যে জীবন ফড়িঙের – ২

দ্বিতীয় পর্ব

ওহ! সে কী উত্তেজনা। আমি কলেজে যাব— যা আমাদের পরিবারের কেউ কখনওই ভাবেনি। সবাই ভেবেছিল থার্ড ডিভিশানে ম্যাট্রিক পাশ করেছে— এর এখানেই শেষ। এবার পাড়ায় নাটক-টাটক করেই চালাতে হবে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে আমি কলেজে ভর্তি হলাম। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে আর্টস নিয়ে। কলেজে পড়া, বিশেষত কো-এডুকেশন কলেজে পড়া আমার জীবনে তখন অনেক কিছু পাওয়া। আসলে সেই সময় আমার জীবনে অদ্ভুত একটা phase চলছে। থার্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি। আর আমার একটা অসুখও তখন ধরা পড়েছে— জিওর্ডিওসিস। আমার সুন্দর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছে। মুড়ি আর খই খেয়ে দিন কাটছে। পশাপাশি পারিবারিক কিছু চাপ। আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ব্যঙ্গের আঙুল তুলে কাকাদের খোঁটা। একদিকে এই চাপা কষ্ট, অন্যদিকে চোখে রঙিন স্বপ্ন— এই দু’টি স্রোত পাশাপাশি কাজ করত আমার মনে। বাইরে থেকে কেউ বুঝত না। এখনও আমার জীবনধারায় সেই দু’টি স্রোত পাশাপাশি প্রবহমান।

সে যাইহোক। আমি তো কো-এড কলেজে ভর্তি হলাম। ইচ্ছে ছিল স্কটিশ চার্চে ভর্তি হব। চান্স পাইনি। আমার কলেজকে ছোটো না করেই বলছি— আমার মতো থার্ড ডিভিশনে পাশ করা ছাত্রদের জন্য, মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ-ই আদর্শ ছিল। কলেজের প্রথম দিন বাড়িতে রীতিমতো শোরগোল। আমার মনে উত্তেজনা। মা-ঠাকুমা খুব ছুটোছুটি করছে। কাকারা একটু বাঁকা চোখে তাকালেও তখন পাত্তা দিইনি। ঠাকুমার অনুরোধে প্রথম দিনটা আমি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কলেজ গেলাম। কপালে চন্দনের ফোঁটা, অনেকটা উত্তমকুমারের ঢঙে ধুতি পরে বেরোলাম বাড়ি থেকে। হাতে ধরা ‘বুক অফ পোয়েমস’। রাস্তায় বেরিয়ে কেমন জানি মনে হল, সবাই আমাকেই দেখছে। যাই হোক বাস নিলাম— 30A, হাতে book of poems লেখা বই দেখে বাসে এক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘কী হে খোকা! ওটা কী বই?’ আমি গম্ভীরভাবে বললাম— ”দেখতে পাচ্ছেন না— বুক অফ পোয়েমস”। ভদ্রলোক আবার ফিচেল হাসি হেসে বললেন, ”অ! ক্লাস এইট-এ পড়ানো হয়?” আমি প্রচণ্ড গম্ভীরভাবে জবাব দিয়েছিলাম, ”না বি.এ-এ ক্লাসে পড়ানো হয়। কিন্তু আপনার বিদ্যে তো এইট অবধি, তাই বোঝানোর জন্য এভাবে নিয়ে বেরিয়েছি।” বাসের অনেকে হেসে উঠল। আসলে, আমার লোক হাসাতে বরাবরই খুব ভালো লাগত। তবে নিজে না হেসে। প্রাণখোলা হাসির পরিস্থিতি জীবনে খুব কম এসেছে বলেই বোধহয় অন্যকে হাসতে দেখে ক্ষণিকের আনন্দ পেতাম। এখনও পাই।

বিরাট বড়ো বড়ো ঘর মণীন্দ্র কলেজের। ক্লাসরুমে ঢুকে দেখি গমগম করছে ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে। প্রথম বেঞ্চে বসার জায়গা হয়নি। অবশ্য আমি নিজেকে বরাবরই লাস্ট বেঞ্চার ভেবেছি।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের লাস্ট বেঞ্চ জুড়ে ৭ জনের একটা দল তৈরি হল— সেভেন মাস্কেটিয়ার্স। দলে চঞ্চল ছিল সবচেয়ে গুণী ছেলে। যেমন পড়াশোনায় তেমনই চৌখস। অন্যদিকে মোটাসোটা অমল ছিল একেবারে সাধাসিধে। কিন্তু দলপতি আমি। আমাদের কলেজ যেমনই হোক, বেশ কয়েকজন ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখ্য ইকোনমিকস-এর অধ্যাপক পীযূষ দাশগুপ্ত। ইকোনমিকস পড়াবার ফাঁকে কমিউনিজম-এর পাঠ পড়াতেন পীযূষদা। একদিকে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হচ্ছি, অন্যদিকে মন খুঁজে চলে আপন মানসীকে। ঠিক যেমনটি আমি স্বপ্নে দেখি। সেই মনের মাধুরী যাকে উত্তমকুমারের মতো প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে সর্বদাই তৈরি আমি। এমনই একজনের দেখা পেলাম শ্যামবাজার কফি হাউসে। এখানে বলে রাখি আমাদের আড্ডার কেন্দ্র ছিল এই শ্যামবাজার কফিহাউস। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের মতোই এখানেও সাহিত্য সিনেমা জগতের বহু তারকা আসতেন। এখন অবশ্য শ্যামবাজার কফি হাউস ভেঙে হরলালকার কাপড়ের দোকান হয়েছে। সেই কফি হাউসে আসতেন এক ডাকসাইটে সুন্দরী। তাঁর নাম আমি বলছি না। প্রথম দর্শনে মনে বাজনা বাজলেও ক’দিনেই বুঝলাম এঁর নখের যোগ্য নই আমি। ইনি প্রেসিডেন্সির ছাত্রী ছিলেন। শ্যামবাজার কফি হাউসের বেয়ারা হরিহর থেকে মণীন্দ্র কলেজের প্রোফেসর চিত্ত ঘোষ সবাই এর রূপমাধুরী ও ব্যক্তিত্বে ধরাশায়ী। ওঁর অপূর্ব চোখের দিকে তাকিয়ে আমরাও পাগল হতাম। তবে সবটাই মনে মনে।

ভীষণ প্রিয় ছিল ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস। অধ্যাপক এস. রায় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করার ম্যাজিক অধ্যাপক রায়ের কাছে শিখতে হয়। প্রথম দিন ক্লাসে হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন, ”তোমরা সবাই ভালো করে পড়াশোনা করো। এটাই হল আরোহণের সিঁড়ি। আর হ্যাঁ স্বাস্থ্যের দিকেও কিন্তু সবাই নজর দেবে। health is wealth— wealth আর knowledge হল সব।” আমি আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে করুণ হেসেছিলাম। তারপরেই হঠাৎ অধ্যাপক রায় মিষ্টি হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”এই যে তোরা— ভালোভাবে পাস করলে সুন্দরী মেয়ে পাবি।” সবাই হেসে উঠল। এই প্রথম কোনও অধ্যাপক বন্ধু হয়ে উঠলেন। আপনি থেকে তুই সম্বোধন।

পড়ার জন্য পড়তে তো যাওয়া নয়। জীবন তখন নতুন নতুন খাতে বইতে চাইছে। ফুটবল খেলতে ছোটোবেলা থেকেই ভালোবাসতাম আগেই বলেছি। কলেজে এসে ক্রিকেট-ও area of interest-এ জায়গা পেল। নবাব পতৌদি তখন প্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন। আর ছিল নাট্যচর্চা। হ্যাঁ— ব্যক্তিগত জীবনের সব কষ্ট—পারিবারিক সমস্যা নাটক-সিনেমার মধ্যে ভোলার চেষ্টা। প্রচুর সিনেমা দেখতাম আর ভাবতাম আমার জীবনেও নায়কের মতো কখন রঙিন বসন্ত আসবে। শ্যামবাজার কফি হাউসে আমরা ৭ জন প্রায়ই নানা ধরনের নাটক নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করতাম। এমন সময় আমার রোম্যান্টিক মনে একটি মেয়ে দাগ কাটল। আমাদের ক্লাসের প্রথম সারির দিকে বসা একটি শ্যামা-তন্বী-সাধারণ অথচ সাধারণ নয় এমন একটি মেয়ে। দেখে মনে হত খুব সচ্ছ্বল পরিবারের মেয়ে সে নয়। আমি ভাবলাম কেন সুজাতা অর্থাৎ এই মেয়েটি আমার মানসী হতে পারে না? আমি সুজাতাকেই আমার প্রেমের জোয়ারে ভাসাব— একেবারে সিনেমার প্রেম দেব। সেভেন মাস্কেটিয়ার্সকে সেকথা বলতে, সবাই একবাক্যে বলল, প্রেম করতে হলে করো— খেলা করা চলবে না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কোনও cinematic মুহূর্তের, যেদিন আমি সুজাতাকে বশে আনব। এমন একটি দিন এসেও গেল। মিনারে ছবি দেখতে গেছি সেদিন। একা ছিলাম। উত্তম-সুচিত্রার কোনও ছবি ছিল। হঠাৎ দেখি সুজাতা ও তার দলবল এসেছে। আমায় দেখে হঠাৎ সুজাতা হনহন করে আমার সামনে এসে, আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আপনার কাছে ৫ টাকা আছে? দিন তো।” আমি ঢোঁক গিলে, কেশে তারপর সামলে স্মার্টলি বললাম, ”কেন দেব?” সুজাতা বলল, ”আহ! দিন না। দরকার আছে।” আমার কাছে ৫ টাকাই ছিল, তাও বার করে দিয়ে বললাম। ”এই নিন, আমার কাছে ৫ টাকাই ছিল। কিন্তু ঠিক আছে, আমি ফেরার ভাড়া জোগাড় করে নেব। আপনি রাখুন।” সুজাতা মিষ্টি হেসে বলল, ”অনেক ধন্যবাদ। কাল আপনাকে ফেরত দেব।” আমায় একেবারে spell bound করে সুজাতা চলে গেল। পরদিন রীতিমতো ‘হিরো’-র মতো ধুতি-শার্ট পরে কলেজে এসেছি। পীযুষ স্যারের ক্লাস চলছে। হঠাৎ সুজাতা উঠে স্যারকে বলল, ”স্যার আমার কিছু কথা আছে ওই যে লাস্ট বেঞ্চে-এ চিন্ময় বসে আছেন, ওকে বলব।” স্যার থমকে আমার দিকে একবার আর সুজাতার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ”বলুন আপনার কী বলার আছে।” সুজাতা যা বলল, শুনে আমার হাড় হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সুজাতা ক্লাসে চিৎকার করে বলল, ”এই যে আপনি, কাল যে টাকাটা আপনি আমায় দিয়েছিলেন, সেটা অচল, আপনাকে ফেরত দিতে চাই এই অচল টাকা।” পীযুষ স্যার বলেছিলেন, ক্লাস শেষ হলে কথা বলে নিতে। কিন্তু অপমানে আমার দু’কান লাল হয়ে গেল, আমি অচল টাকা কখনও দেখিইনি। আর সেটা কাউকে দেব? এই গল্পের রহস্য কয়েকদিন পর ভেদ হল। জানতে পারলাম, আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই নাকি সুজাতা অমন করেছিল। সেভেন মাস্কেটিয়ার্স সেনাপতি আমি— আর আমার প্রতিপত্তি ক্লাসে কমানোর জন্যই সুজাতা তার বান্ধবীদের কাছে বাজি রেখে ওই কাজ করে। আমার কোনও শিক্ষাই হয়নি। বরং আমায় জব্দ করার জন্য যে কয়েকটা মেয়ে ভেবেছে আমায় ‘শুধু আমায়’ নিয়ে এটা ভেবে আরও কলার তুলে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

ইতিমধ্যে আমাদের সেভেন মাস্কেটিয়র্সে যোগ দিল অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, জয়পুরিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্র। অজয় ফার্স্ট ইয়ার-এর মাঝখানে এল মণীন্দ্রতে। সুন্দর দেখতে, ভরাট কণ্ঠস্বরের অজয়কে প্রথম দিনই আমরা দলে লুফে নিলাম। জয় বলল, ”নাটক করতে হবে বুঝলেন? সেই জয়পুরিয়া থেকে আপনাদের ৭ জনের নাম খুব শুনেছি। তাই চলে এসেছি। সবাই মিলে একজোটে নতুন কিছু একটা করতে হবে।” নতুন উদ্যম নিয়ে শ্যামবাজার কফি হাউসে বসলাম সবাই মিলে। নাটকের প্ল্যান হতে লাগল। কিন্তু নায়িকার অভাবে বারবার তা পিছিয়ে যাচ্ছিল। নায়িকা নিজেই এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। অবশেষে পেলাম। নায়িকার সন্ধানও পেলাম।

ছন্দা সরকার, স্কটিশচার্চ থেকে একদিন হঠাৎ আমাদের ক্লাসে পড়তে এল। ঝড়ের মতো এল ছন্দা। সেটাও ছিল পীযুষ স্যারের ক্লাস। হঠাৎ সবার নজর দরজার দিকে— একজন বুদ্ধিমতী সুন্দরী মেয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। স্যারের অনুমতি নিয়ে নতুন মেয়েটি ক্লাসে ঢুকতেই লাস্ট বেঞ্চ থেকে আমরা সমস্বরে— ”নামটা জানলে ভালো হয়।” ছন্দা স্যারের অনুমতি নিয়ে সটান আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল— ”আমার নাম ছন্দা সরকার। স্কটিশে পড়তাম। সেখানে আমার জমছিল না। তাই এখানে চলে এসেছি। এখন এটুকুই থাক। বাকি কথা ক্লাসের পরে।’ আমরা ছন্দার স্মার্টনেস দেখে চমকিত। ক্লাসের পরে করিডোরে পাকড়াও করলাম। ছন্দা আমার নাম শুনে কেটে কেটে উচ্চারণ করল— ‘চি-ন্ম-য় রা-য়’। ছন্দার কথায় জানলাম স্কটিশে নাকি খুব পড়ার চাপ। আর অতিবিদ্বান ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ও মানিয়ে নিতে পারছিল না। তাই মণীন্দ্রর কোনও এক পরিচিতির প্রভাব খাটিয়ে ভর্তি হয়েছে। যাই হোক আমি একা নই, ছন্দার ব্যক্তিত্ব, শাড়ি পড়ার অদ্ভুত সুন্দর ভঙ্গি শুধু ওর অন্যরকম রূপে মোহিত হলাম সকলেই। বোকাসোকা অমল দন্তবিকশিত করে আমার কাছে আর্জি জানাল— ছন্দাকে নিয়ে কফি হাউসে আসার। কফিটা অমলই নাকি খাওয়াবে। আমার চেহারা অমন হলে কী হয়। মনে মনে তো আমি উত্তমকুমার। ছন্দাকে পাকড়াও করলাম কথায় কথায় বললাম, ”চলুন না কফি হাউসে, বসা যাক।” ছন্দা হেসে বলল, ”চলুন তাহলে গোয়ালেই বসি!” আপত্তি করেছিলাম, জানিয়েছিলাম ওই কফি হাউসেই বহু গুণী মানুষ আসে। একদিকে আড্ডা অন্যদিকে জানালার পাশের চেয়ারে বসে অন্য কলকাতার ছবি দেখাবার লোভে ছন্দাকে টেনে আনলাম আমাদের আড্ডায়।

নাটক করার ইচ্ছে বহুদিন থেকেই লালিত হচ্ছিল। নায়িকার অভাবে হয়ে উঠছিল না গোটাটা। ছন্দাকে আমরা প্রস্তাব দিলাম আমাদের সঙ্গে নাটক করার। সঙ্গে সঙ্গে রাজি। তবে জানিয়ে রাখল— রিহার্সালের পর প্রত্যেকদিন ওকে বাড়ি ছেড়ে আসতে হবে। ভালো মেয়ে কোথায় কী করে বসে, এই নিয়ে নাকি ওর মা-বাবা বড়ো চিন্তায় থাকেন। ছন্দা স্বচ্ছতোয়া নদীর মতো ছিল। সবসময় হাসছে। তবু মনে হতো মনের কোণে এ মেয়ের ব্যথা লুকিয়ে আছে— ওর গভীর কালো চোখের দিকে চেয়ে আমার তাই মনে হত। যাই হোক, আলোচনার পরে সবাই মিলে স্থির করলাম আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মালঞ্চ’ মঞ্চস্থ করব। মুখ্য ভূমিকায় আদিত্যের পাট করবে অজয় এবং ছন্দা করবে নীরজার পার্ট। আমার দেওয়া হবে বিহারী চাকরের রোল।

অতএব নাটক হবেই। কিন্তু এবার একজন ডিরেক্টর চাই। আমরা সবাই মিলেই করব তবু মাথার ওপর একজন থাকুন— এই আর কী! সেরকম একজনকে পেলাম। উত্তর কলকাতাতেই একটা ঘর ভাড়া করে চলতে লাগল আমাদের নাটকের রিহার্সাল। বাড়ির বঞ্চনা— ব্যক্তিগত হতাশা ভুলে প্রাণ ঢেলে রিহার্সাল করতাম। আমার চেহারার সঙ্গে রবি ঠাকুরের কোনও চরিত্রের মিল নেই তবু বিহারী চাকরের চরিত্র কীভাবে অন্যরকম করা যায়— মগ্ন হয়ে ভাবতাম। এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মঞ্চস্থ হল ‘মালঞ্চ’। বিভোর হয়ে অভিনয় করেছিলাম সবাই। অজয়কে যেমনটা নির্দেশ করা হয়েছিল সেরকমই অভিনয় করেছিল। সবাইকে ছাপিয়ে যায় নীরজার ভূমিকায় ছন্দা। সাধের বাগানের দিকে চেয়ে নীরজার হাসি কান্নার অব্যক্ত অভিব্যক্তি সূক্ষতার সঙ্গে ফুটে ওঠে অভিনয়ে। সেদিন আমি আর একবার নিশ্চিত হলাম— এ মেয়ের হাসির অন্তরালে কোথাও কোনও ব্যথা লুকিয়ে আছে। বিহারী চাকরের ভূমিকায় আমিও যথাসাধ্য অভিনয় করেছিলাম।

নাটক শেষ হল, গ্রিনরুমে দেখি অজয় উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করছে। আমি ঢুকতেই আমায় ঝাঁকিয়ে বলল, ”জানিস নাটক দেখতে আজ কারা এসেছিলেন?” আমি অবাক। বললাম, ”না তো! কারা?” অজয়—” ”অজিতেশবাবু। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপেন সেন।” আমি হাঁ। আমাদের নাটক দেখতে স্বয়ং অজিতেশবাবু!

তবে কেষ্টটা পেলাম পরদিন। কলেজে ঢুকতেই অজয় মহাব্যস্ত হয়ে আমায় ডেকে নিয়ে গেল। করিডোরে গিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন বাংলা তথা ভারতের নাট্য জগতের মহাতারকা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন দীপেন সেনগুপ্ত। আমি হকচকিয়ে তাকিয়ে আছি। নীরবতা ভেঙে অজিতেশদাই আগে বললেন, ”আপনিই তো চিন্ময় রায়। দেখলাম সেদিন আপনার অভিনয়। বেশ ভালো লেগেছে আমার। একটা নাটকের দল করব ভাবছি বুঝলেন? আপনারা দু’জন সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হয়।” আমি আর অজয় লাফিয়ে উঠে বললাম, ”এ কী বলছেন অজিতেশদা? আপনার মতো গুণী লোকের সঙ্গে কাজ করা তো আমাদের সৌভাগ্য।” অজিতেশদা বিনয়ী হেসে বললেন, ”বেশ তো ওই কথাই রইল। আচ্ছা ছন্দা আসবেন কি আপনাদের সঙ্গে?” ছন্দা ব্যক্তিত্বময়ী— নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়। ওর ব্যাপারে পরে কথা বলে জানাব বলেছিলাম। ছন্দা যদিও পরে আমাদের সঙ্গে নাটকের দলে যোগ দেবার জন্য উৎসাহ দেখায়নি।

নির্দিষ্ট দিনে অজিতশদার সঙ্গে উত্তর কলকাতাতেই আবার দেখা করলাম আমি আর অজয়। এক চিলতে একটা ঘর। ঋজু, ব্যক্তিত্বময় মানুষটা গমগম করছেন ঘর জুড়ে। আমরা গেলাম। অজিতেশদা গণনাট্যের কথা বললেন। বললেন, থিয়েটার হল মানুষের কাছে পৌঁছবার একটা মাধ্যম। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কলেজে পীযুষ স্যার কমিউনিজম-এ দীক্ষিত করেছেন, আর এদিকে অজিতেশদা। সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ-দুঃখ সব ভুলে যাচ্ছিলাম। মনে হল, এই যে আমার নিজের শরীর নিয়ে, পরিবার-পরিজনের বঞ্চনা নিয়ে এত কষ্ট—সব মিথ্যে। তার চেয়ে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি কষ্টে আছে। সেই কষ্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একমাত্র স্টেজ— আর অজিতেশদার বিশ্বস্ত হাত। শুরু হল আমার নতুন স্বপ্ন দেখা। নাহ, স্বপ্ন দেখা তখন এত দামি ছিল না। বরং রঙিন ছিল। নান্দীকার তখনও তৈরি হয়নি। গণনাট্যের শাখা হিসেবে অজিতেশদা একটা দল করার চেষ্টা করেছিলেন। দল তৈরি হতে থাকল। অজিতেশদা অমানুষিক পরিশ্রম করতেন। রেল-কলোনির বস্তি, বি.টি. রোডের ধারের কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে ওঠাবসা। ওদের জীবনযাপন- ভাষা রপ্ত করতেন। বলতেন, সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে গেলে ওই পর্যায়ে এসে করতে হবে। নাহলে তা জীবন্ত হবে না। সারাদিন একটা লেড়ো বিস্কুট আর জল খেয়ে মানুষটা দিন কাটাতেন। অমন tallented একজন নাট্যকার। আমার মতে ভারতসেরা। লঙ্গরখানার খিচুড়িও চেয়ে খেতেন অবলীলায়।

তো আস্তে আস্তে আমাদের দল তৈরি হতে আরম্ভ হল। কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মায়া ঘোষ— তৈরি হল নান্দীকার। ভারতের সেরা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম। দলের নাটক প্রথম স্টেজ করার উত্তেজনা যে কী! অজিতেশদা লিখতে শুরু করলেন নাটক। ‘সেতুবন্ধ’ লেখা হল। অসামান্য নাটক। আমার খুব ছোটো রোল ছিল। মাতালের চরিত্র। অজিতেশদার কথামতো রাস্তাঘাটে মাতালদের স্টাডি করতাম। দেখতাম, কথাবলার ভঙ্গি হাঁটাচলা। প্রাণবন্ত অভিনয় করতে হবে তো। প্রথম শো ছিল নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। ওপেন এয়ার তখন। নাকের তলায় স্পিরিট গামের গন্ধের পর প্রথম পেশাদারি মঞ্চাভিনয়ের অভিজ্ঞতা অনেকটা ঘোরের মতো। সব যেন গুলিয়ে গেল। শুধু মনে আছে, শো শেষে দর্শকাসনে উপস্থিত তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ”ভায়া অসামান্য প্রতিভা তোমার। তেমনই তোমাদের দলের অভিনয়। দলটাকে মজবুত করে ধরে রেখো সবাই মিলে— দল পরে নাম করবে। তুমিও।”

সেদিন বাড়ি এসে ঠাকুমাকে প্রণাম করে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। আমি জানি, আমার চিরবঞ্চিতা মা-ও সেদিন চোখের জল ফেলেছিলেন। ‘সেতুবন্ধ’-কে আমরা বলতাম নান্দীকার আর আমাদের সাফল্যের সিঁড়ি, মানে সেই আমাদের শুরু। পরবর্তী নাটক ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’। চেখভের ‘চেরী অর্চারড’ নাটকের বাংলা অনুবাদ করলেন অজিতেশদা। নাহ! অনুবাদ বলব না— সারটুকু নিলেন মাত্র। বাকিটা আপন খেয়ালে, আপন প্রতিভায় সাজালেন। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ পড়ে মনেই হল না, কোনও বিদেশি অনুপ্রেরণা আছে। বাংলার গন্ধে ভরপুর এই নাটক। বীরভূমের পটভূমিকায় লেখা হয়। জমিদারি প্রথার শেষ লগ্নের সময় সাধারণ কৃষকের যন্ত্রণা প্রত্যেক সংলাপ, দৃশ্যায়নে অদ্ভুত ভাবে ফুটে উঠেছিল। সত্যিই মনে হচ্ছিল একটা মৌলিক নাটক। প্রথম দিন শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম, আমি এ দলের সদস্য— আমি অজিতেশদার স্নেহধন্য। যাই হোক, জোর কদমে মহলা শুরু হল। আমার মনে মহিলাপ্রীতি কমে বেশ একটা ভীতি জন্মেছে। আমার রোগা চেহারার প্রতি তো আর মহিলারা কৃপাদৃষ্টি দিতেন না। অভিনয়ে তা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। তবে মহলার সময় মজা হত বেশ। অজিতেশদা চেহারার সঙ্গে মানানসই গম্ভীর। একদিন খেপাবার জন্য সকলে মিলে বললাম ”অজিতেশদা, নাটকের নাম মঞ্জরী আমের মঞ্জরী না করে বোল, আমের বোল— করলে কেমন হয়?” অজিতেশদা মজাটা না বুঝে গম্ভীরভাবে বললেন, ”না না, কোনও কাব্যরসবোধ নেই দেখছি আপনাদের।” মহিলাদের ফিগার বর্ণনা করতে গিয়ে ক্যাম্প-কোলার বোতলের তুলনা আনায় আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তবে বড়ো আপনভোলা ছিলেন। চা আর লেড়ো বিস্কুট খেয়ে দিনযাপন করে মহলা দিতাম, খিদে-তেষ্টা ভুলে। সেই সময় থেকেই পেটে সামান্য ব্যথা ও জ্বালা অনুভব করতাম। তখন অবজ্ঞা করার ফল ভোগ করেছিলাম পরে। পার্ট মুখস্থ করার জন্য বাড়িতেও ঘুরে ঘুরে জোরে জোরে পড়তাম। মুখস্থ হলে নিজের মনে অভিনয়টাকে আনতাম— মডিউলেশন দিতাম সংলাপ বলতে বলতে। ‘মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী’র প্রথম শো হল মুক্তাঙ্গনে। হল হাততালিতে ফেটে পড়েছিল। কেয়ার অসামান্য অভিনয়। অজিতেশদার ডিরেকশন আর সংলাপের যুগলবন্দি মানুষকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছিল। এ নাটকের একের পর এক শো চলতে লাগল— হাউসফুল শো। সত্তর নাইট শো চলে। মায়া ঘোষ, বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে এই অধমও কাজ করার সুযোগ পায়। মুক্তাঙ্গনে শো চলাকালীনই একদিন দেখতে এলেন পরিচালক তপন সিনহা, সত্যজিৎ রায় এবং হিরো নির্মলকুমার। শো শেষে তপনদা তার সহকারী পলাশকে (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো) দিয়ে আমায় ডাকালেন। ‘গল্প হলেও সত্যি’-র প্রথম অফার। যাই হোক সিনেমার কথা পরে আসুক। এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ, আমার জীবনে— ‘মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী’র গুরুত্ব।

এ নাটকের হাত ধরেই বাড়ির রোগা-ফেলটু ছেলেটা হিরো। নান্দীকারের সঙ্গে তখন জেলায় জেলায় শো করতে যেতাম। প্রসেনিয়ামের প্রথা ভেঙে মানুষের মাঝে গোল করে শো জমানো এই নান্দীকার এবং অজিতেশদার হাত ধরেই শেখা। এখনও মানুষকে সেই রেশ ধরে আনন্দ দিই। যাই হোক— অজিতেশদা কোনও একটা সাফল্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতেন না। এর মধ্যে আমাদের দলে কেয়াকে নিয়ে একটা গুঞ্জন তৈরি হল। মায়া ঘোষ আর অজিতেশদার আলাদা মহলা নিয়েও শুরু হল ফিসফাস। তবু মন দিয়ে নাট্যচর্চা ছাড়িনি।

নতুন নাটকের ভাবনা ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন অজিতেশদা। পিরানদেল্লোর ‘six letters in search for an author’-এর ভাবাশ্রয়ী ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। হ্যাঁ আমিও রোল পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না। প্রবল পেট ব্যথায় কাতর হয়ে স্টেজের বদলে হাসপাতাল বেডে যেতে হল। রিহার্সাল বন্ধ। ঠাম্মার কোন নাতির সহায়তায় আমাকে ভর্তি করা হল আর জি কর মেডিক্যাল হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিজের চোখে দেখলাম। নোংরা— অবহেলা—সব নিয়ে সে এক নরক। ঠাকুমার সে নাতি আর আসেনি। জেনারেল বেডে— আশেপাশের হেঁপো বুড়োর কাশি আর স্ত্রীর জ্বালায় অতিষ্ট সমবয়সির বিলাপে রাত কাটালাম দু’দিন, একদিন সকালে পিছনে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বিশাল নামধারী সাহেবিকেতাওয়ালা এক ডাক্তার এলেন। আমায় দেখার নামে পেটে এমন চাপ দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল, চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিই। তা আর করিনি। টিপেটুপে জুনিয়র ডাক্তারদের দিকে ফিরে সে আধা-সাহেব ডাক্তার জানালেন, আমার অসুখের নাম জিওর্ডিওসিস। খালি পেটে থাকা আর অতিরিক্ত চা খাওয়ার ফল। শুরু হল দিনের পর দিন আমার পেট টিপে জুনিয়র ডাক্তারদের পরীক্ষা নিরীক্ষা।

ঠাকুমা রোজ আসতেন, পাতলা ঝোল আনতেন। আমার বড়ো ইচ্ছা করত তেলেভাজা— কষা ঝাল মাংস খেতে। নাটক ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না। বেডে শুয়ে ভাবতাম, সবাই মহলা দিচ্ছে, আমার রোল অন্য কেউ করছে— চোখ বেয়ে জল গড়াত। একদিন দুপুরবেলা হাসপাতাল করিডোরে বৃষ্টিতে ভেজা একটা কাককে দেখে আমার নিজের কথা মনে এল। আমিও ওইরকম অসহায়। তারপর মজার বিষয়, ওই কাকটা ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে গিয়ে আমায় শিখিয়েছিল, পালাতে হবে। বুদ্ধি করে হাত করলাম এক বুড়ো ওয়ার্ডবয়কে। ২ টাকা ঘুষ দিয়ে, টুপি পরিয়ে পিছনের ছাইগাদার দিক দিয়ে একেবারে বাড়িতে। আমায় দেখে তো সকলে অবাক। আমি কোনও উত্তর দেবার আগেই বললাম, ”যা যা ভালো ভালো খাবার আছে এনে দাও। অনেকদিন ভালো করে খাইনি।” মা ছুটে গেল। সবার নানা বাক্যবাণে আমি চুপ। সে দুপুরে পঞ্চব্যঞ্জন চেটেপুটে খেয়ে শান্তি পেলাম। বাড়িতে নির্লিপ্ত মুখে আবার ঢপ দিলাম। বললাম, ”আমায় ওরা ছেড়ে দিয়েছে। আমি adult বলে নিজেই সই করে বেরিয়ে এসেছি।” আমার মন তখন আনচান করছে নান্দীকার নামক অমোঘ ম্যাজিকের জন্য। মনে আছে, যখন দুপুর নাগাদ নান্দীকারে পৌঁছলাম, দেখি সবাই রওনা হচ্ছে হলের দিকে। নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র স্টেজ হবে। অজিতেশদার দিকে তাকালাম। আমার চরিত্র অন্য কাউকে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। অজিতেশদা আমার কাঁধে হাত দিয়ে জানতে চাইলেন, ”কেমন আছো?” আমি কান্না চেপে বললাম, ”কেমন আর থাকব? অভিনয় করতে পারছি না— রিহার্সাল দিতে পারছি না।” অজিতেশদা— ”সংলাপ মনে আছে?” আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম— ”হ্যাঁ”। অজিতেশদা মেকআপ নিতে বলে বেরিয়ে গেলেন। আহঃ। আবার বহুদিন পরে নাকের তলায় স্পিরিট গামের গন্ধ। মাথায় ঘুরছে সংলাপ আর নিজেকে অজিতেশদার সামনে আবার প্রমাণের ইচ্ছে। শো হল। সেদিন শো শেষে সবাই আমায় জড়িয়ে ধরেছিল। কান্না চেপে আবার মজার জোকস বলে ভারী মুহূর্ত কাটালাম।

এরপরে আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। এখন বুঝি সেটা বড়ো ভুল ছিল। আমরা ৯ জন একদিনের একটা মিটিং ডেকে নান্দীকার ছাড়লাম। অনেকগুলো কারণ আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ফাটল আনছিল। মায়া ঘোষের সঙ্গে অজিতেশদার আলাদা রিহার্সাল, অজিতেশদার একনায়কতন্ত্র— সব মিলিয়ে আমাদের তখন রক্ত গরম। ছাড়লাম নান্দীকার। কারণ দেখালাম অজিতেশদার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক পার্থক্য। নাহ! অনবদ্য সংলাপ স্রষ্টা অজিতেশদা সেদিন কোনও কথা বলেননি। শুধু নীরবে বিদায় দিলেন। নান্দীকারে প্রথম ভাঙন।

আমরা ৯ জন অর্থাৎ বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অজয় গাঙ্গুলি, আমি আর বাকিরা মিলে গড়ে তুললাম ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’। রাতের পর রাত একচিলতে একটা ঘুপচি ঘরে আমাদের প্ল্যানিং শুরু হল। বিভাস ইনটেলেকচুয়ালি বেশি শার্প। নাটক নির্বাচনের দায় পড়ল ওর। হ্যাঁ অসাধারণ নাটক বাছল। জাঁ পল সাত্রেঁর ‘লা গ্যির প্রস্পেক্টেস’ বা ‘The respected Prostitute’ বাংলা অনুবাদ করল সত্যেন মিত্র। অনবদ্য অনুবাদ। তৈরি হল সার্ত্রের ভাবালম্বনে নাটক ‘ললিতা’। সার্ত্রের গল্পের নায়িকা যৌনকর্মী সেই শ্রদ্ধেয়া নারী। যে সময় মূল নাটকটি লেখা তখন সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব চলছে। শ্বেতাঙ্গ পাড়ার এক বারবণিতা, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তার প্রাণ বাঁচায় শ্বেতাঙ্গ গুণ্ডাদের হাত থেকে। প্রেক্ষাপট পালটে দিল বিভাস। আমাদের ‘ললিতা’-নাটকে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হল প্রেক্ষাপট। পতিতাপল্লির নামকরা যৌনকর্মী ললিতা হিন্দু গুণ্ডা এবং পুলিশ মন্ত্রীর হাত থেকে একজন গরিব মুসলমান ছেলেকে কীভাবে বাঁচালো সেই গল্প। লেখা ও স্টেজ-এর ব্যাপারে আমরা বারবার কনফিউজ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি অশোক আর বিভাস তখন দিনরাত ‘ললিতা’-র ভাবনার মশগুল। সেইখান থেকে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব— যা আজও অটুট।

নাটকের এক অংশে ছিল, ললিতার বাড়িতে লুকোতে গিয়ে সেই গরিব ছেলেটি বাথরুমে ঢুকে পড়ে। স্টেজে ঘরের মধ্যে কীভাবে ওই বাথরুম বানাব তা নিয়ে আমরা দ্বিধায় পড়ি। তাছাড়া সম্ভ্রান্ত যৌনকর্মীর পোশাক— ঘর কেমন হবে তা-ও জানতাম না। দুঃসাহসিক ভাবনা এল মাথায়। সোনাগাছিতে যাতায়াত আছে এমন একটি ছেলের সঙ্গে আলোচনা করে সে সময়ে সোনাগাছিতে সবচেয়ে অভিজাত যৌনকর্মীর বাড়ি গেলাম। দুরুদুরু বুকে আমি আর বিভাস প্রথম পতিতাপল্লিতে পা রাখি। পরিচিত কেউ দেখলে, বাড়িতে জানলে মেরে ঠ্যা*ং খোঁড়া করে দেবে। চারদিক দেখে ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম সে মহিলার বাড়ি। প্রথম দেখায় চমকে গেছিলাম। এমন সুন্দরও মানুষ হয়। বড়ো-ঘর— স্টিল-আলমারি মিলে আসবাব ভালোই। আর একটি ছোটো ঠাকুরের সিংহাসন— ফুলে সাজানো। মহিল মিষ্টি হেসে বললেন, ”বলুন কী সাহায্য করতে পারি আপনাদের?” বিভাস আমতা আমতা করে জানাল আমাদের প্ল্যান। মহিলা হাত দিয়ে ভেতরের ঘর আর বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। হ্যাঁ একদম আমাদের স্ক্রিপ্ট মাফিক ঘর বটে। ললিতার ঘরে লুকোতে এসে দরিদ্র মুসলমান ছেলেটি বাথরুমের যে কোণে লুকোবে— তার প্ল্যানিং-ও পেয়ে গেলাম। আমরা যারপরনাই খুশি। বসার ঘরে মহিলার কাছে ফিরে দেখি আমাদের জন্য চা মিষ্টির ব্যবস্থা বসলাম। নানা কথা হতে লাগল। ভদ্রমহিলা (নাম বলব না) জেনে খুশি হলেন খুব আমরা নাটক মঞ্চস্থ করছি এমন বিষয় নিয়ে। তারপর এমন একটা কথা বললেন আমরা দু’জন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বললেন, ”আপনারাও এন্টারটেইন করেন, আমরাও। দুজনেই টাকার বিনিময়ে মানুষকে আনন্দ দিই। তবু দেখুন আপনাদের শুধু সম্মান জোটে আর আমাদের কাদার ছিটে।” কান্না চেপে আমি আর বিভাস পালিয়ে এসেছিলাম। আজও আমার জীবনে খারাপ সময় এলে, ওই মহীয়সী মহিলা ইন্সপিরেশন হয়ে স্বপ্নে আসেন।

স্টেজ করলাম। নামভূমিকায় মায়া, মুসলমান চরিত্রে আমি। মুক্তাঙ্গনে প্রথম শো। মেক-আপ নিচ্ছি, বিভাস দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল— নাকি হাউসফুল। আসলে ললিতা নাম শুনে অনেকেই ভেবেছিলেন এটা নভককোভের লোলিতা— তাই হল উপচে লোক। যাই হোক ‘ললিতা’র হল উপচানো ভীড় আমরা প্রত্যেক বার পেয়েছি। মায়ার অভিনয় আর আমার অভিনয়ের পর দর্শকরা চোখের জল মুছতে মুছতেও বেরোতেন। এই নাটকের রিহার্সাল, অভিনয়— প্রত্যেক সময় নান্দীকার আর অজিতেশদাকে মিস করতাম। মনে হত, নাহ! এভাবে দলটা ছাড়া একদম ঠিক হয়নি। ব্যক্তিগত ঝামেলা— ইগো এইসব গণ্ডি ভেঙে যদি দলটার কথা ভেবে অজিতেশদার পাশে থাকতাম, তাহলে নান্দীকার আজ ভারতের শ্রেষ্ঠ দল হত। সে কথা যাক ‘ললিতা’-য় ফিরে আসি। সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। কারণ এরপর থেকেই থিয়েটার ছেড়ে আমার ‘ফিলমি’ জীবন শুরু। সেই যে ‘মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী’র সময় তপনদার ডাক পাওয়া। সেই শুরু হল টলিপাড়ায় ঘাঁটি গাড়া। ‘ললিতা’র পরেও আর একটা নাটক আমি থিয়েটার ওয়ার্কশপের হয়ে করি— ‘ছায়ায়-আলোয়।’ অশোক আইরিশ একটি গল্প থেকে ভাবানুবাদ করেছিল। আমাদের কলকাতায় তৎকালীন বস্তিবাসীদের নিয়ে তাদের সমস্যার প্রেক্ষাপটে অনবদ্যভবে সাজায় নাটকটা। এই নাটকেই প্রথম আলো করেন তাপস সেন। অসামান্য স্টেজ করেছিল বিভাস। একটা স্টেজে দুটো ভাগে অভিনয়— গলির এফেক্ট-সব দুর্ধর্ষ হয়েছিল। ‘ছায়ায় আলোয়’-এর সব ক’টা শো হাউসফুল হত— হল ফেটে পড়ত হাততালিতে। আর আমি ভাবতাম, হলভর্তি দর্শকের এই হাততালির শব্দ আর বেশিদিন আমার কানে বাজবে না।

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার অভিনয় জগতের শুরু। তিনি কোনওদিন থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক দেখতে এসে -ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে, আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন। উত্তর হল— না। ‘হাটেবাজারে’ ছবির আউটডোরে অজিতেশদাকে বলেছিলাম নাটক দেখতে আসার ব্যাপারে। উনি না বলেছিলেন। আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। তবে অজিতেশদা নিজে না এলেও নান্দীকারের অনেক সভ্য, যেমন— অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপেন সেনগুপ্তরা এসেছিলেন থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক দেখতে। ওঁরা নাটক দেখেছেন। সমালোচনা করেছেন। পরবর্তীতে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাদের দলের নাটক দেখতে এসেছিলেন কিন্তু তাঁর খুব ভালো লাগেনি। কোনও প্রশংসাসূচক বাক্য তাঁর মুখ থেকে বেরোয়নি। তবে মনোজ মিত্র, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নাটকের। হয়তো বা অজিতেশবাবু খুব ভালোভাবে নেননি থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রযোজনা। উনি আসলে আমাদের নাটককে অবজ্ঞা করার মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন যে আমরা নান্দীকার থেকে বেরিয়ে এসে ভুল করেছি। নাটকের অ আ ক খ কিছুই জানি না। পরিচালনা-প্রযোজনা-অভিনয় কিছুই বুঝি না। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা আসলে বালিতে সৌধ নির্মাণের মতোই অবাস্তব। তবে ওঁর ধারণা যে ভুল তা প্রমাণিত হল খুব তাড়াতাড়ি। ‘ললিতা’-র পরের প্রযোজনা ‘ছায়ায় আলোয়’। নাটকটি আমি আর বিভাস যৌথভাবে পরিচালনা করেছিলাম। আমার চরিত্রটি ছিল মাতালের। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাতি পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন। মাতাল, ভবঘুরে একটি লোক সেই খবরটা দিতে এসেছে বাড়িতে। পাঁচ মিনিট কোনও মিউজিক ব্যবহার করা হয়নি। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল চরিত্রটি। মনে আছে, ডায়ালগ বলতে বলতে যখন বেরিয়ে যেতাম— গলাটা কান্নায় বুজে গিয়ে কথা আলতো করে বাতাসে ভেসে বেড়াত— তখন মুগ্ধ দর্শক, বোদ্ধা দর্শক হাততালিও দিতে ভুলে যেতেন।

তিন বছর কাটিয়েছি থিয়েটার ওয়ার্কশপে। অশোক-বিভাস- মনোজদের হাতে ওয়ার্কশপের ভার তুলে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। কোনও তিক্ততা হয়নি। ওরা আমার বন্ধু। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেছি। বিভাস খুব ভালো সেট ডিজাইন করত। ওকে আমি ওদিকটা ছেড়ে দিতাম। আমরা ভালো বন্ধু। প্রায় সমবয়সি। কোনওদিন কাজ করতে গিয়ে ‘ইগো’-জনিত সমস্যা হয়নি। যেমন ‘ললিতা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার আগে তার নাম নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। কী নাম দেওয়া যায়! এসব নিয়ে ভেবে যখন কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না তখন হাল ধরতে এগিয়ে এল বিভাস। ও আবার নাটকের ব্যবসায়িক, বিপণনটা ভালো বুঝত। বুদ্ধিমান ছেলে। নাটকের নায়িকার নামে হল নতুন নাটকের নাম— ‘ললিতা’। আমরা বললাম, কেন ‘পতিতা’ তো ভালো ছিল। বিভাসের উত্তর— পাবলিক খাবে না। জনগণের চাহিদা ও ইচ্ছা বিভাসের থেকে ভালো কেউ বুঝত না। এই প্রসঙ্গে আর একটি নাটকের কথা এখানে বলতে হয়। ‘হাঁড়ি ফাটিবে’। উৎপল দত্তের লেখা নাটক। রিহার্সাল যখন চলছে তখন বিভাস আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিল— ‘উৎপল দত্তের হাঁড়ি ফাটিবে’ থিয়েটার ওয়ার্কশপ। মজার বিজ্ঞাপন। শোভাদি তো সেই বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের ডেকে পাঠালেন। বিভাস, আমি গেলাম উৎপলদার বাড়ি। শোভাদি বললেন— ”এটা কী হল বিভাস, চিন্ময়। এমন ধরনের বিজ্ঞাপন দিলে কেন? উৎপল দত্তের হাঁড়ি ফাটিবে।” আমরা আমতা আমতা করাতে উৎপলদা জোরে হেসে উঠে বলেছিলেন— ”ঠিকই তো করেছে। সকলেই হলে গিয়ে দেখবে উৎপল দত্তের লেখা নাটক। নাটকের ভালো পাবলিসিটি হল। নতুনত্ব বটে।” উৎপলদা গোটা বিষয়টিকে দারুণ স্পোর্টিংলি নিয়েছিলেন। নাটক দেখার পর অবশ্য শোভাদির রাগ পড়ে গিয়েছিল। ঝগড়া হয়নি। সত্যেন মিত্র বলে আমাদের একজন বন্ধু ছিল। তার নাটকসম্পর্কীয় অনেক সাজেশন আমরা নিতাম। অসম্ভব পড়াশোনা ছিল সত্যেনের। নকশাল পিরিয়ডের সময় ওকে খুন করা হয়েছিল।

এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও থিয়েটার ছাড়তে বাধ্য হয়েছি একটি কারণে, তা হল অর্থ। থিয়েটার আমার প্যাশন। ভালোবাসার জায়গা। কিন্তু সেখানে অর্থ নেই। সিনেমায় অর্থ রয়েছে। থিয়েটারে অভিনয় করার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার অফারও আসা শুরু হল। আমি দু’নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাইছিলাম না। তাছাড়া রিহার্সালে সময় একটা ব্যাপার ছিল। আমি সময় দিতে পারছিলাম না। আমার যাওয়া-আসা নিয়ে দলের মধ্যে হুইসপারিং শুরু হয়েছিল। একে দরিদ্র দল। তার উপর এমন ধরনের ব্যাপার-স্যাপার। বেরিয়ে আসাই সমীচীন মনে করেছিলাম। থিয়েটার ওয়ার্কশপকে অবশ্য পরে বিভাস কৃতিত্বে গুছিয়ে তুলেছিল। থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রযোজনায় একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়— ‘ভিয়েতনাম’। নান্দীকারের পক্ষ থেকে নাটকটির সম্পর্কে নেগেটিভ কথাবার্তা বলা শুরু হয়। সকল সদস্যকে অনুরোধ করা হয়েছিল নাটকটি না দেখার জন্য।

যাই হোক, আমাকে সংসারের হাল ধরতে হবে। অর্থ চাই। অতএব সিনেমায় অভিনয় করা ছাড়া সামনে অন্য কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। চাকরি করার ইচ্ছা কোনওকালেই ছিল না। সুযোগ একবার এসেছিল। কাশীপুরে গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সোর্স অ্যাপ্লাই করা হয়েছিল। কিন্ত আমার ইচ্ছা ছিল না। বরং মুদিখানার ব্যবসায় ইন্টারেস্ট ছিল। মাছের ব্যবসায় আগ্রহ ছিল। থিয়েটার ওয়ার্কশপের খ্যাতি যখন ধীরে ধীরে বাড়ছে সেই সময় ফাটল ধরা শুরু হল নান্দীকারে। এসব খবর কখনও চাপা থাকে না। নান্দীকারের ভাঙনের শব্দ শোনা গেল থিয়েটার ওয়ার্কশপের অন্দরমহলে। ফিসফিস-গুনগুন থেকে জোরে, সহাস্যে, সদর্পে। আমি অবশ্য জানতাম সে অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদ কেমিস্ট্রি কখনই মিলবে না। মিলতে পারে না। অজিতেশের প্রখর ব্যক্তিত্ব, নাট্যচিন্তা, শিক্ষাদীক্ষা, রোমান্টিকতার সঙ্গে রুদ্রপ্রসাদের কঠোর বাস্তবতা, চরম পড়াশোনা, তুখড় বুদ্ধিবৃত্তির সংঘাত বাধবেই। তাই হল। সেইসময় আবার কেয়া যোগ দিয়েছে নান্দীকারে। প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী মেয়ে। অজিতেশ রুদ্রপ্রসাদ কেয়া— তৈরি হল ত্রিভুজ। ভাঙনের কবলে পড়ল নান্দীকার। মূলত ব্যক্তিত্বের সংঘাতেই নান্দীকারে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রোধ করা যায়নি।

‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ ছোটো দল। স্থায়ী কোনও মঞ্চ ছিল না। বেশিরভাগ সময় পেতাম আকাদেমি, মহাজাতিসদন, গিরিশমঞ্চ। সেখানেই মঞ্চস্থ হত নাটক। অন্য দিকে নান্দীকার বড়ো দল। প্রতিষ্ঠিতও বটে। সেইসময় ‘রঙ্গনা’ পরিচালনার ভার গণেশবাবুর দৌলতে এসে পড়ে অজিতেশদার উপর। তিনটি দুর্দান্ত নাটক নামিয়েছিলেন অজিতেশদা। অকল্পনীয় ছিল যার বক্স অফিস। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘নটী বিনোদিনী’ ও ‘বিতংস’। পাশাপাশি আমাদের নাটক ছিল ‘ললিতা’, ‘ছায়ায় আলোয়’। মনোজদার পরিচালনায় একটি নাটকের রিহার্সাল চলছিল। নামটা আজ আর মনে নেই। বয়সের কারণে স্মৃতি মাঝেমধ্যেই বিপথগামী হয়ে পড়ে। তবে এটুকু মনে আছে বিভাস ওই নাটকে মারাত্মক অভিনয় করেছিল। নান্দীকারের খবরাখবর রাখতাম। ওখানে কী ধরনের কাজ চলছে তার খবর আসত এখানে। অজিতেশদা নিজে কোনওদিন থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক না দেখতে এলেও অনেক সদস্য লুকিয়ে আসত। অনেকে আবার সরাসরি আসত। তবে আমাদের মন সংকীর্ণ ছিল না। আমরা দলবেঁধে বা একা দেখতে যেতাম নান্দীকারের নাটক। সেই সময় কেয়া নান্দীকারে। কেয়া সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমি ওর রূপ-গুণ দু’টোতেই মুগ্ধ ছিলাম। কাজলকালো চোখ। ওর সঙ্গে একাঙ্ক নাটকও করেছি। কেয়াকে প্রপোজ করার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু কেয়ার ব্যক্তিত্ব ও পড়াশোনা দু’টোই আমার থেকে অনেক অনেক বেশি। আমার প্রস্তাবে ও ‘না’-ই বলত। তাই আর এগোতে সাহস পাইনি। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অনেকবার আমাদের নাটক দেখতে এসেছেন। আর আসতেন পবিত্র সরকার। অধ্যাপক। খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। সেই সময় নান্দীকারের একটি নাটকে তিনি অভিনয় করেন। আর জনপ্রিয় হয়ে যান একরাত্রেই। শ্যামবাজার থেকে রাসবিহারী টালিগঞ্জ পর্যন্ত মুখর ছিল পবিত্রদার নামে।

একটা সময় গিয়েছে যখন আনন্দবাজার-এ নান্দীকার ও থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর নাটকের সমালোচনা একসঙ্গে বেরিয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবই পড়তাম। শুক্রবার করে বেরোত সমালোচনা। বিভিন্ন কাগজে লিখতেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেবাব্রত গুপ্ত, মৃগাঙ্কশেখর রায়। সত্যি কথা বলতে কী নান্দীকারের কোনও নাটকই খারাপ হত না। কেয়া তখন মধ্যমণি। খ্যাতির তুঙ্গে। নান্দীকারের একটার পর একটা নাটক হিট আর কেয়ার প্রশংসা সর্বত্র। এরই মধ্যে যখন নান্দীকার ভাঙল তখন সত্যিই খুশি হয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম, অজিতেশদা আপনি কাউকে নিয়ে থাকতে পারলেন না। আমরা বেরিয়ে এলাম। আজ রুদ্র কেয়াদের সঙ্গেও আপনি মানিয়ে নিতে কপারলেন না। পরে অবশ্য নিজের কাছে নিজেই ক্ষমা চেয়েছি। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। অজিতেশদা আমার গুরু। অভিনয়ের ভিত্তিপ্রস্তর উনিই রচনা করে দিয়েছেন। জীবনে অভিনয় করে সংসার প্রতিপালন করছি তা তো ওঁর জন্যই। উনি না শেখালে কার কাছে শিখতাম। সবাই তো আর জীবনের শুরুতে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষাগুরু পায় না। আমি পেয়েছি। সৌভাগ্যবান। হতে পারে ওঁর ব্যক্তিত্ব সুবিশাল তাই সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারতেন না। তার অর্থ এই নয় যে, মানুষটি খারাপ। রুদ্রপ্রসাদের পড়াশোনা যত গভীরই হোক নাট্যশিক্ষক হিসাবে অজিতেশদা সবার আগে। অমন ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, সেট ডিজাইনিং, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বোধ সেই সময়ে কারওর ছিল না। আজও আছে কিনা সন্দেহ। দল ভেঙে যাওয়ার পর অজিতেশদা নতুন নাটক করেন। নাম— ‘পাপপূণ্য’। সেরা দশটি বাংলা নাটকের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে এটি। জীবনে এক নারীতে স্থির হননি অজিতেশদা। অসিতদার বান্ধবীকে বিবাহ করেন। দ্বিতীয়া স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন উল্টোডাঙায়। অজিতেশদার মৃত্যুর খবর আমার কাছে অনেক দেরিতে এসেছিল। তখন আমি পাকাপাকিভাবে থিয়েটার ওয়ার্কশপ ছেড়ে সিনেমায় প্রবেশ করেছি। শুটিংয়ের কাজে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সব শুনি। ‘ব্রিলিয়ান্ট’— অজিতেশদা সম্পর্কে এই ইংরাজি শব্দটি উচ্চারণ করা যায়।

জীবনে যখনই স্টেজে পরিচালনা করেছি তখনই সেই পরিচালনার উপর অজিতেশদা, বিভাস, অশোকের প্রভাব এসে পড়েছে। এই তিনজনকে এড়িয়ে আমি কখনই কিছু করিনি। করতে পারিনি। আর দল ভেঙে যাওয়ার কথা যদি বলতে হয়, তবে কেবল নান্দীকার কেন— বহুরূপীর মতো দলও তো ভেঙে গিয়েছিল। শম্ভু মিত্র বেরিয়ে এসেছিলেন। কুমার রায়ের উপর গিয়ে পড়ে বহুরূপীর দায়িত্ব। উৎপলদার পি এল টি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রবি ঘোষদা, সমরেশদা, উমানাথ ভট্টাচার্য। আসলে ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই জীবন। নাটক তো জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। বরং জীবনের নির্যাসটি তো থিয়েটারের বুনিয়াদকে মজবুত করে। থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর বাইরে অভিনেতৃ সংঘের হয়ে একটি নাটক করার প্রস্তাব আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু চরিত্র পছন্দ না হওয়ায় আমি অভিনয় করিনি। একটা কথা জোর গলায় বলতে পারি, থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কাজ হত। সেই সময় অন্য কোনও দলে এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ ছিল কিনা সন্দেহ। আজও বোধহয় নেই। নানাদিক থেকে তো তেমন খবরই পাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *