কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও বাঙালির পাণ্ডবগণ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও বাংলায় পাণ্ডবগণ

‘বর্তমান’ পত্রিকায় আমি ‘মহাভারতের তারিখ ও কাহিনি’ শীর্ষক যে প্রবন্ধটি লিখেছিলাম, সে সম্বন্ধে কয়েকজন পত্রপ্রেরক জানিয়েছেন যে, ‘রচনাটির বক্তব্যে কোনো কোনো স্থানে বিভ্রান্তিকর ও বিতর্কিত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।’ সে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক যে তাদের নিজেদেরই সৃষ্ট, তা আমার এ প্রবন্ধ থেকে বুঝতে পারা যাবে। তাঁরা যেসব অভিযোগ এনেছেন, সেগুলো হচ্ছে (বন্ধনীর মধ্যে পত্রপ্রেরকদের নাম দেওয়া হলো)

১. আমি নাকি বলেছি যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, আর যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে বলেছেন ১৪৪১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’-এ বলেছেন ১৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। (অমরকৃষ্ণ চক্রবর্তী ও মলয় কুমারনন্দী)।

২. পাণ্ডবেরা যে একচক্রানগরীতে এসে বাস করেছিলেন তা বীরভূমে নয়, মেদিনীপুর জেলায় বগড়ি পরগণায়। (সিদ্ধেস্বর মুখোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য)।

৩. পাণ্ডবেশ্বরের ভগ্ন শিবমন্দিরগুলো মহাভারতের যুগের নয়, অনেক অর্বাচীন। (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)।

৪. ভীমগড়ের সঙ্গে মহাভারতের ভীমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা রামপালের অন্যতম সমান্তরাজ্য ভীমযশার রাজ্যের প্রত্যন্ত সীমা। (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)।

৫. পাণ্ডুরাজার ঢিবি গৌতম সিদ্ধার্থের খুল্লতাত পাণ্ডুশাক্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের প্রতিধ্বনি বহন করে। (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)।

আমি প্রথমেই বলতে চাই যে আমি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সংঘটিত হয়েছিল বলেছি, এটা পত্রলেখকদের সম্পূর্ণ কাল্পনিক অভিযোগ। কেননা, আমি আমার দীর্ঘ নিবন্ধের কোনো জায়গাতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তারিখ উল্লেখ করিনি। যে তারিখ উল্লেখ করেছি সেটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নয়। সেটা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের তারিখ, এবং সে তারিখটা প্রাচীন ভারতের দুজন প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট ও বরাহমিহিরের গণনা অনুযায়ী। বঙ্কিমচন্দ্র ও যোগেশচন্দ্র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যে তারিখ দিয়েছেন, সে তারিখ সম্বন্ধে তাঁরা নিজেরাই বলেছেন যে তা তাঁদের নিজেদের ‘মত’।

আমি আমার নিবন্ধে পরিষ্কার বলেছি যে মহাভারত চন্দ্রবংশের ইতিহাস, এবং ওই বংশের রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের তারিখ হচ্ছে ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তারিখ নির্ণয়ের আমি কোনো চেষ্টা করিনি, তার কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যথার্থতা সম্বন্ধে আমি সন্দিহান ছিলাম। এ বিষয়ে আমি আমার অনুজপ্রতিম সতীর্থ প্রয়াত ড. দীনেশচন্দ্র সরকারের অভিমত উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছেন, ‘এই ভয়াবহ যুদ্ধে নাকি পূর্বে প্রাগজ্যোতিষ বা আসাম এবং দক্ষিণে পাণ্ড্য দেশ পর্যন্ত সমগ্র ভারতের নৃপতিগণ কোনো এক পক্ষে যোগদান করেছিলেন এবং কৌরবপক্ষে ১১ ও পাণ্ডবপক্ষে ৭ অক্ষৌহিনী সৈন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল। এক অক্ষৌহিনী সৈন্যদলে ২১,৮৭০ রথ, ২১,৮৭০ হস্তী, ৬৫,৬১০ অশ্ব এবং ১,০৯,৩৫০ পদাতিক, অর্থাৎ মাহুত ও সারথিসহ ২,৬১,৪৪০ লোক থাকিত। সুতরাং ১৮ অক্ষৌহিনীতে ৪৭,২৩,৯২০ লোক থাকবার কথা। একটিমাত্র রণক্ষেত্র এই অর্ধ কোটি জনসংঘ যুদ্ধে পরিচালিত করা বর্তমান যুগেও সম্ভব নহে। অতি প্রাচীনকালের খণ্ডযুদ্ধেও দুই- চারি হাজার সৈন্য লইয়া যুদ্ধ চালানোও কঠিন ছিল। সুতরাং কাহিনিটি যে প্রধানত কল্পনামূলক, তাহাতে সন্দেহ নাই। বিশেষত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মগধের নন্দসাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের পূর্বে সুদূরস্থিত রাজ্যসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কের অভাব ছিল। তাই তখন সমগ্র ভারতের রাজন্যবর্গের পক্ষে পূর্ব-পাঞ্জাবের অন্তর্গত একটি রণক্ষেত্রে সম্মিলিত হইয়া কুরু ও পাণ্ডবপক্ষে নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল বলিয়া মনে হয় না। বিশেষত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হইলে বৈদিক সাহিত্যে ইহার অনুল্লেখের কারণ কিছু বুঝা যায় না। যাহা হউক, যদি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনির মূলে কিছুমাত্র ঐতিহাসিক সত্য থাকে, উহা এই যে প্রাচীনকালে দুইটি কুল কিংবা একই কুলের দুই শাখার মধ্যে স্থানীয় সংঘর্ষ হইয়াছিল, এবং তৎসম্পর্কিত একটি জনপ্রিয় চারণগীতি ক্রমে ক্রমে পল্লবিত ও অতিরঞ্জিত হইয়া মগধ সাম্রাজ্যের যুগে মহাভারতের বিরাটকাব্যে পরিণত হইয়াছিল।’ ইহা ব্যতীত মহাভারতের আদিপর্বে বিবৃত হয়েছে যে, ‘রাজ্য জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য বৈশাম্পয়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন। ভগবান ব্যাস এই গ্রন্থে ‘কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধরীর ধর্মশীলতা, বিদূরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্মা পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন।’ এখানেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই। এসব কারণেই আমি আমার নিবন্ধে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তারিখ নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি। মাত্র যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের তারিখেরই উল্লেখ করেছিলাম।

দ্বিতীয়। একচক্রানগরী বীরভূমে নয়, মেদিনীপুরে, এটা সম্ভবপর নয়, তার কারণ, আমরা মহাভারতে পড়ি যে পাণ্ডবরা যখন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় যাওয়ার জন্য একচক্রানগরী থেকে যাত্রা করেছিল, তখন তারা একদিন একরাত্র গমন করেই গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়েছিল। একচক্রানগরী বীরভূমে না হলে এটা সম্ভবপর হতো না।

তৃতীয়। ‘পাণ্ডবেশ্বরের ভগ্ন শিবমন্দিরগুলো মহাভারতের যুগের নয়, অর্বাচীন, এই অনুযোগের বিরুদ্ধে আমি জানাতে চাই যে আমার নিবন্ধে ‘প্রতিষ্ঠিত’ শব্দটা ব্যবহার করেছি, ‘নির্মিত’ শব্দ নয়। এটা সকলেরই জানা আছে যে আমাদের দেশে প্রাচীনকালে দেবতাদের চালাঘরের মধ্যে ‘প্রতিষ্ঠিত ‘ করা হত, পরে কেউ না কেউ মন্দির নির্মাণ করে দিতেন। এ-সম্পর্কে কালীঘাটের মন্দিরের কথা স্মরণ করুন। আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকে আরও উল্লেখ করি, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার এক জীর্ণ মন্দির আমি দশ হাজার টাকা ব্যয়ে যখন সংস্কার করে দিয়েছিলাম, তখন আমি এই মন্দিরের সম্পর্কিত দলিলপত্রাদি পরীক্ষা করে জানতে পেরেছিলাম যে ওই প্রাচীন দেবায়তন প্রথম চালাঘরে ছিল, পরে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে পাকা ইমারত তৈরি করা হয়েছিল। আরও উল্লেখ করি যে শিবমন্দিরের রূপ ও গঠনরীতি দেখলেই বুঝতে পারা যাবে যে ওগুলো চালাঘরের ‘মডেল’-এই নির্মিত। সুতরাং মন্দির অর্বাচীন কালের, এই যুক্তির দ্বারা ওর প্রাচীনত্বকে নস্যাৎ করা যায় না। পাণ্ডবরা যে সিন্ধুসভ্যতার ধারকদের মতো শিবভক্ত ছিলেন, তা মহাভারতখানা পড়লেই বুঝতে পারা যায়। সুতরাং ভীম কর্তৃক শিব-প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।

চতুর্থ। রামপালের সামন্ত ভীমযশা সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, তার কোনো ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক সমর্থন নেই। ভীমযশার উল্লেখ আমরা সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’-এ পাই। সেখানে তাকে মাত্র পীঠিপতি বা বোধগয়ার অধিপতি বলা হয়েছে। ‘রামচরিত’ থেকে আমরা জানতে পারি যে সে-সময় বাংলাদেশে রামপালের আরও সামন্ত ছিল যাদের অধীনে মেদিনীপুর, হুগলি জেলার গড় মন্দারন, সাঁওতাল পরগনা, ধানবাদ-পুরুলিয়া অঞ্চল, বর্ধমান জেলা, রাজমহল, বগুড়া ও পাবনা জেলা ছিল। তাছাড়া তর্কের খাতিরে উল্লেখ করি, সমসাময়িককালে ভীম নামধারী তিনজন রাজা ছিলেন, যথা ভীমযশা, কৈতর্বরাজ ভীম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ভীমপাল। এদের কারুকেই কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ভীমগড়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে না।

পঞ্চম। পাণ্ডুরাজার ঢিবি গৌতম সিদ্ধার্থের খুল্লতাত পাণ্ডুশাক্যের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের প্রতিধ্বনি বহন করছে, এ দাবি এক কথাতেই ভূমিসাৎ হয়ে যায়। কেননা, গৌতম সিদ্ধার্থের খুল্লতাত নিশ্চয়ই খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক ছিলেন। আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো কার্বন-১৪ পরীক্ষায় পাণ্ডুরাজার ঢিবির বয়স নির্ণীত হয়েছে ১০০০+২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। সুতরাং ‘ঘোড়ার সামনে গাড়ি’ হতে পারে না!

এখানে একটা কথা বলতে চাই। ঘটোৎকচ তার পিতামহ পাণ্ডুর নামে পরিচিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ঘটোৎকচ ও তার পুত্র অঞ্জনপর্বা কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে তাদের বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। তা থেকে বোঝা যাবে যে তারা পূর্ব-ভারতের পরাক্রমশালী রাজা ছিল। মনে হয় তাদেরই বংশধররা পাণ্ডুর বংশীয় রাজা নামে বাংলা দেশে অভিহিত হতো, এবং তা থেকেই ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’, ‘পাণ্ডবেশ্বর’ ইত্যাদি নামের উদ্ভব হয়েছিল। এই পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যেসকল কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, তার দ্বারা এটা সমর্থিত। আমরা আগেই বলেছি যে পাণ্ডবরা ভরতবংশীয় রাজা ছিল, এবং ভরতবংশীয়রা আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোক ছিল। আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোকেরা বিস্তৃতশিরস্ক। কিন্তু পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যেসকল কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে তা দীর্ঘশিরস্ক বা নাতিদীর্ঘশিরস্ক। তার মানে আমরা আপাতদৃষ্টিতে এক নৃতাত্ত্বিক বৈলক্ষণের সম্মুখীন হই। কিন্তু এই বৈলক্ষণই প্রমাণ করে যে পাণ্ডুরাজার ঢিবির লোকরা ঘটোৎকচ ও তার পুত্র অঞ্জনপর্বার সন্ততি ছিল, কেননা হিড়িম্বা যে আন্ত্রিকভাষাভাষী দীর্ঘশিরস্ক নরগোষ্ঠীর লোক ছিল, তা মহাভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি থেকেই প্রমাণিত হয়।

উপরে যেসব কথা বললাম, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে পত্রপ্রেরকদের অভিযোগগুলো হয় কাল্পনিক, আর তা নয় তো ভুল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *