রত্নলাভ
গল্পটা রত্নদিদির মুখেই শোনা। তাঁর গল্প।
গল্প শুরুর আগে একটু ভূমিকা সেরে নিতে হয়। আমাদের এক আত্মীয়ার বিয়েতে গিয়েছিলাম ধানবাদের দিকে। কোলিয়ারিতে। না গিয়ে উপায় ছিল না, আত্মীয়জনে দুঃখ পেতেন, ক্ষুব্ধ হতেন। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখি, স্বজনে কুটুমে বাড়ি একেবারে হট্টশালা। চেনাজানা প্রায় সকলেই এসেছেন। এমন কি রত্নদিদিও। ওঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বয়েস সত্তর ছাড়িয়েছে, থাকেন হাজার মাইল তফাতে, অন্তত দু জায়গায় ট্রেন বদল করে আসতে হয় এদিকে, তবু এসেছেন।
অনেককাল পরে রত্নদিদিকে দেখলাম। বছর পনেরো তো অবশ্যই। বললাম, “তুমি একলা এসেছ! এলে কেমন করে? বয়েস তো হয়েছে, দিদি। ছেলে তোমায় ছাড়ল?”
রত্নদিদি বললেন, “আসব না কেন? ছেলে বউ কি ছাড়তে চায়। ঝগড়া মাচিয়ে দিলুম। নাতি বলল, এ বুঢড্ডি রেল ডিব্বায় তুমি উঠতে পারবে না, পুলিশ পাকড়াও করবে। বললাম, যা যা আমায় পুলিশ দেখাস না, তোর বাপের মতন পুলিশ আমি ট্যাঁকে খুঁজি।”
রত্নদিদির কথা শুনে হেসে ফেললাম।
“পারল আটকাতে! কেমন গটগটিয়ে চলে এলাম। নাগপুর পর্যন্ত একটা লোক সঙ্গে ছিল। তারপর একলা।”
“তোমার সাহস আছে।”
“থাকবে না কেন! আমি কি তোদের মতন ভেতো? এই দেখ, এখনও আমার যোলোটা দাঁত আছে নিজের, চোখে চশমা পরি সেলাই-ফোঁড়াইয়ের সময়, নয়ত আকাশের চিলও দেখতে পাই। কান আমার ঠিক আছে। তবে কি জানিস ভাই, ডান হাতের কনুইটা মাঝে মাঝে খটাস করে আটকে যায়। ভাঙা জিনিস মেরামত হলে কলকবজায় একটু গোলমাল থাকেই। কী করব বল? ভগবানের তো কামারের হাত, দু-চারটে হাতুড়ির ঘা না মেরে কি রেহাই দেয়!”
বয়েসে মানুষের অনেক কিছুই বদলে যায়, তবে গড়ন বিশেষ বদলায় না। দিদি মাথায় লম্বা ছিলেন, দোহারা গড়ন। সেই রকমই আছেন প্রায়। পিঠ হয়ত সামান্য নুয়ে পড়েছে, কৃশ হয়েছেন কিছুটা। গাল ভেঙে মুখ সরু সরু দেখায়। মাথার সব চুল সাদা ধবধবে। ঘাড় পর্যন্ত চুল। মাথার কাপড় দেন না। গায়ের রং তামাটে, ঝকঝকে ভাবটা আর নেই। রত্নদিদিকে দেখলে বেশ বোঝা যায়, বাইরের জল বাতাস ধুলো ময়লার শুধু নয় সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশারও একটা ছাপ পড়ে গিয়েছে হাবেভাবে চেহারায়। ওঁর নিজের কথাবার্তায় ততটা হয়ত পড়েনি। দিদি বিধবা, কিন্তু থান পরেন না, পরেন মিলের সাদা জমির মিহি সুতোর শাড়ি, কালো বা খয়েরি ধরনের ছাপা পাড় থাকে শাড়িতে। গলায় একটি সরু হার, হাতে দু গাছা ফিনফিনে চুড়ি। কানে কিছু পরেন না, আঙুলেও আংটি নেই।
রত্নদিদি আমাদের সামান্য দূর সম্পর্কের দিদি। তাঁকে যে বেশি দেখেছি তাও নয়, তবু আগে জামাইবাবু বেঁচে থাকতে ওঁরা দু-চার বছর অন্তর একবার করে বাপ শ্বশুরের দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে আসতেন, দেখাশোনা করে যেতেন যতটা পারতেন আমাদের সঙ্গে। জামাইবাবু চলে যাবার পর সে পাট চুকে গিয়েছে।
অনেককাল পরে আবার রত্নদিদিকে দেখে ভালই লাগল। তাঁর যেমন বয়েস হয়েছে, আমাদেরও তেমন কম বয়েস হল না। আমি নিজেই তো কবে ষাট ছাড়িয়ে গিয়েছি।
কথায় কথায় একবার বললাম, “দিদি, হাজার মাইল ঠেঙিয়ে যখন এদিকে এসেই পড়েছ, তখন বিয়ের পাট চুকলে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় চলো। দশ বিশ দিন থেকে সকলের সঙ্গে দেখা করে ফিরে যেও। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। তোমাকে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের।”
রত্নদিদি হেসে বললেন, “না ভাই, আমায় আর টেনে নিয়ে যাস না। পাক্কা দশ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছে ওপরঅলা। মাথার ওপর এখন বড় ছেলে, বুঝলি তো! এ হল অন্য রাজার রাজত্ব। হুকুম না মানলেই পেয়াদা পাঠাবে। …না রে, এবারে হল না, আবার যদি কোনোদিন আসি তখন কথা রাখব তোদের। এবারও কি এমনি এলাম ভাবছিস! দেখলাম, আমাদের ডালপালায় এটি হল শেষ শুভকাজ। না এলে হয় না। তা ছাড়া আমাদের বাঙালি বাড়ির বিয়ে-থা কতকাল দেখিনি। দেখতে সাধ হল।”
“কেমন দেখলে?”
“ভাল লাগল না। এ কি বিয়ে রে! এ যেন সত্যনারায়ণের পুজো। নৈবিদ্যি সাজিয়ে বসে থাকলি তোরা আর একটা তোতলা বামুন এসে দুটো মন্তর পড়ে চলে গেল। তারপর তো দেখি যা হচ্ছে সবই ভাড়ার ব্যাপার। ভাড়ার লোক বাসর সাজায়, ভাড়াটে একদল লোক এসে রান্নবান্না করে খাইয়ে যায়, কতক লালসবুজ বাতি জ্বাললি তোরা, ঝম্পঝম্প বাজনা বাজালি— ব্যাস, বিয়ের পাট চুকে গেল। এই বিয়ে দেখে কি সাধ মেটে নরেন! বিয়ে ছিল আমাদের সময়ে। বিয়ে তো সাত পাকে মাত্তর, কিন্তু বিয়ের আগে পরে ঊনপঞ্চাশ পাক! কত হইচই, হাসিখুশি, হইহুল্লোড়, মেয়েদের আচার, ভোজের ভিয়েন, বিয়েতলা সাজানো, পিঁড়ি পাতা, আলপনা— বিয়ের রুমাল পদ্য, বাসরের রঙ্গতামাসা… কোথায় গেল সেসব! যাই বলিস, আমার বাপু মন ভরল না।”
“আজকাল এই রকমই হয়, দিদি ; মানুষের আর সময় কোথায়? লোকবল অর্থবল— তাই বা কোথায়?”
“তা নয় রে, ভাই, এখনকার দিনে সবাই কাঁচা রঙে কাজ সারতে চায়, পাকা রঙের দিন ফুরিয়েছে।”
এমন সময় সত্যদার গিন্নি কৃষ্ণাবউদি বলল, “দিদি, এই বিয়ে নিয়ে টানা-হেঁচড়া হচ্ছিল। মেয়ের নিজের পছন্দ, ছেলেরও। চেনাজানা হয়েছিল ওদের। আমাদের তো মেয়ের তরফ, বিয়েটা ভালোয় ভালোয় চুকে গেছে, এতেই আমরা খুশি।”
কথাটা বোধ হয় জানা ছিল না রত্নদিদির। শুনলেন। তার পর কী মনে করে যেন হাসলেন। বললেন, “চেনা-জানা বিয়ে! তাই নিয়ে টানা-হেঁচড়া। আমায় আর ওসব বলিস না। আমার বিয়ের গল্প জানিস! কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হতে লেগেছিল আঠারো দিন। আমার বিয়ে নিয়ে, আঠারো মাসের লড়াই! সে যে কী কাণ্ডই হয়েছিল তোরা ভাবতেই পারবি না।”
গল্পটা সত্যি আমাদের জানা ছিল না। জানার কথাও নয়। একসঙ্গে তো মানুষ নয়, একেবারে নিজেরও কেউ নয় রত্নদিদি। ওঁরা থাকতেন এক প্রান্তে আমরা অন্য প্রান্তে, আর রত্নদিদি? বিয়ের সময় আমাদের নিশ্চয় শিশু অবস্থা।
আমি হেসে বললাম, “তোমার বিয়ের গল্পটাই না হয় বলো, শুনি।”
“শুনবি! তা হলে বলি?”
না-শোনার কারণ ছিল না। বিয়েবাড়ি এখন অনেকটাই নিঝুম। বিকেলের গোড়ায় কন্যা-বিদায়পর্ব মিটে গিয়েছে। দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে এসেছিল। বাতি জ্বলছে ঘরে। বাইরে প্রথম ফাল্গুনের মরা শীত আর সদ্য বসন্তের দু-চার ঝলক বাতাস মেশামিশি হয়ে আছে। বাড়িটার চেহারা উড়ুখুড়ু, খানিকটা ম্লান। ছেলেছোকরার দল যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়ে আরাম করে নিচ্ছে আজকের মতন। কাল থেকে আবার তত্ত্বতাবাসের খাটুনি।
আমাদের দিকের অন্য ব্যবস্থা। বয়স্কজন থাকব বলে যথাসম্ভব সুখসুবিধের ওপর নজর রাখা হয়েছিল।
রত্নদিদির ঘরটি ছোট। খাট বিছানা পাতা। সেখানে বসেই আমরা চার-পাঁচজনে গল্পগুজব করছিলাম।
দুই
রত্নদিদি তাঁর গল্প শুরু করলেন।
“একটু গোড়া থেকেই বলি, না বললে বুঝবি না,” রত্নদিদি বললেন। “আমার বাবা ছিল পোস্ট মাস্টার। সরকারি চাকরি। চাকরির লেজ যত বাড়ে বাবাও তত পুরনো হয়, আর দু-তিন বছর অন্তর বদলি পায়। ছোটখাটো শহরেই বদলি হত বাবা। আমরাও বাবার পেছনে পেছনে আজ মতিপুর, কাল গজুডি, পরশু রামনগর ঘুরে বেড়াই। পাঁচ ঘাটের জল খাই পাঁচ জনে। পাঁচ জন বলতে বাবা মা আমি আমার ছোট ভাই অনু আর আমাদের এক পুষ্যি ভরতদাদা। ভরতদাদা বাবার কাছেই দশ-বারোটা বছর থেকে গিয়েছিল। বাড়ির হাটবাজার করা থেকে পাঁচ-মেশালি ফাইফরমাশ খাটা ছিল ভরতদাদার কাজ।
“আমার বাবাকে লোকে বলত, মাস্টারবাবু, কেউ বা বলত মাস্টারমশাই। নিজের কাজকর্মে বাবার সুনাম ছিল, খাতিরও করত লোকে। বাবার ছিল দুটো শখ। তাস খেলাটা অবশ্য শখ ছিল না, ছিল নেশা ; শখ বলতে এই জ্যোতিষীবিদ্যে করে বেড়ানো, আর মাঝে মাঝে এস্রাজ টেনে নিয়ে বসে নিজের মনে একটা সুরটুর বাজানো। বাবার আর-একটা ঝোঁক ছিল, সিদ্ধি খাবার। সিদ্ধির সরবত, সিদ্ধির গুলি— এ বাবা প্রায়ই খেত, নিজের হাতে তরিবত করে তৈরি করেই খেত।
“মা ছিল আমার নির্বিবাদ মানুষ। শান্তশিষ্ট। হাসিখুশি। দোষের মধ্যে মা গাদা গাদা পান খেত। আবার কত কী, বাবার আনা কাঁচা সিদ্ধিপাতাও মাঝে মাঝে পানের মধ্যে মিশিয়ে দিব্যি খেয়ে নিত। বলত এতে মুখশুদ্ধি হয়।
“তা এইভাবে বড় হতে হতে আমার বয়েস হয়ে গেল পনেরো। শাড়ি পরতে শুরু করেছি। আমি মাথায় ঢেঙা, গায়ে হিলহিলে, লম্বা লম্বা হাত-পা। ওপর পাটির ডান দিকের দাঁতে এক গজদন্ত। জোরে হাসলে দাঁতের ছটা বেরিয়ে যায়।
“আমরা তখন বরিহাগঞ্জ বলে একটা ছোট শহরে থাকি। কে একজন—এখন আর মনে পড়ে না, আমার এক বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এল। আমাদের সময় পনেরো ষোলোয় আকছার বিয়ে হত। তা ছাড়া সম্বন্ধ আনলেই তো বিয়ে হবে না, কথাবার্তা চলতে চলতে, দেখাশোনা, পছন্দ— সেসব করতে করতে কম করেও একটা বছর। ওরই ফাঁকে মেয়ের বয়েসও বেড়ে যায়।..তা প্রথম সম্বন্ধটা দুটো ধাপ এগুতে পারেনি। কেঁচে গেল। কিন্তু ওই যেমন রেল স্টেশনে দেখেছিস না গাড়ি আসছে জানাবার আগে ঢংঢং ঘণ্টা বাজে, এটাও সেরকম। সম্বন্ধ একবার শুরু হওয়ার মানে জানান দেওয়া হয়ে গেল, মেয়ে এবার তোমার বিয়ের ঘন্টি বেজে উঠেছে।
“প্রথমটার কথা আমার মনে নেই। কোথাকার ছেলে কে জানে, পাতে দেবার যুগ্যি নিশ্চয় ছিল না, নয়ত মা বাবার গরজই হল না কেন! তা সে যাই হোক, তখন থেকেই মাঝে মাঝে কথা ওঠে, এক আধটা চিঠিপত্তরও আসে। ষোলো পেরিয়ে আমি যখন সতেরোয় পা দিয়েছি, তখন একটা সম্বন্ধ এল জামালপুর থেকে। কথাবার্তাও দু-চার ধাপ এগুল। শেষে ভেস্তে গেল। বাঁচা গেল।
“সেই বছরেই শেষাশেষি একটা ছোঁড়াকে একদিন আমাদের বাড়ির কাছাকাছি দেখলুম। পোস্ট অফিস আর ইউনিয়ন বোর্ডের ছোট হাসপাতালের কাছেই ছিল আমাদের থাকার বাড়ি। ছোট বাড়ি, মাথায় টালির ছাদ, সামনে খুঁটি পুঁতে বেড়া দিয়ে বাগান করেছি আমরা, সামনে উঁচু-নিচু মাঠ, আম আর কাঁঠালের বড় বড় গাছ দু-চারটে, ও পাশে হাসপাতাল। বাড়ির গায়েই আমাদের ইদারা। সে-জলের স্বাদই আলাদা।
“প্রথমে বুঝিনি ছোঁড়াটা কোথথেকে এল? পরে শুনলাম, হাসপাতালের নতুন ডাক্তারবাবুর ভাগ্নে। মামা-মামির বাড়িতে এসেছে। তা তার মামার বাড়িতে এসেছে আসুক, আদর খাক মামির, আমার তাতে কী! কিন্তু ছোঁড়াটার ভাব-গতিক তো ভাল নয়। মালকোঁচা মেরে ধুতি পরা, গায়ে হাফ শার্ট, পায়ে কাবলি স্যান্ডেল। তখন প্যান্ট পরার চলন হয়নি এত, ধুতিই পরত লোকে। ছেলেটার বয়েস বেশি নয়, আমার চেয়ে বড়, তবে অনেক বড় নয়, বাইশ-টাইশ হবে। ডাক্তারকাকার সাইকেল নিয়ে হাসপাতালের মাঠে আমাদের বাড়ির সামনে সকাল বিকেল চক্কর মারে। আর আমায় দেখলেই, সাইকেল নিয়ে কসরত দেখায়। হাসে। চোখ নাচায়।
“ডাক্তারকাকার মেয়ে মানি ছিল আমার ন্যাওটা। বছর বারো বয়েস। দিদি বলত আমায়। আমার কাছে পড়তে আসত মাঝে মাঝে, সেলাই শিখত ; বাজার কি স্টেশনের দিকে দরকারে যেতে হলে মানি আমার সঙ্গে থাকত।
“মানিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর ওই দাদাটার নাম কিরে? মানি বলল, ডাকনাম লাল। ভাল নাম লালমোহন। …নামটা বলেই ফেললাম। আমার অত লজ্জা নেই। মানামানিও নেই।
“নাম শুনে হাসি পেল। লালুর চেহারায় কোথায় যে লাল ছিল বুঝলাম না। গায়ের রং আমার চেয়েও কালো। গায়ে কাঠ। মুখচোখ চলনসই, বড় বড় চোখ, মাথার চুল ভেড়ার লোমের মতন কোঁকড়ানো।
“মানিকে বললাম, করে কী তোর দাদা? মানি বলল, ডাক্তারি পড়ে। এবার ডাক্তার হবে। আমার তো গোড়ায় বিশ্বাস হয়নি। ওই লালমোহন, অমন হ্যাংলা প্যাংলা চেহারা যার, ফাজিল ফক্কর ধরনের হাবভাব— সেই ছেলে পড়বে ডাক্তারি! মানুষ তো দূরে থাক ওকে ঘোড়ার ডাক্তারি পড়তেও কেউ নেবে না।”
রত্নাদিদি নাকমুখ কুঁচকে ঠোঁট উল্টে এমনভাবে বললেন কথাটা যে আমরা হেসে ফেললাম।
জানলার গায়ে জলের জগ ছিল। কয়েক ঢোঁক জল খেলেন রত্নদিদি। মশলার কৌটো থেকে মশলা বার করে মুখে দিলেন। এ তাঁর নিজের হাতে তৈরি মশলা। জোয়ান মউরি আর কী কী সব মিশিয়ে করা।
“খাবি মশলা?”
আমরা কেউ কেউ মশলা নিয়ে মুখে দিলাম।
“তারপর?”
“তারপর—” রত্নদিদি বললেন, “তারপর দেখি, কথাটা ঠিকই। লালমোহন বাঁকড়োর মেডিকেল স্কুলে ডাক্তারি পড়ে। পড়া প্রায় শেষ করে এনেছে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে বাঁকড়ো দূরও নয়, ভাগা আদরা লাইন দিয়ে যেতে হয়। …তা একদিন লালুচাঁদ তার মামি আর বোনের সঙ্গে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এল। ডাক্তার কাকিমা তো প্রায়ই মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করতে আসত। আমার ছোট ভাইটা তখন হামজ্বর নিয়ে পড়ে আছে। দেখতে এসেছিল ডাক্তার কাকিমা, সঙ্গে লালুচাঁদ। চলে যাবার সময় লালু আমার মাকে বলল, মাসিমা— এই মেয়েটার পেটে কৃমি আছে নাকি? বড় কৃমি থাকলে এই রকম রোগাটে চেহারা হয়। ..মা বলল কই না তো! ও বরাবরই এই রকম। ছিপছিপে তবে কাজেকর্মে তরতরে। লালুচাঁদ হাসল। বলল, বড় কৃমি থাকলে ওই রকম তরতরে হয়। ভেতরে কামড়ায় তো, তাই। আমি কিছু বললাম না তখনকার মতন।
“পরের দিন বিকেল বেলায় দেখি, কাঁঠালতলার একপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে লালু সিগারেট ফুঁকছে। গিয়ে ধরলুম তাকে। চমকে উঠেছিল। বললাম, অ্যাই— কৃমি কত বড় হয়? …আচমকা ধরা পড়লে চোরের যেমন অবস্থা হয় সেই রকম অবস্থা হল লালমোহনের। তোতলাতে তোতলাতে বলল— কেন, বড় বড়ও হয়, এক বিঘত দেড় বিঘত। অনেক সময় জোড়া কৃমিও থাকে। ভেরি ব্যাড। কৃমি মুখ পর্যন্ত উঠে আসে। …বললাম, ও—তা তোমার নিজের পেটে কী আছে, কৃমি না কেঁচো? ছাগলদের পেটে একরকম কেঁচো থাকে লম্বাই আধ হাত।
“লালমোহন থতমত খেয়ে গেল। বলল, তুমি আমায় ছাগল বললে? জানো আমি এল এম এফ পরীক্ষা দিচ্ছি। আজ বাদে কাল ডাক্তার হব।
“ঠোঁট উল্টে আমি বললাম, অমন লম্ফ আর হেরিক্যান ডাক্তার গণ্ডায় গণ্ডায় হয়। … আমার পেটে কী আছে তুমি জানলে কেমন করে? তোমার নিজের পেটের খবরটা নাও আগে গিয়ে। খবরদার, আমার সঙ্গে ফক্কুরি করতে এসো না, তোমার ডাক্তারি ঘুচিয়ে দেব, আমায় তুমি চেনো না।
“বললাম বটে, কিন্তু কাকে! কী কানকাটা নাককাটা ছেলে রে ভাই। মান অপমান জ্ঞান নেই। ধমক খেয়ে তার মজা যেন বেড়ে গেল। সাইকেলের চক্কর শুরু হল একেবারে আমাদের বাড়ির গায়ে। ঘন ঘন দেখতে আসতে লাগল আমার ভাইকে। একটু আড়াল পেলেই আমায় দেখে পিটপিট করে হাসত, আর বলত, শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়, চোখ পাকালে পেটের কৃমি মরে না।
“ভাই সেরে উঠতে না-উঠতে আমি পড়লাম। বড় বয়েসের হাম। সে কী কষ্ট। ডাক্তার লালমোহন আমায় হামে পড়তে দেখল। ততদিনে তার স্কুল খুলে গিয়েছে। চলে গেল।
“ভাবলাম, বাঁচা গেল। আর তো পেছনে লাগতে আসবে না সে!…ওমা, তোরা শুনলে অবাক হয়ে যাবি, লালমোহনের কত বড় দুঃসাহস আর শয়তানি বিদ্যে! আমি সেরে উঠেছি, হঠাৎ একদিন এক চিঠি। একেবারে খামে। ভেবে দেখ কাণ্ডখানা! তখনকার দিনে কোনো গেরস্থবাড়ির আইবুড়ো মেয়ের নামে কি কেউ চিঠি লিখত? আবার খামের ওপরে আমার নাম, নীচে কেয়ার অফ বাবার নাম। ধর, বাবার নাম যদি নাও থাকত— তবু তো পোস্ট মাস্টার। তার মেয়েকে তুমি চিঠি লিখলে সে চিঠি কার নজরে পড়বে গো! বাবার হাতেই পড়ল চিঠি। মায়ের হাত ঘুরে সে চিঠি এল আবার আমার হাতে। ভয়ে লজ্জায় মরি। রাগে মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এমন বেহায়া, অসভ্য, হদ্দ বোকা কেউ হয় নাকি? চিঠির খাম আগেই খোলা ছিল। ভেতরে কী দেখলাম জানিস? শুনলে তোদের বিশ্বাস হবে না। চার-ছ লাইনের এক চিঠি লিখেছে লালমোহন। চিঠির ঠিক ঠিক ভাষা আমার মনে নেই, তবে লেখার ঢংটা ওই রকম : ভাই রতনমণি, আসিবার সময় তোমার হামজ্বর দেখিয়া আসিয়াছি। এতদিনে নিশ্চয় তোমার জ্বরজ্বালা সারিয়াছে। বড় বয়সে হামজ্বর অতি মন্দ। পরে বড় ভোগায়। সাবধানে থাকিবে। তোমার কথা মতন আমাদের এখানকার এক নার্শারির কাগজ পাঠাইলাম। ফলফুলের নাম ও দাম পাইবে। সবই লেখা আছে। পয়লা নম্বরের গাছগুলিতে টিক মারা আছে। লক্ষ করিয়া দেখিও। মামাবাবু মামিমাকে আমার প্রণাম জানাইলাম। তোমরা স্নেহ জানিবে। ইতি তোমার লালুদা।
“চিঠি পড়ে আমি আকাশ থেকে পড়ি রে? এক ফালি চিঠি তো চারপাতা ছাপানো নার্শারির কাগজ। ফলফুলের নাম। দাম। আমি একবারের জন্যেও লালমোহনকে ফলফুল নার্শারির কথা বলিনি। আমাদের বাড়ির সামনে তিন হাতের বাগানে একটা কলাগাছ, লাউমাচা একটা। দুটো লঙ্কাগাছ আর ফুলের মধ্যে জবা, চাঁপা আর শীতের সময় দু-চারটে গাঁদা। বাগানে আমার জল দেওয়াও হয় না, ভরতদা দেয়।…আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। নার্শারির ছাপা কাগজ কেন পাঠাল লালমোহন? তার মতলবটা কী? ছাপা কাগজগুলো বারবার দেখেও আমার বাপু বিদ্যে হল না বুঝি ওর মধ্যে কী হেঁয়ালি আছে।
রত্নদিদি একটু থামতেই, আমি হেসে বললাম, “হেঁয়ালি ছিল নাকি?”
কৃষ্ণাবউদিও হেসে বলল, “পায়ে ধরে পিসি সাড়া দেয় না মাসি— সেই রকম হেঁয়ালি নাকি?”
রত্নদিদি কাপড়ের আঁচল মুঠো করে মুখের সামনে তুলে জোরে জোরে হাঁচলেন বার দুই। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। কাল ছিল ত্রয়োদশী, আজ চতুর্দশী। শুক্লপক্ষ। জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে যেন বাইরে, বাতাস বইছে।
“ছিল। কিন্তু তখন বুঝিনি”, রত্নদিদি বললেন, “পরে বুঝলাম। নার্শারির ছাপা কাগজ পাঠিয়ে ও বাবা-মায়ের চোখে ধুলো দিয়েছে— সেটা ধরতে পারলেও বুঝতে পারিনি ফলফুলের ছাপা নামগুলোর তলায় যেখানে যেখানে পেনসিলের টিক আছে— সেই অক্ষরগুলো বেছে বেছে সাজিয়ে নিলে বোঝা যায় লালু আমার ‘লাবে’ পড়েছে।”
কৃষ্ণাবউদি জোরে হেসে ফেলে বলল, “আপনি তো বললেন, হেঁয়ালি ধরতে পারেননি।”
“পারিনি তো! কেমন করে পারব।… তারপর লালমোহন আবার যখন এল, আমায় বলল, তোমার মাথায় ঘিলু আছে না গোবর! কিস্যু বুঝতে পারো না। নিয়ে এসো নার্শারির কাগজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। গোলাপের ‘লা’ আর বেলের ‘বে নিলে কী হয়— বুঝতে পারো না? ঘেন্টু কোথাকার! …বললাম, সে-কাগজ ফেলে দিয়েছি।…হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ফেলে দিয়েছ। তুমি মেয়ে, না হান্টারওয়ালি! এই ভাবে কেউ চাবুক মারে বুকে!”
আমরা হেসে ফেললাম। হো হো করে।
সত্যদা বলল, “লালমোহন কি প্রায়ই আসত তোমাদের ওখানে?”
রত্নদিদি বললেন, “আসত মানে! এই তোমার গরমে আসছে, পুজোয় আসছে, শীতে আসছে, দোলের ছুটিতে আসছে— দু-এক মাস অন্তর অন্তর হাজির। বাঁকড়ো তো কাছেই আসতে চাইলেই আসা যায়।”
“তারপর—?” আমি বললাম।
রত্নদিদি হাসতে হাসতে বললেন, “দেখ আমি বাহাত্তুরে বুড়ি। আমার আর লজ্জাশরম কী! যা বলব, খোলাখুলি বলব। লালমোহনের সঙ্গে আমার ভাবসাব হয়ে গেল বেশ। ও এলেই আমার ভাই মন ফুরফুর করত। চলে গেলে বুক হু হু করত। তা যাই বলিস, লালুর মামা-মামিও ভাগ্নে বলতে ছিল অজ্ঞান। ভালবাসত খুব। এই যে তাদের ভাগ্নে হরদম ফাঁক পেলেই মামার বাড়িতে ছুটে আসে— তাতে ওদের সায় ছিল, খুশি হত। কিন্তু ভাগ্নে যে কার টানে ছুটে আসে তা কি অত বুঝত! একটু-আধটু বুঝত নিশ্চয়। তারা তো কানা নয়। আমার বাপ-মাও নয়। বুঝত ঠিকই, মুখে কিছু বলত না। বলবেই বা কেন! ছেলে হবু ডাক্তার, মেয়ের বয়েস আঠারো হল। ঘরে মর্যাদায় সমান সমান। ভেতরে ভেতরে একটা সায় ছিল দু তরফের।
“তবে আমাদের সময়ে দিনকাল তো অন্যরকম ছিল। আজকালকার মতন চোখের সামনে নাচানাচি করার জো ছিল না। লুকিয়ে চুরিয়ে, এপাশ সেপাশ নজর রেখে কথাবার্তা, মেলামেশা।
“ওর তখন পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষা। লালমোহন বইপত্তর গুছিয়ে মামার বাড়িতে পরীক্ষার পড়া করতে এল। তাই তো বলত মুখে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে ভিড়লে পড়া হয় না। বাড়ি সেই কোন পাড়াগাঁয়ে, বাপ জমিজায়গা, ধানচাল, পুকুর বাগান নিয়ে থাকেন।
“মামার বাড়িতে এসে লালমোহন যখন বইপত্তর খুলে বসেছে, তখন এক বিকেলে বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল একটা। আমার বেশ মনে আছে দিনটা। বর্ষাকাল নয়, তবু থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। দিন দুপুর মেঘলা। রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিপঝিপে বৃষ্টি।
“তা সেদিন— এই মাঝ দুপুরে লালমোহন বাঁশি বাজিয়ে ডাকল আমায়। এ তোর আড়বাঁশি নয়, সিটি বাঁশি। ফুরর-ফুর—ফুরর-ফুর। চেনা বাঁশি আমার। মেঘলা দিন, দু পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে খানিকটা আগে, আমি নিজের ঘরে খাটে শুয়ে শুয়ে ‘ইন্দিরা’ পড়ছিলাম। বাবার আমার পড়ার নেশা ছিল। এক আলমারি বই, নাটক নবেল, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, দু-একটা পুরনো ইংরিজি বই—এই রকম সব। ..কাজকর্ম না থাকলে আমি চুপ করে শুয়ে থাকতাম খানিক, না হয় পুরনো পড়া বই আবার পড়তাম। সেদিন শুয়ে শুয়ে ‘ইন্দিরা’ পড়ছি। ওই যে একটা জায়গা আছে বইয়ে— ‘ধানের ক্ষেতে,/ ঢেউ উঠেছে,/ বাঁশতলাতে জল।/ আয় আয় সই, জল আনি গে/ জল আনি গে চল—’, পড়তে পড়তে হেসে মরছি নিজের মনে— এমন সময় শুনি ফুরর-ফুর, ফুরর ফুর।…বুঝলাম লালুবাবু ডাকছেন। বই রেখে উঠে পড়ে বাইরে এলাম। এদিক তাকাই ওদিক তাকাই বাঁশিওয়ালাকে দেখতে পাই না। ভর দুপুর, ঘন মেঘলা, বৃষ্টির দরুন মাঠঘাস ভিজে, চারপাশ ফাঁকা, হাসপাতালের দিকেও কেউ কোথাও নেই, দুপুরে কেউ থাকে না, বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতাল, দুটো গোরু আর ছাগল চরছে কাঁঠালতলার দিকে। আমতলাও ফাঁকা। খুঁজতে খুঁজতে আমতলার কাছে এসে দেখি, লালুবাবু একটা আমড়ালের ওপর পাতার আড়ালে কায়দা করে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বসে বসে ভিজে আমপাতার পাতলা ডাল নাড়িয়ে জলের ফোঁটা ফেলছে নীচে। আমায় ভিজিয়ে দেবার আগেই সরে দাঁড়ালাম। চারপাশ দেখছি আর কথা বলছি দু জনে ; কেউ যদি আচমকা বাইরে এসে দাঁড়ায় আমাদের বাড়ির, কিংবা ডাক্তার কাকার বাড়ি থেকে— আমায় দেখতে পাবে, লালুবাবুকে পাবে না। আমায় দেখলে হয়ত ভাববে, গাছতলার নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার ওই একটা দোষ ছিল, এটা সেটা, কানের ফুল, হারের লকেট, পয়সা কড়ি বড় হারাতাম। আমার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘হারানি’।.. তা দু জনে গল্প করছি, কথার তো কোনো মাথামুণ্ডু থাকে না আমাদের, হঠাৎ দেখি লালুবাবু গাছের ডাল থেকে একেবারে ধপাস করে মাটিতে। শব্দ হল। পড়েই চিত। আর নড়ে না চড়ে না। চোখের পাতা বন্ধ। আমার ভাই, বুক ধড়াস করে উঠল। চারপাশ তাকিয়ে নিয়ে ওকে একবার ডাকি, একবার নাড়া দি, তবু সেই কাঠের মতন পড়ে আছে। যাঃ অজ্ঞান হয়ে গেছে বোধহয়। কী করি, আমাদের বাড়ির গায়ে ইদারার পাড়ে দড়ি বালতি পড়ে থাকে। ছুটে গিয়ে বালতির জল এনে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলাম। মৃগি রোগীর মতন মুখ করল একবার। তবু সাড়াশব্দ নেই। ভীষণ ভয় ধরে গেল। কী যে করি? বেঁচে আছে তো? ধারেকাছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, সেই গোরু দুটো আর ছাগল ছাড়া। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, লালুবাবুর চটি জোড়া গাছতলায় পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এল, জুতোর গন্ধ শোঁকালে বেহুঁশ লোকের হুঁশ ফিরে আসে শুনেছি। দৌড়ে গিয়ে একপাটি চটি কুড়িয়ে এনে লালুবাবুর নাকে চেপে ধরলাম। হাতে হাতে ফল রে ভাই। মরা মানুষ যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল। লাফ মেরে উঠে বসল লালুবাবু। বলল, তুমি আমার মুখে জুতো ছোঁয়ালে, গোবর লাগিয়ে দিলে নাকে! কী বিচ্ছিরি গন্ধ! চললাম, আর নয়। যে মেয়ে লাভারের নাকে গোবর লাগানো জুতো ঘষে দেয়, সে মেয়ে নয়, মোষ। বলে লালুবাবু ঘেন্নায় নাকমুখ মুছতে মুছতে দে দৌড়।”
রত্নদিদি নিজেই হেসে উঠলেন। আমরাও অট্টহাসি হেসে বললাম, “জুতোটা না ঘষলেই পারতে! ইচ্ছে করে ঘষে দিয়েছিলে নাকি?”
রত্নদিদি মাথা নেড়ে বললেন, “না ভাই, বিশ্বাস কর, ইচ্ছে করে দিইনি। তাই কি কেউ দেয়! তখন কেমন মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছিল ভয়ে। থতমত খেয়ে গিয়েছিলুম।”
“তারপর কী হল?”
“কী হল! সে আর এক কাণ্ড। বাবুর মুখে জুতো ছোঁয়ানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে একদিন সন্ধের মুখে আমাদের বাড়ির সদরে কাঠচাঁপা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে— এই তোর দু-চার পলকের জন্যে নিজের নরম গালটা এগিয়ে দিতে হল। আমি কি যেচে দিয়েছিলুম নাকি।…ও হঠাৎ বলল, তোমার গালে শুয়োপোকা পড়েছে। শিগগির দাও—ফেলে দি। ওই একটু ভুল হয়ে গেল, প্রথম, আর সেই মুহূর্তে মা এসে দাঁড়িয়েছিল বাইরে। দেখে ফেলল। লালুকে আমি ধাক্কা মেরে সরাবার আগেই সে নিজেই সরে পড়ল।”
আমাদের হাসির রোল উঠে বাইরে ছড়িয়ে পড়ল বোধ হয়।
“এ তো দেখছি—”
“দেখছি আবার কী! ওই টুকতেই সর্বনাশ হয়ে গেল।” রত্নদিদি বললেন, “লালুর পরীক্ষার পড়া হচ্ছে না ঠিকমতন বলে সে ফিরে গেল বাঁকুড়ায়। আমি থাকলাম মায়ের নজরে নজরে। ..দেখতে দেখতে মাস ফুরোল। পরীক্ষা হয়ে গেল লালুর। পাস করে হাসপাতালেই হাত পাকাতে লাগল। দেখাসাক্ষাৎ আর হয় না। শেষে লালুর মামাই বিয়ের কথাটা পাড়ল বাবার কাছে। বাবা বলল, ছেলে তো চেনাজানা, ডাক্তারও হয়েছে— ভাল কথা। তবে ওই ছেলের স্বভাবচরিত্র বুঝতে হবে। আর দেখতে হবে— ভবিষ্যৎটা কেমন? কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বাবা নিজে দেখবে। তারপর কথা—!”
আমি বললাম, “আবার কোষ্ঠী কেন?”
“বাবার যে বিশ্বাস কোষ্ঠীতে। তখন এগুলো হত।”
“এখন আরও বেশি হয়।”
“লালুদের বাড়ি থেকে তার ছক কোষ্ঠী এল। বাবা নিজে পাঁজিপুথি নিয়ে বসল। আমার ছক গেল লালুদের বাড়িতে। …দশ বিশ দিন সময় গেল বাবার কোষ্ঠী বিচার করতে ভাল করে। তারপর বাবা বলল, এই বিয়ে হবে না। জাতকের পতন-যোগ আছে। মানে ছেলের অনিবার্য পতনযোগ। সেটাই ভীষণ খারাপ যোগ। মারকতুল্য। মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপতে পারে— তবে…”
আমি হেসে বললাম, “পতন-যোগ তো কেটেই গিয়েছিল, দিদি। গাছ থেকে পড়ার পর আর কিসের ভয়! অন্য পতন তো তোমার সঙ্গে, প্রেমে পতন।”
রত্নদিদি বললেন, “কে কাকে এ সব বোঝায়! বাবা ছেলের খুঁত ধরে বলল, পতন-যোগ আছে পাত্রর, তো ও-বাড়ি থেকে ছেলের বাবা বলল, মেয়ের ছক থেকে তাদের পণ্ডিত দেখেছে যে, মেয়ের বন্য জন্তু দ্বারা দংশনের যোগ আছে। অগত্যা এ-বিয়ে হবে না।”
“কিন্তু হল তো বিয়ে!”
“হল বইকি! কেমন করে হল সেটা এবার শোন।”
তিন
বিশুর মা আমাদের জন্যে চা এনেছিল। বিয়েবাড়ির কাঠের ট্রে ; ছোট ছোট কাপে কয়েক জনের মতন চা। কেউ নিলাম, কেউ নিলাম না। রত্নদিদি দু বেলা দু বারের বেশি চা খান না। তিনি চা নিলেন না। বরং আরও একবার জল খেয়ে মশলা মুখে দিলেন।
বাইরে বুঝি বসন্তের দমকা হাওয়ার ঝাপটা থেমে গিয়েছে। শীতের সিরসিরে ভাবটাই গায়ে লাগছিল। জ্যোৎস্না আরও পরিষ্কার। উজ্জ্বল।
“তারপর কী ঘটল, বলো?” আমি হেসে বললাম।
রত্নদিদি বললেন, “বলি।….তিন-চার মাস আমাদের আর দেখাদেখি নেই। চিঠিপত্তর লেখার দিনকাল তখন নয়, সে সাহসও নেই। সেই একবার যা চিঠি লিখেছিল লালুবাবু। এদিকে বিয়ের কথাও ভাঙতে চলেছে। মনটন ভাল থাকবে কেন, বল! রাগ হত খুব। ভদ্রলোকের ছেলে তুমি, একটা ভাল ছক কোষ্ঠীও করাতে পার না! বাবার মুখে কতবার শুনেছি, যদু মধু বেলা অনিলার ছক কোষ্ঠী বিচার করে বাবা মাকে বলছে, ‘বেশ ছক গো, দেরে বড় আনন্দ হল, বিয়ে হলে মিলমিশ হবে খুব, রাজযোটক।’..পরের কোষ্ঠীতে যা হবার হোক আমাদের তাতে কী! আমরা তো আর যোটক হতে পারছি না। বলবি, আমারও তো ছকটক ভাল ছিল না। আমি বলছি, মোটেই তা নয়। বাবা হল মেয়ের বাপ— সে যদি ছেলের বাড়ির লোকদের আগ বাড়িয়ে বলে, ছেলের ছকে দোষ আছে— তারাই বা মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ছাড়বে কেন!
“বিয়ের কথা ভেঙেই যাচ্ছিল। এমন সময় একদিন আবার লালুবাবু এসে হাজির। তার ভাবসাব দেখে মনে হল, বাড়ির গুরুজনদের কথাবার্তা নিয়ে সে একটুও মাথা ঘামায় না। বরং নতুন ডাক্তার হয়ে তার যেন চেহারা খুলেছে, আরও বড় বড় ভাব হয়েছে, আমতলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, যখন তখন, দিব্যি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলছে— মামিমা একটু চা খাওয়ান, দুধ কম, আমি আবার কড়া চা ছাড়া খেতে পারি না। কী আর বলব মাসিমা, হাসপাতালে এত খাটায় যে দিনে দশ বারো বার চা না খেলে জোর পাই না। খাটতে আমার ভালই লাগে। এই বয়েসে খাটব না তো কখন খাটব বলুন। কুঁড়েমি দেখলেই আমার মাথা বিগড়ে যায়। ওই যারা খায়দায় আর ঘুমোয়— তাদের কি হয় না।…এই ভাবে নিজের বাহাদুরি ফলায় মায়ের কাছে। আর আমায় খোঁচা মারে।”
কৃষ্ণাবউদি বলল, “বিয়ের কথা তো ভেঙেই গিয়েছে তবু উনি এভাবে আসতেন আপনাদের বাড়িতে?”
“আসবে না কেন, দু কান কাটা যে—” রত্নদিদি হেসে বললেন, “তা ছাড়া ডাক্তার কাকার ভাগ্নে, আমাদের প্রতিবেশী। দু বাড়িতে অত ভাবসাব, ডাক্তার কাকিমা মায়ের বন্ধুর মতন, লালুও আমাদের কত চেনাজানা হয়ে গিয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা ভেঙে গেলেও একেবারে সব কিছু উপড়ে মাটিতে নুয়ে পড়েনি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।… তা লালমোহন এবার এসে মাকে যত তোয়াজ করতে শুরু করল, তার বেশি করতে লাগল আমায়। তখন শীত পড়েছে। ওদিকে জব্বর শীত পড়ত, ভাই ; পৌষ মানে একটা লেপে কুলোত না রাত্তিরে! ভোরে তোলা জলে হাত ছোঁয়ানো যায় না, ইঁদারার টাটকা জলে ধোঁয়া ওঠে, কিন্তু যেই না—বালতির জলে বাতাস এসে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে কনকনে। সকালে সামনের মাঠটা হিনে শিশিরে ভিজে যেন অসাড় হয়ে থাকত।… রোজ সকালে দেখতাম, লালমোহন আমার ঘরের বন্ধ জানলার কাছে এসে ঠকঠক করে টোকা মারত। ধড়মড় করে উঠে বসলাম, জানলা খুললাম কী দেখি মাথার হনুমান টুপি, গায়ে ভট কম্বলের অলেস্টার, গলায় মাফলার, লালুর মুখ। তখন সবে রোদ উঠছে, সুয্যির মুখ দেখিনি, তার আগেই লালুর মুখ। তখনই ঠিক হয়ে যেত, বেলায় কোথায় কখন দু জনে দেখা হবে। আবার বেলায় যখন দেখা হত, বলে দিত বিকেলে কেমন করে দেখা হবে। এই ভাবে সারা দিনে তিন-চার বার দেখা হত দু জনে আড়ালে। কখনো কাঁঠালতলার পেছনে একটা অকেজো রোড রোলারের আড়ালে। কখনো বন্ধ হাসপাতালের পেছনে করবী ঝোপের কাছে। লালু আমায় বলত, একেবারেই ঘাবড়াবে না, বিয়ে আমাদের হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না ; আমি আর এক সেট কুষ্ঠীগুষ্টি করিয়ে দিচ্ছি বাঁকড়োর ফেমাস পণ্ডিতকে দিয়ে, হরিসাধন জ্যোতিষার্ণব। দেখবে সেই কুষ্ঠীতে আমি রাজা, তুমি রানি। …আর তখনও যদি তোমার বাবা বাগড়া মারেন, তোমায় নিয়ে আমি পালাব রতনমণি। সেরেফ ক’টা মাস। আমি চাকরির চেষ্টায় আছি। তুমি লক্ষ্মী, একটু সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে।”
‘ক’ মাস লাগল মেওয়া ফলতে?” আমি বললাম হাসতে হাসতে।
“তা লাগল ক’মাস। তার আগে এক কাণ্ড হল। লালুবাবু যে সেবার একটা বাক্স ক্যামেরা নিয়ে এসেছে ফটো তুলবে বলে, আমায় বলেছিল। ফটোও তুলত, আমি নজর করিনি। একদিন বলল, আমার একটা ছবি তুলবে। আমি না না করলাম। কিন্তু সে একেবারে নাছোড়বান্দা। শেষে একদিন শীতের দুপুরে, কেউ যখন কোথাও নেই, হাসপাতালের পেছনের সেই করবী ঝোপের পাশে একটা পাথরের ওপর বসাল আমায় লালু। বলল, সে সব ব্যবস্থা করে ক্যামেরাটা মানির হাতে দেবে। নিজে থাকবে আমার পাশে, ফটো তুলবে মানি। আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। লালুবাবুও শুনবে না। শেষে আমার পা ধরতে আসে। কী করা করব, রাজি হয়ে গেলাম।”
“ফটোও তোলা হল যুগলের?”
“হল। কিন্তু শয়তানিটা কী করল জানিস লালমোহন।” রত্নদিদি বললেন, “মানিকে ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজে একবার সব দেখে নিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার ভাই লজ্জাই করছিল। মুখ তুলে তাকাতে পারি না। ওদিকে মানিকে রেডি হতে বলে লালুচাঁদ পেছন থেকে ঝপ করে আমার চোখ টিপে ধরল। আর ওদিকে ছবি তোলাও হয়ে গেল মানির। ফটো তুলে নিয়ে মানি দে ছুট। আমি হতভম্ব। বুঝলাম, মানিকে সবটাই শেখানো পড়ানো ছিল। রাগের মাথায় লালুর হাত খামচে, মাথার চুল টেনে ছিড়ে যা মুখে এল বলতে বলতে বাড়ি ফিরে এলাম। রাগে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল।”
রত্নদিদি একটু চুপ করলেন। কিছু যেন ভাবছিলেন।
বললাম হেসে, “ফটোটা উঠেছিল?”
“উঠেছিল মানে, কপালে থাকলে কী না ওঠে রে? লটারির টাকাও উঠে যায় চাপরাশির কপালে। মানির হাতে তোলা সেই ফটোও লালমোহনের কপালে উঠে গেল। ..তা ভাই বলতে পারিস, ফটোটা উঠল বলে বিয়ের ফাঁসটাও লেগে যেতে পারল।”
“কী রকম?”
“রকম আর কী! লালুবাবু চৌখস ছেলে। বাঁকড়াতে থাকতে থাকতেই বি.এন রেলের হাসপাতালে চাকরি জোগাড় করে ফেলল ছোট ডাক্তারের। তারপর একদিন বাবার নামে এক রেজিস্ট্রি এল। নতুন ছক কোষ্ঠী আর পাঠাবার দরকার হয়নি ওর। শুধু ওই ছবির একটা কপি পাঠিয়ে দিল বাবাকে, আর লিখল— ‘আপনাদের বিবেচনায় যা হয় করিবেন। আমি দূরে চলিয়া যাইতেছি, নতুন চাকরি, বিলম্বে আমার অসুবিধা হইবে।”
“বলো কি, সেই ফটো তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল?”
“দেবার জন্যই তো তুলেছিল। কম সেয়ানা নাকি ও। মাথায় যত ফন্দিফিকির তত বুদ্ধি। আইবুড়ো এক মেয়ের অমন ছবি, পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে আছে এক ছোঁড়া— ওই ছবি দেখার পর কোন বাপ-মা আর বসে থাকতে পারে? অন্য সম্বন্ধ-ই বা করবে কেমন করে! কোন সাহসে! কাজেই বিয়েটা হয়ে গেল।” রত্নদিদি হাসলেন, “লালুবাবুর রত্নলাভ হল।”
“বিয়েতে খুব ধুম হয়েছিল তাই না!” কে যেন বলল মেয়েদের তরফ থেকে।
“তা হয়েছিল। তবে তাদের আজকাল যেমন দেখলাম তেমন নয়। সে অন্য রকম, নিজেদের লোকজন, পাড়াপড়শি নিয়ে ধুম। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা সেরে বরের সঙ্গে চলে গেলাম দূরে। সেখান থেকে চাকরির বদলি ঘটতে ঘটতে আটশো হাজার মাইল দূরে গিয়েই পড়লাম একদিন। আমাদের আর এদিকে ফেরা হল না। তারপর একদিন তোদের জামাইবাবু তো চলে গেলেন। আমিই পড়ে থাকলাম ছেলে বউ নাতি আগলে। কী করব বল? কপালে আমার যেমনটি লেখা ছিল সেই ভাবেই আছি। দুঃখ করে কী লাভ!”
সবাই চুপ। একটু যেন গম্ভীর হয়ে এল আবহাওয়া। অবস্থাটা হালকা করার জন্য আমি বললাম, “তা সেই ফটোটা তুমি রেখেছ না হারিয়ে ফেলেছ?
মাথা নেড়ে রত্নদিদি বললেন, “হারিয়ে ফেলব কেন, রেখে দিয়েছি। তা বলে সেটা কি আর, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা যায়! লোকে দেখলে বলবে কী। ছেলেরাও তো বড় হয়ে উঠছিল। আমার বাক্সর তলায় লুকিয়ে রেখে দিতাম।”
“আহা, রত্নদিদি— সে ফটো যদি একবার দেখতে পেতাম…।”
“পাগল, তোদের দেখাতাম আর কী!…এবারই কি হল জানিস! শীতের আগে একদিন আমার তোরঙ্গ খুলে চাদরটা জামাটা বার করছি রোদে দেব বলে। আমাদের ওখানে শীত একেবারে কসাই, মায়াদয়া নেই, পড়ল তো গা-হাত-পা কেটে কেটে রক্ত বার করে দেয়।…তা আমি তোরঙ্গ খুলে আমার শালটা চাদরটা ফ্ল্যানেলের জামাটা বার করছি, করতে করতে তোরঙ্গর তলায় রাখা ফটোটা হাতে এল। তুলে নিয়ে দেখছিলাম। কত পুরনো ছবি, মামুলি একটা ক্যামেরায়, ছবিটা হলুদ হয়ে গিয়েছে। বেসম-বেসম রং, এখানে ওখানে দাগ ধরেছে। উঠে গিয়েছে খানিক— তবু ঘটিহাতা জামা পরা বিনুনি ঝোলানো রোগা পাতলা একটা মেয়েকে চোখে পড়ে, আর পড়ে খোঁচা খোঁচা মাথার চুলের একটা ছেলেকে, মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে শার্ট আর হাতকাটা সোয়েটার। ছেলেটা মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে। চোখ টিপে ধরে আছে মেয়েটার। ও ছবি দেখলে কেউ তোদের রত্নদিদির ছবি বলবে না। তোদের জামাইবাবুরও নয়।…নিজের মনে ছবিটা দেখে নিজেই বুঝি হাসছিলাম, এমন সময় হুড়মুড় করে নাতি এসে পড়ল। ফটোটা লুকোতে গিয়েও পারলাম না। নাতি কেড়ে নিল। দেখল খানিক। তারপর কী বলল জানিস?”
“কী” ?
“বলল, এ বুড়িয়া কার পিকচার এটা?..কী বলি বল নাতিকে? বললাম, ও এমনি। হবে কারও। বাক্সর মধ্যে পড়েছিল।..তা ফটোটা ফেরত দিতে দিতে নাতি বলল, বুঢড্ডি টিভিতে ওল্ড হিন্দি ফিল্ম দেখায় দেখেছ? অছ্যুত কন্যা, ঝুলন– দ্যাট টাইপ…বেচারি হিরো হিরোইন…ফালতু, আদ্মি! একদম ফালতু! বলে সে চলে গেল। …আমি আর কী করব বল! দেখলাম একটু, তারপর কাগজে মুড়ে— যেমনটি ছিল তোরঙ্গর তলায় রেখে দিলুম।…ভাবিস না আমার রাগ দুঃখ হল! কেনই বা হবে ভাই! পঞ্চান্ন ষাট বছর কী কম! অত পুরনো ছবির দাম কী! কদরই বা হবে কেন? নাতিই বা কেমন করে চিনে নেবে তার ঠাকুমা ঠাকুরদাকে ওই ফটো থেকে! চেনা যে যায় না। ”
রত্নদিদি চুপ করে গেলেন। আমরাও চুপচাপ। ততক্ষণে দিদির মাথার ধ্বধবে সাদা চুলের ওপাশে জানলা ঘেঁষে এক ঝলক জ্যোৎস্না এসেছে। মনে হচ্ছিল, আলোটা যেন রত্নদিদির মাথায় মাখানো। সামান্য পরে মুখেও নেমে আসবে।
হঠাৎ দেখি রত্নদিদি একটু হাসলেন। বললেন, “আবার কী মনে হয় জানিস এক একবার। নাতি হয়ত কিছু একটা আন্দাজ করেছিল। করেও আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করল। ওটা কী কম পাজি, না, ধুরন্ধর। কেমন ঠাকুরদার নাতি দেখতে হবে তো!”