মৃত্যুদ্বীপ – ১

এক

এপ্রিলের চার, ভোর হয় হয়।

হিমশীতল আর্কটিক সাগরের মাঝে ধবল তুষার ও নীলাভ বরফ ঢাকা রাশান দুর্গ-দ্বীপ— পোলার আইল্যাণ্ড।

এয়ারস্ট্রিপ থেকে লেজ দাবিয়ে পালাচ্ছে পুরনো বিমানটা, পিছনে ধেয়ে আসছে ভারী মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক উত্তপ্ত বুলেট। একটু পর আকাশে উঠল উড়োজাহাজ। নীচে বিস্তৃত আর্কটিক সাগর, উত্তরদিকে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে বহু দূরে।

বিমানের পাইলটের বয়স ষাট বছর, পেশায় পাইলট নন তিনি- বিজ্ঞানী, নাম, ডক্টর ম্যাকসিম তারাসভ।

তিনি জানেন, বেশিদূরে যেতে পারবেন না এই পুরনো বিমান নিয়ে। রানওয়ে ছাড়বার সময় দেখেছেন, পিছনে লেগেছে দুটো স্ট্রেলা-১ অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ভেহিকেল। উভচর গাড়িগুলো দেখতে প্রায় জিপগাড়ির মতই, তবে প্রতিটির পিঠে রয়েছে চারটে করে ৯এম-৩১ সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল, যে-কোনও সময়ে ওগুলো লঞ্চ করা হবে।

আর বড়জোর আধমিনিট, তারপরই আকাশ থেকে ফেলে দেয়া হবে তাঁর বিমানটা।

উনিশ শ’ ষাট সালে তৈরি সোভিয়েত আমলের কুৎসিততম বিমান বেরিভ বিই-১২। বহুবছর আগে যখন তরুণ রিক্রুট হিসাবে সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিয়েছিলেন, তখন এ ধরনের বিমান চালিয়েছেন ম্যাকসিম তারাসভ। তারপর কর্তৃপক্ষ একদিন আবিষ্কার করল, এ ছেলের সত্যিকারের প্রতিভা রয়েছে ভিন্ন বিষয়ে। তখন তাঁকে নতুন কাজ দেয়া হলো স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেটে।

কিছুদিন আগেও এ ধরনের এক বিমানের বরফ-ঠাণ্ডা হোল্ডে বসে তারাসভ ভেবেছেন, এই বেরিভ বিমান আর তিনি ভাল করেই চেনেন পরস্পরকে। তাঁদের ভিতর অনেক মিল- আসলে বুড়ো হয়ে গেছেন তাঁরা, তবুও কাজ করছেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

বেচারা বেরিভ বিমান!

সত্যিই, অতি পুরনো।

হারিয়ে গেছে আগের সমস্ত জৌলুস, গর্ব ও সম্মান। এখন উত্তর মেরুর পুরনো প্রায় ভুলে যাওয়া একটা বেসে তাঁদের মত পুরনো সব মানুষকে পৌছে দিচ্ছে ধুঁকতে ধুঁকতে। এই বিমানের মতই ফুরিয়ে এসেছেন ম্যাকসিম তারাসভ নিজেও, দিনে দিনে আরও ধূসর হয়ে উঠছে তাঁর ঝোপের মত গোঁফ।

কখনও ভাবেননি আবারও চালাতে হবে বেরিভ বিমান।

কিন্তু আজ ভোরে তাঁর টিম নিয়ে দ্বীপের রানওয়েতে নামতেই শুরু হলো মহাবিপদ।

রাশা থেকে রওনা হয়ে রাতভর একটানা চলার পর নিঃসঙ্গ পোলার আইল্যাণ্ডের উপর দু’বার চক্কর কেটেছে বেরিভ। নীচে দেখেছেন তাঁরা মাঝারি আকারের দ্বীপটা, পাহাড়গুলো ঠেলে উঠে আসতে চাইছিল তাঁদের দিকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সারোভের আরযামাস-১৬ নিউক্লিয়ার রিসার্চ বেস বা কোল্টসোভোর বায়োওয়েপন্স সেন্টার ভেক্টর ইন্সটিটিউটের মতই সর্বোচ্চ সিকিউরিটি ক্লাসিফিকেশন দেয়া হয়েছিল এক সময় এই দ্বীপকে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত বিশাল দালান ও অন্যসব স্থাপনা। শুধু স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেট থেকে রাখা হয়েছে তারাসভের মত গুটি কয়েক ক্রু।

আট সপ্তাহের জন্য এই দ্বীপ পাহারা দিতে পাঠানো হয়েছে তারাসভ ও তাঁর সঙ্গে বারোজন স্পেৎন্যায সৈনিককে।

তাঁরা যখন অবতরণ করলেন, কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না।

কমে এসেছে প্রচণ্ড শীতের দাপট, এ বছর এই প্রথম আকাশে মুখ তুলেছে সোনালি সূর্য, আর দ্বীপের চারপাশের সাগরে ফাটতে শুরু করেছে জমাট বরফ। সেই সুদূর উত্তর মেরুবিন্দু পর্যন্ত সাগর ছেয়ে থাকা বরফের চাদর হয়ে উঠেছে ধোঁয়াটে, ঠিক যেন হাতুড়ি দিয়ে জোর ঘা দেয়া হয়েছে পুরু কাঁচে। চারপাশে সাপের মত এঁকেবেঁকে ছুটেছে হাজার হাজার ফাটল।

এখনও রয়ে গেছে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা। আর পোলার আইল্যাণ্ডের কমপ্লেক্সের উপর রয়েছে পাতলা বরফের আস্তরণ।

তবুও চারপাশ দেখলে জুড়িয়ে যায় মন।

পঁয়ত্রিশ বছর আগে আকাশে মাথা তুলেছিল বেসের সেন্টার টাওয়ার, ঠিক যেন দূর-ভবিষ্যতের কোনও কল্প-শহরের স্থাপনা। বিশতলা দালানের সমান উঁচু মস্ত পাথুরে পিলারের মাথার উপর যেন ফ্লাইং সসার বসানো। মেইন ডিস্ক থেকে আরও উপরে উঠেছে খুদে টাওয়ার, ওখানে রয়েছে বেসের কাঁচ ঢাকা গোলাকার গম্বুজের মত কমাণ্ড সেন্টার।

যেন গোটা দ্বীপের উপর চোখ রাখছে ভবিষ্যতের কোনও মহাকাশ বাতিঘর। পুবে মাথা তুলেছে দুই প্রকাণ্ড একযস্ট ভেণ্ট। দেখলে মনে হতে পারে মস্ত কোনও শিল্পীর নিখুঁতভাবে তৈরি করা টাওয়ার, কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তি ও ক্ষমতা অর্জনের জন্য যেন সৃষ্টি করা হয়েছে ওই দুই ভেণ্ট। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের ভেণ্ট বা কুলিং টাওয়ারের মতই দেখতে, কিন্তু আকারে দ্বিগুণ।

এককালের ভয়ঙ্কর এই বেসে এখন থাকে অল্প ক’জন ক্রু। জরুরি কিছু জায়গায় কাজ করে তারা— অফিসে, গার্ড হাউসে বা উল্টো পিরিচের মত দেখতে টাওয়ারে।

এ দ্বীপ আসলে এক শক্তিশালী দুর্গ। নানান স্থাপনা ও দ্বীপের ল্যাণ্ডস্কেপ এমনই, সামান্য কয়েকজন সৈনিককে নিয়েই একদল শত্রুর হামলা ঠেকাতে পারবেন তারাসভ। পোলার আইল্যাণ্ড দখল করতে হলে বিরাট এক সেনাবাহিনী লাগবে।

দ্বীপের উপর দিয়ে বিমান যাওয়ার সময় হোল্ডে বসে অবাক হয়েছেন তারাসভ। নীচের ওই প্রকাণ্ড দুই এক্যস্ট ভেন্টের মুখ দিয়ে ঝিলমিলে গ্যাস বেরোতে দেখেছেন তিনি। আকাশে উঠে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে গ্যাস। বিষয়টি অত্যন্ত অস্বাভাবিক। তবে চমকে যাওয়ার মত নয়। হয়তো তার টিম নিয়ে জিয়োথারমাল পাইপিঙের বাড়তি বাষ্প বের করে দিচ্ছে সেমেন ইগোরভ।

দ্বীপের এয়ারস্ট্রিপে নামতেই তারাসভের সঙ্গের স্পেন্যায সৈনিকরা নেমে পড়েছিল বেরিভ বিমান থেকে, রওনা হয়েছিল হ্যাঙারের দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেমেন ইগোরভ, হাত নাড়ছিল হাসিমুখে। নেমে পড়বার পর কয়েক মুহূর্ত বিমানের আড়ালে ছিলেন তারাসভ, সঙ্গে এক তরুণ সৈনিক। তার দায়িত্ব তারাসভের হয়ে নতুন স্যামোভার-৬ লেসার-অপটিক কমিউনি- কেশন গিয়ার বহন করা।

ওই জিনিস নামাতে গিয়েই দেরি হয়েছে, নইলে অন্যদের মতই মরতে হতো তারাসভ ও তরুণ সৈনিককে।

তারাসভের স্পেত্ন্যায টিম টারমাকের অর্ধেক পথ পাড়ি দিতেই পুরো খোলা জায়গায় তাদের উপর শুরু হলো ভারী মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ। শত্রুরা লুকিয়ে ছিল গোপন জায়গায়, স্পেন্যায সৈনিকদের কেউ আক্রমণ বা আত্মরক্ষার সামান্যতম সুযোগও পায়নি।

পুরো হত্যাযজ্ঞ দেখবার জন্য অপেক্ষা করেননি তারাসভ, তীরের মত গিয়ে উঠেছেন বিমানের ককপিটে, পাইলটের সিটে বসেই কাজে লাগিয়েছেন অতীতের অভিজ্ঞতা। ইঞ্জিন আবারও চালু করেই পালাতে চেয়েছেন বেরিভ বিমান নিয়ে।

আকাশে উঠেই বিমানের রেডিয়ো ব্যবহার করে রাশান ভাষায় চেঁচিয়ে উঠেছেন তারাসভ, ‘ডিরেক্টোরেট বেস! আমি ডক্টর তারাসভ…’

কানের ভিতর জোরালো খশ্-খশ্ শব্দ শুনলেন তারাসভ।

শত্রুপক্ষ জ্যাম করে দিয়েছে স্যাটালাইট।

টেরেস্ট্রিয়াল সিস্টেম ব্যবহার করতে চাইলেন তারাসভ।

কোনও কাজ হলো না।

ওটাও জ্যাম করা হয়েছে।

ভয়ে দম আটকে আসতে চাইছে ডক্টর তারাসভের। ঝট করে ঘুরেই তুলে নিলেন স্যামোভার রেডিয়ো প্যাক। নতুন যন্ত্রটা এনেছিলেন পোলার আইল্যাণ্ডে বসাবার জন্য। ওটা রেডিয়ো ওয়েভ ব্যবহার না করে সরাসরি লেসার তাক করে স্যাটালাইটে। ফলে কোনও ধরনের জ্যামিং টেকনিক ওটাকে ঠেকাতে পারে না।

ধুপ করে ড্যাশবোর্ডের উপর হাই-টেক রেডিয়ো রাখলেন তারাসভ, লেসার তাক করলেন সরাসরি আকাশে, তারপর চালু করে দিলেন রেডিয়ো।

‘ডিরেক্টোরেট বেস, আমি ডক্টর তারাসভ! কাম ইন! কাম ইন!’

কয়েক মুহূর্ত পর জবাব পেলেন তিনি।

‘ডক্টর তারাসভ, ডিরেক্টোরেট বেস। স্যামোভার-৬ সিস্টেমের অপারেশনাল এনক্রিপশন প্রোটোকল এখনও চালু হয়নি। এমনও হতে পারে ডিটেক্ট করা হবে এই ট্র্যান্সমিশন। কাজেই…’

‘এখন ওসব বাদ দিন! পোলার আইল্যাণ্ডে কারা যেন আছে! আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল! আমার টিম বিমান থেকে নামতেই হামলা করেছে! টারমাকের উপর পড়ে আছে স্পেন্যায সৈনিকদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ! আমার কপাল ভাল, বিমান নিয়ে টেকঅফ করতে পেরেছি! আর এখন আমার বিমান ফেলে দিতে মিসাইল…..’

চট করে একবার নীচে চাইলেন তারাসভ। দেখলেন দ্বীপের প্রকাণ্ড দুই ভেণ্ট দিয়ে ঝিলমিলে ধোঁয়ার মত বেরোচ্ছে গ্যাস। হৃৎপিণ্ডের সমস্ত রক্ত জমাট বেঁধে যেতে চাইল তাঁর।

হায় দয়াময় ঈশ্বর, ভাবলেন।

‘বেস, জরুরি সুরে বললেন, ‘ইউভি-৪ স্ক্যান চালু করে পোলার আইল্যাণ্ডের উপরের আকাশের পরিবেশ পরীক্ষা করুন! মনে হচ্ছে, কেউ চালু করে দিয়েছে অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইস!’

‘কী বললেন, ডক্টর…?’

‘আমি ভেণ্টগুলো থেকে বাষ্পের মত ধোঁয়া উঠতে দেখছি।’

‘হায়, খোদা! কী বলেন…’

আরও কিছু বলতে চাইলেন তারাসভ, কিন্তু ঠিক তখনই বেরিভের পিছনে এসে লাগল স্ট্রেলা-১ লঞ্চার থেকে ৯এম-৩১ সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হলো বিমানের টেইল সেকশন। আকাশে একবার চমকে উঠেই নীচের দিকে রওনা হলো বেরিভ।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর সাগর ছেয়ে রাখা বরফের প্রান্তরে আছড়ে পড়ল ওটা। তারাসভের তরফ থেকে আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

রাশান আর্মির সিগনাল ডিরেক্টোরেট ঠিকই পেয়েছে তারাসভের সিগনাল, কিন্তু তাদের জানা নেই, আরও কেউ ওই সিগনাল শুনেছে।

ওটা ইউএস ন্যাশনাল রেকোনেসেন্স অফিসের একটা কেএইচ-১২ ‘ইমপ্রুভড্ ক্রিস্টাল’ স্পাই স্যাটালাইট।

স্ট্যাণ্ডার্ড প্রোটোকল অনুযায়ী অটোমেটেড সিস্টেমের মাধ্যমে ওই বার্তা ডাউনলোডের পর ডিকোড করা হলো। নিয়মিত রাশান মিলিটারি সিগনাল ইন্টারসেপ্ট করা হয়। কিন্তু যখন বার্তার ভিতর পাওয়া গেল পোলার আইল্যাণ্ড, ইউভি-৪ স্ক্যান 13 অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইস, সঙ্গে সঙ্গে ওটা পাঠিয়ে দেয়া হলো পেন্টাগনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের কাছে।

দুই

আর্কটিক সাগরে পোলার আইল্যাণ্ড থেকে দূরে বেরিভ বিমান ক্র্যাশ করবার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর।

তিন এপ্রিল।

বিকেল পৌনে পাঁচটা।

হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুম, ওয়াশিংটন ডি.সি.।

‘এখন ওসব বাদ দিন! পোলার আইল্যাণ্ডে কারা যেন আছে!’

মস্ত পাতাল ঘরে এখনও ভাসছে ম্যাকসিম তারাসভের কণ্ঠ। রাশান ভাষায় বলছেন তারাসভ, কিন্তু ইউএস আর্মি লিঙ্গুইস্ট সেসব কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছে।

শীতল নীরবতায় তাঁর ক্রাইসিস রেসপন্স টিম নিয়ে কথাগুলো শুনছেন ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

‘আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল! আমার টিম বিমান থেকে নামতেই হামলা করেছে! টারমাকের উপর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে আছে স্পেন্যায সৈনিকদের লাশ!’

ক্রাইসিস রেসপন্স টিমে রয়েছেন আর্মি, নেভি, মেরিন ও এয়ার ফোর্সের সর্বোচ্চ জেনারেল। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রয়েছেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইযার, এনআরও, সিআইএ এবং ডিআইএ-র সিনিয়ার পারসোনেল। এ ঘরে মহিলা বলতে মাত্র একজন। তিনি ডিআইএ-র রিপ্রেযেক্টেটিভ, ডেপুটি ডিরেক্টর কনি হল।

‘আমার কপাল ভাল, বিমান নিয়ে টেকঅফ করতে পেরেছি! আর এখন আমার বিমান ফেলে দিতে মিসাইল…’

ডিজিটাল প্লেব্যাক কন্সোলে কাজ করছে ন্যাশনাল রেকোনেসেন্স অফিসের তরুণ এক অ্যানালিস্ট লুক শর্ট।

‘ইউভি-৪ স্ক্যান চালু করে পোলার আইল্যাণ্ডের উপরের আকাশের পরিবেশ পরীক্ষা করুন! মনে হচ্ছে, কেউ চালু করে দিয়েছে অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইস!’

লুক শর্ট অফ করে দিল রেকর্ডিং।

‘ইউভি-৪ স্ক্যানটা আসলে কী? আমরাও কি ওটা ব্যবহার করি?’ জানতে চাইলেন আর্মি জেনারেল।

প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইযার, প্রাক্তন এক ফোর স্টার মেরিন কর্পস জেনারেল কার্টিস উডল্যাণ্ড জবাব দিলেন, ‘ইউভি-৪ আসলে মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরের লাইট স্পেকট্রাম, আলট্রাভায়োলেট স্পেকট্রামের চতুর্থ গ্রেড।’

‘ওই স্ক্যান আমরা পেয়ে গেছি,’ বলল অ্যানালিস্ট লুক শর্ট। চট্ করে দেখল প্রেসিডেন্টকে। ‘কিন্তু, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এসব আলোচনার আগে অন্য একটা বিষয় দেখাতে চাই আপনাকে। তাতে আপনার অতীত বুঝতে সুবিধা হবে। আমরা যখন ইন্টারসেপ্ট করলাম ওই বার্তা, তখন এনআরও রিস্ক্যান করেছে আমাদের সব স্যাটালাইট ইমেজ। সেটা গত দুই মাস আগের আপার আর্কটিকের ছবি। ব্যবহার করা হয়েছে ইউভি-৪। এর ফলে আমরা পেয়েছি নিখুঁত স্ক্যান। কাজে লাগানো হয়েছে ছয়টি মাল্টি স্পেকট্রাম আইএমআইএনটি রেকোনেসেন্স স্যাটালাইট। ইউভি-৪ স্পেকট্রাম ব্যবহার করে পুরো ছয় সপ্তাহ আগের উত্তর হেমিস্ফেয়ারের তথ্য পাওয়া গেছে।’

এবার স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি স্যাটালাইট স্ক্যানের দৃশ্য।

তাতে দেখা গেল, নর্থ পোলের উপরের নর্দান হেমিস্ফেয়ার। অপেক্ষাকৃত বড় সব দ্বীপ ভ্যালবার্ড, ফ্রান্য জোসেফ ল্যাণ্ড ও সেভারনিয়া যেমলিয়া, তারপর ইউরোপ, রাশা, চায়না, জাপান, উত্তর প্যাসিফিক এবং শেষে ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা ও কানাডা।

বলতে গেলে কিছুই নয়, কিন্তু পোলের খুবই ছোট একটা দ্বীপ থেকে বেরোতে শুরু করেছে কালো, ঘন মেঘের মত ধোঁয়া। ওই ধোঁয়া বাস্তবে স্বচ্ছ, কিন্তু ইউভি ফিল্টারের কারণে দেখাচ্ছে কালো।

ধোঁয়ার মত ওই বাষ্প তৈরি হচ্ছে ছোট্ট একটা বিন্দু থেকে। বিন্দুটার নাম পোলার আইল্যাণ্ড।

এবার ব্যাখ্যা দিল লুক শর্ট, ‘আমি আগেই বলেছি, এই ইমেজ দেড় মাস আগের। তাতে আপনারা দেখছেন, আর্কটিকের পুরনো সোভিয়েত ওয়েপন্স, ল্যাবোরেটরির কমপ্লেক্স বা পোলার আইল্যাণ্ড থেকে তৈরি হচ্ছে ওই ধোঁয়া বা বাষ্প।

‘দেখে মনে হচ্ছে ধোঁয়া আটকে গেছে আকাশে,’ বললেন আর্মি জেনারেল। ‘ওটা তৈরি হয়েছে আইসল্যাণ্ডের আগ্নেয়গিরি থেকে?’

জবাবে লুক শর্ট বলল, ‘অ্যাটমোসফেরিক ডিসপারসাল প্রায় একইরকম হয়। কিন্তু আসলে মেঘের মত নয়। ভলকানিক মেঘ তৈরি হয় ধুলোর মত পাথরের কণার কারণে। কিন্তু এই মেঘ খুদে গ্যাসের কণা। সব আটকা পড়ছে নিম্ন ও মধ্য অ্যাটমোসফিয়ারে।

‘এতই মসৃণ ও মিহি, চোখে পড়ে না। দূরের রাস্তায় সূর্যের তাপের কারণে যেমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়, এটা অনেকটা তেমনই। কিন্তু আলট্রাভায়োলেট স্পেকট্রামে পরিষ্কার চোখে পড়ে। আসলে ওই জিনিস একটা কম্পাউণ্ড থেকে তৈরি- ট্রাইইথাইলবোরেন বা টিইবি। আর ওই টিইবি নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা উনিশ শ’ সত্তর ও আশির দশকে।’

‘টিইবি আসলে কী? ওটা নিশ্চয়ই বাতাসে ভেসে ওঠা বিষ নয়?’ জানতে চাইলেন নেভির অ্যাডমিরাল।

‘তা নয়, বিষাক্ত নয়, তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি বিপজ্জনক,’ বললেন এয়ার ফোর্সের জেনারেল। ‘টিইবি প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরক, সাধারণত জমাট অবস্থায় মজুদ করা হয়। জিনিসটা আসলে রকেট ফিউয়েল। নিজেরাও আমরা ব্যবহার করি। টিইবির পায়রোফোরিক কমপাউণ্ড ব্যবহার করা হয় এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ডের র‍্যামজেট ইঞ্জিনের জন্যে। যখন ট্রাইইথাইলঅ্যালুমিনাম মিক্স করা হয়, ইগনাইটেড হয় স্যাটার্ন-ভি রকেটের ইঞ্জিন।’

দুনিয়ার সবচেয়ে দাহ্য পদার্থ,’ প্রেসিডেন্টকে জানালেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইযার। ‘বিপুল শক্তি নিয়ে জ্বলে উঠে ছারখার করে দেয় চারপাশ।’

সিআইএ এবং ডিআইএ-র পারসোনেলদের দিকে ফিরলেন তিনি। ‘আমি টিইবির লিকুইড সম্পর্কে জানি, ওটার অন্য রূপ জমিয়ে রাখতে হয় হেক্সোন সলিউশনে- আমার ধারণা রাশানরা হেক্সোন ট্যাঙ্কে জিনিসটা জমিয়ে রাখে।

‘অন্যান্য বেসে তাই করে,’ সায় দিলেন ডিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর। ‘কিন্তু পোলার আইল্যাণ্ডের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। ওটা স্পেশাল। আমাদের তথ্য ঠিক থাকলে, আশির দশকে ওই দ্বীপ ছিল স্রেফ আতঙ্ক। পোলার আইল্যাণ্ড ছিল ক্লাসিফায়েড ফ্যাসিলিটি। ওখানে যা খুশি করত সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সব টেস্ট চালাত ওরা। এক্সপেরিমেন্টাল ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক ওয়েপন্স, মাংসখেকো পোকা, মলিকিউলার অ্যাসিড, এক্সপ্লোসিভ প্লাযমা, বিশেষ নিউক্লিয়ার ওয়েপন, নানান জাতের হাইপারটক্সিক পয়জন— সবই পরীক্ষা হতো ওখানে।

‘কোল্ড ওঅরের শেষ কয়েক বছরে পোলার আইল্যাণ্ডে অন্য সব গবেষণার পাশাপাশি সোভিয়েত রিসার্চ চলছিল ভেনিউসিয়ান অ্যাটমোসফেরিক গ্যাসের ওপর। এসব গ্যাস ছিল হাইলি টক্সিক। ভেনেরা প্রোবের মাধ্যমে মহাকাশ থেকে সোভিয়েতরা সংগ্রহ করেছিল এসব গ্যাস। আমাদের ধারণা, তারা বেশকিছু ভেনিউসিয়ান গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল টিইবি।

‘সোভিয়েতরা এমন অ্যাসিড বৃষ্টি চাইছিল, যেটা মানুষের ত্বক গলিয়ে দেবে। আপনারা হয়তো জানেন, ভেনাসের অ্যাটমোস- ফিয়ারে ওই অ্যাসিড বৃষ্টিপাত হয়। সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার ওপর ওই ধরনের বৃষ্টি ফেলা। কোনও দেশ যদি ভেনিউসিয়ান গ্যাসের মেঘ তৈরি করে তার সঙ্গে মেশাতে পারে টিইবি, এবং ওই মেঘ মিশিয়ে দিতে পারে প্যাসিফিকের জেটস্ট্রিমে, পরিবেশ সঠিক থাকলে ওই মেঘের অ্যাসিড-বৃষ্টি পড়বে আমেরিকার ওপর।

‘পোলার আইল্যাণ্ডের অবস্থান কোনও দৈব ঘটনা নয়, ওটা বসে আছে পৃথিবীর মাথার ওপরে। আর ওখান থেকেই শুরু হচ্ছে স্পাইরাল উইণ্ড প্যাটার্ন, আমরা যেটাকে বলি জেটস্ট্রিম। পোলার আইল্যাণ্ডের ওপরের আকাশে কিছু তুলে দিলে ওটা ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ, দক্ষিণ রাশা, চিন, দক্ষিণ এশিয়া, জাপান এবং শেষে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকায়। ওই একই বায়ু-প্রবাহ আইসল্যাণ্ডের আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মেঘ উড়িয়ে আনে ইউরোপে। কিন্তু আমরা যে মেঘ আজকে দেখছি, ওই মেঘ… চুপ হয়ে গেলেন ডিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর।

না জানি কী ভয়ঙ্কর বিষয়ে শুনতে হয়, সেজন্য নীরবে অপেক্ষা করছেন সবাই।

থমথম করছে সিচুয়েশন রুম।

‘সোভিয়েতরা ওই মেঘ তৈরি করতে পারেনি, টিইবি বেড় অ্যাসিড বৃষ্টি প্রজেক্ট কখনও টেস্ট ফেয পার করেনি। কিন্তু সেসব পরীক্ষা করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল আরও অনেক ভয়ঙ্কর এক দানব।

‘সায়েন্টিফিক ওয়েপন্স কমিউনিটিতে গুজব আছে: টিইবি/ ভেনিউসিয়ান গ্যাসের কম্পাউণ্ড দিয়ে অন্য জিনিস সৃষ্টি হয়েছিল। দাহ্য গ্যাসের মেঘ অ্যাটমোসফিয়ারে মিশে যাওয়ার পর শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে ওখানে আগুন জ্বেলে দিলে শুরু হবে ‘অ্যাটমোসফেরিক ইনসিনারেশন ইভেন্ট।’

‘কী বললেন?’ জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

‘আকাশ-মাটি জুড়ে নেমে আসবে আগুনের লেলিহান শিখা! সায়েন্স বলছে: গোটা দুনিয়া জ্বেলে দেয়ার জন্যে লাগবে এমন ডিভাইস, যেটা প্রচণ্ড শক্তিশালী হবে। আর তা-ই করতে পারে থারমোবেরিক ওয়েপন বা ফিউয়েন-এয়ার বম। একবার ওই বোমা জ্বলে উঠলেই বাতাসের অক্সিজেনকে রসদ করে জ্বলতে থাকবে সে আগুন। ওয়েপন্স স্পেশালিস্টরা ওটাকে বলেন টেসলা ডিভাইস। শব্দটা এসেছে বিখ্যাত নিকোলা টেসলার নাম থেকে। তিনি এমনই এক অস্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন; যেটা গোটা অ্যাটমোসফিয়ার জুড়ে আগুন ধরিয়ে দেবে।

‘কিন্তু ওরকম অস্ত্র তৈরি করতে হলে অ্যাটমোসফিয়ারে চাই বিপুল পরিমাণের গ্যাস। আরও চাই এমন এক ডিভাইস, যেটা জ্বেলে দেবে পরিবেশে আগুন। হতে পারে সেটা সেমি-নিউক্লিয়ার বোমা। আমরা আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করে এসেছি, সোভিয়েতরা ওই ধরনের কোনও ডিভাইস তৈরি করতে পারেনি।’

খুক-খুক করে কাশলেন কে যেন।

ভদ্রলোক সিআইএ-র রিপ্রেযেক্টেটিভ।

আরেকবার গলা খাঁকারি দিয়ে প্রথমবারের মত মুখ খুললেন, ‘কথাটা বোধহয় সঠিক হলো না। চারপাশের সবাইকে দেখে নিলেন। ‘আসলে কোল্ড ওঅরের সময়ের একটা অতীত রয়ে গেছে পোলার আইল্যাণ্ডে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সে আমলে সোভিয়েতরা ভয়াবহ সব এক্সপেরিমেন্ট করেছিল ওই দ্বীপে। সেসময় কাটিং এজ সায়েন্স নিয়ে চর্চা হয়েছিল। কোনও সীমানা মানা হয়নি। ধর্ম-নীতি-সমাজ-রাজনীতি কিছুই পাত্তা দেয়া হয়নি। রাশার সেরা ফিযিসিস্টদেরকে ওখানে সব ধরনের গবেষণা করতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসব প্রতিভা কাজ করেছে বিপজ্জনক সব বিষয় নিয়ে। বাদ পড়েনি ভেনাস স্যাম্পলও। মোট কথা, সব ধরনের মৃত্যু নিয়ে গবেষণা হয়েছিল ওই দ্বীপে। সোভিয়েত আর্মির স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেটের মাথার মুকুট ছিল আর্কটিকের পোলার আইল্যাণ্ড। ওখানে সায়েন্টিস্টরা যা খুশি করেছে। ওদের পোলার আইল্যাণ্ড আসলে ছিল আমাদের লস অ্যালামসের এরিয়া ৫১ আর প্লাম আইল্যাণ্ডের মিশ্রণ।

‘কিন্তু উনিশ শ’ একানব্বুই সালে ইউএসএসআরের পতনের ফলে বর্জন করা হয় পোলার আইল্যাণ্ডের সমস্ত প্রোগ্রাম। ওখানে রয়ে গেল দানবীয় সব স্থাপনা ও কদর্য জিনিসগুলো। প্রশ্ন উঠল, কীভাবে ধ্বংস করা হবে সেসব? শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো: রাশানরা ওখানে স্কেলিটন ক্রু রাখবে। নিভু নিভু পিদিমের সলতের মত পোলার আইল্যাণ্ডে সামান্য বাতি জ্বেলে রাখা হলো। স্থির হলো, ওখানে আনস্টেবল লিকুইডগুলো যেন বিধ্বংসী হয়ে না ওঠে, সেজন্য নজর রাখা হবে সেগুলোর ওপর। এককথায়: আজও পোলার আইল্যাণ্ড তেমনি বীভৎস প্রেতের বাসা।’

প্রেসিডেন্টের দিকে চাইলেন তিনি। ‘এবং বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু, স্যর, এটা আপনাকে জানানো আমার ডিউটি- সত্যিই রাশানরা টেসলা ডিভাইস তৈরি করেছিল। ওটা আছে পোলার আইল্যাণ্ডে।

‘নাম দেয়া হয়েছিল ‘অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন’। ওই ডিভাইসে দুটো স্তর আছে। প্রথম স্তর: পোলার আইল্যাণ্ডের প্রকাণ্ড দুই ভেণ্টের মাধ্যমে দাহ্য গ্যাস অ্যাটমোসফিয়ারে পৌছে দেয়া। এবং দ্বিতীয় স্তর: প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে ওই গ্যাসে আগুন জ্বেলে দেয়া। ওই বিস্ফোরক আসলে প্রায় নিউক্লিয়ার বোমার মতই। তৈরি করা হয়েছে করাপটেড ইউরেনিয়াম-২৩৮ দিয়ে। অনেকে ওটাকে বলেন: ‘শোণিত ইউরেনিয়াম’ বা ‘লাল ইউরেনিয়াম’। গাঢ় লাল রঙের কারণে ওই নাম হয়েছে। হলদে কেকের ইউরেনিয়ামের সমান পোটেণ্ট বা রেডিয়োঅ্যাকটিভ নয় লাল ইউরেনিয়াম। তবে ওটার ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাটমিক গঠনের কারণে টিইবির সঙ্গে অনেক গভীরভাবে মিশতে পারে। সাধারণ থারমোনিউক্লিয়ার ব্লাস্টের চেয়ে খুব কম ক্ষতি করে না। এবং সাধারণ নিউক্লিয়ার বোমা থেকে এত পরিমাণে গ্যাসের মেঘও তৈরি হবে না।

‘ছোট হয় লাল ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার, আকারে বড়জোর গলফ বলের সমান। সাধারণ বেরিলিয়াম ব্রিজওয়ায়ার ইমপ্লোসিভ ডেটোনেটার ব্যবহার করলেই চলে। সব নিউক্লিয়ার ওয়েপনে ওই জিনিসই থাকে। লাল ইউরেনিয়ামের ইউনিট মিসাইলের মাধ্যমে গ্যাসের মেঘে ফাটিয়ে দিলেই, সে বিস্ফোরণের ফলে তৈরি হবে গ্যাসের ভেতর বিপুল তাপ। চেইন রিয়্যাকশনে শুরু হবে ভয়ানক সাদা উত্তপ্ত অ্যাসিডের আগুন। তা আবার বিদ্যুদ্বেগে ছড়িয়ে পড়বে নর্দান হেমিস্ফেয়ারে। জ্বলবে গোটা পরিবেশ। জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠির সাহায্যে অকটেন জ্বেলে দেয়ার মতই, কিন্তু ওই দাউ-দাউ আগুনের ঝড় ছেয়ে ফেলবে গোটা দুনিয়াকে।’

অবিশ্বাস নিয়ে আস্তে করে মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট। ‘কে তৈরি করেছে ওই জিনিস? যদি ওই ডিভাইসের কারণে সর্বনাশ হয় নর্দান হেমিস্ফেয়ারের, তা হলে তো ধ্বংস হবে রাশানরাও।’

‘কথাটা ঠিক, এবং সেজন্যেই তৈরি হয়েছে ওই ডিভাইস,’ বললেন ডিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর কনি হল। ‘এ ধরনের ডিভাইসের কাজই আকাশ-মাটি চারপাশ পুড়িয়ে দেয়া। রাশানরা ভেবেছিল যুদ্ধে হারলে তখন ওটা ব্যবহার করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা বুঝল হারবে, তখন পিছিয়ে যাওয়ার সময় জ্বেলে ছারখার করে দিল খামারগুলো। ব্যবহার করেছিল পোড়া মাটি নীতি। চিন্তাটা ছিল এমন: আমরা যখন হেরেই যাচ্ছি, তা হলে বিজয়ীদের জন্য এমন কিছু রাখব না, যা তাদের কাজে লাগবে।

‘সোভিয়েতদের ওই অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন ঠিক একই জিনিস। সত্যিই যদি ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা আইসিবিএম দিয়ে সোভিয়েতদের উপর হামলা করত, হয়তো যুদ্ধে হারত ইউএসএসআর। সেক্ষেত্রে সোভিয়েতরা ব্যবহার করত অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন। বিজয়ীদের জন্য পোড়া মাটি ছাড়া কিছুই রাখত না।’

‘কিন্তু ওই অস্ত্র শুধু তাদের দেশের সর্বনাশ করত না, গোটা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের সবকিছুই শেষ করে দিত,’ বললেন প্রেসিডেন্ট।

‘ঠিক তা-ই,’ বললেন কনি হল। ‘কিন্তু মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সত্যিই যদি কেউ পোলার আইল্যাণ্ড দখল করে থাকে, সে হয়তো চালু করে দিয়েছে টেসলা ডিভাইস। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় মস্ত বিপদে পড়েছি আমরা সবাই। অবশ্য সঠিক সময়ে সতর্ক হওয়া গেছে। পোলার আইল্যাণ্ড যে-ই দখল করে থাকুক, দাহ্য গ্যাস অ্যাটমোসফিয়ারে অ্যারোসলের মত ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় পেতে হবে তাকে। ওই অস্ত্র কাজে লাগাতে হলে লাগবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।’

সিচুয়েশন রুমের প্রায় সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

কিন্তু এনআরও-র রিপ্রেযেক্টেটিভ লুক শর্ট মস্ত ঢোক গিলল।

‘সেক্ষেত্রে আপনারা এটা দেখেননি,’ কোলে রাখা ল্যাপটপ কমপিউটারের স্ক্রিনে নতুন ইমেজ এনেছে সে। ‘এই ইমেজ নেয়া হয়েছে চার সপ্তাহ আগে।’

মনিটরে পৃথিবীর দুটি চিত্র সবাইকে দেখাল সে।

প্রথম চিত্রে পোলার আইল্যাণ্ড থেকে দক্ষিণে হাত বাড়িয়েছে কালো মেঘের দল।

দ্বিতীয় চিত্রে, অনেক ছড়িয়ে গেছে ওই কালো মেঘ।

‘এই যে ছবিটা আপনারা দেখছেন, এটা দুই সপ্তাহ আগের।’

এবার তৃতীয় আরেকটা চিত্র আনল লুক শর্ট মনিটরে।

‘আর শেষ এই ছবি নেয়া হয়েছে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে। যখন ডিসট্রেস সিগনাল ধরলাম আমরা।’

তৃতীয় চিত্রে কৃষ্ণ মেঘে ক্রমশ ঢাকা পড়ছে রাশার দক্ষিণ দিক এবং ইউরোপ হারিয়ে গেছে। ওই কালো মেঘের নীচে আড়াল পড়েছে এশিয়া। রক্ষা পেয়েছে শুধু অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার নীচের অর্ধেক।

‘সর্বনাশ…’ শ্বাস আটকে ফেললেন কে যেন।

‘যিসাস…’

কালচে মেঘে ছেয়ে গেছে গোটা নর্দান হেমিস্ফেয়ার। ঢাকা পড়েছে পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থলভূমি। দেখে মনে হচ্ছে, বিপুল তেল পড়েছে এ গ্রহের উপর। তফাৎ হচ্ছে, ওই কালো জিনিস

ভাসছে বাতাসে। লুক শর্টের ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে হতবাক হয়ে গেছেন ক্রাইসিস রেসপন্স টিম।

‘যে দখল করে নিয়েছে পোলার আইল্যাণ্ড, সে দাহ্য গ্যাস ছাড়ছে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে,’ বলল লুক শর্ট। ‘ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে জেটস্ট্রিমে, এবং বাকি কাজ করেছে ওই বায়ু-প্রবাহ। ওই গ্যাসের মেঘের নীচে ইতিমধ্যেই ঢাকা পড়েছে অর্ধেক পৃথিবী।’

তখনই তরুণ এক অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে ঢুকল রুমে, চট্ করে ডিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর কনি হলের হাতে দিল একটা ট্র্যান্সক্রিপ্ট।

ডেপুটি ডিরেক্টর কাগজটার উপর চোখ বোলালেন, তারপর ঝট্ করে মুখ তুললেন। ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এই বার্তা রাশান এমএএসআইএনটি স্টেশন থেকে এসেছে। এইমাত্র ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছে। রাশান প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে পাঠিয়েছে স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেটের প্রধান। এতে বলা হয়েছে:

স্যর,

অজানা কোনও শক্তি দখল করে নিয়েছে পোলার আইল্যাণ্ড।

স্যাটালাইটের অ্যানালিসিস থেকে জানা গেছে, পোলার আইল্যাণ্ডের অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইস চালু করা হয়েছে বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে। সঠিক সময় একচল্লিশ দিন।

অ্যানালিসিসে আরও জানা গেছে, পোলার আইল্যাণ্ডের আইল্যাণ্ডের ছয়টি ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার উত্তপ্ত করা হচ্ছে কাজে লাগাবার জন্য। সেজন্য লাগে কমপক্ষে বারো ঘণ্টা। আমরা ধারণা করছি, এরই ভিতর সাত ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

অচেনা শত্রুদেরকে ঠেকাবার জন্য আমাদের হাতে আছে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা সময়, এরপর কাজ করবে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন।’

ট্র্যান্সক্রিপ্ট নামিয়ে রাখলেন কনি হল।

ভীষণ থমথমে নীরবতা নামল সিচুয়েশন রুমে।

দেয়ালঘড়ির দিকে চাইলেন প্রেসিডেন্ট। এখন বিকেল পাঁচটা। পোলার আইল্যাণ্ডে সকাল ছয়টা। বেসুরো কণ্ঠে বললেন তিনি, ‘তা হলে কি আপনি বলতে চান আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পর অচেনা একদল শত্রু ফাটিয়ে দেবে ওই সুপারওয়েপন? আর তার ফলে আগুন জ্বলে উঠবে গোটা নর্দান হেমিস্ফেয়ার জুড়ে?’

‘জী, স্যর,’ বললেন কনি হল। ‘পৃথিবী রক্ষা করতে বড়জোর পাঁচ ঘণ্টা সময় পাব আমরা।’

উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট। ‘এক্ষুনি রাশান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলব।’

দড়াম করে খুলে গেল সিচুয়েশন রুমের দরজা।

ভিতরে এসে ঢুকেছে এয়ার ফোর্সের এক মেজর। ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট! এইমাত্র সাইবেরিয়ার ওমস্ক থেকে আইসিবিএম লঞ্চ করেছে রাশানরা। ওটার লক্ষ্য আর্কটিকের একটি দ্বীপ। স্যর, ওরা নিজেদের দ্বীপে নিউক্লিয়ার মিসাইল ফেলছে!’

তিন

ক্রেমলিনের এক পাতাল ঘরে এই মুহূর্তে নিজের ক্রাইসিস রেসপন্স টিম নিয়ে লাইভ ফিড দেখছেন রাশান প্রেসিডেন্ট। সবার চোখ মিসাইল ট্র্যাকিং স্যাটালাইটের পর্দায়।

টিপটিপ করে জ্বলছে নিউক্লিয়ার টিপড্ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের ছবি। ওটা সরাসরি চলেছে পোলার আইল্যাণ্ড লক্ষ্য করে।

‘চার মিনিট পর আঘাত হানবে,’ বলল কন্সোল অপারেটার।

পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে ছুটছে মিসাইল।

মৃত্যু-নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ঘরে।

সবার চোখ ডিসপ্লের উপর।

‘আর মাত্র তিন মিনিট… আরে! কোর্স পাল্টে নিচ্ছে মিসাইল! আসলে কী ঘটছে….

‘খুলে বলো,’ ধমকে উঠলেন রাশান প্রেসিডেন্ট।

‘আমাদের মিসাইল। ওটা… ওটা ফিরতি পথে… সোজা আসছে লঞ্চ সাইলো লক্ষ্য করে!’

.

হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুমে প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর ক্রাইসিস রেসপন্স টিম একই সময়ে একই ধরনের একটা মনিটরে দেখছেন নিউক্লিয়ার মিসাইল ফিরছে রাশার ভূখণ্ডের দিকে।

‘ওদের লঞ্চ সাইট লক্ষ্য করে যাচ্ছে মিসাইল?’ বললেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। ‘তা কী করে সম্ভব?’

‘শত্রুপক্ষ মিসাইলের গাইডেন্স সিস্টেম পাল্টে দিয়েছে,’ নিচু স্বরে বললেন কনি হল।

‘কাজটা করল কে?’

‘যে রয়েছে পোলার আইল্যাণ্ডে।’

‘এটা কি সম্ভব?’

‘আমরা পারি,’ বললেন কনি। ‘দেখাই যাচ্ছে, যে পোলার আইল্যাণ্ড দখল করেছে, সে-ও পারে।’

.

স্ক্রিনের টিপটিপ করা দৃশ্য আতঙ্ক নিয়ে দেখছেন রাশান প্রেসিডেন্ট। লঞ্চ লোকেশন লক্ষ্য করে ফিরে আসছে তাঁদেরই মিসাইল!

তাঁর পাশে কন্সোলের অপারেটার হেডসেটে বলল, ‘ওমস্ক মিসাইল কন্ট্রোল, আমার কথা শুনুন! মিসাইলটা এখন আপনাদের দিকে ফিরছে! …হ্যাঁ, আমরাও দেখছি! সেলফ ডেস্ট্রাক্ট অর্ডার দিন! ….কী বললেন? মিসাইল ফেরাতে পারছেন না?’

কয়েক মুহূর্ত পর সাইবেরিয়ার ওমস্কের লঞ্চ সাইটের তরফ থেকে আর সামান্যতম টু শব্দ এল না।

থমথমে পরিবেশ তৈরি হলো ঘরে, এবং তখনই কথা বলে উঠল দ্বিতীয় কন্সোলের অপারেটার।

রাশান প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরল সে।

‘স্যর, একটা ইনকামিং সিগনাল আসছে পোলার আইল্যাণ্ড থেকে।’

‘স্ক্রিনে তুলে দাও,’ বললেন রাশান প্রেসিডেন্ট

জীবন্ত হয়ে উঠল ভিউস্ক্রিন।

ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছে এক লোক। পরনে স্নো- ক্যামোফ্লেজ আর্কটিক পার্কা, চোখে এলভিস সানগ্লাস।

পার্কার হুড দিয়ে ঢেকেছে মাথা। ওই হুড ও সানগ্লাসের কারণে সামান্যই দেখা যাচ্ছে মুখের অংশ। মুখ বলতে নাক ও চিবুক। বামদিকের কান থেকে চোয়াল পর্যন্ত অ্যাসিডের দগদগে পুরনো ক্ষত, যেন অসংখ্য ফোস্কা— দেখলে শিউরে উঠবে যে কেউ। লোকটাকে টেরোরিস্ট নয়, পিশাচ এক রকস্টার বলেই মনে হচ্ছে।

‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, গুড মর্নিং,’ শান্ত স্বরে নিখুঁত রাশানে বলল লোকটা। ‘আমি নিজের নাম জানাতে পারতাম, কিন্তু বলেই বা কী হবে? আমাকে ডাকতে পারেন বিশৃঙ্খলার সম্রাট হিসাবে, অথবা রাফিয়ান আর্মির একচ্ছত্র জেনারেল বলে। মানুষের আত্মা ও দেহের সর্বনাশ করার বাদশা আমি, ধ্বংসের এমপেরার। …আপনি আমাকে যা-খুশি নামে ডাকতে পারেন। আমার শক্তিশালী, বিজয়ী রাফিয়ান আর্মির একমাত্র নেতা আমি। আমরা একদল ক্ষ্যাপা মানুষ। আমরা গরীব ও ক্ষুধার্তের দল, সমস্ত নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। এমন একদল, যারা বিদ্রোহ করেছি ক্ষমতাশালী আপনাদের সবার বিরুদ্ধে। গৃহস্বামীর দরজার সামনে বসে থাকা ক্ষুধার্ত কুকুর আমরা। কিন্তু আর খালি পেটে থাকতে চাই না। এবার সময় এসেছে আমাদের নিষ্ঠুর ও লোভী মালিকের দিকে ঘুরে চাওয়ার। এবং আমি সেই ধ্বংসের দূত, যার দিকে আপনাদেরকে দ্বিতীয়বার ঘুরে চাইতে হবে।

‘আপনার জঘন্য ছোট্ট দ্বীপ দখল করে নিয়েছি আমি। এবার ব্যবহার করব আপনাদের ভয়ঙ্কর ওই অস্ত্র। এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেনেছেন, আপনারা কোনও মিসাইল লঞ্চ করলে সঙ্গে সঙ্গে তা টের পাব আমরা। আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে দ্বিতীয়বার ভাববেন। আপনাদের মিসাইল গাইডেন্স মোটেও নিখুঁত নয়, সহজেই ওটার বারোটা বাজাতে পারি আমি। আরও মনে রাখবেন, আবার কোনও নিউক্লিয়ার মিসাইল পাঠালে এবার আর লঞ্চ সাইলোর দিকে পাঠাব না, ওটা সোজা পড়বে কাছের বড় কোনও শহরের ওপর। অন্য কোনও দেশ নিউক্লিয়ার মিসাইলের হামলা করলেও, ওই একই হাল হবে সেই দেশের। ভুলেও কোনও বোমারু বিমান বা কাউন্টার টেরোরিস্ট ফোর্স পাঠাবার দুঃসাহস করতে যাবেন না। আমাদের চোখ খোলা, পোলার আইল্যাণ্ডের পাঁচ শ’ মাইলের ভেতর কোনও বিমান এলেই তা ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হবে।

‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি ভাল করেই জানেন আমার কাছে কী ধরনের অস্ত্র মজুদ আছে। আমার দিকে মিসাইল না পাঠিয়ে বরং যাজক ডেকে আপনার ঈশ্বরের সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করুন। অতি মূল্যবান সময়টুকু আপনার ভাল কাজে ব্যয় হোক। আর দেখতে থাকুন কীভাবে আপনাদের সবার ক্ষমতা ধ্বংস করে দিয়ে দুনিয়া জুড়ে কী ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা তৈরি করি।’

দপ্ করে কালো হয়ে গেল স্ক্রিন।

.

হোয়াইট হাউস।

সিচুয়েশন রুম।

এইমাত্র ফোনের ক্রেডলে রিসিভার আছড়ে রাখলেন প্রেসিডেণ্ট। কথা বলেছেন রাশান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে।

‘বিমানে করে যাওয়ার কথা দূর করে দিতে হবে মাথা থেকে,’ বললেন। ‘কাছাকাছি জায়গায় রাশানদের কোনও আর্মি, নেভি বা এয়ারফোর্সের ইউনিট নেই। পাঁচ ঘণ্টার ভেতর পোলার আইল্যাণ্ডের ধারেকাছে পৌঁছতে পারবে না ওরা। …আমাদের নিজেদের কোনও ইউনিটও নেই ওদিকে? কী ধরনের অ্যাসেট আছে আমাদের ওখানে, কাছেপিঠে? এমন কোনও দল বা কেউ, যারা বা যে গোপনে উঠবে গিয়ে ওই দ্বীপে? সাগর বা বরফের ওপর দিয়ে পৌছানো সম্ভব? প্রলয় ঘনিয়ে আসছে দুনিয়া জুড়ে।’

‘আমি দুঃখিত, স্যর, ওদিকে আমাদের কোনও অ্যাসেট নেই.’ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এয়ার ফোর্সের জেনারেল।

‘আর্মিরও নেই, স্যর,’ আস্তে করে মাথা নাড়লেন আর্মির

জেনারেল।

‘আমাদের আছে,’ বললেন নেভির অ্যাডমিরাল। ‘ওই দ্বীপ থেকে উত্তর-পুবে সত্তর নটিকাল মাইল দূরে আমাদের একটা সাবমেরিন আছে। ওখান থেকে পাঠানো যায় সিল টিম। নটি এরিক আর তার দলের ছেলেরা। আর্কটিকে ট্রেনিং নিচ্ছে। খুবই দক্ষ সৈনিক। কাছে আছে, লড়তেও জানে। তিন ঘণ্টার ভেতর ওখানে পৌঁছুতে পারবে ওরা।’

‘পরিস্থিতি জানান ওদেরকে, নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট। ‘বলুন, এখনই রওনা হোক। স্যাবোটাজ করতে হবে। নষ্ট করতে হবে ওই ভয়ঙ্কর অস্ত্র, সম্ভব হলে ধ্বংস করতে হবে। পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে রওনা হোক ওরা, আর এদিকে তৈরি রাখুন বড়সড় কোনও ইউনিটকে। সিল টিম অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন বিকল করলেই যেন পরের দল গিয়ে হামলা করতে পারে।’

আর সবাই কথা শুনতে ব্যস্ত, কিন্তু মেরিন কর্পসের জেনারেল চলে গেছেন ঘরের কোণে, কথা বলছেন সিকিয়োর ফোনে। কথা শেষে ফোন রেখে প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরলেন তিনি। ‘স্যর, বলা যায় আমাদেরও সামান্য অ্যাসেট আছে ওদিকে।’

‘কী সেটা?’

‘কিছুদিন আগে বাছাই করা মেরিনদের সঙ্গে বাংলাদেশ আর্মির কয়েকজন অফিসার ও সৈনিকদের নিবিড় একটা ট্রেনিং হয়েছিল আর্কটিকে। মেরিন ফোর্স ও বাংলাদেশ আর্মির প্রায় সবাই ট্রেনিং শেষে ফিরে গেছে যার যার দেশে। তবে রয়ে গিয়েছিল মেরিন এক ক্যাপ্টেন ও এক কর্পোরাল। তারা আছে ছোট একটা বাংলাদেশি ইকুইপমেন্ট টেস্টিং টিমের সঙ্গে। আমরা মেরিন ক্যাপ্টেন এবং কর্পোরালকে আসলে ওখানে রেখেছি দুটো কারণে। প্রথম কথা, ওরা আমাদের তৈরি কিছু যন্ত্রপাতি আর্কটিকে কেমন কাজ করবে, তা পরীক্ষা করবে। দুই, জানবে কী করছে বাংলাদেশি টেস্টিং টিম।’

‘মেরিনরা আমাদের নির্দেশ মানবে, কিন্তু বাংলাদেশি বৈজ্ঞানিক টিম আমাদের সাহায্যে আসবে কেন?’ ভুরু কুঁচকে চাইলেন প্রেসিডেণ্ট।

‘হয়তো সাহায্যে আসবে, স্যর। মেরিনদের কাছ থেকে সব ধরনের অস্ত্র দেয়া হয়েছিল তাদেরকে। এখন ওই টিম আছে পোলার আইল্যাণ্ড থেকে এক শ’ মাইল দূরে, উত্তরদিকে। ক্যাম্প করেছে সাগরে ভাসমান বরফের মাঠে। আর ওই দলের নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেই দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা। আপনি অনুরোধ করলে ওই প্রাক্তন মেজর আর দুর্দান্ত মহিলা ক্যাপ্টেন হয়তো সাহায্য করবে। দু’জনই দক্ষ কমাণ্ডো যোদ্ধা।’

‘মাসুদ রানার সঙ্গে যে মহিলা ক্যাপ্টেন, তার নাম কি নিশাত সুলতানা?’ জানতে চাইলেন প্রেসিডেণ্ট।

‘জী, স্যর।’

‘মাসুদ রানা আর নিশাত সুলতানা কয়েকবার আমার প্রাণ রক্ষা করেছিল এয়ার ফোর্সের এরিয়া নাইন বেসে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালই হতো,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘কিছুদিন আগে মাসুদ রানার ব্যাপারে ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। অনুরোধ করি, ফ্রেঞ্চ মিলিটারি যেন ওর মাথার ওপর থেকে মৃত্যু-পরোয়ানা তুলে নেয়।’

‘শুনেছি, স্যর, ফরাসি প্রেসিডেন্ট রাজি হননি। মাসুদ রানার মাথার ওপর ঘোষণা করা হয়েছে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার বাউন্টি।’

‘তা-ই আসলে। সত্যিকারের যোগ্য মানুষ মাসুদ রানা ও নিশাত সুলতানা। বিশেষ করে মাসুদ রানা। বোধহয় বিসিআই থেকে তাকে বলে দেয়া হয়েছে, কিছুদিন আড়ালে থাকতে হবে।’

‘জী, স্যর। আগেও দু’বার খুন করতে চেয়েছে ফ্রেঞ্চরা মাসুদ রানাকে। ওই কারণেই তাকে আর্কটিকে লোকের চোখ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’

‘ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট আমার অনুরোধের জবাবে কী বলেছিলেন জানেন?’ তিক্ত হাসলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। বলেছিলেন, মোসিউ, ফিন্যান্স, ট্রেড, আফগানিস্তান, এমনকী ইরানের বিষয়েও আপনার অনুরোধ আমার পক্ষে রাখা সম্ভব, কিন্তু ওই মাসুদ রানার বিষয়ে কোনও অনুরোধ আমার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ওই লোক ফ্রেঞ্চ সৈনিকদের খুন করেছে, ধ্বংস করেছে আমাদের একটা সাবমেরিন, ডুবিয়ে দিয়েছে একটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। তাকে হত্যা না করা পর্যন্ত থামবে না দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স।

আস্তে করে মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট। ‘না, এখন আমি মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। সে হয়তো রাজিও হবে না আমাদের হয়ে কাজ করতে। কিন্তু অন্য উপায় আছে। বিসিআই-এর চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানকে অনুরোধ করব। তাঁকে বোঝাতে পারলে তিনি হয়তো নির্দেশ দেবেন নিজের প্রিয় এজেন্টকে। আশা করি, সিল টিমকে পিছন থেকে ব্যাক করবে মেজর মাসুদ রানা।’

চার

আর্কটিক আইস ফিল্ড।

সকাল আটটা তিরিশ মিনিট।

দু’পাশে বরফের খাড়া দেয়াল, মাঝ দিয়ে বহুদূরে গেছে সরু, আঁকাবাঁকা খাল। তুমুল গতি তুলে ছুটছে দুই অ্যাসল্ট বোট।

গতিবেগ ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটার।

নিঃশব্দে চলছে স্টেট-অভ-আর্ট পাম্পজেট ইঞ্জিন। বোটের খোল বুলেট আকৃতির। প্রায় একই জিনিস তৈরি করেছে আমেরিকার ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি। কিন্তু তাদের বোটের চেয়ে অনেক আধুনিক এই দুই বোট, দু’পাশে ঢেউ তৈরি করে ছুটছে তীরগতিতে।

এসব বোট প্রোটোটাইপ এএফডিভি- অ্যাসল্ট ফোর্স ডেলিভারি ভেহিকেল। তৈরি করা হয়েছে বিসিআই, বাংলাদেশ আর্মি ও নেভির জন্য। যাতে দ্রুত, নিঃশব্দে পৌছতে পারে শত্রু এলাকায়। দেখতে প্রায় ছোট যোডিয়াকের মতই। কিন্তু আরও সরু, পানির সঙ্গে মিশে থাকে আল্ট্রা থিন ইনফ্লেটেবল রিম। এখনও বিসিআই ও সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়নি।

প্রথম বোটের উপর মোটরসাইকেলের আসনের মত সিট। সামনে বসে সাঁই-সাঁই ছুটছে বিসিআইএ এজেণ্ট মাসুদ রানা।

ওর বয়স প্রায় আটাশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। বেশিরভাগ সময় ক্রু কাট থাকে কালো চুল। ক্লিন শেভড। কিন্তু সাত সপ্তাহ আর্কটিকে কাটিয়ে মাথায় গজিয়ে উঠেছে দামাল চুল, গালে ও ঠোঁটের ওপর দাড়ি-গোঁফ। রুক্ষ হয়ে উঠেছে চেহারা। চোখদুটো ওর কুচকুচে কালো, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। অবশ্য আপাতত মায়াময় ওই দুই চোখ ঢাকা পড়েছে নীল মিলিটারি-গ্রেড ওকলে ব্যালেস্টিক সানগ্লাসে। মুখের নীচের অংশ স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। ওকে দেখতে লাগছে অতীত কালের জেসি জেমসের মত। তুমুল বাতাসে ওড়া ঝিরঝিরে তুষার থেকে বাঁচতে চাইছে সানগ্লাস ও স্কার্ফ পরে।

প্রথম অ্যাসল্ট বোটের কমপ্যাক্ট রিয়ার ট্রে-র উপর রানার পিছনে তিনজন আরোহী। প্রথমজন তরুণ এক মেরিন সৈনিক, অন্য দু’জন সিভিলিয়ান। একজন যুবক, অন্যজন তরুণী। তারা বাংলাদেশি এই টেস্টিং টিমের সদস্য।

দ্বিতীয় বোট ড্রাইভ করছে রানার বিশ্বস্ত সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড, বাংলাদেশ আর্মির মহিলা ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা।

ঝাড়া ছয় ফুট লম্বা, দানবীর মতই শক্তিশালী। ওর অ্যাসল্ট বোটের পিছনে আরও দুই যাত্রী। প্রথমজন মেরিন ফোর্সের এক ক্যাপ্টেন, অন্যজন আমেরিকান এক আর্মস কন্ট্রাক্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

দু’ঘণ্টা আগে বিসিআই ও ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস থেকে এসেছে জরুরি বার্তা। এর পর পর দেরি না করে সব গুছিয়ে নিয়ে ওর দলবলসহ রওনা হয়েছে রানা। তার আগে সবাইকে খুলে বলা হয়েছে কতটা ভয়ঙ্কর ও গুরুতর হয়ে উঠেছে পোলার আইল্যাণ্ডের পরিস্থিতি। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের তরফ থেকে এসেছে একগাদা সিকিয়োর ডেটা। সবই ডিজিটাল ডকুমেণ্ট।

তার ভিতর রয়েছে পোলার আইল্যাণ্ড দখল করে নেয়া রহস্যময় এক লোকের সঙ্গে রাশান প্রেসিডেন্টের এমপিইজির সাক্ষাৎকার। দস্যু এক সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা বলে নিজেকে দাবি করেছে ওই লোক। আমেরিকার ডিআইএ-র রিনা গর্ডন নামের একজন উল্লেখ করেছে: গত কিছুদিনের ভিতর সাতটি স্থাপনায় হামলা করেছে এই রাফিয়ান আর্মি। এ ছাড়া মহিলা পাঠিয়েছে পোলার আইল্যাণ্ডের একটি ম্যাপ। কোঅর্ডিনেটস দেয়া হয়েছে বেরিভ বিমান কোথায় ক্র্যাশ করেছে।

সংক্ষিপ্ত আরেকটি ডকুমেন্ট এসেছে। তাতে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কী জিনিস অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন। পোলার আইল্যাণ্ডের ওই ডিভাইসে রয়েছে কিছু কমপোনেন্ট পার্টস। গ্যাস উৎক্ষেপ করছে দ্বীপের দুই প্রকাণ্ড ভেণ্ট। এ ছাড়া রয়েছে ছয়টি লাল ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার। ওগুলোর একটা নিয়ে আকাশে রওনা হবে মিসাইল, বিস্ফোরিত হবে গ্যাসের মেঘের ভিতর। রানাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ওরা যদি ওই ভেণ্ট, ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার বা মিসাইল— তিনটি জিনিসের একটিও স্যাবোটাজ করতে পারে, থামিয়ে দেয়া যাবে ওই ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র।

রানা বুঝে গেছে, ওই ভেণ্ট ধ্বংস করে লাভ হবে না। প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে ওগুলো দিয়ে আকাশে তুলে দেয়া হয়েছে গ্যাস। আসলে এখন মাত্র দুটো কাজ করতে পারে ওরা। নষ্ট করতে পারে মিসাইল, অথবা চুরি করতে পারে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।

ওকে আরও জানানো হয়েছে, দ্বীপের কাছে পৌছে গেছে লস অ্যাঞ্জেলেস-ক্লাস সাবমেরিন ইউএসএস নিউ মেক্সিকো, ওটাতে রয়েছে সিল টিম। তারাই আগে হামলা করবে ওই দ্বীপে।

পোলার আইল্যাণ্ডের মানচিত্র দেখে অস্বস্তি বোধ করেছে রানা। ওর মনে হয়নি সামান্যতম সুযোগ পাবে আমেরিকান সৈনিকরা, যেন চলেছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।

ওই দ্বীপ আসলে প্রাকৃতিক দুর্গ, তীর বা ক্লিফগুলো কমপক্ষে এক শ’ ফুট উপরে। খাড়াভাবে নেমেছে সাগরে।

মাত্র দুটো জায়গায় ওই পাথুরে দ্বীপের দুটি অংশ নেমে এসেছে সাগর সমতলে।

ব্যবহার করা যেতে পারে ঊনবিংশ শতাব্দীর তিমি মাছ শিকারিদের পরিত্যক্ত গ্রাম, আর রয়েছে একটা সাবমেরিন ডক। কিন্তু ওই দুই জায়গায় আবার রয়েছে শক্তিশালী রক্ষাব্যূহ— বেড়া, দেয়াল, গান এমপ্লেসমেন্ট ও ওয়াচটাওয়ার।

তৃতীয় এক জায়গা আছে।

পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর তীরের কাছে রয়েছে তিনটে ছোট ছোট দ্বীপ, ওদিক দিয়েও ওঠা যাবে মূল দ্বীপে। দ্বীপে।

কিন্তু ওই দিকে শক্ত পাহারা থাকবে।

সংক্ষেপে বললে, হামলাকারী কোনও দলের জন্য ওই দ্বীপ দখল করে নেয়া প্রায় অসম্ভব।

দক্ষ একদল সৈনিকের ছোট কোনও গ্যারিসন পাহারা দিলেও, বড় একদল হামলাকারীকে ঠেকিয়ে দিতে পারবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।

এসব ভাবছে রানা, এমন সময় ইউএলএফ সিগনাল এল ইউএসএস নিউ মেক্সিকো থেকে।

পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে রওনা হয়েছে ওই সাবমেরিন।

রানাদের কমপক্ষে একঘণ্টা আগে তারা পৌছবে ওই দ্বীপে।

সংক্ষিপ্ত এবং একপেশে কথা বলল সিল কমাণ্ডার। তার নাম হাতুড়িমাথা নটি এরিক।

‘ওখানেই গ্যাঁট মেরে বসে থাকো, মাসুদ রানা,’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘যা করার আমরাই করছি।’

‘তোমরা একঘণ্টা অপেক্ষা করলে আমরাও তোমাদের সঙ্গে আক্রমণে যেতে পারি,’ রাগ চেপে বলল রানা। ‘এখনও তো জানা গেল না ওরা কতজন দ্বীপে। আমার মনে হয়…’

‘আমি অপেক্ষা করব না, আর তোমাদের কারও সাহায্যও লাগবে না,’ বলল হাতুড়িমাথা। ‘এ ধরনের মিশনে বহুবার গেছি। কারও বাপের সাধ্যি নেই প্রশিক্ষিত সিল টিমকে ঠেকাবে। কাজেই পরিষ্কার ভাষায় তোমাকে বলে দিচ্ছি, মাসুদ রানা- এসব থেকে বাইরে থাকো। আমরা ওই দ্বীপে উঠব, তারপর চোখের সামনে যাকে পাব তাকেই খুন করব। চাই না তুমি পরে এসে লেজের গোড়ায় গুয়ের মত লেগে থাকো। তা ছাড়া, তোমার সঙ্গে আছেই বা কে? দু’জন মেরিন সৈনিক আর কয়েকজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে কী-ই বা করবে তুমি?’

‘আমরা সাতজন। দুই মেরিন যোদ্ধা। দু’জন বাংলাদেশ আর্মির। এ ছাড়া রয়েছে তিনজন সিভিলিয়ান।’

‘তার মানে, কোনও কাজেই আসবে না। তোমরা বড়জোর বদ্ধ লিফটের ভেতর দুর্গন্ধময় বাতাস ছেড়ে আমাদের বিরক্ত করতে পারো, এর বেশি কিছু না। …ছিহ্, সিভিলিয়ান! বরং দক্ষ পেশাদার লোকের হাতে ছেড়ে দাও কাজটা। চুপ করে বসে থাকো, আর দূর থেকে দেখো বড়দের কাজ-কারবার।’

‘আর ওই বিধ্বস্ত বিমানের কী হবে?’ জানতে চাইল রানা। ‘ওটার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে সব। তোমার উচিত হবে না হামলা শুরুর আগে বেরিভ বিমানটা পরীক্ষা করে দেখা? হয়তো এখনও বেঁচে আছে পাইলট, সেক্ষেত্রে নতুন তথ্য জানতে পারবে। হয়তো জানা যাবে কীভাবে নষ্ট করা যায় ওই ডিভাইস।’

‘মরুক চুতিয়া বিমান আর ওর চুতিয়া পাইলট। এরই ভেতর পেয়ে গেছি দ্বীপের লেআউট। ভাল করেই জানি কীভাবে নষ্ট করা যায় ওই ডিভাইস। আমার কোনও কাজেই আসবে না ওই পাইলট।’

‘বেশ, তা হলে আমি যাব তাকে উদ্ধার করতে।’

‘তা-ই করো। আমার কিছু যায় আসে না। তোমার নাম আগেও শুনেছি, মাসুদ রানা। সবাই বলে, কেউ বলতে পারে না এরপর কী করবে তুমি। অনিশ্চিত মগজের লোক আমার পছন্দ নয়। যা খুশি করো, কিন্তু আমার সামনে পড়তে যেয়ো না। নইলে হয়তো গুলি খেয়ে মরবে। আমার কথা বুঝলে?’

‘পরিষ্কার।’

‘নটি এরিক, আউট,’ লাইন কেটে গেল।

দু’পাশে বরফের দেয়াল রেখে সরু খাল দিয়ে দক্ষিণে ছুটে চলেছে রানাদের দুই বোট। উদ্দেশ্য: পতিত বেরিভ বিই-১২ বিমান ও ম্যাকসিম তারাসভের কাছে পৌঁছানো।

.

মধ্য ফেব্রুয়ারি, পুরো মার্চ এবং নবাগত এপ্রিলের সাত সপ্তাহ ধরে আর্কটিকের ক্যাম্পে বাস করছে মাসুদ রানা।

ওর সঙ্গে রয়েছে ছোট একটি বৈজ্ঞানিক টিম

বিসিআই-এর দক্ষ এজেন্ট সত্ত্বেও কেন ওকে জরুরি কাজ থেকে সরিয়ে বরফের এই প্রান্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলো, তার ব্যাখ্যা দিতে হলে আস্ত বই লিখতে হবে।

এর শুরু হয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার নির্জন একটি আমেরিকান বেসে। ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা, লেফটেন্যান্ট তিশা করিম, সার্জেন্ট আরাফাত হোসেন দবির এবং রানা মিলে ঠেকিয়ে দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশদের স্পেশাল ফোর্সের দুই ইউনিটকে। পরেও ইউটার এক সিক্রেট বেস যিরো নাইনে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রাণ রক্ষা করে ওরা। তারপর ম্যাজেস্টিক-১২ নামে একদল ব্যবসায়ী রানার মাথার উপর ঘোষণা করল তেত্রিশ মিলিয়ন ডলারের বাউন্টি।

ওই শেষ মিশনের পর বিসিআই থেকে রানাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল চোখের আড়ালে। অখণ্ড অবসর দেয়া হয়েছিল ওকে।

কিন্তু তার পর পরই এল প্রথম ফ্রেঞ্চ আততায়ীর হামলা।

ঢাকা শহরে এক রোববার রাতে একটি চার তারা হোটেল থেকে বেরিয়েই রানা টের পেল, ওর পিছনে লেগেছে লেজ।

ফ্রেঞ্চ আততায়ীরা চাইছে ফরাসি সেনাবাহিনীর ঘোষণা করা পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারের বাউন্টি।

রাস্তার ওপাশে লোক দু’জনকে দেখল রানা।

ওর গাড়ি ছিল একটু দূরে একটা বহুতল পার্কিং এরিয়ায়। নিশ্চিন্ত ভঙ্গি নিয়ে পার্কিং লটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও ফিরল সিঁড়ির গোড়ায়। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছুটে আসা লোকদুটোর উপর।

ওই দুই ফ্রেঞ্চ এজেন্ট এখন রয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে।

দ্বিতীয় হামলা এল তার দেড় মাস পর।

অবসর কাটাতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের কাছে পৌঁছে গেছে রানা, এমন সময় পিছন থেকে এল গাড়িটা। পাশাপাশি হলো দুই গাড়ি, তখনই গুলি শুরু করল শ্বেতাঙ্গ লোক দু’জন। ওয়ালথার পি.পি.কে. দিয়ে পাল্টা গুলি করল রানা। গোলাগুলির শুরুতেই মারা পড়ল ড্রাইভারের পাশের আরোহী। দুই গাড়ি উঠে এসেছিল নাতিদীর্ঘ এক সেতুর উপর। পাশ থেকে গুঁতো মেরে দুই ফ্রেঞ্চের গাড়ি নদীতে ফেলে দিল রানা।

বেঁচে গেল ড্রাইভার।

তাকে শেষ দেখা গেছে প্যারিসে ডিজিএসই হেডকোয়ার্টারের সামনে সিঁড়ির প্রথম ধাপে। পিঠের পিছনে দু’হাত হ্যাণ্ডকাফে আটকানো, মুখের ভিতর গুঁজে রাখা লাল টাই। কপালে স্থায়ী কালিতে লেখা: ‘এই মাল তোমাদের।’

কিছুদিন আগে মুখোমুখি বসে আলাপ করেছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট। অন্যান্য বিষয়ের ভিতর কথা উঠেছিল মাসুদ রানার উপর থেকে বাউন্টি সরিয়ে নেয়া যায় কি না।

কঠোর মুখে আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে মানা করে দিয়েছেন ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট।

অনেক আগেই রানাকে সতর্ক করেছে বিসিআই।

মস্ত হৃদয়ের দুর্ধর্ষ বাঙালি বৈজ্ঞানিক কুয়াশা বিসিআই, আর্মি ও নেভির জন্য বেশকিছু জরুরি ইকুইপমেন্ট তৈরি করেছে, ওগুলো টেস্ট করবার জন্য রানাকে একটা বৈজ্ঞানিক দলের নেতা হিসাবে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আর্কটিকে। ওদের সঙ্গে জুটে গেছে এক মেরিন ক্যাপ্টেন ও কর্পোরাল। আরও রয়েছে একজন আমেরিকান কন্ট্রাক্টার ও তার অ্যাসিস্ট্যান্ট।

বছরের এ সময়ে জায়গাটা থাকে নিঝুম। আকাশের কোলে দিন-রাত লালচে সূর্য, সর্বক্ষণ যেন ভোর। প্রচণ্ড শীত, কিন্তু তার পরেও অদ্ভুত ওই আলোর দেশে খারাপ লাগেনি রানার।

ওর নেতৃত্বে মেরু অঞ্চলে আরও সাতজন মানুষ ও একটি রোবট চেষ্টা করেছে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে।

বলতে গেলে রানার হয়ে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করছে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা।

দলের প্রায় সবাই বয়সে ছোট, তাদের কাছে বড় বোন ও দক্ষ নার্স হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে নিশাত।

মেরিন ফোর্সের অফিসার ও সৈনিক দু’জনেই নিশাতের চেয়ে বয়সে ছোট। কর্পোরাল বব বউলিংকে সবাই ডাকে ‘সান’ নামে। হাসিখুশি ছেলে। তাকে পছন্দ করে রানা। শুনেছে, প্রায় সব লিখিত পরীক্ষায় ডাব্বা মেরেছে সান, কিন্তু বুদ্ধি নেই, তা-ও নয়। যথেষ্ট চালাক। সব ধরনের অস্ত্র খুলে আবারও কয়েক মিনিটে লাগিয়ে ফেলতে পারে।

তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ইতালিয়ান-আমেরিকান ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো। রসকষহীন, হতাশ মানুষ। ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পসের লোক। কাজ না থাকলে পারতপক্ষে কারও সঙ্গে কথা বলে না। তুখোড় ইঞ্জিনিয়ার, রানাদের দলে আসবার পর থেকে সব ধরনের ভেহিকেল সে-ই মেরামত করছে।

নিজেদের দেশের সেনাবাহিনীর বেশকিছু ইকুইপমেণ্ট পরীক্ষা করছে তারা। তাদেরকে আর্কটিকে পাঠাবার কারণ রয়েছে।

একটা ট্রেনিঙের সময় বিস্ফোরণের ফলে সানের কান প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ভালভাবে শুনতে পায় না। জরুরি মিশন থেকে তাকে সরিয়ে আনা হয়েছে।

আর ম্যাক পাওলোর বিরুদ্ধে এসেছিল চুরির অভিযোগ। প্রমাণ করা যায়নি, কিন্তু তার দায়িত্বে থাকা বেশকিছু অস্ত্র এবং পঁচিশ হাজার ডলারের ভেহিকেল পার্টস হারিয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই শাস্তি হিসাবে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আর্কটিকে। আসলে তার দায়িত্বে জরুরি কোনও ইকুইপমেণ্ট দেয়া হয়নি।

পবন হায়দার ইলেকট্রনিক্স্ ও ইলেকট্রিকাল ইকুইপমেন্টের জাদুকর। বৈজ্ঞানিক কুয়াশার বিশ্বস্ত সাগরেদ। বয়স ছাব্বিশ বছর। মস্ত এক সানগ্লাস ব্যবহার করে, ঢেকে রাখে প্রায় গোটা মুখ। রোবোটিক্সের উপর বিশেষজ্ঞ। কুয়াশার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছে। ছোট বোমা সরিয়ে নিতে পারবে এমন একটি রোবট এবং আরও কিছু জরুরি ইকুইপমেণ্টসহ তাকে আর্কটিকে পাঠিয়েছে কুয়াশা।

পবনের সঙ্গে দেয়া রোবটের নাম: ১০০ কে।

তবে ওটার নাম দিয়েছে পবন: ‘বন্ধু’।

ওই রোবট বর্তমানের ব্যাটলফিল্ড রোবট প্যাকবটের চেয়ে অনেক আধুনিক।

রানা ও নিশাতকে বলেছে পবন, ‘বন্ধুর সঙ্গে বাড়তি কিছু ফিচার দিয়েছেন বস্।’ ক্রেট থেকে খুদে রোবট বের করে ওদেরকে দেখিয়েছে। ‘প্যাকবটের মত দূর থেকে অপারেট করতে হবে না। বন্ধু নিজেই চারপাশ বুঝে চলবে। ওর মাথায় আছে আর্টিফিশাল ব্রেন। যে-কোনও ভাষায় কথা বললেই বুঝবে, নতুন কিছুও শিখে নিতে পারবে। পরিবেশ বুঝতে সময় লাগবে না ওর। ট্যাকটিকাল সিদ্ধান্ত নেবে নিমেষে।

‘ট্যাকটিকাল ডিসিশন নেবে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে রানা। তারপর মনে পড়েছে, বৈজ্ঞানিক কুয়াশার তৈরি রঘুপতির কথা। কাজেই মনোযোগ দিয়ে দেখেছে ও খুদে রোবট।

দুই সরু হাত বন্ধুর, প্রয়োজন পড়লে দশ ফুট দূরে পৌঁছে যায়। কপালে গোল লেন্স। ওটা চোখের কাজ করবে। চারটে ছোট চাকার উপর ভর করে যে-কোনও দিকে যেতে পারে। চাকার পাশেই ত্রিকোণ কয়েকটা লাঠির মত জিনিস, ওগুলো ব্যবহার করে সিঁড়ি বা মই বাইতে পারে অনায়াসে।

‘ও খুবই বুদ্ধিমান,’ বলেছে পবন। ‘তা ছাড়া, ও অনেক কাজ করতে পারে। প্রথমে মাটির নীচের মাইন সরিয়ে নেয়ার জন্যে তৈরি করেছিলেন বস, কিন্তু তারপর একে একে আরও অনেক কিছু যোগ করেছেন। ওর মূল দেহ ঢাকা হালকা অথচ স্টিলের চেয়েও শক্ত টাইটেনিয়ামের পাত দিয়ে। দরকার পড়লে উল্টো হামলাও করবে ও।’

নতুন চোখে খুদে, হাঁটু সমান উঁচু রোবটের দিকে চেয়েছে রানা ও নিশাত।

কুয়াশা তার রোবটের সঙ্গে যোগ করেছে আগ্নেয়াস্ত্র ও হালকা কামান।

‘ষোলোটা ইণ্টারনাল রোটেটারে আছে অ্যামিউনিশন ক্লিপ, ওগুলো থেকে গুলি পাবে বন্ধু। কাস্টম মডিফায়েড লাইটওয়েইট শর্ট-ব্যারেল ইন্টারনাল-রিকয়েল-কমপেনসেটেড ৫.৫৬ এমএম এম২৩৯ গান ব্যবহার করবে। এ ছাড়া ওর আছে ব্লো-টর্চ, দরকার পড়লে কাঁটাতারের বেড়া বা দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে যাবে। বুকে অত্যাধুনিক ডিজিটাল স্যাটালাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম। পাশেই হাই-রেয ক্যামেরা। বিসিআই বা অন্য যে- কোথাও পাঠাতে পারবে ভিডিয়ো ইমেজ। আরও আছে ফার্স্ট- এইড প্যাক, ডায়াগনস্টিক স্ক্যানার ও ডেফিব্রিলেটার প্যাডল ও চারটা এমআরই রেশন প্যাক। ওর সঙ্গীর খিদে লাগলে বের করে দেবে। এসব মিলে বন্ধুর ওজন সবমিলে তিরিশ কেজি। দরকার পড়লে পালাবার সময় তুলে নেয়া যাবে ওকে। মাথার উপর হ্যাণ্ডেলও আছে।’

দু’এক দিন দেখেই কুয়াশার তৈরি বন্ধুকে ভাল না বেসে পারেনি রানা। পবনের পিছনে বিশ্বস্ত কুকুরের মত ঘোরে ওটা। অথচ ওর পিঠে আছে আস্ত একটা মেশিনগান!

নিশাত অবশ্য আপত্তির সুরে বলেছিল, ‘স্যর, আমরা বুঝব কী করে যে ওটার শর্ট-সার্কিট হলো কি না! যদি ওর ওই কামান দাগতে থাকে আমাদের দিকে?’

‘বন্ধু ও শত্রু চিনে নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ওকে,’ বলেছে পবন। ‘আপনাদের সবার ছবি স্ক্যান করে তুলে দিয়েছি ওর মেমোরি ব্যাঙ্কে। বলে দেয়া হয়েছে, ভুলেও আপনাদের কারও দিকে অস্ত্র তাক করবে না।’

‘কিন্তু সিনেমার রোবটদের মত…’ আপত্তির সুরে শুরু করেছিল নিশাত।

‘আপা, চিন্তা করবেন না,’ নিশ্চিন্ত করেছে পবন। ‘আমার বস্ পুরো তিন শ’ ঘণ্টা চালু রেখে পরীক্ষা করেছেন। তখন আমিও ছিলাম তাঁর পাশে। ওই সময়ে কারও ক্ষতি করেনি। কাউকে না কাউকে তো আপনার বিশ্বাস করতে হবে, আপা। ভাল কথা, বন্ধু, তুই মিস্টার রানাকে স্ক্যান কর্। ফেইশাল ও ইনফ্রা-রেড।’

গোল লেন্সে রানার দিকে চেয়ে রইল বন্ধু। কয়েক সেকেণ্ড পর জোরাল বিপ্ আওয়াজ করল। রোবোটিক সুরে বলল, ‘স্ক্যান কমপ্লিট, পবন। এঁকে চিনে নিলাম মাসুদ রানা হিসেবে। বিসিআই একে চেনে এমআর-৯ হিসাবে।’

‘এবার তোর দ্বিতীয় বন্ধু হিসাবে ওঁকে গ্রহণ কর,’ বলল পবন।

‘আমার মেমোরি ব্যাঙ্কে দ্বিতীয় বন্ধু হিসেবে মাসুদ রানার নাম টুকে নিলাম।

‘আগে চিনত না?’ জানতে চাইল রানা।

‘চিনত, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেনি। ওর আবার সবসময় কাউকে না কাউকে অনুসরণ করতে হবে। আমি ওর একনম্বর বন্ধু। কিন্তু আমার কিছু হলে তখন থেকে আপনার পিছু নেবে।

‘খুবই সম্মানিত হলাম,’ হেসেছে রানা।

কয়েক দিনে পবন হায়দারের সঙ্গে খাতির হয়ে গেছে রানার। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর দাবা খেলেছে ওরা। সবসময় হেরেছে পবন। তারপর প্রতিশোধ নিতে চাইল। বন্ধুর বিরুদ্ধে রানাকে খেলতে আহ্বান করল। দু’বার খেলেই যা বুঝবার বুঝেছে রানা, সরু হাতওয়ালা ওই রোবট ওর চেয়ে অনেক বেশি বোঝে দাবা।

কুয়াশার সহযোগীর সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ সরকার থেকে পাঠানো হয়েছে ফারিয়া আহমেদকে। মিষ্টি মেয়েটি মিটিয়োরোলজিস্ট, পরিবেশ দপ্তরে চাকরি করে।

বয়স মাত্র চব্বিশ, কঠোর পরিশ্রম করে। সবসময় ব্যস্ত হয়ে দেখছে কোনও চার্ট, বা কাজ করছে ল্যাপটপে। হিসাব কষছে কীভাবে দ্রুত গলছে আর্কটিক সাগরের বরফ।

কারও চোখ এড়ায়নি, ফারিয়া সত্যিই সুন্দরী।

ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো ও পবন হায়দার ঘুরঘুর করছে ওর আশপাশে। কিন্তু প্রায় কখনোই কাজ থেকে মুখ তুলে তাকায় না ফারিয়া।

ওদের এই টিমে রয়েছে আরও দু’জন। নিজেরা তারা চুপচাপ থাকে। দরকার না পড়লে কারও সঙ্গে কথাও বলে না।

প্রথমজন জার্ড ময়লান, সে বিখ্যাত একটি অস্ত্র কোম্পানির সিনিয়ার এগযেকিউটিভ। তার সব আকর্ষণ অ্যাসল্ট ও স্নাইপার রাইফেলের বিষয়ে। তার কোম্পানি চাইছে মেরিন ফোর্সের কাছে তাদের নিজেদের নতুন অ্যাসল্ট রাইফেল বিক্রি করবে। এমএক্স- ১৯ কারবাইন। কিন্তু কর্পস থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রথমে আর্কটিকে টেস্ট করতে হবে ওই জিনিস। প্রাথমিক রিপোর্ট ভাল এলে তখন তারা আরও দক্ষ একদল অফিসারকে দেখাবে। ওই কারবাইন উপযুক্ত মনে করলে, অর্ডার দেবে মেরিন কর্পস।

জার্ড ময়লানের বয়স আটচল্লিশ বছর। দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য। নিজের অ্যাসিস্ট্যান্টকে পায়ের নীচে রাখে সারাক্ষণ। বিরক্ত চেহারা নিয়ে দিনের পর দিন পার করছে। কারবাইন টেস্ট করবার সময়টা বাদ দিলে অন্য সময় নিজের তাঁবুর ভিতর বসে থাকে। এমনকী খাবারের সময়ও অ্যাসিস্ট্যান্ট জর্জ চ্যাণ্ডোপলকে খাবার নিয়ে আসতে পাঠায়

গত কয়েক দিনে তাদের কারবাইনের যে টেস্ট হয়েছে, তা সন্তোষজনক।

জর্জ চ্যাণ্ডোপলকে ঠাণ্ডা মাথার যুবক মনে হয়েছে রানার। রাগ বলতে কিছুই নেই। সম্ভব হলে অন্যদের কাজও করে দেয়।

এই বরফ রাজ্যেও ওদের অস্ত্রটা ভালই কাজ করছে।

কিন্তু পবনের উপর বিরক্ত জার্ড ময়লান। গতকাল সবাইকে চমকে দিয়েছে কুয়াশার সাগরেদ।

ওর নির্দেশে টার্গেটে এক পশলা গুলি করেছে বন্ধু।

ময়লানকে মেনে নিতে হয়েছে, তাদের রাইফেলের চেয়ে অনেক বেশি কাজের জিনিস ওই রোবটের এম২৩৯ মেশিনগান।

পবন তার বসের নতুন এক বিস্ফোরক নিরোধ জেল নিয়েও বরফের রাজ্যে কাজ করছে। ঠাণ্ডার ভিতর ভাল থাকে ওই জিনিস।

কোনও সাধারণ বাক্সে আঠালো জেল মাখিয়ে দিলে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক দিয়ে তা উড়িয়ে দিতে চাইলেও কিছুই হচ্ছে না ক্রেটের। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করেও ক্রেট উড়িয়ে দেয়া যায়নি। এ ছাড়া ঠাণ্ডার ভিতর দীর্ঘক্ষণ কাজ করবে এমন স্কুবা রিবিদার ও ড্রাইসুট টেস্ট করছে পবন। চমৎকার ফল আসছে। আর কুয়াশার তৈরি অ্যাসল্ট ফোর্স ডেলিভারি ভেহিকেল বা এএফডিভি তো জাদু দেখাচ্ছে।

বন্ধুর পেটে রাখা এমআরই খেয়ে দেখতে বলা হয়েছিল রানা ও নিশাতকে। ওদের খারাপ লাগেনি। প্রতিটি এমআরই রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের ছোট টিউবের ভিতর। চট করে খেয়ে নেয়া যায়। প্রতিটি টিউবে রয়েছে পাউডারের মত এক ধরনের জেল, হাই এনার্জি প্রোটিন বার ও তিনটে করে ফিলট্রেশন পিল। শেষের জিনিসটাও ঠিকঠাক ফল দিচ্ছে। রানা ও নিশাত প্রশংসা না করে পারেনি কুয়াশার আবিষ্কারগুলোর।

‘কুয়াশার জেলি অবশ্য তেলাপোকার গুয়ের মত খেতে, পরে বলেছে নিশাত। ‘আসল জিনিস ওই পানি শোধক বড়ি। এই প্রথম মাঠ পর্যায়ে এত ভাল পানি পেলাম। একবারও ডায়রিয়া হলো না।’

‘ওটা সাইটোস্যান বেযড পিল,’ বলেছে পবন। ‘ন্যাচারাল পলিস্যাকারাইড, মিশে যায় দেহে। আপনারা কি জানেন ওই একই জিনিস আছে সেলক্সের ভেতর? গুলি খেলে তখন ক্ষতে ওই জিনিস না লাগালে থামতে চায় না রক্ত পড়া।’

‘তুমি যখন বলছ, বাছা, নিশ্চয়ই মিথ্যা বলোনি, হেসেছে নিশাত। ‘কে জানত ওই জিনিস ক্ষত মেরামত করবে!’

পবনের একটা ডিভাইসের ব্যাপারে আগ্রহী রানা।

ওটা ওর জন্যেই তৈরি করেছে কুয়াশা।

জিনিসটা হাই-টেক আর্মার্ড রিস্টগার্ড।

কুয়াশা চাইছে আমেরিকান মেরিন ও আর্মি রেঞ্জারদের মত করে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে ওই জিনিস তৈরি করে দেবে। জিনিসটা হালকা কার্বন ফাইবার। বাহু রক্ষা করে, আর ওটার উপর থাকবে হাই-রেযোল্যুশন এলসিডি স্ক্রিন। দামও পড়বে খুবই কম।

‘বর্তমান বিশ্বের সব ডেটা পাবেন এই স্ক্রিনে,’ রানাকে বলেছে পবন। ‘ভিডিয়ো সিগনাল বা স্যাটালাইট ইমেজারি… যুদ্ধে ব্যস্ত যে-কোনও সৈনিকের জন্যে। …এই দেখুন।’ কী যেন টিপে দিল পবন। জ্যান্ত হয়ে উঠল স্ক্রিন। ‘এবার সাদা-কালো দুই মূর্তি ওপরের দিকে দেখছেন? বরফের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, একটু দূরে ছয় কোনা জিনিসটা?’

‘হ্যাঁ,’ বলেছে রানা।

‘এবার হাত নাড়ান।’

দুই মূর্তির একটা সরে গেল বামে।

‘তো কী বুঝব?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপনি নিজের চারপাশ দেখছেন,’ বলল পবন। ‘রিস্টগার্ড কাজ করবে স্যাটালাইট ফোনের মত। এনক্রিপশন করা। স্যাটালাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে সর্বক্ষণ রিয়াল-টাইম ইমেজারি ও ডেটা পাবেন। কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে তার গলার আওয়াজও শুনবেন। জানি, আমার বসের সঙ্গে আপনার খুব ভাল সম্পর্ক, তাঁকে বলবেন না, কিন্তু দরকার পড়লে যেন ইন্টারনেট সার্ফ করা যায়, সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছি আমি।’

গত কয়েক সপ্তাহ ব্যস্ততার ভিতর কেটেছে।

তবুও পবন, রানা ও নিশাত বেশকিছু জিনিস টেস্ট করেছে।

সেগুলোর ভিতর একটি হচ্ছে অ্যাসিড বেড্ অ্যারোসল। বেশকিছু জানোয়ারকে দূরে রাখতে তৈরি করা হয়েছে।

‘ভালুক নিরোধক,’ নাম দিয়েছে ওটার নিশাত।

পবন সবক’টা তাঁবু ও ক্যাম্পের চারপাশে স্প্রে করেছিল।

সত্যিই কিছুদিনের ভিতর একটা ভালুকও এদিকে আসেনি।

কুয়াশার তৈরি সব জিনিস যে ঠিকঠাক কাজ করছে, তা-ও নয়। কয়েক দিন আগেও ভাল ছিল রিস্টগার্ড। কিন্তু ওদের যাত্রার কিছুক্ষণ পর থেকেই ভুল তথ্য দিচ্ছে। বাস্তবে তিন শ’ ফুট দীর্ঘ কিছু ওদের ধারেকাছে নেই।

ওদের ক্যাম্পের কয়েক মাইলের ভিতর আছে শুধু বরফের প্রান্তর। ক্রমেই ফাটছে বরফের মাঠ। মাঝ দিয়ে তৈরি হচ্ছে সরু সব খাল।

‘হয়তো বরফের নীচে সাঁতার কাটছে কিলার ওয়েইল,’ বলেছে রানা। ‘সাবমেরিনও হতে পারে।’

‘সম্ভব নয়,’ বলেছে পবন। ‘আমাদের রিস্টগার্ড আসলে রেঞ্জফাইণ্ডারের বাপ। শত শত মাইল দেখে। কিন্তু বরফের নীচে কী আছে, তা দেখে না। এখন বুঝতে পারছি, নষ্ট হয়ে গেছে যন্ত্রটা। যা-ই হোক, লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে তো টেস্ট করার জন্যেই।’

ফরাসিরা ওকে মেরে ফেলতে চাইছে, তার পরও খুব চিন্তিত নয় রানা। কিন্তু আজ ভোরের আগেই কুয়াশার রিস্টগার্ড ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিল ওকে। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে চোখ রেখেছে ও।

ডিআইএ-র কেভিন কনলন জরুরি তথ্য পাঠিয়েছে।

রানার প্রথমেই মনে পড়ল, জুনিয়র বন্ধুর পাগলাটে টি-শার্ট ও জিন্স। সর্বক্ষণ চিবিয়ে চলেছে চুইং গাম।

কয়েকটি আমেরিকান মিশনে কাজ করে কনলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে রানার।

রিস্টগার্ড থেকে তথ্য পড়বে, এমন সময় ওটার মাধ্যমেই এল মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের নির্দেশ। জানালেন, রানা, এক্ষুনি রওয়ানা হয়ে যাও। রাশার পোলার আইল্যাণ্ডে গিয়ে ঠেকাতে হবে ভয়ঙ্কর রাফিয়ান আর্মির অ্যাটমোসফেরিক হামলা। ভস্ম হয়ে যাবে আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপের বেশিরভাগ এলাকা। পুড়ে ছাই হয়ে যাবে বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত ব্রিফিঙে আরও বললেন তিনি, ‘হোয়াইট হাউস থেকে একটু পরেই যোগাযোগ করবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাঁর দেশ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে।

চিফ যোগাযোগ কেটে দেয়ার একমিনিট পর এল স্যাটালাইট ফোনে অনুরোধ।

আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা শেষে রানা পড়ল কেভিন কনলনের মেসেজ:

কেভিন: আপনার ফ্রেঞ্চ সমস্যা আরও বাড়ছে।

এরপর এনক্রিপ্‌ড্ মেসেজের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করল ওরা দু’জন।

রানা: নতুন কী এমন হলো?

কেভিন: আমাদের নতুন পাওয়া ডিজিএসই-র তথ্য অনুযায়ী এস. এফ. নামের নতুন এক এজেন্টকে আপনার বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রানা: কীসের দায়িত্ব?

কেভিন: আপনাকে খুন করার দায়িত্ব। আমি ওদের ফাইল ঘাঁটতে শুরু করেছি। যা বুঝলাম, এস. এফ. মার্ডার বা ‘এম’ ইউনিটের লোক। রানা, ওটা সিআইএ-র মতই ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী সংগঠন। খুনের প্রয়োজন হলেই ডাকা হয় ওদের। আগে কখনও এস. এফ. আমেরিকান এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করেনি। তার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। চিনে নেয়ার মত চিহ্ন ডানদিকের কব্জির ভেতর অংশের উল্কি। আজ পর্যন্ত পনেরোজনকে খুন করেছে।

রানা: সতর্ক করার জন্যে ধন্যবাদ।

কেভিন: ভাল থাকুন, রানা। পরে দেখা হবে।

.

আর্কটিক আইস ফিল্ড।

সাড়ে চারঘণ্টা পর পৃথিবী ধ্বংস করবে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন।

চার এপ্রিল।

ভোর ছয়টা তিরিশ মিনিট।

তাঁবুগুলো থেকে ডেকে সবাইকে জড় করেছে রানা। সংখ্যায় ওরা আটজন। দুই মেরিন, চার সিভিলিয়ান, নিশাত এবং ও নিজে।

সংক্ষেপে পরিস্থিতি জানিয়েছে ও। রাফিয়ান সেনাবাহিনী নামের একটি দল দখল করে নিয়েছে পোলার আইল্যাণ্ড। ওখানে রয়েছে মারাত্মক বিপজ্জনক এক অস্ত্র: অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন। স্থানীয় সময় সকাল এগারোটার সময় ইগনাইট করা হবে ওটা, ধ্বংস হয়ে যাবে বর্তমানের পৃথিবী। ব্যর্থ হয়েছে রাশান নিউক্লিয়ার মিসাইলের হামলা। কেউ কিছুই করতে পারবে না আকাশ পথে, কাজেই ওদের সাহায্য চেয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। পোলার আইল্যাণ্ডের কাছাকাছি রয়েছে মাত্র ‘দুটো দল। তার একটি ওদের।

‘রাফিয়ান বা দস্যু সেনাবাহিনী?’ বলেছে নিশাত। ‘আগে কখনও ওদের নামও শুনিনি।’

জবাবে রানা বলেছে, ‘খুব কম মানুষই শুনেছে। হঠাৎ করেই এদের কর্মকাণ্ড ইন্টেলিজেন্সগুলোর চোখে পড়েছিল। এখন বিসিআই এবং হোয়াইট হাউস থেকে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিছু পেলেই জানাবে। ডিআইএ এবং সিআইএ-র এজেন্টরাও ব্যস্ত হয়ে জোগাড় করছে খবর।’

‘আগেই অস্ত্রটা ব্যবহার করছে না কেন তারা?’ জানতে চেয়েছে সান।

‘ওটার জরুরি কিছু এলিমেন্ট আগেই প্রস্তুত থাকতে হয়,’ বলেছে রানা। ‘যেমন ছোট ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার— ওটা এখনও যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়নি। আর সে কারণেই কয়েক ঘণ্টা সময় পাব আমরা।’

‘আমাদের হাতে কয় ঘণ্টা সময় আছে, স্যর?’ জানতে চেয়েছে নিশাত।

‘চার ঘণ্টারও কম, আপা,’ বলেছে রানা। ‘এবার আমাদেরকে গুছিয়ে নিতে হবে সব জরুরি গিয়ার। প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে ওই দ্বীপে পৌছতে। তারপর দুর্গের মত দ্বীপটায় ওঠা। ওই মারণাস্ত্র ডিসআর্ম করতে বড়জোর একঘণ্টা সময় পাব। বিকল করতে না পারলে নষ্ট করতে হবে। আমাদের জন্যে দরজা খুলে রাখবে না ওরা। ধরে নিতে পারেন, আমাদের কাজ খুবই কঠিন।’

এবার চার সিভিলিয়ানের দিকে চাইল রানা।

চুপ করে আছে পবন হায়দার, ফারিয়া আহমেদ, জার্ড ময়লান ও জর্জ চ্যাণ্ডোপল।

‘কিন্তু দুই দেশের সেনাবাহিনীর দু’জন করে মোট চারজন যোদ্ধা কোনও কাজেই আসবে না, বলল রানা। ‘আরও লোক চাই। আপনারা যদি যান, তা হলে ভাল হয়। কিন্তু বলে রাখি, জোর করা হবে না কাউকে। ইচ্ছে হলে যেতে পারেন, আবার না- ও যেতে পারেন। আমরা হব দ্বিতীয় দল। ব্যাক-আপ টিম। কিন্তু সিল টিম ব্যর্থ হলে, তখন আমাদেরকেই হামলা করতে হবে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বিপদে।

‘যে কেউ মরতে পারি। যখন লড়ব, গুলি করব খুন করার জন্যেই। হয়তো দেখবেন ভয়ঙ্কর ক্ষত, ভাঙা হাড় ও রক্তাক্ত লাশ। কাজেই কেউ যেতে না চাইলে চাপ দেব না।

‘কিন্তু…’ ডানহাতের তর্জনী তুলল রানা। ‘একবার যদি রওনা হন, একটা কথাই বলব: মেনে চলবেন আমার প্রতিটি কথা। প্রথমে মনে হতে পারে পাগলের মত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু তার ভেতর থাকবে জরুরি কোনও যুক্তি। আমার কথা মেনে চললে, তার বদলে কথা দেব: আপনাদের কাউকে বিপদে ফেলে পালিয়ে যাব না। বন্দি হতে পারেন, কিন্তু বেঁচে থাকলে ফিরে আসব সরিয়ে নিতে। …বেশ, আর কিছু বলার নেই। এবার জানান, কে বা কারা যাবেন।’

চুপ করে গ্যাসের চুলার দিকে চেয়ে রইল বেসামরিক মানুষগুলো।

সবার আগে মুখ খুলল পবন, ঢোক গিলে বলল, ‘আমি আছি আপনার সাথে।’

‘আমিও, অনিশ্চিত সুরে বলল ফারিয়া আহমেদ, ‘যদিও জানি না কীভাবে ব্যবহার করতে হয় অস্ত্র। জীবনে একবার বাবার এয়ারগান ছুঁড়েছিলাম, কিন্তু জায়গামত লাগাতে পারিনি।’

‘চিন্তা কোরো না, সোনা,’ বলল নিশাত। ‘মাত্র পাঁচ মিনিটে তোমাকে মার্কসউওম্যান বানিয়ে দেব।’

নাক ঝাড়ল জার্ড ময়লান। ‘পাগল নাকি আপনারা! আপনাদের বাঁচার কোনও সম্ভাবনাই নেই। একজন মেরিন অফিসার, একজন সৈনিক; দু’জন বাংলাদেশি অফিসার, আর কয়েকজন সিভিলিয়ান— যুদ্ধ করতে চাইছেন দক্ষ একদল সৈন্যের বিরুদ্ধে! আমি এসবের ভেতর নেই। চ্যান্ড্রোপল আর আমি এখানেই নিরাপদ জায়গায় থাকছি। …চ্যাণ্ডোপল?’

‘না, স্যর, আমি যাব,’ বলল ময়লানের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

‘কী বললে, বেয়াদব?’ চরকির মত ঘুরে তাকে দেখল ময়লান।

রানাও ঘুরে চেয়েছে।

‘স্যর, আমি বলেছি যাব।’

‘ফালতু কথা বলবে না,’ ধমক দিল ময়লান। ‘তুমি আমার সঙ্গে থাকছ। মরতে চাইলে ওরা মরুক গিয়ে।’

আস্তে করে মাথা নাড়ল জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল।

রানা ভাবেনি কখনও বসের বিরুদ্ধে টু শব্দ করবে এই ছেলে। ‘সত্যি দুঃখিত, স্যর, কিন্তু কখনও কখনও দায়িত্ব এড়ানো যায় না। …স্যর…’

‘চোপ!’ বেদম কড়া ধমক দিল জার্ড ময়লান। ‘নিশ্চয়ই তোমার মগজে গোবর নেই? নাকি গাধা তুমি?’

‘আমি দুঃখিত, স্যর,’ আরেকবার মাথা নাড়ল জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল। ‘গুরুজন হিসাবে সম্মান করেছি এতদিন, কিন্তু আজ আপনি আমার চোখে অনেক ছোট হয়ে গেলেন।’

‘আমি খুশি যে এ দলে যোগ দিলে, চ্যাণ্ড্রোপল, বলল রানা। ব্যবসায়ীর দিকে চাইল। মিস্টার ময়লান, মনে রাখবেন, একা এখানে থাকা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আরেকবার ভেবে দেখুন….

‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, আমি এখানে ভালই থাকব, মেজর,’ বলল ময়লান। ‘আপনাদের নিজেদেরই বরং ভেবে দেখা উচিত। আপনারা বোকার মত কাজ করছেন! সব ইডিয়ট!’

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা, আর কিছু বলার নেই ওর।

মুখ খুলল নিশাত। ‘আপনি সত্যিকার একজন নীচ ইহুদি ব্যবসায়ীর পরিচয় দিলেন, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুর কোনও মূল্য নেই আপনাদের কাছে! ধিক!’

ভুরু কুঁচকে কটমট করে চেয়ে রইল ময়লান।

মিশনে যাওয়ার আগের আধঘণ্টা খুব ব্যস্ততার ভিতর দিয়ে গেল ওদের। নানান প্রস্তুতি চলল। বাটোয়ারা করা হলো মেরিনদের কাছ থেকে পাওয়া সব অস্ত্র। নিজেদের চারটে ম্যাগহুক পরীক্ষা করল রানা। গুলি দিয়ে বন্ধুর বুক ভরল পবন। ফারিয়া ও চ্যাণ্ড্রোপলকে সংক্ষেপে অস্ত্রের ট্রেনিং দিল নিশাত।

পবনের কাছে বিকল রিস্টগার্ড দিয়েছিল রানা, হঠাৎ ছেলেটার কাছ থেকে চেয়ে নিল জিনিসটা।

রিস্টগার্ডের মাধ্যমে কেভিন কনলনকে পাঠাল মেসেজ

জরুরি কাজে আটকা পড়েছি। যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেভিন, তুমি কি একদল টেরোরিস্টের বিষয়ে তথ্য দিতে পার? নিজেদের নাম দিয়েছে: রাফিয়ান আর্মি। এ ছাড়া, জানতে চাই এক পুরনো সোভিয়েত আর্কটিক বেসের বিষয়ে। নাম: ‘পোলার আইল্যাণ্ড’। যে-কোনও তথ্যই কাজে আসবে। -রানা।

মেসেজ পাঠিয়ে দেয়ার পর সবাইকে জড় করল রানা। ফারিয়া আহমেদ, পবন হায়দার ও জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল— প্রত্যেককে দেয়া হলো ড্রাই সুট। বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে ওগুলো কাজে আসবে। আটকে রাখবে দেহের তাপ। তার উপর থাকল ওদের গানবেল্ট ও হোলস্টার। বাড়তি আর্মালাইট এমএইচ-১২ ম্যাগহুক নেই, এখন সংগ্রহ করাও অসম্ভব। কমব্যাট বুট নেই বলেই আর্কটিকের বুট পরল বেসামরিক তিনজন।

ম্যাক পাওলো, বব বউলিং, নিশাত এবং রানা পরেছে মেরিনদের কাছ থেকে পাওয়া স্নো-কেমোফ্লেজ্‌জ্ড ড্রাই সুট ও পার্কা। ওগুলো সাধারণ ব্যাটল ফেটিকের মতই পাতলা।

তৈরি হওয়ার পর ওরা সাতজন চেপে বসল দুই অ্যাসল্ট বোটে। রওনা হবে দক্ষিণে পোলার আইল্যাণ্ড লক্ষ্য করে।

পিছন থেকে চেয়ে রইল জার্ড ময়লান। ক্যাম্পে রয়ে গেল সে একা। পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি বোকা লোক, মেজর! নিশ্চয়ই জানেন, ওই লড়াইয়ে জিততে পারবেন না জীবনেও!’

জবাব দিল না রানা, ফিরেও চাইল না; রওনা হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিন চালু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *