মৃত্যুদ্বীপ – ২৫

পঁচিশ

হিমশীতল আর্কটিক।

পোলার আইল্যাণ্ড।

দুপুর সাড়ে বারোটা।

মিসাইল লঞ্চের সময় পেরোবার পর কেটে গেছে দেড় ঘণ্টা।

মুখে একের পর এক চড়-চাপড় পড়তেই ভয়ানক বিরক্তি নিয়ে সচেতন হয়ে উঠল মাসুদ রানা। চোখ সামান্য খুলল, স্টিলের পুরনো এক খাড়া খাটিয়ার ফ্রেমে আটকে রাখা হয়েছে ওকে। কটের দু’পাশের হ্যাণ্ডকাফে আটকানো দু’হাত। বেডফ্রেমের নীচের অংশে দুই দড়িতে বাঁধা ওর দু’পা।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে কর্নেল সাইক্লোন। নিচু স্বরে বলল, ‘ভোর হলো, ডাকে পাখি, ওঠো জাগি….

পরিবেশটা পছন্দ হলো না রানার। শালা আবার ছড়া কাটতে শুরু করেছে! মন কু ডাকল ওর, ভয়ঙ্কর কিছু করবে ব্যাটা।

ওর বুক পুরো খোলা।

কাঁধ থেকে টেনে কোমরের কাছে নামানো হয়েছে ওয়ান পিস স্লো ক্যামোফ্লেজ ড্রাইসুট। এভাবে ওভারঅল নামায় গাড়ির মেকানিকরা।

শীতে থরথর করে কেঁপে উঠল রানা।

পার্কা, ওয়েপন্স বেল্ট— সবই সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

অবাক কাণ্ড, মোজা ও বুটও উধাও।

খালি পায়ে কনকনে ঠাণ্ডা লাগছে।

হাওয়া হয়ে গেছে কুয়াশার দেয়া হাই-টেক রিস্টগার্ড।

রয়ে গেছে শুধু ওর ডিজিটাল ঘড়ি। বোধহয় ধরে নেয়া হয়েছে, জিনিসটার দাম এতই কম, ওটা নেয়া অর্থহীন।

অস্ত্র ও ম্যাগহুক সরিয়ে নিয়েছে।

ঘড়ি বাদে সম্বল বলতে ওর আছে সানগ্লাস। মাথার উপর তুলে রাখা।

মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখল রানা। খুবই ছোট একটা ঘরে আছে ও। দেয়ালে সিরামিক টাইল। মেঝের একপাশে অগভীর নালা। দেয়ালে শাওয়ার। এটা কোনও বাথরুম।

এইমাত্র দরজা দিয়ে এল বহু মানুষের চিৎকার।

আওয়াজের দিকে মাথা ঘোরাতে পারল না রানা।

ওটা কি উল্লাসের ধ্বনি?

আবারও রানার গালে চড় দেয়া হলো। আগের চেয়ে জোরে।

কর্নেল সাইক্লোন ধমকে উঠল, ‘জেগে ওঠ, শালা!’

দ্বিতীয় এক লোক এসে দাঁড়িয়ে গেল রানার সামনে।

চিনে ফেলল রানা। এ লোকই ভিডিয়ো লিঙ্কে রাশান প্রেসিডেন্টকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে ভেঁটে দিয়েছে। নিজের নাম দিয়েছে: বিশৃঙ্খলার সম্রাট।

সাইক্লোনের চেয়ে বয়স বেশি এর। কমপক্ষে ষাট। কিন্তু পুরোপুরি ফিট। শক্তিশালী, ব্যায়াম করে নিয়মিত। বাম চোয়ালে অ্যাসিডের দাগ। কাছ থেকে দেখলে ঘিনঘিন করে ওঠে গা। ঘায়ের মত ক্ষত। চোখদুটো অবাক করা, ধূসর। হিপনোটিক। সাইক্লোনের চোখের মত মরা নয় দৃষ্টি। সাইকোটিক নয়। অবশ্য, সামান্যতম দয়ামায়ার আভাস নেই দৃষ্টিতে। বরং উল্টো, দু’চোখ যেন চট্ করে বুঝে নেবে সামনের লোকটার অনুভূতি, চিন্তা ও ব্যথা। বুদ্ধির ঝিলিক দুই চোখে। দৃষ্টি অন্তর্ভেদী।

দাঁড় করিয়ে রাখা খাটিয়ার ফ্রেমে লটকে আছে রানা।

গভীর মনোযোগে ওকে দেখছে লোকটা। যেন অ্যানালিসিস করছে, বুঝে নিচ্ছে ওর ওজন।

‘ও, তা হলে তুমিই সেই বিখ্যাত মেজর মাসুদ রানা,’ বলল। ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমার নাম…

‘থ্রাশার,’ বলল রানা, ‘উইলিয়াম থ্রাশার। সিআইএ-র লোক। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমেরিকান সরকারের নুন খাচ্ছ।

দুঃখ নিয়ে হাসল থ্রাশার। ‘সত্যি দুঃখিত। এই জ্ঞান থাকার কারণে মরতে হবে তোমাকে। আর কখনও বেরোতে পারবে না এই দ্বীপ থেকে।’

‘আরও কিছু তথ্য দেব?’ বলল রানা, ‘এই আর্মি বা এই দ্বীপের মিশন— সবই সিআইএ-র। তুমি সেই গাধার গু-ভরা পোঁদ, যে কিনা ওই এজেন্সিকে বুঝিয়েছ, আমেরিকানদের প্ল্যান চুরি করে এই দ্বীপে ফ্যাসিলিটি তৈরি করুক রাশানরা। ভাল করেই জানতে ওই কাজই করবে ওরা। আগেই তোমার জানা ছিল বাড়তি স্ফেয়ার থাকবে টাওয়ারের নীচের বাঙ্কারে। গোটা কমপ্লেক্স ডিযাইন করেছে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা। এখন সত্যিই অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে চিন, হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বে আমেরিকান কর্তৃত্ব। কাজেই নকল আর্মি তৈরি করে হামলা করবে তুমি অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইস ব্যবহার করে চিনের ওপর।’

হাসল উইলিয়াম থ্রাশার। ‘এই টেরোরিস্ট আর্মি নকল নয়। অন্তত তাই মনে করে সৈনিকরা। ওরা কিন্তু কল্পনা-প্রসূত নয়।

‘আর তুমি? বিশৃঙ্খলার সম্রাট? তোমার মুখের ওই অ্যাসিডের দাগও নিশ্চয়ই নকল?’

বাম চোয়ালের ক্ষত স্পর্শ করল থ্রাশার।

‘নিখুঁত প্লাস্টিক সার্জারি? তোমার চোখের মতই নকল।’

‘আবার দেশে ফিরলে মেরামত করা হবে সব। মুছে ফেলা হবে উল্কি। তখন ফেলে দেব ধূসর কন্ট্যাক্ট লেন্স। বাধ্য হয়েই এসব করতে হয়েছে।’

রানার নাকের কাছে মুখ নিল থ্রাশার। ‘সব শেষে, মেজর, একেবারে অন্য একটা মুখ নিয়ে বাঁচব। যা কিছু করছি, সবই আমেরিকার উন্নয়নের জন্যে। নতুন এক ধনী চিন মানেই তিরিশ কোটি আমেরিকান মধ্যবিত্তের মুখের রুটি কেড়ে নেয়া। ভয়ঙ্কর স্বার্থপর এবং দুর্নীতিপরায়ণ চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। তোমরা কি সত্যিই চাও ওরা পৃথিবী শাসন করুক? বিশ্ব চালাতে গিয়ে হাজার দোষ করছে আমেরিকা, কিন্তু চিন যা করবে, তার চেয়ে অনেক ভাল শাসন করছে। তোমার চোখ বলছে, তুমি বরং চিনা নেতৃত্ব মেনে নেবে। সত্যিই তুমি চাও চিন সুপার পাওয়ার হোক? ছিহ্, রানা, আমার মনে হয় তোমার উচিত আমেরিকার পক্ষে কাজ করা।’

‘আমি চিনের লোক নই,’ বলল রানা, ‘আমেরিকানও নই। নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করি। আর কে পৃথিবীর মাথায় ছড়ি ঘোরাবে, তা দেখার দায়িত্বও আমার না।’ একটু চুপ করে থাকল রানা, তারপর বলল, ‘সত্যিই যদি পৃথিবী শাসনে ব্যর্থ হয় আমেরিকা, সেক্ষেত্রে নেতৃত্ব থেকে তার সরে যাওয়াই উচিত। তোমরা কোনও দেশের ক্ষতি করে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে চাইলে, আমরা অবশ্যই আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ব।’

‘অন্যরা হয়তো লড়বে, তুমি নও, তুমি বাঁচলে তো!’ কাঁধ ঝাঁকাল থ্রাশার। ‘খামোকা সময় নষ্ট করলাম। আমরা একমত হতে পারব না। পাশে তোমাকে পেলে খুশি হতাম, কিন্তু তা হওয়ার নয়। দুঃখজনক। তুমি ব্রিলিয়ান্ট আর দৃঢ়চিত্ত। আমরা একমত হলে খুবই ভাল টিম হতাম।’

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়েছে রানার। বলল, ‘তুমি কিন্তু এখনও স্ফেয়ার হাতে পাওনি।’ সাইক্লোনের দিকে ইশারা করল। ‘এ কারণে আমাকে খুন করেনি তোমার চ্যালা।

আস্তে করে মাথা দুলিয়ে কথাটা মেনে নিল থ্রাশার। ‘হ্যাঁ, আমার লোক খুঁজছে তোমার সিভিলিয়ান সঙ্গীদেরকে। তাদের একজন বাংলাদেশ সরকারের অফিসার, অন্যজন তোমার বন্ধু, বিজ্ঞানী কুয়াশার সহকারী। কিন্তু ধরা পড়তেই হবে ওদেরকে।’

অবাক হয়েছে রানা। পবন ও ফারিয়ার খবরও আছে এর কাছে? এসব তথ্য কোথা থেকে পেল এ? মিলিটারি ডেটাবেসে থাকবে না।

‘তুমি বিস্মিত ওদের নাম জানি বলে, তাই না?’ বলল থ্রাশার, ‘এত খারাপ পরিস্থিতিতেও সবই খেয়াল করছ। মেজর, আশ্চর্য না হয়ে পারছি না। জানতে চাও কী করে জানলাম? …ক্যাপ্টেন?

থ্রাশার ডাকতেই বাথরুমে ঢুকল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো। হাতে হ্যাণ্ডকাফ নেই। চেহারা স্বাভাবিক।

‘পাওলো…’ চুপ হয়ে গেল রানা।

‘যা বলার ওই বলেছে,’ বলল থ্রাশার। তবে এখানে আসার আগে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে খতম করেছে কমবয়েসী মেরিন কর্পোরালকে। তার আগে পাওলোর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। যে প্রস্তাব দিয়েছি, রাজি না হয়ে পারেনি।’

‘কুকুরের বাচ্চা,’ শান্ত স্বরে বলল রানা।

নির্বিকার চেহারায় গালিটা হজম করল লোকটা। তারপর বলল, ‘দুঃখিত, রানা। কোনও দলে যেতেই হয়। আমি আমার দল বেছে নিয়েছি। জানি এই দলই জিতবে।’

‘মেরে ফেলেছিস বব বউলিংকে?’ কর্কশ শোনাল রানার কণ্ঠ।

‘চট্ করে পৌঁছে গেছে ঈশ্বরের কাছে,’ শ্রাগ করল পাওলো। ‘দু’জন এখন গল্প করছে।’

‘তুই সত্যিই কুকুরের বাচ্চা- এমন এক ঘেয়ো কুকুরের, যে এক বেশ্যার গর্ভে তোকে রেখে গিয়েছিল,’ বলল রানা।

মুখ কালো করে ফেলল আমেরিকান ক্যাপ্টেন।

‘মেজর,’ দৃষ্টি আকর্ষণ করল থ্রাশার, ‘জানি মিস্টার হায়দার ও মিস আহমেদ কাছেই কোথাও আছে। আগে হোক আর পরে, ওদেরকে ধরা পড়তেই হবে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, ওদের পালিয়ে থাকা ঠেকাতে কাজে আসবে তুমি।’

‘জীবনেও না!’

‘মেজর,’ হাসল থ্রাশার। ‘আমার নাম শুনেছ। কিন্তু এটা জানো না, কী কাজে আমি দক্ষ। বছরের পর বছর ধরে দারুণ কিছু মেথড সৃষ্টি করেছি। আমার কাজ যখন শেষ হবে, ভুমি জানবে আমেরিকার অশুভ, অন্ধকার একটা দিকও আছে।

‘প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমেরিকাকে নিরাপদ রাখতে চাইছি। সবসময় কাজ করছি মানুষের মন নিয়ে। নির্যাতন করলে কী ঘটে, আমার চেয়ে বেশি কে জানে! আমার জানা আছে বন্দির মন নিয়ে কীভাবে খেলতে হয়। কীভাবে কষ্ট দিতে হয়। কীভাবে আশা দিয়ে ভেঙে দিতে হয় মন। আপাতত ভাবছ সহায়তা করবে না। কিন্তু জানো না, একটু পর ব্যস্ত হয়ে উঠবে। যে অভিজ্ঞতা হবে তোমার, এর আগে আর কখনও হয়নি। আর তোমার ভীষণ কষ্ট টের পেয়েই লুকিয়ে থাকতে পারবে না পবন ও ফারিয়া।’

সাইক্লোনের দিকে আস্তে করে মাথার ইশারা করল থ্রাশার। খুঁটির মত লোকটা চড়-চড় শব্দে ডাক্ট টেপ আটকে দিল রানার মুখে।

‘হয়তো সত্যিই অবাক হব তোমার নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা দেখে,’ বলল থ্রাশার। সে ইশারা করায় খাড়া করে রাখা খাটিয়াটা রানাসহ তোলা হলো একটা চাকাওয়ালা ট্রলির উপর।

‘আমি ভেঙে দেব তোমার মন,’ বলল থ্রাশার। রওনা হয়ে গেল। নিখুঁত অভিনয়, আবার হয়ে উঠেছে সে বিশৃঙ্খলার সম্রাট

পাশেই হাঁটছে বিশ্বাসঘাতক ম্যাক পাওলো।

পিছনে অসহায় রানাকে নিয়ে ট্রলি ঠেলে আসছে সাইক্লোন।

সবাই বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। সঙ্গে সঙ্গে হৈ-হৈ করে উঠল উল্লসিত রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

চাকাওয়ালা ট্রলিতে করে একটা ব্যালকনিতে আনা হলো রানাকে। প্রকাণ্ড ঘরে উপস্থিত হয়েছে কমপক্ষে চল্লিশজন সৈনিক, অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে।

চারপাশে চেয়ে রানা বুঝল, ওকে আনা হয়েছে পোলার আইল্যাণ্ডের মস্ত দুই ভেন্টের নীচের গ্যাসওঅর্কে। তিনতলার বড় একটা ব্যালকনিতে আছে ও। নীচে ফুটবল মাঠের মত ফাঁকা জায়গা। দ্বিতীয়তলায় দীর্ঘ এক কনভেয়ার বেল্ট। ওটার শেষে নীচতলায় ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ফার্নেস। পাশেই তিনটে বিশাল বৃত্তাকার ভ্যাট।

ওই তিন ভ্যাটে বলকাচ্ছে সবুজ তরল। ওখান থেকে উঠছে ধোঁয়া। ইস্পাতের ঘুরন্ত কিছু বাহু বারবার নাড়ছে তরল। ওই ভ্যাট আছে প্রকাণ্ড এক ভেণ্ট টাওয়ারের সরাসরি নীচে। দূরে আরেকটা ভেন্ট টাওয়ার।

দ্বীপে উঠেই আকাশ-ছোঁয়া ওই দুই টাওয়ার দেখেছিল রানা।

এখন কাছ থেকে দেখে বুঝল, টাওয়ারের নীচের ভ্যাট জুড়ে সরু-মোটা পাইপ, গজ ও ভালভ। এসব ভ্যাট অ্যাটমোস-ফেরিক ওয়েপনকে জুগিয়ে চলেছে তাপ। চকচকে গ্যাস উঠছে ভ্যাট থেকে, তার সঙ্গে মিশছে টিইবি— এসবের কারণেই জ্বলে উঠবে গোটা আকাশ।

নীচে, উত্তরদিকে মাঠের মত বিস্তৃত জায়গাটা চোখে পড়ল রানার। ওখানে অপেক্ষা করছে বিশাল এক কালো ট্রেন। আকারে স্বাভাবিক ট্রেনের দ্বিগুণ। পুরু রিইনফোর্সড্ স্টিলের তৈরি। খোলা এক প্ল্যাটফর্মের পাশে থেমেছে। চওড়া এক র‍্যাম্প বেয়ে হাজির হয়েছে গ্যাসওঅর্কে। রেললাইন দেখে রানা বুঝল, গ্যাসওঅর্ক তৈরি করবার সময় ব্যবহার করা হতো ওই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেন। ওটার মাধ্যমেই পুব উপকূলের সাবমেরিন ডক থেকে মালামাল আসত।

গোটা এলাকা জুড়ে ভাসছে বিশ্রী কেমিকেলের দুর্গন্ধ। বোধহয় টিইবি। না, আরও কিছু। হঠাৎ করেই চিনে ফেলল রানা অস্বাভাবিক গন্ধটা। চমকে গেল। পোড়ানো হয়েছে মানুষের শরীর

বন্দি রানাকে দেখেই হৈ-হৈ করে উঠেছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

তখনই অন্য বন্দিদের দেখল রানা।

সবমিলে চারজন। দু’জন কাছেই। এরই ভিতর নির্যাতন শুরু হয়েছে তাদের উপর। এদের কষ্টেই চিৎকার করে ফুর্তি প্রকাশ করছিল সৈনিকরা। চারজনের অন্য দু’জন রানা থেকে বেশ দূরে। কাছের দু’জনের দিকে মনোযোগ দিল রানা।

তাদের একজনকে ওর মত করেই দাঁড় করানো হয়েছে লোহার খাটিয়ার ফ্রেমে। অন্যজন ঝুলছে এক ফোর্কলিফটের প্রং থেকে। ভীষণ ব্যথা পাওয়ার কথা। পিঠের পিছনে দুই কব্জি নিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে হ্যাণ্ডকাফে। মেঝে থেকে তিনফুট উপরে ঝুলছে দুই পা।

বেডফ্রেমে ঝুলন্ত লোকটা সিল টিম নেতা: নটি এরিক বা হাতুড়িমাথা। দলের কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু একাই স্যাবোটাজ করেছিল টিইবি গ্যাস ভেণ্ট। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে।

ফুলে আছে গোটা মুখ। থেঁতলে গেছে গাল-নাক-ঠোঁট। এখন পুরো উলঙ্গ। পিঠে দগদগে পোড়া দাগ। বেচারার পায়ের কাছে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কেব্‌ল্। আরেকপ্রান্ত একটু দূরের ট্র্যান্সফর্মারে। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পিঠ-নিতম্ব ও দুই পা। রানা দেখল, নটি এরিকের রক্তাক্ত দু’সারি দাঁতের মাঝে গুঁজে দেয়া হয়েছে কাঠের গোঁজ।

ফোর্কলিফট থেকে ঝুলছে দ্বিতীয় বন্দি, জাড ময়লান। রাগী আমেরিকান কন্ট্রাক্টার। বুকের উপর নেমেছে মাথা। একদম নড়ছে না। রানা নিশ্চিত হতে পারল না, সে মৃত, না জীবিত। কব্জির হ্যাণ্ডকাফের কারণে কাঁধের হাড়ের জোড়া থেকে মট্ করে খুলে গেছে দু’হাত।

জাড ময়লানের দিকে রানাকে চাইতে দেখেছে থ্রাশার।

‘এই আদরকে বলে ‘স্ট্র্যাপাডো’ বা ‘রিভার্স হ্যাঙিং’। কয়েক শ’ বছর ধরেই চলছে। চালু করেছিল ফ্লোরেন্সের মেডিসি ফ্যামিলি। নাযিরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাজে লাগাত। এখনও টার্কিতে ব্যবহার করা হয়। আমি নিজেই টর্চার অফিসারদের শিখিয়েছি। ভয়ঙ্কর ব্যথা তৈরি করে স্ট্র্যাপাডো, আর ওই পযিশনে বেশিক্ষণ থাকলে পঙ্গু হতে হয়।’

মিষ্টি করে হাসল থ্রাশার। ‘কাউকে ওই পযিশনে দেখলেই মন ভাল হয়ে যায় আমার। বন্দি থাকে সম্পূর্ণ অসহায়। দু’হাত পিছনে ঝুলছে, আর ঠেলে বেরিয়ে আছে বুক— তার প্রাণশক্তি বা হৃৎপিণ্ড আমার নাগালের ভেতর। যা খুশি করতে পারি।’

অন্য দুই বন্দির দিকে চাইল রানা। চমকে গেল তাদেরকে চিনতে পেরে। ধক্ করে উঠল হৃৎপিণ্ড। দ্বিতীয় ফোর্কলিফটের দু’প্রঙে ঝুলছে তারা দু’জন। স্ট্র্যাপাডো পযিশন। জাড ময়লানের মত হাল ছাড়েনি, এখনও উঁচু করে রেখেছে মাথা। সহজেই তাদেরকে চিনেছে রানা।

নিশাত সুলতানা ও পিয়েখে ডিফেখন।

রানার মতই কেড়ে নেয়া হয়েছে ওদের শীতের পোশাক। বাঁধা দু’কব্জির কারণে ফুলে বেরিয়ে আছে ডিফেখনের মস্ত বুক— রোমশ ও পেশিবহুল।

নিশাতের পরনে সামান্য ট্রাউযার ও কালো স্পোর্টস্ ব্রা।

দু’জনের নাকে-ঠোঁটে রক্ত। ঝুলিয়ে দেয়ার আগে বোধহয় পিটিয়ে নেয়া হয়েছে। কাছেই রাফিয়ান আর্মির প্রকাণ্ডদেহী এক লোক। একটু আগে তাকে স্যান্টা ক্ল্য নামে কে যেন ডেকেছিল।. দু’বন্দির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, পিঠে ঝুলছে ডিফেখনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া মেশিনগান- কর্ড।

রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা হৈ-হৈ করে উঠতেই ঘুরে চেয়েছে নিশাত। বেডফ্রেমে রানাকে দেখে মুখ কালো হয়ে গেল ওর। হায় হায় করে উঠল: ‘স্যর! আপনিও…’

মুখে ডাক্ট টেপের কারণে কথা বলতে পারল না রানা। দু’জনের চোখ আটকে গেল পরস্পরের উপর।

‘মন শক্ত রাখুন, স্যর!’ জোর গলায় বলল নিশাত, ‘ওদেরকে হারতেই হবে, স্যর!’

হাতুড়িমাথার পাশেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো রানার বেডফ্রেম। ঝাঁকি খেয়েছে রানা, তখনই দেখল ওর দিকে চেয়ে আছে নটি এরিক। পুরো বিধ্বস্ত। হেরে যাওয়া মানুষ। নির্যাতন শেষ করে দিয়েছে তাকে। বাকি আছে শুধু মৃত্যু। মাথা তুলে দেখাই যেন কঠিন। গা থেকে আসছে পোড়া চামড়ার বাজে গন্ধ।

রানার পাশে দাঁড়িয়ে হাতুড়িমাথার দিকে ইশারা করল থ্রাশার। ‘রানা, আমাদের সিল টিম নেতা ব্যথার অভিযানে তোমার চেয়ে এগিয়ে আছে। কিন্তু ভয় নেই, তুমিও ওকে ধরে ফেলবে।’

রাফিয়ান আর্মির এক সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে ইলেকট্রিকাল ট্র্যান্সফর্মারের পাশে। ওটা থেকে তার গেছে হাতুড়িমাথার লোহার খাটিয়ায়।

থ্রাশার ঘুরণ লোকটার দিকে।

ওই লোক সুদানিয, এখানে ওখানে ত্বক ফুটো করে ঝুলিয়ে দিয়েছে বড় বড় দুল। ফোলা চোখদুটো হলদে। পিঠের হোলস্টারে ঝুলছে ম্যাগহুক।

রানা দেখল, ওটা ওরই।

কর্পোরাল সালা মাতারি,’ নরম

নরম স্বরে বলল থ্রাশার, ‘ইলেকট্রিকের তার কাজে লাগাও। আগে পানিতে ভিজিয়ে নাও নটি এরিককে, তারপর বিদ্যুৎ চালাও ওর ওপর। ও নিকেশ হলে ব্যবহার করবে মেজর রানার ওপর।

পাশেই মেঝেতে রাখা বালতি ভরা পানি এরিকের শিথিল দেহে ছুঁড়ে দিল সুদানিয়।

ব্যাখ্যা দিল উইলিয়াম থ্রাশার: ‘কাউকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করতে চাইলে বড় সমস্যা তার ত্বক। ওটা যখন শুকনো, রীতিমত বাধা দেবে। কাউকে পোড়াতে যতই ভোল্টেজ বাড়াও, বড়জোর পুড়বে তার সামান্য ত্বক। গন্ধ বড়ই খারাপ, রীতিমত আপত্তিকর, কিন্তু তেমন কিছুই হবে না তার। কিন্তু তাকে ভিজিয়ে নিলে? বাধা দেয়ার ক্ষমতা হারাবে ত্বক। কমপক্ষে এক শ’ গুণ সহজে গ্রহণ করবে শক। দাঁড়াও, রানা, একটা কাজ শেষ করি। দ্বীপের সবাইকে জানাতে হবে এখানে কী ঘটছে।’

পাশের ডেস্ক থেকে মাইক্রোফোন নিল থ্রাশার, ওটার তার গেছে দেয়ালের পাশের কমিউনিকেশন কন্সোলে। টিপে দিল ‘টক’ বাটন। কথা বলতেই গমগম করে উঠল গ্যাসওঅর্কে তার কণ্ঠ। দ্বীপের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য লাউডস্পিকার।

‘পবন হায়দার, ফারিয়া আহমেদ- আমি জানি তোমরা আমার প্রতিটা কথা শুনছ। কান খাড়া করো- এবার শুনবে তোমাদেরই এক সঙ্গীর মৃত্যু আর্তনাদ!’

সুদানিয কর্পোরালের দিকে ঘুরল থ্রাশার। মাতারি, প্লিয, দশ হাজার ভোল্ট।’

ট্র্যান্সফর্মারের ডায়াল ঘোরাল লোকটা। তখনই স্বর্গীয় নীল আগুন জ্বলে উঠল হাতুড়িমাথার বেডফ্রেমে। যেন আকাশ থেকে নেমেছে নীলচে বজ্ৰ।

ইলেকট্রিসিটি দেহে বইতেই ভীষণ ঝাঁকি খেল এরিক। কাঁপছে থরথর করে। যেন নদী থেকে ওঠা ভালুক, নানাদিকে ছিটকে দিল পানির ফোঁটা। কামড়ে ধরেছে দু’সারি দাঁতের মাঝে কাঠের গোঁজ। ভয়ঙ্কর কষ্টে ছটফট করছে, সেইসঙ্গে করুণ গোঙানি। সরিয়ে নেয়া হলো কাঠের গোঁজ। ফুলে উঠেছে ঘাড়ের সব রগ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তারপর বিকট এক আর্তনাদ ছেড়েই স্থির হয়ে গেল।

পুরো সময় নটি এরিকের মুখের কাছে মাইক্রোফোন রেখেছে থ্রাশার। দ্বীপের প্রতিটি কোণে শোনা গেছে ওই করুণ মরণ চিৎকার।

ভয়ানক আর্তনাদের পর শিথিল হয়ে গেছে এরিকের প্রতিটি পেশি। এখনও চালু আছে ট্র্যান্সফর্মার, কারেন্ট চলছে বেডফ্রেমের ভিতর দিয়ে।

থ্রাশারের নির্দয়তা দেখে চমকে গেছে রানা।

হাতুড়িমাথা নটি এরিক মৃত, কিন্তু তাতেই সব শেষ হয়নি।

‘আ…গু-ন! আ…গু-ন! আ…গু-ন!’ চিৎকার ছাড়ছে সৈনিকরা।

আস্তে করে লাশের দিকে মাথা তাক করল থ্রাশার।

ট্রলিতে করে সরানো হলো এরিকের লাশ, এখনও আটকে আছে বেডফ্রেমে। ব্যালকনি থেকে বেডফ্রেমসহ নীচের কনভেয়ার- বেল্টে ফেলা হলো লাশ। চলছে ধীর গতির বেল্ট। সামনেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মের চওড়া র‍্যাম্প। তার তলা দিয়ে যাওয়ার পর ওদিকে আবারও দেখা গেল লাশ। শেষমাথায় গিয়ে আবারও বেল্ট ফিরছে তলা দিয়ে। লাশ পৌছে গেছে ফার্নেসের মুখে।

গনগনে কমলা আগুনে উল্টে পড়ল নটি এরিক ও বেডফ্রেম।

‘আ-গু-ন! আ-গু-ন! আ-গু-ন!’ বিকট হুঙ্কার ছাড়ল রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা। বেদম খুশি মৃত্যু দেখতে পেয়ে!

.

পোলার আইল্যাণ্ডের পাহাড়ি এক অংশে পরস্পরের দিকে চাইল পবন ও ফারিয়া। এইমাত্র লাউডস্পিকারে শুনেছে ভীষণ করুণ আর্তনাদ। ভয়ে কাঁপছে ওদের বুক।

‘হায় আল্লা… হায় আল্লা…’ ফিসফিস করছে ফারিয়া, ‘কী ভয়ঙ্কর… কী ভয়ঙ্কর!’

.

গ্যাসওঅর্কে স্ট্র্যাপাডো পযিশনে ফোর্কলিফট থেকে ঝুলন্ত জাড় ময়লানের পাশে থামল থ্রাশার। চড়াৎ করে এক চড় কষাল লোকটার গালে।

গুঙিয়ে উঠল একযেকিউটিভ। মরেনি।

নাটকীয় ভঙ্গিতে সৈনিকদের দিকে ঘুরল থ্রাশার। ‘তোমরা কী বলো? এবার কি ইঁদুরের খেলা?’

খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল লোকগুলো।

‘মাতারি,’ আদেশ দিল থ্রাশার। ইঁদুর আনো।’

পাশের এক ঘরে গেল কর্পোরাল সালা মাতারি, আবারও ফিরল তারের তৈরি বড় এক ক্রেট নিয়ে। ভিতরে হুটোপুটি করছে অনেকগুলো ইঁদুর।

চোখ সরু হয়ে গেল রানার।

নানা আকারের ইঁদুর।

ছোট থেকে শুরু করে পেটমোটা, বড় ইঁদুরও আছে।

কুচকুচে কালো রোম। রোমহীন দীর্ঘ লেজ। চকচকে সাদা দাঁত। হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একটা আরেকটার উপর।

‘জানো, রানা, অতি মস্ত সাহসীও ভয় পায় ওদেরকে?’ দাঁত বের করে হাসল থ্রাশার। ‘ইঁদুর বা তেলাপোকা। এদের বংশ মানুষের চেয়ে বেশি টিকবে। বিশেষ করে ইঁদুর। বছরের পর বছর আছে এই দ্বীপে। সোভিয়েতরা আর নেই, কিন্তু ওরা আছে। এবার মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখো।’

জাড ময়লানের দিকে চিবুক তাক করল থ্রাশার। ‘ওর মাথার ওপর বসিয়ে দাও বাক্স।’

মই এনে উপরের ধাপে উঠে আদেশ পালন করল মাতারি। কাঠের এক বাক্স চাপিয়ে দিয়েছে ময়লানের ঝুলে থাকা মাথার উপর। বাক্সের দেয়াল পোক্ত কাঠের। কিন্তু মেঝেতে গোল গর্ত। শিকারের ঘাড়ে শক্তভাবে আটকে গেছে। ময়লানের মাথায় বাক্স বসাবার পর ন্যাকড়া দিয়ে গর্তের চারপাশ বুজে দিল মাতারি। আমেরিকান কন্ট্রাক্টারকে দেখে মনে হলো, সে যেন ম্যান ইন দ্য আয়ার্ন মাস্কের সেই লোকটা।

বাক্সের উপরে কব্জাওয়ালা প্যানেল।

চুপ করে সব দেখছে রানা। শিরশির করছে গা। বুঝে গেছে এরপর কী হবে।

বাক্সের প্যানেল খুলল মাতারি, অন্যহাতে তারের খাঁচা থেকে খপ্ করে লেজ ধরে বের করে আনল বিশাল এক ধেড়ে ইঁদুর।

রানার মনে হলো, ওর বুকের ভিতর জমাট বেঁধে গেছে রক্ত। অজান্তেই ঢোক গিলল।

খেয়াল করেছে থ্রাশার।

‘তুমি তো শিক্ষিত মানুষ, রানা, হয়তো পড়েছ উনিশ শ’ চুরাশি সালে লেখা অরওয়েলের দারুণ বইটা? ওখানে এমনই একটা ইঁদুরের খেলার বর্ণনা দিয়েছে। উইনস্টন স্মিথের মন ভাঙতে ওই হুমকি দেয়া হয়, বাস্তবে ইঁদুর দিয়ে খাওয়ানো হয়নি। কিন্তু রানা, আমি আবার খামোকা হুমকি দেয়ার লোকই নেই। …মাতারি, কাজ শুরু করো।’

বাক্সের ভিতর ইঁদুর ছেড়ে দিল মাতারি। পরক্ষণে দ্বিতীয় ইঁদুর। এবারেরটা আকারে একটু ছোট। ঠং আওয়াজ তুলে বন্ধ করে দেয়া হলো উপরের প্যানেল।

আবারও বাক্সের কাছে মাইক্রোফোন ধরল থ্রাশার। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘পবন…. ফারিয়া… মনে পড়ে তোমাদের ক্যাম্পের মিস্টার ময়লানকে? এবার ক্ষুধার্ত ইঁদুর খেয়ে ফেলবে তাঁকে জীবন্ত।’

ফোর্কলিফট থেকে ঝুলে ব্যথায় প্রায় মরেই গেছে ময়লান। সামান্যতম নড়ছিল না। কিন্তু এবার হঠাৎ করেই তাকে নড়তে দেখা গেল। আচমকা আর্তচিৎকার ছাড়ল সে। মনে হলো খেপে উঠেছে বদ্ধ কোনও উন্মাদ। ভীষণভাবে ঝটকা খেল দুই পা। ছিঁড়ে ফেলতে চাইল দু’কব্জির বাঁধন। কিন্তু মুক্তি নেই।

রানা চোখে দেখছে না বাক্সের ভিতর কী হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছে। বমি পেয়ে গেল ওর। সামলে নিল কষ্ট করে।

ওই দুই ইঁদুর ভীষণ ক্ষুধার্ত!

জীবিত ময়লানের নাক-মুখ ছিঁড়ে খাচ্ছে ওগুলো!

কিছুই করবার নেই ঝুলন্ত লোকটার!

প্রথমেই তার দু’চোখ খেয়ে নেবে ইঁদুর, চারপাশের মাংস ছিঁড়ে ঢুকে পড়বে অক্ষিকোটর দিয়ে করোটির ভিতর। চিবুতে শুরু করবে মগজ। ভয়ানক কষ্ট পেয়ে মরছে মানুষটা।

চারপাশ ভরে গেল জাড ময়লানের করুণ চিৎকারে, মুহূর্তে মুহূর্তে কেঁদে উঠছে হাউমাউ করে। কাঠের বাক্স কমাতে পারেনি ওই আওয়াজ।

বাক্সের কাছে মাইক্রোফোন ধরেছে থ্রাশার। প্রতিটি আহাজারি শুনছে নির্বিকার চেহারায়।

পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড পর ময়লানকে বাঁচিয়ে দিল সর্বশক্তিমান।

হঠাৎ করেই স্থির হলো দেহ। মৃত্যু হলো তার। তবে থরথর করে কাঁপতে থাকল তার মাথা। হুড়োহুড়ি করে খাওয়ায় ব্যস্ত দুই ইঁদুর।

বিকট চিৎকার করে তাদের ফুর্তি প্রকাশ করল রাফিয়ান আর্মির পিশাচ সৈনিকরা।

তাদের উদ্দেশে হাসল থ্রাশার।

জাড ময়লানের লাশের দিকে চেয়ে আছে নিশাত ও বুনো, হাঁ হয়ে গেছে মুখ। মানতে পারছে না কেউ এ কাজ করতে পারে।

মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে রানার গলা, মাথায় বেদম ব্যথা। চুপ করে চেয়ে রইল উইলিয়াম থ্রাশারের দিকে।

ওর সামনে এসে দাঁড়াল থ্রাশার, চেহারা খুবই স্বাভাবিক। রানাকে দেখতে দেখতে মাইক্রোফোনে বলল, ‘পবন? ফারিয়া? …শুনছ? তোমরা কিন্তু ইচ্ছে করলে এসব বন্ধ করতে পারো। শুধু ধরা দেবে। এর বেশি কিছুই করতে হবে না। আর তা যদি না করো, এবার ধরব ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানাকে। তারপর ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখনকে। শেষে মেজর মাসুদ রানা। এরা সবাই এখানে বন্দি।

কাঁধ ঝাঁকাল থ্রাশার। রানাকে বলল, ‘আমরা ওদের জন্যে অপেক্ষা করব, রানা। ততক্ষণ আলাপ করা যাক। ইচ্ছে করলে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারো।’

কঠোর চোখে তাকিয়ে থাকল রানা।

‘আমার অভিজ্ঞতা বলে, প্রিয় কারও ওপর নির্যাতন হতে দেখলে মানুষ দেরি না করেই মুখ খোলে,’ বলল থ্রাশার। ‘বন্দির কাছ থেকে তথ্য পেতে এটা ভাল পন্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুনিয়ার সেরা অত্যাচারী জাতি জাপানিরা চিনের ন্যানকিঙে কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।

‘তুমি তো জানো, আমি চাইছি দেরি না করে যেন পবন ও ফারিয়া আত্মসমর্পণ করে। রানার কানে ফিসফিস করে বলল থ্রাশার, ‘আমি তোমাকে নিয়ে যাব মৃত্যুর এক ইঞ্চি দূরে। আর তখন পা ধরতে চাইবে তুমি। যেন চট্ করে তোমাকে রেহাই দিই। কিন্তু তা করব না। আগে ভেঙে দেব তোমার মন, তারপর নিজের সময়মত খুন করব। …মাতারি, রানার দু’সারি দাঁতের মাঝে কাঠের গোঁজ দাও।’

রানার দিকে এল সুদানিয সৈনিক, মুখে টিটকারির হাসি। সামনের চারটে দাঁত নেই, বীভৎস দেখাল কালো গহ্বরটা। চড়- চড় শব্দে রানার মুখ থেকে ডাক্ট টেপ খুলল সে। গুঁজে দেবে কাঠের টুকরো।

তার আগেই সুযোগ নিল রানা, মাতৃভাষায় বলল, ‘আপা! আমি যদি চলেও যাই, আপনি কিন্তু শেষপর্যন্ত লড়বেন!’

পরক্ষণে কাঠের টুকরো দিয়ে রানার মুখ বুজে দেয়া হলো।

নিশাত ও রানার চোখের চাহনি মিলেমিশে গেল।

অসহায় দৃষ্টি ওদের।

দূর থেকে বলল নিশাত, ‘আমি তাই করব, ভাই! …তাই করব!’ করুণ শোনাল ওর কণ্ঠ।

‘মেজর, তোমাকে যে ডিভাইসে আটকে দেয়া হয়েছে, ওটার নাম প্যারিয়া,’ বলল থ্রাশার, ‘চিলি সরকারের জনপ্রিয় নির্যাতন ওটা। প্যারিয়া ইংরেজিতে ভাষান্তর করলে হবে: ‘শিককাবাব’। এই নির্যাতন করতে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রিক শক। যে ধাতব ফ্রেমে আটকে রাখা হয় বন্দিকে, তার ভেতর দিয়ে চলে কারেন্ট। এ দ্বীপের মিলিটারি ব্যারাকে বেডফ্রেম পেয়েছি। এসব বেডফ্রেমের সঙ্গে আছে স্টিলের স্প্রিং ও সরু সব ক্রসবার। এ কারণেই ইলেকট্রিক কারেন্ট চমৎকারভাবে কাজ করবে। পুড়তে শুরু করবে বন্দির পিঠ। …মাতারি, মেজরের আনন্দের জন্যে প্রথমে দুই হাজার ভোল্ট, প্লিয!’

ট্র্যান্সফর্মারের ডায়াল ঘুরিয়ে দিল মাতারি।

ভীষণভাবে ঝাঁকি খেল রানা।

চোখের সামনে অতি উজ্জ্বল সাদা আলোর ঝিলিক দেখল, সেইসঙ্গে ভীষণ ব্যথা। যেন আগুন ধরে গেছে গোটা শরীরে। ঝটকা দিয়ে পিছনে যেতে চাইল মেরুদণ্ড। মড়মড় করে উঠল সব কশেরুকা। কিন্তু সামান্যতম নড়তে পারল না রানা। ওকে বাঁধা হয়েছে খুব শক্ত করে। কামড়ে কাঠের গোঁজ ভাঙতে চাইল। আর্তচিৎকারের বদলে মুখ থেকে বেরোল বিদঘুটে, কর্কশ, জান্তব গোঙানি।

ওর মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরেছে থ্রাশার।

দ্বীপের চারপাশে ব্রডকাস্ট হচ্ছে ভয়ানক ব্যথার ধ্বনি।

‘পবন ও ফারিয়া,’ বলল থ্রাশার, ‘তোমরা এখন শুনছ তোমাদের অসমসাহসী মেজরের গোঙানি। তাকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে।

প্রচণ্ড ব্যথার ভিতর হঠাৎই গন্ধটা পেল রানা। পুড়তে শুরু করেছে ওর পিঠের চামড়া। অকল্পনীয় কষ্টে আবারও চিৎকার করে উঠতে চাইল ও।

দু’কব্জির বাঁধন ছিঁড়তে চাইছে নিশাত, চিৎকার করে থ্রাশারকে বলল, ‘বেশ্যার বাচ্চা! আমি কামড়ে ছিঁড়ে নেব তোর হৃৎপিণ্ড!’

আস্তে করে মাথা কাত করে মাতারির দিকে ইশারা করল থ্রাশার। ডায়াল ঘুরিয়ে ট্রান্সফর্মার বন্ধ করে দিল সুদানিয়।

বেডফ্রেমে এলিয়ে গেল রানা। অতিক্লান্ত, হাঁপিয়ে চলেছে। দরদর করে ঘামছে এই শীতে। বুকের কাছে নেমেছে মাথা। বড় করে দম নিতে চাইল।

মৃদু হাসল উইলিয়াম থ্রাশার। ‘ওটা মাত্র দুই হাজার ভোল্ট, রানা। তোমার বন্ধু সিল টিম লিডারকে ভিজিয়ে দেয়ার পর কনডাকটিভিটি বেড়েছিল কমপক্ষে এক শ’ গুণ। একটু পর মাতারিকে বলব, তোমাকেও গোসল করিয়ে নিতে। আর তারপর আগের চেয়ে অনেক বেশি ডায়াল ঘোরাবে। আসলে তোমার চাই বেশি ভোল্ট। তখন শুধু ভেজা ত্বক পুড়বে না, সরাসরি হৃৎপিণ্ডে হামলা করবে কারেন্ট। ফলাফল: আকস্মিক মৃত্যু!’

থ্রাশার মাথা দোলাতেই পানি ভরা বালতি তুলে নিল সুদানিয মাতারি। ঝাপ্ করে পানি পড়ল রানার উপর। বেডফ্রেমে প্রায় ঝুলছে রানা। সারাশরীর থেকে টপটপ করে পড়ছে পানি।

মাথা কাত করে মাতারিকে চোখের ইশারা করল থ্রাশার।

ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে রানা, কিন্তু সবই বুঝল। ধক্ করে উঠল হৃৎপিণ্ড।

ব্যস, সব শেষ? আর কিছুই করার নেই!

কিন্তু কর্কশ আওয়াজে হেসে উঠেছে উইলিয়াম থ্রাশার।

‘ছি-ছি-ছি, রানা, ভয় পেয়েছ? কিন্তু না, এখনই মৃত্যু নয় তোমার জন্যে। তোমাকে না বলেছি, আগে একদম ভেঙে ফেলব তোমাকে? আগে তুমি দেখবে কীভাবে ভীষণ কষ্ট পেয়ে মরছে তোমার বিশ্বস্ত সহকারী নিশাত সুলতানা।’

প্রচণ্ড জ্বলুনির ভিতরেও চট্ করে নিশাতের দিকে চাইল রানা।

‘সত্যি, রানা, প্রিয় কারও চলে যাওয়া বড়ই কষ্টের। …কেমন লাগবে তোমার দেখতে, কী ব্যথা নিয়েই না মরছে তোমার ঘনিষ্ঠ কেউ? চোখের সামনে দেখতে হবে সব। এ কারণেই মন ভেঙে যায় পুরুষদের।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল রানার মুখ।

মিষ্টি করে হাসল উইলিয়াম থ্রাশার।

‘মাতারি, মেয়েলোকটার মাথার ওপর বসিয়ে দাও বাক্স। তারপর ভেতরে দেবে ধাড়ি দেখে দুটো ইঁদুর।’

দুর্বল, অসহায়, বন্দি রানা হতবাক হয়ে চাইল নিশাতের দিকে। কিচ্ছু করার নেই ওর। ভেঙে যাচ্ছে বুকটা। চোখের কোণে টলটল করে উঠল একফোঁটা অশ্রু। মুখ সরিয়ে নিল রানা। কাউকে দেখতে দেবে না ওর দুর্বলতা।

মৃত ময়লানের মাথার উপর থেকে সরিয়ে নেয়া হলো বাক্স। ওদিকে চোখ পড়তেই রানা দেখল, মানুষটার ক্ষত-বিক্ষত মুখ। খুবলে খেয়ে ফেলা হয়েছে দুই চোখ। রক্তাক্ত দুই কোটর ফাঁকা। চারপাশে ঝুলছে ছেঁড়া মাংস। হাঁচড়েপাছড়ে ডান কোটরের ভিতর ঢুকে গেল ছোট ইঁদুরটা, রক্তাক্ত— বেরোল লাশের মুখের গহ্বর দিয়ে।

ভীষণ বমি পেল রানার, আরেকদিকে ফিরিয়ে নিল মুখ।

প্রং থেকে লাশটা খুলে ছুঁড়ে ফেলা হলো কনভেয়ার বেল্টে।

 ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সৈনিকরা বিকট চিৎকার ছাড়ল: ‘আ-গু-ন! আ-গু-ন! আ-গু-ন!’

লাশ গিয়ে পড়ল ফার্নেসের গনগনে কমলা রঙা আগুনে। বাক্স হাতে নিশাতের ফোর্কলিফটের সামনে পৌছে গেল সালা মাতারি।

বুকের ভিতর মুচড়ে উঠল রানার। বুঝে পেল না কীভাবে সহ্য করবে এতদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী নিশাত আপার ভয়ানক মৃত্যুদৃশ্য।

হঠাৎ করেই বলে উঠল থ্রাশার, ‘খেলা আরও জমুক! দুই নম্বর বাক্সটাও আনো! ওটা পরবে আমাদের ফ্রেঞ্চ বন্ধু!’

আনন্দে হৈ-হৈ করে উঠল সৈনিকরা।

দ্বিতীয় বাক্স আসতেই উল্লাস প্রকাশ করল তারা।

কপালের দু’পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে রানার। চিৎকার করে থ্রাশারকে গাল দিতে চাইল, কিন্তু মুখের গোঁজের কারণে সেটা সম্ভব হলো না।

মই বেয়ে উঠে নিশাতের মাথায় রক্তাক্ত বাক্স বসিয়ে দিল কর্পোরাল সালা মাতারি। তার আগে নিশাতের চোখে চেয়েছে রানা।

সরাসরি রানার দিকেই চেয়ে ছিল নিশাত। খুবই বিমর্ষ। আস্তে করে নাড়ল মাথা, মুখ হাঁ হলো, নীরবে বলছে যেন, ‘সত্যিই বিদায়, ভাই!’

তারপর নিশাতের মাথায় বসিয়ে দেয়া হলো বাক্স।

নিশাতের মুখ আর দেখতে পেল না রানা। আপ্রাণ চেষ্টা করল হ্যাণ্ডকাফ খুলতে। কিন্তু কাজটা অসম্ভব। ক্লান্ত হয়ে উঠেছে, ফুরিয়ে গেছে সব শক্তি। ওদের কারও কিছুই করবার নেই। রুখতে পারবে না ও নিশাত সুলতানার মৃত্যু। নিজ চোখে দেখতে হবে প্রিয় মানুষটার নির্মম হত্যাকাণ্ড!

এক মার্কিন পিশাচ ওর চোখের সামনে খুন করছে আপাকে, কিন্তু ওর সাধ্য নেই কিছু করে— ক্ষোভে-দুঃখে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল রানার চোখ থেকে।

ওর দিকেই চেয়ে আছে উইলিয়াম থ্রাশার। বুঝে গেছে মন ভাঙছে শক্ত লোকটার।

দ্বিতীয় বাক্স চাপিয়ে দেয়া হলো পিয়েখে ডিফেখনের মাথায়। ঘাড়ের কাছের ফাঁক-ফোকর বুজে দেয়া হলো ন্যাকড়া দিয়ে। রানার মনে হলো ডিফেখনকে কী যেন বলল নিশাত। কণ্ঠ ছিল অস্পষ্ট। বোধহয় বিদায় নিল।

এবার হাসতে হাসতে দুই বন্দির মাঝে মই বেয়ে উঠল মাতারি, খুলে ফেলল দুই বাক্সের প্যানেল। দু’হাতে তুলে নিল দুটো ধেড়ে ইঁদুর। প্রতিটি বাক্সের জন্য বরাদ্দ চারটে করে। তৈরি সে, চাইল থ্রাশারের দিকে।

চিৎকার শুরু করেছে সৈনিকরা, যেন এখনই খেলা শুরু করা হয়। কিন্তু থ্রাশারের সিগনালের জন্য অপেক্ষা করল মাতারি.।

মাইক্রোফোন মুখের কাছে তুলল থ্রাশার। ‘পবন? …ফারিয়া? আবারও গল্প করব আমরা। এবার তোমরা শুনবে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা আর ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখনের মরণ চিৎকার। জীবন্ত ওদের নাক-কান-চোখ খেতে শুরু করবে ইঁদুর।’

আস্তে করে মাতারির দিকে ইশারা করল থ্রাশার।

প্রতিটি বাক্সে দুটো করে ইঁদুর ফেলল মাতারি।

হুল্লোড় করে উঠল সৈনিক দল।

এবার ফেলা হলো আরও দুটো করে। ঠং করে প্যানেল বন্ধ করে দিল মাতারি।

অসহায় চোখে চেয়ে রইল রানা।

তখনই শুরু হলো নিশাত ও পিয়েখের পা ছোঁড়াছুঁড়ি। ছটফট করছে ওরা, সেইসঙ্গে ভীষণ চিৎকার।

জাড ময়লানের মত করেই করুণ মৃত্যুর দিকে চলেছে ওরা।

নিশাত ও পিয়েখের মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরল থ্রাশার।

বাক্সের ভিতর ভীষণ ব্যথায় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ছাড়ছে ওরা। ভীষণ ঝটকা খাচ্ছে ঝুলন্ত দুই দেহ। নানাদিকে ছুঁড়ছে দু’পা।

বাক্সের ভিতর থেকে অস্বাভাবিক সব আওয়াজ আসছে। চিৎকার, আর্তনাদ, গোঙানি, কচকচ আওয়াজ।

ময়লানের মৃত্যুর মতই, কয়েক সেকেণ্ডে শেষ হয়ে গেল সব। প্রায় একইসময়ে স্থির হলো নিশাত ও বুনোর দেহ, ঝুলছে স্ট্র্যাপাডো পযিশনে। এখন একদম স্থির মাথা।

টপ্ করে আরও দু’ফোঁটা অশ্রু নামল রানার গালে।

‘সত্যিই বিপজ্জনক মানুষ তুমি, রানা, বলল থ্রাশার। ‘সত্যিই জানি না এত মৃত্যু দেখেও কীভাবে বেঁচে আছ। কিন্তু এবার কেউ বাধা দেবে না তোমাকে। রানার চোখ ভেজা দেখে হেসে ফেলল থ্রাশার। ‘সত্যিই ভেঙে পড়লে? তেমনই মনে হচ্ছে! আর তাই যদি হয়, এবার সময় হয়েছে তোমার পরপারে যাওয়ার। রানা…

‘স্যর!’ একটি ডোরওয়ে থেকে ডাক দিল এক সৈনিক I দরজার দিকে ঘুরে চাইল থ্রাশার ও রানা।

‘কী?’ জানতে চাইল থ্রাশার।

‘ধরা পড়েছে, সার! দুই সিভিলিয়ানের কাছে পাওয়া গেছে দুটো স্ফেয়ার! নেইটরিচ ধরেছে তাদেরকে! এখন নিয়ে আসছে!’

.

উইলিয়াম থ্রাশার যেভাবে প্ল্যান করেছে, সেভাবেই বন্দি হয়েছে পবন হায়দার ও ফারিয়া আহমেদ। ওরা খনিতে নিশাত সুলতানার কাছ থেকে আলাদা হয়ে রওনা দিয়েছিল দূরে কোথাও লুকিয়ে পড়বে বলে, সঙ্গে দুই ইউরেনিয়াম স্ফেয়ারের কেস।

নদী পেরিয়ে আবারও ফিরেছে বেসের রানওয়েতে, খুব সতর্ক। ঢুকতে চেয়েছিল গিয়ে ব্যারাকে। দীর্ঘ হল পেরোতেই সামনে পড়ল প্রাক্তন সোভিয়েত ফোর্সের বিশাল লিভিং কোয়ার্টার।

পবন ভেবেছিল পরিত্যক্ত জায়গাটা লুকাবার জন্য আদর্শ। চারপাশে ধুলো। একের পর এক কট, ট্রাঙ্ক ও ফুট-লকার। পাশেই লকার রুম, টয়লেট ও শাওয়ার রুম।

কার বাপের সাধ্যি ওদেরকে খুঁজে বের করবে!

লুকাবার জায়গার অভাব নেই।

কিন্তু সতর্ক পায়ে প্রথম ব্যারাকে ঢুকেই চমকে গেল ওরা।

এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গেল একটিমাত্র পা নিয়ে খোঁড়া এক মহিলা। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট।

‘আরেহ্!’ অবাক হয়ে বিড়বিড় করল পবন।

ওর কানে ফিসফিস করল ফারিয়া: ‘ওই যে আরেকজন!’

সত্যি, দ্বিতীয় মেয়েটি ঢুকল আরেক রুমে। ঠোঁটে সিগারেট।

ওই ঘরের দরজার পাশ থেকে উঁকি দিল পবন।

হিটারের সামনে বসেছে মেয়েটি। আরও কয়েকটা মেয়ে ঘরে। সবার পরনে স্বচ্ছ নাইটি। মুখে কড়া মেকআপ। পুব ইউরোপের কোনও দেশের ভাষায় কথা বলছে।

‘ছয় সপ্তাহ আর্কটিকে থাকবে, তাই রাফিয়ান আর্মির অফিসাররা এদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে,’ ফারিয়াকে বলল পবন। ‘চলো পরের ব্যারাক ঘুরে দেখি।’

কপাল মন্দ, দ্বিতীয় ব্যারাকও খালি নেই।

ওটা ব্যবহার করে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

ঘরগুলো আপাতত ফাঁকা। দীর্ঘ হলে একের পর এক বাঙ্ক বেড। বেশিরভাগ ফুট-লকার খোলা।

‘না, এখানে লুকাতে পারবে না ওরা।

বেরিয়ে এসে দ্বিতীয় ব্যারাক পেরিয়ে রানওয়ের পাশের এক হ্যাঙারে ঢুকল পবন ও ফারিয়া।

এখানে বেশিরভাগ জায়গা দখল করেছে মস্ত বড়’ এক অ্যান্টোনভ বিমান। এমনই এক বিমান নিয়ে সাগরে পড়েছে মাসুদ রানা।

খোলা রিয়ার র‍্যাম্পে উঠে ভিতরে উঁকি দিল পবন। বিমানের পেটে অজস্র ক্রেট ও বড় বড় কী যেন। সব ঢেকে রাখা হয়েছে তারপুলিন ও নেটিং দিয়ে।

‘আরেকটা বিমান আছে ওদের?’ আনমনে বলল ফারিয়া।

‘ভেতরে বহুকিছু রেখেছে, ওসবের পিছনে লুকিয়ে পড়তে পারি,’ বলল পবন। ‘এসো!’

প্রকাণ্ড বিমানের হোল্ডে ঢুকে কোণে রাখা উঁচু মালের স্তূপের পিছনে লুকিয়ে পড়ল ওরা।

তখনই লাউডস্পিকারে শুনল ভয়ানক অত্যাচারিত মানুষের আহাজারি।

প্রথমে মৃত্যু হলো হাতুড়িমাথা নটি এরিকের।

তারপর মারা হলো জাড ময়লানকে।

কিন্তু প্যারিয়ায় রানার ইলেকট্রিক শক ধরিয়ে দিল ওদেরকে।

.

কাদায় পবনের নাইকি বুটের ছাপ দেখবার পর সতর্ক হয়ে উঠেছে ক্যাম্পেন ফন নেইটরিচ।

পবন ও ফারিয়া পালাতে ব্যস্ত, কিন্তু নেইটরিচ তাড়াহুড়ো না করে মেথড মেনে চলেছে। ধৈর্যের অভাব নেই। এসেছে চারপাশ দেখতে দেখতে। নাইকি বুটের ছাপ পেয়েছে বরফে ও কাদায়।

এবং হ্যাঙারের দরজার সামনেই ছিল একটা ছাপ।

এই হ্যাঙারেই আছে অ্যান্টোনভ কার্গো বিমান।

যা বুঝবার বুঝে নিয়েছে নেইটরিচ।

নিঃশব্দে তার লোকজন নিয়ে প্রায়ান্ধকার হ্যাঙারে ঢুকেছে সে।

লাউডস্পিকারে তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ছে জাড ময়লান।

দলের সবাইকে নীরব থাকতে ইশারা করল নেইটরিচ। হাতে জাদু-দণ্ডের মত চেহারার লিসেনিং ডিভাইস। কান পাতল হেডফোনে।

মাসুদ রানাকে ইলেকট্রিক শক দেয়া শুরু হতেই অ্যান্টোনভ বিমানের হোল্ডের দিকে দণ্ড তাক করল নেইটরিচ। আর রানার গোঙানি বাড়তেই হেডফোনে শুনল সবই।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে কোনও মেয়ে।

ঝড়ের মত বিমানে ঢুকল নেইটরিচের লোক।

দশ সেকেণ্ডে ধরা পড়ল পবন ও ফারিয়া।

সর সর শব্দে ওদের মাথার উপর থেকে সরিয়ে দেয়া হলো তারপুলিন।

পবনের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হলো স্যামসোনাইট কেস।

.

ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পবন ও ফারিয়াকে গ্যাসওঅর্কে ঢোকাল পচা নেইটরিচ ও তার দলবল।

প্রকাণ্ড ঘরের পরিবেশটা ভয়ানক।

এইমাত্র শেষ হয়েছে নিশাত ও পিয়েখের উপর অকল্পনীয় নির্যাতন। প্রং থেকে ঝুলছে দুই লাশ, মাথার উপর কাঠের বাক্স। মাসুদ রানাকে আটকে রাখা হয়েছে খাড়া করা খাটিয়ার ফ্রেমে, ওটা থেকে তার গেছে ট্র্যান্সফর্মারে।

একহাতে স্যামসোনাইট কেস নিয়ে উইলিয়াম থ্রাশারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল নেইটরিচ। দু’হাতে তুলে ধরল কেস। ‘স্যর, আমাদের স্ফেয়ার।’

কেসের ঢাকনি খুলল থ্রাশার। গাঢ় লাল, চকচকে স্ফেয়ারের দিকে চেয়ে হাসি-হাসি হয়ে গেল তার চেহারা।

‘ধন্যবাদ, নেইটরিচ,’ আন্তরিক হাসল। ‘ভালভাবেই কাজ সমাধা করেছ।’ মাথার ইশারা করল ফারিয়ার দিকে। ‘পুরস্কার বুঝে নাও। এই মেয়ে এখন তোমার। পুরনো মেয়েলোকগুলোর চেয়ে অনেক নতুন।

সামনে ঝুঁকে গেল নেইটরিচ। ‘স্যর, পুরো আমার?’

‘হ্যাঁ, নেইটরিচ। …ছেলেরা!’ গলা উঁচু করল থ্রাশার। ‘এই মেয়ে এখন থেকে শুধু পচা নেইটরিচের। কেউ হাত বাড়াবে না ওর জিনিসের দিকে। তবে ওর ইচ্ছে হলে ভাগ দিতে পারে, বা ভাড়াও দিতে পারে। সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য পালনের জন্য নেইটরিচকে ওই মেয়েটা দিয়ে দেয়া হলো।’

‘অনেক ধন্যবাদ, স্যর!’ মেঝের কাছে চলে গেল নেইটরিচের মাথা, কুর্নিশ করল বারকয়েক। বেরিয়ে পড়েছে বত্রিশ পাটি হলুদ দাঁত। ‘আপনি অনেক দয়ালু, স্যর!’ খপ্ করে ফারিয়ার ডানবাহু ধরল সে, জোর টান দিয়ে অসহায় মেয়েটিকে নিয়ে গেল ব্যালকনির শেষে।

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল পবন। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো এক তস্কর উল্টো হাতের চড় দিল ওর গালে। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল পবন। মুখের কশা ফেটে বেরিয়ে এসেছে রক্ত।

ওর করুণ অবস্থা দেখে খিঁক-খিঁক করে হাসল অন্য তস্কররা।

কর্নেল সাইক্লোনের দিকে স্ফেয়ার কেস বাড়িয়ে দিল থ্রাশার। ‘কর্নেল, এটা নেবে মিসাইল ব্যাটারিতে। তবে এখনই নয়, আমি নিজে দেখতে চাই গ্যাসের মেঘে ফায়ার করা হলো। আর মনে রাখবে, গ্যাসহীন আকাশ পার করার পর মিসাইল ফাটাতে হবে। নইলে জ্বলবে না আগুন।’

স্ফেয়ার কেস হাতে দৌড়ে দরজা পেরিয়ে গেল কর্নেল সাইক্লোন।

ব্যথা সারা শরীরে, ক্লান্ত রানা অসহায় চোখে দেখল চারপাশ।

স্কেয়ার নিয়ে চলে গেছে সাইক্লোন।

এবার কে ঠেকাবে উইলিয়াম থ্রাশারকে!

খুন হয়ে গেছে নিশাত সুলতানা ও ডিফেখন।

ফারিয়াকে ধর্ষণ করবে পশুর মত এক লোক।

টিইবি ভরা গ্যাসের মেঘে মিসাইল পাঠাবে কর্নেল সাইক্লোন।

পুড়ে ছাই হবে চিন ও উপমহাদেশের বেশিরভাগ এলাকা।

পুরোপুরি রক্ষা পাবে না ইউরোপও।

শত শত কোটি মানুষকে হত্যা করছে আমেরিকার সিআইএ-র কিছু দুর্বৃত্ত।

ঠেকাতে পারবে না ওরা।

কিন্তু এবার আরও খারাপ হয়ে উঠল পরিস্থিতি।

নির্যাতন করবার সময় যেমন হাসি-হাসি মুখ বানিয়ে রাখে উইলিয়াম থ্রাশার, সেই চেহারা নিয়ে রানার সামনে এসে দাঁড়াল। নিচু স্বরে কথা বলে উঠল:

‘কংগ্রাচুলেশন্স, মেজর, তোমার কাজ তুমি সমাপ্ত করেছ। কিন্তু দুঃখের কথা, এরপর কোনও কাজে আসবে না তুমি। এবং এর মানেই, নোংরা এ পৃথিবীর শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে পাবে না। আর কিছুই বলব না তোমাকে। কোনও নির্যাতনও করা হবে না। এবার শুধু চুপচাপ মৃত্যুবরণ করবে।’

রানার মাথার উপর রাখা সানগ্লাস তুলে নিল থ্রাশার। মনে হলো দেখছে দারুণ দামি কোনও হীরা। সানগ্লাসের ফ্রেমে ও কাঁচে অনেক আঁচড়ের দাগ। একটা কাঁচের সামনের দিক চেঁছে নিয়ে গেছে একটা বুলেট।

‘আমি যখন কাউকে হারাই, তার কাছ থেকে সুভ্যেনিয়র নিই,’ বলল থ্রাশার। ট্রফি বলতে পারো। পরে স্মৃতিচারণ করব হয়তো। এই সানগ্লাস আমাকে মনে করিয়ে দেবে আজ হেরে গিয়েছিল আমার একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।’

কোমরের খাপ থেকে ছোরা নিল সে, একটা কাঁচে জোরে আঁচড় কাটল। একটা বৃত্ত তৈরি করে তার ভিতর খোদাই করল R. A.। সানগ্লাসটা তুলে দেখাল তার অনুচরদের।

গর্জন ছেড়ে উল্লাস প্রকাশ করল তারা।

জ্যাকেটের পকেটে সানগ্লাস রাখল থ্রাশার। রানার কাছ থেকে সরে গেল। ‘কর্পোরাল সালা মাতারি, মাসুদ রানার বুকে আরেকটা ইলেকট্রোড লাগাও। এবার পুরো দশ হাজার ভোল্ট। দুঃখিত, রানা, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হয়েছি, সত্যিই ভাল প্রতিযোগী ছিলে।’

মাতারি বাড়তি ইলেকট্রোড আটকে দিল রানার ভেজা বুকে। জায়গাটা ঠিক হৃৎপিণ্ডের উপর। তারপর আদেশের অপেক্ষায় গিয়ে দাঁড়াল ট্র্যান্সফর্মারের পাশে।

আস্তে করে একবার মাথা দোলাল থ্রাশার।

ডায়াল ঘুরিয়ে দিল মাতারি।

আগের চেয়ে অন্তত কয়েক গুণ বেশি কাঁপতে লাগল রানা।

বেডফ্রেম থেকে উঠছে নীল ফুলকি।

ভয়ঙ্করভাবে নানাদিকে ছিটকে যেতে চাইল রানা। যেন উল্টোদিকে গিয়ে ভাঙবে মেরুদণ্ড। কোটর ছেড়ে কপালে উঠতে চাইল দু’চোখ। পরক্ষণে যেন দপ্ করে শেষ হয়ে গেল সব।

পুরো শিথিল রানার দেহ। স্টিলের বেডফ্রেমে ঝুলছে। সামান্যতম নড়ছে না।

ডায়াল ঘুরিয়ে ট্র্যান্সফর্মার বন্ধ করল কর্পোরাল মাতারি।

টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে রাফিয়ান আর্মির সবাই।

মাসুদ রানার পাল্স্ পরীক্ষা করল উইলিয়াম থ্রাশার। সোজা

হয়ে ঘুরে দাঁড়াল, হাসছে আনমনে। কিছুই বলতে হলো না কাউকে।

বিকট চিৎকারে উল্লাস প্রকাশ করল নারকীয় লোকগুলো।

অসহায় অবস্থায় করুণ, নির্মম মৃত্যু বরণ করেছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের তীক্ষ্ণধী এজেন্ট মেজর (অব.) মাসুদ রানা। চিরতরে থেমে গেছে তার বাংলাদেশের জন্য ভালবাসা ভরা বুকটা! দেশের জন্য আর কাঁদবে না তার হৃদয়।

ছাব্বিশ

আর্কটিক সাগর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে— আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি.।

রাত এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিট।

ওয়াশিংটনের সড়কে ঝড়ো গতি তুলছে কেভিন কনলন। পাশের সিটে রিনা গর্ডন। গাড়িটা দু’হাজার সাত সালে তৈরি ছোট টয়োটা প্রিমিও।

উইলিয়াম থ্রাশারের সিআইএ ফাইল খুলবার পর, কিল-ড্রাগন আসলে কী, তা পড়েছে ওরা। জানত, ওই কমপিউটার জানিয়ে দেবে ওদের অবস্থান। তাই কাজ শেষে ফাইল বন্ধ করেই পালাতে শুরু করেছে।

এবং সে কারণেই ওরা এখন প্রিমিও গাড়িতে। ওটা একটা যিপকার নেটওঅর্ক থেকে নেয়া হয়েছে। এ ধরনের ইকো-ফ্রেণ্ডলি গাড়ি শহরের নানা জায়গায় রাখে ভাড়া-গাড়ির কোম্পানি। তাদেরই কাস্টোমার কেভিন কনলন। কার্ড দেখিয়ে যে-কোনও একটায় চড়ে বসলেই হলো।

জানত, ওই ফাইল পড়ার জন্য বেশি সময় পাবে না। এমনকী গাড়ি ভাড়া করতে গিয়েও বিপদ হতে পারে। কারণ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলেই সিআইএ জানবে কোথা থেকে নেয়া হয়েছে গাড়ি। এরপর তারা লেলিয়ে দেবে ওয়াশিংটনের পুলিশকে। তবুও ঝুঁকি নিয়েছে কেভিন, স্থির করেছে বেশিক্ষণ ব্যবহার করবে না এই গাড়ি।

‘আমরা যাচ্ছি কোথায়, কেভিন?’ জানতে চাইল রিনা গর্ডন।

কঠিন মুখে সামনে চেয়ে আছে কনলন। মাত্র একটা জায়গাতেই যেতে পারব। আর ওরা চাইছে আপনি যেন ওখানে যেতে না পারেন।’

বাঁক নিয়ে পেনসিলভ্যানিয়া অ্যাভিনিউর উত্তর-পশ্চিম বাহুতে পড়েছে ওরা। শেষমাথায় বিখ্যাত, বিশাল ম্যানশন— ঝলমল করছে রাতের অত্যুজ্জ্বল ফ্লাডলাইটে।

‘যেভাবে হোক আপনাকে পৌঁছে দেব হোয়াইট হাউসের অ্যাপয়েন্টমেণ্টে,’ বলল কেভিন।

আমাদেরকে ঠেকাতে চাইবে সিআইএ,’ বলল রিনা। রাতের হালকা ট্রাফিকের ভিতর দিয়ে চলেছে গাড়ি। ‘চারপাশে থাকবে তাদের লোক।’

‘জানি,’ মাথা দোলাল কেভিন। ‘কাজেই ভাগ্যের জোর চাই।’

পেনসিলভ্যানিয়া অ্যাভিনিউ ও ওয়েস্ট একয়েকিউটিভ অ্যাভিনিউয়ের কোণে পৌঁছেছে ওরা, সামনের রাস্তায় হোয়াইট হাউসের পশ্চিম গেট।

গাড়ি নিয়ে ওয়েস্ট একযেকিউটিভ অ্যাভিনিউতে পড়ল কেভিন। সোজা চলেছে হোয়াইট হাউসের পশ্চিম গেট লক্ষ্য করে। প্রবেশপথের পাশে দেখা গেল বুমগেটসহ গার্ডহাউস।

সিআইএ-র লোক সতর্ক থাকবে, কাছেই চারপাশে চোখ রেখেছে রিনা গর্ডন। লাফায়েট স্কয়্যারে বরাবরের মতই মানুষের ভিড়: হরেক জাতের টুরিস্ট, আমেরিকান পুলিশ এবং…

সুট পরা চারজোড়া লোক। স্ট্র্যাটেজিক সব জায়গায় পযিশন নিয়েছে। দু’একজনের হাত কানে, কব্জির কাছে কী যেন বলছে ফিসফিস করে। চোখ বোলাচ্ছে চারপাশে।

‘আমি ওদেরকে দেখেছি,’ বলল কেভিন।

‘হয়তো সিক্রেট সার্ভিসের…’ চুপ হয়ে গেল রিনা।

হঠাৎ করেই লোকগুলোর একজন ঝট্ করে হাত তুলেছে ওদের গাড়ির দিকে। পরক্ষণে দৌড়ে আসতে লাগল।

‘সর্বনাশ!’ ফিসফিস করল রিনা। ‘আমরা ধরা পড়ে গেছি!’ ক্রিচ-ক্রিচ শব্দে রাস্তা ছাড়ল প্রিমিও, বামে বাঁক নিয়েই ছুটল ওয়েস্ট উইং এন্ট্রান্স লক্ষ্য করে। মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরেছে কেভিন। শালার কপাল!’ বিড়বিড় করল।

যা ভেবেছে, ইউনিফর্ম পরা সিক্রেট সার্ভিসের প্রহরীরা গেটহাউস থেকে গুলিবর্ষণ করল ওদের গাড়ির উপর। মনে মনে কপাল চাপড়াল কেভিন। শালাদের আক্কেল নেই? হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে হোয়াইট হাউসে হামলা করবে কোন্ টেরোরিস্ট?

ঝট্ করে মাথা নিচু করে নিয়েছে কেভিন ও রিনা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল উইণ্ডশিল্ড। দুটো বুলেট সিঁথি কেটে দিল রিনার চুলে।

বাঁক নিয়েই দড়াম করে রিইনফোর্সড্ গেটপোস্টে গুঁতো লাগাল গাড়ি। থেমে গেল আচমকা। ভয়ঙ্কর মুচড়ে গেছে বনেট। ঝটকা খেয়ে সামনে বেড়েছে কেভিন ও রিনার মাথা— তখনই ভুস্ আওয়াজ তুলে সামনে খুলে গেছে গাড়ির এয়ারব্যাগ।

স্‌স্‌স্‌স্‌ আওয়াজ তুলছে গাড়ির ইঞ্জিন। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে কেভিনদেরকে ঘিরে ফেলল ছয়জন সিক্রেট সার্ভিস গার্ড, হাতে উদ্যত পিস্তল।

,সিআইএ-র যে লোক তেড়ে আসছিল, সে দূরেই রয়ে গেল। কেভিন ও রিনা আছে এখন সিক্রেট সার্ভিসের লোকের হাতে। এবং হোয়াইট হাউসের সিকিউরিটির বিষয়ে কারও সঙ্গে আপোস করে না সিক্রেট সার্ভিস। কাউকে বন্দি করলে তদন্ত তারা নিজেরাই করে।

‘মাথার ওপর হাত রেখে গাড়ি থেকে বেরোও!’ ধমক দিল এক সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট।

নির্দেশ মত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কেভিন ও রিনা। বেদম দুই ধাক্কা খেয়ে জমিতে শুয়ে পড়ল ওরা, ধুলোয় ভরে উঠল মুখ। দু’হাত পিঠের কাছে নিয়ে হ্যাণ্ডকাফে আটকে দেয়া হলো। দেরি না করে গাড়ি সার্চ করতে লাগল সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা।

‘কোনও ডিভাইস নেই গাড়িতে, নীচেও না,’ একটু পর জানাল এক গার্ড।

দলের নেতা তিক্ত চেহারায় মাথা নাড়ল। ‘এদের আইডি চেক করো।’ হ্যাঁচকা টানে কেভিনকে দাঁড় করাল সে। ‘বাছা, এবার মস্ত বিপদে পড়েছ।’

বেসুরো গলায় বলল কেভিন, ‘স্যর, আমার নাম কেভিন কনলন, কাজ করি ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে। আর ইনি রিনা গর্ডন, তিনিও ডিআইএ-তে কর্মরত। দয়া করে ভিটিার্স লগ দেখুন। ওখানে মিস গর্ডনের নাম আছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট।’

সব কাজ শেষ হতে বিশ মিনিট লাগল। পুরো সময় ওয়েস্ট উইং এন্ট্রান্সের ভিতরে এক প্রিযন ভ্যানে বন্দি করে রাখা হলো কেভিন ও রিনাকে। অবশ্য, এরপর ডাক এল ওদের।

সিনিয়ার এক সিক্রেট সার্ভিস গার্ড নিজেই ভ্যানের দরজা খুলল। পাশে সুট পরিহিত প্রেসিডেনশিয়াল এইড।

‘এই ভদ্রমহিলার সত্যিই অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে,’ বলল গার্ড। ‘আর, মিস্টার কনলন, তোমার রেকর্ড খুবই ভাল। আমাকে বলা হয়েছে, রিনা গর্ডন যদি তোমাকে সঙ্গে করে হোয়াইট হাউসে নিতে চান, আমরা যেন আপত্তি না তুলি।’

‘ও আমার সঙ্গে যাবে, সন্দেহ কী,’ রাগী কণ্ঠে বলল রিনা।

‘পরেরবার গেটে থামবেন, সময় হলে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল গার্ড।

‘আমাদের উপায় ছিল না,’ বলল কেভিন। ‘চারপাশে শত্রু। সুযোগ পেলেই ঠেকিয়ে দিত, যাতে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে না পারি। যদি থামতাম, লাশ হতাম।’ দুর্বল হাসি দিল কেভিন। ‘সরি, আপনারদের গেট ভাঙতে চাইনি।’

রিনা গর্ডন রওনা হয়ে গেছে, তার পিছু নিল কেভিন। ঢুকে পড়ল ওরা হোয়াইট হাউসে।

.

বরফখণ্ড ভরা আর্কটিক সাগরের মাঝে পোলার আইল্যাণ্ড।

দুপুর বারোটা পঞ্চান্ন মিনিট।

হাতুড়িমাথা নটি এরিক ও জাড ময়লানের লাশের মতই অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যালকনি থেকে কনভেয়ার বেল্টে ফেলে দেয়া হলো মাসুদ রানার লাশ।

বেডফ্রেম ও মৃতদেহ রওনা হয়ে গেল পঞ্চাশ গজ দূরে, নীচের ফার্নেস লক্ষ্য করে। লাশটা যাবে চওড়া এক র‍্যাম্পের তলা দিয়ে, গিয়ে পড়বে গ্যাসওঅর্কের লেলিহান আগুনে।

তেতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাফিয়ান আর্মির লোক। ওরা দ্বিতীয়তলায় দশ সেকেণ্ডের জন্য দেখতে পাবে না রানার লাশ।

‘আ-গু-ন! আ-গু-ন! আ-গু-ন!’ বদ্ধ উন্মাদের মত চিৎকার করছে লোকগুলো। ব্যস্ত চোখ দেখছে শত্রু-নেতার লাশ গিয়ে পড়বে গনগনে অগ্নিশিখার ভিতর।

মৃতদেহের উপর আঠার মত আটকে আছে তাদের চোখ। কনভেয়ার বেল্টে পড়ে থাকা রানার লাশ চলে গেল র‍্যাম্পের নীচে।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও দেখা যাবে লাশ।

অন্যদের সঙ্গে নিজেও ওদিকে চেয়ে আছে উইলিয়াম থ্রাশার।

এবার চিরকালের জন্য হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে মাসুদ রানা।

কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর ভুরু কুঁচকে গেল থ্রাশারের।

র‍্যাম্পের তলা দিয়ে বেরোচ্ছে না কেন লাশটা!

এগিয়ে চলেছে র‍্যাম্প, কিন্তু যেখানে রানার লাশ থাকা উচিত, সে জায়গা ফাঁকা।

পিটপিট করে আবারও চাইল থ্রাশার, দ্বিধান্বিত।

র‍্যাম্পের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় কী ঘটল ওই লাশের?

নীচে গিয়ে দেখবার জন্য দু’জন লোক পাঠাল থ্রাশার।

মাত্র আধ মিনিট পর র‍্যাম্পের তলা থেকে এল তুমুল গুলির আওয়াজ।

লোক দু’জন ফিরল না।

স্টিলের মইয়ের দিকে পা বাড়াল থ্রাশার, নামবে নীচতলায় …

কিন্তু তখনই ভাবারও দেখা দিল মাসুদ রানা— জ্যান্ত!

এখন বেডফ্রেমের সঙ্গে হ্যাণ্ডকাফে বন্দি নয় সে!

ব্যাটা মরেও আবারও বাঁচে কী করে? হতবাক হয়ে ভাবল থ্রাশার। অভিনয় করছিল? উঁহুঁ।

কয়েক লাফে স্টিলের মইয়ের কাছে পৌছে গেল রানা, ঝড়ের বেগে মই বেয়ে উঠল উপরের ব্যালকনিতে।

নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না উইলিয়াম থ্রাশার।

হতবাক হয়ে রইল রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

হরর সিনেমার দৃশ্য থেকে যেন উঠে এসেছে পাথরের মূর্তির মত অবিচল মাসুদ রানা!

ঘাম ও পানিতে ভেজা খোলা বুক, পায়ে মোজা বা বুট নেই। পিঠে পোড়া দাগ। দেহে রক্তাক্ত জখম। ভয়ঙ্কর দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল। দু’চোখ রক্তলাল। ভুরু কুঁচকে উইলিয়াম থ্রাশারের দিকে চাইল খুনির দৃষ্টিতে।

মাসুদ রানা যে শুধু মৃত জগৎ থেকে ফিরেছে, তা নয়, দু’হাতে শ্টায়ার টিএমপি মেশিন পিস্তল ও সিগ সাওয়ার পি২২৬ পিস্তল!

ব্যালকনিতে উঠে আসতেই কী যেন নামিয়ে দিয়েছে মেঝেতে। পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে বের করেছে দুই অস্ত্র।

রানার পাশে বিশ্বস্ত কুকুরের মত অপেক্ষা করছে ছোট্ট, রুপালি রোবট!

কুয়াশার রোবট সম্বন্ধে কিছু বলতে হলে, এটা জানানো উচিত: খুবই দায়িত্বসম্পন্ন রোবট সে।

কেবল কার টার্মিনালে বিস্ফোরণের আঘাতে নীচের হিমঠাণ্ডা সাগরে গিয়ে পড়েছিল ও। অত উপর থেকে পড়েও সামান্যতম ক্ষতি হয়নি তার। বাতাস ভরা বেলুন ব্যবহার করে আবারও ভেসে উঠেছে। তখন কেউ দেখলে ভাবত, ওটা যান্ত্রিক কোনও হাঁস।

পানির তলা থেকে উঠতেই একটা বিশেষ প্রোগ্রাম কাজ করল ওর চিপসে, কাজেই ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধুকে খুঁজল।

পানির ভিতর বনবন করে ঘুরতে লাগল চাকা, দেরি হলো, কিন্তু দৃঢ়চিত্ত রোবট চলে এল উপসাগরের কিনারায়। ততক্ষণে বুঝেছে, পশ্চিমে রয়েছে পোলার আইল্যাণ্ডের পরিত্যক্ত তিমি-মাছ ধরা গ্রাম।

ওখানে পৌঁছুতে প্রায় একঘণ্টা লেগেছে ওর।

তখনই দেখল, ওই যে দূরে ওর দ্বিতীয় বন্ধু মেজর মাসুদ রানা! পাশেই শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।

গ্রামে ঢুকবার সময় রানা ও শ্যারনকে যে যান্ত্রিক চোখ খেয়াল করেছিল, সে চোখ আসলে রোবট বন্ধুর।

নিজের সাধ্যমত বন্ধুর কাছে যেতে চেয়েছে রোবট, কিন্তু অনেক দ্রুত হেঁটেছে মাসুদ রানা। তারপর রোডব্লকে বন্দি হলো সে। সরিয়ে নেয়া হলো।

তখনই খুব কাছে বলে উঠল এক মহিলা কণ্ঠ: ‘ভাল আছ, বন্ধু?’

‘বন্ধুকে যেতে হবে দ্বিতীয় বন্ধু মেজর মাসুদ রানার কাছে,’ আন্তরিক সুরেই বলল রোবট।

‘তা ঠিক। তা তো যেতেই হবে। আর তুমি যখন ওকে খুঁজে পাবে, তাকে আমার তরফ থেকে কয়েকটা জিনিস দিয়ো,’ বলল শ্যারন।

কিছুক্ষণ পর দু’জনের চেষ্টায় রোডব্লক পেরিয়ে গেল ওরা। রানার ফেলে যাওয়া দুই স্মোক গ্রেনেড গুলি করে ফাটিয়ে দিল শ্যারন। ওগুলো পড়ে ছিল রাস্তার উপর। আর ধোঁয়ার ফলে যে আড়াল তৈরি হলো, সেসময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল বন্ধু।

গাইডেড থারমাল ইমেজার ব্যবহার করে ধোঁয়ার ভিতর সবই দেখেছে। আর নির্দ্বিধায় মেশিনগান দিয়ে উড়িয়ে দিল রোডব্লকের লোকগুলোকে। কারও বাঁচবার উপায় ছিল না। এরপর ছোট ছোট চাকা ব্যবহার করে বেঁটে রোবট রওনা হয়ে গেল খাড়া রাস্তা ধরে। খুঁজতে শুরু করেছে দ্বিতীয় বন্ধুকে।

আহত শ্যারন আগেই বুঝেছে, কোনও সাহায্যে আসবে না, কাজেই বন্ধুকে আরও একটা নির্দেশ দিয়েছে। ‘জিপের চাকার নতুন দাগ অনুসরণ করবে। ওই যে, যে জিপে নিয়ে গেছে রানাকে।

নির্দেশ মেনেছে বন্ধু, শেষপর্যন্ত হাজির হয়েছে গ্যাসওঅর্কে।

ছোট চাকায় ভর করে পাশের এক দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ওখানে। অপেক্ষা করেছে র‍্যাম্পের নীচে। আর তখনই দেখল ধুপ্ করে কনভেয়ার বেল্টে পড়ল রানার দেহ।

বিস্মিত হওয়ার অধিকার তাকে দেয়া হয়নি, নির্বিকার ভাবে অপেক্ষা করল দ্বিতীয় বন্ধুর জন্য। চলে গেল কনভেয়ার বেল্টের পাশে, আর রানা আসতেই কাজে লাগাল রোবটিক বাহু। টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে নিল বেডফ্রেম ও রানাকে। স্ক্যান করতেই বন্ধু বুঝল, ওর বন্ধুর পাস্‌ নেই। পেট থেকে ডিফিব্রিলেটার বের করল সে, ব্যবহার করল সিপিআর প্রোগ্রাম।

‘ধুপ! …ধুপ! … ধুপ!’

নির্দিষ্ট পরিমাণের কারেন্ট দিয়ে শক দেয়া হলো রানাকে।

তিনবার ঝাঁকি খেল রানার দেহ…

তারপর খুলে গেল ওর দু’চোখ। হাঁপিয়ে উঠবার মত করে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে দম নিল। ফুসফুস ভরে গেল অক্সিজেনে।

বারকয়েক শ্বাস নিতে না নিতেই ব্লো-টর্চ দিয়ে ওর হ্যাণ্ডকাফের শিকল ও দড়ি পুড়িয়ে দিল বন্ধু।

দুর্দান্ত বিশ্বস্ত রোবটের কারণে আবারও জীবন ফিরে পেয়েছে রানা। অথচ মৃত্যু ছিল নিশ্চিত।

বন্ধুর ফার্স্ট-এইড প্যাক থেকে কুয়াশার এপি-৭ নিডল নিয়ে বামবাহুতে ইঞ্জেক্ট করল রানা। ব্যথা কমবে, স্থির থাকবে দেহ। কয়েক সেকেণ্ডে সত্যিই স্থিতিশীল হলো ওর শ্বাস, জোরও ফিরে এল দেহে।

তখনই বন্ধুর পিঠে তিনটে জিনিস দেখল রানা।

শ্যারনের টায়ার টিএমপি, সিগ সাওয়ার পি২২৬ পিস্তল ও ম্যাগনেটিউয়েক্স।

উঠে দাঁড়াল রানা, আস্তে করে বলল, ‘বন্ধু, তুমি সত্যি কাজের। এবার এসো কাজে নামি। তবে তার আগে বন্ধু ও শত্রুর মেমোরি ব্যাঙ্ক খুলে দাও।’

‘খুলে দিলাম মেমোরি ব্যাঙ্ক অ্যাক্সেস,’ বলল বন্ধু।

‘বন্ধুর তালিকা থেকে মুছে ফেলো ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলোর নাম।’

‘এন্ট্রি ডিলিটেড।’

‘গুড, চলো এবার। জরুরি কিছু কাজ করতে হবে আমাদের!’

.

গ্যাসওঅর্কে উইলিয়াম থ্রাশার এবং তার দস্যু আর্মির সৈনিকদের মুখোমুখি হয়েছে রানা ও রোবট বন্ধু— চল্লিশজনের বিরুদ্ধে ওরা দু’জন। রানা ও বন্ধুর অস্ত্র একই সময়ে কমলা আগুন উগরে দিল।

ফুল অটোতে মেশিনগান ব্যবহার করছে বন্ধু। নল থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে তিনফুটি আগুনের জিভ। ভারী ক্যালিবারের বুলেট সহজেই পেয়ে গেল ভিড় করা লোকগুলোকে। প্রথম বুলেট স্রোত থেমে যাওয়ার আগেই অক্কা পেল সতেরোজন সৈনিক। মাত্র এক হামলায় প্রায় অর্ধেক শত্রু সাফ করে ফেলেছে রোবট। মেঝের নানাদিকে বইছে রক্তের স্রোত।

বন্ধুর চেয়ে অনেক সতর্ক রানা, গুলি করছে নিখুঁত লক্ষ্যে। কিন্তু ওর বুলেটবর্ষণ রোবটের হামলার চেয়ে কম ক্ষতি করল না।

সবার আগে উইলিয়াম থ্রাশারের বুকে স্থির হলো ওর অস্ত্রের মাযল। কিন্তু সিআইএ এজেন্ট বাঁদরের মতই ক্ষিপ্র। রানা গুলি করবার এক সেকেণ্ড আগে নিজের সামনে কর্পোরাল সালা মাতারিকে নিয়ে এসেছে সে। পরপর দু’বার বুকে গুলি খেল সুদানিয। আর ওই সময়ে ডাইভ দিয়ে কাছের একটি ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল থ্রাশার। তাকে অনুকরণ করল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো।

পরক্ষণে অস্ত্র ঘুরিয়েই পবনকে ধরে রাখা দুই লোকের মাথা ফুটো করে দিল রানা। লাশদুটো মেঝেতে পড়বার আগেই চেঁচিয়ে বলল, ‘পবন, শুয়ে পড়ো!’

কুয়াশার সহকারী মেঝেতে চিৎপটাং হয়েই দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মাথা।

টেকো এক লোকের দিকে অস্ত্র তাক করল রানা। সে লোকই আটকে রেখেছে ফারিয়াকে। সামান্য দ্বিধা নিয়ে গুলি করল রানা, কিন্তু তার আগেই হ্যাঁচকা টানে ফারিয়াকে নিয়ে একটা মই বেয়ে নেমে গেল সে। তার গায়ে গুলি লাগল কি না, নিশ্চিত হতে পারল না রানা। কিন্তু এ মুহূর্তে দেখবার সময়ও নেই। ওর খুব কাছ দিয়ে গেল লেলিহান নীল আগুনের শিখা। ডাইভ দিয়ে আরেক পাশে পড়ল রানা।

ওই আগুনের জিভ আসলে তাক করা হয়েছে বন্ধুর উদ্দেশে।

ছোট রোবট ভয়ঙ্কর ক্ষতি করছে, তাকে ঠেকাতে কাজে নেমেছে এক দস্যু সৈনিক। দু’কাঁধের হার্নেসে ফ্লেমথ্রোয়ার। ছিটকে বেরুচ্ছে আগুনের বর্শা। লেলিহান আগুনে পুরো হারিয়ে গেল বন্ধু। পরক্ষণে শরীর গড়িয়ে বেরিয়ে এল শিখার ভিতর থেকে। জ্বলছে রাবারের চাকা। বন্ধুর গুলির আঘাতে ফ্লেমথ্রোয়ারের দু’চোখের মাঝে তৈরি হলো নতুন একটা রক্তিম নয়ন।

লাশটা মেঝেতে পড়বার আগেই আরও অনেক বিপজ্জনক হামলা এল বন্ধুর উপর।

ইউরোপিয়ান এক অফিসার—জল্লাদ-মেঝে থেকে তুলে নিয়েছে আরপিজি, নিক্ষেপ করল রকেট গ্রেনেড।

দূর থেকে এসে সোজা বন্ধুর নিম্নাঙ্গে লাগল রকেট।

বিকট বিস্ফোরণে খানখান হয়ে গেল বন্ধুর একাংশ।

চারদিকে ছিটকে গেল টাইটেনিয়ামের ধারাল টুকরো ও জ্বলন্ত চাকা। ধূসর ধোঁয়ার মেঘে হারিয়ে গেল বন্ধু।

কী ঘটেছে খেয়াল করেছে রানা। মন খারাপ হয়ে গেল ওর, কিন্তু গুলি বন্ধ করবার উপায় নেই। এই লড়াইয়ে এখন ও একা। বুঝে গেল, চট্ করে শেষ করতে হবে লড়াই।

পরবর্তী তিরিশ সেকেণ্ড লড়াইয়ের সমস্ত দক্ষতা কাজে লাগাল রানা। আধমিনিট আগে ছিল বারোজন সৈনিক, কিন্তু একত্রিশ সেকেণ্ডে কেউ দাঁড়িয়ে থাকল না।

রানা যেন হয়ে উঠেছিল বিধ্বংসী কোনও প্রাকৃতিক শক্তি।

সম্পূর্ণ নির্বিকার চেহারা, চোখে নেই কোনও অনুভূতির ছাপ। ঠাণ্ডা মাথায় নিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপ। নষ্ট করেনি একটিও বুলেট। চোখের সামনে যারা ছিল, কেউ রক্ষা পায়নি।

মাত্র দু’চারজন আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তাক করতে চেয়েছিল, কিন্তু রক্তাক্ত বুক বা মুখ নিয়ে ছিটকে পড়েছে লাশ হয়ে। আরপিজি ফায়ার করবার পর নিজেদের এক লোককে বর্মের মত ব্যবহার করেছে জল্লাদ, কিন্তু এক পশলা টায়ারের গুলি অক্কা পাইয়ে দিয়েছে দু’জনকেই। সামনের লোকটাকে ভেদ করে জল্লাদের হৃৎপিণ্ডে বিঁধেছে বুলেট।

তখনই স্যান্টা ক্ল্যকে দেখেছে রানা, কিন্তু ভীষণ চালু প্রকাণ্ডদেহী চিলিয়ান লেফটেন্যান্ট— ডাইভ করে বেরিয়ে গেছে একযিট ডোর দিয়ে। কয়েকজন পিছু নিতে চেয়েছিল, কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে দেখল, ওদিক থেকে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। পিছন থেকে আসছে স্বয়ং যম- মাসুদ রানা!

ভীষণ ভয় পেল তারা।

গম্ভীর, কঠোর চোখে যেন মৃত্যুর ওপার থেকে ওদেরকে দেখছে ভয়ঙ্কর শত্রু!

মাত্র একটু আগেই ওর উপর প্রচণ্ড নির্যাতন হচ্ছে বলে হৈ-হৈ করে ফুর্তি করছিল তারা।

ব্রাশ ফায়ারে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই লাশ হয়ে পড়ে রইল লোকগুলো।

রানা ও পবন ছাড়া জীবন্ত কেউ থাকল না ব্যালকনিতে।

ছুটে নিশাতের পাশে পৌছে গেল রানা।

ফোর্কলিফটের প্রং থেকে ঝুলছে নিথর লাশ।

কিন্তু হঠাৎ চমকে গেল রানা।

সামান্য নড়ে উঠেছে নিশাতের মাথা।

‘আপা?’ কেঁপে গেল ওর কণ্ঠ। পুরো নিশ্চিত হতে পারছে না ভুল দেখেছে কি না। মারা যাওয়ার পরেও কখনও কখনও পেশি নড়ে লাশের।

‘ভাই?’ কাঠের বাক্সের কারণে ভোঁতা শোনাল নিশাতের কণ্ঠ। ‘সত্যিই কি আপনি? আপনিই কি এত গোলাগুলি করলেন?’

পরের পঁচিশ সেকেণ্ডে ফোর্কলিফট নিচু করে আনল রানা।

মেঝেতে শুয়ে পড়ল নিশাত। পাশেই পড়ে আছে ডিফেখন।

গুলি করে দু’জনের হ্যাণ্ডকাফের শেকল ছিঁড়ে দিল রানা। ঝটপট সরিয়ে ফেলল নিশাতের মাথার বাক্স।

ওটার ভিতর থেকে গড়িয়ে পড়ল চার মৃত ইঁদুর। কামড়ে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে মাথা। ঘাড় রক্তাক্ত।

নিশাতের দাঁতে রক্ত, দেখল রানা।

‘আপা…’ আর কিছু বলতে পারল না ও, দু’হাতে ধরল নিশাতের হাত।

‘ওই লেখক যা খুশি লিখুক,’ আপত্তির সুরে বলল নিশাত। ‘ভয় পাব কেন? কিন্তু…’ রানার দু’হাতে আলতো চাপড় দিল ও।

‘কিন্তু কী, আপা?’

‘দুটো কিন্তু, বলল নিশাত। ‘প্রথম কথা, আটকানো হাতে ক্ষুধার্ত ইঁদুরের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। আর… বড় খারাপ স্বাদ ওগুলোর!’

পবন পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসে খুলে ফেলল ফ্রেঞ্চ বুনোর বাক্স। নিশাতের বাক্সের মতই ওখান থেকে পড়ল চারটে মাথাহীন ইঁদুর।

থু-থু করে কয়েক টুকরো হাড় ফেলল ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন, নিশাতের দিকে চাইল। ‘অত খারাপ না স্বাদ! আসলে সমস্যা ওদের লোম!’

‘কি প্ল্যান করেছিলেন?’ নিশাতের কাছে জানতে চাইল রানা। ‘মারা গেছেন ভঙ্গি করবেন, আর আপনাদেরকে ফার্নেসে ফেলে দেয়ার সময় পালাতে চাইবেন?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। শেষ যা বুঝলাম, আপনাকে টোস্টের মত ভাজা হচ্ছিল। তখন আগে পরে কখন যেন আপনি বললেন, হাল যাতে না ছাড়ি। কাজেই হাল ছাড়লাম না।’

‘ভাল প্ল্যান করেছিলেন।’

কাঁধ ঝাঁকাল নিশাত। ‘মাথার ওপর বাক্স বসিয়ে দিতেই ডিফেখনকে বললাম, ‘ইঁদুরগুলোকে চিবিয়ে খেয়ে চুপচাপ ঝুলতে থাকো, বাপু!’ খুবই ভাল লোক, স্যর, ঠিকই বুঝেছে কী বলতে চাই।’

মৃত্যুও ভয় পাবে আপনাকে, আপা,’ হাসল রানা। ‘ডিফেখন, আপনিও দারুণ দেখিয়েছেন।’

নীরবে প্রশংসা নিল ডিফেখন, রানার অস্ত্রগুলো দেখিয়ে বলল, ‘মোসিউ, এসব অস্ত্র আমার চেনা। খুবই লক্ষ্মী এক মেয়ের। ও কি বেঁচে আছে?’

‘হ্যাঁ। পরে ওর ব্যাপারে আলাপ হবে। আমাদের পুনর্জন্মের পর আপাতত জরুরি কাজ আছে। আরও একটা মিসাইল লঞ্চ করার আগেই কুকুরগুলোকে ঠেকাতে হবে।’

উঠে দাঁড়িয়েই রানা দেখল, একটু দূরে কুঁজো হয়ে কী যেন দেখছে পবন। ওর পাশে চলে গেল ও।

মেঝেতে রোবট বন্ধু, ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

গ্রেনেডের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে নীচের পুরো অংশ।

চাকা ও মোটরও নেই

এত ভাল রোবট হয়ে উঠেছে প্রায় জঞ্জাল।

দেহের উপরাংশ এখনও আস্ত। কাজ করছে ইন্টারনাল ব্যাটারি। একদিক থেকে আরেকদিক ঘোরাচ্ছে অস্ত্র। এদিক ওদিক সরছে চোখ বা লেন্স। সাহসিকতার সঙ্গে এখনও খুঁজছে শত্রু। যদিও তাদের কেউ নেই।

‘ওর অবস্থা কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘এখনও লড়তে চাইছে, কিন্তু নড়তে পারবে না।’

ছোট রোবটের দিকে আবারও চাইল রানা। ‘মরে যাওয়ার পরেও আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে, ও আমার সঙ্গে থাকবে।’

‘আমাকে সঙ্গে নিতে চাওয়ায় অনেক ধন্যবাদ, বন্ধু, বলল বন্ধু, ‘প্রাণের বন্ধু!’

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা, চট্‌পট্ নতুন সব শব্দ শিখছে রোবট। চলে গেল ও কাছের এক রাফিয়ান সৈনিকের পাশে। মেঝে থেকে নিল একটা জিনিস। ফিরে এসে সাবধানে তুলল বন্ধুকে, এবার এমন এক কাজ করল যে হেসে ফেলল পবন।

‘বাহ্, ভাল তো,’ বলল।

আবার ব্যালকনির আরেকদিকে গিয়ে থামল রানা। কর্পোরাল সালা মাতারির পাশ থেকে তুলে নিল নিজের ম্যাগহুক, পিঠে হোলস্টার বেঁধে তার ভিতর রাখল। দরজা দেখিয়ে বলল, ‘চলুন সবাই।’

রওনা হয়ে গেল ওরা।

দলের পিছনে নিশাত ও ডিফেখন। মৃত শত্রুদের পাশ থেকে তুলে নিয়েছে দুটো দুটো করে চারটে একে-৪৭ রাইফেল। সংগ্রহ করেছে বেশকিছু গুলিভরা ম্যাগাযিন ও দুটো ইয়ারপিস।

রানার পিছনে ছুটতে শুরু করেও চট্ করে ফেলে আসা জায়গাটা দেখল নিশাত।

ওখানে পড়ে আছে প্রায় চল্লিশজন সৈনিকের লাশ।

ডিফেখনের পাশে চলতে চলতে নিচু স্বরে বলল নিশাত, ‘একটা কথা মাথায় গেঁথে রাখুন, ডিফেখন, কখনও রাগাতে হয় না মাসুদ রানাকে!’

সাতাশ

পিছনে নিশাত, বুনো ও পবনকে নিয়ে থামল রানা।

গ্যাসওঅর্কের এদিকের দরজা লক করা।

সামান্য প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে তালার জায়গাটা উড়িয়ে দিল রানা, আস্তে করে খুলল কবাট।

দূরে দেখা গেল উইলিয়াম থ্রাশারকে, সঙ্গে প্রকাণ্ডদেহী স্যান্টা ক্ল্য এবং ছয় সৈনিক।

সবাই চলেছে মিসাইল ব্যাটারি লক্ষ্য করে।

তাদের চেয়ে এগিয়ে আছে কর্নেল সাইক্লোন, থ্রাশারের জন্য অপেক্ষা করছে উঁচু সেতুর মুখে। নেতা আসছে দেখেই চলল মিসাইল ব্যাটারির দিকে, হাতে স্ফেয়ারের স্যামসোনাইট কেস।

তখনই ঝট করে পিছনে চাইল থ্রাশার, দরজায় বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়েছে নিশ্চয়ই। রানা ও তার দলের ক’জনকে দেখেই চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল।

ঘুরেই গুলি শুরু করল রাফিয়ান আর্মির সৈনিক। ঠেকিয়ে দেবে শত্রুদেরকে। আর সে সুযোগে স্ফেয়ার কেস নিয়ে মিসাইল ব্যাটারিতে চলে যাবে কর্নেল সাইক্লোন।

দরজার আড়াল নিয়েছে রানা। বুঝে গেছে, দেরি করে ফেলেছে। এখন দৌড়েও পিছনে ফেলতে পারবে না সাইক্লোনকে। তখনই অনেকটা দূরে ছোট কাউকে দেখল রানা।

সে আছে উঁচু সেতুর শেষমাথায়।

তার দিকেই ছুটছে সাইক্লোন।

হঠাৎ করেই ওই দূরের মানুষটাকে চিনল রানা।

আর তখনই আকাশে লাফিয়ে উঠল গোটা মিসাইল ব্যাটারি!

ওখানে সৃষ্টি হলো কমলা আগুনের মস্ত একটি বল।

বোকা হয়ে দৌড় থামাল সাইক্লোন।

উড়ে গেছে তাদের সাধের মিসাইল ব্যাটারি!

একের পর এক বিস্ফোরণে আকাশে উঠছে বিধ্বস্ত ছয় ট্র্যান্সপোর্ট ইরেকটর লঞ্চার এবং ওগুলোর পিঠের মিসাইল।

মাত্র একটা ব্যাখ্যাই এল রানার মনে: ওই দূরের সেতুর শেষে যে বসে ছিল, সে-ই বসিয়েছে এসব এক্সপ্লোসিভ।

কর্পোরাল বব বউলিং!

চোখের সামনে আগুনের মাঝে হারিয়ে গেছে বেচারা, আর দেখা গেল না তাকে।

রানার মনে পড়ল, ওকে নির্যাতন করবার আগে ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলোকে দেখেছে। বিশ্বাসঘাতকটা যোগ দিয়েছিল থ্রাশারের দলে। বাথরুমে বলেছিল, গুলি করেছে তরুণ ববের কপালে।

রানা নিশ্চিত নয়, তবে আঁচ করতে পারছে কী ঘটেছে।

ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো বেশিরভাগ ক্রিমিনালের মতই মস্ত ভুল করেছে। বউলিঙের কপালে গুলি করেই সন্তুষ্ট হয়েছে।

বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস: কারও কপালে গুলি করলে মরতেই হবে তাকে। কিন্তু বাস্তবে হাজার হাজার বছর ধরে মগজ নিরাপদে রাখতে মানুষের কপালের হাড় অনেক শক্ত করে দিয়েছে প্রকৃতি। করোটির সবচেয়ে পুরু হাড় কপালেই থাকে। কাজেই মাথার পিছনে কমপক্ষে দুটো গুলি করে দক্ষ খুনি— একযেকিউশন স্টাইল কিলিং। সুযোগ থাকলে শত্রুর মাথার চাঁদিতে গুলি করে স্নাইপাররা।

কপালে গুলি লাগলে বেশিরভাগ সময় আহতকে হাসপাতালে নিলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে সে।

আহত, কিন্তু বেঁচে ছিল বব বউলিং।

সময় লেগেছে, কিন্তু ঠিকই শেষ করেছে নিজের মিশন।

মনের চোখে দেখল রানা, রক্তাক্ত কপাল নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে বব, এক এক করে বসিয়ে দিচ্ছে গ্যাস ট্যাঙ্কগুলোয় টাইম সেট করা গ্রেনেড। কাজ শেষে চুপ করে বসে পড়েছে সেতুর মুখে। অপেক্ষা করেছে জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য।

মস্ত সব বিস্ফোরণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে শেষে।

.

পুরো বিধ্বস্ত হয়েছে মিসাইল ব্যাটারি, ওদিকে চেয়ে হাঁ হয়ে গেছে উইলিয়াম থ্রাশার। কয়েক সেকেণ্ড পর আস্তে করে মাথা নাড়ল। কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ছাড়া এমনি এমনি এত দূরে আসেনি সে। হাতে এখনও অন্য উপায় আছে।

‘স্যান্টা ক্ল্য!’ হাঁক ছাড়ল সে। সাইক্লোনের কাছ থেকে কেস নিয়ে একটা স্ফেয়ার বের করল, ওটা ধরিয়ে দিল প্রকাণ্ডদেহী তস্করের হাতে। ‘ট্রেন নিয়ে রওনা হও! ব্যবহার করবে মোবাইল মিসাইল লঞ্চার, জ্বেলে দেবে পরিবেশে আগুন! সাইক্লোন! আমার সঙ্গে এসো!’

‘ইয়েস, স্যর!’ গ্যাসওঅর্কের দিকে দৌড় লাগাল স্যান্টা ক্ল্য। বুক থেকে নামিয়ে ফেলেছে কর্ড মেশিনগান। তার সঙ্গে চলেছে ছয় সৈনিক। একে-৪৭ দিয়ে গুলি করছে রানাদের দরজা লক্ষ্য করে। বেরোতে পারবে না কেউ।

গ্যাসওঅর্কে ঢুকবার জন্য রানাদের ওই দরজা ব্যবহার করল না স্যান্টা ক্ল্য। তার দল গুলি করতে করতে পাশ কাটিয়ে গেল, চলেছে গ্যাসওঅর্কের উত্তর কোণে। ওখানে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের আউটার এন্ট্রান্স।

লোকগুলো চলে যাওয়ার পর সামান্য ফাঁক করল রানা দরজা, দেখতে পেল উইলিয়াম থ্রাশারকে।

একটা জিপে লাফিয়ে উঠেছে সিআইএ এজেন্ট। সঙ্গে রয়ে গেছে একটা ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার। সাইক্লোন ও পাওলোও জিপে। ঝড়ের গতি তুলে রওনা হলো গাড়ি। চলেছে রানওয়ের দিকে।

‘যায় কই এরা?’ জানতে চাইল নিশাত।

‘থ্রাশারের অন্য প্ল্যান আছে,’ বলল রানা। ‘ট্রেন থেকে স্ফেয়ার ভরা মিসাইল লঞ্চ করতে একদলকে পাঠাল। তারা যদি সফল হয়, থ্রাশার জিতবে। যদি ব্যর্থ হয়, লোকটার কাছে থাকবে আরেকটা স্ফেয়ার। আর তার যদি আরও একটা বিমান থাকে…’

‘আছে,’ বলল পবন, ‘হ্যাঙারে। ওখানেই লুকিয়ে ছিলাম ফারিয়া আর আমি। আপনি যে বিমানটা নিয়ে সাগরে পড়লেন, ঠিক একই জিনিস ওটা। হোল্ডে বহু কিছু।’

‘তাই?’ চুপ হয়ে গেল রানা। কী যেন ভাবছে। তারপর বলল, ‘ওই ট্রেনের মিসাইল ছাড়া আর নেই ওর কাছে। তার মানেই, ট্রেনের মিসাইল নষ্ট হলে বিমানে উঠে গ্যাসের মেঘে স্ফেয়ার ফেলবে।’

দরজায় দাঁড়িয়ে দ্রুতগতি জিপের দিকে চাইল রানা। অবাক হতে হলো ওকে।

কেবল কার টার্মিনালের সামনে থামল জিপ। ওটা থেকে লাফিয়ে নেমে গেল সাইক্লোন।

রানা ভাবল, আবারও রওনা হবে জিপ। কিন্তু নড়ল না ওটা।

এক দৌড়ে টার্মিনালে ঢুকেছে কর্নেল, একমিনিট পর দেখা গেল তাকে ছাতে।

ওদিকে চেয়ে আছে রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘সর্বনাশ!’

ছাতের নিচু দেয়ালের পাশেই উবু হয়েছে সাইক্লোন, তুলে নিয়েছে কী যেন।

জিনিসটা অত্যাধুনিক, কালো তারের তৈরি স্যাটালাইট ডিশ।

সামান্যতম সময় নষ্ট না করেই আবারও নীচে নেমে এল সাইক্লোন, উঠে পড়ল জিপে। ধুলো-বালি ছড়িয়ে রওনা হয়ে গেল গাড়ি।

সরু হয়ে গেল রানার চোখ, ঝড়ের বেগে ভাবছে। এক এক করে জোড়া দিচ্ছে ছেঁড়া সুতো। একটু পর বলল, ‘বোধহয় বুঝতে পেরেছি থ্রাশার কী করবে।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম আগেই সব বুঝেছেন,’ বলল ডিফেখন।

‘তার দ্বিতীয় প্ল্যান আছে,’ বলল নিশাত। ‘সেটার কথাই বলছেন স্যর।’

‘ওটা তার একটি প্ল্যান,’ বলল রানা। ‘বিশবছর ধরে এই মিশনের জন্য বিমান রেখেছে সিআইএ। ওই একটি স্ট্র্যাটেজির কারণে চিহ্নও থাকবে না রাফিয়ান আর্মির। থাকবে না কোনও সাক্ষী।’

চারপাশে চাইল রানা। এখন একটা গাড়ি দরকার।

একটু দূরেই আছে একটা জিপ।

‘ওই বিমানে করে আকাশে উঠে যাওয়ার আগেই তাকে ঠেকাতে হবে, নইলে দ্বীপও শেষ, আমরাও ইতিহাস,’ বলল রানা।

‘কেন, স্যর?’ জানতে চাইল নিশাত।

‘খুলে বলবেন?’ প্রশ্ন করল ডিফেখন।

‘এখন বলার সময় নেই,’ জরুরি সুরে বলল রানা, ‘আপনারা ট্রেনে গিয়ে উঠুন। যেভাবে হোক ঠেকাবেন মিসাইল লঞ্চ। এদিকে পবন আর আমি যাব থ্রাশারের বিমান ঠেকাতে। পবন…’

ঘুরে চাইল রানা।

কোথাও নেই পবন। একটু আগেই ছিল, এখন একেবারে হাওয়া।

‘এই বিপদের ভিতর কোথায় গেল ছেলেটা?’ বিরক্ত হয়ে বলল নিশাত।’

গ্যাসওঅর্কের দিকে চেয়ে ফারিয়ার কথা মনে পড়ল রানার। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমি বোধহয় জানি কোথায় গেছে। আপাতত ওকে সাহায্য করতে পারব না। থ্রাশারকে ঠেকাতে না পারলে কোটি কোটি মানুষ মরবে। আপা, ডিফেখন, ট্রেনের মিসাইল ঠেকান। আমি দেখছি ওই বিমান।’

আলাদা হয়ে গেল ওরা, গ্যাসওঅর্কের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম লক্ষ্য করে ছুট লাগাল নিশাত ও ডিফেখন।

এদিকে একটু দূরের জিপে চেপে বসল রানা, পাঁচ সেকেণ্ড পেরোবার আগেই ছিটকে রওনা হলো জিপ।

যেভাবে হোক, ঠেকাতে হবে উইলিয়াম থ্রাশারকে।

.

গ্যাসওঅর্কের নীচতলায় ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সাইয পাইপের জটিল জঙ্গলে নিঃশব্দে হাঁটছে পবন হায়দার, চারপাশে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছে ভালভ, একটু দূরে বাষ্প তোলা সব ভ্যাট। প্রতিটি ভ্যাটের পাশের লেবেলে রাশান ভাষায় লেখা সতর্কবাণী। এসবের ভিতর মস্ত এক ভ্যাটে বোল্ড অক্ষরে লেখা: TEB. ওটার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝল পবন।

পচা নেইটরিচের খোঁজে এখানে এসেছে ও।

বুঝে গেছে, আরও অনেক জরুরি কাজে ব্যস্ত অন্যরা, কাজেই সাহায্য চায়নি।

দরজার কাছে একবার ঘুরে চেয়েছিল গ্যাসওঅর্কের দিকে, তখনই নীচতলায় দেখেছে পচা নেইটরিচকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে সে ফারিয়াকে।

মাসুদ রানার পুনর্জন্ম হওয়ার পরে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়েছিল পবন, তখনও দেখেছে নেইটরিচকে।

পবন এখন জানে, পুরস্কার হিসাবে পাওয়া ফারিয়াকে কোথায় নিয়েছে লোকটা।

মিস্টার রানা ও অন্যরা পৃথিবী রক্ষা করুন ভাল কথা, কিন্তু ফারিয়ার কী হবে? ওকে তো ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে ওই ভয়ঙ্কর পিশাচ!

রানা ও অন্যদেরকে কিছুই বলেনি পবন, দৌড়াতে শুরু করেছে গ্যাসওঅর্কের নীচতলা লক্ষ্য করে। মই বেয়ে নেমেছে ওখানে, অবশ্য তার আগে এক লাশের হোলস্টার থেকে নিয়েছে পিস্তল।

গ্যাসওঅর্কের অন্য এক অংশে ছুটছে নিশাত ও ডিফেখন। তারা আছে দ্বিতীয়তলায়। একটু দূরেই উত্তরদিকে রেলওয়ে সাইডিঙে পার্ক করা প্রকাণ্ড রেলগাড়ি। সামনে মস্ত জায়গা ফাঁকা।

ছুটতে ছুটতে নিশাত দেখল, নড়তে শুরু করেছে মস্ত ট্রেন। ওটার উপর দাঁড়িয়ে আছে স্যান্টা ক্ল্য ও কয়েকজন সৈনিক, হাতে একে-৪৭।

ট্রেনে বগি সর্বমোট পাঁচটা। একেকটা দানবসদৃশ। পিছনে এবং সামনে দুই আর্মার্ড লোকোমোটিভ। মাঝের কয়েকটি বগি আসলে কার্গো ক্যারেজ, ওখানে থাকতে পারে জিপ ও অন্যান্য ভারী যান। মাঝখানে এক ফ্ল্যাটবেড কার। ওটার উপর হাইড্রোলিক রাইযারে মোটা মহিলার মত পাশাপাশি শুয়ে আছে মস্ত দুই চুরুট সদৃশ এসএস-৩৩ ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল। আপাতত দিগন্ত দেখছে।

‘রাশানরা অনেক ট্রেন-লঞ্চড্ মিসাইল সিস্টেম তৈরি করেছিল,’ বলল ডিফেখন। নিশাতের পাশে ছুটছে। ‘কিন্তু এসব মিসাইল লঞ্চ করতে হলে আগে থামাতে হবে ট্রেন, নইলে মিসফায়ার হবে।’

‘তার মানে আগে দালান থেকে ট্রেন বেরিয়ে আবারও থামার পর মিসাইল ফায়ার করতে হবে?’ বলল নিশাত।

‘হ্যাঁ।’

ঠোঁট মুচড়ে কী যেন ভাবল নিশাত। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাবো, নিশাত! …স্যর কী করতেন?’

‘কী বলছেন?’

‘কিছুই না। তখনই বুঝল নিশাত। ‘ট্রেনকে থামতেই দিতেন না স্যর। আসুন, ওটার ওপর উঠে সামনের লোকোমোটিভ দখল করব। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন চলতে থাকে ট্রেন।

.

জিপ নিয়ে তুমুল গতিতে ছুটছে রানা, পাশ কাটিয়ে গেল উঁচু মেইন টাওয়ার। চলেছে রানওয়ে লক্ষ্য করে। সঙ্গে রোবট বন্ধু, তবে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে— এ কারণেই তখন হেসেছিল পবন।

বন্ধু আছে রানার পিঠে, ভালভাবে ওকে ঝুলিয়ে নেয়া হয়েছে ফ্লেমথ্রোয়ারের হার্নেসে। সাধারণত জিনিসটার কারাবিনার ক্লিপ ব্যবহার করা হয় কারও পিঠে ট্যাঙ্ক আটকে রাখবার জন্য। নিখুঁতভাবে বন্ধুর ধাতব দেহ ধরে রাখছে।

রানার ডান কাঁধের উপর দিয়ে চোখ রাখছে বন্ধু। ডান থেকে বামে ঘুরছে চোখ। ওদিকে রানার বাম কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিয়েছে ওঁর এম২৪৯ কামান।

জিপের মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরেছে রানা, তুলেছে সর্বোচ্চ গতি। সামনে বড় এক ঢিবি ঘুরে ওদিকে গেল থ্রাশারের জিপ, লক্ষ্য রানওয়ে।

সময় ছিল না বলে নিশাত ও ডিফেখনকে রানা বলতে পারেনি, কেন কেবল কার টার্মিনালে থেমেছিল থ্রাশারের জিপ।

যে স্যাটালাইট ডিশ তুলে নিয়েছিল কর্নেল সাইক্লোন, ওটাই ছিল আপলিঙ্ক। রাশান ও আমেরিকান নিউক্লিয়ার মিসাইল স্ট্রাইক থেকে নিরাপদ রাখছিল পোলার আইল্যাণ্ডকে।

প্রথম যখন কেবল কার ব্যবহার করে দ্বীপে উঠল, আপলিঙ্কের জন্য চারপাশে চোখ বুলিয়েছে রানা। যদি পেত, দরকার পড়লে ডিসেবল করত, বা ধ্বংস করে দিত। কিন্তু জিনিসটা লুকিয়ে রাখা ছিল। অথচ ওটা ছিল খুবই কাছে, টার্মিনালের ছাতে!

কর্নেল সাইক্লোন আপলিঙ্ক সরিয়ে নেয়ার পরিণতি ভয়ঙ্কর!

সবই বুঝতে পারছে রানা।

উইলিয়াম থ্রাশার এবং তার দলের কর্নেল সাইক্লোন ও লেফটেন্যান্টরা সরে যেতে চাইছে দ্বীপ ছেড়ে, পিছনে পড়ে থাকবে তাদের সাধের রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা। এরা ভাবছে একবার আকাশে আগুন জ্বলে উঠলেই জেনারেল ও অফিসাররা ফিরবে।

কিন্তু তা হওয়ার নয়।

নিরাপদ বিমান থেকে নজর রাখবে থ্রাশার, আর তার লোক ট্রেন থেকে মিসাইল লঞ্চ করলেই সফল হবে তার পরিকল্পনা। অথবা, স্ফেয়ার ব্যবহার করে আগুন জ্বেলে দেবে সে গ্যাসের মেঘে। দুটোর যেটাই হোক, খুশি মনে আপলিঙ্কের সুইচ অফ করবে থ্রাশার।

এখনও নিজেদের স্যাটালাইট ব্যবহার করে পোলার আইল্যাণ্ডের উপর চোখ রাখছে রাশান মিসাইল কমাণ্ড, যখন জানবে ডিফেন্সিভ আপলিঙ্ক অফ করে দেয়া হয়েছে, দেরি না করেই কাজে নামবে। মাফ করবার প্রশ্নই ওঠে না, তাদের একটা মিসাইল সাইট উড়িয়ে দিয়েছে থ্রাশার নিউক্লিয়ার মিসাইল ব্যবহার করে। কাজেই সরাসরি পোলার আইল্যাণ্ডে নামবে রাশান মিসাইল।

পরিবেশের আগুনে ইউরোপ, আফ্রিকার একাংশ, এশিয়ার চিন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশ পুরোপুরি ধ্বংস হবে। এদিকে রাশান নিউক্লিয়ার মিসাইলের আঘাতে হাওয়ায় মিশে যাবে নকল আর্মির সৈনিক। চিরকালের জন্য পাল্টে যাবে পৃথিবীর মানব-সভ্যতার ইতিহাস। দোষ পড়বে রহস্যময় এক টেরোরিস্ট গ্রুপের উপর। নিজ দলের কয়েকজনকে নিয়ে উধাও হয়ে যাবে থ্রাশার।

এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে?

কাজেই যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে উইলিয়াম থ্রাশারকে।

রানা যদি কোনওভাবে তাকে দ্বীপে আটকে রাখতে পারে, আপলিঙ্কের সুইচ অফ করবে না সে। নইলে মরতে হবে তাকেও।

রানার জিপে এসে লাগল এক পশলা বুলেট।

ঘুরে চাইল ও, পিছন থেকে তেড়ে আসছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকদের একটা ট্রাক। গুলি আসছে ওখান থেকেই।

‘বন্ধু, ঠেকাও ওদের!

‘ঠিক বলেছেন, রানা! ‘

ড্রাইভিঙে মনোযোগ দিয়েছে রানা, ওদিকে গা মুচড়ে নিজের লেন্স ও কামান ঘুরিয়ে নিয়েছে বন্ধু— গোলা দাগল ‘বুম! বুম!’ আওয়াজ তুলে।

প্রথম গোলা লাগল ট্রাকের গ্রিলে, ফুটো করল রেডিয়েটার— ফণা তোলা সাপের মত ফোঁস আওয়াজ তুলে বনেটের তলা থেকে বেরোল বাষ্পের সাদা মেঘ। পরের গোলা লাগল সামনের বাঁ দিকের চাকায়। টলমল করে উঠল ট্রাক, পরক্ষণে স্কিড করে চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাত হয়ে দড়াম করে পড়ল রাস্তার উপর। ঝরঝর করে ওখান থেকে খসে পড়ল সৈনিকরা।

তিক্ত হাসল রানা। কানে তালা লেগেছে। কিন্তু নতুন একটা চোখও পেয়েছে ও! মাথার পিছনে শক্তিশালী অস্ত্র! খারাপ কী?

সামনে দেখা গেল, খাড়া ঢালু পথে তীর গতিতে নেমে যাচ্ছে থ্রাশারের জিপ। একটু সামনেই রানওয়ে। অনুসরণ করতে চাইল রানা, কিন্তু তখনই রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে গেল রাফিয়ান আর্মির একদল সেন্ট্রি। তাদের তরফ থেকে এল তুমুল গুলিবর্ষণ। আবার একজনের সঙ্গে আছে ফ্লেমথ্রোয়ার, ওটার কমলা লকলকে জিভ জ্বলজ্বল করছে।

‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল রানা। ওর সাধ্য নেই পেরিয়ে যাবে ওই ব্লকেড। অবশ্য সামান্যতম দেরি না করেই বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাল রানা, সামনে দু’দিকে গেছে দু’রাস্তা, ডানদিকের রাস্তা বেছে নিল ও। উত্তরদিকের উঁচু জমি ঘুরে যেতে হবে, কিন্তু ঠিকই পৌছতে পারবে রানওয়েতে।

অবশ্য এর ফলে কতটা বাড়তি সময় লাগবে, জানে না রানা। এ-ও জানে না, সঠিক সময়ে পৌছতে পারবে কি না। প্রাণপণ চেষ্টা করবে, তাতে কোনও ভুল নেই। পিঠে বন্ধুকে নিয়ে জিপের মেঝেতে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল রানা।

আটাশ

ওদের দু’জনকে দেখবার আগেই কথা শুনতে পেল পবন।

‘না-না! ছেড়ে দাও! দোহাই লাগে!’

ফারিয়ার ক্রন্দনরত কণ্ঠ।

চড়াৎ করে জোরালো আওয়াজ হলো।

চড় দেয়া হয়েছে গালে।

‘চুপ্ শালী!’. পচা নেইটরিচের কণ্ঠ ঘুরতে লাগল পাইপের জঙ্গল, ট্যাঙ্ক ও ভ্যাটগুলোর ভিতর। ‘কোনও শালা নেই তোকে সরিয়ে নেবে আমার কাছ থেকে! ওই শালা পবনের কথা ভুলে যা! আমার দিকে দ্যাখ, এই আমিই ঠাণ্ডা করব তোকে! পাগল হবি সুখে! তুই জানিস কত মেয়ে…’

একটা বাঁক ঘুরেই সামনের দৃশ্য দেখল পবন।

মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে ফারিয়া, বুকের উপর চেপে বসেছে পচা নেইটরিচ। একহাতে খুলছে প্যান্টের বোতাম।

‘কত মেয়ের সর্বনাশ করেছিস!’ সামনে বেড়ে দড়াম করে একটা লাথি বসিয়ে দিল পবন নেইটরিচের পাঁজরে।

ছিটকে পড়েছে বদমাশটা। তবে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ঝটকা দিয়ে উঠে বসেছে ফারিয়া, চোখে টলটলে অশ্রু। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘পবন!’ আশা ও ভয় খেলা করছে ওর দুই চোখে।

ভয়ঙ্কর রাগে চোখ পাকিয়ে ফেলেছে পচা নেইটরিচ।

‘শালা পবনের বাচ্চা!’ বেরিয়ে এল নোংরা হলদে দাঁত। কে জানত তুই আসবি, শালা! নিয়ে যেতে চাস আমার মাল? তুই শালা জানিস আমি দুনিয়ার সেরা রেপিস্ট!’

পিস্তল তুলল পবন।

‘আমার কাছে কিন্তু অস্ত্র নেই, পবন শালা,’ বলল নেইটরিচ ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন করবি?’

‘হ্যাঁ, তাই করব।’

‘মিস করবি না তো?’

চোয়াল শক্ত করে ট্রিগার টিপে দিল পবন। দু’বার।

দু’বারই পচা নেইটরিচের মাথার উপর দিয়ে গেল বুলেট। মোটা একটা পাইপে লেগে আরেক দিকে গেছে।

আবারও কয়েকবার ট্রিগার টিপল পবন।

ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!

ভয়ঙ্কর শয়তানি হাসি ফুটে উঠল নেইটরিচের মুখে, ফ্যাসফেঁসে স্বরে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা, এবার লাথিয়ে তোকে হাগিয়ে ছাড়ব! তোকে বেঁধে রেখে তোর ডার্লিংকে আদর করতে করতে মেরেই ফেলব!’

একলাফে ফারিয়ার পাশে পৌছে গেল নেইটরিচ, হ্যাঁচকা টানে ওকে তুলেই ঠেলে দিল লোহার খাঁচার মত এক স্টোরেজ রুমে। দড়াম করে দরজা বন্ধ করেই আটকে দিল বোল্ট।

পাগলের মত খাঁচার দরজা ঝাঁকাল ফারিয়া। কোনও লাভ হলো না। বন্দি হয়েছে ও। চোখের সামনে দেখবে দুই পুরুষের প্রাণপণ লড়াই। বারবার আশা ও নিরাশায় দুলছে ওর মন। এক পক্ষে রাফিয়ান আর্মির খুনি পচা নেইটরিচ, অন্য পক্ষে নিরীহ পবন।

দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পবনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জার্মান রেপিস্ট।

মাথা নিচু করে প্রথম দুই ঘুষি এড়িয়ে গেল পবন, টলমল করছে পা, তারই ফাঁকে থাবা বসাতে চাইল শত্রুর নাকে।

রানার কাছে শুনেছে ওই আঘাতের নাম কিলার পাঞ্চ— ঠিকভাবে নাকের হাড় ভাঙলে মগজে গেঁথে যায়, ফলাফল লোকটার নিশ্চিত মৃত্যু।

থমকে গেল পবন।

ও কি সত্যি পেরেছে…

হাসতে শুরু করেছে পচা নেইটরিচ।

‘ব্যস? এ-ই তোর ক্ষেমতা? …এবার দ্যাখ্!’

গোখরা সাপের মতই ক্ষিপ্র সে, পর পর দুই ঘুষি বসিয়ে দিল পবনের মুখে। সামলে নিতে পারল না কুয়াশার সহকারী, ধুপ্ করে পড়ল মেঝেতে। ঠোঁট ও থুতনি ভেসে গেল …ক্তর স্রোতে।

কলার ধরে ওকে টেনে তুলল নেইটরিচ, নিজের কপাল দিয়ে ভয়ঙ্কর এক গুঁতো দিল শত্রুর কপালে। কলার ছেড়ে দিতেই পা পিছলে মেঝেতে সটান হলো পবন।

‘পবন!’ আর্তচিৎকার করল ফারিয়া।

পবনের উপর ঝুঁকে এল নেইটরিচ, মুখ না ফিরিয়েই ফারিয়াকে বলল, ‘চিৎকার কর্, ডার্লিং! আরও চিৎকার কর্ মেয়েলোকের চিৎকার শুনলে আমার দারুণ লাগে!’

হ্যাঁচকা টানে পবনকে তুলল সে, একহাতে প্রচণ্ড জোরে ঠেসে ধরল পুরু এক পাইপের গায়ে। আরেকটু হলে পবনের মাথা ঠুকে যেত পাইপ থেকে বেরিয়ে আসা এক ভালভে।

ব্যথায় নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে পবনের। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। ভীষণ অসুস্থ লাগছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাবে। আর সেক্ষেত্রে ওরা দু’জনই শেষ। না, যেভাবে হোক বাঁচাতে হবে ফারিয়াকে!

অস্পষ্ট চোখে মাথার পাশে ভালভ দেখল পবন।

ওখানে কী যেন লেখা।

ঝাপসা লাগছে অক্ষরগুলো: T… E…

হঠাৎ করেই পবনের মুখের সামনে মুখ নিয়ে এল নেইটরিচ।

‘কুকুরের বাচ্চা, তুই উড়িয়ে দিয়েছিস আমার একটা কান! ঘড়ঘড় আওয়াজে বলল, ‘এবার তোর দুই কান কেটে নেব আমি, চিবিয়ে খাবো! তারপর তোকে বেঁধে রেখে তোর সামনে ওই সুন্দরীকে…’ খ্যাক-খ্যাক করে হাসল সে। কোমরের খাপ থেকে বের করে ফেলেছে হাণ্টিং নাইফ, ওটা পবনের চোখের সামনে তুলে দেখাল।

লোকটা একহাতে গলা টিপে ধরেছে বলে শ্বাস আটকে গেছে পবনের। কাশি আসছে বেদম।

‘কিছু বলার আছে, শালা, তোর?’ জানতে চাইল নেইটরিচ।

ফিসফিস করে কী যেন বলল পবন।

‘ঠিক করে বল, শালা!’

‘আমি…. বল …..ছি…’ শরীরের শেষ শক্তি কাজে লাগাল পবন, টি করে হাত তুলেই নীচে টেনে দিল পাশের গ্যাস ভালভের লিভার। ওই ভালভের লেবেলে লেখা: TEB.

ভালভ খুলে যেতেই হাই-প্রেশার সবুজ তরল স্প্রে হয়ে ছিটকে ড়ল পচা নেইটরিচের দু’চোখে।

বিকট এক আর্তনাদ ছাড়ল জার্মান রেপিস্ট, অতি উত্তপ্ত তরল মিছে মুখ বেয়ে। পড়ে গেল ছোরা, চেপে ধরল দু’হাতে দু’চোখ। কপাল, গাল, নাক ও মুখের ত্বক গলে পড়ছে!

বেসুরো আর্তনাদ থেমে গিয়ে শুরু হলো করুণ বিলাপ।

আকাশে আগুন জ্বেলে দেয়ার বিস্ফোরক ফিউয়েল মিক্সচার খেয়ে ফেলছে তার গোটা মুখের ত্বক ও মাংস!

খামচে ধরল গাল। তালুর ঘষায় খসে এল ত্বক ও মাংস, বেরিয়ে গেল রক্তমাখা হাড়। নেইটরিচের দু’হাত সরে যেতেই পবন দেখল গলছে লোকটার দু’চোখ। আবারও দু’হাতে চোখ খামচে ধরতেই পিং-পং বলের মত বেরিয়ে এল, শিরার উপর ভর করে ঝুলতে লাগল নাকের দু’পাশে।

ভয়ঙ্কর কষ্টে জন্তুর মত চিৎকার করছে নেইটরিচ। অন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু ধরতে চাইল রক্তাক্ত দু’হাতে। কিন্তু পা তুলে তার বুকে জোরালো লাথি মারল পবন।

মেঝেতে পড়ে গেল পচা, বিকট গলায় কাঁদতে শুরু করেছে। অবশ্য একমিনিট পেরোবার আগেই তার মগজ খেয়ে ফেলল টিইবি তরল। স্থির হয়ে গেল, মহাবদমাশ লোকটা।

ছুটে খাঁচার সামনে গেল পবন, বোল্ট টেনে খুলে দিল দরজা।

পরক্ষণে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফারিয়া, কাঁদছে হু-হু করে।

ওকে আলতো করে ধরে রইল পবন। আজ এতকিছুর পরেও নাকে এল ফারিয়ার চুলের মিষ্টি সুবাস।

.

রেল সাইডিং ধরে রওনা হয়েছে কালো, প্রকাণ্ড ট্রেন, পাশেই ছুটছে নিশাত ও ডিফেখন, লাফিয়ে উঠে পড়ল শেষ ক্যারেজে। ওটা উল্টোদিকে তাক করা আরেকটা আর্মার্ড লোকোমোটিভ।

দুলতে দুলতে ধীরে চলেছে ট্রেন, সোভিয়েত আমলের মত এক দানব। সবদিক থেকে সাধারণ রেলগাড়ির চেয়ে দ্বিগুণ বড় উচ্চতায় দোতলা, চওড়ায় স্বাভাবিক ট্রেনের ডবল।

রেললাইনও তেমন পোক্ত, দুটো নয় লাইন, পাশাপাশি দুটে দুটো করে চারটি পাত।

গতির জন্য তৈরি নয় এসব। ভারী মালামাল বইবার জন্য।

প্রকাণ্ড রেলগাড়ি পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পুবের ডক থেকে এনেছে স্থাপনার সমস্ত মালামাল। পরবর্তীতে ওই ডক বদলে নেয়া হয়েছে সাবমেরিন ডক হিসাবে। দ্বীপের মাঝে গ্যাসওঅর্ক থেকে মন্থরভাবে রওনা হয়েছে দানব ট্রেন, এই মুহূর্তে গতি বড়জোর ঘণ্টায় আড়াই মাইল।

হয়তো বহু বছর পর খোলা জায়গায় এসেছে স্টেশন ছেড়ে। একটু পর থামবে, কারণ ফায়ারিং পযিশন না নিলে লঞ্চ করতে পারবে না পিঠের মিসাইল।

‘সামনের লোকোমোটিভে উঠতে হবে,’ বলল নিশাত। ‘চলার ওপর না থাকলে সব শেষ হয়ে যাবে।’

আস্তে করে মাথা দোলাল ক্যাপ্টেন ডিফেখন।

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াবে চিলিয়ান লেফটেন্যান্ট স্যান্টা ক্ল্য এবং ছয় সৈনিক। তাদের দু’জন আছে সামনের লোকোমোটিভের কন্ট্রোলে। অন্য চারজন স্যান্টা ক্লযের সঙ্গে, আত্মরক্ষামূলক পযিশন নিয়েছে মাঝের মিসাইল ক্যারেজে।

এখন একটা মিসাইলের উপর ঝুঁকে আছে লেফটেন্যান্ট, ওয়ারহেডে বসিয়ে দিচ্ছে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।

হামলার নানাদিক নিয়ে ভাবছে নিশাত।

সামনের লোকোমোটিভে উঠতে হলে পেরোতে হবে মাঝের মিসাইলের ফ্ল্যাট কার।

‘ঠিক আছে,’ ডিফেখনকে বলল নিশাত, ‘আপনি এখান থেকে শিলাবৃষ্টির মত গুলি করুন, আর সেই সুযোগে সামনের ইঞ্জিনে উঠব আমি। পরে চলে আসবেন।’

‘মাফ করুন, নিশাত, ওদেরকে পাশ কাটাবেন কী করে?’ জানতে চাইল ডিফেখন।

‘আমি মোটেও পাশ কাটাব না,’ বলল নিশাত। ‘তলা দিয়ে যাব। এবার গুলি শুরু করুন।’

‘নিশ্চয়ই।’

দেরি না করেই একে-৪৭ দিয়ে স্যান্টা ক্ল্য ও তার লোকদের লক্ষ্য করে বুলেট বর্ষণ শুরু করল ডিফেখন। ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে গেল নিশাত, ঢুকে পড়ল লোকোমোটিভের নীচে। দৌড় শুরু করেছে কুঁজো হয়ে।

উপরে ডিফেখনকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করছে স্যান্টা ক্ল্য, হাতে বুনোরই কর্ড মেশিনগান। জোরালো ঢং-ঢং শব্দে পিছনের লোকোমোটিভের আর্মারে লাগছে ভারী বুলেট। বাধ্য হয়ে আড়াল নিতে হলো দুঃসাহসী ডিফেখনকে।

‘শালা!’ ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, কাউকে বলছে না। ‘আমারই এত সুন্দর অস্ত্র দিয়ে আমারই দিকে গুলি করছে!’

অনেক দুর্বল একে-৪৭ ব্যবহার করে জবাব দিতে চাইল ডিফেখন।

তাতে কাজ হলো, ওর দিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিল স্যান্টা ক্ল্য ও তার চার সহকারী। জানল না গুড়গুড় আওয়াজ তোলা মস্ত ট্রেনের তলা দিয়ে ছুটে চলেছে নিশাত সুলতানা।

আপাতত পাঁচ মাইল গতি তুলছে উঁচু ট্রেন। ওটার তলা দিয়ে অনায়াসেই ছুটছে বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন। সতর্ক থাকল প্রথম কার্গো কার পেরোবার সময়, বুকে ভয়, এই বুঝি ওকে দেখে ফেলল লেফটেন্যান্ট বা তার লোক।

পেরিয়ে গেল মিসাইল ফ্ল্যাটকার। ওটার পর শুরু হলো দ্বিতীয় কার্গো কার। ক্ষণিকের জন্য আড়াল থেকে বেরোতে হলো নিশাতকে। দিনের আলো পড়ল ওর উপর। রেলওয়ে সাইডিঙের অর্ধেক জায়গা পেরিয়ে এসেছে ট্রেন! একবার মিসাইল ক্যারেজ পুরো বেরিয়ে এলে প্রস্তুত হবে উৎক্ষেপের জন্য।

এক ছুটে দ্বিতীয় কার্গো ক্যারেজের অর্ধেক পথ পাড়ি দিল নিশাত, সামনের লোকোমোটিভের দিকে চেয়ে চমকে গেল। সর্বনাশ! ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে আনছে ট্রেন!

থামতে শুরু করেছে!

পৌছে গেছে ফায়ারিং পযিশনে?

‘ঝেড়ে দৌড় দে রে, নিশাত!’ মনে মনে বলল ও। কার্গো কারের তলা থেকে বেরিয়েই প্রাণপণে ছুটল। পিছনে শুনল গুলি করছে ডিফেখন। এখনও কেড়ে রাখছে স্যান্টা ক্লযের লোকদের মনোযোগ।

পরের কয়েক সেকেণ্ডে সামনের লোকোমোটিভের পাশে পৌঁছে গেল নিশাত, লাফিয়ে উঠল পাশের রানিং বোর্ডে। তখনই চাকাগুলোর ক্যাচ-ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে থেমে গেল রেলগাড়ি। পুরো স্থির। একই সময়ে ক্যাবে ঢুকে পড়ল নিশাত উদ্যত অস্ত্র হাতে।

কে এসেছে দেখতে ঘুরে চাইল প্রকাণ্ড রেলগাড়ির দুই চালক। দু’চোখ কপালে উঠল তাদের। পরক্ষণে হাত বাড়াল অস্ত্রের দিকে।

বুম! বুম!

দুই সৈনিকের মাথার পিছন দিক ছেতরে দিয়ে উইণ্ডশিল্ডে লাগল নক্ষত্র আকৃতির রক্তের ছিটা। মেঝেতে পড়ল দুই লাশ।

ব্যস্ত হয়ে কন্ট্রোলের কাছে গেল নিশাত, আবারও সামনে ঠেলে দিল থ্রটল। একটা হোঁচট খেয়ে নতুন করে রওনা হলো ট্রেন। অলস ভঙ্গিতে গতি তুলছে।

মিসাইল কারে ঝাঁকি খেয়ে অবাক হলো স্যান্টা ক্ল্য, ঝট্ করে ঘুরে চাইল।

চার সৈনিকের উদ্দেশে বলল, ‘শালারা ইঞ্জিন দখল করে নিয়েছে!’ চারজনের দু’জনকে নির্দেশ দিল, ‘এখানে থাকবে। মিসাইলের যেন কিছু না হয়। আটকে রাখবে ওই ভালুকের মত শয়তানটাকে।’ অন্য দু’জনের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা আমার সঙ্গে এসো! থামাতে হবে ট্রেন!’

দু’পাশে দু’জনকে নিয়ে রওনা হলো সে, হাতে কর্ড মেশিনগান। আবার দখল করে নেবে লোকোমোটিভ।

.

‘ধুর!’ তিন’ ইবলিশকে দেখতে পেয়েছে নিশাত। চট্ করে উইণ্ডশিল্ড দিয়ে সামনেটা দেখে নিল।

আন্দাজ এক কিলোমিটার দূরে সাবমেরিন ডকের এন্ট্রান্স। তার আগে ফাঁকা জমি, কোথাও আড়াল নেই। তারপর সাগরের কাছে গিয়ে জমির বুকে ডেবে গেছে রেললাইন, দু’পাশে শুরু হয়েছে ক্লিফ। জায়গাটা প্রায় টানেলের মতই। দানবীয় ট্রেন থামিয়ে মিসাইল লঞ্চ করবার জন্য যথেষ্ট সময় ও জায়গার অভাব নেই।

যদি থামতে হয়, সব শেষ— ভাবল নিশাত। কিন্তু ঠেকাব কী করে এদেরকে? তখনই বুদ্ধি এল।

ওর মাথার উপরে ছাতে লেগে ঢং আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল কর্ড মেশিনগানের গুলি। মোটেও পাত্তা না দিয়েই পুরো সামনে থ্রটল ঠেলে দিল নিশাত। যতটা মন্থরগতি মনে করেছিল, দানব ট্রেন তা নয়, চমকে দিয়ে দ্রুত বাড়তে লাগল বেগ।

এবার লিভার রেখে একে-৪৭ তুলে নিল নিশাত, নতুন উদ্যমে যোগ দিল যুদ্ধে।

একা লড়তে হবে সামনের এই লোকোমোটিভে, বিপক্ষে তিন সশস্ত্র যোদ্ধা। অন্তরের ভিতর বুঝে গেল নিশাত, আসলে জিতবে না এই লড়াইয়ে। বড়জোর বেশ কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারবে শত্রুপক্ষকে।

তারপর?

বাধ্য হয়েই মানতে হবে রূঢ় বাস্তবতা— মৃত্যু!

.

উত্তর-পুবের বরফ-ঢাকা ফাঁকা জমির ভিতর দিয়ে গুড়-গুড় আওয়াজ তুলে চলেছে, গতি বাড়ছে রেলগাড়ির।

দুই সৈনিককে নিয়ে দ্বিতীয় ক্যারেজের ছাতে উঠে এগোতে শুরু করেছে স্যান্টা ক্ল্য, গুলি করছে সামনের লোকোমোটিভ লক্ষ্য করে। ওদিক থেকে ঝলসে উঠছে একাকী রাইফেল। ড্রাইভার কমপার্টমেন্টের পিছনের খোলা জানালা দিয়ে গুলি করা হচ্ছে।

এদিকে রেলগাড়ির পিছনে থেমে গেছে গোলাগুলি।

দ্বিতীয় বগির ছাতে নিখুঁত ফর্মেশনে লিপফ্রগ করে সামনে বাড়ছে স্যান্টা ক্ল্য ও তার দু’সৈনিক। কাঁচা লোক নয় তারা, ভাল করেই জানে ভাল অবস্থানে আছে। নিশাত একা, তার ফায়ার পাওয়ারও অনেক কম। কিছুক্ষণের ভিতর লোকোমোটিভের কাছে পৌছে গেল তারা। খুব কাছ থেকে গুলি করছে।

হঠাৎ দেখা গেল ভীষণ ঝাঁকি খেয়েছে মহিলা শত্ৰু।

গুলি লেগেছে ডান কাঁধে। ছিটকে পিছিয়ে গেছে।

সামনেই ড্রাইভারের কমপার্টমেণ্ট। নতুন উদ্যমে সামনে বাড়ল স্যান্ট ক্ল্য এবং তার সঙ্গীরা, কয়েক সেকেণ্ডে ঢুকে পড়ল ক্যাবে।

অস্ত্র তাক করা হলো নিশাতের বুকে।

কন্ট্রোল লিভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল স্যান্টা ক্ল্য, কিন্তু তখনই চোখের কোণে দেখল, কে যেন ধপ্ করে পড়েছে লোকোমোটিভের সামনের বনেটে!

মুখ তুলে চাইল স্যান্টা ক্ল্য। চমকে যেতে হলো তাকে। দাড়িভরা প্রকাণ্ডদেহী এক লোক শুয়ে আছে লোকোমোটিভের বনেটে, অস্ত্র তাক করেছে স্যান্টা ক্লযের মুখ লক্ষ্য করে!

কাঁচের ওপাশ থেকে দু’বার গুলি করল ডিফেখন।

ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচ, একটা বুলেট ঢুকল স্যান্টা ক্লযের বাম চোখে, করোটির পিছন দিক ফাটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, ওখানেই ধুপ্ করে পড়ল লোকটার লাশ। পাশেই কর্ড মেশিনগান। –

ডিফেখনের আরও দুই গুলি শুইয়ে দিল অন্য দুই বদমাশকে।

ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে ক্যাবে নামল সে। বসে পড়ল নিশাতের পাশে।

‘চমৎকার আগমন,’ ব্যথা চেপে বলল নিশাত, একহাতে ধরেছে কাঁধের ক্ষত।

‘আমি ফ্রেঞ্চ,’ বলল ডিফেখন। আমরা মায়ের পেট থেকে বেরোই স্টাইল নিয়ে।’

মৃদু না হেসে পারল না নিশাত। ‘তুমি একটা পচা লোক, এটা জানো? কথা না ছিল ট্রেনের পিছনে থাকবে?’

‘থাকতে পারলাম না, আফসোস করে মাথা নাড়ল ডিফেখন। ‘ওরা আরও লোক পাঠিয়ে দিয়েছে।’

উঠে দাঁড়িয়ে পিছনের জানালা দিয়ে চাইল নিশাত।

দানব ট্রেনে উঠছে রাফিয়ান আর্মির দু’ডজন সৈনিক!

ট্রেনের দু’পাশে চলছে দুই ট্রুপ ট্রাক।

কাজেই না এসে পারলাম না,’ নিশাতের পাশে দাঁড়াল ডিফেখন। ‘তোমার মত করেই ট্রেনের তলা দিয়ে এসেছি।’

ওদের মাথার উপরে ছাতে লেগে ছিটকে গেল একটা বুলেট। পরক্ষণে এল কমপক্ষে এক শ’টা গুলি।

ঝুপ্ করে বসে মাথা নিচু করে নিল ওরা। বামহাতে রাইফেল তুলল নিশাত। মেঝে থেকে প্রিয় কর্ড মেশিনগান নিল ডিফেখন। তাড়া দিল, ‘এসো! বনেটে উঠতে হবে! ওটাই আমাদের শেষ আত্মরক্ষা ব্যূহ! সেরা জায়গা!’

‘তা হলে সব শেষ হয়ে এল, না?’ আনমনে বলল নিশাত। ডিফেখনের পাশে নেমে পড়ল বনেটে।

গুড়-গুড় আওয়াজ তুলে ছুটছে রেলগাড়ি। ওটার পিছনের দিকে চেয়ে আছে ওরা। এগোতে শুরু করেছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

কিছুক্ষণের ভিতর দু’পক্ষের গোলাগুলি হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর।

পিলপিল করে একদল পিঁপড়ের মত রেলগাড়ির নানাদিক দিয়ে উঠছে রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা। আর সামনের লোকোমোটিভের বনেট থেকে তাদের বাধা দিতে চাইছে নিশাত ও বুনো। ডানে ও বামের লোকগুলোকে গুলি করে ফেলে দিচ্ছে ওরা। তবুও থামছে না সৈনিকরা, সামান্যতম ভয় নেই প্রাণে, অভাব নেই গুলিরও।

পাল্টা গুলি করছে নিশাত ও ডিফেখন।

স্‌স্‌স্ শব্দে নিশাতের কানের লতি আঁচড়ে দিয়ে গেল একটা বুলেট। ছিঁড়ে দিল ইয়ারপিসের ফিলামেন্ট মাইক্রোফোন।

কান স্পর্শ করে চোখের সামনে তর্জনী নিল নিশাত, রক্ত বেরিয়ে এসেছে। মাত্র এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হলে…

হঠাৎ গোলাগুলির মাঝে বলল ডিফেখন, ‘নিশাত! তুমি সত্যিই দারুণ যোদ্ধা! তারও বড় কথা, মানুষটাও খুবই ভাল! …. এখন একটা কথা বলতে চাই, কখনও কাউকে ভালবেসেছ বা তুমি কি বিবাহিত? যদি ভালবেসে না থাকো, বা অবিবাহিত হও, আর এই লড়াইয়ের শেষে বেঁচেই যাই, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

প্রথমবারের মত অন্য চোখে ভালুকের মত মানুষটাকে দেখল নিশাত, অবাক হয়েছে। কিছুই বলল না। গুলি করছে শত্রু উদ্দেশে। মনে কীসের যেন অভিমান। সেই ছোটবেলা থেকে চারপাশের সবাই অবহেলা করেছে, কই, কেউ তো কখনও ওকে পছন্দ করেনি, ভালবাসেনি— এখন এই ফ্রেঞ্চ মানুষটা নিজের ভাল লাগার কথা জানাল, কিন্তু এখন যে আর সময় নেই। একটু পর ওরা এই পৃথিবীতে থাকবেই না!

‘নিজের সম্মান রক্ষা করে চলতে জানি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ডিফেখন। চুপ থাকলে বুঝব আপত্তি আছে তোমার। সেক্ষেত্রে কিছুই বলার নেই। আর কখনও এ বিষয়ে কথা উঠবে না।

‘না, আমি কাউকে ভালবাসিনি বা বিয়েও করিনি,’ চাপা স্বরে বলল নিশাত। কেন যেন কাঁপছে বুক, ভিজে গেল চোখের কোণ।

‘আমি বোধহয় ভাগ্যবান!’ কর্ড দিয়ে একপশলা গুলি ছুঁড়ল ডিফেখন। ‘মস্ত মনের এক মেয়েকে জীবনে পেলেও পেতে পারি!’

সামনের লোকোমোটিভের ছাতে উঠে এসেছে রাফিয়ান আর্মির কমপক্ষে দশজন সৈনিক। এবার অনায়াসেই দখল করে নেবে এই রেলগাড়ি।

সবই বুঝল নিশাত ও ডিফেখন। ফুরিয়ে আসছে ওদের সময়। দোরগোড়ায় উঁকি দিচ্ছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

হঠাৎ করেই সামনে বাড়ল ডিফেখন, চট্ করে নিশাতের কপালে আলতো চুমু দিয়েই বলল, ‘ভুলে যেয়ো না, বোকা আর রাগী একটা লোক মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতর ভালবেসে ফেলেছিল- তোমাকে!’

নিশাতের জবাবের জন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করল না ডিফেখন, মস্ত এক লাফে উঠে পড়ল লোকোমোটিভের উঁচু ছাতে। সম্পূর্ণ খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসেছে। ছড়িয়ে দিল দুই দৃঢ় পা। দু’হাতে তুলে ধরেছে প্রচণ্ড শক্তিশালী অস্ত্র— কর্ড।

ট্রিগার টিপে ধরল ডিফেখন।

জ্যান্ত হয়ে উঠল বিশাল মেশিনগান। মাযল থেকে ছিটকে বেরোল লকলকে কমলা আগুন। দা-র আঘাতে কাটা কচু গাছের মত ছিটকে যেতে লাগল সামনের রাফিয়ান আর্মির সৈনিকরা।

ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তারা। রেলগাড়ির উপর থেকে ছিটকে পড়ছে লাশ। কিন্তু সংখ্যায় অনেক বেশি শত্রু। তাদের কারও কারও গুলি লক্ষ্যভেদ করল। প্রথম বুলেট লাগল ডিফেখনের বাম বাহুতে, পরেরটা উরুতে, শেষে কাঁধে।

তিনটা গুলি খেয়েও লড়াই চালিয়ে গেল ডিফেখন।

অসহায় চোখে ওর দিকে চাইল নিশাত, কাঁদছে ওর অন্তর।

সমান জমিনে ছুটে চলেছে দানবীয় ট্রেন, গতি অনেক।

চতুর্থ বুলেট ফেলে দিল ডিফেখনকে।

দু’হাঁটুর উপর ভর করে বসে পড়েছে, তবুও কয়েকটা গুলি করল কর্ড দিয়ে।

তারপর পঞ্চম গুলি বিধল সোজা ডিফেখনের বুকে। ধড়াস্ করে ছাতে উপুড় হয়ে পড়ল ও।

বনেটে রয়ে গেছে নিশাত, আহত। কিছুই করতে পারল না। একবার নিজের উপর প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘না!’

তখনই চারপাশ থেকে আঁধার নামল রেলগাড়ির উপর।

ওরা ঢুকে পড়েছে সাবমেরিন ডকের টানেলে।

প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিয়েখে স্টিফেখন, দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন বুনোকে যে কাজে পাঠানো হয়েছিল, তা নিজ জীবন দিয়ে পালন করে গেছে সে। তার তুমুল লড়াইয়ের কারণে ওরা পৌঁছে গেছে ডকে। এখন আর কেউ রুখতে পারবে না এই রেলগাড়ি।

গর্জন ছাড়তে ছাড়তে খাটো টানেল পেরিয়ে গেল মেগাট্রেন। সামনের লাইন ঢালু। গতি আরও বাড়ছে। ট্রেনে রয়ে গেছে কমপক্ষে বারোজন দস্যু সৈনিক।

বদ্ধ জায়গায় বিকট হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে সাবমেরিন ডকে পৌঁছে গেল দানব রেলগাড়ি— গতি এতই বেশি— এখন আর উপায় নেই নিয়ন্ত্রণ করবার! লাইনের শেষে পলকা ম্যাচকাঠির মত উড়িয়ে দিল কাঠের পোক্ত গার্ডরেল, নানাদিকে কাঠের টুকরো ছিটকে তুমুল বেগে বিপুল পানি ছলকে নেমে গেল সাগরে! সামনের লোকোমোটিভের পিছু নিল একের পর এক ক্যারেজ, ওই রেলগাড়ি যেন মস্ত কোনও খেপা সাপ। মুহূর্তে তলিয়ে গেল মিসাইল ফ্ল্যাটবেড কার। কারও সাধ্য নেই উৎক্ষেপ করবে ওটার পিঠের ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী দুই মিসাইল।

মুহূর্তে ফুরিয়ে এল রেললাইন আর লোকোমোটিভের বনেট থেকে নিশাত দেখেছে, পানিতে অর্ধ নিমজ্জিত মস্কোভা ফ্রেইটারের উপর সারাদিনের সেরা অদ্ভুত দৃশ্য। দলের জন্য নায়কোচিতভাবে জীবন দিয়েছে বুনো, ভাবল নিশাত। টের পেল, ওর নীচ থেকে আরও নীচে লাফিয়ে পড়ছে লোকোমোটিভ।

মাত্র দশ সেকেণ্ডে সাগরে পড়ল ট্রেন।

রাফিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে ওর লড়াই সমাপ্ত করেছে নিশাত, এখন মৃত্যুও যদি আসে, নিশ্চিন্তে মরবে— ওকে হারাতে পারেনি ওই পিশাচগুলো।

রেলগাড়ি তুমুল বেগে সাগরে নেমেই তলিয়ে গেছে। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে ওটাকে ঘুটঘুটে আঁধার।

ঊনত্রিশ

বিশালকায় রেলগাড়িতে চড়ে সলিল সমাধির দিকে ছুটছে বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা ও ফ্রেঞ্চ আর্মির ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন, ওই একই সময়ে পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পশ্চিম সমতলে রানওয়ে লক্ষ্য করে ঝড়ের গতি তুলে জিপ ছুটিয়ে চলেছে মাসুদ রানা। ওর পিছু নিয়েছে দুই আর্মি ট্রাক এবং একটি সাইডকারসহ মোটরসাইকেল। রানার পিঠে হার্নেস থেকে শত্রুর দিকে গুলি করছে বন্ধু। ওই একই কাজ করছে রানা নিজেও, গুলি পাঠাচ্ছে শ্টায়ার টিমপি ব্যবহার করে।

বারবার নিচু করে নিতে হচ্ছে মাথা। এইমাত্র উঠে এল একটা টিলার উপর, সামনেই দেখা গেল রানওয়ে। ওখানেই দেখা গেল উইলিয়াম থ্রাশারের দ্বিতীয় বিমান— অ্যান্টোনভ এন-১২। আগের বিমানটার মতই বেরিয়ে এসেছে হ্যাঙার থেকে, ঘুরে রওনা হয়ে গেছে ট্যাক্সিওয়ে ধরে। নেমেছে মূল রানওয়েতে, টেক-অফ স্পিড পাওয়ার জন্য গতি তুলছে।

কোনাকুনি ভাবে বিমানের দিকে চলল রানা। যে-কোর্স বেছে নিয়েছে, বিমান ও জিপ মিলিত হবে রানওয়ের শেষ মাথায়।

ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ প্ল্যান করেছে রানা। বিমানের সামনে যাবে জিপ নিয়ে, ভেঙে দেবে ল্যাণ্ডিং গিয়ার। টেক-অফ করতেই দেবে না বিমান। এ ছাড়া কোনও উপায়ও নেই ওর। একবার যদি হাত ফস্কে বেরিয়ে যায় উইলিয়াম থ্রাশার, গোটা পৃথিবী…

হঠাৎ করেই ঝনঝন করে জিপের উইণ্ডশিল্ড ভেঙে পড়ল। ঝট্ করে ঘুরে চাইল রানা।

ওটা সেই শত্রু মোটরসাইকেল। পাশেই সাইডকারে অস্ত্র হাতে যাত্রী। লোক দু’জন চলে এসেছে পাশে।

টিএমপি তুলে নিল রানা, কিন্তু ট্রিগার টিপেই টের পেল ফুরিয়ে গেছে গুলি। অবশ্য কপাল ভাল, ওই একই সময়ে কাত হলো দুই গুলিতে খতম করে দিল দুই যাত্রীকে। নিয়ন্ত্রণ নেই, কয়েক ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়ল মোটরসাইকেল।

নতুন করে টিএমপিতে বুলেট ভরে নিল রানা, মেঝের সঙ্গে টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার। রানওয়ের পাশ দিয়ে ছুটছে জিপ। গতি এক শ’ কিলোমিটারের বেশি। একটু পিছনেই অ্যান্টোনভ।

কিন্তু তখনই সামনের দিকে ঝটকা দিল বিমান। এবার পৌঁছে যাবে টেক-অফ স্পিডে। গতি বাড়ছে অকল্পনীয়ভাবে…

বড় একটা লাফ দিয়ে রানওয়েতে উঠল রানার জিপ। সর্বোচ্চ গতি তুলছে ইঞ্জিন।

গর্জন ছাড়তে ছাড়তে টারমাকের শেষের দিকে ছুটছে বিমান, আরও বাড়ছে গতি। কয়েক সেকেণ্ড পর জিপকে ছাড়িয়ে যাবে, আর তারপরই ভেসে উঠবে আকাশে। সঠিক সময়ে আগুন জ্বলে উঠবে গোটা আকাশে, আর পোলার আইল্যাণ্ডে যারা রয়ে যাবে, তাদেরকে শেষ করে দেবে রাশান নিউক্লিয়ার মিসাইল।

এখনও বিমানের পাশেই ছুটছে রানার জিপ।

একটু দূরেই রানওয়ের শেষপ্রান্ত। বড় বেশি কাছে। ওই জায়গা শেষে খাড়া ক্লিফ নেমেছে সাগরে।

‘যেভাবে হোক, ওই বিমানের সামনে পৌছুতে হবে,’ মনে মনে বলল রানা।

স্টিয়ারিঙে মোচড় দিয়ে বামে সরল, কিন্তু তখনই পাশে শুনল বিমানের বিকট গর্জন। সামনের চাকা রানওয়ে থেকে আকাশে উঠতে শুরু করেছে!

যাহ!

দেরি করে ফেলেছে রানা!

রানওয়ের শেষের পনেরো গজ থাকতে ভেসে উঠল প্রকাণ্ড বিমান।

যেভাবে পোলার আইল্যাণ্ডের রানওয়ে থেকে আকাশে ডানা মেলল রাশান বিমান, যে কেউ মুগ্ধ হবে। কিন্তু আজকের ওই বিমানের উড়ে যাওয়া একটু অন্যরকম।

কেউ দূর থেকে চাইলে পরিষ্কার দেখবে আকাশে বিমান ভেসে উঠতেই ওটার পাশ দিয়ে গেছে একটা জিপ, ওটার চালক প্ৰাণপণ চেষ্টা করেছে বিমানের সামনে যেতে। কিন্তু ততক্ষণে উড়তে শুরু করেছে অ্যান্টোনভ

অবশ্য খরদৃষ্টির কেউ এ-ও বলবে, ওই জিপ থেকে লাফিয়ে পড়েছে এক লোক, কী যেন তাক করেছিল বিমানের দিকে। জিনিসটা থেকে ছিটকে গেছে কালো কেব্‌ল্।

জিপ নিয়ে বিমানের পাশাপাশি ছুটবার সময় তুমুল হাওয়া উড়িয়ে নিতে চেয়েছে রানাকে, কানে তালা লেগে গেছে অ্যান্টোনভের বিকট গর্জনে। জিপের সিটে উঠে ভাসমান বিমান লক্ষ্য করে ম্যাগনেটিউয়েক্সের হুক ফায়ার করেছে ও।

ডিভাইসটির তীরের মত ফলা খচ্ করে বিধে গেছে বিমানের নাকের কাছে ফিউজেলাজে, আর তখনই সাঁই করে রানাকে নিয়ে কমপক্ষে এক শ’ ফুট উঠে গেছে অ্যান্টোনভ।

ম্যাগনেটিউয়েক্সের কেবল থেকে ঝুলছে রানা।

ক্রমেই বাড়ছে উচ্চতা। একবার নীচে চাইল বিসিআই এজেণ্ট। পৌছে গেছে জিপ রানওয়ের শেষে, পরক্ষণে ক্লিফ থেকে লাফ দিয়ে পড়ল অনেক নীচের সাগরে।

প্রায় খাড়াভাবে উঠতে লাগল অ্যান্টোনভ, ম্যাগনেটিউয়েক্সের কেবল থেকে ঝুলতে ঝুলতে হিসাব কষে ফেলল রানা। গ্যাসের মেঘের আগে রয়েছে সত্তর কিলোমিটার এলাকা। এখানে গ্যাস নেই। এই জায়গা পেরোতে বড়জোর দশ মিনিট লাগবে অ্যান্টোনভের। আর একবার ওখানে পৌছলে গ্যাসের মেঘে আগুন জ্বালতে ওয়ারহেড ফেলবে থ্রাশার।

কে রিল করে উঠতে লাগল রানা। পৌছে গেল বিমানের নাকের কাছে। এই অ্যান্টোনভ অন্যগুলোর মতই, ককপিট থেকে সামনের সব দেখবার জন্য তৈরি করা হয়েছে কাঁচের বালবের মত নাক।

বিমানের গম্বুজের মত নাকের নীচে পৌছে হোলস্টার থেকে সিগ সাওয়ার পিস্তল নিয়ে কাঁচে গুলি করল রানা।

দুটো গুলি করতেই ফুরিয়ে গেল ম্যাগাযিন, অবশ্য নিজের কাজ সমাধা করেছে পিস্তল। ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে কাঁচের বাধা। পিস্তল ফেলে সামান্য দুলে নিয়ে হাঁচড়েপাছড়ে বিমানের ভিতর ঢুকে পড়ল রানা।

চারপাশে বরফ-ঠাণ্ডা শোঁ-শোঁ হাওয়া।

রওনা হয়ে গেল ও, আর তখনই দেখল ম্যাক পাওলোকে।

রানার মাথা লক্ষ্য করে এম৯ পিস্তল তুলছে সে।

আশপাশে দেখা গেল না উইলিয়াম থ্রাশার বা সাইক্লোনকে। তারা বোধহয় আছে নোয কোনের ওপরের ককপিটে।

পাওলোর পিছনের হোল্ডে তারপুলিন দিয়ে ঢাকা প্রকাণ্ড কী যেন। বিমানের শেষে বন্ধ র‍্যাম্পের কাছে একটা জিপ। ওটাতে করেই গ্যাসওঅর্ক থেকে বিমানে পৌচেছে থ্রাশার।

‘পাওলো…’ শান্ত স্বরে ডাকল নিরস্ত্র রানা। দু’হাত দু’পাশে সরিয়ে রেখেছে। বিমানে উঠবার সময় ফেলে এসেছে সিগ সাওয়ার।

‘আমি দল বেছে নিয়েছি, রানা!’ দমকা হাওয়ার উপর দিয়ে বলল বিশ্বাসঘাতক ক্যাপ্টেন। ‘তার মানেই বাড়ি ফিরব আমাদের দু’জনের যে-কোনও একজন।’

‘তোমার জন্যে এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক,’ বলল রানা। ‘নিজের দেশের বিরুদ্ধে…’

‘চুপ কর, শালা!’ চেঁচিয়ে উঠল পাওলো। ‘আবারও দেখা হবে নরকে!’

ট্রিগার টিপতে শুরু করেছে সে। অবাক হলো।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রানা। দু’হাত দু’দিকে সরিয়ে রাখা। কারণ কী?

কী যেন বলে উঠল মাসুদ রানা, আর তখনই ওর কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিল বন্ধু। ঝট্ করে তাক করল মেশিনগান।

বুম! বুম! বুম!

বিস্ফোরিত হলো ম্যাক পাওলোর বুক। মনে হলো পিছন দিকে ওড়া কোনও পাখি সে। শূন্যে উঠে গেল দুই পা, ছিটকে গিয়ে ধুপ করে পড়ল পিছনে। মেঝেতে পড়বার আগেই মারা গেছে।

‘চোরের উচিত না যোদ্ধার সঙ্গে লড়াই করা, বিড়বিড় করল রানা। চলো, বন্ধু, কাজ আছে!’

পাওলোর লাশ টপকে রওনা হয়ে গেল রানা। চলেছে স্টিলের খাটো সিঁড়ির দিকে। উঠবে ককপিটে।

আঁচ করছে বিমানের ককপিটে আছে থ্রাশার।

.

উইলিয়াম থ্রাশার মনোযোগ দিয়ে দেখছে নির্দিষ্ট মনিটর।

ককপিটের পাশের জানালার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে স্পেকট্রোস্কোপিক লং-পাথ অ্যানালাইযার। জিনিসটা দিগন্তের দিকে তাক করা মোটা এরিয়ালের মত। ওটার মাধ্যমে সহজেই জানবে বিমানের চারপাশের পরিবেশ কেমন।

পর্দায় ভেসে উঠছে রেযাল্ট।

বৃত্তাকার স্কোপের মত ছবির উপরাংশে ঘন মেঘের মত কী যেন। ওটার দিকেই ছুটে চলেছে বিমান। কয়েক সেকেণ্ড পর পর পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্য, দেখা যাচ্ছে ওই মেঘের আরও কাছে পৌঁছে গেছে বিমান।

আপাতত গ্যাসের মেঘ থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে বিমান। আর মাত্র চার মিনিটে পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।

মুচকি হাসল উইলিয়াম থ্রাশার।

স্পেকট্রোস্কোপের তারে যুক্ত রাশান আরএস-৬ নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড, এখন শুইয়ে রাখা হয়েছে মেঝেতে। সামান্য বদলে নেয়ায় এখন ওটার ভিতর রয়েছে রক্তিম ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।কোন্ আইসক্রিমের মত ওয়ারহেডে স্টেনসিলে লেখা সতর্কবাণী।

ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এক বোমা।

ওটার বিস্ফোরণে খুন হবে লাখে লাখে মানুষ।

তার চেয়েও অনেক বড় ক্ষতি করবে ওটা, জ্বেলে দেবে গোটা পৃথিবী জুড়ে দাউ-দাউ আগুন। পুড়ে মরবে শত শত কোটি মানুষ!

বিমানে উঠবার পর দেরি না করেই ওয়ারহেডের চেম্বারে স্ফেয়ার রেখেছে থ্রাশার। আর এখন স্পেকট্রোস্কোপের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে ওয়ারহেড। একবার স্পেকট্রোস্কোপে দাহ্য গ্যাসের মেঘ দেখা দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দেশ পৌঁছে যাবে। এর মাত্র দু’মিনিট পর হবে ওয়ারহেডের ডেটোনেশন। দু’মিনিট রাখা হয়েছে থ্রাশার ও সাইক্লোনের জন্য, সে সময়ে সরে পড়বে তারা।

ভয়ঙ্কর হবে বিশেষ এই ওয়ারহেডের বিস্ফোরণ।

টিশ্যু পেপারের মত ভুস করে আগুনে হাওয়া হয়ে যাবে বিমান। আকাশ জুড়ে জ্বলে উঠবে লেলিহান অগ্নিশিখা, পুড়বে গোটা নর্দার্ন হেমিস্ফেয়ার। অবশ্য, এর আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাবে থ্রাশার ও সাইক্লোন।

ককপিটে আরেকটা ডিভাইস রেখেছে থ্রাশার। ওটা একটি কমপ্যাক্ট, কালো স্যাটালাইট ডিশ। ওটাই আপলিঙ্ক। পোলার আইল্যাণ্ড থেকে বিমান যথেষ্ট দূরে সরলেই অফ করে দেয়া হবে আপলিঙ্কের সুইচ। পোলার আইল্যাণ্ডের কোনও মানুষ বা প্রাণী বাঁচবে না। রাশান নিউক্লিয়ার মিসাইল সেটা নিশ্চিত করবে।

হোল্ডের কাছে গুলির আওয়াজ পেয়ে ঘুরে চাইল থ্রাশার। ব্যাপার? নীচে গিয়ে দেখো তো, সাইক্লোন!’

বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিল থ্রাশার, ককপিট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দরজা খুলল সাইক্লোন। পিস্তল হাতে নামছে সিঁড়ি বেয়ে, বেদম চমকে গেল।

অ্যান্টোনভের ভিতরে শুরু হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। ফড়-ফড় আওয়াজে উড়তে চাইছে তারপুলিন। দড়ি দিয়ে না বাঁধা সব জিনিস নানাদিকে ছুটছে। কাত হয়েছে হোল্ড। এখনও উপরে উঠছে বিমান।

কিছু করবার আগেই হঠাৎ করেই সাইক্লোনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কে যেন!

স্টিলের সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল সাইক্লোন, হাত থেকে ছুটে গেছে পিস্তল।

সাইক্লোনের পাশেই পড়েছে আক্রমণকারী।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল সাইক্লোন, একটু দূরেই দেখল মাসুদ রানাকে— সে-ও উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

‘বারবার ফিরে আসছিস তুই,’ শোঁ-শোঁ হাওয়ার উপর গলা চড়িয়ে বলল সাইক্লোন।

যেন বৃত্তের ভিতর আটকা পড়েছে ওরা। পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে ঘুরছে।

‘থ্রাশার তোমাকে কোথায় পেয়েছিল— চিলিতে?’ জানতে চাইল রানা।

‘লিভেনওঅর্থে,’ বলল সাইক্লোন। ‘আর্মি রেঞ্জারে ছিলাম, কিন্তু খুন করে ফেলেছিলাম আরেক রেঞ্জারকে। সে শালা কর্তৃপক্ষকে আমার কিছু দোষের কথা বলে দিতে চেয়েছিল। আর আমার মত দেশপ্রেমিক দক্ষ লোক দরকার ছিল থ্রাশারের। জেলখানা থেকে বের করে আনে, আর আমি আবার আনি একদল সৈনিক।’

‘বাহ্, দেশপ্রেমিক কাকে বলে,’ বলল রানা। গলা উঁচু করল: ‘বন্ধু!’

আবারও ওর কাঁধের উপর দিয়ে দেখা দিল রোবট…

কিন্তু ক্লিক আওয়াজ তুলল মেশিনগান।

আর গুলি নেই!

রানা কিছু করবার আগেই ওর উপর ঝাঁপিয়ে এল সাইক্লোন। ধুপ্ করে বাড়ি খেল দু’জন। মেঝেতে পড়ে গড়াতে শুরু করেছে। ঘুষি মারতে চাইছে একে অপরকে। কয়েক সেকেণ্ড পর আলাদা হলো ওরা, লাফিয়ে উঠল রিয়ার হোল্ডে রাখা জিপের পিছনে। রানাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে চাইল সাইক্লোন, ফেলেও দিল, কিন্তু তার আগেই তার দুই উরু জড়িয়ে ধরেছে রানা দু’হাতে। ধাতব মেঝেতে হুড়মুড় করে পড়ল দু’জন। গড়াতে শুরু করেছে অপ্রশস্ত জায়গায়।

রানার বুকে ও মুখে ভয়ঙ্কর কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিল সাইক্লোন।

প্রতিবার ঠেকাতে চাইছে রানা। কিন্তু ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে দেহ। শীঘ্রি দেখা গেল মার খেতে শুরু করেছে রানা। একের পর এক ঘুষি পড়ছে বুকে-নাকে-মুখে, প্রতিরোধ করতে পারছে না, পাল্টা হামলা করা তো দূরের কথা!

.

অ্যান্টোনভ বিমানের ককপিটে খুশি হয়ে উঠেছে উইলিয়াম থ্রাশার। এইমাত্র জোরালো বিপ্‌-বিপ্! আওয়াজ ছেড়েছে স্পেকট্রোস্কোপ। বিমান ঢুকে পড়েছে দাহ্য গ্যাসের মেঘে।

শুরু হয়ে গেছে ওয়ারহেডের কাউন্ট ডাউন।

‘এবার সময় শেষ,’ আপনমনে বলল থ্রাশার। ‘বিদায় পোলার আইল্যাণ্ড। রীতিমত ভালবাসি রাফিয়ান আর্মির সবাইকে। হ্যাঁ, ওরা ওদের কাজ ঠিকভাবেই শেষ করেছে।

অফ করে দিল থ্রাশার স্যাটালাইট আপলিঙ্কের সুইচ।

দপ্ করে নিভে গেল ডিভাইসের প্রতিটি আলো।

.

আর একই সময়ে পশ্চিম সাইবেরিয়ার এক রাশান মিসাইল লঞ্চ ফ্যাসিলিটিতে কন্সোল অপারেটার সোজা হয়ে বসল।

‘স্যর! পোলার আইল্যাণ্ডের স্যাটালাইট মিসাইল ডিটেকশন শিল্ড অফ করে দেয়া হয়েছে!’

অপারেটারের স্ক্রিনে কয়েক মুহূর্ত চোখ রাখল তার কমাণ্ডার, তারপর তুলে নিল সিকিয়োর একটি ফোন, দেরি না করেই তথ্যটা জানিয়ে দিল মস্কোতে রাশান প্রেসিডেন্টকে।

সঙ্গে সঙ্গে এল জবাব।

‘ইয়েস, স্যর!’ বলে ফোন রেখে দিল মিসাইল কমাণ্ডার। ‘আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিউক্লিয়ার মিসাইল লঞ্চ করতে! টার্গেট পোলার আইল্যাণ্ড! ফায়ার!’

পাঁচ সেকেণ্ড পর বিশাল সাইলো থেকে ছিটকে আকাশে উঠল এসএস-১৮ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল। মাথায় নিয়ে চলেছে পাঁচ শ’ কিলোটন থারমালনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড।

গন্তব্য: পোলার আইল্যাণ্ড।

ঠিক বাইশ মিনিট পর আঘাত হানবে টার্গেটে।

উইলিয়াম থ্রাশারের তৈরি প্ল্যান ঠিকভাবেই কাজ করছে।

.

উন্মাদের আস্তানা যেন রাশান বিমান অ্যান্টোনভ-১২-এর হোল্ড। এখনও কাত হয়ে উপরে উঠছে বিমান। দামাল হাওয়ায় উড়ছে অনেক কিছুই।

উড়ছে রানা নিজেও, তবে তা এক সেকেণ্ডের জন্য। এইমাত্র কপালে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে জিপের পিছনের মেঝেতে ধুপ্ করে পড়ল। লড়াই পুরোপুরি নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সাইক্লোন। ঝাঁপিয়ে পড়ে একের পর এক ঘুষি বসাচ্ছে রানার বুকে-মুখে-নাকে।

প্রচণ্ড সব ঘুষি খেয়ে চোখে আঁধার দেখছে রানা। ফেটে গেছে ঠোঁট, কশা বেয়ে নামছে রক্ত। তখনই খেয়াল করল, হোল্ডে বইতে শুরু করেছে উল্টোপাল্টা তুমুল হাওয়া। চট্‌ করে রিয়ার র‍্যাম্পের দিকে চাইল।

খুলছে চৌকো দরজা।

চোখের কোণে রানা দেখল ককপিট ছেড়ে হোল্ডে হাজির হয়েছে উইলিয়াম থ্রাশার। এইমাত্র দেয়ালে বসানো কন্ট্রোল ব্যবহার করেছে।

‘আরেহ্, এ দেখি সেই আঠা মাসুদ রানা, হাহ্ হাহ্ হাহ্!’ অট্ট হাসল থ্রাশার। ‘তা হলে আবারও দেখা হলো! প্রশংসা না করে পারছি না, সত্যিই কঠিন লোক তুমি, বাপু! হাল ছাড়তে শেখোনি কিন্তু দেরি হয়ে গেল যে! আমরা পৌঁছে গেছি গ্যাসের মেঘে। আর চালু হয়েছে ওয়ারহেড। আর ঠেকাতে পারবে না কেউ। …সাইক্লোন! গাধাটাকে শেষ করো! সরিয়ে ফেলবে ওই জিপ!’

হোল্ডের সামনের দিকে তারপুলিন দিয়ে ঢাকা জিনিসটার দিকে মাথা কাত করে দেখাল থ্রাশার। জিপ না সরালে বের করা যাবে না ওই জিনিস।

‘ইয়েস, স্যর!’ চিৎকার করে বলল সাইক্লোন। দুর্বল ও মার খাওয়া রানার গলা টিপে ধরল সে, চোখে খুনির দৃষ্টি।

জিপের পিছনের মেঝেতে পড়ে আছে অসহায়, ধুলোমাখা রানা, একহাত ঝুলছে জিপ থেকে। ছেঁচে গেছে গাল। মুখের কোণে অগভীর নালায় রক্তের স্রোত, থুতনি বেয়ে নামছে বুকে।

মুঠো পাকিয়ে হাত উপরে তুলল সাইক্লোন, এবার শেষ করবে শত্রুকে। এক থাবড়া দিয়ে রানার মগজে পাঠিয়ে দেবে নাকের হাড়। মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে।

প্রচণ্ড বেগে নামছে সাইক্লোনের ঘুষি। আর একই সময়ে খোলা হাতে জিপের চাকা আটকে রাখা লিভার খুলে দিল রানা।

ওই লিভার ছেড়ে দিল কয়েকটি শিকল। ওগুলোই হোল্ডে আটকে রেখেছিল জিপটাকে। গাড়ি নড়ে উঠতেই লক্ষ্যচ্যুত হলো সাইক্লোনের ঘুষি। উপরে উঠতে থাকা বিমানের খাড়া হোল্ড ছেড়ে সড়াৎ করে বেরিয়ে গেল জিপ খোলা আকাশে।

ওই জিপে রয়ে গেছে মাসুদ রানা ও কর্নেল সাইক্লোন।

হঠাৎ করেই জিপ উধাও হওয়ায় হাঁ হয়ে গেছে থ্রাশার। আরে! গায়েব হয়ে গেছে তার সেরা অনুচর! এই ছিল, পরক্ষণে নেই!

‘ফাক-ফাক-ফাক!’ বিড়বিড় করে গাল বকল থ্রাশার।

তবে সামলে নিতেও সময় লাগল না।

সাইক্লোনকে হারিয়ে ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু মস্ত কোনও বিপদ হয়নি। সাইক্লোন তার পরিচয় জানত। এ-ও জানত, থ্রাশার সিনিয়ার সিআইএ এজেন্ট। এই কারণে এক সময়ে তাকে মেরে ফেলতেই হতো। হয়তো ভালই হলো, লোকটাকে খুন করতে হলো না নিজ হাতে।

আর ওই মাসুদ রানা, শালা যমের অরুচি! ওই শালাও শেষ!

রওনা হয়ে গেল থ্রাশার। এবার বেরিয়ে যেতে হবে।

এইমাত্র গ্যাসের মেঘে ঢুকেছে বিমান, চলছে অটোপাইলটে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে আরও ঘন মেঘে ঢোকে। দু’মিনিট পেরোবার আগেই বিস্ফোরিত হবে ককপিটের ওয়ারহেড।

ঝটপট তারপুলিন ঢাকা জিনিসটার পাশে পৌছে গেল থ্রাশার, সরিয়ে ফেলল ঢাকনি। নীচে দারুণ একটা মিনি-সাবমারসিবল!

রাশান মির-২-এর চেয়েও আধুনিক— মির-৪। দৈর্ঘ্যে বড়জোর পাঁচ মিটার। সামনের দিকে গম্বুজের মত কাঁচের বুদ্বুদ। ভিতরে বসতে পারে ছয়জন যাত্রী। রাশানরা বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহার করে তারা। কিন্তু শোনা যায়, আসলে মির-৪ ব্যবহৃত হয় গোপনে অন্য দেশের তীরে পৌছতে। কয়েক মাস আগে রাফিয়ান আর্মির দখল করে নেয়া রাশান ফ্রেইটার মস্কোভায় এ জিনিস ছিল দুটো।

এখন জিপ সরে যেতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে বেরোবার পথ। বিমানের দেয়ালের একটা সুইচ টিপল থ্রাশার, লাফ দিয়ে উঠল সাবমারসিবলে। নীচের কেবল হোল্ড থেকে টেনে বের করছে মির- ৪। দেখতে না দেখতে পৌছে গেল র‍্যাম্পে, জিপের মতই ঝুপ্ করে নেমে গেল ওটা আর্কটিকের ধূসর আকাশে।

কিন্তু জিপের মত নয়, মির-৪-এর সঙ্গে রয়েছে চারটে প্যারাশুট, ভারী সাবমারসিবল নেমে যেতেই ফটাশ ফটাশ আওয়াজে খুলে গেল। নামিয়ে নিয়ে চলেছে আর্কটিক সাগরের হিমশীতল পানির দিকে।

একটু পরে আস্তে করে ছলাৎ শব্দ তুলে সাগরে নামল সাবমারসিবল। দেরি না করে পানি-সমতল থেকে ডুব দিল থ্রাশার। চলেছে নির্দিষ্ট একটি জায়গা লক্ষ্য করে। ওখানে সিআইএ-র স্টারজিয়ন-ক্লাস সাবমেরিন অপেক্ষা করছে তার জন্য। বহু বছরের মিশন অবশেষে ফুরিয়েছে। সত্যিই পাল্টে দিতে চলেছে থ্রাশার মানব-সভ্যতার ইতিহাস।

বড় নিখুঁত পরিকল্পনা করেছে সে।

তৈরি করেছে দাহ্য গ্যাসের মেঘ, জোগাড় করেছে ওয়ারহেড— একটু পর ধ্বংস হবে পোলার আইল্যাণ্ড, সঙ্গে যাবে রাফিয়ান আর্মিও।

নিজেও সরে গেছে নিরাপদ জায়গায়।

কিন্তু একটা জিনিস ভুল হয়ে গেছে।

অ্যান্টোনভ বিমানের পেটের কাছে ম্যাগহুক থেকে ঝুলছে এক লোক: সে বিসিআই এজেণ্ট এমআরনাইন— মাসুদ রানা!

বিমান থেকে পড়তেই সোজা সাগরের দিকে রওনা হয়েছিল জিপ। ওটার উপর ছিল কর্নেল সাইক্লোন। হেঁড়ে গলায় কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে সাগরে আছড়ে পড়তে।

কিন্তু আপত্তি আছে রানার এভাবে মরতে।

বিমানের পেট থেকে জিপ খসে পড়তেই ব্যবহার করেছে বিশ্বস্ত ম্যাগহুক। ম্যাগনেটিউয়েক্সের মত অত শক্তিশালী বা আধুনিক নয়, কিন্তু ওটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না রানার কাছে।

লাফ দিয়ে পড়ন্ত জিপছাড়া হয়েছে রানা, বিমানের দিকে ফায়ার করেছে ম্যাগহুক। ঠং করে বিমানের তলপেটে লেগেছে বালবের মত ম্যাগনেটিক হেড। র‍্যাম্পের নীচে কেবলে ঝুলতে শুরু করেছে রানা। সাঁই সাঁই করে নেমে গেছে জিপ অনেক নীচের সাগরে, কিন্তু র‍্যাম্পের নীচে তখন ঝুলছে মাসুদ রানা।

ম্যাগহুকের ইন্টারনাল স্পুলার ব্যবহার করে কেবল গুটিয়ে আবারও র‍্যাম্পের তলে পৌঁছে গেছে রানা। আর তখনই হোল্ড থেকে নীচে নেমে গেল মিনি-সাবমারসিবল। চারটে প্যারাশুট খুলে যেতেই গতি কমল ওটার।

‘বিদায় নিল সত্যিকারের জানোয়ার,’ বিড়বিড় করল রানা। হাঁচড়েপাছড়ে উঠে এল র‍্যাম্পে। ও ছাড়া বিমানে কেউ নেই। ভাবল, এখনও শেষ হয়ে যায়নি সব।

ঝোড়ো হাওয়ার ভিতর হোল্ড পেরিয়ে খালি ককপিটে ঢুকল রানা। ঝটপট চারপাশ দেখল। বিমান চলছে অটোপাইলটে। স্পেকট্রোস্কোপের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, বিমান ঢুকে পড়েছে দাহ্য গ্যাসের মেঘে। পাশেই মেঝেতে শুয়ে আছে জগৎবিধ্বংসী ওয়ারহেড। বলছে ওটার টাইমার:

০০:৪৩…

০০:৪২…

০০:৪১…

‘দুনিয়া শেষ হওয়ার শুরু চল্লিশ সেকেণ্ড পর,’ বিড়বিড় করল রানা। কী করা যায়, ভাবছে।

আসলে ভয়ঙ্কর এক উড়ন্ত বোমার ভিতর ঢুকে পড়েছে ও!

একবার পরিবেশে দাবানল ধরলে পুড়ে ছাই হবে একের পর

এক দেশ!

০০:৩৯

০০:৩৮…

০০:৩৭…

ওয়ারহেডের দিকে চেয়ে আছে রানা। বোমার বাইরের দিকের সব প্যানেল স্ক্রু দিয়ে আটকে গেছে উইলিয়াম থ্রাশার। সঠিক সময়ে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার বের করতে পারবে না ও।

তা হলে? ভাবল রানা। উপায় নেই! বড় দেরি হয়ে গেছে! জীবনে প্রথমবারের মত ওর মনে হলো, কিছুই করবার নেই।

০০:৩৪…

আর তেত্রিশ সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হবে রাশান নিউক্লিয়ার বোমা!

আর তারপর ভয়ঙ্কর আগুন ধেয়ে যাবে একের পর এক দেশ পুড়িয়ে ছাই করতে!

.

বিপুল শক্তি নিয়ে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ারসহ বিস্ফোরিত হলো ভয়ঙ্কর রাশান নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড, চারপাশে ছিটিয়ে দিল চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া ধবধবে সাদা আগুন ও তেজস্ক্রিয়তা।

মির-৪ সাবমারসিবলের ভিতর আর্কটিক সাগরের নীচে সবই টের পেল উইলিয়াম থ্রাশার। এত দূরে এসেও থরথর করে কাঁপছে সাবমারসিবল।

কিন্তু হঠাৎ করেই ভুরু কুঁচকে ফেলল থ্রাশার।

সাগরের এত গভীরে বিস্ফোরণের ঝাঁকি আসার তো কথা নয়! যে-কোনও কংকাশন ঠেকাবার সেরা জিনিস পানি। কিন্তু তার পরেও সবই টের পেয়েছে সে। যেন ওই ওয়ারহেড বিস্ফোরিত হয়েছে পানির…..

‘না!’ থমথমে সাবমারসিবলের ভিতর বিকট কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল থ্রাশার, ‘না! না! অসম্ভব!’

সন্দেহ নেই, ডেটোনেট হয়েছে নিউক্লিয়ার বোমা, ভিতরে লাল ইউরেনিয়ামের স্কেয়ারও ছিল, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: ওই বোমা গ্যাস ভরা আকাশে বিস্ফোরিত হলো না কেন?

এইমাত্র ওটা ফেটেছে পানির নীচে!

.

একমাত্র যৌক্তিক কাজটিই করেছে রানা, গড়িয়ে ককপিট থেকে হোল্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে কোন্ আইসক্রিম আকৃতির ওয়ারহেড।

০০:২৯…

০০:২৮…

০০:২৭

ঠেলে র‍্যাম্পের কাছে নিয়ে গেছে ওটাকে।

০০:২৩…

০০:২২…

০০:২১…

পার করিয়ে দিয়েছে র‍্যাম্প।

টিকটিক করে চলছে তখনও টাইমার।

আকাশ চিরে সাগর লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে ওয়ারহেড। ঝপাস্ করে পড়েছে সাগরে। এক সেকেণ্ডও লাগেনি তলিয়ে যেতে।

০০:০৭…

০০:০৬…

০০:০৫…

আবছা নীলের রাজ্যে আরও নীচে চলেছে ওয়ারহেড।

০০:০২…

০০:০১…

০০:০০…

বী-ই-ই-ইপ! শব্দ তুলল টাইমার, তখনই বিস্ফোরণ হলো।

সাগরের গভীরে থারমোনিউক্লিয়ার ডিভাইস যা করে, মিসাইলের ওয়ারহেডও তাই করল।

নানাদিকে ছিটিয়ে দিল ধবধবে সাদা লেলিহান আগুনের শিখা, ওটা দপ্ করে মিলিয়ে যেতেই সাগর-তলে তৈরি হয়ে গেল মস্ত গোলাকার অতি উত্তপ্ত জল-কণার মেঘ। খ্যাপার মত ঘুরছে মেঘের অতি ক্ষুদ্র কোটি কোটি বুদ্বুদ, ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। উঠে এল সাগর-সমতলে। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাবত, সাগরের বুক থেকে উঠছে বিপুল পানি নিয়ে প্রকাণ্ড এক ফুটবল। আকাশে উঠল মস্ত বড় এক ফোয়ারা। আগে কখনও পৃথিবীর বুকে এমন দেখা যায়নি।

ভাগ্য সত্যিই ভাল, সাগরের গভীরে বিস্ফোরিত হয়েছে নিউক্লিয়ার বোমা। বিপুল পানির চাপে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেনি ওটা, জ্বেলে দিতে পারেনি আকাশে লেলিহান আগুন।

এখন শুধু রাগে থরথর করে কাঁপছে সিআইএ-র সিনিয়ার এজেণ্ট উইলিয়াম থ্রাশার! শেষমেশ হেরেই গেল সে! নিশ্চয়ই ওটাকে প্লেন থেকে ঠেলে নীচের সাগরে ফেলেছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ওই বেপরোয়া এজেণ্টটা!

.

আবারও অ্যান্টোনভ বিমানের ককপিটে ফিরেছে বিসিআই এজেণ্ট মাসুদ রানা। নীচে দেখল, সাগরের বুকে প্রকাণ্ড ফোয়ারা। মস্ত শ্বাস ফেলে ধপ্ করে বসে পড়ল পাইলটের সিটে।

ও রক্তাক্ত। মার খেয়ে ফুলে উঠেছে মুখ ও দেহ। প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া এক মানুষ বলে নিজেকে মনে হলো ওর। ভাবতে গিয়ে ছোট হয়ে গেল মন, প্রায় অসম্ভব এ মিশনে এসে একের পর এক খাঁটি অন্তরের মানুষ হারিয়েছে ও।

সামনে ছিল হিমালয়ের মত উঁচু বাধার প্রাচীর।

ঠেকাতে হবে রাফিয়ান আর্মি, নইলে পরিবেশে আগুন জ্বেলে দেবে তারা, এর ফলাফল: কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু।

সেসব ঠেকাতে পেরেছে ওরা।

কিন্তু পোলার আইল্যাণ্ডের ধ্বংস রুখতে পারবে না।

তখনই জিনিসটার উপর চোখ পড়ল ওর।

আপলিঙ্ক ডিশ।

গ্যাঁট মেরে বসে আছে মেঝেতে। নিভে গেছে সব বাতি।

অফ করে দেয়া হয়েছে সব সুইচ।

‘আরে…’ মনে পড়ে গেছে রানার রাশানদের কথা।

আপলিঙ্ক অফ করে দেয়ায় এখন সম্পূর্ণ অনিরাপদ পোলার আইল্যাণ্ড!

নিশ্চয়ই রাশানরা জেনে গেছে?

এতক্ষণে হয়তো পোলার আইল্যাণ্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছে নিউক্লিয়ার মিসাইল!

তার মানে বড়জোর বিশ মিনিট পর কিছুই থাকবে না ওই দ্বীপে!

অটোপাইলট অফ করেই বিমান ঘুরিয়ে নিল রানা, পূর্ণ গতি তুলে ফিরছে পোলার আইল্যাণ্ড লক্ষ্য করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *