রঙ্গলাল
সকালটি বেশ চমৎকার লাগছিল রঙ্গলালের।
সবেই ভাদ্রমাস পড়ল, তাতেই শরৎ-শরৎ ভাবটি ফুটে উঠেছে। ঝকঝকে রোদ, নীলে-সাদায় মেশামেশি আকাশ। সামনের মাঠে অজস্র ঘাস গজিয়েছে বর্ষায়। ওরই এ পাশ ও পাশে মামুলি দু চারটে ফুল গাছ, করবী ঝোপ, কলকে ফুল ; তফাতে এই শিউলি।
জানকী কেবিন থেকে এই মাত্র চা খেয়ে ফিরেছে রঙ্গলাল।
চা আর গরম কুচো নিমকি। খাসা! শেষ সিগারেটটাও। এইবার দাড়ি কামাতে বসবে।
ঘরের মধ্যে বসে দাড়ি কামাতে ইচ্ছে করছিল না। এখনও ঘরের মধ্যে তেমন করে আলো আসেনি। মানে পশ্চিম আর উত্তরমুখো জানলা হওয়ায়, রোদ ঢোকেনি ঘরে, সকালের আলোও ঝাপসা। বেলা বাড়লে অবশ্য এমন থাকবে না।
নিজের মনে ‘কাম সেপ্টেম্বর’-এর শিস দিতে দিতে রঙ্গলাল একটা পুরনো টুল জুটিয়ে নিল। নিয়ে বারান্দায় এনে রাখল। ঢাকা বারান্দা। সামনে মাঠ। বারান্দার এ-পাশটা তার, মানে একটা শোবার ঘর, আর এই বারান্দাটুকু। স্নানটানের ব্যবস্থা ওপাশে। কুয়াতলার দিকে। বারান্দার সিকি ভাগ তার, বাকিটা বাড়িউলির। পুরনো কাঠের কয়েকটা ভাঙা ফাটা তক্তা আর হাত দুই আড়াই চওড়া এক জাফরি উঠিয়ে বারান্দাটিকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগাভাগিটা পলকা, মাথায় তেমন উঁচুও নয়।
টুলের ওপর আয়না রেখে রঙ্গলাল তার দাড়ি কামাবার উপকণগুলো নিয়ে এসে সাজিয়ে বসল।
এখন প্রায় আট। দাড়ি কামাতে কামাতে সোয়া আট। তারপর স্নানাদি। সেজেগুজে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়বে কালাচাঁদের হোটেলে। খাওয়া-দাওয়া সেরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটা শেয়ারের সাইকেল রিকশা ধরবে। অফিস পৌঁছতে পৌছতে দশ সোয়া দশ।
কলকাতার ছেলে রঙ্গলাল। নারকেলডাঙায় বাড়ি। গত সাত আট বছর সে কলকাতার হেড অফিসেই ছিল। দিব্যি ছিল। বন্ধুবান্ধব আচ্ছা, সিনেমা থিয়েটার, অফিসের অঞ্জলি, পাড়ার হোমসায়েন্সের রীতা দিদিমণি— একটু শখ শৌখিনতার বান্ধবীদের নিয়ে মনের সুখেই ছিল। শালা ঘোষালসাহেব, উইদাউট এনি ওয়ার্নিং তাকে দুম করে বদলি করে দিল। বলল, ‘সেন, তোমাকে ছাড়া কাউকে ভাবতে পারছি না ইউ নো দ্য জব ভেরি ওয়েল। মাই বেস্ট চয়েস। নপাহাড়িতে আমাদের যে ইউনিট সেখানে তোমাকে পাঠাচ্ছি। ইউনিটটা ছোট, কিন্তু পোটেনশিয়ালিটি প্রচুর। কারখানাটাকে আমরা শিঘ্রি এক্সটেন্ড করব। ওখানের অফিস আর স্টোরে নানা ধরনের ম্যালপ্র্যাকটিস শুরু হয়েছে। তুমি হবে সিনিয়ার অ্যাসিসটেন্ট অফিস আর স্টোরের। তোমায় আমরা লিফট দিচ্ছি। দুটো বেশি ইনক্রিমেন্ট, প্লাস একটা অ্যালাওয়েন্স। উইশ ইউ লাক। আসছে মাসেই চলে যাও।’
রঙ্গলাল বারেন্দ্রি না হলেও বদ্যি। আসলে তো সেনগুপ্ত। সেন বলেই চালায়। সে বুঝতে পারল, ঘোষালসাহেবের সঙ্গে বদ রসিকতা করার ফল এটা। মাত্র কদিন আগে সে এসপ্ল্যানেড পাড়ায় ইভনিং শো শেষ করে, চা-টা খেয়ে সামান্য রাত করই মিনিবাসে বাড়ি ফিরছিল। এমনই কপাল তার সেই মিনিবাসে ঘোষাল ছিল। কোনও মক্কেলের পয়সায় পান-ভোজন বেশিই করে ফেলেছে। ফলে মাতলামির মাত্রাটাও বেশি। ব্যাটা একটা ট্যাক্সি করে চলে গেলেই পারত। তা না করে ভুল মিনিবাসে চেপে মাতলামি শুরু করল। কলকাতার নাইট মিনিবাসগুলো মাতাল-মিনি। তা সে যাই হোক, ঘোষালের মাতলামিতে চটে গিয়ে প্যাসেঞ্জাররা তাকে নামিয়ে দিতে বলছিল কন্ডাক্টাবকে। এই নিয়ে যখন বচসা চরম, তখন পিছনের সিট থেকে রঙ্গলাল বদরকম গলা করে আওয়াজ মারল, ‘ব্যাটাকে কান ধরে নামিয়ে দাও!’…জাত মাতালরা বড় চালাক হয়। ঘোষাল পাদানি থেকে প্রায় পড়তে পড়তে লাফিয়ে উঠল, “কে ব্যা-টা বলল। কে বলল! হোয়ার ইজ দ্যাট ব্লাডি ফাদার! কাম অন। কাম অন রাস্কেল। চলে আয়, আমি মদ খেয়েছি— তোর কী! তুম কোন হো বোলনেওয়ালে।’
মিনিবাসের মধ্যেই রঙ্গলাল ততক্ষণে মুখ লুকিয়েছে।
হলে হবে কী! জাত মাতাল ঘোষাল তাকে চিনে ফেলল।
পরিণাম এই। ট্রান্সফার। কোথায় কলকাতা আর কোথায় এই নপাহাড়ি। তিনশো পঁচিশ কিলোমিটার তফাতে বদলি।
রঙ্গলালদের এখানকার কারখানায় তারকাঁটা তৈরি হয়। বড় কাঁটা, ছোট কাঁটা, তিন মুখ— চার মুখ খোঁচা। মিলিটারিতেও সাপ্লাই যায়।
তা রঙ্গলালের কিছু করার ছিল না। বন্ধুদের শুধু দুঃখ করে বলল, শালা আমায় একবার আগে বলল না, কাঁটায় গেঁথে দিল। ঠিক আছে, আমার নামও রঙ্গলাল। ঘোষালকে আমি দেখে নেব। আর অফিসের অঞ্জলিকে বলল, ‘জম্আ করতে হো কিউ রাকিবোঁ কো, ইক তামশা হুয়া গিলা না হুয়া।’ অঞ্জলি এসব শায়েরির কিছুই বুঝল না।
তা রঙ্গলাল আজ মাসখানেকের বেশি এখানে। এসেছিল যখন তখন ঘন বর্ষা। এখন বৃষ্টিবাদলা একটু কমের দিকে। তবে ভাদ্রমাস বলে কথা! কবে কোনদিন ভাসায় কেউ বলতে পারে না। ভরা ভাদর তো পড়েই আছে।
আসার পর প্রথম মাসটা ‘তারা হোটেলে’ ছিল। তারা মানে ‘নবতারা হোটেল’। এখানে হোটেল মেস নেই বললেই চলে। তারা হোটেলে এক মাসেই রঙ্গলালের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ায়— অফিসের সিধুবাবু তাকে একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানে এই বাড়িটি জুটিয়ে দিয়েছেন দয়া করে। পাড়াটা ভাল, ফাঁকা ফাঁকা, বড়লোকদের উৎপাত নেই, আবার গলিঘুঁজি মাছের আঁশ কুমড়োপচার জঞ্জালও পড়ে থাকে না। মধ্যবিত্ত পাড়া, খানিকটা ছিমছাম ভাবও আছে এখানে।
আজ তিনদিন হল রঙ্গলাল এই বাড়িটায় এসেছে। মানে বাড়ির একটা পাত্তা পেয়েছে। ভাড়া একশো পঁচাত্তর, তিনটে আলো একটা পাখার জন্যে ইলেকট্রিক বাবদ পঁচিশ। মানে দু শোতে হয়ে যাচ্ছে। তক্তপোশ আর টুলের জন্যে অবশ্য ভাড়া গুনতে হয় না। একটা চেয়ার একজোড়া মোড়া রঙ্গলাল নিজেই কিনে এনেছে। খাওয়া দাওয়া বাইরে। জানকীর কেবিনে চা নিমকি জিলিপি সিঙ্গাড়া থেকে মাখন রুটিও পাওয়া যায়। কালাচাঁদের হোটেলটাও ভাল, পরিচ্ছন্ন, যা খাওয়ায় যত্ন করেই পাতে তুলে দেয়। ঘরদোর ঝাটমোছ করার জন্যে একটা বাচ্চা মেয়ে আছে— সরস্বতী।
কলকাতা থেকে আসার সময় রঙ্গলালের মেজাজ যতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন তার মাত্রা অনেক কমেছে। ভালই লাগছে তার নপাহাড়ি।
টুলের ওপর আয়না জল সাবান সাজিয়ে, সেফটি রেজারে নতুন ব্লেড লাগিয়ে রঙ্গলাল দাড়ি কামাতে বসে পড়েছিল। কোনও তাড়া নেই। কেমন একটা আলসেমিও লাগছিল। দাড়ি কামাতে কামাতে শরৎশোভাও দেখছিল মাঝে মাঝে। না, আর যাই হোক, কলকাতায় এসব পাওয়া যেত না। এমন রোদ, নীল-সাদা মেঘ, পড়ো মাঠ, অল্পস্বল্প বাগান, করবী কলকে…।
রঙ্গলাল গুনগুন করে একটা গানও ভাঁজছিল, আমার রাত পোহাল, শারদপ্রাতে আমার..’, হঠাৎ একেবারে আচমকাই এক চিল চিৎকার। গেল গেল রব তুলে চকিত আর্তনাদ যেন। রঙ্গলালের হাত কেঁপে গেল। লাগল গালে।
“এই যে—শুনছেন। শুনছেন নাকি—” বলতে বলতে জাফরির ফাঁক থেকে কে যেন বলল, “মাঠে একটা গোরু ঢুকে পড়েছে। সব খেয়ে গেল। একটু তাড়িয়ে দিন না।”।
জাফরির ওপারের মুখ এপার থেকে দেখা গেল না স্পষ্ট করে, শুধু চোখ, নাক আর শাড়ির একটা আভাস। রঙ্গলালের তখন পয়লা নম্বর শেভ শেষ হয়েছে, দু নম্বর সাবান লাগানো চলছে গালে।
“একটু তাড়াতাড়ি করুন না! সব যে গেল বাগানের।”
বিরক্ত হলেও রঙ্গলালকে সাবান-লাগানো মুখ নিয়ে উঠতে হল।
এ পাশ থেকে রঙ্গলাল আর ও পাশ থেকে মেয়েটি বারান্দার নীচে নামল। মাঠে।
“ওই যে দেখুন—, দেখুন! এ মা। পটপট করে কচি দোপাটিগুলো এবার খেয়ে ফেলছে!”
রঙ্গলাল গোরুটাকে দেখতে পেল। খয়েরি রং। সাইজ মিডিয়াম তবে গাঁট্টাগোট্টা। শিং আধাআধি। গোরুটা পরমানন্দে যা পাচ্ছে চিবিয়ে যাচ্ছে। কোনও ভূক্ষেপ নেই। অমন সবুজ ঘাস, লতাপাতা!
“যান না একটু তাড়াতাড়ি যান…। এবার ডাঁটাগুলো খাবে। সর্বনাশ হয়ে গেল।”
রঙ্গলাল হ্যাট হ্যাট করতে করতে এগিয়ে গেল।
গোরু নির্বিকার। দোপাটি শেষ না করেই পাশের ছোট সবজিবাগানে কোনও একটা লতানো ডাঁটা চিবোতে শুরু করেছে।
“একটু পা চালিয়ে যান! ইস বাবা, কী পাজি রে!”
পাজি! কে পাজি? গোরু না সে? তবু রঙ্গলাল পা চালিয়ে গোরুর কাছে যেতেই জীবটি মুখ তুলে দেখল। শুধু দেখল না, মুখে সাবান লাগানো মানুটিকে সে অন্য কিছু ভেবে দু কদম এগিয়ে এল। মাথাটায় গোঁতানোর ভঙ্গি।
রঙ্গলাল পিছিয়ে এল। পিছিয়ে এসে হ্যাট হ্যাট করতে লাগল ডান হাত তুলে, যেন এই বুঝি ইট পাটকেল ছুঁড়ে মারবে।
গোরুদেরও বুদ্ধি থাকে। নকল ব্যাপারটা আঁচ করে এবার সে তেড়ে এল প্রায়।
পিছিয়ে গেল রঙ্গলাল। “গুঁতোতে আসছে!”
“আসবেই তো! ঢিল মারুন। ওটা ভীষণ পাজি।”
“কোথায় ঢিল?”
“মাটিতে। দেখুন খুঁজে।”
আশেপাশে কোনও ঢিল দেখতে পেল না রঙ্গলাল। ইটের টুকরো জমানো আছে। একপাশে অবশ্য, কিন্তু কম পক্ষে বিশ গজ দূরে। বাগানের যত্রতত্র হাত বাড়াতে নেই। ইটের গাদায় তো নয়ই। সাপ বিছে— কত কী থাকতে পারে। সময়টাও বর্ষাকাল।
“লাঠি নেই? একটা লাঠি? …স্টিক বা বাঁশ—!”
“খুঁজে আনতে হবে। লাঠি খুঁজে আনতে আনতে বাগান শেষ। ইস্—কী কাণ্ড করছে গোরুটা!”
“ইট পাটকেলওতো পাচ্ছি না।…এই হ্যাট হ্যাট, যাঃ— ভাগ !”
গোরুটা সত্যিই অতি সাহসী ও নির্বিকার। তাড়া খেলেও নড়ে না। নড়লেও অন্য পাশে সরে যায়।
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি গোরু তাড়াতেও ভয় পান! আশ্চর্য বাবা !”
গোরুর সঙ্গে রঙ্গলালের নকল একটা লড়াই চলল খানিকক্ষণ, তারপর দু চার টুকরো আধলা ইট পাওয়া গেল।
তাতেই কাজ হল ; গোরু চলে গেল বাগান ছেড়ে।
রঙ্গলালও নিশ্বাস ফেলল।
“ফটকটা ঠিক করে লাগিয়ে দিন ! কে যে এভাবে ফটক খুলে রেখে আসে।” মেয়েটি বলল।
রঙ্গলাল সকালে চা খেতে গিয়েছিল জানকী কেবিনে। ফেরার সময় সে ফটক বন্ধ করেই এসেছে। তবু কথাটা কানে লাগল। অসন্তুষ্ট হল।
ফটক বন্ধ করে দিয়ে এসে রঙ্গলাল বলল, “আমি নয়।”
“তবে চৈতন্যদা। খানিকটা আগে বাজারে গেল!”
“তবে তাই— !” বলে রঙ্গলাল নিজের বারান্দার দিকে পা বাড়াল।
“এই যে শুনছেন। আমি এ-বাড়ির মেয়ে—।”
দাঁড়িয়ে পড়েছিল রঙ্গলাল। দেখল মেয়েটিকে।
মেয়েটি বলল, “সাত আট দিন ছিলাম না এখানে। বড় মাসির বাড়ি গিরিডি গিয়েছিলাম বিয়েতে। কাল রাত্তিরে ফিরেছি। মার কাছে সব শুনলাম।”
“ও!…আমি এখানে দিন তিনেক হল এসেছি।”
“মা বলল। আপনার নাম রঙ্গ!”
“রঙ্গলাল সেন।”
“ওই একই। রঙ্গ। মা রঙ্গ বলল।”
“তোমার কথা শুনেছিলাম। উনি বলেছিলেন। তোমার নাম?”
“ডাকনাম ডুমুর! ভাল নাম, কৃষ্ণা।”
“ডুমুর! বাব্বা, এমন নাম তো আগে শুনিনি। বেশ নাম তো।”
“রঙ্গও আমি শুনিনি।…তবে নতুন নতুন। আয় রঙ্গ হাটে যাই, দু খিলি পান কিনে খাই ; সেই রঙ্গ!” ডুমুর খিলখিল করে হেসে উঠল।
রঙ্গলাল ডুমুরকে দেখল। রোগা ছিপছিপে গড়ন, গায়ের রং শ্যামলাও বলা যাবে না, তার চেয়েও ময়লা। মুখটি একেবারে ঝুরঝুরে। কাটাকাটা। বড় বড় দুটি চোখ। চকচক করছে। নাক একেবারে বাঁশির মতন। ধবধবে দাঁত। এক মাথা চুল, গালে আঁচিল।
ডুমুরের পরনে ছিল ছাপা শাড়ি। হালকা নীল জমির ওপর সাদা হলুদ ফুল-নকশা।
রঙ্গলালের মনে হল, ডুমুরের বয়েস বেশি নয়, হয়তো উনিশ কুড়ি, কি একুশ।
“আচ্ছা, আমি যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে…” রঙ্গলাল আবার পা বাড়াল।
ডুমুর হাসতে হাসতে বলল, “চৈতন্যদা বাড়িতে থাকলে আপনাকে গোরু তাড়াতে ডাকতাম না। ওই গোরুটা ভীষণ শয়তান, পাটনাইয়া, কিছু পরোয়া করে না, নয়ত আমি তাড়িয়ে দিতাম। আমার বড় ভয় করছিল বলে আপনাকে ডাকলাম। তবে কলকাতার লোকরা গোরুছাগল তাড়াতে পারে না দেখলাম।”
ঘাড় ঘুরিয়ে রঙ্গলাল বলল, “আমি তো গোরুছাগল তাড়াবার বাগাল নই।”
“এমা! ছিঃ!” ডুমুর যেন লজ্জা পেয়ে লম্বা করে জিব বার করে দিল।
রঙ্গলাল আর দাঁড়াল না।
দুই
অফিসে দুপুরবেলায় সিধুবাবুর সঙ্গে দেখা রঙ্গলালের। সিধুবাবু বয়েসে বড়। বছর চল্লিশের ওপর বয়েস। ছোকরারা সবাই তাকে সিধুদা বলে। সিধুবাবু কারখানার খোঁজখবর সেরে দুপুরে অফিসে এসে বসে। অর্ডারের কাগজপত্র দেখে।
রঙ্গলাল বলব কি বলব না করে সকালের ঘটনাটা সিধুবাবুকে বলল। রাগ করে বা অপমান বোধ করেছে বলে নয়, এমনি বলল, গল্পচ্ছলে।
সিধুবাবু হেসে বলল, “আরে রাম রাম। আপনি কিছু মনে করবেন না। ডুমুরটা খেপি!।”
“খেপি! মানে খেপা?”
“সেরকম নয়, সেরকম নয়। ওই ওর ধাত। মাথায় ছিট আছে। মেয়ে কিন্তু বড় ভাল। আপনি দেখবেন।”
“তা না হয় বুঝলাম। তবে কথা কী জানেন সিধুবাবু, গোরু তাড়াবার শর্তে একুনে দুশো টাকা দিয়ে আমি ঘরভাড়া নিইনি।”
“ছি ছি, এ কী বলছেন। ছেলেমানুষের কাণ্ড, মাপ করে দেবেন। …আমি বরং একবার গিয়ে বড়দির সঙ্গে দেখা করব। বলব।”
“আরে না না, মশাই! পাগল নাকি আপনি! আমি এমনি বলেছি আপনাকে—কিছু মনে করে বলিনি। ভদ্রমহিলাকে বলতে হবে না।”
সিধুবাবু সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “আসলে কী জানেন সেনবাবু, জামাইবাবুর জন্যে ফ্যামিলিটা কেমন ছত্রখান হয়ে গেল। বড়দি আমার নিজের কেউ নয়। ডাকি বড়দি বলে বরাবর। সেই সূত্রে বড়দির স্বামী জামাইবাবু। জামাইবাবু বিচিত্র লোক। এই সেইবার পূর্ণ কুম্ভের মেলায় গিয়ে আর ফিরলেন না। কী হল কী হল করে আমরা যখন উদ্ব্যস্ত, নানান দুশ্চিন্তা, তখন জামাইবাবুর চিঠি এল, তিনি সাধু সন্ন্যাসী হয়ে কুলুমুখীতে যোগীরাজবাবার আশ্রমে বসে পড়েছেন। সাধনভজন করছেন। আর ফিরে আসবেন না সংসারে।”
“সে কী! উনি আর আসেননি?”
“দু বছর আগে একবার এসেছিলেন। চলে গেছেন আবার। তবে চিঠিপত্র ন’মাসে ছ’মাসে দেন।”
“অদ্ভুত মানুষ তো!”
“ডুমুর মেয়েটা তখন থেকে কেমন হয়ে গেছে। খেপি!”।
রঙ্গলাল সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “আপনাকে কিছু বলতে হবে না সিধুবাবু। আমি কোনও কমপ্লেন করছি না। বরং, সত্যি বলতে কী— মজাই পেয়েছি। হাজার হোক মেয়েটি ছেলেমানুষ। কত বয়েস হবে?”
“একুশ টেকুশ।”
“সেই রকমই মনে হয়েছিল।….ঠিক আছে, আমি এখন দু-একটা কাজ নিয়ে বসি, পরে কথা হবে।”
সিধুবাবু উঠে গেল।
পরের দিন গোরু এল না। তার পরের দিন আবার একই কাণ্ড। সেই সকালে। এবার একটা নয়, চার পাঁচটা ছাগল ঢুকে পড়েছিল বাগান।
যথারীতি চৈতন্য গরহাজির। রঙ্গলালের ডাক পড়ল। “ও রঙ্গবাবু, শিগগির। ছাগল ঢুকেছে। চার পাঁচটা।”
রঙ্গলাল মাঠে নামল। দুটো বড় ছাগল, তিনটে ছোট। মনে হল, সপরিবারে প্রবেশ। মনের সুখে ফুলগাছ খাচ্ছে। জবাগাছের নীচের দিকের পাতাগুলো শেষ। ছোটগুলো বেলঝাড়ের পাতা চিবোচ্ছে।
ছাগল তো গোরু নয় যে তেড়ে গুঁতোতে আসবে। রঙ্গলাল সহজভাবেই এগিয়ে গেল। “এই হ্যাট—হ্যাট…ভাগ যত্তসব…, যাঃ যাঃ!” হাত তুলে ছাগল তাড়াবার ভঙ্গিতে অনেকটা কাছেই চলে গেল রঙ্গলাল।
হঠাৎ দেখে প্যাঁচানো শিংঅলা একটা বড় ছাগল তাকে দেখছে। দেখতে দেখতে সামনের পা দুটো মাটিতে ঘষে নিল।
দাঁড়িয়ে পড়ল রঙ্গলাল।
“কাছে যাবেন না। ওর কাছে যাবেন না।” ডুমুর পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “ওটা ভীষণ বদমাশ ছাগল পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের পা ছোঁড়ে। মেরে দেবে। অৰ্জনবাবুর ছাগল। ইট মারুন।’’
রঙ্গলাল দু পা সরে এল। “কার ছাগল?”
“মনাক্কা না মরক্কো ছাগল। উঁচু ক্লাস। অর্জুনবাবুর শখের ছাগল।” “উঁচু ক্লাস এখানে কেন?
“ফাঁক পেয়ে পালিয়ে এসেছে। দাঁড়ান আমি লাঠি নিয়ে আসি।”
অর্জনবাবুর ছাগলের সঙ্গে রঙ্গলালের খানিকক্ষণ অ্যাডভান্স রিট্রিট খেলা চলল। ততক্ষণে অন্যরা মুখের সামনে যা পেল মুড়িয়ে দিল।
ডুমুর লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির ভেতর থেকে। বলল, “এই নিন, এটা ছাতার বাঁট। ভাঙা। মারতে যাবেন না, ভয় দেখান।”
ছাগলের দল বিদায় নিল আরও খানিকটা পরে।
ফটক বন্ধ করে দিতে দিতে রঙ্গলাল বলল, “এই ফটকটা সারিয়ে নাও। তিনখানা কাঠ ছাড়া কিছু নেই। বন্ধও থাকে না, ওপরের আংটা একটু ঠেলা মারলেই খুলে যায়।” বলে কম্পাউন্ড ওয়ালের চারপাশটা দেখল রঙ্গলাল। একে ছোট পাঁচিল, তায় ভাঙাচোরা, কত জায়গায় ইট খুলে পড়েছে। ফাঁক হয়ে আছে জায়গাগুলো, সেখান দিয়েও গোরু-ছাগল গলে আসতে পারে।
রঙ্গলাল বলল আবার, “ফটকটা আগে সারাও তারপর পাঁচিলের ভাঙা জায়গাগুলো ঠিক করে নাও, গোরু-ছাগলের উৎপাত থাকবে না।”
ডুমুর বলল, “ও বাব্বা, ফটক সারাতে অনেক টাকা। অত টাকা পাব কোথায়! তার চেয়ে কতকগুলো তক্তা ঠুকে দিলেই হয়ে যায়। আমার গায়ে জোর থাকলে দিতাম ঠুকে। আপনি পারবেন না?”
রঙ্গলাল অবাক। আড়চোখে দেখল ডুমুরকে। কোনো জবাব দিল না।
পা বাড়াতে যাচ্ছিল রঙ্গলাল, ডুমুর বলল, “রাগ করলেন নাকি?”
কোনও জবাব দিল না রঙ্গলাল। কী বলবে ডুমুরকে! সত্যিই মেয়েটা খেপা। তবে খুব সরল। সপ্রতিভ তো বটেই।
বারান্দার কাছে এসে ডুমুর বলল, “চৈতন্যদাকে নিয়ে আমিই কাল ক’টা তক্তা লাগিয়ে নেব। নিজের কাজ নিজে করাই ভাল। আপনাকে লাগবে না।”
রঙ্গলাল হঠাৎ বলল, “এতদিন এই বুদ্ধিটা কোথায় ছিল? আমি আসার আগে গোরু-ছাগল ঢুকত না?”
“রোজ রোজ ঢুকত না। ঢুকলে আমরা তাড়িয়ে দিতাম, চৈতন্যদা আর আমি। চৈতন্যদার পিঠে এখন ফিক ব্যথা, হাত তুলতে পারে না। আর আমার আবার পেরেক ফুটে গিয়েছিল পায়ে বিয়ে বাড়িতে। কী রক্ত কী রক্ত! দেখছেন না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি এখনও ব্যথা রয়েছে। যাক গে, পরের একটু উপকার করলে যারা কষ্ঠা পেয়ারার মতন মুখ গোমড়া করে তাদের আমি পায় ধরি না।”
ডুমুর চলে গেল।
হেসে ফেলল রঙ্গলাল।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরে ফটক খুলতে গিয়ে রঙ্গলাল দেখল, কাঠের ভাঙা তক্তা, পাতলা কঞ্চি, লোহার তার দিয়ে ফটক মেরামত হয়েছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে ফটকটাকে। সামান্য লজ্জাই হল রঙ্গলালের। হাসিও পেল।
বারান্দার কাছে আসতেই মনোরমাকে দেখতে পেল। ডুমুরের মা। “অফিস থেকে আসছ?” মনোরমা বললেন।
“হ্যাঁ একটু ঘুরে।…আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন?”
“এমনি। আজ বড় গুমোট। ভাদ্দরের গুমোট। বৃষ্টি হবে।”
“মনে হচ্ছে। আকাশটা থম মেরে আছে। …ডুমুর কোথায়?”
“ঘুমোচ্ছে!”
“এই সন্ধের মুখে ঘুমোচ্ছে !”
“সারা দুপুর চৈতন্যকে নিয়ে বসে বসে ফটক সারিয়েছে। কী ছাইভস্ম করেছে কে জানে! কথা তো শোনে না। ভাদ্দর মাসের দুপুর মাথায় নিয়ে কেউ ওভাবে বসে থাকে! এখন মাথা ব্যথায় মরছে। জ্বরজ্বালা না হলেই বাঁচি।”
রঙ্গলাল কেমন কুণ্ঠা বোধ করল। বলল, “বাগানে রোজ গোরু-ছাগল ঢুকে পড়ে।”
‘বাগানের আছে কী! মরা বাগান। দুটো ঘাস আর ঝোপঝাড়ের জঞ্জাল। বর্ষায় একরাশ আগাছা জন্মেছে। না হয় গোরু-ছাগল ঢুকে দুটো আগাছা খেত।”
রঙ্গলাল কিছু বলল না।
“তুমি ভাল আছ তো?”
“হ্যাঁ, মোটামুটি ভালই।…আমি চলি।”
“এসো।”
বৃষ্টি এল আরও খানিকটা পরে। তুমুল বৃষ্টি। আজ সারাদিনই ভীষণ গুমোট গিয়েছে। বৃষ্টি নামায় যেন গা জুড়োল।
রঙ্গলাল একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিল কালাচাঁদ হোটেলের সঙ্গে। রাত্রে সে আর খেতে যেত না হোটেলে, কালাচাঁদের ওখানে কাজ করে—একটা ছেলে এসে খাবার পৌঁছে দিয়ে যেত রঙ্গলালকে। টিফিন কেরিয়ারে। সকালে সরস্বতী সব ধুয়ে মুছে বাড়ি যাবার পথে হোটেলে ফেরত দিয়ে যেত।
এত বৃষ্টিতে হোটেল থেকে লোক আসা মুশকিল। তবে রাত এখন বেশি নয়, আটটা। ঘন্টাখানেক ধরে আরও যে বৃষ্টি হবে তা মনে হয় না। থেমে যাবে। কালাচাঁদের হোটেলও তেমন দূর নয়।
রঙ্গলাল কী করবে কী করবে ভাবতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাড়িতে চিঠি লিখতে বসল। বউদিকেই লিখবে। আগের বার মাকে লিখেছিল। বউদি নিশ্চয় চটে আছে। ভাইপোটা কী করছে কে জানে! সাত বছর বয়েসেই সে শোলের আমজাদ খান।
সবে বিছানায় গুছিয়ে বসে রঙ্গলাল চিঠি লেখার প্যাডটা টেনে নিয়েছে—এমন সময় ঝপ করে সব চলে গেল। আলো পাখা। একেবারে অন্ধকার। চোখে কিছু ঠাওর করা যায় না। এখানে আলো যাওয়া মানে ঘণ্টা দেড় দুইয়ের ব্যাপার। টর্চ আর মোমবাতি রাখতেই হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে কোথায় যে টর্চ রাখা আছে—কোথায় বা মোমবাতির টুকরো, খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে লাগল রঙ্গলাল।
সামান্য পরে বিছানা ছেড়ে উঠে হাতড়ে হাতড়ে টর্চটা পেল। কিন্তু মোমবাতির টুকরোটা শেষ। নতুন আর কেনাও হয়নি। ভুলে গিয়েছে। টর্চ জ্বেলে কতক্ষণ বসে থাকা যায়!
বৃষ্টি জোরেই পড়ছে। একটা জানলা আধাআধি খোলা। বিদ্যুতের ঝলকানি চোখে পড়ছিল। বাতাসও ঠাণ্ডা।
টর্চ জ্বেলে জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। জল আর জল, আতাঝোপে পাতায় বৃষ্টির ঝাপটা লেগে সব দুলছে।
ফিরে এল রঙ্গলাল। বিছানাতেই বসল আবার। টর্চ জ্বালিয়ে অকারণ ব্যাটারি খরচের কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে অন্ধকারে বসে থাকাই ভাল।
একলা অন্ধকার ঘরে বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকতে থাকতে তার গান এসে গেল। রঙ্গলাল প্রথমে নিচু গলায় সামান্য রিহার্সাল দিয়ে নিয়ে ক্রমশই গলা চড়িয়ে গাইতে লাগল : ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়…।’
রঙ্গলাল একটু আধটু গাইতে পারে। গাইতে পারে বলে অফিস থিয়েটারে মাঝারি গোছের একটা পার্টও পেয়ে যায়। সেবার তো স্টেজে ‘ব্যাপিকা বিদায়ের’ গান গাইতে গাইতে ঘোষালের কোমরে এক গুঁতোই মেরেছিল। কেন মারবে না! ওই শালা ঘোষাল হিরোইন অঞ্জলিকে আজেবাজে জায়গায় টাচ করছিল।
গান গাইতে গাইতেই রঙ্গলাল শুনল, বারান্দার দিক থেকে গলা ফাটিয়ে কে যেন চেল্লাচ্ছে।
গান থেমে গেল রঙ্গলালের। তাড়াতাড়ি টর্চ জ্বালিয়ে বারান্দায় এল।
“কে?”
“আমি। দেখুন তো আপনার বারান্দায় সাপ ঢুকল নাকি?” জাফরির ফাঁক থেকে ডুমুর বলল। তার হাতে লণ্ঠন।
“সাপ! বারান্দায়!” রঙ্গলাল লাফিয়ে উঠল।
“দেখুন আগে।”
টর্চের আলো ফেলে ফেলে বারান্দা দেখল রঙ্গলাল। সাপ দেখতে পেল না, তবে ব্যাঙ উঠে পড়েছে দু একটা মাঠ থেকে। আগেও উঠেছে। সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে দিব্যি উঠে আসে।
“কই, সাপ তো নেই”—রঙ্গলাল ভয়ে ভয়ে বলল।
“তা হলে ঘরটা দেখুন।”
“ঘর! কী সর্বনাশ।”
“দেখুন আগে।”
“তুমি সাপ দেখলে কোথায়?”
“বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ দেখি একটা সাপ সরসর করতে করতে পাশের বারান্দায় চলে গেল।”
সাপে রঙ্গলালের ভীষণ ভয়। কলকাতায় সে যেসব সাপ দেখেছে সেগুলো বেদেদের ঝুড়ি থেকে মুখ বাড়ায়, বাঁশির সুরে দোল খায়। আসল সাপ সে দেখেনি। চিড়িয়াখানাতেও সে সাপের দিকে পা বাড়ায় না।
রঙ্গলাল বলল, “ঘরে আমার মোমবাতিও নেই। একেবারে অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে জ্বেলে ঘরের কোথায় সাপ খুঁজব!”
“টর্চ দিয়েই দেখুন! তাতে ভাল দেখা যায়।”
“দেখতে গিয়ে যদি কিছু হয়ে যায়। সাপে আমার ভীষণ ভয়। সাপ শুনেই গায়ে কেমন করছে! সিরসির।”
“কী লোক রে বাবা! গোরুতে ভয়, ছাগলে ভয়, সাপে ভয়। ভয়ের পুঁটলি!” “আলো যে নেই! কী করব!”
“জ্বালাতন! কলকাতার বাবু!.আসছি আমি—”
ডুমুর বাহাদুর মেয়ে! ওই বৃষ্টির মধ্যে হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে বারান্দার সিঁড়ি টপকে ভিজতে ভিজতে এপাশে চলে এল। বৃষ্টি বাঁচাতে মাথায় একটু কাপড় তুলেছিল।
ঘরে এসে ডুমুর লণ্ঠনের আলোয় ঘরটা ভাল করে যেন দেখে নিল। “না, দেখতে পাচ্ছি না। ও তবে মাঠেই নেমে গেছে।’’
রঙ্গলাল নিশ্চিন্ত হল। “সাপ তুমি দেখেছিলে?”
“না দেখলে বলি?”
“কী সাপ? বিষাক্ত!”
“বা রে মশাই, আমি কেমন করে জানব! হতে পারে বিষাক্ত!”
“মহা মুশকিলে পড়া গেল! এখানে সাপও আসে।”
“মেঠো জায়গায় বর্ষাকালে সাপ আসবে না।”
“আমার হয়ে গেল। ঘুম বন্ধ।”
“ঘুম বন্ধ কেন! কাল খানিকটা কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দেব। সাপ আসবে না। অ্যাসিডের গন্ধ ওরা সহ্য করতে পারে না।”
কী মনে করে রঙ্গলাল বলল, “তুমি না মাথার যন্ত্রণা নিয়ে শুয়েছিলে বিছানায়, হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় এলে কেন?”
“বা রে! মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল তো কী হল! মার একটা ওষুধ খেলাম। যন্ত্রণা কমে গেল। গা মুখ ধুয়ে চা খেলাম, বৃষ্টি এল। কী সুন্দর বৃষ্টি। আলো নিয়ে বারান্দায় এলাম একবার বৃষ্টি দেখতে। কানে গেল, কে একটা চেঁচাচ্ছে। বারান্দার এপাশে এসে কান পেতে শুনি আপনি গান চড়িয়েছেন…”
রঙ্গলাল থতমত খেয়ে গেল। “গান চড়িয়েছি মানে?”
“ওই হল!…দম না থাকলে পুরনো রেকর্ড চাপালে ওই রকম শব্দ হয়।”
“আচ্ছা! তুমি গান জান?”
“না। নকল করতে জানি।”
“শুনি তো একটু নকল।”
“না। আপনার ঘরে বসে আমি রাত্তির বেলায় গান গাইব কেন? আমি অসভ্য?”
রঙ্গলাল হেসে ফেলল। পরে বলল, “আমি তোমায় অসভ্য বলেছি। তুমি খুব সভ্য। দারুণ। …বেশ, কাল সকালে না হয় মাঠে দাঁড়িয়ে গান শুনিয়ে দিও।”
ডুমুর ঘাড় হেলিয়ে বলল, “কালকের কথা কাল, যদি পড়ে তাল বড়াভাজা খাবে জাদু এখন খাও গাল…”
রঙ্গলাল হো হো করে হেসে উঠল।
ডুমুর বলল, “আমি যাই। আলোটা থাকল। …একটা লণ্ঠন কিনে আনবেন মশাই কাল, মোমবাতিতে কিছু হয় না।”
“তাই দেখছি।…কিন্তু সাপ! সেটা কোথায় গেল?”
“নিজের জায়গায় চলে গেছে। আর যদি কামড়ায় কী হবে! পায়ে দড়ি বেঁধে দেব। এখানে শিশিরজেঠা ভাল ইনজেকশান দেয় সাপের। পটাপট দু চারটে দিয়ে দেবে। মরবেন না।”
আলো রেখে চলে যাচ্ছিল ডুমুর। রঙ্গলাল বলল, “দাঁড়াও।” বলে আলো হাতে করে তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল।
“সাপ কামড়ালে তোমায় কিন্তু ডাকব”, রঙ্গলাল হাসতে হাসতে বলল।
তিন
রঙ্গলালের সঙ্গে ডুমুরের ভাবসাব জমে গেল। এখন দুজনে গল্পগুজব হয় নানারকম। বাড়ির গল্প, নিজেদের গল্প। হাসিতামাশা। আবার অন্য গল্পও হয়। যেমন ডুমুরের বাবার গল্প। বাবাকে ডুমুর পছন্দ করে না। একটা বয়স্ক মানুষ কুম্ভমেলায় গিয়ে রাতারাতি ভোল পালটে ফেলল কেমন করে ডুমুর ভাবতেই পারে না! সাধু সন্ন্যাসী হওয়া অত সহজ! হাজারটা সাধুর মধ্যে ন’শো নিরানব্বইটা হল ‘ভেকধারী’, খায়-দায় গাঁজা চড়ায় আর বগল বাজায়। বাবা স্বার্থপর ; মাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। এ-বাড়ি কি বাবার নাকি? দিদিমার বাড়ি—মা পেয়েছিল। বাবা তো চুনসুরকি ইটের দোকান করতে করতে একদিন পালিয়ে গেল। যাবার সময় মায়ের ছ’গাছা চুড়ি আর একটা হার নিয়ে পালিয়েছে। … ভাগ্যিস—দিদিমার কিছু টাকাপয়সা মায়ের নামে জমানো ছিল, নয়ত—ডুমুররা না খেয়েই মরত।
রঙ্গলাল ডুমুরের রাগারাগি বেশি বাড়তে দিত না। বাবার কথা থেকে অন্য কথায় চলে যেত বুদ্ধি করে।
“তুমি লেখাপড়া করলে না কেন?”
“করেছি তো। স্কুল শেষ করে আর করিনি।”
“কলেজে?”
“কলেজে নলেজ বাড়ে? ছাই বাড়ে! আসুন না আপনি আমার সঙ্গে অংক কষতে, মশাইকে আমি ঘোল খাইয়ে দেব।” ডুমুর আজকাল রঙ্গলালকে ‘রঙ্গদা’ বলে। মাঝে মাঝে তুমিও হয়ে যায়।
রঙ্গলাল হেসে বলল, “আমি এম কম পাস তা তুমি জান?”
“মাস্টারগিরি রাখুন। আমি ছেলেবেলা থেকে অনেক মাস্টার চিবিয়েছি।” বলে ইশারায় বই দেখাল—মানে অংকের বই। আবার বলল, “মুখে মুখে এক মিনিটে একটা হিসেবের অংক করে দিতে পারেন? তিন হাজার তিনশো তিরানিব্বই, প্লাস পাঁচ হাজার পাঁচশো পঞ্চান্ন, ইন্টু ন হাজার ন’শো নিরানব্বই মাইনাস এক কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ তিরিশ হাজার চারশো ছেচল্লিশ হলে—তোমার অংকফল কী হবে?”
রঙ্গলাল মাথা নাড়তে নাড়তে হেসে বলল, “মুখে মুখে পারব না, কাগজ কলম নিয়ে বসতে হবে।”
“এই বুদ্ধি! পাস! কাঁচকলা।”
“যা বলেছ! কাঁদি।”
“আচ্ছা সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, চারটে চুম্বক এক জায়গায় রাখা আছে। এক কথায় কী বলা যাবে চারটে চুম্বককে? চৌচুম্বক, চুচুম্বক না চতুর্চুম্বক?”
রঙ্গলাল অট্টহাস্য হেসে ফেলল। বলল, “জানি না।”
“আচ্ছা আর-একটা প্রশ্ন। আকাশে পাশাপাশি দুটো তারা একটা থেকে অন্যটা কত দূরে থাকে।”
রঙ্গলাল এবার অবাক হল। এরকম প্রশ্ন তো ডুমুরের করার কথা নয়! সে নিজেও কোনওদিন করতে পারত না। বলল, “তোমার মাথায় হঠাৎ আকাশের তারা এল কেন?”
“বাঃ, আসবে না! আকাশের তারা দেখলে মনে হয় না, কত গায়ে গায়ে রয়েছে। তা বলে তাই কি থাকে! একটা থেকে আরেকটা হয়তো লক্ষ লক্ষ মাইল দূর।”
রঙ্গলাল বলল, “তুমি এসব পড়?”
“এ তো ছেলেবেলা থেকে পড়েছি।…আমাদের বাড়িতে দাদু-দিদিমার রেখে যাওয়া অনেক পুরনো কাগজ আছে। বাঁধানো কাগজ। কত পত্রিকা উই খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। এখনও দেড় দু আলমারি আছে!”
“যা চ্চলে। আমায় তো বলবে একবার। আমি এখানে একটাও বই পড়তে পারি না। শুধু বাসি খবরের কাগজ।”
“তা জানব কেমন করে! মুখ দেখে?” ডুমুর মুচকি হাসল। কী পড়বেন? ষণ্ডার ঘাড়ে গুণ্ডা?”
“যাঃ। ফাজলামি কোরো না।”
“ফাজলামি কেন! দিনেন রায়ের লেখা। বেশ, ‘মেসোপটেমিয়ায় প্রথম বাঙালি’ পড়বেন?”
“না।”
“তা হলে একটা উপন্যাস পড়তে পারেন, ‘ঝড়ের পাখি।’ মেয়ের লেখা। না হয় ‘পরশমণি’।”
রঙ্গলাল বলল, “যা হয় দিও।সময় কাটলেই হল।”
“ঠিক আছে এনে দেব।” …আগে ‘লুলু’-টা পড়ুন।”
“লুলু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, ‘লুলু’। …নগেন গুপ্ত।”
“তাই দিও।”
সত্যিই ডুমুর একটা করে পুরনো বাঁধানো পত্রিকা এনে দিতে লাগল রঙ্গলালকে। ভাদ্রমাস শেষ হয়ে আশ্বিনের মাঝামাঝি চলছে।
সামনে পুজো।
রঙ্গলাল সকালে কিছু জামা প্যান্ট মাটিতে ফেলে সরস্বতীকে বলছিল, এই যাবার সময় এগুলো ধোপার বাড়িতে দিয়ে যাস। বলবি আসছে হপ্তায় দিতে। বাবুর দরকার।
এমন সময় ডুমুর এল। হাতে চায়ের কাপ। আজকাল সে মাঝে মাঝে সকাল সন্ধেতে রঙ্গলালকে চা এনে দেয়। নিজেদের চা হয় যখন তখন বাড়তি এক কাপ তৈরি করে নেয়। মনোরমাই হয়তো বলে দিয়েছেন।
চা রেখে ডুমুর বলল, “আপনি বালতি তুলতে পারেন?” রঙ্গলালকেই বলল, সরাসরি।
“বালতি?”
“কুয়ায় বালতি পড়ে গেছে।”
“কেমন করে?”
“দড়ি ছিঁড়ে। পারেন তুলতে?”
“কেমন করে তুলব। আমি কি কুয়ার মধ্যে নামতে পারি?”।
“না মশাই বালতি তুলতে কুয়ায় নামতে হয় না। কলকাতার বাবুলোক—কিছুই জানেন না। বালতি তোলার কাঁটা আছে। কাঁটা দিয়ে তুলতে হয়।”
“ও। তা চৈতন্য..”
“তার জ্বর। জ্বর হয়ত একশো, কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে—আর ভবতারার গান গাইছে।’’
রঙ্গলাল চা খেতে খেতে বলল, “তুমি যদি দেখিয়ে দাও—আমি একবার ট্রাই করতে পারি। আমার আবার অফিস। তবে আজ শনিবার। দুপুর দুপুর ছুটি। বিকেলে অনেক সময় পাব।”
“তা পাবেন। তবে তখন অন্ধকার হয়ে আসবে।”
“আরে না না, অত অন্ধকার হবে না। আমার চোখ খুব ব্রাইট। দারুণ ভিশন। তবে তোমার চোখ আরও ঝকঝকে।”
ডুমুর আড়চোখে দেখল রঙ্গলালকে। মুচকি হাসল। “দেখা যাক।”
বিকেলের গোড়াতেই রঙ্গলাল ডুমুরকে নিয়ে কুয়াতলায় বালতি তুলতে গেল। দড়িতে অন্য একটা বালতি বাঁধা। বালতি খুলে ভারি কাঁটাটা বাঁধল। তারপর ঝুঁকে পড়ল। এমন সময় বৃষ্টি এল। আশ্বিনের বৃষ্টি। হঠাৎ এল এবং জোরেই। কুয়াতলার পাশে কলাগাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ। হরীতকী গাছের পাতা উড়তে লাগল। দেখতে দেখতে ঘোর হয়ে গেল আকাশও।
রঙ্গলালদের পালিয়ে আসতে হল। দু’জনেই ভিজে গিয়েছে। জামা পাজামা শাড়ি লেপটে রয়েছে শরীরে।
ডুমুর নিজেদের দিকে চলে গেল। রঙ্গলাল তার ঘরে।
জামাটামা বদলাবার সময় রঙ্গলালের ভালই লাগছিল। কুয়াতলার পারে শুয়ে বুক ঝুঁকিয়ে কাঁটা নিয়ে সে যেন চমৎকার এই খেলা শুরু করেছিল। পাশে ডুমুর। মাথার ওপর আশ্বিনের আকাশ কখন আচমকা মেঘ এনে দিল বৃষ্টি নামিয়ে। এ একেবারে ঝাপটা মারা এলোমেলো বৃষ্টি, যেন দোলনায় দুলে আসছিল বৃষ্টি, এই এল, গেল, আবার এল। কলাগাছের সবুজ পাতাগুলোও দুলে দুলে উঠছিল।
বৃষ্টি থামল। সন্ধে হল।
ডুমুর এল আরও খানিকটা পরে। মাথার চুল পিঠে ছড়ানো। ভেজা চুল তো আর বিনুনি করে রাখা যায় না। পরনে ডুরে শাড়ি। গায়ের জামাটা সাদা।
“এই যে মশাই নিন, গ্লাসে করে এনেছি। মা বলল, আদার রস দিয়ে করে দে, অবেলায় আশ্বিনমাসে বৃষ্টিতে ভিজেছে। জ্বরজ্বালা হতে পারে। নিন, আদা গোলমরিচ চায়ের মিক্সচার খান। ঘোড়া মিক্সচার।’’
চা নিল রঙ্গলাল। “তুমি খাবে না?”
“না। আমি এমনি চা খেয়েছি।”
“জ্বরজ্বালা তো তোমারও হতে পারে।”
“দূর, আমাদের শরীর অত পলকা নয়। গরিবের শরীর। দরকার পড়লে বাসন মাজতে হয়, ঘর ঝাঁট দিতে হয়…”
“ও, অ-পলকাদের জ্বর হয় না?”
“হলে শুয়ে পড়ে থাকব। আপনাকে তো আবার পুজোর ছুটিতে কলকাতায় যেতে হবে। জ্বর হলে যাবেন কেমন করে?”
“যাবার এখন আট দশদিন বাকি! বাঃ, দারুণ হয়েছে তো! থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। বসো৷”
“কত দিনের ছুটি আপনার?”
“দিন দশেক।’’
“পূর্ণিমা পর্যন্ত।”
“হ্যাঁ। আগেই তো বলেছি তোমায়।”
মোড়ায় বসে পড়েছিল ডুমুর। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে মাথার এলানো চুল ছড়িয়ে ফাঁক করে নিচ্ছিল।
“তোমাদের পাড়াতেও তো পুজো হচ্ছে প্যান্ডেল বাঁধছে দেখলাম।” “বরাবরই হয়।”
একটু চুপচাপ। তারপর রঙ্গলাল বলল, “কাল রবিবার। কাল একবার সকালে ট্রাই করব। পারব মনে হচ্ছে।”
“পারবেন না। কাঁটা দিয়ে ডোবা বালতি তোলা অত সহজ নয়! এলেম চাই। পশুপতিকে খবর দেব। তুলে দিয়ে যাবে। ওরা পারে। ওদের কাজ।”
“চেষ্টা করে দেখি…।”
“দেখতে পারেন। আপনার মুরোদে কুলোবে না।”
রঙ্গলাল চায়ের গ্লাস নামিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। তুলে নিল আবার গ্লাস। হাসল। “আমার মুরোদ সম্পর্কে তুমি সবজান্তা হয়ে গেছ?”
ঘাড় হেলিয়ে দিল ডুমুর। “আধজান্তা হয়েছি।”
“কথায় তুমি খুব পাকা।”
“আজ্ঞে, বয়েস তো কম হল না। আপনার মতন পেটভরা বিদ্যে না থাক—একটু মাথা তো আছে।”
রঙ্গলাল হাসতে হাসতে বলল, “মাথা তোমার আছে। তবু মাসিমা বলেন, ও কেমন পাগলি মেয়ে। বিধুবাবু বলেন, খেপি।”
“জানি। মুখ আছে, বলে। আমিও তো বলতে পারি…”
“কী?”
“বাদ দিন ওসব।” ডুমুর সামান্য চুপ করে থাকল। হাঁচল বার কয়েক। আঁচলে নাক চেপে থাকল দু মুহূর্ত। তারপর বলল, “কই, দাবা খেলবেন না?”
‘না। আজ আর ভাল লাগছে না। দাবাটা আমার মগজে ঢোকে না। তুমি ভালই পার।”
“মগজে কী ঢোকে!”
“আর সব ঢোকে।…আমি ক্রিকেট খেলতে জানতাম, তবলায় ঠেকা দিতে পারতাম, নাটক করেছি অফিস ক্লাবে—। তাসটাও জানি। ভালই জানি।” “ওরে বাবা, অনেক গুণ। গানও তো গাইতে জানেন।”
“খারাপ নয়, সে তুমি যাই বলো।”
“নমুনা তো পাই মাঝে মাঝে,” ডুমুর হাসল। “পরশু সকালে কী একটা যেন গাইছিলেন গলা চড়িয়ে।”
“কবে? পরশু? পরশু সকালে।…দাঁড়াও মনে করি?…হ্যাঁ, মনে পড়েছে— একটা গজল গাইছিলাম : ‘ইয়ে জান তুম না লোগে তো ইয়ে আপ জায়েগি। ইস বেবফা কি খ্যয়ের কঁহা তক্ মানায়েঁ হুস্!’ আমার গলাটা স্লাইট ভাঙা ভাঙা একটু নাকি নাকি করে গাইলে গজলে দারুণ সুট করে যায়।”
“তাই বুঝি! তা মানে কী মশাই জান তুম না লোগে না কী যেন বললেন?”
“মানে আছে। তবে বাংলায় বললে এর রস নষ্ট হয়ে যায়…। আরবি, ফারসির ব্যাপারটাই আলাদা…গজল ঠিক বাংলায় হয় না।”
“মানেটা বলুন না।”
“মানে—মানের জন্যে কেউ গান গায়! মানেটা শুনে—’’
“শুনি!”
রঙ্গলাল কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তারপর আমতা আমতা করে নিচু গলায় বলল, “মানে হল, মানে একজন লাভার বলছে এই প্রাণ আমার তুমি যদি না নাও তবে সে নিজেই আমাকে ছেড়ে যাব! মানে, আমি ডেড। ইস বেবফা কী খ্যয়ের…”
“বারে”, ঠোঁট কেটে ডুমুর বলল, “না নিলে প্রাণ ছেড়ে যাবে! কোথায় যাবে? খাঁচায় না মাচায়, আকাশে না মাটিতে?” বলে হি হি করে হেসে উঠল।
রঙ্গলাল একেবারে অপদস্থ। কথা আসছিল না! দূর শালা, বাংলায় কি ইয়ে জান তুম না লোগে গাওয়া যায়? শরিফ মিয়ার গলায় গানটা শুনলে বুঝতে পারত ডুমুর এই গানের কী ডেপথ, কী রকম এক্সটেনসান অফ সরো, কী প্রচণ্ড আকুলতা।
নিজেকে সামলে নিয়ে রঙ্গলাল বলল, “হেসে সব জিনিস উড়িয়ে দিয়ো না মিস ডুমুর। এবার আমি কলকাতা থেকে ফেরার সময় আমার টেপ রেকর্ডার আর গজলের ক্যাসেট নিয়ে আসব। তখন শুনবে। রেকর্ডার খারাপ হয়ে আছে আনতে পারিনি। আমি যদি প্রিপেয়ার হয়ে আসতাম—তোমায় শুনিয়ে দিতাম।”
ডুমুর হাসতে হাসতে বলল, “ক্যাসেট আনবে তো। এনো! প্রাণ তো আনবে না “ ডুমুর নিজের অজান্তেই তুমি বলে ফেলল।
চার
লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনই রঙ্গলাল কলকাতা থেকে ফিরে এল।
এবার অনেক জিনিস গুছিয়ে এনেছে। শীত সামনে বলে গরম পোশাক কিছু, তার শখের টেপ রেকর্ডার, যেটা সারাতে দেওয়া ছিল বলে আগের বার আনতে পারেনি, একগাদা ক্যাসেট, নিজের ক্যামেরা, এমন কি একটা চার সেলের চৌকো টর্চ, কয়েকটা থ্রিলার বন্ধুবান্ধবদের হাত ফেরতা।
ফিরে এসে দেখল, ডুমুর নেই। কোথায় গেল?
মনোরমা বললেন, আর বোলা না, আমার বড় বোন আর বোনঝিরা কিছুতেই ছাড়ল না। গিরিডি গিয়েছে। দ্বাদশীর দিন। বড় বোনঝির বিয়ে হয়েছে গত শ্রাবণে। তখন গিয়েছিল ডুমুর। এবার টেনে নিয়ে গিয়েছে নতুন জামাই, মেয়ে পুজোর সময় এসে রয়েছে ওখানে। দু-চার দিন হইচই করবে সবাই মিলে তাই। আমি আর কেমন করে না করব! আমার তো একটিই মেয়ে, সমবয়েসি সঙ্গী নেই বাড়িতে। যাক, ঘুরে আসুক। দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।
রঙ্গলালের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এরকম কথা তো ছিল না। ছুটি ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গে সে কলকাতা থেকে রিটার্ন করল, আর তুমি নেই, নতুন জামাইবাবুর সঙ্গে আহ্লাদ করতে গিয়েছ!
দুটো দিন অবশ্য এমন কিছু নয়। কোনও রকমে কাটিয়ে দিতেই হবে।
রঙ্গলাল একটা কথা ভেবেই এসেছিল। ফটকটা সে সারিয়ে দেবে। যেভাবে আছে তাতে বড় খারাপ দেখায়। কম্পাউন্ড ওয়ালের ফাঁকফোকরগুলোও মেরামত করাবে ধীরেসুস্থে। আর বাগানটাও পরিষ্কার করিয়ে মালি রাখবে একটা। হপ্তায় দুদিন মালি আসবে। এখানে ভাল গোলাপ হয়। শীত আসছে। দু-চারটে গোলাপ আর মরসুমি ফুল রাখলে মন্দ হয় না।
কিন্তু বাড়ি তো তার নয়। করবে কেন?
“মাসিমা?”
“বলো বাবা।”
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?”
“মনে করব কেন?”
“আমাদের অফিসের এক ছুতোর মিস্ত্রি আছে। তাকে বলেছিলাম, এ বাড়ির ফটকটা একটু মেরামত করে দিতে। তার কাছে ঝড়তিপড়তি কাঠ আছে। একটা কি দুটো দিনের ব্যাপার। সে করে দিয়ে যেতে চাইছে। মানে, ফটকটা ঠিক না করলে যখন তখন গোরু-ছাগল কুকুর ঢুকে যায়। সারিয়ে নেওয়াই ভাল।”
“খরচ?”
“ও কিস্যু না। আমাদের অফিসের মিস্ত্রি। অর্ধেক দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকে। …আপনি এ নিয়ে ভাববেন না। এ বাড়িতে তো আমিও থাকি।”
“যা ভাল বোঝ করো।”
রঙ্গলাল এখন শুধু ফটক নিয়ে থাকল। একসঙ্গে বেশি লাফাবার চেষ্টা করা উচিত নয়। ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে।
পরের দিনই এক ছুতোর মিস্ত্রি ধরে আনল রঙ্গলাল। অফিসের ধারেকাছেও থাকে না।বলল, একদিনে মেরামতি করে দিতে হবে। কাঠের দাম মজুরি আমি দিচ্ছি। তুরান্ত হাত লাগাও।
রাত্রে রঙ্গলাল অতি বিমর্ষ চিত্তে টেপ রেকর্ডারে সেই গজলটা বাজাতে লাগল। ‘ইয়ে জান তুম না লোগে তো ইয়ে আপ জায়েগি…”
বাইরে কার্তিকের আকাশ, কৃষ্ণপক্ষ চলছে। কত তারা আকাশে। হেমন্তের গন্ধ লেগেছে গাছপালায়, কুয়াশা নামা শুরু হল।
ডুমুর নেই। ধ্যুত—কোনও মানে হয়!
তিন দিনের দিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখল, ডুমুর এসে গিয়েছে।
বাঁচা গেল! ‘আনন্দে ভরিল মন, কুসুমসুবাস এল নিশীথ শয়নে…’
সন্ধেবেলায় ডুমুর এল। হাতে চায়ের কাপ, একটা প্লেটে দুটো বালুসাই আর সেউ নিমকি।
“কী, রঙ্গবাবু! কেমন আছেন? কলকাতায় কেমন কাটল?” মজার গলায় বলল, ডুমুর।
“তোমার কেমন কাটল গিরিডিতে?”
“মজাসে। অনেক মজা হল, হই হই। দিনগুলো যে কেমন করে কেটে গেল খেয়াল করতেই পারলাম না।’’
“হাতে ওসব কী?”
“বিজয়া করুন।”
“মাসিমা করিয়েছেন।”
“আরে এ অন্য বিজয়া, এমন বালুসাই খাননি জীবনে। বাইরে থেকে আনা। নিন, খেয়ে নিন।
রঙ্গলাল প্লেটটা নিল। বলল, “আমি ফিরে এসে দেখলাম তুমি নেই—!”
“এই রকমই হয়। আমি ফিরে এসে দেখলাম, বাড়ির ফটকটা সারাই হয়ে গেছে।”
“খারাপ হয়েছে?”
“বলেছি নাকি?”
বালুসাই মুখে দিয়ে রঙ্গলাল বলল, “বাঃ, বেশ তো?”
‘মহাদেব হালুইকরের বালুসাই। গিরিডির নয় মশাই…বাইরে থেকে আনা।”
“ভেরি গুড।…তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। সামান্য জিনিস।”
“কী?”
“দাঁড়াও খেয়েনি আগে। সুটকেসে আছে।”
রঙ্গলাল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে লাগল।
ডুমুর দাঁড়িয়ে। পরনে ছাপাশাড়ি, মস্ত বিনুনিটা পিঠের পাশে ঝুলছে। কালো মুখে যেন আলো জ্বলছে খুশির।
“গিরিডিতে গিয়ে তুমি আরও ব্রাইট হয়ে গিয়েছ?” রঙ্গলাল বলল।
“কই! বাজে কথা।”
“রিয়েলি! কী ব্যাপার বলো তো?”
“কিছুই না। খেয়েছি দেখেছি আড্ডা মেরেছি…”
“জলবাতাসের গুণ। মনের ফুর্তি।”
ডুমুর আড়চোখে দেখল রঙ্গলালকে।
খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপ তুলে নিল রঙ্গলাল। “আরে, তুমি বসবে না।” “বসছি।” মোড়ায় বসল ডুমুর।
“দাঁড়াও, জিনিসটা বার করি।” মাটিতে কাপ রেখে, সুটকেসটা টেনে বার করল রঙ্গলাল তক্তপোশের তলা থেকে। চাবি লাগানো ছিল না। খানিকটা আগে সিল্কের মাফলারটা বার করেছে রঙ্গলাল। গলায় জড়ানো ছিল। গলাটা আজ বিকেল থেকেই খুসখুস করছিল। হয়তো সিজন চেঞ্জের সঙ্গে।
রঙ্গলাল একটা কৌটো বার করল। গোল কৌটো। বেশ রংচঙে কাগজ মোড়া। কৌটো খুলে দেখাল ডুমুরকে। “এটা আজকাল মার্কেটে খুব চলছে। ফ্যান্সি জিনিস। সিলভার ব্রেসলেট। চুড়িই বলতে পার। প্লেটিং করা আছে। দু-চারটে কুচি লাল পাথর। বাজারে দারুণ ডিম্যান্ড। ফ্যাশানেবল প্রোডাক্ট। মাপটা ঠিক হল কি না কে জানে! আন্দাজে কেনা। নাও ধরো।…দেখো কেমন?”
ডুমুর নিল। দেখল।
“হাত মে লাগাও জি” ঠাট্টার গলায় বলল রঙ্গলাল। “দেখো, ফিট করে কি না?”
ডুমুর হাতে দিল। চুড়িটা তার হাতে মানিয়ে গেল।
চায়ের কাপ মাটি থেকে আগেই তুলে নিয়েছে রঙ্গলাল। চুমুক দিচ্ছিল। খুশি হয়ে বলল, “বিউটিফুল! ফিট করে গেছে! কী হাত।”
“কার।’’
“তোমার, আবার কার?”
“এর দাম কত?”
“দা-ম! যা, এ আবার কী! এসব হল শখের জিনিস, নট ফর সিন্দুক। মেয়েরা শখ করে পরে। বউদিকে দিয়ে পসন্দ করিয়ে নিয়েছি। দাম কিছু না!”
“বউদি?”
“আমার বউদি।”
“ও।”
“আচ্ছা, এবার তোমায় সেই গানটা শোনাই। ওই দেখো টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট।”
ডুমুর দেখল। হয়তো আগেই দেখেছে। কিছু বলেনি।
রঙ্গলাল নাচতে নাচতে গিয়ে ক্যাসেট দেখে টেপ রেকর্ডারে লাগিয়ে দিল।
ক’ মুহুর্ত পরেই গান শোনা গেল : ‘ইয়ে জান তুম না লোগে তো ইয়ে আপ জায়েগি…!’
গানটা ভাল।
শেষও হয়ে গেল এক সময়।
“কী! বলেছিলাম কী!” রঙ্গলাল খুশির গলায় বলল, “আমি বাজে কথা বলি না। ভাল ভালই, তা আমার কাছে তোমার কাছেও।’’
ডুমুর চুপ। আড়চোখ করে কী দেখছিল। ভাবছিল। হঠাৎ বলল, “কিন্তু অন্য একটা মুশকিল হয়ে গিয়েছে…।”
“কী?”
“ওই যে জান বলছেন—ওটা তো নেওয়া যাবে না আর।”
“কেন? কেন?” রঙ্গলাল যেন দু পা এগিয়ে গেল।
ডুমুর একটু চুপ। পিঠের বিনুনি যেন পিঠের কাছে সুড়সুড় করছিল। হাতের ঝাপটায় ঠিক করে নিল। বলল, “হয়ে গেছে।”
“হয়ে গেছে! যাঃ! হাউ হয়ে গেল?”
“ইয়ে—মানে ওই যে এবার গিরিডিতে গেলাম। তা জামাইবাবু একজনের ব্যবস্থা করেছে। বড় মাসিকে বলেছে। বাড়ির সবাইকে। ওদের পছন্দের পাত্র…”
রঙ্গলাল মাথা নাড়তে লাগল। “জামাইবাবুর পছন্দ!…কোথাকার কে…”
“ঝাঁঝায় থাকে।”
“ঝাঁঝাকে যা যা করে দাও। কী নাম?”
“নাম আবার কী? ওই ইয়ে—এমনি নাম—শ্রীবিলাস—”
“ধ্যৎ বি-বিলাস! বিড়ি বিড়ি গন্ধ। করে কি ব্যাটা!”
“জামাইবাবুর মতন রেলে চাকরি।”
“রেলওয়ে ক্লার্ক!”
“আজ্ঞে না। টিটি মিটি। বেড়াবার পাস পায়, ডিউটি নিয়ে বেরুলে দুহাতে…”
“বুঝেছি। শেম! ডুমুর তুমি এইসব হাতকে হাত বলছ। ডোন্ট কল ইট হাত ওগুলো হস্ত…ওদের হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। ঘুষ-ইটার…! প্লিজ !”
“তা আমি কী করব?”
“দেখতে কেমন?”
“চোখে দেখিনি, ফোটো দেখেছি।”
“আরে ফোটো কেউ বিশ্বাস করে। ফোটোতে দিনকে রাত করা যায়, রাতকে দিন। তোমায় ভড়কি মারছে। বিশ্বাস করবে না।…আমাকে তুমি নিজের চোখে দেখছ! কী আমি বাজে দেখতে? পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি, ওজন সাতষট্টি, এম-কম পাস, কাঁটা কারখানার অ্যাসিসটেন্ট অফিসার-ইন-চার্জ, কলকাতার নারকোলডাঙায় বাড়ি, রেসপেক্টেবল ফ্যামিলি আমাদের, বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল, ভেরি অনেস্ট ম্যান, বাবা নেই, মা আছে। দাদা বউদি বাচ্চু…। ইউ নো এভরিথিং। কোনও সিক্রেট আমার নেই।
“জামাইবাবু ওই শ্রীবিলাসদের—’’
আবার শ্রীবিলাস! কোনও ভদ্দরলোকের নাম অমন—”
“তোমার নামও তো রঙ্গলাল” ডুমুর এবার তুমিই বলল।
“রঙ্গলাল একটা ক্ল্যাসিক নাম। সেই বিখ্যাত রঙ্গলাল বাঁড়ুজ্যের—কথা ভাব। স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে..রিমেমবার! সেই রঙ্গলাল আর আমি—! তুমি ভাই প্লিজ ঝাঁঝার শ্রীবিলাস বোষ্টমকে কাটিয়ে দাও। ও তোমার চয়েস নয়, আমিই রাইট চয়েস। রাইট চয়েস বেবি!” রঙ্গলাল ঝুঁকে পড়ল।
ডুমুর হঠাৎ বলল, “ওমা, ঠিক তো! ওরা বোস্টম নয়, তবে ও নিরামিষাশী। কী ভাল! আমার আবার নিরামিষ বলেই বেশি পছন্দ।
“ছাগল!”
“কী?
“না। কিছু না!” রঙ্গলাল সরে এল। “যাক গে, তোমার কথাটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে! তুমি আমার প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করছ না? বিয়ে করতে রাজি নও!”
“বিয়ে! পুরুত ডেকে?”
“সই করেও হতে পারে।”
“যেভাবেই হোক, সেই বাসরঘর, ফুলশয্যে! ছি !”
রঙ্গলাল অবাক। “ফুলশয্যে কী দোষ করল! সবাই করে। সোশাল প্র্যাকটিস।”
“না বাবা, ওই এক বিছানায় শোয়া। তোমার সঙ্গে…। আমি পারব না। ন্যাকা ন্যাকা কথাই বা কী বলব!”
“ঝাঁঝার বেলায় কী হত? সে তোমায় কোন শয্যায় শোয়াত?”
ডুমুর আড়চোখে দেখল রঙ্গলালকে। বলল, “বারে, তাকে আমি চিনি? সে কী করত, কী করবে—কেমন করে বলব!”
রঙ্গলাল এবার অধৈর্য হয়ে পড়ল। বলল, “ও কে। চ্যাপ্টার ক্লোজড। আমি জানি, দিল হি তো হ্যায় ন সঙো-যিশু দর্দ সে ভর্ন্ আয়ে কিউ? রোয়েঙ্গা হম হাজারো বার, কোঈ হমে সতায়ে কিউ!…আমার এই হৃদয়, হৃদয়ই, ইট বা পাথর নয় যে দুঃখে ব্যথা পাবে না। যদি কেউ এই হৃদয়কে আঘাত করে তা হলে আমি না কেঁদে কেমন করে থাকি।…ও কে ডুমুর, গুড বাই…”
ডুমুর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রঙ্গলালকে দেখছিল। দেখতে দেখতে বলল, “একটা টাকা দাও তো?”
“টাকা!” রঙ্গলাল থতমত খেয়ে গেল। “টাকা কী করবে?”
“দাও না। কয়েন দেবে।’’
রঙ্গলাল আলনায় ঝোলানো জামা হাতড়ে একটা গোল টাকা বার করে ডুমুরকে দিল।
টাকা নিয়ে ডুমুর বলল, “শোনো, এটাই ফাইন্যাল। টাকাটা টস করব। হেড টেল। যদি তুমি ঠিক ঠিক বলতে পার, ঝাঁঝা বাদ ; যদি না বলতে পার তুমি বাদ! বুঝলে?”
রঙ্গলাল ঘাবড়ে গেল! এ আবার কী? কোন দরের ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ঠিক করা! টস করে বিয়ের পাত্র বাছাই। রঙ্গলাল বলল, “কী পাগলামি করছ? কয়েন টস করে এসব সিলেকশান হয়?”
“হয়! বিয়ে মানেই তো তাই! লাগলে তুক, না লাগলে তাক! সবই কপাল।..তুমি টাকা ছুড়বে, না, আমি! কে হেড টেল বলবে? তুমি বলবে!”
রঙ্গলাল ভয় পেয়ে গেল। সর্বনাশ! কল তো ভুল হতেই পারে! ক্রিকেট খেলায় এসব চলে! জীবনের খেলায় চলে না। ডুমুর সত্যিই পাগল। রঙ্গলালের ভয় করতে লাগল। যদি ভুল হয়? হতেই পারে!
“কী আমি টাকা ছুড়ব। না তুমি ছুড়বে! ডাকবে কিন্তু তুমি।”
রঙ্গলালের গলা বন্ধ হয়ে এল। “তুমিই ছোড়। তবে এটা ফেয়ার হল না ডুমুর।”
ডুমুর টাকা ছুড়ল। উঁচুতে উঠে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ার সময় রঙ্গলাল চোখ বন্ধ করে ডাক দিল, ‘হেড’।
ঠক করে মাটিতে পড়ল টাকাটা।
ডুমুর বলল, “কে দেখবে? তুমি না আমি?”
“তুমিই দেখো,” রঙ্গলালের গলা শুকিয়ে গেছে।
ডুমুর টাকার কাছে গিয়ে মাটিতে বসল। দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াল। টাকা তুলল না। খুব আক্ষেপের গলা করে বলল, “তোমার কপাল খারাপ। হেরে গেলে! কী করবে বলো! দুঃখ করো না। জীবনে কত হারজিত আছে!” বলে একটু হাসল। “আমি যাই। রাত হয়ে যাচ্ছে।”
বালুসাইয়ের প্লেট আর চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ডুমুর চলে যেতে যেতে বলল, “মন খারাপ কোরো না।…আমি তো কিসের ছাইপাঁশ! তুমি কত সোনাদানা পেয়ে যাবে। অত ভাল ছেলে! চলি।”
ডুমুর চলে গেল।
রঙ্গলাল এতটা ভাবেনি। তার মাথায় যেন ছাদ ভেঙে পড়েছে। বেচারি এখন কী করবে! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল! শালা, একটা ডাকও ঠিক মতন দিতে পারল না। বোগাস।
ঘরের মধ্যে বার কয়েক পায়চারি করল রঙ্গলাল। এ-বাড়িতে আর থাকা চলবে না। থাকলে তুষের আগুনে পুড়ে মরতে হবে। হাম ভি বনে হি রিন্দ…। আমি মদ্যপান করার জন্যে মেতে উঠেছিলাম, জানতাম না শূন্য পাত্র হাতে ফিরে আসতে হবে।…
রঙ্গলাল প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। ইচ্ছে হল, মাটিতে পড়ে থাকা টাকাটা লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। শালা, নেমকহারাম, চিট। তুই আমার পকেটের টাকা হয়ে আমায় ঠকালি!
লাথি মারতে গিয়েও লাথি মারা হল না। পিঠ নুইয়ে তুলে নিতে গেল টাকাটা। নিতে গিয়ে অবাক। চোখকে কেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। আরে শালা, এ কী! এ তো হেড। রঙ্গলাল ঠিক ডাকই দিয়েছিল। ডুমুর তাকে মিথ্যে বলল? কেন? তার কি চোখের ভুল হয়েছিল! নাকি মজা করে গেল। ইচ্ছে করেই শয়তানি করলে! দারুণ বিচ্ছু তো!
এখন কী করবে রঙ্গলাল? ডাকবে ডুমুরকে। ডুমুর যদি বলে, মশাই—চালাকি রাখো। আমি থাকতে থাকতে কেন দেখলে না! আমার সামনে? এখন টেলকে হেড করে রেখে আমায় দেখাতে ডাকছ। চালাকি!
ডুমুর তা বলতে পারে। বলা সম্ভব! অথচ ভগবানের দিব্যি, রঙ্গলাল ওই টাকা স্পর্শ করেনি।
সারা রাত তো এভাবে থাকা যাবে না। ছটফট করতে করতে মরে যাবে রঙ্গলাল। সে ভদ্রসন্তান, চিট নয়।
কেমন খেপার মতন রঙ্গলাল বারান্দায় বেরিয়ে এল।
বেশ কুয়াশা জমছে। হিম পড়ছে। তারাগুলো ঝাপসা।
“ডুমুর! ডুমুর! এই ডুমুর?”
বার কয়েক হাঁক দেবার পর ডুমুর বারান্দার ওপারে জাফরির কাছে এল।
“কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?”
“তুমি আমায় ব্লাফ মারলে! আশ্চর্য! হেডকে টেল বলে ঠকিয়ে এলে! আমি স্পষ্ট দেখছি হেড। মাই কল ওয়াজ রাইট।”
ডুমুর একটু চুপ করে থেকে বলল, “তো কী হয়েছে! তুমি দয়া করে একটু ঘাড় নুইয়ে দেখলেই পারতে! লাটের মতন দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?”
“আমি তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম।”
“এখন?”
“এখনও করছি। তুমি আমাকে নিয়ে নাচাচ্ছিলে!”
“আহা! …কত রঙ্গ জানো জাদু, কত রঙ্গ জানো! …দড়ি দিয়ে না বাঁধতেই যে এত নাচে, পরে সে কত নাচবে!…এখন ঘরে যাও! মা ডাকছে। কাল কথা হবে।”
“পাকা কথা।” বলে রঙ্গলাল প্রাণের সুখে হাসতে লাগল।