মৃত্যুদ্বীপ – ৫

পাঁচ

আর্কটিক আইস ফিল্ড।

সকাল আটটা চল্লিশ মিনিট।

মাত্র দু’ঘণ্টা বিশ মিনিট পর পৃথিবী ধ্বংস করবে অ্যাটমোস- ফেরিক ওয়েপন।

আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকার ভিতর রয়েছে দুটো মিল। একটা হচ্ছে: প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং দ্বিতীয়টা কিলার ওয়েইল।

এ ছাড়া অনেক তফাৎ দুই মেরুর।

অ্যান্টার্কটিকা মস্ত ভূখণ্ড, লক্ষ লক্ষ বছর আগে তাকে ঢেকে দিয়েছে তুষার ও বরফ। এদিকে আর্কটিক হচ্ছে প্রকাণ্ড বরফের চাঁই দিয়ে তৈরি জমাট সাগর। উত্তর মেরুবিন্দু রয়েছে ভাসমান বরফের মাঠের মাঝে। উনিশ শ’ তেপান্ন সালে সাবমেরিন ইউএসএস নটিলাস পৌঁছেছিল মেরুবিন্দুতে। ছয় বছর পর বরফ ফাটিয়ে ভেসে উঠেছিল ইউএসএস স্কেইট সেইখানে।

প্রতি বছর মার্চ মাসে প্রথমবারের মত আকাশে ওঠে সূর্য। এবং তখন থেকে গলতে শুরু করে বরফের মাঠ। জমাট সাগরে তৈরি হয় অসংখ্য ফাটল। ওগুলোর নাম: লিড্‌স্। যতই গরম পড়ে, ক্রমেই আরও চওড়া হতে থাকে এসব খাল। শেষে দেখা যায় জমাট সাগরে হাজারে হাজারে লিস্। কোনও কোনওটা তিরিশ ফুট গভীর, অন্যগুলো অত্যন্ত অগভীর। এসব লিডের রাজ্যে অক্সিজেন নেয়ার জন্য ভেসে ওঠে সিল ও ছোট তিমি মাছ, এবং তাদেরকে মনের সুখে সাবাড় করে মেরু ভালুক।

কারও ঘাঁটিতে হামলা করবার ভাল পথ হতে পারে লিডগুলো। সাগরে ভাসমান বরফ স্ক্যান করতে পারে ল্যাণ্ড-বেড্ রেইডার, কিন্তু বরফের মাঠ থেকে নীচে নেমে যাওয়া লিড দেখবার সাধ্য নেই তাঁর।

এসব লিডের ভিতর কী আছে দেখতে হলে আকাশযান থেকে নীচে চাইতে হবে।

আর এটা জানে বলেই দুই খুদে অ্যাসল্ট বোট নিয়ে প্রধান সব লিড ধরে পতিত বেরিভের দিকে চলেছে রানা।

এখন পর্যন্ত কোনও বিধ্বস্ত বিমানের দেখা পায়নি ওরা।

সকাল আটটা একচল্লিশ মিনিট পেরোবার পর প্রধান লিডের মাঝে প্যানকেক আকৃতির ছোট এক ভাসমান বরফের মাঠ দেখল রানা।

ওই ধবল মাঠে কাত হয়ে পড়ে আছে সাদা কী যেন।

একদম নড়ছে না।

‘ওটা কী…’ রেডিয়োতে বলল নিশাত।

বোটের গতি কমাল রানা, চলে গেল ভাসমান মাঠের খুব কাছে।

এবার বোঝা গেল সাদা জিনিসটা কী।

‘মেরু ভালুক,’ বলল রানা।

‘ভাল, এবার জানব মিস্টার কুয়াশার রেপেলেন্ট কাজ করে কি না, বলল নিশাত। ‘সান, নেমে পড়ো। ওটার পেট চুলকে দিয়ে এসো।’

‘পরে কখনও, আপা,’ বলল রানা। বরফের মাঠের আরেক পাশে পৌছে গেছে। চুপ করে পড়ে থাকা ভালুকটাকে দেখা গেল পরিষ্কার। ‘মারা গেছে।’

কোনও শিকারির বুলেটের আঘাতে শেষ হয়নি ওই ভালুক।

ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে কণ্ঠনালী। ক্ষত-বিক্ষত পেট। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি।

‘যিশু, একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে,’ বিড়বিড় করল সান।

‘কিন্তু খাওয়া হয়নি,’ মন্তব্য করল রানা, ‘এটা অস্বাভাবিক।’

‘ঠিকই বলেছেন, মিস্টার রানা,’ বলল ফারিয়া। ‘চরম নিষ্ঠুর শিকারি পোলার বেয়ার। এ এলাকায় অন্য শিকারি প্রাণীও নেই যে এ কাজ করবে। ধরে নেয়া যায়, একে খুন করেছে আরেকটা বড় ভালুক। দুটো কারণে এ কাজ করবে: চরম খিদে, অথবা এলাকার দখল বজায় রাখতে। শত্রুকে শেষ করে তার লাশ খায় বিজয়ী পোলার ভালুক— পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী। খাবার পেলে সঙ্গে সঙ্গে পেটপুজো করে। মানুষের লাশ বা অন্য ভালুক— সবই খায়। কিন্তু এই ভালুককে খুন করে চলে গেছে। পোলার বেয়ার কখনও এ কাজ করে না।’

‘কোনও গুলির ক্ষত আছে?’ জানতে চাইল নিশাত।

‘না,’ কয়েক সেকেণ্ড ভালুকটাকে দেখল রানা। ওটা প্রকাণ্ড, গায়ের সাদা লোমে কাদার মত লেগে আছে রক্ত। বোঝা গেল না কে বা কারা ওটাকে খুন করেছে।

চট্ করে মনে পড়ল রানার, ওরা পৌছে গেছে পোলার আইল্যাণ্ডের তিরিশ মাইলের ভিতর।

‘এবার রওনা হওয়া উচিত,’ বলল ও, ‘খুঁজে বের করতে হবে বিমানটা।’

গর্জে উঠল রানার বোটের অলস ইঞ্জিন, ছিটকে সামনে বাড়ল ওরা।

পিছনে পড়ে রইল মৃত ভালুক।

বিশ মিনিট চলবার পর চওড়া একটা মোড়ে থামল ওরা। এখানে একটা যোগচিহ্ন তৈরি করেছে প্রধান দুই লিড। ওদের দুই বোটের দু’পাশের প্রাচীর উঠেছে বারো ফুট। দু’ঘণ্টার বেশি হলো রওনা হয়েছে ওরা। বুঝতে পারছে, কো-অর্ডিনেটস অনুযায়ী পৌছে গেছে পড়ে যাওয়া বেরিভ বিমানের খুবই কাছে।

বোট থেকে মই নিয়ে বরফের দেয়ালে আটকে নিল রানা, উঠতে লাগল। নীচে বোটে রয়ে গেল দলের সবাই, অসহিষ্ণু। উপরের দিকে চেয়ে আছে।

মইয়ের উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে বরফের মাঠে চোখ বোলাল রানা।

ওই যে!

পতিত রাশান বিমান।

বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে।

বামদিকে কাত হয়ে আছে। নাক তাক করেছে দক্ষিণ দিকে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে টেইল সেকশন। ফিউজেলাজ গড়াতে শুরু করতেই তার ওজনে মট করে ভেঙেছে বাম ডানা। বিমানের ওপাশে পশ্চিমে বিস্তৃত বরফের মাঠ। এখানে ওখানে অগভীর ও গভীর লিড।

বহুদূরে দক্ষিণে প্রথমবারের মত পোলার আইল্যাণ্ড দেখল রানা।

দিগন্তের কাছে আকাশ থেকে ঝুঁকে এসেছে উঁচু দ্বীপ। ছোট মনে হলো। কিন্তু পরিষ্কার দেখা গেল এবড়োখেবড়ো সব পাহাড়ের উপর জড় হয়েছে ঘন মেঘ। এত দূর থেকেও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক মনে হলো মৃত্যুদ্বীপটাকে।

চট্‌ করে আকাশে চোখ রাখল রানা।

না, কোথাও কোনও সার্ভেইল্যান্স এয়ারক্রাফট নেই।

ভোরের মত লালচে আকাশের অনেক উপরে ভাসছে মেঘ। দক্ষিণ দিকে বা দ্বীপের উপরে কী যেন ঝিলমিল করছে।

বহুদূরে কী যেন।

খুব ছোট। অলসভাবে উড়ছে।

আকাশের অনেক উপরে।

ওটা কোনও সার্ভেইল্যান্স বিমান নয়।

সে-তুলনায় অনেক ছোট।

হয়তো আর্কটিকের কোনও পাখি।

বিড়বিড় করে কপালকে দোষ দিল রানা।

এই মিশনের জন্য তৈরি ছিল না। কোনও প্রস্তুতিও নেই।

বেসামরিক কয়েকজনকে নিয়ে চলেছে মস্ত বিপদের দিকে।

সার্ভেইল্যান্সের কোনও ইকুইপমেণ্ট নেই।

কপাল ভাল থাকলে ওয়েভগাইড রেইডার বা প্যারাবোলিক ডিস্ক থাকত। চট্ করে দেখে নিত আশপাশের আকাশে শত্রু বিমান আছে কি না।

সার্ভেল্যান্সের জন্য রয়েছে শুধু নিজের চোখ।

এবং চোখ যথেষ্ট নয়।

‘আপা, উঠে আসুন। সঙ্গে বন্ধুকে আনবেন। অন্যরা বোটে অপেক্ষা করুক।’

এমপি-৭ হাতে বরফের মাঠে উঠে এল রানা, শত্রু মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।

একটু পর ওর পাশে পৌছে গেল নিশাত। দু’জনের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিল বন্ধুকে।

বিপ্ আওয়াজ ছাড়ল খুদে রোবট। ছোট ছোট চাকার উপর ভর করে ঘুরে গেল।

বন্ধু ঘুরে যেতেই খপ্ করে হেকলার অ্যাণ্ড কচ জি৩৬এ২ অ্যাসল্ট রাইফেল ঘোরাল নিশাত।

আমেরিকার বেশিরভাগ রেকন ফোর্স এম৪ ব্যবহার করে, কিন্তু এবার মেরিনদের কাছ থেকে জার্মানদের তৈরি জি৩৬এ২ অ্যাসল্ট রাইফেল চেয়ে নিয়েছিল নিশাত। এই অস্ত্রের রয়েছে নানা কারিগরী। সবচেয়ে বড় সুবিধা: ওটার রয়েছে সি-ম্যাগ ড্রাম ম্যাগাযিন। এক শ’টা বুলেট আঁটে। নলের নীচে এজি৩৬ গ্রেনেড লঞ্চার। ব্যবহার করে যিঙ্ক-টিপড্ ইনসেনডিয়ারি গ্রেনেড। সঙ্গে যেইস আরসিএ রিফ্লেক্স সাইট ও ওরলিকন কনট্র্যাস্ এলএলএম০১ লেসার লাইট মডিউল। এসব রয়েছে, কিন্তু দেখলে মনে হবে উঠে এসেছে অস্ত্রটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমা থেকে।

নিজের ছোটখাটো এমপি-৭ একবার দেখল রানা, তারপর চাইল নিশাতের হাতের জি৩৬-এর দিকে। ‘ওটার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করবেন, আপা?’ মৃদু হাসল ও।

‘কোনও কামান?’ চারপাশ দেখে নিল নিশাত। ‘মন্দ হতো না।’

‘বন্ধু, চারপাশ দেখে নাও,’ বলল রানা। ‘তারপর বের করো দক্ষিণ আকাশে ওটা কী।’

‘সবই তো দেখছি, বন্ধু রানা,’ উদাস সুরে বলল রোবট, অপটিকাল লেন্স তাক করেছে আকাশের দিকে।

ওকে পিছনে রেখে বিমানের দিকে রওনা হয়ে গেল রানা ও নিশাত। বাগিয়ে ধরেছে অস্ত্র।

বেরিভের পাশে পৌছে হেলমেটের থারমাল-ভিশন স্কোপ চালু করল রানা।

ভেঙে পড়া বিমানের উপর তাক করেছে ইনফ্রা-রেড।

গরমের তাপ আসছে ডানার উপর বসে থাকা ইঞ্জিন থেকে। আর ককপিটে রয়েছে মনুষ্য আকৃতির দুটো কী যেন। অস্পষ্ট, কিন্তু মৃদুভাবে দপদপ করছে লাল রঙে।

‘দু’জনের সিগনেচার,’ বলল রানা। ‘বোধহয় এখনও বেঁচে আছে।’

হঠাৎ চমকে গেল ও। ইয়ারপিসে কড়কড়ে স্বরে বলে উঠল সিল টিমের নেতা নটি এরিক: ‘পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পুব কোণে পজিশন নিয়েছি। এবার পানির নীচ দিয়ে ঢুকে পড়ব পুরানো সাবমেরিন ডকে।

যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে সিল টিম।

বিমানের দিকে মনোযোগ দিল রানা, সাবধানে সামনে বাড়ছে। ফাটল ধরা ককপিটের উইণ্ডশিল্ডের পাশে চলে গেল। বারকয়েক গড়িয়ে গেছে বিমানটা। ভিতরে ঢোকা যাবে না চেপ্টে যাওয়া পাশের দরজা দিয়ে। অস্ত্রের বাঁট ব্যবহার করে ককপিটের জানালা ভেঙে ফেলল রানা। জি৩৬ হাতে ওকে কাভার দিল নিশাত, দরকার পড়লে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে।

রানা দেখল, ককপিটে দুই ফ্লাইট সিটে এলিয়ে পড়ে আছে দুই লোক। পাইলটের সিটে এখনও স্ট্র্যাপে আটকে আছে বয়স্ক এক লোক, ঠোঁটের উপর ঝোপের মত ধূসর গোঁফ। পার্কার বুকে লেখা: ডক্টর ম্যাকসিম তারাসভ।

গুঙিয়ে উঠল লোকটা।

ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে তার পাশে পৌছে গেল রানা। চট্ করে পরীক্ষা করল ক্যারোটিড আর্টারি।

‘ইনিই বোধহয় মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, এখনও বেঁচে আছেন,’ বলল রানা। পার্কার ফার্স্ট-এইড পাউচ থেকে হিট-প্যাক নিল ও, চেপে ধরল তারাসভের বুকে। আগের চেয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিতে লাগলেন রাশান বিজ্ঞানী

রানাকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় লোকটার সামনে গেল নিশাত।

এ তরুণ এক সৈনিক। পরনে রাশান আর্মির পোশাক। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। কিন্তু নিশাতের হাতের গোটা দুই মৃদু চড় খেয়ে ঘোঁৎ করে উঠল অচেতনতার ভিতর।

তার পাশের সিটে জ্ঞান ফিরেছে ম্যাকসিম তারাসভের। রাশান ভাষায় বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। তারপর আমেরিকান পার্কা পরা রানা ও নিশাতকে দেখে ইংরেজি ব্যবহার করলেন, ‘জানতে পারি আপনারা কারা?’

‘আমরা বাংলাদেশি সায়েন্টিফিক টেস্টিং টিমের সদস্য,’ বলল রানা। ‘আমেরিকানরা আপনার ডিসট্রেস সিগনাল পেয়ে আমাদের জানিয়েছিল। আমরা এসেছি সে কারণেই। আপনি…’

চমকে গেল রানা।

বাইরে শুরু হয়েছে গুলির আওয়াজ।

চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা ও নিশাত।

কিন্তু গোলাগুলি হচ্ছে দূরে।

আওয়াজটা আসছে ইয়ারপিসের মাধ্যমে।

হাতুড়িমাথা নটি এরিকের কণ্ঠ শুনল রানা।

সিল টিম নেতা চিৎকার করছে।

মনে হলো মস্ত বিপদে পড়েছে দল নিয়ে।

সোভিয়েত আমলে পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পুবের ক্লিফ কেটে তৈরি করা হয়েছিল সাবমেরিন ডক। লড়াই চলছে ওখানে। চৌকো কংক্রিটের গুহা গেছে পাথুরে ক্লিফের গভীরে। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের আর সব দালানের মতই বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সাবমেরিন ডক।

ভিতরে রয়েছে দুটো সাবমেরিন বার্থ, খ্যাপা প্রকৃতির হাত থেকে পুরোপুরি নিরাপদ। পাশাপাশি থাকতে পারে একটা নিউক্লিয়ার ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন ও একটি তিরিশ হাজার টন বাল্ক ক্যারিয়ার। ডকের শেষে সাধারণ রেল লাইনের দ্বিগুণ চওড়া রেল লাইন। তার উপর দিয়ে এসে থামত মস্ত আকারের লোকোমোটিভ। পুরনো সোভিয়েত আমলে ফ্রেইটার থেকে রেলগাড়ির উপর চাপিয়ে দেয়া হতো কার্গো— ওয়েপন, ওয়েপন গ্রেড নিউক্লিয়ার মেটারিয়াল, নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদি।

অবশ্য, বর্তমানে বার্থে রয়েছে অস্বাভাবিক দুটো জিনিস।

প্রথমটি ডকে লাল খোলওয়ালা প্রায় নিমজ্জিত এক রাশান ফ্রেইটার, ইচ্ছে করেই আধ ডোবা করা হয়েছে ওটাকে। ঝুঁকে তলিয়ে গেছে বো। পানি থেকে এখনও জেগে আছে স্টার্ন। ওখানে সাদা রঙে লেখা ভেসেলের নাম: মস্কোভা।

ওটা রহস্যময় রাশান ফ্রেইটার। হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিল প্রচুর অস্ত্র ও অর্ডন্যান্স নিয়ে। জাহাজে ছিল একে-৪৭, আরপিজি, স্ট্রেলা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ভেহিকেল, যালা এরিয়াল ড্রোন, আরপিআর টর্পেডো ও দুটো মির মিনি সাবমারসিবল।

শেষের জিনিসদুটোর একটা এখনও রয়ে গেছে ফ্রেইটারের প্রায় নিমজ্জিত ফোরডেকে। ক্ষতি হয়নি সাবমারসিবলের কাঁচের তৈরি গম্বুজ বা নিরেট দেহে।

ডকের পাশে প্রায় তলিয়ে গেছে মস্কোভা, এ ছাড়া মস্ত কংক্রিটের গুহা একেবারেই ফাঁকা। বহুদিন ব্যবহার করা হয়নি এদিকটা। দেয়ালে দেয়ালে মই, ক্যাটওয়াক ও চেইন। ধুলো ও তুষারে ঢাকা পড়েছে সব।

রানা জানে না, কিন্তু নেভির সিল টিম দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। প্রথমটি নিঃশব্দে বরফ-ঠাণ্ডা পানি থেকে মাথা তুলেছে। এখানে ওখানে ভাসছে খুদে সব বরফের চাঁই। সাইলেন্সার লাগানো এমপি-৫এন সবার হাতে। নটি এরিকের দলের প্রথম লোকটি ডকে উঠে যাওয়ার পর পিছু নিয়েছে দ্বিতীয়জন। এরপর ডকে উঠতে চেয়েছে নটি এরিক।

টেক্সট বুক এন্ট্রি করেছে তারা। সামান্যতম আওয়াজও করেনি। কিন্তু ঠিকই তৈরি হয়েছে সমস্যা।

ডকের চারপাশে নানান জায়গায় খাপ পেতে বসে ছিল কমপক্ষে এক শ’জন সশস্ত্র লোক। পুরনো আবর্জনা ও প্রায় তলিয়ে যাওয়া মস্কোভা ফ্রেইটারের চারপাশে আড়াল নিয়েছে তারা। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে সিল টিমকে।

আমেরিকার বারোজন যোদ্ধা ডকে উঠতেই গুলি শুরু করল তারা।

চাঁদমারীর টার্গেটগুলোর মতই ঝাঁঝরা হতে লাগল সিল টিম। নিখুঁত লক্ষ্য, উপায় রইল না কোথাও পালাবার।

ঝাঁক ঝাঁক গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে হাতুড়িমাথা নটি এরিকের চিৎকার শুনল রানা।

‘শুয়োরের বাচ্চারা! ওরা এক শ’রও বেশি! ডুব দে! ডুব দে!’

হৈ-চৈ আর গোলাগুলি চলছে।

‘বেস, নটি এরিক বলছি! আক্রমণ ব্যর্থ! শালারা অপেক্ষা করছিল সাবমেরিন ডকে! কচুকাটা করছে! নিউ মেক্সিকো! আমরা ফেরার চেষ্টা করছি! নিউ মেক্সিকো, কাম ইন!’

দশ মাইল দূরে নীল আর্কটিক সাগরের নীচে অপেক্ষা করছে অ্যাটাক সাবমেরিন ইউএসএস নিউ মেক্সিকো। কমিউনিকেশন সেন্টারে রেডিয়ো অপারেটার মাইকে বলল, ‘হাতুড়িমাথা, ইউএসএস নিউ মেক্সিকো থেকে বলছি! শুনেছি আপনার…’

‘আরে শালা…’ রেডিয়ো অপারেটারের পাশের কন্সোল থেকে চেঁচিয়ে উঠল সোনার অপারেটার। টর্পেডো! পানিতে টর্পেডো! সিগনেচার রাশান এপিআর-৩ই টর্পেডোর! বেয়ারিং ২৩৬! দ্রুত আসছে পোলার আইল্যাণ্ড থেকে!’

‘লঞ্চ করো সব কাউন্টারমেযার!’

‘আমাদের ওপর লক করেছে…

চুপ করে আমেরিকান সাবমেরিনের লোকগুলোর কথা শুনছে রানা, চিন্তিত।

‘সরে যাওয়ার চেষ্টা…’

‘সম্ভব নয়! খুব বেশি কাছে!’

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে!’

‘আঘাতের জন্যে তৈরি হও! ধূশালা! সর্বনাশ…’

হঠাৎ কেটে গেল ইউএসএস নিউ মেক্সিকোর রেডিয়ো সিগনাল।

হাতুড়িমাথা নটি এরিকের চিৎকার শুনল রানা: ‘নিউ মেক্সিকো? কাম ইন! ইউএসএস নিউ মেক্সিকো, সাড়া…’

ওই সাবমেরিন থেকে আর কোনও উত্তর এল না।

অবাক চোখে রানার দিকে চাইল নিশাত।

চুপচাপ শুনছে রানা।

‘আরে, শালা! ধূর!’ ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল নটি এরিক। আরও বাড়ল গুলির আওয়াজ। তারপর হঠাৎ করেই বিচ্ছিন্ন হলো রেডিয়ো সিগনাল।

আরও কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করল রানা ও নিশাত।

কেউ কিছুই বলছে না ওদিকে।

‘খাইছে,’ প্ৰায় ফিসফিস করল নিশাত। ‘স্যর, এক শ’জন লোক অপেক্ষা করছে? এমন কোনও দল, যারা শেষ করতে পারে গোটা সিল টিম? ডুবিয়ে দিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস-ক্লাস অ্যাটাক সাবমেরিন? রাফিয়ান আর্মির এরা আসলে কারা?’

ওই একই কথা ভাবছে রানাও।

‘ওরা যারাই হোক,’ ভাঙা ককপিট দিয়ে পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে চাইল রানা। ‘আমরা পৃথিবীর এদিকে একমাত্র দল, যারা ঠেকাতে চাই ওই আর্মিকে।’

.

টানটান উত্তেজনা চেপে লিডের ভিতর অ্যাসল্ট বোটে বসে আছে রানার দলের অন্যরা।

দুই বোটের থ্রটলের সামনে সান ও ম্যাক পাওলো। দরকার পড়লে ঝড়ের গতি তুলে ভাগবে।

ফারিয়া আহমেদ ও জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল মইয়ের দিকে চেয়ে আছে, আশা করছে যে-কোনও মুহূর্তে ফিরবে রানা ও নিশাত।

এদিকে ব্যস্ত হয়ে রিস্টগার্ড পরীক্ষা করছে পবন।

প্রিয় বিজ্ঞানী কুয়াশার হাই-টেক ডিভাইস ঠিক কাজ করছে না বলে গম্ভীর হয়ে গেছে ওর চেহারা। অথচ, জিনিসটা আগে ঠিক ছিল।

ওটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক মিশনের কথা ভুলে গেছে ও।

চট্ করে রিস্টগার্ডের উপরের প্যানেল খুলে ফেলল পবন। চোখ রাখল ভিতরের যন্ত্রাংশে।

খুদে একটা পার্টস্ অন করল। সঙ্গে সঙ্গে পিঁপ-পিঁপ আওয়াজ ছাড়ল রিস্টগার্ড। বারবার জ্বলতে শুরু করেছে লাল একটা বাতি।

ভুরু কুঁচকে গেল পবনের।

‘আশ্চর্য তো! আমাদের পাশে তিন শ’ ফুট লম্বা জিনিস কোথা থেকে আসে!’

‘ওটা সাগরের বরফ হতে পারে? জানতে চাইল সান। চারপাশের বরফের দেয়াল দেখছে ও।

‘না, তা নয়। জিনিসটা ধাতব। রিস্টগার্ডের সেন্সরগুলো ভাল করেই চেনে কোনটা বরফ আর কোনটা লোহা। আস্তে করে মাথা নাড়ল পবন। ‘এরকম করছে কেন? কারণ কী? …ও, বুঝতে পেরেছি!’

রিস্টগার্ডের ওয়ায়ারিঙের ত্রুটি বুঝেছে।

‘কাত হয়ে গেছে এমিটার মিরর। কোথাও গুঁতো লেগেছিল। সর্বক্ষণ নীচে তাক হয়ে আছে এমিটার আয়না।’

এবার পবনের বদলে ভুরু কুঁচকে ফেলল সান।

‘একমিনিট! আপনার ওই নষ্ট যন্ত্র জানাচ্ছে আমাদের ঠিক নীচে তিন শ’ ফুট লম্বা ধাতব জিনিস আছে?’

‘তা-ই তো বলছে,’ মাথা দোলাল পবন। ‘ওটা কতটা কাছে?’ জানতে চাইল সান।

‘দুই শ’ গজ দূরে… না… একমিনিট। এক শ’ নব্বুই… এক শ’ আশি। …ওটা যা-ই হোক, কাছে চলে আসছে।’

ঝুলে গেল তরুণ ববের চোয়াল। চট করে চাইল যেদিকে আছে বেরিভ বিমান। ‘খারাপ খবর,’ নিচু স্বরে বলল সে।

বেরিভ বিমানের ভাঁঙা উইণ্ডশিল্ডের কাছে বিপ আওয়াজ শুনে ঘুরে চাইল রানা।

‘মেজর রানা,’ রোবটিক স্বরে ডাকল বন্ধু, ‘ওই জিনিস চিনতে পেরেছি।’

‘দেখাও,’ এখনও বেরিভের ভিতর তারাসভের পাশে রানা। ককপিটের ভাঙা জানালা টপকে ঢুকল রোবট। পিঠ ফিরিয়ে দেখাল ডিসপ্লে স্ক্রিন।

ওদিকে চেয়ে চমকে গেল রানা। ‘সর্বনাশ!’

‘জিনিসটা রাশানদের তৈরি যালা-৪২১-০৮ আনম্যাণ্ড এরিয়াল ভেহিকেল,’ বন্ধু বলল, ‘রেকনেসেন্স ও সার্ভেইল্যান্সের কাজ করে। কোনও অস্ত্র নেই। ইলেকট্রিক ইঞ্জিন। ডানা আশি সেন্টিমিটার। উড়তে পারে একটানা নব্বুই মিনিট। সাধারণত সঙ্গে থাকে ৫৫০ টিভিএল ইনফ্রা-রেড কেপেবল ভিডিয়ো ক্যামেরা। আরও আছে ১২ মেগাপিক্সেল ডিজিটাল স্টিল ক্যামেরা।’

প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বিমান থেকে বেরিয়ে এল রানা, ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। চোখ রেখেছে দক্ষিণের আকাশে।

ওই যে পাখির মত জিনিসটা।

কিন্তু আসলে ওটা পাখি নয়।

ড্রোন বিমান।

হালকা ওজনের ছোট সার্ভেইল্যান্স ড্রোন।

‘ওরা জানে আমরা এখানে,’ আপন মনে বলল রানা।

যেন ওর কথার প্রেক্ষিতেই দক্ষিণ দিগন্তে দেখা দিল চারটে কালো আকাশযান, মাঝের দুটোর চেয়ে দু’পাশের দুই উড়োজাহাজ বড়। সব আসছে পোলার আইল্যাণ্ডের দিক থেকে।

প্রতি সেকেণ্ডে বড় হয়ে উঠছে আকারে।

তুমুল গতি।

আসছে ঠিক এদিকেই!

‘মেজর রানা!’ গলা ফাটিয়ে ডাকল বব বউলিং। ‘মিস্টার হায়দারের রিস্টগার্ডের প্রক্সিমিটি সেন্সর কাজ করছে! উনি বলছেন আমাদের নীচে ওটা একটা সাবমেরিন! খুব দ্রুত আসছে!’

ঝড়ের মত কাজ করছে রানার মগজ।

ড্রোন… অগ্রসরমাণ এয়ারক্রাফট… যুদ্ধে হেরে গেছে হাতুড়িমাথা নটি এরিক… ডুবে গেছে আমেরিকান সাবমেরিন… আর এখন হাজির হয়েছে আরেকটা সাবমেরিন…

সর্বনাশ!

বড় ঝটপট ঘটছে সব।

বরফের এই ফাঁকা মাঠে মাত্র কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে কী লড়বে ও?

উপযুক্ত অস্ত্রও তো নেই।

এক সেকেণ্ড পর হাল ছেড়ে দিল রানা।

না, এ মূহূর্তে মগজে কিছুই ঢুকবে না ওর।

কিন্তু এটা বুঝতে পারছে, এখন প্রথম কাজ বেঁচে থাকা।

যদি বাঁচতে পারে, পরে সবই মনে গুছিয়ে নিতে পারবে।

‘বব!’ গলা ছাড়ল রানা, ‘ইঞ্জিনদুটো চালু রাখো! …আপা! ওদের দু’জনকে ককপিট থেকে বের করুন! ভাগতে হবে!’

.

চার এয়ারক্রাফটের দুটো ভি-২২ অসপ্রে, অন্য দুটো এএইচ-১ কোবরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার। গত চারমাস আগে আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রভিন্স থেকে চুরি হয়েছিল মেরিন কর্পসের এসব এয়ারক্রাফট।

অসপ্রেগুলোকে আকাশের ভয়ঙ্কর দানব বললেও ভুল হবে না। কাত রোটরের কারণে বিমানের মত বা হেলিকপ্টারের মত উড়তে পারে। ভাসতে পারে ভ্রমরের মত। এসব অসপ্রের নাম: ‘ওয়ারবার্ড’। অস্ত্রে বোঝাই। প্রতিটির সঙ্গে একটা করে নয়, দুটো করে ২০এমএম ছয় ব্যারেলের এম৬১ ভালকান কামান, দরজার উপর .৫০ ক্যালিবারের এএন/এম২ মেশিনগান। এ ছাড়া, ডানার নীচে মিসাইল ভরা পড়। ওয়ারবার্ডকে সর্বকালের সেরা গানশিপ বলা হয়। মস্ত আকার, ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, অথচ প্রচণ্ড গতি, চট্ করে সরে যেতে পারে যে-কোনও দিকে। ওই জিনিসের দুটো দখল করেছে রাফিয়ান আর্মি নামের সংগঠন!

অন্য দুই এয়ারক্রাফট, বা কোবরা কপ্টারও লাজুক-লতা নয়। অসপ্রের কামানের চেয়ে সামান্য ছোট এম১৩৪ ছয় ব্যারেলের মিনিগান আছে কপ্টারের ছুঁচোর মত নাকের নীচে।

বজ্রের মত আওয়াজ তুলে বরফের মাঠের উপর দিয়ে ছুটছে দুই অপ্রে, মাঝে কোবরা কপ্টার। সাঁই-সাঁই করে অসংখ্য পানিভরা লিডের উপর দিয়ে আসছে বেরিভ বিমানের দিকেই।

বিমান বিধ্বস্ত এলাকার কাছে পৌছেই ঝট করে ঝাঁক থেকে একপাশে সরে গেল এক অসপ্রে, রওনা হলো উত্তর-পশ্চিম লক্ষ্য করে। সোজা পতিত বেরিভের দিকে তেড়ে গেল অন্য তিন এয়ারক্রাফট।

ঝাঁকের সঙ্গে রয়ে যাওয়া অসপ্রের পাইলট মাইকে বলল, ‘বেস, মাথাছেলা বলছি।’

তার মাথায় মেরিন কর্পসের ট্যাকটিকাল ফ্লাইট হেলমেট, গায়ে শীতের ওয়ারফেয়ার পার্কা। ঘাড়ে ও চোয়ালে একের পর এক উল্কি— সবই সাপ, লতা ও করোটির। হাতে উযবেক গ্লাভস, পায়ে রাশান বুট।

পিছনের হোল্ডে বসে আছে ঘাড়ে ও চোয়ালে উল্কি আঁকা আটজন, প্রত্যেকে চিলির লোক। পরনে নানাধরনের আর্কটিক গিয়ার। হাতে একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল।

‘আমরা তারাসভের বিমানের কাছে পৌছে গেছি,’ জানাল মাথাছেলা। ‘ওটার দিকে দু’জন লোককে যেতে দেখেছে ড্রোন। এরা বোধহয় লিডের ভেতর দিয়ে এদিকে এসেছে। নইলে পোলার আইল্যাণ্ডের রেইডার আগেই দেখত।’

পাইলটের ইয়ারপিসে খুব শান্ত একটা কণ্ঠ ভেসে এল: ‘আগেই জানি এমন হতে পারে। এরা বাংলাদেশি সায়েন্টিফিক টেস্টিং টিম।’ কর্কশ, নিষ্ঠুর হাসি শুরু হয়েই থেমে গেল। ‘বোধহয় ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে পেন্টাগনের সবাই, নইলে বাংলাদেশের মত সামান্য একটা দেশের অশিক্ষিত ক’টা বিজ্ঞানীকে পাঠাত না। মিসাইল মেরে উড়িয়ে দাও তারাসভের বিমান। তারপর খতম করে দেবে টেস্টিং টিমের সবাইকে।’

বেরিভ বিমানের ককপিটে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রানা ও নিশাত।

তরুণ রাশান সৈনিককে ফ্লাইট সিট থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিশাত, বেরোতে শুরু করেছে ককপিটের ভাঙা জানালা দিয়ে।

বিজ্ঞানী তারাসভের পাশে পৌছে সিট থেকে তাকে সরিয়ে নিতে চাইল রানা। কাজের ফাঁকে ওর চোখ গেল কাত হওয়া ককপিটের জানালার দিকে। চমকে গেল। দুই কোবরার একটা থেকে ছোঁড়া হয়েছে দুটো হিট সিকার মিসাইল।

বাতাসে পাক খেতে খেতে আসছে ওগুলো। নাক তাক করেছে বিধ্বস্ত বিমানের ককপিট লক্ষ্য করে।

গর্জে উঠল রানা, ‘বন্ধু! মিসাইল স্ক্র্যাম্বলার! জলদি!’

বেরিভ বিমানের বাইরে থেকে জবাব দিল খুদে রোবট, ‘মিসাইলের মগজ নষ্ট করে দিচ্ছি, বন্ধু।’ ভয়ঙ্কর শক্তিশালী শর্ট- রেঞ্জ ইলেকট্রনিক জ্যামিং চালু করেছে রোবট।

ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ করেই খেপে গেল দুই মিসাইল, ছিটকে রওনা হলো আরেকদিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর বিমান থেকে পঁচিশ গজ দূরে গিয়ে নাক গুঁজল বরফের মাঠের ভিতর। দুই বিস্ফোরণে ছিটকে উঠল আগুন ও বরফের কুচি।

তারাসভের সিটবেল্ট খুলতে গিয়ে আটকে গেছে, টানা- হ্যাঁচড়া করছে রানা। লকের উপর জমেছে বরফ।

‘আপা!’ ডাকল রানা, অসঙ্গে ল্যাণ্ড করলে অস্ত্রসহ লোক নামবে, তার আগেই বোটে ফিরে যান!’

‘আর আপনি, স্যর?’ পাল্টা চেঁচাল নিশাত।

‘আগে একে বের করব! পিছনে আসছি! দেরি করবেন না!’

ঝিমিয়ে থাকা তরুণ রাশান সৈনিককে পাকড়ে ধরে দৌড় লাগাল নিশাত। বেরিভ থেকে বোট পর্যন্ত যেতে পেরোতে হবে পঞ্চাশ গজ ফাঁকা জায়গা। কিন্তু তার মাঝে রয়েছে একটা কোবরা কপ্টার, ওটা থেকে ছোঁড়া হলো মিসাইল।

কিন্তু ছিটকে আরেকদিকে রওনা হলো মিসাইল, মাথা খুঁড়ল বরফের মাঠে।

‘কোবরা কপ্টার, মিসাইল থাক,’ জানাল মাথাছেলা পাইলট। ওদের কাছে অ্যান্টি-মিসাইল কাউন্টারমেজার আছে। আমি মাঠে নামিয়ে দিচ্ছি দলের লোক। তোমরা ওই দুই দৌড়বিদকে শেষ করো।’

দুই কোবরা কপ্টারকে পিছনে ফেলে ছিটকে সামনে বাড়ল অসপ্রে, খাড়া করে ফেলেছে রোটর, নেমে আসতে লাগল ভ্রমরের মত করে।

তারই ফাঁকে খুলে গেল দু’পাশের দরজা, ওখান থেকে নীচে ফেলা হলো দড়ি। মাথায় ব্যালাক্লাভা, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বরফের মাঠে নেমে এল আটজন সশস্ত্র লোক। নিখুঁত ফর্মেশন তৈরি করে সামনে বাড়ছে তারা। হাতে একে-৪৭, ছুটতে শুরু করেছে বিধ্বস্ত বিমানের দিকে।

ওই একইসময়ে একটা কোবরা কপ্টার সরাসরি নিশাত ও রাশান সৈনিকের দিকে তাক করল এম১৩৪।

কির-কির আওয়াজ তুলে চালু হলো মিনিগান। ঘুরতে শুরু করেছে ছয় ব্যারেল। বজ্রের আওয়াজ ছাড়ল হাইপারমেশিনগান, উগরে দিল অজস্র বুলেট। নিশাতের পায়ের কয়েক ফুট দূরে মাথা খুঁড়ল বরফের বুকে।

‘ডাইভ দাও!’ চেঁচিয়ে উঠল নিশাত।

ওর পাশে লেংচে লেংচে ছুটছে তরুণ সৈনিক।

সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা।

সামান্য দূরে বরফের খাড়া দেয়াল নেমেছে লিডে।

ওখানেই রয়েছে মইয়ের মাথা।

পিছন থেকে আসছে তপ্ত বুলেট।

বরফের মাঠে পড়েই পেট ঘষ্টে সামনে বেড়েছে নিশাত, পিছলে চলেছে বাইম মাছের মত। পৌঁছে গেল কিনারায়, পরক্ষণে খসে পড়ল পানির দিকে। তারই ফাঁকে টের পেল, ওর বাম বুটের সোলে বিধেছে বুলেট। পেটমোটা ময়দার বস্তার মত ধুপ করে সামনের বোটের উপর নামল নিশাত।

ওর পিছনে একই কাজ করল তরুণ সৈনিক, কিন্তু সামান্য দেরি হয়েছে। আর ওই এক সেকেণ্ডে …

কিনারা পেরিয়ে পড়ছে সে, এমন সময় একপশলা গুলি ছিঁড়ে ফেলল তার দেহ। ফোয়ারার মত নানাদিকে ছিটকে গেল রক্ত। পতনের গতির কারণে লিডের কিনারায় পৌঁছে নিশাতের মতই প্রথম বোটের উপর নেমে এল তার মৃতদেহ। পাশেই ফারিয়া, ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল সে। যেন কসাইয়ের চাপাটি দিয়ে খণ্ড খণ্ড করেছে কেউ ওই লাশ। মনেই হলো না ওটা কোনও মানুষের শরীর।

উঠে বসে হাঁফাতে শুরু করেছে নিশাত। তার ফাঁকে বলল, ‘শালার কপাল! আরেকটু হলে… স্যর কোথায়?’ চমকে গেছে ও।

পিছনে বরফের মাঠে আটকা পড়েছে রানা! .

কানে তালা লেগে যাচ্ছে ভাসমান অসপ্রের আওয়াজে, বেরিভ বিমানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে তুষার ও বরফের কুচির ঝড়।

বিধ্বস্ত বিমানের ককপিটে ক্যান্টিন থেকে সামান্য পানি নিয়ে তারাসভের সিটবেল্টের বাকলে ফেলল রানা। বরফ গলে যেতেই ঝটকা দিয়ে খুলে ফেলল সিটবেল্ট লক, টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইল রাশান বিজ্ঞানীকে। তারই ফাঁকে উঁকি দিল বাইরে।

‘আসুন!’

ওদের দিকে দক্ষিণ থেকে আসছে ব্যালাক্লাভা ও পার্কা পরা আটজন, হাতে অস্ত্র। চট্‌ করে পুবে চাইল রানা।

‘আপা, আপনি ঠিক আছেন?’

‘আছি। কিন্তু কিমা হয়ে গেছে রাশান সৈনিক। আপনার কী অবস্থা, স্যর?’

‘এবার রওনা হব… ভেবেছিলাম…’ চুপ হয়ে গেল রানা।

ব্যালাক্লাভা পরা এক লোক বসে পড়েছে বরফের মাঠে, চোখ রেখেছে আগ্নেয়াস্ত্রের সাইটে।

সামনের বাইপড়ে শক্তিশালী মেশিনগান।

এইমাত্র টিপে দিল ট্রিগার।

তখনই শুরু হলো কর্কশ আওয়াজ: খ্যাট-খ্যাট-খ্যাট-খ্যাট-খ্যাট!

মেশিনগানধারী নিজেই ছিটকে গেল পিছনে।

এক পশলা মেশিনগানের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে সে। ঝট্ করে ঘুরে চাইল রানা, বিস্মিত।

কুয়াশার তৈরি বন্ধুর গানব্যারেলের মুখ থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া।

‘সত্যিকারের বন্ধু তুমি!’ বলল রানা, ‘ভাল রোবট!’

‘থ্যাঙ্কিউ,’ সবসময় কান খাড়া রাখে বন্ধু, কয়েক পশলা গুলি করল শত্রুদের লক্ষ্য করে।

কিন্তু সঙ্গীর পরিণতি দেখে সতর্ক হয়েছে অন্যরা। ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেরিভ বিমানের আড়ালে। ওখান থেকে পাল্টা গুলি করল বন্ধুকে লক্ষ্য করে। বৃষ্টির মত বুলেট এসে লাগছে ধাতব দেহে। ঠং-ঠং আওয়াজ উঠছে। পাত্তাই দিল না বন্ধু, লেন্স ব্যবহার করে এদিক থেকে ওদিকে নজর রাখছে।

এইমাত্র ডানদিকে লেন্স ঘুরিয়েছে বন্ধু, কিন্তু বামদিকে আরেক কমাণ্ডোকে দেখল রানা। সে আছে বেরিভ বিমান ও লিডে রাখা বোটের মাঝে। কাঁধে তুলে নিয়েছে রাশার তৈরি রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড লঞ্চার।

সে বেরিভ বিমানের ফাটল ধরা উইণ্ডশিল্ডের দৃষ্টিসীমার কোণে। এমন এক অ্যাংগেলে, তাকে গুলি করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া, রানার কাছে এমন কোনও অস্ত্রও নেই যা দিয়ে ঠেকাবে আরপিজি।

কী করবে, ভাবছে রানা।

এক সেকেণ্ড…

রকেট লঞ্চারের সাইটে চোখ রেখেছে কমাণ্ডো। ঠিকভাবে বসিয়ে নিল কাঁধের উপর।

কিন্তু বেরিভের ককপিটে পাইলটের সিটে ধাক্কা দিয়ে তারাসভকে সরিয়ে দিল রানা। ‘দু’হাতে চেপে রাখুন কান!’

দেরি না করে কো-পাইলটের সিটের ইজেকশন লিভার খুলে দিল রানা।

ভুউউউশ্ করে গ্যাসের মত আওয়াজ উঠল ককপিটে।

ছিটকে বেরিয়ে গেল বিমানের ওদিকের ছাত, এবং ওই জায়গা দিয়ে রকেটের মত বেরোল কো-পাইলটের সিটটা।

কাত হয়ে পড়ে আছে বিমান, ফলে বাতাসে ভেসে বিদ্যুদ্বেগে ছুটল ফ্লাইট সিট। বরফের মাঠ থেকে মাত্র এক ফুট উপর দিয়ে ছুটছে ওটা।

আরপিজি কাঁধে লোকটার উপর ভয়ঙ্কর গতি নিয়ে চড়াও হলো সিট। পাঁজরের হাড়গুলো চুরচুর হয়ে গেল কমাণ্ডোর। তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল সিট, প্রায় দু’ভাঁজ করে ফেলল মৃতদেহটাকে।

ককপিটের ছাতের গর্তের দিকে গোল গোল চোখে চেয়ে রইলেন তারাসভ। বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, দূরে দেখলেন বরফের মাঠে মৃত কমাণ্ডোকে।

‘বুঝলেন?’ বলল রানা। নতুন উদ্যমে গুলি করছে পার্কা পরা অন্য কমাণ্ডোরা। ‘আমরাও ওই পথে বেরিয়ে যাব! আপনার ফ্লাইটসুট কি আর্কটিকের পানিতে টিকে থাকার মত?’

‘কিছুক্ষণ শীত ঠেকাবে, হ্যাঁ,’ থমকে থমকে বললেন তারাসভ।

‘গুড,’ ভাঙা ককপিট উইণ্ডোর দিকে একহাত বাড়াল রানা। হ্যাঁচকা টানে কোলের কাছে নিয়ে এল বন্ধুকে। ওকে তুলে দিল ডক্টর তারাসভের হাতে। ‘ঠিক করে ধরুন!’ পাইলটের সিটে বসে পড়ল নিজে, দেরি না করে বাচ্চা কোলে নেয়ার ভঙ্গিতে টেনে নিল বিজ্ঞানীকে। তাঁর কোলে বিপ আওয়াজ তুলল বন্ধু। বোধহয় খুশিই হয়েছে খাতির পেয়ে। ‘এবার পেটের নাস্তা উগরে আসতে পারে।’

মাত্র এক সেকেণ্ড বিরতি দিল রানা, তারপর খুলে দিল সিটের ইজেকশন লিভার। রওনা হয়ে গেল ওরা মিসাইলের গতি তুলে।

বেরিভ বিমান থেকে ছিটকে বেরোল ফ্লাইট সিট— তার উপর বসে আছে রানা, বিজ্ঞানী ও খুদে রোবট। চারপাশের শত্রুদেরকে কলা দেখিয়ে বিদ্যুদ্বেগে চলে গেল বহু দূরে।

কাত হয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে সিট, গতি এতই বেশি, চারপাশের সবই মনে হলো ঝাপসা।

ওরা গেঁথে আছে সিটের ভিতর।

প্রচণ্ড গতি নিয়ে চল্লিশ গজ যাওয়ার পর বরফের মাঠে নামল সিট। পর পর দুই ডিগবাজি দিয়ে হিমশৈল থেকে ভারী পাথরের মত ছিটকে পড়ল লিডে।

অ্যাসল্ট বোটে বসে হতবাক হয়ে উড়ন্ত রানাদের দেখল নিশাত ও অন্যরা।

কিনারা পেরিয়ে যাওয়ার পর পড়ন্ত ঢিলের মত বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে গিয়ে পড়ল ফ্লাইট সিট।

মস্ত ঝপাস্ আওয়াজ তুলেছে।

‘জিনিসটা কী?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল।

‘উনি আমার স্যর, বিসিআই এজেন্ট, মেজর, মাসুদ রানা,’ গর্ব নিয়ে বলল নিশাত। ড্রাইভারের সিট থেকে ধাক্কা দিয়ে ববকে সরিয়ে দিল ও, নিজে ওখানে বসে মুচড়ে ধরল অ্যাক্সেলারেটার। ‘সবাই টিকে থাকো বোটে! এবার ছোঁ দিয়ে খপ্ করে ভেজা বেড়ালের মত তুলে আনতে হবে স্যরকে!’

ছয়

হিম সাগর-তলে শান্ত পরিবেশ

ফ্লাইট সিট ছুটে গিয়ে সাগরে পড়তেই আলাদা হয়ে গেছে রানা ও তারাসভ, ওদের চারপাশে শুধু নীলের রাজ্য।

ডুবতেই চট্ করে কাজ করেছে বন্ধুর ফ্লোটেশন বেলুন।

রানা দেখেছে, সাগর সমতলের দিকে উঠে যাচ্ছে রোবট।

দেহে ড্রাইসুট, তবুও বরফ-ঠাণ্ডা জলের সূচ বিঁধছে রানার মুখে। অসহ্য শীত! পড়বার সময় কপালের উপর রাখা সানগ্লাসে ঝপাৎ করে লেগেছে পানি।

নীল আর্কটিক সাগর-তলের নীরবতা পুরোপুরি থমথমে নয়।

কোথা থেকে আসছে ভোঁতা থ্ৰম-থ্ৰম-থ্ৰম-থ্রম-থ্ৰম আওয়াজ।

শব্দটা সামনের দিকে।

জিনিসটা প্রকাণ্ড এবং কালো, ঝুলছে গভীর পানিতে।

কোনও প্রাণী নয়।

মানুষের তৈরি যান্ত্রিক কিছু।

বুঝে ফেলল রানা, ওটা মস্ত এক সাবমেরিন।

আগেও একবার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর।

অ্যান্টার্কটিকায় বাংলাদেশ-আমেরিকান এক মিশনে মুখোমুখি হয়েছিল ও ফ্রেঞ্চ নিউক্লিয়ার ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিনের।

সেবার ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল ওটাকে।

এবং সে কারণে পরবর্তীতে ওকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ সামরিক বাহিনী।

না, এটা কোনও ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন হতে…

তখনই বো-তে নীল-সাদা ও লালের পতাকা দেখল রানা।

হ্যাঁ, সত্যি আরেকটা সাবমেরিন পাঠিয়েছে ফ্রেঞ্চরা!

এক সেকেণ্ডের দশভাগ সময়ে সব বুঝে নিল রানা।

কিছুক্ষণ আগে এই সাবমেরিনের কথাই জানিয়েছে কুয়াশার রিস্টগার্ডের প্রক্সিমিটি সেন্সর।

অর্থাৎ, নষ্ট হয়নি ওটা।

আগে থেকেই সিগনাল দিচ্ছিল। কোনও সন্দেহ নেই, ওদের পিছু নিয়েই এসেছে এই সাবমেরিন

আর এ থেকে একটা ব্যাপার আন্দাজ করা যায়, পোলার আইল্যাণ্ডের গুরুতর পরিস্থিতির সঙ্গে ফ্রেঞ্চদের কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের জানাও নেই ওখানে কী ঘটতে চলেছে।

আরও একটা বিষয় পরিষ্কার, আর্কটিকে ফ্রেঞ্চদের সাবমেরিন পাঠানো হয়েছে শুধু ওকে খতম করতে।

রানা খেয়াল করল, প্রকাণ্ড সাবমেরিনের পিঠে রয়েছে তিনটে ছোট সাবমারসিবল।

কমপ্যাক্ট সুইমার ডেলিভারি ভেহিকেল।

ওগুলো এএফডিভি-র মতই, কিন্তু আরও ছোট।

প্রতিটি নৌযানে বসতে পারবে তিনজন করে ফ্রগম্যান।

রানা আরও খেয়াল করল, প্রকাণ্ড সাবমেরিনের পিঠ থেকে রওনা হয়েছে তিন সাবমারসিবল। আসছে সোজা ওর দিকেই!

আততায়ীদের স্কোয়াড!

ওকে খতম করবে খুনির দল, অথচ জানে না তাদের চেয়ে ঢের ভয়ঙ্কর একদল লোক গোটা পৃথিবী জুড়ে তৈরি করবে লেলিহান আগুনের ঝড়। রক্ষা পাবে না ওদের মাতৃভূমিও।

সাগর-সমতলে উঠতে অলিম্পিকের সেরা সাঁতারু মাইকেল ফেল্পসের মত তুমুল হাত-পা ছুঁড়ল রানা।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠেই দেখল, ওর পাশেই ভাসছে ম্যাকসিম তারাসভ ও বন্ধু।

আরামসে ভাসছে কুয়াশার খুদে রোবট। পেটমোটা ঘুরন্ত টায়ারের কারণে ধীরে ধীরে আসছে রানার দিকেই।

‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, রানা?’ জানতে চাইল রোবট। ‘আপনি চাইলে আমাদের বন্ধুরা পৌছনো পর্যন্ত আপনাকে ভাসিয়ে রাখতে পারি।’

এমন সময় গভীর পানি কেটে হাঙরের মত এল প্রথম ফ্রেঞ্চ এসডিভি, ভেসে উঠেছে রানাদের কাছ থেকে মাত্র দশ গজ দূরে!

সাবমারসিবল ড্রাইভ করছে এক ফ্রগম্যান, অন্য দু’জন উঁচু করে ধরেছে খাটো ব্যারেলের ফ্যামাস অ্যাসল্ট রাইফেল।

এবার একপশলা গুলি উড়িয়ে দেবে রানার খুলি।

কিন্তু ঠিক তখনই তুমুল বেগে কী যেন চড়াও হলো ফ্রেঞ্চ এসডিভির উপর। ছিটকে আকাশে উঠল তিন ফ্রগম্যান, পরক্ষণে ঝপাস্ করে গিয়ে পড়ল সাগরে।

বড় নৌযানটা নিশাত সুলতানার অ্যাসল্ট বোট। ফ্রেঞ্চদের অপেক্ষাকৃত ছোট সাবমারসিবলের বুকে চেপে বসেছিল, জোর এক গুঁতো মেরে দু’টুকরো করে দিয়েছে ফ্রেঞ্চদের নৌযান। সাঁই করে ঘুরে গেল নিশাতের বোট, থামল ঠিক রানার পাশে।

বব, ফারিয়া ও পবনের উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়ল নিশাত, ‘অ্যাই, তোলো ওঁদের!’

বন্ধুকে দু’হাতে তুলে নিল রানা, এবং এক সেকেণ্ড পর ওকে টেনে বোটে তুলল ফারিয়া ও পবন।

পরক্ষণে বোটে তোলা হলো তারাসভকে।

‘জলদি, আপা!’ তাড়া দিল রানা। ‘আশপাশে বেশি লোক! চারপাশে গোলাগুলি চলবে এবার!’

যা বলতে পারত, তার প্রায় কিছুই বলেনি রানা। বাস্তবে এবার যা শুরু হলো, তা নরকের দৃশ্য যেন!

একইসঙ্গে ঘটল কয়েকটা ঘটনা।

প্রথমে, ফ্রেঞ্চদের অন্য দুই সাবমারসিবল ভেসে উঠল। ওটার পিঠে সশস্ত্র আরও কয়েকজন ফ্রগম্যান।

আর তখনই ক্র্যাশ করা বেরিভের দিক থেকে এল কোবরা কপ্টার, বিকট আওয়াজ তুলছে রোটর। মিনিগানের মুখে ঝলসে উঠল কমলা আগুন। শত শত বুলেট সেলাই করছে সাগরের বুক। একরাশ গুলি ঝাঁঝরা করল সদ্য ভাসমান ফ্রেঞ্চ এক সাবমারসিবলকে। কুচি কুচি হতে লাগল ওটার তিন ফ্রগম্যান।

কোবরা কপ্টারের পিছু নিয়ে সাগরের বিশফুট উপরে নেমে এসেছে দ্বিতীয় এএইচ-১ অসপ্রে, নিশাতের বোটের গতিপথের ঠিক সামনে! বিকট আওয়াজ তুলে ভাসছে বাতাসে, অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাক করছে মিনিগান।

‘শালার পো শালা! কপালও!’ বিড়বিড় করল নিশাত।

কোবরা কপ্টারের ভয়ঙ্কর কামানের বিরুদ্ধে ওদের অস্ত্র বলতে নিশাতের জি৩৬ রাইফেলের গ্রেনেড লঞ্চার। কিন্তু ওটা আছে ওর পায়ের কাছে, হাতের নাগালের বাইরে।

ওটার কথা ভাবলও না রানা, খপ্ করে বন্ধুকে তুলে নিজের সামনে ধরল। ট্রিগার নেই, কিন্তু বদলে গলা ছাড়ল, ‘বন্ধু! গুলি করো! গুলি!’

জ্যান্ত হয়ে উঠল বন্ধুর এম২৪৯ মেশিনগান।

চাকা ফুটো করবার তীক্ষ্ণ চুঁই আওয়াজ তুলছে প্রতিটা গুলি। বেশিরভাগ রিকয়েল সহ্য করছে বন্ধুর ইন্টারনাল কমপেনসেটর। সামান্য নড়ছে রানার দু’হাত। লক্ষ্যভেদ করছে রোবটের প্রতিটি গুলি, খুবলে তুলছে কপ্টারের দেহ। ফাটল ধরল ক্যানোপিতে, বুলেট লাগল ইঞ্জিনের হাউসিঙে। ইঞ্জিনের ভিতরে কী যেন বিকল হলো, সঙ্গে সঙ্গে কোবরার এক্যস্ট দিয়ে বেরোল ঘন কালো ধোঁয়া। পাগল হয়ে উঠল পাইলট, ঝট করে বাঁক নিয়েই সরে গেল আরেকদিকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু হারতে রাজি নয়।

‘স্যর!’ গলা ফাটাল নিশাত, ‘এবার? কোন্ দিকে যাব?’

এটাই এখন মূল সমস্যা, যাব কোথায়? টাশ্-টাশ্ গুলি ও রোবটের মেশিনগানের খ্যাট-খ্যাট আওয়াজের ভিতর ভাবতে চাইল ও।

রাশান লোকটার সঙ্গে আলাপ করা দরকার, তার কাছ থেকে হয়তো পাবে দ্বীপের বিষয়ে জরুরি তথ্য। কোনও পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। কিন্তু সময় নেই। মিলিটারি ম্যাক্সিম মনে পড়ল রানার- প্রচুর সময় নিয়ে তৈরি বাজে প্ল্যানের চেয়ে ঢের ভাল স্বল্প সময়ে তৈরি নিখুঁত প্ল্যান। …এখন বোধহয় ভাল হয় আবারও উত্তরদিকে ফিরলে, তারপর পরিকল্পনা তৈরি করে আবারও রওনা হবে পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে।

পিছনে ফেলে আসা মোড়ের দিকে চাইল রানা। এবং তখনই বাতাসে তৈরি হলো জোরালো হুইশ্ আওয়াজ। বিস্ফোরণের শব্দ তুলে কালো কী যেন ভেসে উঠছে সাগর ফুঁড়ে! নানাদিকে ছিটকে গেল বিপুল পরিমাণে পানি। দৃশ্যটা অকল্পনীয়: মাথা তুলেছে প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন! কমপক্ষে তিরিশ ফুট উপরে উঠল মস্ত বাবের মত নাকটা, তারপর আবারও ঝপাস্ করে নামল সাগরে। চারপাশে তৈরি হলো মস্ত সব ঢেউ। মাতালের মত টলমল করতে লাগল রানাদের দুই সরু, ছোট বোট।

থ হয়ে গেল রানা।

ওদের ফিরবার পথ জুড়ে ভাসছে ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন!

আর উপায় নেই উত্তরে যাওয়ার।

তখনই বিকট গর্জন ছেড়ে মাথার উপরের আকাশে হাজির হলো ভি-২২ অসপ্রে, সোজা গিয়ে থামল ফ্রেঞ্চ সাবমেরিনের উপর।

আগে সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকারের বারোটা বাজাবে ওটা, ভাবল রানা। সাবমেরিন ডুবিয়ে দিয়ে ওদেরকে শেষ করবে আয়েস করে।

উপরের দিকে রোটর কাত করল অসপ্রে, ধীরে ধীরে পেরোল সাবমেরিন, তারপর ডানা থেকে ফেলে দিল দুটো মার্ক ৪৬ মোড ৫এম অ্যান্টি-সাবমেরিন টর্পেডো।

ঝপাৎ আওয়াজ তুলে পানিতে নেমেছে দুই যমজ-ভাই, যিরোঈং করেই রওনা হয়ে গেল সাবমেরিন লক্ষ্য করে।

মার্ক ৪৬ খুবই ভাল টর্পেডো।

সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায়, নিখুঁতভাবে পৌঁছে যায় লক্ষ্যে।

এবং এত কম রেঞ্জে সামান্যতম সুযোগ পাবে না ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন। সময় নেই যে কাউন্টারমেজার ব্যবহার করবে।

মাত্র তিন সেকেণ্ডে গন্তব্যে পৌঁছে গেল দুই টর্পেডো।

এর ফলে যে ভয়ঙ্কর বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো, তাতে মনে হলো ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে গোটা দুনিয়া।

মুহূর্তে মর্ত্যের এই সাগর ছেড়ে স্বর্গের দিকে রওনা হলো মস্ত সাবমেরিন। সঙ্গে চলেছে সাদা পানির ফেনিল ফোয়ারা, দেখতে না দেখতে উঠে গেল এক শ’ ফুট উপরে। ঝরঝর করে চারপাশে বৃষ্টির মত নেমে এল পানি। গুলি খাওয়া হরিণীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে শূন্যে উঠেছে সাবমেরিন, তারই ভিতর জোরালো মড়াৎ আওয়াজ তুলে ভেঙে গেল ওটার মাজা। তুবড়ে গেল একেবারে, যেন মুচড়ে দেয়া বিয়ারের ক্যান। বিপুল ফেনা তোলা সাগরে ঝপাস্ করে আবারও নেমে এল, ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বেরিয়ে এসেছে পেটের নাড়িভুঁড়ি বা পাইপিং। এক সেকেণ্ডও লাগল না, ডুবতে শুরু করল।

হতবাক রানার মুখে এসে নেমেছে বৃষ্টির ফোঁটা। চুপ করে চেয়ে রইল ডুবন্ত সাবমেরিনের দিকে।

দৃশ্যটা যেন নিজ চোখে বিশ্বাস করবার মত নয়।

দাউ-দাউ আগুনে জ্বলছে ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন, বুক-পেট থেকে ভলকে বেরোচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া। সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে প্রকাণ্ড নৌযান। ওটার পেট থেকে এল লোকজনের চিৎকার ও হৈ-চৈ। এদিকে আবারও আকাশে ঘুরে গেছে অসপ্রে, সাবমেরিনের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত ঝাঁঝরা করতে লাগল শত শত বুলেট। কনিং টাওয়ার ব্যবহার করে নৌযানের পিঠে উঠে আসছে নাবিকরা, কিন্তু কিছুই করবার নেই তাদের। সাবমেরিনে রয়ে গেলে মরবে, খোলা জায়গায় থাকলেও।

মাত্র কয়েক মিনিটে শেষ হয়ে যাবে ফ্রেঞ্চ সৈনিকরা।

আকাশে ভাসছে দুই কোবরা অ্যাটাক চপার।

একটা ক্ষতিগ্রস্ত, অনর্গল বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া।

অন্য কপ্টার ভাসছে লিডের মোড়ের সামান্য উপরের আকাশে। ফ্রেঞ্চদের তৃতীয় সাবমারসিবলের তিন ফ্রগম্যানকে বাগে পেয়েছে ওটা। কিছুই করবার নেই ফ্রেঞ্চদের, মিনিগান ঝাঁঝরা করে দিল তাদের সাবমারসিবল। তার আগেই জান বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তিন ফ্রগম্যান। তারা খুনি, খুন করতেই এসেছে, কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী হত্যাকারীরা তাদেরকে কোনও সুযোগই দিতে রাজি নয়। রক্তাক্ত কিমা হয়ে গেল ফ্রেঞ্চদের দেহগুলো।

‘মিস্টার রানা!’ পিছনে একটা কণ্ঠ শুনল রানা। ‘মিস্টার!’

ঘুরে চাইল রানা।

ডাক দিয়েছে রাশান লোকটা।

‘আমরা দক্ষিণে যেতে পারি, এমন না যে পোলার আইল্যাণ্ডে গিয়ে উঠতে হবে! ওই দ্বীপের কোলের কাছে আরও ছোট কয়েকটা দ্বীপ আছে! আমরা ওগুলোতে গিয়ে উঠতে পারি!’

‘তাই?’ ঘুরে দাঁড়াল রানা। ‘আপা…’

থমকে গেছে ও।

সামান্য দূরে উড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত কোবরা অ্যাটাক চপার। ওটা ঘোরাতে শুরু করেছে মিনিগান। সাগরে ভাসমান তিন ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যানকে উড়িয়ে দেবে। ওর বোট ব্যবহার করে এই তিন ফ্রেঞ্চের সাবমারসিবল দু’টুকরো করে দিয়েছিল নিশাত। লোকগুলো সাঁতার কেটে ভেসে আছে, কোথাও যাওয়ার নেই। জানা কথা, তাদেরকে মাফ করবে না ধোঁয়া-ওঠা কোবরা কপ্টারের পাইলট।

তখনই একটা কথা মনে হলো রানার।

যারা কোবরা কপ্টার ও অসপ্রে নিয়ে এসেছে, এরা ঠাণ্ডা মাথার খুনি। ফ্রেঞ্চরাও এসেছে ওকে খুন করতেই। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে অসহায় পাখির মত গুলি করে শেষ করে দেয়া হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। আরেকটা কথা ভেবেছে রানা, এরা ফ্রেঞ্চ ট্রুপ, যদি এদেরকে সরিয়ে নিতে পারে, এরা হয়তো কাজে আসবে পৃথিবী রক্ষার প্রচেষ্টায়।

এক সেকেণ্ডও দেরি করল না রানা, খপ্ করে তুলে নিল নিশাতের জি৩৬, গ্রেনেড লঞ্চার তাক করল কপ্টারের দিকে, পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার।

ভুস্ আওয়াজ তুলে ব্যারেল থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল যিঙ্ক- টিপ্‌ড্ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গ্রেনেড। পিছনে রেখে গেল সরল রেখার মত ধোঁয়া। তুমুল গতি তুলে কপ্টারের উইণ্ডশিল্ড ভেদ করল রকেট, পরক্ষণে বিস্ফোরিত হলো।

ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কোবরা কপ্টার।

বাইরের দিকে ছিটকে গেল আগুনের মস্ত এক কমলা গোলক। তার ভিতর দিয়ে নানাদিকে ছুটল ধাতব টুকরো। দুই সেকেণ্ড পর শীতল সাগরে ঝপ্ করে নামল পোড়া কাঠামো। ছ্যাৎ করে নিভে গেল সব। তলিয়ে গেল সাগরের নীচে। হতবাক হয়ে ওদিকে চেয়ে রইল তিন ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যান।

‘স্যর, জি৩৬-এর আরও কিছু অপশন থাকা উচিত ছিল, খুশি খুশি স্বরে বলল নিশাত।

কোনও মন্তব্য করল না রানা, ঘুরে চাইল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো এবং চ্যাণ্ড্রোপলের দিকে। ওরা আছে দ্বিতীয় এএফডিভি- তে। ‘পাওলো! চ্যাণ্ড্রোপল! এদিকে আসুন! বোটে তুলে নেবেন ফ্রগম্যানদের, তারপর লেজ গুটিয়ে ভাগতে হবে!’

‘স্যর, এ কী বলছেন!’ আপত্তির সুরে বলল নিশাত, ‘এরা তো আপনাকে খুন করতেই এসেছে!’

‘যা বলছি, তা-ই করুন,’ নির্দেশ দিল রানা।

কুয়াশার দুই বোট গিয়ে থামল তিন হতভম্ব ফ্রেঞ্চের সামনে। হ্যাঁচকা টানে তুলে নেয়া হলো তাদেরকে। দু’জন উঠেছে পাওলোর রিয়ার ট্রেতে। তৃতীয়জন প্রকাণ্ডদেহী, সে উঠল রানাদের বোটে। ওয়েটসুট থেকে টপটপ করে পড়ছে পানি।

‘বঁশো,’ বলল রানা, পরক্ষণে ইংরেজিতে জানাল, আমাদের দুঃস্বপ্নে স্বাগতম! …আপা! দক্ষিণে রওনা হন! … পবন!’

কী যেন ভাবছিল কুয়াশার সহকারী, হঠাৎ চমকে গেল রানার হাঁক শুনে। মুখ তুলে দেখল, ওর বামবাহুর দিকেই আঙুল তুলেছে রানা।

‘তুমি আমাদের গাইড! স্যাটালাইট ইমেজিং ব্যবহার করবে! এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে নিয়ে যাবে পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তরদিকের দ্বীপের কাছে!’

রিস্টগার্ডের দিকে চাইল পবন। ডিসপ্লেতে অসংখ্য সরু সরু লিড। দু’পাশে বরফের দেয়াল। অপেক্ষাকৃত চওড়া এক লিডে রয়েছে ওরা।

‘আমি গাইড হব?’ সন্দেহ নিয়ে বলল পবন।

‘হ্যাঁ, তুমি। সঠিক পথে যাবে, নইলে মরব সবাই,’ বলল রানা। নিশাতের কাছ থেকে হ্যাণ্ডলবার নিল, ফিরিয়ে দিল জি৩৬। ‘তুমি আমাদের গাইড। ড্রাইভ করব আমি। …আপা, গুলি শুরু করুন! রওনা হচ্ছি!’

থ্রটল মুচড়ে ধরল রানা, সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ছুট লাগাল এএফডিভি। পিছনে ছিটকে উঠল পানির তৈরি মোরগের লেজ। পিছু নিল দ্বিতীয় অ্যাসল্ট বোট।

তীরের মত দক্ষিণে চলেছে ওরা।

পিছনে পড়ল নিমজ্জিত ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন।

সোজা সামনে পোলার আইল্যাণ্ড বা মৃত্যুদ্বীপ!

সাত

মাসুদ রানার পরিত্যক্ত ক্যাম্প থমথম করছে।

নিজের তাঁবুতে কয়েকটা টেস্টের নোট নিয়ে বসেছে জার্ড ময়লান, এমন সময় কানে এল একটা এয়ারক্রাফটের আওয়াজ।

গম্বুজের মত তাঁবু থেকে বেরোতেই চোখ গেল দক্ষিণে।

দূর-দিগন্তের দিক থেকে আসছে একাকী বিমান।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ভীষণ ভয় পেল ময়লান। মনটা বলল, বোধহয় মস্ত ভুল করেছে এখানে থেকে গিয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখল, ওটা একটা আমেরিকান ভি-২২ অসপ্রে এয়ারক্রাফট। একপাশে বড় অক্ষরে লেখা: ‘মেরিন’

স্বস্তির শ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হলো জার্ড ময়লান।

সে-ই ঠিক ছিল, ভুল করেছে ওই মাসুদ রানা ব্যাটা।

নিশ্চয়ই এদিকে কোথাও ছিল মেরিনদের দল, আর ওদের জন্য এদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে পেন্টাগন।

হাত নাড়তে লাগল ময়লান।

কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেল অসপ্রে, ভাসতে ভাসতে নেমে পড়ল ক্যাম্পের পাশে।

হাসিমুখে মেরিনদের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হলো জার্ড ময়লান।

.

দু’পাশের বরফ-দেয়ালের মাঝ দিয়ে সরু লিডে বুলেটের গতি তুলে ছুটছে রানাদের দুই এএফডিভি।

পবনের দেখিয়ে দেয়া পথে বারকয়েক বামে এবং ডানে সরেছে রানা, তারপর পৌঁছে গেছে প্যানকেক আকৃতির এক বরফ-মাঠের পাশে। লেজ তুলে ভাগছে ওরা। কোবরা কপ্টার ও অসপ্লের থেকে দূরে সরে যেতে হবে। সাবমেরিনের নাবিকদের শেষ কবেই ধাওয়া করবে মৃত্যবাহী দুই এয়ারক্রাফট।

এরই ভিতর তুমুল গতি তুলে সরে এসেছে ওরা অনেক দক্ষিণে। ফ্রেঞ্চ সাবমেরিনে টর্পেডো লাগবার পর থেকে, এখন পর্যন্ত মাঝে ফেলেছে কমপক্ষে দশ মাইল সাগর।

রানার পিছনে বসে আছে নিশাত, চোখ পিছনের আকাশে, হাতে উদ্যত জি৩৬। রিয়ার ট্রে-তে ফারিয়া, বব, তারাসভ এবং প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যান। শেষেরজনকে এখনও হতভম্ভ এবং দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে।

‘এবার বামের লিডে ঢুকুন!’ জোর বাতাস ছাপিয়ে চেঁচাল পবন, ‘এরপর সোজা ডানদিকে!’

নির্দেশ মেনে নিল রানা।

লিডের দুই দেয়ালের মাঝ দিয়ে দেখা গেল দূরে কী যেন।

পোলার আইল্যাণ্ড!

আর্কটিকের সাদা ল্যাণ্ডস্কেপের বিপরীতে অদ্ভুত লাগল দ্বীপটা। চারপাশে সমতল, ধবধবে সাদা জমাট সাগর, আর তার ভিতর কালো, এবড়োখেবড়ো, উঁচু, প্রকাণ্ড পাহাড়ি দ্বীপ। কালো পাথরের পেরেকের মত আকাশে উঠেছে সব পাহাড়-চূড়া। আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে ওগুলো উঠে এসেছিল বরফের বুক চিরে, ওখানেই আছে আজও। সাগরের দিকে ঝুঁকে আছে তুষারাবৃত চূড়া ও খাড়া ক্লিফ— মস্ত এক প্রাকৃতিক দুর্গ।

একটা ক্লিফের চূড়ায় বাতি দেখল রানা। ওখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার বা লাইট হাউস আছে, উপরের জানালা থেকে আলো আসছে। মস্ত ওই দ্বীপের তুলনায় ওই দালান সত্যিই খুবই ক্ষুদ্র।

অবশ্য তারাসভের কথামতই, দ্বীপের সামনে আছে দু’-একটা ছোট দ্বীপ। সেসব নিচু ঢিবির মত, জেগে আছে সমতল বরফের মাঠের উপর। ঢিবিগুলো তুষার ও কাদা দিয়ে ছাওয়া। অবশ্য ওদিকে দেখা গেল বিদঘুটে কিছু দালান।

প্রশংসার সুরে বলল রানা, ‘ভাল দেখিয়েছ, পবন। ঠিকই নিয়ে এসেছ এখানে।’

‘প্রথম দ্বীপে থামবেন না, ওটা বিষাক্ত!’ রানার পাশে পৌঁছে গেছেন তারাসভ। ‘দ্বিতীয় দ্বীপে চলুন। এসব বোট কি পানির নীচ দিয়ে চলতে পারে?’

‘হ্যাঁ, পারে। … কেন?’ অবাক হয়েছে রানা। ভাবল, কী কারণে সন্দেহ জাগল রাশান বৈজ্ঞানিকের মনে? এএফডিভি-র গোপন এ ক্ষমতা সম্পর্কে বিসিআই, আর্মি ও নেভির সর্বোচ্চ অফিসার ছাড়া আর কেউ জানে না।

‘দ্বিতীয় দ্বীপে ছোট লোডিং ডক আছে, ওখানে ভিড়তে পারবে সাবমারসিবল,’ বললেন তারাসভ। ‘কারও চোখ এড়িয়ে ওঠা যাবে।’

কুঁচকে গেল রানার ভুরু। ‘সাবমারসিবল ভিড়বে এমন লোডিং ডক কারা তৈরি করেছিল?’

‘ওভাবে তৈরি করা হয়নি, জানালেন বিজ্ঞানী। ‘কিন্তু বাধ্য হয়ে ধ্বংস করা হয় ওই ডক। কারণ… ওখানে… একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছিল।’

‘কী ধরনের দুর্ঘটনা?’ জানতে চেয়েই চমকে গেল রানা। ওদের বোটের সামনের সাগরে শিলা-বৃষ্টির মত পড়ছে মিনিগানের গুলি। পরক্ষণে ওদের মাথার উপর দিয়ে শোও করে বেরিয়ে গেল দ্বিতীয় কোবরা কপ্টার।

‘ওরা পেয়ে গেছে আমাদেরকে!’ চেঁচিয়ে উঠল বব।

‘আপা!’ জরুরি সুরে বলল রানা, ‘টানা গুলি করুন!’

‘জী, স্যর!’ জি৩৬ তুলেই পাল্টা গুলি শুরু করল নিশাত।

দু’পাশের বরফ-দেয়ালের মাঝ দিয়ে তীরের বেগে দ্বীপের দিকে ছুটছে ওরা।

ব্যস্ত হয়ে গুলি ছুঁড়ছে নিশাত, কিন্তু কোবরা কপ্টারের আর্মার্ড প্লেট থেকে ঠং-ঠং আওয়াজে ছিটকে পড়ছে বুলেট। রানার অনুকরণে গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করতে চাইল নিশাত। কিন্তু তৈরি হয়ে আছে কোবরা কপ্টারের পাইলট। একরাশ পটকার মত তুবড়ি ছাড়ছে সে, নিশাতের লক্ষ্যভ্রষ্ট গ্রেনেড সেখানেই আঘাত হানছে। কোবরা কপ্টারে পৌঁছানোর অনেক আগেই বিস্ফোরিত হচ্ছে গ্রেনেড।

পলায়নরত দুই বোটের উপর তুমুল বৃষ্টির মত নামল গুলি।

বারকয়েক বরফের দেয়ালের আড়াল নিয়ে কপ্টার থেকে দূরে থাকতে চাইল রানা। পৌঁছেও গেল সামনের বাঁকে, আর তখনই মিনিগানের গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হলো পিছন বরফ-দেয়াল।

‘বব!’ গলা ছাড়ল রানা, ‘অসপ্রের জন্যে আকাশে চোখ রাখো! ওরা নিশ্চয়ই আলাদাভাবে সার্চ করছে। আর কোবরার পাইলট জানিয়ে দেবে আমরা কোথায়…

তখনই হাজির হলো অসপ্রে, কানে তালা লেগে গেল ওটার ইঞ্জিন ও রোটরের ভয়ঙ্কর আওয়াজে। অনেক নিচু দিয়ে এসেছে, দুটো ছয় ব্যারেলের ভালকান কামানের মুখ থেকে ঝলসে উঠল কমলা আগুন।

এইমাত্র লিডের তীক্ষ্ণ একটি কোনা ঘুরে ছুটছে দুই স্পিডবোট, এমন সময় পিছনে ছিটকে উঠল বরফের কুচি ও সাগরের পানি।

শালীর ‘কপালটাই খারাপ!’ জি৩৬ দিয়ে তুমুলভাবে গুলি করছে নিশাত। ওর সঙ্গে যোগ দিল বব। ওর হাতে ঢের ছোট অস্ত্র এমপি-৭। পাশাপাশি গুলি করছে দু’জন, কিন্তু ওদের প্রতিপক্ষ অসপ্রে এবং কোবরা কপ্টারের ফায়ারপাওয়ার ঢের বেশি।

সামনের দিকে চেয়ে আছে রানা। বিষাক্ত দ্বীপের কাছে পৌছতে হলে এরই ভেতর দিয়ে যেতে হবে কমপক্ষে একমাইল।

গন্তব্য অনেক দূরে।

সিকি মাইল যাওয়ার আগেই মারা পড়বে ওরা সব ক’জন।

‘স্যর…’ ব্যস্ত কণ্ঠে ডাকল নিশাত।

‘জানি,’ বলল রানা। হাতে সময় পাবে না ওরা।

এখন একমাত্র কাজ হওয়া উচিত…

‘পাওলো! স্কার্টগুলো গুটিয়ে নিন, তলিয়ে যেতে হবে! …আপা! ওদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে আরও অন্তত একটা মিনিট!’

‘হয়তো বড়জোর আধমিনিট পাবেন, স্যর!’

‘চেষ্টা চালিয়ে যান!’

কন্ট্রোল প্যানেলে একের পর এক সুইচ টিপছে রানা। একই সময়ে একটা সি-ম্যাগ ইজেক্ট করল নিশাত, অস্ত্রে আটকে নিল আরেকটা ম্যাগাযিন, তারপর গুলি করল নতুম উদ্যমে।

বাঁক নিয়ে ওদের পিছনে পৌঁছে গেছে অসপ্রে। একই সময়ে সরু খালের সামনের দিকে পৌঁছল কোবরা। অস্ত্র তাক করেছে রানাদের লক্ষ্য করে। চরকির মত ঘুরছে রোটর, আরও নেমে এল কপ্টার। পথ আটকে দিল রানাদের।

শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল রানার গলা।

ওরা আটকা পড়েছে দুই শত্রু এয়ারক্রাফটের মাঝে।

নিশাতও বুঝতে পেরেছে। বিড়বিড় করে বলল, ‘এবার খেলা শেষ…’

‘মেই নন,’ পিছনে ভারী ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ শুনল নিশাত। পরক্ষণে শুনল জোরালো শাক-শাক আওয়াজ।

ঝট্ করে প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যানের দিকে ঘুরে চাইল রানা ও নিশাত। লোকটা সাত ফুটি, হাতে মস্ত এক অস্ত্র। একটু আগেও ওটা ঝুলছিল পিঠে। জিনিসটা নিশাতের জি৩৬-এর চেয়ে কম করেও আট গুণ ভারী। ওই জিনিস আগেও দেখেছে রানা। রাশানদের তৈরি ৬পি৪৯ কর্ড। হেভি মেশিনগানের পেট থেকে ঝুলছে গুলি ভরা বেল্ট। সাধারণত ট্যাঙ্কের টারেটে থাকে এসব ভারী মেশিনগান। বুলেট হয় ১২.৭ এমএম। কিন্তু মডিফাই করা হয়েছে এই কর্ড, দানব ফ্রেঞ্চের চওড়া দুই কাঁধের স্ট্র্যাপে ঝুলছিল।

হ্যাঁচকা টানে মুখ থেকে স্কুবা হুড খুলে ফেলল লোকটা, চারপাশে ছড়িয়ে গেল একরাশ বাদামি চুল। তার খ্যাপাটে দাড়িও বাদামি, নেমেছে প্রায় নাভি পর্যন্ত। দু’হাতে কর্ড তুলে ধরেছে সে, গুলি শুরু করেছে অনায়াস ভঙ্গিতে।

প্রায় কামানের মত মেশিনগানের মুখ থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে তিন ফুটি কমলা আগুনের হলকা। ভারী ক্যালিবারের বুলেট গিয়ে লাগছে কোবরা কপ্টারের গায়ে।

নিশাতের জি৩৬-এর গুলি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে কোবরা চপারের আর্মার্ড প্লেট ও উইণ্ডশিল্ড, কিন্তু কর্ড একেবারেই অন্য জিনিস!

দানব ফ্রেঞ্চের বুলেট চিবুতে শুরু করেছে কপ্টারের দেহ।

ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল উইণ্ডশিল্ড, কাঁচের সঙ্গে মিশে আছে মৃত পাইলটের রক্ত। সরাসরি বুলেট লাগল কপ্টারের ইঞ্জিনে। মাত্র এক সেকেণ্ড পর শতখানেক বুলেটের আঘাতে বিস্ফোরিত হলো গোটা এয়ারক্রাফট। নানাদিকে ছিটকে গেল ভাঙা টুকরো।

জোরালো ধপাস্ আওয়াজ তুলে সাগরে নামল কোবরার জ্বলন্ত কাঠামো। ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যান তার দানবীয় অস্ত্র ঘোরাতেই চমকে গেছে অসপ্নের পাইলটও, ঝট্ করে সরে গেল রেঞ্জের বাইরে, অনেক দূরে।

ফরাসি দানবের দিকে ঘুরে চাইল রানা।

গম্ভীর ‘হুম’ আওয়াজ তুলে ট্রিগার থেকে আঙুল সরাল লোকটা, একবার হাতড়ে নিল প্রিয় দাড়ি। রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘অ্যালি! গো!’

হতভম্ভ হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে আছে নিশাত, একবার চট্‌ করে দেখে নিল নিজের অস্ত্রটা। ওটাকে মনে হলো গুলতি।

এদিকে বসে নেই রানা, ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অন করল আরও কয়েকটা সুইচ। ‘পাওলো! আপনি রেডি? অসপ্রে ফেরার আগেই ডুব দিতে হবে!’

‘ডাইভ দেয়ার জন্যে আমরা তৈরি,’ ইয়ারপিসে শুনল রানা। নিজের বোটের যাত্রীদের দিকে ঘুরল ও। ‘রেগুলেটর প্যানেল খুলে দিন, আপা। সবাই বুঝে নিন একটা করে মাউথপিস। একহাতে ধরবেন রিস্ট কর্ড। ডেকের স্টিরাপে ঢুকিয়ে নেবেন পা, নইলে খসে পড়বেন। … পবন, দেখো, যেন ভেসে না ওঠে বন্ধু।’

বোটের মাঝের দীর্ঘ সিটের পাশের ছোট এক প্যানেল খুলল নিশাত, ওখান থেকে বেরোল আটটি স্কুবা রেগুলেটর, সঙ্গে হোস। সব গিয়ে ঢুকেছে বড় একটি কমপ্রেভ্ এয়ার ট্যাঙ্কে সিটের পাশেই রাবারের কর্ড। কব্জিতে পেঁচিয়ে নিলেই আর ছুটন্ত সাবমারসিবল থেকে ছিটকে পড়বে না যাত্রীরা।

‘ঠিক আছে, পাওলো, পিছু নিন,’ জানিয়ে দিল রানা।

রেগুলেটর ও কর্ড বুঝে নিয়েছে সবাই, এবার এএফডিভি’র বাইরের দিকের রাবারের স্কার্ট থেকে বাতাস বের করে দিল রানা। সরু, অ্যাসল্ট বোট হয়ে উঠল দ্রুতগামী, কালো এক সাবমারসিবল। আগেই কোমরের পাউচে সানগ্লাস ভরে ফেলেছে রানা, এবার সিটের নীচ থেকে স্কুবা মাস্ক নিয়ে পরে নিল চোখে, মুখে রেগুলেটর।

আকাশের রাজ্য থেকে সাগর-তলে পিছলে নেমে গেল ওদের বোট। জমাট বরফের নীচ দিয়ে চলেছে। তলিয়ে গেছে দ্বিতীয় এএফডিভিও, পাশাপাশি চলল দুই সাবমারসিবল। পরেরটায় রয়েছে পাওলো, জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল এবং অন্য দুই ফ্রেঞ্চ ফ্রগম্যান।

মাত্র দশ সেকেণ্ড পর আবারও হাজির হলো অসপ্রে, এবার শেষ করে দেবে শত্রুদেরকে। পাইলট আগে থেকেই চালু করেছে মিনিগানের ব্যারেল।

কিন্তু সাগরের বুকে কাউকে দেখতে পেল না সে।

আট

আর্কটিক সাগরতলের থমথমে নৈঃশব্দ্য চিরে ছুটে চলেছে দুই সাবমারসিবল।

চারপাশে ভুতুড়ে ফ্যাকাসে নীল। মাথার উপর ধবধবে সাদা প্যাক আইস। রিস্ট কর্ড ও পায়ের স্টিরাপের গুণে এএফডিভির উপর টিকে আছে সবাই।

আবছা সাদা আলোর ভিতর দিয়ে চলছে রানারা, ক্রমেই উঠে আসছে সাগরের মেঝে।

কিছুক্ষণের ভিতর প্রথম দ্বীপের কাছে পৌঁছে গেল ওরা।

স্কুবা মাস্ক পরেছে রাশান বৈজ্ঞানিক, মুখে রেগুলেটর, হাত তুলে ডানদিক দেখাল। গতি না কমিয়ে দ্বীপের ভিত্তির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল রানা, এখনও চলেছে ভাসমান বরফের তলা দিয়ে। কয়েক মিনিট যাওয়ার পর পড়ল খাটো এক নালার ভিতর। ওটা পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারও উঠে এল সাগরের জমি, উপরে প্যাক আইস। ওরা পৌছে গেছে দ্বিতীয় দ্বীপের কাছে।

দিক নির্দেশ করল তারাসভ।

দ্বীপের পাশ দিয়ে চলেছে রানা। পৌছে গেল চৌকো কংক্রিটের মস্ত এক দরজার সামনে। যেন রেলগাড়ির টানেল, এসব থাকে পাথুরে এলাকায়।

এই লোডিং ডকের কথাই বলেছে বিজ্ঞানী।

ছাতের ভাঙা কংক্রিটের চাঁই ঝুঁকে এসেছে নীচে। দাঁত বের করেছে বেঁকে যাওয়া সব লোহার পুরু রড। অতীতে কোনও এক সময়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে ডকের ছাত। এখন আর এ পথে ভিড়তে পারবে না কোনও বোট। কিন্তু ডকের তলা দিয়ে চলবে সাবমারসিবল।

ভাঙা কংক্রিটের টানেলের ওদিকে শুধু ঘুটঘুটে আঁধার।

পিছনে ম্যাক পাওলোর সাবমারসিবলটাকে নিয়ে সাবধানে এগোতে লাগল রানা।

তিরিশ গজ যাওয়ার পর পাওয়া গেল ভেসে উঠবার মত জায়গা। এদিকের পানি এতই টলটলে, যেন চৌকো কোনও কাঁচের পাত।

নিশাত ও প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চের দিকে ইশারা করল রানা। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে গেল দুই কমাণ্ডো। এবার উপরে উঠতে লাগল রানা।

ভেসে উঠল কয়েক সেকেণ্ড পর।

ছোট একটা কংক্রিটের ডকে হাজির হয়েছে ওরা। চারপাশে দিনের ধবধবে আলো।

মাস্ক খুলে ফেলল রানা। চমকে গেছে।

কংক্রিটের দেয়ালের নানাদিকে লেগে আছে রক্তের ছিটে।

একপাশের কাঁচের দরজায় ফাটল।

একটু দূরে পড়ে আছে একটা পোলার বেয়ার। খুবলে খাওয়া হয়েছে ওটার মাংস।

ভয়ানক দুর্গন্ধে নাক কুঁচকে গেল সবার।

পচা রক্ত ও মাংসের বদবু।

একটু দূরেই রিইনফোর্সড কাঁচের দরজা। পাশের দেয়ালেই কি-প্যাড। এখনও কাজ করে। জ্বলজ্বল করছে বাতি।

ওই দরজা দিয়ে যেতে হবে দ্বীপের ওদিকে।

কপাল ভাল, এখনও আস্ত আছে কাঁচের দরজা।

ওদিক থেকে যেন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল বালতি ভরা রক্ত।

ওয়ায়ার-ফ্রেমের কাঁচের দরজার ওপাশে কোনও জন্তুর খামচির গভীর সব দাগ।

‘এ জায়গাটা আসলে কী?’ এএফডিভি থেকে নেমে কংক্রিটের ডকে পা রাখল রানা। কেউ জবাব দেয়ার আগেই অন্ধকার এক কোনা থেকে ছুটে এল কী যেন।

ওটা প্রকাণ্ড। সাদা। প্রচণ্ড গতি। ভয়ঙ্কর এক গর্জন ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল রানার ওপর।

প্রতিক্রিয়ার সুযোগই পেল না রানা, চরকির মত ঘুরেই আবছাভাবে দেখল অসংখ্য হলদে দাঁত। জট পাকানো সাদাটে রোম, দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে দীর্ঘ দুই বাহু। থাবার আঙুলগুলোয় নোংরা বাঁকা সব নখ!

অন্তত দশটা গুলি করা হয়েছে ডকের বদ্ধ পরিবেশে।

ঝটকা খেল বিশাল প্রাণীটার মাথা।

দ্বিতীয় দফা গুলি করা হলো পোলার বেয়ারের বুকে।

হ্যাঁ, জন্তুটা মেরু ভালুকই। কিন্তু আগে কখনও এমন পোলার বেয়ার দেখেনি রানা।

হৃৎপিণ্ডে গুলি লাগতেই থমকে গেছে জানোয়ারটা। ধুপ করে পড়ল মেঝেতে, মৃত।

কে ওকে রক্ষা করেছে দেখবার জন্য ঘুরে চাইল রানা। ভেবেছিল গুলি করেছে নিশাত বা ফ্রেঞ্চ দানব।

তা নয়।

অন্য দুই ফ্রগম্যানের একজনের অস্ত্রের নল থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। তিন ফ্রেঞ্চের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সে। হাতে শ্টায়ার টিএমপি মেশিন পিস্তল। অস্ট্রেলিয়ান অস্ত্রটা দেখতে উযির মতই, কিন্তু আধুনিক। নিখুঁত ফায়ারিং পজিশনে রাখা হয়েছে ওটাকে।

এক সেকেণ্ড পর ঘুরে গেল ফ্রগম্যান, এবার অস্ত্র তাক করল রানার বুকে। তখনই আততায়ীর ডান কবজির ভিতরের অংশ দেখল রানা। ওখানে একটা উল্কি। তার ভিতর লেখা: পনেরো।

তারমানে এই লোকই ডিজিএসই-র এজেণ্ট সেই এস. এফ।

ফ্রান্সের এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, বা ডিজিএসই-র আততায়ী।

রানাকে খুন করবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে একেই।

অস্ত্রটা বাড়িয়ে রেখেছে, অন্যহাতে ঝটকা দিয়ে খুলে ফেলল স্কুবা হুড।

অবাক হয়ে রানা দেখল, এ কোনও লোক নয়!

কৃষ্ণ কেশের, কুচকুচে কালো চোখের অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর চোখে!

‘অ্যালো, মেজর রানা,’ ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে নিচু স্বরে বলল সুন্দরী, ‘আমার নাম শ্যাখন ফ্যেনুয়্যা। আমাকে পাঠানো হয়েছে ডিখেকস জেনাখেলে দে লা সিকিউখিতে এক্সতেখিয়েখ থেকে। নিশ্চয়ই জানো, আমি এসেছি তোমাকে খুন করতে। কিন্তু কাজটা করার আগে জানতে চাই, বলো তো, এখানে আসলে কী ঘটছে?’

শ্যাখন ফ্যেনুয়্যার অস্ত্রের ব্যারেলের দিকে চেয়ে আছে রানা।

পিছনে ওর দলের অন্যরা। নিশাত সুলতানা, বব, পাওলো এবং তিন সিভিলিয়ান – জর্জ চ্যাণ্ডোপল, ফারিয়া ও পবন।

মেয়েটার নাম ইংরেজিতে শ্যাখনের বদলে শ্যারন হবে, ভাবল রানা। তার পিছনে অন্য দুই ফ্রেঞ্চ সঙ্গী। বাগিয়ে ধরেছে অস্ত্র। বদ্ধ জায়গায় দানবের কর্ড দেখাচ্ছে হাউয়িটারের মত।

একপাশে দাঁড়িয়ে রাশান বিজ্ঞানী ম্যাকসিম তারাসভ।

সৃষ্টি হয়েছে ভীষণ অস্বস্তিকর পরিবেশ।

কঠোর চোখে রানার দিকে চেয়ে আছে শ্যারন। কীসের যেন হিসাব কষছে।

আমার ওজন বুঝতে চাইছে, মনে মনে বলল রানা।

আন্দাজ করল, মেয়েটার উচ্চতা হবে পাঁচ ফুট ছয়।

পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মেয়েটিকে ভাল লাগতে পারত রানার।

অদ্ভুত অপরূপা। দেহ ক্ষিপ্র চিতার মত, অ্যাথলেটিক। জ্যোৎস্না রঙের ত্বক। গোল মুখটা পূর্ণ চাঁদের মত। কপালের শেষে কালো চুল, চুড়ো করে খোঁপা করা। এখন সামান্যতম নড়ছে না দু’চোখের কালো দুই মণি।

শ্টায়ার ছাড়াও ওয়েপন বেল্টে স্মোক ও স্টান গ্রেনেড। পাশে ঝুলছে এনার্জি ড্রিঙ্কের ক্যান আকৃতির কয়েকটা পাঁচ মিনিট চলবার মত স্কুবা ব্রেদিং বটল। কোমরে দুটো ছোরা, একটা রুপালি সিগ সাওয়ার পি২২৬ পিস্তল। বুকে ছোট হোলস্টার। শেষ উপায় হিসাবে রাখা হয়েছে ছোট্ট পিস্তল রুগার এলসিপি।

আস্তে করে মাথা কাত করল রানা। ‘শ্যারন ফ্যেনুয়্যা?’

‘তুমি যেন নামটা আগেও শুনেছ?’

সতর্ক সুরে বলল রানা, ‘অ্যান্টার্কটিকার এক আইস স্টেশনে দেখা হয়েছিল এক ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীর সঙ্গে। তার নাম ছিল ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা।’

পলক পড়ল না শ্যারন ফ্যেনুয়্যার চোখে।

‘ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যা তোমার আত্মীয়?….ভাই?’

‘চাচাতো ভাই। ছোটবেলা থেকেই খাতির ছিল আমাদের।’ মনের চোখে লোকটাকে দেখল রানা। যেন ক’ দিন আগের কথা। ফ্রেঞ্চ উপকূলীয় রিসার্চ স্টেশন ডুমো ডি’খ-ঈলেখ থেকে এসেছিল সে। সঙ্গে ছিল নকল বিজ্ঞানী ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপার দল। তাদের কাজ ছিল উইলকক্স আইস স্টেশনের সবাইকে খুন করে স্পেসশিপ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

‘ম্যাথিউ সিভিলিয়ান ছিল, একজন বিজ্ঞানী…’ শুরু করেও থেমে গেল শ্যারন।

‘যার কাজ ছিল বাংলাদেশ এবং আমেরিকার বিজ্ঞানীদেরকে খুন করে সবার আগে স্পেসশিপ দখল করা,’ পাল্টা খোঁচা দিল রানা। ‘কিন্তু পরে দেখা গেল, ওই স্পেসশিপ আসলে মোটেও ভিনগ্রহের নয়।’

আরও শীতল হয়ে গেল শ্যারনের চোখ। ‘তুমি কি তাকে নিজ হাতে খুন করেছ?’

‘ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্র করেছিল, খুন করেছিল…’

‘তুমি কি তাকে খুন করেছ?’

‘না। ওকে খুন করেছিল এসএএস-এর প্রধান জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।’ বাধ্য হয়ে উইলকক্স স্টেশন ত্যাগ করে সরে যেতে হয়েছিল রানাকে। ব্যবহার করেছিল কয়েকটি হোভারক্রাফট। একটা খুঁটির সঙ্গে হ্যাণ্ডকাফে আটকে রেখে গিয়েছিল ও ম্যাথিউ ফ্যেনুয়্যাকে। পরে তার মাথায় গুলি করে খুন করেছিল গুণ্ডারসন।

রানার বুকে এখনও অস্ত্র তাক করে রেখেছে শ্যারন।

কালো চোখদুটো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রানাকে। টানটান উত্তেজনার ভিতর দিয়ে দীর্ঘ একটা সময় পেরিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ করেই মাথা সামান্য কাত করল শ্যারন, চোখে দ্বিধা।

কারণটা বোধহয় বুঝতে পারছে রানা।

কোনও মিথ্যার জন্য তৈরি ছিল মেয়েটি, কিন্তু তার ধারকাছ দিয়েও যায়নি ও।

অবাক হয়েছে শ্যারন।

বোধহয় বিস্মিত হতে অভ্যস্ত নয় এই মেয়ে।

খুন করতে এসেছে এক খুনিকে। বদলে দেখছে…

‘মেজর রানা, নিশ্চয়ই জানো দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স তোমার মাথার উপর পুরস্কার ঘোষণা করেছে? তুমি উইলকক্স আইস স্টেশনে এবং পরে যা করেছ, সেজন্যে তোমাকে মরতে হবে। ধ্বংস করেছ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ব্রিয়া পওলাস। আর আমার নিজের ব্যক্তিগত কারণে চাই তুমি মারা পড়ো। আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে তোমাকে হত্যা করতে, তার পরেও একটু আগে আমার লোক এবং আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে সরিয়ে এনেছ। …এর কারণ কী?’

সহজ গলায় বলে গেল রানা, ‘আমি প্রায় অসম্ভবের বিরুদ্ধে লড়ছি। তোমার দেশ বা আমার বিরুদ্ধে তোমাদের প্রতিশোধের চেয়েও ঢের বড় হয়ে উঠেছে এখন গোটা পৃথিবীটা রক্ষা করা। একটু আগে আস্ত একটা সাবমেরিন হারিয়েছ তোমরা। পারলে সবাইকে বাঁচাতাম। এখন শত শত সৈনিক দরকার। আমার মনে হয়েছে, আমরা যদি তোমাদেরকে উদ্ধার করি, তোমরা হয়তো জানতে চাইবে কী ঘটছে এখানে। এমনও হতে পারে, তোমরা হয়তো আমার মিশনে যোগ দেবে।’

অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।

নিষ্কম্প হাতে অস্ত্র তাক করে রেখেছে রানার বুকে।

তারপর আস্তে করে অস্ত্রটা নামিয়ে নিল সে।

‘ঠিক আছে, মেজর, আমি শুনছি। যা বলার বলো। কিন্তু একটা কথা মগজে গেঁথে নাওঃ এই বিপদ থেকে বেরিয়ে গেলেই মুখোমুখি হব আমরা। আমার হাতে মরবে তুমি।’ নিজের লোকদের দিকে হাতের ইশারা করল মেয়েটা। ‘ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন ও সার্জেন্ট লেটিনিয়া। …ঠিক আছে, এবার জানাও কী ঘটছে এখানে।’

সংক্ষেপে শ্যারন এবং তার দুই সঙ্গীকে সবই খুলে বলল রানা। তাতে সময় নিল বড়জোর তিন মিনিট। পোলার আইল্যাণ্ড, দস্যু আর্মি, অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন বিষয়ে সবই জানা হয়ে গেল ফ্রেঞ্চদের। শেষে রানা যোগ করল, ‘আমাদেরকে শেষ করতে হাজির হয়েছিল রাফিয়ান আর্মির এয়ারক্রাফট, এবং ঠিক সেই সময়ে হাজির হয়েছ তোমরা, ফলে খুইয়েছ সাবমেরিনটা।

পবনের কাছ থেকে রিস্টগার্ড নিল রানা, ওটার স্ক্রিন চালু করল। রাফিয়ান আর্মির নেতা এবং রাশান প্রেসিডেন্টের ভিডিয়ো ক্লিপ দেখাল শ্যারনকে।

এ সময়ে প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেনের পাশে চলে গেল নিশাত। বলল, ‘হ্যালো।’

‘অ্যালো।’

‘ভাল অস্ত্র। কর্ড।’

‘অস্ত্রের প্রশংসার জন্যে ধন্যবাদ,’ আস্তে করে মাথা দোলাল দানব। নিশাতের রাইফেলটা দেখল। ‘জি৩৬। ওটাও ভাল অস্ত্র।’

হাত বাড়িয়ে দিল নিশাত, ‘বাংলাদেশ আর্মি, ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা।’

‘আমি ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন, ফার্স্ট প্যারাশুট রেজিমেন্ট। আর্মি থেকে আমাকে ডিজিএসই-এর সঙ্গে কাজ করতে পাঠানো হয়েছে। বন্ধুরা ডাকে বুনো বলে।’

লোকটার উস্কোখুস্কো চুল ও দাড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেন বুনো বলা হয়, ভাবল নিশাত। ‘বুনো? ভাল নাম।’

‘আস্থা রাখতে পারেন আমার ওপর, ওই নাম এমনি এমনি হয়নি। আমি ভালুকের মত খাই, মদ গিলি ভাইকিঙের মত, খুন করি সিংহের মত— সমস্যা শুধু…’ ভুরু কুঁচকে ফেলল ক্যাপ্টেন।

‘বলুন, অসুবিধে কী?’ উৎসাহ দিল নিশাত।

‘না, থাক।’

‘বাদ থাকবে কেন?’

মস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুনো। ‘না, কোনও মেয়ে কখনও আমাকে ভালবাসেনি।’

‘একদিন নিশ্চয়ই বাসবে,’ সান্ত্বনা দিল নিশাত।

‘হয়তো…’ আরেকবার নিশাতের জি৩৬ রাইফেল দেখল সে, তারপর বলল, ‘আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে বুনো নামে ডাকতে পারেন।’

লোকটার বয়স কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ, কিন্তু এখনও ক্যাপ্টেন রয়ে গেছে কেন, ভাবল নিশাত। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, অনেক বেশি বয়সে আর্মিতে যোগ দিয়েছেন?’

আস্তে করে মাথা নাড়ল বাদামি চুলের দানব। ‘না। বাড়াবাড়ি করায় এক ব্রিগেডিয়ারকে পিটিয়ে দিয়েছিলাম, তাই দুই ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে।’

‘আচ্ছা, তার মানে আগে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল?’

‘হ্যাঁ।’

সাহসের অভাব নেই এর, কেন যেন দানবটাকে পছন্দ করে ফেলল নিশাত। বাংলায় বিড়বিড় করল, ‘ব্যাটা লোক খারাপ মনে হচ্ছে না।’

‘কিছু বললেন?’ জানতে চাইল বুনো।

‘না, কিছু না।’

কথা আরও চলত, কিন্তু তখনই রাফিয়ান আর্মি সম্পর্কে কী যেন বলল শ্যারন ফ্যেনুয়্যা। বুনো ও নিশাত মনোযোগ দিল আলাপে।

‘তা হলে এরাই রাফিয়ান আর্মি…’ এমপিইজি দেখা শেষ করেছে শ্যারন।

‘আগেও এদের নাম শুনেছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘ডিজিএসই-র যে ডিভিশনে আছি, তার কাজ টেরোরিস্ট অর্গানাইযেশন নিয়ে নয়,’ বলল শ্যারন, ‘কিন্তু, হ্যাঁ, কয়েক মাস আগে আমাদেরকে ওই সংগঠনের বিষয়ে ব্রিফ করা হয়েছে।

‘তাতে কী বলা হয়েছে?’

‘গত বছর থেকে এই দলের ওপর চোখ রাখছে ডিজিএসই। বিসিআই-এর মত প্রতিটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি তাই করছে।’

‘আমাদেরকে এই তথ্য পাঠানো হয়েছে,’ ডিআইএ-র মহিলা এজেণ্ট রিনা গর্ডনের কাছ থেকে পাওয়া রিপোর্ট রিস্টগার্ডের স্ক্রিনে শ্যারনকে দেখাল রানা।

চট করে পড়ল ডিজিএসই এজেন্ট।

‘আমিও কাছাকাছি একই রিপোর্ট পেয়েছি।’

‘এরা কারা, বা কী কারণে এসব করছে?’ বলল রানা।

‘এরা কারা?’ কাঁধ ঝাঁকাল শ্যারন। ‘নতুন কোনও টেরোরিস্ট গ্রুপ? আল-কায়েদার এক অংশ? কোনও দস্যু আর্মি, যাদের নীতি নেই? কোনও দেশের নয়? …. কেউ জানে না কিছুই।’

‘এদের নেতা সম্পর্কে কিছু জানো? অনায়াসে রাশান প্রেসিডেন্টকে অপমান করছে। …কে এই লোক?’

‘যে লোক ওই আর্মির প্রধান, তার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। সামান্য কয়েকটা সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে। ওই লোক সবসময় বড় সানগ্লাস পরে। মাথায় থাকে হুড বা হেলমেট। পরিচয় জানার উপায় থাকে না। কিন্তু বাম কান ও চোয়ালের অ্যাসিডের ক্ষত লুকায় না- হয়তো ইচ্ছে করেই। প্রতিটি মিলিটারি ডেটাবেস খুঁজে দেখেছে ডিজিএসই, কোথাও এই চেহারার কোনও সৈনিক বা স্পেশালিস্টকে পাওয়া যায়নি।

‘এ ছাড়া, কয়েকটা হামলার সময় তার কয়েকজন লেফটেন্যান্টের ছবি পাওয়া গেছে ক্লো-সার্কিট ক্যামেরায়। রাফিয়ান আর্মি চিফের ডানহাত বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের একজনকে। সে প্রাক্তন এক চিলিয়ান টর্চারার। নাম: সাইক্লোন।’

চুপ হয়ে গেল শ্যারন, কী যেন ভাবছে।

‘আমাদের ধারণা রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে অত্যন্ত দক্ষ একদল মিলিটারি অফিসার। দলের সদস্যদের তেমন মূল্য নেই। আবার এ-ও ঠিক, এরা খুবই নিয়ন্ত্রিত এবং পেশাদার দল। কয়েকবার রাশান মিলিটারি ভেসেল এবং ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসের বেসে হামলা করেছে।’

‘কিন্তু কী চায় ওরা?’ বলল রানা। ‘এ ধরনের দল সাধারণত কিছু না কিছু চায়। হয়তো নতুন কোনও দেশ গড়বে, বা ছুটিয়ে নিতে চায় কারাগার থেকে দলের বন্দিদের…’ কাঁধ ঝাঁকাল ও। ‘রাফিয়ান আর্মির সর্বোচ্চ নেতা রাশান প্রেসিডেন্টকে বলেছে: ‘আমরা গরীব ও ক্ষুধার্ত দল, সব নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এমন এক দল, যারা বিদ্রোহ করেছে ক্ষমতাশালী আপনাদের সবার বিরুদ্ধে। গৃহস্বামীর দরজার সামনে বসে থাকা ক্ষুধার্ত কুকুর আমরা।’ এসব পংক্তি নিয়েছে উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা অগারিয অভ ইনোসেন্স থেকে।’

‘ভাল রেফারেন্স,’ মাথা দোলাল শ্যারন। ‘ভুল পথে চলে যাওয়া আরেক রবিন হুড? গরীবদের হয়ে ধ্বংস করবে ধনী রাষ্ট্র?’

‘জানি না কী চায়,’ বলল রানা।

‘আমরাও জানি না।’ আস্তে করে মাথা নাড়ল শ্যারন।

ভুরু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা, ‘চিলির কারাগার থেকে পালিয়ে গেছে এক শ’ কয়েদী। এর পর পরই সুদানের জেল থেকে বেরিয়ে গেছে আরও এক শ’ জন। এ ছাড়াও রয়েছে দস্যু আর্মির অফিসাররা। ওই দ্বীপে উঠলে হয়তো মুখোমুখি হব দুই শ’ বিশজন খুনির।’

‘আর আমরা মাত্র দশজন,’ বলল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো। ‘আমাদের বোধহয় উচিত……’

‘আমি নিজেই দশজনের সমান,’ হাসিমুখে বলল নিশাত।

‘আর আমি বিশজন,’ বলল ফ্রেঞ্চ বুনো।

‘সাবমেরিন ডকে এক শ’ যোদ্ধার মুখোমুখি হয়েছিল বিখ্যাত হাতুড়িমাথা নটি এরিকের টিম,’ হতাশ সুরে বলল পাওলো। ‘মনে রাখুন তাদের কী হয়েছে। আর তারা ছিল সিল টিম!’

রানা চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি:

৯:৩৫

‘হাতে একঘণ্টা পঁচিশ মিনিট আছে,’ গম্ভীর সুরে বলল রানা।

উঠে দাঁড়াল মেরিন ক্যাপ্টেন পাওলো। ‘আপনি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন, মেজর? আমাদের সঙ্গে যদি আরও পঞ্চাশজন সৈনিকও থাকত, এক সপ্তাহ লড়াই করেও ওই দ্বীপে উঠতে পারতাম না! নিজের দলের দিকে দেখুন। আমরা আটকা পড়েছি দুর্গন্ধভরা এই গর্তে। কোথাও যাওয়ার নেই। এরা যদি আমাদের পিছনে সৈনিক পাঠিয়ে দেয়, আমরা শেষ। এই মিশন অফিশিয়ালি আত্মহত্যার।’

স্থির চোখে পাওলোর দিকে চাইল রানা, কিন্তু টু শব্দ করল না।

মিথ্যা বলেনি মেরিন ক্যাপ্টেন, সত্যিই ওরা ঝাঁপ দিতে চলেছে মৃত্যুর মুখে।

নয়

যখন দ্বিতীয় দ্বীপের ডকে আলাপ করছে রানা ও তার দলের সবাই, সেই সময় ওদের উপর হামলা করা ভি-২২ অসপ্রে ফিরছে পোলার আইল্যাণ্ডে।

দেখতে না দেখতে উত্তরদিকের U আকৃতি উপসাগরে পৌঁছে গেল এয়ারক্রাফট, ছোট্ট তিন দ্বীপ পেরিয়ে বাড়িয়ে নিল উচ্চতা, ডিঙিয়ে গেল মৃত্যুদ্বীপের উত্তরের ক্লিফ। পিছনে রইল আকাশ- ছোঁয়া ক্লিফের পায়ের কাছে তৃতীয় জনশূন্য দ্বীপ। ওটার চারপাশের সাগরে গলতে শুরু করেছে বরফের মাঠ। এখানে ওখানে টলটল করছে নীল জল। তার ওপর ভাসছে ট্রাকের সমান সব বরফখণ্ড।

পুরনো কেবল কার টার্মিনালের উপর দিয়ে ভেসে গেল অসপ্রে। কাছের খুদে দ্বীপের সঙ্গে তারের মাধ্যমে সংযুক্ত মূল দ্বীপের টার্মিনাল। ওটা পেরোবার পর অদ্ভুত দৃশ্য দেখল বিমানের পাইলট— মাথাছেলা।

দূরে, বামে প্রকাণ্ড দুই ভেণ্ট থেকে আকাশে উঠছে ঝিলমিলে টিইবি মিশ্রণ। ভোরে দুই ভেন্টের একটার গায়ে আঁকা হয়েছে মস্ত এক বৃত্ত, ভিতরে বিশাল অক্ষরে লেখা: R. A.। ওটা জানিয়ে চলেছে রাফিয়ান আর্মি বা দস্যু আর্মির দাপট। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য রেকনেসেন্স স্যাটালাইটকে সামান্যতম পাত্তা দেয়া হয়নি। ভাবটা এমন: ‘শালারা, দ্যাখ আমাদেরকে! কী করবি? পারলে কর্ দেখি!’

অসপ্রের সামনে পড়ল মেইন টাওয়ার। দোতলা প্রকাণ্ড এক তস্তরির মত দালান বসে আছে দুই শ’ ফুট উঁচু কংক্রিট পিলারের উপর। গোটা ভবন রয়েছে মস্ত এক বৃত্তাকার গভীর কুয়ার ভিতর। সমতল থেকে ভবনে পৌঁছতে হলে ব্যবহার করতে হবে ক্রেন ব্রিজ। কুয়া ও ভবনের দু’দিকে রয়েছে দুটো ওই জিনিস। ভবন থেকে নামিয়ে দেয়া বা তুলে নেয়া যায় বিশাল দুই সেতু।

বড় ডিস্কের মাথায় হেলিপ্যাড। পাশে, উপরের দিকে দুই কাঁচ ঢাকা গম্বুজ। ওখানে কমপ্লেক্সের কমাণ্ড সেন্টার।

কুয়া থেকে আরম্ভ হওয়া প্রকাণ্ড পিলারের শেষমাথা বা সবচেয়ে উঁচু অ্যান্টেনা কমপক্ষে চার শ’ ফুট উঁচু। ওটা ভাসমান অসপ্রে থেকে অনেক উপরে। ওখান থেকে নীচে চাইলে স্টেশন, গার্ডহাউস, ওয়াচ টাওয়ার ও রাফিয়ান আর্মির সদস্যদেরকে মনে হবে খুবই ছোট পিঁপড়ের মত।

সামনে বেড়ে হেলিপ্যাডের উপর ভাসতে লাগল অসপ্রে, তারপর আস্তে করে নেমে পড়ল। অন্য ক্রুদেরকে নিয়ে এয়ারক্রাফট থেকে নামল মাথাছেলা। মার্চ করে গিয়ে ঢুকল কমাণ্ড সেন্টারে।

দলের সবাইকে নিয়ে সর্বোচ্চ নেতার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মাথাছেলা।

কাঁচ ঢাকা কমাণ্ড সেন্টারের একদিক থেকে আরেকদিক কমপক্ষে সত্তর ফুট দৈর্ঘ্যের। ওখানে একের পর এক কন্সোল, কমপিউটার ও কমিউনিকেশন ডেস্ক। ওগুলো ঘিরে রেখেছে উঁচু এক কংক্রিটের মঞ্চকে। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় গোটা দ্বীপের চারপাশ।

মঞ্চে কমাণ্ড চেয়ারে বসে আছে রাফিয়ান আর্মির সর্বোচ্চ নেতা নামহীন জেনারেল।

এ মুহূর্তে চোখে এলভিস সানগ্লাস নেই। যে-কেউ দেখতে পাবে দুই চোখ। পলক পড়ছে না। ফ্যাকাসে ধূসর মণি। অ্যাসিড পুড়িয়ে দিয়েছে কানের লতি, বাম চোয়াল ও গলা, ফলে ওসব জায়গায় জ্বলে গেছে ত্বকের স্বাভাবিক রং। বগলে, পিঠে, কোমরে ও উরুতে বেশ কয়েকটা পিস্তল ভরা হোলস্টার। দরকার পড়লে বের করবে পিস্তল। ঘাড়ের পাশে একের পর এক ছোট উল্কি তার ভিতর রয়েছে এক রাশান কার্গো জাহাজের ছবি ও একটা দালান।

অধীনস্থদের কাছে সে বিশৃঙ্খলার সম্রাট বা দস্যু সেনাবাহিনীর জেনারেল হিসাবে পরিচিত। সবাই তাকে ডাকে: ‘মাই লর্ড’, ‘লর্ড’ এবং ‘স্যর’ বলে।

শ্বেতাঙ্গ সে, কিন্তু সূর্যের তাপে পুড়ে গেছে ত্বক। কেউ জানে না আসলে কোথাকার মানুষ।

আমেরিকানদের মত করেই ইংরেজি বলে, আবার একই সময়ে নিখুঁতভাবে বলতে পারে রাশান, স্প্যানিশ, ফরাসি ও ফারসি।

রাফিয়ান আর্মির সবাই জানে: এ দলের প্রত্যেককে নিজে বাছাই করেছে লর্ড। তার কাছের লোকগুলো কীভাবে জড় হলো, কেউ জানে না। লর্ডের সিনিয়ার অফিসাররা সংখ্যায় পাঁচজন। প্রত্যেকের আছে ছদ্মনাম। তারা: মাথাছেলা, হাঙর, কসাই, জল্লাদ এবং সাইক্লোন।

আর্মির ভিতর নানা গুজব আছে।

অনেকে বলে : এসব অফিসার তুরস্কের প্রাক্তন আর্মি অফিসার। যোগ দিয়েছিল আল-কায়েদায়। কিন্তু পরে দেখা গেল এরা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর। আল-কায়েদা থেকে ভাগিয়ে দেয়া হলো তাদেরকে।

কেউ কেউ ধারণা করে: এসব অফিসার আসলে প্রাক্তন চিলিয়ান আর্মির অফিসার।

একদল বলে: তারা প্রাক্তন মিশরীয় টর্চারার। কাজ করত আমেরিকার হয়ে। কাউকে টেরোরিস্ট বলে সন্দেহ হলেই নির্যাতনের পর খুন করত।

আরেকদল বলে: এসব অফিসার আসলে আমেরিকান মার্সেনারি, রক্ত না দেখলে গালের খাবার পেটে নামে না।

বিশৃঙ্খলার সম্রাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ডানহাত- সাইক্লোন। প্রকাণ্ডদেহী লোক, মৃত মাছের চোখের মত চোখদুটো ভয়ঙ্কর খুনির। যার দিকে তাকায়, শীতল দৃষ্টি থরথর করে কাঁপিয়ে দেয় তার বুক।

রাফিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়ার সময় প্রত্যেককে বাজিয়ে দেখে সাইক্লোন। পদোন্নতি দেয়ার সময় নির্দিষ্ট চিহ্ন এঁকে দেয় সে-ই। বাহুর উপর চেপে ধরে গনগনে আগুনের ব্র্যাণ্ডিং আয়ার্ন। তারপর চিরস্থায়ী কালিতে আঁকে উল্কি। র‍্যাঙ্ক হিসাবে কারও পোশাকের কাঁধে বা কব্জিতে পদ সেলাই করা হয় না এই আর্মিতে, চিহ্ন এঁকে দেয়া হয় ত্বক পুড়িয়ে।

দলের নতুন সদস্যকে নির্দিষ্ট সব অনুষ্ঠান দেখায় সাইক্লোন। ড্রাগ দেয়া হয় তাকে। চারটে টিভি স্ক্রিনে দেখানো হয় কাউকে ভয়ঙ্করভাবে পেটাচ্ছে সাইক্লোন। শেষে ছোরা দিয়ে কেটে নিচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত লোকটার মাথা। বা টিভির পর্দায় ফুটে ওঠে কীভাবে অসহায় কোনও মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে, ডুবিয়ে মারা হচ্ছে বালতিতে মাথা চুবিয়ে ধরে, বা অন্য কোনওভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে শিশুকে।

রাফিয়ান আর্মির প্রত্যেকে বিশৃঙ্খলার সম্রাটকে মেনে চলে, কারণ তিনি স্রষ্টার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষমতাশালী। সাইক্লোনকে মেনে চলে নিজ নিজ প্রাণের ভয়ে।

‘রিপোর্ট দাও,’ বলল দস্যু আর্মির সর্বোচ্চ নেতা।

‘মাই লর্ড, বলল মাথাছেলা, ‘তারাসভের বিমান আমরা পেয়েছি। যখন পৌছলাম, ওই একইসময়ে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশি দলটাও। তাদের খতম করছি, এমন সময় ভেসে উঠল ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন।’

একটা ভুরু উঁচু করল জেনারেল। ‘একটা ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন? বলে যাও।’

‘আমার মনে হয় না আমেরিকানদের সঙ্গে মিলে কাজ করছিল ওই ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন। আমরা টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দিই ওটাকে। তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, আর সে সময় বাংলাদেশি টিম উড়িয়ে দিল আমাদের একটা কোবরা কপ্টার। এরপর দেরি না করে অ্যাসল্ট বোট নিয়ে পালাতে লাগল তারা। আমার দলের অন্য কোবরা একটু আগে তাদেরকে দেখেছে ওদিকের সামনের দ্বীপের কাছে। কিন্তু তখনই বাংলাদেশিরা ওটাকে আকাশ থেকে ফেলে দিল। এরপর যখন ওদিকে পৌছলাম, দেখলাম সাগরের উপরে কেউ নেই।‘

‘তার মানে?’

‘তাদের বোট বোধহয় নতুন কোনও সাবমারসিবল, স্যর।’

‘ক্যাপ্টেন, ওরা বাংলাদেশি সায়েন্টিফিক টেস্টিং টিম। যা-ই হোক, তুমি তোমার রিপোর্টে একটা বিষয় উপেক্ষা করেছ।’

বরফ-মূর্তি হয়ে গেল মাথাছেলা। ‘স্যর… উপেক্ষা করেছি?’

‘ব্যর্থ হয়েছে তোমার মিশন। তোমাকে বলে দেয়া হয়েছিল, ওখানে গিয়ে সবাইকে খুন করবে। কাজটা শেষ করতে পারোনি কাজেই ব্যর্থ হয়েছ তুমি।’

‘ভয়ঙ্কর লড়াই শুরু করে ওরা…’

‘আমি ব্যর্থতা সহ্য করি না, ক্যাপ্টেন। বিশেষ করে কোনও মিশনে। এই আর্মি জানে শুধু একটা বিষয়: নিখুঁতভাবে কাজ করতে হবে। তুমি তোমার কাজ সমাধা করোনি, কাজেই আমাদের সবাইকে বিপদের মুখে ফেলেছ। …তোমার পরবর্তী জুনিয়র অফিসার কে?’

পাশের তরুণকে দেখাল মাথাছেলা। ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রাফায়েল, স্যর। চিলি থেকে এসেছে।’

তরুণ অফিসারের দিকে চোখ গেল জেনারেলের। দেখল আপাদমস্তক। তারপর সামান্য মাথা দোলাল সাইক্লোনের দিকে চেয়ে।

কোমরের বেল্ট থেকে চাপাটি বের করল সাইক্লোন, ওটা রাখল মাথাছেলা ও তরুণ লেফটেন্যান্ট রাফায়েলের সামনের টেবিলে।

বিশৃঙ্খলার জেনারেল বলল, ‘লেফটেন্যান্ট রাফায়েল, আমি তোমার ক্যাপ্টেনকে শিক্ষা দিতে চাই। আশা করি এরপর কখনও ভুল করবে না সে। এখন কথা হচ্ছে, চাইলে আমি তাকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন্য কিছু বলে। আসলে সত্যিকারের শিক্ষা দিতে হলে, শাস্তি দিতে হলে, কাউকে নির্যাতন করতে হলে, বা জরুরি তথ্য আদায় করতে হলে, প্রথম কাজ হওয়া উচিত লোকটার খুব কাছের কাউকে কষ্ট দেয়া। …কাজেই, বাছা রাফায়েল, তুমি কি দয়া করে তোমার বাম কব্জিটা কেটে ফেলবে?’

শুনছিল কয়েকজন কমিউনিকেশন অপারেটার, বোকা চোখে সামনের দিকে চাইল তারা।

বিস্ফারিত হয়েছে লেফটেন্যান্ট রাফায়েলের দুই চোখ।

চট করে একবার চাইল মাথাছেলার দিকে।

কিন্তু তার ক্যাপ্টেন চেয়ে আছে বহু দূরে।

অধীনস্থের দৃষ্টি এড়াতে ব্যস্ত।

ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে দস্যু আর্মির জেনারেল। কোনও কথা বলছে না।

একবার সামান্য দ্বিধা করল তরুণ লেফটেন্যান্ট, তারপর সামনের টেবিল থেকে তুলে নিল ইস্পাতের ক্ষুরধার চাপাটি।

আর্মির সবাই এ ধরনের ঘটনার কথা আগেও শুনেছে। কেউ কেউ নিজ চোখেও দেখেছে এসব। প্রয়োজন পড়লে অবাধ্য সদস্যকে জেনারেল বলেন, যেন সে তার হাত-পা বা দেহের অন্য কোনও অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে। আগেও আঙুল, গোড়ালি খুইয়েছে কেউ কেউ। অনেকেই জানে একটা গল্প: একবার রাফিয়ান আর্মির এক সদস্য রেপ করেছিল এক আফ্রিকান নানকে। জেনারেল তাকে নির্দেশ দেন নিজ পেনিস কেটে ফেলতে। লোকটা তা-ই করেছিল।

কাজটা কীভাবে করেছিল, কেউ জানে না।

আফ্রিকান এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে আসা আর্মির সদস্যরা বলে, ওটা ব্ল্যাক ম্যাজিক বা ভুডু। আবার পশ্চিমা সদস্যরা বলে, এ আর্মিতে যোগ দেয়ার সময় যেসব দৃশ্য দেখানো হয়, তাতেই মনোবিকৃতি তৈরি হয় সবার। ঘটনা যা-ই হোক, চরম নিষ্ঠুরতার ছাপ প্রত্যেকের মনেই পড়ে। এবং সে-কারণেই বোধহয় সম্পূর্ণ বাধ্য থাকে সবাই।

চুপচাপ অপেক্ষা করছে সবাই।

ডানহাতের তর্জনী দিয়ে মাংস-কাটা চাপাটির ধার পরীক্ষা করল রাফায়েল, তারপর বাম কব্জি রাখল কাঠের টেবিলের উপর।

উঁচু করে ধরল চাপাটি।

শ্বাস আটকে ফেলেছে কমিউনিকেশন অফিসাররা।

চোখে আতঙ্ক নিয়ে চেয়ে আছে অসপ্রের ক্রুরা।

সরাসরি সামনে চেয়ে রইল মাথাছেলা।

নিষ্পলক চোখে সবই দেখছে চরম বিশৃঙ্খলার জেনারেল। মুচকি মুচকি হাসছে তার সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড, কর্নেল সাইক্লোন।

নেমে এল মাংস-কাটা চাপাটি, ভোঁতা ধপ্ আওয়াজ হলো, পরক্ষণে ভয়ঙ্কর এক চিৎকার ছাড়ল লেফটেন্যান্ট। বাতাস চিরে গেল।

মাথাছেলার দিকে ঘুরে চাইল জেনারেল।

‘আশা করি আবারও ব্যর্থ হবে না, ক্যাপ্টেন। তোমার ওপর নির্ভর করছে এই আর্মি। ডিসমিস।’

অবশিষ্ট তিন ক্রুকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল মাথাছেলা।

নিজের ব্যক্তিগত প্রহরীদের দিকে চাইল জেনারেল।

দু’হাঁটুর উপর ভর করে বসে পড়েছে লেফটেন্যান্ট রাফায়েল। কাটা কব্জি চেপে ধরেছে কোমরের পাশে।

‘মেইন ভেণ্টে গ্যাসও অর্কের কাছে ওকে কাজ দেবে,’ বলল জেনারেল। ‘এমন কোথাও, যেখানে ওকে দেখবে সবাই। কথাটা যেন ছড়িয়ে যায়।’

হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো রক্তাক্ত তরুণ রাফায়েলকে।

সে বিদায় হওয়ার পর নিষ্ঠুর ডানহাতের দিকে চাইল জেনারেল।

‘কর্নেল সাইক্লোন, আর কতক্ষণ লাগবে ইউরেনিয়ামের বল গরম হতে?’

‘আরও একঘণ্টা বিশ মিনিট, স্যর।’

‘ওই বাংলাদেশি টেস্টিং টিমের কারণে অস্বস্তি বোধ করছি। সংখ্যায় তারা মাত্র কয়েকজন। কিন্তু মনে হচ্ছে অসম্ভব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমস্যা তৈরি করতে পারে এরা।’

‘তাদের ক্যাম্প থেকে ফিরছে জল্লাদ। ওখানে একজন রয়ে গিয়েছিল। এক মিলিটারি কন্ট্রাক্টার। নাম জার্ড ময়লান। দ্বিতীয় অসপ্রেতে করে তাকে নিয়ে আসছে জল্লাদ।’

‘জার্ড ময়লানকে গ্যাসওঅর্কে পাঠিয়ে দেবে, নির্যাতন শুরু করতে হবে। আমি জানতে চাই সায়েন্টিফিক টেস্টিং টিম সম্পর্কে কী জানে সে। পরে আমাদের দলের সবাইকে মজা দেবে সে।’ সার্ভেইল্যান্স স্ক্রিনের দিকে চোখের ইশারা করল জেনারেল। ‘ওরা এখন কোথায়?’

‘ভালুক দ্বীপে।’

‘নিজের চোখে দেখেছ?’

‘ইয়েস স্যর। সিসিটিভি ফিড।’

‘প্রত্যেকের স্থির ছবি চাই। মিলিটারি ডেটাবেসে এদের বিষয়ে তথ্য খুঁজবে। এদিকে পচা নেইটরিচকে বলবে, তার দল নিয়ে যেন ওখানে যায়। সঙ্গে নেবে উন্মাদ দলের কয়েকজনকে। উল্টোদিক থেকে হামলা করবে হাঙর। আমরা অনেক দূর পৌঁছে গেছি, এখন চাই না কোনও গাধা হিরো সব বানচাল করুক। দু’দিক থেকে হামলা হোক। পিষে ফেলতে হবে ওদেরকে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *