের করে একটা কল করো। আমি কথা বলব।

 দুই সর্দার ও বেনদের অবস্থা তখন ভীত-বিহ্বল। তাদের চোখ ভয়ে বিস্ফোরিত। মুখ তাদের অন্ধকার। তাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই।

 আহমদ মুসার নির্দেশ পেয়ে বেন পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তার হাত কাঁপছে। সার্চ করছে সে মোবাইলে। নাম্বার পেয়ে বলল সে,

কমিশনার এবং অন্যান্য সব পুলিশ অফিসারের নাম্বার পেয়েছি।

দাও মোবাইলটা। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা মোবাইল হাতে নিতেই বিশপ বলল, জনাব, পুলিশে টেলিফোন করবেন না প্লিজ। আপনাদের কোনো ক্ষতি তো হয়নি, আমাদের হয়েছে। আপনারা কি চান বলুন।

আমাদের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের দুই ছেলেমেয়েকে খ্রিস্টান বানিয়েছেন। পিতা-মাতা, পরিবারের অনুমতি ছাড়া তাদের বিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় সর্বনাশ আর কি হতে পারে! বলল আহমদ মুসা।

ওরা আসলে খ্রিস্টান এখনো হয়নি। ওরাও এটা জানে। আর বিয়েও এখনো হয়নি। সেদিন প্রকৃতপক্ষে যেটা হয়েছে সেটা হলো, যিশুর কাপল হওয়ার জন্যে প্রার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র। একমাস পরে তাদের বিয়ে হবে। তার আগে তাদের ব্যাপটাইজ করা হবে। বিশপ বলল।

আপনি যে ঠিক বলছেন, কি করে তা আমরা বিশ্বাস করর? বলল আহমদ মুসা।

আমাদের চার্চের বিয়ে সংক্রান্ত রেজিস্টারে আমি যা বলেছি সেভাবেই লেখা আছে। বিশপ বলল।

রেজিস্টার আনুন, আমরা দেখব। বলল আহমদ মুসা। বিশপ পেছনে তাকিয়ে পিএ-কে নির্দেশ দিল রেজিস্টারটি আনার জন্যে।

পিএ চলে গেল।

আহমদ মুসা বিশপকে লক্ষ করে বলল, আরেকটা বিষয় আপনাকে নিজ হাতে লিখে দিতে হবে। সেটা হলো, যিশুর নিউ কাপল কর্মসূচিতে ফিপা ও নিয়ামওয়েজী গোত্রের দুই ছেলেমেয়েকে কাপল হিসেবে বিয়ের তালিকায় শামিল করা হয়েছিল, সেই ব্যাপারে আলোচনা করতে গোত্র দুটি থেকে লোক এসেছিল। তাদের জানানো হয় তাদের ছেলেমেয়েকে খ্রিস্টান বানানো হয়নি কিংবা তাদের বিয়েও দেয়া হয়নি। সেদিন প্রাথমিক প্রসেস শুরু হয়েছিল মাত্র। তারা তাদের ছেলেমেয়েকে যিশুর কাপল সূচি থেকে বের করে নিয়ে যায়। এতে চার্চ পক্ষও রাজি হয়। প্রথমদিকে উত্তপ্ত আলোচনার। এক পর্যায়ে চার্চের কয়েক জনের হটকারিতায় একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরে উভয় পক্ষ বিষয়টি ভুলে যাবার ব্যাপারে একমত হয়। সব পক্ষের শুভেচ্ছা-সম্প্রীতির মধ্যে আলোচনা শেষ হয়। এ ব্যাপারে সব পক্ষ একমত হয় যে, ছেলেমেয়ে দুটির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করা হলে, তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকার গোত্রদ্বয়ের থাকবে।

এর মধ্যে দ্বিমত পোষণের কিছু নেই, আমি এটা লিখে দিচ্ছি।

বলেই বিশপ ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে নিল।

ইতিমধ্যে আহমদ মুসা আহত লোকদের ও তাদের অস্ত্রের ফটো তুলে, নিয়ে আহতদেরকে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাবার অনুরোধ করল।

সংগে সংগেই উপস্থিত লোকরা আহতদের নিয়ে গেল। পিএ রেজিস্টার নিয়ে ফিরে এলো। বিশপ আহমদ মুসাকে তার টেবিলে ডাকল।

আহমদ মুসা-রেজিস্টার দেখল এবং সরদারদের বলল, বিশপ স্যার যা। বলেছিলেন, রেজিস্টারে তাই লেখা আছে।

আহমদ মুসা তাকাল বিশপের দিকে। বলল, আমরা পাতাটা নিতে চাই।

ঠিক আছে, ফটো করে দিচ্ছি। বিশপ বলল।

না আমরা পাতাটাই চাই। আমরা চাই এই রেজিস্টারে আমাদের। ছেলেমেয়েদের নাম না থাকুক। বলল আহমদ মুসা।

বিশপ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। একটু চিন্তা করল। তারপর পাতাটা রেজিস্টার থেকে ছিঁড়ে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।

আহমদ মুসা ফিরে এলো সরদারদের কাছে।

 বিশপ তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আমি কি আপনাকে আপনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে পারি? আপনি নিশ্চয় এ শহরের লোক নন?

আমাকে একজন সাংবাদিকও বলতে পারেন। আমি ওয়ার্ল্ড ফ্রি প্রেস (WFP) এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি (IITv)  এর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি। বলল আহমদ মুসা।

বিশপ-এর সাদা মুখে একটা অন্ধকার ছায়া নামল। বলল, আপনি এই ব্যাপারটাকে আবার ছাপানো ও ব্রডকাস্টের জন্যে পাঠাবেন না তো? প্লিজ আমরা এই ঘটনার জন্যে সত্যিই দুঃখিত।

আজকের ঘটনা আমি পাঠাব না, তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও চার্চ মানুষকে খ্রিস্টান করার জন্যে যে অবৈধ কাজ করছে, সেটার উপর নিউজ করতে পারি। বলল আহমদ মুসা।

সংগে সংগে বিশপ কিছু বলল না। তাকিয়েছিল সে আহমদ মুসার দিকে।

চেয়ারে সে সোজা হয়ে বসল। বলল, এ ধরনের নিউজ না করতে যদি অনুরোধ করি। আপনি তা শুনবেন কিনা জানি না। তবে এই ধরনের নিউজ করে আমাদের ক্ষতি করতে পারবেন, কিন্তু আপনার কোনো লাভ হবে না। লাভ হবে না মানে আপনি যে কাজ বন্ধ করার জন্যে কাজটা করবেন, তা বন্ধ হবে না।

বন্ধ হবে না, তা আগাম বলছেন কি করে? বলল আহমদ মুসা।

 বলছি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। দুএকটা চেষ্টা, অতীতে হয়েছে। আমাদের অবৈধ কাজ বন্ধ করার জন্যে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। মাঝখানে আমাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে। বিশপ বলল।

কাজ বন্ধ না হলে আপনাদের ক্ষতি হলো কি করে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

 আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কাজ নিয়ে হৈ চৈ হওয়ার ফলে পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনীতিকরা আমাদের উপর চড়াও হওয়ার সুযোগ নিয়েছে। প্রচুর পয়সা খরচ করে পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনীতিকদের মুখ বন্ধ করতে হয়েছে। এতে তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক ক্ষতি হলেও আমাদের কাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজ আমাদের চলেছে, চলছে। আমি স্বীকার করছি, আমরা এই প্রথম ধরা খেলাম, সেটা আপনার কাছে। আমার অন্তর বলছে, আপনি শুধুই সাংবাদিক নন। আপনি যেভাবে রিভলভার বের করেছেন, যেভাবে গুলি করেছেন, একজন কলমবাজ সাংবাদিকের হাত এমন হতে পারে না। এমন সাহস সাংবাদিকদের হয় না। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আমার বুক কেঁপেছে, কিন্তু আপনার মুখের স্বাভাবিকতায় কোনো ভাঁজও পড়েনি। থামল বিশপ।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দুর্বলও ঘুরে দাঁড়ায়। যাক এসব কথা। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার লিখিত স্টেটমেন্টটা পেলে আমরা বিদায় নিতে পারি।

বিশপ তার পিএর হাত দিয়ে কাগজটি পাঠিয়ে দিল আহমদ মুসার কাছে।

 আহমদ মুসা দেখল বিশপ তার নিজস্ব প্যাডে স্টেটমেন্টটি লিখেছে।

লেখার উপর চোখ বুলাল আহমদ মুসা। দেখল সব ঠিক আছে।

আহমদ মুসা মুখ তুলল বিশপের দিকে। বলল, ধন্যবাদ বিশপ স্যার আপনাকে। আপনি আমাদের কথা রেখেছেন, আমরাও আপনার কথা রাখব ইনশাআল্লাহ।

ধন্যবাদ ইয়াংম্যান। আপনার কাছে পরাজিত হয়েও আমি খুব খুশি। সত্যিই আপনি যোগ্য এবং হৃদয়বান এক প্রতিপক্ষ। আরো খুশি হতাম আপনার পরিচয় জানতে পারলে। বিশপ বলল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, আমি পথের মানুষ, পথের মানুষের বিশেষ কোনো পরিচয় থাকে না।

 একটু থামল আহমদ মুসা। আবার বলে উঠল, আমরা বিদায় নিচ্ছি। বিশপ স্যার। আপনি দয়া করে আপনার অস্ত্রধারীদেরকে আগে হাঁটতে বলুন।

বিশপ তার অস্ত্রধারীদেরকে একত্রিত হয়ে সামনে এগোতে বলল। তারপর হেসে আহমদ মুসাকে বলল, ব্রাভো ইয়ংম্যান, আপনার সিদ্ধান্ত ও সতর্কতায় কোনো খুঁত নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।

চার্চের অস্ত্রধারীরা আগে আহমদ মুসারা তাদের পেছনে পেছনে চলল। কার পার্কিং পর্যন্ত এসে অস্ত্রধারীরা ফিরে গেল। আহমদ মুসারা কার পার্কে আসার সংগে সংগে গেট খুলে গিয়েছিল। আহমদ মুসারা গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। আগে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। পেছনে চার গাড়িতে দুই সর্দার এবং তাদের লোকজন। চলছিল পাঁচটি গাড়ি। আজানের আওয়াজ প্রবেশ করল আহমদ মুসার কানে। তাকাল আহমদ মুসা আজানের শব্দ লক্ষে।

চিনতে পারল মসজিদে ইন্তিকাম, যাওয়ার সময় দেখেছিল।

মসজিদের ফ্রন্ট সাইড দিয়েই রাস্তা। রাস্তার পরেই মসজিদের গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা। পার্কিং-এর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মসজিদের প্রধান গেট। গাড়ি পার্কিং-এর জায়গাটা নিচু ওয়াল দিয়ে ঘেরা। গাড়ি ঢোকার জন্যে ওয়ালে প্রশস্ত দরজা। দরজা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা নেই।

 এখানে কিবলা একটু পূর্ব ঘেঁষা উত্তর দিকে।

আহমদ মুসা পেছন দিকে তাকিয়ে ইংগিত করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। মসজিদের দিকে।

গাড়ি প্রবেশ করল মসজিদের কার পার্কিং-এ। পেছনের চারটি গাড়িও প্রবেশ করল মসজিদের কার পার্কিং-এ। গাড়ি থেকে বেরুল আহমদ মুসা। সর্দাররাও বেরিয়ে এসেছে। দুই সর্দার এবং বেন ও জিজি ছুটে এলো আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সর্দারদেরকে কিছু বলার জন্যে।

সর্দাররা এসে আকস্মিকভাবে বসে পড়ল আহমদ মুসার পায়ের কাছে। এবং তাদের মাথা ঝুঁকে পড়ল মাটির উপর সিজদার মতো।

 আহমদ মুসা চমকে উঠে দুই ধাপ পেছনে সরে দাঁড়াল। বলল, একি করছেন আপনারা! মানুষ মানুষকে সিজদা করা বা তার কাছে মাথা ঝোকানো আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ এবং বিরাট পাপের কাজ।

তারা উঠে দাঁড়াল। বলল ফিপা সর্দার, আপনি আমাদের ঈশ্বর, ঈশ্বরের কাজ করেছেন আপনি।

 চার্চে যা ঘটল, তা ঈশ্বরের শক্তি ছাড়া ঘটানো অসম্ভব। মানুষ সেজে আপনি ঈশ্বর হয়ে এসেছেন। চার্চ সবাইকেই অধীন করে ফেলেছে। ঈশ্বর ছাড়া তাদের কেউ এভাবে যেমন ইচ্ছা হুকুমের অধীনে আনতে পারে না। নিয়ামওয়াজীর সর্দার দিগগা দাইশা বলল।

দেখুন, চার্চে যা ঘটল তা আপনাদের সকলের সামনেই ঘটেছে। কোনো কিছুতেই কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। কিছুটা সাহস এবং তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ বিশপকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। নিজেরা পুলিশের ঝামেলা থেকে বাঁচবার জন্যে আমাদের সব কথাই মেনে নিয়েছে। আর আমি যেটুকু করেছি তা আল্লাহর দেয়া বুদ্ধি, শক্তিতেই করেছি। এ জন্যে প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা আল্লাহকেই জানাতে হয়, আমাকে নয়। বলল আহমদ মুসা।

গাড়ি থেকে নেমে টুপি মাথায় প্যান্ট সার্ট পরা একজন লোক তার গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সে এগিয়ে এলো আহমদ মুসার কাছে। বলল, আপনি কি মুসলিম?

আহমদ মুসা তাকে সালাম দিয়ে বলল, জি হ্যাঁ, আমি মুসলিম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। আজান শুনে নামাজ পড়ার জন্যে ঢুকেছি। নামাজ কয়টায়?

সোয়া একটায়। জামায়াতের আর দশ মিনিট আছে।

একটু থেমেই লোকটি আবার বলল, আমি মাচুই মোহাম্মাদী। সিভিল সার্ভিসের একজন চাকুরে। এই মসজিদের সেক্রেটারি আমি।

খুশি হলাম আপনার সাথে পরিচিত হয়ে। হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিলাম বুরুন্ডির দিকে। একটা কাজ পড়ায় শহরে ঢুকেছি। কাজ শেষ হয়েছে। নামাজের পর আমি চলে যাব। আর আমার নাম আবু আব্দুল্লাহ। বলল আহমদ মুসা।

আসুন মি, আবু আব্দুল্লাহ, নামাজের বেশি দেরি নেই। বলেই মাচুই মোহাম্মাদী গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

আহমদ মুসা তাকাল দুই সর্দারের দিকে। বলল, আমি নামাজে যাচ্ছি। আপনারা কি বসবেন? আমার মনে হয় আপনারা কষ্ট না করে চলে যেতে পারেন। আমি নামাজ পড়েই চলে যাব।

দুই সর্দার আহমদ মুসার দিকে কয়েকধাপ এগিয়ে এলো। দুজনেই হাত জোড় করে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, আমরা একটা অপরাধ করেছি। আপনাকে জিজ্ঞাসা না করেই একটা কাজ করে ফেলেছি। আমাদের মাফ করুন।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, কোনো অপরাধই আপনারা আমার কাছে। করতে পারেন না। অতএব মাফ করার কোনো প্রশ্ন নেই। বলুন ঘটনা কি? আপনারা এমনভাবে কথা বলছেন কেন?

না আমরা অপরাধ করেছি জনাব। আজ দুপুরে আমার বাড়িতে আপনার দাওয়াতের আয়োজন করেছি। গোশ হালাল করার জন্যে আমার এলাকার একজন ইমাম সাহেবকে আনা হয়েছে। আমাদের গোত্রের কিছু মুসলমানকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে আপনার সম্মানে। রাতে নিয়ামওয়েজী গোত্র প্রধান দিগো দাইশার বাড়িতে আপনার দাওয়াতের আয়োজন হয়েছে। তাদের গোত্রেও অনেক মুসলমান রয়েছে।

আহমদ মুসা প্রথমে গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। তারপর হেসে ফেলে বলল, দাওয়াত গ্রহণ করতে আমাকে বাধ্য করেছেন। এটা অপরাধ নয়। ভালো কাজ করতে বাধ্য করা হয়তো যায়। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

কি শর্ত স্যার বলুন। দুই সর্দার এক সাথে বলে উঠল।

 আহমদ মুসা তাকাল বেন ও জিজির দিকে। দুজন পাশাপাশি। দাঁড়িয়েছিল। তাদের দেখিয়ে আহমদ মুসা দুই সর্দারকে বলল, এরা দুজন। আমার ভাইবোন। আমার অনুরোধ, আমার এই ভাইবোনকে আজই আপনারা বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি খুশি হবো।

দুই সরদারকে প্রথমে বিব্রত দেখাল। তারপর তারা একে অপরের দিকে তাকাল। দুজনের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাকাল তারা আহমদ মুসার দিকে। নিয়ামওয়েজী গোত্রের সরদার দিগো দাইশা বলল, আমি রাজি আছি জনাব।

ফিপা গোত্রের সরদার আশা আরুশাও একই কথা বলল। আরো বলল, জনাব কোনো দিন যা ঘটেনি, সেটাই আপনি ঘটালেন। প্রার্থনা করুন জনাব, আপনার আল্লাহ যেন আমাদের দয়া করেন। আপনার আদেশের এই পবিত্র কাজটি যেন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির দরজা খুলে দেয়।

আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, আল্লাহ তো আমার একার নয়, আল্লাহ আপনাদেরও, আল্লাহ সকলের।

নিশ্চয় জনাব। আল্লাহ সকলের, আমাদেরও। জনাব মুসলমানদের আমরা ভালো জানি। ইয়াও গোত্রের মতোই আমরা মুসলমানদের সহযোগী। আমরা এক সাথে পর্তুগীজ, জার্মান, বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই। করেছি। একথা সত্য জনাব, আমরা মুসলমানদের শ্রদ্ধা করি তারা উন্নততর ধর্মের অনুসারী হিসেবে। বলল ফিপা সর্দার আশা আরুশা।।

 ধন্যবাদ। খুশি হলাম। আপনারা একটু দয়া করে অপেক্ষা করুন। আমি নামাজ পড়ে আসি।

নামাজ পড়ে আসতে একটু দেরিই হলো আহমদ মুসার। একটা জানাজা ছিল। ইমাম ছিল না, যার উপর ভার ছিল তিনিও আসতে পারেননি। নামাজ

ও জানাজার ইমামতি আহমদ মুসাকেই করতে হয়েছে।

আহমদ মুসাকে বিদায় দিতে বেরিয়ে এসেছিল মসজিদের সেক্রেটারি মাচুই মোহাম্মাদী। আহমদ মুসা কথা বলছিল তার সাথে।

মসজিদের ইমাম কবে থেকে নেই? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। আটমাস হলো। মাচুই মোহাম্মাদী বলল।

 কেন নেই? বলল আহমদ মুসা।

ইমাম সাহেব সৌদি মোবাল্লেগ ছিলেন। তার বেতন বন্ধ হওয়ায় তিনি চলে গেছেন। মাচুই মোহাম্মদী বলল।

অন্যান্য মসজিদের ক্ষেত্রেও কি এটাই ঘটেছে? বলল আহমদ মুসা।

আমাদের এই দুটো বড় মসজিদে সৌদি মোবাল্লেগ ছিল। দুই মসজিদ থেকেই সৌদি মোবাল্লেগ চলে গেছেন।

একটু থামল মাচুই মোহাম্মাদী। আবার বলল, স্যার মসজিদটা তৈরি হয়েছিল বাদশাহ ফয়সলের আমলে। তারপর থেকেই এখানে সৌদি মোবাল্লেগ ইমামতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ইদানিং মোবাল্লেগের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। এখন বন্ধই হয়ে গেল। সমস্যা হলো। ইমামতির উপযুক্ত লোক পাওয়া যায় না। অন্যদিকে উপযুক্ত লোক রাখার পয়সাও আমাদের নেই। এ অঞ্চলের মসজিদগুলো এ সমস্যায় ভুগছে। আর এজন্যে আমরা মুসলমানরা ভুগছি দারুণভাবে। মোবাল্লেগরা ইমামতি করার সাথে সাথে মাদ্রাসাও চালাতেন। মাদ্রাসা বন্ধ হওয়ায় আরবি শিক্ষার পথ, আমাদের বন্ধ হয়ে গেছে।

দাঁড়িয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। বেদনার প্রকাশ ঘটেছিল তার চোখে মুখে। বলল, দুর্ভাগ্য মুসলমানদের। বিশ শতকের ইসলামী রেনেসাঁ আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহের অবহেলিত ও হারিয়ে থাকা মুসলমানদের জীবনে সৌভাগ্যের সূর্যোদয় ঘটিয়েছিলেন বাদশাহ ফয়সল, বাদশাহ খালেদের মতো নেতা। তাদের মতো লোকদের অভাবে একুশ শতকে ডুবতে বসেছে। এই কারণেই আপনাদের মতো হাজারো মসজিদ ইমাম হারিয়েছে এবং মাদ্রাসাগুলো শিক্ষক হারিয়েছে। আমি বলব আপনাদের ধৈর্য ধরতে। আল্লাহ এই অবস্থার অবসান ঘটাবেন। আমার যতটুকু সাধ্য চেষ্টা করব। আর আপনাদেরকে আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি। আপনারা এ অঞ্চলের মুসলমানরা একটা সম্মেলনে বসুন এবং তহবিল গঠন করুন। মুসলমানদের প্রত্যেকেই প্রতি সপ্তাহে এক শিলিং করে তহবিলে দান করবেন। যারা এক শিলিং-এর বেশি পারবেন বেশি দিবেন। এভাবে আপনারা একটা তহবিল গড়ে তুলুন এবং আল্লাহর সাহায্য চান। দেখবেন, একসময় আল্লাহর ফান্ড নিশ্চয় আপনারা পেয়ে যাবেন। থামল আহমদ মুসা।

পকেটে হাত দিল আহমদ মুসা। এক হাজার ডলারের একটা নোট বের করে মাচুই মোহাম্মাদীকে দিয়ে বলল, আপনাদের ফান্ডে আমার ক্ষুদ্র দান এটা।

 আহমদ মুসার কথা শুনছিল দুই সরদার। তারা তাদের পকেট থেকে পাঁচশ শিলিং-এর নোট বের করে দুটি নোট মাচুই মোহাম্মাদীর হাতে তুলে। দিয়ে বলল, প্রতিমাসেই আমরা কিছু করে দেব।

মাচুই মোহাম্মাদী তাদের দান দুই হাত পেতে নিল। তার দুই চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল। বলল, স্যারের পরামর্শ আমি গ্রহণ করেছি। আমি নিশ্চিত সবাই উৎসাহের সাথে গ্রহণ করবে। স্যারের এবং আপনাদের পবিত্র দানের বরকতে এবং আল্লাহর সাহায্যে প্রস্তাবিত ফান্ড একদিন বিশাল রূপ পাবে।

ইনশাআল্লাহ। বলে মাচুই মোহাম্মাদীকে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসা তাকাল সরদারদের দিকে।; ফিপা গোত্রের সরদার আশা আরুশা বলল, আমরা সবাই রেডি স্যার। চলুন। দিগো দাইশাও আমার বাড়িতে যাচ্ছেন। তারও দাওয়াত। সেখানে গিয়ে বিয়ের বিষয় নিয়েও আলাপ-আলোচনা হবে।

ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা তার গাড়ির দিকে এগোলো।

সবাই গাড়িতে উঠল। চলতে শুরু করল পাঁচটি গাড়ি।

.

চার্চের ঘটনাটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে দুই গোত্রের সবখানে। সবার মধ্যে বিস্ময়, আনন্দ! বেশি আনন্দ দুই গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে। এই বিস্ময়কর কাজ একজন মুসলমান করেছে, এই খবরে তাদের বুক গর্বে ফুলে উঠেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর থেকেই ফিপা গোত্র প্রধান আশা আরুশার বাড়িতে দুই গোত্রের মানুষের ঢল নেমেছে আহমদ মুসাকে এক নজর দেখার জন্যে।

দুই গোত্রের প্রধান এবং দুই গোত্রের গণ্যমান্য লোকরা আলোচনায়। মিলিত হয়েছে ফিপা সরদারের বিশাল দরবার কক্ষে। বিষয় ছিল দুই। গোত্রের ছেলেমেয়ের আজ সন্ধ্যায় বিয়ে।

দরবার কক্ষের সাথে অ্যাটাসট একটা সুসজ্জিত বিশ্রাম কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিল আহমদ মুসা। বিশ্রাম কক্ষের বড় বড় জানালাগুলো খুলে রাখা হয়েছিল মুক্ত আলো বাতাসের জন্যে, আহমদ মুসা এসির চেয়ে মুক্ত আলো বাতাসই পছন্দ করেছে। আহমদ মুসা গোত্র দুটির আলোচনায় যোগ দেয়নি, যাতে তারা দ্বিধাহীনভাবে আলোচনা করতে পারে। আহমদ মুসার সাথে আলোচনা করেই তারা ভিন্নভাবে বসেছে আহমদ মুসার অনুরোধেই। আহমদ মুসা খোলা বিশ্রাম কক্ষে থাকায় উৎসুক লোকদের খুব লাভ হয়েছে।

দরবার কক্ষের আলোচনা শেষ করে দুই গোত্র প্রধানসহ সকলে এসেছিল আহমদ মুসার কাছে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবার জন্যে। দুই গোত্র প্রধান। আনন্দের সাথে জানিয়েছিল, দুই গোত্রই একমত হয়েছে বিয়ের কাজ কনের চাচা ও গোত্র প্রধান আশা আরুশার বাড়িতেই আজ সন্ধ্যায় সম্পন্ন হবে। বিয়ের পরই দুই গোত্রের যৌথ ভোজ বিয়ে বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হবে। এইসাথে সবার পক্ষ থেকে অনুরোধ এসেছে খাওয়ার পরই দুই গোত্রের লোকরা বসবে। আহমদ মুসাকে সেখানে দুচারটা কথা বলতে হবে। দুই গোত্রের মুসলমানদের গণ্যমান্য কয়েকজন এই বৈঠকেই আহমদ মুসার। সাথে কথা বলতে চায়।

বিয়ে সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে আহমদ মুসা খুশি হয়েছিল। দুই গোত্র একস্থানে একসাথে ভোজ অনুষ্ঠান করতে রাজি হওয়া একটা বড় সিদ্ধান্ত। নিয়ামওয়েজী গোত্র এই ক্ষেত্রে বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। খাওয়ার পরের যে বৈঠক, তাতেও রাজি হলো আহমদ মুসা। বিশেষ করে দুই গোত্রের মুসলিম গণ্যমান্যরা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায় শুনে খুবই খুশি হলো আহমদ মুসা।

সন্ধ্যায় আহমদ মুসা দুই গোত্রের মুসলমান যারা হাজির ছিল, তাদের নিয়ে দরবার কক্ষের কিছুটা সামনে উঁচু ও সমতল জায়গায় চাদর বিছিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করল। ফিপা গোত্র সর্দার আশা আরুশা দরবার হলেই নামাজ পড়ার জন্যে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু দরবার হল এবং তার সামনের বড় চত্ত্বর বিয়ের জন্যে চেয়ার ও সোফা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই সাজানো-গোছানোর মধ্যে অন্যথা ঘটাতে আহমদ মুসা রাজি হয়নি। বলেছিল, মুসলমানদের কাছে গোটা দুনিয়াই মসজিদ। জায়গাটা পাকসাফ হলেই সেখানে নামাজ পড়া যায়।

আশা আরুশা বলেছিল, সত্যি মুসলমানদের সবকিছু সরল, সহজ। তাদের নামাজ, ঈদ, বিয়ে, রোজা সবকিছুই সবার জন্যে সব অবস্থায় পালনের উপযুক্ত। এজন্যে ইসলাম ধর্মকে মানুষের ধর্ম বলা যায়।

মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ জীবন বিধান। দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত চলার উপযুক্ত করে আল্লাহ ইসলামকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ বার্তাবাহী রাসুল মোহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। বলেছিল আহমদ মুসা।

মুসলমানদের সরল জীবন এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার কারণেই আফ্রিকার মানুষ খুব দ্রুত ইসলাম ধর্মকে আপন করে নিতে পারে।

 আহমদ মুসা নামাজ শেষ করার পর বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান দুই ঘণ্টা ধরে চলে। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর খাওয়ার অনুষ্ঠান শুরু হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত তা চলে। খাওয়ার এক পর্যায়ে ফিপা গোত্র সর্দার আশা আরুশা আহমদ মুসাকে পাশে নিয়ে উচ্চস্বরে বলেছিল, আমাদের মুসলিম মেহমানের সৌজন্যে আমরা সবাই মুসলিম রীতি

অনুসারে হালাল করা গোশত খাচ্ছি।

আহমদ মুসা হের্সে বলেছিল, আল্লাহ দুনিয়ার সব মানুষকে গোশত হালাল করে খাওয়ার তৌফিক দিন। আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করলে যারা

জবাই হয় তারাও খুশি হয়। আল্লাহও খুশি হন।

সবার খাওয়া শেষ হলে দরবার হলেই বৈঠক বসে।

দরবার হলের বারান্দা এবং চত্বরেও বেশ কিছু লোক বসে। বিয়ের জন্যে আনা মাইক্রোফোন বৈঠকে ব্যবহারের ব্যবস্থা হয়।

দরবার হলের সব দরজা খুলে দিলে হল ও চত্বর একাকার হয়ে যায়। বৈঠকের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সদ্য বিবাহিত বেন। বৈঠকে কথা বলেন ফিপা গোত্র সর্দার এবং নিয়ামওয়েজী গোত্র সরদার। তারা দুজনে আহমদ মুসা সম্পর্কেই কথা বলে। শেষে আহমদ মুসার পালা আসে। আহমদ মুসা সোহাইলি ভাষায় প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে। তারপর বলে, দুনিয়ার সাদা, কালো, পীত মানুষ সবাই মিলে এক জাতি। এক পিতা, এক মাতা থেকে আমাদের উদ্ভব। আল্লাহ মানবিক মর্যাদার দিক দিয়ে সবাইকে সমান বানিয়েছেন। এখানে আল্লাহর কাছে কেউ বড়, কেউ ছোট নয়। মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে দুনিয়ার কিছু স্বার্থবাদী মানুষ। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ চান দুনিয়ার মানুষ একে অপরের সহমর্মী, সহযোগী হয়ে দুনিয়ায়। শান্তির সমাজ কায়েম করুক। এই সমাজে মানুষ অতি ধনী হবে না, আবার খাদ্য, বস্ত্র, গৃহহীন হয়ে পড়ার মতো অতি গরিবও হবে না। দুনিয়ায় সব। মানুষ খেয়ে পরে নিজ গৃহে শান্তি ও স্বস্তির সাথে জীবনযাপন করতে পারে এর জন্যে প্রয়োজনীয় সব সম্পদ, উপকরণ ও জ্ঞান আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। কিন্তু দুনিয়ার কিছু মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে, ক্ষমতা ও সম্পদের মোহে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অস্বীকার করে মানুষের প্রভু হয়ে বসেছে। তাদের শোষণ, স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচারে বেশির ভাগ মানুষের জীবনে অপার দুঃখ-কষ্ট নেমে এসেছে এবং সমাজ ভরে গেছে অশান্তিতে। যা আমরা শুধু সোমবাওয়াংগা নয়, শুধু আফ্রিকা নয়, গোটা দুনিয়ায় দেখছি।

মানুষের জীবন থেকে নিপীড়নজাত দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে হলে মানুষের মধ্যে চালু করে রাখা বিভেদ, বৈষম্য দূর করতে হলে এবং মানব সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে-সব মানুষকে, বিশেষ করে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালীদেরকে আল্লাহর আদেশ, নিষেধ মেনে চলতে হবে এবং সব মানুষকে একে অপরের সহমর্মী, সহযোগী ও সমর্থক হতে হবে। প্রিয় ভাইসব, আমার কথাগুলো কল্পনাপ্রসূত নয়, দিবাস্বপ্ন নয়। আমাদের রাসুল (সা.) এবং তাঁর অনুসারীগণ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ধরনের নিপীড়ন, বিভেদ, বৈষম্যহীন শান্তি ও স্বস্তির সমাজ গঠন করেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছিল। অপরাধ সেখান থেকে এতটাই বিদায় নিয়েছিল এবং শান্তি, নিরাপত্তা সেখানে এতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, একজন সুন্দরী যুবতী নারী বহুমূল্যের অলংকারে সজ্জিত হয়ে একাকি হাজার মাইল পথ চললেও তার শরীর কেউ স্পর্শ করেনি, তার অলংকারেও কেউ হাত দেয়নি।

আহমদ মুসা এইসব কথাসহ ককটা জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেছিল। তার সামনের হাস্যোজ্জ্বল কালো ও বাদামী মানুষেরা দীর্ঘ হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি হাততালি দিয়েছিল দুই সরদার, তাদের চারপাশের ঘনিষ্ঠজনরা এবং বেন ও জিজি।

আহমদ মুসার বক্তব্যের পর দুই গোত্রের মুসলিম প্রতিনিধিরা আহমদ মুসার সাথে দেখা করে।

অনেক কথা হয় তাদের সাথে।

সবশেষে আহমদ মুসা তাদের জিজ্ঞাসা করে এই মুহূর্তে তাদের বড় সমস্যা কি?

তারা বলেছিল, একটা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ তাদের খুব প্রয়োজন। তারা জানায়, এই রকম একটা মসজিদ হলে তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ একটা মুসলিম কম্যুনিটি গড়ে উঠতে পারে।

কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ তৈরিতে আপনাদের অসুবিধা কি? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।

 প্রতিনিধি দলের মধ্যে থেকে একটা মসজিদের ইমাম বলল, জামে মসজিদটি হাইওয়ের কাছাকাছি এলাকায় হলে দুই গোত্রের মুসলমানরা এখানে নামাজে জমায়েত হবার সুবিধা পাবে। কিন্তু এই এলকায় জমি পাওয়া কঠিন এবং ঐ রকম একটা মসজিদ তৈরির অর্থও আমাদের নেই।

পাশেই বসে দুই সরদার মনোযোগের সাথে আহমদ মুসাদের কথা। শুনছিল। ইমাম সাহেবের কথা থামতেই ফিপা সরদার আশা আরুশা বলে উঠে, দুই গোত্রের মধ্যে আমার বাড়িটাই সড়কের সবচেয়ে কাছাকাছি, প্রায় সড়কের লাগোয়াই বলা যায়। মসজিদ তৈরি পুণ্যের কাজ, পবিত্র কাজ। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের জন্যে জায়গা আমি দিতে চাই। সামনের চত্বরের ওপাশে উঁচু জায়গা যেখানে সম্মানিত মেহমান নামাজ পড়লেন, এটাই আমি মসজিদ তৈরির জন্যে দিয়ে দিতে চাই। উঁচু জায়গাটার সাথে একই প্লটে আরো এক বিঘা জমি আছে। গোটা পুটটাই আমি মসজিদের জন্যে দিয়ে দিতে চাই। আর মসজিদ তৈরির গোটা খরচ আমিই দেব।

আল-হামদুলিল্লাহ। বলে উঠে আহমদ মুসা।

আর ইমামসহ মুসলিম প্রতিনিধি দলের সকলেই সিজদায় পড়ে গিয়েছিল।

আহমদ মুসা সরদার আশা আরুশাকে লক্ষ করে বলে, জনাব অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি একটা খুব বড় ও মহৎ কাজের সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার মনে হয় আফ্রিকার এ অঞ্চলে এত বড় কাজ আর কেউ করেনি। আপনার দরবার হলের সামনে জুমআ মসজিদের চিত্র এবং নামাজ আদায়ের দৃশ্য আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি। সেই সাথে আমার মনে একটা কথা জাগছে জনাব। আমার মনে এই কথাটা খুব লাগছে যে, নামাজের সেই পবিত্র দৃশ্যে আপনি হাজির নেই। আপনার বাড়ির সামনে মসজিদ, সেখান থেকে দিনে পাঁচবার নামাজের জন্যে আহ্বান আসবে, কিন্তু নামাজে আপনি থাকবেন না! আহমদ মুসা থামল।

সরদার আশা আরুশা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

পরক্ষণেই তার মুখটি আবার হয়ে উঠল উজ্জ্বল। বলল, আমি যদি নামাজ পড়ি আপনি তাতে খুশি হবেন জনাব?

আমি আল্লাহর একজন সামান্য বান্দা। আমি তো খুশি হবোই। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ খুশি হবেন। বলল আহমদ মুসা।

সত্যি জগস্রষ্টা আল্লাহ খুশি হবেন? সরদার আশা আরুশা বলল। গভীর আবেগে তার কণ্ঠ কাঁপছে।

বলেই সরদার আশা আরুশা তার ডান হাত বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কীভাবে মুসলমান হতে হয় আমি জানি না। আমাকে আপনি মুসলিমদের ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত করুন।

আহমদ মুসা তার হাত ধরল। বলল, মুসলমান হওয়া বা ইসলামে প্রবেশ করা খুব সহজ। আপনাকে ঘোষণা দিতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মোহাম্মাদ (সা.) তার দাস ও রাসুল।

একটু থেমেই আহমদ মুসা সরদার আশা আরুশাকে বলল, জনাব গোত্রের গণ্যমান্যরা সবাই এখানে হাজির আছেন। আপনার সিদ্ধান্তের কথা তাদের জানালে আমার মনে হয় ভালো হয়।

ঠিক বলেছেন জনাব। যাই করি, তাদের নিয়ে বা জানিয়ে করাই ভালো।

 বলেই উঠে দাঁড়াল সরদার আশা আরুশা। তার নিজের উপস্থিত ঘনিষ্ঠজন ও গোত্রের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার প্রিয় ঘনিষ্ঠজন ও গোত্রের সম্মানিত ভাইয়েরা, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইসলাম আমাদের কাছে অপরিচিত ধর্ম নয়। এ অঞ্চলের বড় গোত্র ইয়াও এর সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে এবং আমাদের পিতৃ গোত্র বান্টুদের উত্তরসূরি অনেক শাখা-গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে। বান্টুদের ভাষা থেকে আসা সোহাইলি ভাষা, বলা যায় প্রায় মুসলিম ভাষায় পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আল্লাহর কাছ থেকে আসা পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম ইসলামকে সত্য ধর্ম বলে আমি মনে করি। এই বিশ্বাস নিয়ে এবং আমাদের প্রিয় মেহমানকে ইসলামের এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আমি পেয়ে তার কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

থামল সরদার আশা আরুশা।

সরদার আশা আরুশা বসার আগেই উঠে দাঁড়াল শুধু তার ঘনিষ্ঠজনরা ও ফিপা গোত্রের উপস্থিত লোকরা নয়, এক সাথেই উঠে দাঁড়াল নিয়ামওয়েজী গোত্র প্রধান দিগো দাইশাসহ তার গোত্রের উপস্থিত সবাই। সবাই সমস্বরে বলে উঠল, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করা সহজ-সরল সত্য ধর্ম ইসলাম আমরা সকলেই গ্রহণ করব সম্মানিত মেহমানের কাছে।

 সবার দাবি সম্মানিত মেহমানের কাছে বসে সবাই ইসলাম গ্রহণ করবে।

সবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অনুষ্ঠান শেষ হতে ভোর হয়ে গেল। আহমদ মুসা দুই সরদারকে বলল, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের সবাইকে নিয়ে ভোরের নামাজ, যাকে ফজর নামাজ বলে, পড়ে নিতে চাই।

তাহলে খুব ভালো হয়। বলল দুই সরদার খুশি হয়ে।

 আহমদ মুসা ইমাম সাহেবকে বলল, সবাইকে নিয়ে ফজরের নামাজ হবে এই ঘোষণা দিন। অজু করা শিখিয়ে দিন সবাইকে মাইকে।

মসজিদের জন্যে দান করা সেই উঁচু জায়গাতেই ফজরের নামাজ অনুষ্ঠিত হলো। আজান দিয়েছিল আঞ্চলিক এক মসজিদের ইমাম।

দুই গোত্রের মুসলমান যারা হাজির ছিল, তাদের একেকজনকে প্রত্যেক লাইনের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। সবাইকে বলা হয়েছিল মাঝের লোক যখন যা করবে, সবাইকে তা-ই করতে হবে।

আহমদ মুসা ফজর নামাজের জামাতে ইমামতি করেছিল। সুরা মুজাম্মিল ও সুরা ক্বাফ-এর অর্ধেক করে পড়েছিল আহমদ মুসা। আল্লাহর রাসুল (সা) ফজর নামাজের জামাতে এই দুই সুরা পড়েছেন বহুবার।

নামাজের সময় আবেগে সবাই কেঁদে ফেলেছিল।

নামাজ শেষে আহমদ মুসা তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেছিল, ভাইসব, আমাদের দুনিয়ার জীবন আশি, নব্বই, একশ বছরের বেশি নয়। কিন্তু মৃত্যুর পর আমরা যে জগতে প্রবেশ করব, সেখানে চিরকাল থাকতে হবে। মৃত্যু নেই সেই জগতে। দুনিয়ার জীবনে যে সৎপথে চলবে, ভালো কাজ করবে, তারা মৃত্যুর পরের জগতে চিরসুখের জান্নাত লাভ করবে। আর দুনিয়ায় যারা বিপথে চলবে, মন্দকাজ করবে, তারা মৃত্যুর পরে পাবে চিরদুঃখের জীবন দুঃসহ শাস্তির জাহান্নাম। আপনারা আজ ইসলামের পথে চলার যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তা আপনাদেরকে চিরসুখের জান্নাতে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এই জান্নাত লাভ করার জন্যে আপনাদেরকে আল্লাহর দেয়া আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধের মধ্যে প্রধান পাঁচটি হলো, আপনারা যে কালেমা পড়ে মুসলিম হলেন তা ভালো করে বুঝতে হবে এবং সবসময় পাঠ করতে হবে। আপনাদের নামাজ পড়তে হবে, বছরে একবার তিরিশ দিন রোজা রাখতে হবে। আপনাদের বাড়তি ধন-সম্পদ থাকলে তা থেকে গরিবকে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ দান করতে হবে। পারলে জীবনে একবার হজ্জ করতে হবে। আপনাদের আরো একটা বড় কাজ করতে হবে, সেটা হলো ভালো কাজ করার জন্যে মানুষকে উৎসাহ দিতে হবে এবং মন্দকাজ, অন্যায়, অত্যাচার করা থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

কথা শেষ করে একটু থেমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাইসব, আজই আমাকে চলে যেতে হবে। আপনারা এখানকার সবাই আমার ভাইবোন। আল্লাহ চাইলে ভাই-বোনদের দেখার জন্যে আবার আসা হতে পারে।

হাসিতে উজ্জ্বল মানুষেরা আহমদ মুসার শেষ কথায় হঠাৎ নির্বাক হয়ে গিয়েছে। প্রিয়জনকে হারানোর মতো বেদনা তাদের মুখে ফুটে উঠেছিল।

আহমদ মুসা চলে এলো তার বিশ্রাম কক্ষে।

তার সাথে এসেছিল দুই গোত্রের সরদার, বেন এবং আরো কয়েকজন। বেন রাতে বেশিক্ষণ আহমদ মুসার সাথে থাকতে পারেনি বিয়ের ফর্মালিটি পালনের জন্যে। কিন্তু ফজর নামাজের আগে সে এসে গেছে।

কক্ষে গিয়ে বেন আহমদ মুসাকে বলল, স্যার জিজি এসেছে। আমরা দুজন আপনার সাথে কথা বলতে চাই।

এখানেই আসবে? না আলাদাভাবে? বলল আহমদ মুসা।

 এখানেই আসতে পারে জিজি, আমি তো আছিই। গুরুজনরা আছেন, ক্ষতি নেই। বেন বলল।

নিয়ে এসো জিজিকে। বলল আহমদ মুসা।

জিজি এলো। বিয়ের কাপড়ে মোড়া। মুখটুকুই মাত্র খোলা। হাত মেহেদী রঙে ঢাকা। তার চোখে অশ্রু।

কক্ষে ঢুকেই সালাম দিল জিজি। কান্না ভেজা কণ্ঠ।

 আহমদ মুসা সালাম নিয়ে বলল, আনন্দের দিনে তোমার অশ্রু কেন জিজি?

স্যার, আল্লাহর প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতার অশ্রু এটা। আমরা যখন বিপদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যখন আমাদের উপর একটা অবাঞ্ছিত ধর্ম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যখন আমরা সর্বনাশা হানাহানির গ্রাসে পড়ে গেছি, সেই সময় আপনি আমাদের রক্ষা করেছেন, চার্চের ষড়যন্ত্রকে অবিশ্বাস্যভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছেন, আমাদেরকে নতুন ধর্ম দিয়েছেন, যা একমাত্র সত্য ধর্ম এবং আমাকে ও বেনকে দিয়েছেন নতুন জীবন। দুটি গোত্রকে রক্ষার জন্যে আল্লাহই আপনাকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও দয়ার জন্যে আল্লাহর যতই প্রশংসা করা হোক, সেটা কম হবে। মহান আল্লাহর সত্য ধর্ম গ্রহণে নেতৃত্ব দেবার জন্যে আমাদের দুই সম্মানিত সরদারকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আল্লাহ তাদেরকে উপযুক্ত যাযাহ দান করুন। থামল জিজি।

ধন্যবাদ জিজি। আমি তোমাদের দুজনের দুটি নাম ঠিক করেছি। তোমাদের পছন্দ…।

আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই জিজি বলে উঠল, নাম দুটি আমরা গ্রহণ করলাম। নাম বলুন স্যার।

 তোমার নাম ফাতিমা জাহরা জিজি। ফাতিমা জাহরা আমাদের রাসুল (সা.)-এর অতি আদরের কনিষ্ঠা কন্যার নাম। আর বেন-এর নাম বেন বেলাল। বেলাল রাসুল (সা.) এর একজন অতি সম্মানিত সাথীর নাম। রাসুল (সা.)-এর মসজিদে আসার জন্যে নামাজে মানুষকে আহ্বান করা। অর্থাৎ আযান দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব তার উপর ছিল। বলল আহমদ মুসা।

বেন ও জিজি এক সাথে বলে উঠল, আল-হামদুলিল্লাহ। নাম আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এমন নামে আমাদের খুব গর্ব লাগছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।

 দোয়া করি আল্লাহ তোমাদের ফাতিমা (রা.) ও বেলাল (রা.)-এর মতো পুণ্যবতি ও পুণ্যবান করুন। বলল আহমদ মুসা।

ভাই-বোনকে মুসলিম নাম দিলেন। ভাই-বোনদের বাবা-মায়েরা এবং অনেকেই মুসলিম নাম পেল না। বলল আশা আরুশা। তার মুখে হাসি।

  আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ইমাম সাহেবদের বলে দিয়েছি সকলের পছন্দ মতো মুসলিম নামকরণ করার জন্যে। আর আপনাদের কয়েকজনকে মুসলিম নাম আমিই দিয়ে যাব। আগের নির্দোষ, দেশজ নাম ঠিক রেখেই মুসলিম নামকরণ করা হবে।

আলহামদুলিল্লাহ। দুই সরদারই বলল।

 স্যার, আমাদেরকে ভাই-বোন বলেছেন। ভাই-বোনের একটা আবদার। আপনার কাছে আছে। রাখতে হবে। জিজি বলল।

আবদার যেহেতু, সাধ্য থাকলে রাখব। বলল আহমদ মুসা।

জিজি তার গাউনের ভেতর থেকে হাত বের করল। হাতে গোল্ডেন ভেলভেটের ছোট বক্স। বক্সটি বেন-এর হাতে তুলে দিয়ে বলল, দুজনের পক্ষ থেকে তুমিই দাও স্যারকে।

বেন ভেলভেটের কেসটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে স্মৃতি হিসেবে আমাদের স্যারকে, মহান

ভাইকে।

কি আছে এতে, খুলব? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

ন্যা স্যার, বাড়ি গিয়ে খুলবেন। আমরা চাই এই ক্ষুদ্র বাক্স আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাক। বলল জিজি।

ভালো কৌশল করেছ তোমরা। তবে দুঃসংবাদ হলো, আমি ককে বাড়ি পৌঁছব নিজেই জানি না। আহমদ মুসা বলল।

 এটা দুঃসংবাদ নয় স্যার

 আমাদের স্মৃতিবাহী বাক্সটা তো আপনার সাথেই থাকছে, ব্যাগের এক কোণায়। বলল বেন।

স্যার, আপনার পরিচয় জানি না। বাড়ি কোথায় তাও জানতে পারিনি? আমরা যাবার সুযোগ যদি করে উঠতে পারি! জিজি বলল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, মুসলমান হয়েছ। হজ্জ করতে তো যেতেই পার। হজ্জ করতে মক্কা শরিফ থেকে মদিনা শরিফে তাৈ যাবেই। গেলে আমাকে না পেলেও স্ত্রী, ছেলেদের পাবে।

তার মানে আপনার বাড়ি মদিনা শরিফে জনাব? বলল ফিপা সরদার আশা আরুশা।

 জি মদিনা শরিফে। সৌদি সরকার সেখানে একটা বাড়ি আমাকে দিয়েছেন। আমার জন্মভূমি কিন্তু সুদূর চীনের একটা প্রদেশে। আহমদ মুসা বলল।

এখন শুধু আপনার পরিচয়টা বাকি থাকল স্যার। চার্চের বিশপ বলেছিলেন যে, আপনার পরিচয় সাংবাদিকের চেয়ে বড় কিছু। সেই থেকে আমাদের মনে দারুণ কৌতূহল। আপনার পরিচয় যদি ঢেকে রাখার মতো হয় তাহলে আমরা কি তা ঢেকে রাখার মতো বিশ্বাসী নই? বলল। নিয়ামওয়েজী গোত্র প্রধান দিগো দাইশা।

আহমদ মুসা মুখ নিচু করল মুহূর্তের জন্যে। তারপর মুখ তুলে ধীরে ধীরে বলল, আমি যে নাম বলেছি, আবু আব্দুল্লাহ, সেটাও সঠিক নয়। এই নামের পাসপোর্ট নিয়েই আমি নেমেছিলাম দারুস সালাম এয়ারপোর্টে। নাম গোপন করা সত্তেও শত্রুপক্ষ জানতে পারে আমি দারুস সালাম বিমানবন্দরে নামছি। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনেই তারা আমাকে কিডন্যাপ করে এবং কফিনে পুরে পরবর্তী ফ্লাইটে আমাকে লুসাকা নিয়ে আসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, দুই একদিনের মধ্যেই আমাকে আমেরিকায় পাচার করা। কিন্তু তার আগেই তাদের বন্দিখানা থেকে নিজেকে মুক্ত করি। আমি শত্রুদের থেকে সাবধান থাকার জন্যেই আমার পরিচয় গোপন রেখে চলি।

আপনার এত শত্রু কেন? বলল জিজি।

 গতকাল চার্চের ঘটনায় চার্চ অর্থাৎ এখানকার খ্রিস্টানরা এখন আমার শত্রু হয়ে গেছে। এভাবেই দুনিয়া জুড়ে আমার শত্রু সৃষ্টি হয়েছে। আহমদ মুসা বলল।

আপনি বুরুন্ডির বুজুমবুরায় যাচ্ছেন কেন? জিজ্ঞাসা বেন-এর।

বুজুমবুরার সব বিষয় আমাকে জানানো হয়নি। তবে এটুকু জানতে পেরেছি, এই অঞ্চলের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজে মুসলমানদের মধ্যে সবার নজরে পড়ার মতো কোনো প্রতিভা দেখা গেলেই সে নিহত হয়, অথবা গুম হয়। আবার কারো কারো লেখা পড়াই বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় বা কিছুই করতে পারছে না। বুজুমবুরায় বুরুন্ডি বায়তুর রহমান জামে মসজিদের একটি মুসলিম মিশনারী ইউনিট আছে। মক্কা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামীর সহযোগিতায় এই মিশনারী ইউনিট এবং মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিশনারী ইউনিটটি স্থানীয় মুসলিম সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় বুরুন্ডির মুসলমানদের ভালো মন্দের দেখাশোনা করে এবং মসজিদ, মাদ্রাসাসমূহেরও দেখভাল করে। ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের প্রচার প্রসারে এই মুসলিম মিশনটি কাজ করে থাকে। গত কয়েকদিন আগে মুসলিম মিশনের তিনজন মোবাল্লেগ একই সাথে নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশ কাউকে ধরা তো দূরে থাকুক কাউকে সন্দেহ পর্যন্ত করতে পারেনি। বুজুমবুরাসহ বুরুন্ডিতে মুসলমানদের মধ্যে একটা নীরব আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে কেন এসব ঘটছে, কে ঘটাচ্ছে তার অনুসন্ধানেই আমি সেখানে যাচ্ছি। বলল আহমদ মুসা।

একটা দেশের পুলিশ বাহিনী এই সব সাংঘাতিক ঘটনার কোনোই হদিস করতে পারবে না, কাউকে ধরার মতো সন্দেহও করতে পারবে না, তা হয় কি করে? বলল ফিপা গোত্র প্রধান আশা আরুশা।

অনেক সময় অপরাধী পক্ষ যদি বড় হয়, খুব কুশলী হয় কিংবা খুব গভীর পানির মাছ হয়, তাহলে পুলিশ জানতে নাও পারে, আবার জানতে দেরিও হতে পারে। এছাড়া অপরাধী চক্র যদি পুলিশের চেয়ে বড় হয়, তাহলে পুলিশ নীরব হয়ে যেতে পারে। অথবা তাদের কথামতো পুলিশকে তদন্ত চালাতে হতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে কোনটা সত্য আল্লাহ জানেন। আহমদ মুসা বলল।

কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল ফিপা সরদার আশা আরুশাকে লক্ষ করে, জনাব, আমি দশটার দিকে যেতে চাই।

আপনাকে আটকানো যাবে না। আপনি তো যাবেনই। কিন্তু আমরা যদি আপনাকে অন্তত কয়েকদিন সাথে পেতাম, আমাদের অনেক উপকার হতো। বলল ফিপা সরদার।

আমিও খুশি হতাম জনাব। কিন্তু থাকার উপায় নেই। আহমদ মুসা বলল।

কিন্তু আপনার নামটা জানতে পারব না স্যার? জানা নামটা তো আসল নয়। বলল জিজি। নরম ও বিনীত তার কণ্ঠস্বর।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমার নাম দিয়ে তোমরা কি করবে। নামের সাথে তো আর পরিচয় লেখা থাকে না। তবু নামটা তোমাদের কাছে থাক। আহমদ মুসা লিখে লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে অন্তত কিছু জানতে পারবে তাদের মতো করে যারা ইন্টারনেটে আমার কথা লিখেছে।

আপনি আহমদ মুসা! স্যার ধন্যবাদ আপনাকে। বলল বেন ও জিজি একই সাথে।

ইন্টারনেটে আপনার সম্পর্কে জানা যাবে কোন সাইটে? জিজ্ঞাসা সরদার আশা আরুশার।

যে কোনো সার্চসাইটে কিংবা উইকিপিডিয়াতে গেলে পাওয়া যাবে। বলল আহমদ মুসা। নাস্তার ডাক এলো।

নাস্তা এসেছে, চলুন সবাই। দরবার হলের ওপাশের হলটাকেই সাজানো হয়েছে নাস্তার জন্যে। চলুন উঠি সবাই।

বলে উঠে দাঁড়াল সরদার আশা আরুশা। বলল, মা জিজি তুমি ভেতরে যাও দেখ সব। আর বেন, তুমি মেহমানকে নিয়ে এসো। আমি এগোচ্ছি, ওদিকটা দেখি।

সরদার আশা আরুশা ঘর থেকে বেরুল। তার সাথে সরদার দিগো দাইশাসহ অন্যরাও।

আহমদ মুসা ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে তৈরি হতে লাগল নাস্তার ওখানে যাবার জন্যে।

নাস্তা শেষে আহমদ মুসা সরদার দুইজনের সাথে আধাঘণ্টার মতো কথা বলে শুয়ে পড়ল কিছুটা ঘুমিয়ে নেবার জন্যে। ঘুম থেকে উঠেছিল আহমদ মুসা পুরো দুই ঘণ্টা পর।

ঘুম থেকে উঠেই রেডি পেল চা।

অজু করে ফ্রেশ হয়ে চা খেল আহমদ মুসা। চা খাওয়ার পর হ্যান্ডব্যাগ গুছিয়ে নিল সে। বুঝাই যাচ্ছে যাবার সময় তার আসন্ন।

.

গাড়ির দিকে এগোচ্ছে আহমদ মুসা। তার পেছনে দুই গোত্রের দুই সরদারসহ বলা যায় এক ঝাক মানুষ। এখানে মাকার বাড়ির মতো বিদায়ের সময় মানুষের অশ্রু মাড়াতে হলো আহমদ মুসাকে, কিন্তু অনেক চোখের বেদনার্ত দৃষ্টি তাকে অনেক কষ্ট দিল।

গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

পেছনে তাকাতেই সে দেখতে পেল বেন ও জিজি ছুটে আসছে তার দিকে। এসে দাঁড়িয়েই সরদার আশা আরুশার দিকে তাকিয়ে জিজি বলল, বড় বাবা, যাকে আপনারা বিদায় দিচ্ছেন তিনি কে জানেন, তিনি আজকের দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সংগ্রামী মানুষ। তার যুদ্ধ, তাঁর সংগ্রাম দুনিয়ার মজলুম মানুষদের রক্ষার জন্যে, শান্তির জন্যে আর ন্যায়ের শক্তির বিজয়ের জন্যে। মানুষের জন্যে তার লড়াইয়ে তিনি কখনো পরাজিত হননি। তিনি তাঁর শত্রুর কাছে অজেয় বলে গণ্য, বড় বাবা। বিপদগ্রস্তকে তিনি ধর্ম পরিচয় জাতি পরিচয় দিয়ে বিচার করেন না। বিপদকালে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন সকলকে তিনি সমানভাবে সাহায্য করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী, চীনের প্রধানমন্ত্রীর মতো মহামান্য লোকরা তাকে ভালোবা…।

 থামো জিজি। বলে আহমদ মুসা থামিয়ে দিল জিজিকে। বলল, ইন্টারনেটের কথা বলো না জিজি। ওরা যা ইচ্ছে তাই লিখে। আর জিজি কাউকে তার সামনাসামনি প্রশংসা করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। যা পড়েছ তোমরা, তা নিজেদের মধ্যেই রেখে দাও বোন। আমার নিজের কোনো শক্তি নেই, বুদ্ধি নেই, মেধা নেই। আমার যা আছে আল্লাহর দেয়া আমার প্রতি তার অনুগ্রহ। প্রশংসা করতে হলে আল্লাহরই করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।

জিজি কোনো কথা বলল না। তার ও বেন-এর দুচোখ থেকে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

সরদার আশা আরুশা বলল, জনাব, আপনার কথার উপর কথা বলা আমাদের জন্যে বেয়াদবী। কিন্তু গত বিশ-বাইশ ঘণ্টায় আপনার কাজের মধ্যে দিয়ে আপনার যে পরিচয় পেয়েছি, তা জিজি ইন্টারনেটে যা পড়েছে। তারচেয়ে আরো বেশি কিছু।

একটু থামল সরদার আশা আরুশা। বলল আবার, আল্লাহর হাজার শুকরিয়া আদায় করছি আমরা, আপনার মতো একজন মহান মানব দরদী বিশ্ববরেণ্য মানুষের হাতে ইসলাম গ্রহণ করতে পেরেছি। আপনার পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে আমার দরবার গৃহ, বিশ্রাম কক্ষ এবং আমার বাড়ি। নির্ধারিত মসজিদের জায়গায় নামাজ পড়ে উদ্বোধন করে গেলেন ভবিষ্যতের মসজিদকে। আল্লাহ আপনাকে অফুরন্ত জাযাহ দান করুন। আপনি শুধু রক্ষাই করেননি আমাদের দুই গোত্রকে, জিজি ও বেনকে বিয়ে দিয়ে এক করে গেলেন দুই গোত্রকে। বিশ-বাইশ ঘণ্টার এই স্মৃতি আমাদের জীবনের অক্ষয় সঞ্চয়। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সরদারের শেষ কথাগুলো।

 আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলল, আপনি আমার জন্যে দোয়া করুন, আমিও আপনাদের সকলের জন্যে দোয়া করছি। আল্লাহ যেন আপনাদের সোমবাওয়াংগাকে দক্ষিণ তানজানিয়ার জন্যে ইসলামের বাতিঘরে পরিণত করেন।

আহমদ মুসা সবার দিকে তাকিয়ে সবাইকে সালাম দিল এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল গাড়িতে উঠার জন্যে।

পেছন থেকে জিজির কণ্ঠ, স্যার আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন না? কান্না জড়িত কণ্ঠ জিজির।

আহমদ মুসা আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, তোমাদের সামনে কাজ অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি তোমরা ইসলামের উপর পড়াশোনা করো ও আরবি ভাষা শেখ। ইন্টারনেটে আরবি শিক্ষার অনেক কোর্স আছে। সে কোর্স ফলো করে আরবি ভাষা শেখা যায়। এরপর তোমরা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আরবি ভাষার উপর পড়াশোনা করো। এর সাথে সাথে তোমরা কোরআন ও হাদিসের উপর পড়াশোনা অব্যাহত রাখবে

 এরপর দেশে ফিরে যেকোনো পেশা নিতে পার, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিও করতে পার। কিন্তু তোমাদের মূল কাজ হবে ইসলামের প্রচার ও মানুষকে সাহায্য করা। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যবস্থা আমি করতে পারি।

আল-হামদুলিল্লাহ। পথ আপনি দেখিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ এই পথেই আমরা চলার চেষ্টা করব। বলল জিজি ও বেন।

আবার সালাম দিয়ে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। উঠে পড়ল গাড়িতে বিসমিল্লাহ বলে।

চলতে শুরু করল গাড়ি।

পাশের সিটে ছোট একটা স্টিল বক্স দেখতে পেল আহমদ মুসা। নিশ্চয় ওটা লাঞ্চ প্যাক। জিজি অথবা বেন-এর কাজ এটা অবশ্যই।

হাসল আহমদ মুসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *