ডাক – অমৃতা ব্রহ্ম
পরকাল সম্বন্ধে আমরা সকলেই কমবেশি অজ্ঞ। তবে শুনেছি কারোর পৃথিবী থেকে চলে যাবার সময় হলে নাকি সেখানকার বাসিন্দারা আসেন, তাঁদের প্রিয়জনকে ডেকে নিয়ে যেতে।
এরকমই একটি ঘটনার গল্প শুনেছিলাম আমার দাদুর কাছে। তিনি আবার শুনেছিলেন তাঁর জনৈক গুরুভাইয়ের কাছে!
যাক! এবার ঘটনায় আসি।
উনিশশো বারো/চোদ্দো সালের কথা।সদ্য-বিপত্নীক যামিনীরঞ্জন গুপ্তকলকাতা হাইকোর্টের ওকালতির পাট তুলে দিয়ে কাশীর পৈতৃক বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি।
যামিনীরঞ্জনের কাশীর বাড়িতে আত্মীয় সমাগম বেশি হত না। কেবল পুজোর সময়ে দুই ছেলে সপরিবারে এসে কয়েকদিন কাটিয়ে যেতেন। তাই বলে, তিনি মোটেই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন না। পরোপকারী, পরিহাসপ্রিয় যামিনীরঞ্জন অল্প দিনের মধ্যেই বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে স্থানীয় সবারই প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর একতলার সুপ্রশস্ত বৈঠকখানাটি নিয়মিত সান্ধ্য আড্ডা ছাড়াও নববর্ষে, বিজয়াদশমীতে, দোলে, জন্মাষ্টমীতে অতিথি-সজ্জনে পূর্ণ থাকত।
এইভাবে কাশীতে বছর বারো কাটানোর পর এক শারদোৎসবের শেষে ঘটনাটি ঘটল।
বিজয়াদশমীর সন্ধ্যায় প্রত্যেক বছরের মতো সেবারেও যখন যামিনীরঞ্জনের বাড়িতে তাঁর বন্ধুরা উপস্থিত হয়েছিলেন আর প্রৌঢ়-বৃদ্ধরা মিলে সাদর কোলাকুলির শেষে, সিদ্ধির সরবৎ,লাড্ডু, নিমকি, প্যাঁড়ার সঙ্গে গল্পে গল্পে চলছিল শুভ বিজয়া পালন, ঠিক সেই সময়েই বৈঠকখানার দরজায় এসে দাঁড়ালেন এক সধবা ভদ্রমহিলা। তিনি যামিনীরঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এবার চলো.. “
সমবেত ভদ্রলোকেরা তাঁদের অপরিচিতা এই মহিলার আগমনে ও কথায় বেশ কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লেন। সেই সময়কার প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নিরিখে, এভাবে প্রকাশ্যে কোনো ভদ্রমহিলার, হতে পারে তিনি গৃহস্বামীর বিশেষ পরিচিতা, তবুও এভাবে সম্বোধন করাটা বেশ অশোভনই ছিল, বাংলাদেশের বাইরে তো বটেই!
তাঁদের বিস্ময়-বিমূঢ়তার মাঝেই যামিনীরঞ্জন খুব স্বাভাবিকভাবে,”এসে গেছ?চলো তাহলে.. ” বলে যেন কোথাও যাবার জন্যই তাঁর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং পরমূহুর্তেই টলে পড়ে গেলেন মাটিতে-কার্পেটের ওপর। মহা গোলযোগ উঠল ঘরে, মাথায় উঠল পানভোজন। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কাশীর তখনকার দিনের বিখ্যাত কবিরাজ নিত্যধন বন্দ্যোপাধ্যায়। সবার ভীত দৃষ্টির সামনে তিনিই পরীক্ষা করে জানালেন, যামিনীরঞ্জন মৃত। আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর। শুনে, অতিথিরা, বেশিরভাগই যামিনীরঞ্জনের কমবেশি সমবয়স্ক বৃদ্ধ, খুবই ভয় পেয়ে গেলেন। অসুস্থও হয়ে পড়লেন কেউ কেউ। সেই গোলযোগের মধ্যে, রহস্যময়ী সেই নারী যে কোথায় চলে গেলেন, তাঁর খোঁজ করার কথা কারোরই মাথায় এলো না।
বিস্মিত যামিনীরঞ্জনের ছেলেরাও কিছু কম হন নি। ঘটনার সময়ে তাঁরা বাড়িতে ছিলেন না। কাশীতে তাঁদের বন্ধু-বান্ধবও কিছু কম নেই। গিয়েছিলেন তাঁদের একজনের বাড়িতেই-বিজয়া করতে। বৌমারা দুর্গাবাড়িতে গিয়েছিলেন সিঁদুর খেলতে।নাতি-নাতনিরা তাদের মায়েদের সঙ্গেই ছিল।বাড়ির লোক বলতে,কাজের লোক ভীখু ছিল দোতলায়। নীচে হৈ-চৈ শুনে নেমে এসে ব্যাপার দেখে সে ছুটল খবর দিতে। খবর পেয়ে ছুটে এসে যখন সব শুনলেন, শোকের থেকে বিস্ময়টাই যেন তাঁদের বেশি হল।
“…. কে ঐ মহিলা? বাবাকে কোথায় যেতে বলেছিলেন?তিনি নিজেই বা কোথায় চলে গেলেন? এই ঘটনার পর একবারও এলেন না কেন?”….. নিজেদের মধ্যে বহু আলোচনায়ও এসব প্রশ্নের উত্তর পেলেন না দুই ভাই।
উত্তর পেলেন ক’দিন বাদেই। বন্ধুর মৃত্যু শোক সামলে উঠে, বন্ধুপুত্রদের সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন জনার্দন চতুর্বেদী, সংস্কৃত চতুষ্পাঠীর প্রধান অধ্যাপকদের একজন। । সদর দরজা খোলা ছিল। কাজের লোকটি হয়তো কাছেই কোথাও গিয়েছিল। একতলা অন্ধকার দেখে তিনি উঠে এলেন ওপরে-এই প্রথম। এর আগে কখনো এই বাড়ির দোতলায় ওঠেন নি তিনি। যামিনীরঞ্জনের শোবার ঘরে বসেই তখন দুই ভাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নিমন্ত্রিতদের তালিকা লিখছিলেন। তাঁদের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েরা ছিলেন ভিতর দিকের ঘরে। যাই হোক, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে, বেরিয়ে এসে পিতৃবন্ধুকে ঘরে নিয়ে গেলেন তাঁরা। বসতেও বললেন। তবে চতুর্বেদী বসলেন না। তাঁর দৃষ্টি তখন সামনের দেওয়ালে নিবদ্ধ। দেওয়ালে ঝোলানো যামিনীরঞ্জনের পরলোকগতা স্ত্রীর অয়েলপেন্টিংটার দিকে দেখে তিনি বলে উঠলেন, “এই তো! সেই ভদ্রমহিলা, ঐ দিন যিনি এসে গুপ্তাদাদাকে ডেকেছিলেন, কে ইনি? “
দুই ভাইয়ের মুখে কোনো কথা যোগাল না। বিচক্ষণ বৃদ্ধ চতুর্বেদীও বুঝতে পেরেছিলেন, এ ঘরে,
এত বড়ো কার ছবি থাকতে পারে!
নির্বাক তিনজনের চোখের সামনে, ঘরের টেবিলের ওপর অস্থায়ীভাবে রাখা যামিনীরঞ্জনের ছবির সামনে ধূপের ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ঘুরছিল। ধোঁয়ার মধ্যে মনে হল যেন যামিনীরঞ্জনের মুখে একচিলতে হাসি খেলে গেল।