মিলনোৎসব

মিলনোৎসব

দেওয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজল। শব্দ করেই। উনিশ শো একের ইংলিশ ‘রয়েল’ ওয়াল ক্লক ; এখন রয়েলের গলা প্রায় বুজে এসেছে। কেদারহরি বলেন, ওটা রয়েল নয় ‘বয়েল’। তবু ওটা বাজল। সাতটা বাজতেই জয়গোপাল মিত্তির হাত তুলে বললেন, “আর নয়, গল্পগুজব অনেক হয়েছে, এবার কাজের কথা। হাতে সময় নেই। আজ বারোই কার্তিক। চোদ্দোই পুজো।”

বারিদ ভট্টাচায্যি বললেন, “আজ ভূত চতুর্দশী!”

শম্ভ হালদার বললেন, “প্রেতলোকের চোদ্দোটি প্রেতকে আজ ক্যান্ডেল দান করতে হয়, ভট্টাচায্যিমশাই! কেননি?”

বারিদ কিছু বলার আগেই জয়গোপাল লাঠি ঠুকে বললেন, “স্টপ। বলেছি কাজের কথা ছাড়া এখন আর কিছু হবে না। আটটায় আমরা উঠব।”

প্রিয়গোপাল চড়েচড়ে বসলেন, “তা হলে আর দেরি কেন মিত্তিরদা, শুরু হয়ে যাক। কথায় কথা বাড়ে। আটটার জায়গায় ন’টা হয়ে যাবে দেখবেন!”

জয়গোপাল মাথা নাড়লেন। তা তিনি হতে দেবেন না।

জয়গোপাল সম্পর্কে কয়েকটা কথা এখানে বলতে হয়। তাঁর বয়েস বাহাত্তর ছাড়িয়ে গিয়েছে। শরীরে দশ আনা হাড়, চার আনা মেদ মজ্জা, দু আনা পোশাক-আশাক। মাথাটি পুরোপুরি টাকে ভরা, ঘাড় আর কানের দিকে দু-চার গাছা সাদা ধবধবে চুল। তবে মুখটিতে এখনও ব্যক্তিত্ব রয়েছে। লম্বা নাক, বসা গাল, সরু থুতনি। গায়ের রং ফরসা। চোখের দৃষ্টি সতর্ক। জয়গোপাল একসময় জজ-ম্যাজিস্ট্রেটকেও নাকানিচোবানি খাইয়েছেন, পয়লা নম্বর উকিল ছিলেন এই অঞ্চলের। ব্যক্তিত্ব হল ছাই চাপা আগুন। তাঁর সেই ব্যক্তিত্ব যাবে কোথায়! এখনও আছে।

জয়গোপাল মিত্তিরের আরও অনেক কিছু আছে। যেমন এই তেতলা বাড়িটি। পৈতৃক বাড়ি। তিন ভাই থাকেন। সদ্ভাবে এবং সহর্ষে। নীচের তলায় এই ঘরটি জয়গোপালের বৈঠকখানা। এককালে এখানে বসে মক্কেলদের মামলা শুনতেন। এখন এটিকে তিনি নিজস্ব বৈঠকখানা করে নিয়েছেন। সাজসজ্জা সেই পুরনো আমলের। তবে এরই মধ্যে ফরাস তাকিয়ার সঙ্গে দু-এক জোড়া সোফাসেটিও ঢুকে পড়েছে। জয়গোপাল বসেন আর্মচেয়ারে।

জীবনটাকে এখন মোটামুটি ছকে সাজিয়ে ফেলেছেন জয়গোপাল। সকালে এক ঘন্টা ধোপি মাঠে প্রাতর্ভ্রমণ, বেলায় চা আর পরিজ, সংবাদপত্র পাঠ ; বেশি বেলায় কিঞ্চিৎ নুন মেশানো ঈষদুষ্ণ জলে স্নান, স্বল্প আহার, দুপুরে বিশ্রাম, বিকেলে চা ও একটি ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিট, রামদাস মালিকে নিয়ে বাগান পরিচর্যা। সন্ধেবেলায়’ পাড়ার বুড়োদের সঙ্গে বৈঠকখানায় বসে গল্প। রাত্রে পারিবারিক আসর। শোবার সময় বিগতা স্ত্রীর ছবিতে একটি স্নেহচুম্বন। অবশেষে নিদ্রা।

জয়গোপাল নিজে যদিও নামকরণ করেননি—তবু তাঁর সভাসদরা এই বৈঠকের নাম দিয়েছেন, ‘সজ্জন মণ্ডল’। এই সভার সদস্য হতে হলে বয়েস কম করেও ষাট হতে হবে, ওপরের দিকে কোনো বয়েস-বাধা নেই। তবে আপাতত বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে আছেন জয়গোপাল, আর কেদারহরি। দু জনেই বাহাত্তর। আর এক জন ছিলেন, হরেন ঘটক, সত্তর বাহাত্তর টপকে চুয়াত্তরে আসতেই গত বছর নিউমোনিয়াতে চলে গিয়েছেন।

আপাতত গল্পে আসা যাক।

জয়গোপাল ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা কজন আছ?” প্রিয়গোপাল মাথা গুনে বলল, “ন’জন মিত্তিরদা।”

“ওতেই হবে। সারখেল আর মালপানি আসেনি?”

“আসার কথা। সারখেলের চেম্বার বন্ধ হয় সাতটায়। এসে পড়বে।”

বারিদ বললেন, “গর্জন বন্ধ না হলে আসবে কেমন করে?”

“কিসের গর্জন?”

“ওই প্র্যাকটিস আর কী, মিত্তিরদা! সারখেল ডাক্তার এখনও গর্জনশীল—মানে বোরিং প্র্যাকটিস নিয়ে থাকে তো?”

সভ্যরা হেসে ফেললেন।

কেদারহরি পানের পাতায় কিমামের মতন একটু করে আফিং লাগিয়ে গালে রাখেন। বলেন, কাবলি কিমাম। তাঁর গলা এবং চোখ দুইই ঝিমিয়ে আসে সন্ধে বাড়লেই। কেদারহরি বললেন, “মালপানি! সে কোথায়! তারই তো উদ্‌যুগ বেশি ছিল!”

শম্ভু হালদার মাথা নাড়লেন। “তার একার কেন হবে, আমাদেরও ছিল। আমরাও বলেছিলাম, এবারের কালী পুজোর গোল্ডেন জুবিলিতে—আমরা বুড়োরাও একটা কিছু করব!…মিত্তিরদা, আজ আমরা বুড়োহাবড়া, কিন্তু আপনি বলুন—চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে যখন জোয়ান ছিলাম—তখন কারা বেল দ্য ক্যাট করত।”

ফণিপ্রসাদ বললেন, “আঃ-হা! মা কালী আবার ক্যাট হল কবে! শম্ভু, তুমি যে কী বলো! কালী হলেন, উজ্জ্বল জ্যোতিষাদগ্ধ স্তেষান্ত পরমাং গতিম।’’

শম্ভু হালদার ভুরু কুঁচকে বললেন, “সংস্কৃত শেখাচ্ছ আমাকে।”

জয়গোপাল আবার লাঠি ঠুকলেন। “আঃ, থামো। বুড়ো হলেই বকবক। যত্ত বাজে অভ্যেস। কাজের কথা হোক।…আমরা কী করব, তাই বলো?”

বারিদ ভট্টাচায্যি বললেন, “সে সব তো মোটামুটি ঠিক করা আছে, মিত্তিরদা। কাল পুজো, বিসর্জন। তরশু প্যান্ডেলে ছেলেছোকরারা আর কালী-কমিটি জলসা করবে। নরশু আমাদের সজ্জন মণ্ডলের অনুষ্ঠান।”

“সব বলা-কওয়া আছে?”

“হ্যাঁ। শরদিন্দু, সেনাপতি, অভয়-কমিটির সবাইকে বলে দিয়েছি। ছেলেগুলোকেও।”

জয়গোপাল খুশি হলেন। বললেন, “কাল সকালে বেড়াতে যাবার সময় আমি শরদিন্দুর সঙ্গে একবার কথা বলে যাব।…এবার পুজোর ব্যবস্থা কেমন? সেদিন চোখে পড়ছিল। কাজ চলছে। ভাল বলেই তো মনে হল।”

শম্ভু হালদার বললেন, “খারাপ কেন হবে, দাদা? ট্রাডিশন বলে একটা কথা আছে। রঘুপুরে কোনওদিন খেলো কুচ্ছিত কালীপুজো হয়েছে? পঞ্চাশ বছর আগে যেভাবে ভাবভক্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই ভাবেই আছে। প্রত্যেকটি মরাল কোড মেনে।”

ফণিপ্রসাদ মজা করে বললেন, “রঘুবংশ তো ফেলনা নয়!…তবে সেই পঞ্চাশ বছরের পুরনো পাড়া তো আর নেই। তখন এই পাড়া ছিল ধাপধাড়া, শহরছুট ; বুনো কুল, টোকো আমড়া আর আঝোপে ভরা। রেল লাইনের দিকে মারশি—পেঁকো জমি। হাতে গোনা বাড়ি। তখন আমরা হ্যাফ প্যান্ট পরি, মাঝে মাঝেই লেটার বক্স খুলে যায়…”

সকলেই জোরে হেসে উঠলেন।

হাসি থামলে জয়গোপাল বললেন, “তা ঠিক। তবে তোমাদের চেয়ে আমার দেখাশোনা খানিকটা বেশি হে! আমি সিনিয়ার মোস্ট।”

কেদারহরি আধবোজা চোখে মাথা নেড়ে বললেন, “মিথ্যে বলিস না মিত্তির। আজ ভূতচতুর্দশী, মাথার ওপর মঘা আছে। তুই ভাই আমার চেয়ে বারো দিনের ছোট। …এক আঁতুড়ে জন্মাইনি বলে তুই সিনিয়ার মোস্ট হয়ে যাবি!”

“তোর পাঁজিতে ভুল আছে। ভুল ছক। নতুন ক্যালকুলেশানে পিছিয়ে যাবি।…যাক, বাজে কথা থাক, ফণী কী বলছিল!”

ফণিপ্রসাদ বললেন, “বলছিলাম ট্রাডিশানের কথা। আপনার ইয়াং এজে যেমনটি দেখেছেন, আমরা ছেলেবেলায় যেমন দেখেছি— সব তেমনই আছে। হ্যাঁ, তখন পাড়া ছোট বলে পুজোর চেহারাটা ছিল খানিকটা টিমটিমে ; এখন পাড়া বড়, লোকজন অনেক ; কাজেই ব্রাইটনেস বেড়েছে। তবে মিত্তিরদা, পুরনো কোড ভাঙা হয়নি। চাঁদা যে যেমন দেয়, প্রতিমা সেই আগের মডেলেই, মায়ের হাতে খাঁড়া আছে তবে গলায় মুণ্ডমালা নেই, পায়ের তলায় শিব আছে, মা কিন্তু ঊর্ধবনেত্র। গায়ের অলঙ্কার মাকে ঢেকে রেখেছে। ভেরি বিউটিফুল।”

শম্ভু হালদার বললেন, “ফণী আসল কথাটাই বলল না। আসল কথা হল, পুজো আমাদের ভালই হয় মিত্তিরদা, আপনিও জানেন। যা হয় না, কোনো কালে এখানে হয়নি, তা হল—ওয়াগান ব্রেকার, গুণ্ডা ক্লাস, ট্রান্সপোর্ট বিজনেসের লোক, চাল চিনি সিমেন্টের ইয়েদের কাছ থেকে কোনো সেলামি নেওয়া হয় না।”

জয়গোপাল বললেন, “তা হলে আমাদের জন্যে যে দিনটা ঠিক করা হল— সেদিন আমরা বুড়োরা কী করব! কিছু ভেবেছ?”

বারিদ ভট্টাচায্যি বললেন, “আমি ভেবেছি।”

“কী?”

“প্রথমে উদ্বোধনী সংগীত, পরে খানিকটা গান-বাজনা—বুড়োদের, শ্যামাসঙ্গীত কালীকেত্তন, শেষে সজ্জন মণ্ডলের সভাপতি মিত্তিরদার অভিভাষণ…”

বারিদের কথা শেষ হয়নি তখনও, দরজায় তিন মূর্তিকে দেখা গেল।

সারখেল ডাক্তার একপাশে, অন্যপাশে মালপানি ; মাঝখানে এক ভদ্রলোক। সারখেল ডাক্তার আর মালপানি মাঝের ভদ্রলোকের দু পাশের দুই হাত এমন করে চেপে ধরে আছেন, যেন দুই সৈনিক দু পাশ থেকে কোনো শত্রুপক্ষের গুপ্তচরকে ধরে রাজ্যসভায় পেশ করছে। নাটকীয় ব্যাপারের মতন দেখাচ্ছিল দৃশ্যটি।

ঘরের সবাই হাঁ করে সারখেলদের দিকে তাকিয়ে।

সারখেল ডাক্তারই কথা বললেন প্রথমে জয়গোপাল মিত্তিরের দিকে তাকিয়ে। “দেখুন মিত্তিরদা, কাকে ধরে এনেছি।”

বৈঠকখানার কেউই বুঝতে পারছিলেন না—কাকে ধরে আনা হয়েছে। মাথায় কালো মাদ্রাজি টুপি, গায়ে গলাবন্ধ কোট, পরনে প্যান্ট।

জয়গোপাল বললেন, “কে ও?”

“আমাদের ইউ. জি. ঘোষ। উদয়গোপাল। ইউ. জি.-কে আমরা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ঘোষ বলতাম, মনে পড়ছে না?”

প্রিয়গোপাল যেন লাফিয়ে উঠলেন, “আরে আরে, ইউ. জি. !… এ জুয়েলকে তুমি কোথথেকে পেলে সারখেল?”

মালপানি বললেন, “ধরতে হয়েছে। ইফ দেয়ার ইজ এ উইল দেয়ার ইজ এ ওয়ে…।”

জয়গোপাল ধাতস্থ হয়ে এসেছিলেন। বললেন, “সত্যিই উদয় নাকি?”

উদয়গোপাল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সকলকে নমস্কার জানালেন। বললেন, “আমি উদয়গোপাল ঘোষ। ইউ. জি.। আমাকে এখানে ইনভাইট করা হয়েছিল। মালপানি লিখেছিল, আমরা কালী পুজোতে গোল্ডেন জুবিলি করছি, তুমি অবশ্যই এসো।আমি এসেছি।”

শম্ভু হালদার বললেন, “সেই যে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে, কত বছর হল যেন, পঁচিশ ত্রিশ বছর—তারপর এই তোমার উদয়!”

ইউ. জি.—মানে উদয়গোপাল বলল, “তিরিশের বেশি, শম্ভুদা। আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম সিক্সটি টুয়ে…সঙ্গে ললিতা ছিল। ললিতা এখনও আছে। তাকে আনতে পারলাম না। অনেক কাজ…।”

“তুমি এখন আছ কোথায়?” বারিদ জিজ্ঞেস করলেন।

“সাউথে। পাট্টা ডাকালে…!”

“সেখানে কী কর?”

“আমাদের ক্লিনিক আছে। ন্যাচারাল এলিমেন্ট অ্যান্ড হারবাল মেডিসিন দিয়ে নানা রকম অসুখের চিকিৎসা করা হয়। ললিতা সেখানকার সুপারিনটেনডেন্ট।”

“তুমি?”

“ডাক্তার…। ডাইরেক্টারও।”

“বা বা, বেশ। তা তোমায় খুঁজে বার করল কেমন করে মালপানি?”

“মালপানির এক শালী আমাদের ওদিকের একটা টেকনিক্যাল স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। সে একবার অ্যাকসিডেন্টালি আমাদের কাছে এসেছিল। তখনই..!”

“বুঝেছি। ভেরি ওয়েল। তোমায় আমরা ওয়েলকাম করছি—!”

জয়গোপাল বললেন, “না, তা কেমন করে হয়! উদয় এসেছে এ খুবই সুখের খবর। উই আর অল হ্যাপি। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওকে জায়গা দেব কেমন করে! ওর বয়েস কত? ষাট না হলে তো এনট্রি পাবে না।”

সারখেল বললেন, “মিত্তিরদা, ইউ. জি. সবে একষট্টি। আমি চেক আপ করে নিয়েছি আগেই। ওর মাথায় কিছু নেই, নি-কেশ। তাই টুপি লাগিয়েছে। দাঁত ফলস— মানে বাঁধানো। বি. পি, তলায় এক শো ওপরে দেড় শো। হার্ট…!”

মালপানি বললেন, “ইউ. জি.-কে গ্রেস দিয়ে পাস করাতে হবে না, দাদা। ও এমনিতেই বেড়া টপকে গিয়েছে।”

জয়গোপাল তিনবার লাঠি ঠুকে বললেন, “উদয়, তুমি আমাদের মণ্ডলিতে প্রবেশাধিকার পেলে! খুশি হলাম।… যাক, আমাদের এখানে কী কথা হচ্ছিল— তোমার জানা দরকার। সারখেল আর মালপানিও শুনুন।… বলো হে তোমরা যা ভেবেছ বলো। আমি একটু আসছি…!”

কেদারহরি বললেন, “তুই কি ওঁ জলং তৎসৎ করতে যাচ্ছিস! তা হলে আমিও যাব!”

“আয়।”

খানিকটা পরে জয়হরিরা— মানে জয়গোপাল আর কেদারহরি ফিরে এসে দেখলেন, উদয় অন্যদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, “এই কী একটা মেনু! মানে সজ্জন মণ্ডলের গোল্ডেন জুবিলির অনুষ্ঠানের প্রোগ্রাম! সেই থোড় বড়ি খাড়া! খাড়া বড়ি থোড়! গান, শ্যামাসঙ্গীত, সভাপতির বক্তৃতা! ও কেউ শুনবে না। লোক উঠে যাবে। প্যাণ্ডেল ফাঁকা।”

“তা হলে?” জয়গোপাল বললেন।

“আমি একটা ভেবে এসেছি। আসবার সময় ট্রেনে বসে ভাবছিলাম। লং জার্নি! যদি অভয় দেন, বলি।”

“বলো!”

“একেবারে নতুন ধরনের হবে! ইন্টারেস্টিং! লেগে যাবে।”

“আগে তোমার প্ল্যানটা শুনি।”

উদয়গোপাল একবার সারখেল আর মালপানির দিকে তাকালেন। চোখে চোখে কথা হল। মানে উদয় আগে থেকেই বন্ধুদের মতলবটা শুনিয়ে রেখেছেন। সারখেল চোখ টিপলেন, গো অন…!

উদয় বললেন, “দাদারা, এটা তো এখানকার কালী পুজোর পঞ্চাশ বছর— গোল্ডেন জুবিলি, আপনাদের বয়েসের তো নয়,সে জুবিলি সবাই পেরিয়ে এসেছেন! আজ যাঁদের বয়েস ষাট, পঁয়ষট্টি, সত্তর ছাড়িয়ে গেল— তাঁরা—মানে তাঁদের কাছ থেকে লোকে দু’পাঁচটা মজার কথা, জীবনবাণী, কী বলে গার্হস্থ্য উপদেশ, সহজ সত্যকথা শুনতে চায়। কাজেই আমি একটি ভাবনাচিন্তা করেছি।”

“বলে ফেলো। অকারণ বাকবিস্তার করো না। আটটা সোয়া আটটার মধ্যে মিটিং শেষ করে কচুরিবিলাসে বসতে হবে,” বারিদ বললেন। বলেই নাক টানলেন। এই ঘরের কাছাকাছি এক ঘেরা-বারান্দায় জয়গোপালের নিজস্ব বাবুর্চিখানা। সেখানে, কুকিং বুথে, মিত্তিরমশাইয়ের হুকুমমতন বন্ধুবান্ধবের জন্যে চা ও এটা-ওটা খাবার তৈরি হয়। বলরাম হল কুক। হাত ভাল। মিত্তিরমশাইদের বৃহৎ সংসারের সঙ্গে এই রান্নাঘর বা চা পর্বের কোনো সম্পর্ক নেই।

উদয় বললেন, “কচুরিবিলাসটা কী?”

“নতুন টাটকা কড়াইশুঁটির কচুরি। হিং সমেত।”

উদয় সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, “বাঃ, বাঃ! দারুণ! তা হলে আমি থাকতে থাকতে একদিন কালিয়াদমনও হয়ে যাক।”

বারিদ বললেন, “সেটা আবার কী হে!”

“তেমন কিছু নয় দাদা, ভাল পাকা মাছের কালিয়া। তাকেই বলি কালিয়াদমন।”

সবাই হেসে উঠল।

শম্ভু হালদার বললেন, “ইউ. জি. তুমি সাউথে থাক বলছ! বাংলাটা এখনও জিব দিয়ে ভালই খসছে তো!”

“আজ্ঞে, আমি অবসর সময়ে বাংলা নভেল লেখার চর্চা করি, আর পুরনো বাংলা বইপত্র যা জোটাতে পেরেছি তাই পড়ি। কথাটা আমার নয়, কেদার বাঁড়জ্যের। বই খুলে দেখতে পারেন।”

জয়গোপাল হাত তুলে বললেন, “স্টপ। তোমরা থামো। ওই দেখো সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। সাতটা চল্লিশ। উদয়, তুমি কাজের কথা বলো। সময় নষ্ট কোরো না।”

কচুরিবিলাসের জন্যে সবাই তখন ব্যস্ত। অকারণ বিলম্ব কারও পছন্দ নয়।

উদয় বার দুই গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিজের প্ল্যান বাতলাতে লাগলেন।

যথারীতি আপত্তি উঠল, অসুবিধের কথা তোলা হল, এমন কি সন্দেহ প্রকাশও করা হল উদয়ের অনুষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু সারখেল, মালপানি, প্রিয়গোপাল উদয়ের প্রস্তাবকে সরবে সমর্থন করলেন।

জয়গোপাল আর ভোট নিলেন না, তাঁরও পছন্দ হয়েছিল ব্যাপারটা। তিনি বললেন, “তবে তাই হোক। বেশ নতুনই হবে। শম্ভু, তুমি আর সারখেল পাড়ার মধ্যে ব্যাপারটা বলে দাও। ছেলেদেরও জানিয়ে দিও ; মাইকে বলে দেয় যেন আমাদের কথা। তবে ডিটেল না বলে। বুঝলে?”

দুই

কালীপুজো, দেওয়ালি উৎসব, বিসর্জন, ছেলেদের আর কালী-কমিটির জলসা শেষ হয়ে যথা দিনে সজ্জন মণ্ডলের উৎসব বা অনুষ্ঠান শুরু হল।

কার্তিক মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। সামান্য ঠাণ্ডাও পড়ছিল আজকাল। বাজি পটকার চোটে সেই ঠাণ্ডা ভাবটাও আচমকা কমে গিয়েছিল মাঝের ক’দিন। আজ আবার ঈষৎ ঠাণ্ডা দেখা দিয়েছে, কুয়াশাও জমছে চারপাশে, আকাশের কালো পটে তারা বেশ উজ্জ্বল।

রঘুপুরের কালীবাড়ির মাঠে মাঝারি ধরনের প্যান্ডেল। শ চার পাঁচ লোক অনায়াসেই বসতে পারে চেয়ারে বেঞ্চিতে। আলোটালোর ব্যবস্থাও ভাল। সভা মণ্ডপটিতে কোনো জমকালো ব্যাপার নেই। সাধারণভাবে সাজানো। তবে ওই যে পঞ্চাশটি বড় বড় প্রদীপ প্রায় গোল করে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে, আর আশেপাশে চার পাঁচ জোড়া ছোটবড় হরিনাম-লেখা চাদর পেছন দিকে পতাকার মতন উড়ছে— এটি বেশ দেখাচ্ছিল। কিছু ফুলও অবশ্য আছে।

সভার জায়গাটি আগেই করা ছিল। স্টেজের দু দিকে তিনটি করে চেয়ার। দুটি টেবিল। মানে এপাশে তিন ওপাশে তিন, মোট ছটি চেয়ার, দুটি টেবিল। মাঝমধ্যেখানে সামান্য পেছনে আরও একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। তারও পেছনে প্রায় সিংহাসন মার্কা একটা চেয়ার, সামান্য উঁচুতে, একটি ছোট টেবিল। মাইক-ম্যান চার টেবিলে চারটি মাইক লাগিয়ে দিয়েছে।

সাতটা বাজার আগেই পাড়াপড়শিরা মণ্ডপে জুটতে শুরু করল। কালী-কমিটির ছেলেরা কয়েকটা তুবড়ি জ্বালিয়ে দিল, পটকা ফাটাল, হাউই উড়িয়ে দিল আকাশে। অর্থাৎ সভা শুরু হতে চলেছে, আয় তোরা সবে ছুটিয়া। পাড়ার বুড়োবুড়ি থেকে মধ্যবয়স্ক ভদ্রজন, বউ, বাচ্চা সবাই এসে ভিড় করে ফেলল প্যান্ডেলের তলায়।

এমন সময় মালপানি স্টেজের মধ্যে দাঁড়িয়ে পেটা ঘণ্টায় সাতটা ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন।

ইউ জি— মানে উদয়গোপাল একেবারে বাঙালি বয়স্ক ভদ্রলোকের মতন পোশাক আশাক পরে স্টেজের মাঝখানে এসে হাত জোড় করে বললেন, “নমস্কার, নমস্কার। সুধীজন ও ভাইবোনেরা, সবাইকে নমস্কার। আমি উদয়গোপাল ঘোষ। আপনাদেরই লোক। পেটের দায়ে বিভুঁয়ে পড়ে আছি। কিন্তু তবু আমি আজ এসেছি— আপনাদের স্নেহভালবাসার টানে।…আজ এখানে কী অনুষ্ঠান হবে তা সামান্য পরেই দেখতে পাবেন। তার আগে বলি, রঘুপুর কালীপুজোর এটি পঞ্চাশ বছর। সকলেই সেকথা জানেন। আমাদের পুজোর এই গোল্ডেন জুবিলিতে এখানকার, মানে এই পাড়ার বাসিন্দদের মধ্যে যাঁদের বয়েস ষাট পেরিয়ে গিয়েছে, যাঁরা সজ্জন মণ্ডলের সদস্য— তাঁরা একটি অনুষ্ঠান করতে চলেছেন। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘বৃদ্ধস্য মিলনোৎসব’।…আমি প্রথমে আমাদের সভাপতির নাম ঘোষণা করছি। প্রস্তাবও করছি। শ্রী জয়গোপাল মিত্র মহাশয়।”

সারখেল ডাক্তার কাছেই ছিলেন, সমর্থন করলেন।

জয়গোপালকে এনে সিংহাসন মার্কা চেয়ারে বসানো হল। জয়গোপাল ধুতি চাদর লাঠি সমেত নিজের জায়গায় বসলেন।

সভা থেকে হাততালির শব্দ হল।

তারপর পাড়ার বিগতজনের জন্যে দু মিনিট শোকজ্ঞাপন।

উদয় ঘোষ বললেন, “এর পর যা তা পরে জানাচ্ছি। তার আগে আমাদের উদ্বোধনী সংগীত হবে। গাইবেন বৃদ্ধরা। আমাদের শম্ভুদা গানটির পরিচালক। তিনিই দলবল নিয়ে গাইবেন। আসুন শম্ভুদা।”

শম্ভু হালদার জনা সাতেককে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। সঙ্গে হারমোনিয়াম ডুগিতবলা, মৃদঙ্গ, খঞ্জনি।

বাজনা গুছোতে খানিকটা সময় গেল। দলে জনা সাতেক থাকলেও গায়ক তিন চার জন। বাকিরা মুখ নাড়বেন, নয়ত মাঝে মাঝে গলা চড়াবেন।

গান শুরু হল।

শম্ভু হালদার গান গাইতে পারতেন এককালে। এখন গলায় জোর পান না।

তিনিই শুরু করলেন, “আমরা সবাই বুড়ো আমাদের এই বুডোর রাজত্বে, বুড়িগুলোর দয়ায় আছি বেঁচে বরতে। আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি…”

গানের শুরুতেই হাসির দমকা বয়ে গেল মণ্ডপে। গায়করা যে যার খুশি মতন চেঁচাচ্ছেন, শেখানো বানানো গানে ভুলটুল যা পারেন বলে যাচ্ছেন, প্রবলভাবে মৃদঙ্গ আর খঞ্জনি বাজছে। হারমোনিয়ামের রিড আটকে গেছে, তবলা বুঝি ফেঁসে গেল।

হাসির হররা ছুটছে তখন মণ্ডপে। হাততালি। কেউ কেউ সাধু সাধু বলে চেঁচিয়ে উঠল।

উদয় ঘোয চিৎকার করে মাইকে বললেন, “সাধু সাধু নয়, মধু মধু বলুন। এনকোর থেকে বাংলায় মধু বলা যায়। মধু ঋতয়তে বাতাঃ— বাতাসে এখন শুধু মধু। আপনারা আমাদের ধন্য করলেন।”

গান শেষ হল। মণ্ডপে তখনও হাসির ঝড় থামেনি।

কে একটা ছেলে মণ্ডপের বাইরে ডবল তুবড়ি জ্বালিয়ে দিল।

সামান্য চুপচাপ থাকার পর উদয় ঘোষ বললেন, “এবার একটু শান্ত হন। আমাদের পরের অনুষ্ঠান শুরু হবে।” বলে উদয় মালপানির দিকে তাকালেন। মালপানি ঘণ্টা বাজালেন।

উদয় ঘোষ বললেন, “মহাশয় মহাশয়ারা এবার আমরা যা করব, সেটা আপনারা অন্য কোথাও দেখেছেন বলে মনে হয় না। আমরা তিনজন বৃদ্ধকে ওপরে ডাকব। তিনজন বৃদ্ধাকে। দাদা বউদিরা এসে আমাদের কাছে এই মঞ্চে বসবেন। দাদারা রাইট সাইডের চেয়ারে, বউদিরা বাঁ দিকের চেয়ারে। না না, একেবারেই ভাববেন না যে এসব আগে থেকে আমরা ঠিক করে রেখেছি। লটারি করে নাম ঠিক করা হয়েছে দাদা বউদিদের। অবশ্য একটা কথা আগেই বলা উচিত। এই দাদা এবং বউদিরা কেউ কারুর হিজ হিজ হুজ হুজ নয়—মানে কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই। সেটা থাকলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেওয়ার মতন হত। তাই না।…সারখেল, তুমি দাদাদের বউদিদের নাম ডেকে দাও।”

সারখেল ডাক্তার নীচে থেকেই কাগজে টুকে রাখা নাম ডাকতে লাগলেন। অখিলবন্ধু চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র মজুমদার, গুঞ্জন দত্ত।

“অখিলদা, মাধবদা, গুঞ্জন— আপনারা দয়া করে ওপরে আসুন।”

অখিলরা একে একে ওপরে এলেন। বারিদ আগে থেকেই নোটিশ ঝেড়ে রেখেছিলেন।

এরপর মেয়েরা। সুশীলাবউদি (সুশীলা সরকার), কনকবউদি (কনক মুখখাপাধ্যায়), সতীদি (সতী সেন)।

সুশীলার হাঁটুতে বাত, প্রস্থ অত্যাধিক, বছর খানেক আগে চোখের ছানি কাটিয়েছেন। বয়েস সাতষট্টি আটষট্টি। মাথার কাপড়, পরনে লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সিথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। গায়ে আবার সেন্টও ঢেলেছেন।

সুশীলা কষ্টেসৃষ্টে দু পা এগুতেই দুটো ছেলে ছুটে এসে হাত ধরল। “আসুন, জেঠাইমা।”

উনি মঞ্চে উঠলেন। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন, দেখলেন— বসার জায়গার প্রস্থ কম। তাঁর সাহস হচ্ছিল না।

উদয় বললেন, “বসুন বউদি, এগুলো বাড়ি থেকে আনাননা, ডেকোরেটারের চেয়ার নয়।”

সুশীলা বসলেন, সাবধানে।

তারপর নাম ডাকা হল কনকবউদির। কনকের বয়েস বাষট্টি তেষট্টি। উনি ব্রাহ্মবাড়ির মেয়ে ছিলেন একসময়। তারপর হিন্দুবাড়ির বউ এবং গৃহিণী। একরঙা দক্ষিণী শাড়ি পরেছেন। হালকা রং, ঘি রঙের। পাড় মেরুন ধরনের। মাথায় সামান্য কাপড়। কাঁধের কাছে হাড়ের ব্রোচ। হাতে চুড়ি আর ঘড়ি।

কনকবউদিকে ধরতে হল না, নিজেই মঞ্চে উঠে এলেন। বসলেন সুশীলার পাশের চেয়ারে। বসেই একবার আড়চোখে মাধবচন্দ্রকে দেখে নিলেন।

শেষে ডাক পড়ল সতী সেনের। সতী এঁদের মধ্যে কনিষ্ঠা। সবে ষাট।বেশ রোগাটে চেহারা। মাথার সামনের সব চুল পাকা। গাল সরু। সতী সেন চাকরি করতেন কো-অপারেটিভ ব্যাংকে। বেশ কড়া ছিলেন। সাজসজ্জায় ফিটফাট। তিনিই যা হালকা রঙের ছাপা শাড়ি পরেছেন, গায়ে সিল্কের পাতলা স্কার্ফ।

সতীদি বসতেই উদয় ঘোষ বললেন, “এবার আমি আমাদের সকলের মাননীয়া, এবং পপুলার—শোভাদিকে অনুরোধ করব ওপরে আমাদের মধ্যে আসতে। শোভাদি আমাদের এখানকার মেয়ে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে মাত্র চার মাস আগে রিটায়ার করেছেন। তিনি এই পাড়ার জন্যে অনেক কিছু করেছেন, মহিলা সমিতি, গরিব বাচ্চাকাচ্চাদের পড়াবার জন্য ছোট্ট স্কুল, চ্যারিটেবল হোমিও সেন্টার। শোভাদির গুণের শেষ নেই। শোভাদি—মানে শোভনাদি এখানে থাকবেন মহিলাদের পক্ষ থেকে নয়, তিনি থাকবেন আমাদের পক্ষ থেকে। সভার পরিচালনা তিনিই করবেন, আমি তাঁকে শুধু সাহায্য করব। আসুন শোভাদি।”

শোভনা উঠে এলেন সামনে থেকে। চেহারাটি গোল, মাথায় খাটো, গায়ের রং ফরসা, মাথার কোঁকড়ানো চুল কাঁচা পাকায় মেশানো। ঘাড় পর্যন্ত চুল। চোখে চশমা, পরনে গরদ শাড়ি। ছোট পাড়। পায়ে হিল তোলা জুতো।

শোভনা আসতেই উদয় বসার চেয়ারটি তাঁকে এগিয়ে দিয়ে, পাশে সরে দাঁড়ালেন।

শোভনা এসেই প্রথমে সভাপতি জয়গোপাল মিত্রকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, তারপর মঞ্চের সকলকে এবং শেষে মণ্ডপের দর্শকদের।

শোভনা নিজের চেয়ারে বসলেন।

উদয় ঘোষ গলা পরিষ্কার করে বললে, “প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি। আমাদের মঞ্চে মাইকের ব্যবস্থা কম। সব কথা হয়ত সকলের কানে যাবে না ভাল করে, ত্রুটি মার্জনা করে নেবেন।… আজকের এই অনুষ্ঠান— যার আমরা নাম দিয়েছি, ‘বৃদ্ধস্য মিলোনৎসব’— সেখানে একটি নতুন ধরনের খেলা হবে। বলতে পারেন ‘বুড়োদের খেলা’ বা ‘বুড়োবুড়িদের মেলা’।…খেলার নিয়মটা আমি বলে দি। আমাদের মধ্যে যে। তিনজন বউদি দিদি উপস্থিত আছেন— তাঁরা ওই তিন বৃদ্ধজন— মানে আমাদের দাদাদের কয়েকটি করে প্রশ্ন করবেন। প্রশ্নগুলি ব্যক্তিগত হতে পারে, সাধারণও হতে পারে। তবে কোনো প্রশ্নই অভব্য, ইয়ে— মানে ইনডিসেন্ট যেন না হয়। মজার মজার প্রশ্ন হবে, মজা এবং রঙ্গটাই আসল। একটু আধটু খোঁচা নিশ্চয় থাকবে, তবে মন্দ প্র্রশ্ন করবেন না। করলে সেটা কাটান যাবে। বাদ যাবে আর কী। আপনারা মনে রাখবেন, দিস ইজ গেইম, এ গেইম অফ লাইফ অ্যান্ড লাফটার।

“আর আমার বলার কিছু নেই। এবার শোভাদির এজলাসে মামলা তুলে দিলাম। নিন শোভাদি।” বলে উদয় ঘোষ মাইকটা শোভনার দিকে এগিয়ে দিলেন।

ওদিকে তিন বৃদ্ধের মধ্যে অখিলবাবুর গলা শুকিয়ে এসেছে। তিনি বরাবরই ডিসপেপটিক এবং আমাশা আর অম্বলের রোগী। নার্ভাস টেনশানে থাকেন। অথচ রেলওয়ের স্কুলে যখন সিনিয়ার অঙ্ক টিচার ছিলেন— দেদার মার দিয়েছেন ছাত্রদের। জ্যামিতিতে তিনি বাঘ ছিলেন। ছাত্ররা আড়ালে নাম দিয়েছিল, জিয়ো-টাইগার। তাঁর লেখা অঙ্কের বই কলকাতার বইপাড়ায় ছাপা হয়েছে, বিক্রিও হয়েছে দেদার। অখিল তাঁর মাথামোটা ছাত্রদের ঘরে বন্ধ করে বিনি পয়সায় অঙ্কও শেখাতেন এককালে।

সেই অখিল আজ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। “উদয় এক গ্লাস জল।”

মালপানি ঘণ্টা বাজাতে যাচ্ছিল, ঘন্টা না বাজিয়ে দুটো ছেলেকে জল দিতে বলল টেবিলে টেবিলে।

ফটাফট ছ’ গ্লাস জল চলে এল কাচের গ্লাসে। টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।

সুশীলাবউদির সামনে জল রাখতেই তিনি হাত নেড়ে বললেন, “জল কী হবে, ওই বুড়োদের দে। আমাদের জল লাগবে না। বরং পরে একবার পান-জরদা এনে দিস।”

এবার মালপানির ঘণ্টা বাজল। মানে খেলা শুরু। মণ্ডপ থেকে আওয়াজ উঠল, শুরু হয়ে যাক আরম্ভ করে দিন।

শুরু হল।

শোভনা বললেন, “প্রশ্ন মেয়েরাই করবেন। উত্তর দেবেন পুরুষরা। তাঁরা কোনও সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন না। প্রশ্ন হবে পাঁচটি থেকে বড় জোর দশটি। তার বেশি নয়। পনেরো মিনিট পর্যন্ত এক একজন সময় পাবেন। মনে থাকবে তো? সুশীলাদি আপনি কী বলেন?”

“আমি আর কী বলব! যেমন তোমাদের ইচ্ছে।”

“তা হলে আপনাকে দিয়েই শুরু করি। আপনি এখানে মহিলাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠা। আপনি প্রশ্ন করবেন— অখিলদাদাকে। দাদা, এখানে— মঞ্চে আপনি বয়েসে সবার বড়। আমি শুরু করলাম।”

মাইকের দুই ছোকরা ছুঁচোর মতন ছুটে গিয়ে সুশীলা আর অখিলবাবু— যার যার দিকের টেবিলে মাইক ঠেলে দিয়ে অ্যাডজাস্ট করে দিল।

মণ্ডপ থেকে একটা হালকা আওয়াজ শোনা গেল হাসির।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ।

তারপর শোভনা বললেন, “নিন, সুশীলাদি শুরু করুন।”

“দাঁড়াতে পারব না বাপু!’

“না না, বসে বসেই বলুন।”

অখিল জল শেষ করে ফেলেছেন। আর একবার মুখ মুছলেন। মণ্ডপে তাঁর স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে— মায় নাতনি বুলবুলি পর্যন্ত আজ। আজ একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। পেটটাও মুচড়ে উঠেছে। সুশীলা বউঠাকরুনকে বিলক্ষণ চেনেন তিনি। কথায় কম যান না। জয় বাবা মহাদেব।

সুশীলার স্বামী মণ্ডপের সামনেই বসে আছেন। ছেলেপুলে বউ নাতিরা বসে আছে। তারা মজা দেখছে।

সুশীলা কথা বলতে গিয়ে যেন আটকে গেলেন। কী বলবেন? মাথায় ছাই কিছুই যে আসছে না।

সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

শোভনা হেসে বললেন, “বলুন সুশীলাদি, লজ্জা কিসের?”

সুশীলার থমকে যাওয়ার ভাবটা কেটে গেল। তিনি অখিলবাবুর দিকে তাকালেন। দু চারটে পুরনো অপ্রিয় কথা মনে পড়ল। পাশাপাশি বাড়ি না হলেও একবার বাড়ির ময়লা বাইরে ফেলা নিয়ে অখিল-গিন্নি মমতার সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি হয়েছিল ; আর-একবার মমতার বাড়ির কাজের লোককে তিনি বেশি টাকা দিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন বলে মমতা তাঁকে আড়ালে ‘ঝি-ভাঙানি’ বলেছিল। আর ওই মাস্টার তো এইট ক্লাসে সুশীলার ছোট ছেলেকে অঙ্কে ফেল করিয়ে ক্লাস-ওঠা বন্ধ করে দিয়েছিল আর কি! এবার একবার নেবেন নাকি অঙ্কের মাস্টারকে! …না, না। এসব ব্যাপার অনেক পুরনো। পাশাপাশি ঘটিবাটি থাকলেও ঠোকাঠুকি হয়। সেসব তুচ্ছ ব্যাপার কবেই তাঁরা ভুলে গেছেন। পড়শি হিসেবে মমতার সঙ্গে তাঁর বেশ সদ্ভাব এখন। তা ছাড়া তাঁর সেই ছোট ছেলে এখন জোয়ান, সে হারামজাদা মাস্টারের মেজো মেয়ের সঙ্গে কচু দেবযানী করল গত কালই। সুশীলা কি কচি খুকি? অসভ্য অভব্যও নয়।

সুশীলা হঠাৎ বললেন, অখিলবাবুর দিকে তাকিয়েই, “কত হল আপনাদের মাস্টারমশাই?”

অখিল ঠিক বুঝতে পারলেন না। বললেন, “ছেষট্টি শেষ হল।”

“আপনার বয়েসের কথা বলছি না, সংসারধর্মের কথা বলছি।”

“ও! তা—তা—বছর চল্লিশ।”

“আমার চেয়ে চার বছর কম।…তা চল্লিশ বছরে কেমন লাগল?”

“কেমন।…ইয়ে, যেমন লাগে।”

“ও কী একটা জবাব হল! বলুন, ভাল না মন্দ?”

অঙ্কের মাস্টার অখিল এবার সাহস পেয়ে গেলেন। বললেন, “দিদি, চৌবাচ্চার অঙ্ক জানেন? একদিক থেকে জল ঢুকছে জলে, ওপরের নল দিয়ে ; নীচের নল দিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। কম বেশি। সংসারধর্মটা হল সেই রকম, সুখ আনন্দও জোটে, আবার সেগুলো বেরিয়ে গেলে দুঃখকষ্টও জোটে। এইভাবে চলে!”

“ও তা হলে আপনি বলছেন, বিয়ে-থা করে বউ ছেলেপুলে নিয়ে সংসারধর্ম করাটা চৌবাচ্চার অঙ্ক!”

প্রবল একটা হাসির ঢেউ উঠল মণ্ডপে। হাততালির শব্দ। মধু মধু ধ্বনি। বুড়োবুড়ির দল হেসে এ ওর গায়ে পড়লেন।

সুশীলা এবার একেবারে ফ্রি। কোনও সঙ্কোচ নেই আর। গলা বেশ ভালই উঠছে। বললেন, “তা বেশ দাদা, অঙ্কই হল। এবার বলুন তো— বিয়ের সময় মমতার মুখটি কেমন দেখতে ছিল? হাসিহাসি, না, কান্না কান্না?”

অখিলবাবু ইতস্তত করে বললেন, “অত পুরনো কথা কী মনে থাকে!…তবে একটা কথা মনে আছে দিদি। আমি দেখতে বড় রোগা ছিলুম। বিয়ের সময় আমার দাদাশ্বশুর আমাকে কানে কানে বলেছিলেন, ক্ষীণদেহং মীনসম সরোবরে শোভিত হে, পুচ্ছং উচ্চং তুলি ক্রীড়া করে শালা রে—! মানে, তোমার এই রোগা শরীর ওই পুকুরের জলে শোভা পাচ্ছে, তুমি দাদু শালা লেজ তুলে খেলা করে যাও?”

এবার একেবারে চারপাশ অট্টহাস্যে ভরে উঠল। দারুণ জেঠু, মধু মধু…, অতি মধু।

সুশীলা যেন মার খেয়ে গেলেন। অঙ্কের মাস্টার সংস্কৃত বলে। এ বাবা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। সুশীলা নিজেও হেসে ফেলেছিলেন। শাড়ির আঁচলে হাসি মুছে নেবার চেষ্টা করলেন।

হাসি থামলে সুশীলা বললেন, “দাদা, আপনি আর মমতা— কে কতবার ঝগড়া করেছে এই চল্লিশ বছরে?”

“এই তো মুশকিলে ফেললেন দিদি। চল্লিশ বছর মানে, ফরটি ইনটু থ্রি হানড্রেড সিক্সটি ফাইভ।…রাফলি সাড়ে চোদ্দ হাজার দিন। বাপের বাড়ির জন্যে একশো দিন বাদ দিয়েছি। না, আমি বলতে পারব না, দিদি। তবে আপনি ওর দিকে সিক্সটি পার্সেন্ট আমার দিকে ফরটি পার্সেন্ট রাখতে পারেন। দোষ হয়তো আমার।”

“আপনি বরাবর রগচটা।”

“সে আমার ধাত। বাকিটা ছাত্রদের জন্যে।”

“আচ্ছা, এবার বক আর যুধিষ্ঠিরের মতন প্রশ্ন করি?”

“করুন! আপনি কি বক?”

আবার হাসির হররা উঠল।

সুশীলা বললেন, “বক তো ধর্ম।”

“তা ঠিক।”

“জগতে কোন স্বামী সবচেয়ে বেশি সুখী?”

“যে স্বামী স্ত্রীর চরণাশ্রিত।”

আবার হাসি। জোর হট্টরোল।

সুশীলা বললেন, “কোন স্ত্রী বেশি সুখী?”

“যার আঁচলে যত ভারি চাবির গোছা থাকে।”

পুনরায় হট্টরোল।

“গেরস্থ জীবনে কে জেগে ঘুমোয়?”

“স্বামী, মানে পুরুষরা।”

“চতুর কত রকমের হয়?”

“এ কোন মহাভারত দিদি?”

“উদ্ভট মহাভারত। চতুর কত রকমের হয়?”

“বলতে পারব না।”

“জীবনটা কেমন?”

“গায়ের বস্ত্রের মতন। গায়ে বস্ত্র দিলে তা ময়লা হয়। ছেঁড়ে ফাটে। তা বলে কি আমরা বস্ত্র ফেলে দিই দিদি! কেচেকুচে সেলাই করে আবার পরি। এই জীবন সেই রকম। ইট ইজ নট ডার্টি, ইট শুড নট বি ডার্টি। যদিও আমাদের জীবনে— আমরা ডার্টকে ঠেকাতে পারি না।”

জোর হাততালি পড়ল মণ্ডপে। রব উঠল মধু মধু।

মালপানি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। মানে সুশীলা-অখিল প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ।

ধন্য ধন্য রব নয়, তবে জোর করতালি ধ্বনি উঠল মণ্ডপ থেকে। কেদারহরি চেয়ারে বসে বসে ঝিমোননা গলায় বললেন, “আহা, কী স্বর্গ। মাস্টার লড়েছে ভাল।”

এবার কনক মুখোপাধ্যায়— মানে কনকবউদি ভার্সেস মাধবচন্দ্র মজুমদার।

শোভনা নাম ঘোষণা করলেন, কনকবউদি আর মাধবচন্দ্রের।

মাইকের ছোকরা দু তরফের টেবিলের মাইক সরিয়ে জায়গা মতন করে দিল।

উদয়গোপাল বললেন, “এবার যাঁরা মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা দু জনেই এই পাড়ার একেবারে পুরনো বাসিন্দে না হলেও কিছুদিন পরে এসেছেন—তবু পঁচিশ তিরিশ বছর হয়ে গেল। আসুন তাঁদের কথা শুনি।”

শোভনা কনকবউদির দিকে তাকালেন। হাসলেন। “নিন, শুরু করুন।”

মাধবচন্দ্র অখিলবাবুর মতন ডিসপেপটিক রোগী নন। তেষট্টি বছরেও ঘোরাফেরা, সাইকেল স্কুটার চড়া, হাটবাজার— সবই করেন। বাড়ির সারাই-টারাই নিজেই দেখেন শোনেন। কর্মক্ষম মানুষ। খাওয়া-দাওয়ায় রুচি আছে। পানেও। মাধবচন্দ্রের মুখটি গোল, সামান্য ভোঁতা নাক, জ্বলজ্বল করছে চোখ। মাথায় আধ সাদা চুল অল্প হলেও মাঝখানে সিঁথি রেখে ব্যাক্ ব্রাশ করা। গায়ের রংটি কালো।

মাধবচন্দ্র এমনভাবে মাইকের সামনে ঝুঁকে বসলেন, যেন তিনি কিছু কেয়ার করেন না। মিসেস মুখার্জিকে তো নয়ই।

কনকের বাপের বাড়ি ছিল কলকাতায়। ব্রাহ্মসমাজের বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন। পড়েছেন বেথুন কলেজে। বাপের বাড়িতে বেশ একটা সমাজ পরিবেশ ছিল। শ্বশুরবাড়িতে অবশ্য পট-পুতুলের হাট। স্বামী দেখতে ভাল, বড় কাজকর্ম করতেন বলে হিন্দুবাড়ির ছেলেকেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল মা বাবার। তা বলতে নেই মুখার্জিমশাই যখন কাজ থেকে অবসর নিলেন— তখন তিনি কাউবয় অ্যান্ড মিল্টন কোম্পানির জোনাল চিফ, ডেপুটি ডিরেক্টর।

কনক একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে মাধবচন্দ্রের দিকে তাকালেন।

কনক বললেন, “আমি শুরু করছি। আপনি তৈরি?”

মাধব বললেন, “সব সময় তৈরি।”

“আপনি তো পুলিশে কাজ করতেন?”

“সরি ম্যাডাম, আমি পুলিশে কাজ করতাম না। আয়রন ওয়ার্কসের সিকিউরিটি অফিসার ছিলাম। চিফ অফিসার।”

“ওই একই হল। ইউনিফর্ম পরে অফিসে যেতেন দেখতাম…”

“ইউনিফর্ম পরা অফিসিয়াল অর্ডার ছিল। অফিসের পোশাক যদি পরিচয় হয়— তবে তো ডাবের খোল আর নারকোল একই জিনিস।”

মণ্ডপে হালকা হাসি শোনা গেল।

কনক ঘাবড়ালেন না। ঘাবড়াবেন কেন? মাধবের স্কুটার একবার তাঁদের গাড়ির হেড লাইট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। গাড়িতে কনক ছিলেন, স্বামীও ছিলেন। মাধবকে দিয়ে তিনি ক্ষমা চাইয়েছিলেন। স্বামী অবশ্য অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাসিডেন্ট। তা বলে পাড়ার পরিচিত লোককে কেউ ওভাবে ধমকায়।

কনক ধমকের মেজাজেই বললেন, “আপনি কি নারকোল?”

“বলতে পারেন। আমার মধ্যে জল এবং শাঁস দুইই আছে।”

কনক একটু থমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন। “আপনি—আপনি মিসেস মজুমদারকে টর্চার করেন।”

“শুনুন কনকদেবী, আমি খাস মতি মজুমদারের নাতির ছেলে। কলকাতার বনেদি বংশ। আমাদের বাড়িতে কেউ মিসেস নয়, সকলেই শ্ৰীমতী। আমার শ্রীমতী মানে স্ত্রীকে আমি টর্চার করি, আপনি দেখেছেন?’

“হ্যাঁ, দেখেছি।”

“বলুন?”

“দুটো বাঘা কুকুর, বারো চোদ্দটা বেড়াল, একটা কাকাতুয়া— সব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে আবার যিশু-বিশু। যমজ। অবশ্য যিশুরা ভেরি ব্রাইট। তবে প্রচণ্ড দুরন্ত। একে আপনি কী বলবেন!”

মাধবচন্দ্রের স্ত্রী অতসী মণ্ডপে বসে বসে হাসছিলেন। যিশু-বিশু দুই ভাই শিস দিয়ে উঠল। দু জনেই সবে পায়ে দাঁড়িয়েছে, একজন ইনজিনিয়ারিং পাস করেছে সবে, অন্যজন সি এ চালাচ্ছে।

মাধব বললেন, “দেখুন কনকদি, কিংবা লেডিদি, আমি জানি কাজ করলে শরীর ভাল থাকে। কুকুর স্বর্গের জীব। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে একমাত্র কুকুরই ওই হাইটে পৌঁছতে পেরেছিল। আমার স্ত্রীকে ওই আলটিমেট জায়গায় গাইড করে নিয়ে যাবার জন্যে এক জোড়া হেল্পার দিয়েছি। অন্যায় করেছি?”

হো হো হাসি উঠল মণ্ডপ থেকে। জোর হাততালি। মধু মধু রব। কে যেন দুটো পটকা ফাটিয়ে দিল।

মাধব হাত তুলে নিরস্ত্র হতে বললেন মণ্ডপের শ্রোতাদের। তারপর কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি বেড়ালের কথা বললেন। ওগুলো হল মাতৃহারা সন্তান। নানা জায়গা থেকে জুটিয়ে আনা। নালা, নর্দমা, ডাস্টবিন, রেললাইন, রাস্তা, ধোপি বস্তি থেকে। ওরা একসঙ্গে লালিত পালিত হচ্ছে মানে ওই যাকে বলে— ওদের মধ্যে একটা ইউনিটি ডেভলাপ করার চেষ্টা হচ্ছে এ-দেশীয় প্রথায়।…আর কাকাতুয়াটা আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে পেয়েছি। ওর বয়েস ছাপান্ন। আমায় ‘জামাইবাবু’ বলে ডাকে, বিশ্বাস করুন।”

এবার যেন মণ্ডপ হাসির তোড়ে ভেঙে পড়ল। কী প্রচণ্ড হাস্যরোল। সেই সঙ্গে হাততালি।

মাধব বললেন, “তবে কনকদি, আমি নিশ্চয় কনফেস করব, আমার বেশি বয়েসের দুই ছেলে একেবারে সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি।”

আবার হাসি। যিশু-বিশু জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “বাপি, বহুত মাজা আয়া। থ্যাংক ইউ।”

কনক একেবারে বিপর্যস্ত। ওই বুড়োটা—এমন বাক্যবাগীশ জানা ছিল না। তাঁকে একেবারে অপদস্থ করে দিল।

কনক একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “মজুমদারবাবু, আপনি তো নিজেকে খুব রসিক প্রমাণ করলেন। এবার কটা কথা বলি?”

“বলুন?”

“অতসীদি— মানে আপনার স্ত্রী, মাথায় আপনার চেয়ে এক ইঞ্চি মতন লম্বা কেন?”

“জেনেশুনেই সেটা হয়েছে দিদি। আমি রমণীজাতিকে শ্রদ্ধা করি। সেই জন্যে একটু বাড়তে দিয়েছি।”

হাসি আর থামছিল না।

“অতসীদিকে একবার কাঁকড়া বিছে কামড়েছিল। জ্বালায় যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছিলেন। আপনি তখন তাস খেলায় মত্ত ছিলেন। কিস্যু করেননি।”

“হ্যাঁ তা ঠিকই। তবে আমি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, ভাবছ কেন! আমার মতন বৃশ্চিক নিয়ে তোমার জীবন কাটছে, ওই বেটা পুঁটি কাঁকড়া তোমার কী করবে!”

এবারে হাসির তোড়ে মণ্ডপের চেয়ারগুলো হেলে গেল

কনক রণে ভঙ্গ দিলেন। বললেন, “না, আপনাকে নিয়ে পারা যায় না। ভীষণ অসভ্য আপনি।”

মাধব বিজয়ী হয়েও হাত জোড় করে হাসতে হাসতে কনককে বললেন, “কনকদি, কিছু মনে করবেন না। এ হল মজার খেলা। অপরাধ করে থাকলে মাফ চাইছি।”

“যান! আর ন্যাকামি করবেন না— এই বয়েসে।”

মণ্ডপ থেকে মধু মধু ধ্বনি উঠল। হাততালি। আবার যেন কে দুটো তুবড়ি জ্বালিয়ে দিল।

ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন মালপানি।

শোভনা, উদয়—সবাই তখনও হাসছিলেন।

বাকি থাকলেন সতী সেন আর গুঞ্জন দত্ত।

তাঁদের পালা শুরু হল এবার। শোভনা নাম ডাকলেন। মাইকের ছোকরা মাইক সাজিয়ে দিল।

সতী সেনকে বয়েসের তুলনায় যেন আরও বয়স্কা দেখায়। স্বভাবে সামান্য গম্ভীর, কিঞ্চিৎ উগ্র। চাকরি জীবনে পুরুষদের মাথায় চড়তে দেননি অফিসে। বাড়িতেও তিনি স্বামীর মাথার ওপর। ওঁদের কোনও সন্তানাদি নেই।

গুঞ্জন কোলিয়ারিতে চাকরি করতেন। অ্যাকাউন্টস অফিসার। সবে রিটায়ার করেছেন। এই অঞ্চলের ছেলে। তবে এই পাড়ার বাড়ি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। বাবা করেছিলেন পরে।

সতী সেনও এদিককার মেয়ে। তাঁর বাড়ি মাত্র বছর দশেকের। উনি খানিকটা বয়েসে বিয়ে করেছেন। স্বামী ব্যবসা করেন।

সতী গুঞ্জনের দিকে অনেকক্ষণ থেকেই আড়চোখে লক্ষ করছিলেন। পাতিহাঁসের মতন চেহারা হয়েছে গুঞ্জনের এখন। তিনি আর গুঞ্জন আজই শুধু এক পাড়ারই বাসিন্দে নয় এককালে তাঁরা এই শহরের এখানকারই পাশাপাশি দু মহল্লায় থাকতেন দুজনে। মহল্লা আলাদা হলেও চেনাচিনি ছিল। পরিচয়ও ছিল ভাল। তারপর সতী যখন বাইরে পড়তে গেলেন, মেয়ে হোস্টেলে থাকতেন— তখন কলকাতার রাস্তায় গুঞ্জনকে দেখতে পাওয়া যেত। গুঞ্জনও পড়তে এসেছেন। দুজনে প্রায় সমবয়স্ক।

সে-সময় গুঞ্জন মাঝে মাঝে সতীর হোস্টেলে দেখা করতে আসতেন। দুজনে ফুটপাথে পায়চারি করেছেন, চা খেয়েছেন নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে।

গুঞ্জন দু-চারটে চিঠিও লিখেছিলেন হোস্টেলের ঠিকানায়। সতী জবাবও দিয়েছিলেন। মামুলি চিঠি, তবু তার মধ্যে অল্পস্বল্প ভাবোচ্ছ্বাস থাকত। চিঠির তলায় গুঞ্জন লিখতেন, ‘ইতি তোমার গুনুদা।’ সতী লিখতেন, ‘ইতি স’।

দিনগুলো পালটে গেল। সতীকে ফিরে আসতে হল, পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নিতে হল। আর গুঞ্জন পড়া শেষ করে বাপের চেষ্টায় গোকুলপুর কোলিয়ারিতে চাকরি পেল। অর্থাৎ যেটুকু উচ্ছ্বাস ফেনিয়ে উঠেছিল— তা মিলিয়ে গেল। এসব অনেক পুরনো কথা।

সতী চুপ করে আছেন দেখে শোভা বললেন, “সতীদি আপনি শুরু করুন।”

গুঞ্জন চুপ করে বসে। তাঁর চেয়ারের বসার জায়গায় ছারপোকা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উসখুস করছিলেন। এমনিতেই গুঞ্জনকে একটু ব্যস্ত দেখায়।

সতী সেন প্রায় না তাকিয়েই বললেন, “আমরা তো এখানকারই লোক, এক সময় শহরের লাহাপাড়ার দিকে থাকতাম। এই জায়গাটা তখন নতুন, গড়ে উঠছে সবে। সেই চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই গুনুদাকে আমি চিনি। তারপর কত জল গড়াল, পাড়া বদলাল, গুনুদা কোলিয়ারিতে, আমি এখানে অফিসে। আবার একদিন এই পাড়ায় দুজনেই থাকতে এলাম। গুনুদাদের বাড়ি পুরনো হয়ে গেল। ওর বাবা করেছিলেন। আমারটা ছোট কুঁড়ে। এই তো সবে হল। ..আমি আর কী জিজ্ঞেস করব গুনুদাকে! চেনা-জানা মানুষকে কী আর জিজ্ঞেস করা যায়?”

গুঞ্জন বার কয়েক চোখ পিটপিট করলেন। চোখ দুটি গোল। ছোট। ভুরুতে কয়েকটা পাকা চুল।

শোভনা হেসে বললেন, “এখানে এই পাড়ার লোকরা সবাই তো চেনাশোনা সতীদি। তবু, আপনি কিছু প্রশ্ন করুন। নয়ত ঠিক মানাবে না আজকের এই ব্যাপারটার সঙ্গে।…করুন না, যা মনে আসে তেমন প্রশ্ন! ভালই লাগবে শুনতে।”।

সতী এবার গুঞ্জনের দিকে তাকালেন। কাশলেন মুখ চাপা দিয়ে। তারপর বললেন, “করি তা হলে?…আচ্ছা বেশ, আমার প্রথম প্রশ্ন হল, গুনুদা আগে— সেই লাহা গলিতে থাকার সময় আমাদের দু-তিনজনকে নিয়ে ঘর অন্ধকার করে প্ল্যানচেট করতে বসত। আমার হাতে পেনসিল গুঁজে দিত। ভূতটুত আসত কিনা জানি না, ভয় হত, গা ছমছম করত, কাঁটা দিত। সেই অভ্যেসটা কি আছে?”

গুঞ্জন বুঝতে পারলেন। সেই কিশোর বয়েসে গায়ে গা লাগলে কাঁটা লাগবেই। লাগারই কথা। সতী বেশ খোঁচাটা মারল।

গুঞ্জন বললেন, “না, না। ওসব আর করি না।” বলে ঢোঁক গিললেন।

“কেন? ভূত নেই, না, আর আসে না?”

“সে তখন ছেলেমানুষি করতাম। ও-রকম অনেকেই করে। বড় বড় লোকরাও করেছেন। ফেমাস লোকরা। শখ! ওসব বোগাস!”

“কোনটা বোগাস! ভূত, না, ভূতের হিজিবিজি?”

“ভূত-ভূত করছ কেন! আত্মা! স্পিরিট। আমি ওসবে আর বিশ্বাস করি না।” বলে গুঞ্জন একবার মণ্ডপের দিকে তাকালেন। গিন্নি, দুই মেয়ে, নতুন জামাই বড় মেয়ের, বসে আছে। সতী অন্ধকার ঘরে প্ল্যানচেটের কথাটা না তুললেই পারত!

সতী মুখ টিপে হাসলেন। বললেন, “আমার কাছে ওরকম— ওই ধরনের হিজিবিজি দু একটা আছে!”

গুঞ্জন প্রায় চমকে উঠলেন! ও ধরনের হিজিবিজি মানে! সতী কি অন্য কিছু মনে করিয়ে দিল! উনি একটু ঘাবড়ে গেলেন। “বাজে কথা! কবেকার হিজিবিজি— মিনিংলেস, কেউ রাখে নাকি! তুমি পাগল!”

সতী ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। গুনুদাকে বেশ ঘাবড়ে দেওয়া গিয়েছে। মজা লাগল। “আমি পাগল! একদিন তা হলে ঘেঁটেঘুঁটে বার করতে হয় হিজিবিজিগুলো?”

গুঞ্জন আঁতকে উঠলেন। বললেন, “এ আবার কী রে, ভাই! হিজিবিজি কি মানুষের হাতে লেখা। আত্মা এসে ভর করে লেখায়। লেখাগুলো থাকে না, মুছে আসে। শেষে ভ্যানিশ! তুমি পাবে কেমন করে?” মণ্ডপের লোকরা হেসে উঠল।

সতী দমবার পাত্রী নন। হেসে বললেন, “দেখি পাই কিনা! ষাট সত্তর আশি বছর আগের করা সব ছক-কোষ্ঠীর বাসি কাগজ যদি থাকতে পারে, ভূতের লেখা থাকবে না!”

“কী মুশকিল! থাকে না বলেই এখন আমেরিকায় ইউরোপে একরকম টাইপ মেশিন চালু হয়ে গিয়েছে। তার ট্রেড নাম ‘প্ল্যানচেটো’। স্পিরিটরা এসে মেশিন চালিয়ে যায়।”

“কোন স্পিরিট! লোকাল না ফরেন?”

জোর হাসি উঠল মণ্ডপে।

সতী সেন আজ গম্ভীর মেজাজ, রুক্ষ চোখ মোলায়েম করে ফেলেছেন। এ তো তাঁর পুরনো অফিস নয় যে, পুরুষদের জব্দ করার জেদ থাকবে। তা ছাড়া তিনি এখন ভক্তিভরে লীলাপ্রসঙ্গ পড়ছেন, মাঝে মাঝে বসুমতী সংস্করণ পুরনো বিদ্যাপতি গ্রন্থাবলির পাতা উল্টে মনে মনে গানও গেয়ে ফেলেন দু-এক কলি। স্বভাবতই মেজাজে কিঞ্চিৎ আর্দ্রতা এসেছে।…আজকের অনুষ্ঠানও মজার। অকারণে খোঁচাখুঁচি টিপ্পনি কেন?

সতী একটু ভেবে বললেন, “গুনুদা, ভূত থাক। অন্য কথা। তুমি রোজ সকালে দুধ আনতে কৈলাসের খাটালে যাও না?”

“যাই। এক ঢিলে দুই পাটি মারা হয়। মর্নিং ওয়াক হয়ে যায় আর দুধটা খাঁটিও পাই।”

“দুই পাখি কেন? বলো তিন পাখি?”

“মানে!”

সতী চোখ টেরা করে হেসে বললেন, “রসময় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারেও তো বেঞ্চির ওপর বসে থাকো।”

“হ্যাঁ। এক পেয়ালা চা খাই বসে বসে। মর্নিং টি!”

“তা খাও। কিন্তু ছোট প্লেটে আলাদা করে কী খাও? রসগোল্লা! তাই না!”

গুঞ্জন এবার বিপদে পড়ে গেলেন। থতমত খেয়ে বললেন, “রোজ খাই না, মাঝে মাঝে খাই। রসময় আগের দিন রাত্তিরে যে টাটকা রসগোলা বানায়— দিশি চিনির— মানে গুড়ের ব্যাপার থাকে, সেটা খেতে খুব ভাল! খেয়েছ? ওটা ভাটপাড়া ব্র্যান্ড।”

নীচে মণ্ডপের সামনে থেকে সারখেল ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠলেন। “আরে, দত্তর যে দুশো সত্তর ব্লাড সুগার। ফটাফট সুগার বাড়ছে। মাই গড, রোজ সাত সকালে রসগোল্লা খায়?”

গুঞ্জনের ছোট মেয়ে তার মাকে না ঠেলে বলল, দেখেছ মা!

গুঞ্জন মাথা নাড়তে লাগলেন। “মিথ্যে কথা। দু শো সত্তর আমার বাবার ব্লাড সুগার ছিল। আমার এক শো সত্তর। বাবাকে আমার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।…আর রোজ খাই না! বিশ্বাস করুন!…সতী আমায় নিয়ে মজা করছে!’

সভায় হাস্যরোল উঠল।

সতী হেসে বললেন, “বাঃ, মজা করব কেন! যা দেখেছি তাই বলছি।”

“ইমপসিবল! কেমন করে দেখবে তুমি? দূরবিন কষে!”

“রসময়ের কাছে শুনেছি গুনুদা! তুমি রসগোল্লা খাও, গরম জিলিপি খাও, গজাও খাও…! মিথ্যে কথা বলছ কেন! বুড়ো বয়েসেও মিথ্যে কথা বলবে! খনা বলেছে, যদি ঠকাও পঞ্চাশে, বাঁধা পড়বে নাগপাশে…”

“ড্যাম ইওর খনা!” গুঞ্জন বললেন।

“ওমা, ওকি কথা! বউদির নাম যে খনা!”

প্রবল হাসি শোনা গেল মণ্ডপে। গুঞ্জনের খেয়াল ছিল না তাঁর গিন্নির নাম খনা। বড় অপ্রস্তুতে পড়লেন গুঞ্জন।

সতী এবার বললেন, “আচ্ছা, আর বেশি তোমায় জ্বালাব না। এবার সোজা সোজা প্রশ্ন। …সেই পদ্যটা তোমার মনে আছে? বিয়ের সময় যেটা ছাপা হয়েছিল তোমার?”

“না। বিয়ের পদ্য কে মনে রাখে! বড়দি লিখেছিল। বিয়ের পদ্য আর বিয়ের ছাতা কেউ রাখতে পারে কোনোদিন!”

“বড়দির নাম করে নিজে তুমি লিখলে, আমার মামার প্রেসে ছাপালে ; অলি গুঞ্জন, হৃদি মহুন— কত কী লিখলে আর এখন সব ভুলে গেলে!”

“আমার মনে নেই। শুধু মাথার ওপর প্রজাপতিটা মনে আছে। শুঁয়োপোকার মতন দেখাচ্ছিল সেটা। যেমন ছাপা, তেমন প্রজাপতি।”

“তা হলে বলছ, প্রজাপতির বদলে শুঁয়োপোকা নিয়ে জীবনটা শুরু হয়েছিল?”

জোর হাসি উঠল মণ্ডপে, হাততালি পড়ল।

সতী বললেন, “শুঁয়োপোকাই প্রজাপতি হয় গুনুদা। যাক আর মাত্র দুটো প্রশ্ন!” “বলো?”

“বউদির সঙ্গে তোমার কত বছর ঘরসংসার হল?”

“বত্রিশ।”

“কেমন মনে হয় এখন—?”

গুঞ্জন একটু ভেবে রসিকতার গলায় বললেন, “ভেরি ইনটারেস্টিং, এ যেন ভাই, বত্রিশটি দন্ত উৎপাটনের কেরামতি দেখা…!”

হো হো হাসাহাসি। হাততালি। মণ্ডপ অট্টরোলে ভরে উঠল।

সতী সেন এবার বললেন, “আর আমার কোনও কথা নেই।…গুনুদা, কিছু মনে করো না। এক পাড়ায় থাকলেও গল্পগুজব তত বেশি হয় না। তোমার সঙ্গে অনেকদিন পরে একটু ঠাট্টা তামাশা করলাম।…আমাদের বয়েসটা এই ভাবেই এক একদিন হারিয়ে যায়। আজও গেল।”

মালপানি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। মানে সতী-গুঞ্জন পর্বও শেষ হল।

শোভনা উদয় ঘোষের দিকে তাকালেন।

উদয় দু হাত তুলে মণ্ডপকে শান্ত হতে বললেন। মণ্ডপ শান্ত হল।

উদয় বললেন, “আমাদের দাদা, বউদি, দিদি, ও ছেলেমেয়েরা। এবার আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হবার মুখে। এখন একটি সমাপ্তি সঙ্গীত গেয়ে শোনাবেন শম্ভুদা ও তাঁর দলবল। আপনারা সামান্য অপেক্ষা করুন।”

শম্ভু হালদার তাঁর দলবল নিয়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দলে পুরনোরা প্রায় সবাই, নতুন আরও দু-তিনজন। হারমোনিয়াম মেরামত হয়ে গিয়েছে। ডুগি-তবলা অবশ্য নেই। তার বদলে একটা ঢাক নিয়ে নেমেছেন তারক পালিত। মৃদঙ্গ, খঞ্জনি, কাঁসর-ঘণ্টা সবই রয়েছে।

পাশাপাশি দাঁড়ালেন সবাই। শম্ভু হালদার থিয়েটারি কায়দায় নমস্কার জানিয়ে বললেন, “আমাদের এই গানটি অনেক পুরনো। একালে তেমন শোনা যায় না। আমরা ছেলেবেলায় দু-চারবার শুনেছি। বিখ্যাত এই গানটি আমি এঁদের নিয়ে গাইব। সুর তাল নিয়ে আপনারা ভাববেন না। সুরে কী যায় আসে, প্রাণই তো আসল! আমরা প্রাণমন ভরে গাইব। নেচে নেচে। আপনারাও আমাদের সঙ্গে গাইতে পারেন। তবে নাচতে যাবেন না। চেয়ারে পা লেগে পড়ে গিয়ে বুড়ো বয়েসে হাত-পা-কোমর ভাঙতে পারেন। শুরু করছি। নাও হে হারমোনিয়াম ধরো, মৃদঙ্গ রেডি, নাও হে তারক, বোল দাও।”

বোল উঠল। মৃদঙ্গও বাজল। কাঁসর ঘন্টা। খঞ্জনি।

শম্ভু গলা ছেড়ে গান ধরলেন, “আর যে কদিন আছিস বেঁচে ওরে মন, হরিনাম নিতে ভুলিস না।/ একলা এসেছিস একলা যেতে হবে সঙ্গে তো কেউ যাবে না।”

গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচ। একেবারে উর্ধববাহু হয়ে। দশ বারো জনের গলা এবং নাচের চোটে মঞ্চ কাঁপতে লাগল।

মণ্ডপে অট্টরোল। কেদারহরিও নীচে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেছেন।

শম্ভুর তখন হুঁশ নেই। গেয়ে চলেছেন, “বাল্যকালে খেলা করে কাটালে/ যৌবনে কামিনী ছাড়লে / বুড়ো হয়েও তবু টাকা টাকা টাকা/ টাকাগুলি তোমার ঘুচলো না…/তাই বলি ওরে মন… যে কটা দিন আছিস বেঁচে হরিনাম নিতে ভুলিস না…।”

গানের তাণ্ডবের মধ্যেই হাততালি, তুবড়ি, পটকা চলতে লাগল। সে-এক মহাদৃশ্য। মৃদঙ্গ ঢোল দুইই ফেঁসে গেল।

গান শেষ হল।

সব যখন প্রায় শান্ত, উদয় ঘোষ বললেন, “এবার আমাদের সজ্জন মণ্ডলের সভাপতি শ্রী জয়গোপাল মিত্র দুটি কথা বলবেন। তারপর সভা শেষ।”

জয়গোপাল একসময় আদালত কাঁপিয়ে দেওয়ানি ফৌজদারি দুই মামলাই লড়েছেন। তাঁর গলা বুজে আসার কোনও কারণ ছিল না। তবু আজ বৃদ্ধের গলা বুজে আসছিল। কোনও রকমে বললেন, “তোমরা আমার কনিষ্ঠ। তুমি করেই বলছি। আজকের দিনটি আমার জীবনে হয়ত আর ফিরে আসবে না। তোমাদের সকলকে আমার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জানাই। তোমাদের যেন মঙ্গল হয়।…একটা কথা বলি। উদয় না থাকলে, এমন একটা অনুষ্ঠান হত না। তাকে বাহবা দিতে হবে।…আমার শেষ কথা হল, অখিলমাস্টার যা বলল— প্রায় তাই। একই। দেখো ভাই, জীবন হল সত্যিই এক বস্ত্রের মতন। আমাদের পরনে রয়েছে। এখানে ধুলোময়লা লাগবে, নোংরা হবে, তা বলে জীবন তো ফেলে দেবার নয়! যা মন্দ, যা ময়লা, তা যতটা পারা যায় সাফসুফ করে নিয়ে বাঁচতে হবে। তোমরা সেই ভাবেই বাঁচো, ঈশ্বরের চরণে আমার তাই প্রার্থনা।” বলতে বলতে থামলেন জয়গোপাল। চোখে পড়ল, মঞ্চের পঞ্চাশটি প্রদীপের অনেকগুলিই নিবে গিয়েছে। বাকিগুলোও প্রায় নিবে এল।

জয়গোপাল একটু যেন হাসলেন নিজের মনে।

সভা ভঙ্গ হল। বাইরে তখন শেষ কার্তিকের হিম পড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *