চীনেমাটির পুতুল

চীনেমাটির পুতুল

শেষরাতে তিনি আজও কান খাড়া করে রাখলেন। কে গায়! কোনো দূরবর্তী মাঠে উদাস গলার স্বর—কাছাকাছি তো কোন মাঠ নেই, শস্যক্ষেত্র নেই! কে গায়! আগে মনে করতেন স্বপ্ন, ভেঙে গেলে মনে হত স্বপ্ন নয়, সত্যি। নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে কেউ তাঁকে ডাকছে। কে সে? ইদানীং ভয়ে ভয়ে আগেই ঘুম ভেঙে যায়। আজও ঘুম ভাঙলে টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখলেন, ঠিক চারটে। শেষ রাত। জানালা খোলা থাকে। রাস্তার আলো জ্বালা থাকে বলে, রাত কত গভীর বোঝা যায় না। শুধু নিঝুম একটা ভাব থেকে, তার তারতম্য থেকে আন্দাজ করতে পারেন রাত নিশুতি, না আরও গভীরে কিংবা শেষের দিকে। জানালা খুলে তিনি দেখতে পান সেই বিশাল আকাশ, আর কিছু নক্ষত্র। যা তার জন্মেও এক ছিল, শেষ রাতেও এক আছে।

কে গায়!

গায়, না তিনি নিজের মধ্যেই কোন উদাস গানের সুর সঞ্চার করেন। শুনতে পান যেন সে আর কেউ নয়, তিনি নিজেই।

জানালা খুললে কিছু গাছপালা নজরে আসে। সামনে পাকা রাস্তা। ছিমছাম সব কিছু। সামনে বড় স্কুলবাড়ি। স্কুলবাড়ির মাঠটায় কেউ দাঁড়িয়ে গাইছে না তো! না সেখানে কেউ নেই। গানের কোন শব্দ স্পষ্ট নয়। অদ্ভুত এক ব্যঞ্জনা সেই সুরের। যেন বলে যায় কেউ, এক অন্ধকার থেকে আর এক অন্ধকারে যাত্রা!

আসলে বয়স হলে মানুষের বুঝি এমনই হয়। তিনি ভয় পাচ্ছেন। এক অন্ধকার থেকে আর এক অন্ধকারে যাত্রা কেন?

শেষ রাতের দিকে এইসব বাড়ির জানালায় বেশ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যায়। পাখা চালাতে হয় না। তিনি নিজে অন্তত ঘুম ভাঙলে পাখা বন্ধ করে দেন। পাখার আওয়াজে তাঁর মনে হয় তিনি বিভ্রমে ভুগছেন। পাখাটা বন্ধ করে দিলে চরাচরের গোপন সত্য ধরতে পারবেন তিনি—কিন্তু কে গায়, কোথায় গায়, গানের অস্পষ্ট শব্দমালায় হতচকিত হয়ে নিদারুণ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। তখন নিজেই মনে করে নেন, আসলে কেউ তাঁকে সতর্ক করে দিচ্ছে—নিজের একাকিত্বে এত বিচলিত কেন! সারাজীবন খড়কুটো সংগ্রহ করেছ, এখন তোমার ছুটি। তোমার অপেক্ষায় কেউ আর বসে নেই।

বুকটা তাঁর এত খালি কখনও হয়ে যায় নি। স্ত্রীর মৃত্যুর সময়েও না। তিনি পুত্রকন্যাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বল ভরসা খুঁজেছিলেন, শক্ত ছিলেন। ক’দিন থেকে তাও কে যেন হরণ করে নিয়েছে।

বালিশের পাশ থেকে চশমাটা তুলে নিলেন। চোখে ভাল দেখতে পান না। চশমাটা কত বল ভরসা না পরলে বোঝা যায় না। তিনি যে অক্ষম নন, চশমাটা পরলে টের পান। আগে এদিকটায় ফাঁকা মাঠ ছিল। বাড়িটা করার সময় সবাই তাঁকে কিছুটা মাথাখারাপ লোক ভেবেছিল। যামিনীকে জমিটা দেখিয়ে তিনি বোকা বনে গেছিলেন। বাস-স্ট্যাণ্ডে উঠে হাউহাউ করে কান্না—এ-কেমন জায়গায় জমি কিনলে। অঘ্রান মাসে হাঁটু জল।

বেশ নিচু জায়গায় জমি। কিছুদূর দিয়ে জ্যাংরার দিকে একটা খোয়ার রাস্তা চলে গেছে। তিনি বলেছিলেন, এত কম টাকায় কলকাতার কাছাকাছি আর কোথায় জমি পাবে যামিনী!

যামিনী কোন কথা বলেনি আর।

জমিটা কেনার পর মনে হয়েছিল, জীবনে এমন শখ না জন্মালেও পারত তাঁর। যা আয়, নিজের সংসার, মা বাবা সবাই মিলে বড় টানাটানি যায়। তবু কি যেন থাকে মনে। দারিদ্র্য বড় ক্ষোভের বস্তু। আজীবন ছুটিয়ে মারে। আজীবন ভাবনা, বাসাবাড়ি, চাকুরি, মৃত্যু এবং অক্ষমতার যে কোন একটা তাঁকে অপদস্থ করলে তিনি ফুটপাথের মানুষ। নিজের জীবন দিয়ে যে দুর্ভাগ্য ভোগের অধিকারী তিনি ছিলেন, পুত্র-কন্যাদের জীবনে তা ঘটবে ভাবলে তাঁর হাঁটু কাঁপত। কেমন নিরুপায় মানুষের মতো তখন পুত্রকন্যা এবং স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

সেই নিরাপত্তা বোধের অভাবই তাঁর বোধহয় সহায় ছিল শেষ পর্যন্ত। একটা জমি, বাড়িঘর, এবং ছাদের নিচে আশ্রয় পাবার জন্য কী না অমানুষিক পরিশ্রম গেছে তাঁর। কী না ব্যাকুলতা!

এ-সময়ে মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল তাঁর! ফাঁকা বাড়িতে একা মানুষের এই হাসি বড় নির্জীব!

কেন হাসলেন?

মনে পড়ল শ্রীমানের জন্মদিনের কথা। ঝড় জল ভেঙে হাসপাতাল। মফস্বল শহরে বাস তাঁর তখন। এমনি আশ্বিনে তাঁর বড় পুত্রের জন্ম। এমনি শেষ রাতে তিনি আজকের মতো উদ্বেগে পায়চারি করছিলেন। কান্না—কোথাও তিনি নবজাতকের কান্না শুনতে পান। দুহাত দুমড়ে মুচড়ে বলছে, আমি এসেছি। আমি খাব। আমার জায়গা চাই। আসলে যে যার জায়গার খোঁজ পেয়ে গেলে সংসারে কেউ কারো না।

জায়গা তিনি সবার জন্য করতে পেরেছেন। শুধু এ-বয়সে দেখছেন, নিজের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে।

জানালার পাশে এক গ্লাস জল থাকে। জলের গ্লাসটা তুলতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। জীবনটা পোকা-মাকড়ের মতো মনে হচ্ছিল।

দোতলার জানালায় দাঁড়ালেই দেখা যায়, কত সব ঘরবাড়ি। এই সব ঘরবাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকে হাজার রকমের সুখ-দুঃখ। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না, এক অতি নিরন্তর নিঃসঙ্গতা অন্তরালে কাজ করে যায়। সব একদিন কেমন অর্থহীন মনে হয়।

আকাশে কিছু মেঘের ওড়াউড়ি চলছে। এই জানালাটা তাঁর ভারি প্রিয়। যামিনী বেঁচে থাকতে সব লক্ষ্য রাখত। ইজিচেয়ার পাতা থাকত। এখানে বসে, সকালের সূর্য ওঠা থেকে পাখি ওড়া সব দেখতেন। খাল পার হয়ে যে বড় উপনগরী তৈরি হচ্ছে, সেখানে তখন ঘরবাড়ি ছিল না। শুধু নিরন্তর মাঠ আর কাশবন। অনেক দূরে দেখা যেত একটা সাদা মত বাড়ি। কেমন রহস্যময় লাগত বাড়িটাকে। ঝাউগাছের গ্রীন ভার্স তৈরি হচ্ছে তখন। আর খালের এপারে সব জলা জমি ধানের খেত। দেখতে দেখতে সব কোথায় ক’বছরে হারিয়ে গেল।

এগুলো তিনি কেন ভাবছেন! কিছুই তো ভাবার কথা না। সব ঘরগুলো ফাঁকা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেল। বড় চলে গেল বাইরে। ছোট ছিল। বউমা ছিল। আর ছিল বাপ্পা। কতদিন থেকে সেই ছোট শিশুটি তার একাকিত্বের সঙ্গী ছিল। তারাও ফ্ল্যাট কিনে চলে গেল! এই চলে যাওয়াটা যে কী করুণ কেউ বুঝল না!

আমি দাদু যাব না।

না, যাও। তোমার স্কুল কাছে হবে।

আমি তো এখান থেকেই যেতাম।

যেতে। এখন যেতে কষ্ট।

কে বলে!

কে যে বলে বুঝি না!

বাপ্পা বায়না ধরেছিল। ছোট বলল, আপনি বুঝিয়ে বলুন। ও তো বোঝে না, এতদূর থেকে কত অসুবিধা!

সেই।

কে যেন মনের কোণ থেকে উঁকি দিয়ে বলল, কী বুঝছ!

কিছু না।

বুঝতে চাও না। সব করলে কার জন্য!

সেই।

ছোটর সেই এক কথা, আপনার বউমার কষ্ট হয় এতদূর থেকে রোজ ট্রেনে যেতে।

তিনি শুধু বলেছিলেন, আমার জন্য ভেব না। আমার চলে যাবে।

ওরা চলে যাবার পর ক’দিন খুব উতলা হয়েছিলেন। কিছু আর করার নেই। কারো জন্য আর ভাবতে হবে না। ঠিকঠাক সবাই বাড়ি ফিরে এল কি না বারান্দায় দাঁড়িয়ে আর অপেক্ষা করার কেউ নেই। মুক্তি। মুক্তি। এ সময়ে তাঁর চোখে জল দেখা দিল।

সেই পাখির বাসার মতো, নিরন্তর ঝড় বাদলায় খড়কুটো সংগ্রহ করা—বাসা তৈরি। ডিম ফুটলে ছানা-পোনার আহার। তারপর উড়ে যাওয়া। পাখির কোন নিঃসঙ্গ বেদনা থাকে না। মানুষের কেন যে থাকে!

তখনই মনে হল কে ডাকে, দাদু, আমি!

কে!

আমি! চিনতে পারছ না, তোমার ছোট আমি।

ছোট আমি বলে কী বলতে চায়!

কেউ যেন দৌড়ে বড় উঠোন পার হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুরদা লাঠি নিয়ে বের হচ্ছেন। তাঁরা সেই ছোট আমি সঙ্গে। সকালবেলায় ঠাকুরদা গোপাট ধরে হাঁটেন। তারা ক’ভাই। কখনও ঠাকুরদা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা ছুটে বেড়ায়। চোখে দেখতে পান না—অথচ অভ্যাস এতকালের, কোথায় কি গাছ, কোন বৃক্ষলতা বড় হয়ে উঠেছে টের পান। কী জমজমাট! উত্তরের ঘরে ঠাকুরদা ঠাকুমা, দক্ষিণের ঘরে বৈঠকখানা, পুবের ঘরে বড় জেঠি, পশ্চিমের ঘরে সোনা জেঠি, কামরাঙা তলার ঘরে ছোট কাকী থাকেন—ছোটরা বড়রা মিলে সারাদিন ঠাকুরদার চারপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে রাখে। দাদুর শেষ জীবনটা ছিল ভারি বর্ণাঢ্য। মৃত্যুর সময় ঘোড়ায় চড়ে এসেছিল অবিনাশ কবিরাজ, উত্তর-দক্ষিণে যত আত্মীয়স্বজন সবার বাড়ি বাড়ি লোক গেল, খবর দিল কর্তার সময়কাল উপস্থিত। শেষ দেখা দেখে আসুন। ঠাকুরদা নিজেও বুঝেছিলেন। সাদা বিছানায় সাদা চাদরে শুয়ে। সবাই আসছে—দাদু বলছেন, কে?

আমি হেমন্ত।

কে তুমি?

আমি নন্দ।

তরমুজের জমি, চাষ আবাদ সব ঠিকঠাক আছে তো!

আছে কর্তা।

বিলের জমি হাতছাড়া শোনলাম।

মামলায় সাক্ষী পেলাম না কর্তা।

দাদুর মুখে সরল হাসি। যে বোঝে সে বোঝে।

এক অন্ধকার থেকে অন্য কোনো অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আগে ডানা ঝাপটানো। ঘোড়ার পায়ের শব্দ কোথাও। কবিরাজ এসে দেখেছিল, বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতে ভর্তি। বড় জেঠিমা, সোনা জেঠিমা হেঁশেলে। সিংবাড়ির অন্নদা কুয়ো থেকে কেবল জল তুলছে। দাদুর ইহলোক ত্যাগের আগেকার ছবিটা কেমন ঝুলে থাকল কিছুক্ষণ চোখের উপর। হরিনাম সংকীর্তন, নাপিত-বাড়ির হরকুমার খোলে চাঁটি মারছে। করতাল বাজাচ্ছিল গৌর সরকার। দাদু সাদা চাদর গায়ে সব শুনছিলেন, আর মাঝে মাঝে বলছিলেন, সবার খাওয়া হল! যেন কত সোজা একটা রাস্তায় রওনা হয়েছেন। বরবেশে কোথাও যাত্রা! সবার খাওয়া হলেই পালকিতে চড়ে বসা। দুই পুরুষ আগেকার এমন মৃত্যুর ছবি এই শেষ রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি মনে করতে পারছিলেন। সঙ্গে অভ্যাসবশে কাজ করে যাওয়া। সব ঘড়িগুলোতেই আগে দম দিতেন। এখন একটাতে এসে ঠেকেছে। হাতে নিয়ে দুবার চাবি ঘোরালেন, তারপরই মনে হল, হাতটা তাঁর অসাড় লাগছে। ঘড়ি মিলিয়ে এ-বাড়িতে আজ আর কারো স্নান আহার করার দরকার নেই। নীল রঙের বাসে তুলে দেবার জন্য কারো হাত ধরে আজ আর হাঁটতে হবে না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। চাবি দিতে ভুলে গেলেন। ঘড়িটা হাফ দম খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকল।

সারারাত জল পড়ার শব্দ আজ তিনি শুনতে পেয়েছেন। যেন বাপ্পা রোজকার মতো দাদুকে রাগিয়ে দেবার জন্য চৌবাচ্চার কল খুলে রেখেছে। তিনি ছুটে গেছেন। না কেউ কল খুলে রাখেনি। কেউ অন্যমনস্কভাবে, কলটা বন্ধ করতে ভুলে যায় নি। তার নজর এত তীক্ষ্ণ হয়ে গেছিল শেষ দিকটাতে কিংবা শ্রবণশক্তি, যে কোথাও বিন্দুমাত্র দাগ ধরলে দেয়ালে, ঘুণপোকা বাসা করলে ঠিক টের পেতেন। বউমা বউমা, দেখ এসে দেখ, কার আঙুলের ছাপ।

কার আবার হবে! আপনার নাতির।

এ-বাড়িতে সবাই জেনে গেছিল, বাপ্পার সাতখুন মাপ। সবাই নিজের দোষ বাপ্পার উপর চাপিয়ে রেহাই পাবার চেষ্টা করত।

লক্ষ্মণের কাজ।

লক্ষ্মণ বাড়ির কাজের লোক। সকালে আসে। রান্নাবান্না করে দিয়ে চলে যায়। বউমা লক্ষ্মণের উপর চোটপাট হবে ভয়ে কত সহজে মিছে কথা বলত, না না, লক্ষ্মণ জানে দেয়ালে হাত দিলে ছাপ ধরে যায়। সে করবে কেন! আসলে বউমা ভয় পায় চোটপাটের ঠেলায় লক্ষ্মণ না আবার পালায়। এরা মিছে কথা আজকাল কত সহজে বলতে পারে। আসলে বাড়িটার চেয়ে লক্ষ্মণ তাদের কাছে বেশি মূল্যবান।

মিছে অজুহাত দেখিয়ে ছোট সহজে এজন্য চলেও যেতে পারল। এই ছোট একবার দেরি করে ফেরায় কি হাউহাউ কান্না। তখন ছোট কলেজে পড়ে। বড় নির্ভরশীল ছিল তারা পরস্পরের। ধরে ধরে বড় হওয়া অথবা বলা যায় কালাতিপাত করা। দায় কারো না। নিজেরই। এই দায় বহন করতে পারার মধ্যে একটা গৌরববোধ কাজ করত। আমি এবং আমার, আমি এবং আমার পুত্র, আমি এবং আমার পুত্র কন্যা, বি-এ বি-টি, কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনীয়ার—আমি এবং আমার অস্তিত্ব এম-এ বি-টি পাস। তার সঙ্গে বাড়িঘর। উপর নিচ মিলিয়ে ছটা শোবার ঘর। টাইল বসানো, ফ্লোরোসেণ্ট বাতি, দেয়ালে প্লাস্টিক কালার। সোফাসেট বাতিদান—কারুকার্য করা জীবনপ্রবাহ। জানালায় ভেলভেটের পর্দা। দক্ষিণের বাতাসে দোলে। সিঁড়ি সাড়ে তিন ফুট। চার ফুট করার ইচ্ছে ছিল। কাজকর্মের বাড়িতে সরু সিঁড়ি অসুবিধার সৃষ্টি করে। তিনতলায় ঘর করার দরকার নেই। উপরে সামিয়ানা টাঙিয়ে এক লপ্তে দু’শো জন খাওয়ানো যাবে। সবটাই আমার, আমার অস্তিত্বের শিকার। ওরা এখন বাপ্পাকে নিয়ে এম-এ বি-টি হতে চায়। এম-এ বি-টি পাস, সোজা কথা না। প্রধান শিক্ষক নীলরতন বসু। কাঁধে পাটভাঙা চাদর, করিডরে হাঁটার সময় দৃপ্ত ভঙ্গি। জেলা বোর্ডের প্রেসিডেণ্ট। কত কিছু অস্তিত্বের শিকার—এখন শুধু সামনে ফাঁকা মাঠ। একটা ঘড়িতে তার চাবি দেবার কথা। তাও দিতে গিয়ে হাত অসাড়।

মনে হল ঘড়িটা থেমে গেছে। তিনি শেষ রাতের আলোতে বুঝতে পারছেন না। তবে ঘড়ির বুকে শব্দ হয়—শব্দটা থেমে গেছে। আলো জ্বেলে বুঝলেন, ঘড়িটার স্বভাব ইদানীং বেয়াড়া রকমের। চাবি দিয়ে কিছুক্ষণ কানের কাছে না ঝাঁকালে বাবুর কাঁটা নড়ে না। হাফ দম দিয়ে ফেলে রাখলে ঘড়ি শুনবে কেন! ঘড়িটা আরও বেয়াড়া হয়ে উঠছে।

তিনি বললেন, বেটা তুইও শোধ তুলছিস।

ঘড়িটার কাঁটা দুবার নড়ল। আলো জ্বালা বলে মাকড়সার ঠ্যাংয়ের মতো মনে হচ্ছে। কতকাল দম দিয়ে ঠিক রেখেছেন। অয়েলিং করেছেন কতবার। আবার তেল গ্রীজ খেতে চায়। ঘড়িটা নিজেও ক’বার খুলে কারিগরি করেছেন। ঘড়িটা নিয়ে আবার কেন জানি তাঁর বসতে ইচ্ছে হল। কারণটা তিনি ঠিকই জানেন, কিছু নিয়ে পড়ে থাকা অভ্যাস মানুষের। এককালে, প্রকৃতি, তার উদাস মাঠ, বিদ্যালয়, এককালে বাবা-মার গ্রাসাচ্ছাদন, ভাই-বোনেদের বড় করা—সোজা কথায় কর্তালী করার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করা এবং পরে যামিনী, পুত্রকন্যা সব নিয়ে আবার ঠেলে উজানে নৌকা নিয়ে যাওয়া—সারাজীবন একজন মাঝি আর নৌকার সম্পর্ক যেমন থাকে আর কি!

ঘড়িটা নিয়ে বসার আগে তাঁর কেমন চা খাবার বাসনা হল। বাসনাগুলো আছে বলেই রক্ষা। যদি না থাকত, তিনি আছেন, অথচ তাঁর আর কোন বাসনা নেই, তবে তো মৃত ঘোড়া। এখনও কতটা টগবগে ভাবার জন্য বেশ দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন। অন্ধকারে পায়ের মধ্যে কি একটা ঠেকল। সিঁড়িটার এদিকটায় তিনি হাঁটেন না বড়। ছোট এ-ঘরটায় থাকত—পড়ত। ডাক্তারি পড়াটা এত বিদঘুটে তিনি যদি জানতেন। আস্ত মানুষের কঙ্কাল একটা না হয় থাকলই ঘরে! তাই বলে মানুষের আলগা সব যন্ত্রপাতি এনে ঘরটা যে ভরে ফেলা কেন! মানুষের ভিশেরা এবং লিভার দেখতে এমন কদাকার! আর উৎকট ফরমেলিনের গন্ধে ঘরে ঢোকাই দায়। বছর দুই এ-সব ঘরটায় জাঁকিয়ে ছিল। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার আগে সব বিদেয় করে দেওয়া হল। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। দক্ষিণা কালীর পূজা এবং চণ্ডীপাঠ। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন। সন্ধ্যায় মনে হয়েছিল তাঁর বাড়িটার আবার তিনি শুচিতা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। এবং রাতে চাদরের নিচে কী একটা শক্ত কিছু লাগতেই উঠে বসেছিলেন। কী লাগে! হাত দিয়ে মনে হয়েছিল একটা শক্ত কিছু। চাদর তুলে মনে হয়েছিল স্পঞ্জের মতো কি যেন—নরমও নয়, খুব শক্তও নয়। ছোটকে ডেকে বলেছিলেন, এটা এখানে কি দেখতো!

ছোট দেখে বলল, নাকের হাড়!

সব যে তোর কাছ থেকে কে কিনে নিয়ে গেল! এটা এখানে এল কি করে!

সেই তো।

তিনি জানেন ছোটর স্বভাবটা বড় এলোমেলো। কঙ্কালটা সে নিয়ে এসেছিল একটা বড় বেতের ঝুড়িতে। দু-দফায় আনতে হয়েছে। এক জায়গায় বসে এক নাগাড়ে পড়তে পারে না বলে, এখানে ওখানে সব ঘরে, কেবল ঠাকুরঘর আর রান্নাঘর বাদে কি-ভাবে যে কঙ্কালটার অজস্র হাড় এখানে সেখানে পড়ে থাকত! মানুষের মধ্যে কত হাড় থাকে তার হিসাব ছোট রাখে। কলেজের নতুন ছেলেটি যখন ঝুড়িটা সহ হাড়গোড়গুলি কিনতে এল, বার বার তিনি বলেছিলেন, মিলিয়ে নিও। ছোটর কিছু ঠিক থাকে না। কোথাও কিছু পড়ে থাকল কি না….।

 ছোট, ছেলেটিকে বলেছিল, সবই আছে। এদিক ওদিক দু-একটা পড়ে থাকলে তোমায় খবর দেব।

 সেই থেকে তিনি প্রায়ই প্রশ্ন করতেন, আর নেই তো!

 ছোট বলেছিল, নেই।

তারপর বছর না ঘুরতেই বিছানার নিচে কি করে যে একটা নাকের হাড় ভেসে ওঠে!

 সেই থেকে কখনও অন্ধকারে কিছু শক্ত মতো পায়ে ঠেকলে ভাবেন, ছোটর সেই কঙ্কালের হাড়। সে কবেকার কথা—অথচ সেই আতঙ্কটা তাঁর এখনও আছে। নিচের ঘরের জানালা বন্ধ থাকে বলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এখনও এ-বাড়িতে কঙ্কালটা তবে আছে! আসলে প্রেতাত্মা এবং কঙ্কাল, সংসারে নানাবিধ সংস্কার মানুষের—সবই কিন্তু কিম্ভূতকিমাকার। আলোটা জ্বালতেও ভয় পাচ্ছেন। কাউকে যে ডাকবেন তারও উপায় নেই। এখন একটা বুড়ো মানুষ খালি বাড়িতে প্রেতাত্মার ভয়ে ছোটাছুটি করছে ভাবতে গেলেও লজ্জা। বরং উপরে উঠে যাওয়া যাক। বাড়িটা ফাঁকা বলে তেনার উপদ্রব বাড়তেই পারে। কোনরকমে তবু আলোটা জ্বাললেন। বড় ঘাম হচ্ছে। দেখলেন পায়ের কাছে পড়ে আছে বাপ্পার একটা চীনেমাটির কড়ে আঙুলের মতো পুতুল।

পুতুলটি হাতে নিতেই মনে হল তিনি একা নন। তাঁর দোসর বাপ্পার পুতুল। সুতরাং পুতুলটি তিনি রান্নাঘরে নিয়ে একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখলেন—চা করলেন গ্যাসে। তারপর এক হাতে পুতুল অন্য হাতে চা। তিনি পুতুলটিকে সামনে বসিয়ে ঘড়ি মেরামত করতে বসলেন। কথাবার্তা পুতুলটার সঙ্গেই হচ্ছে।

—বাপ্পা তোমাকে আদৌ ভালবাসে বলে মনে হয় না।

পুতুলটা বলল, হ্যাঁ ভালবাসে।

ভালবাসলে ফেলে যাবে কেন।

ওর কত কাজ। স্কুলের পড়া আছে না। বাপ্পার মা তো আমার উপর রেগে সব সময় টং হয়ে থাকতো।

তিনি ঘড়িটা একটা ছোট ছুরি দিয়ে খুলে ফেললেন এ-সময়। কাপ তুলে চা খেলেন। তারপর যেন কিছু বলা—বলতে হয় বলে বলা—তুমি বাপ্পার সঙ্গে সব সময় খেললে রাগ তো করবেই।

বাপ্পার মাও তো খেলে। ওই তো নিয়ে গেল—কেবল সারাদিন পেছনে লেগে থাকবে। পড় পড় বলবে। এটা খেলা না!

কখনও না। সকালবেলা আর সন্ধ্যায় পড়বে। আমি বলে দিয়েছি, বিকেলে ওকে খেলতে দিও।

 দেবেই না। একগাদা টাসক দিয়ে বসিয়ে রাখবে। এখানে এসব পারতো না বলেই তো চলে গেল।

মিছে কথা। স্প্রিংটা সহ ঘড়িটা তিনি কানের কাছে ধরে তখন বললেন।

সত্যি কথা। তোমার উপদ্রবে বাপ্পার মা চলে গেল। তুমি না কিছু বোঝা না!

আমার উপদ্রবে!

তা-ছাড়া কী। তুমি এত আসকারা দিলে ও মানুষ হবে কি করে?

পুতুলটির এত কথা শোনার পর তিনি কেমন আরও গুম মেরে গেলেন।

সকালে বাপ্পা এসে দুষ্টুমি করত। তা করবে। না করলে বাড়িটা বাড়ি মনে হবে কী করে! চশমাটা নিয়ে দৌড়াত। দু-হাত ভর করে চশমা চোখে দিয়ে বিছানায় উবু হয়ে শুত। কখনো তাঁর বাঁধান দাঁত লুকিয়ে মজা করত। সকালবেলাতে প্রায় দাদু নাতি এই নিয়ে উপর নিচ ছোটাছুটি চলত। বউমার মেজাজ তখন ভারি অপ্রসন্ন হয়ে থাকত। বউমা যত অপ্রসন্ন হত তিনি তত মজা পেতেন। বাপ্পাও। আমার বাড়ি, আমার নাতি, তুমি কোথাকার কে হে—ওর ভাল-মন্দ তুমি আমার চেয়ে বেশি বোঝ!

নাও এবার। শুধু নিজে গেল না, ঘাটি বাটি সুদ্ধু নিয়ে চলে গেল। একা থাকার কী মজা বোঝ এবার!

তিনি কেমন মিইয়ে গেলেন। তারপরেই কী মনে হতে বললেন, এই একটা কাজ করবে?

কী কাজ?

আমার নাতি তুমি। সকালবেলাটায় ঠিক আগের মতো উপর নিচ ছুটোছুটি চলবে। কে বন্ধ করে দেখি!

সেই ভাল।

তারপর নিজেই বোকার মতো হেসে ফেললেন। কী যে পাগলামি করছেন বাপ্পার পুতুলটার সঙ্গে। তারপরেই মনে হল, পুতুল, না সেই কঙ্কালটার বুড়ো আঙুলের হাড়। আলোর কাছে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকলেন। কখনও মনে হচ্ছে বুড়ো আঙুলের হাড়, অথবা কখনও চীনেমাটির পুতুল। বেঁচে থাকার পক্ষে কোনটা এখন বেশি দরকার। একটা মরা মানুষের বুড়ো আঙুলের হাড় না, বাপ্পার চীনেমাটির পুতুল! কোনটা? কোনটা! চীনেমাটির পুতুল! এটা সত্যি চীনেমাটির পুতুল! বুড়ো আঙুলের হাড় না। না—না না। এই তো কথা বলছে, আচ্ছা তুমি নিচে সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে চাও। বাপ্পার মত আমাকে উপর নিচ হয়রানি করতে চাও। সেই ভাল। তুমি আর যাই হয়ে যাও একটা কঙ্কালের হাড় হয়ে যেও না। হ্যাঁ হ্যাঁ যা বলবে শুনবো–এই তো যাচ্ছি। আরও জোরে! ছুটছি তো।

লাফিয়ে লাফিয়ে নামো। আমি কেমন সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে নামছি দেখ। কতকাল, কতবার সিঁড়ি ধরে নামব উঠব, তুমি পারবে না কেন।

হ্যাঁ আমি পারব। বাপ্পার সঙ্গে পেরেছি, তোমার সঙ্গেও পারব। তিনি হাতে পুতুলটা নিয়ে নিচে উপরে দ্রুত নামতে উঠতে থাকলেন। যেন কথা না শুনলে চীনেমাটির পুতুলটা বায়না ধরেছে, কঙ্কালের বুড়ো আঙুলের হাড় হয়ে যাবে।

লক্ষ্মণ এসে দেখল সদর বন্ধ। অন্যদিন খোলা থাকে। সকালে বুড়োকর্তার জলখাবার, দুপুরের খাবার করে দিয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যায় এসে আর এক প্রস্থ কাজ। রাত্রে ডাক্তারবাবুর ফ্ল্যাট পাহারা। সদর খোলা নেই কেন! বুড়ো মানুষটা বারান্দাতেও নেই। সে বেল টিপল। লোডশেডিং হতে পারে। সে কড়া নাড়ল। একবার দু’বার। পরে জোরে, খুব জোরে। দরজাটা আজ কেউ খুলে দিল না।

দরজা ভাঙলে দেখা গেল সিঁড়ি ধরে নেমে আসার পথে তিনি দুহাত বিছিয়ে পড়ে আছেন। স্ট্রোক, অথবা দুর্ঘটনা। সবাই দেখল হাতের মধ্যে কিছু একটা আছে। কী ওটা! হাতে দিতেই ছোট টের পেল, মানুষের বুড়ো আঙুলের হাড়। মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটিকে সোজা রাখে হাড়টা। সে, হাড়টা গোপনে বাবার হাত থেকে তুলে নিল। কঙ্কালের হাড়টা সব বাড়িতে শেষ পর্যন্ত কেন যে থেকে যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *