ফণীমনসা

ফণীমনসা

মনোবীণা গিয়েছিলেন তীর্থ করতে। তীর্থ মানে হরিদ্বার হৃষীকেশ ঘুরে আসতে। গিয়েছিলেন বন্ধু হালদারের দলের সঙ্গে। বাড়ি ফিরে যা দেখলেন তাতে ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠার অবস্থা।

মনোবীণার কর্তা ফণীশ্বর শোবার ঘরে দড়ির জালের দোলনা—যাকে কিনা হ্যামক বলে—সেইরকম এক দড়ি-দোলনা ঝুলিয়ে তার মধ্যে শুয়ে আছেন। তিন চারটে গোল লম্বা বালিশ বা কুশন তাঁর দেহের এ-পাশে ও-পাশে, মাথায়। বাঁ হাতে প্লাস্টার, ডান পায়ে প্লাস্টার। পরনে লুঙ্গি, গায়ে বেঢপ ফতুয়া। ফণীশ্বরের ডান হাতের কাছে এক ফিডিং বটল, আজকাল যেমনটি দেখা যায়—সেই ছাঁদের।

মনোবীণা তীর্থ সেরে এসেছেন। তীর্থ সেরে এসে তাঁর ডাকসাইটে শাশুড়ি সদরে দাঁড়িয়ে তিন ঘটি জল পায়ে ঢেলে তবে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেন। মনোবীণা দেখেছেন।

গাড়ি থেকে নামতেই পারুল আর খেঁদা ছুটে এসে যে-খবর শোনাল—তাতে আর মনোবীণার পায়ে জল ঢালার সময় হল না। ক’দিনের ঘোরাঘুরি হাঁটাহাঁটিতে এমনিতেই তাঁর পা ফুলেছে, ব্যথা ; তবু সেই ফোলা পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সোজা দোতলায়। শোবার ঘরে।

ঘরে ঢুকে দেখেন স্বামী দোলনায় শুয়ে, ডান হাতে দুধ-বোতল। কর্তা ছাদের দিকে চোখ তুলে শুয়ে গান গাইছেন, ব্রহ্মসঙ্গীত।

“ওমা! কী হয়েছে? এ কী দশা তোমার?” বলতে বলতে মনোবীণা স্বামীর দোলনার পাশে এসে ঝুঁকে পড়লেন। এমন করে ঝুঁকলেন যেন কর্তার বুকের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

ফণীশ্বর যেহেতু ব্ৰহ্মসঙ্গীত গাইছিলেন, ‘হৃদয় আরাম তুমি হৃদয়নাথ’ সেহেতু আধবোজা চোখে, আধ্যাত্মিক আবেশের গলায় বললেন, “পতিত হয়েছি।”

মনোবীণা একে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তার ওপর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই স্বামী-দুঃসংবাদে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় দিশেহারা, কাজেই স্বামীর ওই মিনমিনে আধ্যাত্মিক গলা ভাল লাগল না ।বললেন, “আদিখ্যেতা রাখো। কী হয়েছিল? কেমন করে পড়ে গেলে?”

ফণীশ্বর বললেন, “তোমার তেলের শিশিতে।…তেলের শিশি ভাঙল বলে—।”

মনোবীণা অবাক। আজ পনেরো দিনের বেশি তিনি বাড়ি-ছাড়া, তাঁর তেলের শিশিতে কর্তার আছাড় খাবার কী হল?

গায়ের পাতলা চাদরটা খুলে একপাশে ছুড়ে দিতে দিতে মনোবীণা বললেন, “আমি রইলুম হাজার মাইল দূরে, আমার তেলের শিশিতে তুমি আছাড় খেলে? তামাশা।”

“তামাশা কেন হবে! যা হয়েছে তাই বললাম। ”

“কখনওই নয়। আমি বিশ্বাস করি না। কত খেয়েছিলে তখন—পেট পর্যন্ত, না, গলা পর্যন্ত?”

ফণীশ্বর তখনও শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “সেদিন পূর্ণযোগ ছিল না, ফকির চেটো—মানে চাটুজ্যের মা উননব্বইতে স্বর্গ গেলেন ; আমরা বন্ধুর মাতৃশোক জানাতে অর্ধযোগ সেরেই ফিরে এসেছিলাম। বীণা, স্বামীকে বিশ্বাস করা তোমার পবিত্র কর্ম।”

মনোবীণার মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। এই ন্যাকামি আর সহ্য হচ্ছিল না। রাগের মাথায় দোলনাটা ঠেলে দিলেন। দোলনা সামান্য দুলতে লাগল। বললেন, “নিকুচি করেছে তোমার পবিত্তর কম্মে। ঠিক ঠিক বলল কী হয়েছিল। আমার তেলের শিশি থাকে কলঘরে। সেই শিশি উড়ে এসে তোমার পায়ে পড়ল! তার পাখা গজিয়েছিল নাকি?”

ফণীশ্বর কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বীণা ধমকে উঠে বললেন, “ঢং করে কথা বলবে না। সাফ সাফ বলো। সাদা কথায় বলো।”

“ভেতো বাংলায়?”

“হ্যাঁ।”

ফণীশ্বর বললেন, “তা হলে যা যা ঘটেছিল বলি। একটিও মিথ্যে কথা বলছি না, ধর্ম সাক্ষী। …সেদিন বিকেলে চাটুজ্যের মায়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটল! আমরা চেটোকে বললাম, তুমি শ্মশানে যাবে—লোকজন তোমার অঢেল, রাবণের ফ্যামিলি, আমরা আর বোঝার আঁটি হয়ে কী করব! তার চেয়ে বরং একটু শোক পান করে বাড়ি ফিরে যাই। চেটো এক পাত্তর টেনে চলে গেল। বড় দুঃখ তার। মা বলে কথা। হোক না নব্বইয়ের গোড়ায়। আমি, দ্বিজু, গণেশ খেলাম খানিকটা, পুরো খাইনি। অর্ধযোগ। তারপর যে যার বাড়ি।… বাড়ি ফিরে এসে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তুমি নেই। তুমি না থাকলে আমি একেবারে অনাথ শিশু। অরফ্যান—”, বলতে বলতে ফণীশ্বর একটু থামলেন। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার বললেন, “ভাবলাম, একটু শুদ্ধ হয়ে নিই চান করে। হাজার হোক চেটোর বাড়ি থেকে ফিরছি। সংস্কার বলে একটা কথা আছে তো!… তা ইয়ে, মানে তোমার অভাবে তোমারই মাথার তেল—জবাকুসুম মাথায় ঘষতে ঘষতে পায়চারি করছিলাম এখানেই। সাম হাউ, হাত ফসকে শিশিটা পড়ে গেল। অ্যান্ড ব্রোকেন…। আমিও তেলের মেঝেতে পা হড়কে পড়লাম। জবর পড়লাম গো! অ্যান্ড ব্রোকেন..!”।

“বেশ হয়েছে।”

“বেশ হয়েছে। আমার হাত ভাঙল, পা ভাঙল—আর তুমি বলছ বেশ হয়েছে। তোমার বাক্য শুনে…।”

“তোমার মাথাটা ভাঙল না কেন!” বলে মনোবীণা স্বামীর হাতটা দেখতে লাগলেন, “গোটা হাতটাই ভেঙেছে?”

“কবজির ওপরটা দুটুকরো…”

“চমৎকার। চার হল না কেন? …আর পা? দেখি পা দেখি।”

ফণীশ্বরের কপাল ভাল গোড়ালির তলার দিকে হাড় পুরোপুরি না ভাঙলেও চিড় ধরেছে। প্লাস্টার করা আছে পা, প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত।

পা দেখতে দেখতে মনোবীণা বললেন, “ছেলেকে খবর দিয়েছিলে?”

“দিয়েছিলাম। খোকা বউ নিয়ে ছুটতে ছুটতে এল মোটর বাইক হাঁকিয়ে। ওদের কারখানায় হুজ্জোতি চলছে। প্লাস্টার হয়ে যাবার পর আমিই ওদের বললাম, তোরা যা, এসময় কারখানা ছেড়ে থাকিস না।”

“ওরাও চলে গেল? মানুষ, না জন্তু?”

‘আহা, গালাগাল দিচ্ছ কেন! ছেলে আর বউমার দোষ কোথায়? আমি বললাম বলেই ওরা চলে গেল। খোকার কারখানায় ভীষণ ঝামেলা চলছে না! গো স্লো, মিটিং, লাঠালাঠি, পুলিশ—যা হয় আজকাল। খোকার কোয়ার্টারটাও বেমক্কা জায়গায়। এ সময় নিজের কোয়ার্টার আর কারখানা ছেড়ে আসতে নেই।”

মনোবীণ খুশি হলেন না। গরমকালের বাঁধাকপির মতন বিদিকিচ্ছিরি মুখ করে বললেন, “খোকার বউ কী করছিল? সে কোন আক্কেলে বুড়ো হাত-পা ভাঙা শ্বশুরকে ফেলে রেখে চলে গেল?”

ফণীশ্বর বললেন, “দুঃসময়ে স্ত্রীকে পাশে থাকতে হয়। সীতা রামকে ফলো করেছিল কেন?”

“চুলোয় যাক তোমার সীতা!… খোকাকেও বলিহারি। তোর বুড়ো বাপ থাকল পা-ভেঙে পড়ে, তুই বেহায়ার মতন বউ ট্যাঁকে করে পালালি! ছি ছি, আজকালকার ছেলেমেয়েদের লজ্জা শরম, কর্তব্য জ্ঞান বলে কিছু নেই!”

ফণীশ্বর গম্ভীর হয়ে বললেন, “আগেও ছিল না!”

“ছিল না? আমরা হলে এ কাজ করতে পারতাম?”

“চমৎকার পারতাম। এই ধরো, তোমার-আমার কথা। তখন আমাদের মাত্তর পাঁচ মাস বিয়ে হয়েছে। বাবার টাইফয়েড হল। পানাগড়ে। খবর পেয়ে আমরা ছুটে গেলাম। দিন আষ্টেকের মাথায় বাবা যখন টাল সামলেছে—আমি চলে আসতে চাইলাম। তুমি তখন কী করলে? আমার লেংটি ধরলে। কিছুতেই বাবা-মায়ের কাছে থাকবে না, বললে—আমায় নিয়ে চলল, আমি একলা থাকতে পারব না। সে কী মুখ তোমার? কী কান্না!..কই, তখন তোমার লজ্জা-শরম কোথায় ছিল?”

মনোবীণা ধরাপড়া চোরের মতন মিইয়ে গিয়ে বললেন, “অমন জলজ্যান্ত মিথ্যে কথাটি বোলো না। বাবার মোটেই টাইফয়েড হয়নি। জঙ্গল ম্যালেরিয়া হয়েছিল। বাবা তখন সেরে উঠেছেন। মা বললেন বউমা—তুমি যাও, ছেলে একা থাকে—রাত-বিরেতে চাকরি। তুমি না থাকলে ওর অসুবিধে হবে।”

“মা বললেন—”আর তুমি আমার কাছাটি ধরে সুড়সুড় করে চলে এলে! কী আমার শাশুড়ি-ভক্তি।”

‘কাঁচা তোমার ছিল যে ধরব! করতে তো এ টি এস-এর কাজ, পরতে খাকি হাফ প্যান্ট…, ধরতে হলে ওই পেন্টুল ধরে টানতে হত।” বলতে বলতে বীণা দেওয়ালের পুবদিকে তাকালেন। শাশুড়ির বড় ফটো। জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। হাত জোড় করে বার কয়েক প্রণাম সেরে ফেললেন স্বর্গ শাশুড়ির উদ্দেশে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে পশ্চিমের দেওয়ালে শ্বশুরমশাইয়ের ফটোকেও প্রণাম জানালেন। তীর্থ সেরে ফিরে এসেছেন সবে, গুরুজনরা সশরীরে বর্তমান থাকলে ঘটির জলে পা ধুইয়ে দিয়ে প্রণাম করতেন। তা যখন নেই, তখন তো নমো নমো করতেই হয়।

ফণীশ্বর এবার দুধ-বোতল মুখে তুললেন।

মনোবীণা বললেন, “ওটা কী? খোকা হয়েছ?”

ফণীশ্বর বললেন, “টু ইজটু থ্রি প্রপোরশানে মেশানো আছে। দুই তিন ভাগাভাগি।”

“গন্ধতেই বুঝতে পারছি কী মেশানো আছে।”

ডাবের জল আর ইয়ে—মানে এক নম্বর দিশি।”

“দিশি! দিশি…।”

“ডাক্তার বলল আমি কী করব! বলল, বিলিতি রাত্তিরে খেয়ো, সারাদিন খেলে সইবে না। তার চেয়ে ডাবের জলের সঙ্গে লোকাল মিশিয়ে খেলে গরমে তেষ্টা মিটবে, গায়ে-হাতের ব্যথা মরবে। ফুরফুরে হয়ে থাকতে পারব—তাই!”

“তাই! তাই খোকাপনা ধরেছ!”

‘না, না, তার জন্যে কেন হবে! দোলনায় দুলে দুলে খাই তো, হাত ভাঙা মানুষ, ধরতে সুবিধে। আমি তো আর বোঁটা চুষি না! ওটা খুলে রেখেছি।”

মনোবীণা স্বামীকে বিলক্ষণ চেনেন। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সমানে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল মানুষটা। বললেন, “এটাও কি ডাক্তারে বলেছে?”

“মাপ! মাপ পাব কোথায়! এখানে শিশির গায়ে মাপের দাগ আছে, ওয়ান আউন্স টু আউন্স—! কত সুবিধে!”

“কে দেখেছে তোমাকে কোন ডাক্তার?”

“সরোজ।”

“সরোজিনী! সরোজিনী তোমাকে দেখেছে! ও তো মেয়ে ডাক্তার!” বীণার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলেন।

ফণীশ্বর বেশ গম্ভীর এবং আবেগের গলাতেই বললেন, “সরোজ না থাকলে সেদিন হাড়ভাঙা দ হয়ে পড়ে থাকর্তাম। খবর পেয়েই ছুটতে ছুটতে এল। তারপর যা করার সেই করছে। শুধু প্লাস্টারটা করে দিয়েছে মানিক মুখুজ্যে।”

সরোজিনী থাকেন কাছেই। দু’চার বাড়ির পরই। একটু কোনাচে জায়গায় বাড়িটা। পেশায় ডাক্তার। রেল হাসপাতালের। মহিলার চেহারা দেখলে পুরুষ বলে ভুল হতে পারে। মাথায় বেঁটে, রং কালো, বহর বিশাল, সামান্য গোঁফ আছে নাকের তলায়, সপ্তাহে বার দুই মিহি করে গোঁফ পরিষ্কার করে নেন ইলেকট্রিক রেজারে। মেজাজ অতি উগ্র। চোখে বড় বড় কাচের চশমা, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, ঘাড় পর্যন্ত চুল। সরোজিনী হলেন মিস, মানে বাহান্ন-তিপান্ন বছর বয়েসেও কুমারী।।

মনোবীণার ইচ্ছে হল, শুয়ে পড়ে মেঝেতে মাথা ঠোকেন কিছুক্ষণ! শহরে এত ডাক্তার বদ্যি থাকতে শেষে নাকি ওই ‘মা মনসা’!মনোবীণা আড়ালে সরোজিনীকে মা মনসা বলেন। পাশাপাশি বাড়ি, (যদিও মা মনসার হল ভাড়া বাড়ি) আলাপ পরিচয় আছে বইকি! কিন্তু মেলামেশা তেমন নেই। মনসা মদ্দ নয়, মাগি ; ও সিগারেট খায় বলে শুনেছেন মনোবীণা, এমন কি বাড়ির মধ্যে রাত্রে ঢুকুঢুকুও চলে!

“তুমি শেষ পর্যন্ত মনসার খবরদারিতে আছ, ছিছি!”

“সরোজ ভাল ডাক্তার। গোল্ড মেডেল পেয়েছিল।”

“ও তো মেয়েদের ডাক্তার!”

“তা বলে গাইনি নয়। জেনারেল ফিজিশিয়ান, প্লাস কার্ডিওলজিস্ট!”

“নিকুচি করেছে অমন ডাক্তারে। আসলে তোমার ধাতটি ও বোঝে তো! রতনে রতন চেনে। তাই ফিডিং বোতলে মদ ঢেলে খেতে বলে গেছে! ঘেন্নায় মরি।”

ফণীশ্বর যেন কত কৃতজ্ঞ সরোজিনীর কাছে, মুক্তকণ্ঠে বললেন, “এই দোলনাটিও ও নিজের বাড়ি থেকে এনে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে, জানলার কাছে নিচু করে টাঙিয়ে দিয়ে গেলাম। শুয়ে শুয়ে সব দেখবেন শুনবেন, ভাল লাগবে। দিন কেটে যাবে।”

মনোবীণা বললেন, “তা হলে আর কী! ওই দোলনায় শুয়ে শুয়ে দোলো! ঢং যত্ত।”

দুই

আর খানিকটা বেলায় স্বামীকে এমন করে স্নান করিয়ে দিলেন মনোবীণা যেন পনেরো দিনের ময়লা কলঘর সাফ করছেন। অবশ্য প্লাস্টার সামলে, যেন না জলে ভিজে যায়!

স্নানের পর স্বামীকে পোশাক পরিয়ে দিলেন। লুঙ্গি আর ঢোললা ফতুয়া। দিয়ে বললেন, “একটু বসো, আমি চান সেরে নিই!”

স্নান শেষে মনোবীণা পুজোর শাড়ি পরে খালি গায়ে স্বামীর কাছে এসে তীর্থ থেকে আনা প্রসাদী ফুল পাতা ছোঁয়ালেন তাঁর মাথায় বুকে। তারপর আঁচলের গিট খুলে কাগজে মোড়া একটা মাদুলি বার করলেন। বললেন, “পুজো দেওয়া শুদ্ধ করা মাদুলি। এটা পরো।”

“কেন?”

“আমি কোন মুলুক থেকে এনেছি ; ভৈরবচণ্ডীর মন্দিরে পুজো দিয়ে…”

“কী হবে পরে? পুজোই বা দিতে গেলে কেন?”

“এ খুব জাগ্রত। এতে কত কী হয়!”

“আমার আবার কী হবে! হবার দিন তো শেষ।”

“তোমার ওই নেশাটি আমি ছাড়াব! বয়েস এখন কত হল? পঁয়ষট্টি। সেই কোন বয়েস থেকে গেলাস ধরেছ! তবু যৌবনকালে সব সয়। এখন কি ওই সব সইয়ে নেওয়ার বয়েস আছে! বরং দিন দিন তুমি ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে বসে গেলাস গিলছ গাদা গাদা। শরীর তো যেতে বসেছে। লিভার পচে গেল।”

ফণীশ্বর স্ত্রীকে দেখতে দেখতে বললেন, “লিভার পচবে কেমন করে! সব সময় অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখছি। তুমি জান, অ্যালকোহল হল বেস্ট জার্মিসাইডাল। বীজাণু নিরোধক : অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়া প্রপার্টি রয়েছে ওতে। আমার লিভার…”

স্বামীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বীণা কর্তার পিঠে এক ধমক-মারা কিল বসিয়ে দিলেন। রুক্ষ গলায় বললেন, “আমি পরতে বলছি, পরতে হবে। এর বেশি কথা নেই। আমি তোমার বউ, আমার কথাই শেষ কথা।”

কী ভেবে ফণীশ্বর একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “বেশ। তোমার কথাই থাক। যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।”

মনোবীণা স্বামীর হাতে মাদুলি বেঁধে দিলেন।

তিন

ফণীশ্বর যাকে ‘পতিত হওয়া’ বলেছিলেন সেই ঘটনাটি ঘটেছিল—গরমের মুখে, ফাল্গুন মাস নাগাদ। তারপর তিনটি মাস কেটে গেল। তিন মাসে হাত-পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়ে গিয়েছে। পায়ের চোট এখনও সামান্য ভোগাচ্ছিল, যেমন ব্যথা, মাঝে মাঝে গাঁট ফোলা। হাত মোটামুটি কর্মক্ষম। বয়সের হাড়-ভাঙা, সহজে কি সারবে! বাত-টাত ধরবে বইকি।

এই তিন মাসে ফণীশ্বরের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বন্ধুদের আসরে যাওয়া কমেছে খানিকটা। আরও কমে আসছে ক্রমশ। সাইকেল রিকশা করে চেটোদের আড্ডাখানায় আসা যাওয়ায় বোধহয় অসুবিধে হয়। পায়ের জন্যেই হবে হয়তো। ফলে পানাদি অভ্যাস কমে আসছে। বাড়িতে তো মনোবীণা মেয়ে দারোগা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সর্বক্ষণ, কাজেই সুবিধে হয় না তেমন। তবে মনোবীণা তো অতিরকম নিষ্ঠুর নন, স্বামীর ধাত বোঝেন। মানুষটাকে তিনি ধীরে সুস্থে সামলাতে চান, সৎ পথে আনতে চান। এতকালের অভ্যেস দুম করে একদিনে ছাড়িয়ে দিতে তিনি চান না, তাতে ভীষণ ক্ষতি হবে। রয়ে সয়ে যা করার তেমন করাই ভাল। মানুষটার শরীর মনও তো দেখতে হবে।

ফণীশ্বর মদ্যমাত্রা বেশ কমিয়ে ফেলেছেন।

মনোবীণাও কত স্বস্তি পাচ্ছেন মনে মনে। আর দু’চার মাস পরে স্বামী একেবারে সাধু সন্ত হয়ে যাবেন।

বীণা যখনই সময় পান ফণীশ্বরের হাতে বাঁধা মাদুলিটি দেখেন প্রাণভরে, মনে মনে ভৈরবচণ্ডীকে প্রণাম জানান। ঠাকুর তুমি আমায় বাঁচালে। তোমার মতন জাগ্রত দেবী আর কে আছে। তা সেদিন সন্ধের মুখে মুখে ফণীশ্বর পাজামা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নীচে নামতে যাচ্ছেন-—মনোবীণা বললেন “যাচ্ছ কোথায়?”

ফণীশ্বর বললেন, “এই কাছেই।”

“কোথায়?”

“এই তো— আশেপাশে। খেতে যাচ্ছি না আজ। শরীরটা বড় অলস হয়ে যাচ্ছে। একটু ঘোরা-ফেরা না করলে কী চলে!”

মনোবীণারও মনে হল, কর্তার আগে যেমন হাঁক ডাক ছিল—এখন তার অর্ধেক কমে গিয়েছে। গলার জোর কমতির দিকে। আগে সকালে বাজার যাবার সময় খেঁদাকে গোটা চারেক থলি নিতে বলতেন, এখন দুটোতেই চলে। বয়েস হলেও খাওয়া-দাওয়ায় রুচি ছিল খানিকটা ভোজনপটু ছিলেন ; অকারণ সাত রকম বাজার সেরে ফিরতেন। মিষ্টিমাস্টা তো বাঁধা ছিল। দু’দুটো করে রসগোল্লা একসঙ্গে মুখে ফেলতেন। মাছ মাংসও চলত সমানে। বীণা শত বলেও খাওয়া-দাওয়ায় সামলাতে পারতেন না তাকে। এখন সেই মানুষেরই বাজার কমেছে, খাওয়া কমেছে। দিন রাত বড় বেশি হাই তুলছেন। হালে কোথথেকে ঘেঁটেঘুটে একটা গীতা বার করেছেন। পাতা ওলটান রোজ।

ছেলে ছেলের বউ হপ্তায় একদিন করে আসে। শনিবার। রবিবার সন্ধেবেলায় আবার মোটর বাইক হাঁকিয়ে নিজের জায়গায় চলে যায়। খোকাও বলছিল, “মা, বাবাকে কেমন উইক উইক দেখাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তুমি কিছু বলছ না?”…ছেলের বউয়েরও একই কথা, “মা, বাবার শরীরটা কেমন ভেঙে আসছে।”

মনোবীণা ছেলে বা ছেলের বউকে কিছু বলেননি। ওকথা কি বলা যায়, আমি তোদের বাপকে নেশা ছাড়াবার জন্যে মাদুলি পরিয়েছি মানত করে। নেশাখোর মানুষ তো, নেশা ছাড়তে গিয়ে একটু-আধটু ন্যাতানো লাগতেই পারে। ও ঠিক হয়ে যাবে।

ফণীশ্বর পা বাড়াতে যাচ্ছেন, মনোবীণা বললেন, “বেরোেচ্ছই যখন—আরও খানিকটা আগে আগে বেরুলে পার। বিকেল বিকেল। সকালেও তো খানিকটা হেঁটে চলে আসতে পার!”

ফণীশ্বর বললেন, “সকালে উঠতে ইচ্ছে করে না। আমি তো হাঁস-মুরগি নই যে ভোর হল কি বেরিয়ে পড়ব!… আর বিকেল-বিকেল বেরুব কোথায়! যা ভ্যাপসা গরম!”

মনোবীণা আর কিছু বললেন না।

ফণীশ্বর বেরিয়ে গেলেন।

সন্ধের গোড়ায় গা ধুয়ে, এক কৌটো পাউডার গায়ে ছড়িয়ে, চুলের একটা আলগা ঝুটি বেঁধে মনোবীণা গেলেন ঠাকুরঘরে। ঠাকুরঘরে তিনি রোজই প্রদীপ জ্বালান। শাশুড়ির সেই প্রদীপটি এখনও তিনি মেজে ঘষে পরিষ্কার করেন নিজের হাতে। প্রদীপ জ্বালান। ঠাকুর নমস্কার করেন।

ঠাকুরঘর থেকে ফিরে নিজের ঘরে এসে জল পান খাচ্ছেন, এমন সময় বৃষ্টি এল।

‘ওরে খেঁদা, ওরে খেঁদা—বৃষ্টি এল দেখ দেখ— বলতে বলতে তিনি শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় আসতেই আচমকা চোখে পড়ল—একেবারে কোণাকুণি বাড়ির দোতলায় একটা ঘরের পরদা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, আর পরদার ফাঁক দিয়ে কাকে যেন দেখা গেল না? কর্তা! কর্তা—এই বাড়িতে না?

বৃষ্টির ছাঁট বাঁচাতে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গেল বাড়িটার। আর কিছু দেখা গেল না।

মনোবীণা নিজের চোখকে বিশ্বাস করবেন? নাকি মাথাটাই গোলমাল হয়ে গেল? ওই বাড়িটা তো মা মনসার—মানে সরোজিনীর। কর্তা ওই বাড়িতে গিয়েছেন কেন? ওখানে কী দরকার তাঁর? আশ্চর্য তো!

চোখের ভুলও হতে পারে।

তা চোখের ভুল হোক না-হোক, ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ হল না। ভাল লাগল না মোটেই। মন কেমন খুঁত খুঁত করতে লাগল।

আসুন কত বাড়ি ফিরে, তারপর দেখা যাবে!

ফণীশ্বর বাড়ি ফিরলেন আটটা নাগাদ।

মনোবীণা দেখলেন কর্তাকে। “কোথায় গিয়েছিলে?”

“এই তো! বৃষ্টি চলে এল।”

“সে সবাই জানে। তুমি কোথায় গিয়েছিলে!”

“এই তো—এদিকেই। কাছেই ছিলাম।”

“এই তো সেই তো রাখো! কোথায় গিয়েছিলে বলো?”

ফণীশ্বর গিন্নিকে দেখতে দেখতে বললেন, “হল কী তোমার?”

“তুমি ওই মা মনসার বাড়ি গিয়েছিলে?”

ফণীশ্বর একটু যেন থতমত খেলেন। “হ্যাঁ, একবার যেতে হল!”

“যেতে হল? কেন?”

“তেমন কিছু নয়।”

“তেমন-টেমন থাক। কেন গিয়েছিলে?”

ফণীশ্বর নিজের বুকটা দেখালেন। বললেন, “একটু ব্যথা-ব্যথা করে উঠল।”

“কী! মনসার জন্যে ব্যথা?”

“আরে না! কী যে বলো! হার্ট।… হার্টের এই পজিসনে— বাঁ দিকে ব্যথা-ব্যথা। বাঁ-হাতটাও ঝিনঝিন করে উঠল। তা ভাবলাম, যাই একবার সরোজকে দেখিয়ে নিই।”

“মনসাকে তোমার বুকের ব্যথা দেখাতে গেলে?”

“বাঃ! সরোজ ভাল কার্ডিওলজিস্ট। সে আমাকে গত তিন চার মাস ধরে দেখছে। ওর কাছে, মানে বাড়িতেই যত্তর আছে। পটাপট ইসিজি করে ফেলে।”

মনোবীণার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল, “ও, তুমি বুড়ো—ওই মনসার বাড়িতে গিয়ে জামা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লে!”

“বিছানা! হায় প্রভু! বিছানা! চওড়া সোফা—সোফা, লম্বা সোফা। টেবিল তো একতলায়। সেখানে গিয়ে শুতে হলে…”

মনোবীণার আর সহ্য হল না, খপ করে স্বামীর হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায়। “কী হয়েছে তোমার বুকে?”

“ব্যথা?”

“কই আগে তো বলোনি?”

“বলে তোমাকে—মানে তোমাদের অনর্থক উ-উদ্বেগ— উদ্বিগ্ন করব—তাই বলিনি।”

“উদ্বিগ্ন! ন্যাকামি! কবে থেকে হচ্ছে ব্যথা?”

“তা হচ্ছে—” ফণীশ্বর মাথা হেলালেন সামান্য, “হচ্ছে আজকাল। মাঝে মাঝে। সরোজ সেই পা-ভাঙার সময় থেকেই দেখছে। ভয়ের কিছু নেই! এই বয়েসে হয় একটু। কলকবজার ব্যাপার তো! পুরনো হয়ে গেলে আলগা হয়ে পড়ে।”

“আচ্ছা!… তা মনসা তোমায় দেখল!”

“সঙ্গে সঙ্গে।”

“এত খাতির!”

“বলো কী! গায়ে-গায়ে থাকি। পা-ভাঙার সময় থেকেই তো দেখছে আমাকে। …তা তুমি কিন্তু ওই যে মা মনসা মা মনসা করো—ওটা কিন্তু ঠিক নয়। সরোজ ভাল ডাক্তার। হরেনবাবুর মাকে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনল, দত্তর তো…”

মনোবীণা ধমক মেরে কথা থামিয়ে দিলেন স্বামীর। “যাও যাও ডাক্তার দেখিয়ো না। অমন ডাক্তারকে আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। …তা ছাড়া মনসাকে মনসা বলব—তাতে তোমার অত গায়ে লাগার কী আছে! আমি বলব, একশো বার বলব আমার খুশি!

“বললে তো কারুর মুখে হাত চাপা দেওয়া যাবে না।”

“দেবার চেষ্টা করে দেখো, হাত মুচড়ে দেব!”

“ভাঙা হাত, না, আস্ত হাত।”

“আস্ত হাত।”

“সর্বনাশ! তা তুমি এত খেপে গেল কেন?”

“তুমি খেপাবে, আমি খেপব না। ..কী বলল মনসা তোমার বুক দেখে?”

“বলল, মাঝে মাঝেই দেখিয়ে নিতে।”

“মাঝে মাঝে দেখাতে বলল, রোজ নয়?”

“কই তেমন কিছু তো বলেনি।”

“পান খেয়েছ কোথায়?”

“পান! দোকানে! কেন?”

“মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মনসা তোমায় চা পান খাইয়ে আতিথ্য করেছে!”

“পা-ন! না, পা-ন তেমন কই?”

“কাল থেকে বাড়ির বাইরে যখন যাবে—খেঁদা তোমার সঙ্গে থাকবে। আমার হুকুম

চার

বর্ষা ঘোরতর হয়ে উঠল। ভাদ্র মাস। ফণীশ্বর একটু বেশি রকম মনমরা। বৃষ্টিবাদলা হলেই সকাল থেকে নেতিয়ে থাকতেন, দুপুরে বড় বড় শ্বাস ফেলতেন ; আর বিকেল হলেই খেঁদাকে ডাকতেন। ‘ওরে খেঁদু, নে। একবার চেটোর বাড়ি যাব।”

খেঁদার বাবা ছিল ফণীশ্বরের অফিসের খাস পিয়ন। চাকরি থেকে যখন ছুটি পেলেন ফণীশ্বর, খেঁদার বাবা তার ছেলেটিকে সাহেবের হাতে গুঁজে দিল। পাঁচ পাঁচটা ছেলে খেঁদার বাবার, খেঁদা ছোট। ধরে করেও তো পাঁচ ছেলের কাজ জোটানো সম্ভব নয়। কাজেই খেঁদা হল ফণীশ্বরের ফাউ। তা ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে রেখে মানুষ করেছেন ফণীশ্বর। সামান্য লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বয়েসটা বেটার যোলোও হয়নি তায় রোগা-পাতলা, বেশ ট্যারা। ফণীশ্বরের ইচ্ছে—এবার ধরে-করে কোথাও ঢুকিয়ে দেবেন কাজে। থাকবে এখানেই। খোকার কারখানায় ঢোকাতে পারলে অবশ্য এখানে থাকা হবে না।

খেঁদা তার প্রতিপালকের পরম ভক্ত। প্রতিপালিকারও। আবার প্রতিপালিকাকে ভয়ও পায় ভীষণ। মনোবীণা তাকে এ-বেলায় যদি মাথায় তোলেন, ও-বেলায় গালমন্দ করে ভূত ভাগিয়ে দেন।

খেঁদার সবই ভাল। দোষের মধ্যে সে হিন্দি সিনেমার নামে পাগল, আর বিড়ি টানে লুকিয়ে লুকিয়ে।

মনোবীণার হুকুম, খেঁদা ছাড়া কর্তার বিকেলে বেরুনো চলবে না। তা গিন্নির হুকুম মেনেই তিনি খেঁদাকে নিয়ে বেরোন।

খেঁদা বড়বাবুর সঙ্গে বেরিয়ে যায়, ফেরে বাবুর সঙ্গেই সন্ধে উতরে, কোনও দিন সামান্য রাত করে।

বাড়িতে কাজকর্মের অসুবিধে যে না-হয়, এমন নয়, তবু মনোবীণা তাঁর হুকুম পালটাননি।

একদিন মনোবীণা স্বামীকে বললেন, “তুমি ওকে চোখে চোখে রাখো, না ছেড়ে দাও?”

ফণীশ্বর বললেন, “সে কি কথা! ওই তো আমায় চোখে চোখে রাখবে বলে পেছনে জুড়ে দিয়েছ। গোয়েন্দাগিরি! ওকেই তুমি জিজ্ঞেস করো।”

মনোবীণা বললেন, “গোয়েন্দা লাগাব কেন? হার্টের রোগী তুমি, পথে-ঘাটে যদি একটা বিপদ হয় ; সাবধান হবার জন্যেই সঙ্গে নিয়ে যেতে বলি।”

ফণীশ্বর বললেন, “তা হলে আর কথা কেন! ও থাকে।”

“কোথায় থাকে?”

“চেটোর বাড়িতে বন্ধুদের আসরে তো ওকে পাশে বসিয়ে রাখতে পারি না ; বাইরে কোথাও থাকে। ওকে জিজ্ঞেস করো।”

“অন্য সময়—? যখন ইয়ারদের আড্ডায় থাকো না—তখন ও কী করে?”

“আমাকে ফলো করে।”

“ও!… তো তোমার ছেলে বলছিল, বাবার হার্ট নিয়ে ছেলেখেলা কোরো না, মা! হার্টের অসুখের মজা হল, আজ এখন এই—তো তখন একেবারে ওই।”

“ঠিকই বলেছে। কারেক্ট। হার্ট এই—ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো ছক্কার দান ফেলেছে, পরের মুহূর্তে অক্কার দান ফেলবে।”

“আমায় ভয় দেখাচ্ছ!”

“তোমায় ভয় দেখাব! তুমি হলে ভয়তারিণী ভয়ভঞ্জনা…!”

“দেখো, ঠুসে ঠুসে কথা বলবে না। এক্কেবারে বলবে না।.. যখনই বলো, বুকটা কেমন কেমন করছে—সঙ্গে সঙ্গে তোমার হুকুম মতন ওই মা মনসাকে ডাকতে হয়। আমার তো গা জ্বালা করে, মাথা আগুন হয়ে ওঠে ওকে দেখলে। তবু তোমার বায়না শুনে ডাকতে হয়।… হাজার বার করে বলছি, মনসা কিচ্ছু জানে না, মাদি মদ্দা হলেই কি সব জেনে বসে থাকবে। আমাদের জয়রাম ডাক্তার কত বড়, তাকে দেখাও, তা তুমি দেখাবে না কিছুতেই।”

ফণীশ্বর বললেন, “জয়রাম খোস পাঁচড়ার ডাক্তার। সে হার্টের কী বুঝবে?”

“অত বড় ডাক্তার…?”

“দুঃ ।”

“বেশ, তবে চৌধুরি ডাক্তারকে দেখাও।”

“সেটা তো ডাক্তার নয়, টাকার কল। টাকা টাকা করে বেটার এমন হয়েছে, শুনেছি, নিজের শাশুড়িকে দেখতে গিয়ে ফিজের জন্যে হাত বাড়িয়ে ফেলেছিল। ওকে জেলে দেওয়া উচিত।”

“শহরে আর ডাক্তার নেই?”

“রায় ভাল ডাক্তার। রায়কে দেখিয়েছি। বলেছে, দাদা মিস সরোজিনী গুপ্ত এ-ব্যাপারে ভাল বোঝেন। আপনার চয়েস ঠিক হয়েছে। তা ছাড়া বাড়ির পাশেই থাকেন উনি, ইমারজেন্সিতে উনি যত হেলপফুল হবেন—আমরা অতটা হব না।”

মনোবীণা বিরক্ত হয়ে বললেন, “যত্ত ছুতো! আচ্ছা, আমি দেখছি।”

ফণীশ্বর কিছু বললেন না। মনে মনে হাসলেন।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। মনোবীণা গিয়েছিলেন, পাল মশাইয়ের বাড়ি, সন্ধেবেলায়। পালগিন্নি বারবার বলে পাঠাচ্ছিলেন। তিনি নিজে সদ্য ভুগে উঠেছেন, শরীর বড় দুর্বল। পালগিন্নির বড় ইচ্ছে, এবারে বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন প্রতিমা গড়িয়ে। সংসারে অনেক শুভ ঘটনা ঘটেছে, সবই মায়ের কৃপায়। এবার মাকে যদি এনে না বসান তা হলে কী চলে! এ-ব্যাপারে দিদির পরামর্শ দরকার। মনোবীণা হলেন পাড়ার সবচেয়ে যোগ্য পরামর্শদাতা।

পালবাড়ি থেকে ফিরছিলেন মনোবীণা। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। পালবাড়ির খাস-ঝি রাধা ছাতা আর টর্চ নিয়ে মনোবীণাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল। গলিতে আলো কম। সামান্য কাদা জমেছে।

মনোবীণা ধীরে ধীরেই আসছিলেন। পা টিপে টিপে, সাবধানে। গড়াইদের বাড়ি পেরিয়েছেন, হরেনের ছোট্ট চা-খাবারের দোকান পাশে, গায়ে এক লম্বাটে রক, হঠাৎ রাধা টর্চের আলো ফেলে বলল, “ওমা, খেঁদা।”

মনোবীণা তাকালেন। প্রায় অন্ধকারে বৃষ্টি বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে খেঁদা।।

“তুই এখানে?”

খেঁদা যেন ধরা পড়ে গেছে। মুখে কথা নেই। চোর যেমন করে হকচকিয়ে যায় ধরা পড়ার পর সেইভাবে হকচকিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

“এখানে তুই কী করছিস?”

খেঁদার মুখে কথা নেই।

“বাবু কোথায়?”

খেঁদা চুপ। বাবুর সঙ্গেই সে বেরিয়েছিল। বাবুর সঙ্গেই ফেরার কথা।

“কথা বলছিস না?” মনোবীণা ধমকে উঠলেন।

খেঁদা ভয় পেয়ে বলল, “বড়বাবুকেই খুঁজছি।”

মনোবীণা বলতে যাচ্ছিলেন, বাবু কি গোরু ছাগল না কচি খোকা যে তুই তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিস রাত্তির বেলায়! কথাটা মুখ ফসকে বেরুতে দিলেন না, জিবের ডগায় আটকে নিলেন। বললেন, “কেন, বাবু তোর সঙ্গে ছিলেন না?”

খেঁদা মাথা নাড়ল। “ছিলেন, না ছিলেন না। …বড়বাবু…!”

মনোবীণার কী মনে হল, মুখ তুলে তাকালেন। বিশ তিরিশ পা দূরে মা মনসার বাড়ি। সদর বন্ধ।

মনোবীণা খেঁদাকে বললেন, “আয় তুই।”

খেঁদা মুখমাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মায়ের পিছু ধরল, ঠিক যেন চোর-আসামী ধরা পড়ে পুলিশের পাশে পাশে চলেছে।

বাড়ি এসে মনোবীণা খেঁদাকে সার্চ করলেন। প্যান্ট, জামা, ট্যাঁক—কিছুই বাদ দিলেন না।

খেঁদার কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়া গেল। সিনেমার টিকিটের ভেঁড়া কাগজ, নতুন পুরনো, সরু চিরুনি, একটা পেট্রল লাইটার, বিড়ি আর দুটো দুমড়ানো সিগারেট, সিনেমার একটা চটি বই, নগদ সাড়ে পাঁচ টাকা, আধ-প্যাকেট চানাচুর, একটা লোহার আংটি ইত্যাদি।

মনোবীণা বললেন, “এসব থাক এখানে। তুই নীচে যা। …আজ তোর খাওয়া বন্ধ। কাল তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। এখানে তোর জায়গা হবে না। চোর, বদমাশ, মিথ্যুক, শয়তান। ডুবে ডুবে জল খাওয়া দেখাচ্ছি তোকে।”

খেঁদা প্রায় কেঁদে ফেলেছিল, “মা আমার দোষ নেই। বড়বাবু—”

“চোপ। হারামজাদা। দেখাচ্ছি তোকে। যা আমার চোখের সামনে থেকে। বেরিয়ে যা।”

খেঁদা মুখ নিচু করে বেরিয়ে গেল। মনোবীণা বিছানায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।

পাঁচ

ফণীশ্বর বাড়ি ফেরার পর পরই মনোবীণার ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি ঝাঁপালেন না। এমনকি, এতটা দেরি কেন, খেঁদা কেন অমুক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল—সেসব কথাও তুললেন না। ফণীশ্বরের চোরের মন—নিজেই দু‘একবার খেঁদা, বৃষ্টি, চেটো, ঘাড়ের ব্যথা—ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে দেখলেন, গিন্নি হয় কথাগুলো কানেই তুলছেন না, না-হয় ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছেন। বাক্যালাপের সুযোগই হচ্ছে না।

মনোবীণা কিন্তু স্বামীকে যে নজর করছিলেন না—তাও নয়। আড়ে আড়ে করছিলেন। স্বামীর চোখ মুখ তাঁর তো কম জানা নয়। ওই চোখের মধ্যে যে পাতলা ঢুলুঢুলু ভাব ছিল তাও তিনি নজর করেছেন। লক্ষ করেছেন, কথা বলার সময় ভদ্রলোকের দু’চারটে কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, শব্দ পিছলে যাচ্ছিল জিবের ডগা থেকে।

ফণীশ্বর পাকা লোক। তিনি বুঝতে পারছিলেন, বাঘ বা বাঘিনী এখন আশপাশে নিজেকে আড়াল করে রেখে শিকারটিকে দেখছে। যথাসময়ে লাফ মারবে।

ফণীশ্বর অনুমান করার চেষ্টা করতে লাগলেন, কখন কোন দিক থেকে কী ধরনের আক্রমণ ঘটলে তিনি বাঘিনীকে জব্দ করতে পারবেন।

খাওয়া সেরে ফণীশ্বর শুয়ে পড়লেন।

মনোবীণা খানিকটা পরে ঘরে এলেন।

ফণীশ্বর ভাব করলেন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনোবীণা নিত্যকার মতন ঘরের মধ্যে ঘুরলেন ফিরলেন, ছোটখাটো কাজ সারলেন। দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। কোনও কথাই বললেন না।

ফণীশ্বর অনুমান করেছিলেন, নিভৃতে শয্যায় তাঁর ওপর আক্রমণটা ঘটতে পারে। তিনি মনে মনে নিজেকে তৈরি করে রেখেছিলেন। হায় রে, কিছুই যে ঘটছে না।’

রাত বাড়তে বাড়তে বুঝি মাঝরাত পেরিয়ে যাচ্ছিল, ফণীশ্বর বাস্তবিকই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ পেটের কাছে খোঁচা খেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, “আঃ!”

আবার খোঁচা। বার দুই তিন।

ঘুম ভাঙল ফণীশ্বরের। কী হল?”

“আমার বুকটা কেমন করছে। উঠতে পারছি না। জল দাও!”

ফণীশ্বরকে উঠতে হল। “অম্বলের ব্যথা?”

“উঃ! মাগো—”

“কী খেয়েছিলে রাত্তিরে?” বলতে বলতে ফণীশ্বর উঠে পড়ে ঘরের বাতি জ্বাললেন। জল গড়িয়ে দিলেন স্ত্রীকে।

মনোবীণা উঠে বসলেন। বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন।

“নাও। …ইয়ে একটু জোয়ানের আরক খাবে নাকি? বুকের তলায় ব্যথা তো! অম্বল! গ্যাস আটকে গেছে। “

জলের গ্লাসটা নিলেন মনোবীণা, তারপর আচমকা, একেবারে আচমকাই বললেন, “মনসা তোমায় যে ওষুধটা খেতে দেয়—সেটা দাও!”

ফণীশ্বর থতমত খেয়ে গেলেন।

“মনসা—মানে সরোজের ওষুধ?”

“হ্যাঁ।”

“সেটা তো হার্টের…।”

“আমারও হার্ট।”

ফণীশ্বর বললেন, “কে বলল! তোমার অম্বল। গ্যাসট্রিক। গ্যাস—।”

“হার্ট। আমার শরীর আমি ভাল বুঝব না, তুমি বুঝবে?”

“তুমিই বোঝে। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে হার্টের ওষুধ খেয়ে বসবে।”

“খাব।”

“তারপর যদি কিছু হয়!”

“হলে পাপ চুকবে।…দাও ওষুধটা দাও।”

ফণীশ্বর বড় বিপদে পড়লেন। হার্টের ওষুধ তাঁর কাছে কিছু নেই। সরোজ তাঁকে কোনও ওষুধ দেয়নি খেতে। কেননা, এই বয়েসেও হার্টের এমন কোনো গণ্ডগোল নেই যে নিত্য কোনও ওষুধ খেতে হবে। ওষুধের ব্যাপারে সরোজ বড় কড়া। হুটহাট ওষুধ খাওয়া সে পছন্দ করে না। একটা ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে চান খাবেন। পেটে বুকে চাপ বুঝলে—সোডামিন্ট। আপনার তো সোডার অভ্যেস ভালই আছে। কোনও ক্ষতি হবে না।’…ফণীশ্বরের কাছে সেই সোডামিন্ট ট্যাবলেট পড়ে ছিল। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে দেখিয়ে সেটাই খেতেন। কিন্তু আজ এই সময়—!

ফণীশ্বর তবু ওষুধ খোঁজার ছুতো করে একটা কী এনে দিলেন।

মনোবীণা দেখলেন ওষুধটা। বললেন, “এটা তো তোমার ত্রিফলার কবিরাজি বড়ি।”।

“আরে না না।”

“না না মানে! আমি জানি না। গুণ্ডু কম্পানির ত্রিফলা বড়ি। নিজের হাতে উষ্ণ জলের সঙ্গে মিশিয়ে আমি তোমাকে খেতে দিই।”

ফণীশ্বর বিপাকে পড়ে গেলেন। “ও! তা হলে ভুল হয়ে গেছে। ঘুম চোখে মাঝরাত্তিরে—দাও তবে?”

“তোমার আজকাল খুব ভুল হচ্ছে, না?” মনোবীণা এবার পা গুটোলেন।

“ভুল! কই না!”

“খুব হচ্ছে, রোজই হচ্ছে। উত্তরে যাব বললে দক্ষিণে যাও, চেটোর বাড়ি যাচ্ছি বলে মনসার বাড়ি যাও।”

ফণীশ্বর বুঝতে পারলেন, বাঘিনী সময় মতন ঝাঁপ দিয়েছেন। প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, “সরোজের বাড়ি যাই! কী আশ্চর্য! কে বলল? কোথায় সরোজ! কোথায় আমি!”

“যাও না?”

ফণীশ্বর ভয় পেয়ে গেলেন কিনা কে জানে, বললেন, “দরকার না-পড়লে যাব কেন? এই হার্টের কোনও…”

“আজ যাওনি?”

ফণীশ্বর বললেন, “খেঁদা বলেছে?”

“খেঁদাকে তুমি উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দিলে! ছিছি! ওই হারামজাদাকে তুমি টাকা খাইয়ে বশ করে নিয়েছ! ওকে পয়সা দাও সিনেমা দেখার, বিড়ি-সিগারেট ফোঁকার। ওকে বলো, যা খেঁদা পিকচার দেখে আয়। আর নিজে গিয়ে ওঠো মনসার বাড়ি। লজ্জা করে না তোমার! বুড়ো হাবড়া। এই বয়সে কোথায় ধম্ম কম্ম করবে, ঠাকুরুদেবতার কথা ভাববে, তা নয়—কোথাকার একটা মদ্দাটে মেয়েছেলের বাড়িতে গিয়ে বসে বসে ফস্টিনস্টি করো। ছি ছি! আমার মরতে ইচ্ছে করছে।”

ফণীশ্বর স্ত্রীকে দেখলেন। বললেন, “ফস্টিনস্টি করি না। ভগবানের দিব্যি। তোমার দিব্যি।.. মিথ্যে বলব না, সরোজের কাছে যাই। গল্প গুজব করি। আর ইয়ে একটু জিন খাই। ব্লু রিবন উইথ লাইম।”

“কী খাও?”

“জিন!…মেয়েরাই বেশি খায় ওটা। আমাদের কাছে কিস্যু নয়। জল। লেবু জল!”

“ওই মদ্দা মাগিটাও বুঝি খায় তোমার সঙ্গে?”

“এক আধ দিন। বেশির ভাগ দিন সরোজ সফট ড্রিঙ্ক খায়….”

“আর তুমি মদ গেলো!”

“ধুত, ও আবার মদ নাকি? আমাদের পেটে বার্লি…সেরেফ বার্লি….।”

স্বামীকে দেখতে দেখতে মনোবীণা বললেন, “তোমার যত দোষই থাক—এই মনসা-দোষ তো ছিল না। কী কুক্ষণে তোমার পা ভাঙল, আমি ছিলাম না বাড়িতে, আর ওই মনসামাগি এসে জুটল! আমার কী কপাল! কোথায় আমি কোন পাহাড়ে গিয়ে মায়ের পায়ে মাথা ঠুকে তোমার জন্যে মাদুলি নিয়ে এলাম মদের নেশা ছাড়াব বলে, তা ওটা যদি বা কমল একটু এটা একেবারে চড়চড়িয়ে বেড়ে গেল।”

ফণীশ্বরের মাথায় যেন বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে গেল। বললেন, “মাই গড। ঠিক তো! মাদুলি পরার পর থেকেই চেটোর আচ্ছা কমেছে বটে—বেশ কমেছে। কিন্তু ওই সরোজ আমায় চোঁ চোঁ করে টানছে। যেন ম্যাগনেট। দারুণ পাওয়ারফুল ম্যাগনেট। সত্যি তো— আগে কথাটা খেয়াল করিনি।”

মনোবীণা বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন স্বামীকে। ফণীশ্বর গ্লাস ধরলেন।

মনোবীণা কোনও কথা বললেন না। স্বামীর হাতে বাঁধা মাদুলির সুতোটা টেনে পট করে ছিড়ে ফেললেন। যথেষ্ট জোর আছে হাতে। মাদুলিটা ছুড়ে দিলেন জানলা দিয়ে। বললেন, “নাও, এবার তুমি তোমার ইয়ার বন্ধু চেটোর বাগানে চরে বেড়াও। ও বরং আমার সইবে। এতকাল সহ করেছি, আর না হয় ক’বছর—যতদিন না মরছি। কিন্তু ওই মনসা আমার সইবে না।”

ফণীশ্বর চতুরের মতন হাসলেন। বললেন, “মাদুলিটা তুমি ফেলে দিলে? তা ভালই করেছ! ওটা বোধ হয় ভুল মাদুলি ছিল। ‘ম’য়ের ভুল। এক করতে আরেক করছিল। তবে মনো, আমি আগের মতন চরে বেড়াব ঠিকই—কিন্তু সরোজকে তুমি গালমন্দ কোরো না। সত্যি সে ভাল। আমায় দাদা বলে। “

“বলুক। দাদা বললেই সাত খুন মাপ!”

“না ইয়ে—! মানে এর মধ্যে সরোজেরও একটা পার্ট ছিল। সে সবই শুনত, আর হাসত। বলত, দাদা—আপনি কিন্তু বউদিকে অনর্থক খেপাচ্ছেন। এটা চোর-পুলিশ খেলা হচ্ছে। বুড়ো বয়েসে এত মজার খেলাও খেলতে পারেন! ধন্যি আপনারা।”

মনোবীণা স্বামীর হাত থেকে খপ করে জলের গ্লাস কেড়ে নিয়ে ফণীশ্বরের মাথায় ঢেলে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *