নিতাই – তুহিন বন্দ্যোপাধ্যায়
এক
আজ কালীপুজো ; যেই সেই তিথির পুজো নয়, একেবারে ভাদ্র মাসের কালীপুজো। ছোটবেলায় এই দিনটি বড়ই ভয় পেতাম। গুরুজনরা বিশেষ করে আমার ঠাকুমা বলতেন, “এই দিনটি খুবই মারাত্মক হয়, রাত হলেই নানান অপদেবতা মর্তে এসে ঘুরে বেড়ান “। আমি ভয়ে বাইরে তো বেড়োতামই না, উপরন্তু ওই পচা গরমে শোয়ার সময় জানালা দরজা ভালো করে দিয়ে শুতাম, যাতে কোনো অপদেবতা উঁকিটি পর্যন্ত না মারতে পারেন। সে সময় আবার লোডশেডিং হলে দের দু ঘন্টা আগে আসতোনা, এমনকি বেশ রাতে লোডশেডিং হলে তো ব্যস, সারারাতের কারবার,এমন বহু রাত্রি জাগতে হয়েছে গরম আর মশার দংশন নিয়ে। আর এই মাহেন্দ্রক্ষণ যদি একসাথে কোনো বছরের ভাদ্র মাসের ওই দিনটি তে হতো, মানে ওই কালী পুজোর দিন লোডশেডিং হতো তবে একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ, ঘুটঘুটে অন্ধকারে চুপটি করে মায়ের আঁচলে তলায় থাকা ছাড়া উপায় ছিলোনা।
এমন ভাবেই বড় হয়ে উঠলাম, আর ধীরে ধীরে মগজের শিক্ষা এই সমস্ত দিনের ভ্রান্তি কে ক্রমশ হাস্যকর করে তুলতে লাগলো। তাই আজও আমি যখন আমাদের পাশের চক্কোত্তি বাড়ির কালীপুজো দেখছিলাম, পুরোনো সেইসব দিনের কথা মনে পড়তে লাগলো।
তবে সেই সঙ্গে আরো একটি স্মৃতির কথা আজ বড় মনে পরে গেলো। সেই ছোটবয়সের স্মৃতি, এবং সেটা বলার জন্যই আমার এই কাহিনীর অবতারণা।
আজ যখন মন দিয়ে পুজো করা দেখছি তখন পুরোহিত ঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণ শুনে কেমন যেন ঠিক জাগ্রত ভাবটি আসছিলো না। কিন্তু যার মন্ত্র পাঠ শুনে প্রতিটি শিরা উপশিরা দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে যেত, প্রতিটি রোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠতো, সেই নিতাই পুরোহিতের কথা খুব মনে পরে যাচ্ছিলো।
আজ থেকে প্রায় আঠারো উনিশ বছর আগেও এই বাড়ির মন্দিরেই এই প্রতিষ্ঠিত শ্যামা মায়ের সামনেই পুজো করতো। আসলে কালী পুজোই তার পেশা আর নেশা ছিল। যদিও পূর্ব পুরুষ প্রদত্ত ঐতিহ্য বহন নয়, একান্তই নিজের বাসনা আর ভক্তি তাকে এই পথে নামিয়েছিল। আমার ঠাকুমা বলতেন, নিতাই নাকি ছোট থেকেই খুব কালী ভক্ত ছিল। তাই পড়াশুনা ছেড়ে কালী পুজো নিয়েই বেশি মেতে থাকতো। তাদের পরিবার ছিল খুব গরিব, আর যেহেতু বাড়িতে পুজো আচ্চার বালাই ছিলোনা, তাই সে কালী পুজো করতো অন্য ভাবে। ব্যাপার টা হলো, বিশেষ অমাবস্যার তিথির দিনটি তে কালী পুজো হয়ে গেলে পরদিন বিসর্জিত কালির কাঠামো নিয়ে বাড়ি আসতো। এরপর দিন রাত এক করে সে কাঠামোতে পুকুর থেকে মাটি তুলে এনে প্রলেপ দিতো। শরীর গঠন হয়ে গেলে একটা গোলাকার মাটির ডেলায় চোখ মুখ জিব দিয়ে মাথা হিসেবে বসিয়ে দিতো। কালী আর শায়িত শিবের গায়ে আলকাতরা রং মাখাতো, চোখ জিব হাতের তালু আলতা রঙে রাঙাতো, ব্যাস, নিতাই ঠাকুরের কালী মূর্তি তৈরী। ঠাকুমা বলতেন যে, ওই মূর্তি কী যে বীভৎস হতো বলার অপেক্ষা রাখেনা। সত্যি তো, ঐরকম চেহারা, তার ওপর মূর্তির মাথায় নেই চুল, ভয়ানক তো হবেই!এবার পুজোর পালা। সাঙ্গ পাঙ্গ জোটানো নিতাইয়ের অভাব ছিলোনা। পাঠকাঠির কাঠামো করে, নিজের মায়ের পুরোনো শাড়ি দিয়ে ঘিরে, ওপরে কঁচু পাতার চাউনি দিয়ে প্যান্ডেল তৈরী হতো, অন্য ছেলেরা ভাঙা নারকেল মেলায় মোম বাতি জ্বালিয়ে একটি লাঠির সাথে আটকে প্যান্ডেলের সামনে হ্যালোজিন লাইটের ব্যবস্তা করতো। রাতে বেশ ভালোই লাগতো। সকালে পুজো করতো স্বয়ং নিতাই ঠাকুর, মা মা করে কী মন্ত্র পড়তো সেই জানে, বলিও দিতো নিজে। এক্ষেত্রে বড় বড় কঁচু গাছের ডাট কেটে এনে তাতে তেল সিধুর মাখিয়ে “জয় মা ” বলে দা দিয়ে এক কোপে বলি সম্পূর্ণ হতো।
তো যার এতো ভক্তি তাকে কি আর কেউ আলাদা করতে পারে কালী মায়ের সেবা করা থেকে দূরে রাখতে? তাই একদিন নিজের প্রচেষ্টায় যথা যত নিয়ম পালন করে, পুজোর মন্ত্র শিখে সত্যি কারের একজন যথার্থ পুরোহিত সে হয়ে উঠতে পেরেছিলো। তিন চার বাড়ির যজমান হয়ে প্রতিষ্ঠিত কালী পুজো করে দিব্বি চলে যেত। বিয়েও করেছিল, ছেলেও একটা হলো, কিন্তু বৌ টা চলে কেন গেছিলো টা জানতে পারিনি। তবে ছেলেটাকে আমি দেখেছি, নাম ভ্যাবলা। ভালো নাম জানিনা, সত্যি ভ্যাবলা গোছের, উঠতে বললেন উঠতো, বসতে বললে বসতো। পাড়ার লোকের কাজ বিনা কৈফিয়ত এ করে দিতো।
নিতাই ঠাকুরের একটা আশ্চর্য ঠোঁটের গড়ন ছিল। ব্যাপারটা হলো, তার প্রায় সর্বক্ষণ সামনের পাটির দাঁত বের হয়ে থাকতো, অথচ দাঁতের মাড়ি কিন্তু উঁচু ছিলোনা। তাই কখন যে হাসতো আর কখন যে রাগ করতো বোঝাই যেতোনা। যেন সবসময় হেসে চলেছে।একদিন এক লোকের সাথে তার তুমুল ঝগড়া বাঁধে। সেই সময় তার মুখের অবস্থা দেখে আশেপাশের লোক হেসেই গড়াগড়ি খেয়েছিলো। গালাগাল দিচ্ছিলো, নানান কটু কথা বলছিলো, সপ্তমে সুর ছড়িয়ে ধমকাচ্ছিলো, অথচ মনে হচ্ছিলো সে সারাক্ষন হেসে হেসে এসব বলেচলছিলো। মানে এই দৃশ্য না দেখলে ঠিক বোঝানো যায় না। এমনকি যার সাথে ঝামেলা সেও নিজে একবার হো হো করে হেসে ফেলেছিলো।
দুই
যাই হোক এই বিচিত্র চরিত্রের মানুষটির পেছনে অনেক মানুষই লাগতো। বিশেষ তার এই ভক্তি নিয়ে টিকা টিপ্পনিও কম শুনতে হয়নি। আর সেই সব অবিশ্বাসীর বিদ্রুপ নিবারণের জন্যই সেই রাতে এক কান্ড করেছিল।
প্রতিবারের মতো আমার উৎসাহের ঘাটতি কম ছিলোনা।চক্কোত্তি বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির হৃদ্যতা বহু কালের। তাই অনুষ্ঠান হলে বলতে হয়না, আপনা থেকেই চলে যেতাম দরকারের সঙ্গী হতে। যদিও আমি ছোট ছিলাম তবুও ফুল সজ্জা, আলোক সজ্জায় সাহায্য করে ফেললাম। যেহেতু প্রতিষ্ঠিত শ্যামা মূর্তি, তাই ঠাকুর পাঁচদিন আগের থেকে নতুন করে রং করা হতো, তাতেও আমার উপস্থিতি থাকতো। বেশ এক দেড়শো লোক রাতে খাওয়ানো হতো, তার রান্না বান্নার লোক ও উপস্থিত হয়ে গেছিলো। সকাল বেলা নিতাই ঠাকুর এসে সরোজমিনে তদারকি করে গেলো। রাত পোনে ন’টায় চতুর্দশী ছাড়বে। সেই মতো করে সমস্ত বন্দোবস্ত হয়ে গেলো।
যথারীতি সন্ধ্যে থেকে ঢাকে কাঠি পড়লো। সমস্ত মন্দির চকমকি আলোতে উদ্ভাসিত, মাইকে শ্যামা সংগীত সকাল থেকেই বেজে চলছে। আমি সেজে গুঁজে মন্দিরে এলাম।বাড়ির মেয়েরা সব পুজোর কর্মে ব্যস্ত, ছেলেরা মায়ের সাজসজ্জায় নিপুন ভাবে নিযুক্ত। শ্যামা মায়ের মূর্তি তে কত যত্ন করেই না লাল পেড়ে বেনারসি শাড়ী, সোনার গয়না, রজনীগন্ধা আর গোলাপের মালা, রুপোর মুকুট আরো নানান শোনা রুপার অলংকারে সাজানো হয়েছিল। যেন রক্ত মাংসের মাতৃ প্রতিমা।লোকজন ভালোই হয়েছিল, সমস্তই প্রায় তৈরী হয়ে ছিল।
নিতাই ঠাকুর লাল পেড়ে ধুতি আর নামাবলী গায়ে মন্দিরের এক কোনায় বসে মায়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। অমন সময় বাড়ির কর্তা অমল ঠাকুর মন্দিরে এসে নিতাই ঠাকুর কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হাঁ রে নিত্য, তুই এবারও ভড়ে পড়বিতো?”
নিতাইয়ের চমক ভাঙলো, সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে বললো,” আজ্ঞে কত্তা। তবে একখান কথা ছিল।”
অমল বাবু বললেন,” বল কি কথা?”
উপস্থিত অমল বাবু ছাড়াও অনেক নিমন্ত্রিত, অনাহুত, আর বাড়ির লোক জন তো ছিলই। নিতাই হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে সে দাঁতের পাটি বের করেই বললো, “আপনারা সবাই একটু মন দিয়ে শুনুন আমার কথা।”
পাশে একটা ছোকরা ছেলেকে নিতাই বললো, “এই মাইকটার আওয়াজ কম কর। “সে ছোকরা মাইকের তদারকি করছিলো, নিতাইয়ের কথা মতো শব্দ কমিয়ে দিলো।
নিতাই শুরু করলো,”প্রতিবার আমিই যখন এই চক্কোত্তি বাড়ির মায়ের পুজোয় ভড়ে পরি তখন এইবার তার অন্যথা হবেনা। তবে এইবার টা একটু আলাদা হবে, তা আগে থাকতে জানিয়ে রাখছি।”
আমরা সবাই বেশ একটু আগ্রহ সহ মুখে চেয়ে থাকলাম যে আলাদা কি হতে পারে!
অমল বাবু প্রশ্ন করলেন, “কি রকম শুনি?”
নিতাই বললো, “বলছি কাকা; আজকের এই রাতের মাহাত্ম অনেক, মা জাগ্রত হন, নানা অপদেবতা মর্তে এসে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু আজ কাল এসব আর কেউ মানতে চায়না। তারা বলেন অপদেবতা বলে কিছু নেই। এই নিয়ে আমাকেও অনেকে অনেক হাসি ঠাট্টা করেছে। তাই আজ আমি প্রমান করে দেবো যে অপদেবতা বলে কিছু আছে।”
ভিড়ের মাঝখান থেকে কেউ একজন হেসে বলে উঠলো, “তুই বুঝি আজ ভুত হয়ে দেখাবি রে নিতাই?”- সাথে আরো জনা পাঁচেক সেই হাসিতে যোগ দিলো।
টিপ্পনি শুনে সাথে সাথে নিতাইয়ের চোখ যেন জ্বলে উঠলো, সেই হাসি মাখা দাঁত বের করে গর্জে উঠে আঙ্গুল তুলে সে হুঙ্কার দিয়ে বললো, “ওরে অবিশ্বাসীর দল! তোদের যদি এতোই অবিশ্সাস, তবে নিজে চোখে দেখবি আজ।”
আগেই বলেছি নিতাইয়ের রাগ দেখানো তে সকলে হেসে ওঠে, তাই এইবারও মৃদু হাসির গুঞ্জন শোনা গেলো বটে, কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা তটস্থ ভাব ও আমি লক্ষ্য করলাম।
বিশেষত অমল বাবু ভিড়ের উদ্দেশ্যে একটু বিরক্ত হয়েই বললেন,”আআআআ, ইয়ার্কি ঠাট্টা নয়!” তারপর নিতাইয়ের দিক চেয়ে বললেন, “তা করবি তা কি?”
নিতাই কিছুটা শান্ত হয়ে অথচ দৃঢ় স্বরে বললো, “আজ রাত একটায় আমি ভরে পড়বো। সেই সময় আমাকে কেউ ছোবেননা। আমি আজ আপনাদের সকলকে ব্রম্মদৈত্ত দেখাবো।”
বলে কি! ব্রম্মদৈত্ত! আমার তখন কাঁচা বয়স, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তা এখনো মনে করতে পারি। নিতাই ঠাকুরের দিকেও যেন তাকাতে ভয় করছিলো। চোখ দুটো যেন লাল রক্তবর্ণ, গলা থেকে মোটা উপবীত কোমর পর্যন্ত ঝুলছে, কপালে রক্ত চন্দনের মোটা করে টিপ লেপা। ক্ষণকালের জন্য ওকেই ব্রম্মদৈত্ত মনে হচ্ছিলো।
সবাই প্রায় নির্বাক। কিন্তু অমল বাবু কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, “এসব আবার কি ছেলেমানুষি নিতাই, যারা বিশ্বাস করেনা তারা নাই করতে পারে, তাতে তোর বা আমার কী এসে গেলো?”
নিতাই কিন্তু আজ দমলোনা, বললো, “ক্ষমা করবেন কাকা, কিন্তু মায়ের আদেশ অমান্য করতে আমি পারবোনা।”
অমল বাবু অবাক হয়ে বললেন,” মায়ের আদেশ মানে?”
-“মানে কাল রাতে মা আমায় স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন যে আমি যেন প্রমান করে দিই যেমন দেবতা আছেন তেমনি অপদেবতাও আছেন।”
নিতাইয়ের ভক্তির ওপর অমল ঠাকুরের একটু দুর্বলতা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন নিতাইয়ের তারা মায়ের প্রতি টান তা একটু আলাদা। তাই তার কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারলেন না, বরং বললেন, “বলিস কী, স্বপ্নাদেশ!তা আমাদের বাড়ি তে তো সবাই বিশ্বাসী, তুই কী এখানেই দেখাবি?”
নিতাই আশস্ত করে বললো, “না কাকা,ভয় নেই;আমি ভড়ে পরে সোজা শ্মশানে চলে যাবো, ওখানেই দেখতে পাবেন।” তারপর জনতার উদ্দেশ্যে বললো, “যাদের বুকের পাটায় দম আছে তারা যেন যায় আমার পেছন পেছন, সব সত্য মিথ্যা প্রমান হয়ে যাবে।”
ভিড়ের মধ্যে জনা পাঁচেক বলে উঠল, “হাঁ যাবো যাবো, দেখবো তোর ব্রম্মদৈত্ত কেমন দেখতে!”
অমল বাবু কী যেন ভাবলেন তারপর বললেন, “তাহলে আমিও যাবো, মায়ের চ্যালা বলে কথা। অমান্য করি কী করে!”
অমনি অমল বাবুর পাঁচ ছেলেও বলে উঠলো, “তাহলে আমরাও যাবো।”
নিতাই সম্মতি জানিয়ে বললো, “তাহলে বেশ, ওই কথাই থাকলো, ঠিক একটায়।”- বলে পুজোর কাজ তদারকি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
এইদিকে আমার অবস্থা যে কী তা বলে বোঝানো অসম্ভব। ভুত দেখাবে, তাই ইচ্ছেও করছে যেতে, আবার ভয় ও করছে; আর শুধু ভুতের ভয়ই শেষ নয়, মা বাবার শাসনের ভয় তাও ছিল। তবু কী করে যে বুঝিয়ে ছিলাম, ঠাকুমা কেনই বা যেতে দিয়েছিলেন, তা আজ আর মনে পরে না। সাথে মধু ছিল, আমার বন্ধু, সে যেতে রাজি হওয়াতে হয়তো যেতে পেরেছিলাম।বয়সে দুই বছর বড় ছিল, তবু একসাথে খেলা ধুলো করতাম বলে ভালো বন্ধু ছিল।সে আমার সঙ্গী হবে তাই ভয়টা তখন একটু কম লাগছিলো।
যাইহোক, যথারীতি খেয়ে দেয়ে তৈরী হয়ে পুজোর সময় মতো মন্দিরে মধুর সাথে এসে জড়ো হলাম। দেখলাম ভিড় তা ভালোই। বুঝলাম ব্রম্মদৈত্ত দেখানোর কথাটি বেশ ভালোই চাউর হয়েছে।তাছাড়া লোকে যতই টিপ্পনি কাটুক, নিতাইয়ের ভড়ে পড়া সর্বজনবিদিত।সে দেখতেও লোকের অভাব কখনো কম দেখিনি।
ঠিক আটটা পঞ্চান্নতে নিতাই ঠাকুর পুজোয় বসলো। ধীরে ধীরে ঢাকের বোলের সাথে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হলো। অমল ঠাকুর আর বাড়ির সকলে হাত জোর করে পুজো মণ্ডপে বসে আরাধ্য দেবীর প্রতি ভক্তি সহকারে তাকিয়ে রইলেন।
তিন
এমন করে ঘড়িতে একটা বেজে উঠলো।নিতাই ঠাকুর ভড়ে পড়লো।
সেকি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সে মাথা বন বন করে ঘোরাতে শুরু করলো। “মা মা”- বলে সে কী ডাক! সমস্ত শরীর তার বার বার ঝাকুনি দিয়ে উঠছিলো। কখনো নিজের চুল ধরে টানছে, কখনো সামনে রাখা মনুষ্য করোটি হাতে নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে লাগলো, কখনো বা তেল সিঁদুর নিয়ে নিজেই নিজের মুখে মেখে নিলো।কখনো বা তারা মায়ের উদ্দেশ্যে সংস্কৃতে মন্ত্র বলে বলে হাতের কাছে যা পেলো ছুড়তে শুরু করলো। কখনো ফুল, কখনো ফল, আবার কখনো গামছা, এমনকি একবার পঞ্চ প্রদীপ নিয়ে ছুড়তে যাবে অমনি অমল বাবুর ছেলেরা ধরে নিরস্ত্র করলো। এদিকে জোর কদমে ঢাক কাশর ঘন্টা বেজে চলেছে। আমরা সকলে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। ওই অবিশ্বাসীর দলেরও অবস্থা তথৈবচ।
এমন কিছুক্ষন চলার পর হঠাৎ নিতাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে রাগে যেন ফুঁসতে লাগলো। সে কী মুখের ভঙ্গি! যেন এখনই আমাদের ঘাড় মটকে দেবে! তারপর একটু চুপ থেকে সামনের দাঁতএর পাটি বের করে ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কর্কশ স্বরে আমাদের উদ্দেশ্যে বললো,”চল তবে শ্মশানে, কার কত হিম্মত দেখবো আজ”, -বলেই প্রায় এক লাফে আসন ছেড়ে বাইরে চলে এসে দ্রুত পদে হাঁটা শুরু করলো। সে জোড়ে জোড়ে “মা মা” করতে করতে এই নিশুতি রাতে শ্মশানের দিকে এগিয়ে চললো, আর পেছনে জনা দশেক লোক হারিকেন হাতে নিয়ে পেছন পেছন রওনা দিলো। অমল বাবু, তার ছেলেরা আর সব শেষে আমরা দুই বন্ধু অজানা আতঙ্কে গুটি গুটি পায়ে তাদের পিছু নিলাম।
হাঁটা পথে মিনিট দশেক সময়ের মধ্যে শ্মশানে এসে পৌঁছে গেলাম।তখন দেড়টা বাজে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু শ্মশান কালী মন্দিরে একটা বড় সলতের প্রদীপ জ্বলছে। কিছুক্ষন আগে হয়তো একটা মরা পোড়ানো হয়েছিল, তার প্রমান চিতার সামনে গেলেই বোঝা যায়। আশেপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক। পাশের ধু ধু প্রান্ত থেকে শিয়াল কুকুরের ডাক ও শোনা যাচ্ছিলো।
আমরা দুই বন্ধু সবার পেছনে একে অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ দিব্বি কানে আসছিলো।
এইদিকে নিতাই ঠাকুর চিতার পাশেই একটি উঁচু ঢিবির ওপর উঠে অট্ট হাস্যে সকলকে যেন আরো সন্ত্রস্ত্র করে তুলছিলো।যারা অবিশ্বাস করতো, তাদেরও মুখের অবস্থা খুব একটা আরাম দায়ক নয়।
যতই অন্ধকার থাকুক খোলা জায়গায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে বেশ কিছুটা দেখা যায়। আর তাই চিতার পাশেই যে যেখানে নিতাই দাঁড়িয়ে ছিল সেখান ঠিক হাত দশেক দূরে ছোট একটা পুকুর, আর তার ওপারের লম্বা লম্বা জিলিপি গাছ গুলো কালো কালো হয়ে দেখা যাচ্ছিলো।
নিতাই আর সময় নষ্ট না করে পুকুরের ওপারের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে কর্কশ স্বরে বললো, “তোরা অবিশ্সাস করিস তো, তবে দেখ তোরা ওপারে চেয়ে দেখ.. ব্রম্মদৈত্ত দেখ! ব্রম্মদৈত্তর নৃত্য দেখ!”-বলেই জয় মা বলে আবারো অট্টহাস্যে আকাশে পাতাল কাঁপিয়ে তুললো।
আমরা সকলে নিতাইয়ের কথা মতো পুকুরের ওপারে যথা সম্ভব তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।মিনিট দুই পর হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো।স্পষ্ট না হলেও দেখতে অসুবিধা হলোনা যে একটি দীর্ঘ দেহি সাদা শরীর যার মুন্ডু নেই, এমনকি হাঁটুর নিচ থেকেও নেই খালি গায়ে দাঁড়িয়ে মোটা গলায় জোড়ে জোড়ে হেসে চলছে। কাঁটা মুণ্ডুর বাম কাঁধ থেকে কালো মোটা একটা দড়ি কোমর পর্যন্ত ঝুলছে, পরনে সাদা ধূতি। হাঁ ব্রম্মদৈত্ত বটে!
-“ওরে বাবা রে!”- বলেই আমার বন্ধু আমায় ফেলে দিলো দৌড়। সামনে অমল ঠাকুর সহ আরো কিছু লোক ফিট হয়ে পরে গেলেন। তার ছেলেরা হারিকেন্ ফেলে কোনো ক্রমে তাকে তুলে ধরে বাতাস করতে লাগলো। কেউ কেউ নিজের অজান্তে মাটিতে বসে পরে জ্ঞান হারালো। আর আমার কথা কী বলবো?অনেক্ষন ধরেই আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। এখন সেটা কাঁপুনি তে গেলো।ভয়ে কেঁদে ফেললাম।পা আর যেন চলে না, যেন দু পায়ে শিকল দিয়ে পাথরআটকে রাখা আছে।
এমনি করে আরো সময় এগোলো। আমি অজ্ঞান হবো হবো করছি, হঠাৎ ওপার থেকে ব্রম্মদৈত্ত একটা বিকট শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠলো। ভয়ে ঠিক তখন খেয়াল করিনি, তবে “বাবা গো ” গোছের কিছু একটা হবে পরে বুঝেছিলাম। সাথে সাথে ব্রম্মদৈত্ত অদৃশ্য হলো। কোথায় গেলো ওতো ভেবে দেখার সময় নেই কারো। শুধু বুঝতে পারছিলাম এবার পালাতে হবে, কারণ তেনাকে আর দেখা যাচ্ছেনা, এপারে এসে নৃত্য করলে ভবসাগর পাড় নিশ্চিত। অমল ঠাকুরের ছেলেরা তাকে কাঁধে তুলে আমায় বললো, “কষে দৌড়া!”
আমিও চোখ বুঝে দিলাম ছুট। ঐটুকু পথ যেন কয়েক ক্রোশ মনে হতে লাগলো। ঝোপ ঝাড় রাস্তা পেরিয়ে দৌড়ে চলেছি, পায়ে চটি কোথায় কখন খুলে গেছে জানিনা। এর আগে এমন কখনো ছুটেছি বলে মনে পরে না। যাইহোক সোজা বাড়ির সামনে এসে যখন ঘেমে নেয়ে স্নান করে ধপাস করে পরে দরজায় কড়া নেড়েই অজ্ঞান হয়ে গেলাম তখন হয়তো সবে আড়াইটে হবে।
পরদিন সকালে যখন জ্বর নিয়ে ঘুম ভাঙলো তখন বেলা এগারোটা বাজে। জ্ঞান হারিয়ে কী করে যে জ্ঞান এসেছিলো, কখন ঘুমোলাম কিছুই জানিনা।বলা বাহুল্য মা বাবা খুব চিন্তিত ছিল আমাকে নিয়ে। বকতেও পারছে না।
এদিকে ঠাকুমা এসে অন্য মাকে এক ঘটনা শোনালো। আমি তো শুনে অবাক!
ব্যাপারটা হলো, কাল থেকে নাকি নিতাই মন্দিরে ফেরেনি। আজ সকালে তাই তার খোঁজ করতে অমল ঠাকুরের ছেলেরা আরও কিছু লোক নিয়ে সেই শ্মশানে গিয়ে দেখে যে নিতাই মাথায় হাত দিয়ে তারই ছেলের মৃত দেহের সামনে বসে আছে। মুখ দিয়ে গেজা ঝরেছে হয়তো, তার চিহ্ন স্পষ্ট।সর্বাঙ্গে শাঁখের গুঁড়ো মাখা,পরনে ধূতি, পাশে রাখা এক খন্ড কালো কাপড়, হয়তো মাথা ঢাকা দিতে লেগেছিলো, হাঁটু থেকে ঢাকার জন্য আরো দু খন্ড কালো কাপড় পরে ছিল। এই সেই কালকের ব্রম্মদৈত্ত!
একটু ভেঙে বলা যাক।নিতাই অপদেবতা প্রমান করতে তার ছেলেকে কাজে লাগিয়েছিল। ছেলেও সে সুযোগ বেশ জমিয়ে নিয়েছিল। বিশেষত তার ভয় ভীতি একটু কম ছিল। আর তাই তার বাপের কথায় রাত হতেই সারা গায়ে শাঁখের গুঁড়ো মেখে তিনটে কালো কাপড় নিয়ে শ্মশানে চলে যায়। তারপর মুখ আর হাঁটু পর্যন্ত কালো কাপড় পরে পুকুরের ওপারে ওই অন্ধকারে অপেক্ষা করতে থাকে। নিতাইয়ের অট্টহাস্যর সংকেত পেয়ে সে ব্রম্মদৈত্ত রূপে সামনে আসে। কিন্তু জঙ্গলে যে অন্য প্রাণী থাকতে পারে সেই সাবধানতা হয়তো ভুলে গেছিলো। আর তাই হয়তো বা কোনো এক বিষাক্ত সাপের শরীরে পা পরে যেতেই সেও সেই কৃত্তিম ব্রম্মদৈত্তর পায়ে দাঁত বসিয়ে পালায়। “বাবা গো” শব্দ তা এখন যেন বড় কানে বাজতে লাগলো। তখন যেটা মাথাতেই আসেনি। ব্যস, সব শেষ।
যারা কালকে অজ্ঞান হয়েছিল, এমনকি অমল ঠাকুরের ছেলেরাও শোকার্ত নিতাইয়ের সামনে বীরত্ব ফলাতে লাগলো। অমল ঠাকুরও এর জন্য একমাত্র নিতাইয়ের নির্বুদ্ধিতা কে দায়ী করলেন, আর রাগে তার জজমানি চাকরি কেড়ে নিলেন।
নিতাই তার মৃত ছেলেকে আরো কিছু লোকের সাহায্যে ওই শ্মশানে পোড়ালো।কিন্তু তারপর থেকে নিতাইকে আর কেউ দেখতে পেলোনা। অথচ বাড়ির সব আসবাব পত্র, কাপড়জামা এমনকি তার সাধের কালী মূর্তি টি পর্যন্ত রয়েছিল। কিন্তু সে আর ফিরলোনা।
মাস খানেক বাদে সে নাকি একটা চিঠি লিখেছিলো অমল ঠাকুরকে। তাতে সে নিজের সব দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলো। কিন্তু আর যে সে ফিরবে না সেটাও বলেছিলো।বৃদ্ধ অমল ঠাকুর সে চিঠি পরে চোখের পাতা ভিজিয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম।
তবে আজ অবধি সেই নিতাই চক্রবর্তীকে ভুলতে পারিনি। সেই হাসি ভরা মুখ, সেই বিচিত্র মুখাবয়ব, সেই মন্ত্রোচ্চারণ,আর তেমন খুঁজে পেলাম কই?জানি অন্যায় করেছে নিজের ছেলেকে দিয়ে। তবু মানুষটা বড়ই দুর্লভ যে!তাই আজও এই কালী মায়ের সামনের আসনটি দেখলে অজান্তেই মনটা কেমন যেন করে ওঠে; মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।