মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা

মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা

ক.

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত যে মহাভারত বর্তমানে চালু আছে, তাতে ৮০,০০০ থেকে এক লক্ষ শ্লোক আছে। কিন্তু গোড়াতে মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোক ছিল না। মাত্র কয়েক শত বা কয়েক হাজার শ্লোক ছিল। কিভাবে মহাভারত বিরাটত্ব লাভ করেছিল, তা মহাভারতের সূচনাতেই, আদিপর্বে বিবৃত হয়েছে। বর্তমানে মহাভারত নামে যে মহাকাব্য প্রচলিত আছে, প্রথমে তার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে মহাভারত তার লিখিতরূপ পেয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে। কিন্তু এই সময়কালের কোনো বিশেষ বৃত্তান্ত বা ইতিহাস মহাভারতে নেই। তবে লিখিত রূপ পাওয়ার আগেই, প্রয়োজনবোধে মহাভারতের সংশোধন ও পরিবর্ধন হয়ে গিয়েছিল। তার মানে, মহাভারতের রচনাকাল এক, আর এর আদি কাহিনিকাল আর এক। আমি এই গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে মহাভারতের আদি কাহিনিকাল হচ্ছে তার রচনাকালের তিন হাজার বছর বা তার চেয়েও বেশিকাল আগের। তার মানে, ন্যূনপক্ষে এর আদি কাহিনিকাল হচ্ছে আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে।

মহাভারতের উদ্ভব কিভাবে ঘটেছিল, তা মহাভারতের একেবারে গোড়াতেই আদিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, লিখিত রূপ পাওয়ার পূর্বে মহাভারতের কাহিনি কীর্তিত হতো। যাদের দ্বারা এটা কীর্তিত হতো, তাদের সুত বা মাগধ বলা হতো। ‘সুত’ বলতে এক শ্রেণিবিশেষকে ও ‘মাগধ’ বলতে মাগধ দেশের লোক বোঝাত। তা থেকে মনে হয় যে ‘সুত’রা প্রাচ্যদেশের লোক ছিল এবং এরূপ কাহিনি কীর্তিত করা প্রাচ্যদেশের ঐতিহ্যেরই এক ধারা ছিল। তা যদি হয়, তাহলে বলা যেতে পারে যে কীর্তিত মহাভারত কাহিনির উদ্ভব প্রাচ্যদেশেই ঘটেছিল।

খ.

মহাভারত পাঠে আমরা জানতে পারি যে কুরুবংশে শান্তনু নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর দুই মহিষী ছিল, একজন আর্যকুলের ও অপরজন অনার্যকুলের। প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে তাঁর দেব্রত বা ভীষ্ম নামে ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে বিচিত্রবীর্য নামে, পুত্রদ্বয় জন্মগ্রহণ করে। হস্তিনাপুরে তাঁর রাজধানী ছিল। দেবব্ৰত ভীষ্ম হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করায় বিচিত্রবীর্য সিংহাসন লাভ করে। কিন্তু বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু ঘটায় তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ধৃতরাষ্ট্রেরই হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন বলে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তাঁর সিংহাসনে বসা হয়নি। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পাণ্ডুই সিংহাসনে বসে রাজত্ব করতে থাকেন, কিন্তু এক অভিশাপের শিকার হয়ে পাণ্ডু সিংহাসন ত্যাগ করে তপস্যার জন্য শতশৃঙ্গ পর্বতে চলে যান। সঙ্গে যান তাঁর দুই পত্নী কুন্তী ও মাদ্রী। সেখানে যথাক্রমে ধর্ম, বায়ু ও ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে তিন পুত্র হয়— যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন। আর অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে মাদ্রীর গর্ভে দুই সন্তান হয়, নকুল ও সহদেব। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মাদ্রী অনুমৃতা হয়। পরে কুন্তী ছেলেদের নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। যুধিষ্ঠিরের তখন বয়স ১৬, ভীমের ১৫, অর্জুনের ১৪ এবং নকুল ও সহদেবের ১৩। ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের সঙ্গে তারা দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যের অধীনে অস্ত্র শিক্ষায় প্রবৃত্ত হয়। যুধিষ্ঠির বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। এতে দুর্যোধনাদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা ক্ষুণ্ণ হয়, এবং পাণ্ডুপুত্রদের মারার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের পুড়িয়ে মারার জন্য বারনাবতে এক জতুগৃহে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখান থেকে পাণ্ডুপুত্ররা পালিয়ে গিয়ে একচক্রানগরে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পাণ্ডবরা একদিন দ্রুপদ রাজার গৃহে গিয়ে দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রোপদীকে স্বয়ম্বর সভ্য হতে জয় করে নিয়ে আসে এবং পাঁচ ভাই একসঙ্গেই তাকে বিয়ে করে। দ্রুপদ রাজার সভাতেই পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁর সঙ্গে তারা সখ্যতা স্থাপন করে। সেই থেকেই কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সহায় হয়ে দাঁড়ান।

এইসব সংবাদ পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ডেকে পাঠান এবং কুরুরাজ্য পঞ্চপাণ্ডব ও নিজ পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেন। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থ তাদের নতুন রাজধানীর পত্তন করে।

কিন্তু এই রাজ্যবিভাগে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা তুষ্ট না হয়, পাণ্ডবদের রাজ্যভ্রষ্ট করার জন্য, তাদের মাতুল শকুনির পরামর্শে যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরে এক দ্যূতক্রীড়াতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। দুর্যোধনের মাতুল দ্যূতক্রীড়ায় জয় লাভ করার সমস্ত গোপন কৌশল জানত। সেগুলো প্রয়োগ করে সে যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় হারিয়ে দিতে থাকে। শেষে যুধিষ্ঠির নিজ রাজ্য ও এমনকি নিজ স্ত্রী দ্রৌপদীকে পর্যন্ত পণ রাখতে বাধ্য হয়। যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ের পর সিদ্ধান্ত হয় যে পঞ্চপাণ্ডবকে বারো বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করতে হবে। তখন ফিরে এলে তারা রাজ্য ফিরে পাবে।

এই শর্ত পালন করে পঞ্চপাণ্ডব যখন তেরো বছর পরে ফিরে এলো, তখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ তাদের রাজ্য ফেরত দিতে অস্বীকার করল। এর ফলে সমন্তপঞ্চক দেশে অবস্থিত কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে উভয়পক্ষে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। আঠারো দিনের যুদ্ধে সকলেই বিনষ্ট হয়, কেবল পঞ্চপাণ্ডব, কৃষ্ণ ও সাত্যকি জীবিত থাকেন। যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করা হয়, এবং ৩৬ বৎসর শান্তিপূর্ণভাবে রাজত্ব করার পর, অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিতকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে, যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভাই ও দ্রোপদী হিমালয়ের অপর পাড়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে সকলেরই মৃত্যু ঘটে কেবল যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে যান। এদিকে পরীক্ষিতের পর তাঁর পুত্র জনমেজয় রাজা হয়।

মোটামুটি এটাই হচ্ছে ‘মহাভারত’ নামে মহাকাব্যের কাহিনির কঙ্কাল। এই কঙ্কালকেই মহাভারত নামে মহাকাব্যে পল্লবিত করা হয়েছে। পুরানো যুগের নানা উপাখ্যান ও আখ্যায়িকা মূল কাহিনি সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া, প্রতি যুগেই সুত, মাগধরা কাহিনিটাকে বাস্তোপযোগী করার জন্য ও শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছিল, যার ফলে মহাভারত এক বিরাট কাব্যে পরিণত হয়েছে।

গ.

নানা যুগের নানা উপাখ্যান ও আখ্যায়িকা এর মধ্যে স্থান পেয়েছে বলে, আমাদের পক্ষে মহাভারত থেকে কোনো বিশেষ যুগের সামাজিক পরিস্থিতির পরিচয় পাওয়া কঠিন তবে সমগ্র মহাভারতের ভিত্তিতে রাজশেখর বসু একটা সামাজিক চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেটাই আমি এখানে উদ্ধৃত করছি। মহাভারত পড়লে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি সকলেই প্রচুর পরিমাণে মাংসাহার করত, ভদ্র-সমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংস ভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু গ্রন্থ রচনাকালে তা গর্হিত গণ্য হতো; অস্পৃশ্যতা কম ছিল, দাস-দাসীরাও অন্ন পরিবেষণ করত। মহাভারতের সর্বত্রই যুবতী-বিবাহ দেখা দেয়। রাজাদের অনেক পত্নী এবং দাসী ও উপপত্নী থাকত, যার এক ভার্যা তিনি মহাসুকৃতিশালী গণ্য হতেন। নারীর মর্যাদার অভাব ছিল না, কিন্তু সময়ে সময়ে তাদেরও দানবিক্রয় এবং জুয়াখেলায় পণ রাখা হতো। ভূমি, ধনরত্ন, বস্ত্র, যানবাহন প্রভৃতির সঙ্গে রূপবতী দাসীও দান করার প্রথা ছিল। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যার দল নিযুক্ত হতো। ব্রাহ্মণরা প্রচুর সম্মান পেতেন; তাঁরা সভায় তুমুল তর্ক করতেন বলে লোকে উপহাস করত। দেবপ্রতিমার পূজা প্রচলিত ছিল। রাজাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা হতো, কিন্তু অনুশাসন পর্বে ১৩ পরিচ্ছেদে ভীষ্ম বলছেন, যিনি প্রজারক্ষার আশ্বাস দিয়ে রক্ষা করেন না সেই রাজাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান অতি বীভৎস ছিল। পুরাকালে নরবলি চলত, মহাভারতের কালে তা নিন্দিত হলেও লোপ পায়নি। জরাসন্ধ তার আয়োজন করেছিলেন।’

তবে মনে হয় যে গোমাংস ভক্ষণ ও গোমেধ যজ্ঞ করা, বৈদিক আর্যসমাজেরই রীতি ছিল, প্রাগ-বৈদিক আদি-মহাভারতীয় যুগে নয়! আমি এই গ্রন্থে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি যে আদি-মহাভারতীয় যুগের সভ্যতা, সিন্ধুসভ্যতার যুগেরই সমকালীন ছিল। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল।

এছাড়া, তারা পশুপতি শিবের আরাধনা করত। বলীবদ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধুসভ্যতার বাহকরদের কাছে বলীবর্দ আরাধ্য জন্তু ছিল। এটা আমরা সিন্ধুসভ্যতার সীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃপুনঃ বলীবর্গের প্রতিকৃতি খোদ থেকে বুঝতে পারি। মনে হয়, পরবর্তীকালে (মধ্যযুগে) সম্প্রদায় বিশেষ হিন্দুদের জব্দ করার জন্য যেমন গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ করত, বৈদিক আর্যরাও তেমনি সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের জব্দ করার জন্য গোমেধ যজ্ঞ ও গোমাংস ভক্ষণ প্রবর্তন করেছিল। আরও মনে হয় বৈদিক আর্যরা নরমাংসও ভক্ষণ করত। এটা আমরা ঋগ্বেদে বর্ণিত শুনশেপ কাহিনি থেকে বুঝতে পারি। (ঋগ্বেদ ১/১২)। শুক্ল যজুর্বেদের ৩০ ও ৩১ অধ্যায়ে নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে। তাছাড়া, মহাভারতে বর্ণিত ব্রাহ্মণ কর্তৃক কর্ণপুত্র বৃষকেতু ও শিবিপুত্র বৃহদগর্ভের মাংস ভক্ষণ থেকেও জানতে পারি। বলা বাহুল্য, এগুলো অতি প্রাচীন প্রথা এবং মহাভারতের মধ্যে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল।

মহাভারতের উপসংহারে বলা হয়েছে যে মহাভারত ভরতবংশীয়গণের ইতিহাস। কিন্তু মহাভারতের আদিপর্বে সৌত্রির মুখে আমরা শুনি— ‘ভগবান ব্যাস এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, (কুরু ভারতের অধস্তন দশম পুরুষ) ) গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণের দুবৃত্ততা বিবৃত করেছেন। উপাখ্যান সহিত এই মহাভারতে আশি হাজার থেকে এক লক্ষ শ্লোক আছে। উপাখ্যান ভাগ বর্জন করে ব্যাস চব্বিশ হাজার শ্লোকে এক সংহিতা রচনা করেছেন, এবং পণ্ডিতগণের মতে তাই প্রকৃত মহাভারত। তাছাড়া, ব্যাস দেড়শ শ্লোকে সমস্ত পর্বের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত ‘অনুক্রমণিকা’ অধ্যায়ে দিয়েছেন। সৌতির এই উক্তি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে মহাভারত আগে আকারে অনেক ছোটো ছিল, পরে বৃহদাকার ধারণ করেছিল।

ঘ.

আমরা এখানে প্রথমে সৌতি উল্লেখিত কুরুবংশের ইতিহাস সম্বন্ধেই আলোচনা করব। কুরুবংশের রাজাদের নাম ও তাদের বিস্তার সম্বন্ধে বিবরণ পুরাণসমূহে পাই। পুরাণসমূহ সংখ্যায় আঠারো। যথা : ১. ব্রহ্ম, ২. পদ্ম, ৩. বিষ্ণু, ৪. শিব, ৫. ভাগবত, ৬. নারদ, ৭. মার্কন্ডেয়, ৮. অগ্নি, ৯ ভবিষ্য, ১০. ব্রহ্মবৈবত, ১১. লিঙ্গ, ১২. বরাহ, ১৩. স্কন্দ, ১৪. বামন, ১৫. কূর্ম, ১৬. মৎস্য, ১৭. গরুড়, ও ১৮. ব্রহ্মাণ্ড। এটা সকলেরই জানা আছে যে পুরাণসমূহ একই সময়ে রচিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রচিত হওয়ার দরুন পুরাণসমূহের কাহিনিগুলোর মধ্যে আমরা কুরুবংশের ইতিহাস সম্বন্ধে যথেষ্ট অসামঞ্জস্য ও পরস্পরবিরোধী উক্তি পাই। কিন্তু একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত পুরাণসমূহ বিশ্লেষণ করে কুরুবংশের একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ বংশতালিকা তৈরি করেছেন। যে বংশতালিকা পণ্ডিতসমাজ মোটামুটিভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। যে গ্রন্থে তিনি এই বংশতালিকা দিয়েছেন তার নাম হচ্ছে ‘পুরাণ টেকস অভ দি ডাইন্যাস্টিজ্ অভ দি কলি এজ্’। এ গ্রন্থের প্রণেতা হচ্ছেন একজন বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নাম ফ্রেডেরিক ইডেন পার্জিটার। তার সংকলিত বংশতালিকায় বৈবস্বত মনু হতে কুরুবংশীয় পরীক্ষিতের পিতা অভিমন্যু পর্যন্ত ৫৪টি নাম আছে, তার মধ্যে যযাতি-পুত্র-পুরুর স্থান হচ্ছে সপ্তম, দুষ্মন্ত-পুত্র ভরতের বাইশ, সংবরণ পুত্র কুরুর বত্রিশ ও পরীক্ষিতের পিতা অভিমন্যুর চুয়ান্ন। প্রতি পুরুষ ২৫ বৎসর ধরলে মোট ১৩৫০ বৎসর হয়। যদি বরাহমিহির কর্তৃক নির্ণীত যুধিষ্ঠিরের রাজাভিষেকের তারিখ ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হয়, তাহলে বলতে হবে যে জগতে যে মহাপ্লাবন ঘটেছিল তা ৩৭৯৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল, এবং ওই ৩৭৯৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ তারিখেই মনুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। এই হিসাব অনুযায়ী অন্যান্য নৃপতিগণের আবির্ভাবকাল দাঁড়ায় য্যাতি ৩৬৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, পুরু ৩৬২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, দুষ্ম্যন্ত ৩২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, ভরত ৩২৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, কুরু ২৯৯৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, যুধিষ্ঠির ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। মহাভারত থেকে আমরা জানতে পারি যে যুধিষ্ঠির ৩৬ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। সুতরাং পরীক্ষিতের রাজাভিষেক ঘটেছিল ২৪১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।

পুরাণকাহিনি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে সংবরণপুত্র কুরু প্রয়াগ ত্যাগ করে সমন্তপঞ্চক দেশে গিয়ে বাস করতে থাকেন। সমন্তপঞ্চক দেশটা কোথায়, তা এখানে বলা প্রয়োজন। পাঁচটা হ্রদ দ্বারা বেষ্টিত বলে একে সমন্তপঞ্চক বলা হয়। কথিত আছে যে পরশুরাম একবিংশতিবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করে তাদের রক্তের দ্বারা এই হ্রদগুলো সৃষ্টি করেন, এবং সেখানে পিতৃতর্পণ সমাধা করেন। এই পাঁচটি হ্রদের নাম হচ্ছে তরন্তক, অরন্তক, রামহ্রদ, মচক্রক ও শরণ্যাবৎ। মাত্র প্রথম চারটি হ্রদই সমন্তপঞ্চক দেশের চতুঃসীমার মধ্যে অবস্থিত ছিল। আর শরণ্যাবৎ হ্রদ সরস্বতী ও দৃযদ্বতী নদীদ্বয় প্রবাহিত দেশে অবস্থিত ছিল। সুতরাং সমন্তপঞ্চক দেশ একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল এবং এরই মধ্যে কুরুক্ষেত্র অবস্থিত ছিল। কুরুক্ষেত্র নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে মহাভারতে (১/৯৪) বলা হয়েছে যে সংবরণ পুত্র কুরু যখন প্রয়াগ থেকে সমন্তপঞ্চক দেশে গিয়ে বাস করেন, তখনই এর নাম কুরুক্ষেত্র হয়েছিল (৯/৫৩/২)।

ঙ.

আমরা মহাভারতে দেখি যে কুরুদের মূল রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর (বর্তমান মীরাট জেলায়), এবং দ্বিতীয় রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে (বর্তমান দিল্লির নিকটে)। তবে ব্রাহ্মণসাহিত্যে পরীক্ষিতপুত্র জনমেজয়ের রাজধানী আসন্দীবৎ বলা হয়েছে। কিন্তু জনমেজয় তক্ষশিলার সর্পযজ্ঞ করেছিলেন। তা থেকে মনে হয় যে জনমেজয়ের আমলে কুরুরাজ্য বোধ হয় তক্ষশিলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এখানে আমাদের যে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা হচ্ছে কুরুবংশ যদি ২৪৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পূর্বে প্রাদুর্ভূত হয়ে থাকে, তবে তা ঋগ্বেদে উল্লেখিত হয়নি কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রথম, ঋগ্বেদের বা বৈদিক আর্যগণের ভারতে আগমনের তারিখটা নির্ণয় করতে হয়। এ সম্বন্ধে সাম্প্রতিককালের অধ্যাপিকা ডক্টর সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন যে ঋগ্বেদের রচনা ১২০০ খ্রিষ্টাপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ বা ৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সমাপ্ত হয়েছিল। ডক্টর সুকুমার সেনও এই তারিখকে ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পূর্বে নিয়ে যেতে রাজি নন। আগে মনে করা হতো যে আর্যরা ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারতে প্রবেশ করেছিল এবং পঞ্চনদে বসতি স্থাপন করে ঋগ্বেদ রচনা করেছিল। কিন্তু ঋগ্বেদের অভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে প্রকাশ পায় যে বৈদিক আর্যরা পঞ্চনদে বসতি স্থাপনের পর নিরন্তর দেশজ জনগণের সঙ্গে সংগ্রাম লিপ্ত হয়েছিল। যাদের সঙ্গে ঋগ্বেদের রচয়িতারা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তারা যে সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা ব্যতীত আর কেউ নয়, তা ঋগ্বেদে আর্যগণ কর্তৃক দেশজ শত্রুদের কৃষ্টির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্ৰসমূহে যে সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তার তুলনা করলেই সহজে বুঝতে পারা যায়। সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুসমূহের রেডিয়ো কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা গিয়েছে। তা থেকে প্রকাশ পায় যে সিন্ধু সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল ২৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। সেই ভিত্তিতে আমি মনে করি যে আর্যদের ভারতে আগমন ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ঘটেছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা ও বৈদিক-আর্যরা অভিন্ন, এবং সেই কারণে সিন্ধুসভ্যতা বৈদিক-আর্যসভ্যতারই বিকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এ মতবাদ আমি অন্যত্র খণ্ডন করেছি। তা সত্ত্বেও আমি আমার যুক্তিসমূহের পুনরুক্তি করা এখানে প্রয়োজন মনে করি।

১. বৈদিক-আর্যরা গ্রামে বাস করত। সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা ছিল নগরবাসী। নগরের ওপর ঋগ্বেদের আর্যদের ভীষণ বিদ্বেষ ছিল। সেজন্য তারা নগর ধ্বংস করত এবং সেই কারণেই তাদের প্রধান দেবতার নাম রেখেছিল ‘পুরন্দর।

২. সিন্ধুসভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। বৈদিক-আর্যরা প্রথমে কৃষিকার্য জানত না। এটা আমরা শতপথব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি। (২/৩/৭/৮) অধ্যায়। (অতুল সুর, ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষা, দ্বিতীয় সংস্করণ পৃষ্ঠা ৩৮ দ্র.)

৩. বৈদিক-আর্যরাই প্রথমে ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। কিন্তু ঘোড়ার কোনো অশ্মীভূত (fossilized) অস্থি বা কঙ্কাল সিন্ধুসভ্যতার কোনো কেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। তার মানে সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা ঘোড়ার সঙ্গে অপরিচিত ছিল। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা সীলমোহরের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবদের খোদিত প্রতিমূর্তি থেকে বুঝতে পারা যায়। (সীলমোহরসমূহের ওপর বৃষের মূর্তি মহাভারতে উম্মেমিত বৃষপর্বা, বৃষকেতু প্রভৃতি রাজার প্রতীকচিহ্ন কি না তা বিবেচ্য) পশুপতি-শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে বলীবদের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়।

৪. সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর আরাধনাও তারা করত। বৈদিক-আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না। তারা শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। বৈদিক-আর্যরা পুরুষ দেবতার উপাসনা করত। মাতৃকাদেবীর পূজার কোনো আভাস আমরা ঋগ্বেদে পাই না।

৫. বৈদিক-আর্যরা সাধারণত মৃতদেহকে দাহ করত। সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।

৬. বৈদিক-আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর কোনো প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের মধ্যে লিখন-প্রণালী প্রচলিত ছিল।

৭. সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা হাতির সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। ঋগ্বেদের আর্যদের কাছে হাতি এক নতুন জীবন বিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুত হাতিকে প্রাচ্য ভারতের বালকাপ্য নামে এক মুণি প্রথম পোষ মানিয়েছিল।

৮. ঋগ্বেদের আর্যরা মৎস্য ভক্ষণ করত না। সিন্ধুসভ্যতার লোকরা মৎস্য ভক্ষণ করত।

৯. সিন্ধুসভ্যতার যে বৈদিক-আর্যসভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড়ো প্ৰমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র কুরু-পাঞ্চাল দেশ তার মানে বৈদিক আর্যসভ্যতার যেখানে বিস্তার লাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রং ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে যেসব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর রং হচ্ছে ‘কালো লাল।’

১০. বৈদিক-আর্যরা ও সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা যে একই, এটা আবয়বিক নৃতাত্ত্বিক তথ্য দ্বারা সমর্থিত নয়।

এসব প্রমাণ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে বৈদিক-আর্যসভ্যতা ও সিন্ধুসভ্যতা এক নয়।

চ.

এখন কথা হচ্ছে এই যে বৈদিক-আর্যসভ্যতা যদি সিন্ধুসভ্যতার উত্তরকালের হয়, তবে সিন্ধুসভ্যতার পূর্ববর্তীকালে প্রাদুর্ভূত কুরু-পাণ্ডবদের উল্লেখ আমরা ঋগ্বেদে পাই না কেন? যদি ঋগ্বেদের দশম ও অষ্টম মণ্ডলে উল্লেখিত ‘কুরুশ্রবণ’ এবং ‘পাকসামা কৌরায়ণ (১০:৩৩:৪; ৮:৩:২১) নামের মধ্যে কুরুদের নামের ইঙ্গিত আছে বলে আমরা ধরে নিই, তা হলেও এটা স্বীকার করতে হবে যে ঋগ্বেদে কুরুদের সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই। ঐতরেয় ইত্যাদি ব্রাহ্মণগ্রন্থে পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুদের উল্লেখ আছে, কিন্তু ঋগ্বেদে পাঞ্চালদেরও কোনো উল্লেখ নেই। তবে ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহে পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুদের উল্লেখ দেখে নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে এই উভয়কুল পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। এ প্রসঙ্গে আরও এক কথা আছে। যদিও উত্তর-ঋগ্বেদযুগের সাহিত্য কুরুকুল, কুরুক্ষেত্র, বিচিত্রবীর্যের পুত্র ধৃতরাষ্ট্র এবং পরীক্ষিতপুত্র জনমেজয়ের উল্লেখ আছে, কিন্তু কোনো জায়গায় পাণ্ডু ও পাণ্ডুপুত্রগণের, তার মানে পাণ্ডবদের বা কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘটিত কোনো যুদ্ধের কথা বা ইঙ্গিত নেই।

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কাত্যায়ন পাণিনির একটি সূত্রের (৪/১১/১৬৮) যে বার্তিক রচনা করেছিলেন, তাতে ‘পাণ্ডোর্ডণ’ শব্দটি আছে। অনেকে মনে করেন যে এই শব্দটির দ্বারা পাণ্ডুগোষ্ঠীকেই বোঝাচ্ছে। আবার ওই খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস লিখে গেছেন যে এক জনশ্রুতি অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতের পাণ্ডীয়গণের আদি নিবাস উত্তর ভারতের মথুরা অঞ্চলে ছিল এবং সেখান থেকেই তারা দক্ষিণ ভারতে গিয়ে মাদুরা নগর প্রতিষ্ঠা করেছিল।

ছ.

ঋগ্বেদে কুরুপাণ্ডবদের অনুল্লেখ সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে ‘আর্য’ শব্দটা জাতিবাচক শব্দ নয়, ভাষাবাচক শব্দ মাত্র। যেসব বিশেষ নরগোষ্ঠীর লোকরা ‘আর্য’ ভাষায় কথা বলত, তাদেরই আমরা ‘আর্য’ বলি। ভারতে আগত আর্যভাষাভাষী লোকেরা দুই বিভিন্ন নরগোষ্ঠীতে recial groups বিভক্ত ছিল— ১. আলপীয় ও ২. নর্ডিক। আলপীয়রা ছিল হ্রস্বকপাল (Brachycephals) জাতি, আর নর্ডিকরা দীর্ঘ-কপাল (dolichocephals) জাতি। ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করেছেন যে রুশদেশের উরাল পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত শুষ্ক তৃণাচ্ছাদিত সমতল ভূখণ্ডই আর্যভাষাভাষী জাতির আদি বাসস্থান ছিল। এখানে ‘নর্ডিক’ ও ‘আলপীয়’ এই উভয় গোষ্ঠীর আর্যরাই বাস করত। নবোপলীয়যুগের বিকাশকালে আলপীয়রা কৃষিপরায়ণ হয়, আর নর্ডিকরা পশুপালনে রত থাকে। এর ফলে উপাস্য দেবতা সম্বন্ধে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়। নর্ডিকরা ‘প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের উপাসক ছিল এবং উপাস্য দেবতাদের তারা ‘দেব’ নামে অভিহিত করত। আর আলপীয়রা কৃষির সাফল্যের জন্য ‘সৃজনশক্তি’ রূপে দেবতাসমূহের পূজা করত। তারা তাদের ‘অসুর’ নামে অভিহিত করত। মনে হয় আলপীয়রা নিজেদের এক বিশেষ শাখায় বিভক্ত করে প্রথমে শিরদরিয়া ও আমুদরিয়া নদীদ্বয় বেষ্টিত সুবিস্তীর্ণ সমতল ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করে। তারপর তারা পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে ইরান থেকে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। অপরপক্ষে তার কিছুকাল পরে নর্ডিকরা দুইদলে বিভক্ত হয়ে একদল পশ্চিমে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয় ও অপর দল স্থলপথে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন তাদের সঙ্গে কাস্সুরা (Kassites) ছিল। এদেরই একদল খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫৫০ বৎসরের মধ্যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রবেশদ্বার দিয়ে পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে ও পরে নিজেদের উত্তর ভারতে বিস্তার করে। কিন্তু তার আগেই আলপীয়রা এশিয়া মাইনর বা বেলুচিস্তান থেকে পশ্চিম সাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ সিন্ধু-কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ, কণাদ ও তামিলনাড়ুর উপকূলভাগ ধরে বাংলা ও ওড়িশ্যায় আসে। আর্যদের মধ্যে দুই কুল যথা তুর্বশ ও যদুরা যে সমুদ্রপথে এসেছিল, তার উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। মহাভারত অনুযায়ী যদু, তুর্বশ, দ্রুহা, অনু ও পুরুরাজাক যযাতির পুত্র, তমন্ধে দ্রুষ্টু, অনু ও পুরু অসুররাজ। বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার সন্তান। পুরুর বংশেই ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম হয়েছিল। সুতরাং তারা যে অসুর যোনি সম্ভৃত্ত তা মহাভারতে স্পষ্টই বলা হয়েছে। মনে হয় অসুর আর্যদের অনুসরণেই আলপীয়রা, দ্রাবিড়রা এদেশে এসেছিল। আরও উল্লেখণীয় যে ভারতে তাদের বিস্তৃতি বাংলা থেকে পশ্চিমদিকে বারাণসী পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়, আর নর্ডিক উপাদান পঞ্চনদ থেকে পূর্বদিকে বারাণসী পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে, সেখানেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।

মনে রাখতে হবে যে বৈদিক আর্যরা যখন এদেশে এসেছিল, তখন ভারত জনশূন্য দেশ ছিল না। ভারতে যে জনগণ ছিল বৈদিক সাহিত্য তাদের অসুর, দাস, দস্যু, পনি নিষাদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। সর্বত্রই তাদের সঙ্গে আর্যদের প্রথম সংগ্রাম ও পরে সংমিশ্রণ ও আপোশ ঘটেছিল।

আমরা আগেই বলেছি যে আর্যভাষাভাষী আলপীয়রা ‘অসুর’ নামে আখ্যাত ছিল। যেহেতু তারা বাংলা দেশে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, সেই হেতু প্রাচীন সাহিত্যে বাংলা দেশের লোকদের ‘অসুর’ জাতিভুক্ত বলা হয়েছে। বস্তুত ঋগ্বেদে ‘অসুর’-গণের যেমন নিন্দাবাদ ও কটাক্ষ প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনই দেবতাগণের বিশেষণ হিসেবেও ‘অসুর’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডল ‘অসুর’ শব্দটা ১২ বার প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কোনো স্থলেই দানবদের সম্বন্ধে এ শব্দের প্রয়োগ করা হয়নি। প্রথম মণ্ডলের যে যে দেবতা সম্বন্ধে ‘অসুর’ শব্দ আছে, সেগুলো হচ্ছে— ২৪ সুক্তের ১৪ ঋকে বরুণ সম্বন্ধে, ৩৬ সুক্তের ৭ ঋকে সূর্যরশ্মি সম্বন্ধে, ৩৫ সুক্তের ১০ ঋকে সবিতা সম্বন্ধে, ১১০ সুক্তের ২ ঋকে মরুদগণ সম্বন্ধে, ১২২ সুক্তের ১ ঋকে রুদ্র সম্বন্ধে, ১২৬ সুক্তের ২ ঋকে ভাবয়ব্য রাজা সম্বন্ধে, ১৫১ সুক্তের ৪ ঋকে মিত্র ও বরুণ সম্বন্ধে, ১৭৪ সুক্তের ১ ঋকে ইন্দ্র সম্বন্ধে। দ্বিতীয় মণ্ডলে ‘অসুর’ শব্দ দেবগণের সম্বন্ধে তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে, যথা প্রথম সুক্তের ৩ ঋকে রুদ্র সম্বন্ধে, ২৭ সুক্তের ১০ ঋকে বরুণ সম্বন্ধে ও ২৮ সুক্তের ৭ ঋকে বরুণ সম্বন্ধে। অনুরূপভাবে ‘অসুর’ শব্দ তৃতীয় মণ্ডলে ছয়বার, চতুর্থ মণ্ডলে ২ বার, পঞ্চম মণ্ডলে ১১ বার, ষষ্ঠ মণ্ডলে আটবার, অষ্টম মণ্ডলে আটবার, নবম মণ্ডলে তিনবার ও দশম মণ্ডলে ১৯ বার।

মহাভারতে বলা হয়েছে অসুররাজ বলির পঞ্চপুত্রই অঙ্গ, বঙ্গ পৌণ্ড্র, সুহু্য ও কলিঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামে এক প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থেও বলা হয়েছে যে অঙ্গ, বঙ্গ প্রভৃতি দেশের লোকরা ‘অসুর’ জাতির ভাষায় কথা বলে। ভারতের ভাষাতত্ত্ব সমীক্ষার অধ্যক্ষ গ্রিয়ারসন এটা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি এই ভাষাভাষী লোকদের Outer Aryans এবং বৈদিক-আর্যদের Inner Aryans বলেছিলেন। এছাড়া অসুরদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা স্থপতিবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। এ সম্পর্কে ময়াসুরের নাম উল্লেখযোগ্য। স্থপতিবিদ্যায় পারদর্শী থাকা মানেই তারা ঘরবাড়ি ও নগর নির্মাণে বিশেষ দক্ষ ছিল। বৈদিক-আর্যরা নগর নির্মাণ করতে জানত না। তারা নগর ধ্বংসই করত। যেহেতু অসুররা সমুদ্রপথে এসেছিল, সেই হেতু নৌবিদ্যাতেও তারা পারদর্শী ছিল, এবং বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে রত ছিল। আর বৈদিক-আর্য’ সমাজে কোনো রাজা ছিল না। ছিল দলপতি বা কুলপতি। অসুরদের ‘রাজা’ ছিল! ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (১/১৪) খুব খোলাখুলিভাবেই এ কথাটা স্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে— ‘দেবাসুরের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। প্রতিবারই অসুররা দেবগণকে পরাহত করছিল। তখন দেবগণ বলাবলি করতে লাগল, যেহেতু আমাদের কোনো ‘রাজা’ নেই (‘অরাজতয়’) সেই হেতু অসুরগণ আমাদের পরাহত করছে। সুতরাং আমাদের একজন ‘রাজা’ নির্বাচিত করা হউক। সকলেই তাতে সম্মতি দিল। (‘রাজানাম করবমহ ইতি তথেতি’)। সেই থেকেই বৈদিক-আর্যসমাজে ‘রাজা’ সৃষ্টি হলো। অথর্ববেদেও ‘একরাট’ শব্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘যেরূপ প্রাচ্যদেশে আছে’। সুতরাং এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ‘রাজা’র concept-টা বৈদিক-আর্যরা প্রাচ্যদেশের অসুরগণের কাছ থেকেই পেয়েছিল।

জ.

মনে হয় প্রাচ্যদেশের এই আর্যভাষাভাষী আলপীয়দেরই, প্রাচীন সাহিত্যে ‘ভরতবংশীয়’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা, পাণিনি বলেছেন যে, ভরতবংশীয়রা প্রাচ্যদেশের লোক। পাণিনির এই উক্তি পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। মনে হয় পাণিনির এই উক্তি সত্য এবং ভরতবংশীয়দের বিস্তার প্রাচ্যদেশ থেকে পশ্চিমদিকে হয়েছিল। এটা আবয়বিক নৃতত্ত্বের দ্বারা সমর্থিত। যদিও আলপীয় আর্যদের বাংলা দেশেই কেন্দ্রীভূত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়, তাদের সংখ্যা পশ্চিমদিকে ক্রমশ ক্ষীয়মান হয়ে, বারাণসীতে গিয়ে বিলুপ্ত হতে দেখা যায়।

দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত থেকেই ভরতবংশের সৃষ্টি। ভরতের নবম অধস্তন পুরুষ ছিলেন কুরু, আর শান্তনু ছিলেন তার চতুদর্শ অধস্তন পুরুষ। তার মানে, কুরু-পাণ্ডবরা ভরত বংশেরই লোক। ঋগ্বেদের সময় ভরতবংশীয় রাজা সুদাস তাঁর পুরোহিত বৈশিষ্ট্যের নেতৃত্বে, বিশ্বমিত্রের নেতৃত্বাধীনে সম্মিলিত দশজন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন! এই জয়লাভের পরই ভরতবংশ উত্তর ভারতের সার্বভৌমত্ব লাভ করে। শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ভরতবংশীয় নৃপতিদের মতো পরাক্রমশালী নৃপতি ভূভারতে আর দ্বিতীয় ছিল না। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত (৩২৮৪ খ্রিষ্টপূর্ব) নিজেই যমুনাতীরে একশত, সরস্বতী নদীতীরে তিনশত ও গঙ্গাতীরে চারশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। পরে তিনি আবার সহস্র অশ্বমেধ ও একশত রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। তাছাড়া, অগ্নিষ্টোম, অতিরাত্র, উকথ, বিশ্বজিৎ ও সহস্র বাজপেয় যজ্ঞ করেছিলেন। এক কথায় ভরত নিজে অত্যন্ত প্রভাবান্বিত রাজা ছিলেন এবং তারই নাম থেকে এদেশের নাম ‘ভারতবর্ষ’ হয়েছিল। (আগে নাকি এর নাম ছিল অজনাভ ও মতান্তরে ঋষভদেবের জ্যেষ্ঠ-পুত্র ভরতের (জন্মান্তরে জড়ভরত) নামানুসারে ভারতবর্ষ নামের প্রচলন হয়। বিষ্ণুপুরাণ ২/১/১৮,৩২ মার্কন্ডেয় পুরাণ ৫৩/৩ ৮-৪০)। সুদাসের পিতা দিবোদাস শম্বর নামে এক ‘দাস’ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রাচ্য ভারতে কিকটদের বিরুদ্ধে ভরতবংশীয়রা যুদ্ধাভিযান চালিয়েছিলেন। যেহেতু কুরুপঞ্চাল দেশে অগ্রসর হওয়ার পর বৈদিক-আর্যগণ ভরতদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, সেজন্য ভরত রাজাদের সম্বন্ধে জনশ্রুতিসমূহ বৈদিক সাহিত্য আত্মসাৎ করার সময় তারা তৎকালীন বৈদিক সমাজে প্রচলিত অশ্বমেধ, রাজসূয় ইত্যাদি যজ্ঞ সম্পাদনের গৌরব ভরত রাজাদের ওপর আরোপিত করেছিল, তা না হলে প্ৰাগবৈদিক সমাজে এসব যজ্ঞ সম্পাদন প্রচলিত ছিল না।

ঝ.

মোট কথা কুরু-পাঞ্চাল অনুপ্রবেশের পূর্বে বৈদিক-আর্যরা ভরতবংশীয়দের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। সেজন্যই আমরা ভরতদের উদ্ভব বা ভরতদের আগমন সম্বন্ধে কোনো স্মৃতি ঋগ্বেদে লিপিবদ্ধ থাকতে দেখি না। তবে ঋগ্বেদ থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে আর্যরা দুই বিরোধী দলে বিভক্ত ছিল। তাদের কৃষ্টিও স্বতন্ত্র ছিল। এক দলকে আমরা সুজয় ও ভরতদের সঙ্গে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ দেখি; আর আরেক দলকে আমরা যদু, তুর্বশ, দ্রহ্য, অনু ও পুরুদের সঙ্গে সম্মিলিত দেখি। মনে হয় আর্যদের এই দুই দলে বিভক্ত হওয়ার মধ্যেই কুরু-পাণ্ডবদের বিরোধিতার কাহিনি নিহিত ছিল এবং ভরতবংশীয় নৃপতি সুদাস যখন বিশ্বমিত্রের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দশজন রাজাকে পরাহত করে সার্বভৌমত্ব লাভ করেছিল, তখনই আর্যসমাজে একটা ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা হয়েছিল, এবং সেই সময়েই প্রাচীন জনশ্রুতিসমূহকে একত্রিত করে মহাভারত রচিত হয়েছিল। যদিও ভরতকুলের আর্যরা কবে ভারতে এসেছিল, সে সম্বন্ধে কোনো সংবাদই আমরা ঋগ্বেদে পাই না, তবে তার প্রতিধ্বনি আমরা ঋগ্বেদের স্থানে স্থানে শুনতে পাই।

উপরে যে দুই বিরোধী আর্যদলের কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে শেষোক্ত দলকে আমরা দেশজ জাতিসমূহের সহিত সম্মিলিত দেখি, এবং ঋগ্বেদে তাদের যজ্ঞবিরোধী, ইন্দ্রবিরোধী, ও অনৃতদেবা বলে বর্ণিত করা হয়েছে। এই শেষোক্ত বিরোধীদলের মধ্যেই তুর্বশ ও যদুরা ছিল, যাদের সম্বন্ধে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে তারা বাংলা দেশে এসেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। আমার শিক্ষাগুরু হারানচন্দ্র চাকলাদার একজন অসাধারণ বেদজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তাঁর শেষজীবনে ‘প্রাচ্যভারতে আর্য অধিকার’ (আরিয়ান অকুপেশন অভ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া) সংজ্ঞক এক গ্রন্থ লিখেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে লিখেছিলেন যে প্রাচ্যভারতেও আর্যদের বসতি ছিল এবং প্রাচ্যভারতের এইসব আর্যরা বৈদিক সংস্কৃতি গঠনে অনেককিছু উপাদান করেছিল।

আমি আগেই বলেছি যে সুদাসের আধিপত্য স্থাপনের পরই আর্যসমাজে একটা ঐক্য ও সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ ঘটেছিল। এই ঐক্য মাত্র আর্যসমাজের বিভিন্ন কুলের মধ্যেই সংসৃষ্ট হয়নি, অনার্যদের সঙ্গেও। আমি বহুবার বহু জায়গায় এ কথা বলেছি ও লিখেছি যে বৈদিক-আর্যরা ছিল যোদ্দার জাত, সেজন্য তারা তাদের সঙ্গে যথাযথ সংখ্যক স্ত্রীলোক আনতে সক্ষম হয়নি। কাজেই তাদের এদেশের মেয়ে বিয়ে করতে হয়েছিল। ঋগ্বেদে আমরা পুনঃ পুনঃ তাদের ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করতে দেখি, ‘হে ইন্দ্র, আমাদের শত্রুর ধন দাও, শত্রুর স্ত্রী দাও।’ এর ফলেই প্রতিলোম বিবাহের উদ্ভব ঘটেছিল। যখন দেশজ মেয়েরা আর্যগৃহিনী হলো, তখন তারা আর্যসমাজের রীতিনীতি, আচার- ব্যবহার ইত্যাদির ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করল। এর ফলে একটা সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ ঘটল যার রূপ আমরা অথর্ববেদ ও ব্রাহ্মগ্রন্থসমূহে দেখি। এটা ঘটেছিল কুরুপাঞ্চাল দেশে। এই সময়েই আদি মহাভারতের কাহিনি যা পূর্ব বৈদিক-আর্যসমাজে অজ্ঞাত ছিল, তা যুগোপযোগী করে আর্যসমাজে গ্রহণ করা হবে। তখন মহাভারতে বর্ণিত কুরুপাঞ্চাল সমাজে প্রচলিত উপাখ্যান ও আখ্যায়িকসমূহের সহিত বৈদিক-আর্যরা পরিচিত হলো। সেজন্যই এই পর্বে ঋগ্বেদে আমরা কুরু-পাঞ্চালের সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ পাই না। কিন্তু বৈদিক- আর্যসমাজে মহাভারত স্থান ও স্বীকৃতি পাওয়ার পর কুরু-পাঞ্চাল, প্রদেশে প্রচলিত সমস্ত উপাখ্যান ও আখ্যায়িকা মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত করে মহাভারতের কলেবরও বৃদ্ধি করা হলো।

ঞ.

মহাভারতের লিখিতরূপ সম্বন্ধে মহাভারতের অধিকাংশ সংস্করণেই একটা কাহিনি বিবৃত আছে। সে কাহিনিটা হচ্ছে—’মহাভারত রচনার পর ব্যাসদেব ভেবেছিলেন, কোন উপায়ে এই ইতিহাস তিনি শিষ্যদের অধ্যয়ন করাবেন? তখন ভগবান ব্রহ্মা তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেন, তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনি তোমার গ্রন্থের লিপিকর হবেন। ব্যাস গণেশকে অনুরোধ করলে তিনি বললেন, আমি সম্মত আছি, কিন্তু আমার লেখনি ক্ষণমাত্র থামবে না। ব্যাস ভাবলেন, আমার রচনায় আট হাজার আটশ’ এমন কুটশ্লোক আছে যার অর্থ কেবল আমি ও আমার পুত্র শুক বুঝতে পারে, সঞ্জয় পারেন কি না সন্দেহ। ব্যাস গণেশকে বললেন, আমি যা বলে যাব আপনি অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। গণেশ বললেন, তাই হবে। গণেশ সর্বজ্ঞ হলেও কুটশ্লোক লেখার সময় তাকে ভাবতে হতো, সে অবসরে ব্যাস বহু শ্লোক রচনা করতেন। এখানে দুটো প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে মনে জাগে। ব্যাস ও গণেশ কে? ব্যাস সম্বন্ধে আমরা জানি যে তিনি পরাশর-সত্যবতীর অবৈধ-মিলনের সন্তান। ব্যাস যে মাত্র মহাভারত ও পুরাণ রচনা করেছেন তা নয়। তিনি বেদ সংকলনও করেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন মনে জাগে। প্রশ্নটা হচ্ছে, তথাকথিত বৈদিক-আর্যসমাজে বড়ো বড়ো পণ্ডিত থাকা সত্ত্বেও বেদসংকলন ও পুরাণ- মহাভারত প্রভৃতির রচনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কেন একজন অনার্য রমনীর জারজ সন্তানের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল? ব্যাসের সেই জন্ম-কাহিনির মধ্যেই ভারতীয় সংস্কৃতির এক গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। (অতুল সুর, হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৬০)।

আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন, গণেশ কে? পুরাণে পার্বতীর (প্রাগার্যদেবতা শিবের স্ত্রী) গর্ভে গণেশের জন্ম সম্বন্ধে একটা কাহিনি আছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আলোচনাটা অন্যভাবেও করা যেতে পারে। এটা সকলেরই জানা আছে যে বৈদিক-আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের মধ্যে যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আমরা সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে প্রাপ্ত সীলমোহসমূহ থেকে পেয়েছি। বর্তমানে ভারতে প্রচলিত অধিকাংশ লিখন-প্রণালী ব্রাহ্মীলিপি থেকে উদ্ভূত। পণ্ডিতগণের অভিমত এই যে ব্রাহ্মলিপি, সিন্ধুসভ্যতার লিখন-প্ৰণালী থেকে উদ্ভূত। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে আমিও (ক্যালকাটা রিভিউ, ‘স্কিপ্ট, প্যালিওনটোলজি’ দ্র.) এই মত প্রকাশ করেছিলাম। ব্যাস যখন মহাভারত রচনা করেছিলেন, তখন তিনি গণেশ বা বিনায়ককে লিপিকর নিযুক্ত করেছিলেন। গণেশ প্রথমে সিদ্ধিনাশক দেবতা ছিলেন। সিদ্ধিদাতা দেবতা হিসেবে ব্রাহ্মণ্যধর্মে গণেশের প্রবেশ খুব অর্বাচীন। রামায়ণ এবং পুরাণে গণেশের উল্লেখই নেই। তার নাম আমরা প্রথম পাই যাজ্ঞবন্ধ্যে-তাও দেবতা হিসেবে নয়, রাক্ষস হিসেবে এবং মানবের সর্ব কর্মের সিদ্ধিনাশক হিসেবে। গণেশের alias বিনায়ক নামে একশ্রেণির রাক্ষসের নামও আমরা প্রাচীন সাহিত্যে পাই। মনে হয়, যেহেতু আর্যদের মধ্যে কোনোরূপ লিখনপদ্ধতির প্রচলন ছিল না, সেই হেতু মহাভারত লেখার জন্য যখন একজন লিপিকরের প্রয়োজন হলো, তখন তারা বিনায়ক নামধারী এক দেশজ জাতির কাছ থেকে এক লিপিকরের সাহায্য নিয়েছিল। লিপিকর হিসেবে তিনি আর্যদের যে প্রভূত উপকার সাধন করেছিলেন, তার জন্যই ব্রাহ্মণ্য দেবতামণ্ডলীতে তাঁকে দেবতার স্থান দেওয়া হয়। তখন যাজ্ঞবন্ধ্যের সিদ্ধিনাশক রাক্ষস বিনায়ক-জাতিভুক্ত সিদ্ধিদাতা গণেশ হিসেবে গণ্য হন। (অতুল সুর, ‘প্রি-আরিয়ান, এলিমেন্টস্ ইন ইন্ডিয়ান কালচার, ক্যালকাটা রিভিউ’ ১৯৩১-৩২ ও ‘ইন্ডিয়ান হিস্টারিকাল কোয়াটারলি’ ১৯৩৪ দ্র.)।

ট.

মহাভারতের বহু জায়গা থেকে প্রকাশ পায় যে পাণ্ডবদের কুলদেবতা ছিলেন পশুপতি-শিব। যদিও মহাভারতের কৃষ্ণের ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা হলেও পশুপতি-শিবই মহাভারতের শ্রেষ্ঠ দেবতা। কেননা, অনুশাসনপর্বে আমরা পড়ি, যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ আপনি জগৎপতি মহেশ্বর শঙ্করের নামসকল বলুন। ভীষ্ম বললেন, তাঁর নামকীর্তন আমার সাধ্য নয়। এই মহাবাহু কৃষ্ণ বদরিকাশ্রমে তপস্যা করে মহাদেবকে তুষ্ট করেছিলেন, ইনিই তাঁর নাম ও গুণাবলি কীর্তন করুন। পশুপতি-শিবই যে পাণ্ডবদের কুলদেবতা ছিলেন, সেটা আমরা আরও বুঝতে পারি ধৃতরাষ্ট্রের এক উক্তি থেকে। কেননা, ‘পশুপতি উৎসব’ দর্শনের ছলনাতেই ধৃতরাষ্ট্র কুন্তি ও তাঁর পুত্রগণকে বারনাবতে পাঠিয়েছিলেন। তাছাড়া, যেসব জনশ্রুতি বীরভূমে ছড়িয়ে আছে, সে সকল জনশ্রুতি অনুযায়ী পাণ্ডবরা বীরভূমে কয়েকটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের আরাধ্য দেবতা যে পশুপতি-শিব ছিল, তা আমরা মহেঞ্জোদারো হতে যে ত্রিমুখবিশিষ্ট দেবতার মূর্তি পেয়েছি, তার দ্বারা প্রমাণিত হয়। তিনি সিংহাসনের ওপর আসীন, তাঁর বক্ষ, কণ্ঠ ও মস্তক উন্নত। তাঁর এক পা অপর পায়ের ওপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত, তাঁর হাত দৃষ্টি বিস্তৃত অবস্থায় হাঁটুর ওপর অবস্থিত। তিনি পর্যঙ্কআসনে উপবিষ্ট হয়ে, ধ্যানস্থ ও উর্দ্ধলিঙ্গ। তাঁর উভয় পার্শ্বে চার প্রধান দিকনির্দেশক হিসেবে হাতি, বাঘ, গন্ডার ও মহিষের প্রতিমূর্তি অঙ্কিত। তাঁর সিংহাসনের নিচে দুটি মৃগকে পশ্চাৎদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এখানেই যে আমাদের আদি পশুপতি-শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিব যে অবৈদিক দেবতা, তা আজ স্বীকৃত! বৈদিক রুদ্র দেবতা যে মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত আদি-শিবের প্রতিরূপই কল্পিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কেননা, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে রুদ্র সুবর্ণ নির্মিত অলংকার ধারণ করেন, এবং মহেঞ্জোদারোয় আমরা আদি-শিবের যে মূর্তি পেয়েছি, সেখানেও আমরা আদি- শিবের বাহুতে ও কণ্ঠে অলংকার ধারণ করতে দেখি। বৈদিক রুদ্র আর্যদের যে একজন অর্বাচীন দেবতা ছিলেন, তা বুঝতে পারা যায় এই থেকে যে সমগ্র ঋগ্বেদে তাঁর উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল, এবং অগ্নিদেবতার সঙ্গে তার সমীকরণ করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে শতশথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে ‘শব’ ও ‘ভব’ (শিবেরই অপর নাম) এই দেবতাদ্বয় প্রাচ্যদেশীয় অনুসরগণ কর্তৃক পূজিত হন। শেষের দিকের বৈদিক সাহিত্যে আমরা হর, মৃদ, শর্ব, ভব, মহাদেব, পশুপতি, শঙ্কর, ঈশান প্রভৃতি দেবতাকে শিবের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে দেখি। এ সম্বন্ধে বেরিয়েডেল কীথ-এর একটা মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন— ‘বৈদিক যুগের শেষের দিকের রুদ্র দেবতার মধ্যে আমরা একাধিক দেবতার সমন্বয় ও আর্য মানসিকতার ওপর অনার্য প্রভাব পাই।

এটা নিশ্চয়ই সম্ভবপর যে কতকগুলো অরণ্য, পর্বত ও কৃষি সংক্রান্ত দেবতা বা মৃতাত্মা সম্পর্কিত দেবতা বৈদিক রুদ্র দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শিবরূপে কল্পিত হয়েছিল। পরবর্তীকালের শিবের মধ্যে দেখতে পাই যে শিবের লিঙ্গ পূজা যা ঋগ্বেদে নিন্দিত হয়েছে, তা হিন্দুদের মধ্যে যেরূপ জনপ্রিয়, ভারতের আদিবাসীগণের মধ্যেও সেরূপ জনপ্রিয়।’ কীথ এ মন্তব্য করেছিলেন মহেঞ্জোদারোয় আদিশিব আবিষ্কারের পূর্বে। সেজন্য তিনি শিবের আদি কল্পনা সম্বন্ধে এক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছিলেন।

সিন্ধুসভ্যতার প্রাচীন অধিবাসীরা যে লিঙ্গ-যোনি উপাসক ছিল, তা সেখানে প্রাপ্ত মণ্ডলাকারে গঠিত প্রস্তর প্রতীকসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায়। এছাড়া, আমরা সেখানে প্রস্তরনির্মিত পুরুষলিঙ্গের এক বাস্তবানুগ প্রতিরূপ পেয়েছি। সিন্ধুসভ্যতার বাহকরাই যে ঋগ্বেদে বর্ণিত সমৃদ্ধশালী নরগসমূহের ‘শিশ্ন উপাসক’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘অ্যানাল’ অভ দি ভান্ডারকার ওরিয়েন্টাল ইনস্টিট্যুট’ পত্রিকায় লিখিত এক প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছিলাম যে লিঙ্গ উপাসনা ভারতে তাম্রাশ্মযুগের পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। মহাভারতের অনুশাসন ও দ্রোণপর্বদ্বয়েও আমরা শিবলিঙ্গের উল্লেখ পাই।

ঠ.

সিন্ধুসভ্যতার বাহকগণ মাতৃকাদেবীরও উপাসনা করত। মহাভারতে মাতৃকাদেবীর উল্লেখ আছে। মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বাধ্যায়ে রক্তবদনা রক্তবসনা রক্তমালাধারিণী পাশহস্তা কালরাত্রিরূপা কালীর তাঁর সহচরীদের সঙ্গে আবির্ভাবের কথা আছে। আবার অনুশাসনপর্বে লক্ষ্মদেবীর উল্লেখ আছে। সেখানে লক্ষ্মী বলছেন- ‘আমি লোককান্তা শ্রী; আমি দৈত্যদের ত্যাগ করেছি; সেজন্য তারা বিনষ্ট হয়েছে, আমার আশ্রয়ে দেবতারা সুখভোগ করছেন, আমি তোমাদের (গাভীদের) দেহে নিত্য বাস করতে ইচ্ছা করি, তোমরা শ্রীযুক্ত হও। গাভীরা বলল, তুমি অস্থিরা, চপলা বহু লোকের অনুরক্তা, আমরা তোমাকে চাই না। পরে গাভীরা মন্ত্রণা করে বলল, কল্যাণী যশস্বিনী, তোমার সম্মান রক্ষা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তুমি আমদের পুরীষ ও মুত্রে অবস্থান কর। লক্ষ্মী তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক, আমি সম্মানিত হয়েছি।’ এখানে লক্ষ্মীকে ‘বহু লোকের অনুরক্তা’ বলা দ্বারা মনে হয় সিন্ধুসৌবির থেকে সুমের পর্যন্ত অঞ্চলে মাতৃপূজার সঙ্গে যে ধর্মীয় গণিকাবৃত্তির প্রচলন ছিল, তারই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে কালী ও লক্ষ্মী, দুইই যে প্রাগবৈদিক দেবী, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ড.

আমি মহাভারতের কাহিনি যে প্রাগবৈদিক, তার আর এক প্রমাণ তক্ষশিলার নাগজাতির আধিপত্য থেকে পাওয়া যায়। অর্জুন পৌত্র পরীক্ষিতকে তক্ষশিলার নাগরাজ তক্ষকই নিহত করেছিল। যদিও আর্যগণ পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করেছিল, তথাপি নাগজাতির কোনো উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই। অথচ সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রে আমরা নাগজাতির অস্তিত্বের নিদর্শন পাই। সেখানে একটা উজ্জ্বল রঙের প্রলেপবিশিষ্ট মৃৎ-অলংকরণ ফলক পাওয়া গিয়েছে যার ওপরে চিত্রিত রয়েছে দুপাশে দুজন সর্পের ফণাস্বরূপ কিরীটধারী ভক্ত ও এক আড়াআড়িভাবে পা রেখে বসা দেবতা। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সিন্ধুসভ্যতার এই নাগ-কিরীটধারী ভক্তবৃন্দ নাগজাতির লোক ব্যতীত আর কেউই নয়, এবং তাদের নাগ-কিরীট, তাদের কুল প্রতীক বা ‘টটেম’ ছাড়া আর কিছু নয়। নাগজাতি যে একসময় পাঞ্জাবে খুব প্রতাপশালী জাতি ছিল সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাদের বিনাশের জন্যই পরীক্ষিতপুত্র রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাছাড়া, জনমেজয় তক্ষশিলা আক্রমণ করে নাগাদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছিল।

অক্ষক্রীড়া মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে অক্ষক্রীড়া যে খুব জনপ্রিয় ছিল, তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমরা সেখান থেকে পেয়েছি।

ঢ.

আদি মহাভারত যে তাম্রযুগের একেবারে গোড়ার দিকের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছিল, সেটা বুঝতে পারা যায় তামার স্বল্প উল্লেখ ও তার অলৌকিক শক্তি থেকে। মাত্র দু’ক্ষেত্রেই এটা উল্লেখিত হয়েছে। কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র যে তাম্রনির্মিত চক্র ছাড়া আর কিছু নয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মহাভারতের নায়কদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর এরূপ অস্ত্র ছিল। এই অস্ত্র থাকার দরুনই দ্রোণ সংশপ্তকবধপর্বে দুর্যোধনকে বলেছিল যে কৃষ্ণ অজেয়। দ্বিতীয় কাহিনিটা বিবৃত হয়েছে মহাভারতের বনপর্বে আরণ্যকপর্বাধ্যায়ে। যুধিষ্ঠির যখন সহগামী ব্রাহ্মণদের অনুদানের অভাবের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলেন, তখন তিনি সূর্যের স্তব করেন। সূর্যদেব প্রীত হয়ে এক তাম্রময় থালি দিয়ে বলেছিলেন যে পাঞ্চালী পাকশালায় গিয়ে এই তাম্রখালিতে বা কিছু রন্ধন করে যতক্ষণ অনাহারে থাকবেন ততক্ষণ চতুর্বিধ অন্ন অক্ষয় হয়ে থাকবে। এ থেকেই বোঝা যায় যে পাণ্ডবদের আবির্ভাব এমন সময়ে হয়েছিল, যে সময় তামার ব্যবহার সবেমাত্র শুরু হয়েছে। পাণ্ডবদের আবির্ভাব ঘটেছিল দ্বাপর যুগে, এবং পুরাণসমূহ অনুযায়ী দ্বাপরযুগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ তাম্রপাত্রে অন্ন-ভোজন।

ণ.

মহাভারতের বনপর্বে তীর্থযাত্রাপর্বাধ্যায়ে আরও বিবৃত হয়েছে যে যুধিষ্ঠির যখন নানাতীর্থ ভ্রমণ করে, দ্বারাবতী হয়ে পিণ্ডারক তীর্থে গিয়েছিলেন, তখন তিনি সেখানে ত্রিশুল ও পদ্ম ইত্যাদি চিহ্নাঙ্কিত মুদ্রা বা সীলসমূহ রেখেছিলেন। সেখানে আরও উক্ত হয়েছে যে দ্বারাবতীতে তখন যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকার দরুন নগরে প্রবেশের জন্য এরূপ মুদ্রা অভিজ্ঞান পত্র বা Identity card স্বরূপ ব্যবহৃত হওয়া বলবৎ ছিল। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এগুলো মহেঞ্জোদারোর সীলের অনুরূপ কোনো সীল।

আদি-মহাভারতের কাহিনি যে সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন, হে মতবাদের এ আর এক প্রমাণ।

মহাভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার সমীকরণ করা যেতে পারে কি না, তা বিচারের সুবিধার জন্য এই গ্রন্থে সিন্ধুসভ্যতারও একটা পরিচয় দেওয়া হয়েছে। মহাভারতীয় সভ্যতাকে আমি ভারতের ‘প্রোটো-হিস্টরিক সিইিলজেশন’ বলতে চাই। সে সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল সিন্ধু উপত্যকা থেকে বাংলা দেশ পর্যন্ত আমি আশা রাখি কোনোদিন সেটাই কেউ প্রমাণ করবেন।

ত.

যাঁরা এ সম্বন্ধে অনুশীলনে রত হবেন, তাঁদের সুবিধার জন্য আমি এই গ্রন্থে প্রদত্ত বিশেষ তথ্যগুলো পুনরায় সংক্ষেপে উল্লেখ করছি—

১. আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ বৎসরের মধ্যে বৈদিক-আর্যরা স্থলপথে ভারতে প্রবেশ করে পঞ্চনদের উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল। নৃতাত্ত্বিক লক্ষণের দিক দিয়ে এরা ‘নর্ডিক’ নরগোষ্ঠীর লোক ছিল। দীর্ঘশিরস্কতা (dolichocephaly) এই নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ছিল।

২. বৈদিক-আর্যদের ভারতে আগমনের বহু পূর্বে আর্য ভাষাভাষী আর এক নরগোষ্ঠী জলপথে ভারতে এসে বাংলা তথা প্রাচ্যভারতে কেন্দ্ৰীভূত হয়েছিল। নৃতাত্ত্বিক লক্ষণের দিক দিয়ে এদের ‘আলপীয়’ গোষ্ঠীর লোক বলা হয়। এদের বৈশিষ্ট্য বিস্তৃতশিরস্কতা (brachycephaly)। প্রাচীন সাহিত্যে এদের ‘অসুর’ নামে অভিহিত করা থেকে বুঝতে পারা যায় যে অসুররাও আর্যভাষাভাষী ও পুরাকালীন আর্য সংস্কৃতির বাহক ছিল!

৩. মহাভারতের উপসংহারে বলা হয়েছে যে ‘মহাভারতে ভরতবংশীয়গণের মহৎ জন্মকথা বর্ণিত হয়েছে’। ভরতবংশীয় রাজাদের অভ্যুত্থান পূর্বভারতে হয়েছিল। ভরতবংশীয় রাজারা ঋগ্বেদে বর্ণিত সম্মিলিত দশ রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। পাণিনি ও পতঞ্জলি ভরতদের প্রাচ্যদেশীয় বলে অভিহিত করেছেন। ‘কাশিকা’ টীকা অনুযায়ী পাণিনি উল্লিখিত প্রাচ্যদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পাঞ্চাল, বিদেহ, অঙ্গ ও বঙ্গ। ‘কাশিকা’র এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, মহাভারতের কাহিনি থেকে আমরা অবগত হই যে পঞ্চপাণ্ডব বীরভূমের একচক্রানগরীতে অবস্থানকালে পাঞ্চালরাজার কন্যা দ্রৌপদীকে বিবাহ করেছিল। সুতরাং পাঞ্চালদেশ বীরভূমের একচক্রানগরীরই নিকটবর্তী কোনো রাষ্ট্র হবে! দ্রৌপদী শ্যামাঙ্গী ছিল। এটা প্রাচ্যদেশের মেয়েদেরই বৈশিষ্ট্য। বৈদিক আর্যরা গৌরবর্ণ ছিল। পাণ্ডবরা পাণ্ডুবর্ণ বা ময়লা রং বিশিষ্ট ছিল। এই বৈশিষ্ট্যও পাণ্ডবগণকে প্রাচ্যদেশের সঙ্গেই সংযুক্ত করে। মহাভারতের প্রধান নায়ক শ্রীকৃষ্ণও শ্যামবর্ণ ছিলেন। তিনি যদুবংশভূত ছিলেন। ঋগ্বেদ অনুযায়ী আর্যভাষাভাষী যদুরা সমুদ্রপথে ভারতে এসেছিলেন।

৪. পঞ্চনদের উপত্যকায় থাকাকালীন বৈদিক-আর্যদের সঙ্গে কুরুদের বিশেষ পরিচয় ছিল না। কুরুদের সঙ্গে তখনই তাদের পরিচয় ঘটে, যখন বৈদিক-আর্যরা কুরু-পাঞ্চালদেশে নিজেদের বিস্তৃত করে, অথচ পৌরাণিক বংশতালিকা অনুযায়ী সংবরণ-পুত্র কুরুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল ২৯৯৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।

৫. বৈদিক-আর্যরা গ্রামে বাস করত। সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা নগরে বাস করত। তারা স্থপতিবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। এ সম্পর্কে মহাভারতে উল্লেখিত ময়াসুরের নাম উল্লেখনীয়।

৬. সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের সঙ্গে প্রাচ্যভারতের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচ্যভারতের প্রধান নৃতাত্ত্বিক উপাদান বিস্তৃত- শিরস্কতা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় অন্তসলিলার মতো প্রবাহিত ছিল, ও সিন্ধুসভ্যতার প্রধান বন্দর-নগর লোথালে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। মৎস্য ভক্ষণ ও চাউলের ব্যবহারও তাদের প্রাচ্যভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

৭. সিন্ধুসভ্যতা তাম্রাক্ষ্মসভ্যতা। তাম্রাক্ষ্মসভ্যতার অভ্যুদয় অন্তিম নবপলীয় যুগের শেষে। মহাভারতে বর্ণিত জতুগৃহ নির্মাণ অন্তিম নবপলীয় যুগের কৃষ্টির ইঙ্গিত করে। দ্রৌপদীই প্রথম নারী যে রন্ধনশালায় তাম্রস্থলী ব্যবহার করেছিল। সুতরাং আদি মহাভারত কাহিনি যে অন্তিম নবপলীয় ও তাম্রাক্ষ্মসভ্যতার সন্ধিক্ষণের যুগের, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, তামার ব্যবহার বাংলা দেশেই প্রথম ঘটেছিল।

৮. সিন্ধুসভ্যতার প্রধান দেবতা ছিল পশুপতি শিব। পশুপতি শিবই ছিল পাণ্ডবদের কুলদেবতা। মনে হয় পশুপতি শিবের আরাধনা বাংলা দেশেই উদ্ভূত হয়েছিল। কেননা বাংলা দেশে যত শিবমন্দির দেখা যায়, ভারতের আর কোথাও তা দেখা যায় না। সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে লিঙ্গপূজা ও মাতৃকা-পূজারও প্রচলন ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী পাণ্ডবরা বীরভূমে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মহাভারতে আমরা কালী ও লক্ষ্মী এই দুই মাতৃদেবীর উল্লেখ পাই। এঁরা দুজনেই অবৈদিক দেবতা। এবং এই দুই দেবতার পূজা বাংলা দেশে যেরূপ প্রচলিত, অপর কোথাও তা নয়।

৯. সিন্ধুসভ্যতার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য খোদিত লিপিচিহ্নযুক্ত মুদ্রা বা ‘সীল’। মহাভারতেও আমরা পড়ি যে যুধিষ্ঠির দ্বারাবতীতে এবং দ্বারাবতী থেকে রৈবতক তীর্থে যাওয়ার সময় এরূপ লিপিচিহ্নযুক্ত মুদ্রাসমূহ দেখেছিলেন।

১০. পাণ্ডবগণের বহুপতিক বিবাহের স্মৃতি বর্তমান বাঙালি সমাজের বিবাহ-আচারের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়!

১১. বহুপতিক বিবাহ ছাড়া মহাভারতে বর্ণিত অন্যান্য বিবাহপ্রথা প্রাকবৈদিক যুগের সমাজে প্রচলিত বিবাহ পদ্ধতির ইঙ্গিত করে।

১২. মহাভারতীয় যুগে অনূঢ়া কন্যার যৌন-সংসর্গ ও তাদের সন্তানদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হতো। দেবোত্তর যুগে এ স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। সূত্র গ্রন্থসমূহে কন্যা রজস্বলা হওয়ার পূর্বেই তার বিবাহ দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। (এ সম্পর্কে বর্তমান লেখকের ‘ভারতে বিবাহের ইতিহাস’ দ্ৰ.)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *