যে জীবন ফড়িঙের – ৬

ষষ্ঠ পর্ব

সবেমাত্র তপনদার কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছি। নামডাক ও হয়েছে। সেই সময় ভানুদা আড্ডা মারতে আসতেন তপনদার সঙ্গে। আমিও সেই আড্ডার সঙ্গী হতাম। একদিন এমনই একটি আড্ডায় আমি তপনদার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছি; ভানুদার প্রবেশ। বললেন— ”চিনু আছে?” তপনদা বললেন ”ওই তো বসে আছে।” সঙ্গে সঙ্গে ভানুদা আমার কাছে এসে কৌতুক নাটিকার প্রস্তাব দিলেন। জানালেন, প্রতি পুজোয় উনি কৌতুক নকশার রেকর্ড বের করেন। এবছর সেই নাটকের অন্য কুশীলবদের সঙ্গে আমিও থাকছি। আমি ভানুদার প্রিয়পাত্র জানতাম। আমাকে স্নেহ করেন, ভালোওবাসেন কিন্তু তাই বলে ভানুদার জনপ্রিয় কৌতুকনাটিকার রেকর্ডে আমার নাম থাকবে! একসঙ্গে অভিনয় করব! এ যেন স্বপ্নেরও অতীত। জিজ্ঞাসা করলাম— ”কী নাটক? নাম কী?” বললেন— ”গৌরকিশোর ঘোষের লেখা ‘হরিদাস পালের গুপ্তকথা’।’ গীতা দে, ভানুদার সঙ্গে আমিও অভিনয় করব। ভাবতেই মনে আনন্দ আর ধরছিল না। রাজি হয়ে গেলাম। হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুজোয় আমার রেকর্ড বেরোবে তাও আবার কমেডির। এ যেন অনেক পুণ্যের ফল।

ভানুদা রিহার্সালের কথা বলাতে আমি তো এক পায়ে খাড়া। আমাদের রিহার্সালের জন্য তপনদা অরুন্ধতী দেবীর ঘরটা ছেড়ে দিলেন। ভানুদা স্ক্রিপটা দিলেন। বললেন— পড়ে নিতে। হরিদাসের ভূমিকায় ভানুদা স্বয়ং। আমি তাঁর শ্যালক। গীতাদি আমার দিদি। ভানুদার নির্দেশনায় নাটকের রিহার্সাল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। নাটকের বেশ কিছুটা বাঙালভাষায়। ভানুদা ঘটিতে বলেছিলেন। আমি ঘটিভাষার কথাবার্তা বলেছিলাম বাঙালভাষায়। HMV-তে রেকর্ডিং হয়েছিল। রেকর্ডিংয়ের সময় ভানুদার টিপসগুলো মনে রেখেছিলাম। সেগুলি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। রেকর্ডিং শেষে যখন ভানুদার গাড়িতে ফিরছি তখন ভানুদা বললেন— ”তুই তো কাজ করে টাকা পেলিনা?” বললাম— ”না।” বললেন— ”এক্সপেক্ট করস তো?” বললাম— ”তা তো করি। সামান্য টাকা পেলে মন্দ হয় না।” পরে ভানুদার কাছ থেকে জানলাম, HMV-র টাকা পেতে পেতে সেই একবছর। ভানুদা তো পকেট থেকে কড়কড়ে তিনহাজার টাকা বের করে আমাকে দিলেন। বললেন— ”রেখে দে।” তিন হাজার টাকা সেই যুগে। রয়্যালটি পাব কি পাব না সেটা বড়ো কথা নয়, ভানুদা টাকা দিচ্ছেন সেটাই অনেক বড়ো ব্যাপার। আসলে ওটা আমার কাছে কেবলমাত্র টাকা ছিল না। ছিল ভানুদার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে নাটকটিকে যথার্থ রূপদান করার পুরস্কার। তখনকার দিনে HMV থেকে জনপ্রিয় না হলে রয়্যালটি পাওয়া ছিল খুব কঠিন। কাজেই ভানুদার এই তিনহাজার টাকা আমাকে দেওয়া মানে একটু বেশি পাইয়ে দেওয়া। আর কিছু নয়। এর মানে একটাই, আমি ভানুদার হৃদয় জয় করতে পেরেছি। আসলে জুনিয়ার শিল্পীর প্রতি স্নেহ, তাকে সাহায্য করা এসব ছিল ভানুদার মজ্জাগত। উদার মনের পরিচয়। বাড়ি কেনার সময় যখন কোনও গ্যারেন্টার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন মনে আছে ভানুদাই হয়েছিল আমার একমাত্র গ্যারেন্টার। চোখ বুজে সই করে দিয়েছিলেন। বড়ো মনের মানুষ। উদারতা, বিশ্বাস করা ও নির্ভরতা ছিল ওঁর চরিত্রের অন্যতম দিক। যাইহোক, রেকর্ড বের হওয়ার পর জনপ্রিয় হয়েছিল। টের পেয়েছিলাম ভানুদা গীতাদির সঙ্গে একত্রে অভিনয় করার উষ্ণতা। আজও ভুলিনি।

শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বেতার নাটকে অভিনয়ের ডাক আসতেই যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম তার থেকে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম বিকাশ রায়ের সঙ্গে অভিনয় করতে হবে একথা শোনার পর। তাই শুক্লাদির প্রস্তাব ফেরাতে পারিনি। আমার চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে বা মধ্যবর্তী সময়ে বিকাশ রায়ের সঙ্গে কখনও অভিনয় করা হয়নি। এবার বেতারে সেটা সম্ভব হবে ভেবেই পুলকিত হচ্ছিলাম। আকাশবাণীতে ঢোকার পর, বিকাশ রায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করেছিলাম— ”কী করে সুচিত্রা সেনের নায়ক হলেন বলুন তো?”

শুনে হো হো করে হাসি। বললেন— ”এমন প্রশ্ন আমাকে কোনওদিন কেউ করেনি। তুমিই প্রথম করলে। যাই হোক চেহারাটা তোমার মতো ছিল না। একটু ভালো। একটা লাবণ্য ছিল চেহারার মধ্যে। তবে তোমার মতো লাবণ্য ছিল না।” বললাম— ‘বিকাশ রায়ের মধ্যে লাবণ্য থাকবে না, তা কখনও হয়! আমি আপনার অভিনয় দেখেছি। হেমেন গুপ্তের পরিচালনা। দারুণ অভিনয়। শুনেছি আপনাকে নাকি দর্শকরা একবার উত্তেজিত হয়ে তাড়া করেছিল। অভিনয় ভালো না হলে কী আর দর্শক তাড়া করে? কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে আমার আপনার সঙ্গে অভিনয় করা হয়নি কোনও ছবিতে।”

বিকাশদা, আমি, ধীমান সবাই অভিনয় করছি বেতার নাটকে। কে কী ডায়লগ বলবে তা ঠিক হল। রিহার্সাল হল। এক মৃত ভদ্রলোকের আংটি নিয়ে গল্প। মৃত ভদ্রলোকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বিকাশ রায়। যখন সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা হচ্ছিল তখন মৃত ভদ্রলোক কথা বলে ওঠেন। বলেন, না, না আংটিটা আসলে ও পাবে। এ পাবে না। অসাধারণ অভিনয় করেন বিকাশদা। আমরা ওঁর অভিনয় দেখে অণুপ্রাণিত হয়ে আরও ভালো অভিনয় করি। নাটকের নাম আজ মনে নেই। স্মৃতি বড়ো বিপথগামী।

তবে এই নাটকের একটা মজাদার অংশের কথা মনে রয়েছে। রেকর্ডিংয়ের সময় একদিন আমার আর বিকাশদার একটা এনকাউন্টার ছিল। দু’জনেই ডায়লগ বলছি। আমার বলার পরে বিকাশদা বলবেন। কিন্তু যে ডায়লগটা বলার তা না বলে বিকাশদা অন্য ডায়লগ বলতে শুরু করলেন। আমি পড়লাম ফাঁপড়ে। কোনও সূত্র পাচ্ছি না। কোথা থেকে কী বলব এরপর বুঝতে না পেরে কাট কাট বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে গেল। বিকাশদা বললেন— ”এটা কী হল? কাট বললেন কেন?” বললাম— ”ভুল ডায়লগ বলছেন।” তারপর দেখা গেল যে পাতা থেকে ডায়লগ বলার কথা সেই পাতাটাই পড়ে গিয়েছে নীচে। ফলে উনি চলে গিয়েছেন অন্যপাতায়। সেই পাতার ডায়লগ আবার তাঁর নায়িকার সঙ্গে শেয়ার করার কথা। আমার সঙ্গে নয়। উলটোপালটা হয়ে গিয়েছে সব। ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর ফের শুরু হল রেকর্ডিং। সেদিন ‘ভুল’ ডায়লগ বলার কারণে বিকাশদা আকাশবাণীর ক্যান্টিন থেকে ডিমের ডেভিল, চা, কাটলেট এনে সকলকে খাইয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভুলের মাশুল।

পরে বিকাশদার সঙ্গে আমি একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। নাম ‘হীরে মানিক’। আমি বিকাশদার শ্যালকের ভূমিকায় অভিনয় করি। বেতার নাটকের অন্যতম সফল প্রযোজক শোভনলাল মুখোপাধ্যায় ছিল আমার বন্ধু। ও যখনই কোনও নাটক প্রযোজনা করেছে তখনই আমি ডাক পেয়েছি। শোভন অত্যন্ত গুণী। শুক্লাও খুব গুণী মানুষ। ভালো অভিনেত্রী। জগন্নাথ বসুও এঁদের দু’জনের থেকে কোনও অংশে কম যান না। বেতার নাটকের ক্ষেত্রে জগন্নাথ, শুক্লা দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছেন। বেতারে এঁরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিভাসের নামও করব এক্ষেত্রে। তবে বেতারে নাটকের ক্ষেত্রে টাকা খুবই কম পাওয়া যেত। এক হাজার টাকা। খুবই কম। ইন্টারেস্ট পেতাম না। তবু শুক্লা,শোভনের ডাক ফেরাতে পারিনি। তবে যখন আমি বেতার নাটকে অভিনয়ের ডাক পাই তখন আমার সুনাম সর্বত্র। বেতার জগৎ দিয়ে নাম করার কোনও বাসনা ছিল না। তবে ধীরে ধীরে বেতার নাটকের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে শুরু করল। পরে অজিতেশদা, সবিতাব্রত দত্তকে দেখেছি বেতার নাটকে অংশ নিতে। অনেক ভালো ভালো নাটক হয়েছে। শুনেছি। অভিনয় করেছি। সুন্দর জায়গা। সৌমিত্রদাও বেতার নাটকে অভিনয় করেছেন। শুক্লা ও শোভনের প্রযোজনাতেই বেশি নাটক করেছি। শুক্লা কাজ করিয়ে নিতে জানতেন। আর শোভন আমার প্রতি খুব লিবারাল। ”চিনুদা যা বলবে তাই হবে।” এরকম টাইপের আর কী। আমার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছিল অনেক বেশি। অন্যদিকে শুক্লা সমালোচক। শিক্ষয়িত্রী। ওঁর কাছ থেকে অনেক শিখেছি। তবে সিনেমার আউটডোর শুটিংয়ের ব্যস্তার কারণে বেতার নাটকে খুব বেশি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে বিভাস যখন ‘ব্যাপিকা বিদায়’ বেতারে করার কথা ভাবল তখন না বলতে পারিনি। আমি ঘনশ্যামের ভূমিকায় অভিনয় করি। বিভাস তো কাজ যখন করে তখন আঁটোসাঁটো নিখুঁত। সেই কাজের ভুল বের করা শক্ত। ওর সংগীতের প্রতি খুব একটা প্যাশন না থাকলেও ‘ব্যাপিকা বিদায়’ নাটকে সংগীতের অংশ সংযোজনে বিভাস ব্যতিক্রমী ভূমিকার পরিচয় দিয়েছিল। ‘ব্যাপিকা বিদায়’ সিনেমায় হিট। বেতার নাটকও হিট। সফল প্রযোজনা বিভাসের।

অন্যদিকে সফল প্রযোজক ছিলেন জগন্নাথ বসু। মনোজ মিত্রের নাট্যরূপ— প্রমথনাথ বিশীর কাহিনি ও জগন্নাথ বসুর প্রযোজনায় ‘চোখে আঙুল দাদা’ নাটকে আমি অভিনয় করি। জনপ্রিয় সেই নাটকের স্বত্ব পরে HMV কিনে নেয়। প্রায় দশহাজার টাকা পেয়েছিলাম। তবে HMV থেকে এই নাটকের কোনও ক্যাসেট বা সিডি আজও বেরোয়নি। আইনগত কোনও সমস্যা থাকতে পারে এর পিছনে। আমার ঠিক জানা নেই।

বেতারের ক্ষেত্রে আর একটা কথা বলে শেষ করব। একদিন শুক্লার কাছ থেকে খবর পেলাম, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আসছেন। দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। অপেক্ষা করছি। এলেন। খুব নস্যি নিতেন। প্রণাম করলাম। পরিচয় দিলাম। শুনে বললেন— ”নান্দীকারে তুমি অভিনয় করো তো? তোমার নাম শুনেছি। ভালো দল। কাজ করে যাও। তোমার মঙ্গল হোক।” আরও বললেন— ”আমার অনুষ্ঠান শোনো তো?” বললাম— ”শুনি। মহিষাসুরমর্দিনী।” খানিকক্ষণ চুপ। তারপর বললেন— ”এবার থেকে প্রায়ই শুনবে আমার কণ্ঠ। একটা কাজ করছি।” বললাম ”শুনব।” জীবনে যে কয়েকজন মানুষের জন্য আগ্রহে, শ্রদ্ধায় অপেক্ষা করেছি তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তুলনাহীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *