জীবন-সত্য

জীবন-সত্য

সমর ভগ্নিপতির চিঠি পেয়ে চলে এসেছে। চিঠিটি এ-রকমের—বাড়ির সম্পত্তি যেটা এতদিন অনুমতি-দখল বলে রেকর্ডভুক্ত ছিল তা আপনাদের নামে নামে করে নিতে হবে। প্রত্যেকের নামে রেকর্ড হবে। এর জন্য তিন ধারার ফর্ম ফিল-আপ করে ক্যাম্প অফিসে জমা দিতে হবে। এতে অনেক ঝামেলা—তা ছাড়া বাড়ির একটা দাগ নিয়ে গণ্ডগোল ধরা পড়েছে। বিয়াল্লিশ শতক জমির কোনো কাগজপত্র নেই। কাগজ বের করার চেষ্টা করছি—দেখা যাক কী হয়! এ-সব কারণে আপনাদের সবার বাড়ি আসা দরকার। তিন তারিখের মধ্যে ফর্ম জমা দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক দিনের জন্য হলেও আসবেন। আপনি না এলে সব কাজ বন্ধ হয়ে থাকবে। যেটা এখন সহজে হবে তারিখ পার হয়ে গেলে কোর্টে আপিল করতে হবে।

ট্রেন লেট। স্টেশনে নেমে সে ঘড়ি দেখল—সোয়া আটটা বাজে। বাড়ি যেতে ন’টা বেজে যাবে। স্টেশন থেকে রিকশায় চেপে প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ। গতকাল বড়দা সকালে তার কলকাতার বাড়িতে হাত-চিঠিটি দিয়ে গেছে। সে বাড়ি ছিল না। দেখা হলে জেনে নিতে পারত বড়দা কবে যাবে। হাতে আরও আট দশদিন সময় থাকা সত্বেও সমর দেরি করতে পারেনি। তাকে নিয়েই সবার বেশি চিন্তা। সময় করে শেষ পর্যন্ত সে একদিনের জন্য হলেও বাড়ি যেতে পারবে কি না! সে না গেলে কিছু হবেও না। মার দুশ্চিন্তা বাড়বে। সবারই কম বেশি তাকে নিয়ে অভিযোগ আছে। মায়ের সব চেয়ে বেশি।

সমর রিকশায় বসে এ-সব ভাবছিল। জ্যোৎস্না রাত। রাস্তার দু-পাশে গভীর বন-জঙ্গল এখনও ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। আগে ছিল একেবারে নির্জন। বেশি রাতে একা এই রাস্তায় যেতে গা ছম ছম করত। এখন এখানে সেখানে ঘর বাড়ি, হিমঘর, শহরের কাছাকাছি জায়গা বলে, মানুষজন এদিকটায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ঠিক সাঁইত্রিশ বছর আগে এই রাস্তাটা সে প্রথম আবিষ্কার করেছিল—বাবা জেঠা কাকার সঙ্গে। শহরের জেলখানার পাঁচিল পার হয়ে, পঞ্চাননতলা পার হয়ে লাল সড়ক চলে গেছে লালবাগের দিকে। খোয়ার লাল রাস্তা। ধূলো উড়ত। গরুর গাড়ি সার বেঁধে চলত। সাঁইত্রিশ বছর। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। তার শরীরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সব কিছুই বদলে গেল। রাস্তা পাকা হয়েছে। ট্রাক বাস চলাচল বেড়েছে। সেই নির্জনতা হারিয়ে গেছে। মায়া-মমতা স্নেহ ভালোবাসারও ঠিকানা বদল হয়েছে।

তবু এই রাস্তা কেন যে অমোঘ নিয়তির মতো তাকে টানে! দু-পাশের বিশাল সব শিরীষ গাছগুলির কিছু আছে কিছু নেই। দু-পাশে সরকার থেকে লাগানো কোথাও ইউক্যালিপটাস গাছ সাদা রঙের। জ্যোৎস্না রাতে রিকশায় যেতে বড় মায়াবী মনে হয় চারপাশের সব কিছু। যেন সে তার কৈশোরকাল এই রাস্তায় ফেলে গেছে। পৃথিবীর কত দেশে সে একসময় ঘুরে বেড়িয়েছে, কত সব বর্ণময় দ্বীপ সে দেখেছে, আফ্রিকার জঙ্গলে তার রাত্রিবাসও ঘটেছে অথচ এমন নির্জন কৈশোরের রাস্তা সে কোথাও আর আবিষ্কার করতে পারেনি। এই রাস্তাটায় এলেই সে ভারি মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সব কিছু ভুলে যেতে ইচ্ছে হয়। যেন এক কিশোর কোনো মাঠের প্রান্তভাগ থেকে হেঁকে ওঠে, তুমি ভাল আছ সমু?

ভাল নেই। সে জানে ভাল নেই। না বলে, বাবা গত হবার দশ বছরের মধ্যে ভগ্নিপতির এই চিঠি পেত না। বন-জঙ্গলের মধ্যে বাবা জেঠা কাকাদের বাড়ি ঘর বানানোর কথা এখন মনে পড়ত না। রাজার পতিত বনজঙ্গল জলের দরে কেনা। মাত্র পাঁচশ টাকায়, এক লপ্তে কুড়ি বিঘার এক বনভূমি কিনে জঙ্গল সাফ করা, বাঁশের গুঁড়ি ওপড়ানো কোদাল মেরে, সে কী দিন গেছে! ছিন্নমূল হবার পর থিতু হয়ে বসার মতো জায়গা পেয়ে বেঁচে থাকার জন্য আরও কিছু দরকার তাঁরা ভুলেই গেছিলেন। ভাগে তিন বিঘে করে জমি, ঠাকুরের নামে বিঘে দুই-জমির বন্দোবস্ত এ-ভাবেই ঠিকঠাক করে নিয়েছিলেন তাঁরা। বাবা কাকারা ছাপড়া ঘর বানিয়ে যে যার মতো সংসার পেতেছিলেন। দেশের একান্নবর্তী সংসার ছিন্নমূল হবার পর ভেঙ্গে গেল। তখন তার কান্না পেত—একসঙ্গে লম্বা রান্নাঘরে আর পাত পড়ে না। সব খুড়তুতো জেঠতুতো ভাই-বোনেরা আলাদা পাতে খায়।

মানুষের ভিতর একটা আলাদা কষ্ট থাকে। যা গভীর এবং গোপন। সেই থেকে টের পেত সে, কষ্টটা তাকেও আলাদা করে দিচ্ছে। নিরুপায় বাবার মুখ দেখলে সে এটা আরও বেশি টের পেত। দেশ থেকে আনা সামান্য টাকা পয়সা শেষ হতে ছ’মাসও সময় লাগল না। ঘরে খাবার না থাকলে মা আঁচল পেতে মাটিতে শুয়ে থাকতেন। বাবা তখন ঘরে থাকতেন না। রোজ পোস্টাপিসে যেতেন এক ক্রোশ রাস্তা হেঁটে, যদি তাঁর বড় পুত্র কিছু টাকা পাঠায়। বড় পুত্র রেলে কাজ পেয়েছে জানিয়েছে। জীবনের দুঃসময়ে বাবার কাছে এ বড় সুখবর ছিল। সকাল হলেই রোজ হাঁটা দিতেন পোস্টাপিসের দিকে। বাবা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে লিখতেন, তোমার কটি টাকা আমাদের সবার প্রাণ রক্ষা করতে পারে। সমু পাশ করলে আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। ও একটা চাকরি পেয়ে যাবে আশা করছি। অভাবের তাড়নায় তারও মাথার ঠিক নেই। হাতের কাছে যা পাচ্ছে, তাই ধরছে। পড়াশোনা বন্ধ হবার যোগাড়।

দাদা টাকা পাঠাত না। তবে চিঠি দিত। তার শরীর ভাল না। অস্থানে কুস্থানে খেয়ে পেটের পীড়ায় কষ্ট পাচ্ছে। বাবা কী বুঝে মাকে বললেন, তোমার পুত্রটির বিবাহের চেষ্টা করা দরকার। পেটের পীড়ায় কষ্ট পাচ্ছে ভেবে মন খারাপ কর না। বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিয়ে দাদা নিজেই করে ফিরেছিল। মাসখানেক বাড়িতে থাকার সময় বাবার হাতে কিছু টাকাও দিয়েছিল। বাবার সংসারের চেয়ে তার নিজের সংসারের দায়িত্ব কতখানি, বাবাকে আভাসে ইঙ্গিতে তাই বোঝাবার চেষ্টা করত। সমর সব শুনত। দাদাটি এমন আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর হয়ে গেছে ভেবে ক্ষোভ হত তার।

মার তখন এক কথা—কী চাকরী। টাকা দেবে কোত্থেকে! মার দুর্বলতা সমর বুঝতে পারত। কোন বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকে—নিজের বলতে কাছে কেউ নেই। কি-ই বা চাকরি! রেলের ওয়ার্কশপে কাজ। লেখাপড়া তেমন হয়নি, পাশ টাস নেই যে ছেলে তোমার দু-হাতে কামাবে, বাপ তা মচর মচর করে ওড়াবে। দাদার কথা উঠলে মা সবসময় তার পক্ষ নিয়ে কথা বললে, সমর না পেরে বলত, ইচ্ছে থাকলে ও থেকেই বাবাকে কিছু দিতে পারে। ভাই-বোনেরা খেল কি খেল না মাথায় নেই। বেঁচে থাকতে গেলে কিছুটা ছাড়তে শিখতে হয় মা।

রিকশাটা পঞ্চাননতলা পার হয়ে যাচ্ছে। দু-পাশে মাঠ, অসময়ের আবাদ, স্যালোর নীলবাতি চোখে পড়ছে। বড় বড় আমবাগানগুলি নেই, কাঠ চেরাই-এর কল বসেছে। তার আওয়াজ পাচ্ছিল সমর। কিছু পাখি উড়ে গেল। জোনাকি পোকা ঝোপে জঙ্গলে উড়ছে। জমি ভাগ সে না গেলে হবে না। কেন হবে না, তাও সে জানে। সে তার চাকরি এবং মেধা বিক্রির টাকায় সবচেয়ে সচ্ছল। অসময়ে সে সবার ভরসা। দু-বোনের বিয়ে, ছোট দু-ভাইকে থিতু করার জন্য প্রাণপণ খেটে একটা জায়গায় হেরে গেছে। ছোট ভাইটি বড় বিপাকে পড়ে গেছে। পড়াশোনা করল না, করানো গেল না—তার বৌদি কত বুঝিয়েছে! সমর এবং তার স্ত্রী স্কুলে শিক্ষকতা করে নিজের কাছে রেখে পড়িয়েছে। তবু পারেনি। বোনের জন্য মাস্টার রেখেছে। তখন সমরের আলাদা সংসার। দু’জনের আয় থেকে অতি কষ্টে বাঁচিয়ে বাবাকে মাসোহারা দিয়ে গেছে।

স্ত্রী তার চাপা স্বভাবের। সহজে ক্ষোভ প্রকাশ করত না। ভাই-বোনেদের নিজের কাছে রেখে পড়িয়ে, দু’জনের উপার্জিত টাকায় এমন উদ্বৃত্ত থাকে না, বাবার সংসারে আলাদা কিছু দেওয়া যায়। এক পয়সা সঞ্চয় নেই। স্ত্রীও তখন সন্তানসম্ভবা। চিন্তা হবারই কথা। দাদা ইতিমধ্যে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হলে বাবার সংসারে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটি কন্যা হয়েছে দাদার। বৌদিকে নিয়ে গেছে, কন্যাটি মার কাছে রেখে গেছে। যজনযাজনে কিছু আয় করেন বাবা। শাকসব্জি জমিতেই হয়—সমর যে টাকা পাঠায় তাতে করে বাবার গাঁয়ের বাড়িতে অভাব আর সে-ভাবে জাঁকিয়ে বসে নেই। দাদা তার স্ত্রীর প্রসূতিকেন্দ্রটি বাড়িতেই রেখেছিল। তার দায় ছিল একটাই, কোনোরকমে বাড়িতে মার কাছে ফেলে রেখে যাওয়া। টাকার কথা বাবা লিখলেই পেটের পীড়ায় কষ্ট পাচ্ছে এমন খবর আসত দাদার। বাবা গুম মেরে যেত। এবং পর পর তিনটি কন্যার জন্ম হলে সমর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুই কীরে দাদা! পর পর মেয়ে হচ্ছে, ভাবছিস না! আবার বৌদিকে নিয়ে এয়েছিস! এদের বড় করবি কী করে! খাওয়াবি কি! লেখাপড়া আছে। দিনকালের কথা ভাবছিস না। এত অবিবেচক তুই! দাদার তখন এক কথা, আমার সন্তান না হলে বংশ রক্ষা করবে কে? পুত্র সন্তান লাভে দাদা প্রায় মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচটি কন্যা এবং দুটি পুত্রের পিতা।

সমর বাড়ির মুখে এসে গেছে। এখান থেকে নেমে কিছুটা রাস্তা তাকে হেঁটে যেতে হবে। কাঁচা রাস্তা। রিকশাওয়ালা ভিতরে ঢুকতে কিছুতেই রাজি না। মাসখানেক আগে দাদা এক বিকেলে তার বাড়িতে হাজির। দাদাকে দেখলে এখন তার কষ্ট হয়। কেমন নিস্তেজ গলায় কথা বলার স্বভাব। মুখে চোখে কোনো গোপন অপরাধ যেন ভেসে ওঠে কথা বলার সময়। দাদা তাকে জানিয়েছিল, জুন মাসে রিটায়ার করছে। বাড়ির কোনদিকটা সে নেবে, বাড়ি ঘর বানাবে, তারই প্রায় বলতে গেলে অনুমতি নিতে গিয়েছিল।

সে বলেছিল, বাঁশঝাড়ের দিকটায় আপাতত বাড়ি ঘর বানিয়ে থাক।

দাদা বলেছিল, রাস্তার সামনের জমির একটা অংশ আমাকে দিবি। একটা দোকান টোকান না করতে পারলে খাব কি! পেনসনের কটাই বা টাকা!

সমর বুঝতে পেরেছিল, গর্ত থেকে তাহলে সাপ এবার সত্যি বের হয়ে পড়েছে।

ফাল্গুনের এটা মাঝামাঝি সময়। অথচ কী কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। সে জানে, এ-সময়টায় কলকাতার শীত না থাকলেও এখানটায় শীত জাঁকিয়ে বসে থাকে। স্টেশনে নেমেই কোট গায়ে দিয়েছিল। রিকশায় উঠে গরম চাদর বের করে কান মুখ মাথা ঢেকে নিয়েছে। শীতে বড় কাবু সে। একটু এদিকে ওদিক হলেই সর্দি কাশি।

এখন এটাচিটা নিয়ে হাঁটায় শরীর আর টাল মেরে যাচ্ছে না। টর্চ সঙ্গে এনেছে, কিন্তু সাদা জ্যোৎস্নায় টর্চ জ্বালার দরকার হয় না। সে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাচ্ছিল—আর চারপাশটা দেখছিল। মানুষজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। লাইট আসায় দূরের ঝোপজঙ্গলে আর এখন অন্ধকার গুঁড়ি মেরে থাকে না। নির্জন মাঠে দাঁড়িয়ে গাছ-গাছালির মধ্যে বাড়িঘরের আলাদা এক মাধুর্য টের পায় সে।

জায়গাটা কী ছিল, কী হয়ে গেল! জমির দর চড় চড় করে বাড়ছে। এক কাঠা জমি হাজার তিন টাকার কমে হয় না। কত পরিবর্তন! অথচ তার বাড়িতে সে পরিবর্তনের কোনো ছাপই পড়েনি। লাইট নেবার ক্ষমতা অমরের হয়নি। সেজ ভাই মনোজ মার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বৌকে নিয়ে আলাদা বাড়ি করে পাশেই উঠে গেছে। কী-রকম লাগে ভাবতে! এরা সবাই একই গাছের ডালপালা আর মনেই হয় না। এখন এক একজন আলাদা গাছ হয়ে গেছে। সম্পর্ক শূন্য।

তার কেমন দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। মা বাবা ভাই-বোন ছিল তার কাছে চন্দ্রকিরণের মতো। সাহস যোগাত, স্বপ্ন দেখাতো, দূরের মাঠে যেতে বলত, কোথাও কেউ অপেক্ষা করে আছে একসঙ্গে হেঁটে যাবে বলে, এবং বিয়েটা শেষ পর্যন্ত সে করেছিল একজন চাকুরিজীবী মেয়েকে। দু’জনের উপার্জনে সে এবং সবাই ভালভাবে বেঁচেবর্তে থাকবে ভেবে। তার পরের বোন দশ বছরের ছোট, মনোজ বার বছরের, অমর আর কণা যমজ, তার সঙ্গে তাদের বয়সের ফারাক অনেক। নিরুপায় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সব দায়িত্ব কাঁধে নেবার সময় একটা ক্ষেত্রেই তাকে পীড়া দিয়েছে। দাদা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। বয়স যত বেড়েছে, জীবনে যত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তত এই ক্ষোভ জমতে জমতে এক সময় পাহাড় প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রমীলাও মাঝে মাঝে মাথা ঠিক রাখতে না পারলে বলত, তাঁরা কেবল তোমারই মা বাবা, তোমার দাদার নয়! সারা জীবন মাথার উপর এত বড় বোঝা নিয়ে হাঁটছ কখন একদিন মুখ থুবড়ে পড়বে দেখবে! তখন আমাদের একটা কানাকড়ি দিয়ে কেউ সাহায্য করবে না।

সমর হেসে বলত, বোঝা নিয়ে হাঁটতে শিখতে হয় প্রমা। না হলে মানুষ বড় একা হয়ে যায়।

এ-সব দার্শনিক কথাবার্তা স্ত্রী একদম পছন্দ করত না। বলত, অপমান তোমার নেই। নিজের ছেলেদের পৈতে দিতে পারলে না, দাদাটি তো বেশ দু-ছেলের ঘটা করে পৈতে দিল। বাবার কাজের সময় কেউ হাত উপুড় করেছে! ঘটা করে কাজ করেছ, ছেলের কাজই করেছ। কিন্তু উচিত অনুচিত বুঝবে না! সবারই দায়িত্ব আছে।

সমর বোঝাবার চেষ্টা করত, প্রমা, আমার তো ভালই লাগে। আমি করছি।

প্রমার ঝাঁঝ বোঝা যেত তখন। বলত, আসলে তোমার অহংবোধ থেকে এ-সব করছ। কত লায়েক তুমি, ভাইয়েরা রাঙাদা বলতে অজ্ঞান, ঠুনকো মান অপমান থেকে করছ। নিজে খালি হয়ে যাচ্ছ বুঝতে পারছ না। একদণ্ড বিশ্রাম নাও না। কোথাও বেড়াতে বের হয়েছ! একবার পুরী নিয়ে গিয়ে উদ্ধার করেছ।

আসলে সমর বোঝে সে অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর দিকটা ভাল করে বুঝে দেখেনি। কলকাতায় একটা কারখানায় কাজ নিয়ে আসার পরই মনে হয়েছিল, সে জলে পড়ে গেছে। সে নির্বান্ধব। বাবার মাসোহারা পাঠাতে দেরি হলেই চিঠি আসত। বাবা লিখতেন, দোকান বাকি থেকে, ভাই বোনদের স্কুলের মাইনে অসুখ বিসুখে কত ধার হয়েছে এ-সব। একবার লিখেছিলেন, মাসোহারা তোমার তেষট্টি সালে যা ছিল সাতষট্টি সালেও তাই-বলে দুটি ফর্দ পাঠিয়ে ছিলেন, একটি তেষট্টি সালের জিনিসপত্রের দরদাম দিয়ে, আর একটি সাতষট্টি সালের। প্রথম এবং শেষবারের মতো সেবারেই মাথা ঠিক রাখতে পারেনি সমর। সেও একটা তালিকা পাঠিয়ে দিয়ে লিখেছিল, কলকাতায় জিনিসপত্র জলের দরে বিক্রি হচ্ছে বাবা, আপনারা সবাই আপাতত এখানেই চলে আসুন। আমরা সুখে থাকব, আপনারা কষ্ট করবেন সে হয় না। চিঠি পাবার পর বাবা বছরখানেক আর চিঠি দেননি। সমর বাবার মাসোহারা ঠিক পয়লা তারিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাসাভাড়া, দুই পুত্রের স্কুলের খরচ একজন কাজের লোকসহ সব সামলাতে গিয়ে দু-হাতে মেধা বিক্রি করেছে। স্বামী-স্ত্রীর রোজগারে কলকাতার খরচই চলে না। প্রমা রাত জেগে লিখতে দেখলেই ক্ষেপে যেত—কী দায় পড়েছে। কোনদিন মাথা ঘুরে পড়ে মরে থাকবে—বলে সব টেনে নিয়ে যেত। বলত, যাও শুয়ে পড়। তোমার বাড়ির টাকা পাঠিয়ে দরকার হয়, শুধু না হয় ডাল ভাতই খাব। আর একটা অক্ষর লিখেছ তো আমার মাথা খাও।

 সে কেমন বুঁদ হয়ে গেছিল ভাবনার মধ্যে। কখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি। বাবার লাগানো সার সার আম গাছ সব বিশাল ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার সামনে গাছের ছায়া পার হলে অমরের কুঁড়ে ঘর। দু’দুবার দোকান বসে গেলে থোক টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে—বছরখানেক আগে আতপ চাল রাখার দায়ে পুলিশের হামলা—প্রায় দশ কুইন্টাল চাল আটক করে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। মামলার খরচ সহ যতটা সম্ভব সাহায্য করার সে করছে। সবই এখন গোপনে। ঘরে আলোও জ্বলছে না। গাঁয়ে রাত একটু বেশি তাড়াতাড়ি হয়। পাশে গোয়ালঘর, গরুটা শুয়ে জাবর কাটছে। এখন সম্বল বলতে শুধু এই গরুর দুধ, আর তার পাঠানো মাসিক বরাদ্দ। আম গাছের ছায়ায় সে এসে দাঁড়াল। আশেপাশের বাড়িতে লাইট আসায় তার কিছুটা আলো এ-বাড়ির অন্ধকার কিছুটা পাতলা দুধের মতো আবছা। কেমন নিজীব ভিতরে আতঙ্কের সামিল গোটা বাড়িটার অস্তিত্ব। তার ভয় ধরে গেল। আর কিছুটা ভিতরে ঢুকলে মাটির দেয়াল, টিনের চৌচাল ঘরটা। সামনে তুলসী মঞ্চ। ঘরটায় মা আর বড় ভাইঝি থাকে। সে বারান্দায় উঠে ডাকল, মা আমি সমর। দরজা খোলো।

 কোনো সাড়া শব্দ নেই। বয়েস হয়ে যাওয়ায় কানে কম শোনে। বাবার মৃত্যুর পর দশ বছর কেটে গেছে। মা এখনও সক্ষম। ইদানিং জরায়ুর অসুখ। মাঝে মাঝে রক্তপাত হয়। সমর তার ছোট ছেলেকে বলেছিল, কী করবি, একবার তোর কলেজে ভর্তি করে দিলে হয়। ছোট ছেলের এক কথা, এ-বয়সে বাবা খোঁচাখুঁচি করবে! ভেবে দেখ। তা ঠিক। মার তো আশি পার হয়ে গেছে। অথচ কী সক্ষম—নিজে স্বপাকে খান। উঠোন নিয়মিত ঝাঁট দেন। শুকনো পাতা ডাল সংগ্রহ করে রাখেন জ্বালানির জন্য। বাড়ি ছেড়ে একদণ্ড কোথাও গিয়ে স্বস্তি পান না।

সে আবার ডাকল, মা আমি সমর। মা মা !

কোনো সাড়াশব্দ নেই। মা কানে কম শুনতে পারে, কিন্তু প্রীতি! সে তো সাড়া দেবে।

সহসা মনে হল, অমরের ঘরে আলো জ্বালছে কেউ বলছে, এই ওঠো, রাঙাদা এসেছে। দরজা খুলে অমর বৌমা আর বাচ্চা তিনটেও বের হয়ে এসেছে। উঠোনে দাঁড়িয়ে বলছে, কটার ট্রেনে এলি! অমর বারান্দায় উঠে দরজায় ধাক্কা মারল। ডাকল, মা মা রাঙাদা এয়েছে। ওঠো।

মা এবার ভিতর থেকেই সাড়া দিল, প্রীতি যাত্রা দেখতে গেছে।

অমর বলল, তুমি ওঠো না। রাঙাদা এসেছে।

—কে এসেছে?

—রাঙাদা।

—এত রাতে কে এল?

—রাঙাদা। কী বলছি শুনতে পাচ্ছো না। অমর চিৎকার করে কথা বলছে।

—অ সমু এয়েছে। সমু। বলে মা বোধ হয় কিছু হাতড়াচ্ছে। আর বিড় বিড় করে বকছে, এত করে বললাম যাস না। শোনে। কেউ শোনে। দেশলাইটা মরা যে কোথায় রেখে গেল।

—বৌমা এবার এগিয়ে গেল। —দরজাটা খুলুন।

মা অন্ধকারেই দরজা খুলে দাঁড়ালে সমু গড় হল। বলল, কোথায় যাত্রা দেখতে গেছে?

—মিলে।

সমর জোরে কথা বলছে। প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে। মা কেমন অসার চোখে তাকিয়ে বলছে, কিছু দেখতে পাই না। কী যে ছানি কাটালি। সব আবছা দেখি বাবা। আয়। ভিতরে আয়। কী খাবি! চোখে মুখে জল দে। প্রিয় তোকে চিঠি দিয়েছিল! পেয়েছিস বাবা।

প্রিয় মানে প্রিয়ব্রত। বীণার বর। এক হাজার টাকা নগদ, হাতে কানে গলার গহনা, মেধা বিক্রি করে তখন এত টাকা হত না। কী লড়ালড়িটাই না গেছে। বাবার এক কথা, বিয়েতে খাট ড্রেসিংটেবিল দিতে হবে। বীণা স্কুলে মাস্টারি করে। দেখতে খুব সুন্দর না। প্রিয়ব্রতর বাবা বীণার চাকরির লোভে সম্বন্ধ ঠিক করে বলে গেছিল, এ-সব না দিলে মান সম্মান থাকবে না।

ভগ্নিপতিদের নাম শুনলেই তার কেন যে নগদের টাকাটার কথা মনে হয়। কোথায় যেন এতে মানুষের নীচতা সে টের পায়। ছোট বোনের বেলায়, নগদের আড়াইশ টাকা যোগাড় করতে পারেনি বলে বর আটকে রেখেছিল তার মামারা। সে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এসেছে। কম্পাউণ্ডার বরের মামারা তাঁত চালায় মিলে। মা বাবা নেই। মামারাই অভিভাবক। সে ক্ষমা চেয়ে বলেছিল, আমি কথা দিচ্ছি, কলকাতায় গিয়ে খাই না খাই বাকি টাকাটা পাঠিয়ে দেব। মাত্র আড়াইশ টাকার জন্য আমার বোনের এত বড় সর্বনাশ করবেন না। এ-সংসারের জন্য তার হেনস্থা দেখে প্রমার চোখে সে কী জ্বালা ফুটে উঠেছিল সেদিন। সবাই নির্বিকার। সমরই সব।

এই অপমান, তাকে যতটা না কাবু করেছিল, প্রমাকে করেছিল তার চেয়ে বেশি। বাড়ির চিঠি এলে মুখ গোমড়া করে রেখেছে। প্রমার কাছে একমাত্র বাবা বাদে মনে হয়েছে সব অমানুষ। তার অভিযোগ, কোথাকার কী সব অশিক্ষিত মানুষ, তাদের কাছে গিয়ে তোমাকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হল! বাড়ির বড় ছেলের কোনো দায় নেই!

সমর বুঝেছিল প্রমার সঙ্গে বাড়ির সবার তিক্ততা ক্রমে বাড়ছে। নিষ্ক্রিয় স্বভাবের মানুষ সব। তা দোকান বাকি, ভেব না, সমরকে চিঠি লিখছি। সে ঠিক পাঠিয়ে দেবে। নগদ হাজার টাকা, ভেব না, সমর যখন আছে সব হয়ে যায়। পাত্র হাতছাড়া করা যাবে না। চিঠির পর চিঠি। একটা চিঠিও সমর পায়নি যাতে বাবার অভাব অভিযোগের কথা লেখা থাকত না। চিঠি এলেই প্রমার মুখ গোমড়া হয়ে যেত। লোকটার সঙ্গে বাড়ির সবার শুধুই টাকার সম্পর্ক। শুধু বাড়ি কেন, আত্মীয় স্বজনরাও এসেছে একই কারণে। তার সংসারের ভাল মন্দের খবর কেউ নেয়নি। তার সংসারেও যে পোকামাকড়ের উপদ্রব আছে, অসুখ-বিসুখ আছে, মানুষটার ভবিষ্যৎ আছে, তার নিজের ছেলেদের ভবিষ্যৎ আছে, একবার বোধ হয় কেউ এটা ভেবে দেখে না! না হলে কলকাতার কাছে শহরতলিতে চার কাঠা জমি জলের দরে কেনার পর বাবার চিঠি আসত না, তোমার শেকড় আলগা হয়ে গেছে।

মা প্রতিবেশীদের বলত, সমু আমার আর নিজের নেই। বৌমার কথায় চলে। বৌমা সমুকে নিয়ে আলাদা থাকবে বলেই জমি কেনা। সমর বাড়ি গেলে, বাবা গম্ভীর গলায় বলেছেন, তোমার এটা খুবই অনুচিত কাজ হয়েছে। টাকাটা দিয়ে এখানে তুমি পাকা ঘর তুলতে পারতে। শেষ বয়সে তোমার মার অন্তত একটা বাসনা পূরণ হত। বাবার পাশে বসে থাকলে তখন সমর কেন যে সত্যি ভাবত, এটা তার অনুচিত কাজ, সেও কম স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক নয়! প্রমাকেও মনে হত বড় বেশি আত্মপর। কাকারা বলতেন, তুই নাকি কলকাতায় বাড়ি করছিস!

সমুর তখন বলতে ইচ্ছে হত, বাড়ি; হ্যাঁ তা বাড়িই বটে। ভণ্ডুল মামার বাড়ি হবে। একদিন তুলতে তুলতে আর একটা দিক ভেঙ্গে পড়বে। প্রমার জেদে পড়েই জমি কেনা। বাড়ি করার সামর্থ্য হবে সে স্বপ্নেও ভাবে না।

প্রমার একটাই কথা, আমি আমার ছেলেদের নিয়ে ভেসে যেতে রাজি না। আর আশ্চর্য, জমিটা কেনার পরই তার ভাগ্য যেন কিছুটা সুপ্রসন্ন হয়ে উঠল। না হলে একসঙ্গে হাজার টাকা অগ্রিম কেউ দেয় সে কল্পনাই করতে পারে না। টাকাটা হাতে আসতেই সে ভাবল বাড়ির ভিতটা করে ফেললে হয়। হাতে থাকলে খরচ হয়ে যাবে। বাড়িতে বাবা মা ভাই বোনদের জন্য একটু বেশি বেশি পুজার কেনাকাটা এবারে আর নাই হল। তের টাকা বস্তা সিমেন্ট, একশ পাঁচ টাকা হাজার ইট—দরদাম করে বুঝেছিল, যতটুকু এগিয়ে থাকা যায়। নিজের বাড়ি। ভাবতেই আনন্দে তার সারা শরীর কেমন মাতাল হয়ে পড়েছিল। নিজের বাড়ি, নিজের বাড়ি—চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হত—আমার নিজের বাড়ি!

বাড়ি যখন উঠতে শুরু করেছে, তখনই বাবার চিঠি এসেছিল, তোমার ছোট বোনের সম্বন্ধের কথা চলছে। পাত্রপক্ষ পলাশ চক্রবর্তীর ভাগ্নে। তুমি তাকে চেন। পত্রপাঠ বাড়ি আসবে। তোমার সঙ্গে তারা কথা বলতে চায়। মনে হয় এ-সম্বন্ধ হাতছাড়া হলে তুমি সারা জীবন পস্তাবে। সমর পত্রপাঠই বাড়ি চলে গেছে। বাড়ি উঠছে তার। পাকা বাড়ি। তাও আবার কলকাতায়। যে বাড়িটায় সে বড় হয়েছে, কৈশোর যৌবন কেটেছে, তার কোনো পরিবর্তন নেই। দুটো মাটির ঘর, দুটো পাটকাঠির ঘর—রান্না ঘরে তালপাতার ছাউনি। ঠাকুরঘর একদিকে, কলপাড়ে কাদা জমে থাকে। বাড়ি গিয়ে নিজেরই ভারি সংকোচ হচ্ছিল। দাদাকে আত্মপর ভেবেছে, সে কী! এই অপরাধবোধই শেষ পর্যন্ত পাত্রপক্ষের সব দাবিদাওয়া মানতে বাধ্য করিয়েছিল তাকে। এমন কী নগদ হাজার টাকা। তার এতদিনকার একগুঁয়েমি নগদ এক পয়সা দেব না জেদ সব নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল। মেধা বিক্রির টাকা, কার কাছে কীভাবে অগ্রিম বাবদ নেবে, এই সব ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হবার যোগাড়। বাড়ির কাজ বছর তিন পিছিয়ে গেছিল। প্রমার আচরণ আরও তিক্ত হয়ে উঠেছিল। সংসারে শান্তি নষ্ট হচ্ছে। সে কিছুই ভ্রূক্ষেপ করেনি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, যে সাপটা গর্ত থেকে মুখ বার করেছে, সেটা এখন তার গায়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। মা হারিকেন হাতে ভিতরে ঢুকে বলল, আয়। সে ভিতরে ঢুকে তক্তপোশে বসল।

মা বলল, কী খাবি।

সমর বলল, সেদ্ধ ভাত কর। ওতেই হয়ে যাবে।

ছোট বৌমা ঘরে ঢুকছে না। ছেলে মেয়েদেরও ঢুকতে দিচ্ছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শুধু জামা গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবকটা প্রায় যেন উলঙ্গ। বড়টি সাত বছরের, মেজটি বছর পাঁচেক। ছোটটি মেয়ে। বছর তিন বয়স হবে। সমর বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত চিঠি না লিখে, থাকতে পারেনি—আর যদি কোনো সন্তান-সন্ততি হয়, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক ছেদ ঘটবে। এ-সব কী হচ্ছে! কী খাওয়াবে পরাবে ভাবছ! শুধু জন্ম দিয়ে খালাস। এ-সব চিঠি লেখার সময় নিজেরই খারাপ লেগেছে। বাবা বেঁচে থাকলে এমন চিঠি সে লিখতে পারত না। বড়দার বেলাতেই দেখেছে—বাবার কী রাগ! তুমি কে বলার! পৃথিবীতে কে আসবে না আসবে তার দায় তেনার। খোদার উপর খোদগিরি করছ বলেই তোমাদের এত অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। বাবার আস্কারাতেই দাদা মহা আনন্দে সংসারের এ-দিকটায় বিন্দুমাত্র গাফিলতি দেখায়নি।

অমর ডাকল, মা তোমার কিছু করতে হবে না। ছোট বৌমাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, ডিমের ঝোল ভাত করে দিচ্ছি রাঙাদা। বলে ছুটে কলপাড়ে চলে গেল। বারান্দায় হাতমুখ ধোয়ার জন্য এক বালতি জল রেখে গেল। সাবান সব। মা শুনতে পায়নি বোধ হয়, ওদিকের বারান্দায় মার হেঁসেল। পাঠকাঠি ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে দেখে সমর বলল, তোমায় কিছু করতে হবে না। বৌমা করে দিচ্ছে।

অমরের বড় ছেলেটা বলল, জেঠু কাল থাকছ তো! একটু বেশি পাকা পাকা কথা বলার স্বভাব। সমরের হাসি পেল। বলল, প্যান্ট পরে আয়। বড় হয়েছিস। তিনজনই দৌড়ে চলে গেল। প্যান্ট পরে এসে আবার বারান্দায় দাঁড়াল। সমর বলল, ভিতরে আয়।

 মেজ ছেলেটা বলল, না। মা বকবে।

—বকবে কেন! আয় বলছি! আমার পাশে বোস।

আসলে সমর বোঝে মার আদরের নাতনি প্রীতিকে নিয়ে ছোট বৌমার সঙ্গে লড়ালড়ি চলছে। কিছুদিন আগে মার চিঠিতেই সে তা টের পেয়েছে। মা লিখেছে, অমরের দুধ খাওয়া যায় না বাবা। বৌমা জল মিশিয়ে দেয়। অমরকে আমিই লিখেছিলাম, বিকেলের দুধ থেকে মাকে আধসের দুধ দেবে। শত হলেও তিনি আমাদের মা। সে কথা রেখেছিল। কিন্তু মাস দুই যেতে না যেতেই চিঠি, শেষ বয়সে একটু দুধ পর্যন্ত খেতে পাই না। অমর দুধ দেয় না। বাধ্য হয়ে সমর লিখেছিল, ঠিক আছে আলাদা দুধের টাকা পাঠাচ্ছি। তুমি ভাববে না। মাসোহারার সঙ্গে দুধের বাবদ সে আরও পঞ্চাশ টাকা বাড়তি পাঠিয়ে যাচ্ছে।

মাটিতে আসন পিঁড়ি হয়ে খাওয়ার অভ্যাস সমরের নেই। শরীরে তার অন্য অভ্যাস গড়ে উঠেছে। শীতকাল ছাড়া সে বাড়িও আসতে সাহস পায় না আজকাল। ঘরের দুটি জানলা বড় ছোট। আলো হাওয়া ঢোকে না। পাখা নেই। গরমে এলে তার বড় কষ্ট হয়। সে হাঁসফাঁস করে। সাপখোপেরও ভয় থাকে। এলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মার তখন অভিযোগ—সবই করলি, বাড়িটার দিকে তাকালি না। দু-দিন এসে যে থাকবি তাও পারিস না।

ভাতের থালা মা এগিয়ে দেবার সময় বলল, সাপ নিয়ে আমি ঘর করছি বাবা। কিছু একটা কর? আপদ দূর না করলে আমি যে মরেও শান্তি পাব না।

সমর বোঝে মার এই নালিশের হেতু কী। দাদা বড় ভাইঝির কোনো দায়িত্ব নিতেই রাজি না। প্রীতির তো কম বয়স হল না। সম্বন্ধ দেখতে সে সাহস পায় না। পরে কিছু হলে দোষের ভাগী সে হবে।

সময় ভাত ভাঙ্গার সময় বলল, বলেছি তো সম্বন্ধ দেখ। আমার যথাসাধ্য আমি করব।

মার এক কথা।—তুই মাথা না পাতলে হবে না। তোর নিজের একটা মেয়ে থাকলে কী করতিস। বিয়ে দিতিস না। ফেলে রাখতে পারতিস! তোর কোনো সম্বন্ধই পছন্দ হয় না।

সমর কথা বলছে না। আস্তে আস্তে ভাত ভাঙছে। কী বলবে। বিচিত্র সব বায়নাক্কা পাত্রপক্ষের। প্রীতি যদি লেখাপড়াটাও করত। অন্তত স্কুল ফাইনাল পাসও হত। ঠাকুরদা ঠাকুরমার আদরে লোক দেখানো স্কুলে যাওয়া আসা সার করে লাউডগার মতো বেড়ে উঠেছে। পাত্রপক্ষ হয় ট্যাকসি ড্রাইভার, নয় স্যালো চালায়, অথবা রেলে কাজ করে—কখনও পুলিশ পাত্রপক্ষ, দাবির কথা শুনলে মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। দশ পনের হাজার টাকা নগদই চায়-সেই মত দান সামগ্রী। এত দেবে কোত্থেকে সে! অথচ মার চোখের দিকে তাকাতে সে সাহস পায় না। গলায় কাঁটা ঠেকে আছে।—আমার এটাই শেষ আবদার তোর কাছে বাবা। তুই রাজি হ। সে রাজি হয় কী করে। এবারের সম্বন্ধটি খারাপ না। মধ্য বয়সী। পাত্র কলকাতায় ল পড়ার সময় পাগল হয়ে যায়। হাতের সামনে কাগজ পেলেই কুটি কুটি করে ছেঁড়ার অভ্যাস ছিল। এখন ভাল হয়ে গেছে। পাত্রের মার দাবি ছেলে আমার এখন ভাল হয়ে গেছে। তার আইন পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ল পাস করলে বিয়ে। পাত্রের শহরে বাড়ি আছে। কেবল ল পাস করলেই প্রীতির সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হতে পারে।

ভগ্নিপতি প্রিয়ব্রতও চিঠি লিখে জানিয়েছিল, দাদা এটাই একমাত্র উপায়। আপনি এসে পাত্রটিকে দেখুন। পছন্দ হবে। আপনার বাড়িতে রেখে কলকাতায় পড়ার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। দাবিদাওয়া এই একটাই। আপনি রাজি হলে মা এ-যাত্রা রক্ষা পায়।

তারও মনে হয়েছিল, মন্দ না। সে প্রমীলাকে প্রস্তাবটা দিতেই ক্ষেপে গিয়েছিল—কী বললে! একটা অচেনা মানুষ আমার বাড়িতে এসে উঠবে।

ওর মুখ তিক্ততায় কালো হয়ে গিয়েছিল। তবু সমর হেসে বলেছিল, হবু জামাইকে না হয় দু-বছর বাড়িতে রাখলেই।

প্রমীলা তখন চাপা ক্ষোভে ভেঙ্গে পড়েছিল। বলেছিল, আসতে পারে। তুমি হবু জামাইটিকে নিয়ে থাকবে। দুচোখ যেদিকে যায় আমি চলে যাব। তারপরই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, তোমার বাড়ির লোকেরা ভাবে কী! আমি মানুষ না। আমরা মানুষ না। তুমি অফিসে চলে যাও বিকেলে, কত রাত হয় ফিরতে তোমার। তার কলেজের ভাত করে দেওয়া, তার যত্ন আত্তি করা, তাছাড়া একটা অচেনা লোক সারাদিন বাড়িতে থাকবে, তার পাগলামি যদি দেখা দেয় কে সামলাবে! তুমি না আমি! বল! বল! চুপ করে থাকলে কেন?

সমর খেতে খেতে বলল, আমি কিছু ভাবতে পারছি না মা। প্রমীলা রাজি না। আমি কী করব।

মাও কেমন উত্তপ্ত, সংসারে এত টাকা কে কামায়। তুই না বৌমা। আমি তোকে পেটে ধরিনি। আমার আবদার থাকতে পারে না! কিছুই তো করলি না। সারাজীবন বৌ-এর কথায় চললি! বৌ ছেলেরাই তোর সব। আমি তোর কেউ না!

 সমর জবাব দেয়নি। কারণ কৈশোরের রাস্তার সে এখনও হেঁটে যাবার স্বপ্ন দেখে। মা বাবা ভাই বোনেরা সেই রাস্তার শেষ প্রান্তে জেগে বসে আছে যেন—সবারই আশা সমু আসছে। তাকে দূর থেকে দেখলেই মনোজ ছুটে যেত চিৎকার করে, মা দাদা আসছে। দাদা সারাদিন পর সবার জন্য দু মুঠো অন্ন সংস্থান করে ফিরছে। এই দৃশ্যটা সে এখনও ভুলতে পারে না।

প্রীতি এসে বলল, কাকা কখন এলেন!

সমর শুয়ে থেকেই জবাব দিল, রাত বিরেতে কোথায় যাস। মা একা থাকে।

প্রীতি বলল, আমি কী করে জানব আপনি আসবেন। রবিদার বৌরা গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে গেছি। সমরের ঘুম পাচ্ছিল। মনোজ এল দেখা করতে । সে মশারির নিচ থেকেই বলল, সবাইকে খবর দিস আমি এসেছি।

সকালে উঠে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে বেড়াল সমর। বাড়ি এলেই এটা তার বিলাস। বাবা বাড়িটা জুড়ে কতরকমের ফুল ফলের গাছ লাগিয়ে গেছেন। পঁচিশ ত্রিশ বছরে গাছগুলি আর গাছ নেই, বৃক্ষ হয়ে গেছে। আম জাম কাঁঠাল নারকেল হেন ফলের গাছ নেই বাবা লাগিয়ে যাননি। তাঁর উত্তরপুরুষদের জন্য এসবই স্মৃতি রেখে গেছেন। বাঁশঝাড়ের দিকটায় এসে মনে হল খালি খালি লাগছে। এই সব গাছপালার ছায়ায় ঘুরে বেড়ালে সে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। সে তার অতীতকে খুঁজে পায়। ভাল করে লক্ষ্য করতেই দেখল, আবার মা একটা গাছ বিক্রি করে দিয়েছে। পাঁচ সাত বছর ধরে দু চারটা গাছ যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সে সেটা জানে। তার এখানটায় এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা গাছের ডালপালা ভাঙ্গলে পর্যন্ত রেগে যেতেন। বলতেন, দিই তোমার কান ছিঁড়ে, হাত ভেঙ্গে, কী রকম লাগবে টের পাবে। বাবার সঙ্গে গাছগুলির এমনই সম্পর্ক ছিল।

এ সময় দেখল, অমর চুপি চুপি তার কাছে হাজির। কিছু বলতে চায়। সে মুখ তুলে তাকাতেই বলল, দাদা ওরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

সমর অবাক হয়ে বলল, ষড়যন্ত্র!

হ্যাঁ দাদা। বলছে সামনের প্লটটা দুভাগ করবে। একটা অংশ বড়দাকে দেবে। আমি কিন্তু বলে রাখছি ওটা আমি ছাড়ব না।

অমরের রোগা শরীর—ধূসর এবং ফ্যাকাসে। কতই বা বয়েস! এরই মধ্যে চুলে পাক ধরেছে। শরীর ভেঙ্গে গেছে। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় মাথা ঠিক না থাকারই কথা। সমর বলল, ঠিক আছে, সামনের সব জমিটা তোরই থাকবে। শত হলেও সবার ছোট। সে ভেবেছে, কেউ তার কথায় আপত্তি করবে না।

বাড়ি ফিরে এলে দেখল, প্রিয়ব্রত হাজির। সে জলচৌকিতে বসে। এদিক ওদিক কিছু কথার পর বলল, রেকর্ডে ওয়ারিশানদের নাম দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, মার নামেও একটা অংশ রেকর্ড করানো হোক। তাছাড়া আপনারা চার ভাই…বলেই থেমে গেল প্রিয়ব্রত।

সমর বলল, পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ তো শুনেছি মেয়েরাও পায়।

প্রিয়ব্রত বলল, তা পায়।

সমর কেমন দ্বিধায় পড়ে বলল, তাহলে বোনেদের সম্পত্তির দরকার।

প্রিয়ব্রত মানুষটি ঠাণ্ডা মেজাজের এবং বিবেচক। সে বলল, সাধারণত মেয়েদের এসব ক্ষেত্রে দাবি না তোলাই ভাল। প্রিয়ব্রত তার নিজের স্ত্রী অর্থাৎ বীণার নাম করে বলল, ওর একটাই দাবি, মার নামে সমান অংশ লিখে দিতে হবে। সামনের জমিটাতে দুটো প্লট করে একটা অংশ বড়দাকে দিতে হবে।

সমর ছোট বোনকে ডেকে পাঠাল। বলল, জমি নামে নামে রেকর্ড হচ্ছে। আইনত তুইও অংশীদার। তোর কী মত।

ছোট বোন এতটুকু দ্বিধা না রেখে বলল, আমার দুটো মেয়ে বড় হচ্ছে দাদা। ওদের বিয়েথা আছে। দরকারে বিক্রি করতে পারব। দিদি ছাড়লেও আমি ছাড়তে রাজি না।

সমর বলল, তাহলে আর বীণাকে বাদ দিয়ে কী লাভ। তার নামেও রেকর্ড হবে। শুধু মার নামে কোনো রেকর্ড হবে না। মা যতদিন আছেন, আমার অংশে থাকবেন।

এতক্ষণে বীণা মনোজ হাজির। অমর তার ঘরে বসে আছে। মা যাতে শুনতে পায় সেজন্য সব ভাই বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। অমর ঘরে বসে সব শুনতে পাচ্ছে।

সমর বলল, আমি কাল সকালের ট্রেনে চলে যাব। ফর্ম এনে সই করিয়ে নাও। সামনের অংশটা অমরকেই দাও। পাশ দিয়ে আটফুটের একটা রাস্তা বের করে নেবে ভেতরে ঢোকার।

বীণা বলল, তা হবে কেন। রাস্তার সামনের জমি, ভেতরের জমির দাম এক নাকি—তোর এটা কেমন বিচার। বড়দাকে নাকি বলেছিস, বাঁশঝাড়ের দিকে বাড়ি তুলতে? পাঁচ-সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে খাবে কী। মারও অংশ রাখতে হবে। জমি সাত ভাগ হবে।

সমর না বলে পারল না, মাকে নিয়ে তোদের এত ভাবনা কেন বুঝি না। মাকে তোরা দেখিস?

আর তখুনি সমর দেখল, ঝড়ের বেগে লাফাতে লাফাতে অমর উঠোনে হাজির। ওর চোখে জ্বলছে। গায়ে ফতুয়া। কেমন উন্মত্তের মতো চেহারা। সমর ভয় পেয়ে গেল। অভাবে অনটনে মাথার ঠিক নেই। সে এসে উঠোনে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিয়েছে। হবে না। কিচ্ছুতেই হতে দেব না। আমার জমিতে যে আসবে লাস নামিয়ে দেব। মার নামে রেকর্ড হবে। কেন হবে! আদরের নাতনিকে মা দিয়ে যেতে পারবে তবে। এদের সব ষড়যন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে বৌমাও হাজির। সেও চিৎকার করে বলছে, আমরা বুঝি না কিছু, কচি খুকি? দাদা, আপনি যে এত টাকা পাঠান মার নামে, কী হয় জিজ্ঞেস করুন। বাঁশঝাড়ের বাঁশ বিক্রি, গাছের ফল বিক্রির টাকা কী হয়। ঘরে একটা বাসন আছে! সব বড়দির বাসায় নিয়ে তুলেছে। আপনি এলে কলাই করা থালায় ভাত বেড়ে দেয়। আপনার চোখ নেই—দেখতে পাননা। মিথ্যে মিথ্যে চিঠি লিখে আপনার কাছ থেকে টাকা আনায়। সব জমা পড়ছে। মার দরদ সবার উথলে পড়ছে। একটা সিনেমা বাদ যায়। আপনার টাকায় মচ্ছব।

সমর বিরক্ত হয়ে বলল, বৌমা ঘরে যাও বলছি। যাও। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন।

সে সব বোঝে। মার আদরের নাতনিকে নিয়ে অশান্তি কেন বোঝে। মা ছোট থেকে বড় করে এখন ফাঁপরে পড়ে গেছে।

 বৌমা আবার চেঁচাতে থাকল। মান সম্ভ্রমের বালাই এতটুকু নেই।—কার টাকায় সেলাই মেসিন কেনা হয়েছে! আপনার টাকায়! আপনাকে চুষে নিচ্ছে।

অমর ফের চিৎকার করছে, আজ থেকে না। বাবা বেঁচে থাকতেই, সব দিদির বুদ্ধিতে হয়েছে। দিদি সেজদা চাকরি করত। দিদি বাবাকে কি পয়সা দিয়েছে! থাকতিস সাজাপুরে। খেতে লাগে না পরতে লাগে না। কথায় কথায় শোনাবে, দাদা করছে, আমরা করিনি। তুই কী করেছিস, কত মাইনে পেতিস। করতিস মাদার টিচারের কাজ। কী মাইনে, গোপনে তুই টাকা জমিয়ে সোনার জিনিস করেছিস। বিয়ের সময় হাত ভর্তি গয়না এসব তোর কোত্থেকে!

সমর কেমন হতবাক হয়ে গেছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, একই গাছের ডালপালা ছিল তারা। এখন সবাই গাছ হয়ে গেছে ঠিক, দূরত্বও তৈরি হয়েছে অনেক। তাই বলে এতটা দূরত্ব, সে কেমন নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকল। এ কী দেখছে! সব ফাঁকা। একটা মৃত গাছ—তার ডালপালায় কটা শকুন বসে আছে। ঘাড় বাঁকিয়ে ভাগাড় খুঁজছে। সে অসহায় বোধ করতে থাকল। এটা কেন দেখল! এমন অশুভ দৃশ্য যেন জীবনেও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি।

অমরের সঙ্গে বীণার কথা কাটাকাটি চলছে। কিছুই কানে আসছে না! এরা কারা! বীণা বড়দার পক্ষ হয়ে লড়ছে কেন সমর তাও বোঝে। বীণার পরামর্শেই বাবা মা শেষ পর্যন্ত প্রীতিকে তার মা-বাবার কাছে পাঠায়নি। ভাইঝিকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। ছোট থেকে মা-বাবার সঙ্গে সেও তাকে বড় করেছে। কারও চেয়ে কম টান না তার।

সমর বার বার সতর্ক করে দিত।

বীণার এক কথা, আমিও চাকরি করি। বড়দা বড়বৌদি ওকে দেখতে পারে না। গেলে দূর দূর ছাড় ছাড় করে। ভাইবোনেরা ভাবে ভাগ বসাতে এয়েছে। বড়দার সংসারে সব হয়—শুধু প্রীতির বেলায় যত অভাব।

বীণা এখনও চাকরি করে। প্রীতির বিয়ের কিছুটা নৈতিক দায়িত্ব তার উপর বর্তে গেছে। বীণার নিজেরও দুটো মেয়ে আছে। মার অংশ বীণার অংশ বড়দার অংশ আর তার অংশ মিলে প্রায় বেশির ভাগটাই বীণার কব্জায় চলে যাবে। বাবার মৃত্যুর পর সমরই দু-ভাইকে ডেকে বলেছিল, তোমরা মাকে কিছু দিতে পার না। মা যতদিন আছে সব তিনি ভোগ করবেন। তিনি হাতে ধরে দিলে খাবে, না দিলে খাবে না। মার এই অধিকার প্রীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। মার ধকল প্রীতিই সব ভোগ করেছে। অমর মনোজ কথা রেখেছে—তারা বাদ সাধেনি।

অমর চিৎকার করছে, আমরা সব বানের জলে ভেসে এসেছি। আমরা ছেলেরা গাছতলায় গেলে হই হই করে তেড়ে যায়। আমরা চোর। আমার ছেলেরা চোর! আর তুই সতী! ভরিখানেক সোনা নিয়ে তুই বাবাকে বিশ্বাসঘাতক বলেছিস! বিশ্বাসঘাতকের সম্পত্তির অংশ নিতে লজ্জা করে না!

প্রিয়ব্রত তার স্ত্রীকে সামলাচ্ছে, কী হচ্ছে! তোমরা কী আরম্ভ করলে!

মনোজ মাথা নিচু করে বসে আছে। মা দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছু শুনতে না পেলে বলছে, কী বলছে রে!

মনোজ বলছে, মা তুমি চুপ কর!

চুপ করব কেন! আমার নাতিন চোর! তোর বৌর নোলা তুই দেখিস না! চুরি করে গাছের সব সাবাড় করে দেখিস না।

মনোজ আর পারল না।—মা তোমার নাতিনকে চোর বলেনি। তুমি চুপ কর বলছি। শেষে অত্যন্ত ধীর গলায় বলল, সংসারে আগুন মা তুমি নিজেই লাগিয়েছ। সমরের দিকে তাকিয়ে বলল, বড় ছেলে মার সব কব্জা করতে চায় দাদা। প্রীতির এখন কী আদর! প্রীতি রানাঘাটে গেলে আর আসতেই চায় না। প্রীতির জন্য নতুন শাড়ি, ভালমন্দ সব হাতে করে নিয়ে আসে। প্রীতিকে হাত করতে পারলে সব হবে। সামনের প্লটের জমিটাও। দাদা এই ঘরে এসে উঠতে চায়। রিটায়ার করার পর শুনেছি আশি নব্বই হাজার টাকা পাবে। পেনসন আছে। তার তবু অভাব। অমর কাল কী খাবে জানে না। মার নাতিনকে নিয়ে আমার সঙ্গে কম অশান্তি হয়নি। সাধে বাড়ি ছেড়ে গেছি!

সমরের মনে হচ্ছে একটা পেরেক কেউ তার ঘিলুতে পুঁতে দিচ্ছে। সাপটা তার গা বেয়ে উঠছে। জমি জমার এত ঝামেলা। অধিকার কেউ হারাতে রাজি না। সে এবার না পেরে উঠে দাঁড়াল। বলল, না, মার নামে জমির রেকর্ড হবে না। সামনের জমি অমরকে দেবে। এ-ঘরে এসে কেউ উঠতে পারবে না।

মা তাকিয়ে আছে সমরের দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল বলছে, কী বলছে ছাই বুঝতে পারছি না।

মনোজ বলল, বলছে তোমার মাথা। তোমার কিসের অভাব! তুমি সব শুনতে চাও।

সমরই চিৎকার করে বলল, তোমার কোনো অংশ থাকবে না। তোমার অংশ নিয়ে পরে আবার লাঠালাঠি শুরু হবে। সম্পত্তি তোমার ছেলেমেয়েদের নামে রেকর্ড হবে।

—আমার নামে হবে না! মা ভারি আর্তগলায় কথাটা বলল।

সমর ফের চিৎকার করে বলল, না না না।

আর তখনই মা কেমন ভেঙে পড়ল বলতে বলতে, তুই যদি আমার আগে চলে যাস বাবা! আমাকে কে দেখবে! জমিটুকু থাকলে, সম্পত্তির লোভে আমি অন্তত খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারব বাবা। সম্পত্তির লোভে সবাই মা মা করে।

সমরের ভেতরটা সহসা একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেল। শরীর গোলাচ্ছে। সে তো ভাবেনি, সে মরে যেতে পারে। সে তো একবার ভাবেনি, মরে যাবার পর মার কী হবে! মা তাও ভেবে রেখেছে। সে ভারি অসহায় বোধ করতে থাকল। সে কিছু আর বলতে পারল না। চেয়ারের হাতল ধরে বসে পড়ল। প্রীতির কোনো সাড়া শব্দ নেই। প্রীতি আবার কোথাও চলে যায়নি তো। চিরদিন সে মেয়েটিকে অনাথ ভেবেছে। প্রীতির প্রতি তারও ভেতরে কম টান ছিল না।

শেষবারের মতো শক্ত হবার চেষ্টা করল। বলল, দাদা সামনের জমি পাবে না। বাঁশঝাড়ের ওদিকটাতে বাড়ি করতে হয় করবে, না হয় করবে না। তার মেয়ের বিয়ের দায় তার। আমি আর কারো দায়িত্ব নিতে পারব না।

আর তখনই প্রীতি উঠোনে কোথা থেকে ছুটে এসে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকল, আমার বাবা ত্যাজ্য পুত্র। আমার বাবার কিছু লাগবে না। ত্যাজ্য পুত্র। ত্যাজ্য পুত্র।

প্রীতির এই রুদ্রমূর্তি সমর কখনও দেখেনি। তাকে প্রীতি সমীহ করে, ভয় পায়। কিন্তু এটা কী দেখছে! সে না পেরে বলল, ত্যাজ্য পুত্র হয় তো কী করা। তাই হবে। তবু তাকে সামনের প্লট দেওয়া যাবে না। তার ছেলেমেয়ের কী হবে সে ভাববে। কে বলেছিল, মহাআনন্দে এতগুলি সন্তানের পর পর জন্ম দিয়ে যেতে। কাউকে জিজ্ঞেস করেছিল। বলেই সে কেমন হতবাক হয়ে গেল। সেও কী আর এক অমানুষ। বাবা বেঁচে থাকলে তাই বলতেন। যারা এসে গেছে এতে যে তাদের খাটো করা হয়।

সাঁজবেলায় মা সহসা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল—প্রীতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে সমর রক্তের মধ্যে বরফের কুচি ঢুকে যাচ্ছে টের পেল। সে ছুটে গেল মনোজের কাছে, শিগগির আয়। প্রীতি কোথায় চলে গেছে।

প্রিয়ব্রত এসে খবর দিয়ে গেল, প্রীতি তার বাড়িতে চলে গেছে। গিয়েই শুয়ে পড়েছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। কিছু খাচ্ছে না।

সমর নিজেও খেতে বসে খেতে পারল না। তার ওক উঠে আসছে। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করল। কেমন হাসফাঁস করছে। সাপটা যেন এবার সত্যি তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কপালে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। প্রীতি যদি কিছু একটা করে বসে তবে কৈশোরের রাস্তাটাই সে হারিয়ে ফেলবে। ফেলবে, না হারিয়ে ফেলেছে—আবার সেই মৃত বৃক্ষ, এক পাল শকুন গাছের ডালে বসে আছে দেখতে পেল। একধারে মৃত বৃক্ষ, একধারে শকুন, কখনও বাবার চাদরে ঢাকা শেষ বিদায়ের ছবি—এমন সব দেখতে দেখতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল। আর দেখল, একদল শববাহক কাঁধে করে কাকে নিয়ে যাচ্ছে। আরে এ যে সেই মানুষটা, সমর যার নাম! সে শুয়ে আছে। অন্ধকার রাতে বাবার হাতে লণ্ঠন—ছুটে ছুটে আগে যাচ্ছে। সারা রাস্তায় একটাও গাছ নেই, সব মরা গাছ, ডালে ডালে শকুন। দূরবর্তী কোনো গভীর অতীত থেকে কে যেন বলছে, কোথায় যান কর্তা এত রাতে! লণ্ঠন নিয়ে কোথায় যান! বাবা হেঁকে বলছেন, ইস্টিশনে সমুকে তুলে দিতে যাচ্ছি। একা ইস্টিশনে যাবে। যদি ভয় পায়। আর তখনই সহসা সমর এটা কী দেখছে, কী এটা, লাস? কার লাস! গলায় দড়ি। কার লাস! প্রীতি প্রীতি বলে সে চিৎকার করে উঠতেই মা জেগে গেল, কী হয়েছে সমু, এত ঘামছিস কেন। মা হ্যারিকেনটা উসকে মুখের কাছে তুলে ধরে বলল, চিৎকার করছিলি কেন? কী হয়েছে।

কিছু হয়নি মা। সে রুগণ বালকের মতো বলল, মা আমার পাশে এসে শোও। আমার কেমন ভয় করছে। সে মরে যাবে এ-কথা কখনও মনে হয়নি। মা আজ মনে করিয়ে দিল, কে কার আগু পিছু কেউ বলতে পারে না তারা।

মা বলল, ঠিক আছে, তুই ঘুমো। আমি জেগে থাকছি। কী দেখে এত ভয় পেলি বুঝি না বাবা!

সকালে উঠে সমর সবাইকে ডেকে পাঠাল। বলল, জমি নামে নামে রেকর্ডভুক্ত হবে। মার নামেও। সামনের জমি অমর পাবে। জমির প্লট ভাগ হবে না। জমি বিক্রি করে প্রীতির বিয়ে হবে। অবশিষ্ট জমির অংশ বিক্রি করে মার কাজ হবে। কেউ যদি এখুনি পার্টিশন সুট করতে চায় করতে পারে। আদালতে লড়ব। হারলে হাইকোর্ট। আবার হারলে সুপ্রিম কোর্ট। সেখানে হারলে কী করবে, সে আর একটা কথাও বলতে পারল না।

 কারণ সে জানে না, তারপর কার কাছে আপিল করতে হয়। জীবনের কাছে না মৃত্যুর কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *