তৃতীয় পর্ব
রুপোলি পর্দা— স্বপ্নের জগৎ, ম্যাট্রিকে থার্ড ডিভিশনে পাস করা সেই আমি কখনও ভাবিনি যে সিনেমায় কাজ করব। হাজারও লোক আমার দেখবে— ছুঁতে চাইবে। সেই বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো আমিই নাকি গেলাম সিনেমায় কাজ করতে। বাংলা চলচ্চিত্রে আমায় হাত ধরে এনেছিলেন তপনদা। তপন সিনহা। ‘মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী’ করার সময় মুক্তাঙ্গনে তপনদার কাছ থেকে ছবির অফার পাওয়র গল্প আগেই বলেছি। থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর হয়ে ‘ললিতা’ করার মাঝেই আমি প্রথম ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’ করে ফেলেছি। তাই ‘ললিতা’ করার সময়েই তপনদার পরের ছবিতে ডাক পাওয়ার সূত্র ধরেই বুঝলাম, এবার স্টেজ-কে টা টা বলতে হবে। কারণ সিনেমা আর থিয়েটার আমি চালাতে পারব না একসঙ্গে। মন চায়নি থিয়েটার ছাড়তে, কিন্তু কদ্দিন আর ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়াব? ‘ছায়ায় আলোয়’ করতে করতেই বুঝতে পারছিলাম নিঃশ্বাস চেপে আমায় স্টেজ-কে বিদায় দিতে হবে।
‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে চাকরের রোলে অভিনয় করেছিলাম। ছোটো রোল। কিন্তু বেশ প্রশংসা পেয়েছিল পরে। তপনদা যেদিন স্ক্রিপ্ট শোনাচ্ছিলেন গম্ভীর গলায় বললেন, ”ছোটো রোল, করবেন কিনা দেখুন।” আমি তো হাতে চাঁদ পেয়েছি তখন। তপনদার ছবিতে কাজ করব না— তাও হয়? প্রথম দিন শুটিং-এ গেলাম। আমি একেবারে নতুন। ছবিতে বাকিরা সব সেসময়ে রুপোলি পর্দার নক্ষত্র। ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, রবি ঘোষ, তুষার মিত্র— আরও কত বলব। আমার কাছে থিয়েটারের পরিচিত— ওই light-sound-action— এখানে সব অচেনা। বাকিদের হাঁ করে দেখছি। বিশেষত ছায়া দেবীকে। সমস্ত রকম চরিত্রে ওঁকে অভিনয় করতে দেখেছি। আমার কাছে বাংলা ছবির জগতে সাবিত্রী ছাড়া আর একজন বহুমুখী অভিনেত্রী যদি কেউ হয়ে থাকেন তো তিনি ছায়া দেবী। তো প্রথম দিনের শ্যুটিং শেষ হল। আমার স্বপ্নের ছায়া দেবী আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ‘আপনি’ করে কথা বলতেন। আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ”দেখুন ভাই, আপনি অভিনয়টা কখনও ছাড়বেন না।” এ আশীর্বাদ আমার পাথেয় হয়ে থাকল। ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবির প্রিমিয়ার হয়েছিল গ্লোব-এ। বাংলা ছবির বড়ো বড়ো নক্ষত্ররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিনেমা শেষে কাননদেবী এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। পিঠে হাত রাখলেন। যে সৌন্দর্য আর অভিনয় রুপোলি পর্দায় এতদিন দেখে আমি মুগ্ধ ছিলাম, তা আমার সামনে, আমি হতবাক। ভুবনমোহিনী হাসি হেসে কানন দেবী স্নেহের সুরে বললেন, ”তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোটো। আশীর্বাদ করি অনেক বড়ো হও। আর অভিনয়টা মন দিয়ে করে যাও। অনেক দূর যাবে তুমি!” আমি সেদিন চোখের জল চেপে রাখতে পারিনি।
প্রথম ছবি— ‘গল্প হলেও সত্যি’। ক্যামেরাম্যান ও শিল্পীর মধ্যে সম্পর্ক। লাইটের। জোনের। বৃত্তের মধ্যে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। ক্যামেরাম্যান ছিলেন দীপক মুখোপাধ্যায়। আলোকবৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে মনে বিড়বিড় করছিলাম সংলাপ। একটু টেনশন ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম— টেনশন ধাতে সয় না। তাই ওটাকে দূর করে দিয়েছিলাম। ক্যামেরাম্যানের সহকারী এলেন। লাইট মাপলেন ফিতে দিয়ে। আলো কমল। সহকারী ক্যামেরাম্যান বলেছিলেন— ”আচ্ছা আপনি বাঁ-পায়ের উপর জোর দিয়ে দাঁড়ান কেন? এর ফলে তো আলোর বৃত্তের অর্থাৎ যেখানে স্পট পড়েছে তার থেকে সরে যান।” আমি তা কিন্তু জানতাম না। সচেতনভাবে নয়। অচেতনভাবেই করতাম। উনি বললেন— ”আপনি এবার থেকে ডান পায়ের উপর চাপ দেবেন, যখন সংলাপ বলবেন। তাহলে বৃত্তের বাইরে যাবেন না। আপনার উপরই আলো পড়বে।” আমার উপর আলো পড়ুক সেটাই তো চেয়েছিলাম। ছোট্ট উপদেশটা সারাজীবন মেনে চলেছি। মনেও রেখেছি। ওঁরও নাম ছিল দীপক। দীপকদা। প্রথমদিন থেকে ক্যামেরা ও তার অ্যাঙ্গেলগুলিকে জানার চেষ্টা করেছি। বিগ ক্লোজ আপ, ক্লোজ আপ, মিড শট, মিড লং, লং— অ্যাঙ্গেল অনুযায়ী, নিজের অভিনয় পরিবর্তিত হত। সংলাপও সেভাবে বলতাম। কেবলমাত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পুতুলের মতো অভিনয় করে যাওয়া নয়, পরিবর্তে ক্যামেরাকে বোঝা, জানা, অভিনয়কে ভালোবাসা। সবই খুঁটিয়ে লক্ষ করতেন তপনদা। উৎসাহ দিতেন। যেমন— ক্লোজ আপ বা বিগ ক্লোজ আপে ক্যামেরার সামনে খুব বেশি নড়াচড়া করতে নেই. আবার লং শটে হাত-পা ছড়িয়ে অভিনয় করতে হয়। ক্যামেরার space যেখানে বেশি, যেদিকে খুশি যাও। এসবই আমার দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতার ফসল। যার ভিত তৈরি হয়েছিল ‘গল্প হলেও সত্যি’-র দিন থেকে। ‘আপনজন’, ‘সাগিনা মাহাতো’ ও ‘পঙ্খীরাজ’— জীবনে তিনটে বড়ো ‘হিট হ্যাট্রিক’ রয়েছে আমার। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রথম ছবি থেকেই নিজেকে কতটা ভেঙেছি। কতটা গড়েছি।
‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে স্টারের মেলা। কে নেই! রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, বঙ্কিম ঘোষ— আমি চাকরের ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। প্রথম শটেই বাজিমাত। এন.জি. হয়নি। টেনশন থাকলেও বুঝতে দিইনি। ছবির সেটেই আলাপ হল ভানুদা ও রবিদার সঙ্গে। অসাধারণ মানুষ। সেদিন শুটিংয়ের পর রবিদা প্রায় জোর করেই আমাকে নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে। তখন উনি থাকতেন কালীঘাটে। বেশ বড়ো বাড়ি। বৈঠকখানা ছিল। সেখানেই আড্ডা বসত। উৎপলদার নাটকের দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ‘চলাচল’ তৈরি করেছেন। আড্ডাটা ছিল স্বাস্থ্যকর ও সুখকর। কে না আসতেন— উমানাথ ভট্টাচার্য, সমরেশদা, অনুভাদি তো থাকতেনই। ড. বারীন রায়, সৌম্যেন্দু রায়, রবি বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশিরভাগ আলোচনা হত নাটক নিয়ে। তখনকার দিনে সিরিয়াস, ভালো লাগা ছবির বিষয়,অভিনয়, আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করা হত। সবাই অংশ নিতেন। মতামত ব্যক্ত করতেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, অজয় কর, সলিল দত্ত, পীযূষ বসু, অরবিন্দদাদের ছবি নিয়ে আলোচনা হত। বিশ্লেষণাত্মক সেই আলোচনায় মস্তিষ্কের পুষ্টিবৃদ্ধি হত।
‘গল্প হলেও সত্যি’-র সাফল্যের পরই ‘আপনজন’। একেবারে ভিন্ন চরিত্র আমার কেরিয়ারের। এ ছবিতে ছায়া দেবীর ছোটোবেলার husband-এর চরিত্রাভিনয়। এ একটা অদ্ভূত চরিত্র। একাধারে কমিক এফেক্ট আবার অন্যদিকে অত্যন্ত মারাত্মক সিরিয়াস চরিত্র। কারণ চরিত্রের সূচনা হচ্ছে কমেডি দিয়ে। ফুলশয্যা রাতে স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনে চরিত্রটির লাজুক কমেডি খুব গৃহীত হয়। আবার পরে চরিত্রটির শেড একেবারে পালটে যায়। একটি দেশপ্রেমিক স্বদেশিকে আশ্রয় দিয়ে চরিত্রটি যেভাবে বলে উঠেছিল— ”আপনার রিভলবারটা একবার দেখাবেন?” তখন চরিত্রের গভীরতা প্রথমবার বোঝা যায়। আমার প্রিয় দৃশ্য— চরিত্রটি যখড জানতে পারে, তার আশ্রয় দেওয়া স্বদেশিটি মারা গিয়েছে, তখন সেই স্বদেশির প্রতি তার সম্মান প্রদর্শনের অব্যক্ত অভিব্যক্তি সে অভিনয় এখনও লোকে মনে রাখে। আমিও নিজে অভিনয় করে বড়ো আনন্দ পেয়েছিলাম। তপনদাকে ওই চরিত্রের জন্য বহুবার ধন্যবাদ জানিয়েছি। ‘আপনজন’-এর প্রিমিয়ারের পরও বহু খ্যাতনামা শিল্পীর শুভেচ্ছা-ভালোবাসা পেয়েছি। এই ছবির পর থেকেই আমার সামান্য নাম-ডাক শুরু হয়। রাস্তাঘাটে লোকে চিনতে পেরে কথা বলতে কাছে আসতে থাকে। প্রথম দিকে সে কী রোমাঞ্চ। আমি সেই থার্ডক্লাসে ম্যাট্রিক পাস করা, সবার হাসির দয়ার পাত্র আমাকে নাকি রাস্তার অচেনা লোক দেখে ছুটে আসছে। সম্মান জানাচ্ছে।
এরপর আমায় ডেকে পাঠান সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন থাকতেন টালায়। ভাইপো পলাশ আমার বন্ধু ছিল। আমায় বললেন, ”এসো এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। আমি নিজেই যেতাম দেখা করতে, কিন্তু শরীরটা ভালো নেই বলে পারলাম না। যাই হোক, তোমার শরীরটা একটু ভালো করো— অবশ্য এই শরীর নিয়েই তুমি যা অভিনয় করেছ তাক লাগানোর মতো। ‘আপনজন’-এ তোমার চরিত্রটা flash back-এ অথচ— তুমিই তো অন্যতম হে!” আমি তো অবাক। ওঁর সাহিত্যের অত্যন্ত ভক্ত আমি।
পরবর্তী যে ক’টা ছবি তপন সিনহার করেছি, তার মধ্যে অন্যতম ‘হাটে বাজারে’। বড়ো চরিত্র। কিন্তু সেখানেও হাফপ্যান্ট পরা হাসপাতালের বেয়ারার চরিত্র। বনফুলের গল্প নিয়ে ছবি। এখানে আলাপ হল বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে। আমি তো সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলাম, ওর সঙ্গে অভিনয় করব সে কথা। তপনদার কাছে প্রথমদিন শোনার পর তো রাতে আমার ভালো করে ঘুমই হল না।
সে ছবিতে বৈজয়ন্তীমালা একা নন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দাদামণি অশোককুমার। সেইসময় আমি বৈজয়ন্তীমালার প্রচণ্ড ভক্ত। ওর নাচ দেখলে মনে হত যে— কোমরে হাড় নেই। অজন্তা-ইলোরার মূর্তিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তা এ ছবিতে এক কাণ্ড হল। আমাদের রিহার্সাল শুরু হল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। সেখানে বৈজয়ন্তীমালার জন্য আলাদা এসি মেকআপ রুম ছিল। ছবিতে আমার জন্য একটা গান ছিল। তপনদা আমার ওরিজিনাল গলায় গানটা রাখতে চাইলেন। গানের রিহার্সাল করাতেন রাধাকান্ত নন্দী ও অলোকদা। গানটা ছিল— ”আগে আগে ননদি চলে পিছে ননদৈয়া/উসকে পিছে ম্যায় বিচারি, মেরি পিছে সইয়াঁ/” … গানের সঙ্গে বৈজয়ন্তীমালার নাচের রিহার্সালও শুরু হল, ওহ! কী অসাধারণ ফুটস্টেপিং! ছন্দ তৈরি! আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম— একদিন বললেন, ”হরবখৎ কেয়া দেখতে হো তুম?” বললাম, ”আপনার নাচ। যে নাচে সঙ্গম-এ রাজকাপুরকে হারিয়েছিলেন।” তাও আমার হাঁ করা চেহারা দেখে বললেন, ”আমার মনে হচ্ছে, তুমি আরও কিছু বলবে? আমি আমতা আমতা করে বলে ফেলি, ”আপনার কোমরটা একটু টাচ করব? আপনাকে দেখলে মনে হয়, অজন্তার-মূর্তিগুলো প্রাণ পেয়েছে।” হা হা করে হেসে বললেন, ”তোমাকে টাচ করতে হবে না, আমিই টাচ করিয়ে দেব।” ঘটনাটা ঘটল সিন টেকিং-এর দিন। সাউন্ড বক্স গমগম করছে। উনি নাচতে লাগলেন, আমি গাইছি। হঠাৎ মেরি পিছে সইয়াঁ-তে আমার কোমরে বিশাল ধাক্কা মারলেন নিজের কোমর দিয়ে, তারপর আবার নাচতে লাগলেন, আমি হাঁ— কী সাংঘাতিক ব্যালান্স। রক্তমাংসের মানুষের এ ক্ষমতা থাকে না। এরপর সবাই আমায় নিয়ে মশকরা করা শুরু করল, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেই লোকে জিজ্ঞেস করত, ”কী হল?” আমি বলতাম, ”বৈজয়ন্তীমালা কোমরে ধাক্কা দিয়েছেন। সেই স্মৃতিটাকে ধরে রাখছি।’ পরে উনি সব শুনে নাকি খুব হেসেছিলেন।
‘হাটেবাজারে’-র আউটডোর শুটিং শুরু হল ভুটানের কাছে রেড ব্যাঙ্ক বলে একটা জায়গায়। সেখানেই আলাপ হল দাদামণি অশোককুমারের সঙ্গে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অথচ আত্মভোলা। স্টারডমের জন্য সাদামাটা জীবনযাপন করতে পারতেন না। আমায় প্রথমদিন দেখার পর অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলেন। তারপর বললেন, ”ছেলেটার স্ট্রাকচার আইডিয়াল কমেডিয়ানের।” তখন দাদামণির শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। একটা কাঠের বাড়িতে থাকতেন। ওর স্ত্রী রান্না করতেন। সম্পূর্ণ বাঙালি জীবনধারা। হোমিওপ্যাথির ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল দাদামণির। ভালো ‘পেইন্টিং’-ও করতেন। আমাদের শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-কে দুর্দান্ত একটা ছবি উপহার দিয়েছিলেন। আমি একটা সময় ভাবতাম, মানে সিনেমায় নামার আগে— বম্বে পালিয়ে যাব। আর অশোককুমারের বাড়িতে চাকর হয়ে থাকব। এরকম ফ্যান ছিলাম আমি। দাদামণির সংস্কার ছিল— ডাবিং-এ কোনও টেকনিক্যাল গণ্ডগোল হলে বলতেন— ”এ ছবি সুপারহিট হবে।” হাটেবাজারে’-র ক্ষেত্রেও তাই বললেন। মারাত্মক সুপারহিট হল।
এরপর থেকে আমিও বিখ্যাত হলাম। রাস্তায় নানা লোক এসে কথা বলত। সমবয়সি ছেলেমেয়েরা ‘সারারারা’ বলে রোল তুলত। দেখলাম পাবলিকলি আর চলাফেরা করা যাচ্ছে না। লোকজন ঘিরে ফেলছে। তখনই হঠাৎ ঠিক করলাম আর বাসে চড়ব না। ট্যাক্সি করে যাতায়াত করব। খরচ একটু বেশি হবে হোক। স্টুডিও পাড়ার মুখটায় ট্যাক্সি করে ছেড়ে দিতাম। একদিন তপনদা দেখে বললেন, ”শোনো, তুমি রোজ ট্যাক্সি করে যাতায়াত করো কেন”? আমি বললাম সব। গম্ভীরভাবে শুনে বললেন, ”তা রোজ রোজ ট্যাক্সি… সংসার চালাতে পারবে?” আমি বললাম, ”সে হয়ে যাবে’খন। তাছাড়া আমার বাড়িতে বিশেষ কোনও দায়বদ্ধতা তো আমার নেই। তপনদা সব শুনে টুনে বললেন, ”তুমি এক কাজ করো। আশেপাশেই কোনও একটা ঘর ভাড়া নাও। আর একটা জনতা স্টোভ কিনে নাও। আলু সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে নেবে। এতে তোমার খরচটা বাঁচবে। বুঝলে?”
আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ তৈরি হয়নি। যা হোক আড্ডার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। রবিদার বাড়িতে কেবলমাত্র আলোচনা নয়। মাঝেমধ্যে খেলাও হত। শীতের সময় ব্যাডমিন্টন ও অন্য সময় তাস। রীতিমতো টাকা দিয়ে তাস খেলা হত। পরে যে জিতত তার টাকা দিয়ে ভুরিভোজ হত। রবিদার কয়েকজন বড়োলোক বন্ধু ছিলেন। তাঁরাও আসতেন। টাকা দিতেন। রবিদার বাড়িতে এলাহি খাওয়া দাওয়া হত। রবিদা ভয়ংকর খাদ্যরসিক। অল্প খেতেন। বারে বারে খেতেন। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। সুন্দর মন ও শরীর ছিল তাঁর। উচ্চতা কম। তবে সুঠাম শরীর। এই আড্ডাতেই একদিন রবিদা বললেন— ”তোর কথা এক জায়গায় বলেছি।” আমি অবাক। ”কোথায়?” রবিদার সহাস্য উত্তর— ”তুই যা। তোকে মানিকদা ডেকে পাঠিয়েছেন। গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবি হবে।” আমার মুখের ভাষা ততক্ষণে হারিয়ে গিয়েছে। কণ্ঠ স্তব্ধ। কী বলব বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারলাম রবিদা আমায় কত স্নেহ করেন। গেলাম মানিকদার বাড়ি। সকালে। স্মৃতি আজ আর সঙ্গ দেয় না। তাই দিন সাল বলতে পারলাম না। মানিকটা তখন থাকতেন লেকের কাছে। শিল্পীদের কাছে তীর্থস্থান। গেলাম। নিজেই দরজা খুললেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন ‘বোসো’। বসলাম। ঘরভর্তি বই-কাগজ। এদিক ওদিক ছড়ানো-ছিটানো। মুগ্ধ হয়ে দেখছি সব। ঘোর কাটল মানিকদার কথায়। বললেন— ”বুঝলে চরিত্রটা খুব বড়ো নয়। ছোটো। তবে গুরুত্ব রয়েছে। দূতের চরিত্র। একপেট খিদে নিয়ে সে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়। রাজা মন্ত্রীকে তথ্য সরবরাহ করে। তুমি একবার অনন্তের সঙ্গে দেখা করে নিও।” অনন্ত দাস ছিলেন মানিকদার মেকআপ ম্যান। অনন্তদা একটা খেরোর খাতা বের করলেন। লাল রঙের খেরোর খাতা মানিকদার। পাতা উলটে দেখালেন স্কেচ। মানিকদা নিজে এঁকেছেন। কীরকম পোশাক হওয়া উচিত দূতের। তার চেহারা। সবটাই এত নিখুঁত যে দেখেশুনে একেবারে তাজ্জব। নাটক বা থিয়েটারে আমরা এরকমভাবে চরিত্রানুযায়ী বিভিন্ন স্কেচ করতাম। কিন্তু কোনও সিনেমায় যে এমন খেরোর খাতা থাকতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিল না। ব্রিলিয়ান্ট। মানিকদার কাজের ধরনটা আন্দাজ করতে পারলাম। আমাকে একটা জুতো দেখানো হয়েছিল। বালিয়াড়িতে দৌড়ানোর জন্য। আমি জুতোর নাম দিয়েছিলাম ‘অবাকজুতো’।
অন্য ধরনের খেরোর খাতা দেখে বুঝেছিলাম তা চরিত্র ছোটো হোক বা বড়ো হোক মানিকদার কাছে তার সমান গুরুত্ব। তিনি স্কেচ করার সময় যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। চরিত্রের হাঁটাচলা, পোশাক আশাক সবই বড়ো চমৎকার। মানিকদা মানিকদাই। ওঁর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছাড়া ‘চিড়িয়াখানা’-তেও অভিনয় করেছি। সেখানে ছিল বোবার চরিত্র। দারুণ অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন উনি।
মানিকদার আমাকে নির্বাচিত করার ব্যাপারে রবিদার সহযোগিতা যেমন ছিল তেমনই ছিল তপন সিনহার ছবিতে আমার অভিনয়। মানিকদা তপন সিনহার ছবি দেখতেন। আমার অভিনয় ওঁর ভালো লেগেছিল। নইলে কেবলমাত্র রবিদার কথায় মানিকদা সিলেকশন করবেন তেমন মানুষ ছিলেন না। নিজে যা ভালো বুঝতেন তাই করতেন। অন্যের কথা শুনতেন মাত্র। শেষ সিদ্ধান্তটা নিতেন নিজেই। তবে রবিদার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ রবিদাকে মানিকদা অসম্ভব স্নেহ করতেন। বাঘার চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদের সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য শুনেছিলেন রবিদা। গুপীর চরিত্রে আমাকে নেওয়ার জন্য ভাবনাচিন্তাও হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তপেন চট্টোপাধ্যায়কে চরিত্রটিতে ভালো মানায় তাই চরিত্রটি তপেনদাই পেয়েছিলেন। রবিদা দূতের ভূমিকায় মানিকদার কাছে আমার নাম প্রস্তাব করেন। আসলে আমার চেহারাটা এত রোগা ছিল যে আমি গুপীর চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে তপেনদার কাছে হার স্বীকার করেছি।
একটা কথা এখানে বলা দরকার, আমার অভিনয়ের ব্যাপারে মানিকদার কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি বিখ্যাত নাটক ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’-তে আমার অভিনয় দেখেছিলেন। আমাকে তাই দূতের ভূমিকায় রিহার্সাল দিতে হয়নি। সকলে শুটিং-এর জন্য দল বেঁধে গেলাম জয়সলমীর। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চিত্রনাট্য হাতে দেওয়া হয়নি। লালরঙের খাতা থেকে চিত্রনাট্য পড়তেন মানিকদা। পরবর্তীতে সৌমিত্রের হাতেও দেখেছি অমন খাতা। নাটকের সময় ব্যবহার করত। ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল— ”মানিকদাকে অনুসরণ করছি।” যাই হোক ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির শুটিংয়ে রাজস্থানের মরুভূমিতে দাপিয়ে বেড়াল মানিকদা অ্যান্ড কোং। ওখানে গিয়ে টিম ম্যানেজার বা প্রোডাকশন কন্ট্রোলারকে রবিদা বললেন— ”চিনু আমার সঙ্গে থাকবে।” রবিদা বুঝতে পেরেছিল আমি ওঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছি। যেসমস্ত ছবিতে রবিদার সঙ্গে অভিনয় করেছি প্রত্যেকটিতেই আমি ছিলাম ওঁর রুমমেট। ‘বসন্তবিলাপ’ ছবির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল। রবিদা আমার খেয়াল রাখতেন। বিশেষত খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে। শরীর যাতে খারাপ না হয় সেদিকটা দেখতেন। আমি ওঁর অভিনয়, অ্যাটিটিউট, চলাফেরা, আচার আচরণ লক্ষ করতাম। ওঁকে অনুসরণ করেছি অন্ধের মতো। অভিনয়ে ‘পজ’ ও ‘ডবল টেক’ বলে দু’টো ব্যাপার রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় রবিদা হাতে ধরে আমাকে শিখিয়েছেন। ‘ডবল টেক’ উৎপলদার কাছ থেকে শিখেছিলেন রবিদা। রবিদার কাছ থেকে শিখেছিলাম আমি।
আমার ছিল সাতদিনের কাজ। বেশি কিছু বলতেন না মানিকদা। কেবলমাত্র বলতেন— এইভাবে শটটা দিতে হবে, বুঝলে। বলেই ক্যামেরার পিছনে চলে যেতেন। অসম্ভব ভদ্র ব্যবহার। অমায়িক। ইন্ডোর শ্যুটিং হয়েছিল এনটিওয়ান-এ। বংশীচন্দ্র গুপ্ত সেট ডিজাইনিং করেছিলেন। আউটডোর শুটিং হয়েছিল জয়সলমীরে। ভালো লাগলে বলতেন— ওকে, ফাইন অথবা গুড, ভেরি গুড। ভালো না লাগলে বললেতন— ”শটটা যদি এইভাবে হত তবে ভালো হত।” একটা শটের পর অন্য শটে চলে যেতেন। আগের শটটটাকে মনে রাখতেন না। ভুলে যেতেন। সৌম্যেন্দু রায়কে অন্যত্র ক্যামেরা বসানোর কথা বলতেন অর্থাৎ পরবর্তী শটের জন্য রেডি হতেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে থাকার সময় পরিচালনার দিকগুলি লক্ষ রেখেছি। তপন সিনহা তরুণ মজুমদারের সঙ্গেও কাজ করেছি। কাছ থেকে দেখেছি ওঁদের পরিচালনা। তপন সিনহা আমার শিক্ষক। কিন্তু সত্যজিৎ রায় পরিপূর্ণ পেশাদার। একদম চাপ দেন না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ফুরফুরে মেজাজ থাকত। স্বাধীন। পিছনে কোনও অভিভাবক নেই। কোনও গার্জেনগিরির ব্যাপার ছিল না। খোলামেলা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। ঋদ্ধ মানসিকতার মানুষ। ভুল হলেই বলতেন— ”কাট। আর একবার নেব। দিস ইজ মাই ফল্ট, নট ইয়োর্স। ক্যামেরাটা অন্য দিক থেকে নিতে হবে।” কখনও বলতেন না ভুল অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অথবা টেকনিশিয়ানদের। সবসময় বলতেন ”ভুল আমার। শটটা আর একবার নেব।” তখনই বুঝতে পারতাম ভুলটা আমি করেছি। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ঠিক করে খুব কাছে এসে বললেন— ”ওই যে ডানদিকে তাকালে ওটা কোরো না।” এই হলেন মানিকদা। সত্যজিৎ রায়। শ্রদ্ধেয়, বরেণ্য একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে কাজ করে মনে হয়েছে প্রতিদিন আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। নতুন করে অনেক কিছু শিখেছি। জয়সলমীরের সাতদিনের শুটিং জীবনের অন্যতম সেরা সময়। মণিমুক্তো সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। মানিক মুক্তো।
সত্যজিৎ রায়ের দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছি। আরও ছবিতে অভিনয় করলে ভালো হত। তবে হয়নি। কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেইসময় আমি থিয়েটার নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। যদি যোগাযোগ থাকত, একটু তদ্বির করতাম তাহলে হয়তো আরও কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করতে পারতাম। সেইসময় নান্দীকারের গণ্ডগোল। নান্দীকার ছেড়ে থিয়েটার ওয়ার্কশপে যুক্ত হই। ওইসময়ই বিরাট ভাঙন চারপাশে। এত ব্যস্ততা। তারপরে এটাও ঠিক যে এমন কোনও চরিত্র যা চিনুকে ছাড়া চলবে না, তাহলে হয়তো উনি আমাকে ডাকতেন। আমার চেহারাটা একটু অন্য রকম। সফিস্টেকেটেড ছবি— সেখানে হয়তো আমার উপযোগী কোনও চরিত্র ছিল না। যেমন নায়কের জন্য সৌমিত্রদা অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পরে বোঝে ভুল হয়েছিল। ওই চরিত্র একমাত্র উত্তমকেই মানায়। মানিকদা নিজেও বলেন— ”তুমি তো অনেক চরিত্র করেছ এটা উত্তমকেই মানাবে। ওই করুক।” তবে বড়ো পরিচালকদের ক্ষেত্রে পছন্দের একটা ব্যাপার থাকে। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সৌমিত্রদা। তপন সিনহার ছবিতে নির্মল কুমার।
যে ক’দিন ছিলাম জয়সলমীরে শুটিংও করেছি, ঘুরেও বেরিয়েছি। মানিকদা খুব ভোরবেলা উঠতেন। আমি ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে বসে থাকতাম। একদিন মানিকদার সঙ্গ নিতেই জিজ্ঞেস করলেন— ”তুমি কী ব্যাপার?” বললাম— ”আপনার সঙ্গে যাব।” বললেন— ”যাবে?” বললাম— ”হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে থাকব, দেখব সবকিছু।” খুব অবাক। কিন্তু বললেন না। মনে মনে খুশি হয়েছেন তা বোঝা গেল। বললেন, ”এমন তো দেখিনি যে আমার সঙ্গে থাকবে বলে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে বসে রয়েছে। বেশ চলো। তবে আর কাউকে বোলো না। বেশি লোকজন হয়ে গেলে কাজের অসুবিধে হবে।” গেলাম। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। কী করতেন মানিকদা? আলোর বাড়া কমার সঙ্গে বালিয়াড়ির রং বদল, উনি তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। বিশ্লেষণাত্মক সেই সমস্ত দৃশ্যপট যার অনুষঙ্গে মানিকদা পরবর্তী শটের কথা ভাবতেন। জয়সলমীরে একটা ছোটো গ্রাম ছিল। প্রায় ১০০-১৫০ লোকের বাস। সেই গ্রামে একটা বড়ো কুয়ো ছিল। সেই কুয়োর জল নিতে আসতেন দূরের গ্রামের মানুষ। মিছিল করে আসা সেই সমস্ত মানুষদের দেখতে পেতাম ভোরে। মরুভূমিতে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অসাধারণ। একটা পুরোনো দুর্গ ছিল। আমরা সেখানে যেতাম। বলতেন— ”হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?” বললাম— ”না হচ্ছে না।” মানিকদা নিবিষ্টভাবে দেখতেন। একদিন সকালে যুদ্ধক্ষেত্রের জায়গা বাছাই করে নিজের মনেই বললেন— ”এখানে তিনটে ক্যামেরা ছাড়া চলবে না।” বলেই আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন— ”একটু মনে রেখো তো ভাই।” মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গী হতেন রায়দা অর্থাৎ সৌম্যেন্দু রায়, ছবির ক্যামেরাম্যান। মানিকদা যেমন ভালো বাংলা বলতেন তেমন বলতেন ইংরাজি। তবে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে আমার অভিনীত চরিত্রের সেরা শট নেওয়া হয়েছিল কলকাতায়। যেখানে আমি মন্ত্রীমশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যে দেশের সঙ্গে যুদ্ধ সেই দেশের কথা বলছি, সেখানে মন্ত্রীর সামনে কথা বলে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে বারণ করেন। এখানে একটু ধীর পদক্ষেপের প্রয়োজন। সাদা বাংলায় যাকে বলে Slow motion। অর্থাৎ কথাটা বলে হালকা চলে চলে যাওয়া। তাই করেছিলাম। মানিকদা খুশি হয়েছিলেন। পরে জেনেছিলুম যে Camera highspeed- এ চালানো হয়েছিল। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবি তৈরির সময় দেখেছিলাম মানিকদার লোকেশন বাছাই। আমার মনে হয় জয়সলমীর, বালিয়াড়ি, পুরোনো কেল্লা— এসবই ‘সোনার কেল্লা’-র ভিত তৈরি করে দিয়েছিল।
পরবর্তী ছবি তপনদার, ‘এখনই’। নায়িকা অপর্ণা সেন, নায়ক স্বরূপ দত্ত, শুভেন্দু একটা গেস্ট রোলে ছিল। আমার চরিত্রটা অসম্ভব ইন্টারেস্টিং একটা হিপির চরিত্র। ভারতের অন্য প্রদেশের হিপি সে। আত্মভোলা, দার্শনিক, কবিতা, স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে একটা চরিত্র মারাত্মক serious comedy। ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে সে ধ্যানচাঁদের কথা বলে অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে। একেবারেই আলাদা চরিত্র। তা শুটিংয়ে একটা ঘটনা ঘটল। এই চরিত্রের প্রেমে পড়ে এক আমেরিকান মেয়ে। তা, তাকে নিয়ে আমি গড়ের মাঠে হাওয়া আর বাদাম খেতে খেতে নানা অদ্ভুত কথা বলছি। মেয়েটি শুনছে হাঁ করে। হঠাৎ একপাল ভেড়ার মাঝে যেতে যেতে আমি পড়ে গেলাম প্রেমিকাসুদ্ধ। খানিকক্ষণ পরে তপনদা এসে কাঁধে হাত দিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার সিনটা ৫ মিনিট হয়ে গেছে। এবার মেয়েটিকে ছেড়ে উঠে পড়ো। সবাই হেসে উঠল। মেয়েটি অবশ্য পরে রেগে গেছিল, আসলে আমি উত্তেজনার বশে তপনদার কাট শুনতে পাইনি। এই চরিত্রের স্টাইল কায়দা সবই আমি আমার বন্ধু কবি তুষার রায়কে ফলো করে করি। তপনদা বেশ অ্যাপ্রিসিয়েটও করেন। যখন সবাই প্রশংসা করত, আমি আমার মধ্যেকার সেই ”ফেলনা” ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিতাম।
এরপর ১৯৭২ সালে আমি পেলাম “BFJ” (Bengali film journalist) পুরষ্কার। সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার। BFJ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। আমার কাছে স্বপ্নের যেটা, সেটা হল ওই বছরই একই মঞ্চে বাংলা ও হিন্দিতে যথাক্রমে সেরা অভিনেতা হলেন উত্তমকুমার এবং অমিতাভবচ্চন। রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান ছিল। উপস্থিত ছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় ও ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী শতপথি। শেষ মুহূর্তে জানলাম অমিতাভ আসবেন না। শুনে মনটা দমে গেল। পরে অন্যভাবে অমিতাভের সঙ্গে আলাপ হয়। যাইহোক, পুরষ্কার নিতে আমার নাম ডাকা হতেই হলে এমন হাততালি পড়ল যে চমকে গেলাম। ফিরে আসছি, উইংসের ধারে উত্তমকুমার। আমায় অবাক করে বললেন, ”আপনি তো চমৎকার লোক মশাই, আমি স্টেজে-এ উঠতে কয়েকবার ‘গুরু’ ডাক শুনলাম। কিন্তু আপনার মতো হাততালি পাইনি তো। আমি বিনয়ী সুরে বললাম, ”আমার মতো রোগা কিছু ছেলে হাততালি দিয়েছে হয়তো।” বললেন, ”চেহারাটাকে কাজে লাগান। কোথায় অভিনয় করেন?” আমি বলি, ”নান্দীকার আর থিয়েটার ওয়ার্কশপে করেছি। এখন তপনদার কাছে।” কাঁধে হাত রেখে অভিনয়টা চালিয়ে যেতে বলে আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করে বেরিয়ে গেলেন আমার ও বাঙালির সর্বকালীন রোমান্টিক হিরো উত্তমকুমার। বহু পরে ওঁর সঙ্গে অনেক ছবি করেছি।
এরপর থেকেই আমি অন্যান্যদের ছবিও করতে থাকি। মানে এতদিন খালি তপনদার ছবি করতাম। এরপর থেকে বাইরে ডাক পেতে থাকলাম। অজয় কর, সলিল দত্ত এবং অরবিন্দবাবু (ঢুলুদা)। ঢুলুদার ছবিতে কাজ করলাম— সুপার-ডুপার হিট ছবি— ‘ধন্যি মেয়ে।’ এখনও এ ছবি প্রশংসিত। উত্তমকুমার, জয়া ভাদুড়ি, রবি ঘোষ, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়,আমি। মাল্টিস্টারার ছবি। অসম্ভব সিরিয়াস কমেডির ছবি, এ ছবিতে আমার স্বপ্নের হিরো উত্তমকুমার আমার ‘দাদা’ হয়ে গেল। আমার কোনও সিন পছন্দ হলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশংসা করতেন, আবার কোনও দৃশ্য পছন্দ না হলে, নিজে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। রবিদা বলতেন, ওঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ফলো করতে— তাতেই নাকি অভিনয়ের অনেকখানি শেখা যায়।
‘ধন্যি মেয়ে’-র পরে আমার পরবর্তী হিট ছবি ঢুলুদারই নির্দেশনায়— ‘মৌচাক’। উত্তমদা, রঞ্জিৎ মল্লিক, সাবিত্রী, অনুপকুমার। এখানেও তারকাদের হাট। খুব অল্প পরিসরের চরিত্র কিন্তু। আমার খুব পছন্দ। এই ছবি করার সময় আমি ডাক পেলাম দীনেন গুপ্তর কাছ থেকে। তখন তিনি বিখ্যাত লোক। ‘পথের পাঁচালী’-র first camera assistant। ছবির স্ক্রিপ্ট অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা— ‘নতুন পাতা’। আরও যেটা আমার কাছে আগ্রহের ছিল, আমি শুনেছিলাম এ ছবিতে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কাজ করতে পারব। বাংলা নাট্য জগতের পৌরপিতা। যাঁর ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’ দেখে ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্রকে অবাক হয়ে দেখতাম, যে মানুষটা নাটকে অভিনয় করার সময় নাক দিকে অদ্ভূত সুন্দর টোনে কথা বলতেন, তিনিই আবার ক্যামেরার সামনে একেবারে অন্যরকম। আমি ৬০-৬৫ বছরের একজনের ঘটকের ভূমিকায় অভিনয় করছিলাম। আমায় একদিন ডেকে বললেন, ‘তোমার বয়স কত?’ আমি বললাম, ”২৫”। বললেন, ”বাহ! এই বয়সে এমন বয়স্ক একটা চরিত্র অভিনয়ের voice-body-language সবই তো রপ্ত করেছ। বাহ! চালিয়ে যাও চালিয়ে যাও।” মনে হল দেবতার আশীর্বাদ পেলাম। এই ছবি করার সময় IPTA- এর অনেক মহান প্রতিভার সঙ্গে আলাপ হয়। শুরুটা উৎপল দত্ত দিয়ে, যা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরিতে শেষ হয়। ‘নতুন পাতা’ ছবিতেই প্রমাণিত হয়, আমি অন্যান্য নানারকম চরিত্রে অভিনয় করতে পারি।
এরপর পরপর অজয় কর, সলিল দত্তের ছবিতে অভিনয় করেছি। সলিল দত্তের একটা ছবির নাম উল্লেখ করতেই হয়। ‘হীরে-মানিক।’ কমেডি-ভিলেন গোছের একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। বাচ্চারা এ চরিত্রটা ভালো হিসেবে নেয়নি। তার কারণ এ ছবির আগে আমার বিখ্যাত ছবি, ‘চারমূর্তি’। যেখানে আমি টেনিদার ভূমিকায় অভিনয় করি। অসম্ভব জনপ্রিয় ছবি, ভীষণ মজার চরিত্র— বাচ্চাদের খুব প্রিয় চরিত্র। তাই হীরে-মানিক ছবিতে— ওই আমার বেত মারা, বাচ্চাদের কষ্ট দেওয়া, বাচ্চাদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে অভিনয় ভালো হয়েছিল তা বুঝেছিলাম— একেবারে ভিলেন হিসেবেই আমাকে দেখেছিল সবাই। স্কুল বাসে করে যেতে যেতে বাচ্চারা বলত, আঙ্কেল, ওই চরিত্রটা কেন করলেন? বাচ্চাদের মারছেন… ওরকম না করলেই পারতেন।” এমন feed back পাওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভিলেনের চরিত্রে আর অভিনয় করব না। পরে ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-য় যে চরিত্র করি— তাতে ভালোমন্দের একটা দ্বন্দ্ব ছিল বটে, কিন্তু সেটা অন্যরকম চরিত্র, কিন্তু একেবারে ভিলেনের চরিত্রে আর আমি অভিনয় করিনি।
এরপর আমার কেরিয়ারের আর এক স্বপ্নের ছবি, ‘সাগিনা-মাহাতো’। আবার সেই তপনদা। আমার ফিল্ম-কেরিয়ার-এর গুরু— ঈশ্বর। শুনলাম এতে অভিনয় করবেন সায়রা বানু, দিলীপকুমার, শুনে তো আমি প্রায় চাঁদে। দিলীপকুমার! আমার প্রিয় তিনি হিন্দি অভিনেতা দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ। দিলীপকুমার সেরা আমার কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফল বিক্রি করতেন। সেই অবস্থা থেকে উঠে, শুধুমাত্র অভিনয়ের জোরে ভারতসেরা— আহা! ওই চোখ, ওই বাচনভঙ্গি, ওই expression। যাইহোক ছবিতে আমি সায়রা বানুর স্বামী। সে নিয়েও মজার ঘটনা। সায়রা বানু আমার চেহারা দেখে প্রথমে বেশ হতাশ হন। পরে অভিনয়ের পর, আমায় ডেকে বলেছিলেন, “you are so much handsome।” আমার তো মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। তিন ধরিয়ায় ইলা পালচৌধুরির বাংলোয় শুটিংয়ের ব্যবস্থা। তখনই দিলীপ-কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ। আমায় চানু বলে ডাকতেন, বড্ড স্নেহ করতেন, একদিন বললেন, ”চানু, তুই আমায় দাদা বলে ডাকিস না। বম্বেতে-গুণ্ডা বদমাইশদের দাদা বলা হয়।” ভাঙা বাংলা বলতেন, খুব সুন্দর সায়গলের গান গাইতেন।
দিলীপকুমারের সঙ্গে আমার সেই সময়ের কথোপকথন নিয়েই একটা বই লেখা হয়ে যায়। একদিন ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে সাহস করে বলে ফেললাম, ”আপনি তো এখানে শ্রমিক। এত আস্তে কথা বলে না শ্রমিকরা, আর একটু লাউড বলে।” আমার দিকে তাকালেন। আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া, তারপর পিঠ চাপড়ে বললেন, ”তুনে আচ্ছা বোলা।” এরপর শুটিংয়ে আমাকে থাকতেই হত। আমি চোখের ইশারায় আমার ভালো মন্দ বোঝাতাম। একদিন তপনদা বললেন, ”ওঁর মতো এত বড়ো অভিনেতাকে কী পরামর্শ দাও? এত খুঁতখুঁতে মানুষ। এরপর তুমি আর শুটিংয়ের সময় সামনে যেয়ো না। ৫-৬ টেক করতে হয়।” আমায় না দেখলেই বলতেন, ”চানু কাঁহা? উসকো বুলাও।” এমনই স্নেহের ডোরে বেঁধেছিলেন। উনি যে কত বড়ো হৃদয়ের শিল্পী ছিলেন তারও পরিচয় পেয়েছিলাম। একদিন ব্রেকফাস্ট করছেন পাঁউরুটি, মুরগির রোস্ট, আর প্রচুর ফল দিয়ে। আমি বললাম, ”উত্তমকুমারকে আপনার কী রকম অভিনেতা বলে মনে হয়।” ভাসা চোখে তাকিয়ে বললেন, ”আহ! উত্তম। আমার দেখা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, সুপুরুষ রোম্যান্টিক হিরো। ওই চোখ, ওই কণ্ঠস্বর, অভিনয়। ট্র্যাজেডি-র কম্পিটিশন হলে আমি খানিকটা টক্কর দিতে পারি। কিন্তু রোমান্টিক ছবিতে ওই ভারতসেরা।” এক অভিনেতার প্রতি ওঁর এই শ্রদ্ধা, ওঁর গভীর হৃদয় উপলব্ধি আমায় মুগ্ধ করেছিল। মনে মনে প্রণাম করেছিলাম। এরপর নাকি তপনদা যখন হিন্দিতে সাগিনা-মাহাতো করেন তখনও দিলীপকুমার আমার নামোল্লেখ করেন। তপনদা বলতেন, ”ইউসুফকে তুমি কী মন্ত্র পড়িয়েছ বলো তো?” হিন্দিতে আমি অভিনয় করিনি। আসলে ভাষা আর শহর (বম্বে) কোনওটাই আমার কব্জায় ছিল না। তাই হৃষীকেশদার বহু ছবিতে অফার পাওয়া সত্ত্বেও অভিনয় আমি করিনি।
দিলীপকুমারের সঙ্গে আবার দেখা হল জ্যোতি বসুর বন্যাত্রাণের জন্য আয়োজিত বাংলা-ম্যাড্রাস-বম্বে ক্রিকেট ম্যাচে। বম্বের ক্যাপ্টেন দিলীপসাহেব, বাংলার উত্তমকুমার। অমিতাভ বচ্চনও এসেছিল, কিন্তু তখন এত পপুলার যে ওকে নামানো হয়নি। অমিতাভ তখন আমাদের বাংলার জামাই। আমার ও রবিদার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ— জয়ার মাধ্যমে। ড্রেসিংরুমে বহুক্ষণ কথা হল। এরপর কলকাতা এলে রবিদা আর আমার সঙ্গে আড্ডা দিতেন। মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন। আমরা মাছ নিয়ে যেতাম, রাত ১টা, দেড়টা অবধি আড্ডা হত। আমরা গর্ববোধ করতাম ও জয়ার স্বামী বলে। ওঁর এই উত্থানের জন্য জয়ার অবদান অনেক। জয়া তো আমাদের বোন ছিল।
পরবর্তী হিট ছবি— ‘সাধু-যুধিষ্ঠিরের কড়চা’। উমানাথ ভট্টাচার্য, রবি ঘোষ ও আমার লেখা। দুই চোরের গল্প। লেখা তো হল— এবার প্রডিউসার? জয়াকে অভিনয় করাব, এই শর্তে কুণ্ডু স্পেশাল-এর এক ভাইকে প্রডিউসার করতে রাজি করালাম। জয়া এক রাতের ফোনেই রাজি। কোনও পারিশ্রমিক নেয়নি কলকাতায় এসে ১০-১২ দিনের শুটিংয়ে। তখন ও ‘মিলি’, ‘গুড্ডি’ করে ভীষণ জনপ্রিয় তাই গ্র্যান্ড হোটেলে থাকার আবদার করেছিল। আদরের বোনের এটুকু আবদার মেনে নেওয়াই যায়। এ ছবি সুপার-ডুপার হিট হওয়ার পর একদিন মানিকদা— সত্যজিৎ রায় ডেকে বললেন, ”চিনু, রবি— তোমরা কিন্তু এ ছবিতে জয়ার কাছে হেরে গেছ। তোমরা হিরো কিন্তু ও ওই অতটুকু রোলে কী সাংঘাতিক নরম্যাল অভিনয় করে গেল।” ভীষণ গর্ব হয়েছিল সেদিন। বোনের কাছে দাদারা হেরে গেছে এ যে কী আনন্দের।
‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে পানুগোপাল নামক একটি বোবার চরিত্র। উত্তমদার সঙ্গে ছবিতে আবার কাজ। আর মানিকদার পরিচালনা— উফ! সঙ্গে সৌমেন্দু রায় ক্যামেরায়। দৃশ্য ছিল— আমার ছবি তুলছে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা ব্যোমকেশ ওরফে উত্তমকুমার। একজন বোবা-কালা কীভাবে তা ফুটিয়ে তুলবে, তা মানিকদা যেভাবে দেখালেন, তা সারাজীবন মনে থাকবে। আর উত্তমদা গলার স্বরে ছেলেমানুষি আনতে বলেন। ২টো টেকে দৃশ্যটি উতরে যায়। মানিকদার চোখের প্রশংসা উপভোগ করছিলাম মনে মনে। আসলে উত্তমদার মতো সহ-অভিনেতা থাকলে ভালো না করে পারি? প্রথাগত শিক্ষা বেশি দূর না থাকলেও ‘অবজারভেশন’ আর গ্রহণ ক্ষমতায় উত্তমদা অসাধারণ ‘ইম্প্রোভাইজ’ করেছিলেন। সবার শেখার মতো।
পরবর্তী ছবি ‘আঁধার-পেরিয়ে’। ভালো চলেনি ছবিটা। কিন্তু সহ-অভিনেতা অভিনেত্রী শুভেন্দু আর মাধবী দারুণ। মাধবী তো দারুণ কেয়ারিং। কুলু মানালিতে প্রথম শ্যুটিং— আমার প্রথম বরফ আর আপেল দেখা। ঠান্ডায় ডাঃ শুভেন্দুর পা জমে গেছিল— আগুনে পা সেঁকে তবে সারে। ছবিটা না চললেও— শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা মজার। ইন্ডো-চিন বর্ডারে সেনাদের কষ্টকর জীবন। সব মিলিয়ে কয়েকদিনের শুটিংয়ে বেশ মজা করেছিলাম শুভেন্দু, মাধবী, সুমিত্রা আমি সবাই মিলে। ছবিতে আমার টুকরো-টুকরো কয়েকটা গান ছিল। তপন সিনহার সঙ্গে এটাই আমার শেষ ছবি।
অরুণ চৌধুরীর ‘পদীপিসির বর্মি বাক্স’ করলাম এবার। পরিচালনায় অরুন্ধতী দেবী। অসাধারণ পরিচালক। বাচ্চাদের ছবি। দুর্দান্ত ছবি। নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জহর রায়, আমি এবং সর্বোপরি ছায়া দেবী। ছায়া দেবী যে কতটা বহুমুখী অভিনয় প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন, তা এই ছবিতে আবারও প্রমাণিত হল। এইখানে সেই গম্ভীর, পরিচিত ছায়া দেবীর বাইরে গিয়ে একেবারে অন্যরকম একটা চরিত্র। আউটডোরে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়। পুরোনো দিনের অনেক বড়ো বড়ো মানুষের গল্প বলেন। সুশীল মজুমদারের খুব ভক্ত ছিলেন। কিন্তু অত ভালো ছবিও হারিয়ে গেল। লীলা মজুমদারের অত সুন্দর লেখা আর ছায়া দেবীর ওই অভিনয়। সে ছবির print-ই পাওয়া যাচ্ছে না। চলচ্চিত্র জগতে তা বড়ো খামতি। বহু চেষ্টা করেছি ছবিটার print পেতে— পাইনি। বাচ্চাদের ছবি তো বিশেষ নেই বাংলায়। অনেক ভালো জিনিসের মতো এটাও হারিয়ে গেছে।
পরবর্তী আর যা যা ছবি করেছি, আলাদা করে বিশেষ কোনও গল্প আমার মনে নেই। তাই নাম করে যাই। অরুন্ধতী দেবীর ‘মেঘ ও রৌদ্র’ আমার পরের ছবি। এরপর তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘ঠগিনী’— প্রায় সব হিট ছবিতেই আমি কাজ করেছি। অসম্ভব strong director। সত্যিই আমি ধন্য। তরুণদা, রীতিমতো অভিনয় করে দেখাতেন।
ইন্দর সেন, আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা পরিচালক। ওঁর অর্জুন ছবিতে বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করেছি। একটি স্বপ্নদৃশ্য ছিল তরুণবাবুর স্ত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে। সেটা করতে গিয়ে মহাসমস্যা। মানে, আমি কোনও মতেই আর সহজ হতে পারি না। মানে ওঁকে জড়িয়ে ধরতে পারছিলাম না। তারপর উনিই অ্যাকটিভলি দৃশ্যটা করলেন।
এরপর ইন্দর সেনের ‘মন মানে না’, ‘চামেলি মেমসাব’ করেছি। এই ছবি করার সময় রাখীর সঙ্গে আলাপ হল। খুব সুন্দর রান্না করে খাওয়াতেন।
সলিল দত্তর সঙ্গে আলাপ হওয়াটাও বেশ মজার। উত্তর কলকাতার দত্ত বাড়ির ছেলে। একদিন বললেন, ”এতদিন তোকে কেন যে খুঁজে পাইনি। এসে পার্ট চাইলেই দিতাম।” আমিও বললাম, আমি নিজে পার্ট চাই না। বললেন, ”হ্যাঁ জানি, তোর এ ফুটানি আছে।” সলিল দত্তর সঙ্গে প্রথম ছবি ‘হীরে মাণিক’। এরপরে ‘লেডি ডক্টর’, ‘প্রেয়সী’, ‘শ্যামসাহেব’— ভালো ভালো ছবি করেছি।
অজয় কর— আরও একটা অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা ছবি করলেন— ‘মধুবন’। হাজারিবাগ জঙ্গলে শুটিং হয়েছিল। ধাবার মালিক উৎপল দত্ত, তাঁর বিহারী চেলার রোল ছিল— সারাদিন ভোজপুরি গান আর লরি ড্রাইভারকে দেশি মদের জোগান এই আমার চরিত্র। এখানেই ভিক্টর-এর সঙ্গে আলাপ হল। প্রথমে কথা বলতাম না। ভারী ইংরেজি বলে। তারপর আলাপ হল। খুব ভালো মানুষ। আমরা পরে একসঙ্গে যাত্রাও করেছি।
আমার শেষ কমার্শিয়াল ছবি পীযুষ বসুর ‘জীবন জিজ্ঞাসা’। এখানেই আলাপ হল সুপ্রিয়ার সঙ্গে। সে বন্ধুত্ব আজও অটুট। জীবনের সেরা সময় সিনেমা করে পেয়েছি। বন্ধু-দাদা-প্রেম-সম্পর্ক সব। আবার যদি মানুষ জন্ম পাই, অভিনেতা হতে চাই। মৃত্যুর আগে অবধি আমার কানে বাজুক— ”লাইট-ক্যামেরা অ্যাকশন”।