কবরবন্দি ইতিহাস – পৌলমী গাঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব-১
দিনের বেলাগুলো সুন্দর মনে হলেও রাতগুলোকে খুব ভয় পায় জুবেদা। সারাদিনটা একরকম ভালো কাটলেও কালো জটাধারী দস্যুর মত রাতগুলো এলেই শিউরে ওঠে সে! ভয়! এক অজানা ভয়! রাত যদি বিনিদ্র কাটানো যেতো তাহলে হয়তো এই অজানা ভয়ের থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসা যেত! কিন্তু প্রতিটা রাত কি বিনিদ্র কাটানো সম্ভব? না! সম্ভব নয়! কিন্তু দু চোখের পাতা এক করলেই যে সেই একই স্বপ্ন! বারবার, প্রতিবার! কেন আসে এইরকম স্বপ্ন তার? সে জানেনা! সে চেনেনা সেই স্বপ্নের স্থান, কাল, পাত্রগুলোকে! কোনদিন সেই জায়গা সে দেখেনি আজ পর্যন্ত! সেই মানুষগুলোকেও সে চেনেনা! কিন্তু শিউরে ওঠে সে প্রত্যেকবার স্বপ্নের শেষ পরিণতিটা দেখে! চোখ খুলতে চায় কিন্তু পারেনা খুলতে! কোন এক অজানা শক্তি যেন প্রত্যেকবার তাকে শেষটা না দেখা পর্যন্ত ঘুম ভেঙ্গে গেলেও চোখ খুলতে দেয়না! এ এক বিনিদ্র রাতের চেয়েও ভয়ংকর নিদ্রা যেন! এর কি কোন অন্ত নেই তবে?
জুবেদা, জুবেদা সুলতানা শ্রীনগরে থাকে তার আব্বু মুজিব রহমান, আম্মি সায়েদা বেগম আর ছোট ভাই রেহানের সাথে। মুজিবের নিজস্ব দুটি শিকারা আছে যেগুলো থেকে পর্যটকদের আসার সিজনে বেশ ভালই রোজগার হয়! তাছাড়া কাশ্মীরি শাল, সোয়েটার এসবের একটা ছোট্ট দোকানও ভাড়া নেওয়া আছে তার আর তারই সঙ্গে নিজেদের দোতালা বাড়িটার নিচের তলাটা পুরোটাই লজ করে রেখেছে পর্যটকদের জন্য! সবমিলিয়ে বেশ স্বচ্ছল অবস্থা জুবেদাদের। জুবেদার আম্মি লজটার দেখাশোনা করেন আর ওর আব্বু বাইরের কাজগুলো দেখেন, বেশ সুন্দর বোঝাপড়া দুই মিয়াঁ বিবির! জুবেদা এখন ক্লাস নাইনে উঠেছে! ভাই রেহান ক্লাস ফোরে পড়ে। ওরা দুজনেই সরকারি স্কুলে পড়াশুনা করে! জুবেদা ছোট থেকেই বেশ নম্র ভদ্র, শান্ত স্বভাবের মেয়ে! কাশ্মীরি মেয়ে হলেও জুবেদাকে যে কেউ চিনা মেয়ে ভেবে ভুল করতেই পারে! ফর্সা, চ্যাপটা নাক, চোখদুটো একটু ছোট ছোট! সবমিলিয়ে তাকে চিনা মেয়েদের সাথে গুলিয়ে ফেললে সেটা কারুর ভুল বলে বিবেচ্য হবেনা! জুবেদা সকালে উঠে আম্মিকে নাস্তা বানাতে সাহায্য করে। তারপর স্নান করে, খেয়ে দেয়ে, টিফিন নিয়ে ভাই রেহানের সাথে সকাল ৮টার মধ্যে স্কুলে চলে যায়। ওরা স্কুলে চলে যাওয়ার পর সায়েদা বেগম হাতের কাজগুলো মিটিয়ে মুজিবকে খেতে দিয়ে দেয় আর নিজেও দুটো খেয়ে নিয়ে লজের তদারকি করতে লেগে পড়ে! মুজিব সকাল ১০টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে দোকান খুলতে! লজটা সবসময় দেখাশোনা করা, গেস্টদের খাবার, জল দিয়ে আসা, এসবের জন্য একটা ছেলেকে রেখেছে তারা! ছেলেটা সায়েদার দূর সম্পর্কের লতায় পাতায় এক ভাই হয়, নাম রামিজ। যদিও সম্পর্কে ভাই কিন্তু বয়সের দিক থেকে রামিজ অনেকটাই ছোট সায়েদার থেকে! পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলে রামিজ সায়েদা আপার কথামত সব কাজ একা হাতে সামলে দেয়! সায়েদা লজের সামনের ছোট্ট রিসেপসনটাতে বসে গেস্টদের রিসিভ করে আর বাকি জিনিসগুলোও তদারকি করে একই সাথে! যখন কাজ হালকা থাকে তখন বাড়ি তথা লজের সামনের ছোট্ট বাগানটাতে গিয়ে বসে সায়েদা! রামিজ বাহারি ফুল, বিভিন্ন রঙের গোলাপ লাগিয়েছে সেখানে! রোজ নিয়ম করে জল দেয় সে! শীতের আগে আগে গোলাপের গন্ধে চারপাশটা ম ম করতে থাকে! এবার রামিজকে বলেছে যে বসন্ত আসার আগে কিছু রঙ বেরঙের টিউলিপের চারা এনে লাগাতে এখানে! পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এই টিউলিপ! তাই লজের বাগানে এক দুটো টিউলিপ উঁকি দিলে সেটা তাদের ব্যবসার জন্য লাভজনকই হবে বলে মনে করে সায়েদা বেগম। মার্চ থেকে মে মাসটা হল পর্যটকদের আসার সবচেয়ে সুবর্ণ সময়! এমনিতে সারা বছরই টুকটাক করে লোকজন ভারত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ভূস্বর্গে আসতেই থাকে! কিন্তু এই তিনমাস সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার ক্ষেত্রে! জুবেদাদের বাড়ির নিচের তলার লজটা খুব বড় না হলেও বেশ সুন্দর আর ছিমছাম! সর্বমোট ৬টা ঘর আছে নিচের তলায়! সাইডে একটু বাড়ানো হয়েছে আরও তিনটে সিঙ্গেল বেড রুম করার জন্য! এই বাড়তি রুমগুলো সিজনে খুব কাজে আসে! সর্বমোট ৬টা ডাবল বেডেড আর ৩টে সিঙ্গেল বেডেড রুম গেস্টদের জন্য সবসময় তৈরি রাখা হয়! কোন কোন গেস্ট আবার ডাল লেকের উপর ভাসমান হাউসবোট গুলোতে থাকতে বেশি উৎসাহী থাকে! তাই খাওয়ারেরও একটা ব্যবস্থা করেছে সায়েদা আর মুজিব মিলে! যারা লজে থাকছে তাদের জন্য তো তিনবেলার খাওয়ার থাকেই এমনকি যারা শুধু খাওয়ার প্যাক করে নিয়ে যেতে চায় তাদের জন্যও এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে! জুবেদাদের বাড়ি তথা লজটা একদম ডাল লেকের ধারেই! তার উপর রান্নার দিকটা সায়েদা নিজের হাতে সামলায়, কাজের মেয়ে রাবেয়া যদিও সাহায্য করে দেয় তাকে! তাই সায়েদার তৈরি খাবারে একটা ঘরোয়া ছোঁয়া থেকেই যায়, আর অনেক বেশি সুস্বাদুও হয়! তাই অনেক হোটেল থাকা সত্ত্বেও বহু পর্যটক এক ওর থেকে জানতে পেরে জুবেদাদের থেকেই খাওয়ার প্যাক করিয়ে নিয়ে যায়!
রাবেয়া সকালে আসে, তারপর সব রুমগুলো ঝাঁট দিয়ে, মুছে পরিষ্কার করে সামনের দালানটা জল দিয়ে ধুয়ে দেয়! তা করতে সায়েদা জুবেদার সাথে সকালের নাস্তাটা বানিয়ে ফেলে আর তারপর জুবেদা, রেহান আর শেষে মুজিব বেরিয়ে গেলে রাবেয়া আর রামিজকে দুটো নাস্তা দেয়। তারপর রাবেয়া রান্নার যোগার করতে চলে যায় আর সায়েদা কিছুক্ষণ রিসেপসনে এসে বসে। রামিজ সেই সময়টা সব রুমে জল দিয়ে আসে, আর বাগানের গাছগুলোতে জল দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ রিসেপসনে থেকে সায়েদা রান্নাঘরে চলে যায় দুপুরের খাওয়ার তৈরি করতে! তখন রিসেপসনে রামিজ থাকে। রাবেয়া আর সায়েদা মিলে সব রান্নাবান্না শেষ করে খাওয়ার গুলো সাজিয়ে দেয় আর রামিজ গেস্টদের রুমে সেইগুলো পৌঁছে দিয়ে আসে! এক একজন গেস্টের এক একরকম ফরমান থাকে! সব করে উঠতে উঠতে প্রায় দুপুর ৩টে বেজে যায়! রাবেয়া কোন কোন দিন বসে খেয়ে নেয় ৩টের পর, আবার যেদিন তাড়া থাকে সেদিন কাজ মিটিয়ে খাওয়ার নিয়ে চলে যায় ৩:৩০-৪:০০ এর মধ্যে! সায়েদা চটজলদি রামিজকে খেতে দিয়ে নিজের খাওয়াটা সেরে নেয়! মুজিব দুপুরে খেতে আসেনা! খাওয়ার যা নিয়ে যায় তাই খেয়ে নেয়! কারণ সিজনে দোকান দুপুরে বন্ধ রাখাটাও ক্ষতিরই সমান! যদিও যখন অফ সিজন চলে তখন এত চাপ সায়েদা কিম্বা মুজিব কারুরই থাকেনা! তখন মুজিব মাঝে মধ্যে দুপুরে খেতে চলে আসে! কিন্তু সিজনে দম ফেলার সময় থাকেনা। সারা বছর এই মাস তিন-চারেকের জন্যই তো তারা অপেক্ষা করে থাকে! এই সময়টাতে যত খাটতে পারবে, শীতের মরসুমে ততই আরামে কাটাতে পারবে! জুবেদা আর রেহান ৪টের দিকে স্কুল থেকে ফেরে। দুই ভাইবোনকে দুটো খেতে দিয়ে একটু বিশ্রাম করে সায়েদা! এরই মধ্যে সন্ধ্যে হতে হতেই আবার খাওয়ারের দিকটা দেখতে হয়! রাতে রাবেয়া থাকেনা। তাই রাতের রান্নার দিকটা সায়েদা আর জুবেদা মিলেই সামলায়! রান্নাবান্না শেষ হলে রামিজ খাওয়ারগুলো গেস্টদের রুমে রুমে দিয়ে আসে। সায়েদা তখন একটু আবার রিসেপসনে এসে বসতে পারে! জুবেদা উপরে নিজেদের ঘরে গিয়ে পড়াশুনা করে আর ভাইকেও পড়তে সাহায্য করে! এই করতে করতেই রাত প্রায় ৯:৩০-১০:০০ বাজলে মুজিব ফিরে আসে। লজটা রামিজের ভরসায় রেখে সায়েদা উপরের ঘরে উঠে আসে! তারপর চারজনে মিলে খেতে বসে! সারাদিনের যাবতীয় গল্প এইসময় চারজন চারজনের সাথে ভাগ করে নেয়! এই সময়টা সায়েদার সবচেয়ে প্রিয় সময়! সারাদিনের সব ক্লান্তি এইসময় যেন ধুয়ে মুছে যায় তার! খাওয়া শেষ হলে রামিজকে খেতে ডাকে সায়েদা। আর নিজে গিয়ে লজের রিসেপসনে বসে! যখন অফ সিজন চলে তখন রামিজও তাদের সাথেই রাতের খাওয়ারটা খেতে পারে! রামিজ অনাথ! মামার কাছে মানুষ হয়েছে সে! কিন্তু ১৮ বছর বয়স হতেই মামা তাকে তাড়িয়ে দেয় নিজের দিক নিজেকে দেখে নিতে বলে! খুড়তুতো এক বোনের মারফত এসব জানতে পারে সায়েদা! তখন সে রামিজকে নিজের কাছে এনে রাখে! এমনিতেও লজটা তখন সবে সবে শুরু হয়েছে তাদের! কারণ আগে জুবেদাদের একতলা বাড়ি ছিল! পরে টাকা জমিয়ে জমিয়ে দোতালা তোলা হয়! উদ্দেশ্য ছিল নীচটাকে লজ বানানোর।অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছিল! তাই একজন নিজের লোক কাছে থাকলে অনেক সাহায্য হয়! সেইভেবে রামিজকে নিজের কাছে এনে রাখে সায়েদা! মুজিবও আপত্তি করেনি এতে! সেই থেকে আজ প্রায় ৭ বছর হতে চলল রামিজ এখানে আছে, আর খুব ভালো আছে! সায়েদা আপা আর মুজিব মিয়াঁ তাকে যথেষ্ট ভালবাসেন আর সেও চেষ্টা করে যথাসাধ্য তাদের খুশি রাখার! প্রথমে ৪টে রুম নিয়ে শুরু হয়েছিল এই “জান্নাত লজ”। এখন তা ৯টা রুমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! তার সাথে সাথে অনেক পরিচিতিও বেড়েছে! খাওয়ারের ব্যবস্থাটা আগে ছিলনা! গত ৩ বছর ধরে খাওয়ারের ব্যবস্থাটা যুক্ত হওয়ায় ব্যবসাতে আরও উন্নতি হয়েছে তাদের! এই ব্যবসার দৌলতে মুজিব নিজের শাল সোয়েটারের ছোট্ট দোকানটাও সুন্দর করে সাজাতে পেরেছে, আগে একটা শিকারা ছিল, এখন দুটো শিকারা ভাড়ায় খাটায় সে!
সায়েদার মাঝে মাঝে নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ে যায়! তার আব্বুর নিজের একটা শিকারাও ছিলনা। মালিকের শিকারা চালিয়ে যা আয় হত তার বেশিরভাগটাই মালিকের পকেটেই চলে যেত। আর সায়েদার আম্মি ভালো সেলাই করতেন। কিন্তু সেসব করেও সায়েদা সহ আরও চার ভাইবোনের পেট আধা দিন ভরত না! সায়েদা সবচেয়ে বড় সন্তান ছিল তার আব্বু আম্মির! তাতে আবার মেয়ে! তাই স্কুলের গণ্ডি কোনোদিন পার করা হয়নি তার! ক্লাস ৬ অব্দি পড়াশুনা করে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল ঘরের কাজে আম্মিকে সাহায্য করার জন্য! তারপর ১৫ বছর হতে না হতেই মুজিবের সাথে তার নিকাহ হয়ে যায়! মুজিবও সায়েদার আব্বুর মতই শিকারা চালাত! কিন্তু তার নিজের শিকারা ছিল সেটা। অবস্থা কিছুটা হলেও ভাল ছিল সায়েদাদের থেকে! নিকাহর পর সায়েদা আর মুজিব মিলে বুঝতে পারে যে দিন যত এগোচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বাড়ছে! সায়েদা অল্প শিক্ষিত হলেও বুদ্ধিমান ছিল! বিয়ের এক বছরের মাথায় জুবেদার জন্ম হতেই সে মুজিবকে শিকারার সাথে সাথে আরও কিছু ব্যবসা খোলার জন্য বোঝায়! মুজিব সায়েদার কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরে একটা ছোট্ট দোকান ভাড়া নেয় শাল বিক্রির উদ্দেশ্যে! আস্তে আস্তে দোকান চলতে শুরু করে! সায়েদা নিজের আম্মির কাছ থেকে বোনাবুনি ভাল মতই শিখেছিল! বাচ্চা সামলে রাত জেগে সে শাল, সোয়েটার বুনে দিত! হাতে বোনা জিনিসের কদর সবসময়ই বেশি! তাই সিজনে সেইসব জিনিস খুব করে বিক্রি হতে লাগলো। শিকারাটা ততদিনে ভাড়া খাটাতে শুরু করেছে মুজিব! এইভাবে আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা ভাল হতে লাগলো। তারপর লজ খোলার কথাটা তাদের মাথায় আসে! এরই মাঝে রেহানের জন্ম হয়! আর আস্তে আস্তে আজ নিজেদের ব্যবসাকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে তারা! জুবেদা আর রেহানকে অনেক দূর পড়াশুনা করানোর ইচ্ছা সায়েদা আর মুজিব দুজনেরই! তাই দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে তারা! জুবেদাও আম্মিকে সাধ্যমত সাহায্য করে! সব মিলিয়ে এক সুখী পরিবার! কিন্তু এরই মাঝে শুধু একটা জিনিস জুবেদাকে শান্তি দেয়না! সেটা হল এই রাতগুলো! ছোট থেকেই রাতে ঘুমোতে গেলেই কিছু অস্পষ্ট স্বপ্ন ভিড় করে আসতো তার চোখে! কিন্তু দিন যত এগোতে লাগলো তত সেগুলো যেন বেশি করে স্পষ্ট হতে শুরু করলো! এখন তো শুরুটা অস্পষ্ট মনে হলেও শেষটা বেশ স্পষ্ট দেখতে পায় সে! কেউ কাতরাচ্ছে! বুক ফালাফালা করে কিছু একটা গেঁথে রয়েছে তার! কিন্তু চোখে তার আগুন! মুখটা স্পষ্ট না হলেও সেই বীভৎস দৃষ্টিতে সে যেন জুবেদার দিকেই তাকিয়ে থাকে প্রত্যেকবার! যেন সেই ক্রোধের আগুনে সে জ্বালিয়ে দেবে জুবেদাকে! জুবেদা সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনা! সে চোখ খুলতে চায়! কিন্তু পারেনা! মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগে কিছু একটা সে বলে! কিন্তু তা খুবই ক্ষীণ! জুবেদা শুনতে পায়না! আর ঠিক তখনই তার চোখ খুলে যায় অজান্তেই! বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে সে! আম্মিকে বলেছে অনেকবার! আম্মি বলে অতি পরিশ্রমে এরকম হতে পারে! আল্লাকে স্মরণ করে কোরান শরিফ মাথার কাছে রেখে ঘুমাতে! জুবেদাও তাই করেছে! কিন্তু কই, এই জিনিস তো থামার নামই নিচ্ছে না! বরং ধূসর কুয়াশার চাদর একটু একটু করে সরে যেন কিছুর একটা ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে জুবেদাকে! এখন রীতিমত ভয় হয় জুবেদার রাত হলেই! এমন কি কোন রাত আসবে কখনো যে রাতে জুবেদা শান্তিতে ঘুমোতে পারবে? একি নিছকই স্বপ্ন নাকি অন্য কিছু? জুবেদা জানেনা এর উত্তর! কেউ কি তবে জানে?
পর্ব-২
“আপা, যুদ্ধ কেন হয়?” বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রেহান হটাত জিজ্ঞেস করে উঠলো। “প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের স্বভাব হল সবকিছুকে ছিনে, তাকে জয়ের নাম দিয়ে নিজেকে আল্লার সমান দেখানো! আর এই জয়ের নামে খুনোখুনি করাকেই যুদ্ধ বলে! তা, হটাত এই প্রশ্ন কেন?” বলে তাকাল জুবেদা রেহানের দিকে। “তাহলে কি কাশ্মীরকে জয় করতেই এত যুদ্ধ হয়ে চলেছে আপা?” জুবেদা রেহানের প্রশ্নে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “হ্যাঁ! কিছুটা তাই! তবে এসব কথা এখানে তুই জোরে জোরে বলিস না রেহান!…” জুবেদার কথা শেষ হওয়ার আগেই রেহান আবার বলতে চেষ্টা করে “কিন্তু আপা…” “ব্যস! আর এই বিষয়ে কোন কথা নয়! যা কথা সব বাড়ি পৌঁছে হবে!” জুবেদার কথায় তখনকার মত চুপ করে যায় রেহান। জুবেদা রেহানের হাতটা শক্ত করে ধরে জোরে জোরে বাড়ির পথে পা চালায়।
“আরে রুবেল ভাইজান যে! সালাম ওয়ালেকুম!” বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে জুবেদা সামনের বাগানে বসে থাকা বছর চব্বিশ-পঁচিশের এক যুবককে বলে উঠলো। “ওয়ালেকুম আসালাম! কেমন আছো তোমরা? রেহান কি খবর?” এক গাল হেসে বলে উঠলো রুবেল। “আমি ভাল ছিলাম না এতক্ষণ ভাইজান! আপা আমাকে বকছিল এতক্ষণ! কিন্তু তোমার দেখা পেয়ে আমি একদম ভাল হয়ে গেছি! আমার এত্ত প্রশ্ন জমে আছে মনে ভাইজান! আমি জানি তুমি সেসব উত্তর দেবেই!” বলে প্রায় লাফাতে লাফাতে এক ছুটে রেহান ঘরের মধ্যে ঢুকে স্কুল ব্যাগটা রেখেই আবার ফিরে এল। “রেহান! ভাইজান কোথাও পালিয়ে যাবেনা! চল এখন আম্মি আমাদের জন্য উপরে ইন্তেজার করছে! খাওয়ারটা খেয়ে তারপর আবার আসবি!” জুবেদার কথার রেশ টেনে রুবেল বলল “জুবেদা ঠিক বলছে রেহান! যাও জামাকাপড় পালটে কিছু খেয়ে নিয়ে এসো! আমি এখানেই আছি!” রেহান অনিচ্ছা সত্বেও সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। জুবেদা সেইদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল “তা ভাইজান, প্রায় ২ বছর পর এলে! সব খেইরিয়েত তো?” রুবেল হালকা হেসে বলল “হ্যাঁ সব ভাল!” “ঠিক আছে ভাইজান! আমিও খেয়ে নিয়ে আসছি! কথা হবে আবার! সালাম!” জুবেদার কথায় রুবেল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
“লেখকদের কি আর কোন স্থায়ী ঠিকানা হয় বল! ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয় নতুন প্লটের খোঁজে! আবার এক জায়গায় দশবারও যেতে হতে পারে সেখানকার অজানা কিছু কথা যদি অসম্পূর্ণ রয়ে যায় জানতে!” বলে রুবেল কফির কাপে চুমুক দিল। জুবেদা চুপ করে রইল। “কিন্তু ভাইজান যুদ্ধ কেন হয় বললে না তো!” রেহান অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো। রুবেল একটু হেসে বলল “যুদ্ধ হয় মানুষের লোভের জন্য! বলতে পারো মানুষের লোভ যখন মানুষের সকল চিন্তা ভাবনাকে অতিক্রম করে যায় তখনই তা এক প্রলয়ের রূপ নেয়, যাকে আমরা যুদ্ধ বলি!” রেহান হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে কিছুটা বুঝল, কিছুটা বুঝল না! “লোভ কি জিনিস ভাইজান?” রেহানের প্রশ্ন শেষ হতেই জুবেদা বলে উঠলো “রেহান! তোর সওয়াল কোনদিনও শেষ হওয়ার নয়! কি যে যুদ্ধ যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে সেই তখন থেকে!” রেহান মুখটা কালো করে বলল “আপা! তোমাকে তো আর জিজ্ঞেস করছিনা! ভাইজানকে করছি! তুমি কেন বকছ তাও?” “দেখেছো ভাইজান! বড় আপার সাথে কিভাবে কথা বলছে?” জুবেদা আর রেহানের ঝগড়া লেগে গেল। রুবেল কাউকেই বুঝিয়ে পাচ্ছেনা! এই করতে সায়েদা এল। “জুবি, রেহু কি হচ্ছে এসব? রুবেল কতদিন পর এসেছে! আমাদের লজের মেহেমান! তার সামনে এগুলো কি?” বলে হালকা ধমক দিল সায়েদা জুবেদা আর রেহান দুজনকেই! “আঃ খালা! কেন বকছেন ওদের! আমার কিছু খারাপ লাগেনি!” বলে একগাল হাসল রুবেল। “জুবেদা, রেহান যাও একটু আরাম করে নাও! তারপর আবার রাতের রান্না করার আছে!” বলে সায়েদা রুবেলের সামনের চেয়ারে এসে বসলো। জুবেদা রেহানকে নিয়ে রুবেলকে সালাম জানিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এখন অক্টোবর মাস চলছে! শীত এসে গেছে তাই লজে তেমন ভিড় নেই! এই সময়টাতে সায়েদার একটু হাত ফাঁকাই থাকে বলতে গেলে! “তা মিয়াঁ! কাহানি লেখা কতটা এগোলো?” সায়েদা হেসে জিজ্ঞেস করলো। রুবেল কিছুটা বিষন্ন হেসে বলল “চলছে আর কি! এই নিয়ে চারবার এলাম কাশ্মীরে! প্রতিবারই আপনাদের এখানেই এসে থাকি! প্রতিবারই একটা কিছু নতুন খুঁজে চলি! কিন্তু পাইনা! কেন পাইনা জানিনা! আসলে কি জানেন তো খালা, এখন অনেকেই লেখালিখি করেন। কেউ সখে কেউ আবার প্রয়োজনে! কিন্তু আমি করি এক তীব্র আকর্ষণে! আমি এমন কিছু একটা লিখতে চাই যেটা পড়ে মানুষ হতভম্ব হয়ে যাবে! ভাববে যে এমনও কি হয়? কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু সৃষ্টি করে উঠতে পারিনি!” সায়েদা স্মিত হাসে। লেখালিখির ব্যাপারে সায়েদা সেরকম কিছুই বোঝেনা বলতে গেলে! তবে এই রুবেলকে প্রায় বিগত ৫ বছর ধরে দেখছে সায়েদা! এই ৫ বছরে চারবার মত এখানে এসেছে রুবেল। যখনই আসে, শীতের শুরুতে কিম্বা শীতকাল চলাকালীনই আসে সে! কারণ সে লেখার কাজেই আসে প্রতিবার আর অন্যসময় মানে সিজনের সময় আসলে অনেক ভিড় থাকে লজে! বেশি কোলাহল হলে মনোযোগ করতে অনেক অসুবিধা হয় তাই রুবেল শীতকালটা শুরু হলে তবেই আসে। “তা এবার কদিন থাকছ?” সায়েদার প্রশ্নের জবাবে রুবেল বলল “ঠিক নেই! দেখা যাক! এমনিও আমার মনে হয় এই শীতকালে কাশ্মীরের এক অন্যরূপ ফুটে ওঠে! শান্ত, নিরিবিলি অথচ এক অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হয় এই সময়টাতে! এবার একরকম দৃঢ়ভাবেই চেষ্টা করছি সেরকম কিছু লেখার! কাল থেকেই লেখা শুরু করবো! সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরবো আর রাতে এসে লিখব!” বলে হাসে রুবেল। সায়েদাও হাসে তারপর বলে “আগের তিনবারেও সবটা ঘোরা হয়নি মিয়াঁ?” রুবেল বলে “খালা, একই জায়গাকে বারবার, প্রতিবার যদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন অনেক কিছু নতুন জিনিস সেই একই জায়গায় খুঁজে পাবেন! আমি অনেকবারই এখানে এসেছি, ঘুরেছি ঠিকই, কিন্তু তাও সেই জিনিসটা খুঁজে পাইনি যা আমার উপন্যাসটাকে এক অন্যমাত্রা এনে দেবে!” “কাশ্মীরেই পাবে সেই জিনিস তার কি নিশ্চয়তা?” সায়েদা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো। রুবেল কফির কাপটা সামনের ছোট্ট টেবিলটাতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল “না! তার কোন নিশ্চয়তা নেই! কিন্তু কি জানেন তো, আমি এই জায়গাটাকে ভালবেসে ফেলেছি, বাকিরা তো এই কাশ্মীরের প্রেমেই পড়ে কেবল!” “আর তাও যদি এখান থেকে কিছু লাভ না হয় তো?” সায়েদার কথায় রুবেল বলে “তাহলে আর কি! আরও উপরের দিকে যেতে হবে! গুলমার্গ, সোনমার্গ কিম্বা হয়তো লে! কোথাও তো আমার গল্পের ক্লাইম্যাক্সটা পাবোই খুঁজে! গুড থিংস টেক টাইম!” “এই রে! শীতকালে কখন যে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে বোঝাই যায়না! ঠাণ্ডা বেশ বাড়ছে! তুমি ভিতরে চলে যাও মিয়াঁ! রাতে কি খাবে? মুরগির ঝোল আর রুমালি রোটি চলবে?” সায়েদার কথার মাঝেই উঠে পড়ে রুবেল। তারপর বলে “চলবে কি খালা! বলুন ছুটবে!” সায়েদা মাথা নাড়িয়ে বলে “ঠিক আছে! তুমি আর আরেকজন গেস্ট আছেন! রামিজকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করিয়ে নেব যে সে আর কিছু খেতে চায় কিনা! আর তুমি এখন রুমেই যাচ্ছ তো? কফি বা হট চকলেট কিছু পাঠিয়ে দেব কি রামিজকে দিয়ে?” “হ্যাঁ এখন রুমেই যাব! আজকে বেশ লম্বা সফর ছিল! সেই দিল্লি থেকে সরাসরি এখানে এলাম! আর একটু ব্ল্যাক কফি পাঠিয়ে দিলে মন্দ হয়না এই শীতের সন্ধ্যেবেলায়!” বলে অমলিন হাসল রুবেল। সায়েদা একমুখ হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে রামিজকে ডাকতে লজের রিসেপ্সনের দিকে এগিয়ে গেল।
মাঝরাতে হটাত করে একটা চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল রুবেলের। চিৎকারটা উপর তলা থেকে এল বলেই মনে হল। শীতের রাত, তাই চারদিক একটু বেশিই নিস্তব্ধ। ফোনের আলোটা জ্বালিয়ে টাইমটা দেখার চেষ্টা করলো রুবেল। দেখল ৩:৪৫ বাজে! ভুল শুনেছে ভেবে শুতে যাচ্ছিলোই তখন মনে হল যে গলাটা শুকিয়ে গেছে! গায়ের ব্ল্যাঙ্কেটটা সরিয়ে রুমের লাইটটা জ্বালাল রুবেল। রুমে নাইট ল্যাম্প আছে যদিও কিন্তু রুবেল ঘর অন্ধকার করে শুতেই অভ্যস্ত! লাইটটা জ্বালাতে দেখল জগে জল শেষ।“রামিজ কি জল ভরে দিয়ে যায়নি?” নিজের মনেই প্রশ্ন করে উঠলো সে। তারপর হটাতই মনে পড়লো যে রামিজ জলভর্তি জগটা দেওয়ার জন্য এসে তো ছিল কিন্তু তখন সে ওয়াশরুমে ছিল তাই দরজা খুলতে পারেনি! পরে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে ভেবেছিল!কিন্তু পরে ভুলেই গেছিল আনতে! কি আর করা যাবে! গায়ে একটা শাল জড়িয়ে, চটিটা পায়ে গলিয়ে রুম থেকে জগ সমেত বেরিয়ে এল রুবেল। করিডরটাতে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে! পর পর রুমগুলো সব বন্ধ!” আরেকজন যে আছে সে কোন রুমে আছে কি জানি!” মনে মনে ভাবল রুবেল। যাই হোক রিসেপ্সনে এসে কোণার ওয়াটার ফিল্টারটার দিকে এগিয়ে যায় রুবেল। জল ভরতে ভরতে হটাতই মনে হয় কেউ যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আওয়াজটা উপরের তলা থেকেই আসছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে! আর কান্নাটা কোন মেয়ের কান্নাই মনে হচ্ছে, সাথে ফিসফিস করে কথা বলারও আওয়াজ আসছে! তবে কি সায়েদা খালা কিম্বা জুবেদার কিছু হয়েছে? জল ভরা শেষে রুবেল এসবই ভাবতে থাকে! তারপর কি মনে হতে সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির তলা থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা রুমের দরজার তলা দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে! রুবেল সায়েদা খালাদের উপরের ঘরগুলোতে কোনদিন যায়নি! বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার আওয়াজ আসে! রুবেল সিঁড়ির রেলিঙের সাইডে লুকিয়ে যায়! দেখে সায়েদা আর মুজিব আলো জ্বলা রুমটা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর রুমের আলোও নিবে গেল। সায়েদা আর মুজিব কিছু ফিসফিস করে কথা বলছিল, কথাগুলো শুনতে না পেলেও তারা যে বেশ চিন্তান্বিত সেটা কিছুটা বুঝতে পারছিল রুবেল। কিছুক্ষণ কথা বলে দুজন পাশের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রুবেল এবার সিঁড়ির রেলিঙের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে জলের জগটা নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
“কি রেহান মিয়াঁ! আজকে একা একাই স্কুলে যাচ্ছ! আপা কই?” রুবেল নিজের রুম থেকে বেরচ্ছিল তখনই রেহানকে স্কুলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে। “না ভাইজান! আপার না খুব জ্বর! ঐ কাল রাতে…”রেহানের কথা শেষের আগেই মুজিব এসে পড়ে সেখানে আর বলে ওঠে “হ্যাঁ, আসলে কাল রাত থেকেই জুবেদার খুব জ্বর! মওসম বদল হচ্ছে না! তাই জন্য! আমি যাচ্ছি রেহানকে স্কুলে ছেড়ে আসতে! এখন তো দোকানে কাজের চাপ কম! দেরি করে যাবো!” বলে একগাল হাসে মুজিব। তারপর বলে “নাস্তা হয়েছে মিয়াঁ?” রুবেল হেসে বলে “না জনাব! হবে! রামিজকে সামনের বাগিচায় নাস্তা নিয়ে আসতে বললাম! শীতের সকালটা উপভোগ করতে চাই!” “বেশ বেশ! আমি মিয়াঁ রেহানকে স্কুলে ছেড়ে আসি তবে! আল্লা হাফিজ!” মুজিবের কথার প্রত্যুত্তরে রুবেলও তাকে বিদায় জানায়।
রুবেলের মনে একটা খটকা লাগে! তবে রাতের চিৎকারটা কি জুবেদার ছিল? এর আগেও যখন এসেছিল এক আধবার শুনেছিল রাতে এরকম চিৎকার! কিন্তু কালকেরটা যেন একটু বেশিই জোরালো ছিল! জুবেদার কি কিছু অসুবিধা আছে তবে! পরোটার কামড় দিতে দিতে ভাবছিল রুবেল। তারপর লজটার দিকে তাকায় সে! কি মনে হতে নাস্তাটা তাড়াতাড়ি শেষ করে লজের ভিতরে ঢোকে সে! ভিতরে ঢুকতেই সায়েদার সাথে দেখা! একমুখ স্বভাবসিদ্ধ হাসি খেলিয়ে সে বলে “কি মিয়াঁ, নাস্তা হল?” আজকে কেন জানিনা সায়েদার হাসিটা বেশ বিষন্ন মনে হল রুবেলের। রুবেল একটু আস্তে করে বলল “জুবেদার জ্বর কমেছে খালা?” সায়েদা মুহূর্তেই একটু গম্ভীর হয়ে বলল “হ্যাঁ না মানে কিছুটা ভালো আছে!” রুবেল এবার বেশ সাহস নিয়ে বলল “যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি কি একবার জুবেদাকে দেখে আসতে পারি? ভাইজান ভাইজান বলে ডাকে আমাকে! তাই আর কি!” সায়েদার মুখটা একটু কালো দেখাল। তারপর আমতা আমতা করে বলল “ঠিক আছে মিয়াঁ! চল!”
সায়েদা রুবেলকে নিয়ে উপরের ঘরে উঠে এল। এই প্রথম রুবেল সায়েদাদের উপরের ঘরগুলো দেখল। মাঝের ঘরটাতে এসে দুজনে ঢুকল। রুবেলের মনে পড়লো যে কাল রাতে এই ঘরটা থেকেই আলো বেরিয়ে আসছিল! এসব ভাবতে ভাবতেই রুমে ঢুকে দেখল জুবেদা একটা মোটা ঢাকা গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে! “মনে হয় ঘুমোচ্ছে! থাক আমি সন্ধ্যেবেলা এসে দেখা করে যাব!” বলে রুবেল রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই যাচ্ছিল তখনই জুবেদার ক্ষীণ আওয়াজ কানে এল “কে? ভাইজান নাকি?” রুবেল দেখল জুবেদা এই পাশ ফিরেছে। এক রাতেই মেয়েটাকে কি দুর্বলটাই না লাগছে! অথচ কাল রেহানের সাথে কত খুনসুটি করছিল! রুবেল কাছে এসে জুবেদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে “এখন তুমি আরাম কর বেটা! আমি সন্ধ্যেবেলায় আসব আবার কেমন?” জুবেদা খুব কষ্টে একটু হাসে! রুবেল সায়েদার সাথে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে এই জ্বর স্বাভাবিক কারণে আসেনি! কিছু তো একটা ব্যাপার আছেই! কিন্তু কি হতে পারে সেটা? লজের বাগানের কাছে এসে পৌঁছাল রুবেল।
পর্ব-৩
“আজকে শরীর কেমন জুবেদা?” রুম থেকে বেরিয়ে রিসেপ্সনের ছোট্ট সোফাটাতে জুবেদাকে শাল গায়ে বসে থাকতে দেখে বলে ওঠে রুবেল। “এখন অনেকটাই ভাল আছি ভাইজান! দুদিন ধরে স্কুল যাওয়া হচ্ছেনা! ইমতেহান আছে সামনেই! কিন্তু আম্মি যেতে দিল না আজকেও!” একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল জুবেদা। রুবেল দেখল রামিজ সামনের বাগানের গাছগুলোতে জল দিতে ব্যস্ত। সায়েদা কিম্বা মুজিবকে ধারেকাছে দেখতে পেলনা। এটাই সুযোগ! সে আস্তে করে জুবেদার সামনের সোফাটাতে এসে বসলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো “জুবেদা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?” রুবেলের প্রশ্নে একটু অবাক হল জুবেদা। তারপর অবাক হয়েই বলল “হ্যাঁ করো না ভাইজান!” রুবেল একটু গলাটা নামিয়ে বলল “পরশু রাতে একটা চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছিল! প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো মনের ভুল! কিন্তু এর আগেও যখন এখানে এসেছিলাম এক দুবার এরকম চিৎকার শুনেছিলাম! তবে পরশুদিনেরটা বেশ জোরাল ছিল! তোমারাও কি শুনেছিলে?” জুবেদার মুখটা মুহূর্তেই শুকিয়ে গেল! জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটদুটো চাটতে শুরু করলো সে! রুবেল জুবেদার দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায়নি! জুবেদাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার বলে উঠলো “তাহলে মনে হয় শোনোনি কিছু! আমারই মনের…” “ভাইজান ওটা তোমার মনের ভুল নয়!” রুবেলের কথার মাঝেই হঠাৎ করে বলে ওঠে জুবেদা। রুবেল প্রশ্নসূচকভাবে তাকায় জুবেদার দিকে। জুবেদা আস্তে করে বলে “ওটা…ওটা আমার চিৎকার ছিল ভাইজান!” রুবেল অবাক হওয়ার ভান করে বলে “তুমি ছিলে? কিন্তু কেন জুবেদা? কিছু অসুবিধা আছে কি তোমার? আমায় বলতে পারো নিজের ভাইজান ভেবে!” জুবেদা একটা ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করলো “আসলে এটা কোন হঠাৎ করে শুরু হওয়া জিনিস নয়! যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, তবে থেকেই প্রতি রাতে…” “জুবেদা…নাস্তাতে কি খাবি বেটি?” জুবেদার কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়েদা এসে ঢুকল রিসেপ্সনে। রুবেলকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো সায়েদা “কি মিয়াঁ! আজ বেরোবে না শ্রীনগর সফরে? গল্পের বিষয় পেয়ে গেছো নাকি?” রুবেল একটু বিরক্তই হয়েছিল সায়েদার ঠিক এই সময়ে এখানে এসে উদয় হওয়াতে! তবে মনে হয় ইচ্ছা করেই সে এখানে এসেছে! কারণ সে অথবা তার শোহর মুজিব হয়তো চায়না যে জুবেদার সাথে প্রায় প্রতিরাতে ঘটে চলা কিছু অদ্ভুত জিনিসের বিবরণ কেউ জানুক। আর রুবেল যে সেটা জানতে উৎসুক সেটা কিছুটা মনে হয় আঁচ করেছে সায়েদা! মেয়ে মানুষ বলে কথা! এদের ঘ্রাণশক্তি একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি হয়! তাও আবার যদি ব্যাপারটা নিজের সন্তান সম্পর্কিত হয়, তাহলে তো কথাই নেই! রুবেল বুঝতে পারছিল আর কিছু কথা জুবেদার সাথে সেই বিষয়ে হওয়া সম্ভব নয়! তাই একগাল মেকি হেসে সে জবাব দিল “আরে না না খালা! এত তাড়াতাড়ি কি আর বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়! অনেক মুসক্কত করতে হবে যদি সফলতা পেতে হয়! নাস্তার জন্য ইন্তেজার করছিলাম! খেয়েই বেরিয়ে যাবো!” সায়েদা একটু হেসে রামিজকে ডাক দিল ”রামিজ, রাবেয়া রান্নাঘরে আছে! সব তৈয়ার করে ফেলেছি দুজনে মিলে! তুই যা আর রুবেল মিয়াঁর জন্য নাস্তাটা রাবেয়ার থেকে নিয়ে চলে আয় জলদি!” রামিজ মাথা নেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।
রুবেলের মনে যেন শান্তি নেই! তাকে জানতেই হবে কি এমন ব্যাপার যেটা জুবেদার আম্মি আর আব্বু মিলে সবার থেকে লুকাতে চাইছে! সে মনে মনে প্রমাদ গুনতে থাকে কখন জুবেদাকে একা পাওয়া যায়! কিন্তু স্কুলে সে রেহানের সাথে যায় আর আসে। তারপর সায়েদাকে কিচেনে রান্নার কাজে সাহায্য করে, তারপর উপরের ঘরে চলে যায়! রুবেল ভাবতে থাকে কিভাবে জানা যায় পুরো ব্যাপারটা! অনেক ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মুখে খেলে যায় এক অদ্ভুত হাসি!
দুদিন পরঃ
“আরে! রুবেল ভাইজান যে! এইদিকে এসেছিলে নাকি কোন কাজে?” স্কুলের গেটের বাইরে সামনাসামনি চায়ের দোকানটাতে রুবেলকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে জুবেদা। রুবেল চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে টাকা মিটিয়ে জুবেদার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল “হ্যাঁ ওই একটা কাজেই এসেছিলাম এই দিকে! তুমি এই স্কুলে পড় সেটা জানতাম না যদিও!” জুবেদা স্মিত হেসে বলল “আচ্ছা ভাইজান! আমি চলি তাহলে!” রুবেল বলে উঠলো “আরে আমিও এবার লজেই ফেরত যাবো! চল একসাথেই যাওয়া যাক! তা রেহানকে দেখছিনা! আজ স্কুলে আসেনি নাকি?” “না ভাইজান! রেহানের কাল থেকেই পেট ঠিক নেই! বিকেলে খেলতে যায় মহল্লার ছেলেগুলোর সাথে তখন কি জানি কি খেয়ে বসে থাকে! ব্যস! হওয়ারই ছিল এসব! আমার কথা তো একটাও শোনেনা! আম্মির কথাও শোনেনা! শুধু আব্বুকে একটু ভয় পায়” বিষন্ন গলায় বলল জুবেদা। রুবেল একটু হেসে বলল “আচ্ছা জুবেদা, সেদিন লজের রিসেপ্সনে বসে কিছু কথা বলছিলে তুমি আমাকে মনে আছে?” জুবেদা অবাক হয়ে রুবেলের দিকে তাকিয়ে বলল “কোন দিন ভাইজান?” “এই তো দুদিন আগেই, যেদিন তোমার জ্বরটা একটু ঠিক হয়েছিল বলে তুমি রিসেপ্সনে এসে বসেছিলে! আমি তোমাকে প্রায় রাতেই শুনতে পাওয়া চিৎকারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলাম, মনে পড়ল?” রুবেল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জুবেদার দিকে। জুবেদা প্রশ্নটা শুনে চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। রুবেলও দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো আবার “কি হল জুবেদা? দেখো তুমি সেদিন কিছু বলতে চেয়েছিলে আমাকে কিন্তু সায়েদা খালা চলে আসাতে আর বলে উঠতে পারনি! আমি বুঝেছি সেটা! কিন্তু এখন এখানে তো কেউ নেই…তুমি বলতে পারো…” “না ভাইজান, আমাকে সেসব কথা আম্মি কাউকে বলতে বারণ করেছে! আমি তোমাকে বলতে পারবোনা!” বলে জুবেদা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো। রুবেল জুবেদার সামনে এসে বলল “এসো আমার সাথে, সামনের এই বসার জায়গাটাতে বসা যাক…” “কিন্তু ভাইজান দেরি হয়ে যাবে বাড়িতে ফিরতে! আম্মি ফিকার করবে!” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো জুবেদা। “কিচ্ছু দেরি হবেনা! দু মিনিট লাগবে, এসো!” বলে রুবেল আর জুবেদা রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে ছোট বসার জায়গায় গিয়ে বসলো। রুবেল বলা শুরু করলো “দেখ জুবেদা, কিছু কিছু জিনিস আছে যা কাউকে বললে অনেক শান্তি পাওয়া যায়! হয়তো আমি তোমার সেই অসুবিধার কিছু উপায় দিয়ে দিতে পারি!” জুবেদা রুবেলের দিকে তাকাল, তারপর বলল “এর কিছু উপায় নেই ভাইজান! আব্বু বলছে মৌলবি সাহাবের কাছে এই রবিবারে আমাকে নিয়ে যাবে!” বলতে বলতে চুপ করে গেল জুবেদা। “চুপ করে গেলে কেন জুবেদা? মৌলবি সাহাবের কাছে কেন যেতে হবে? দেখো এতটা যখন বললে বাকিটাও আমাকে খুলে বল! আমি কথা দিচ্ছি তোমার আম্মিকে কিচ্ছু জানাবো না!” রুবেলের কথা শেষ হতেই জুবেদা অস্থির হয়ে বলে ওঠে “ঠিক আছে ভাইজান আমি বলছি কিন্তু দয়া করে খেয়াল রেখো যেন আম্মি কিম্বা আব্বু এটা জানতে না পারে!” রুবেল সম্মতিসূচকভাবে মাথা দোলাল।
“সববার একই স্বপ্ন দেখো? কোন হেরফের নেই?” রুবেল ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো। “হেরফের বলতে একটা জায়গা দেখি, খুব স্পষ্ট না হলেও জায়গাটা আমার দেখা কিম্বা পরিচিত জায়গা নয়! চারিদিকে পাহাড়, সবুজ সবুজ পাহাড়ের মাঝে একটা তাবুমত! এসবের মাঝেই হঠাৎ সেই বীভৎস লোকটা! মুখটা স্পষ্ট না হলেও থুতনির নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা সাদা দাঁড়ি আর মাথায় সাদা মত একটা কাপড় বাঁধা! লোকটার বুকে কেউ যেন ছুরি জাতীয় কিছু দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে! লোকটার সেই দৃষ্টি! যেন আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত! আমি চোখ খুলতে চাইলেও খুলতে পারিনা! আর সেই রাতে…” বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠলো জুবেদার। রুবেল অসম্ভব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “ সেই রাতে কি জুবেদা? বল আমাকে।“ জুবেদা আস্তে আস্তে বলল “সেই রাতে স্বপ্নটা আরও ভয়াবহ ছিল! লোকটা…তখনও ছুরিবিদ্ধ হয়নি! আমি দেখলাম সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, মুখে এক অদ্ভুত ক্রূর হাসি! আর আমি যেন পালাতে পারছিনা…কোনভাবেই পারছিনা! তারপর হঠাৎ করে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপরে! আর তখনই আমি চিৎকার করে উঠি আর ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার!” “তার মানে সেদিনের জ্বরটা সেই ভয় থেকেই এসেছিল, তাই তো?” রুবেলের কথায় নীরবে মাথা নাড়ায় জুবেদা, তারপর বলে ওঠে “এবার চল ভাইজান, নইলে আম্মি রেগে যাবে খুব! আর কাউকে বোলোনা এসব কথা দয়া করে! আম্মি বলছিল এসব কোন অপদেবতার জন্য হতে পারে, জানাজানি হয়ে গেলে আমার নাকি আর নিকাহ হবে না!” জুবেদার সরল কথাগুলো শুনে রুবেল তাকে আশ্বস্থ করলো যে সে কিছুই বলবে না কাউকে। তারপর দুজনে রাস্তায় নেমে এল।
“হ্যালো শান্তনুদা? কেমন আছো?” ফোনটা অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হতেই বলে উঠলো রুবেল। “আমি ভালো ভায়া! কিন্তু তোমার কি খবর? আজ এতোগুলো বছর পরে আমাকে হঠাৎ মনে পড়লো?” শান্তনুর কথার জবাবে রুবেল বলল “না গো সেরকম কিছু নয়! আসলে নিজের কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম! বাড়িতেই বছরের ৮ মাস থাকা হয়না!…আচ্ছা শোনোনা শান্তনুদা, তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে! তুমি কখন ফ্রি হবে একটু জানালে ভাল হতো!” শান্তনু কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল “এই সন্ধ্যের পর থেকে তো রাত প্রায় ১০:৩০ অব্দি আমার একদম সময় হবেনা, পেসেন্ট দেখতে হয়!” “ঠিক আছে দাদা, আমি যদি ১১টার পর ফোন করি, কিছু অসুবিধা হবে কি?”রুবেলের কথা শুনে শান্তনু বলল “না অসুবিধা নেই! কি ব্যাপার বলতো এবার! এত কি আর্জেন্ট আছে?” রুবেল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল “কিছু জানার আছে তোমার থেকে!” “আমার থেকে? একজন উঠতি লেখকের আমার মত মনচিকিৎসকের কাছ থেকে কি জানার থাকতে পারে ভায়া?” রসিকতা করে বলল শান্তনু। “সব বলবো দাদা! রাতে তবে ফোন করছি। ঠিক আছে?” বলে উঠলো রুবেল। “হম ঠিক আছে ভায়া!” বলল ডাঃ শান্তনু।
কয়েকদিন পরঃ
“জুবেদা একটু শোনো এদিকে!” চাপা গলায় আস্তে করে বলল রুবেল। জুবেদা স্কুল থেকে ফিরে উপরের ঘরে যাচ্ছিল। রেহান আগে আগে দৌড়ে চলে গেছিল, জুবেদা পিছন পিছন ঢুকছিল, তখনই রিসেপ্সনের কাছে রুবেল জুবেদাকে ডাক দেয়। “বল ভাইজান, কিছু বলবে?” বলে জুবেদা এগিয়ে গেল রুবেলের দিকে। “হম, তোমার প্রব্লেমের একটা উপায় পেয়েছি আমি! কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমার সঙ্গ দিতে হবে জুবেদা!” বলে থামল রুবেল। “কিরকম সঙ্গ ভাইজান?” প্রচণ্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো জুবেদা। “বলবো! কিন্তু এই ব্যাপারে তুমি কাউকে কিছু জানাবে না, কেমন?” রুবেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো জুবেদা, তারপর বলল “এসব করে কি আমার সেই স্বপ্নগুলো আসা বন্ধ হয়ে যাবে ভাইজান?” রুবেল অন্যমনস্ক হয়ে বলল “সেটা জানিনা, তবে কেন হচ্ছে এসব, কি থেকে হচ্ছে তার উত্তর পেলেও পাওয়া যেতে পারে!” “ঠিক আছে ভাইজান! আমাকে করতে কি হবে?” জুবেদা তাকাল রুবেলের দিকে।
“কবে থেকে এরকম স্বপ্ন দেখছ তুমি জুবেদা?” ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ডাঃ শান্তনুর কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে জবাব দেয় জুবেদা “অনেক ছোট থেকে! কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত সবকিছু স্পষ্ট হচ্ছে…” “স্পষ্ট হচ্ছে মানে? কি স্পষ্ট হচ্ছে জুবেদা?” ডাঃ শান্তনুর কথা শুনে জুবেদা বলল “স্পষ্ট মানে সেই জায়গাগুলো, সেই লোকটা…সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি…” কথা শেষ না করেই কাঁপতে শুরু করলো জুবেদা। “হ্যালো…হ্যালো জুবেদা?” ডাঃ শান্তনু বারবার বলতে লাগলেন। “হ্যালো শান্তনুদা, জুবেদা কথা বলার মত অবস্থায় নেই, এই ব্যাপারে বেশিক্ষণ কথা বললেই ও ভয় পেতে থাকে! আমি তোমাকে একটু পরে কল করছি” বলে ফোনটা নামিয়ে রাখল রুবেল।
“কি বুঝলে শান্তনুদা? মেয়েটার কি কিছু মানসিক প্রব্লেম থাকতে পারে?” রুবেলের কথা শুনে ডাঃ শান্তনু বলল “দেখো রুবেল এইভাবে একদিন দুটো কথা তাও আবার ফোনে বলে আমি কেন আমার চেয়ে আরও অনেক বড় মন চিকিৎসকও বলতে পারবে না যে মেয়েটি মানসিকভাবে সুস্থ না অসুস্থ! তবে হ্যাঁ, এইটুকু বলতে পারি যে মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছে! এবার সেটাকে আমি মানসিক রোগ বলে অভিহিত করতে পারিনা! আমার সিটিং চাই মেয়েটার সাথে, সামনাসামনি! অনেকগুলো সিটিং! তবে হয়তো কিছু কিনারা করতে পারা যাবে! যাই হোক একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? কিছু মনে করোনা প্লিস!” রুবেল বলল “না না বল!” ডাঃ শান্তনু একটু থেমে বলল “তুমি হঠাৎ এই মেয়েটা মানে জুবেদার জন্য এত তৎপরতা দেখাচ্ছ কেন? ওর মা বাবা কি জানে যে ও আমার সাথে কথা বলেছে? লেখালিখি ছেড়ে এবার জনসেবায় মন দিলে নাকি ভায়া?” রুবেল কি জবাব দেবে ভাবছিল। তার মনে কি চলছিল সেটা একমাত্র সেই জানতো! কথা ঘুরিয়ে বলল “আরে না গো, সেরকম কিছু নয়! আসলে মেয়েটা বহুদিন ধরে এরকমভাবে ভুগছে আর আমিও এদের অনেক বছর ধরে চিনি তাই ভাবলাম যদি একটু হেল্প করে দেওয় যায় আর কি! ঠিক আছে শান্তনু দা! রাখলাম তাহলে, পরে আবার কল করবো! অনেক ধন্যবাদ তোমার হেল্পের জন্য!” বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে চিন্তা করতে বসলো রুবেল। কি করা যাবে এটা ভাবতে ভাবতে বিছানায় রাখা ল্যাপটপটা তুলে নিল সে, শুরু তো হোক, শেষটা হতে এখনও অনেকগুলো পর্ব বাকি!
পর্ব-৪
একটা অদ্ভুত বিকট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল রুবেলের। না! আজকে কিন্তু এই আওয়াজটা জুবেদার চিৎকারের আওয়াজ বলে মনে হল না! রুবেল ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কেন জানিনা হঠাৎ করেই বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে তার! গায়ের কম্বলটা ভালোভাবে মুড়ি দিয়ে মাথাটা উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো যে রুমের কোন ফাঁকফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা আসছে কিনা! কিন্তু কিছুই সেরকম দেখতে পেলনা। এর কয়েক মুহূর্ত পরই দুমদাম আওয়াজ আসতে লাগলো! মনে হচ্ছে কেউ যেন দরজাটা সর্ব শক্তি দিয়ে পেটাচ্ছে! রুবেল এবার একটু যেন ভয় পেল। দরজার দুমদাম আওয়াজটা যেন থামার নামই নিচ্ছে না! রুবেল না চাইতেও গায়ের কম্বলটাকে সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে এল। তারপর আস্তে করে নিজের রুমের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল। আজকেও অন্যদিনের মত করিডরে টিমটিমে আলোটা জ্বলছে! অন্যদিন কিছু মনে না হলেও আজকে কেন জানিনা রুবেলের একটু গাটা ছমছম করছিল! তাড়াতাড়ি করিডরটা পেরিয়ে রিসেপ্সনে এসে দেখে মেন দরজাটা বন্ধ! কিন্তু পাশের বড় জানলাটার একটা পাল্লা সম্ভবত কোন কারণে খুলে গেছে আর বাইরে প্রচণ্ড হিমশীতল হাওয়া বইছে আর সেই হাওয়ার জন্যই জানলাটা দুমদাম আওয়াজে ধাক্কা মারছে বারবার! রুবেল একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলাটার পাল্লাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেল! জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে বাইরের বাগানে হঠাৎ নজর পড়ে তার! দেখে একটা অস্পষ্ট অবয়ব সম্ভবত দাঁড়িয়ে আছে সেখানে! “কে? কে ওখানে?” বলতে গিয়ে ঈষৎ গলাটা যেন কেঁপে গেল রুবেলের! ঘন কুয়াশা আর তাতে অদ্ভুত এক হিমশীতল পাগল করা হাওয়া! কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না! রুবেল আর একটু জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। আস্তে আস্তে যেন কুয়াশার চাদর সরে যাচ্ছে বলে মনে হতে লাগলো তার! আর অস্পষ্ট অবয়বটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো! অদূরে দাঁড়িয়ে আছে এক সৌম্যদর্শন ব্যক্তি! মাথা সম্পূর্ণভাবে মুণ্ডিত! গায়ে একটা গেরুয়া রঙের কিছু আর দৃষ্টি যেন রুবেলের দিকে স্থির! “কেউ আছেন ওখানে?” গলাটা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো রুবেল। কিন্তু সেই ব্যক্তির মধ্যে কোন হোলদোল দেখা গেলনা! যেন কোন মূর্তি একইভাবে একই জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে! সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস হল এই অসম্ভব হিমশীতল হাওয়ার মাঝেও সেই ব্যক্তির শরীরে তেমন কিছু আবরণ নেই! আর তার জন্য যে তার ঠাণ্ডা লাগছে সেরকম কিছু অভিব্যক্তিও মুখে ফুটে উঠছে না! রুবেলের এবার কেন জানিনা সত্যিই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে লাগলো! এই অনুভূতি ভয়ের নাকি কৌতূহলের সেটা রুবেলের বোধগম্য হচ্ছিল না এই মুহূর্তে! সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে একটা সুমিষ্ট গন্ধ পাচ্ছে সে অনেকক্ষণ থেকে!কিসের গন্ধ কিছুতেই মনে করতে পারছে না! না! মনে হয় চোখের ভুল! এসব ভাবতে ভাবতে জানলা থেকে নজর সরাতেই গেছিল রুবেল তখনই একটা আওয়াজ কানে এল। এক অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষায় কেউ যেন কিছু একটা মন্ত্র পড়া শুরু করেছে! জানলার কাছে আবার গিয়ে দেখে রুবেল সেই ব্যক্তিটা যেন কিছুটা এগিয়ে এসেছে! মুখটা তাও অস্পষ্ট! কিন্তু ঠোঁটদুটো মনে হচ্ছে নড়ছে সমানে! মন্ত্রটা তাহলে সেই পড়ছে কি? রুবেল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! নড়তেও ভুলে গেল যেন! হঠাৎ সেই মন্ত্রপাঠ থেমে গেল! এবার সেই ব্যক্তি যেন কিছু একটা বলে উঠলো রুবেলের দিকে তাকিয়ে! খুবই অস্পষ্ট আওয়াজ আর সেই দুর্বোধ্য ভাষা! রুবেল নির্বোধের মতই তাকিয়ে রইল! এবার আস্তে আস্তে সেই ব্যক্তি পিছনের দিকে ফিরে চলে যাওয়ার উপক্রম করতে লাগলো। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে রুবেলের দিকে তাকাল শেষবারের মত! তারপর নিজের ডানহাতের তর্জনীটা তুলে দুদিকে হেলালো! তারপর হঠাৎ করেই যেন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেল! রুবেল যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! মানুষটা চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর যেন সম্বিৎ ফিরে পেল সে! কে ছিল সে? কেনই বা এই মাঝরাতে এখানে এসেছিল? আর কিসের জন্য মানা করে গেল রুবেলকে? কিছুই বুঝতে পারছিল না রুবেল! জানলার সামনে থেকে খানিকটা টলমল পায়ে সরে আসতেই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলো রুবেল! সিঁড়ির কাছের আলো আধাঁরিটাতে জুবেদা দাঁড়িয়ে রয়েছে! চোখ মুখ অস্বাভাবিক রকমের শান্ত! কিছুক্ষণ পরে হালকা হাসল জুবেদা রুবেলের দিকে তাকিয়ে! অন্যসময় একরকম লাগে! কিন্তু এই মাঝরাতে সিঁড়ির কাছে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয় জুবেদার! এবার নিজের মনেই কিসব বলা শুরু করেছে জুবেদা ফিসফিস করে! রুবেল তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে প্রায় ছুটে নিজের রুমের সামনে গিয়ে পৌঁছায়! ছুটে আসার সময় জুবেদার একটাই কথা তার কানে আসে “ওরা এসে গেছে!”
পরের দিন অনেকটাই দেরিতে ঘুম ভাঙল রুবেলের। ঘুম ভাঙতেই কালকে রাতের কথা মনে পড়ে গেল তার! সবটাই একটা স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল তার! নিজেকে সামলে মোবাইলটা খুলে টাইমটা দেখল, প্রায় ৯টা বাজতে চলেছে! উঠে বাথরুমে গিয়ে স্নানটান সেরে রুম থেকে বেরিয়ে এল রুবেল। রিসেপ্সনে এসে দেখল সায়েদা বসে আছে! রুবেলকে দেখতে পেয়ে স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলল “কি মিয়াঁ! রাত জেগে লেখালিখি চলছে নাকি? রামিজ দুবার গিয়ে ফিরে এসেছে! তুমি এত ঘুমচ্ছিলে যে দরজা ঠকঠকের আওয়াজও পাওনি মনে হয়!” রুবেল কষ্ট করে একটু হাসে। তারপর কি মনে হতে বলে “জুবেদা, রেহান কি স্কুলে নাকি?” সায়েদা অল্প হেসে বলে “হ্যাঁ, ওরা তো সেই আটটায় বেরিয়ে গেছে! তা, তোমার নাস্তাটা রামিজকে নিয়ে আসতে বলি?” “না খালা! আজকে শরীরটা খুব একটা ভালো নেই! কিছু খাবনা! একটু বেরিয়ে আসছি!” বলে রুবেল বেরিয়ে যেতে গেল। “আরে মিয়াঁ, শরীর খারাপ তো লজেই আরাম করো! বাইরে তো খুব ঠাণ্ডা! শরীর বেশি খারাপ হয়ে যেতে পারে!” পিছন থেকে বলে উঠলো সায়েদা। রুবেল ততক্ষণে লজের বাগান পেরিয়ে মেন গেটের কাছে পৌঁছে গেছে। সায়েদার কথা শুনে একটু চিৎকার করে বলল “না না খালা তেমনও কিছু শরীর খারাপ নয়! একটু ঘুরে ফিরে এলে ভালই লাগবে!” বলে উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বেরিয়ে এল রুবেল।
সামনের ডাল লেকের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কালকে রাতের ঘটনাগুলোর কথা ভাবছিল রুবেল। ব্যাপারটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না তার! তবে কি জুবেদার স্বপ্ন দেখা আর তার এই জেগে জেগে এসব দেখার মধ্যে কিছু সম্পর্ক আছে? না! আজকে জুবেদার সাথে কথা বলতেই হবে তাকে! এসব ভাবতে ভাবতে মেন রাস্তায় এসে পড়ে রুবেল।
জুবেদার স্কুলের সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কি মনে হতে ফিরে চলে আসে রুবেল। রেহান থাকবে আজকে জুবেদার সাথে! কিছু সেরকম জিজ্ঞেস করা যাবেনা! কিছু জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেই রেহান এটার মানে কি ভাইজান, ওটার মানে কি ভাইজান এসব বলতে শুরু করবে! কিন্তু জুবেদার সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি! তাকে জানতেই হবে এসব হচ্ছেটা কি! যেন সব কিছু জানার একটা নেশা পেয়ে বসেছে রুবেলকে!
“জুবেদা! তোমার সাথে কিছু কথা আছে!” জুবেদা স্কুল থেকে ফিরলে বাগানে বসে থাকা রুবেল বলে উঠলো। “কি কথা ভাইজান?” জুবেদা তাকাল রুবেলের দিকে। “ ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর বলছি!” রুবেলের কথা শুনে জুবেদা বলল “ঠিক আছে ভাইজান! আসছি।“
“জুবেদা, কাল রাতে তুমি সিঁড়ির ওখানে কি করছিলে?” কোনরকম ভনিতা না করেই বলে উঠলো রুবেল। “আমি? আর রাতে সিঁড়ির কাছে? কিসব বলছ ভাইজান!” যেন প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলে উঠলো জুবেদা। রুবেল চোখদুটোকে সরু করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল “কারা এসে গেছে জুবেদা? কি হচ্ছে এসব? বলো আমাকে প্লিস!” জুবেদা অসহায়ের মত তাকিয়ে রইল রুবেলের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল “তুমি যেসব কথা বলছ ভাইজান সেরকম একটা স্বপ্ন কাল রাতে আমি দেখেছি!” “স্বপ্ন? ওটা স্বপ্ন ছিলনা জুবেদা! আমি সাক্ষী তার! ওটা বাস্তব ছিল! কে ছিল সেই অদ্ভুত লোকটা? আগে কখনো তাকে দেখেছো নিজের স্বপ্নে?” প্রচণ্ড উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুবেল। জুবেদা ইতস্তত করতে থাকে। রুবেল অধৈর্য হয়ে বলে “জুবেদা প্লিস বল! আমার জানাটা খুব জরুরি!” সন্ধ্যে নেমে আসছিল। হঠাৎই রুবেলের বেশ শীত করতে লাগে! জুবেদা সামনে মাথাটা নামিয়ে বসে আছে। ওর কি শীত লাগছে না? নাকি একা তারই লাগছে! হঠাৎ চারপাশটাতে সাদা ধোঁয়ার মত কুয়াশা ছেয়ে যেতে শুরু করলো। “জুবেদা?” ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো রুবেল। না! জুবেদা মুখ তুলছে না তাও! কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তোলে জুবেদা। সেই হাসি! আগের দিনের রাতের মত! জুবেদা আবার বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুরু করেছে! রুবেল অসম্ভবরকম বিস্মিত হয়ে জুবেদার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় বিড়বিড় করা থামিয়ে সরাসরি রুবেলের দিকে তাকাল। তারপর ফাঁসা গলায় বলল “সসসস!!! ওরা শুনে ফেলেছে! ওরা দেখেও ফেলেছে! ওরা অন্য কারুর দেখা কিম্বা জানাটাকে পছন্দ করেনা!” বলে নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনীটা ঠেকাল জুবেদা। জুবেদার এরকম কথায় রুবেল খুব অবাক হয়ে গেল আর সাথে একটু একটু ভয়ও পাচ্ছিল। “জুবেদা…জুবি কোথায় গেলি? ওহ! এখানে! চল রাতের রান্নার কাজটা সেরে নিতে হবে যে বেটা!” সায়েদার গলার আওয়াজে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল জুবেদা। নিজের চোখদুটো রগড়ে রুবেলের দিকে তাকাল। রুবেল তখনও বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে জুবেদার দিকে! জুবেদা কিছু বলার আগেই সায়েদা এগিয়ে এল তাদের দিকে। “কি মিয়াঁ, এখন শরীর কেমন?” সায়েদার প্রশ্নটা যেন ঠিকমতো শুনতেই পায়নি রুবেল। সায়েদা কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রুবেলের দিকে। “কি মিয়াঁ? কিছু হয়েছে?” একটু গলাটা তুলে আবার জিজ্ঞেস করলো সায়েদা। এবার রুবেল যেন শুনতে পেল। “না কিছু হয়নি! আমি রুমে যাচ্ছি!” বলে তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে ছিটকে রুমের দিকে চলে গেল রুবেল। সায়েদা অবাক হয়ে একবার জুবেদার দিকে তাকাল। তারও চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে।
“এই রহস্যের কিনারা করাটা তোমার কাজ নয়! ওনার ব্যাপারে কোন অযাচিত লোক উৎসাহ দেখালে তার পরিণাম ভয়াবহ হয়! আগেও বুঝিয়েছি আবারও বলছি! নিজের কাজ করো। নাহলে…প্রলয় আসবে! প্রলয়!” সেই লোকটা, পরনে গেরুয়া বস্ত্র, মুণ্ডিত মস্তক! কিন্তু আজকে সেই দুর্বোধ্য ভাষায় কোন মন্ত্র উচ্চারণ নেই, বরং পুরোটাই বোধগম্য ভাষায় এক সতর্কবার্তা দিচ্ছে! রুবেল যেন হিলতে পারছেনা! কোন অশরীরী শক্তি যেন তাকে বেঁধে রেখেছে! লোকটা স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে এখন তার দিকে! তারপর কাছে এসে বলল “সসসস!!!! ওরা তোমাকে পছন্দ করেনা! তোমার এইসব কাজে ওরা খুব বিরক্ত! আর উনি কিন্তু জানতে পারলে আর রক্ষে নেই! এটা আমার সর্বশেষ সতর্ক বার্তা!…” পরের কথাগুলো আর শুনতে পেলনা রুবেল। অস্পষ্ট কিছু মশালের মত আলো দেখতে পেল অদূরে। আর সাথে একদল লোক। নিঃশব্দে কোথাও চলেছে তারা! যেন তাদের পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছেনা! হঠাৎ সেই দলের একজন চোখ গিয়ে পড়লো রুবেলের উপর! তারস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বলে উঠলো সে! তখনই বাকি সবাই মিলে তরোয়াল বের করে রুবেলের দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসতে শুরু করলো। রুবেলের পা দুটো যেন কেউ মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে! সে এক ইঞ্চি নড়তে পারছেনা! ওরা এসে গেছে! অনেক কাছে! এবার হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে……। “রুবেল মিয়াঁ! দরজা খোলো, আমি রামিজ! কফি নিয়ে এসেছি!” দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো রুবেল।স্বপ্ন দেখছিল তার মানে এতক্ষণ সে! কিন্তু এত পরিষ্কার, এত প্রানবন্ত কি স্বপ্ন হতে পারে? এই তুমুল শীতেও রুবেল ঘেমে উঠেছে। রামিজ মনে হয় চলে গেছে! কতক্ষণ থেকে দরজা ঠকঠক করছিল কে জানে! বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইলো রুবেল। স্বপ্নের ঘোরটা কাটেনি এখনও তার! তারপর কিছুটা ধাতস্থ হতে বিছানা থেকে আস্তে আস্তে নেমে আসে সে।
সেদিন আর কোথাও বেরোল না রুবেল। রুমে বসে সারাদিন নিজের ল্যাপটপে কাজ করে গেল। মাঝে রামিজ এসে নাস্তা আর পরে লাঞ্চ দিয়ে গেছিল। অনেকগুলো লিঙ্ক ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো নিজের ল্যাপটপের নোটপ্যাডে সেভ করে রাখল রুবেল। সব কিছু সার্চিং শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। এবার ল্যাপটপটা বন্ধ করে একটু রুমের বাইরে বেরিয়ে এল রুবেল। “না! আজকের দিনটা বৃথা গেলনা! অনেক কিছুই এবার বুঝতে পারছি আমি একটু একটু করে! “মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই রিসেপ্সন পেরিয়ে সামনের বাগানটাতে এসে বসলো রুবেল। লজটা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন? রামিজ তো থাকে অন্যদিন রিসেপ্সনে! আজ রিসেপ্সনও ফাঁকা! অদ্ভুত মনে হলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সামনের টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিল রুবেল। কিছুক্ষণ পর তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন জানান দিতে লাগলো যে তার আশে পাশে কেউ আছে! খবরের কাগজটা মুখের সামনের থেকে নামাতেই একটু আঁতকে উঠলো রুবেল। সামনে জুবেদা বসে আছে তার দিকে তাকিয়ে, হাসিমুখ! “ওহ জুবেদা! কখন এলে, বুঝতেই পারিনি!” রুবেলের কথার কোন জবাব না দিয়ে জুবেদা আঙ্গুল তুলে বাগানের একদম শেষ কোণার বড় মত গাছটার দিকে নির্দেশ করে ফাঁসা গলায় বলে উঠলো “তোমাকে উনি ডাকছেন!” রুবেল অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো! সন্ধ্যের আঁধার ততক্ষণে চারপাশটাতে নামতে শুরু করে দিয়েছে!
পর্ব ৫
হাত নেড়ে ডাকছে সে! আজ মুখের স্নিগ্ধভাবটা আর নেই! বরং অনেক বেশি ভীত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মনে হচ্ছে তাকে! রুবেল আর তাকিয়ে থাকতে পারছিলনা। চোখগুলো জ্বলতে শুরু করেছে তার! মাথাটা ঘুরছে! হঠাৎ করেই লোকটা গাছের তলা থেকে বেরিয়ে গেরুয়া চাদরটাকে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে রুবেলের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে! রুবেল বিস্ফোরিত চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বাগানের চেয়ারটা ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়! জুবেদা আর নেই এখানে! কোথায় গেল, আর কখনই বা গেল? এসব ভাবতে ভাবতেই দেখে লোকটা অনেকটা সামনে এসে পড়েছে! আবারও সেই সুমিষ্ট গন্ধটা পাচ্ছে রুবেল! মনে পড়েছে এবার তার! এটা চন্দনের গন্ধ! কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় নেই আর তার! সে প্রায় এক ছুটে বাগান ছেড়ে লজের রিসেপ্সনে এসে পৌঁছায়। সেই দুর্বোধ্য মন্ত্র পাঠ আবার শুরু হয়েছে, ঠিক সেদিনের মত! সভয়ে পিছন ফিরে দেখে লোকটা বাগানের চেয়ারের পাশটাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে! কুয়াশার ঘন চাদর যেন তাকে ছুঁতেও নারাজ! আবারও সেই আঙুল তুলে মানা করে উঠলো সে! কিসের মানা সেটা কিছুটা হলেও এবার বুঝতে পারছিল রুবেল।
জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে রুবেলের! কিছুতেই জ্বরটা নামছে না তার! “রামিজ, যা তো একবার ডাক্তারবাবুকে খবরটা দিয়ে আয়! মিয়াঁর জ্বরটা তো একদমই নামছে না!” বলে উঠলো মুজিব। রামিজ মাথা হেলিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
“রোগীর জ্বরটা ভালোই আছে! ইঞ্জেকশন দিলাম একটা। আর কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি আজকে নয়তো কাল সকালের মধ্যে কিনে এনে এনাকে দেওয়া শুরু করতে হবে! আর তাও যদি শরীর ঠিক না হয় তাহলে আমাকে একবার খবর দিয়ে দেবেন! আসি আমি!” বলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যেতেই সায়েদা এসে রুবেলের রুমে ঢুকল। রুবেল তখন ইঞ্জেকশন আর জ্বরের প্রভাবে বেহুঁশ। বেশ কিছুক্ষণ রুবেলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সায়েদা বলল “রিসেপ্সনে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল মিয়াঁ!দুপুর অব্দি তো ভালই ছিল! তারপর কি হল কি জানি! আল্লাহর রেহেম যে রামিজ সময়ে দেখতে পায় রুবেল মিয়াঁকে! না জানি কতক্ষণ সেইভাবেই পড়ে ছিল!” মুজিব একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে কিন্তু বিপদ! তখন রুবেল মিয়াঁর বাড়ির লোককে খবর দিতে হবে! দেখা যাক কাল অব্দি কেমন থাকে!” মুজিবের কথা শুনে সায়েদা নিঃশব্দে মাথা হেলালো।
“ওরা তো আগের থেকেই সব জানতো কিন্তু এবার উনিও জেনে গেছেন! আর কিন্তু রক্ষে নেই! আমি তোমাকে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েওছিলাম, কিন্তু তুমি শোনোনি! এবার বাজবে প্রলয়ের ডঙ্কা! উনি কাউকে ক্ষমা করেননা! কাউকে না! ওনার যুদ্ধের মাঝে যেই আসবে, তাকে তার মূল্য দিতে হবে! আর সেই মূল্য তাকে তার নিজের প্রাণ দিতে চোকাতে হয়…” গগনভেদী এক চিৎকার শুরু হল এরই সাথে! বারবার যেন অনুরণিত হতে থাকলো “মূল্য দিতে হবে নিজের প্রাণ দিয়ে…” আচমকা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল রুবেলের। কি ভয়ানক স্বপ্ন! স্বপ্ন নাকি অন্যকিছু? রুবেলের গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! ঘুম ভেঙ্গে কিছুটা ধাতস্থ হতে নিজের শরীরের দুর্বলতাটা টের পেল সে! “আমি রুমে কখন এলাম? আমি তো বাগানে…” ভাবতে গিয়ে একটা ভয়ের স্রোত যেন তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। নিজেকে সামলে অনেক কষ্টে উঠে বসলো সে! আজ ঘরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে! এখন কত রাত কে জানে! বিছানার সাইড টেবিলটাতে হাত বাড়িয়ে জলের জগটা টেনে আনল রুবেল। তারপর পাশে রাখা কাঁচের গ্লাসটাতে জল ঢালতে শুরু করলো। জলের গ্লাসে এক চুমুক সবে দিয়েছে তখনই ঝুপ করে ঘরের নাইট ল্যাম্পটা নিবে গেল। আচমকা এরকম হওয়াতে রুবেল প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। এমনিতে তার লাইট সব অফ করেই শোয়া অভ্যেস! তাই অন্ধকারে এরকম কিছু মনে হওয়া তো উচিত নয় কিন্তু একে জ্বরে শরীর দুর্বল তার উপর কদিন ধরে ঘটে চলা এসব অদ্ভুত ঘটনার জন্য রুবেলের বেশ ভয়ই করছিল! হঠাৎ একটা খুব মৃদু গুনগুন আওয়াজ কানে এল রুবেলের! আওয়াজটা মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে আসছে! কিন্তু সেটা কি এগিয়ে আসছে ক্রমশ? ধীরে ধীরে যেন পরিষ্কার হচ্ছে আওয়াজটা! কেউ গাইছে, কোন মেয়ে! কিন্তু গাইছেটা কি সেটা বোঝা যাচ্ছেনা! গানের আওয়াজটা করিডর হয়ে রুবেলের রুমের দরজা পর্যন্ত এসে গেছে! খুবই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে! কিন্তু কথাগুলো বোধগম্য নয়!”কে? কে ওখানে?” কাঁপা গলায় বলে উঠলো রুবেল। গানটা সেই মুহূর্তে থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ এক অস্বাভাবিক নীরবতা। তারপর হঠাৎই যেন একটা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এল রুবেলের কানে! খুবই ক্ষীণ! কিন্তু শীতের রাতের নিস্তব্ধতার জন্য মনে হয় এত ক্ষীণ আওয়াজও কানে এল রুবেলের! পরক্ষণেই মনে হল কেউ যেন রুবেলের দরজার বাইরে থেকে করিডর ধরে ছুটে যাচ্ছে! কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে! ক্রমশ সেই চিৎকারের আওয়াজটা স্পষ্ট হচ্ছে যেন! রুবেল এটা সেটা ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে অতি কষ্টে নেমে আসে। তারপর মোবাইলটা হাতড়ে বের করে মোবাইল থেকে আলোটা জ্বালাল। মুহূর্তেই নিকষ অন্ধকারের গভীরতাটা আলোর অনুপ্রবেশের ফলে ম্লান হয়ে গেল! গায়ে একটা মোটা শাল জড়িয়ে টলোমলো পায়ে রুমের দরজাটা সভয়ে খুলে বেরিয়ে এল রুবেল। করিডরটাও অন্ধকারে ডুবে আছে! না কেউ নেই করিডরে! তবে কি যে এসেছিল সে চলে গেছে? কিন্তু এই মাঝরাতে ভিতর থেকে বন্ধ লজে কেই বা আসতে পারে? প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছে রুবেলের! লজটা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে আছে যেন! শুধু এই লজটাই নয় এমনকি আশেপাশের কোন দিক থেকেও আলোর লেশমাত্র দেখা যাচ্ছেনা! তবে আজকে চাঁদ উঠেছে বেশ সুন্দরভাবে! একদম ঈদের চাঁদের মত! এদিকে চিৎকারটাও আর শোনা যাচ্ছেনা! তবে কি জ্বরের ঘোরে ভুল শুনল সে? হবে হয়তো! রিসেপ্সন অব্দি আসার আগেই ফিরে যাচ্ছিল সে কিন্তু তখনই মনে হল যেন কেউ ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! চট করে পিছনে ফিরতেই একরাশ হিম শীতল হাওয়া তাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল! এতটাই শীতল সেই হাওয়া যার প্রভাবে রুবেলের অন্তরাত্মা পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠলো। একটু ধাতস্থ হতেই তার চোখ যায় লজের মেন দরজার দিকে! দরজাটা খোলা মনে হচ্ছে যেন! একরাশ কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে রুবেল।
দরজাটা খোলা! আবার সেই চিৎকারটা শোনা যাচ্ছে! রুবেল মন্ত্রমুগ্ধের মত দরজা ছেড়ে বাগানে এসে পৌঁছায়! সে ঠাহর করার চেষ্টা করতে থাকে আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে! কোন এক মন্ত্রবলে সে লজের বাগান পেরিয়ে মেন গেট খুলে বেরিয়ে আসে। ধীরে ধীরে গলির মধ্যে হাঁটতে থাকে সে আর চেষ্টা করতে থাকে চিৎকারের উৎসটা ঠিক কোনদিকে! এইভাবে একসময় ডাল লেকের ধারে এসে পৌঁছায় সে! লেকের অপরপারে অনেকটা দূরে কিছু আলোর চলমান উৎস তার চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে সেই আলোর উৎসগুলো লেকের দিকেই এগিয়ে আসছে আর সাথে সেই চিৎকার আর এবার যেন কিছু ঘোড়ার ক্ষুরেরও আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল! রুবেল আবিষ্টের মত দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগলো।
অনেকটা এসে গেছে এবার তারা! ঘোড়সওয়ারগুলোর প্রত্যেকের হাতেই একটা করে বিশালাকার তরোয়াল! প্রত্যেকেই লম্বাটে টাইপের একরকমের কিছু পোষাক পড়ে আছে! আলো আঁধারিতে সবটা পরিষ্কার ঠাহর করা যাচ্ছেনা। রুবেল দুপা এগিয়ে এসে দেখার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে তারা একেবারেই লেকের ওই পাড়ে নেই বরং অদ্ভুতভাবেই তারা লেকের একদম মাঝখানটাতে এসে দাঁড়িয়েছে! রুবেল যেন কিছু ভাবনা বা চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে! লেকের অন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক দল ঘোড়সওয়ার দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে! এখন দুটো ঘোড়সওয়ারের দল পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে! দুটো দলের মাঝে ঢিল ছোঁড়া দুরত্ব এখন! আস্তে আস্তে এবার যেন চারপাশটা হঠাৎই বদলে যেতে থাকে! রুবেল তাকিয়ে দেখে লেকের জলটা আর নেই বরং সেটা এক এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমিতে পরিণত হয়েছে! চারপাশের বাড়িঘর, হাউসবোট কিচ্ছু নেই বরং ধু ধু বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় পরিণত হয়েছে! চাঁদের আলো আর দেখা যাচ্ছেনা! শুধু দুই পক্ষের মশালগুলো ধিকিধিকি জ্বলে যেন যুদ্ধ পূর্ববর্তী নীরবতাকে বয়ান করে চলেছে! এরপর প্রথম ঘোড়সওয়াদের দলনেতা কিছু একটা দুর্বোধ্য ভাষায় বলে উঠলো! ভাষাটা না বুঝতে পারলেও সেটা যে যুদ্ধের হুংকার তা বুঝতে বাকি রইল না রুবেলের! চকিতেই রে রে করে দুই পক্ষের ঘোড়সওয়াররা ছুটে আসতে থাকলো! তারপর শুরু হল এক অসম তুমুল যুদ্ধ! যার সাক্ষী হয়ে রইল রুবেল! অসম এই কারণেই যে অপর পক্ষের সেনারা বেশিক্ষণ সেই প্রথম পক্ষের সেনাদের সামনে টিকতে পারলনা! দলে দলে সব ঘোড়া থেকে নিচে পড়ে ধরাশায়ী হতে থাকলো! সবশেষে পরাজিত দলের দলনেতা, বেশ সুসজ্জিত পোষাকে পরিহিত যে, তাকে বিজয়ী দলের দলনেতার সামনে এনে দাঁড় করানো হল! বিজয়ী দলনেতা মনে হয় ভেবেছিল সেই পরাজিত দলনেতা নিজের প্রাণভিক্ষা করবে! কিন্তু সে নিচু গলায় কিছু একটা বলে ওঠে! যেটা শোনা মাত্রই বিজয়ী নেতা তার হাতের তরবারি দিয়ে সেই পরাজিত দলের নেতার মুণ্ডচ্ছেদ করে দেয়! ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে! রুবেল আঁতকে ওঠে এবার! তারপর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করতে থাকে! কিন্তু পারেনা! কেউ যেন তাকে আটকে দিয়েছে ওখানেই! আবার সামনের দিকে নজর যেতেই সে দেখে কিচ্ছু নেই সেখানে! পুরো ফাঁকা! শুধু একটা তাবু মাঝখানে রয়েছে যার ভিতরে দুজন নরনারী আছে সম্ভবত সেটা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে কারণ ভিতরে প্রদীপ জাতীয় কিছু আলোর উৎস রয়েছে সম্ভবত যার জন্য তাদের দুজনের ছায়া রুবেলের সামনে প্রকট হয়ে উঠেছে বাইরে থেকেই!
পুরুষ অবয়বটা নারী অবয়বটার সাথে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে! আবার মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে রুবেল! পুরুষ অবয়বটা নারী অবয়বটার পোষাক টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে সম্ভবত কিন্তু পেরে উঠছে না কেন জানিনা! এরকম ধস্তাধস্তি বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎই এক গগনভেদী আর্তনাদ ভেসে আসে তাবুর ভেতর থেকে! আর আর্তনাদটা ছিল পুরুষ কণ্ঠের! কয়েক মুহূর্ত পর রুবেল দেখে পুরুষ অবয়বটা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছে আর নারী অবয়বটা উঠে দাঁড়িয়েছে! হাতে একটা বড় ধারালো কিছু যার কানা বেয়ে কিছু একটা চুইয়ে পড়ছে! রক্ত কি সেটা তবে?
এরপর হঠাৎ তাবুর ভেতরের আলোটা নিবে গেল! নিকষ অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা! হঠাৎ সেদিনের স্বপ্নে দেখা জিনিসটা দেখতে পেল রুবেল। অনেক দূরে অনেকগুলো লোক মিলে দুটো তিনটে মশাল জ্বালিয়ে একটা বড় মত বাক্স নিয়ে নিঃশব্দে কোথাও চলেছে! রুবেলের হঠাৎ করেই যেন সম্বিত ফিরে এল। সে জানে এরা কারা! সে জানে এরা কি নিয়ে চলেছে! হ্যাঁ! এটাই তো কাল সারাদিন ধরে সার্চ করে সে বের করেছিল! স্বপ্নে দেখা সেই ঘটনাটা কি বা কার সাথে সম্পর্কিত! কিন্তু সে ভেবেছিল অতিরিক্ত ফিকশন আর থ্রিলার গল্পের কথা ভাবা আর পড়ার জন্য তার সাথে এরকম হচ্ছে! এ অসম্ভব! সে কি বাস্তবে আছে নাকি স্বপ্নে? রুবেলের মাথা ঘুরতে থাকে!
“তুমি বাস্তবে আছো! আর ওরা তোমাকে চিনে ফেলেছে! ওরা এই রাস্তায় আসা কাউকেই আজ অব্দি জীবন্ত ছাড়েনি!” মাথা ঘোরাতেই দেখে সেই গেরুয়া বসন পড়া লোকটা! একদম তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! “এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? এ বাস্তব হতে পারেনা! অসম্ভব!” বলে আবারও ছুটতে চেষ্টা করে রুবেল! এবার ছুটতে পারে সে! কোন বাঁধন নেই আর! সামনের দিকে পাগলের মত ছুটতে গিয়ে হঠাৎ করে কিছু একটা ঠাণ্ডা জিনিসে তার পা ঠেকে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে টাল সামলাতে না পেরে ঝপ করে পড়ে যায়! “এখানে জল…” বরফ ঠাণ্ডা জলের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে বলতে থাকে রুবেল! জল থেকে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু পারেনা! কেউ যেন জলের তলা থেকে তার পা দুটোকে টেনে রেখেছে! জ্বর শরীর নিয়ে আর বেশিক্ষণ সেই আসুরিক শক্তির সাথে আর পেরে উঠতে পারলনা রুবেল! পা সমেত তাকে সেই আসুরিক শক্তি সর্বশক্তি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল জলের তলায়! হিমশীতল জলের তলায় শেষবারের মত দমটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে রুবেল অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল তাকে! থুতনিতে সাদা দাঁড়ি আর তার ফাঁকে ক্রূর হাসি!
সেদিন রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়লো! অসম্ভব ঠাণ্ডা! ডাললেকের জলটা পুরোপুরি জমে গেল সেই এক রাতে! আর সেই বরফের তলার জলে কবর হয়ে গেল একজন, একজন উঠতি লেখক! নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, হারিয়ে গেল!
পর্ব ৬
“দ্যা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইস কারেন্টলি সুইচড অফ! প্লিস ট্রাই এগেন লেটার!” এই নিয়ে প্রায় পঞ্চাশবার ট্রাই করা হয়ে গেল পারভেজের! কিন্তু না! কোন উত্তর পাওয়া গেলনা! কি হল তবে রুবেলের? সে যত জরুরী কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন, ফোন তো অফ রাখেনা! আজ প্রায় তিনদিন ধরে ট্রাই করে চলেছে সে রুবেলের ফোনে! কিন্তু প্রত্যেকবারই সেই একই মেশিন জেনারেটেড ভয়েসে সেই একই কথা! এবার খুব চিন্তা হতে লাগলো পারভেজের! “জান্নাত লজের ফোন নাম্বারটাও নিয়ে রাখা হয়নি! শিট!” নিজের মনেই কথাগুলো বলে মাথা চাপড়াতে থাকলো পারভেজ।
এইভাবে আরও চারদিন বেরিয়ে গেল। কিন্তু রুবেলের ফোনও লাগছিলনা আর রুবেলও নিজের থেকে কোন যোগাযোগ করছিল না পারভেজের সাথে! দুশ্চিন্তাটা এবার যেন অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছিল পারভেজের। অনেক ভেবেচিন্তে অফিসে একটা এক সপ্তাহের লিভ অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে ছুটি মঞ্জুর হতেই দিল্লি থেকে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে পারভেজ। রাস্তায়ও বহুবার রুবেলের ফোন ট্রাই করতে থাকে সে! কিন্তু না! সেই একই জবাব প্রতিবার!
“ভাইজান, একটু শুনবেন?” পারভেজের ডাক শুনে একজন ফিরে তাকিয়ে বলল “বলুন মিয়াঁ!” পারভেজ একটু এগিয়ে এসে বলল “এই জান্নাত লজটা ঠিক কোনদিকে পড়বে একটু বলতে পারবেন?” লোকটা একবার পারভেজকে উপর থেকে নীচ অব্দি দেখে নিয়ে বলল “কোন জান্নাত লজ?ডাল লেকের সামনে যেটা?” পারভেজ উত্তেজিত হয়ে বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই হবে! আমার ছোটা ভাই বলেছিল লজটার একদম সামনেই লেকটা পড়ে!” লোকটা বলল “ওখানে কেন যাবেন এত লজ থাকতে?” পারভেজ কিছু একটা বলার আগেই লোকটার একটা ফোন এসে গেল। সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পারভেজ আর অপেক্ষা না করে চায়ের দোকানে টাকাটা মিটিয়ে বেরিয়ে এল। “ভাইজান? ডাল লেকটা এখান থেকে কতদূর পড়বে?” রাস্তায় একজনকে পারভেজ জিজ্ঞেস করলো। “বেশিদূর না মিয়াঁ! পায়ে হেঁটে পন্দ্রা মিনিট মত লাগবে!” জবাব শুনে সুক্রিয়া জানিয়ে পারভেজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
“হ্যালো কেউ আছেন? কি ব্যাপার! এই লজটা বন্ধ কেন? হ্যালো?” জংগ ধরা মেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো পারভেজ। লজটার আশেপাশে বেশ কিছুটা দূরত্বে অন্যান্য বাড়িঘর, লজগুলো আছে! “কাউকে তো জিজ্ঞেস করতেই হবে! “ বলে সামনের গলিটা ধরে বেরোতে যাওয়ার সময়ে একজনের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় পারভেজের। কোন ভূমিকা না নিয়েই বলে ওঠে পারভেজ “ভাইজান, এইটাই জান্নাত লজ তো?” বলে আঙ্গুল তুলে পিছনের লজটার দিকে দেখায়! লোকটা অসম্ভব বিস্ময়ে বলে ওঠে “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন?” “আসলে এই লজেই আমার ভাই এসে উঠেছে প্রায় ২০ দিন মত হল! কিন্তু দেখছি লজটা তো বন্ধ…” পারভেজকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে লোকটা আরও অবাক হয়ে বলল “দাঁড়ান দাঁড়ান মিয়াঁ! কি বললেন এখনি আপনি? আপনার ভাই এই লজে ২০ দিন আগে এসে উঠেছে? মিয়াঁ আপনি ভুল শুনেছেন হয়তো! অন্য কোন লজে এসে উঠেছে হয়তো আপনার ভাই! একবার জিজ্ঞেস করে নিন ভাইকে!” পারভেজ বলল “আরে না না ভাইজান, এক সপ্তাহ আগেই কথা হল রুবেল মানে আমার ভাইয়ের সাথে! বলল যে জান্নাত লজেই উঠেছে এবারও! যদিও আমি এখানে প্রথমবার এলাম। আর কোন জান্নাত লজ আছে কি এই লেকের ধারে?” লোকটা মাথা নাড়িয়ে বলল “না! আর তো নেই! আপনি আপনার ভাইকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিন! হয়তো ভুল শুনেছেন!” পারভেজ অস্থির হয়ে বলল “না না, এতবার কথা হল ওর সাথে! ও জান্নাত লজেই এসে উঠেছে! আর তাছাড়া ওর ফোনও লাগছে না ৭ দিন ধরে!” লোকটা এবার কি মনে হতে পারভেজের হাতটা ধরে লজটার সামনে নিয়ে এল। তারপর মেন গেটের তালাটার দিকে দেখিয়ে বলল “এই দেখুন মিয়াঁ! এখানে তালা মারা তার উপর সরকারি সিল! দেখেছেন? এই লজটা প্রায় দুবছর আগেই সিল হয়ে গেছিল! আপনার ভাই কিভাবে ২০ দিন আগে এই লজে এসে উঠতে পারে বলুন তো?” পারভেজ এবার তাকিয়ে দেখল সিল করা তালাটার দিকে! সত্যিই তো! এতক্ষণ তার নজরই পড়েনি এইদিকে! পারভেজ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা পারভেজের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলল “মিয়াঁ, আপনি মনে হচ্ছে অনেকটা রাস্তা সফর করে এসেছেন! আমার বাড়ি পাশের গলিতেই! চাইলে একটু পানি খেয়ে আরাম করে পারেন!” পারভেজ কিছু না বলে লোকটার পিছু পিছু চলল।
“এই জান্নাত লজটা একসময় খুব নাম করেছিল! মুজিব মিয়াঁ আর ওর বেগম মিলে একদম একা হাতে ছোট্ট লজটাকে দারুণ সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলেছিল! সবই খুব ভাল চলছিল কিন্তু হঠাৎই একদিন কানে আসে যে লজের উপর তলা থেকে মাঝ রাতে কারুর চিৎকারের আওয়াজ শোনা যায়। এটা ওই লজে যারা গিয়ে উঠত তাদেরই মুখ থেকে শোনা গেছিল! এরপর যত দিন যেতে থাকে তত এই রোজ রাতের চিৎকারের মাত্রা বাড়তে থাকে। বেশ কিছুদিন পর দেখি মুজিব আর ওনার বেগম মিলে মেয়ে জুবেদা আর ছেলে রেহানকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। অনেক লাগেজ ছিল, একটা বড় মত গাড়ি সম্ভবত ভাড়া করে যাচ্ছিল। আমার সাথে দেখা হয়ে যায় সেই সময়ে! আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম কোথায় যাচ্ছে কিন্তু মুজিব এড়িয়ে যায়। বলে “এই তো সায়েদার আম্মির বাড়িতে যাচ্ছি একটু!” গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে এক ঝলক দেখেছিলাম জুবেদাকে সেদিন। বেহুঁশ মত হয়ে সায়েদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল! এবার আপনিই বলুন, কেউ সিজনে এত ভাল চলা বিসনেসকে রামিজের হাতে ছেড়ে দিয়ে সপরিবারে কোথাও এমনি এমনি কি ঘুরতে যায়?” বলে থামল লোকটা। বিস্ময়ভাবটা কাটিয়ে পারভেজ জিজ্ঞেস করলো “এই রামিজ কে?” লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “রামিজ এই লজের কেয়ার টেকার ছিল, সায়েদা বেগমের দূর সম্পর্কের কোন এক ভাই বলে শুনেছিলাম।“ “আচ্ছা! তারপর কি হল?” পারভেজ তাকাল লোকটার দিকে। “তারপর যে কি হল সেটা কেউই জানেনা। পরে শুনেছিলাম মুজিবের মেয়ে জুবেদাকে কোন জিনে ধরেছিল সম্ভবত। আর তার উপায় বের করতেই সপরিবারে কোন মৌলবি সাহেবের কাছে গেছিল তারা!” লোকটার কথা শেষ হতেই পারভেজ বলল “তারপর? রামিজ তো এখানেই ছিল! সে কিছু বলেনি? আর এখন সে কোথায়?” “সেইদিন যেদিন মুজিব সপরিবারে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেছিল তারপর তারা আর কেউই ফিরে আসেনি! মানে তাদের আর দেখা যায়নি! হ্যাঁ, রামিজ লজটা সামাল দিচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু একদিন রামিজও নিরুদ্দেশ হয়ে যায় হঠাৎ করেই! আর তারপর প্রায় একমাস পর লেকের অন্য এক প্রান্তে তার লাশ পাওয়া যায়!” লোকটার কথাটা শেষ হতে অজান্তেই শিউরে ওঠে পারভেজ। তারপর বলে “কিন্তু রামিজ এইভাবে কি করে…” “জানিনা মিয়াঁ! পুলিশ এসেছিল! তদন্তও হয়েছিল! কিন্তু কিছুই জানা যায়নি! তখনই মুজিব আর তার পরিবারের অন্তর্ধানের ব্যাপারটাও সামনে আসে। পুলিশ শেষ পর্যন্ত মনে হয় এইটুকুই জানতে পেরেছিল যে মুজিবদের শেষ লাদাকের কোন এক গ্রামে দেখা গেছিল। সবই লোকমুখে শোনা, বুঝতেই পারছ! অনেক কিছু উপায় করেও শুনেছিলাম পুলিশ মুজিবের পরিবারের অন্তর্ধান রহস্য কিম্বা রামিজের মৃত্যু রহস্যের কোন কিনারা করতে পারেনি! আর বেশ কিছুদিন পর লজটাকে সিল করে দেওয়া হয় সরকারি ভাবে! এই সব ঘটনা প্রায় দুবছর আগের! তবে এখানের স্থানীয় মানুষ জান্নাত লজটাকে ভৌতিক বলে মনে করে! অনেকেই এখনো সেই চিৎকার কিম্বা হাসির শব্দ কিম্বা কোন মেয়ের গুনগুন করে গান গাওয়ার শব্দ পেয়েছে, রাতে এমনকি দিনের বেলাতেও!” বলে থামল লোকটা। পারভেজ চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বলল “ভাইজান, আমার খুব ভয় করছে! আমার এখনও পরিষ্কার মনে পড়ছে আমার ভাই রুবেল বলেছিল যে সে এবারও জান্নাত লজেই উঠেছে! তার সাথে কিছু…” লোকটা পারভেজকে শান্ত করতে করতে বলল “আপনি মিয়াঁ শান্ত হন! ভয়ের কিছু নেই! আপনি যদি ভাইয়ের সাথে একেবারেই যোগাযোগ করতে পারছেন না তাহলে আমার মনে হয় আপনার একবার পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত! আল্লা না করুক হয়তো আপনার ভাই কোন অন্য মুসীবতে পড়েছে!” পারভেজ ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে।
“কবে থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা?” পুলিশের কথায় পারভেজ বলে “ সাতদিন ধরে কোন যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা!” “ঠিক আছে! আপনার ভাইয়ের একটা ফটো আর বাকি ডিটেলস গুলো দিয়ে দিন! কিছু জানা গেলে আপনাকে জানানো হবে। আপনার ফোন নাম্বারটাও লিখিয়ে দিয়ে যান!” পুলিশের কথায় নীরবে মাথা নাড়ে পারভেজ।
দুদিন পরঃ
“হ্যালো, মিঃ পারভেজ আহমেদ বলছেন?” ফোনটা তুলে পারভেজ বলল “হ্যাঁ বলছি, বলুন!” অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল “আপনি এখুনি একবার শ্রীনগর থানায় চলে আসুন!” “কেন স্যার? আমার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন নাকি?” পারভেজের কথার জবাবে অপরপ্রান্ত থেকে শোনা যায় “আপনি আসুন, এলেই বুঝতে পারবেন!” ফোনটা রেখে চুপ করে বসে রইল পারভেজ। কেন জানিনা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু তো একটা খারাপ হতে চলেছে!
“আপনারা আমাকে মর্গে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? কিছু বলবেন প্লিস?” উত্তেজিত হয়ে বলে চলে পারভেজ। দুজন কনস্টেবলের একজন বলে “দুদিন আগে লেকের ধার থেকে একটা লাশ পাওয়া গেছিল। শনাক্ত করা যাচ্ছিল না! দুদিন আগে আপনার দেওয়া বর্ণনা আর ছবি অনুযায়ী আমরা খোঁজ শুরু করি আর সাথে মর্গের অশনাক্ত লাশগুলোর সাথেও মেলানো শুরু হয়! তো সেই লেকের পাশ থেকে পাওয়া লাশটার সাথে অনেকটাই মিল পাওয়া গেছে আপনার ভাইয়ের। লাশে পচন শুরু হয়ে গেছে তাই মুখ দেখে কতটা শনাক্ত করতে পারবেন জানিনা। তবে মৃত ব্যক্তির কিছু জিনিস পাওয়া গেছে সাথে যেমন শার্ট, প্ল্যান্ট ইত্যাদি। সেগুলোও একবার করে দেখে নেবেন আসুন।“ পারভেজের বুকের ভিতর যেন হাজারটা হাতুড়ি পেটাচ্ছিল কেউ। একটা রুমের মধ্যে তাকে সাথে নিয়ে ঢোকে তারা। তারপর একজন কম্পাউনডার এসে একটা সাদা চাদরে ঢাকা লাশের মুখের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দেয়। পারভেজ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই ছুটে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসে। হড়হড় করে বমি করে ফেলে সে।
“এই কিছু জিনিস পাওয়া গেছিল লাশের সাথে! এগুলো আপনার ভাই রুবেলের তাই তো?” অফিসারের হাত থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরা জামাপ্যান্ট গুলো কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলো পারভেজ। তার আর চিনতে ভুল হলনা যে এগুলো তার ভাইয়েরই! তার এটাও বুঝতে বাকি রইলো না যে রুবেল আর এই দুনিয়ায় নেই।
“অফিসার, আমার ভাইয়ের মৃত্যু কিভাবে হয়েছে?” পরের দিন থানাতে এসে বলে পারভেজ। পুলিশ অফিসার আমির রহমান ইশারায় পারভেজকে বসতে বলেন। তারপর বলেন “আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি মিয়াঁ। ময়না তদন্তে পাঠানো হয়েছে, রিপোর্ট এখনও আসেনি! কিন্তু একটা কথা আমি আপনাকে বলে রাখতে চাই। এই নিয়ে গত দুবছরে লেকের পাশ থেকে ১০ নম্বর মৃতদেহ পাওয়া গেল। প্রতিবারই ময়না তদন্ত হয় কিন্তু অদ্ভুতভাবেই ময়না তদন্তের রিপোর্টে কিছু অস্বাভাবিক ধরাই পড়েনা। আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা জিনিস এই সবের মাঝে আছে যেটা ঠিক নেই! কিন্তু এর কিনারা করে উঠতে পারছিনা।“ পারভেজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “আমি সেসব জানিনা অফিসার! আমার ভাইয়ের মৃত্যুর কিনারা করতেই হবে! উঠতি লেখক ছিল সে, লেখা পাগল ছিল আমার ভাই! লেখালিখির জন্য প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো! এবারের উপন্যাসটার জন্য কাশ্মীরকেই বেছে নিয়েছিল সে, যদিও এখানে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো তার! কিন্তু এবার মনস্থির করেই ফেলেছিল যে এমন কিছু একটা সৃষ্টি করবে সে যা সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে হবে কিন্তু তা মানুষকে ভাবাবে যে এরকমও হয়? কাশ্মীরেই সেই রসদ পাওয়া যাবে বলে মনে হয়েছিল তার! তাই এখানে এসেছিল, জান্নাত লজে উঠেছিল, আর সে কথা আমাকে ফোনে জানিয়েওছিল। আর এখন শুনছি এই জান্নাত লজটা নাকি দুবছর আগেই সিল হয়ে গেছে! এটা কিভাবে সম্ভব অফিসার? আমার ভাই আমাকে মিথ্যা কথা কেন বলবে বলুন তো” পারভেজের কথা শেষ হতেই বিস্মিতভাবে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন অফিসার আমির “কি বললেন? আপনার ভাইও জান্নাত লজে উঠেছে বলে বলেছিল আপনাকে?” পারভেজ অবাক হয়ে বলে “আমার ভাইও মানে?” অফিসার আমির বলেন “মানে আগের ৯টা কেসেও ভিকটিমরা প্রত্যেকেই বাড়ির কাউকে কিম্বা বন্ধুদের এটাই জানিয়েছিল যে তারা জান্নাত লজে এসে উঠেছে! আর প্রতি ক্ষেত্রেই তারা একাই এসেছিলেন কাশ্মীরে বিভিন্ন কাজে! অথচ এই জান্নাত লজটা আজ থেকে দুবছর আগেই সিল হয়ে গেছিল যখন লজের কেয়ার টেকারের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, কোইন্সিডেনটলি তারও লাশ লেকের পাশ থেকেই পাওয়া গেছিল নিখোঁজ হওয়ার বহুদিন পর! কি যেন নাম ছিল…” “রামিজ?” পারভেজ হঠাৎ বলে উঠলো। অফিসার আমির বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ রামিজ ঠিক! এই রামিজের মৃত্যুর পর থেকেই এই লাশ পাওয়া শুরু হয়! তা আপনি কিভাবে জানলেন তার নাম?” অফিসারের প্রশ্নে পারভেজ জান্নাত লজের সামনে দেখা হওয়া লোকটার থেকে জানতে পারা সব কিছু খুলে বলল তাকে। সব কিছু শুনে অফিসার আমির বললেন “আমি এসব জিন টিনে বিশ্বাস করিনা তবে এই লজের মালিক ও তার পুরো পরিবারকে সত্যিই ট্রেস করা যায়নি। লাদাকে শেষ দেখা গেছিল তারপর যেন সপরিবারে কোথাও গায়েবই হয়ে গেছে!” পারভেজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল “অফিসার আমি চাই আমার ভাইয়ের মৃত্যুর কিনারা হোক!” অফিসার আমির বললেন “আগে ময়না তদন্তের রিপোর্টটা তো আসতে দিন মিয়াঁ!” পারভেজ বলল “আমি সেই অব্দি অপেক্ষা করতে পারবনা অফিসার! আমি দরকার পড়লে নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর রহস্য নিজেই খুঁজে বের করবো। আপনার কাছে এটা হয়তো একটা কেস শুধুই! কিন্তু আমার কাছে এটা আমার এক অঙ্গের বাদ চলে যাওয়ার সমান, কিম্বা তারও বেশি কিছু। আমরা দুই মা-বাপ মরা ভাই, রুবেল ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই আমার! আমার রূহকে এইভাবে যে বা যারা কেড়ে নিল আমার থেকে তাকে খুঁজে বের করে একটাই সওয়াল করতে চাই আমি “কেন? কেন সে কেড়ে নিল রুবেলকে! কি দোষ ছিল তার?”” অফিসার বললেন “মিয়াঁ আপনি শান্ত হন! বেওয়াকুফি করবেন না! আমরা আছি কেসের তদন্তের জন্য! আপনি নিজে কেন সেধে বিপদে পড়তে যাবেন! ভরসা রাখুন আমাদের উপর!” পারভেজ আর কিছু না বলে বেরিয়ে এল থানা থেকে।
এইভাবে আরও দুদিন গেল। রুবেলের বডি পারভেজকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে এখনও অব্দি ময়না তদন্তের রিপোর্ট কেন এল না! ইসলাম মতে রুবেলের দেহকে সমাধিস্থ করা হল শ্রীনগরেই! রুবেলের কবরে মাটি দেওয়ার সময় পারভেজ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা। হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আশেপাশের লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এল।
হোটেলের রুমে ফিরে পারভেজ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। কান্নাটা এখনও দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের ফোনটা নিয়ে অফিসে একটা কল করলো “আমার ছুটিটা বাড়াতে হবে যেমন করেই হোক! আমি কিছু জানিনা! আমার ভাই রুবেল আর নেই! তুমি দেখো কিভবে কি করা যায়! রাখছি আমি!” বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে নিজের লাগেজ গোছাতে শুরু করলো পারভেজ। হোটেল থেকে চেক আউট করে বেরিয়ে এল সে। তারপর ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল।“ভাইজান, আমি লাদাকে যাবো রিসার্ভ করে, যাবেন?” পারভেজের কথা শুনে ক্যাবের লোকটা বলল “কেন যাবনা মিয়াঁ! আসুন বসুন!” বলে ক্যাবের দরজাটা খুলে দিল। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গন্তব্য লেহ!
পর্ব ৭ (শেষ পর্ব)
“হ্যালো মিঃ পারভেজ? আপনি কোথায় আছেন এই মুহূর্তে?” ফোনের অপরপ্রান্তে অফিসার আমিরের গলা পেল পারভেজ। একটু কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল “আমি এই মুহূর্তে লেহতে আছি অফিসার!” “আপনি কার পারমিশনে শ্রীনগর ছেড়ে বেরোলেন? আপনাকে আমি বলেছিলাম তো যে আপনার ভাইয়ের কেসটার তদন্ত চলছে! তার পরেও আপনি…” অফিসার আমিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই পারভেজ বলে ওঠে “আমার ভাইয়ের ইন্তেকালের পর তাকে সমাধিস্থ পর্যন্ত করা হয়ে গেল! আর আপনারা কি এখনও ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাননি? হয়তো আগের ৯টা কেসের মতই এটাতেও কোন সলিউশন বেরোইনি বলে দেবেন! কিন্তু আমি সেটা মানবোনা!” “দেখুন মিঃ পারভেজ, আমরা আমাদের কাজ করছি!” অফিসারের আমিরের কথার প্রত্যুত্তরে পারভেজ বলে “ঠিক আছে অফিসার করুন! আর প্লিস আমাকেও আমার কাজ করতে দিন! রাখলাম।“ বলে ফোনটা নামিয়ে রাখল পারভেজ।
“গ্রামের নামটা তো এটাই বলছিলেন অফিসার আমির! মাথু গ্রাম! কিন্তু এবার কিভাবে শুরু করবো! আমাকে আগে এই জান্নাত লজের ব্যাপারে সব কিছু জানতে হবে। আর সে ব্যাপারে সব কিছু জানতে গেলে জান্নাত লজের মালিক আর তার পরিবারকে খুঁজে বের করতে হবে! কিন্তু কিভাবে! আমার কাছে তো তাদের কোন ছবিও নেই!…আচ্ছা! রুবেলের কাছে তো নিশ্চয়ই ছিল ওদের কারুর ছবি! এতবার রুবেল এখানে এসেছে, আর প্রতিবার জান্নাত লজেই থেকেছে!…” নিজের মনেই এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি মনে হতে নিজের ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে কল করে পারভেজ। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভড হয় “বলুন মিঃ পারভেজ!” “হ্যাঁ, অফিসার আপনাকে ফোন করলাম একটা জিনিস জানতে!” পারভেজের কথায় অফিসার আমির বলেন “কি জিনিস?” “বলছি আমার ভাইয়ের…ব…ডির মানে লাশের সাথে কোন ফোন কিম্বা আর কিছু পাওয়া যায়নি?” পারভেজের কথায় অফিসার আমির বলেন “না পাওয়া তো যায়নি কিন্তু তল্লাশি করা হচ্ছে! খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে কিছু না কিছু!” “ঠিক আছে রাখলাম অফিসার!” বলে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রাখল পারভেজ। “রুবেলের ফোন কিম্বা ল্যাপটপটা পাওয়া গেলে অনেক কিছুই জানা যেত! কিন্তু এই পুলিশ কোনই কাজের না! কিন্তু রুবেলের জিনিসগুলো গেলই বা কোথায়?” অস্ফুটে এসব কথা নিজের মনেই বলে মাথা চাপড়াতে থাকে পারভেজ।
মাথু গ্রামটা লেহতে অবস্থিত একটা সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম! দূরে যতদূর চোখ যায়, শুধুই পাহাড়ের সারি! নীলাভ সাদা পাহাড়ের সারিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানুষ নিজের দুঃখের কথাও কি ভাবতে ভুলে যেতে পারে? হয়তো না!
একটা ছোট্ট কটেজের মত লজে এসে উঠেছে পারভেজ। কাল বিকেলে এসে পৌঁছেছিল। অতটা সফর করে মানসিক আর শারীরিক উভয় দিক থেকেই বেশ ক্লান্ত ছিল সে! তাই ঘুমিয়ে গেছিল অল্প একটু খাওয়া দাওয়া করেই! আজ সকালে তাই বেশ তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার! প্রচণ্ড ঠাণ্ডা কিন্তু তাও কি অসম্ভব মনোরম লাগছে বাইরেটা! পারভেজ শালটা গায়ে ভালভাবে জড়িয়ে রাস্তায় নেমে এল আর মনে মনে ভাবতে লাগলো কিভাবে শুরু করবে এক অদেখা পরিবারের খোঁজ! বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটা বড় মত পাথরের উপর গিয়ে বসলো পারভেজ। দিনের আলো এখনও ঠিক করে ফোটেনি কিন্তু দু একজন লোক ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে! এখানের বেশিরভাগই চাষবাস করে নয়তো পশুপালন করে। বেশ গরীব এরা! তার উপর লেহর এই দিকটাতে পর্যটকও সেইভাবে আসেনা এক দুজন ছাড়া! এসব দেখতে দেখতেই পারভেজের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। রুবেল বলেছিল “ভাইজান এবারের উপন্যাসটা সুপার হিট হলেই কিছুদিনের জন্য লাদাকের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নিশ্চিন্তে কদিন থেকে আসব! তুমিও ছুটি নিয়ে নিও! দুজনে বেশ অজানা অনেক কিছু একসাথে খুঁজে বের করা যাবে! বলা যায়না, সেখান থেকে হয়তো আবারও আরেকটা গল্পের প্লটও পেয়ে গেলাম আমি…” দুজনে খুব হেসেছিল সেদিন। হয়তো এরকমই এক গ্রামে আসতে চেয়েছিল রুবেল! পারভেজ তো আজ আসতে পেরেছে লাদাকের এই অনামি গ্রামে! কিন্তু এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে তাকে আসতে হবে তা সে কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি! হঠাৎই এসবের মাঝে পারভেজের মনে পড়লো একটা খুব দরকারি কথা! রুবেলের একবার ল্যাপটপ খারাপ হয়ে গেছিল। তাই জরুরী মেলগুলো চেক করতে পারছিল না! তাই সেইসময় পারভেজের ল্যাপটপ থেকে অনেকবার নিজের মেলটা ব্যবহার করেছিল রুবেল! এটা মনে আসতেই প্রায় তড়িৎ গতিতে পাথরের উপর থেকে উঠে কটেজের দিকে এগিয়ে গেল পারভেজ। দিনের আলো ততক্ষণে ফুটে গেছে!
কটেজে ফিরে তাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করে পারভেজ। ল্যাপটপটা খুলতে খুলতে বার বার আল্লাকে স্মরণ করছিল পারভেজ। তারপর ল্যাপটপে নেটটা কানেক্ট করেই মেলটা খুলল। নিজের মেল আইডিটা লগ আউৎ করতে গিয়ে দেখল নিচে রুবেলের মেল আইডিটার পাশে সাইনড আউট দেখাচ্ছে না! এবার মনে মনে আবারও আল্লাকে স্মরণ করে রুবেলের মেল আইডিটাতে ডাইরেক্ট ক্লিক করলো সে। বেশ কিছুক্ষণ কারসারটা গোল গোল ঘোরার পর মেলটা খুলে গেল! পারভেজ উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠলো। রুবেল তারমানে তার মেলটাকে সাইন আউট করেনি কিম্বা ভুলে গেছিল হয়তো! আর পারভেজও সেইভাবে লক্ষ্য করেনি কারণ তার ল্যাপটপে তার নিজের মেলটাই খোলা থাকে, সাইন আউট করার দরকার পড়েনা! পারভেজ যেন এই রহস্যের কিনারায় পৌঁছানোর প্রথম সিঁড়িটা খুঁজে পেয়ে গেছিল! সে রুবেলের মেলের ড্রাইভটাতে এবার ক্লিক করলো।
রুবেল অনেককিছুই নিজের ল্যাপটপে ছাড়াও মেলের ড্রাইভে সেভ করে রাখতো যাতে ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থেকে কোনভাবে ডিলিট হয়ে গেলেও মেলের ড্রাইভ থেকে সেইসব জরুরি তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। পারভেজ ভাবছিল হোক না হোক এবারেও কিছুনা কিছু তো নিশ্চিতভাবেই রুবেল নিজের মেলের ড্রাইভে সেভ করেছে যা তার প্রয়োজনে আসতে পারে! ড্রাইভটা খুলতেই পারভেজ দেখে সেখানে বেশ কিছু পিডিএফ আর ওয়ার্ড ফাইল সেভ করে রাখা আছে। সেগুলো সে একদম রিসেন্ট তা বোঝা যাচ্ছে! স্ক্রল করে নিচের দিকে চেক করতে থাকলো সে এই আশায় যে যদি জান্নাত লজের মালিক কিম্বা তার পরিবারের কোন ছবি পাওয়া যায়! কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়লোনা তার! অগত্যা রিসেন্ট পিডিএফ আর ওয়ার্ড ফাইলগুলো ড্রাইভ থেকে ডাউনলোড করে নিজের ল্যাপটপের ডেক্সটপে রেখে দিয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে রাখল পারভেজ! “এখন একটু এদিক ওদিক দেখি গিয়ে কিছু জানা যায় কিনা! রাতে এই ফাইলগুলো চেক করবো না হয়!” মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে এল পারভেজ।
মাথু গ্রামটার একদম শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট মত বাজার আছে! আসলে বাজার না বলে সেটাকে কয়েকটা অস্থায়ী পশরার সমন্বয়ে তৈরি হাট বললেই ভাল হয়! পারভেজ ভাবল বাজারের দিকে বেশি লোকের দেখা মিলতে পারে! সেই ভেবে সেই বাজার তথা হাটের দিকেই এগিয়ে গেল।
“ভাইজান, আপনার বাড়ি কি এই মাথু গ্রামেই নাকি?” হেসে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো পারভেজ। “লোকটা নিজের সব্জির পশরা সাজাতে সাজাতে ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল “হ্যাঁ, কেন বলুন তো? আর আপনাকে তো এই গ্রামে আগে কখনও দেখিনি! বেড়াতে এসেছেন নাকি?” পারভেজ মেকি হেসে বলল “না মানে আমি একটা কাজে এসেছি এখানে!” লোকটা এবার পারভেজের দিকে তাকিয়ে বলল “কি কাজে?” “আসলে আমি কাউকে খুঁজছি!” পারভেজের কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলল “আপনিও কি পুলিশের লোক নাকি? একজন পুলিশের লোক মাঝে এখানে এসেছিল অনেকদিন আগে! কোন এক পরিবারকে খুঁজছিল! আপনিও কি তাদেরই খুঁজছেন নাকি?” লোকটার কথায় আশান্বিত হয়ে পারভেজ বলে “হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও এক পরিবারকেই খুঁজছি! এই গ্রামেই তাদের শেষবারের মত দেখা গেছিল! আপনি কিছু জানেন তাদের ব্যাপারে? দুই ছেলে মেয়ে আর মিয়াঁ বিবি ছিল!” লোকটা বলল “দেখুন ভায়া, আমি আপনার আগে যে পুলিশের চর এসেছিল তাকেও বলেছিলাম আপনাকেও বলছি একই কথা, এরকম একটা পরিবার এখানে এসে তো ছিল। তবে মাথু গ্রামেই ছিল কিনা জানিনা!” পারভেজ অবাক হয়ে বলল “মানে? এখানে ছিলনা তো দেখলেন কিভাবে তাদের?” লোকটা বলল “আমাদের মাথু গ্রামের একদম অন্যপ্রান্তে একজন সিদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন। উনি বহু দেশ ঘুরেছেন এবং অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী! ওনার কাছে তাই অনেক দূর থেকে বহু মানুষ নিজেদের সমস্যা নিয়ে আসেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে! উনি মনে করেন উনি কোন ধর্মের আওতায় পড়েন না! সব ধর্মই এক ওনার কাছে!” পারভেজের বেশ অবাক লাগছিল এটা ভেবে যে মুজিব আর তার পরিবার কোন মৌলবি সাহেবের কাছে না গিয়ে কেন এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে এসেছিল! অবশ্যই সেটা যে জুবেদার জন্যই এসেছিল সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না পারভেজের! ভাবনা থামিয়ে পারভেজ লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো “ভাইজান আর একটু সাহায্য করে দিন! এই সিদ্ধ ভিক্ষু বাবা ঠিক কোন দিকটাতে থাকেন একটু বলে দেবেন?” পারভেজের কথা শুনে লোকটা তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে দিল।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর বাড়িটা যেরকম হবে বলে ভেবেছিল পারভেজ, সেরকম কিন্তু নয়! কোন কুটিরের মত ঘর হবে ভেবেছিল কিন্তু সামনে দোতালা বৌদ্ধ স্টাইলে তৈরি একটা পাকা বাড়ি। আর তার চারপাশে বেশ কিছু গাছপালা! এমনিতেও মাথু গ্রামটা ফাঁকা ফাঁকাই! কিন্তু এই জায়গাটা যেন একটু বেশিই নিস্তব্ধ আর শান্ত! আস্তে আস্তে সদর দরজার কাছে এগিয়ে যায় পারভেজ। তারপর দরজায় একটা টোকা দেয়। বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া না পাওয়াতে আবার টোকা দিতে যাচ্ছিলই তখনই ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ এল। দরজা খুলতেই একজন অল্প বয়সী মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত বালককে দেখতে পেল পারভেজ। সে মুখে কিছু না বলে প্রশ্নসূচকভাবে তাকিয়ে রইল পারভেজের দিকে। পারভেজ আমতা আমতা করে বলল “ভিক্ষু বাবার সাথে দেখা করতে চাই! অনেক দূর থেকে এসেছি!” ছেলেটা কোন জবাব না দিয়ে ইশারায় পারভেজকে ভেতরে আসতে বলল। তারপর খুব নিচু গলায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল “আপনি বসুন আমি ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে এসে বলছি আপনাকে!”
ঘরটা বেশ বড়। ঘরের একদম শেষপ্রান্তে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যানরত অবস্থায় বসে রয়েছেন। চারিদিকে একটা সুমিষ্ট গন্ধ ছেয়ে আছে! এক অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হচ্ছিল পারভেজের! অল্পবয়সী ছেলেটা ইশারায় পারভেজকে সন্ন্যাসীর কাছে যেতে বলল। পারভেজ এগিয়ে চলল তাঁর দিকে।
“বল বেটা! কিভাবে তোমার সাহায্য করতে পারি আমি?” মৃদু হাসি হেসে বললেন সন্ন্যাসী। পারভেজ একটু ধাতস্থ হয়ে বলল “বাবা আমি কিছু জানতে এসেছি আপনার কাছে! কারুর ব্যাপারে!” সন্ন্যাসী সেই মৃদু হাস্যমুখে ইশারায় পারভেজকে বলতে বললেন। পারভেজ তারপর সবকিছু খুলে বলতে শুরু করলো। যা যা অস্বাভাবিক জিনিস হয়েছে সবকিছু, জান্নাত লজের মালিক ও তার পরিবারের অন্তর্ধান, রামিজের মৃত্যু, সাথে তার ভাই রুবেলের মৃত্যু, সবকিছু খুলে বলে সে! সবকিছু শুনে সন্ন্যাসী বাবা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করেন “বেটা তুমি তো ইসলামি! তুমি নিশ্চয়ই জন্মান্তরে বিশ্বাস করোনা?” পারভেজ মাথা নাড়িয়ে বলল “কোরান জন্মান্তর মানেনা! তাই…” পারভেজের কথা শেষ হওয়ার আগেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন “মুজিব আর তার স্ত্রী সায়েদা আমার কাছে এসেছিল প্রায় বছর দুই আগে! সাথে মেয়ে জুবেদা আর ছেলে রেহানও ছিল! মূলত জুবেদার জন্যই এসেছিল তারা! অনেক মসজিদ, পিরবাবা, মৌলবি, সন্ন্যাসীদের কাছে ঘুরেও কিছু লাভ হয়নি তাদের! তাই না জানি কিভাবে জেনে এতদূরে আমার কাছে এসেছিল! জুবেদার এমনিতে কিছুই অসুবিধা ছিলনা! কিন্তু রাত হলেই সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত! সেই স্বপ্ন তাকে রাতের পর রাত ঘুমোতে দিতনা! এরপর জুবেদার ১৬তম জন্মদিনের পর থেকে সে যেন কেমন বদলে যায়! লম্বা ঢোলা হানফু টাইপের জামাকাপড় পড়ার জন্য জেদ করতে থাকে! চাইনিস খাওয়ার ছাড়া খাবেনা, এরকমও অস্বাভাবিক আচরণ সামনে আসতে থাকে! মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে এক দুর্বোধ্য ভাষায় গান গেয়ে বেড়াতো জুবেদা তারপর কিছু একটা দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারাতো! মানে এতদিন যা তার স্বপ্নে আসতো সেটা আস্তে আস্তে তার স্বত্বাকে কাবু করতে থাকে! যত দিন যাচ্ছিল জুবেদার মধ্যে ততই যেন পরিবর্তন আসছিল। অবশেষে একদিন সে নমাজ পড়তে অস্বীকার করে! আর নিজেকে ইসলামি বলতেও অস্বীকৃত হয়! আমি এইসব কথা শুধুমাত্র জুবেদার মা-বাবার কাছে শুনেই বলছিনা বরং তাদের আমি আমার বাড়িতে দুদিন থাকতে বলি আর জুবেদাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করি দিনে এবং বিশেষ করে রাতে! সবটা দেখে অনেকেই হয়তো ভাববে যে জুবেদা মানসিক রোগী কিম্বা অন্যকিছু! কিন্তু আমি এরপর আমার অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বুঝতে পারি যে জুবেদা আসলে মানসিক রোগী নয়! এ এক অদ্ভুত জিনিস! এ কোন জিনও নয় আবার কোন আত্মাও নয়! এ হল এক পিশাচ! এক বহু হাজার বছর পুরনো পিশাচ যে কিনা তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এত হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল যে কবে সেই মেয়েটা আবার জন্ম নেবে! আর সে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারবে! এই পিশাচী আত্মাটা যার সে কোনদিন হারকে মেনে নিতে পারেনি নিজের জীবন দশায়! কিন্তু মৃত্যুর কাছে সবাইকে এক না একদিন হেরে যেতেই হয় সে যত বড়ই বিজয়ী হোকনা কেন! মৃত্যু আর ভবিতব্য কেউই পাল্টাতে পারেনা!” একটু থামলেন সন্ন্যাসী। পারভেজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দেখে তিনি আবারও বললেন “ আমি জানি তুমি জন্মান্তর কিম্বা অপদেবতাতে বিশ্বাসী নও! আমি বিশ্বাস করতেও বলবো না! এক এক ধর্মাবলম্বীদের এক একরকম মান্যতা থাকে! কিন্তু আমি শুধুমাত্র অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী! হ্যাঁ, আমি দেবতাতেও বিশ্বাসী তেমনি অপদেবতাতেও বিশ্বাসী! রাত না হলে যেমন দিন আসেনা তেমনি অশুভ শক্তি আছে বলেই বারে বারে শুভ শক্তির আবির্ভাব হয়ে এসেছে! আর জন্মান্তরের অনেক নমুনা আমি আমার অর্জিত অভিজ্ঞতায় পেয়ে এসেছি! আমি এর আগে আরও অনেক রকম পিশাচী শক্তির নিদর্শন পেয়েছি কিন্তু জুবেদার ব্যাপারটা সেই সমস্ত অভিজ্ঞতার উপরে! আমি আগে কখনও এত শক্তিশালী, এত ভয়ংকর আর এত প্রলয়কারী পিশাচের সংস্পর্শে আসিনি! আমি আমার গুরুজির সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছিলাম! তিনিও তার জীবদ্দশায় এতটা অদ্ভুত কিছু শোনেননি! সবশেষে আমি আমার গুরুজির পরামর্শে মুজিব আর সায়েদাকে চীন দেশ পেরিয়ে মঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার সীমান্তে স্থিত একটা নদী ওননের তীরে গিয়ে কিছু বিধি করার কথা বলি! যদিও এই বিধি করতে শুধুই জুবেদার একা যাওয়াটাই উচিত ছিল কিন্তু এত ছোট মেয়ে তার উপর মানসিকভাবে দুর্বল তাই মুজিব আর সায়েদাকেও যেতে বলেছিলাম!” “তারপর?” পারভেজের কথায় সন্ন্যাসী বলেন “ওরা সেইসময় মেয়ের জন্য সবকিছু করতে রাজি ছিল! তাই রাজি হয়ে যায়! সায়েদা, জুবেদা আর রেহান আমার বাড়িতে কদিন ছিল আর তার মাঝে মুজিব গেছিল পাসপোর্ট আর ভিসার ব্যবস্থা করতে! এরই মাঝে অনেকগুলো অদ্ভুত জিনিস হতে থাকে! হঠাৎ হঠাৎ আমার বাড়িটা দুলে উঠত! একদিন আমি পাশের আখরোট গাছের তলায় বসে ধ্যান করছিলাম হঠাৎ মড়মড় করে একটা আওয়াজ আসে কানে! চকিতে আমি সেখান থেকে সরে না এলে গাছটা আমাকে পিষে দিত! রাতের বেলা অনেকরকম আওয়াজ আসতো, ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ, চিৎকারের আওয়াজ আরও কতকি! আর তখন জুবেদাকে সামলানো যেতনা একদমই! যাই হোক, সপ্তাহখানেক পর মুজিব ফিরে আসে! তারপর তারা সপরিবারে আমার এখান থেকেই মঙ্গোলিয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়! কথা ছিল ১৫দিনের মধ্যে সব মিটিয়ে ফিরে আসবে! বিধির সবকিছু আমি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ওদের! ফিরে আমার সাথে দেখা করেও যাবে বলেছিল! কিন্তু আর আসেনি ওরা! আজ তোমার মুখে জানতে পারলাম যে ওরা আর ফেরেইনি বরং ওদের বাড়িটাকে ঘিরে এক মৃত্যুলীলা শুরু হয়ে গেছে! এসবই সেই পিশাচের কাজ! আমি ধ্যান করে আর আমার অভিজ্ঞতায় যেটুকু বুঝেছি সেটা হল সেই পিশাচী শক্তি চায়না যে কেউ তার এই প্রতিশোধের মাঝে আসুক কিম্বা তার ব্যাপারে কিছু জানুক! আমিও অনেকবার এরকম কিছু সাবধানী স্বপ্ন পেয়েছিলাম! তাই মন্ত্রপূত ধাগা দিয়ে আমার সারা বাড়িটা ঘেরা আছে! কোন অশুভ শক্তি কিম্বা পিশাচ এই ঘরের মধ্যে ঢুকে কিছু করতে পারবেনা! কিন্তু তাও বাড়ি থেকে বেরোলেই আমার সাথে আজও কিছুনা কিছু হয়! আমার প্রাণ না নেওয়া অব্দি সেই পিশাচের শান্তি নেই!” “কিন্তু কেন বাবা? আর এই পিশাচী আত্মাটা কার?” পারভেজের কথায় সন্ন্যাসী বলেন “কার জানিনা! মানে জানতে দেয়নি সেই শক্তিশালী পিশাচ! তবে অনেক অনেক বছরের পুরনো এই শক্তি! তাই তার এত দাপট! কোন বিধ্বংসী মানুষের পিশাচী আত্মা হবে নিশ্চিতভাবে! এর সাথে লড়ার সামর্থ্য আমারও নেই, হয়তো কারুরই নেই! তবে আমাকে মেরে ফেলতে চায় কারণ আমি তার উদ্দেশ্যের অনেকটাই ধরে ফেলেছিলাম আর সে চায়না যে কেউ তার মৃত্যু পরবর্তী ব্যাপারে কিছু জানুক! হয়তো তোমার ভাইও কিছু জেনে গেছিল তাই…” পারভেজ একটু যেন চমকে উঠলো! নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “ও! কিন্তু জুবেদার সাথে সেই পিশাচের কি শত্রুতা ছিল জানতে পেরেছিলেন?” পারভেজের কথায় সন্ন্যাসী বলেন “না! তবে সে জুবেদার প্রাণ না নেওয়া অব্দি থামবেনা সেটা বুঝতে পেরেছিলাম! জুবেদার সাথে পূর্বজন্মের কোন হিসাব ছিল তার, আর সেই হিসাব বরাবর করার জন্যই এত হাজার বছর সেই পিশাচী শক্তি অপেক্ষা করেছে! তাই আমি আর আমার গুরুজি মিলে একত্রভাবে ধ্যান করে এর একটা উপায় বার করেছিলাম! সেটা হল জুবেদাকে যেতে হবে ঠিক সেই জায়গায় যেখানে সেই পিশাচী শক্তির মরদেহ দাফন করা আছে! ধ্যানবলে জানতে পারি সেই জায়গাটা মঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক নদীর নীচে! আমি বহু দেশ ঘুরেছি তাই সেইসব তথ্য ঘেঁটে বুঝতে পারি সেই নদীটি হল ওনন নদী! সেখানে গিয়ে জুবেদাকে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে নদীর জলে নিজের পাঁচ ফোঁটা রক্ত শরীরের যেকোনো অংশ থেকে ফেলতে হবে! তবেই সেই পিশাচ কিছুটা হলেও দুর্বল কিম্বা শান্ত হবে! সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমি তাদের! কিন্তু জানিনা কি হয়েছে তারপর…কেনই বা তারা আর ফেরেনি!” “তবে কি তারা…?” পারভেজের কথায় সন্ন্যাসী বলেন “হয়তো তারা আর এই দুনিয়াতে নেই! সেই পিশাচ তার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে! হয়তো না! “ “তাহলে আমার ভাই রুবেল কিভাবে দুবছর আগে সিল হয়ে যাওয়া লজ আর দুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া লোকেদের দেখতে পেল? তাদের সাথে রইল প্রায় ২০ দিন?” পারভেজের কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে সন্ন্যাসী বললেন “হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া পরিবারটা ন্যায় চাইছে! তারা চাইছে কেউ সেই পিশাচী শক্তির রহস্যটা সারা দুনিয়াকে জানাক! তাই তারা আজও সেখানে রয়েছে! হয়তো তোমার ভাইও আমার মতই অনেক কিছুই জেনে গেছিল তাই সেই পিশাচী শক্তি তাকে হত্যা করে, কারণ সেই পিশাচ অনেক বেশি শক্তিমান অন্যান্যদের থেকে! তবে আমার একটা কথা রাখো! আর এই ব্যাপারে কিছু জানার চেষ্টা করোনা! যতটুকু বুঝতে পারছি এই শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়! তুমি অনেকটাই জেনে গেছো, এর বেশি জানলে তোমারও প্রাণ সংশয় হতে পারে! তোমার ভাইয়ের মৃত্যুতে আমিও ব্যথিত! কিন্তু এর কারণ আরও গভীরে গিয়ে জানার চেষ্টা ছেড়ে দাও! ফিরে যাও বেটা!” পারভেজ হতভম্বের মত বসে রইল সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে।
ভিক্ষুবাবার বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। জ্যাকেটের চেনটা ভালভাবে লাগিয়ে কটেজের পথে হাঁটতে হাঁটতে বারবার ভিক্ষু সন্ন্যাসীর একটা কথাই মনে আসছিল পারভেজের “হয়তো তোমার ভাইও এমন কিছু জেনে গেছিল…”।
কটেজে ফিরেই ল্যাপটপটা খুলে বসলো পারভেজ। রুবেলের মেলের ড্রাইভ থেকে ডাউনলোড করা ফাইলগুলো এক এক করে খুলে দেখতে শুরু করলো। অনেকগুলো পিডিএফ আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যাপার নিয়ে! তারপর একটা ওয়ার্ডফাইলের দিকে নজর গেল পারভেজের! ফাইলটা “কবরবন্দি ইতিহাস”নামে সেভ করেছিল রুবেল।“তাহলে কি রুবেল নতুন উপন্যাস লেখা শুরু করে দিয়েছিল?” অস্ফুটে কথাটা বলে ফাইলটা খুলল পারভেজ। লেখাটা কিছুটা এরকম “স্বপ্ন! স্বপ্ন সবসময় যে অবাস্তব বিষয়ের উপর হয় তা কিন্তু নয়! কিছু স্বপ্নে কিছু ইঙ্গিত থাকে! ভবিতব্যের ইঙ্গিত! আমি রোজ রাতেই একটা স্বপ্ন দেখি! কিছু লোক মশাল হাতে তরবারি উঁচিয়ে কাউকে কবরবন্দি করে কোথাও নিঃশব্দে নিয়ে চলেছে! সেই রাস্তায় যদি কোন অযাচিত কেউ এসে পড়ছে তাহলে তাকে সেই মুহূর্তেই তরবারির কোপে মেরে ফেলা হচ্ছে! কি নিষ্ঠুর!এর পিছনে কারণ আছে! কারণটা হল কবরবন্দি হয়ে যে রয়েছে সে চায়না যে তার মৃত্যুর ব্যাপারে দুনিয়ার কোন মানুষ জানতে পারুক! তাহলে আমাকে কেন দেখাল এই স্বপ্ন? তার উত্তর আমি খুঁজে চলেছি!” স্ক্রল করে আবার এক জায়গায় দেখে পারভেজ রুবেল লিখেছে “আমি আজ এর উত্তর পেলাম কেন সেই কবরবন্দি ইতিহাসের সাক্ষী আমি প্রতিরাতে হয়ে চলেছি! কারণ আমিই তার এই কবরবন্দি হওয়ার মূলে ছিলাম!” ব্যস এটাই শেষ লাইন। আর কিছু লিখে উঠতে পারেনি রুবেল হয়তো। কিন্তু এই “আমিটা কে? রুবেল কার জবানিতে লিখছিল এটা” মনে মনে ভেবে পারভেজ পর পর বাকি পিডিএফগুলো চেক করতে করতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল একটা নাম দেখে “ওনন নদী!” একটা কোন অজানা জার্নালিস্টের লেখা খুবই পুরনো একটা আর্টিকেল! লেখাটার বিষয়বস্তুটা ঠিক এরকম “দিগ্বিজয়ী বীর চেঙ্গিজ খাঁ তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছেও বিজয়ী হওয়ার লালসা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি! পারস্য ক্যাম্প থেকে ফিরে ওনার পরবর্তী লক্ষ্য ছিল উত্তর পশ্চিম চিনকে নিজের দখলে আনা! যেমন ভাবা তেমন কাজ! ১২২৭ সালে উনি তখনকার উত্তর পশ্চিম চিনে রাজত্বকারী তাংগুট সাম্রাজ্যের রাজাকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু রাজা রাজি না হওয়ায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়! চেঙ্গিজ খাঁর লক্ষ্য শুধু তাংগুট সাম্রাজ্যের পতনই ছিলনা বরং তাংগুট রাজার সুন্দরী যুবতী মেয়ের দিকেও তার দৃষ্টি ছিল! যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে চেঙ্গিজ খাঁ রাজাকে প্রাণভিক্ষা দিতে চান কিন্তু তার জন্য শর্ত দেন যে তাকে নিজের মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে হবে! রাজা নিজের যুবতী সুন্দরী মেয়েকে এক ৬৫ বছরের বয়স্ক অত্যাচারী কুখ্যাত লোকের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে নিজে মৃত্যুটাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। তার কথায় অস্বীকৃত হওয়ার চরম ক্রোধে খাঁ রাজাকে হত্যা করেন। এরপরের দিন তাংগুট রাজকুমারীকে টেনে হিঁচড়ে নিজের শয়নকক্ষে নিয়ে আসার হুকুম দেন খাঁ। কিন্তু খাঁ হয়তো জানতেন না তার দিন ঘনিয়ে এসেছে! রাজকুমারী নিজের ঘন মোটা চুলের ভেতর একটা চাকু লুকিয়ে রেখেছিল! খাঁ তার সাথে জবরদস্তি করার চেষ্টা করতেই কায়েদা করে রাজকুমারী সেই তীক্ষ্ণ চাকু দিয়ে তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়! খাঁ আর এবার পেরে উঠতে পারেননি সেই যুবতি সাহসী নারীর কাছে! দিগ্বিজয়ী বীর চেঙ্গিজ খাঁ, যার নামে সারা এশিয়ার মানুষ ভয়ে থরথর করে কাঁপত সে কিনা শেষ অব্দি এক নারীর কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে! এ কি কম লজ্জার, কম অপমানের কথা? খাঁ তাই মরেও মরতে চাননি! রাজকুমারীকে খাঁর সৈন্যরা ধরার আগেই সে কোনরকমে পালিয়ে যায়! কিন্তু বেশিদূর পালাতে না পেরে শেষ অব্দি হলুদ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে! কিন্তু খাঁর হত্যা করা হয়েছিল! আর খুনি ছিল সেই সাহসিনী রাজকুমারী। খাঁ শেষবারের মত পার্থিব দেহত্যাগের আগে নিজের লোকদের বলে গেছিলেন যে তার কবর যেন কেউ কোনদিন খুঁজে না পায়! তাকে এমন জায়গায় দাফন করা হয় যেন তা চাইলেও কেউ জানতে পারবেনা! তাই খাঁর কবর চুপিসারে চিন সীমান্ত পেরিয়ে মঙ্গোলিয়ার শেষ সীমান্তে এনে এক অজানা জায়গায় কোন চিহ্ন না রেখে দাফন করা হয়! আর দাফনের পর পাশের ওনন নদীর গতিপথ বদলে তার কবরের উপর দিয়ে বইয়ে দেওয়া হয়! দাফন হয়ে যায় চেঙ্গিজ খাঁ চিরতরের জন্য সেই ওনন নদীর তলায়!” এইটুকু পড়ে পারভেজ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে! তারপর অস্ফুটেই বলে ওঠে “জুবেদাই কি তবে তাংগুট রাজকুমারীর পরবর্তী জন্ম? আর সেই পিশাচ কি তবে ইতিহাস কুখ্যাত চেঙ্গিস খাঁর রুহ?” হঠাতই খুব ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করে পারভেজের! সম্বিত ফিরলে পারভেজ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে শুরু করে যে হঠাৎ এই ঠাণ্ডা কোথা থেকে ঢুকছে রুমে! জানলা দরজা সব বন্ধ! হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ হয়! পারভেজ চমকে ওঠে! তারপর কি মনে হতে রুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে! কটেজটা এমনিতেই খুব ছোট! তার উপর আবার অন্ধকার হয়ে আছে করিডরটা। মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে কটেজের ছোট্ট রিসেপ্সনটা অব্দি এসে দেখে সদর দরজাটা খোলা আর বাইরের জোর হাওয়াতে সেটা বারবার ধাক্কা দিচ্ছে আর আওয়াজ করছে! পারভেজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজাটা বন্ধ করতে এগিয়ে আসে। তারপর কি মনে হতে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে! মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়া থান গায়ে লোকটার মুখটা খুবই অস্পষ্ট কুয়াশার জন্য! লোকটা বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা মন্ত্র পড়ছে আর একটা অজানা সুগন্ধে চারদিক ম ম করছে! পারভেজ যেন চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছেনা লোকটার দিক থেকে! বেশ কিছুক্ষণ পর লোকটা এবার চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো! তারপর পিছন ফিরে পারভেজের দিকে তাকিয়ে নিজের ডান হাতের তর্জনীটা দুদিকে হেলাল। তারপর আস্তে আস্তে কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেল!