যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গারোহণ কি সত্য?

যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গারোহণ কি সত্য?

সবশেষে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। যুধিষ্ঠিরের সশরীরের স্বর্গারোহণ ঘটেছিল কি না? কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের প্রথমেই নির্ণয় করতে হবে, স্বর্গ কোথায়? এর বিশদ ও বিস্তৃত আলোচনা আমি করেছি আমার ‘দেবলোকের যৌনজীবন’ তৃতীয় সংস্করণ গ্রন্থে। সেখানে আমি দেখিয়েছি যে স্বর্গ অন্তরীক্ষে কোনো জায়গা নয়; ইহজগতেই হিমালয়ের উত্তরাংশে। মহাভারতের মহাপ্রসস্থানিকপর্ব অনুযায়ী যুধিষ্ঠির হিমালয়ের অপরপ্রান্তে অবস্থিত স্বর্গে গিয়েছিলেন। পৌরাণিক তথ্যের ভিত্তিতে আমি সে জায়গাটার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা আমার ‘দেবলোকের যৌনজীবন’-এ দিয়েছি। সেটাই এখানে আবার বলছি।

ঋগ্বেদে ‘স্বর্গ’ সম্বন্ধে কোনো কথা নেই! পুরাণেই স্বর্গের কথা আছে, এবং সেটাই দেবতাদের নিবাসস্থল বলা হয়েছে।

স্বর্গ সম্বন্ধে পুরাণ থেকে যেসকল তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে, সেগুলোই আমি প্রথম এখানে স্থাপন করছি। পুরাণমতে সুমেরু পর্বতে বিশ্বদেব ও মরুদণ বাস করতেন। এর শিখরেই ছিল বরুণালয়। ইন্দ্রের আলয় রাজধানী অমরাবতীও অবস্থিত ছিল সুমেরু পর্বতে। অমরাবতীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল অলকানন্দা নদী। সুতরাং সুমেরু পর্বত ও অলকানন্দা নদীর অবস্থান যদি আমরা নির্ণয় করতে পারি, তাহলে দেবতাদের বাসভূমি দেবলোক বা স্বর্গের আমরা হদিস পায়।

বদরিকাশ্রমের পর যে পার্বত্য ভূভাগ অবস্থিত তাকে বলা হয় হিমবতবর্ষ। বদরিকাশ্রমের ঠিক পরেই যে পর্বতশ্রেণি ছিল, তার নাম পুরাণে নৈষধপর্বত। এর পশ্চিমে ছিল হেমকূট পর্বতশ্রেণি, আর উত্তরে ক্রমান্বয়ে গন্ধমাদন, সুমেরু, এবং সর্বশেষ নীল পর্বত। হেমকূট পর্বতশ্রেণির পরেই ছিল কৈলাস পর্বত, তারপর মৈনাক পর্বত। এর পরবর্তী অঞ্চলে দুটি সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল—একটি কেতুমাল ও অপরটি উত্তরকুরু। এই অঞ্চলকে বলা হত হরিবর্ষ। সুমেরু পর্বতের পাশে ছিল ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্বু এবং উত্তরকুরু। কেদারনাথ তীর্থ তিনদিকে সুমেরু পর্বত দ্বারা বেষ্টিত ছিল।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে তিব্বত দেশের উত্তর ও চীন দেশের পশ্চিম পর্বতশ্রেণিকেই সুমেরু পর্বত বলা হতো। অলকানন্দা গঙ্গোত্রীর কাছে গঙ্গার চার ধারার মধ্যে একটি। অমরাবতীর মধ্য দিয়েই অলকানন্দা প্রবাহিত হতো, এবং এর দক্ষিণ তীরেই বদ্রিনাথ তীর্থ অবস্থিত। গঙ্গোত্রীয় ভৌগোলিক অবস্থান হচ্ছে ৩০°৫৯ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৭৮°৫৯ পূর্ব দ্রাঘিমায়। এর উচ্চতা ৩৪৪১ মিটার। বদ্রিনাথ অঞ্চলের চৌখাম্বা (উচ্চতা ৭,৬৪৬ মিটার) শিখর হতে উদ্ভূত গঙ্গোত্রী, হিমবাহের উত্তর-পশ্চিমে যে স্থান হতে পূর্ব হিমবাহ গলে গঙ্গানদীরূপে প্রকাশিত হতো, সেই স্থানটিই গঙ্গোত্রী নামে খ্যাত। এখান হতেই গঙ্গার অপর উৎসমুখ অলকানন্দা প্রবাহিত। ইহা ভারতের অন্যতম দীর্ঘ হিমবাহ। এই হিমবাহের নিকটেই কেদারনাথ শৃঙ্গ (উচ্চতা ৬৯৪০ মিটার) ও এর বামদিকে শিবলিঙ্গ পর্বতমালা। কেদারনাথ তীর্থ (উচ্চতা ৩৫২৫ মিটার) চামোলি জেলার উখিমঠ মহুকুমায় অবস্থিত। হৃষীকেশ হতে বাসে ১৭৯ কিলোমিটার নেমে কুণ্ডবটি। সেখান থেকে হাঁটাপথে ৫১ কিলোমিটার দূরে ত্রিষুগীনারায়ণ। ত্রিষুগীনারায়ণ হয়ে কেদারনাথ তীর্থে যেতে হয়।

কৈলাস পর্বত মহাদেব ও কুবেরের বাসস্থান। কৈলাসের উচ্চতা ৬৭১৪ মিটার। লিঙ্গাকৃতি এই শিখরটি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতে, লাসা হতে কাংরিম পোচেতে। মহাভারতে (৬/৭/৩৯) কৈলাসকে হেমকূট বলা হয়েছে। কৈলাসের ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মানসসরোবর। এই মানসসরোবরের উত্তর তীরস্থ পর্বতেই ইন্দ্রের সঙ্গে বৃত্রের একশত বৎসর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতেই আমি কতকগুলো জায়গায় অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা দিচ্ছি। এ থেকেই স্বর্গ বা দেবলোকের অবস্থান বুঝতে পারা যাবে।

কেদারনাথ ৩০° ৪৪ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯° ৬৩ পূর্ব দ্রাঘিমা।

গঙ্গোত্রী ৩০° ৫৬ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯° ০২ পূর্ব দ্রাঘিমা।

বদ্রিনাথ ৩০° ০০ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯° ৩০ পূর্ব দ্রাঘিমা।

মানসসরোবর ২৬° ১৩ উত্তর অক্ষাংশ ৯০° ৩৮ পূর্ব দ্রাঘিমা।

মানসসরোবরের ২৬ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণ কৈলাস।

এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে দেবলোক বা স্বর্গ অন্তরীক্ষে কোনো জায়গায় নয়; ইহজগতে হিমালয়ের উত্তরাংশ।

সুতরাং যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সেখানে যাওয়া কিছু অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। অর্জুন ও বেহুলাও সেখানে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *