যথাযথ মৃত্যু

যথাযথ মৃত্যু

কালটা শীতকাল ছিল এবং সম্ভবত বখের আলী শিরীষ গাছের ঘন অন্ধকারে পুরোনো জীর্ণ রিকশর হাতলে ভর করে স্টেশনের সিঁড়িতে যাত্রী দেখার ইচ্ছায় চোখ কচলাল। স্টেশন অতিক্রম করে রাত দুটোর ট্রেন চলে যাচ্ছে। বখের আলী দেখল, বাবুরা এখন যথাযথভাবে সিঁড়ি ধরে নামছেন। শীতের দুঃসহ ঠাণ্ডা এইসব বাবুদের চোখমুখ বিবর্ণ করছে। আলী এইসব দেখেও গাড়ি ছেড়ে অন্য অনেক প্যাডল্যারের মত সিঁড়ির মুখে ভিড় করল না। সে অত্যন্ত সুচতুর কায়দায় রুগ্ন শরীরকে টান টান করে রাখল এবং রুগ্ন চোখ দুটোকে ভয়ানক সতেজ করতে গিয়ে সামনে গাঢ় অন্ধকার দেখল। সে দেখল, অন্য অনেক প্যাডলার রিকশ ভর্তি লোক নিয়ে ওর মুখের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে তবু সিঁড়ির মুখে আলোর নীচে গিয়ে দাঁড়াল না। অথবা রিকশ টেনে যাত্রীদের সামনে গিয়ে হাজির হল না। বস্তুত বখের আলীর দীর্ঘ জীবন, হাঁপির টান এবং মৃত সাদা চোখ-দুটো যাত্রীদের সন্দিগ্ধ করে তুলবে—সে এমন জানত। সে তাড়াতাড়ি শীর্ণ হাত দুটোকে যথাসম্ভব ছেঁড়া আস্তিনে ঢেকে অন্ধকার থেকেই বড় রুক্ষ অথচ বিনীত ঈর্ষায় ডাকল, আসেন হুজুর আসেন। এ বান্দা হাজির।

বখের আলী যথেষ্ট চেষ্টা সত্বেও কাশির আবেগটুকু সামলাতে পারল না। সে একজন ভদ্র যুবার মুখের উপরই কেশে দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখল, তরতর করে সব যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। ওরা অন্যত্র সরে দাঁড়াল। রিকশ ডাকল। তারপর একে একে স্টেশন খালি করে চলে যেতে থাকল। আলী ভাবল, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। ওকে দেখলে যাত্রীরা বরং পীড়িত বোধ করবে। এইসব ভেবে সে অন্ধকারে নীচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকল। সকল যাত্রীদের দামদস্তুর করতে দেখে অথবা চলে যেতে দেখেও অন্য কোন কথা বলতে পারল না। সে ফের বলল না, এ বান্দা হাজির। নসিবে থাকলে জুটবে—এমত ভাব নিয়ে সে অন্ধকারে মৃত চোখ দুটোকে উজ্জ্বল করে অপেক্ষা করতে থাকল।

রাত দুটোর ট্রেন চলে যাচ্ছে। পিছনের লাল আলোটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশে গেল। অনেকক্ষণ লাল আলোটা এক-চক্ষু ভূত সেজে আলীর চোখের উপর নৃত্য করছিল। ভূতের নৃত্য দেখে সে শীতের তীব্র তীক্ষ্ণ জ্বালাটুকু ভুলে থাকতে চাইল। তবু সে প্রচণ্ড শীতে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। ছেঁড়া গামছা দিয়ে কান দুটো ঢেকে নিয়েও শীতের তীক্ষ্ণতা ভুলতে পারল না। ওর শীর্ণ হাতে তখন শিশির ঝরল। সে শীতে জমে যাচ্ছে। সোয়ারী পেলে, রিকশ টানলে শরীরের এ-ভাব থাকবে না। শরীর গরম হলে রক্ত গরম হবে এবং সে এ শীতেও তখন ঘামবে। অথচ সোয়ারীর দেখা নেই—দূরে গির্জার ঘণ্টা বাজছে। কবরখানার ঝোপে জোনাকি জ্বলছে। শিরীষ গাছে কাঠবেড়াল দুটো পর্যন্ত শীতে কটকট করল। ঠিক এই সময়েই একজন সোয়ারীকে নিঃসঙ্গ স্টেশনে রিকশ খুঁজতে দেখে সে প্রাণপণে ডেকে উঠল, আসেন হুজুর, আসেন। এ বান্দা হাজির। একথা বলার পরও আলী অন্ধকার থেকে নড়ল না। ওর শরীর এবং চোখের রঙ দেখে যদি লোকটা স্টেশনেই থেকে যাওয়ার মতলব করে, যদি বিস্মিত হয় এবং ভয় পায়! সে যথাসম্ভব ভয়ানক হাঁপের টানকে দমন করল। শেষে বলিষ্ঠ যুবার মত ডাকল, আসেন হুজুর লিয়ে যাই। অন্য কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভয়ানক কাশির যন্ত্রণা বুক ঠেলে উঠে আসছে। সে অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য বার দুই বেল বাজাল। রিকশ টেনে উপরে তোলার উদ্দেশ্যে বার দুই হাত পা শক্ত করল।

এই প্রচণ্ড শীতে আলীর, হাত-পা ঠকঠক করছে। সে কোন রকমে রিকশ টেনে উপরে তুলে বলল, চলেন হুজুর লিয়ে যাই।

মহাজন ব্যক্তিটি বৃদ্ধ। চোখ দুটো ছোট ছোট এবং কোটরাগত। যেন দীর্ঘদিনের চুরির অভ্যাস বৃদ্ধের সমস্ত অবয়বে। দামী শাল জড়ানো শরীরে। পা খোঁড়া, হাতে লাঠি! মহাজন মানুষটিকে আলী চেনে যেন। এ শীতেও মহাজন মানুষটি বার দুই লাঠি হাতের উপর ঘোরালেন। এবং আয়েস সহকারে গাড়িতে বসে বললেন, কত দেব বল?

যদিও আলী দেখেছে, বৃদ্ধবাবুটি সেই প্রথম থেকে দর কষাকষি করে বিপর্যস্ত, যদিও বাবুটির নয়া পয়সার হিসাব প্রখর, তবু বখের আলী কথাবার্তায় যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিল। বলল, হুজুর, আপনার সঙ্গে দর করা ভাল দেখায় না। কিন্তু মহাজন ব্যক্তিটি পীড়াপীড়ি করলেন বলে সে বলল, এক টাকা দেবেন। আলী যথার্থ ভাড়ার কথা বলে রিকশর সিটে চেপে বসল।

—কতদিন থেকে লোকের গলা কাটছ?

বখের আলী থামল না।—তবে বার আনা দিন।

কথা আমি একটাই বলি। আট আনা দেব।

শীত এবং রাতের এই কষ্টটুকুর কথা স্মরণ করে আলীর কথা বলার ইচ্ছা হল না। যেন বলার ইচ্ছা হুজুর, যথার্থ দাম থেকে চার আনা কম চেয়েছি, আপনি চার আনা আরও কমিয়ে দিলেন, হুজুর, নসিব মন্দ। তাও সে বলল না। শুধু কাশতে থাকল।

তিনি মুখ র‍্যাপার দিয়ে ঢেকে বললেন, তোমার ভয়ানক কাশি বাপু।

আলী এবারেও কোন জবাব দিল না। আলী চলেছে। সে তার ভাঙা রিকশ নিয়ে, রুগ্ন সোয়ারী নিয়ে চলে যাচ্ছে। দোকানীর ঝাঁপ বন্ধ হল। স্টেশনের শেষ যাত্রীটি চলে যাচ্ছে। রিকশর ক্যাচক্যাচ শব্দ, আলীর কাশি এবং ভাঙা হুডের ছেঁড়া কাপড়ের পতপত শব্দে দোকানী ঝাঁপ ফেলে দিল। বৃদ্ধ মহাজন ব্যক্তিটি গলাবন্ধ কোটের উপর কান, গলা, মাথা ঢেকে বসলেন র‍্যাপার দিয়ে। রাত, অন্ধকার এবং এই নির্জনতা ভাল লাগছে না বলেই যেন একটু কথাবার্তা চালু করলেন। কি নাম তোমার?

শীত বলেই সম্ভবত পথ এত নির্জন। এত নিঃসঙ্গ। ব্যাঙ ডাকছে না। অথবা রাতের বিচিত্র প্রাণীরা। আলীর কাশির শব্দ, রিকশর ক্যাচক্যাচ আওয়াজ এবং বৃদ্ধের কোটরাগত চোখ, আলীর শরীরের রঙ, মুখের রঙ ভয়ানক সব দৃশ্যের অবতারণা করছে। বৃদ্ধ হুডটা তুলে দিলেন এবং এ সময়েই দেখলেন রিকশটা প্রচণ্ড রকমের ঝাঁকুনি খেল। আলী রিকশ থেকে নামছে। আলী কথা বলছে না। সে রিকশর পিছনে গিয়ে নুয়ে পড়ল। সে চেনটা তুলে দিয়ে বলল, হুজুর, আমার নাম বখের আলী।

—চালাতে না চালাতেই হুড পড়ে গেল! চেন পড়ে গেল!

বখের আলী বলল, কিছু ভয় পাবেন না হুজুর। ঠিক পৌঁছে দেব।

বৃদ্ধ বাবুটি গাড়ির স্বল্প আলোতে বখের আলীর চোখ দেখেন। চোখ দুটো ভয়ানক দুঃসহ, বেড়ালের চোখের মত উজ্জ্বল অথচ সহসা চোখ দুটো দেখলে মনে হবে মৃত এবং সাদা এবং নিজের চোখ দুটোর চেয়েও ভয়ানক বীভৎস। তিনি আঁতকে উঠছেন, তিনি বলেছেন, আলী, তুমি ত গাড়োয়ানের মত রিকশ চালাচ্ছ। একটু জলদি না করলে যে চলবে না।

দুধারে কিছু শিরীষ গাছ এবং দেবদারু গাছ। দূরে কলোনীর ইতস্তত আলো। এখনও শহর দূরে। সদর জেলের আলো মাঠ অতিক্রম করে, যুবতী মেয়েদের হোস্টেল অতিক্রম করে অস্পষ্ট। কাপড়ের মিলের শব্দ, কুকুরের শব্দ—দূরে গাড়ির সিটির শব্দ। আলীর শরীর কাঁপছে। আলী রাতের যাত্রী পার করছে। দিনে শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে, ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে বস্তির একপাশে, ছোট্ট চালাঘরটায়—নর্দমার পাশে আলী ছেঁড়া কাঁথার নীচে কাতরায়। ক্ষুতপিপাসায় ডুবে আলী দিনের যাত্রী পেল না। ওর কোটরাগত চোখ, ভয়ানক বুকের ব্যামো দেখে, ভাঙা পুরোনো রিকশ দেখে সোয়ারীরা হাঁটতে থাকল শুধু।

বৃদ্ধবাবুটি বললেন, গাড়ি চালাচ্ছ, না মোট বইছ?

আলী তার শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে গাড়ি টানতে থাকল। তার মনে হয়—সে রুগ্ন ঘোড়ার মত ছুটছে। সে কথা বলল না। অথবা যন্ত্রণায় চিঁহি-চিঁহি করার বাসনাতে সে হাঁ করল না। কয়েকটা দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করার বাসনাতে মুখটা বড় করতে গিয়ে দেখল, বাবুটির গোয়ার্তুমি কমছে না। সে অন্যদিনের মত রিকশার গতি কমিয়ে দিল এবং সোয়ারীকে অন্যমনস্ক করার জন্য সে তার কিস্যা আরম্ভ করল। দুনিয়া বহুত পালটে গেল হুজুর।

—এখন ত তোমাদেরই রাজত্ব গো। দুনিয়া পালটে গিয়ে তোমাদেরই সুখ। তোমরা যখন-তখন লোকের গলা কাটছ। বৃদ্ধ বাবুটির মনে অন্য দুর্মুখ রিকশওয়ালার মুখের ছবি। বিশেষত দুর্মুখ কথাবার্তা স্পষ্ট উঁকি দিতেই দুঃসহ অপমান বোধে জ্বলতে থাকলেন তিনি।

—জনগণের রাজত্ব। তোমাদের কি এখন কিছু বলবার জো আছে!

আলী ঘটনাটা দেখেছিল বলেই এখন আর কিস্যার কথাগুলো আবৃত্তি করল না। সে বলল, হুজুর, টগবগ করে রক্ত ফুটছে ত ফুটছেই। কাকে কি বলতে হয় ও শালা কি করে জানবে। তা ছোটলোকের কথা মনে রাখবেন না, হুজুর।

এখন প্রায় গাড়ি চলছে না বললেই হয়। আলী এইসব বলে কিছুক্ষণ বিশ্রামের আয়োজন করল যেন।

—তুমিও যেমন! ছোটলোকের কথা মনে রাখার আমার দায় পড়েছে।

—হুজুরকে টাকার গরম দেখাস!

—ওসব কথা থাক বাছা।

—আপনার মত নসীব ক’জনের হয়।

—ওসব কথাও থাক বাছা। টাকার গরম দেখালে টাকা থাকে না। মা লক্ষ্মী রাগ করেন। যেন বলার ইচ্ছা বাবুটির আমি ত বড় হয়েছি ছোট থেকেই। কাঁধে কাপড় নিয়ে ঘরে ঘরে বিক্রি করেছি, হকারি করেছি, তা বলে ত লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি।

আলী রিকশ থেকে ফের নামল। চেনটা আবার পড়ে গেছে। বৃদ্ধ বাবুটি বিরক্ত হবার মুখে হিসাব করলেন—বাড়ি ভাড়া সুদের টাকা এবং সেলস ট্যাক্সের বড়বাবুকে তিনশ….। আয়কর ফাঁকির জন্য বিদ্যালয়ে বিশ হাজার….পরম দানশীল ব্যক্তি অথবা হাল আমলের শহীদ হওয়ার জন্য জেলা সমাহর্তাকে সভাপতি করে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা এবং এবারের জন্যও কিছু কিছু হোলসেল ডিলারসিপ। তিনি এ সময় মুখের রেখাতে আত্মপ্রসাদের ভঙ্গী টানলেন। তারপর বগলের নীচে টিপে টিপে কি যেন দেখলেন। কি যেন লক্ষ টাকার জিনিস বগলের নীচে লুকিয়ে রেখেছেন। অন্ধকার পথটুকু এইজন্য বাবুটির কাছে এখন ভাল লাগছে। বখের আলীর রিকশ চলছিল কি থেমেছিল বোঝা যাচ্ছিল না। দুদিকের মাঠ থেকে শীতের ঠাণ্ডা শুধু বরফের কুচির মত ওদের দুজনকে স্পর্শ করছে।

—বুঝলে বখের আলী, সময় আর নসিবকে ফাঁকি দিলে তারাও তোমাকে ফাঁকি দেবে। তিনি উপদেশের ভঙ্গীতে কথাগুলো বললেন, বুঝলে বখের আলী, সময় আর নসিব, কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। তোমার রিকশটা এমন উঠছে পড়ছে হে কেন বাছা! ঠিকমত চালাতে না পারলে নিলে কেন?

—হুজুর পথটাই খারাপ। তারপরও যেন ওর বলার ইচ্ছা, দেশে সকলে চুরি করতে আরম্ভ করেছে হুজুর। বাবু মানুষেরা বেশী চুরি করছে। এতগুলো কথা বললে সে অনেকক্ষণ বড় বড় শ্বাস নেবে। সে শুধু বলল, সকলে চুরি করছে হুজুর। দু সালে পথটা ভেঙে গেল।

বাবুটিরও যেন বলার ইচ্ছা, যে চুরি করছে সেও সুখী, যার চুরি করছে সেও সুখী। এক হাতে নিচ্ছে, অন্য হাতে দিচ্ছে। কোন হিসাব নেই। লাগে টাকা দেবে ….। এখন আর গৌরীসেনদের টাকা দিতে হচ্ছে না। গৌরীসেনরা শুধু সেলস ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে মরছে। এতগুলো কথা তিনি ইচ্ছে করেই আলীর সঙ্গে বলেননি। ছোটলোকদের সঙ্গে বেশী দহরম ভাল নয় এমন একটি ভাব নিয়ে বসে থাকলেন। এবং সহসা যেন দেখলেন, গাড়িটা একেবারেই চলছে না। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, চালাও চালাও। বড় আস্তে চালাচ্ছ। তুমি দেখছি আমাকে পৌঁছতে ভোর করবে। এবং এ সময়ে রিকশর চেনটা পড়ে গেল। আলী বুঝল,বাবুর বিরক্তি ভয়ানক রকমের। সে তার কিস্যা আরম্ভ করল, জাফর আলী বখের আলী তফাত কত হুজুর! সব নামটা ত আপনাকে বলিনি! বললে এ গাড়িতেই চড়তে সাহস পেতেন না। মীর্জা জাফর আলীর নাম শুনেছেন! বইয়ে ওঁর নাম লেখা আছে। সে ভক্তিতে গদগদ হল।

বাবুটি উদাসীন। যেন এমন নাম তিনি এই প্রথম শুনলেন। বললেন, অঃ। মীর্জা জাফর আলী।

—হাঁ হুজুর সহজ কথা ভেবে লিবেন না। নাম আমার মীর্জা বখের আলী। কিন্তু কি করি বলেন। সরকারী নজরানা আমাদের বাড়ছে না। নানাজী পেত একশ এক রূপেয়া। তার দশ ছেলে দশ টাকা। বাপজীর দশ। ফের বাপজীর পাঁচ। তবে বুঝতে পারছেন, এ হারামের নসিবে দুই। বখের আলী এতগুলো কথা বলে হাঁপাতে থাকল।

—বছরে দুই।

—জী হুজুর। সেদিন তকমা এঁটে, লবাবী টুপি পরে শেরওয়ানী গায়ে ঝুলিয়ে, মুখসীপাতি জর্দা মুখে হাসতে হাসতে এস ডি ও অফিসে চলে যাই। সেদিন বাবুরা দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাবে। আমি একটু হাসব বাবু।

—শুধু গল্পই করবে! রিকশ চালাবে না!

আলী নক্ষত্র দেখল এবং আকাশ দেখল। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশতই সে যেন এখনও রিকশ টানতে পারছে। এখনও বেঁচে আছে। বাবুকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবার কর্তব্যবোধে ফের শক্তিসঞ্চয় করতে পারছে। সে বলল, দেখেন একটানে এবার লিয়ে যাচ্ছি। বলে সে হ্যাণ্ডেলের উপর নুয়ে পড়ল।

গির্জা অতিক্রম করে ইতস্তত করবী গাছের ছায়ায়, অর্জুন গাছের নীচে অথবা ভাঙা পথটার উপর আলীর কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ছাতিম গাছ দুটো অতিক্রম করার সময় ওর মনে হল সেই যুবক যুবতীকে। গতকাল এই ছাতিমের ডালে ওরা ঝুলেছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আলীর রিকশ আলো ফের ভূতুড়ে হয়ে গেছে। আলী এখানে একটু থামল। প্রতিদিনের মত সে চোখ তুলে দূরের মাঠ দেখল, অন্ধকার মাঠ অতিক্রম করে সাহেবদের কবরখানা দেখল। কবরের ঝোপে ঝোপে তেমনি সব জোনাকি পোকারা জ্বলছে। উড়ছে অথবা হেস্টিংসের প্রিয়তম কন্যার অবয়ব ধরে দূরের মাঠে পাশাপাশি খালের ধারে উড়ে উড়ে শীতের মাঠকে প্রত্যক্ষ করছে। এবং হাওয়া খাওয়ার নাম করে আলীর নিত্য পথ পরিক্রমা দেখছে। অথচ আলীর ফুসফুস হাওয়া টানতে পারছে না, সাদা মৃত চোখ দুটো শীতে নীল নীল হয়ে উঠছে। দূরের মাঠে ঝাউগাছ, শহরের আলো, পাশাপাশি কোথাও সান্ত্রীর বুটের শব্দ আলীকে অন্যদিনের মত শক্ত সতেজ করতে পারল না। তথাপি অন্যদিনের মত সেইসব শব্দের মধ্যে ডুবে যেতে পারল বলে খুশী হল। পলাশীর প্রান্তর থেকে জাফর আলী পালাচ্ছে। ঘোড়সোয়ার সৈন্যেরা পালাচ্ছে। হেস্টিংসের প্রিয়তমা কন্যা জোনাকির অবয়বে জ্বলছে নিবছে। ঘোড়সোয়ার সৈন্যগণ বর্শা অথবা কিরিচ নিক্ষেপ করে শীতের মাঠকে শিহরিত করে তুলল। সে এইসব দেখল। আলী প্রতিদিনের মত এখানে এসে সহসা গাড়ি থামিয়ে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে থাকল।

বুদ্ধ বাবুটি বললেন, এসব, হচ্ছে কি!

আলী বলল, জিনিসপত্রের দাম চড়ছে অথচ সরকার কিছু দেখছে না হুজুর। রিকশর আলোটা নিবে গিয়েছিল বলে সে নেবে পড়ল এবং ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে বাবুটিকে যেন ভুলিয়ে রাখতে চাইল।

ইচ্ছা করেই আলী আলো জ্বালাতে দেরি করছে।

এই অন্ধকারে তিনি নিঃসঙ্গ। এবং এই প্রেতাত্মার মত লোকটির উপস্থিতি ও উপরে ছাতিম গাছের ডালে ডালে পাতার আওয়াজ, নির্জন প্রান্তরে কবরের আলো বৃদ্ধ বাবুটিকে বার কয়েক প্রচণ্ড রকমের নাড়া দিল। আলী কি জানতে পেরেছে সব! সে কি নতুন ব্যবসাটার কথাও জানতে পেরেছে। বাবুটির কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকল। তিনি বগলের নীচে অন্ধকারে টিপে টিপে দেখলেন। তারপর তিনি ফের ধমক লাগালেন, বখের আলী, আলো জ্বালতে কত সময় নেবে! এমন করলে আমি কিন্তু পুলিস ডাকব।

—হুজুর বড় ভয় পেয়ে লিচ্ছেন। দূরে সিপাই-এর বুটের শব্দ আসছে না। এখানে চোর-বাটপাড়ের ভয় নেই হুজুর। বখের আলী এই বলে দাঁড়িয়ে থাকল।—হুজুর এই ছাতিম গাছে গতকাল দুজন মাগী-মরদ ঝুলেছে! (আলী মরার ইচ্ছায় কতবার কত ছাতিমের ডালে বিশমিল্লা বলে ঝুলে পড়বার জন্য প্রাণপাত করেছে… অথচ—অথচ…) মেয়েটার শরীরে কত গহনা ছিল। পথে এতলোক যে আমরা এই পথে গাড়িই চালাতে পারিনি। কিছুই হয়নি বলে হুজুর ভুখা আছি। গতর দিচ্ছে না হুজুর। তবে ভয়ে পাবেন না, ঠিক পৌঁছে দেব।

—কি বলছ! আমি ভয় পাব! তুমি এমন কথা ফের বলবে না। তবে যথার্থই তোমাকে পুলিসে দেব। আজকাল এটা হল কি! সবাই ফোঁস করতে শিখেছে। কি কাণ্ড সব! কেবল পুলিসগুলোই দিন দিন ভদ্র হয়ে উঠছে। পাঁচেও খুশী, পাঁচ হাজারেও খুশী।

আলী আলো জ্বেলে সিটে চেপে বসল। ওর পা দুটো ভেঙে আসছে। হাত দুটোর ভিতরে কোন উত্তাপ নেই যেন। রক্ত সমস্ত শরীরে কোন উত্তাপ সঞ্চার করতে পারবে না। ভাঙা আরশিতে মুখ ও শরীর দেখে ভাবত, এমন একটা শরীর দীর্ঘদিন বাঁচে কি করে! দীর্ঘদিন বাঁচার পথকে অতিক্রম করছে কি করে। অথচ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার অভ্যাস ওকে কোনদিনের জন্য মরতে দিল না। অথবা এমন কোন ঘটনাই ঘটল না। সেজন্য শরীর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, রক্ত উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারছে না জেনেও নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আলী কোন সন্দেহ লালন করতে পারল না। শুধু বুক স্পর্শ করে অসহায় ভঙ্গীতে ফের সে নক্ষত্র দেখল এবং আকাশ দেখল।

আলী রিকশ টেনে যাচ্ছে। ওরা পরস্পর এখন কথা বলছে না। আলী কথা বলতে পারছে না। গলাটা শুকনো কাঠ। ওর জলতেষ্টা পাচ্ছে। চোখ দুটো চিংড়ি মাছের মত গোল গোল, চিংড়ি মাছের মত বের হয়ে চোখের পাশে যেন ঝুলে পড়বে। হ্যাণ্ডেলের উপর হাতের আঙুলগুলো শীর্ণ—সে টানতে পারছে না। পারছে না। এখন বাবুটি জোরে চালাবার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে, পাশাপাশি কোথাও গাছের পোকা ফরফর করে উঠল এবং সে দেখল টায়ারটা অদ্ভুত রকমের জীর্ণ শব্দ করে ফেঁসে গেছে। কপালে করাঘাত করার ইচ্ছায় ডান হাত তুলে পরীক্ষা করতে বুঝল—বৃথা। হাতটা তুলে এনে কপালে করাঘাত করার শেষ সামর্থ্যটুকুও যেন শেষ। সে নীচে কোন রকমে গড়িয়ে নামল।

বৃদ্ধবাবুটি চিৎকার করে উঠলেন, তোমাকে আমি শূলে চড়াব।

—হু-জু-র!

—আমি নামতে পারব না বাপু। হেঁটে যেতে পারব না।

—হু-জু-র হাঁটতে হবে না। ঠিক পৌঁছে দেব। দম ফেলবার ফুরসত চাই হুজুর।

—তুমি এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে বখের আলী?

—হুজুর, হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। পায়ে ঘা। আমি পৌঁছে দিচ্ছি হুজুর।

—এমন করলে আমি তোমাকে এক পয়সাও ছোঁয়াব না।

বাবুকে অন্যমনস্ক করার জন্য সে পুনরাবৃত্তি করল, একটা কিস্যা শোনবেন?

ভিতরে ভিতরে বাবুটি এতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন যে পারলে তিনি আলীর গলা টিপে ধরেন। পারলে তিনি আলীকে খুন করেন। আলী মশকরা করছে। আলী ফের কাশতে থাকল। রাতের শেষ ট্রেনের শব্দ আরা শোনা যাচ্ছে না। শুধু কাপড়ের মিল থেকে এখনও শব্দটা ভেসে আসছে। এ তল্লাটে কোন কুকুর পর্যন্ত নেই। কোন পাখি অথবা কাঠবিড়ালীর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না! বখের আলীর বুকের শব্দ এবং গলার ঘরঘর শব্দ বৃদ্ধ বাবুটিকে অবসন্ন করছে। অশেষ যন্ত্রণার মত রুগ্ন কণ্ঠে বললেন, আলী, তোমাকে আমি এক টাকাই দেব। তুমি নিয়ে চল। লোকের আমি কত উপকার করেছি, তুমি আমার এ উপকারটুকু কর।

আলী হ্যাণ্ডেলের উপর মাথা রেখে বলল, একটু সবুর করেন হজুর। ততক্ষণে কিস্যাটা বলি, আমার হাঁপের টানটা কমুক। আলী গল্প আরম্ভ করল। ওর এটাও একটা অভ্যাস। সোয়ারী নিয়ে যখন সে টানতে পারেনি, যখন সে অবসন্ন হয়ে পড়েছে তখন এই মসনদের গল্প বলেছে। সে কত সোয়ারীকে এই মসনদের গল্প শোনাল। সে নিজের মসনদে চেপে সোয়ারীকে গল্প শোনাল কতবার। কতবার বলল, হুজুর, এ মসনদের আখের খারাপ। মুর্শিদকুলী খাঁ বলেন, আলিবর্দি বলেন, সিরাজ বলেন কেউ ত থাকল না হুজুর। ব্যাভারটাই থাকে। হে হে করে এ সময়ে বখের আলী কাশল কি হাসল তিনি ধরতে না পারায় হাতের টর্চ জ্বেলে মুখ দেখেই আঁতকে উঠলেন—আলীর মুখে রক্ত, চোখ দুটো সাদা এবং মৃত মানুষের মত মুখ করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।

—এই! এই! বৃদ্ধ বাবুটি চিৎকার করে উঠলেন।

—হুজুর, এমন করলে কিন্তু রিকশ ফেলে চলে যাব।

রাস্তার দুপাশে কিছু বাঁশের বন। তারপর শহরের প্রথম আলো। শহরের প্রথম ল্যাম্পপোস্ট। বাঁশবনে বাদুড় নেই। অন্ধকারের মত, বাদুড়েরাও যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। শীতকাল বলেই হোক অথবা রাতের গভীরতার জন্যেই হোক দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোর উত্তাপ ওদের টেনে নিতে সক্ষম হবে না। বৃদ্ধ বাবুটি বললেন, যাক, তবু শহরে উঠে যেতে পারছি।

আলী কোন জবাব দিল না। বৃদ্ধ বাবুটির ইচ্ছা হল লাঠি দিয়ে একবার আলীকে খোঁচা দিতে। লোকটা রিকশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ত, না, যাবার ভান করে শুধু হেলে শরীরকে টান করে রিকশ টানার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। না, লোকটা বাজ-পড়া মৃতের মত দাঁড়িয়ে অন্ধকারকে তামাশা দেখাচ্ছে। তিনি লাঠিটা কাছে নিয়েও খোঁচা দিতে সাহস করলেন না। আলী যদি সেই চোখ নিয়ে ফের তাকায়, যদি বলে, থাকল সব—আমি চললাম হুজুর…সুতরাং সুতরাং…। তিনি প্রিয়-জনের মত কণ্ঠ করে বললেন, এ ঠাণ্ডায় এমন ছেঁড়া কোট গায়ে দিয়ে স্টেশনে আসা উচিত হয়নি। বুঝলে বখের আলী, বখের আলী, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি গল্প করছ না কেন বখের আলী!…আলী!…আলী!

সহসা আলী ধনুষ্টঙ্কারের রুগীর মত বেঁকে গেল এবং সহসাই বাবুটির মুখের উপর উপুড় হয়ে বলল, সে সব নবাবী আমলের কিস্যা আপনার কি ভাল লাগবে হুজুর!

বৃদ্ধ বাবুটি যখন দেখল, আলী বাজপড়া মৃত মানুষ অথবা বখের আলী সত্যি রিকশ টানার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ছিল না এবং বস্তুত বখের আলী যখন জীবিতই আছে তখন গল্প না শুনে যতটা সম্ভব শীঘ্র নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানো দরকার। তিনি বলেন, অত প্রাচীন গল্প কি হাল আমলে ভাল লাগবে?

—সে ভাল না লাগারই কথা। কিন্তু হুজুর, ঘুলঘুলি দিয়ে নবাব যা দেখলেন, আমরা কটা লোক তা দেখতে পেলাম।

—কি দেখলেন! কি দেখলেন। তখন সোনা পাচার হত! বৃদ্ধ বাবুটি ইচ্ছাকৃত অন্যমনস্কতায় বললেন, যাক, আমরা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এসে পৌঁছে গেলাম।

—আমি বলেছি হুজুর আপনার কোনও ভয় নেই। ঠিক পৌঁছে দেব। নবাব ঘুলঘুলি দিয়ে দেখলেন; লোকটা রোজ গঙ্গায় মাছ ধরতে আসে।

বৃদ্ধ বাবুটি ফোড়ন কাটলেন, নবাবের বুঝি কোন কাজ ছিল না?

—ছিল হুজুর। কাজও করত, ঘুলিঘুলি দিয়ে মাছ ধরাও দেখত।

কথা বলতে যত কষ্টই হোক তখন যেন শরীরের কষ্ট থাকে না আলীর। আলী তার শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে হেঁটে হেঁটে রিকশ টেনে চলেছে। একটি ল্যাম্পপোস্ট, দুটি ল্যাম্পপোস্ট সে পার হল। সে একবার সার্কাস পার্টিতে সিংহ দেখেছিল। আলোগুলো অন্ধকারে সিংহের চোখের মত জ্বলছে। সে বলল, হুজুর, আপনি সিংহের ডাক শুনেছেন?

—আলী, তুমি ভয়ানক কথা বলতে পার।

—এ শীতে একটা বিড়ি খেতে পারলে বড় ভাল হত হুজুর।

বৃদ্ধ বাবুটি পকেট থেকে আল্গা করে বিড়ি এবং দেশলাই দিলেন। আলী বিড়ি ধরাল। হ্যাণ্ডেলের উপর ভর করে বিড়িটা পরম নির্ভরতার সঙ্গে টেনে সদর জেলের পাঁচিল দেখল। পাঁচিলটার ভিতরের দিনগুলো ওর সবচেয়ে সুখের ছিল এমন ভাবল। শেষে বড়বাড়ির বাগানের কেয়া ফুলের গন্ধ নেওয়ার সময় দেখল বড় বাড়ির একটি জানালা খুলে গেছে। জানালায় যুবতীর মুখ। জানালার আলো নীচে গড়িয়ে নামছে। সেই আলো ধরে একজন যুবক তরতর করে উপরে উঠে কার্নিশ ধরে ঘরে ঢুকে গেল।

বিড়িটা খাওয়াতে আলীর মনে হল সে আরও একশ বছর বাঁচবে। সে বলল, হুজুর এবার আপনাকে ইস্কুলে নামিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব।

বাস্তবিক পক্ষে আলী কোথাও থামেনি। একটি বিড়ি শীতের ঠাণ্ডায় যথার্থই তাকে একশ বছরের পরমায়ু দিয়েছিল। সারাদিন পর এই বিড়ির ধোঁয়া ওর সমস্ত রক্তে ফের বেঁচে থাকার প্রাণপণ ইচ্ছার ধুনুচি জ্বালিয়ে ওকে পাগলা ঘোড়ার মত কদম দিতে সাহায্য করছে। সে হাঁটছে, হাঁটছে। বৃদ্ধ বাবুটি শরীর ঢেকে বসে আছেন। শহরের আলো, ইতস্তত অন্ধকার পার্ক-ময়দান পার হয়ে তিনি চলছেন। চলছেন। আকাশের হাজার নক্ষত্রের আলোতেও তিনি লক্ষ টাকার হিসাবের ভিতর এক পয়সার গরমিলের দুঃখ ভুলতে পারলেন না।

বখের আলী তখন তার কিস্যা শেষ করল।

[আলীর কিস্সা খুবই অস্পষ্ট। আলীর মুখে রক্তের কস। সে কাশতে কাশতেও শেষ পর্যন্ত গল্পটা করছিল। বৃদ্ধ বাবুটি শুনছিলেন। শোনার স্পৃহা না থাকলেও যেন শুনছিলেন। আলীর অস্পষ্ট কথার ভিতর থেকে তিনি অর্থ উদ্ধার করেছিলেন : লোকটা রোজ মাছ ধরতে আসত, অথচ কোনদিন বঁড়শিতে খোট দেবার প্রয়োজন মনে করত না। ঘুলঘুলি দিয়ে নবাব রোজ দেখেন আর ভাবেন। একদিন অবশেষে নবাব পাত্রমিত্রসহ নদীর পারে এসে দাঁড়ালেন। সেদিনই সে প্রথম খোট দিয়েছিল এবং নবাবের পাগড়িটা বঁড়শিতে তুলে এনেছিল। এমত অপমানে নবাব গর্দান নিলেন লোকটির এবং ওর গৃহে গিয়ে দেখলেন স্ত্রী সুন্দরী, স্ত্রী পাথর খোদাই করে সব রমণীয় মূর্তি তৈরী করেছে। রমণীয় পসরা খুলেছে। নবারের আদেশে সুন্দরী স্ত্রী নবাবের মসনদ তৈরির জন্য নিযুক্ত হল। মসনদের সৌন্দর্যে নবাব বিমুগ্ধ এবং উত্তেজিত। রমণীর শিল্পসত্তা নবাবকে গ্রাস করল। অভিষেকের বাৎসরিকে তিনি রমণীর ঘরে শয়ন করার বাসনা জানালেন। সে রাতে হতভাগ্য রমণী আত্মহত্যা করল। তারপর কত নবাব এল গেল। মসনদের আখের একটা দুঃস্বপ্ন।]

 যেন সে শেষ কয়েকটি কথায় বলতে চেয়েছিল : দুঃস্বপ্নের অংশীদার বস্তুত সে নিজেও।

বৃদ্ধবাবুটি দেখলেন, আলী হ্যাণ্ডেলের উপর পড়ে কাশছে। দম নিতে ফুরসত পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে পঞ্চাশটি নয়া পয়সা ওর হাতে গুঁজে দিলেন। আলী উঠে একবার দেখল না। আলী ধীরে ধীরে হ্যাণ্ডেলের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। সে সামনে গাঢ় অন্ধকার দেখছে অনেক দিনের মত। অনেক দিনের মত সেরেও যাবে এমন ভেবে গামছা দিয়ে ঠোটের কস গড়ানো রক্ত মুছতে চাইল। অথচ হাতটাকে টেনে আনতে পারল না। আকাশ সমস্ত শরীরে বরফের কুচি ঢেলে দিচ্ছে যেন। সে শেষবারের মত আন্তরিক স্পৃহাতে শরীরকে শক্ত করার জন্য মাথা তুলতে গিয়ে দেখল, ঘাড়েও কোন শক্তি নেই। বৃদ্ধবাবুটি লাঠিতে ভর দিয়ে চলে যাচ্ছেন। নির্জন নিঃসঙ্গ পথে লাঠির শব্দ ঠ্যাঙাড়ে দস্যুদের রাহাজানি শেষে অন্ধকারে মিশে যাওয়ার মত। সে দূরে তিনটে ঘণ্টা পেটার শব্দ শুনল! সদর জেলে ঘণ্টি পড়ছে। সে ক্রমশ হ্যাণ্ডেলের দুপাশে ঝুলে পড়তে থাকল।

 যে পথ ধরে জাফর আলী পলাশীর প্রান্তর থেকে সৈন্য নিয়ে ফিরে গিয়েছিল দীর্ঘদিন পর সেই পথে আলী ঘুমিয়ে পড়ল।

তখন বৃদ্ধবাবুটি ফের এই পথে ফিরে আসছেন। আট আনা পয়সার পরিবর্তে একটা টাকা দিয়ে ফেলেছেন এই সন্দেহে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রায় দৌড় দেওয়ার মত করে তিনি ফিরে আসছেন। তিনি ডাকছিলেন আলী, আলী—কিন্তু কাছে এসে দেখলেন আলী পূর্বের মতই হ্যাণ্ডেলে ঝুলে আছে। তিনি এবার যথার্থই লাঠি দিয়ে খোঁচা দিলেন এবং যখন দেখলেন, লোকটা শীতে জমে গেছে তখন কর্তব্যনিষ্ঠ অর্থবিদের মত সব পয়সাকটা তুলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্ধকারে মিশে গেলেন। এবং তিনিও যেন আজ শুনতে পেলেন একদল ঘোড়াসোয়ার সৈনিক এইমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেইমানি করে এই পথ ধরেই ফিরে চলেছে। ঘোড়ার পায়ের শব্দে আলীর দেহটা কাঁপছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *