মহাভারত ‘জাতীয় ইতিহাস’

মহাভারত ‘জাতীয় ইতিহাস’

ক.

আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত যে মহাভারত মাত্র মহাকাব্য নয়, এটা আমাদের জাতীয় ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ শীর্ষক ক্লাসিক নিবন্ধে (‘প্রবাসী’, বৈশাখ, ১৩১৯)। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার এই নিবন্ধটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন (‘মর্ডান রিভিউ’ আগস্ট ও সেপ্টেম্বর, ১৯১৩)। ওই নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘আর্যসমাজে যতকিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি (ব্যাস) এক করিলেন। মাত্র জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস তর্কবিতর্ক ও চরিত্রনীতিকেও তিনি এইসঙ্গে এক করিয়া জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত! ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’

মাত্র মহাভারত নয়। অপর মহাকাব্যে রামায়ণ ও পুরাণসমূহ থেকেও আমরা ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক উপাদান পাই। আমার শিক্ষাগুরু ড. দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকার বলতেন যে, পুরাণসমূহের মধ্যেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। এফ. ই. পারজিটার, ভিনসেন্ট স্মিথ, এল. ডি. বার্নেট ও ইদানীংকালে অধ্যাপিকা রমিলা থাপারও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। পুরাণসমূহে যে বংশতালিকা দেওয়া আছে, তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, জগতে যে মহাপ্লাবন ঘটেছিল, তা থেকে রক্ষা পেয়েছিল মাত্র বৈবস্বত মনু। মনুকর্তৃক মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল বলে মানুষের নাম মানব বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষাকু সূর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আর মনুর কন্যা ইলার পুত্র পুরূরবা চন্দ্রবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এই দুই রাজবংশের রাজারাই প্রাচীনকালে ভারতে রাজত্ব করেছিলেন। এবং তাদের কথাই আমাদের দুই মহাকাব্যে (রামায়ণ ও মহাভারত) বিবৃত হয়েছে। রামায়ণে বিবৃত হয়েছে সূর্যবংশের ইতিহাস, আর মহাভারতে চন্দ্রবংশের ইতিহাস।

এখন কথা হচ্ছে মহাভারতে যে ইতিহাস বিবৃত হয়েছে, সে ইতিহাসটা কবেকার? বিজ্ঞ পণ্ডিতরা বলেন যে মহাভারত রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রখ্যাত ইতিহাসকার ভিনটারনিৎস্-এর তাই অভিমত। মহাভারতের রচনা ও সংকলন যে বহুকাল ধরে হয়েছিল, তা মহাভারতের অভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকেই বুঝতে পারা যায়। কেননা, মহাভারতের সূচনাতেই উল্লেখিত হয়েছে যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসের গ্রন্থ প্রথমে ৮০০০ শ্লোকে রচিত হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল ‘জয়’। পরে এটা ২৪,০০০ শ্লোকে বিস্তৃত হয়। তখন এর নাম হয় ‘ভারত’! আরও পরে একে ৮০,০০০ থেকে এক লক্ষ শ্লোকে বর্ধিত করা হয়। তখন এর নাম হয় ‘মহাভারত’। আজকের দিনে ‘মহাভারত’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা এই শেষের গ্রন্থখানা।

মহাভারত যে বহুকাল ধরে রচিত হয়েছিল, এবং এতে যে বহু হাতের লেখা আছে, তা বোঝা যায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসের দীর্ঘকালীন উপস্থিতি থেকে। কেননা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসকে আমরা শান্তনু থেকে আরম্ভ করে জনমেজয় পর্যন্ত সাতপুরুষের সমকালীনরূপে দেখি! এ থেকেই বুঝতে পারা যায় যে ব্যাস একাধিক!

আমি বহুবার বহু জায়গায় বলেছি যে মহাভারতের রচনাকাল এক, আর এর কাহিনিকাল আর এক। মনে রাখতে হবে আজকালকার দিনে আমরা যাকে বৈচারিক (ক্রিটিক্যাল) ইতিহাস বলি এরূপ কিছু প্রাচীন ভারতে ছিল না, ছিল রাজা-রাজড়াদের কীর্তি ও অতীতের ঘটনাবলি সম্বন্ধে নানা বিশ্রুতি ও লোকপরম্পরাগত কাহিনি। এই সকল বিক্ষিপ্ত কাহিনিসমূহকে একত্রিত করে রচিত হয়েছিল, গাথা (গীত), নারশংসি (প্রশস্তি), আখ্যান (নাটকীয় বৃত্তান্ত এবং পুরাণ (প্রাচীন কাহিনি)। এই রচনাসমূহ গীত বা কীর্তিত হতো। তার মানে, এগুলো মুখে মুখেই এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে হস্তান্তরিত হতো। যারা এ কাজে রত ছিল, তাদের বলা হতো সুত বা মাগধ। এরা প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রবক্তা ছিল। প্রাচীন কাহিনিসমূহ সংরক্ষণ করার এই রীতি প্রাক-বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। (অতুল সুর ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ পৃষ্ঠা ৪৮ দ্র.)। কিন্তু সুত বা মাগধরা এইভাবে কাহিনিগুলোকে এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে হস্তান্তরিত করার সময় দেশ-কাল-পাত্র ভেদে তাতে নতুন বিষয় সংযুক্ত করত। এভাবেই মহাভারতের কলেবর বেড়ে গিয়েছিল।

তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মহাভারতের মধ্যে নানাকালের কাহিনি আছে। আদিকাহিনিকাল যে কত প্রাচীন, তা সহজে বের করা খুবই মুশকিল। তবে মহাভারতের আদিকাহিনিকাল সম্বন্ধে আমাদের এক নির্ভরযোগ্য সূত্র আছে। বরাহমিহির (খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী) আমাদের দেশের একজন বড়ো জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষী ছিলেন। সুতরাং কালনির্ণয়ে আমরা তাঁর গণনা নির্ভুল বলে ধরে নিতে পারি। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’র গণনানুসারে ৬৫৩ কল্যাব্দে পাণ্ডুপত্রে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। বর্তমানে (১৩৯৪ বঙ্গাব্দে) ৫০৮৮ কল্যাব্দ চলছে। সুতরাং সেই হিসাব অনুযায়ী যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের সময় ছিল ৪৪৩৫ বৎসর পূর্বে বা খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৪৮ অব্দে। বরাহমিহিরের আগে আর একজন গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ আর্যভট্টও (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী) এটা সমর্থন করে গিয়েছিলেন (অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, জিজ্ঞাসা ১৯৭৬ পৃষ্ঠা ১৬ দ্র.)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আদি মহাভারতের কাহিনিকাল হচ্ছে ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা তার পূর্বের। এটা সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন। কেননা রেডিয়ো কার্বন-১৪ পরীক্ষার ফলে আমরা জানি যে সিন্ধুসভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে। মনে হয়, তখনই ওই সভ্যতায় তামার ব্যাপক ব্যবহারের সূচনা হয়েছিল। তবে এটা সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপার যে, যে গ্রন্থ ৮০০০ শ্লোক থেকে এক লক্ষ শ্লোকে পরিণত হয়েছিল, তার অভ্যন্তরস্থ সবকিছু সিন্ধুসভ্যতার যুগের নয়। তার আগেরকালেরও। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—’আর্যসমাজে যতকিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহাদিগকে তিনি (ব্যাস) এক করিলেন।’ ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যখন এ কথা বলেছিলেন, তখন সিন্ধুসভ্যতা আবিষ্কৃত হয়নি। সিন্ধুসভ্যতা আবিষ্কৃত হয় তার দশ বছর পরে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। এই আবিষ্কারের ফলে আমরা জানতে পারি যে বৈদিক-আর্যসভ্যতার পূর্বে ভারতে অন্য এক উন্নত সভ্যতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সে-সভ্যতার ধারকদের সমাজ আর্যসমাজ থেকে ভিন্ন ছিল। পরে সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণের ফলে হিন্দুসভ্যতার উদ্ভব হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘আর্যসমাজ’ বলেছেন সেটা ‘হিন্দুসমাজ’। সুতরাং মহাভারত যখন রচিত হয়েছিল (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) তখন ভারতীয় সমাজ আর্যীভূত হয়ে গিয়েছিল। তার মানে তখন প্রাগার্য জনগণের ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আর্যদের সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণ ঘটেছিল। দুই সমাজের ঐতিহ্য ও ট্রাডিশন তখন আর্যসমাজের সাধারণ সম্পদ হয়েছিল। আর্যসমাজ, প্রাগার্যদের শ্রুতি ও বিশ্রুতিগুলো অঙ্গীভূত করে নিয়েছিল বলেই, আমরা মহাভারতের মধ্যে সিন্ধুসভ্যতার যুগের সমাজের চেহারাও দেখতে পাই। আমি এ নিয়ে পরে বিশদ আলোচনা করব। তবে এখানে মাত্র দু-একটা দৃষ্টান্ত দেব। প্রথমেই উল্লেখ করব আদিপর্বে বর্ণিত রাজপুত্রগণের অস্ত্রশিক্ষা উপাখ্যানের। রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা নিবদ্ধ ছিল শরসন্ধান, মল্লযুদ্ধ ও গদাযুদ্ধে। ধাতুনির্মিত কোনোরূপ অস্ত্রের উল্লেখ নেই। এটা সিন্ধুসভ্যতার আদি প্রতিরূপের বা তার আগেরকালের সভ্যতার লক্ষণ বলেই মনে হয়। যদিও আদিপর্বের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে নকুল ও সহদেব অসিচালনায় পারদর্শী ছিল সেটা পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে হয়, কেননা অস্ত্রশিক্ষা পরীক্ষার জন্য যে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে আমরা নকুল ও সহদেবের অভাব ও অনুপস্থিতি লক্ষ্য করি। সেখানে ধৃতরাষ্ট্র বলছেন—’কুন্তীর তিন পুত্রের গৌরবে আমি ধন্য হয়েছি, অনুগৃহীত হয়েছি, রক্ষিত হয়েছি।’ দ্বিতীয়ত, আদিপর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে পঞ্চপাণ্ডবের বসবাসের জন্য বারণাবতে লাক্ষামিশ্রিত মাটির ঘর নির্মিত হয়েছিল। এটা এমন এক যুগের সমাজের ইঙ্গিত করছে যে যুগের রাজপুত্ররা মাটির ঘরে বাস করত। তৃতীয়ত, আমি দেখাব যে ওই যুগের সমাজে বহুপতিকবিবাহ প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল এবং পাঞ্চালীর বহুপতিকবিবাহ পরবর্তীকালে সমর্থন করার জন্য ব্যাস নানারূপ কৌশল অবলম্বন করেছেন। চতুর্থত, মহাপ্রস্থানিকপর্বে উল্লেখিত আছে যে স্বর্গারোহণের পথে এক কুকুর পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর অনুগামী হয়েছিল। এটা সিন্ধুসভ্যতার কিছু পূর্বের সমাজে কুকুরকে অনুগামী করে মানুষকে সমাধিস্থ করার প্রথার ইঙ্গিত করে। এছাড়া, মহাভারতের কাহিনি যে সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন সে সম্বন্ধে আরও যুক্তি আমি আগে উল্লেখ করেছি।

খ.

আর্যভট্ট ও বরাহমিহির আমাদের দেশের এত বড়ো গণিতজ্ঞ ছিলেন যে তাঁদের গণনা চ্যালেঞ্জ করার মতো ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস আমাদের নেই। এরা দুজনেই পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের যে তারিখ দিয়েছেন, তা থেকে স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে মহাভারতের আদিম কাহিনিকাল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বেকার।

প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় সে যুগটাকে আমরা নবপলীয় যুগের অন্তিমকাল বলি। নবপলীয় যুগের এই অন্তিমকালের কৃষ্টি থেকেই সিন্ধুসভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। সিন্ধুসভ্যতার যুগের লোকেরা ইটের কোঠাবাড়ি নির্মাণ করত ও তামার ব্যবহার শিখেছিল। কিন্তু নবপলীয় যুগের অন্তিমকালের লোকেরা ছ্যাচা-বেড়ার মাটির ঘরে বাস করত। অনেকসময় আবার তারা মাটির তলায় গর্ত করে গৃহাগৃহে ও বাস করত। নবপলীয় যুগের অন্তিমকালের মাটির ঘরের নিদর্শন আমরা ভারতে নানা-স্থান থেকে পেয়েছি। আর মাটির তলায় গৃহাগৃহে বাস করার নিদর্শন পেয়েছি কাশ্মীরের বুরজহোমের নবপলীয় যুগের কৃষ্টিতে। কাশ্মীরের বুরজহোমের নবপলীয় যুগের কৃষ্টি সম্বন্ধে আমি ইতোপূর্বে যে বিরবণ দিয়েছি, তা এখানে উদ্ধৃত করছি। ‘কাশ্মীরের বুরজহোমের নবপলীয় যুগের লোকেরা গৃহাগৃহে বাস করত। গুহার প্রবেশদ্বারের নিকট রন্ধনের জন্য উনুন তৈরি করত। বৈষয়িক বস্তুর মধ্যে ধূসর ও কৃষ্ণবর্ণের পালিশ করা মৃৎপাত্র, হাড়ের তৈরি সূঁচাল যন্ত্র সূঁচ ও হারপুন, পাথরের তৈরি কুঠার, পাথরের তৈরি গোল বালা ও মাংস কাটার অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। তবে এখানে পাথরের তৈরি ছুরির ফলা ও যাঁতাজাতীয় কোনো পেষণ-যন্ত্র পাওয়া যায়নি। রেডিয়ো কার্বন-১৪ পরীক্ষা দ্বারা জানা গিয়েছে যে এই কৃষ্টি খ্রিষ্টপূর্ব ২২৫৫ অব্দ থেকে ১৪০০ অব্দ পর্যন্ত প্রাদুর্ভূত ছিল। অন্তিমদশায় ধনুকে ব্যবহারের জন্য মাত্র একটি তামার তৈরি ব্যানমুখ পাওয়া গিয়েছে! এরা মৃত ব্যক্তিকে ডিম্বাকার গর্তের মধ্যে কবর দিত এবং মৃতের সঙ্গে কুকুর সমাধিস্থ করত।’ (অতুল সুর, “সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও অবদান”, জিজ্ঞাসা ১৯৮০, পৃষ্ঠা ২১)। আমি আজ পঞ্চপাণ্ডবের বারণাবতে জতুগৃহে অবস্থান সম্বন্ধে যে আলোচনা করব, তার সঙ্গে নবপলীয় যুগের অন্তিমদশার কৃষ্টির যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক আছে বলেই, বুরজহোমের নবপলীয় যুগের কৃষ্টির বিবরণ দিলাম।

বারণাবতে যে জতুগৃহ নির্মিত হয়েছিল, সে সম্বন্ধে মহাভারতের আদিপর্বে যে বর্ণনা আছে, তা এখানে উদ্ধৃত করছি। বারণাবতে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে পাঠানো হয়েছিল পশুপতি উৎসব দর্শনের (সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শনসমূহের মধ্যে পশুপতি বা আদিশিবের প্রতিকৃতি স্মরণ করুন) ছলনায়। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যে ছিল তাদের বিনাশ করা। এবার মহাভারতের আদিপর্বে যা লেখা হয়েছে, সেটা পড়ুন। ‘দুর্যোধন অতিশয় হৃষ্ট হলেন এবং পুরোচন নামক এক মন্ত্রীর হাত ধরে তাকে গোপনে বললেন, তুমি ভিন্ন আমার বিশ্বাসী সহায় কেউ নেই, তুমি দ্রুতগামী রথে আজই বারণাবতে যাও, এবং শণ, সজরস (ধুনা) প্রভৃতি দিয়ে একটি চতুঃশাল সুসজ্জিত গৃহনির্মাণ করাও। মৃত্তিকার সঙ্গে প্রচুর ঘৃত, তৈল, বসা, জতু (লাক্ষা), মিশিয়ে তার দেয়াল লেপে দেবে এবং চতুর্দিকে কাষ্ঠ, তৈল প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ এমন করে রাখবে যাতে পাণ্ডবরা বুঝতে না পারে তুমি সমাদর করে পাণ্ডবদের সেখানে বাসের জন্য নিয়ে যাবে এবং উত্তম আসন, শয্যা, যান প্রভৃতি দেবে। কিছুকাল পরে যখন তারা নিশ্চিত মনে নিদ্রামগ্ন থাকবে, তখন দ্বারদেশে অগ্নিদান করবে। পুরোচন তখনই দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে বারণাবতে গেলেন।’ (রাজশেখর বসু মহাভারত, পৃষ্ঠা ৬৩)।

জতুগৃহটা যে মাটির তৈরি কুঁড়েঘর ছিল, তা মহাভারতের এই অভ্যন্তরীণ বর্ণনা থেকে বুঝতে পারা যায়। সহজেই অনুমেয় যে রাজা-রাজড়াদের ছেলেদের বসবাসের জন্য (মনে রাখতে হবে যুধিষ্ঠিরকে তখন যৌবরাজে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে) মাটির কুঁড়েঘর তৈরি করা—এ নবপলীয় যুগের অন্তিমদশার কৃষ্টিকেই ইঙ্গিত করছে। তারপর আমরা মহাভারতে আবার পড়ি—’যুধিষ্ঠির সেখানে গিয়ে ঘৃত বসা ও লাক্ষার গন্ধ পেয়ে ভীমকে বললেন, নিপুণ শিল্পীরা এই গৃহ আগ্নেয় পদার্থ গিয়ে প্রস্তুত করেছে, পাপী পুরোচন আমাদের দগ্ধ করতে চায়। আমরা মৃগয়ার ছলে এই দেশের সর্বত্র বিচরণ করে পথ জেনে রাখব এবং এই জতুগৃহের ভূমিতে গর্ত করে তার ভিতরে বাস করব, আমাদের নিশ্বাসের শব্দ ও কেউ শুনতে পাবে না।’ (প্রগুক্ত পৃষ্ঠা ৬৪)। বলা বাহুল্য, মাটির নিচে গর্ত করে বাস করা; আমাদের বুরজহোমের নবপলীয় যুগের মাটির তলায় গর্ত করে বাস করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং মহাভারতে বিন্যস্ত জতুগৃহ নির্মাণের কাহিনিটাও যে নবপলীয় যুগের অন্তিমকালের বা আদি-সিন্ধুসভ্যতার যুগের ঘটনা, এবং তা পরোক্ষে আর্যভট্ট ও বরাহমিহির প্রদত্ত যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের তারিখটাকে সমর্থন করে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এরপর জতুগৃহ থেকে পলায়নের সংবাদটা শুনুন। জতুগৃহ থেকে পালিয়ে পাণ্ডবরা যে বাংলা দেশে এসেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, এটা মহাভারতে প্রদত্ত বর্ণনা থেকেই জানতে পারা যায়। বিদুর প্রেরিত বায়ুবেগসহ যন্ত্রযুক্ত পতাকাশোভিত নৌকায় যাত্রা করে (‘সর্ববাত সহাং নাবাং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিত্ৰীম’) নৌকায় (তার মানে পালতোলা নৌকায় করে) তারা গঙ্গার অপর পাড়ে অবতীর্ণ হয়ে দক্ষিণদিকে যেতে লাগলেন। ‘দুর্গম দীর্ঘপথ অতিক্রম করে পরদিন সন্ধ্যাকালে তাঁরা হিংস্র প্রাণী সমাকুল ঘোর অরণ্যে উপস্থিত হলেন।’

তারপর তারা একদিন ও একরাত্রির পর অতিক্রম করে একচক্রানগরে এসে উপস্থিত হলেন। (দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যাওয়ার সময়ও পঞ্চপাণ্ডবদের একচক্রানগর হতে গঙ্গাতীরে আসতে একদিন ও একরাত্রি সময় লেগেছিল। এ সম্বন্ধে আমি পূর্বে অন্যত্র বলেছি—’মনে হয়, মহাভারতের বারণাবত ও বর্তমান বরোনী অভিন্ন। বিদুর কর্তৃক প্রেরিত জলযানে আরোহণ করে পাণ্ডবরা পূর্বদিক রওনা হয়ে প্রভাতকালে গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবতরণ করেছিলেন। মনে হয় সে জায়গাটা রাজমহলের নিকটবর্তী কোনো স্থান। তারপর তাঁরা ঘোর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করে অবশেষে একচক্রানগরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই ঘোর জঙ্গল সাঁওতাল পরগনার জঙ্গল হবে এবং তা অতিক্রম করেই তাঁরা বীরভূমে প্রবেশ করে একচক্রানগরে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন।’ (অতুল সুর, “বাংলার সামাজিক ইতিহাস”, জিজ্ঞাসা ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ২০)।

মহাভারতে বর্ণিত একচক্রানগর যে বাংলার বীরভূম জেলার অন্তর্গত ‘একচক্রা’, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা একচক্রা নামে ভারতে আর কোনো জায়গা নেই। (এ সম্বন্ধে পরবর্তী এক অধ্যায়ে এক বিরোধী মত দেখুন)। তাদের আত্মগোপনের সময় পঞ্চপাণ্ডব যে বীরভূমে অবস্থান করেছিলেন, সে জনশ্রুতি সমগ্র বীরভূমে ছড়িয়ে আছে। এ জনশ্রুতিকে আমরা একেবারে নাকচ করে দিতে পারি না। ইতিহাস রচনায় জনশ্রুতির যে এক বিরাট ভূমিকা আছে, সে কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন যে যুক্তির সাহায্যে আমরা জনশ্রুতিকে নস্যাৎ করে দিতে পারি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রতি জনশ্রুতির মূলে কিছু না কিছু সত্য আছে। পঞ্চ পাণ্ডবদের বীরভূমে অবস্থান সম্বন্ধে জনশ্রুতি যে একেবারে কাল্পনিক নয়, তা প্রমাণিত হচ্ছে বীরভূমের অনেকগুলো জায়গার নামকরণ থেকে যথা একচক্রা, ভীমগড়, পাণ্ডবেশ্বর ও বীরভূমের সীমান্তরেখা অজয় নদীর অপর (দক্ষিণ) তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবি ইত্যাদি। বীরভূমের কয়েকটি দেবায়তনও পাণ্ডবগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে প্রসিদ্ধ। যেমন অজয় নদের উত্তরে অবস্থিত ভীমেশ্বরের শিবলিঙ্গ এবং অজয় নদের দক্ষিণে পাণ্ডবেশ্বরে অবস্থিত শিবলিঙ্গসমূহ। এছাড়া পাণ্ডুরাজার ঢিবি পাণ্ডবদের বীরভূমে অবস্থানের প্রতিধ্বনি বহন করে। পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে আমরা তাম্রাক্ষ্ম এবং তৎপূর্ব যুগের সভ্যতার নিদর্শনসমূহ পেয়েছি। এ সম্বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, পাণ্ডবরা একদিন একচক্রানগর থেকেই পাঞ্চাল রাজ্যে গিয়ে স্বয়ংবর সভা থেকে পাঞ্চালীকে জয় করে এনেছিলেন। পাঞ্চাল রাজ্য যে একচক্রানগরের সন্নিহিত দেশ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা আমি পরবর্তী প্রবন্ধে প্রমাণ করব। পণ্ডিতগণ যে বলেন দ্রৌপদীর বিবাহের সময় পাঞ্চালরাজ্য উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত ছিল, সেটা একেবারেই ভুল। যারা বলেন যে—দ্রৌপদীর বিবাহের সময় পাঞ্চালদেশ উত্তর ভারতে অবস্থিত ছিল, তাঁরা মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত এক কাহিনি ও পঞ্চপাণ্ডবের বারণাবত থেকে একচক্রানগরে আসার কাহিনির মধ্যে নিহিত এক তথ্যের প্রতি নজর দেন না। এগুলোর প্রতি নজর দিলে, তাঁরা কখনোই বলতেন না যে দ্রৌপদীর বিবাহের সময় পাঞ্চালদেশ উত্তর ভারতে অবস্থিত ছিল। বস্তুত দ্রৌপদীর বিবাহের সময় পাঞ্চাল উত্তর ভারতের পরিবর্তে প্রাচ্যভারতেই অবস্থিত ছিল। এর সপক্ষে মহাভারত ছাড়া অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থের সাক্ষ্য বিদ্যমান। তাছাড়া, মহাভারতের প্রমাণ থেকে অনুমিত হয় যে পাঞ্চালী প্রাচ্যভারতেরই মেয়ে ছিল, উত্তর ভারতের মেয়ে নয়। মহাভারতের কাহিনিকাল, ও প্রাচীন ভারতের ভূগোল, সমাজ, নৃততত্ত্ব ও জন-বিন্যাস সম্বন্ধে পণ্ডিতসমাজে বহু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। অথচ তাদের সেইসব ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যে তাঁরা মহাভারতের গ্রন্থিমোচনে প্রবৃত্ত হন, তা আমার পরবর্তী স্তবকে আলোচনা থেকে বোঝা যাবে।

গ.

আগেই বলেছি যে দ্রৌপদীর বিবাহের সময় পাঞ্চাল দেশ যে উত্তর প্রদেশে অবস্থিত ছিল, পণ্ডিতমহলের এই ধারণা একেবারে ভুল। এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহল কী বলেন, সেটাই আগে বলি। এ. এল. বাশাম তাঁর ‘দি ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ৮৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, গঙ্গা ও যমুনার অন্তর্বর্তী ভূভাগেই পাঞ্চাল দেশ অবস্থিত ছিল। আমাদের দেশের পণ্ডিতরাও তার প্রতিধ্বনি করেন। এ সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্র সরকার ‘ইতিহাস’ পত্রিকায় (নবপর্যায় ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ ৩য় সংখ্যা) বলেছেন, ‘পাঞ্চাল কুরুক্ষেত্রের উত্তরে এবং কুরুক্ষেত্র ও কুরুদেশের পশ্চিমে পাঞ্জাব ও দক্ষিণ কাশ্মীর অঞ্চলে অবস্থিত।’ পাঞ্চাল দেশের অবস্থান সম্বন্ধে, এই সকল মত প্রকাশ করতে গিয়ে পণ্ডিতগণ মহাভারতের আদিপর্বে নিহিত এক কাহিনিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন। কাহিনিটা হচ্ছে—রাজকুমারগণের অস্ত্রশিক্ষা সমাপনের পর দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা চান। দ্রোণাচার্য শিষ্যগণকে বললেন, তোমাদের শিক্ষা শেষ হয়েছে, এখন আমার দক্ষিণা চাই, তোমরা যুদ্ধ করে পাঞ্চাল রাজপ দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে নিয়ে এসো, তাই শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা। রাজকুমারগণ সম্মত হলো এবং দ্রোণকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্যে পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করল! কুমারগণ দ্রুপদ আর তাঁর অমাত্যকে ধরে এনে দ্রোণকে দক্ষিণাস্বরূপ উপহার দিল। কিন্তু বাল্যকালের সখ্যতা স্মরণ করে দ্রোণ দ্রুপদকে বললেন, “তোমাকে আমি ধর্মরাজ্য দিচ্ছি, যদি ইচ্ছা কর, আমাকে সখা মনে করতে পার।’ দ্রুপদ বললেন, ‘আমি আপনার আচরণে প্রীত হয়েছি, আপনার চিরস্থায়ী প্রণয় কামনা করি।’ তখন দ্রোণাচার্য তুষ্ট হয়ে দ্রুপদকে মুক্তি দিলেন। ‘গঙ্গার দক্ষিণে চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত দেশ দ্রুপদের অধিকারে রইল, দ্রোণাচার্য গঙ্গার উত্তরে অহিচ্ছত্র দেশ পেলেন।’ মহাভারতে এই বিবরণ থেকে দুটো জিনিস প্ৰকাশ পায়। প্রথম, পাঞ্চাল দেশ গঙ্গার উত্তরেও বিস্তৃত ছিল, যে অংশ দ্রোণাচার্য নিজ অধিকারে রাখলেন; আর গঙ্গার দক্ষিণে চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত দ্রুপদের অধিকারে রইল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই শেষোক্ত অংশ কতটা? এটা নির্ণয় করতে গিয়ে পণ্ডিতরা বলেন, চর্মস্বতী নদী, আর চম্বাল নদী একই। কিন্তু তারা ভুলে যান যে চম্বাল নদী যমুনার দক্ষিণে ও যমুনারই এক শাখা নদী, এবং তার অবস্থিতি গঙ্গার দক্ষিণে নয়, যমুনার দক্ষিণে। মহাভারতের এই অংশ পাঠ করলে বুঝতে পারা যায় যে দ্রুপদকে যে অংশ দেওয়া হয়েছিল তা গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থ প্রয়াগের পর যেখানে মাত্র গঙ্গানদী প্রবাহিত সেই গঙ্গানদীর ধারার দক্ষিণাংশ এবং পূর্বদিক তা চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আমার অনুমান চমন্বতী বর্তমান ভাগলপুর জেলার বাঁকা মহকুমায় প্রবাহিত চম্বন নদী। তার মানে গঙ্গা নদীর দক্ষিণে দ্রুপদ পাঞ্চাল রাজ্যের যে অংশ পেয়েছিল, তা ভাগলপুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটা সমর্থিত হয় পাণ্ডবগণের বারণাবত থেকে একচক্রানগরে পলায়নের কাহিনি থেকে। কেননা, মহাভারতে বর্ণিত ওই কাহিনির মধ্যে বলা হয়েছে যে পাঞ্চবরা গঙ্গার দক্ষিণ তীরে অবতরণের পর পাঞ্চাল দেশের ভেতর দিয়ে একচক্রানগরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আমি একটু পরেই দেখাব যে পাণ্ডবদের একচক্রানগর থেকে পাঞ্চাল রাজ্যে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যাওয়ার যে কাহিনি মহাভারতে আছে, তার দ্বারাও এটা সমর্থিত। সে বর্ণনা থেকে প্রকাশ পায় যে পাঞ্চাল দেশ বীরভূমের একচক্রানগরের নিকটবর্তী কোনো দেশ।

মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী পাণ্ডবরা মাতাকে নিয়ে একচক্রানগর থেকে বেরিয়ে একদিন ও একরাত্রি পরে গঙ্গাতীরে এসে উপস্থিত হয়। তারপর গঙ্গার তীর ধরে তারা ‘দ্রুপদের অধিকৃত’ দক্ষিণ পাঞ্চালে এসে ভার্গব নামে এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই তারা স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়ে, দ্রৌপদীকে জয় করে কুম্ভকারের গৃহে এসে আনন্দিত মনে কুন্তীকে জানাল যে তারা ভিক্ষা এনেছে। কুটীরের ভেতর থেকে কুন্তী বললেন, ‘তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর।’ তারপর দ্রৌপদীকে দেখে বললেন, আমি অন্যায় করে বলে ফেলেছি। তিনি দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে বললেন, তোমরা দুই ভ্রাতা দ্রুপদ রাজার এই কন্যাকে আমার কাছে এনেছ, আমি প্রমাদবশে বলেছি, তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর। যাতে এর পাপ না হয়, তার উপায় বল। যুধিষ্ঠির একটু চিন্তা করে বললেন, অর্জুন তুমি যাজ্ঞসেনীকে জয় করেছ, তুমিই এক বিবাহ কর। অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমাকে অধর্মভোগী করবেন না, আগে আপনার, তারপর ভীমের, তারপর আমার, তারপর নকুল-সহদেবের বিবাহ হবে। দ্রৌপদী সকলকেই দেখছিলেন, পাণ্ডবরাও পরস্পরের দিকে চেয়ে দ্রৌপদীর প্রতি আসক্ত হলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের মনোভাব বুঝলেন। তিনি ভ্রাতাদের মধ্যে যাতে ভেদ না হয় সেই ভয়ে বললেন, ইনি আমাদের সকলের ভার্যা হবেন। এখানে মহাভারতের কাহিনিটা পরিষ্কার নয়। কেননা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, দ্রৌপদীর বহুপতিকবিবাহটা, মাতৃ আজ্ঞায়, না যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে?

দ্রৌপদীর বহুপতিকবিবাহ সম্বন্ধে মহাভারতে মাত্র এই একটা কাহিনিই প্রদত্ত হয়নি। এর সমর্থনে আরও দুটো কাহিনি প্রদত্ত হয়েছে। আমি আগেই বলেছি যে মহাভারতের মধ্যে কোনো বিশেষ যুগের ঘটনা বা আচার-নীতির চিত্র নেই। পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের নবপলীয় ও সিন্ধুসভ্যতার যুগদ্বয়ের সন্ধিক্ষণের ঘটনা থেকে শুরু করে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর ঘটনা ও আচার- ব্যবহারের সমাহার আছে। লিখিত রূপ ধারণের পূর্বে মহাভারতের কাহিনিসমূহ সুত-মাগধগণ কর্তৃক মুখে মুখে কীর্তিত হতো। তখন যুগকালোপযোগী করার জন্য সুত-মাগধরা ওই কাহিনিসমূহের পরিবর্তন ঘটাত। যে সময় মহাভারত লিখিত রূপ পায়, সেটা হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্রের যুগ। তখন বহুপতিকবিবাহ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং যুগ ও কালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য দ্রৌপদীর বহুপতিকবিবাহকে সমর্থন করার জন্য একাধিক কাহিনি উদ্ভাবিত হয়েছিল। প্রথম কাহিনি যা মহাভারতের আদিপর্বে দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে, কোনো এক ঋষির এক পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল। পূর্বজন্মের কর্মদোষে তার পতিলাভ হয়নি। তার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব এসে বললেন, অভীষ্ট বর চাও। কন্যা বার বার বললেন, সর্বগুণান্বিত পতি কামনা করি। মহাদেব বললেন, তুমি পাঁচবার পতি চেয়েছ, এজন্য পরজন্মে তোমার পাঁচটি ভরতবংশীয় পতি হবে। সেই কন্যাই দ্রুপদের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবে।

মনে হয় এ কাহিনিটা পরবর্তীকালের জনসমাজকে খুব বেশি তুষ্ট করতে পারেনি। তখনই মাতৃ আদেশের অবতরণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই অবতারণার মধ্যে এক সাংঘাতিক প্রমাদ বয়ে গিয়েছিল। পাণ্ডবরা যখন একক্রানগরে ছিলেন, ‘তাঁরা ভিক্ষা করে যা আনতেন, কুন্তী সে সমস্ত খাদ্য দু’ভাগ করতেন। এক ভাগ ভীম একাই খেতেন অন্য ভাগ অপর চার ভ্রাতা ও কুন্তী খেতেন। সুতরাং সেক্ষেত্রে কুন্তীর পক্ষে ‘তোমরা সকলে মিলে সমানভাবে ভোগ কর’ এ কথাগুলো বলা কি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়?

মহাভারতের এই জায়গায় আর এক অসঙ্গতি আছে। কিছুদিন পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করার পর, তারা আবার দ্রুপদের গৃহে গিয়েছিল, দ্রৌপদীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করার জন্য! এ থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে. মহাভারতীয় যুগের সমাজের প্রথম অবস্থায় (প্রাগার্যকালে) বিবাহ সম্পাদন করার জন্য যজ্ঞ নিষ্পাদন, মন্ত্র উচ্চারণ, সপ্তপদীগমন ইত্যাদি বিধিসম্মত কোনো পদ্ধীতর প্রয়োজন হতো না। বৈদিক যুগেই এগুলোর প্রবর্তন ঘটেছিল। সেজন্য পরবর্তীকালের রীতিনীতি ও প্রথার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য মহাভারতের মধ্যে এই অংশটা প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। সেটা মহাভারতে চিত্রিত সমাজের শেষ দশা। তখনই দ্রৌপদীর বহুপতিকবিবাহের সমর্থনে তৃতীয় কাহিনি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই তৃতীয় কাহিনি অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক বিবাহের জন্য পঞ্চপাণ্ডব দ্রুপদগৃহে উপস্থিত হলে দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘কুরুনন্দন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তুমি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্রস্বভাব, এমন বেদবিরুদ্ধ কার্যে তোমার মতি লো কেন?’ এমন সময় ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘পুরাণে শুনেছি গৌতম বংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন; মুনিকন্যা বাক্ষীর দশপতি ছিল।’ তখন ব্যাস বললেন, ‘পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির যা বলছেন তাই সনাতন ধর্ম।’ ব্যাস কর্তৃক বহুপতিকা বিবাহ সনাতন ধর্ম বলা মানেই একসময় বহুপতিকবিবাহ প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল। সে সময়টা কবে? নিশ্চয়ই প্রাক-বৈদিক যুগে। কেননা, বৈদিক বা বেদোত্তর যুগে বহুপতিকবিবাহ প্রচলিত ছিল না। সুতরাং মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর বিবাহ যে প্ৰাক-বৈদিক ঘটনা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সেই প্রাক-বৈদিক যুগের প্রতিষ্ঠিত প্রথা অনুযায়ী দ্রৌপদীর বহুপতিকবিবাহ হয়েছিল। আমি আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছি— ‘বহুপতিগ্রহণ একসময় ব্যাপক ছিল। কেননা, আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে—একসময় কন্যাকে কোনো বিশেষ ভ্রাতার হাতে দেওয়া হতো না, ভ্রাতৃবর্গের হাতে দেওয়া হতো। ধর্মশাস্ত্রকার বৃহস্পতি এর প্রতিধ্বনি করেছেন। তবে তাঁদের সময়ে এরূপ বিবাহ বিরূপদৃষ্টিতে দেখা হতো। পরবর্তীকালের স্মৃতিকারগণ অবশ্য পরিষ্কার বলেছেন—’এক স্ত্রীর বহুস্বামী থাকতে পারে না।’ (অতুল সুর, ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’, আনন্দ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৩)।

বহুপতিকবিবাহ যে একসময় বাঙালির সমাজেও প্রচলিত ছিল তার অশ্মীভূত স্মৃতি আজও বাঙালি আর বিবাহের লোকাচারের মধ্যে ধারণ করে আছে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যখন বিবাহ করে সস্ত্রীকে নিজগৃহে ফিরে আসে, তখন কনিষ্ঠ ভ্রাতা তার পথরোধ করে তাকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা আমার বিয়ে দেবে তো? দাদা সম্মতিসূচক উত্তর দিলেই তবে কনিষ্ঠ ভ্রাতা পথ ছেড়ে দেয়। এর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, একসময় কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভাবির উপর দাম্পত্য অধিকার ছিল। এবং এই অশ্মীভূত অনুষ্ঠান দ্বারা সে অধিকার বিচ্যুত করা হয়। অনুরূপভাবে ‘জামাইবরণ’ অনুষ্ঠান দ্বারা কনিষ্ঠা শ্যালিকার উপর জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতির দাম্পত্য অধিকার প্রত্যাহার করানো হয়। (এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা পাওয়া যাবে, ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত অতুল সুরের ‘সাম বেঙ্গলি কিনশিপ ইউসেজ’ প্রবন্ধে। )

মহাভারতে অনেকরকম বিচিত্র বিবাহপ্রথার উল্লেখ আছে। যাঁরা এ বিষয়ে কৌতূহলী তাঁরা ভারত সরকারের ‘অ্যানথ্রপলজিক্যাল সারভে অভ ইন্ডিয়া’র মুখপত্র ‘ম্যান ইন ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত আমার ‘সেকস্ অ্যান্ড ম্যারেজ ইন দি মহাভারত’ নিবন্ধটি পড়ে নিতে পারেন। নিবন্ধটি স্প্যানিস ও ইটালিয়ান ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। (ম্যান ইন ইন্ডিয়া, মার্চ, ১৯৬৩)।

ঘ.

এক লক্ষ শ্লোকে গ্রথিত যে মহাভারতখানা আমাদের হাতে এসে পড়েছে, তার মধ্যে যে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ঐতিহাসিককাল পর্যন্ত নানা যুগের রীতিনীতি স্থান পেয়েছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি যখন এতে বর্ণিত বিবাহপ্রথাসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিবাহ সম্পাদনের জন্য বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ, সপ্তপদীগমন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। কিন্তু মহাভারতে এমন সব বিবাহপ্রথার উল্লেখ আছে, যার জন্য বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ ইত্যাদির প্রয়োজন হতো না। তার মানে এ সকল বিবাহপ্রথা প্রাক- বৈদিককালের। সেগুলো সিন্ধুসভ্যতা বা তারও আগের যুগের হতে পারে। এ সকল বিবাহপ্রথা তৎকালীন সমাজে নারী-পুরুষের যৌন আচরণ ও সমাজ সংগঠনের পরিচয় দেয়।

ঋগ্বেদের যুগে মাত্র একরকম বিবাহেরই প্রচলন ছিল। সে বিবাহ নিষ্পন্ন হতো মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদন দ্বারা। কিন্তু আদি মহাভারতীয় যুগের সমাজে এমন সবরকমের বিবাহের প্রচলন ছিল, যার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ বা যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হতো না।

মহাভারতে আমরা চার রকম বিবাহের উল্লেখ পাই। ব্রাহ্ম, গান্ধর্ব, অসুর ও রাক্ষস। এর মধ্যে ব্রাহ্মবিবাহেই মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হতো। বাকি তিন রকম বিবাহে এসবের কোনো বালাই ছিল না। ব্রাহ্মবিবাহ ছিল ব্রাহ্মণ আচরণ সম্পৃক্ত বিবাহ। এই বিবাহে মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে সবস্ত্রা, সালঙ্করা ও সুসজ্জিতা কন্যাকে বরের হাতে সম্পাদন করা হতো। বাকি তিন রকম বিবাহপ্রথা প্রাক-বৈদিক আদিবাসী সমাজের বিবাহ। তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সেগুলো আদিবাসী সমাজে এখনও প্রচলিত আছে। অসুরবিবাহ ছিল পয়সা দিয়ে মেয়ে কেনা। তার মানে, যে বিবাহ কন্যাপণ দেওয়া হয়। এরূপ বিবাহে মেয়ের বাবাকে কিংবা তার অভিভাবককে পণ বা মূল্য দিতে হতো। আর মেয়েকে জোর করে কেড়ে নিয়ে যে বিবাহ করা হতো, তার নাম ছিল রাক্ষসবিবাহ। আর নির্জনে প্রেমালাপ করে যেখানে স্বেচ্ছায় মাল্যদান করা হতো, তাকে বলা হতো গান্ধর্ববিবাহ। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ববিবাহই ছিল প্রশস্ত। মহাভারতের নায়কদের মধ্যে অনেকেই গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন। যথা গঙ্গার সঙ্গে শান্তনুর বিবাহ, ভীমের সঙ্গে হিরিম্বার বিবাহ, অর্জুনের সঙ্গে উলপীর ও চিত্রাঙ্গদার, দুষ্মন্তর সঙ্গে শকুন্তলার, ও ইক্ষাকুবংশীয় পরীক্ষিতের সঙ্গে সুশোভনার বিবাহ! তবে রাজা-রাজড়ার ঘরের মেয়েদের পক্ষে স্বয়ংবর বিবাহ ছিল রাক্ষস বিবাহেরই একটা সুষ্ঠু সংস্করণ মাত্র! রাজা-রাজড়াদের মধ্যে স্বয়ংবর প্রথার বিবাহই যে প্রশস্ত ছিল, তা আমরা কাশী রাজার তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকার স্বয়ংবর সভায় ভীষ্মের উক্তি থেকেই পরিষ্কার বুঝতে পারি। ঐ সভায় ভীষ্ম বলেছিলেন—স্মৃতিকারগণ বলেছেন যে, স্বয়ংবর সভায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাহত করে কন্যা জয় করাই ক্ষত্রিয়দের পক্ষে শ্রেষ্ঠ বিবাহ। মনে হয়, পাছে এরূপ প্রতিদ্বন্দিতা রক্তপাতে পরিণত হয়, সেজন্য পরবর্তীকালে স্বয়ংবর সভায় একটা শর্ত রাখা হতো এবং ওই ‘শর্ত পালন করতে যিনি সক্ষম হতেন, তাঁকেই জয়ী বলে ঘোষণা করা হতো। এরূপভাবেই পাণ্ডবভ্রাতারা দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদীকে স্বয়ংবর সভায় জয় করেছিলেন। ভারতে আর্যদের অবস্থানের পর আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের যে একটা সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল, সেটা আমরা বুঝতে পারি বিবাহের আদান- প্রদান থেকে। কেননা, স্বয়ংবর সভা থেকে নিষাদরাজ নল বিদর্ভ রাজার মেয়ে দময়ন্তীকে জয় করেছিলেন।

আমরা আগেই বলেছি যে আদি মহাভারতীয় যুগের সমাজে বিবাহ নিষ্পন্ন করার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ, যজ্ঞ সম্পাদ, সপ্তপদীগমন প্রভৃতি পরবর্তীকালের বিধিসম্মত কোনো পদ্ধতির প্রয়োজন হতো না। পরবর্তীকালে হিন্দুসমাজেই এগুলো প্রবর্তিত হয়েছিল এবং তখন মহাভারতের মধ্যে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। দ্রৌপদীর বিবাহকাহিনি থেকে এটা আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি। পাণ্ডবভ্রাতারা দ্রৌপদীকে জয় করে এনে কিছুকাল তাঁর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করেছিলেন। পরে তাঁরা আবার দ্রুপদ-রাজার গৃহে ফিরে গিয়েছিলেন, যজ্ঞ সম্পাদন ও আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য। তার মানে পরবর্তীকালের রীতিনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যই মহাভারতের মধ্যে এই অংশটি উত্তরকালে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ-আচার সম্পৃক্ত বিবাহই যে কালক্রমে প্রাধান্য লাভ করেছিল, তা আমরা নরদ-পর্বত-শৃঞ্জয় এবং ভূগ-পুলোমা প্রভৃতি উপাখ্যান থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারি।

আচার-অনুষ্ঠানগত বিবাহ যখন প্রচলিত হলো, তখন এইরকম বিবাহের ওপরই জোর দেওয়া হলো, এবং তখনই মহাভারতের মধ্যে এই অংশগুলো প্রবেশ করানো হলো। সেজন্য আমরা দেখতে পাই যে, ভৃগু যখন পুলোমাকে বিবাহ করলেন, তখন এক রাক্ষস এসে দাবি করে বলল যে পুলোমাকে সে-ই আগে বিবাহ করেছে। এই বিবাহের মীমাংসার জন্য অগ্নিকে সাক্ষী মানা হলো। অগ্নি রাক্ষসকে বললেন—রাক্ষস, এ কথা সত্য যে, তুমিই পুলোমাকে প্রথম বিবাহ করেছ, কিন্তু যেহেতু করেছে সেই হেতু পুলোমা ভৃগুর স্ত্রী। মহাভারতের অপর এক জায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—’একমাত্র যজ্ঞ সম্পাদন, মন্ত্রপাঠ ও সন্তপদীগমন দ্বারাই বিবাহ নিষ্পন্ন হতে পারে!’ এ উক্তি যে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল, যে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, তা না হলে মহাভারতের সমস্ত নায়কদের বিবাহই ‘অসিদ্ধ’ বিবাহ হয়ে যায়।

রাক্ষসবিবাহে কন্যাকে বলপূর্বক কেড়ে এনে বিবাহ করা হতো। এরূপ বিবাহের অনেক উল্লেখ মহাভারতে আছে। যথা, কৃষ্ণ রুক্মিনীকে বলপূর্বক হরণ করে এনে বিবাহ করেছিলেন। দেবকের রাজসভা থেকে দেবকীকে শিনি বলপূর্বক অধিকার করে এনেছিলেন বসুদেবের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য। অনুরূপভাবে দুর্যোধনের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য কলিঙ্গরাজার সভা থেকে চিত্রাঙ্গদাকে কর্ণ বলপূর্বক হরণ করে এনেছিল। রৈবতকে থাকাকালীন অর্জুন যখন কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রার প্রতি আসক্ত হয়েছিল, কৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বলেছিলেন—’ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বযংবরই প্রশস্ত বিবাহ। কিন্তু যেহেত সুভদ্ৰ কাকে মাল্যদান করবে তা জানা নেই, সেই হেতু আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, তুমি তাকে বলপূর্বক অধিকার করে নিয়ে যাও! শাস্ত্রকারগণ বীরের পক্ষে এরূপ বিবাহ সম্মানজনক বলেছেন।’ এই কথা শুনে অর্জুন সুভদ্রাকে বলপূর্বক হরণ করে এনে, বিবাহ করেছিল। অর্জুনের এই আচরণে যাদবরা যখন ক্রুদ্ধ হয়েছিল, কৃষ্ণ তখন তাদের এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন— ‘আমরা যে অর্থের বিনিময়ে কন্যা বিক্রয় করি, অর্জুনের পক্ষে এরূপ চিন্তা কল্পনার বাইরে। স্বয়ংবর বিবাহে অর্জুন সম্মত নয়, সেজন্য অর্জুন বলপূর্বক সুভদ্রাকে বিবাহ করেছে।’ লক্ষণীয় যে এখানে যদিও অর্জুন সুভদ্রাকে ‘রাক্ষস’ প্রথায় বিবাহ করেছিল, তবে আরও দুরকম বিবাহের কথা বলা হয়েছে—অসুর বিবাহ ও স্বয়ংবর প্রথায় বিবাহ। কোনটা যাদব সমাজে প্রকৃত প্রচলিত ছিল তা নিষ্কাষণ করা কঠিন। তবে মনে হয় অসুরবিবাহই প্রশস্ত ছিল।

অসুরবিবাহের দৃষ্টান্ত আমরা মহাভারতের আরও অনেক জায়গায় পাই। পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য মাদ্রীকে তো মদ্ররাজ শল্যের কাছ থেকে বহু মূল্যবান জিনিসের বিনিময়ে নিয়ে আনা হয়েছিল। ভৃগুমুনির পুত্র রিচিক যখন কান্যকুব্জরাজ গাধীর কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন, গাধী তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের বংশের রীতি অনুযায়ী কন্যার মূল্যবাবদ তোমাকে এক হাজার তেজস্বী ঘোড়া দিতে হবে।’ যযাতির মেয়ে মাধবীকে পাওয়ার জন্য গালবকেও চার সহস্র অশ্বপণ দিতে হয়েছিল। মহাভারতের অন্যত্র উল্লেখিত হয়েছে যে, অঙ্গদেশে কন্যাপণ দিয়ে বিয়ে করাই প্রচলিত রীতি ছিল।

মহাভারতে বিধবা ও সধবা এই উভয় অবস্থাতেই কন্যার দ্বিতীয়বার বিবাহের উল্লেখ আছে। এরূপ কন্যাকে ‘পুনর্ভূ’ বলা হতো! ঐরাবত দুহিতার স্বামী যখন গড়ুর কর্তৃক নিহিত হয়, তখন অর্জুন তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে ইরাবন নামে এক সন্তান উৎপাদন করেছিল। ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে গৌতম ঋষি যখন জনৈক নাগরিকের গৃহে ভিক্ষার্থে এসেছিলেন, তখন তাঁকে ভিক্ষাস্বরূপ এক বিধবা শুদ্রাণীকে দান করা হয়েছিল। গৌতম তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন। এগুলো বিধবাবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকার দৃষ্টান্ত। সধবার পক্ষে দ্বিতীয়বার বিবাহ প্রয়াসের দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নলের কোনো সংবাদ না পেয়ে দয়মন্তী দ্বিতীয়বার স্বয়ংবরা হওয়ার চেষ্টা করেছিল।

মহাভারতে যেমন সবর্ণে বিবাহের কথা আছে, তেমনই অসবর্ণ বিবাহের দৃষ্টান্তও আছে। ব্রাহ্মণ কর্তৃক শুদ্রকন্যাকে বিবাহ আমরা একটু আগেই দিয়েছি। কিন্তু মহাভারত যখন প্রক্ষিপ্ত হতে লাগল, তখন উচ্চবর্ণের কন্যার সঙ্গে নীচবর্ণের পুরুষের বিবাহ বিরূপদৃষ্টিতে দেখা হলো। এরূপ বিবাহকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হতো। এই কারণে ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে শূদ্রপুরুষের বিবাহের ফলে যে সন্তান উৎপন্ন হতো, তাকে চণ্ডাল বলা হতো এবং তার স্থান ছিল সমাজে সকল জাতির নিচে। একমাত্র অনুলোম বিবাহ, তার মানে উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নীচবর্ণের কন্যার বিবাহই বৈধ বলে গণ্য হতো।

বহুপত্নীগ্রহণও মহাভারতীয় যুগে বেশ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মহাভারতের অনেক নায়কেই একাধিক স্ত্রী ছিল। যেমন যযাতি বিবাহ করেছিলেন শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীকে, দুষ্মন্ত বিবাহ করেছিলেন শকুন্তলা ও লক্ষণাকে, শান্তনু বিবাহ করেছিলেন সত্যবতী ও গঙ্গাকে, বিচিত্রবীর্য বিবাহ করেছিলেন অম্বিকা ও অম্বালিকাকে, ধৃতরাষ্ট্র বিবাহ করেছিলেন গান্ধারী বৈশ্যাকে, পাণ্ডু বিবাহ করেছিলেন কুন্তী ও মাদ্রীকে, এবং যুক্ত-স্ত্রী হিসেবে দ্রৌপদী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ভীম বিবাহ করেছিলেন হিরিম্বাকে এবং অর্জুন বিবাহ করেছিলেন উলপী, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রাকে। মগধের রাজা বৃহদ্রথও বিবাহ করেছিলেন কাশীরাজ্যের দুই যমজ কন্যাকে। মহাভারতের একস্থলে উল্লেখিত হয়েছে যে কৃষ্ণের ১০১৬ স্ত্রী ছিল, আবার অপর একস্থলে বলা হয়েছে যে কৃষ্ণের ১৬০০০ স্ত্রী ছিল। মহাভারতে আরও উল্লেখিত হয়েছে যে রাজা সোমকের একশত স্ত্রী ছিল।

বিবাহের পূর্বে মেয়েদের যৌনসংসর্গ মহাভারতীয় যুগে অনুমোদিত হতো। মহাভারতে এরূপ সংসর্গের দৃষ্টান্তস্বরূপ সত্যবর্তী-পরাশরের কাহিনি বিবৃত করা যেতে পারে। উপরিচর বসুর কুমারী কন্যা সত্যবতী যৌবনে যমুনার খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। একদিন পরাশর মুনি তাঁর নৌকায় উঠে তার অপরূপ যৌবনে মোহিত হয়ে তাঁর সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করেন। সত্যবতী তখন পরাশরকে বলেন— ‘নৌকার মধ্যে আমি কিভাবে যৌনকর্মে রত হব; কেননা, তীর হতে লোকেরা আমাদের দেখতে পাবে। পরাশর তখন কুজঝটিকার সৃষ্টি করেন ও তারই অন্তরালে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হন। এর ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয়। তারপর তিনি সত্যবতীকে বর দেন যে এই যৌনসংসর্গ সত্ত্বেও সে কুমারী থাকবে। কুন্তীও কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে মিলনের ফলে পুত্র কর্ণকে প্রসব করেছিলেন। এক্ষেত্রেও দুর্বাসা মুনির বরে কুন্তী কুমারিত্ব হারায়নি। মাধবীগালব উপাখ্যানেও আমরা দেখি যে, প্রতি সন্তান প্রসবের পর মাধবীর কুমারিত্ব অটুট ছিল। বিবাহের পূর্বে মেয়েদের যে যৌনসংসর্গ সমাজে বরদাস্ত হতো, তা আমরা বিবাহের পূর্বে প্রসূত সন্তানের আখ্যা থেকে বুঝতে পারি। কৃষ্ণ কর্ণকে বলছেন—’কুমারী মেয়ের দুরকমের সন্তান হতে পারে— ১. কানীন ও ২. সহোঢ়। যে সন্তানকে কুমারী বিবাহের পূর্বে প্রসব করে, তাকে বলা হয় ‘কানীন’। আর যে কুমারী বিবাহের পূর্বে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে বিবাহের পরে প্রসব করে তাকে বলা হয় ‘সহোঢ়’। মহাভারতের অপর এক জায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—’কুমারী যে সন্তানকে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে, তাকে বলা হয়, ‘কানীন’, তার যে সন্তান বিবাহের পরে প্রসব করে তাকে বলা হয় ‘অরোঢ়’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মহাভারতীয় যুগে কুমারী কন্যার পক্ষে গর্ভধারন করা সমাজে বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না। মহাভারতীয় যুগে বিবাহিতা নারীর পক্ষে স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গও নিন্দিত ছিল না। অম্বা ও অম্বালিকার এবং কুন্তী ও মাদ্রীর অপরের সাহায্যে সন্তান উৎপাদন এ সম্বন্ধে আলোকপাত করে।

মহাভারতে চিত্রিত সমাজ পিতৃকেন্দ্রিক ছিল পুত্র-কন্যাকে পিতার নাম অবলম্বনেই অভিহিত করা হতো। যেমন বসুদেবের পুত্র বাসুদেব, গান্ধার রাজার মেয়ে গান্ধারী, দ্রুপর রাজার মেয়ে দ্রৌপদী, মদ্র রাজার মেয়ে মাদ্রী ইত্যাদি। মাতৃকেন্দ্রিক সমাজে এরূপ করা হয় না। তবে মহাভারতে দু-এক এর ব্যতিক্রম আছে, এবং তা আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি।

মহাভারতীয় যুগের সমাজে অনুঢ়া মেয়েরা যৌনসংসর্গে লিপ্ত হতো। সমাজ তা বরদাস্ত করত। সধবা মেয়েরাও স্বামী ব্যতীত অপরের সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হতে পারত। দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের কথাও ভাবতে পারত। বহুপতিকবিবাহও ‘সনাতন ধর্ম’ বলে গৃহীত হতো। সবর্ণ ছাড়া অসবর্ণ বিবাহেরও কোনো বাধা ছিল না। বিধবা বিবাহও প্রচলিত ছিল। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ ব্যতীতও বিবাহ হতো। কিন্তু এটা বেদোত্তর যুগের সমাজে স্বীকৃত হতো না। এ থেকেই বোঝা যায় যে মহাভারতের আদিরূপের সমাজ, প্রাক- বৈদিক সমাজ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *