যে জীবন ফড়িঙের – ১

প্রথম পর্ব

অনেকগুলো বছর কাটিয়ে এলাম। স্মৃতির সরণি বেয়ে যখনই পিছনে ফিরে তাকাই ছেলেবেলা বড়ো মায়া-হাতছানি দেয়। সেই কোন ছোটোবেলায় দাদুর হাত ধরে কুমিল্লা থেকে শহর কলকাতায় পা রাখা। তখন যৌথ পরিবারের অনুশাসনে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি অভিনয় জগতে পা রাখব। রুপোলি পর্দার সাজমহলেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে। ছোটোবেলার কথা বলতে গিয়ে অনেকে খুঁটিনাটি তথ্য মিস করে যাব হয়তো, পাঠকদের কাছে সেজন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে একেবারে সাল-তারিখ মনে করিয়ে দেবার মতো অভিভাবক বা শৈশবের সহচর কেউ নেই— তাই যেমন প্রথমেই বলে রাখি আমার জন্ম সালটিই আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমার ঠাকুরদা রসময় দত্তরায়ের হাত ধরে সপরিবারে আমরা বাংলাদেশের কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতার ভবানীপুরের ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলাম। আমার দাদু রসময় দত্তরায় ঢাকা জেলায় ওকালতি শুরু করেন। পরবর্তীকালে কুমিল্লা। তবে দাদুকে ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি দেশে ঘুরে ঘুরে পসার জমাতে। এমনকী আমরা কলকাতায় চলে আসার পরেও। এর কারণ কী তা ঠিক জানি না— তবে বিষয়টা বেশ ছোঁয়াচে ছিল। কারণ আমার বাবা অমিয়প্রসাদ রায়ও ওইরকম ঘুরে ঘুরে ওকালতি করতেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি আমাদের পরিবারে সেই সময়েও প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। আমার কাকারা এবং পিসিরাও প্রায় সকলেই তখনকার graduate।

কুমিল্লার স্মৃতি খুব বেশি থাকার কথা নয়। আমার বয়স তখন বড়োজোর তিন কি চার। কুমিল্লার ঈশ্বরদীপ পাঠশালায় একদিনই গিয়েছিলাম। আর তার একটাই স্মৃতি— রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ি।

দাদু ছিলেন নামকরা উকিল। বড়ো বড়ো মাছ নিয়ে মক্কেলরা সব দাদুর কাছে আসতেন। ফল, ফুলও উপহার দিতেন। আমরা আসলে দত্তরায়। দাদুর নাম রসময় দত্তরায়। আসলে রায়টা আমাদের উপাধি। পরে দত্ত উঠিয়ে দিয়ে আমরা রায় হয়ে যাই। আমি জাতপাত মানি না। আমরা বড়োলোক ছিলাম। ঠাকুরদা-ঠাকুমার তেরোটি সন্তান। সকলকে মনে নেই। ছবি দেখে বলতে হয় ইনি ন’কাকা, ইনি চিনি কাকা। আমার বাবা ছিলেন সকলের বড়ো। নাম অমিয়প্রসাদ দত্তরায়। বাবা ছিলেন উকিল। বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে শহরে ঘুরে বেড়াতেন। বাবা চিরকাল ঘুরে ঘুরে ওকালতি করেছেন। বাবা কুমিল্লায় থেকে কোনওভাবেই ওকালতি করেননি। দাদুর আলাদা বাড়ি ছিল। বেশ বড়ো বাড়ি। টিনের চাল। গাছপালা দিয়ে ঘেরা। ঠান্ডা। আমাদের একজন পুরাতন ভৃত্য ছিল। নাম ঈশ্বর। তার সঙ্গে বেশ ভালো সখ্য ছিল আমার। একটা ইটের পিঁড়ির উপর বসিয়ে আমাকে ঈশ্বর রান্নাঘরে নিয়ে যেত। মূলবাড়ি থেকে রান্নাঘর ছিল দূরবর্তী। তিন-চার মিনিট লাগত যেতে। সে এক অভিজ্ঞতা! সকলকে রান্নাঘরে গিয়ে খেতে হত।

বাড়িতে একটা বড়ো আমগাছ ছিল। আমি ছিলাম সব থেকে ছোটো। ঈশ্বর আমার থেকে বড়ো ছিল। মা ও ঈশ্বর ছাড়া কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে হত না। যুদ্ধের সময় মিলিটারিরা তিনতলা বাড়ির দখল নেয়। আমরা বিনাশর্তেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসি। তবে পরে কলকাতা থেকে একবার আমি কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। তখন বাড়িটার খারাপ অবস্থা দেখেছি। তবে ঈশ্বরের খোঁজ পাইনি।

তখনকার দিনে গ্রামগঞ্জের লোকেরা সামান্য কারণেই কোর্টে মামলা ঠুকে দিতেন। কিন্তু মামলা ঠুকলে কী হবে! ভালো উকিল তো পাওয়া দুষ্কর। বাবার পক্ষে তাই সদরে না থেকে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ওকালতি করে পসার জমানো খুব সহজ ছিল। ফলে গ্রামেই থাকতেন। কুমিল্লার বাড়িতে কম আসতেন। বাবার সান্নিধ্য কম পেয়েছি। তাই বাবার চরিত্র বা প্রভাব আমার উপর কম। বাবার স্মৃতিও কম। কুমিল্লার স্মৃতি আমার নেই প্রায়।

কলকাতায় তো ভবানীপুরে এলম। হেশ্যাম রোড। নেতাজির বাড়ির কাছাকাছি। এখানে আসার পর আমার জীবনে প্রথম সিনেমা দেখা। হাওড়ায় একটা কেসের কাজে বাবা গিয়েছিলেন। সেখানকার একটা সিনেমা হলে, নামটা এখন ঠিক মনে পড়ছে না। সিনেমাটা বোধহয় ‘লাটসাহেবের নাতনি’* এমন ধরনের নাম হতে পারে। অভিনয়ে অহীন্দ্র চৌধুরি, শিপ্রা মিত্র, মলিনা দেবী। বাবার সঙ্গে আমি জীবনে প্রথম হলে গিয়ে সিনেমা দেখি। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমস্ত কুশীলবদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-ই। কিনে দিয়েছিলেন মুড়ি, চানাচুর, চকোলেট। দিনটা হয়ে উঠেছিল রঙিন।

বাবা এমনিতে রাশভারি মানুষ ছিলেন না। কোনওদিন তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। আস্তে আস্তে কথা বলতেন। কম কথা বলতেন। আমি তখন পড়তাম ক্লাস ফাইভে। বাবা মারা যান। বাবার স্পর্শ বেশি পাইনি, তাই তাঁর মৃত্যুও জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারেনি। ঠাকুমা ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। বাবার মৃত্যুর পর ঠাকুমা বললেন মাথা ন্যাড়া করতে হবে না, নিরামিষ খেতে হবে না। মা-র জন্য মনটা খারাপ লাগত। ব্যস এইটুকুই। তবে ভবানীপুরের স্মৃতি বলতে ব্ল্যাক আউট-এর সময়ের কথা খুব মনে পড়ে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টগুলো কালো রং করা হয়েছিল। এমনকী আমাদের বাড়ির জানলা-দরজা-সব কালো রঙে ঢেকে দেওয়া হয়— যাতে করে ভেতরের আলো বাইরে না পৌঁছয়। আর সাইরেন বাজলেই দাদু সবাইকে গম্ভীর স্বরে বলতেন— ”সবাই সিঁড়ির নীচে চলো”— অর্থাৎ একতলার সিঁড়ির নীচে আমাদের সবাইকে সেঁধোতে হত। আমার কাছে অবশ্য তখন গোটা বিষয়টা ভয়ের থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর ছিল— কারা বোমা ফেলবে— বোমা কেমন দেখতে হয়— সমস্ত কিছু মিলিয়ে ওই বয়সে বেশ পুলকিত হতাম। এখন ভাবলে ভয় করে।

ভবানীপুর মানেই স্মৃতির অনেকখানি জুড়ে আছে নর্দান পার্ক। সেখান থেকে আমার খেলাধুলার শুরু। ক্রিকেট-ফুটবল দু’টোই বেশ জাঁকিয়ে খেলতাম। ও হ্যাঁ দাদুর হাত ধরে পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনেও ভর্তি হই। ক্লাস-টু পর্যন্ত পড়ি এই স্কুলে। নর্দান পার্কের ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে ওই বয়েস থেকেই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করি। রাইট-আউটে জুনিয়র টিমে বেশ ভালো খেলতাম এবং খেলার সূত্রেই একটু অল্পবয়সে বেশি পেকে গিয়েছিলাম। অবশ্য শুধু ফুটবল নয়, ভবানীপুর বালক সংঘের ক্রিকেট টিমেও অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিলাম অচিরেই। ফলে ভবানীপুরের ওই কয়েকবছরে স্কুলের স্মৃতি সেভাবে নেই— কিন্তু নর্দান পার্ক খেলার নেশাকে পাকাপাকিভাবে ধরিয়ে দিয়েছিল।

ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার সময়টা সবদিক থেকে ভাইটাল। জুনিয়র স্কুল থেকে হাই-স্কুলে উত্তরণ হয়। ভবানীপুর পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন স্কুলে ভর্তি হলাম, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সংস্কৃত পড়তে ভালো লাগত না। পণ্ডিতমশাই বোঝাতেন সংস্কৃত খুব ঋদ্ধ ভাষা। ফলে পড়তে হত। স্কুলে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিবর্তন এল আমাদের পরিবারেও। আমাদের বিশাল যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পাট চুকল ভবানীপুরের বাসার। ইতিমধ্যে আমার দাদু গত হয়েছেন। আমরা ছয়-সাত ভাইবোন, মা-বাবা এবং ঠাম্মার হাত ধরে এসে উঠলাম বরাহনগরের একটা দোতলা ভাড়া বাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন চিনিকাকা নামে এক মজার কাকা। বরাহনগরের এই বাড়িটি বিশাল—পুরো দোতলাটা আমাদের। খুব কাছেই গঙ্গা। অবশ্য এখনকার চোখে তখনকার বরাহননগর দেখা ঠিক হবে না। কারণ সেইসময় বরাহনগর একেবারে গ্রাম। আশেপাশে জঙ্গল। তার মাঝে আমাদের ৬০ টাকার ভাড়া-বাড়ি।

বরাহনগরে এসে একটা নতুন দিগন্ত আমার সামনে খুলে গেল। আসলে এখানে সদর্থে স্বাধীনতা পেলাম। যৌথ পরিবারে থাকতে যে বিধিনিষেধ— কড়া অনুশাসনে হাঁসফাঁস করতাম— তার থেকে মুক্তি পেলাম। এই মুক্তির কাণ্ডারী অবশ্যই আমার ঠাকুমা মৃণালিনী দত্তরায়। এইখানে ঠাকুমার কথা একটু বলে রাখি। বাবা যেহেতু ঘুরে-ঘুরে ওকালতি করতেন তাই বাবার শাসন বা স্নেহ বিশেষ পাইনি। অন্যদিকে মা খুব শান্ত— চুপচাপ ছিলেন। তাই ঠাকুমার সঙ্গে আমার সখ্য তৈরি হয়। আমার ঠাকুমা বেশ প্রোগ্রেসিভ মহিলা ছিলেন। আমার যাত্রা-থিয়েটারের প্রতি ঝোঁক প্রাথমিকভাবে ঠাকুমার প্রশ্রয়ে লালিত হয়েছে। অবশ্য বরাহনগরে তা সম্ভবও হত। কারণ এইখানে মন্দিরের মতো নাট্যচর্চা সমিতির সংখ্যা ছিল প্রচুর। যাত্রা— থিয়েটারের বহু দিকপালরা বরাহনগরে থাকতেন। প্রায়ই পাড়ায় কোনও না কোনও পালা নামানো হত। পাড়ায় পাড়ায় কম্পিটিশনও হত। ঠাকুমার মাধ্যমে সবেতেই আমার অবাধে যাতায়াত ছিল ওই বয়সেই। এছাড়া যৌথ পরিবারের বাঁধন ছিঁড়ে তখন মাঠে যাওয়ার বা রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাফেরার অনুমতি মিলল ঠাকুমার কাছ থেকে। আমার ঠাকুমা তাঁর চিন্তা-ভাবনা, জীবনযাত্রার দিক থেকে কতটা প্রোগ্রেসিভ ছিলেন, তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের বাড়ি ছিল বরাহনগর প্রামাণিক ঘাটের পাশে। আশেপাশে জেলেপাড়া। জেলেপাড়ার বউরা নানা সময়েই ঠাকুমার কাছে নানাধরণের খাবার, হাতের কাজ শিখতে আসত, এ পাড়ার মেয়ে-বউদের বারোমাসেই ‘হাজার’ সমস্যা দেখা দিত। জলে ভেজা থাকত বলে আর কী। ঠাকুমা মৃণালিনী দেবী সেই সময়েই জেলেবউদের এই সমস্যার সমাধানে জুতো পরে চলার প্রচলন শুরু করেন। চামড়ার নয়; বাটার তখনকার আমলের দু’টাকা দামের রবারের চটি পরতে বলেন জেলেবউদের। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় আশেপাশের সমস্ত জেলে পাড়ার মেয়ে বউরা বাটার চটি পায়ে মশমশ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাকুমার আর একটা ঘটনা না বললেই নয়। বরাহনগরে এসেও লোকাল ফুটবল টিমে রাইট-আউটে খেলতাম। তবে ভালো খেললে বাহবার সঙ্গে মাঝেমাঝে তিরস্কারও জুটত। এই তিরস্কার ‘বাঙাল’ হওয়ার কারণে। যদিও নিজেকে আলাদা করে ‘বাঙাল’ আমি মনে করতাম না। কারণ কুমিল্লার স্মৃতি তো আমার নেই। সচেতন মনে বড়ো হওয়া পুরোটাই এখানে— তাই মনেপ্রাণে আমি এদেশি। ‘তবু’ ”বাঙালগুলো এয়েচে”— এই বলে একবার পাড়ায় একটা দল আমায় মেরেছিল যখন, খুব কান্না পেয়েছিল। এই সময় আমায় সামলালেন ঠাকুমা। তেজের সঙ্গে আমায় বলেছিলেন, ”আমাগো বাড়ির পোলায় কখনও কাইন্দ্যা বাড়ি ফেরে নাই— অগো মাইর্যা যেদিন বাড়ি ফিরবি, আমি খুশি হইব”— মনে মনে মারপিট করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। ঠাকুমার এই বাণী একেবারে ভগবদগীতার মতো মনে হল। তখন আমার চেহারা মোটেও রোগা-প্যাটকা না— বেশ স্বাস্থ্যবান। আমি পাড়ায় আমার সহচরদের নিয়ে একটা দল তৈরি করলাম— তারপর সময় সুযোগ বুঝে সেই ‘ঘটি’-র দলটাকে বেশ করে পিটিয়ে বাড়ি গিয়ে ঠাকুমার হাতে তৈরি নাড়ু খেয়েছিলাম।

বাবার মৃত্যুর পর আমাদের যৌথ পরিবারে ছোটোখাটো অশান্তি শুরু হল। সামান্য কারণে খিটিমিটি লেগেই থাকত। মন্বন্তরের আগে সকল ধান বাড়ন্ত। সেই সময় ‘কনট্রিবিউশন’-এর উপর কোপ পড়া শুরু হল। মেজো কত দিল, ছোটো কত দিল— এইসব ব্যাপার-স্যাপার— ভালো লাগত না। কী করা যাবে। ঠাকুমা ছিলেন অত্যন্ত যুক্তিবাদী, নির্ভীক, প্রগতিশীল মহিলা। দাদু সমস্ত সম্পত্তি ঠাকুমার নামে লিখে দিয়েছিলেন। তিনি ছেলেদের বললেন, ”তোগো লগে থাকুম না”। তিনি তাঁর পছন্দের মানুষ যেমন আমি, মা, আমার দুই দাদা ও চিনিকাকা— আলাদা হয়ে গেলাম। ভেঙে গেল দত্তরায় বা রায়দের যৌথপরিবার। চিনিকাকা ছিলেন চিরকালীন বেকার। কোনওদিন কাজ করেননি। দাদু বলেছিলেন, ওর দ্বারা কোনো কাজ হবে না। কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন চিনিকাকার জন্য। যৌথপরিবার ভেঙে যাওয়ায় আমাদের রোজগার একটু কমল বটে তবে গরিব হলাম না। দাদু অনেক টাকা রেখে গিয়েছিলেন। সেই সময়কার হিসাবে আমাদের পরিবারকে উচ্চবিত্ত বলা যায়। যৌথপরিবার ঠাম্মার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ঠাম্মার সমস্ত নির্দেশ আমরা মেনে চলতাম। মাকেও দেখতাম ঠাম্মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। এখানে বলে রাখি, কুমিল্লা থেকে চলে আসার সময় চিনিকাকা দাদুকে বলে কিছু টাকা আর জমি ঈশ্বরকে দিয়ে এসেছিলেন। কষ্টে হোক বা যন্ত্রণায় আমরা যেদিন কুমিল্লা থেকে চলে আসি, সেদিন অনেকবার বলা সত্ত্বেও ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। এরপর কত খোঁজ করেছি। বাংলাদেশে শ্যুটিংয়ে গিয়েছি, কিন্তু কোথায় ঈশ্বর! কোথাও দেখা পাইনি তার।

আমার মায়ের নাম ঊষারানি রায়। আমার নামটা রেখেছিল দিদি। ও নামকরণ করতে ভালো লাগত। আমার নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল শান্তি। পরে তা বদলে রাখা হল চিন্ময়। ঠাম্মা খুব ভালো রামায়ণ পাঠ করতেন। বরানগরে রামায়ণ পাঠে বেশ নাম করেছিলেন। ঠাম্মার মৃত্যুর সময় আমি ছিলাম নবমশ্রেণির ছাত্র। সেই সময় ‘সপ্তপদী’ মুক্তি পেয়েছে। উত্তমকুমারকে বেশ পছন্দ করতেন ঠাম্মা। ওঁর ছবি দেখতে ভালোবাসতেন। ঠাম্মার সঙ্গে শিবরাত্রিতে বিভিন্ন পালাগানের আসরে যেতাম। দুর্গাপুজোর সময় পাড়ার তথাকথিত বড়ো-ছোটো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হত। বরানগরে এমনই একজন অভিনেতা ছিলেন ঠাকুরদাস মিত্র। অহীন্দ্র চৌধুরির পর যদি অন্য কেউ ‘শাহজাহান’ নাটক করে বিখ্যাত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ঠাকুরদাসবাবু। তিনি থাকতেন আমাদের পাড়ায়। বরানগর মুন্সির মাঠে বসত পৌরাণিক নাটকের আসর। বরানগরের সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান ছিল মুন্সির পাঠ। ঠাম্মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন মুন্সির মাঠে। নাটকের প্রতিযোগিতাও হত। বেনেপাড়া বনাম জেলেপাড়া। নৈহাটি, ইছাপুর, খড়দহ, বারাসাত থেকে আসত নাটকের দলগুলি। গুনাগুণের বিচারে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থানাধিকারীকে পুরষ্কার দেওয়া হত। আমি ছিলাম চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ। পড়াশোনা করতাম না। ঠাম্মার সঙ্গে নাটক দেখতে যেতাম। পরে বাড়িতে এসে নাটকের চরিত্রগুলি অভিনয় করে দেখাতাম। পথচলতি সাধারণ মানুষের হাঁটাচলা অবিকল অনুসরণ করতাম। তবে অভিনয়ের যাবতীয় কলাকৌশল দেখাতাম বন্ধু, মা, দিদি সহ বাড়ির আর সকলের সামনে। ঠাম্মার সামনে দেখাতাম না। কোনও মানুষের চলাফেরা, অভিব্যক্তির অনুকরণকে উনি ব্যঙ্গ বলে মনে করতেন। দাদু, সরোজ, স্বরাজ, মান্তি— এই সমস্ত বন্ধুদের সামনেও অভিনয় করে দেখাতাম। উল্লেখ্য, আমি কলকাতার ভাষায় কথা বললেও আমার বাড়ির লোকজন কথা বলত পূর্ববঙ্গের ভাষায়। আমার পরিবারের সকলেই পড়াশোনায় ভালো হলেও আমি কিন্তু ছিলাম খুব খারাপ। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উঠতে গিয়ে অকৃতকার্য হলাম। ঠাম্মা ডেকে বললেন, ”লজ্জার কী আছে। পাশ আছে বলেই না ফেল আছে। তোর পড়াশোনা ভালো লাগে না। তাহলে কী ভালো লাগে?” প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মানুষটির শান্ত কণ্ঠস্বর। বললাম— নাটক, অভিনয় ভালো লাগে। ঠাম্মা জিজ্ঞাসা করলেন— ”ক্রিকেট ভালো লাগে না?” আমি ভালো ক্রিকেট খেলতাম। কিন্তু বরানগরের মাঠ বড়ো ছোটো, অত ছোটো মাঠে খেলা যায় না। আসলে মন তো পড়ে আছে অভিনয়ে। অন্য কিছু ভালো লাগবে কেন! ঠাম্মাকে সেকথা জানাতেই বললেন— ”অভিনয় করতে গেলেও তো লেখাপড়া করতে হবে। অভিনয়ের বই রয়েছে জানিস তো। শিশিরকুমার ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষের পড়াশোনা ছিল মারাত্মক। ভালো অভিনেতা, বড়ো অভিনেতা হতে গেলে শিক্ষিত হতে হবে।” আমি তখন কাশীপুর ইনস্টিটিউশনে পড়ি। বাংলার শিক্ষক নরেশবাবু ছিলেন বন্ধুর মতো। কোঁকড়ানো চুল, চোখে চশমা, সদাহাস্যময়। তাঁর কাছে বইয়ের জন্য হত্যে দিয়ে পড়লাম। তিনি বললেন, ”স্কুলের লাইব্রেরিতেই অনেক ভালো নাটকের বই রয়েছে।” অপরেশচন্দ্র লাহিড়ি, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশির ভাদুড়ি, ডি এল রায় পড়তে দিলেন নরেশবাবু। পড়তে পড়তে অনুভব করলাম বাংলা সাহিত্যের বিশালত্ব। যা এক অর্থে অসীম, গভীর, প্রাণবন্ত। আর ভাবলাম জীবনে কত বড়ো ভুলই না করে ফেলেছি। নিজেকে দোষারোপ করলাম, কেন এতদিন বইয়ের জগতের বাইরে ছিলাম। যা হোক পড়া শুরু করলাম। বাড়িতে আসত ‘যুগান্তর’ ও ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা। দুটো কাগজই খুঁটিয়ে পড়তাম। পাশাপাশি পড়তে শুরু করলাম গল্প ও উপন্যাস। মাঝেমধ্যে মনে হত, সবকিছু বড়ো বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আর ভার বহন করতে পারব না। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছু সহজ হয়ে এল আমার কাছে। সাহিত্য সমুদ্রের গভীরে ডুব দিলাম। ছাদে উঠে নাটকের বিভিন্ন অংশ জোরে জোরে চিৎকার করে পড়তাম। ঠাম্মা সব শুনতেন আর বলতেন— ”খুব ভালো হচ্ছে। তবে তোর গলা বড়ো পাতলা, এত পাতলা হলে চলবে না। জানিস তো থিয়েটার যারা করে তাদের গলার স্বরে গাম্ভীর্য থাকে। গলা ভালো করার লগে তোকে খেলাধুলা করতে হবে। সব থেকে ভালো হয় কারেন্টওয়ালা জলে অর্থাৎ গঙ্গায় যখন জোয়ার-ভাঁটা শুরু হয় তখন যদি গলা জলে ডুবিয়ে আ আ আ করতে পারিস।” আশ্চর্য মানুষ ছিলেন ঠাম্মা! আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। এই জোয়ার-ভাঁটার বিষয়টা আমাকে অসম্ভব ভালো করে বুঝিয়ে বলেছিলেন ঠাম্মা। ব্যাপারটিকে বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে হয়েছিল। ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি এত কিছু জানলে কী করে? বলেছিলেন— ”পড়েছি”। বললাম— ”কোথায় পড়েছ”? ঠাম্মার উত্তর— ”কাগজে”। আমি অবাক! স্তব্ধ! কবে পড়েছেন! আবার মনেও রেখেছেন! ঠাম্মা লিখতেন পার্কার কলমে। দারুণ ছিল হাতের লেখা। টানটান গদ্য। হাতের লেখার আদল অনেকটা রবি ঠাকুরের মতো। আমার পড়াশোনার যাবতীয় খবর রাখতেন মা-ও। ঠাম্মার কাছে গিয়ে সেই সম্পর্কে বলাও হত। চিরাচরিত পাঠাভ্যাসের বাইরে গিয়ে এই সে নতুন শিক্ষালাভ, এই বিষয়ে মা ঠাম্মার নির্দেশই মেনে চলতেন। কখনও অমান্য করেননি। ঠাম্মা মা-কে আশ্বস্ত করেছিলেন, ”দেখো এবার ওর সব ভালো হবে। পড়াশোনা হবে। তুমি চিন্তা কোরো না।” এদিকে নাটকের বই পড়তে পড়তে আমার অন্যান্য বই যেমন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস শেলী পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মাল। সংস্কৃত বাদে অন্য সমস্ত, বিষয়ের প্রতি আমার ভালোলাগা তৈরি হল। বুঝতে পারলাম যে, নাটকের জন্য ভূগোল, বীজগণিত, জ্যামিতি জানা খুবই দরকার। কারণ মঞ্চটাকে জ্যামিতিকভাবে ব্যবহার না করতে পারলে অভিনয় করা সম্ভব নয়। অনেকক্ষণ পড়ার পর বাইরে চলে যেতাম। রকে বসে তুমুল আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে আবার পড়তে শুরু করতাম। পাড়ার মুড়িওয়ালা আমার বন্ধু ছিল। ওর দোকানে যাতায়াত করা খদ্দেরদের দেখে তাঁদের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম বাড়িতে। পড়শোনা ও অভিনয় দুই-ই চলতে থাকল সমানতালে।

আমি খুব ভালো সাঁতার কাটাতাম। বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গঙ্গা সাঁতরানো ছিল জলবৎ তরলং। আমার কয়েকজন মৎস্যজীবী বন্ধু ছিল। এদের মধ্যে একজনের নাম ছিল রঞ্জিত। বাকিদের নাম আজ আর মনে নেই। গঙ্গা সাঁতরানোর ক্ষেত্রে একটা দারুণ স্মৃতি আছে। ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসবে। সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গঙ্গায় নামার ব্যাপারেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সেই বিধিনিষেধের মধ্যেও গঙ্গায় নামার পরিকল্পনা করলাম। বাড়ির কেউ জানতে পারল না। তেল মেখে গামছা পরে নিলাম। রঞ্জিত ছিল ডাকাবুকো। বলল— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আগে থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে যদি গাধাবোটের (যে নৌকাগুলো স্টিমার বা লঞ্চ টেনে নিয়ে যায়। গঙ্গার মাঝখান দিয়ে পাটের নৌকা জোয়ারের সময় ঠেলে নিয়ে যেত। আবার ভাটার সময় থেমে যেত বা চলাচল বন্ধ থাকত।) মাথায় উঠে বসে থাকি, তারপর যখন বড়ো ঢেউটা চলে যাবে তখন গঙ্গায় ঝাঁপ দিলে অনায়াসে ওপারে চলে যেতে পারব। দস্যিপনার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখল পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। বরানগর কুঠিঘাট রোড থেকে ঝাঁপ মারলাম। উঠলাম বালি ব্রিজের কাছে। প্রায় তিন মাইল সাঁতরে ছিলাম। লালবাবার আশ্রম ছিল বালিব্রিজের কাছে। ওই আশ্রমে গিয়ে উঠলাম। লালবাবার ভক্তরা দুধ ফল খাইয়ে আমাদের চাঙ্গা করলেন। তিন মাইল সাঁতরে তো হাঁপিয়ে গিয়েছি। ওদিকে বাড়িতে খবর চলে গিয়েছে যে আমরা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছি। পরে হাঁটাপথে লালবাজার আশ্রম থেকে যখন বাড়ি ফিরলাম, দাদার হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলাম। ঠাম্মা-মা-দিদি কিছু বলেনি। এই মার খাওয়ার অবশ্য কারণও আছে। যুক্তিসংগত সেই কারণ হল আমি বাড়ির সকলকে টেনশনে রেখেছিলাম। সেটা ঠিক কাজ হয়নি। তবে তখনকার মতো মার হজম করেও পরে বলতে পেরেছি গঙ্গা এপার ওপার করেছি।

আগেই বলেছি ঠাকুমার হাত ধরে আমার যাত্রা-পালা গানের নেশা তৈরি হয়েছিল। পাড়ায় বা মুন্সির মাঠে ‘কেত্তন’ শুনতে যেতাম ঠাকুমার সঙ্গে। এমনকী রাত জেগে থিয়েটারও দেখতাম। পরদিন স্কুল থাকায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার হুকুম আসত— প্রায়ই তা মানতাম না। পালাগানের কথক ঠাকুর অবলীলায় কীভাবে প্রশ্নোত্তরে পালা চালিয়ে যেতেন তা ওই বালক বয়সের বিষ্ময় ছিল। আমার অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা তখন থেকেই। একবার পাড়ায় ‘বিয়াল্লিশ’ অভিনীত হল। আমাদের প্রামাণিক ঘাটের পাড়ায় এসবের চর্চা ছিল। সমাদরও ছিল। পাড়ায় ছোটো বড়ো সবাই মিলে ‘বিসর্জন’ ‘রক্তকরবীর’ মতো নাটকও মঞ্চস্থ করেছি। তা হেমেন গুপ্তের ‘বিয়াল্লিশ’ নিয়ে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। অত্যাচারী ইংরেজ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় এর আগে বিকাশ রায়ের অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসিত। সেই পার্ট দেওয়া হল আমায়। তখন স্কুল ফাইনালও পাশ করিনি। তবে অভিনয় যে জবরদস্ত হয়েছিল তা বুঝেছিলাম, যখন নাটক শেষে একটানা হাততালি আর পিঠচাপড়ানি জুটেছিল ভাগ্যে। বাড়ি ফিরে সব শুনে ঠাকুমাই প্রথম বলেছিলেন, অভিনয়ে যাওয়ার কথা। সেই সময় এই আশীর্বাদ ক’টা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের ভাগ্যে জোটে জানি না। তবে আমার ভাগ্যে জুটেছিল। অবশ্য মা সেদিন হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন, যাই করি পড়াশোনাটা যাতে না-ছাড়ি। কেন জানি না বড়ো কান্না পেয়েছিল। মা তো মুখ ফুটে কিছু চাইতেন না। মায়ের ওই একটা কথাতেই পড়াশোনাটা চালিয়ে নিয়ে যাই।

শুধু যাত্রাপালা নয়, সিনেমার প্রতি ঝোঁকটাও স্কুল বয়েস থেকেই। আমাদের চারজনের একটা দল ছিল। বিশ্বনাথ, সমীর, দাদু আর আমি। দাদু বেশি বয়সে পড়াশোনা শুরু করে— তাই ওই নামকরণ। লোকের বাগানের পাকা আম-কাঁঠাল চুরি থেকে শুরু করে মেয়ে দেখা সবই চারজন মিলে। সমীর বেশ ভালো ছবি আঁকত। আর বিশ্বনাথ পড়াশোনায় একেবারেই কাঁচা ছিল। স্কুল পাশের পর ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না। এরপর বহু বছর বাদে আমি যখন অভিনয় করছি, তখন একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দেখি বিশ্বনাথকে। হাতে খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এত বছর বাদে ওকে দেখে চিনতে পেরে এগিয়ে যাই। বিশ্বনাথও চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরে। অদ্ভুত সরল হেসে জানায় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. করছে— ক্লাস ছিল। আমি জানতাম বিশ্বনাথ স্কুল ফাইনাল পাশ করতে পারেনি। সেদিন বাল্যবন্ধুকে ওইভাবে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। যাই হোক ছোটোবেলায় ফিরে যাই। ঠাকুমার প্রশ্রয়ে প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে নিউ তরুণ, জয়শ্রীতে সিনেমা দেখতাম। তবে এ ব্যাপারে ঠাকুমার একটা বাধা ছিল। কোনও হিন্দি সিনেমা দেখার অনুমতি একেবারেই ছিল না। ”আমাগো সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখো, ওরা ভদ্রভাবে ভালোবাসা-বাসি করে— কিন্তু ওইসব হিন্দি-সিন্দি এক্কেরে না।” প্রবলভাবে বিদ্রোহ করে বললাম, ”তাহলে টারজান দেখলাম যে? মেমসাহেবকে চুমু খায়— তাতে দোষ নেই?” ঠাকুমা গম্ভীরভাবে বললেন, ”ওরা ইংরেজি চুমু খায় ওতে দোষ নাই।” যাই হোক প্রায়ই ঠাকুমা টাকা দিত সিনেমা দেখার জন্য। যতই ‘ভদ্রভাবে ভালোবাসা-বাসি’ করুক— ওই সিনেমা দেখেই মেয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারতাম না। রাস্তায় বা অন্য বাড়ির দোতলায় সুন্দরী মেয়ে দেখলেই নিজেকে সিনেমার হিরো ভেবে আকুলভাবে তাকাতাম। এই ‘ঝাড়ি মারা বিদ্যে’-র ভাগীদার ছিল আমার বন্ধুরা। বহুবার মেয়ে দেখতে গিয়ে তাদের বাড়ির অভিভাবকদের তাড়া খেয়ে বাড়ি ফিরেছি। তো যাই হোক। এই সিনেমা দেখার ফল ও প্রভাব কতটা মারাত্মক ছিল, তার একটা উদাহরণ দিই। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। সদ্য ‘রবিনহুড’ দেখে এসেছি। বীরত্বে টগবগ করতে করতে বাঁশের বাখারি আর দড়ি দিয়ে তীর-ধনুক বানিয়ে গোটা দোতলা জুড়ে ছুটে বেড়াতাম। তীরের মুখে একটা করে পেরেক লাগানো। এই করেই একদিন মহাবিপত্তি হল। বাড়ির একটা বিশেষ দরজা ছিল, সেটা মাসের এক তারিখেই খোলা হত। কারণ মাসের এক তারিখেই আমাদের বাড়িওয়ালা বলাইবাবু ভাড়া নিতে আসতেন। তো আমার রবিনহুডগিরি চলছে। ভুলে গেছি সেটা মাসের প্রথম দিন আর সকাল সাড়ে দশটা বাজে। সাড়ে দশটা ছিল বলাইবাবুর আসার সময়। আমি দরজা লক্ষ্য করে একটা তীর ছুড়েছি আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। তীর সোজা লাগল বলাই বাবুর বুকে। পেরেক গেঁথে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। উনি তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলেন, ”বাঙালটা মেরে ফেললে রে।” সে এক মারাত্মক কাণ্ড। রীতিমতো বাঙাল-ঘটি যুদ্ধ হয় আর কী, তারপর তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা হল। বলা হল এটা ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়। রবিনহুড দেখার ফল। তারপর থেকে বাড়িতে কোনো সিনেমা দেখে ফিরলেই ঠাকুমা হালকা করে সাবধান করতেন।

ঠাকুমার কথা বলতে গেলে একটা গোটা বই হয়ে যাবে। এককথায় ঠাকুমা আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। ছোটোবেলায় একবার বক্সিং শিখতে গেছিলাম। বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলাম তো। তবে প্রথম দিনে মার খেয়ে বক্সিংয়ের আশা ছেড়ে দিই। তবে তারপর ঠাকুমার উৎসাহে গঙ্গার ধারে কুস্তির আখড়া খুলেছিলাম। কয়েকজন কুস্তিগীরও হল। সে উৎসাহও ক’দিনেই মিটে গেল। তারপরই আবার নতুন ঝোঁক উঠত আর ঠাকুমা সঙ্গ দিতেন। আসলে তখন বাড়িতে আমিই ছোটো। বড়দা রেলে কাজ করতেন। মেজদা ছোটদাদুর বাড়িতে থাকত। ঠাকুমার আদরের সব ভাগ আমি পেতাম। আজ এই বয়সেও ঠাকুমার স্নেহ বড়ো মিস করি। ঠাকুমার হাতের এঁচোড় বা ‘গাছ পাঁঠা’ আর কাসুন্দির স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে।

ছেলেবেলার স্মৃতি মানেই সিংহভাগ জুড়ে আমার স্কুলজীবন। তবে পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন মানে ভবানীপুরের স্কুল নয়। ক্লাস সিক্স-এ যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম অর্থাৎ কাশীপুর ইনস্টিটিউশন। থ্রি,ফোর,ফাইভে ছিলাম ভবানীপুরের স্কুলে।তারপর বরাহনগরের একেবারে লাগোয়া স্কুল। বিলিতি আমলে তৈরি আমাদের স্কুল বাড়িটি বিশালাকায়। গঙ্গার ধারের কাশীপুর ইনস্টিটিউশন তখন এ এলাকার অন্যতম অভিজাত স্কুলও বটে। প্রখর গ্রীষ্মের সকালে মনোরম প্রকৃতির আমেজ গায়ে মেখে স্কুলে ক্লাস বা বসন্তে পলাশ-কৃষ্ণচূড়া-শিমুলের লাল কার্পেট-মোড়া পথের শোভা এখনকার শহরবাসীরা অনেকেই পান না। বিলিতি আমলে তৈরি বলেই কাশীপুর ইনস্টিটিউশনের উঁচু সিলিং আর রাজকীয় চেহারা তাক লাগানো ছিল। একেকটা ঘর এতই বড়ো যে কথা বললেও ইকো হত, পরীক্ষা হলের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আমার মতো কাঁচা ছাত্রের ‘টুকলি’ মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হত। চুরিবিদ্যার প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন একটা ঘটনা দিয়ে স্কুলজীবনের ইতিহাস শুরু করি। সংস্কৃতে আমি বরাবরই কাঁচা ছিলাম। কেন জানিনা ধাতুরূপ বা সংস্কৃতে অনুবাদ মাথায় বিশেষ ঢুকত না। সেকথা তো আর মাস্টারমশাইরা শুনবেন না। বিশেষত স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায়। যখন খাতা অচেনা কোনো গম্ভীর মাস্টারমশাই দেখবেন। দুরুদুরু বুকে স্কুল ফাইনালের পরীক্ষা হলে বসেছি। মনে মনে প্রায় ইষ্টনাম জপ করছি— কোনওভাবে উতরে গেলেই হয় আর কী। আমার সামনের বেঞ্চে বসেছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় সুরেশ। সুরেশকে প্রায় কাকুতির স্বরে বললাম, ”ভাই বেশি না— তোর খাতাটা মাঝে মাঝে একটু দেখাস, পাশ নম্বরটা তুলেই ব্যস আমি খাতা জমা দিয়ে দেব।” সুরেশ নিমরাজি মতো হল। পরীক্ষা শুরু হল। সুরেশ দেখি খসখস করে লিখেই চলেছে। আমায় আর খাতা দেখায় না। আমি সুরেশকে পিছন থেকে খোঁচা মেরেই চলেছি। সুরেশ অনড়। শেষে মাথায় দুর্বুদ্ধি জাগল। হাত বাড়িয়ে হঠাৎ সুরেশের খাতা লক্ষ্য করে পেন ঝাড়লাম। ব্যস লেখা পাতার ওপর কালির ছোপ। ফিসফিসিয়ে সুরেশকে এমন হুমকিও দিলাম— ”না দেখালে বাকি লেখারও এই হাল হবে।” প্রচণ্ড ভয় পেয়ে শেষে সুরেশ সামনের বেঞ্চ থেকে তেরচা করে ধরল পাতাটা। আমি পেছন থেকে টুকলাম। তবে ভদ্রলোকের এক কথা। খালি পাশ নম্বর অবধি টুকে বেরিয়ে এলাম। এভাবেই স্কুল ফাইনালে টুকে পাশ করলাম সংস্কৃত। এই প্রসঙ্গেই আরেকটা বেশ মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। সেবার প্রি-টেস্ট। ভূগোল পরীক্ষার একটা বিষয় থাকত— মানচিত্র আঁকো। এমনিতে আঁকবার হাত আমার ভালোই ছিল। কিন্তু একেবারের নিখুঁত মানচিত্র আঁকতে সেভাবে সড়গড় ছিলাম না, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার অংশটুকু কেমন যেন গুলিয়ে যেত। তা যাই হোক, মোটামুটি একটা এঁকে কোথায় কোন জায়গায় সেগুলো অবস্থিত পয়েন্টিং-এর মাধ্যমে আমরা ক্লাসে ঠিক করে নিতাম। তো প্রি-টেস্ট পরীক্ষার আগে আমার এক বন্ধু হরিদাস হঠাৎ করে musical হয়ে গেল। সুর করে গান গাইতে আরম্ভ করল— “Geography পরীক্ষায় ফাটিয়ে দেব।” কী হল ব্যাপারটা? একটু তলিয়ে দেখতে হয়। হরিদাসকে একফাঁকে ধরে সিনেমা আর খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ব্যাপারটা জানলাম। পাতলা সরু লোহার জালে তৈরি একটা ভারতের মানচিত্র জোগাড় করেছে হরিদাস। খাতার ওপর সেই জালি রেখে হালকা চাপ দিলেই ফুটে উঠবে মানচিত্রের আকার। আমার তো চোখ ছানাবড়া। প্রভূত ঘুষের লোভ দেখিয়ে হরিদাসের সেই প্রসাদের ভাগ নেবার বন্দোবস্ত করলাম। পরীক্ষা শুরু হল। গুনগুন গান গাইতে গাইতে হরিদাস বুকের প্রায় পাঁজর হাটকে সেই মানচিত্রের ছাপ বের করল। আমি পেছন থেকে বিস্ফারিত চোখে অপেক্ষারত। হাসিমুখে খাতার ওপর হালকা চাপ দিয়ে হরিদাস ফিসফিসিয়ে বলল— ”হয়ে গেছে”। প্রথম পাতায় নিখুঁত ভারতের মানচিত্রের ছাপ। এরপর হালকা পেনসিল বুলিয়ে নিলেই হবে। তবে আমি লক্ষ করলাম পরের দু’টো পাতা ওলটাতেই হরিদাসের মুখের ভাব হাসিখুশি থেকে বিস্মিত ও কাঁদোকাঁদো চেহারায় পরিণত হল। প্রায় কেঁদে ফেলে এই ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল— ”প্রেশারটা উত্তেজনায় জোরে দিয়ে ফেলেছি ভাই। প্রত্যেক পাতায় ভারতের মানচিত্র।” সব দেখে আমি তড়িঘড়ি নিজে নিজে মানচিত্র আঁকায় মন দিলাম। হরিদাস সেবার ভূগোল পরীক্ষায় ফেল করে। কারণ উত্তেজনাবশত লোহার মানচিত্রে এত জোর চাপ দিয়েছিল যে খাতার প্রতি পাতায় ভারতের মানচিত্র ফুটে ওঠে।

স্কুল মানেই মাস্টারমশাইদের স্মৃতি ভীড় করে আসে। আমাদের যুগে মাস্টারমশাইদের সঙ্গে খুব সুন্দর সম্পর্ক থাকত। যেমনটা আজকাল আর দেখি না। বকা খেতাম দোষ করলে আর যে পরিমাণ স্নেহ পেয়েছি— তার তুলনা মেলা ভার। বাংলার মাস্টারমশাই মাখনবাবু যেমন। এই মাখনবাবুর কাছে সপ্তাহে তিনদিন টিউশন পড়তে যেতাম। আমরা সেই চারজনের দল মিলে। কুড়ি টাকা নিতেন মাখনবাবু। বাংলা পড়াতেন, আমার সংস্কৃতের বহর দেখে বললেন, ”তোগো মাঝেমাঝে সংস্কৃতও পড়াই দিবো। না হইলে পাশ করবি ক্যামনে?” মাখনবাবুর তত্ত্বাবধানে বাংলা-সংস্কৃত দুই-ই চলতে লাগল। বাংলার আর এক মাস্টারমশাই প্রভাতবাবু আমাদের সবার কাছে ”ভূতস্যার” নামে পরিচিত ছিলেন। এর পিছনেও একটা ঘটনা আছে। একদিন বর্ষার দিনে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বড়ো কম। মাস্টারমশাইরাও বেশি আসেননি। ক্লাসে শোরগোল চলছে মহানন্দে হঠাৎ প্রভাতবাবু আসলেন। পূর্ববঙ্গের লোক। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”কীরে? খুব হাসিখুশি? পড়া নাই? মাথার উপর কেউ নাই। ভালো ভালো।” পিছন থেকে বিশ্বনাথ হঠাৎ বলল, ”আজ একদম পড়তে ভালো লাগছে না স্যার। একটা ভূতের গল্প বলুন।” এককথায় রাজি প্রভাতবাবু ভূতের গল্প শুরু করলেন। শুরুটা ছিল— ”এমনই এক বারিধারা দিন। চারদিকে শেয়াল ডাকার আওয়াজ হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া— এরই মাঝে গিন্নি আমায় কইল বর্ষায় ইলশা বড়ো জমে। গিন্নিরে বড়ো ভালোবাসতাম তো।” ইতিমধ্যে ক্লাসে স্যারের বারিধারার বর্ণনা আর গিন্নির প্রতি ভালোবাসা শুনে হালকা আওয়াজ উঠেছে। প্রভাতস্যার বলে চলেছেন, ”বাজারে গিয়া দেখি চারদিক ফাঁকা— কেউ নাই। একখানা সাদা থান পড়া বুড়ি ইলশা সামনে নিয়া বইস্যা। ভয়ে ভয়ে দাম জিগাইলাম— একখান শীর্ণ হাত দেখাইল পাঁচ টাকা। দাম দিয়া দেখি বুড়ি নাই। মাছ লইয়া দৌড় লাগাইছি, শুনি পিছনে বুড়ি তার খোনা গলায় চেঁচাইতেছে— দাম কম দিচ্ছেন। আমি একখান কবরের ওপর উঠলাম। হা হা-কবরে দাঁড়াইলে ভূতে ধরে না।” স্যার গল্প শেষ করতেই সারা ক্লাসে চারদিক থেকে নানা স্বরে শুরু হল— ”এমনই বারি ধারা— ধারা-ধারা-ধারা।” ”শিয়াল ডাকে হুক্কা হুয়া-হুয়া- হুয়া।” আর রাস্তাঘাটে প্রভাতবাবুকে দেখলেই ‘ভূত স্যার’ উপাধি কাশীপুর স্কুলের favourite তখন।

স্কুল থেকে একবার বেড়াতে গেছিলাম হাজারিবাগে। স্পোর্টসের স্যার উপেনবাবুর তত্ত্বাবধানে মাত্র জনা ছ’য় ছাত্র গেলাম হাজারিবাগ। মাত্র ১৫ টাকার বিনিময়ে। সে এক মহা রোমাঞ্চ। প্রথম দিন হাজারিবাগ স্টেশন লাগোয়া বাংলোয় জিনিসপত্র রেখে এদিক-ওদিক ঘুরলাম। রাতে অসামান্য খাবার। পরদিন গেলাম পরেশনাথ পাহাড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির। এমনিতে সেটা গরমকাল হলেও সেদিন কোনও কারণে প্রকৃতি বিরূপ। ঝড়বাদল পাত্তা না দিয়েই আমরা ছ’জন পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পাহাড়ি পথে প্রায় সারাদিন কাটিয়ে খিদে তেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে যখন পাহাড়ের মাথায় এলাম তখন মন্দিরে ওঠার শক্তি নিঃশেষ। বন্ধুরা বলল ফিরে যেতে। জানি না কেন, প্রকৃতির ওই রুক্ষ সৌন্দর্য অদ্ভুত জোর দিল। দৃঢ়ভাবে সবাইকে অবাক করে আমি সিঁড়ি দিয়ে মন্দিরে উঠতে লাগলাম। হামাগুড়ি দিয়ে উঠছিলাম। ঝড়ের তাণ্ডব তখনও চলছে। জানি না, কতক্ষণে পৌঁছলাম। হঠাৎ ঘণ্টার শব্দে চমক ভাঙল। মন্দিরের পুজারী বিগ্রহের সামনে প্রসাদের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত শান্ত হেসে আমায় মাথায় টিকা দিলেন। মোহাবিষ্টের মতো চরণামৃত পান করে নীচে নামলাম বন্ধুদের জন্য প্রসাদ নিয়ে। কোনও ধর্মীয় ভাবনায় নয়, সেদিন আপ্লুত হয়েছিলাম প্রকৃতির আদি-অকৃত্রিম শক্তির জোয়ারে। প্রসাদ খেয়ে হোটেলে ফেরার সময় আর এক কাণ্ড। একখানাই গাড়ি নাকি ওইখান থেকে যাবে স্টেশন। অবিশ্বাস্য শোনালেও ড্রাইভারের কোলে, ডিকির ওপর, গাড়ির ছাদে মিলিয়ে সবশুদ্ধ বাইশ জন অ্যাম্বাসাডার করে বেরোলাম ওই স্থান থেকে।

হাজারিবাগ ট্যুরে ফুটবল খেলেছি। এলাকার কিছু লোক আমাদের উপেনস্যারের কাছে এসে পড়েছিল। আমাদের দল দেখে কেন জানি তারা মনে করেছিল আমরা ফুটবল খেলি। পরদিন ম্যাচ, শহরের দলের সঙ্গে। ওদের দলে ছেলে কম পড়েছে। উপেনস্যার মহা উত্তেজিত হয়ে আমার নাম সাজেস্ট করলেন। আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধোয় আর কী! একে সারা গায়ে ব্যথা— তায় প্র্যাকটিস নেই। তারপরে নাকি বুট পরে খেলতে হবে। তবু স্যার ও বন্ধুদের উৎসাহে খেলতে নামলাম পরদিন। খানিকটা ওয়ার্ম-আপ করে বুঝলাম গায়ে একেবারে জোর নেই— আর ভারী বুটে পা তুলতেই পারছি না। খেলা শুরু হল। সে কী নাকানিচোবানি। হাফ টাইমের আগে চার গোল খেয়ে বসে আছি। স্যারও বুঝতে পারছেন না। হাফ টাইমের পর আবার এক গোল খেলাম। খেলা শেষের কিছু আগে বহু কষ্টে এক গোল দিলাম— ওইটা আমার সঞ্জীবনী ছিল। না-হলে মার খেয়ে মরতাম সেদিন সমর্থকদের হাতে। খেলা শেষে হাজারিবাগের সমর্থকরা এসে বলল, ”আপ আচ্ছা নেহি খেলা। জো ভি হো এক গোল তো দিয়া।”— যাই হোক ড্রেসিংরুমে ফিরে দেখি, জামা-জুতো নেই। হারের শোধ নিতে আমায় পেটায়নি বটে সমর্থকরা। তবে আমার জামা-জুতো ফেলে দেয়। উপেনস্যার বলেন, ”প্রাণ নিয়ে ফিরে চল।” পরে স্যার আমায় জামাপ্যান্ট আর চটি কিনে দেন। খেলার শেষে ল্যাংচানোর অভিনয় আর ওই একটি গোল না দিলে মারাই পড়তাম সেবার।

বেড়াতে যাবার কথা যখন উঠল তখন আর একটি ঘটনা বলি। প্রথম দার্জিলিং যাবার স্মৃতি। স্কুল ফাইনাল পাশের পর গেছিলাম। আমার চার পিসতুতো বোনকে দার্জিলিং দেখানোর ভার পড়েছিল আমার কাঁধে। খোঁটা দিয়ে পিসিমা বললেন, ”থার্ড ডিভিশনে পাস করলি। যা এবার বোনদের ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।” আমার চার পিসতুতো বোন আলতা, কাজল, সুরমা, সিঁদুর— বেশ সুন্দরী। ডায়োসেশনে পড়া স্মার্ট ছাত্রী। ওদের সামনে হিরো সাজার জন্য বললাম দার্জিলিংয়ে আমার চেনা লোক আছে। পুরোটাই ঢপ। যাই হোক কাজলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশি ছিল। নির্দিষ্ট দিনে হইহই করতে করতে ট্রেনে চড়লাম। গান-আড্ডায় সময় কেটে গেল। পরদিন পৌঁছলাম শিলিগুড়ি। সেখানে প্রথম আমার ছোটো ট্রেনে চড়া। পাহাড়ের ধার দিয়ে চলা ট্রেন। সে কী দৃশ্য। পাহাড়ের গায়ে থোকা থোকা লাল ফুলের সমাহার দেখে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা মনে এল। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটাই রডোডেনড্রেন গুচ্ছ— গোটা দার্জিলিংয়ে এ ফুলের ছড়াছড়ি, বোনেদের কাছে গর্ব করে এ তথ্য দেওয়ার সময় দেখি সাংঘাতিক কাণ্ড। বোনেরা ঠান্ডায় কাঁপছে। সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী। ঠান্ডা বস্ত্র সব লাগেজ কামরায়। আবার আমার হিরোগিরি। ট্রেন থামলে ইঞ্জিন ড্রাইভারকে মিনতি করে খানিকক্ষণ ট্রেন থামিয়ে গরম বস্ত্র বার করলাম। খানিক পরে এল সেই স্বপ্নের দার্জিলিং। যদিও আমার ঘাম দিচ্ছে। কারণ এবার তো ঢপ ধরা পড়বে। দার্জিলিঙে কোথায় থাকব। বোধহয় ভাগ্য আমার সহায় ছিল। নিকটবর্তী এক ব্যানার্জি হোটেলের কিছু গাইড স্টেশনে ছিল। আলাদা করে কথা বলে দারুণ ব্যবস্থা করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি আমাদের পিছু নিয়েছে ফার্স্ট ক্লাসের একদল কলেজ পড়ুয়া তরুণ। পরে জেনেছি ওরা ভদ্র ছেলে। ব্যানার্জি হোটেল আমাদের পাঁচজন আর ওই ছেলেগুলির দল মিলিয়ে রমরমিয়ে উঠল। আমার চার সুন্দরী বোনের নাম-মহিমা নিয়ে গান বাঁধল ছেলের দল। শেষে ভাবও জমল। দলের সবচেয়ে সুন্দর সুবোধের বেশ মনে ধরে কাজলকে। মাথা ধরার ওষুধ চাওয়ার মাধ্যমে যে আলাপ তা দীর্ঘকাল কলকাতায় ফিরে চিঠি চালাচালিতে রূপ পেয়েছিল। পরে বাড়ির লোকের হস্তক্ষেপে সে সম্পর্কে ছেদ পড়ে।

গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন বড়ো মন কেমন করত। একমাস স্কুলে না আসতে পারায় মন খারাপ। আমরা সাধ্য অনুযায়ী সমস্ত স্যারদের ফুল-মিষ্টি-ফল-চাদর দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতাম। চরম দুষ্টু ছাত্রকেও আশীর্বাদ করতেন অঙ্কের কড়া টিচার শৈলেনস্যার। হেডস্যার পি সেনের ধুতির ওপর কোটপরা গম্ভীর চেহারা সেদিন উৎফুল্ল থাকত। একমাস দেখা হবে না বলে মন কেমন করত— “Stand up on the bench”- এর হুকুম জারি করা ভূগোলের স্যারের জন্যও। সব দুষ্টু ছাত্রের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতেন শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইরা। এখনও সে আশীর্বাদ পাথেয় করে এগিয়ে চলেছি।

_____

* ছবিটির নাম জজসাহেবের নাতনি (১৯৪৩) পরি : কালীপ্রসাদ ঘোষ ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *