বুলুর শেষ লুডোখেলা
সিঁড়িতে পা দিতেই অমলেশ টের পেল বিজু এসেছে। বিজুর স্লিপার বারান্দার এক পাশে, ঠিক দরজার মুখে এবং চৌকাঠের বাঁদিক ঘেঁষে থাকে—কারণ এটা স্বভাব বিজুর, সে এলেই তার হলুদ রঙের স্লিপার দরজার বাঁদিক ঘেঁষে রাখবে। অমলেশ দেখল এপাশে বিজুর হলুদ রঙের স্লিপার। দড়িতে ওর মীর্জাপুরি শাড়ি। এ-সব দেখলেই অমলেশ যেন ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে।
এ-সপ্তাহে বিজুর আসার কথা নয়। বিজ আসছে সপ্তাহে আসবে এমন কথা ছিল। চিঠিতেও তেমন লিখেছে। অথচ সহসা এই চলে আসা, এলেই একটা বিস্ময় নিয়ত খেলা করে বেড়ায়, যেন বিজু তার জন্য গ্রাম মাঠ থেকে নানারকমের ফসল সংগ্রহ করে এনেছে। ছেলে দুটো ঘুমিয়ে পড়লেই সে তার সব সংগ্রহ খুলে দেখাবে।
যা হয় অমলেশের—ওর তখন রা-রা করে গান গাইতে ইচ্ছা হয়। গলা জড়িয়ে চুমু খেতে ইচ্ছা হয়। অথচ সে এখন কিছুই পারছে না। যতক্ষণ না টুলু বুলু ঘুমোয়, ততক্ষণ সে চুপচাপ, যেন তার আর তর সয় না, সে যে কি করবে ভেবে পায় না, রান্নার লোকটাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে সে বিজুর পিছু পিছু তখন কেবল ঘুরে বেড়ায়।
অমলেশ বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল। বিজুর গলা পাওয়া যায় কিনা শোনার চেষ্টা করল। ভিতরে কোন সাড়া শব্দ নেই।
অথচ বিজু এলে এমনটা হয় না। চারপাশের যা কিছু অগোছালো, যেমন টুলু বুলুর টেবিল, তার টেবিল, নোংরা ঘর-দোর, বিজু এলেই সব পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে। যে কদিন থাকে ঘর-দোর কি তকতকে ঝকঝকে! আর বিজু চলে গেলেই সংসার বড় অগোছালো হয়ে যায়। ওর পিয়ন এসে দুই ছেলেকে স্কুলে রেখে আসে। বিকেলে সে বাড়ি এসে দুই ছেলেকে নিয়ে পার্কে যায় এবং রাত্রিতে ফিরে এসে ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়লে সে একটা ক্রাইম নভেলে মুখ ডুবিয়ে পড়ে থাকে। ঘর-দোর সাফ সুতরোর ব্যাপারে সে কেমন উদাসীন হয়ে যায় তখন।
আর বিজু এসেই ঘর-দোরের অবস্থা দেখে দু পা ছড়িয়ে ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে বসে। তোমাদের এত বলেও পারি না। লোকজন এলে কি ভাবে!
অমলেশের তখন সত্যি হুঁশ হয়—ওদের পড়ার টেবিলটা সত্যি অগোছালো। যেখানে যা থাকবার কথা সেখানে তা নেই। কোন বই টেবিলের নীচে, কোনটা খাটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পড়ার পর তুলে রাখার কথা ওদের মনে থাকছে না। বুড়ো মাসির পক্ষে এত দেখাশুনো করা কষ্ট। বিজু চলে গেলে সংসারের সবাই কেমন বাউণ্ডুলে হয়ে যায়। আলনাতে জামা-কাপড় ভাঁজ করে রাখে না কেউ। কোন কোন দিন অমলেশ ভয়ে ভয়ে নিজের টেবিলটার দিকে তাকাতে পারে না পর্যন্ত। বিজু এবার তাকে নিয়ে পড়বে। সে যেন ভয়ে ভয়েই তখন কতকটা নিজের টেবিলের বইপত্র, লেখার প্যাড সব সাজিয়ে রাখতে গেলে দেখতে পায়, বিজু তেড়ে আসছে।—হয়েছে থাক। আর কাজ দেখাতে হবে না, যতক্ষণ আছি করে যাব।
একবার অমলেশের সঙ্গে বিজুর এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। বিজু চলে গেলে অমলেশ এবং টুলু বুলু মিলে খুব সাবধানে থাকল। টেবিল, আলনা, বইপত্র যেখানে যা থাকার রেখে দিল। যেদিন আসবে সেদিন সকালে আর একবার গুছিয়ে রাখল সব।
আর বিজু এসেই দেখল, একেবারে চারপাশটা ঝকমক করছে। কোথায় সে এসব দেখে খুশী হবে, তা না, সে ভয়ঙ্কর দুঃখী মানুষের মতো মুখ করে ফেলল। সে যেভাবে সব রেখে গেছে সব প্রায় তেমনি গুছানো। বিজুর মনটা টনটন করে উঠল। সে এতটা শাস্তি আশা করেনি। সে সারাক্ষণ কাজকর্ম ছাড়া বাঁচে না। কাজকর্ম করতে করতে একটু বচসা করা ওর স্বভাব। দুই দামাল ছেলে, ঠিক দুজন নয়, ওর কাছে ওরা তিনজন, কারণ সে এ-সময় কখনও অমলেশকে স্বামী বলে ভাবতে পারে না, যেন ঘরে সে তিন দামাল ছেলে রেখে গেছে—ওরা হুটোপুটি করে সব অগোছালো করে না রাখলে তার হাতে কাজ থাকে না—সে চুপচাপ বসে থাকলে মনে হয় বেড়াতে এসেছে এখানে, সে অমলেশের কাছে বেড়াতে এসেছে। সে এ-সংসারের কেউ নয়।
বিজু এসেই সে রাত্রে আর অমলেশের সঙ্গে কথা বলেনি।
—কি ব্যাপার! অমলেশ প্রশ্ন করেছিল। এসেই একেবারে মুখ গোমড়া করে বসে থাকলো।
কোন কথা না বলে বিজু বাথরুমে চলে গিয়েছিল। সে ঘাড়ে গলায় জল দিয়েছিল। অন্যদিন সে যেমন এসেই আয়নায় মুখ দেখে সেদিন সে তাও দেখেনি। হাত-পা ধুয়ে একটা চাদর গায়ে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিল।
অমলেশ বলেছিল, আরে হয়েছে কি তোমার?
বিজু জবাব না দিলে অমলেশ কেমন উদবিগ্ন গলায় বলেছিল, তোমার শরীর খারাপ! ডাক্তার ডাকব।
বিজু আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সে ফেটে পড়ল।—আহা, বাবুদের চোখে ঘুম নেই। বাস ট্রেন করে এতদূরে আসা—বিজুর কি কষ্ট! সব কাজ ওর আমরা করে রাখি! বিজু এবার উঠে বসল। সে তার বড় ছেলেকে ডাকল, এই টুলু তোরা সবাই মিলে যে খুব সংসারী হয়েছিস!
ঠিক আছে আর কিছু করব না। তুমি এসে বোকার মতো খাটবে।
বিজুর একটা অদ্ভুত অভিমান আছে ভিতরে। কিছু কথা কাটাকাটি হলেই বিজু বলে, সংসার থেকে তাকে ইচ্ছা করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, যেন ইচ্ছা করলেই অমলেশ তাকে এই বড় শহরে নিয়ে আসতে পারে। আনে না, অমলেশের ইচ্ছা নেই তাকে নিয়ে আসার। অমলেশের প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। একটু অনুরোধ করলে কে তেমন মানুষ আছে তাকে অবহেলা দেখায়।
অমলেশ তখন চুপচাপ থাকে। বিজু রেগে গেলে ভীষণ ভয় করে তার। সে কিছুতেই বোঝাতে পারে না, অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না। সুতরাং আজ এসেই আবার বিজুর তেমন কিছু হল কিনা—কারণ সব চুপচাপ, টুলু বুলুর পর্যন্ত সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, অমলেশের চোখে-মুখে অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠছে। সে ঘরে ঢুকে দেখল পর্দাটা নড়ছে হাওয়ায়। এ-ঘরে কেউ নেই। সে দেখল ক্যালেণ্ডারে এসেই বিজু একটা দাগ দিয়েছে, আবার সে কবে আসতে পারবে তার নির্দেশ। সে আর মুহূর্ত দেরি করতে পারল না। পর্দা ঠেলে শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখল, নিবিষ্টমনে মা এবং দুই ছেলেতে কি যেন করছে। টেবিলের উপর চেয়ার রেখেছে বিজু। টুলু বুলু চুপচাপ টেবিলের পাশে। টুলু দু’হাতের ফাঁকে কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে এবং বিজু চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে টুলুর হাত থেকে সেটা নেবার সময় দেখল পিছনে অমলেশ। যেন ধরা পড়ে গেছে এমন সংকোচে সে তাড়াতাড়ি ওটা উপরে রেখে দেবার সময় শুনল অমলেশ বলছে পড়ে গেলে বুড়ো হাড় জোড়া লাগবে না। যেন এসব কথা বিজুকে বলছে না, এই ঘরের দেয়াল, খাট আলনা এসবের উদ্দেশে বলছে।
বিজু কোন উত্তর করছে না দেখে সে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, নাগাল পাচ্ছ না। দাও আমি রেখে দিচ্ছি।
বিজু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, দেখো যেন পড়ে না যায়।
—এত মায়া তোমার!
অমলেশ যে এমন একটা খোঁচা দেবে সে যেন জানত। কারণ চড়াই পাখি দুটো যখন প্রথম এ দেয়ালে এসে বাসা বাঁধে, বিজুর কি রাগ। সে এসেই যতবার দেখেছে মেঝেতে চড়াই হেগেমুতে একেবারে যাচ্ছেতাই করে রেখেছে, তখন সে যে কতবার রাগে দুঃখে পাখি দুটোকে তেড়ে গেছে, আর বলিহারি যাই পাখি দুটোও কি বেহায়া। বিজুকে সারা ঘর ছুটিয়ে মেরেছে, কিন্তু ঘর ওরা ছেড়ে দেয়নি। বিজু প্রতিবার এসেই চড়াই দুটোর বাসা ভেঙে দিত। আর বিজু চলে গেলেই চড়াই দুটো আবার বাসা বানিয়ে নিবিষ্টমনে সুখে-স্বচ্ছন্দে এ-ঘরে উড়ে বেড়াত।
আর এ ব্যাপারেও বিজু অমলেশকে দায়ী করত। এরই কাজ। যেন অমলেশ শলাপরামর্শ করে বিজুকে এভাবে বার বার জব্দ করছে পাখিদের দিয়ে। সুতরাং বিজু ভেবেছিল, চড়াইর ছানাটাকে অমলেশ আসার আগে আগেই তুলে রাখতে হবে। যাতে অমলেশের কাছে সে ধরা না পড়ে। এবং বিজু এবারই প্রথম বাড়ি এসে সব সাফসুতরো করার সঙ্গে পাখিটার বাসা ভেঙে দেয়নি। সে বরং দেখল পাখির একটা ছোট্ট বাচ্চা নীচে পড়ে আছে। বুলু খেলতে যায়নি। সে সারাক্ষণ বাচ্চাটাকে পাহারা দিয়েছে। কারণ পাশের ফ্ল্যাটের বেড়ালটা ওৎ পেতে আছে, কখন বুলু উঠে যাবে এবং সে খপ করে গিলে খাবে।
বিজু যখন এসে দেখল বুলু খেলতে বের হয়নি, যখন দেখল বুলু বলছে দ্যাখো মা বাচ্চাটা এখানে পড়ে আছে, আমি সারাক্ষণ বসে আছি, বাবা এলে বলব তুলে দিতে তখন বিজুর এই ঘরসংসারের মত বাচ্চাটার উপর চড়াই পাখি দুটোর উপর কেমন মায়া পড়ে গেল!
বিজু টেবিলটার একপাশে দাঁড়িয়েছিল। অমলেশ কতটা যত্ন নিয়ে পাখির ছানাটাকে উপরে রাখছে লক্ষ্য করছে। এতক্ষণ ওরা যা গোপন করতে চেয়েছিল, কারণ বুলু যেন ছানাটাকে রেখে দেবার ভিতর টের পেয়েছিল মা সংগোপনে কাজটা করে ফেলতে চায়। সেও মার মতো বাবা এলে একেবারে সব চাপতে চেয়েছিল। মা এলেই বুলু কেন জানি মাঝে মাঝে আজকাল বাবাকে প্রতিপক্ষ ভাবে। অথবা সে যদি বলে দিত, বাবা পাখির ছানাটা পড়ে গেছে, মা তুলে রাখছে, তবে যেন মা বলবে, তুমি বলে দিলে কেন বুলু? যা রেগে যাবে। রেগে গেলেই মা তাকে পাশে নিয়ে শোবে না। বলবে বুলু আমি আজ বাবার সঙ্গে শোব। তোমার সঙ্গে শোব না। সুতরাং বুলু এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে মার এই কাজ সমর্থন করে যাচ্ছিল। সে বাবাকে দেখেও কিছু বলেনি। মা-কে কেন্দ্র করে বুলুর প্রায়ই তার বাবাকে প্রতিপক্ষ মনে হয়। প্রায় বছর হতে চলল, মা তাকে এখানে রেখে গেছে। আগে বুলু থাকত মার কাছে। কিন্তু এখন সে বড় হয়েছে। তাকে পড়াশোনা করতে হবে। বুলু এখন বাবার কাছে থাকে। বুলু এবং টুলু এক বিছানায়—বাবার আলাদা বিছানা, মা এলে কার সঙ্গে শোবে, ওদের সঙ্গে না বাবার সঙ্গে—বুলুর ঘুম আসে না, মা যতক্ষণ না ওকে পাশে নিয়ে শোবে ততক্ষণ সে ঘুমোবে না।
বিজু এলেই বলবে বুলু, মা তুমি কার সঙ্গে শোবে?
—তোমার সঙ্গে।
কিন্তু বুলু টের পায় যেন গভীর রাতে বাবা তার প্রতিপক্ষ। তখন চোখে তার ঘুম আসে না। পাশে হাতড়ায়। মা নেই। মা বাবার কাছে পালিয়ে বনবাসে চলে গেছে। সে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
তখন অমলেশেরও কেন জানি মনে হয়, ছেলে তার প্রতিপক্ষ। সে বিরক্ত এবং অস্বস্তিতে বলে ওঠে, দ্যাখো তোমার ছেলের কাণ্ড। যেন ঠেলে ফেলে দিতে চায় বিজুকে। বিজুকে সে তুলে দিয়ে নিজে একটা নীল রঙের আলো জ্বেলে বসে থাকে। আর তার ঘুম আসে না। সে তখন একটা ট্রেনের শব্দ পায়। যেন কোন দূরবর্তী স্টেশনে একটা ট্রেন আটকে গেছে। বার বার ট্রেনটা হুইসল বাজাচ্ছে।
মাঝে মাঝে অমলেশ খুব ছেলেমানুষের মতো বুলুকে বলবে, তোমার মা কতদূর থেকে আসেন। তোমাদের পাশে শুলে ওর ঘুম আসে না। তোমরা ঘুমের ভিতর মাকে বড় বেশি হাত পা ছুঁড়ে মার। তখন বুলু যেন কিছুই শুনতে পায় না। কেবল ওর মনে হয় সবুজ বনের ভিতর একটা লাল রঙের পাখি তাকে উড়ে উড়ে কোথাও চলে যেতে বলছে। সে মাকে ছেড়ে দিতে ভয় পায়। অথচ অমলেশ, বিজুর এমন সুন্দর শরীর, মসৃণ ঘাড় এবং কোমল মুখ দেখে আর স্থির থাবতে পারে না।
অমলেশ বলল, বাচ্চাটার ডান গজিয়েছে। রাখছি ঠিক, কিন্তু বাচ্চাটা আবার উড়ে পালাবে।
—না পালাবে না। তুমি রাখ। বিজু গোড়ালিতে উঁকি দিয়ে দেখল ঠিকমতো অমলেশ রাখছে কি না।—ওটা ওর বাপের কাণ্ড।
—তুমি জানো খুব। অমলেশ বলল।
—ঠিক জানি। বাপটা ঠুকরে ফেলে দিয়েছে।
—ফেলে দিয়েছে ত ভাল করেছে। কতদিন আর খাওয়াবে। বাপটা চাইছে, আর কতদিন! এবার উড়ে খাওগে।
—ভাল করে উড়তে পারছে কই!
—ঠেলে ফেলে না দিলে কেউ উড়তে চায় না।
—বাজে বকো না। বলে সে অমলেশের চেয়ারটা শক্ত করে ধরল।
অমলেশ এবার ভয় দেখাবার জন্য বলল, বরং কাল পাখিটাকে পাতাবাহারের গাছটায় রেখে আসব। সে ঠিক নিজের মতো উড়ে চলে যাবে কোথাও।
বুলু এবং বিজু একসঙ্গে প্রায় কান্না জুড়ে দেবার মতো।—তুমি কি পাগল। ভাল করে উড়তে শিখল না এখনও, ওটাকে তুমি ছেড়ে দিয়ে আসবে!
—বিজু বাচ্চাটা উড়বার জন্য হাতের মুঠোয় পাখা ঝাপটাচ্ছে। ছেড়ে দেব নাকি! বলে সে বাসাটার ভিতর উঁকি দিল, দেখল, মেয়ে চড়াইটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এতটুকু ভয় পাচ্ছে না। কিংবা উড়ে যাচ্ছে না। সে এবার বিজুর দিকে তাকাল। একটা শর্তে সে পাখিটাকে তুলে দেবে এবং এখন বিজু চোখের দৃষ্টিতে শর্তটা যেন পড়তে পারছে।
বিজু বুঝতে পেরে বলল, সে হবে।
অমলেশ বলল, হবে বল ঠিক, কিন্তু কিছু হয় না। শুয়ে পড়লেই ভোঁসভোঁস করে ঘুমাও।
বিজু চোখ টিপল। টুলু সব বুঝতে পারবে এমন একটা মুখ করে বাসাটার দিকে তাকাল।
হাতের মুঠোয় পাখিটা রেখে এবার অমলেশ বুলুকে বলল, বুলু তুমি বড় হয়েছ।
বুলু বাবার কথায় মার দিকে তাকাল। সে বড় হয়েছে কি না মা ঠিক বলতে পারবে।
অমলেশের মাথায় জিদ চড়ে গেছে। সে বলল, তুমি ক্লাস থ্রিতে পড়। ক্লাস থ্রিতে পড়লে মার সঙ্গে আর শুতে নেই।
বুলুর চোখ ছলছল করে উঠল। সে এখন কিছু বলবে না, অথচ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। বিজুর মনটা তখন ভারি হয়ে আসে। সে যে কার সঙ্গে শোবে ঠিক যেন এ-মুহূর্তে বুঝতে পারে না। কারণ সে সারাক্ষণ ট্রেনে একটা ফসলের মাঠ দেখেছে। এক পাশে দেখেছে একটা সাদা রঙের বাড়ি। বড় একটা জানালা খুললে সে দেখেছে দুই ছেলের হাত ধরে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। তার ভালবাসার বৌ আসছে ফসলের মাঠ ভেঙে। মানুষটার চোখমুখ দেখে বিজু নিজেও স্থির থাকতে পারে না তখন।
বিজু বলল, রাখো। দাঁড়িয়ে আছ কেন?
অমলেশ বিজুর কথা যেন শুনতে পেল না। সে বুলুকে ফের বলল, কি রেখে দেব, না ছেড়ে দিয়ে আসব?
—রেখে দাও বাবা।
অমলেশ এখন বুলুকে ভয় দেখাতে পারলে যেন বাঁচে। ভয়, এই যে পাখির ছানা হাতের ভিতর, ছানা ধরে আছি, এখন ছেড়ে দিয়ে আসব তাকে। জঙ্গলে সে উড়ে গেলে, তুমি বুলু কাঁদবে। অথবা অমলেশ বলবে কি না ভাবল, বুলু এস আজ আমরা আবার বাজিতে বসি।
বুলু আবার বলল, বাবা তুমি রেখে দাও পাখিটা। বুলু, মা কার সঙ্গে শোবে এখনও বলছে না। এবার অমলেশ শেষবারের মতো তার সেই খেলাটার কথায় এল। বলল, ঠিক আছে তবে লটারি হবে।
বুলু অন্য দিন এমন শুনে হাত পা ছুঁড়ে বলত, ঠিক আছে। সে বাবার সঙ্গে লুডো খেলতে বসবে। যে জিতবে সেই মাকে পাবে। ওর মুখ খুশীতে ভরে উঠত।
ওরা খেলতে থাকল। টেবিলের ও-পাশে দাদা, এ-পাশে মা আর মুখোমুখি সে এবং তার বাবা। ওরা দুই প্রতিপক্ষ। তখন সেই নীল রঙের আলোটা জ্বেলে দেওয়া হয় ঘরে। জানালাটা খোলা থাকে। ঠাণ্ডা বাতাস এলে বিজু কোন কোনদিন জানালাটা বন্ধ করে দেয়। কি করুণ দেখায়, তখন অমলেশের মুখ। খেলার সময় সে জোরে জোরে হাঁকে ছক্কা পাঞ্জা। সে তার বয়সের কথা ভুলে যায়। ভিতরে ভিতরে মনে হয় শীতে কাঁপছে অমলেশ। বিজু তখন একটা চাদর এনে শরীর ঢেকে দেয় অমলেশের এবং গোপনে হাতে চাপ দেয়। যেন বলার ইচ্ছা, তুমি খেলতে খেলতে এমন ছেলেমানুষের মতো হয়ে যাও কেন! বুলু জিতছে, জিতুক না। বুলু ঘুমোলে আমি ঠিক তোমার কাছে চলে আসব।
সকলের আগে বুলু টেবিলে এসে বসেছে আজ। সে লুডোর ছক খুলে আজ নিজেই গুটি সাজিয়েছিল। মা এবং বাবা খাচ্ছে। টুলু হাত মুখ মুছে তৈরি হচ্ছিল। কারণ সে বাবার পক্ষে চেঁচায়। মা চেঁচায় বুলুর পক্ষে। হারার মুখে টুলু বাবাকে উৎসাহ দেবে। ছক্কা পাঞ্জা, যেন ওরা পাশা খেলায় বসবে এবার। যেন কুরু পাণ্ডবের সভায় পণ রেখে খেলা হচ্ছে, ভালবাসার পণ, মা কাকে বেশি ভালবাসে, বাবাকে না তাকে। মা এসে বুলুর পাশে সুন্দর শাড়ি পরে বসবে। পাট ভাঙা শাড়ি। মুখে পাউডার। কপালে বড় টিপ। মা তার মাথায় হাত রাখলে সে কেমন সাহস পায়। কেউ তাকে হারাতে পারবে না এমন মনে হয়।
বিজু বলেছিল, প্রথম দান বুলুর।
টুলু বলল, সে কেন হবে। রোজ রোজ বুলু আগে খেলবে কেন! প্রথম দান বাবার।
—আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার। বলে বিজু অমলেশের দিকে তাকাল।
অমলেশ ছকের উপর চেলে দিল—ছক্কা!
বিজু দেখল চৌকো উঠেছে। সে বলল, ফুঁঃ।
বুলু খুব সন্তর্পণে চেলে দেখল পাঞ্জা উঠেছে। আবার পোয়া। ছক্কা পড়ছে না। গুটি বের হচ্ছে না। অমলেশ পর পর তিনবার কোন ছক্কা ফেলতে পারল না। বুলু এবার পর পর তিনটা ছক্কা এবং একটা পোয়া পেয়েছে। অমলেশ হাঁ করে বুলুর খেলা দেখছে। মাথার উপর চড়াই পাখি দুটি ঝুঁকে আছে। নীল রঙের আলো। চারটি মাথা টেবিলে ঝুঁকে আছে। বিজু বুলুকে উৎসাহ দিচ্ছে, টুলু অমলেশকে। মাকে পণ রেখে বাপ ছেলেতে খেলা হচ্ছে। বেশ খেলছে। কি নিদারুণ খেলা, কি অসীম উত্তেজনা, কারণ ঘাম দেখা যাচ্ছে অমলেশের মুখে। অমলেশ হেরে যাচ্ছে।
কিন্তু শেষ দিকে কী হয়ে গেল। অমলেশ পর পর তিনটে পাকা গুটি বুলুর ঘরে ফিরিয়ে দিল। এবং শেষ পর্যন্ত বুলু হেরে গেলে, অমলেশ বলল, তুমি কাঁদবে না বুলু। এখন কাঁদতে বসবে না। মা তোমার সঙ্গে শোবে। আমি জিতে গেছি ত কি হয়েছে। যেন অমলেশ কত মহান আর উদার। জিতে গিয়েও পণ ফিরিয়ে দিতে রাজি।
বুলু কিছু বলল না। সে উঠে গেল নিজের খাটে এবং শুয়ে পড়ল।
বিজু বলল, তুমি সরে শোবে। আমার জন্য জায়গা রাখবে বুলু।
অমলেশ বিজুর দিকে তাকাল। বিজু তাকাল না। সে পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখছে। এখন অমলেশের শুধু প্রতীক্ষা। বুলু কতক্ষণে ঘুমোবে। ঘুমোলেই সে পশুপাখির মতো নির্বোধের হাসি হাসতে থাকে। এবং অমলেশ অন্ধকারে আজগুবি এক জগৎ তৈরি করে নেয় এই সংসারে—বিশ্বাসই হয় না পশুপাখির চেয়ে তারা তখন অন্ধকারে বেশি কিছু দেখতে পায়।
বিজু বলল, তুমি ওকে হারিয়ে দিলে!
—একটু হারতে শিখুক।
বিজু বলল, আস্তে। বুলু শুনতে পাবে। মশারি তুলে বিজু উঁকি দিতেই বুলু পাশ ফিরে শুলো। তুমি সরে শোও। না হলে শোব কি করে!
—আমার পাশে তুমি শোবে না। বুলু কেমন শক্ত গলায় বলল।
বিজু ভাবল অভিমান বুলুর। সে ওকে বুকে টেনে শুলে সে হাত ছুঁড়তে থাকল। বুলু তার মাকে কিছুতেই আজ পাশে শুতে দিল না। দু হাত দু পা ছড়িয়ে জায়গা দখল করে রাখল। এবং বিজু উঠে গিয়ে অমলেশের বিছানায় শুলে মনে হল বুলু ঘুমিয়ে পড়েছে।
মশারির নীচে অমলেশ এত ক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে, তার ইচ্ছা করছিল উঠে গিয়ে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। এত জেদ কেন হবে। অথচ সে জানে বুলুকে মারলে সারারাত বিজু পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে। গায়ে হাত দিতে দেবে না। দিতে গেলেই ছ্যাঁৎ করে উঠবে।
বিজুর ঘুম আসছিল না। সে এক পাশ হয়ে শুয়ে আছে। বুলু না ঘুমিয়ে এখন যদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত তবে সে যেন ওকে পাশে নিয়ে ঘুমোতে পারত। নদীর পারে কোন রেল স্টেশনের মতো বুলু ওর কাছ থেকে ক্রমে সরে যাচ্ছে। বুলু বুঝি টুলুর মতো বড় হয়ে গেল। ওর ঘুম আসছিল না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। এবং বিজুর কেন জানি কেবল এ সময় কান্না পাচ্ছে।
অমলেশ বলল, কাছে এস।
বিজু বলল, আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি এখন ঘুমোব।
বিজু অমলেশের দিকে পাশ ফিরতেই লেপটা তুলে দিল অমলেশ। জানলা খোলা—টুলু ঘুমুচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছে, বুলু বুঝি এখনও ঘুমোয়নি, তবে না ঘুমোলে সে কথা বলতে পারছে না, না ঘুমোলে বুলু পা নাড়ে, মশারি কাঁপছে এবং এই কাঁপুনি থামলেই অমলেশ বুঝতে পারবে বুলু ঘুমোচ্ছে। সে তখন জোনাকির আলো জ্বালতে বসবে।
বিজুর কিছুই ভাল লাগছিল না। শেষ পর্যন্ত সে আলগা সে হয়ে শুতে চাইলে। অমলেশও কোন জোর করল না আর। পাশাপাশি দুজন শুয়ে আছে অপরিচিতের মতো। কোন কথা না। পথে কোন অসুবিধা হল কি না, ওদের কলেজের সুধাদির কি খবর এবং যা হয়ে থাকে, কিছু না কিছু কথা, খেতে বসে, খেয়ে উঠে, মুখ ধুয়ে এবং বিছানায় শুয়ে—কথার শেষ থাকে না। অথচ আজ চুপচাপ।
শেষ রাতের দিকে অমলেশ টের পেল বিজু ওর পাশে নেই। অমলেশ ধড়ফড় করে উঠে বসল। বিজু গেল কোথায়! সে বুলুর বিছানা দেখল, না বিজু নেই।
সে যে এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। অথচ বারান্দায় এসে দেখল দরজা খোলা।
সে কেমন ভয় পেয়ে ডেকে উঠল, বিজু! বিজু! তারপর সে চিৎকার করবে ভাবতেই দেখল, বিজু পাতাবাহার গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে কি যেন খুঁজছে।
—তুমি কি খুঁজছ বিজু।
—পাখিটাকে।
—পাখিটা মানে।
—সেই বাচ্চা পাখিটা। বাথরুমে যাব বলে আলো জ্বেলেছি। পাখিটা এসে আমার মাথায় বসল। ধরতে গেলাম উড়ে জানালা দিয়ে গাছটায় এসে বসল।
—সে ত ভাল হল। উড়তে শিখে গেছে।
—অন্ধকারে কোথায় যাবে বলত! ওত বেশিদূর উড়ে যেতে পারে না। গাছটার কোন ডালে বসে আছে খুঁজে দেখছি। বলে বিজু এ-ডাল ও-ডালের ফাঁকে মোমবাতিটা তুলে ধরে বলছে, দ্যাখ তো আছে কি না!
অমলেশ ম্লান হাসল—এস, ঘরে যাবে। মোমবাতির আলোতে পাখিটাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু বিজু এতটুকু নড়ল না।
ওরা এবার পরস্পর মোমবাতির আলোয় নিজেদের মুখ দেখল। মনে হল ওরা এক দূরবর্তী রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে! একটা ট্রেনের জন্য ওরা অপেক্ষা করছে। এই চেনা মুখ বড় অচেনা মনে হচ্ছে বিজুর। বিজু বেশিক্ষণ সেজন্য তাকাতে পারল না। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। বাঁ হাতে মোমবাতি জ্বলছে বিজুর এবং গলে গলে অন্ধকার ওর চার পাশে জোনাকির মতো উড়ছিল। বিজু পাতার ভিতর মুখ লুকিয়ে রেখেছে। মুখটা পাতার ভিতর মোমবাতির আলোতে কাঁপছে। অমলেশ আর স্থির থাকতে পারল না। বিজুকে গাছের নীচে জোর করে সে চুমু খেল। বিজু অমলেশকে চুমু খেল। মোমবাতির আলোতে আর পাখি খোঁজা হল না। বিজুর চোখে জল এসে গেল।