কালিদাস ও কেমিস্ট্রি
যেন বাঘে তাড়া করেছে, মহেশ্বরী পড়িমরি করে ছুটে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল।
ঘরের মধ্যে তখন সাত আটটা মেয়ে মিলে তালে তালে তালি বাজাচ্ছে, মুখের মধ্যে জিবের শব্দ করছে টক্ টক্ টাকাস্ট্টক্। আশা মেঝেতে উবু হয়ে বসে সিগারেটের কৌটোর মধ্যে রাখা ক্যারামের গুটি বাজাচ্ছিল। আর বকুল হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত পাকে পাকে শাড়িটা জড়িয়ে দুহাত মাথার ওপর তুলে তুড়ি দিয়ে ভ্রূভঙ্গি ও কটাক্ষসহযোগে পা ঠুকে ঠুকে বিচিত্র নাচ নাচছিল। ইরানি নাচ হয়ত। তার গলা হাঁসের গলার মতন দোল খাচ্ছিল।
এই নৃত্যবাদ্যের মধ্যেই মহেশ্বরী একটু আগে উঠে কলঘরে গিয়েছিল। ফেরার সময় বাঘের তাড়া খাওয়ার মতন ছুটতে ছুটতে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল। মেয়েরা ভেবেছিল, দৌড়ে আসতে গিয়ে মহেশ্বরী চৌকাটে হোঁচট খেয়েছে। পড়ল তো পড়ল একেবারে আশার ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মহেশ্বরী। আশা মোটাসোটা গোলগাল মানুষ, ব্যাঙের মতন হাত পা তুলে মেঝেতে উলটে গেল। কোনও রকমে মহেশ্বরী শুধু বলল, ‘কার্বন ডায়োক্সাইড আতি হ্যায় রে।’
মুহুর্তের মধ্যে ঘরের চেহারা পালটে গেল। এ-বিছানা ও-বিছানা থেকে মেয়েরা আতঙ্কের ডাক ছেড়ে লাফ মেরে উঠে দরজার দিকে ছুটল, ঊষা ছুটে গিয়ে আলনার পাশে শাড়ি শায়ার আড়ালে লুকোল।
পালাবার পথ পাওয়া গেল না। খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল কার্বন ডায়োক্সাইড আসছে। মেয়েরা তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
মেয়েরা বলে ‘কার্বন ডায়োক্সাইড’ আসলে নাম ওর ফুলরেণু সোম। কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। এদিকে আবার মেয়ে হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
ঘরের চৌকাটের সামনে দাঁড়িয়ে ফুলরেণু রঙ্গমঞ্চের অবস্থাটা কিছুক্ষণ দেখল; গুটি ছয় সাত মেয়ে, ঘরের মধ্যে তিনটি বিছানাই লণ্ডভণ্ড ধামসানো। মেয়েরা বিছানার কাছে, কেউ বা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের জানলা খোলা, পড়ার টেবিলে কেরোসিন টেবিল-বাতি জ্বলছে। বকুল তার হাত দুটো মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু সারা অঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো শাড়িটা আর আলগা করতে পারেনি; তাকে লেত্তি পরানো ঘোড়া লাট্টর মতো দেখাচ্ছিল।
চৌকাটে দাঁড়িয়ে ফুলরেণু বলল, “এত নাচগান হল্লা কিসের?”
মেয়েদের মুখে কথা নেই, ঠোঁটে সেলাই দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। একেবারে নিরীহ, গোবেচারি মূর্তি সব।
অপরাধীর মতন মুখ করে বকুল শেষে বলল, “আমরা একটু আনন্দ করছিলাম দিদি।”
আনন্দ করার কথায় ফুলরেণু বিন্দুমাত্র আনন্দিত হল না; বরং আরও গম্ভীর বিরক্ত মুখ করে বলল, “আনন্দ করতে হলে মাঠে যাও, রাস্তায় যাও, আমার হোস্টেলের বাইরে যাও। এখানে আনন্দটানন্দ চলবে না। এটা আনন্দধাম নয়। এরকম বেয়াড়াপনা, হইহুল্লোড় আমি অ্যালাও করব না।” ফুলরেণু থামল, যেন তার রায় দিয়ে দিল দু-কথায়। তারপর মেয়েদের জনে জনে লক্ষ্য করল, বকুলকেও। বলল, “বকুল তুমি ওটা কি করে শাড়ি পরেছ? ওটা শাড়ি, না সাপের খোলস। আমার এখানে সাপের খোলস করে শাড়ি পরা চলবে না। যত অসভ্যতা, সব…প্রীতি, তুমি আড় চোখে চোখে কী বলছ? আমি তোমাদের এ সব আড়বাঁশি-চাউনি দু চক্ষে দেখতে পারি না।…আর, মহেশ্বরী, তুমি—তুমি আমায় দেখে দুদ্দাড় দৌড় দিলে, ভাবলে আমি তোমায় দেখিনি। এভাবে দৌড়তে হলে তোমায় ঘোড়দৌড় মাঠে যেতে হবে, এখানে চলবে না। মেয়েদের কাছে আমি সভ্যতা ভদ্রতা ডিসেন্সি চাই—অসভ্যতা বেলেল্লাপনা নয়।”
আশা ঢোঁক গিলে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, ফুলরেণু ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কলেজে তোমরা যা করো আমি দেখে অবাক হয়ে যাই। এ কলেজে ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, তোমরা দল করে সাইকেল চড়ছ, জল ছোঁড়াছুঁড়ি করছ, ছেলেদের সঙ্গে তুই-তুকারি করছ, ডালমুট কেড়ে খাচ্ছ! কী যে না করছ।…এ কলেজে কোনও ডিসিপ্লিন নেই, সহবত শিক্ষা, ভালমন্দ, ছোটবড় জ্ঞান দেখি না কোথাও; সবাই যেন নাগরদোলায় চড়ে আছে। কী অসভ্য সব। ছি ছি!…তা আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি নাচানাচি, লাফালাফি, তুড়ি বাজানো, যা তোমাদের ইচ্ছে তোমরা কলেজে সেরে আসবে, আমার এখানে আমি অসভ্যতা করতে দেব না।…যাও, নিজের নিজের ঘরে যাও।…মহেশ্বরী, আমি আধঘন্টার মধ্যে তোমাদের ঘর পরিষ্কার পরিছন্ন দেখতে চাই।” ফুলরেণু শেষবারের মতন তার তাড়না শেষ করে যেমনভাবে এসেছিল, সেইভাবেই চলে গেল! বারান্দায় তার পায়ের শব্দ শোনা গেল কয়েক মুহূর্ত।
ফুলরেণু অদৃশ্য হলে মেয়েরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আলনার আড়াল থেকে ঊষা বেরিয়ে এল, তার চুলের বিনুনিতে কার যেন নীচের জামার হুক আটকে ঝুলছে।
মহেশ্বরী বলল, “বাস রে বাস, কার্বন ডায়োগাইড কি টেমপারেচার হট হয়ে গেছে রে…”। মহেশ্বরীর হিন্দি-বাংলা মাঝে মাঝে এই রকমই হয়। যদিও সে বাংলা কথা মোটামুটি ভালই বলতে পারে বলে তার ধারণা।
প্রীতি বলল, “হবে না। কতদিন ধরে বলছি জামাইবাবুর সঙ্গে দিদির একটা হট-লাইন পেতে দে, তা তো তোরা দিবি না।”
বকুল পাক দেওয়া শাড়ির প্যাঁচ গা থেকে খুলতে খুলতে বলল, “বলিস না আর তোরা। হট-লাইন না পাততেই এত হট, পাতলে সারাদিন আগুন জ্বলবে।”
মেয়েরা সমস্বরে খিলখিল করে হেসে উঠল।
আসর ভেঙে যেতে ঊষা বলল, “এই বা কি কম জ্বলছে। একেবারে কোপানল। আজ আবার জামাইবাবু পড়াতে আসবে। দিদি কী করবে ভাই? মদনভস্ম।”
মেয়েরা এবার কলকল করে হাসল।
এই গল্পের এইটুকু ভূমিকা। কিন্তু ফুলরেণুর রাগ বা উষ্মা কিংবা বিরক্তি বুঝতে হলে আমাদের এবার তার কাছে যেতে হবে।
মেয়েদের শাসন করে ফুলরেণু তার ঘরে ফিরে গেল। ঘরে ঢুকল না ঠিক, পশ্চিমের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সন্ধে হয়ে গেছে। সামনের নেড়া জমিতে ধুলোভরা করবী ঝোপ। ফাল্গুনের বাতাসে মাঝে মাঝে দুলছিল। হোস্টেলের পাঁচিলের ওপাশে রাস্তা, টাঙা গাড়ি যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে দু একটা লরিটরি। শীত কবে ফুরিয়ে গেছে, সামনে ফাগুয়া, রানি-বাঁধের দিক থেকে ধোপাপট্টির হল্লা ভেসে আসতে শুরু করেছিল, ফাগুয়ার গান হচ্ছে। বাতাস খুব এলোমেলো, দক্ষিণ থেকে দমকে দমকে আসছে আর যাচ্ছে। অনেকটা তফাতে দেশবন্ধু সিনেমা হল, এখন আর গান নেই, ন’টা নাগাদ আবার সিনেমা হলের লাউডস্পিকারে গান বাজাবে এবং সেই তীব্র গান এখানেও ভেসে আসবে। ফুলরেণুর পক্ষে তখন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।
বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফুলরেণু ঘরে এল। এসে আবার জল খেল এক গ্লাস। এই নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তার তিনবার তিন গ্লাস জল খাওয়া হল। না, এখনও এতটা গরম পড়েনি যে ক্ষণে ক্ষণে জল খেতে হবে। তবু ফুলরেণুকে আজ জল খেতে হচ্ছে। মাথা আজ আগুন, ফুলরেণু ভাবতেও পারছে না, এটা কী করে হয়, কী করে হওয়া সম্ভব? ছি ছি!
ঘরের মধ্যে নড়ে চড়ে ফুলরেণু বিছানায় গিয়ে বসল, বসে আবার উঠল, টেবিলের দিকে তার আর তাকাতে ইচ্ছে করছিল না। একরাশ খাতা টেবিলের এক পাশে ডাঁই করে পড়ে আছে। কয়েকটা মাত্র দেখা হয়েছে, বাকিগুলো হয়নি। কে বিশ্বাস করবে, নিরীহ ওই খাতাগুলোর মধ্যে এ-রকম বেলেল্লাপনা লুকিয়ে থাকতে পারে! ছি ছি। ফুলরেণুর হাতের আঙুলের ডগা বোধহয় এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে ঘামে। বুকের ধকধক ভাবটা কমেছে অবশ্য, মাথা এখনও বেশ গরম, কপালের শিরা দপদপ করছে। ফুলরেণু টেবিলের দিকে যেন লজ্জায় আর তাকাতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল: মৃদুলা যেন বুকের কোথাও একটু আবরণ রাখেনি, একেবারে বেহায়ার মতন বসে আছে, বসে বসে নিজেকে দেখাচ্ছে। ছি ছি! ওই একরত্তি মেয়ে পড়ে তো সেকেন্ড ইয়ারে, কতই বা বয়স উনিশ কুড়ি বড়জোর না হয় একুশ, এরই মধ্যে এত! অসভ্য, পাকা মেয়ে কোথাকার।
বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না ফুলরেণু, উঠল; উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল দু দণ্ড। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েদের ক্লাসে একটা প্রশ্নের উত্তর লিখতে সে দিয়েছিল। একেবারে সাধাসিধে প্রশ্ন: হোয়াট আর দি চিফ প্রপারটিস অফ সালফার ডায়োক্সাইড? হাউ ইজ ইট প্রিপেয়ারড, অ্যান্ড ফর হোয়াট পারপাসেস ইজ ইট ইউসড?…এই প্রশ্নের উত্তর যা লিখেছে মৃদুলা তাতে তাকে শক্ত হাতে নম্বর দিলেও দশের মধ্যে অন্তত চার দিতে হয়। অবশ্য এ পরীক্ষা নম্বর দেওয়া-দেওয়ির নয়, ছেলেমেয়েদের কিছু আসে যায় না এতে। ফুলরেণু নিজে ফাঁকিটাকি পছন্দ করে না, পড়ানোর ব্যাপারে সে খুব কড়াকড়ি করে, নিজে পরিশ্রমী; ছেলেমেয়েরা কেমন পড়ছে, কতটা শিখছে তা তার দেখা দরকার—এই বিবেচনায় নিজের ক্লাসে মাঝে মাঝে ‘লেসন টেস্ট’ নেয়। তার জন্য আলাদা খাতা করতে হয়েছে ছেলেমেয়েদের। ফুলরেণু ঘাড়ে করে সেই খাতা বয়ে আনে, দেখে, আবার ক্লাসে ফেরত দেয়। এবারে গতকাল তার সেকেন্ড ইয়ারের কেমিস্ট্রি ক্লাসে ওই প্রশ্নটা লিখতে দিয়েছিল; প্রপারটিস অফ সালফার ডায়োক্সাইড…।
ফুলরেণু জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে টেবিলের দিকে আবার একবার তাকাল। যেন আড়চোখে মুদুলাকেই দেখছে। ‘মৃদুলা তুমি সালফার ডায়োক্সাইডের চিফ প্রপারটিস যা লিখেছ—ডিসইনফেকটান্ট, ব্লিচিং অফ কালারড মেটিরিয়াল…এ সব মোটামুটি ঠিক, কিন্তু তোমার খাতার মধ্যে ওটা কি?’ ফুলরেণুর চোখের দৃষ্টি যেন এই কথাগুলো বলল। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের দিকে আর সে তাকাতে পারল না, কানের লতি গরম হয়ে উঠল; মুখ ফিরিয়ে নিল।
জানলার কাছে আরও একটু দাঁড়িয়ে থেকে ফুলরেণু বিছানায় এল, বসল। চশমার কাচটা মুছে আবার পরল। গালে হাত রেখে ভাবল খানিকটা। তারপর উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। লবঙ্গ খাবার ইচ্ছে করছিল, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। জিবে আর কোনও স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা ফুলরেণুকে টেবিলের কাছে এসে লবঙ্গের শিশি বের করতে হল।
লবঙ্গ মুখে দিয়ে নিতান্ত যেন জোর করেই ফুলরেণু চেয়ারে বসল। বসে তাকাল: টেবিলের ওপর মৃদুলার খোলা খাতা; পাশে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া ভাঁজ করা চিঠি। এই খোলা চিঠিটাই মৃদুলার খাতার মধ্যে পাওয়া গেছে। যদি খামের মধ্যে থাকত ফুলরেণু দেখত না। একেবারে খোলাখুলি, তায় আবার রঙিন ফিনফিনে কাগজ। চোখে না পড়ে পারেনি।
কাঠি দিয়ে বাচ্চারা যেমন শুঁয়োপোকা ছোঁয়, ফুলরেণু অনেকটা সেইভাবে তার খাতা-দেখা লাল-নীল পেন্সিল দিয়ে চিঠিটা ছুঁল। এখনও তার গা বেশ সিরসির করছে। মুখের মধ্যে জিবে লবঙ্গের ঝাল ভাবটায় ঠোঁট ভিজে গিয়েছিল, লালা আসছিল সামান্য।
মৃদুলা যে চূড়ান্ত অসভ্য হয়ে গেছে, ফুলরেণুর তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছিল না। মেয়ে একেবারে পেকে হলুদ। লজ্জা-শরম বলে কিছু নেই। ছি ছি ওইটুকু মেয়ে, এই বয়সে এতটা উচ্ছন্নে গেছে কে জানত! বুদ্ধিসুদ্ধি তো একেবারে কম নেই, কিন্তু এই তোমার রুচি? আড়াই পাতা ধরে ভালবাসার চিঠি লিখেছ। তুমি এত শয়তান যে কাকে চিঠি লিখছ তা কোথাও ধরাছোঁয়ার উপায় নেই, নীচে নিজের নামটাও লেখনি। তা বলে হাতের লেখাটা যে তোমার তা তো বোঝাই যায়, খাতার আগে পেছনে তোমার বাংলা হাতের লেখার নমুনা আছে।…পেটে পেটে এত শয়তানি তোমার, অথচ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।
হতচ্ছাড়া পাজি মেয়ে কোথাকার। তুমি এত ধূর্ত যে কাকে চিঠিটা লিখেছ বুঝতে পারছি না। কলেজের কোনও ছেলেকে নিশ্চয়। তার নাম জানতে পারলে দেখতুম। এই কলেজে তাকে আর ঢুকতে দিতাম না। প্রিন্সিপ্যালকে বলে তাড়িয়ে দিতাম। তোমাকেও। তোমাদের শাস্তি এবং শিক্ষা হওয়া দরকার।
কিন্তু—ফুলরেণু ভেবে দেখল, এ যা কলেজ এখানে কোনও কিছুরই শাস্তি হত না, শিক্ষাও নয়। ছেলেমেয়েরা এইরকমই, কোনও সহবত শেখে না, মানে না। বিশ বছরের ধুমসি মেয়ে দুটো ছোঁড়ার সঙ্গে সেদিন কলেজ-মাঠে সাইকেল রেস দিচ্ছিল। আর একদিন এক ডজন কলা কিনে এনে থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়ের মধ্যে সে কি লুফোলুফি, কলা ছোড়াছুড়ি, খামচাখামচি। ক্লাসে কোনও ছেলে জব্দ হলে মেয়েগুলো উলু দেওয়ার মতন শব্দ করে ওঠে, মেয়েরা জব্দ হলে ছেলেরা টেবিল চাপড়ে গরুবাছুরের ডাক ডাকে। এত হুড়োহুড়ি দাপাদাপি, নাচানাচি, ঝগড়াঝাটি, তুই-তোকারি ছেলেমেয়েদের মধ্যে, তবু প্রফেসাররা কেউ কোনও কথা বলে না। বরং দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজের যেন এটাই ঐতিহ্য। তেমনি হয়েছেন প্রিন্সিপ্যাল, বুড়ো মানুষ, ছেলেমেয়েদের হাতেই লাগাম তুলে দিয়েছেন, যা করার তোমরা করো, কেউ রাশ ধরবে না।
এ-রকম যদি কলেজ হয় তবে ছেলেমেয়েরা এর বেশি কী হবে? প্রফেসারদেরও কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই; নিতান্ত তারা মাস্টার-মাস্টারনি, বয়স হয়েছে, চুলটুল পেকেছে, কারও কারও দাঁত পড়েছে, মেয়েদেরও কারও কারও গায়ে গতরে মেদ জমে মাথার চুল উঠে ভারিক্কি হয়েছে—নয়ত এরাও সব এই কলেজের ছেলেমেয়েদের মতন, বাঁধাবাঁধি ধরাধরি বলে কিছু নেই। নিজেদের ঘরে বসে রঙ্গ রসিকতা, হাহা হোহো দাদা-দিদি করে দিব্যি আছে সব। প্রফেসারস রুমের একটা পাশে পার্টিশান করা মেয়ে প্রফেসারদের ঘর। কিন্তু সারা দিনে যদি একটা ঘন্টাও সেই ঘরে মেয়ে প্রফেসাররা বসে! তারা প্রায় সব সময়ই পুরুষদের ঘরে বসে গল্প করছে, চা শরবত খাচ্ছে, পান চিবুচ্ছে, জদা বিলি করছে। ফুলরেণু অনেকবার এ-বিষয়টা আভাসে ইঙ্গিতে বলতে গেছে মেয়েদের। কথাটা কেউ কানে তো তোলেনি; যেন শোনার মতন বা ভাববার মতন কথাই ওটা নয়। ফুলরেণু এ কলেজে নতুন, মাত্র মাস ছয়েক এসেছে; তার পক্ষে পাঁচ সাত এমন কি দশ বছরের পুরনো মেয়ে প্রফেসারদের আর কি বা বলা সম্ভব। হিস্ট্রির সুমিত্রা দেবী তো একদিন বলেই দিয়েছিলেন, “এ সব ফিকির ভাল না, বহিন। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি ছোড় দো।” হাসতে হাসতেই বলেছিলেন সুমিত্রা দেবী, কিন্তু খোঁচাটা বেশ লেগেছিল ফুলরেণুর। বেহারি মেয়ে সুমিত্রা দেবী, সাত বছর এই কলেজে আছেন, এখানকারই মেয়ে, স্বামী ছেলেদের স্কুলের হেডমাস্টার। দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজের ধারাবাহিক ইতিহাস তাঁর মুখে ম্যাগনাকার্টা চার্টারের মতন, রাজা দীপনারায়ণের কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, আদর্শ তাঁর মুখস্থ। এক দুই তিন করে পর পর তিনি বলে দিতে পারেন; এখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই, জাতিধর্ম সংস্কার নেই, প্রাদেশিকতা নেই, মাস্টার-মাস্টারনির দাপট নেই…ইত্যাদি। সোজা কথা, দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজেরর প্রফেসাররাও এই কলেজের গড়িয়ে যাওয়া জলে গা ডুবিয়ে মহাসুখে দিন কাটাচ্ছেন।
ফুলরেণুর এসব ভাল লাগে না। লাগছেও না। সভ্যতা, ভদ্রতা, সহবত, শিষ্টতা—এ-সব যদি না শেখানো হয় তবে ছেলেমেয়ের মাথা চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না। হচ্ছেও তাই। এই যেমন মৃদুলার বেলায় দেখা গেল। আগে আরও কিছু কিছু দেখেছে ফুলরেণু কিন্তু এরকম পরিষ্কার ও প্রত্যক্ষ নয়, এভাবে হাতেনাতে তার কাছে আর কেউ আগে ধরা পড়েনি।
হাতের পেনসিল টেবিলে ফেলে রেখে এবার আস্তে হাত বাড়াল ফুলরেণু, যেন শুঁয়োপোকার কাঁটা তার হাতে ফুটবে কিনা বুঝতে পারছে না। দু আঙুলে চিঠিটার কোনা ধরে টানল আস্তে আস্তে; বোধহয় কাঁটা যা ফোটার আগেই ফুটেছে, নতুন করে কিছু ফুটল না। চিঠিটা খুলল ফুলরেণু। আবার পড়ল। এই নিয়ে সাত আটবার পড়া হল।
বাব্বা, কী ছটা ভাষার! এতটুকু লাজ-লজ্জা নেই। কিছুই যেন আটকাচ্ছে না। আবার কথায় কথায় কবিতা, ময়ূরের মতন হৃদয় জাগছে, প্রজাপতির পাখার মতন স্বপ্ন ছুটছে, ডালে ডালে ফুল ফুটছে, মাঝরাতে বালিশের কানে কানে কথা হচ্ছে! বালিশের আবার কান! ফুলরেণুর মনে হচ্ছিল মৃদুলাকে কাছে পেলে ঠাস করে এক চড় মারত। কুমারী মেয়ে তুমি, রাত্তিরে বালিশটাকে তুমি অন্য জিনিস ভেবে গাল ঘষছ? স্বভাব-চরিত্র একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে তোমার…ছিছি এ-সব কথা কি ভাবা যায় যে মেয়েমানুষে লেখে। কোনও মেয়ে কি ভাবতে পারে তার বুকের সামনে একটা পুরুষ আয়না ধরুক, ধরে দেখুক কে আছে! অথচ ওই মেয়ে লিখেছে। হতভাগা মেয়ে কোথাকার। আবার কত আশা, আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে।
চিঠিটা বন্ধ করে ফেলল ফুলরেণু। চোখের পাতাও বুজে ফেলল। দাঁত চেপে চেপে বলল, তোমার ফুল আমি ফোটাচ্ছি ডেঁপো মেয়ে। কাল প্রিন্সিপ্যালের কাছে যাব। তোমার মা বাবার কাছেও যদি যেতে হয় তাও যাব।
চিঠি রেখে দিল ঠেলে ফুলরেণু। এত ভাষার ছটা এরা কোথায় পাচ্ছে এবার যেন তা আবিষ্কার করতে পারল। নির্ঘাত ওই বাংলা-সংস্কৃতের ভদ্রলোক স্বর্ণকমলবাবুর বিদ্যে থেকে। অমন অসভ্য তো আর দেখা যাবে না ভূ-ভারতে। কোঁচা দুলিয়ে ধুলো ঝাঁট দিতে দিতে কলেজে আসছে, মাথায় উড়ু উড়ু চুল, চোখে কুচকুচে কালো ফ্রেমের চশমা, গায়ে ঢিলে পাঞ্জাবি! হাতে চটি চটি বই, কাব্যটাব্যর হবে হয়ত। গলা কী, যেন সব সময় থিয়েটার করছে ক্লাসে। রসিকতায় প্রোফেসাররা মুগ্ধ, ছেলেমেয়েরা সব ইয়ার-বন্ধু হয়ে উঠেছে। ক্লাসে যখন পড়ায় নিজের মানসম্মান সম্রম সৌজন্যটুকু পর্যন্ত রাখে না। কি সব কথা বলে রঙ্গ রসিকতা করে, আজেবাজে গল্প…। ভীষণ ডিস্টার্বিং। ফুলরেণুকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচবার ওই কার্তিক-টাইপের লোকটার পাশাপাশি ঘরে ক্লাস নিতে হয়। ছাই, এ-কলেজের আবার ওই এক রয়েছে; ওয়েস্ট ব্লক বলতে হলঘরের হাট। একটা বড় হলঘরের তিনটে পার্টিশান আছে কাঠের—সেখানেই ওয়েস্ট ব্লকের ক্লাস বসে ভাগে ভাগে। পাশাপাশি ঘরে ক্লাস পড়লে ফুলরেণু আর পড়াতে পারে না, কাঠের পার্টিশান টপকে ওই লোকটার থিয়েটারি গলা ভেসে আসে, সংস্কৃত কাব্য পড়াচ্ছে, তার যত ব্যাখ্যা। রীতিমত অসভ্য। কিংবা বাংলা পড়াচ্ছে—সুর করে করে—কথায় কথায় হাসি উঠছে পাশের ঘরে। জ্বালাতন একেবারে। ফুলরেণু ক্লাসের মধ্যে রাগ করেছে, ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে এসে ওই লোকটার ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে, লোকটা বেরিয়ে এলে বলেছে, “এভাবে গোলমাল হলে আমার পক্ষে ক্লাস করা যায় না।” লোকটা মুচকি হেসে বিনীত গলায় জবাব দিয়েছে, “ক্ষমা করুন। আমার ক্লাস শান্ত রাখছি, আপনি পড়ান।”
…ক্লাসের বাইরেও প্রফেসারদের ঘরে কথাটা তুলেছে ফুলরেণু, “আপনার ক্লাসে বড় গোলমাল হয়, আমি পড়াতে পারি না। কেমিষ্ট্রি একটা ছেলেখেলার সাবজেক্ট নয়।” স্বর্ণকমল হাত দুটি জোড় করে ঘাড় হেলিয়ে হেসে হেসে জবাব দিয়েছে, “আমি বড়ই লজ্জিত। রসশাস্ত্র আর রসায়নশাস্ত্রের তফাতটা ছেলেমেয়েরা বোঝে না। আমি ওদের বুঝিয়ে দি, মনে রাখতে পারে না।” ফুলরেণু গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিল, “আপনি নিজে মনে রাখলেই আমি খুশি হব।” লোকটা চটপট হেসে জবাব দিয়েছে, “আমি তো দিবারাত্রি স্মরণে রাখি।”…হাসিটা ফুলরেণুর ভাল লাগেনি। কী রকম যেন। আর ঘাঁটাতেও ইচ্ছে হয়নি।
বাংলা-সংস্কৃতের ওই স্বর্ণকমলের সঙ্গে তার চটাচটির ব্যাপারটা প্রফেসাররা জেনেছেন, ছেলেমেয়েরাও দেখেছে, জেনেছে। ফুলরেণুর তাতে খানিকটা রাগ বেড়েছে বই কমেনি। কিন্তু উপায় কি! স্বর্ণকমল দেড় বছর এখানে আছে, সিনিয়ার; সে মাত্র ছ’ মাস—জুনিয়ার। স্বর্ণকমলের নাকি খুঁটির জোর বেশি, তার বাবা মুঙ্গেরের নামকরা ডাক্তার ছিলেন, ধনী লোক, ভাইরা সব এক একটি দিক্পাল। ইনি ছোট, কাজেই বয়ে গেছেন আদরে, কাব্যটাব্য নিয়ে পড়ে আছেন।
তা যাক, ফুলরেণু এবার উঠল চেয়ার থেকে, মৃদুলার চিঠিতে যত ভাষার ছটা, পাকামি, অসভ্যতা, তাতে বেশ বোঝা যায় যে স্বর্ণকমলের প্রভাব ওতে আছে। ফুলরেণুর সন্দেহ নেই। কাল কলেজে গিয়ে মেয়ে প্রফেসারদের কাছে কথাটা তুলবে ফুলরেণু। বলবে, দেখুন আপনারা—ভেবে দেখুন, মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে আপনাদের যদি কোনও কিছু কর্তব্য না থাকে করবেন না কিছু। কিন্তু আমি সহ্য করব না। আমার সাধ্যমত আমি করব! ফাইট করব। না হলে কলেজ ছেড়ে চলে যাব।
ফুলরেণু আর-একটি সিদ্ধান্ত করে নিল। স্বর্ণকমল সপ্তাহে দুদিন এই হোস্টেলে ঊষা আর মমতাকে পড়াতে আসে, শখের টিউশানি; মেয়েদের হোস্টেলে ওর আসা বন্ধ করতে হবে। লোকটা ভয়ঙ্কর, ওর ছোঁয়াচে হোস্টেলের মেয়েদের মতিগতি খারাপ হতে পারে, ফুলরেণু তা হতে দিতে পারে না। তার একটা দায়িত্ব আছে।
চিঠিটা সন্তর্পণে ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিল ফুলরেণু। সে ভেবে পেল না—কেমিষ্ট্রি মেয়ে মৃদুলার কি করে এইসব বাজে প্রেম-ফ্রেমে মাথা গেল! জগৎ-সংসারে জানা এলিমেন্ট এখন একশো আট, তার বাইরে যে কিছু নেই মৃদুলার তা জানা উচিত। তুমি সালফার ডায়োক্সাইডের প্রপারটিস লিখেছ, ডিসইনফেকটান্ট মানে যে জিনিস ছোঁয়াচের আক্রমণ থেকে বাঁচায়, তুমি…তুমি…ছি ছি—এইসব বাজে ছোঁয়াচে নোংরামির পাল্লায় পড়লে!
ফুলরেণুর নিজের মাথাই যেন লজ্জায় কাটা যাচ্ছিল।
মাথা ধরে যাচ্ছিল বলে ফুলরেণু পায়চারি করার জন্য ঘরের বাইরে এল। বাইরে এসে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লক্ষ্য করল, মাঠ দিয়ে স্বর্ণকমল আসছে। আজ তার পড়াবার দিন নাকি? এত দেরি করে আসা কেন? কটা বেজেছে?
স্বর্ণকমলকে তাড়িয়ে দেবার ইচ্ছে হল ফুলরেণুর। কিন্তু উপায় নেই।
মাঝে মাঝে স্বর্ণকমল পড়াতে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। ভদ্রতার জন্য ফুলরেণু কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ঘরেও ঢুকতে দেয় না। আজ ফুলরেণু ঠিক করল, স্বর্ণকমলের সঙ্গে দেখাও করবে না। ওর হোস্টেলে আসাও বন্ধ করতে হবে।
লোকটা বড় ছোঁয়াচে। ইভিল।
দুই
পরের দিন কলেজে এসে কথাটা তুলব তুলব করেও ফুলরেণু তুলতে পারল না। এ যা সৃষ্টিছাড়া কলেজ, যেমন সব মাস্টার-মাস্টারনি তাতে হুট করে একটা কথা তুলে সকলের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়া বিচিত্র নয়। হয়ত তাকে নিয়ে আড়ালে হাসিঠাট্টা করবে, কাজের কথাটা কানেই তুলবে না। মৃদুলার চিঠিটা এক্ষুনি ওদের কাছে মেলে ধরতে চায় না ফুলরেণু। সেটা উচিত হবে না। তাতে ব্যাপারটা একেবারে হাটেবাজারে হয়ে যাবে। হাজার হলেও মৃদুলা মেয়ে এবং ছাত্রী; তার ভালবাসাবাসির চিঠি পুরুষদের চোখে পড়ুক এটা ফুলরেণু চায় না। সে যা করবে, শালীনতা ও সন্ত্রম বজায় দেখে করবে, গোপনে এবং যথাসাধ্য সতর্কতায়। ব্যাপারটা হই-হই করে করার নয়, হাটে হাঁড়ি ভেঙে জল ছিটানোর বিষয়ও নয়। চিঠিটা এখন থাক। ফুলরেণুর কাছে যেন ওটা বঁড়শি। প্রথমেই জোরজবরদস্তি করে টান মারতে গেলে ছিঁড়ে যেতে পারে, মাছের টাগরা থেকে খুলে যেতেও পারে; তখন আর করার কিছু থাকবে না। তার চেয়ে ধীরেসুস্থে বেশ করে খেলিয়ে তবে যা করার করতে হবে। ফুলরেণু শুধু যে মৃদুলাকে শিক্ষা দিতে চায় তা নয়, এই বেলেল্লা বেহায়া কলেজের চরিত্র শুধরে দিতে চায়, ভদ্র শালীন সভ্য করতে চায়। …তা ছাড়া আরও একটু নজর করার আছে, মৃদুলাকে নজর করতে হবে, অন্য ছেলেমেয়েদের, স্বর্ণকমলকেও। মেয়ে প্রফেসারদের কাছেই কথাটা আভাসে তুলবে ফুলরেণু প্রথমে, তুলে মনোভাবটা বুঝবে; তারপর তার ইচ্ছে পুরুষ প্রফেসারদের কিছু না জানিয়ে যদি কিছু করা যায় করবে, এমন কি, প্রিন্সিপ্যালকে যদি জানাতে হয় মেয়ে প্রফেসারদের তরফ থেকেই আড়ালে জানাতে হবে।
সেদিন আবার উমাদি আসেননি। উমাদির ওপরেই ফুলরেণুর একটু ভরসা আছে। উমাদি পুরনো লোক, বয়েস হয়েছে অনেকটা, এ-অঞ্চলের পুরনো নাম করা গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে, সভ্যতা শালীনতা মান্য করেন। কথাটা তাঁর কাছে তোলাই ভাল।
ফুলরেণুর সেদিন আর কিছু বলা হল না, কিন্তু ওয়েস্ট ব্লকের হলে ক্লাস নিতে গিয়ে পাশের ঘরে স্বর্ণকমলের পড়ানো কিছু কিছু শুনে রাখল। কাঠের পার্টিশানের ওপর থেকে যে কথাগুলো ভেসে আসছিল ফুলরেণু তার কিছুই বুঝছিল না; স্বর্ণকমল সংস্কৃত পড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে শুধু ফুলরেণু শুনছিল; ‘ফুলরেণু মদন’ ‘প্রিয়তমা রতি’ ‘বসন্ত’ ‘মকরন্দ’ ‘পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকস্তানাভ্যঃ এইসব। শেষের কথাটা ফুলরেণু পুরোপুরি শুনতে এবং স্পষ্ট বুঝতে পরছিল না; তবু তার কান মুখ গরম হয়ে উঠছিল। এইসব অসভ্য শব্দ বইয়ে থাকে? নাকি স্বর্ণকমলের বানানো; সে বুঝে উঠতে পারছিল না। সংস্কৃত-টংস্কৃত পড়ানো উচিত না। ছি ছি!
পরের দিন কথাটা আভাসে তুলল ফুলরেণু। মেয়ে প্রফেসারদের ঘরে ওরা তখন তিনজন—উমাদি, ফুলরেণু আর বিজয়া। দুপুরের চা খেতে খেতে কথাটা ওঠাল।
“এদের আর সামলানো যায় না—” ফুলরেণু বলল।
উমাদি চেয়ারে পিঠ টেলিয়ে আলস্যের ভঙ্গিতে বসে খাচ্ছিলেন। বললেন, “তোমার ক্লাসে গোলমাল আর কোথায় হয়! দেখি না তো!”
ফুলরেণু চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে বলল, “গোলমাল নয়। গোলমাল হওয়া তবু ভাল, তার চেয়েও বেশি হচ্ছে।”
বিজয়া কোলের ওপর মাথার কাঁটা খুলে রেখে খোঁপাটা সামান্য ঠিক করে নিচ্ছিল। এলাহাবাদের মেয়ে, বাঙালিদের মতন এলোমেলো করে খোঁপা রাখতে পারে না। দিনের মধ্যে পাঁচবার করে খোঁপা শক্ত করে। বিজয়া বলল, আমার সিভিকস ক্লাসে মার্কেট বসে যায়। কী গপ্ করে…বাসরে বাস।’
ফুলবেণু বিজয়ার মুখে প্রশ্রয় এবং হাসি ভিন্ন কিছু দেখল না। বিজয়া একেবারে বাজে। কিছু পড়াতে পারে না, নিজেই গল্পের রাজা ফাঁকিবাজ। তার ক্লাসে হুল্লোড় ছাড়া কিবা হবে আর। কিন্তু কথাটা তো ক্লাসের গোলমাল নিয়ে নয়। ফুলরেণু একচুমুক চা খেয়ে বলল, “আমাদের ডিসিপ্লিন থাকা দরকার।”
উমাদি যেন তেমন গা করলেন না কথাটায়, হাই তুললেন।
ফুলরেণু আবার বলল, “মেয়েদের ওপর অন্তত একটু নজর রাখা দরকার। এখানে যা হয় তাতে ভাল কিছু হচ্ছে না।”
উমাদি বললেন, “খারাপটা তো আমি কিছু দেখিনি। কেন, কি হয়েছে?”
ফুলরেণু চট করে কোনও জবাব দিল না। বিজয়ার সামনে যেন তার কথাটা বলতে ইচ্ছে নেই। আড়চোখে বিজয়াকে দেখল, তারপর সতর্ক হয়ে বলল, “আপনারা চোখ চেয়ে দেখেন না কিছু। দেখলেই বুঝতে পারতেন।”
উমাদির বোধ হয় ঘুম পাচ্ছিল, গরম পড়ে আসায় দিনের বেলায় আলস্য লাগছে; বড় করে হাই তুলে বললেন, “কই, আমার কিছু চোখে পড়ে না।”
“মেয়েদের খানিকটা সভ্যভব্য হওয়া উচিত”, ফুলরেণু বলল।
“তা অবশ্য উচিত—” উমাদি চায়ের বাকিটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করলেন, রুমালে মুখ মুছলেন, তারপর বললেন, “মেয়েরা একটু চঞ্চল, হুড়মুড় করে। তা করুক। এই তো বয়েস। যত জীবন্ত হবে ততই ভরন্ত লাগবে। হইচই না থাকলে ওদের মানায় না।” বলে উমাদি হাই তুলতে তুলতে পানের ডিবে বের করে উঠে দাঁড়ালেন, পাশের ঘরে গিয়ে পান বিলোবেন পুরুষ মাস্টারদের, গল্পটল্প করবেন।
বিজয়া মাথার খোঁপা আট করে কাঁটা গুঁজে নিয়ে বলল, “মাসে দু’ডজন করে কাঁটা কিনি, মাগর খালি হারায়…।”
ফুলরেণু কোনও জবাব দিল না। বরং তার বিরক্তি হচ্ছিল, বিজয়া কলেজে পড়াতে আসে না মাথার চুল সামলাতে আর কাঁটা গুঁজতে আসে বলা মুশকিল। চুলের যত্ন শেষ হল, এইবার গিয়ে ছোকরা প্রফেসারদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বসবে। যেমন কলেজ, তেমনি সব মাস্টারনি। ফুলরেণু নাকমুখ কুঁচকে ঘৃণার গন্ধে টেবিল থেকে একটা কাগজ টেনে নিয়ে মুখ আড়াল করল।
অথচ ব্যাপারটা এমন যেন ফুলরেণু ছেড়ে দিতে পারল না। স্বার্থ তার নয় কিছু মন্দ উদ্দেশ্যও তার নেই। সে তো ভালই করতে চাইছে, মন্দ নয়; মেয়েদের ভাল, কলেজের ভাল, সমাজের ভাল। মেয়েদের মা-বাবারও এতে উপকার বই অপকার হবে না, বরং তাঁরা যা জানেন না—তাঁদের লুকিয়ে লুকিয়ে যা চলছে সেই নোংরামিটা বন্ধ হবে।
কয়েকটা দিন ফুলরেণু তার মেয়ে সহকর্মীদের কাছে খুঁত খুঁত করল। স্পষ্ট কিছু বলল না, সরাসরি কারও নামও করল না, কিন্তু তার আপত্তি এবং অপছন্দটা প্রকাশ করতে লাগল।
“দেখুন, আমি ছেলেমানুষ নই”, ফুলরেণু একদিন ঘরভর্তি মেয়েদের কাছে বলল, “একটা প্রমাণ না থাকলে একথা আমি বলতাম না। যা হচ্ছে এখানে সেটা খুব খারাপ, মেয়েদের স্বভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
মিসেস চৌধুরী—মানে মনোরমা চৌধুরী বললেন, “তুমি যে কী বলতে চাইছ ফুলরেণু আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।”
সুমিত্রা দেবী হেসে বললেন, “আরে বহিন, তুমি খালি বিল্লি বিল্লি ডাকছ! মাগর বিল্লি কাঁহা? পাত্তা দাও।”
ফুলরেণু রেগে বলল, “বেড়াল ঘরে না ঢুকলে আমি বলতাম না।”
“কোথায় বেড়াল?” উমাদি বললেন, “তুমি সেটা বলো, দেখাও।”
এরা অন্ধ। বেড়াল যে ঘরে ঢুকে দুধ মাছ শুঁকে যাচ্ছে, ঢাকা সরিয়ে মুখ দিয়ে পালাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না। ফুলরেণু বলল, “বেড়াল আছে। আপনারা দেখতে চাইছেন না, তাই দেখতে পারছেন না!… এইটুকু এইটুকু মেয়ে তারা কি না করছে। কেমন করে শাড়ি পরে দেখেছেন?”
“তা ভাই, যখনকার যা চলন—” গীতাদি বললেন, “কলকাতা বম্বের হাওয়া এসেছে, পরবেই তো। ওদের সাজপোশাকে হাত দেওয়ার কিছু নেই আমাদের।”
“ঘাড়ে বুকে কাপড় রাখে না”, ফুলরেণু বলল, ঝাঁঝাঁলো গলায়।
“মুঙ্গের জেলায় গরমটা বেশি যে”—মনোরমা হাসতে হাসতে বললেন।
ফুলরেণুর মাথা আগুন হয়ে উঠল; বলল, “সেদিন একটা মেয়ে জল মুখে করে ন্যাকামি করছিল, একটা ছেলে তার গায়ে সুড়সুড়ি দিতে সে ছেলেটার জামায় কুলকুচো করে দিল।”
“এরকম দুষ্টুমি ওরা করে, ফুলরেণু। তুমি নতুন বলে তোমার চোখে লাগছে—আমাদের লাগে না।” উমাদি বললেন।
“এটা হেলদি সাইন” বিজয়া বলল, “রিলেশান ইজি থাকছে। কো-এডুকেশানে অ্যায়সেই হওয়া দরকার।”
ফুলরেণু প্রায় বিজয়াকে ধমকে উঠল, “কো-এডুকেশানে এরকম হয়। আপনি আমাকে শিক্ষা দেবেন না।”
উমাদি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলে নেবার চেষ্টা করলেন। “আমি একটা কথা বলি ফুলরেণু, হয়ত এখানকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশি হই হই করে। কিন্তু ওটা ওদের দোষ নয়। এখানে এই রকমই হয়ে আসছে। তুমি স্বভাব চরিত্র খারাপ হবার কথা বলছ। আমরা এই কলেজে পুরনো কোনও স্ক্যান্ডেল কখনও হতে দেখিনি, শুনিনি। বরং এ রকম দেখেছি—এই কলেজেই পড়েছে এমন ছেলেমেয়েতে বিয়ে-থা হয়েছে পরে, যখন ছেলেরা আরও বড় হয়েছে, চাকরি-বাকরি ব্যবসাপত্র করেছে। ঠিক কিনা সুমিত্রা? তুমিই বলো।”
সুমিত্রা দেবী বললেন, “অনেক হয়েছে”, বলে গীতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
গীতাদি বলল, “উমাদি, পাস্ট ইজ পাস্ট।”
সুমিত্রা জবাব দিলেন, “প্রেজেন্টয়েতেও হয় রে।”
সবাই হেসে উঠল, ফুলরেণু বাদে। ফুলরেণুর রীতিমত আত্মসম্মানে লাগছিল। সবাই মিলে তাকে উপহাস করল। কেউ বিশ্বাস করল না, মেয়েদের কতটা অধঃপতন হচ্ছে চরিত্রের। ফুলরেণু নিজের ব্যাগ থেকে টুকরো কাগজ বের করল, চোখ-মুখ তার লাল হয়ে উঠেছে রাগে, গলার স্বর চিকন ও তীক্ষ্ণ। কাগজটা বের করে ফুলরেণু বলল, “আমার ক্লাসে হাট বসেছিল। কি পড়ানো হচ্ছিল আপনারা শুনুন, আমি দু চারটে টুকে এনেছি !” বলে, ফুলরেণু পড়ল,…“তোমার মতো নবযুবতীরা যদি ইন্দ্রিয়সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে তপস্যায় অনুরক্ত হয়, তা হলে মকরকেতুর মোহনশর কি কাজে লাগল ? সুন্দরী, তোমার নবীন বয়স, তোমার কোমল শরীর, শিরীষকুসুমের মতো সুকুমার অবয়ব। তোমার তপস্যার সময় এ নয়।…” ফুলরেণু থামল, তার চোখমুখ লালচে, কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা। “এইরকম আরও আছে। আমার মনে থাকে না। কিন্তু বুঝতে পারি যা পড়ানো হচ্ছে তা আগলি।…সেদিন শুনছিলাম বলা হচ্ছে : ‘সরোবরের জল দিন দিন যেমন বাড়ে, তেমনি নারী নিতম্…’ বলতে বলতে থেমে গেল ফুলরেণু। অনেক কষ্টে জিব আটকাল।
মেয়েরা চুপ। গীতাদি হঠাৎ হেসে বললেন, “আপনি ভাই বড় বেরসিক। স্বর্ণকমলবাবু আলাদা কী আর পড়াতে পারেন। বোধহয় কাদম্বরী পড়াচ্ছিলেন। ওদের খানিকটা ‘কুমার সম্ভব’—আর বোধহয় ‘শকুন্তলা’র দু-একটা অংশ আছে।” গীতাদি নিজে বাংলা পড়ান।
ফুলরেণু বলল, “কাদম্বরী-টরী জানি না, আপনারা জানবেন। ওসব নোংরা জিনিস পড়ে কি হয় ?”
“বলছেন কি ভাই আপনি ! ‘কাদম্বরী’, ‘রঘুবংশ’, ‘মেঘদূত’, ‘শকুন্তলা’—এ সব হল আমাদের প্রাচীন কাব্য, কত নামকরা বই, সংস্কৃত সাহিত্যের মণিমাণিক্য, এসব না পড়লে সংস্কৃত পড়া হবে কেন !”
“পড়তে হবে না।”
“হবে না ?”
“আমি হলে সংস্কৃত পড়া বন্ধ করে দিতাম। কথায় কথায় শুধু নলিনী আর মালিনী…।”
“পীনপয়োধরও আছে—” গীতাদি উলটো ঠাট্টা করলেন, “আলপিন নয় কিন্তু…।”
উমাদি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাকগে—যাকগে, যেতে দাও। সব পড়াই পড়া। পড়ার মধ্যে দোষ কিছু নেই।…আমি বলি কি ফুলরেণু, তুমি মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখো। কলেজের ছেলেমেয়েরা তো শিশু নয়, তারা নিশ্চয় খানিকটা বোঝে। যা বোঝে না, তা না বুঝুক। বয়েস হয়েছে—জগতের কিছুটা বুঝবে বই কি ! তোমার যদি কোনও আপত্তি থাকে, কারও সম্পর্কে কোনও কমপ্লেন থাকে, তুমি প্রিন্সিপ্যালকে বলতে পারো, আমাদেরও পারো।”
ফুলরেণুর মাথার ঠিক ছিল না, রাগে অপমানে জ্বলছিল। বলল, “আপনারা যা করেছেন তাতে ছেলেমেয়েদের মাথা খাওয়া হচ্ছে। নয়তো ওইটুকু মেয়ে ভালবাসাবাসির চিঠি লেখে ?”
উমাদি, সুমিত্রা, মনোরমা, গীতা, বিজয়া—সবাই ফুলরেণুর দিকে তাকিয়ে থাকল। নয়ন বুঝি অপলক হল একটুক্ষণ।
মনোরমা বললেন, “ওমা, তাই নাকি ! কোন মেয়ে ?”
ফুলরেণু নাম বলল না। “নাম জেনে কি হবে ! এই কলেজেরই ছাত্রী, আপনাদেরই স্টুডেন্ট…”
বিজয়া পরম কৌতুকে জিজ্ঞাসা করল, “কোন ইয়ার ? আর্টস না সাইন্স ?”
বিজয়ার কথায় ফুলরেণুর ঘেন্না হচ্ছিল ! এটা কি তামাশার কথা ? কিছুই বল না ফুলরেণু।
উমাদি সিঁথির কাছে কাঁচাপাকা চুলের কাছটা একটু চুলকোলেন। সুমিত্রার মুখের দিকে তাকালেন সামান্য, তারপর বললেন, “আমি আর কী বলব ! যে বয়েসের যা⋯! এরা তবু উনিশ-কুড়িতে লিখছে, আমি ষোলো সতেরোয় লিখেছি…।”
উমাদির কথায়, সকলে কলরোল তুলে হেসে উঠল। ফুলরেণুর মনে হল সবাই মিলে তাকে নিয়ে তামাশা করল, উপহাস করল, একশেষ করল অপমানের। তার একমাত্র ভরসা ছিলেন উমাদি, সেই উমাদিই তাকে সকলের সামনে এমন ভাবে অপ্রস্তুত করলেন যে লজ্জায় অপমানে তার মাথা কাটা গেল।
আর কিছু বলল না ফুলরেণু ; কলেজ ছুটি হয়েছে, ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ফুলরেণু বুঝতে পেরেছিল উমাদিদের দিয়ে কিছু হবে না। এরা এই কলেজের ধাত পেয়েছে, সব ব্যাপারেই হেলাখেলা, তামাশা ; দায়দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা এরা ভাবে না। সভ্যতা শালীনতার জন্য মাথাব্যথা এদের হবার কথা নয়, যদি সে জ্ঞান থাকত তবে পুরুষ প্রফেসারদের ঘরে বসে অত গল্প গুজব, হাসি, পান-জরদার আসর জমাত না। নিতান্ত এদের বয়েস হয়েছে, ছেলেপুলে আছে—ঘরসংসার করে নয়ত বয়েস কমিয়ে এই গোয়ালে ঢুকিয়ে দিলে ওই ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে এরাও সমান মিশে যেত !
যাক, এরা চুলোয় যাক। ফুলরেণু ওদের মতন হতে পারে না, পারবে না। যা করার সে একলাই করবে। সহকর্মীদেরই যখন পাওয়া গেল না, তখন পুরুষদেরও সাহায্য পাওয়া যাবে না। পুরুষদের সাহায্য নেওয়ার কথা অবশ্য ফুলরেণু আগে ভাবেনি। তবে এটা পাওয়া গেলে, ওটা পাওয়া যেতে পারত হয়ত। না পেয়েছে না পাক, কথাটা সে সরাসরি প্রিন্সিপ্যালের কাছে ওঠাবে। তার আগে তাকে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। মামলা সাজিয়ে না নিয়ে মোকদ্দমা লড়তে যাওয়ার মতন বোকামি সে কবে না।
তিন
সেদিন হোস্টেলে মমতাদের ঘরে এসে ফুলরেণু বলল, “মমতা, তোমার সংস্কৃত বইখানা দেখি।”
মমতা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিছুই বুঝতে পারছিল না। বলল, “কোন বই, দিদি ?”
“ক্লাসে যা পড়ানো হয়…”
“আমাদের চারটে বই। একটা বই সিলেকসানের মতন, অন্য তিনটে…”
“একটাই আগে দাও।”
মমতা একটা বই এনে হাতে দিল।
ফুলরেণু বইটা হাতে নিয়ে পাতা খুলল। “এ আমি কি বুঝব ! সংস্কৃত টংস্কৃত আমি জানি না। মানের বই নেই ?”
মমতা এবার যেন বুঝল একটু। বলল, “বাংলা আছে, দিচ্ছি।”
বইয়ের ডাঁই থেকে মোটা মতন একটা বই এনে ফুলরেণুর হাতে দিল মমতা। বলল, “এটায় দিদি, বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখা আছে, মানে দেওয়া আছে বাংলায়। খুব সুন্দর…”।
ফুলরেণু পাতা উলটে এক লহমা দেখে নিল। কালিদাস গ্রন্থাবলি…। বলল, “তোমাদের এ বই সবটা পড়ানো হয় ?”
মমতা মাথা নাড়ল। “না, ওটা পড়ানো হয় না ; ওর থেকে দুটো কাব্যের চারটে সর্গ পড়ানো হয় !”
“কোনটা কোনটা ?”
“রঘুবংশম্ আর অভিজ্ঞান শকুন্তলম্…” মমতা বলল, কোন কোন সর্গ তাও বলল।
ফুলরেণু বই নিয়ে ফিরে আসতে আসতে বলল, “তোমাদের উনি পড়াতে এলে বলবে যাবার সময় যেন আমার সঙ্গে কথা বলে যান।” স্বর্ণকমলের নামটা ইচ্ছে করেই ফুলরেণু বলল না।
মমতা মাথা হেলিয়ে বলল, “আজ তো উনি আসবেন না, কাল আসবেন। এলে বলব।”
ফুলরেণু চলে গেল।
এতক্ষণ রেবা ঘরের একপাশে বসে কত যেন মন দিয়ে সেলাই করছিল। ফুলরেণু চলে যেতেই মাথা উঠিয়ে চোখ ভরা হাসি নিয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে ?”
“কী জানি !”
“কার্বন ডায়োক্সাইড কালিদাস পড়বে ! বাব্বা, এর চেয়ে নাইনথ ওয়ান্ডার আর কিছু নেই। কাল সকালে উঠে দেখবি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে।”
“ইচ্ছে হয়েছে পড়বার… !”
“ইচ্ছে !…তুই একেবারে নেকু মমতা। ইচ্ছে-টিচ্ছে নয়, চাপ—প্রেশার। জামাইবাবু চাপ দিয়েছেন, ভাল ভাল ভাষা দিয়ে কথাটথা বলতে হবে তো। পরশু বকুলের কাছ থেকে দিদি ‘চন্দ্রশেখর’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-টুইল নিয়ে গেছেন…বকুল বলছিল।”
মমতা হেসে ফেলল। “তুই এত জানিস, বাবা !”
রেবা ঘাড় দুলিয়ে কটাক্ষ করে বলল, “জানব না কেন ! সবাই জানে। গলা টিপলে দুধ বেরোবার বয়স আমাদের নেই। জামাইবাবু এলে দিদির যেমন হয় দেখিস না। বারান্দায় এত পায়চারি কিসের ? অত গঙ্গা গঙ্গা বলে গঙ্গাদিকে ডাকাই বা কেন ?”
মমতা হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, “ওই বইটা আমার নয় রে ! আমাদের জামাইবাবুর। আমি ভাল বুঝতে পারি না বলে দিয়েছিলেন পড়তে।”
রেবা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলল, “তুই পাতায় পাতায় যাস।”
রাত্তিরে ফুলরেণু নিজের ঘরে বসে কালিদাস গ্রন্থাবলি পড়ছিল। পড়তে পড়তে সে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে যে পাতাটা খোলা তার দিকে অনেকক্ষণ আর সে তাকাতে পারল না। সর্বাঙ্গ যেন ফাল্গুনের গরমে জ্বালা করছে, চোখ মুখ লাল, ঠোঁটের ডগায় দাঁতের চাপ বসে লাগছিল। নিশ্বাস গরম। অনেকক্ষণ পরে কোনও রকমে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে ফুলরেণু পাতাটার দিকে আবার তাকাল। নীচের দিকে বাংলা তর্জমা। ফুলরেণু আচ্ছন্নদৃষ্টিতে পড়ল :…“সেই মুহূর্তে বায়ুবেগে পার্বতীর পরিধেয় বস্ত্র অপসারিত হইলে তাঁহার ঊরুমূলে নখচিহ্ন সমূহ দেখিয়া তৎপ্রতি শিবের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। পার্বতী শিথিল বসন বন্ধন করিতে উদ্যত হইলে মহাদেব প্রিয়তমাকে নিবারণ করিলেন। রাত্রি জাগরণ হেতু পার্বতীর নয়ন রক্তবর্ণ, গাঢ় দন্তক্ষত হেতু অধর প্রপীড়িত এবং অলকাবলী ছিন্নভিন্ন হইয়াছিল…।”
ফুলরেণু আর পড়তে পারল না। কপাল, গাল, গলা, ভীষণ জ্বালা করছিল ; নিজের নিশ্বাসের গরমটা অনুভব করে তার মনে হল তার জ্বর এসেছে। হাতের তালুতে ঘাম জমে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে ফেলল। চোখের পাতা বুজে যেন সে আর কিছু দেখছে না, তাকে কেউ দেখছে না—এই ভাব করে বসে থাকল ! কী বিচ্ছিরি, কী যাচ্ছেতাই। ছি ছি। মেয়েরা এই সব পড়ে ? শিব তো গাঁজা খায় জানত ফুলরেণু, একেবারে ক্ষ্যাপা, বোমভোলা লোক। অথচ এ সব কী ? সে নিজে মদ খাচ্ছে, পার্বতীকে খাওয়াচ্ছে…আর যা যা করছে—ছি ছি…।
ফুলরেণু উঠে পড়ল, উঠে পড়ে জল দেখল। তারপর মুর্ছা যাবার মতন করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে কলেজে পড়াবার কেমিস্ট্রি বইটা খুলে বসল ফুলরেণু। চোখ মুখ গম্ভীর, থমথমে গলার স্বর ভারি যেন কাল সারারাত ঘুম হয়নি, গরমে জানলা খুলে রেখে ঠাণ্ডা লেগেছে, নাকের ডগায় জল আসছে বার বার। কেমিস্ট্রি বই খুলে অ্যাসিডের চ্যাপ্টারটা বের করল। পড়ার কিছু নেই ; তবু বার কয়েক অ্যাসিডের চ্যাপ্টার পড়ল। আজ ফার্স্ট ইয়ারে অ্যাসিড পড়াবে ফুলরেণু।
কালিদাস গ্রন্থাবলির দিকে কিছুতেই আর তাকাবে না ফুলরেণু। তাকাবে না বলেই বাসি খবরের কাগজটা চাপা দিয়ে বইটা আড়াল করে রেখেছে।
অ্যাসিড পড়া শেষ করে ফুলরেণু যখন উঠল তখন তাকে অ্যাসিডের মতনই তীব্র দেখাচ্ছিল। হয়ত সেটা শরীর খারাপের জন্য।
কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরল ফুলরেণু। আজ শেষের দিকে ক্লাস ছিল না। অন্য সময় হলে সে থাকত, এতটা রোদে আসত না, গল্পগুজব করে সময়টুকু কাটিয়ে বিকেলের গোড়ায় ফিরত। আজ থাকল না। থাকতে ইচ্ছে করল না। মনোরমা চৌধুরী আর বিজয়া বসে গল্প করছিল। ওদের সঙ্গ অসহ্য লাগে আজকাল ! শরীরটাও ভাল নেই। আলস্য আর জ্বর জ্বর লাগছে, বেশ ব্যথা হয়েছে গায়ে কোমরে। টাঙা ডাকিয়ে এনে টাঙায় চড়ে ফুলরেণু ফিরে এল হোস্টেলে। হোস্টেল খাঁ খাঁ করছে। ঝি বামুন ছাড়া কেউ নেই। রোদের কী তাত এখনও। ধুলোভরা বাতাস উড়ছে। কাক ডাকছিল, একা একা।
ঘরে এসে ফুলরেণু শাড়ি বদলাল, চোখে মুখে জল দিয়ে এসে অ্যাসপিরিন ট্যবলেট খেলে গোটা দুই : দরজা ভেজিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। খানিকটা ঘুমোতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এতটা অবেলায় ম্যাজমেজে শরীর নিয়ে ঘুমোত সাহস হল না। ঘুমও পাচ্ছিল না। কোমরের কাছটায় এত ব্যথা হলে রাত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ দিতে হবে।
এ-পাশ ও-পাশ করে, চোখ বুজে, কখনও চোখ খুলে শুয়ে, নোট লিখেও সময় যেন ফুরোচ্ছিল না। হাই উঠছিল। টুকরো কয়েকটা শব্দ ছাড়া কোনও কিছু কানেও আসছে না। কাশীর কথা মনে পড়ল। মার চিঠি আসেনি দিন সাতেক ; টোকনটাও চিঠিপত্র দিচ্ছে না। কী ব্যাপার কে জানে ! সামার ভেকেশানের এখনও দেরি। সবে তো দোল এল।
ফুলরেণু সময় কাটানোর জন্য আলস্যভরে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ তুলে নিল ! তারপর পাতা উলটোতে লাগল। পড়তে শুরু করেছিল সেদিন, মাঝপথে ফেলে রেখেছে। পাতা খুঁজে নিয়ে আবার পড়তে লাগল : “তুমি, বসন্তের কোকিল। প্রাণ ভরিয়া ডাক তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই, কিন্তু তোমার প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ যে, সময় বুঝিয়া ডাকিবে।…” এ সব বই ফুলরেণু দু-চারটে এক সময়ে পড়েছিল, তখন বোঝার মতন মন হয়নি, আগ্রহও হয়নি। কী হবে এ সব পড়ে, তার চেয়ে শক্ত একটা কেমিক্যাল কম্পোজিশান বোঝা ভাল। সেটা বুঝতে বুঝতে কলেজ জীবনটা কাটাল। তারপর এক জায়গায় চাকরি করছিল পড়ানোর, বছর খানেক সেখান থেকে এখানে—এই মুঙ্গের জেলার দীপনারায়ণ জুবিলি কলেজ।
‘রোহিণীর কলসী ভারি, চাল-চলনও ভারি। তবে রোহিণী বিধবা।’…ফুলরেণু পড়ে যাচ্ছিল। হাই উঠছে। জানলার বাইরে বাতাসের ঝাপটা লেগে জানলায় শব্দ হল, কাকটা ডাকছে এখনও।
‘…অমনি সে রসের কলসী তালে তালে নাচিতেছিল। হেলিয়া দুলিয়া, পালভরা জাহাজের মতো, ঠমকে ঠমকে, চমকে চমকে, রোহিণী সুন্দরী সরোবর পথ আলো করিয়া জল লইতে আসিরেছিল—এমন সময় বকুলের ডালে বসিয়া বসন্তের কোকিল ডাকিল। কুহুঃ কুহুঃ কুহুঃ…।’ ফুলরেণু অন্যমনস্ক হল, বইয়ের পাতায় মন থাকল না। বরং তার কেমন একটা কৌতূহল—বসন্তের কোকিলকে সময় বুঝে ডাকতে বলার অর্থটা কি ? হেঁয়ালি নাকি ? কখন ডাকবে ? কোন সময়ে ?
ফুলরেণু চোখের পাতা আধবোজা করে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাল লাগছে না। কেমন উদাস লাগছে। তা যতই বল, কালিদাসের চেয়ে এই কৃষ্ণকান্তের উইল সভ্য। মেয়েরা পড়তে পারে।
ফুলরেণুর যেন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।
কতক্ষণ পরে, ঠিক খেয়াল নেই, ফুলরেণু সাড়া পেল। মেয়েরা ফিরেছে? তাদের গলা পাওয়া যাছিল। বিকেল হয়ে গেছে।
রাতের দিকে স্বর্ণকমল এল।
বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ডাকল। ফুলরেণু অপেক্ষা করছিল। বলল, “ভেতরে আসুন।”
স্বর্ণকমল ঘরের মধ্যে এল।
ফুলরেণু আগে ভেবেছিল, লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না, বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলবে, বা নীচে মাঠে নিয়ে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলবে। পরে ভেবে দেখল, এটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। মেয়েরা দেখবে, ঝি বামুনরা দেখবে। ফুলরেণু রাগের মাথায় একটু জোরেই কথা বলে, বাইরে জোরে জোরে কথা বললে মেয়েদের কানে যেতে পারে। তার চেয়ে ঘরেই কথাবার্তা বলা ভাল। তা ছাড়া শরীরটাও ভাল নেই, বাইরে যেতে ইচ্ছেও করছিল না।
“আপনি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন, মমতা বলছিল”, স্বর্ণকমল বিনয় করে বলল।
“হ্যাঁ—বসুন।”
স্বর্ণকমল বসার জায়গা খুঁজল। ফুলরেণু চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে, হাত কয়েক তফাতে একটা টুল। চোরা চোখে বিছানাটাও একবার দেখে নিল স্বর্ণকমল। তারপর ইঙ্গিতে টুলটা দেখিয়ে বলল, “ওখানেই বসি ?”।
ফুলরেণু তাকিয়ে দেখল। মনে মনে বলল : হ্যাঁ—ওখানেই বসো—ওই টুলে ; টুলটা উঠিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বাইরে বসলেই ভাল হত। কিন্তু তা তো বলতে পারি না, হাজার হোক ‘কোলিগ’। নিতান্ত যেন খারাপ দেখাবে, অসৌজন্য প্রকাশ পাবে বলে ফুলরেণু স্বর্ণকমলকে টুলের ওপর বসতে বলতে পারল না। চেয়ারের পাশ থেকে সরে যেতে যেতে ফুলরেণু বলল, “না না, ওখানে কেন, এই চেয়ারে বসুন।” বলে বিছানার দিকে চলে গেল।
স্বর্ণকমল চেয়ার টেনে নিল। “আপনি বসবেন না?”
“বসছি ; আপনি বসুন।”
স্বর্ণকমল বসল।
ফুলরেণু হাতের ঘড়ি দেখল। আটটা বেজে মিনিট পাঁচেক হয়েছে। সন্ধের আগে আগেই ঘড়িটা হাতে পরে নিয়েছে ফুলরেণু, যেন হিসেব রাখছে স্বর্ণকমল কখন পড়াতে এল কতক্ষণ পড়াল, তার সঙ্গে কখন দেখা করতে এল।
কথাটা ঠিক কীভাবে শুরু করা যায় ফুলরেণু বুঝতে পারছিল না। মনে মনে যা ভেবে রেখেছে—সেসব নিশ্চয় বলবে পরে, কিন্তু প্রথমে কি বলা যায় ! ফুলরেণু অস্বস্তি বোধ করল। বিছানার ওপর বসবে কি বসবে না ভাব করে দাঁড়িয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকল। দিন তিনেক পরেই দোল পূর্ণিমা। বাইরে চাঁদের আলো টলটল করছে, জানলায় জ্যোৎস্না এসে পড়েছে।
কথা শুরু করার আগে স্বর্ণকমলকে একবার লক্ষ্য করল ফুলরেণু। চেহারাটা দেখলেই বোঝা যায়—লোকটা খুব চালাক-চতুর। ছলছলে হাসিখুশি মুখ হলে কি হবে, ওই সুন্দর কার্তিকঠাকুরের মতন মানুষটা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ধূর্ত।
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল ফুলরেণু। তারপর যেন তৃতীয় কাউকে উদ্দেশ করে কিছু বলছে, বলল, “হোস্টেলের মেয়েদের ঘরে বসে পড়ানোর ব্যাপারে একটা অসুবিধে হচ্ছে। একটা ঘর দেড় দু ঘণ্টা আটকে থাকে…অন্য বোর্ডারের অসুবিধে হয়।”
স্বর্ণকমল শুনল। হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মমতার ঘরে বসে পড়াব না বলছেন?”
“রেবার অসুবিধে হয়। সে অন্য ঘরে গিয়ে বসে থাকে, গল্প করে।”
“ঊষা যখন এ-ঘরে—মমতার ঘরে এসে আমার কাছে পড়ে, রেবা তখন উষার ঘরে যেতে পারে।”
“না, নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য ঘরে গিয়ে পড়াশোনা হয় না।”
“ও !”
সামান্য অপেক্ষা করে ফুলরেণু বলল,“মেয়েরা আমায় কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু আমার একটা দায়িত্ব আছে। সকলেরই সুবিধে অসুবিধে আমার দেখা দরকার।”
স্বর্ণকমল প্রতিবাদ করল না, বরং সমর্থন জানিয়ে মাথা নাড়ল। “তা যথার্থ। তা হলে অন্য কী করা যায় ?” স্বর্ণকমল যেন আদেশের অপেক্ষায় ফুলরেণুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
ফুলরেণু কোন জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, পা যেন কাঁপছে, হাঁটুর ওপরটায় ব্যথা-ব্যথা। বাধ্য হয়েই ফুলরেণু বসল।
স্বর্ণকমল বলল, “নীচে একটা ঘর আছে না ? কোনার দিকে ?”
ফুলরেণু অবাক হয়ে তাকাল। “আছে এক ফালি ঘর। ঝিদের ঘরের পাশে। কেন ?”
“তা হলে ওখানে বসে ওদের পড়াই।”
ফুলরেণু এ দিকটা একেবারে ভেবে দেখেনি। চালে হেরে যাওয়ার মতন অবস্থা হল তার। বিপন্ন বোধ করে হঠাৎ বলল, “ওই ঘরটা, আমি সিকরুম করব ঠিক করেছি।” বলে অনেকটা নিশ্চিত হল যেন ফুলরেণু। উলটো চালটা যেন সামলে নিয়েছে। মনে মনে ভাবল, লোকটা কী চালাক ! এ তবুও অন্য পাঁচটা ঘরের মধ্যে ছিল, নীচে যাওয়া মানে আড়ালে পালানো। ওখানে বসে মেয়ে দুটোকে পড়াবে না ছাই, একেবারে পাকিয়ে ছাড়বে।
স্বর্ণকমল বলল, “সিকরুম করবেন ওটা?”
“হ্যাঁ।”
“তবে তো ভালই—”
“ভাল কিসের ?”
“সিক আর ক’টা বছরে ! খালিই পড়ে থাকবে। ওখানেই বেশ পড়ানো চলবে।”
ফুলরেণু অবাক চোখ করে স্বর্ণকমলকে দেখল। লোকটা কি মুখটিপে হাসছে নাকি ! মুখ বেশ চকচক করছে, কী ফরসা রং, স্নো পাউডার মেখে পড়াতে আসে নাকি ও ?
বাইরে গঙ্গার গলা। পরদা সরিয়ে দিতে বলছে। ফুলরেণু কিছু বুঝল না। স্বর্ণকমল উঠে দরজার কাছে গিয়ে পরদা সরাল। গঙ্গা ঘরে এল, হাতে দু কাপ চা। ফুলরেণু বুঝতে পারল না গঙ্গাকে কে চা আনতে বলেছে।
স্বর্ণকমল হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল। গঙ্গা অন্য কাপটা ফুলরেণুর হাতে দিতে গেল। প্রায় ধমকে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল ফুলরেণু, অনেক কষ্টে সংযত করল নিজেকে। “এখন চা ?”
স্বর্ণকমল হাসিমুখে বলল, “খান। চায়ে কিছু হয় না।…আমি আসবার সময় মমতাদের বলে এসেছিলাম। পাঠিয়ে দিয়েছে।”
ঝিয়ের সামনে কিছু বলা যায় না, উচিতও নয়, ফুলরেণু চায়ের কাপ নিল। ভেতরে ভেতরে রেগেছে। আমার হোস্টেলে এসে তুমি আমাদের মেয়েদের চায়ের ব্যবস্থা করে দিতে বল ? এ প্রায় ধৃষ্টতা !
গঙ্গা চলে গেল। স্বর্ণকমল চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে তৃপ্তির শব্দ করল বার কয়েক। ফুলরেণু চায়ের পেয়ালায় মুখ ছোঁয়াল না।
স্বর্ণকমল বলল, “তা হলে ওই ব্যবস্থাটাই ভাল হল, নীচের ঘরে—মানে সিকরুমেই আমি মমতাদের পড়াব।”
ফুলরেণু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বোধ হয়, কথাটা কানে যেতেই হঠাৎ তার খেয়াল হল। শক্ত গলায় বলল, “না।”
“না— ! না কেন ?” স্বর্ণকমল যেন কতই অবাক হয়েছে এমন চোখে তাকাল।
“সিকরুম পড়বার জায়গা নয়।”
“কিন্তু ওটা যখন খালিই পড়ে থাকবে—”
“কে বলেছে খালি পড়ে থাকবে !”
“না, মানে—তেমন কিছু বড় রোগ—বসন্ত, হাম, কলেরা, টাইফয়েড না হলে তো আপনি কাউকে সিকরুমে পাঠাচ্ছেন না। এখানে রোগটোগ বড় হয় না। মেয়েদের হবে না বলেই মনে হয়।”
“আপনার কি মনে হয় না হয় আমার তা জানার দরকার নেই। যে কোনও রকম অসুখ করলেই আমি মেয়েদের সিকরুমে পাঠাব।”
“সর্দি-কাশি হলেও ?”
“হাঁ, হাঁচি হলেও।”
স্বর্ণকমল ঢোঁক গিলল। তার চোখ চকচক করছে। পরে বলল, “আমার বাড়ি অনেকটা দূরে। মাইল খানেক। মমতাদের গিয়ে পড়ে আসতে কষ্ট হবে।”
পাগল নাকি ফুলরেণু। তোমার বাড়িতে তুমি একলা থাক, সেখানে এই সব মেয়েকে পড়তে পাঠাবে ফুলরেণু। তা হলে এখানে যাও বা পদার্থ আছে তোমার কাছে গেলে তার কিছু থাকবে না। ওই সব অসভ্যতা পড়বে, তুমি পড়াবে, আর মেয়েগুলোর ইহকাল একেবারে নষ্ট হবে।
ফুলরেণু বলল, “দূরে গিয়ে পড়া বিশেষ করে রাত্রে আমি অ্যালাও করতে পারি না।’
স্বর্ণকমল চুপ।
ফুলরেণু এবার অন্যমনস্কভাবে কাপে কয়েক চুমুক দিল। দিয়ে ভালই লাগল। গলাটা ভারি হয়ে জড়িয়ে এসেছিল, আরাম লাগল। সংস্কৃত বাংলার প্রফেসার এবার জব্দ।
স্বর্ণকমল শেষে বলল, “আপনি যেরকম বলছেন তাতে তো আর পড়ানো হয় না।”
মনে মনে খুশি হল ফুলরেণু। কে তোমায় পড়াতে বলেছে। তোমার পড়ানো বন্ধ করতেই তো চাই।
স্বর্ণকমল বেশ মনোযোগ দিয়ে ফুলরেণুকে লক্ষ করল। তারপর দুশ্চিন্তার ভাব করে বলল, “প্রিন্সিপ্যালকে তা হলে একবার কথাটা বলি, কি বলেন ?”
“কেন প্রিন্সিপ্যালকে কেন—?”
“উনিই পড়াতে বলেছিলেন। ওঁকে না জানিয়ে কিছু তো করা যায় না।”
ফুলরেণু এবার সমস্যায় পড়ল। প্রিন্সিপ্যালকে এখনই কথাটা জানানো কি উচিত হবে ? তাঁর কানে কথাটা উঠলে ফুলরেণু কি ধরনের কৈফিয়ত দেবে এখনও তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। স্বর্ণকমলের বিরুদ্ধে তার মামলা এখন পর্যন্ত সাজানো হয়নি।…বেশ মনমরা হয়ে গেল ফুলরেণু। বলল, “অন্য ব্যবস্থা কী করা যেতে পারে আমি এখনও ভাবিনি। ভেবে দেখি। তারপর যা হয় করব। আপনি পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।”
স্বর্ণকমল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। “কবে দেখা করব ?”
“করবেন। দু একদিন পরে করবেন। শুক্রবার নাগাদ।”
এক মুহূর্ত ভাবল স্বর্ণকমল। “শুক্রবারই দেখা করব।”
“করবেন।”
“সন্ধের দিকে !”
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল ফুলরেণু। স্বর্ণকমল যাবার জন্য পা বাড়িয়ে বলল, “আপনার শরীর তেমন ভাল নেই, না ?”
“না !”
“শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে তাই…’ স্বর্ণকমল দু পা এগিয়ে প্রায় ফুলরেণুর মুখোমুখি হল, জানলার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “বসন্তের এই বাতাসটা ভাল না। …কা ললনা দিবসন্তং কুসুমশরমসোয় হৃদ্যনাদিবসন্ত…” বলতে বলতে হাসিমুখে স্বর্ণকমল দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
ফুলরেণু কিছু বুঝল না। কী বলল, স্বর্ণকমল ? কি মানে ওই বিদঘুটে কথাটার ?
বাইরে বেরিয়ে এসে স্বর্ণকমল হাসল। মনে মনে শ্লোকটার তর্জমা করল : বসন্তের এই দুরন্ত সময়ে, এমন কোন কামিনী আছে যে হৃদয়স্থিত ফুলবান মদনকে সহ্য করতে পারে ? কেউ পারে না সখি, কেউ পারে না।
চার
সারাটা দিন মেয়েরা রং খেলছে। সেই যে দল মিলে ভূত সেজে বেরিয়ে গিয়েছিল সব, সারা শহর বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে হল্লা করে রং মেখে ঘুরে বেড়িয়েছে। হোস্টেলে ফিরেছিল বেশ বেলায়। স্নান খাওয়া করে জিরিয়ে আবার সব বেশবাস করে বেরিয়ে গেল ; মেয়েদের হাতে গায়ে কানে তখনও রঙের আবছা দাগ, চুলের তলায় আবিরের আভা। ওরা গেছে দুর্গাবাড়িতে ‘পূর্ণিমা মিলনে’, সেখানে আজ গান বাজনা। যাবার সময় বলে গেছে অবশ্য ফুলরেণুকে। ফুলরেণু নিষেধ করেনি। করা উচিত হত না। সুমিত্রা দেবী, মনোরমা চৌধুরী, গীতাদি, বিজয়া—সকলেই ও বেলায় রং মাখাতে এসেছিল ফুলরেণুকে। তখনই বলে গিয়েছিল : মেয়েদের ও-বেলায় ‘মিলনে’ পাঠিয়ে দিও, আভাদি বলে দিয়েছেন।
হোস্টেল ফাঁকা। ঝি বামুনরাও বোধ হয় সকলে নেই। ঘরদোর বারান্দায় এখনও রং লেগে আছে, আবিরের গুঁড়ো জমে রয়েছে। কেমন একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। ফুলরেণুকে স্নান করতে হয়েছে মাথা ঘষে, আবিরের ধুলোবালি এখনও যেন মাথায় কিচকিচ করছে, চোখ মুখ গাল গলা খসখসে লাগছে, বেশ একটু উষ্ণও যেন। আজ আর চুল বাঁধা হয়নি, রুক্ষ এলোচুলে একটা গিট দিয়ে নিয়েছে ফুলরেণু। সাদা খোলের শাড়ি পরেছে, পাড়টা চওড়া, সোনালি রং পাড়ের, গায়ের জামাটাও সাদা, চিকনের কাজ করা।
সন্ধের দিকটায় আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। চুপচাপ নিস্তব্ধ হোস্টেল, রান্নাঘরে ঝি-বামুনে রান্নাবান্না করছে। নীচে এসে মাঠে ফুলরেণু ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কী পরিষ্কার ঝকঝকে জ্যোৎস্না, পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ মাথার ওপর, বাতাসটা এত সুন্দর যে গা-মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। ফুলরেণু গায়ের আঁচল বাতাসে উড়িয়ে মাঠে পায়চারি করছিল, মেয়েরা নেই, কেউ তার আঁচল ওড়ানো, মাথার এলোচুল দেখছে না। কাশীর কথা মনে পড়েছিল মাঝে মাঝে। মা চিঠি দিয়েছে ; টোকনও চিঠি দিয়েছে। টোকনের চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে ; বাড়িতে তাকে নিয়ে রহস্যময় কিছু হচ্ছে। কী হচ্ছে ফুলরেণু অনুমান করতে পারে। টোকন লিখেছে ; ফুলদি, তুই এলে তোর কাছে—মানে সিলেকশান বোর্ডের চেয়ারপার্সনের কাছে ‘ফর সিলেকশন’ ফাইলগুলো দেওয়া হবে।’…টোকনটা বড় ফাজিল হয়ে উঠেছে আজকাল। ফুলরেণুর নিজের ভাই-বোন নেই, মামাতো ভাইবোনরাই সব।
গেট খোলার শব্দ হল। ফুলরেণু অন্যমনস্কভাবে তাকাল। কে যেন আসছে। তারপর খেয়াল করে তাকাতেই যেন অবাক হয়ে গেল। স্বর্ণকমল, স্বর্ণকমল এ সময় কেন ? আজ তার আসার কি দরকার ?
কোঁচা দুলিয়ে, চুড়িদার সাদা দুধের মতন পাঞ্জাবিতে চাঁদের আলো মাখিয়ে কার্তিক ঠাকুরের মতন লোকটা আসছে। ফুলরেণু তাড়াতাড়ি নিজের উড়ন্ত আঁচল সামলে নিল।
স্বর্ণকমল কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে হাসল। ফুলরেণু অবাক গলায় বলল, “কি ব্যাপার ? আপনি ?”
“এলাম।” স্বর্ণকমল হাসিহাসি মুখে বলল।
“আজ কী ? আজ তো দোল। মমতারা কেউ নেই।”
“আপনি আমায় শুক্রবার সন্ধেবেলায় দেখা করতে বলেছিলেন।”
আজ অবশ্য শুক্রবার, এবং সময়টাও সন্ধে। তা বলে লোকটা একেবারে দিনক্ষণ মেপে আসবে। যখন বলেছিল…ফুলরেণু তখন কি অত ভেবে বলেছিল, নাকি তার খেয়াল ছিল শুক্রবার দোল। মমতাদের পড়াতে আসবে যেদিন সেদিন এলেই চলত।
ফুলরেণু সে রকমই ভেবেছিল।
বিরক্ত হয়ে ফুলরেণু বলল, “তা বলে আপনি দোলের দিন সন্ধেবেলায় আসবেন। আজ কি মেয়েরা পড়ে ?”
“তা তো বলেননি আপনি”—স্বর্ণকমল বিনয় করে বলল, “মেয়েদের পড়াব বলেও আমি আসিনি। দেখা করতে বলেছিলেন তাই এলাম। আপনার সময়ের তো দাম আছে। অন্য সময়…”
বাধা দিয়ে ফুলরেণু বলল, “আপনার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত ছিল।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, তা ঠিক।”
ফুলরেণু কি বলবে আর বুঝতে পারল না। লোকটা কি ইচ্ছে করেই এ সময় এসেছে ? ভীষণ চতুর তো ! কিছুই বলা যায় না। এখন কি করবে ফুলরেণু ? স্বর্ণকমলকে তাড়িয়ে দেবে ? অন্যদিন দেখা করতে বলবে ! ফুলরেণুর মনে হল, সেটা বড় বেশি অসভ্যতা এবং অভদ্রতা হবে। হাজার হোক এভাবে আজকের দিনে কাউকে তাড়ানো যায় না।
দাঁড়িয়ে থাকা অস্বস্তিদায়ক। ফুলরেণু পা বাড়াল। শাড়ির আঁচলটা বাঁ হাতে ধরে রেখেছে। স্বর্ণকমলও পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।
ফুলরেণু বলল, “ও ব্যাপারে আমি এখনও কিছু ভেবে দেখিনি। সময় পাইনি।”
স্বর্ণকমল বিন্দুমাত্র বিরক্ত হল না, বলল, “তাতে কি ! পরে ভেবে দেখবেন।”
ফুলরেণু বলার মতন আর কিছু পেল না, পায়চারি করার মতন হাঁটতে লাগল নীরব ; স্বর্ণকমলও পাশে পাশে হাঁটছে।
“মেয়েরা সব—কি বলে যেন—পূর্ণিমা মিলনে গেছে…” ফুলরেণু শেষে বলল, চুপচাপ থাকলে এই সময় অন্যরকম মনে হচ্ছে, অস্বস্তি বোধ করছে সে।
“হ্যাঁ, আজ দুর্গাবাড়িতে ‘মিলন’। দোলের দিন প্রতি বছরই হয়। এখানকার বাঙালিরা করে।”
“আপনি গেলেন না।”
“এখানে এলাম।”
ফুলরেণু বলতে যাচ্ছিল : এখানে কি ‘মিলন’ হচ্ছে ? বলতে গিয়েও কোনও রকমে বেফাঁস কথাটা সামলে নিল। নিয়ে যেন ঢোঁক গিলল। মনে মনে রাগল সামান্য।
স্বর্ণকমল চোরা চোখে ফুলরেণুকে দেখছিল। ফুলরেণুর গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, মুখটি লাবণ্যভরা। যেন বেলআটা মাখানো। বয়স বেশি না ফুলরেণুর, বছর চব্বিশ পঁচিশ ; সর্বাঙ্গে পুষ্টতা এবং শ্ৰী আছে। ফুলরেণুর মুখে ভাবে ভঙ্গিতে যে গাম্ভীর্য আছে তা কিছুটা কৃত্রিম, কিছুটা যেন কোনও সংস্কার বা গোঁড়ামি বলে…ফুলরেণুকে আজ আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল, একমাথা রুক্ষ এলো চুল, বেলফুলের মতন মুখটি যেন ফুটে আছে। চোখের পাতা বন্ধ করে স্বর্ণকমল নিশ্বাস নিল দীর্ঘ করে। নিশ্বাসে শব্দ হল।
ফুলরেণু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কি শুকছে লোকটা ! ফুলরেণু অবাক হয়ে বলল, ‘কী ?”
“কিসের…?”
“ও-রকম করলেন যে !”
“বেশ একটা গন্ধ পেলাম।” স্বর্ণকমল মুখ উঁচু করে নাক টানতে লাগল। “কিসের গন্ধ ?”
“ফুলের—”, স্বর্ণকমল মনে মনে হাসল। ফুলরেণু যেন বাতাসে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল, কোনও গন্ধ পেল না। বাতাসটা অবশ্য চমৎকার লাগছিল। মাঠের চারপাশে তাকাল, অনেকটা দূরে করবী গাছের একটা ঝোপ ছাড়া কোথাও কোন গাছ নেই।
ফুলরেণু বলল, “এখানে আবার ফুল কোথায় ?”
স্বর্ণকমল মনে মনে বলল : আমার সামনে : মুখে বলল, “বসন্তকাল—, পবনঃ সুগন্ধি।”
ফুলরেণু আড়চোখে তাকিয়ে স্বর্ণকমলকে দেখল একবার। তারপর মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগল। মাঠের কোথাও কোথাও রং শুকিয়ে আছে, কোথাও বা আবির পড়ে আছে ধুলোয় ; মেয়েরা সকালে দৌড়োদৗড়ি করে রং খেলেছে মাঠে। ফুলরেণু মুখ উঠিয়ে সামনে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে চোখ তুলল : টলটল করছে পুর্ণিমার চাঁদ।
স্বর্ণকমল বলল, “বেশ লাগছে না ?”
ফুলরেণু কোনও জবাব দিল না।
স্বর্ণকমল আবার বলল, “আহা সেই বসন্তবর্ণনাটি মনে পড়ছে : দুমাঃ সপুষ্পা সলিলং, সপদ্মং, স্ত্রিয়ং সাকামাঃ পবনঃ সুগন্ধ…”
শ্লোকটা শেষ করতে দিল না ফুলরেণু। প্রায় ধমকে উঠে বলল, “আমার সামনে সংস্কৃত বলবেন না।”
“কেন, কেন ?” স্বর্ণকমল যেন খুব অবাক।
“আমি পছন্দ করি না।”
“ও !…কিন্তু এটা কালিদাসের বসন্ত বর্ণনা…”
“কালিদাস…।” ফুলরেণু যেন আঁতকে উঠল। মুহূর্ত কয়েক আর কথা বলতে পারল না, তারপর বলল, “অত্যন্ত অসভ্য, ভালগার।”
স্বর্ণকমল দাঁড়িয়ে পড়ে আবার হাঁটতে লাগল। “আজ্ঞে এর মধ্যে কোনও ভালগারিটি নেই। শুনুন না—‘রম্য-প্রদোষ সময়ঃ স্ফুটচন্দ্রহাসঃ পুংস্কোকিলস্য বিকৃতঃ পবনঃ সুগন্ধি’,…মানে হল—রমণীয় সন্ধ্যাকাল, বিমল চন্দ্রকিরণ, পুংস্কোকিলের কুজন, সুগন্ধি বায়ু…”
“আপনি থামুন, মানে বলতে হবে না”, ফুলরেণু আদেশের মতন করে বলল।
স্বর্ণকমল থামল।
ফুলরেণু বলল, “কলেজে ছেলেমেয়েদের সংস্কৃত পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমি হলে করতাম। …যত সব কুশিক্ষা হচ্ছে।”
“আজ্ঞে—কুশিক্ষা !”
“আপনার কি ধারণা সুশিক্ষা হয় ?”
“না, মানে—, এটা তো রস অনুভবের ব্যাপার।”
“বেশি রসে স্বাদ তেতো হয়।” ফুলরেণু ঠোক্কর দিয়ে বলল। “এখানকার ছেলেমেয়েদের তো দেখছি—কী রকম সব তেতো হয়ে গেছে। যত অসভ্যপনা, বেয়াড়াপনা, বাঁদরামি শিখেছে।”
স্বর্ণকমল নিরীহ ভালমানুষ মতন মুখ করে বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন এদের চিত্ত-প্রকৃতি তরল ও চঞ্চল হয়ে উঠছে।”
“আপনার ওসব ছলছল ভাষা আমি বুঝি না। আমি বলছি এরা বাঁদর হয়ে উঠছে, অভব্য অশালীন হয়ে উঠছে।”
“সংস্কৃত পড়ে ?”
“আপনাদের কাছে ওইসব ছাইভস্ম পড়ে।”
“আপনি যে কোথায় ভস্ম পাচ্ছেন আমি বুঝছি না।…তবে হ্যাঁ, বলতে পারেন ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নি ! দু একটা যদি পড়ে দেখতেন ?”
“পড়েছি—পড়েছি।” ফুলরেণু অধৈর্য হয়ে বলল।
“পড়েছেন ! বাঃ !” স্বর্ণকমল পুলকিত বোধ করল। “আরও পড়ুন—খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন কুমারসম্ভবম্ রঘুবংশম্ অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ মেঘদূতম্…আহা এ-সবের কি তুলনা আছে। অতুলনীয়। যদি বলেন বাংলা মানে দেওয়া বই আমি দিতে পারি।”
“থাক আমার দরকার নেই।” গম্ভীর হয়ে ফুলরেণু বলল। “সে কষ্ট আপনাকে করতে হবে না।”
“কষ্টের কিছু না। এখানেই আছে। মমতার কাছে। আমি চেয়ে নিয়ে দেব। আপনিও চেয়ে নিতে পারেন।”
“আমার চেয়ে দরকার নেই।… আমি জানি কী আছে।” ফুলরেণু গলা চড়িয়ে চোখের দৃষ্টি আগুন করে বলল। “যত ট্রাশ অসভ্যতা ! আপনাদের মতন লোকের এই সবেই মজা।”
‘আজ্ঞে…’ স্বর্ণকমল করজোড়ে বলল, “অপরাধ নেবেন না, একটা কথা বলি : উদেতি পূর্বং কুসুমং ততঃ ফলং ঘনোদয়ঃ—আগে পুষ্পেদগম পরে ফল, আগে জলোদয় পরে বর্ষণ—এই তো নিয়ম। আপনি পড়ে যান পুষ্পেদগম হচ্ছে ধীরে ধীরে পরে ফল হবে ; মেঘের উদয় আমি দেখছি বর্ষণ পরে হবে…”
ফুলরেণুর আর সহ্য হল না। লোকটা তার সঙ্গে রসিকতা করছে ! তামাশা ! কী সাহস দেখেছ ? ফুলরেণু সোজা গেট দেখিয়ে দিল, “আগে আপনি যান পরে অন্য কথা।”
স্বর্ণকমল হেসে ফেলল। ফুলরেণুকে চোখ ভরে দেখতে দেখতে বলল, “যাচ্ছি। আজ দোল পূর্ণিমা, আপনাকে তো হাতে করে আবির-কুঙ্কুম দিতে পারলাম না, প্রশস্তি লেপন করে যাই। সত্যি আপনাকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।…কালিদাস যে এই বসন্ত ঋতুতে অনঙ্গদেবকে বহুরূপে রমণীদেহে অবস্থান করতে দেখেছেন, তা যথার্থ। আমিও, দেখছি—নেত্রেষু লোলো মদিরালসেষু গণ্ডেষু পাণ্ডুং কঠিনঃ স্তনেষু…আপনার মদিরালস চক্ষুতে চঞ্চলভাবে, গণ্ডদেশে পাণ্ডুরূপে সেই দেবতা বিরাজ করছেন…” বলতে বলতে স্বর্ণকমল গলার স্বর অতি নিচু করল, এবং শেষ শব্দের ব্যাখ্যাটা অশ্রুতভাবে নিজের কাছেই করল ! আর দাঁড়াল না, পালাল।
রাগে ফুলরেণুর সর্বাঙ্গ কাঁপার কথা, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠার কথা, কিন্তু বেচারি হঠাৎ কেমন লজ্জায় অস্বস্তিতে আরক্তিম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এবং তার বুক কি কারণে যেন কাঁপল।
পাঁচ
দেখতে দেখতে দেড় দু মাস কাটাল। গরমের ছুটিতে ফুলরেণু কাশীতে নিজের বাড়িতে এল। মা বললেন, “আমি কত ভাবনায় ভাবনায় মরতুম, কি জানি কেমন থাকিস। তা বলতে নেই রেণু, তোর শরীর বেশ সেরেছে। মুঙ্গেরের দিকে জলহাওয়া খুব ভাল, না রে ?…” ফুলরেণু শুধু হাসল, কিছু বলল না।
রাত্তিরে টোকন এসে হাতে একটা মস্ত খাম দিল। বলল, “নে ফুলদি, তোর ফাইল। পাঁচজন ক্যান্ডিডেট আছে। তাদের ফটো, নাম ধাম বয়েস প্রফেশন—সমস্ত পার্টিকুলার নোট করে দিয়েছি। এখন তুই বাবা তোর পছন্দমত বেছে নে। …ব্যাপারটা কিন্তু বর্ষায় সারতে হবে, আষাঢ় মাসে।’’
ফুলরেণু হাসল। “বড় ফাজিল হয়ে গিয়েছিস।”
“ফাজিলের কি, বিজনেস ইজ বিজনেস। তোর পর আমি লাগাব।…যাকগে, শোন—ওই পাঁচটা একেবারে পঞ্চপাণ্ডব—ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ল’ ইয়ার, ব্লাকমার্কেটিয়ার অ্যান্ড প্রফেসার।”
“প্রফেসার কী রকম প্রফেসার? শুধু প্রফেসার না ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার প্রফেসার?” ফুলরেণু হাসল।
“সব দেখতে পাবি। আমি চলি, একটা নেমন্তন্ন আছে।”
টোকন চলে গেলে ফুলরেণু বিছানায় শুয়ে খানিকটা সময় গড়াগড়ি দিল। বেশ লাগছে। তার হাসি পাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে এসে খাম খুলল। ডাক্তার পাত্র একেবারে গজকচ্ছপ টাইপের, বয়েস আটত্রিশ। বোগাস। এঞ্জিনিয়ার সাহেব একেবারে হাতুড়ি মার্কা, লিডসের ডিপ্লোমা পেয়েছে। রাবিশ। ল’ ইয়ারকে দেখেই নাক কুঁচকে নিল ফুলরেণু, ইয়ারমার্কা মুখ। যাচ্ছেতাই একেবারে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার—অর্থাৎ বিজনেসম্যান। ওরে বাবা, এ যে বাঘ-ছালের ওপর পা দিয়ে ফুলসাইজের ফটো তুলিয়েছে, চেহারাটা শিকারি ধরনের, গোঁফটা কী বাহারি! দূর দূর! শেষে প্রফেসার মশাইয়ের ছবি বেরুল। এ যে স্বর্ণকমল। ফুলরেণু ছবিটা হাতে নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর পাটিকুলার্স দেখল। কী রকম শয়তান, কোথাও দীপনারায়ণ কলেজের নাম দেয়নি, কলেজে পড়ায় এই পর্যন্ত উল্লেখ আছে। অবশ্য স্বর্ণকমলের কোনও দোষ নেই, ফুলরেণুই বলে দিয়েছিল: “আমি জানি না, তোমাদের বাড়ির তরফ থেকে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে চিঠি দিও ; তবে মা টোকন যদি জানতে পারে আমার কলেজে তুমি পড়াও তবে আমি সিলেকশান করব না, তা বলে দিচ্ছি কিন্তু।”
স্বর্ণকমলের ছবিটা নিয়ে ফুলরেণু বিছানার মধ্যে গড়াগড়ি খেল, অনেকক্ষণ হাসল, কত কথা ভাবল, শেষে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখ: হোস্টেলে তার ঘরে বসে স্বর্ণকমল তাকে মেঘদূত পড়াচ্ছে: চুড়াপাশে নবকুরবকং…কর্ণে শিরীষং…
দিন তিনেক পরে স্বর্ণকমলের চিঠি এল। মস্ত চিঠি।
মা বলল, “কার চিঠির?’’…ফুলরেণু অন্যদিকে মুখ করে যেতে যেতে বলল, “কলেজের উমাদিটুমাদির হবে।”
বিকেল এবং সন্ধেটা চিঠি পড়ে পড়েই কাটল। বার বার পড়ল ফুলরেণু। যত পড়ছিল ততই বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল, আবার আনন্দেও কেমন অবশ হয়ে পড়ছিল, থেকে থেকে নিশ্বাস ফেলছিল।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে দরজা বন্ধ করে ফুলরেণু চিঠির জবাব লিখতে বসল। লেখার প্যাডে কালির আঁচড় আর পড়ে না। যাও বা পড়ে মনে হয় এমন চিঠি সে মাকে লিখেছে, টোকনকে লিখেছে ; এ চিঠি স্বর্ণকমলের বেলায় অচল। পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে আবার ফাউন্টেন পেন দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে ফুলরেণু। এইভাবে অনেকটা রাত হল, অনেকগুলো প্যাডের ফিনফিনে পাতা নষ্ট হল অথচ চিঠি লেখা হল না। ফুলরেণুর কান্না পেতে লাগল। এতদিন সে কেমিস্ট্রির শ শ’ পাতা নোট লিখিয়েছে ; সে সোডিয়াম কার্বোনেটের বিবরণ লিখতে পারে, অক্লেশে নাইট্রোজেন প্রবলেম সম্পর্কে বারোটা পাতা ঝড়ের মতন লিখতে পারে, এখুনি ক্রিস্টাল, সিমেট্রি—তাও পারে কিন্তু হায় হায়—ভালবাসার একটা চিঠি লিখতে পারে না। এই সহজ কাজটা এত শক্ত কে জানত?
শেসে ফুলবেণু উঠল। ঘরের একপাশ থেকে তার সুটকেস টেনে নামিয়ে খুলল। তারপর শাড়ি জামা হাতড়ে সুটকেসের তলা থেকে মৃদুলার খাতার মধ্যে পাওয়া সেই চিঠিটা বের করে বিছানায় নিয়ে এল। বালিশে বুক রেখে ফুলরেণু এবার চিঠি লিখতে বসল। মৃদুলার সেই চিঠি একপাশে খোলা, ফুলরেণু ফাউন্টেনপেনের ঢাকনা খুলে মৃদুলার চিঠি দেখে দেখে—অবিকল সেইভাবে সেই একই ভাষায়—চিঠির নকল করতে লাগল।
পঁচিশ বছর বয়েসে ফুলরেণুর হৃদয় মৃদুলার চিঠির বয়ান অনুযায়ী ময়ূরের মতন নাচতে লাগল, বাতাসের ঝাপটা দিতে লাগল, চাঁদের আলোয় ভরে উঠল। “চোখের পাতা বুজলে তোমায় দেখছি, চোখ খুললেও তুমি। তুমি আমার কাছে সব-সময় আছ, আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার! তোমার মুখ তোমার হাসি আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না ‘ রাত্তিরে শুতে এসে ঘুম আসছে না, এপাশ ওপাশ করছি, বাইরে সব ঘুমিয়ে পড়েছে এ সময় তুমি কাছে থাকলে সব চাওয়া পূর্ণ হত। তুমি নেই তাই বালিশের কানে কানে তোমায় আমার কথা বলছি! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”…এই সমস্ত মৃদুলার চিঠিতে যা ছিল, যেমন ছিল লিখল ফুলরেণু। এবং চিঠির শেষে মৃদুলার চিঠির মতনই লিখল, “তুমি আমার আদর নিও।” মৃদুলার চিঠিতে তলায় নাম ছিল না। ফুলরেণু নিজের নাম দিল। দিয়ে চিঠিটা আড়াগোড়া পড়ে আনন্দের আবেশে ঘুমিয়ে পড়ল।
ছয়
বিয়ের পর ফুলশয্যার দিন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে স্বর্ণকমল বলল, “ফুল, কাশী থেকে তুমি আমায় প্রথম যে চিঠিটা লিখেছিলে সেটা স্রেফ ‘টুকলি’।”
“টুকলি?” ফুলরেণু চমকে উঠে বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে উঠে পড়ে আর কি।
“তুমি নিজে লেখোনি।”
“মানে!…”
“ওটা—মানে ওই চিঠিটা একটা বইয়ে আছে।”
“বই!” ফুলরেণু অপ্রস্তুতের একশেষ। কিন্তু মৃদুলার খাতার মধ্যে যে ছিল চিঠিটা। কেমন সন্দেহ হল ফুলরেণুর। বলল, “তুমি জানলে কী করে!”
“জানলাম।”
“এমনি এমনি জেনে গেলে!”
“না না, এমনি কেন! বইটা আমার কাছে ছিল।” স্বর্ণকমল হাসছিল। “খুব পপুলার বই। প্রেমপত্র সংকলন।”
“ইয়ার্কি! তোমার মতন অসভ্য নাকি সবাই, যে নিজেদের কীর্তি ছাপাবে।!”
“আরে না, কীর্তি ছাপাবে কেন। বাংলা গল্প উপন্যাস থেকে বাছাই করে নেওয়া চিঠি। প্রেমপত্র।”
“বইটা আছে তোমার?”
“এখন আর পাচ্ছি না। কে যে পড়তে নিয়ে চুরি করে নিল! সকলেরই দরকার পড়ে তো!” বলে হেসে ফুলরেণুর হাত ধরে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলল, “তুমিই চুরি করেছিলে নাকি? তুমি যা চোর। ইউ আর এ টুকলি।”
স্বর্ণকমলের বুকে লজ্জায় মুখ রেখে কিছুক্ষণ পড়ে থাকল ফুলরেণু। তারপর মুখ ঘুরিয়ে স্বর্ণকমলের কানের দিকে ঠোঁট নিয়ে বলল, “আর তুমি যে আমার প্রশস্তি গাইতে, মন ভোলাতে সেও তো তোমার কালিদাসের টুকলি। তুমি চোরের বেশি বাটপাড়।”
স্বর্ণকমল হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “এ সব চুরিতে দোষ নেই।…কি বল।”
ফুলরেণু পিঁপড়ের মতন নিশব্দে স্বর্ণকমলের কানের লতি কামড়ে দিল।