লকেটের খোঁজ – শ্রীতম রায়
বই পত্র গুছিয়ে নিয়ে সামলে সুমলে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম বেশ রাত হয়েছে। সামনে পরীক্ষা। স্যার এতক্ষণ আমাকে পাখি পড়ার মতো করে বোঝাচ্ছিলেন। আমার সঙ্গী-সাথীরা অবশ্য আগেই চলে গেছে।আমি একা এতক্ষণ বসে পড়াশোনা করছিলাম । আলোকিত ঘরের মাঝে বসে খেয়ালই করতে পারিনি রাত কখন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেছে গভীরতার দিকে।
উঠে আসার সময় স্যার বলেছিলেন-‘আজ অনেকে রাত হয়ে গেল তোর,বাড়ি ফিরবি কি করে?’
আমি বললাম- ‘দেখছি স্যার এখনও দু-একটা বাস চলছে বোধহয় দেখি ধরতে পারি কি-না?’
‘না হলে অটো- টোটো যা পাবি ধরে বাড়ি ফের।রাস্তায় অযথা দেরি করার দরকার নেই..।’
—‘হ্যাঁ স্যার,তাই করছি, ‘ বলে তড়িঘড়ি স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নির্জন খাঁ খাঁ গলিটা প্রায় দৌড়ে পার হয়ে, বড় রাস্তার বাসস্টপেজে এসে দাঁড়ালাম।
হাত ঘড়িতে দেখলাম পৌনে এগারোটা বাজে।এমনিতে ছুটি হয় রাত সাড়ে নটা,কিন্তু পরীক্ষার দরুন দেরী হয়ে গেল ।
ইস! সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে।চমকে উঠলাম মনে মনে। শীতের রাত ,তাই এগারোটার মধ্যেই নেমে এসেছে গভীর রাতের নিরবতা ।আশপাশের বাড়ি ঘরের আলো নিভে গিয়েছে।দোকানপাটও বন্ধ। এছাড়া রাস্তাতেও কোনো আলো জ্বলছে না সেরকম ভাবে।মুহূর্তটা যেন থমকে আছে কোন কিছুর প্রতীক্ষায়।রাস্তার লোক চলাচলও কমে গেছে একেবারে। দু একজন পথিক আর প্রাইভেট গাড়ি যারা পথে রয়েছে তখনও, তাদের চলার মধ্যেও গন্তব্যে পৌঁছনোর ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কোনো রুটের বাসও চোখে পড়ছে না। আপ ডাউন কোন দিকেই নয় । মনে হয়,চলছে না এখন।কোনো অটো টোটোর ও তো হদিস নেই । ঘড়ি দেখলাম,প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি স্টপেজে।এখান থেকে বাড়ি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার হাঁটা পথ। যা বুঝছি হেঁটেই ফিরতে হবে। কিন্তু মন চাইছিল না,যা দিনকাল পড়েছে এখন !এদিক ওদিক তাকিয়ে উসখুস করে উঠলাম।নাহ্! বাসের আশায় দেরি করা ঠিক হবে না ।হাটাই শুরু করি । রাস্তায় কোনো যানবাহন পেলে না হয় ধরে নেব।
চাঁদের আলোতে সবে দু-পা এগিয়েছি,হঠাৎ পিছনে কোন কিছুর খসখস শব্দ ঘুরে দাঁড়ালাম । আবছায়া দেখলাম এক মহিলা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।পরনে কোনো হালকা রঙের গাউন।অত অন্ধকারে মহিলার বয়স অনুমান করতে না পারলেও বুঝলাম মহিলার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন- মাই বয়,এখানে কোনও লকেট পড়ে থাকতে দেখেছো রাস্তায়?’
অনুমান ঠিকই।তবে তিনি বিদেশিনী নন ।
এত রাতে বৃদ্ধা মহিলাকে রাস্তায় দেখে খুব আশ্চর্য হলাম।এর ওপর আরও আশ্চর্য হলাম বৃদ্ধার প্রশ্নে । ….কার লকেট ,কিসের লকেট এর কিছুই বুঝতে পারলাম না।
বিস্মিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে তিনি ফের আগের মতোই চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন-‘তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, রাস্তায় এই বাঁকটায়,তোমার আশেপাশে ,পায়ের কাছে কোনো লকেট পড়ে রয়েছে কি?দেখো তো মাই বয় একটু খুঁজে দেখো তো–? ‘
বৃদ্ধার অনুরোধে সেই অন্ধকারের মাঝেই ঝুকে ঝুকে দৃষ্টি চালিয়ে কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করার পরে তাকে জানালাম ,-‘না ম্যাডাম,সেরকম তো কিছু নজরে পড়ছে না । আপনার বুঝি…,হারিয়ে গেছে?’
-‘নাহ্! ওহো, নো নো মাই বয়,ওটা আমার নয়।আমার ছেলের।মাই ওনলি সন- টনি। টনির ওটা। ওর একুশ বছরের জন্মদিনে আমি ওকে একটা হার উপহার দিয়েছিলাম, লকেট টা তারই।ও সব সময় গলায় পড়ে থাকত ওটা। ‘
একটা সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধার বুকের অন্তস্থল থেকে।বাতাসের বুকে তা কেমন এক শীতল শিহরণ জাগিয়ে ঢেউ খেলে গেল আমার চারপাশে। আমি নিস্পলক চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আর যেন কোন সুদূর থেকে ভেসে ভেসে আমার কানে বেজে চলল তার ফিসফিসানি,-‘জানো মাই বয়, আমার ওই একমাত্র ছেলে,মাই অনলি সন টনি, কথা শুনল না।মিলিটারিতে নাম লিখিয়ে চলে গেল। তখন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার চলছে । এই ক্যালকাটা তেও বম্বিং শুরু হয়েছে।মাঝে মাঝে ওর চিঠি পেতাম। কখনো আফ্রিকার কোনো জায়গা থেকে,কখনো ইউরোপের কোনো শহর থেকে।কাটাকুটিতে ভরা, ওর ছোট্ট চিঠি অনেক আশা জড়িয়ে নিয়ে আসতো আমার কাছে । ওই বিশ্বজোড়া নরকের আগুনের মাঝেও, ও বেঁচে আছে জেনে আমি খুব স্বস্তি পেতাম। ওর ঘরে ফেরার আশায় দিন গুনতাম বুক বেঁধে।
লাস্ট চিঠিটা এল মিলিটারি হাইকমান্ড অফিস থেকে।ওর গলার লকেট টা পাঠিয়ে আমায় জানালো, ও মারা গেছে! সব শেষ! সব শেষ!অল ফিনিশড্!’ একটা ঝড়ো বাতাসের মতো হাহাকার তুলে বৃদ্ধা থামলেন।
আমারে সর্ব শরীর শিউরে উঠলো।সভয়ে বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করলাম।এই অন্ধকারে শীতের রাতে,নির্জন রাস্তায় এ কার পাল্লায় পড়েছি আমি?কোন বিকৃত মস্তিষ্ক-টস্তিষ্ক কেউ নাকি!
কিন্তু কিছু বলার বা করার আগেই বৃদ্ধা পুনরায় বলতে শুরু করলেন -‘মাই বয়, তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি তুমি তখন এই পৃথিবীতে আসোনি এ সেই সময়ের কথা । তা একসময় মহাযুদ্ধ থেমে গেল একদিন।কিন্তু আমার ছেলের মত ক-ত ছেলে আর ফিরে এলো না তাদের বাবা-মায়ের কাছে। আমার মত ক-ত অভাগিনী মা ,তাদের হারানো ছেলের স্মৃতিটুকু শুধু আজীবন ধরে রাখল নিজের মনের গভীরে আপন করে। যেমন আমার কাছে থাকতো ওই লকেটটা,বুঝলে মাই বয়! শেষে আমারও একদিন শেষ হল সব।সব দুঃখ -শোক কাটিয়ে গেলাম প্রভু জোসেফের পায়ে আশ্রয় নিতে। আর ওই লকেটটা, সেও ঠাঁই পেল আমার পার্থিব দেহের সঙ্গে মাটির নিচে।
কিন্তু কি জানো মাই বয়? পৃথিবীতে কোথাও-না-কোথাও কোনো না কোনোভাবে লড়াই চলছেই ….। অস্তিত্বের লড়াই ,আর ওতেই হেরে গিয়ে আমি আমার ছেলের শেষ সেই স্মৃতিচিহ্নটুকু কেও হারিয়ে ফেললাম।
ততদিনে আমার পার্থিব দেহ কফিনের কাঠের সাথে মিশে গেছে ধুলোয়-ডাস্ট-টু ডাস্ট! কটা জরাজীর্ণ হাড়ের টুকরোর সঙ্গে শুধু ওই পুরনো, স্মৃতি জড়ানো আমার ছেলের লকেটটা নিয়ে আমি শুয়ে আছি মাটির গভীরে।
কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে হঠাৎ একদিন গাইতি আর শাবলের আঘাতে আঘাতে আমি শিউরে উঠলাম।কিন্তু কি-বা করার আছে তখন আমার..।আমার দেহাবশেষ ওরা বেলচায় তুলে গাড়িতে করে উঠিয়ে নিয়ে গেল দূরে, অনেক দূরে…।
সেই সময়ই আমার ছেলের স্মৃতিচিহ্ন -আমার শেষ সম্বল, ওই লকেটটা এইখানেই কোথাও পড়ে গিয়েছিল । তা জানো, আমি আসি আমার ছেলের জন্মদিনের রাতে।আমি আসি সেই হারিয়ে যাওয়া লকেটের খোঁজে,কিন্তু খুঁজে পাইনা ,কোথাও সেটাকে খুঁজে পাইনা।মাই বয়,এই নতুন রাস্তা টা আমার সেই কবর ভেঙেই তৈরি হয়েছে না!
আর তুমি ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো এখন, ওইখানেই ছিল আমার সেই কবরটা। দেখতো একটু খুঁজে লকেট টা এখানেই কোথাও পড়ে আছে,কিনা?
বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ল,ঠিকই তো- বাবা,জ্যাঠা দের মুখে শুনেছি এই জায়গারই পাশে ছিল খ্রিস্টান বসতি । লোকে বলত সাহেবপাড়া। আর এইখানেই ছিল কবরস্থান । কিন্তু সে তো বহুদিন আগের কথা।আমি হতভম্ব হয়ে বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বৃদ্ধার কথাগুলি আমার কানে আসছিলো ঠিকই কিন্তু কেমন এক সম্মোহিতের মত আমার শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল।তাহলে আমার সামনে কে !সহসা এক অমানুষিক ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলাম।একটা ভয়ার্ত চিৎকারের শব্দ আমার গলা ভেদ করে বেরিয়ে এলো, ‘আ……!’ আর সেই চিৎকারের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দেখলাম, বৃদ্ধার শরীর কুয়াশার মতো ভাসতে-ভাসতে এলোমেলো হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।
এই ঘটনার অপার্থিবতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম, যদি না ঠিক সময় এক টোটো এসে পড়তো সেখানে।
টোটো থামিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল আমায়-‘ কি বাবু কি করছো? ‘
সম্বিত ফিরে পেলাম টোটো চালককে সামনে দেখে ।ধীরে ধীরে মন থেকে ভয়টা কেটে যাচ্ছে। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম-‘তুমি কিছু দেখেছো,এখানে?’
সে অবাক হয়ে বললো-‘ না-তো! আমি শুধু দেখলাম একা একা সামনের দিকে চেয়ে তুমি কি সব বিড়বিড় করছো ।তা তুমি কিছু দেখেছ নাকি?জায়গাটা ভালো নয়। কৌতুহলী হয়ে উঠল টোটো চালক।
তার কৌতূহল মেটাতে তার কাছে আমার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলাম না শুধু বললাম -‘না-না,কিছু না, তা আমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে তুমি?’
রাজি হল সে ।টোটোতে উঠে বসলাম।টোটো এগিয়ে চলল কুয়াশার ঘেরাটোপে ঢাকা শীতার্ত রাতের নির্জন রাজপথ মাড়িয়ে আমার বাড়ির দিকে।
চলন্ত টোটোয় বসে শীতল বাতাসের স্পর্শে শরীরের সজীবতা ফিরে পাচ্ছি ধীরে ধীরে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম।চোখে পড়ল আবছাভাবে বৃদ্ধার সেই কবরস্থানের জায়গাটি এখন যা বাস স্টপেজ হয়েছে। ধীরে ধীরে কুয়াশার অন্ধকারে তা মিলিয়ে যাচ্ছে।
তখনই বুকের কাছটা মোচড় দিয়ে উঠল।অনুভব করলাম একজন মা কতটা স্নেহময়ী হতে পারে নিজের সন্তানের জন্য…।
সেই মুহূর্তে মনে হল যেন কানের কাছে যেন শুনতে পেলাম,-‘এক চিরন্তনী মাতৃত্বের আকুল আর্তি…
মাই বয় দেখতো একটু খুঁজে লকেট টা এখানেই কোথাও পড়ে আছে কি-না?