মৃত্যুদ্বীপ – ২০

বিশ

পোলার আইল্যাণ্ড।

সকাল এগারোটা বিশ মিনিট।

মিসাইল লঞ্চ করা হয়েছে এগারোটায়।

রানা ধারণা করছে: কেউ উঁচু মহাকাশ থেকে নর্থ পোলের উপর চোখ রাখলে দেখবে ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল এক সাদা বজ্রের মত ঝিলিক। পুরনো এ পৃথিবী ধ্বংস করতে রওনা হয়েছে হলদে-সাদা এক বিপুল আগুনের ঢেউ।

চিন্তাটা মনে আসতেই চট্ করে রিস্টগার্ডে স্যাটালাইট ইমেজারি আনল রানা। সাদা-কালো স্ক্রিনে পোলার আইল্যাণ্ড ও আর্কটিক সার্কেলের দৃশ্য।

দেখা গেল পরিবেশ পুড়িয়ে দেয়ার লেলিহান অগ্নিশিখা।

ওটা পোলার আইল্যাণ্ড থেকে দূরে যাওয়া ভয়ঙ্কর এক জান্তব থাবা যেন। দক্ষিণ থেকে পৃথিবীর বাঁকে হারিয়ে গেছে পুবে। দামাল হাওয়া বা জেটস্ট্রিমকে অনুসরণ করেছে আগুন।

কী ভয়ঙ্কর হবে এর ফলাফল!

সব বুঝতে পেরে অসুস্থ বোধ করছে রানা।

চোখের সামনে মৃত্যু হচ্ছে এই গ্রহের!

মারা পড়বে শত শত কোটি মানুষ।

বিলুপ্ত হবে সভ্যতা।

যে ক’জন বাঁচবে, বাধ্য হয়ে ফিরবে আদিম আমলে।

চারপাশে থাকবে শুধু ধ্বংসস্তূপ।

কিন্তু…

স্ক্রিনে রানা দেখল, হঠাৎ করেই কেন যেন মস্ত হোঁচট খেল লকলকে সাদা আগুন।

মনে হলো বাড়ি খেয়েছে কোনও বিশাল দেয়ালে।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। বিড়বিড় করে বলল, ‘হঠাৎ কী…’

মাত্র কয়েক মিনিটে গর্জনরত ভয়ঙ্কর আগুন চলে গেছে ছয় শত মাইল দূরে, আর তারপরই যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেছে।

তখনই রাফিয়ান আর্মির জেনারেল, বিশৃঙ্খলার সম্রাটের কথা শুনল রানা। লোকটা ওকে উদ্দেশ করে বলেনি: ‘হঠাৎ কী হলো? থেমে গেল কেন আগুন?’

আরেকটা কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল: ‘স্যর! এক হারামিকে ধরেছি! সে ছিল মেইন ভেন্টের নীচের গ্যাসওঅর্কে! টিইবি পাইপ যেখানে ভেণ্টে গেছে, ওখানে বন্ধ করে দিয়েছিল সব ভালভ! ওগুলোর অক্সিডাইযেশন থেকে বুঝছি, হারামজাদা দু’ঘণ্টা আগে আটকে দিয়েছে ভালভ! গত দু’ঘণ্টা ধরে খামোকা গ্যাস পাম্প করছি আকাশে!’

‘কী? …কে সে?’ ধমকে উঠল বিশৃঙ্খলার সম্রাট।

‘বলছে নাম হাতুড়িমাথা! নেভি সিল, স্যর! আমরা যখন সাবমেরিন ডকে সবাইকে খতম করলাম, পালিয়ে গিয়েছিল এ।’

মগজ খেলাতে শুরু করেছে রানা।

নটি এরিক। হাতুড়িমাথা।

লোকটা কীভাবে যেন বেঁচে গেছে হামলা থেকে।

পরে ভালুক দ্বীপ থেকে এসে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার সরাতে চেয়েছে রানা, ওই একই সময়ে পোলার আইল্যাণ্ডের ফ্যাসিলিটিতে ঢুকে পড়েছিল হাতুড়িমাথা। বন্ধ করে দিয়েছিল গ্যাসের ভেণ্ট I কেউ জানত না স্যাবোটাজ করা হয়েছে।

স্কেয়ার নিয়ে ডেটোনেট করেছে এসএস-৩৩ মিসাইল, কিন্তু হাতুড়িমাথার কল্যাণে পোলার আইল্যাণ্ডের আশপাশে ছিল না দাহ্য গ্যাস। তেমন কিছুই জ্বেলে দিতে পারেনি। বা’ বলা উচিত, দাহ্য গ্যাসের সামান্য রেশ ছিল। তার কারণে ‘ছোট্ট’ বজ্র-শিখা জ্বলে উঠেছিল আকাশে।

চট্‌ করে আরেকটা বিষয় মনে এল রানার।

একই কথা বোধহয় ভাবছে বিশৃঙ্খলার পিশাচ সম্রাট।

‘আমাদের কপাল ভাল স্যাবোটাজ করেছে হাতুড়িমাথা, ‘ শ্যারনকে বলল রানা, ‘এই দ্বীপের কয়েক শ’ মাইল এলাকা নিরাপদ। কিন্তু নর্দান হেমিস্ফেয়ারের অন্য অংশে ভাসছে দাহ্য গ্যাস। নতুন করে কোনও ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার পেলেই পরের মিসাইল পাঠাবে নিরাপদ এলাকার ওপাশে।’

‘ওদিকে আছে দাহ্য গ্যাস,’ বলল শ্যারন।

‘সেক্ষেত্রে জ্বলে উঠবে পৃথিবীর পরিবেশ। বুঝতেই পারছ, শেষ হয়নি আমাদের লড়াই।’

ঝট্ করে বাইরে চাইল রানা।

‘…এসব স্ফেয়ার আবারও চাই ওদের। এবার অপেক্ষা করবে না, হামলা করবে প্রাণপণে।’

কথাটা মাত্র বলেছে, এমন সময় ওদের বিমানকে ঘিরে রাখা ভেহিকেলগুলোর আড়াল থেকে ছিটকে এল বারোজন নেশাখোর। একে-৪৭-এর টানা গুলি করতে করতে রানওয়ে ধরে দৌড়ে আসছে বিমানের উদ্দেশে। তাদের পিছনে ছুটে এল গোটা আর্মি ফোর্স।

এইমাত্র মাসুদ রানা এবং ওর দলের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে রাফিয়ান আর্মি।

প্রথম সারির চরমপন্থীদের দিকে গুলি পাঠাল নিশাত ও বুনো। আগের কোনও হামলা এত ভয়ঙ্কর ছিল না। ওরা বুঝে গেল, এবার ঠেকাতে পারবে না শত্রুদেরকে।

মৃত্যু এখন নিশ্চিত।

‘আর বড়জোর দশ সেকেণ্ড, তারপর…’ চুপ হয়ে গেল শ্যারন। চেয়ে আছে রানার চোখে। ভাবছে, সামান্যতম ভীত নয় কেন এই অদ্ভুত বাঙালি লোকটা!

শ্যারনের পাশ থেকে ডক্টর তারাসভ বললেন, ‘কিন্তু কোথাও যাওয়ার নেই আমাদের। এবার…’

‘সবসময় কোথাও না কোথাও যাওয়া চলে, ডক্টর, বলল রানা। দেখছে দূরে। বেড়ে গেছে গোলাগুলির আওয়াজ।

চওড়া নদীর উপর স্থির রানার চোখ। ওটা সামান্য দূরেই। রানওয়ের পাশেই। কয়েক ধাপে নেমেছে পশ্চিমের ক্লিফ বেয়ে, তারপর বড় এক জলপ্রপাত তৈরি করে ঝরে পড়েছে সাগরে।

‘ক্ষতি কী?’ আনমনে বলল রানা, পরক্ষণে শ্যারন ও ডক্টর তারাসভকে পাশ কাটিয়ে ঠেলে দিল অ্যান্টোনভ বিমানের চার থ্রটল। একই সময়ে বিশাল বিমানের পিছনে পৌঁছে গেল পরের সারির উগ্রপন্থীরা। কিন্তু হঠাৎ ঝাঁকি খেল বিমান, রওনা হয়ে গেল শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে। জোরালো ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলল টায়ার। তীক্ষ্ণ আওয়াজ ছাড়ল ভাঙা ফরোয়ার্ড ল্যান্ডিং গিয়ার। ঘষ্টে চলেছে রানওয়েতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর বিমান পেরোল পাকা জমিন, নেমে গেল সামান্য নীচের সরু পারে। তুষার ও মাটি খামচে তুলে ঘড়-ঘড় আওয়াজ তুলে নদী লক্ষ্য করে চলেছে বিমান।

অ্যান্টোনভ হোঁচট খেয়ে রওনা হতেই হোল্ডে পা পিছলে পড়েছে নিশাত ও ডিফেখন।.

হাঁচড়ে-পাছড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল নিশাত, তারই ফাঁকে চেঁচাল, ‘এসব কী করছেন, স্যর!’

‘বাঁচার চেষ্টা!’ পাল্টা জানাল রানা।

গোঁ-গোঁ শব্দে গতি তুলছে অ্যান্টোনভ, এবড়োখেবড়ো জমিতে লাফিয়ে উঠছে ছাগলছানার মত। অবশ্য, কয়েক সেকেণ্ড পর ঝপাস্ করে নাক গুঁজে দিল নদীর বুকে। ওখানেই থামল না, ওটাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল পাহাড়ি নদী।

অ্যান্টোনভ পানিতে নামতেই ছলকে উঠেছে বিপুল পানি।

বেশিরভাগ আকাশযানের মতই সাগর বা নদীতে পড়লেও চট্‌ করে তলিয়ে যায় না এই বিমান। রিয়ার র‍্যাম্প খোলা, কিন্তু ভাসছে কর্কের মত।

ধীরভাবে চলেছে ভাটিতে, কিন্তু ক্রমে বাড়তে লাগল গতি। নাক তাক করেছে সাগরের দিকে। সামনে পড়বে ছোট কয়েকটি জলপ্রপাত, সেসব পেরোলেই আরেকটি জলপ্রপাত, ওখানে মস্ত পতন হবে বিমানের।

ডান দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে নিশাত। রেডিয়ো করল, ‘এতে কী উপকার হবে আমাদের, স্যর?’

‘ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার চাইছে ওরা,’ বলল রানা, ‘কাজেই সাগরে গিয়ে পড়ব বড় জলপ্রপাত পেরিয়ে।’

তাতে স্ফেয়ার কেড়ে নেয়া সহজ হবে না, এই তো, স্যর?’

‘হ্যাঁ।’

চমকে গেছে নিশাত।

প্রায় পৌঁছে গেছে দুই স্ট্রেলা অ্যামফিবিয়াস অ্যান্টি- এয়ারক্রাফট ভেহিকেল। ভাসমান অ্যান্টোনভের পাশেই ছুটছে রানওয়েতে। দেরি না করেই ঝপাস্ করে নদীতে নেমে এল।

ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে চমকে গেল নিশাত। কখন যেন রক্তিম চোখের এক লোক রিয়ার র‍্যাম্প পেরিয়ে উঠেছে হোল্ডে, হাতে এখন করাতের মত মস্ত এক দাঁতাল ছোরা!

ছুটে আসছে নিশাতের বুক ফাড়তে!

অ্যান্টোনভ নদীর দিকে যেতেই সে ও তার তিনসঙ্গী ডাইভ দিয়েছে রিয়ার র‍্যাম্পে। সবার হাতে ছিল একে-৪৭, কিন্তু তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হারিয়েছে এই লোকটা।

রক্ত জমাট করা এক হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশাতের ওপর। কিন্তু থাবা দিয়ে ছোরা সরিয়ে দিল নিশাত। ওর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা।

ভারসাম্য হারাল মহিলা ক্যাপ্টেন। মাথা দিয়ে বেদম গুঁতো দিয়েছে জানোয়ারটা ওর বুকে। পিছিয়ে গিয়ে পিছলে পড়তে শুরু করেছে নিশাত, বেরিয়ে গেল সাইড ডোর দিয়ে। খপ্ করে কিছু ধরতে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে জি-৩৬। অবশ্য, একহাতে ধরেও ফেলল ডোরফ্রেম। ঝুলছে বিমানের বাইরে। বুকের ব্যথায় শরীর প্রায় অশ। সামান্য নীচে খলখল করে ছুটছে খরস্রোতা নদী।

লাফিয়ে সামনে বাড়ল আততায়ী, এবার বেদম লাথি দিয়ে বিমান থেকে ফেলে দেবে মহিলা শত্রুকে। কিন্তু তার আগেই জোর এক দুলুনি দিয়ে আবারও বিমানে ঢুকল নিশাত। উরুর হোলস্টার থেকে তুলে নিয়েছে বেরেটা এম৯। হামলাকারীর মুখে পিস্তলের নল ভরেই টিপে দিল ট্রিগার।

বিস্ফোরিত হলো চরমপন্থীর মাথা। নানাদিকে ছিটকে গেল রক্ত ও মগজ। ধুপ করে মেঝেতে পড়ল লাশ। মাথা নেই বললেই চলে।

হোল্ডের অন্য অংশে চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়েছে ফ্রেঞ্চ বুনো। এইমাত্র দেখেছে নিশাতের উপর হামলা করেছে এক শত্রু।

তখনই ডিফেখনের চারপাশে ছিটকে উঠল অসংখ্য রঙিন ফুলকি। হোল্ডের আরেকপাশ থেকে তেড়ে আসছে দুই ফ্যানাটিক, হাতে একে-৪৭ রাইফেল। জিপ ও সিমেন্ট মিক্সার ঘুরে এসেই গুলি করল।

ওর কর্ড দিয়ে পাল্টা হামলা করল বুনো। পাশেই সিমেন্ট মিক্সারের ক্যাবের কাছে লুকিয়ে আছে ভীত পবন ও ফারিয়া। হুস্ আওয়াজ তুলে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট। ঠং-ঠং করে লাগছে ছাতে।

পবন ও ফারিয়াকে তাড়া দিল ডিফেখন, ‘সোজা উঠে পড়ো সিমেন্ট মিক্সারে! লুকিয়ে পড়বে ভিতরে!’

তর্ক না করে নির্দেশ মানল পবন ও ফারিয়া।

ওদেরকে কাভার দিল বুনো।

ট্রাকের ক্যাবে উঠেই সিটে বসে পড়েছে দুই সিভিলিয়ান।

মস্ত সিমেন্ট ব্যারেলে লাগল কমপক্ষে বিশটা গুলি।

কিন্তু পিছনের ব্যারেল পুরু ইস্পাতের, ঠেকিয়ে দিল বুলেট।

দুই চরমপন্থী লক্ষ্য করে গুলি করছে বুনো।

বুম! বুম! আওয়াজ তুলছে কর্ড।

পরিষ্কার বুনো বুঝল: এরা সত্যিই উন্মাদ; কিন্তু মাথা পুরো গুলিয়ে যায়নি। বদলে নিচ্ছে লড়াইয়ের কৌশল। লুকিয়ে পড়েছে জিপের পিছনে. টিটকারি দেয়ার জন্য শিয়ালের মত খ্যা-খ্যা করে হাসছে। লাফিয়ে উঠছে কাভার থেকে, গুলি করেই বসে পড়ছে। যেন দুই শয়তানের চ্যালা। –

‘শালারা! রেগে গেছে, ডিফেখন। তখনই জিপের পিছনের সিটে উঠে এল এক উগ্রপন্থী, ওর দিকেই তাক করেছে একে-৪৭!

কর্ডের তাক বদলে নিয়েই গুলি করল ডিফেখন।

বুলেট লাগল জিপের পিছনের ঢাকার হ্যাণ্ডব্রেক ক্ল্যাম্পে।

টুকরো টুকরো হয়ে গেল জিনিসটা।

পিঠে আততায়ীকে নিয়ে ভীষণ দুলে উঠল জিপ, রওনা হয়ে গেল বিমানের রিয়ার র‍্যাম্পের দিকে। পরক্ষণে ভাসমান বিমান থেকে নদীতে গিয়ে পড়ল জিপ। ছলকে উঠল পানি।

মনে মনে বলল বুনো, ‘একটা শত্রু কমল।’

.

বিমানের পিছনে যখন এসব ঘটছে, রানা দেখছে ককপিটের স্টারবোর্ডের জানালা দিয়ে। পাশেই শ্যারন ও তারাসভ। মুখ শুকিয়ে গেছে ওদের দু’জনের।

তখনই পিছলে গেল বিমান।

ছোট একটা জলপ্রপাতের সঙ্গে গিয়ে পড়ল কয়েক ফুট নীচের নদীতে। তাল রাখতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেলেন ডক্টর তারাসভ।

পতন সামলে রানা দেখল, ডানদিকে দুই অ্যামফিবিয়াস স্ট্রেলা, জোর গতি তুলে আসছে বিমানের দিকেই।

দুই উভচর গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়াও আছে একজন করে লোক। কাঁধে তুলে নিয়েছে আরপিজি-৭ রকেট-প্রপেল্ড গ্রেনেড লঞ্চার।

‘অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে, এটা ধরো,’ বলল রানা। শ্যারনের হাতে দিয়েছে তিন স্যামসোনাইট কেসের একটা।

ওটার ভিতরে রয়েছে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার। ‘আমরা বড় জলপ্রপাতের মুখে পৌঁছলেই যত দূরে পারো ছুঁড়ে ফেলবে কেস।’

‘ওই পর্যন্ত কি আর যেতে পারব?’ আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল শ্যারন। ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে ককপিটের জানালা। কোথা থেকে যেন গোলাগুলি শুরু করেছে কেউ।

চমকে গিয়ে প্রায় বসে পড়েছে শ্যারন।

‘ধুপ! ধুপ!’ আওয়াজ পেল।

অ্যান্টোনভে উঠে আসা তিন ফ্যানাটিকের দু’জন নেমেছে বিমানের বনেটে।

রানা বুঝে নিল কী ঘটেছে।

ওই দুই লোক উঠে পড়েছিল বিমানের পিঠে

এইমাত্র হামলা করেছে ককপিট দখল করতে।

‘ককপিট থেকে বেরোও!’ শ্যারন ও তারাসভের পিঠে দু’হাতে ঠেলা দিল রানা। হোল্ডের দিকে পাঠাতে চাইছে।

ককপিটের দরজা খোলা, হুড়মুড় করে বেরোতে চাইল ওরা। পরক্ষণে ককপিটে ঝড় বয়ে গেল গুলির।

ছিঁড়েখুঁড়ে গেল ককপিটের দেয়াল ও সিট।

কিন্তু দেরি করে ফেলেছেন ডক্টর তারাসভ।

অন্তত দশটা বুলেট বিঁধল তাঁর পিঠে। ধুপ্ করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। পরক্ষণে শ্যারনকে নিয়ে দরজা পেরিয়ে গেল রানা।

ডক্টর তারাসভ অনেক সাহায্য করেছেন। আর কখনও ছেলে- মেয়ে বা নাতিপুতির মুখ দেখবেন না।

ককপিট থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ করেই আছাড় খেল শ্যারন এবং রানা। এইমাত্র আরেকটা জলপ্রপাত পেরিয়ে আরেকটু নীচের নদীতে পড়েছে বিধ্বস্ত বিমান। নতুন করে গতি পেল। দূরে গিয়ে সরাসরি সাগরে পড়েছে নদী।

ককপিটের দরজার ওদিক থেকে আসছে গুলি। কানের পাশ দিয়ে বুলেট যেতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, টেনে তুলল শ্যারনকে। হোল্ডের পিছনে যাবার জন্য ঝেড়ে দৌড় দিল।

একটা বুলেট গাঁথল শ্যারনের কোমরে, বেরোল পেট ফুটো করে। ব্যথায় কাতরে উঠেছে ও। পড়ে গেল হোঁচট খেয়ে।

থমকে ওকে তুলে নিতে চাইল রানা, তারই ফাঁকে দেখল হোল্ডের চারপাশ। বিমানের পোর্ট সাইডের দরজার কাছেই ডিফেখন, সিমেন্ট মিক্সারের পাশে। সতর্ক ফ্যানাটিকের দিকে পাল্টা গুলি করছে। মিক্সার টাবে লাগছে প্রতিপক্ষের বুলেট। ছিঁড়ে ছিটকে পড়ছে কেবল, নেটিং ও সিটের ফোম। খোলা রিয়ার র‍্যাম্প থেকে আসছে আলো, সামান্য পিছনেই নদী। স্টারবোর্ডের দরজার কাছে উবু হয়ে বসেছে নিশাত

হঠাৎ করেই ওর মাথা ছুঁয়ে দরজা পেরোল একটা আরপিজি, লাগল সিমেন্ট মিক্সারে। বিকট আওয়াজ তুলে বিস্ফোরিত হলো বোমা! আঘাত লাগতেই লাফিয়ে উঠেছে সিমেণ্ট মিক্সার… সোজা ঘুরে গেল ক্যাপ্টেন ডিফেখনের দিকে, চিঁড়েচ্যাপ্টা করে দেবে।

কোথাও যাওয়ার নেই বুনোর। সময় বা সুযোগও পেল না।

রানার চোখের সামনে ডিফেখনকে আড়াল করল সিমেন্টের ভারী মিক্সার। বিকট বুম আওয়াজে বাড়ি খেল ওটা স্টিলের দেয়ালে। এক সেকেণ্ড আগেও যেখানে ছিল ডিফেখন।

‘হায় ঈশ্বর!’ এত ব্যথার ভিতরেও আফসোস করল শ্যারন।

ওকে টেনে তুলল রানা, টলমল করছে নিজের দু’পা।

বিস্ফোরণের ফলে ভীষণ দুলছে বিমান।

দ্বিতীয় স্ট্রেলা থেকে এল আরেকটা আরপিজি, লাগল অ্যান্টোনভের ডান পাখার ইঞ্জিনে। ছিটকে আরেকদিকে গিয়ে নদীতে তলিয়ে গেল বিচ্ছিন্ন ইঞ্জিন।

খুঁড়িয়ে হাঁটা লোকের মত নাটকীয় হোঁচট খেল বিমান।

ডানদিকের ইঞ্জিন খসে যেতেই সাঁই করে কাত হয়ে বামে ঘুরে গেল অ্যান্টোনভ, হারিয়ে ফেলেছে ভারসাম্য। খোলা রিয়ার র‍্যাম্প বেয়ে হুড়মুড় করে উঠে এল নদী। কয়েক সেকেণ্ডে বিমানের মেঝেতে জমল এক ফুট উঁচু পানি।

খপ্ করে রানা ধরেছে হ্যাণ্ডরেইল। হঠাৎ করেই কাত হয়েছে হোল্ড।

‘বড় প্রপাতের কাছে যাওয়ার আগেই আমাদেরকে তলিয়ে দিতে চাইছে,’ বলল রানা।

আহত শ্যারন কিছু ধরতে পারেনি। বিমান কাত হতেই বেকায়দাভাবে পড়ল ও। হাত থেকে ফস্কে গেল স্যামসোনাইট কেস। মুহূর্তে হারিয়ে গেল একফুট পানির নীচে।

কাত হয়ে যাওয়া হোল্ডে এক ফ্যানাটিকের পায়ের সামনে সরসর করে গিয়ে থামল কেস।

এ লোকই খ্যাক-খ্যাক করে হেসে রাগিয়ে তুলছিল বুনোকে।

স্যামসোনাইট কেস দেখেই বুঝে নিল জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ। খপ্ করে তুলে নিল পানি থেকে।

পরিস্থিতি এমনিতেই গুরুতর, কিন্তু এবার দেখা দিল সত্যিকারের মহাবিপদ। সগর্জনে রিয়ার র‍্যাম্প বেয়ে উঠে এল এক উভচর স্ট্রেলা, ওটার সামনের দিকে তৈরি হলো উঁচু ঢেউ। থমকে গেল গাড়ি।

ওটার ওপাশে রয়ে গেছে নিশাত সুলতানা। বুনো বোধহয় শেষ, এবং রানা ও শ্যারন রয়েছে অনেকটা দূরে।

বাঁদরের মত লাফিয়ে স্ট্রেলার দিকে ছুটল চরমপন্থী, হাতে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার কেস। আরেক লাফে উঠল গাড়ির বো- ডেকে। চিৎকার করছে ড্রাইভারের উদ্দেশে। ‘পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি! রওনা হও!’

সময় নষ্ট করল না ড্রাইভার, তীক্ষ্ণ গর্জন ছাড়ল গাড়ি— সাঁই- সাঁই করে পিছিয়ে গেল। ঝপাস করে পড়ল নদীতে।

এমন সময় কর্কশ আওয়াজ হলো।

খ্যার-খ্যার-খ্যার!

ওটা দেখবার আগেই আওয়াজ পেয়েছে রানা।

পিঠে সিমেন্ট মিক্সার টাব নিয়ে গর্জে উঠেছে ট্রাক। ছিটকে পিছিয়ে গেল— বাড়ছে গতি- সোজা পিছিয়ে চলেছে পানি ভরা হোল্ডে।

ওই ট্রাক ড্রাইভ করছে পবন। এক সেকেণ্ড পর রিয়ার র‍্যাম্প থেকে নেমেই চেপে বসল’ পিছাতে শুরু করা স্ট্রেলার নাকে। ভারী সিমেন্ট মিক্সারের রিয়ার বাম্পার গেঁথে গেল ড্রাইভারের কমপার্টমেন্টে। ভয়ঙ্করভাবে দুমড়ে গেল গাড়িটা। মুহূর্তে চ্যাপ্টা হয়ে মরল ড্রাইভার ও গানার।

শেষসময়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল পবন। পরিষ্কার দেখেছে ছোট কেস নিয়ে উভচর গাড়িতে উঠছে উগ্রপন্থী। তার পালিয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছে ও।

কিন্তু লড়াই শেষ হয়নি।

হাইব্রিড স্ট্রেলার উপর চেপে বসেছে সিমেন্ট মিক্সার, কিন্তু ক্রমেই ভাসতে ভাসতে সরছে বিমান! মাঝে তৈরি হচ্ছে ফারাক। কয়েক ফুট কাছের বিমান সরে গেল বহু দূরে। নদীর বুক চিরে রানওয়ের উল্টোদিকের পারে চলল স্ট্রেলা ও সিমেন্ট মিক্সার।

স্ট্রেলার উপর এখনও রয়ে গেছে ফ্যানাটিক।

ওই লোকের কাছেই আছে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ারসহ কেস। সিমেন্ট মিক্সারের ক্যাব লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল সে। জানে, জিতে গেছে। সিমেন্ট মিক্সারের কারণে ঠিকভাবে গুলি করতে পারছে না, কিন্তু পবন ও ফারিয়ার আশপাশ দিয়ে যাচ্ছে বুলেট। মাথা নিচু করে নিয়েছে ওরা। ঝরঝর করে ওদের উপর ঝরে পড়ল উইণ্ডশিল্ডের ভাঙা কাঁচ।

ঝুঁকি নিয়ে চট্ করে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রাখল পবন। আত্মা খাঁচা-ছাড়া হয়ে গেল ওর। ক্যাবের দিকেই আসছে লোকটা, হাতে উদ্যত অস্ত্র। পরক্ষণে গুলির আঘাতে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল রিয়ার ভিউ মিরর।

মাথা নিচু করে ফেলেছে পবন ও ফারিয়া। ওদের মাথার উপরে নামল ধারালো সব কাঁচের টুকরো। দু’সেকেণ্ড পর আবারও মুখ তুলে চাইল ওরা। আততায়ী এসে দাঁড়িয়েছে ওদের ক্যাবের দরজায়। একহাতে স্ফেয়ারের কেস, অন্যহাতে একে-৪৭ রাইফেল। অস্ত্রটা তাক করল দুই অসহায় মানুষের দিকে।

পাগলের মত করে খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল। এবার হাসতে হাসতে টিপে দেবে ট্রিগার।

‘বাই-বাই, শালা-শালী!’

কিন্তু তখনই বেকায়দাভাবে ছিটকে পিছনে গেল তার মাথা। ঠিক নাকের উপর গুলি করেছে নিশাত সুলতানা। সিমেন্ট মিক্সারের আরেক পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে, হাতে বেরেটা এম৯ পিস্তল।

কেউ দেখেনি, কিন্তু পবন সিমেন্ট মিক্সার পিছাতে শুরু করতেই ডাইভ দিয়ে ওটার পাশের রেইল ধরেছে নিশাত, উঠে এসেছে ট্রাকে।

নাকে গুলি নিয়ে দুলল আততায়ী, আর তখনই খপ্ করে তার হাত থেকে কেড়ে নিল ফারিয়া স্যামসোনাইট কেস। পরক্ষণে রানিং বোর্ড থেকে ধুপ করে নদীতে পড়েই টুপ করে ডুবে গেল লোকটা!

‘আপা! ধন্যবাদ দেব না!’ বলল পবন। আরও কিছু বলত, কিন্তু হোঁচট খেল বেচারা। হাইব্রিড স্ট্রেলা ঠেলে তীরে তুলেছে সিমেন্ট মিক্সার ট্রাকটাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর দক্ষিণের কয়েকটা বোল্ডারের ফাঁদে আটকা পড়ল দুই গাড়ি।

রানওয়ের উল্টো তীরে আছে ওরা।

পশ্চিমে চাইল নিশাত।

তিন শ’ গজ দূরেই উঁচু জলপ্রপাত, প্রায় ওটার কাছে পৌঁছে গেছে বিমান। তখনই দ্বিতীয় স্ট্রেলা দেখল নিশাত। নদীর আরও ভাটিতে এ তীরেই উঠেছে ওটা। গা থেকে ঝরঝর করে পড়ছে পানি।

‘কপাল!’ বিড়বিড় করল নিশাত।

আরেকবার চট করে দেখে নিল বিধ্বস্ত অ্যান্টোনভ। ওটা চলে গেছে জলপ্রপাতের খুব কাছে।

‘স্যর!’ রেডিয়ো করল নিশাত। ‘আমার সঙ্গে পবন-ফারিয়া! সঙ্গে একটা স্ফেয়ার কেস! কিন্তু ক্লিফের দিকে যেতে পারব না! ওদিক থেকে আসছে আরেকটা স্ট্রেলা!’

‘সরে যান ওখান থেকে!’ তাড়া দিল রানা, ‘লুকিয়ে পড়বেন! অবস্থা বুঝে…’

কেটে গেল সিগনাল।

দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে নিশাত। পাঁচ সেকেণ্ড পর বলল, ‘পবন-ফারিয়া, এসো! ক্লিফের দিকে যেতে পারব না। অন্য কোনও উপায়ে সরিয়ে ফেলতে হবে স্ফেয়ার।’

সিমেণ্ট মিক্সার ট্রাক থেকে নেমে পড়ল ওরা, দৌড় শুরু করল দক্ষিণ লক্ষ্য করে। ওদিকে পোলার আইল্যাণ্ডের পর্বতমালা।

.

এখনও বিধ্বস্ত অ্যান্টোনভ বিমানে রয়ে গেছে মাসুদ রানা। দুই স্যামসোনাইট কেস নিয়ে ভেসে চলেছে জলপ্রপাতের উদ্দেশে। সাগরে ফেলে দিতে হবে ওই চারটে ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার।

সবই যেন হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রণহীন। ছুটছে বিমান জলপ্রপাত লক্ষ্য করে। কোথায় চলেছে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা, জানে না রানা। বিমানের দেয়ালে সিমেন্ট মিক্সার লেগে মারা পড়েছে ক্যাপ্টেন ডিফেখন। মেঝেতে বসে পড়েছে আহত শ্যারন, প্রায় অচেতন। এদিকে ককপিটে রয়ে গেছে আরও দুই আততায়ী।

হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল ককপিটের দরজা, হোল্ডের চারপাশে গুলি পাঠাল দুই খুনি। ককপিটের সিঁড়ির কাছেই রানাকে দেখল তারা। ঝট্ করে অস্ত্র তাক করল ওর দিকে।

নিজে রানা অস্ত্র তাক করতে পারেনি।

এবার কেউ ঠেকাতে পারবে না নিশ্চিত মৃত্যু!

কিন্তু মস্ত হোঁচট খেল অ্যান্টোনভ বিমান! পৌছে গেছে ওরা জলপ্রপাতে! হুড়মুড় করে নীচে রওনা হয়ে গেল বিমান। পরক্ষণে আরেকটা হোঁচট খেয়ে থামল, থরথর করে কাঁপছে। কানফাটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুরু হচ্ছে ধাতুর উপর পাথরের ঘষায়। আচমকা থমকে গেছে বিমান!

বাইরে থেকে কেউ দেখলে বিস্মিত হবে:

আর্কটিকের মস্ত জলপ্রপাতের মুখে থেমে আছে প্রকাণ্ড কার্গো বিমান, ডানদিকের ডানা থেকে উঠছে কালো ধোঁয়া ও লাল আগুন। নাক নীচে তাক করেছে ককপিট। নদীর ঢেউয়ের সামান্য উপরে ঝুলছে দুই ডানা। তলা দিয়ে গিয়ে সাগরে পড়ছে বিপুল পানি।

কাছেই রানওয়েতে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাফিয়ান আর্মির প্রায় সব ভেহিকেল। শুধু নদীর অপর তীরে দুই স্ট্রেলা। একটার নাকে পবনের সেই সিমেন্ট মিক্সার ট্রাক। অন্য উভচর গাড়িটা পাহারা দিচ্ছে ক্লিফ।

বিমান হুমড়ি খেতেই সামনে ছিটকে গেছে সবাই।

শ্যারনকে নিয়ে দেয়ালে গুঁতো খেয়েছে রানা।

ওকে খতম করে দেয়ার এক সেকেণ্ড আগে ছিটকে পড়েছে দুই চরমপন্থী নীচের ককপিটে।

আসলে কী ঘটছে বুঝতে এক সেকেণ্ড সময় লাগল রানার।

ওই ল্যাণ্ডিং গিয়ার….

জলপ্রপাতের মুখে আটকে গেছে বিমানের রিয়ার ল্যাণ্ডিং হুইল। ওটাই থমকে দিয়েছে ওটার সাগরে পতন।

এমন চাইনি, তিক্ত মনে ভাবল রানা। নদীর শেষে ক্লিফের মাথা থেকে খসে পড়বে বিমান সাগরে। ফেলে দেবে স্ফেয়ার। হলো না, ওরা থেমে গেছে জলপ্রপাতের মুখে! দু’সেকেণ্ড পর আবারও খুন করতে আসবে দুই উন্মাদ!

রানার চোখ গেল বিমানের দুই সাইড ডোরের উপর। ওগুলো মাত্র আট ফুট উপরে। ভাবল, ওখানে উঠে যাওয়ার সময় পাব? একবার স্ফেয়ারগুলো সাগরে ফেলতে পারলে…

কিন্তু ককপিটে নড়াচড়া!

বিমানের পতন সামলে নিয়েছে দুই চরমপন্থী।

দু’চার সেকেণ্ড পরেই হাজির হরে।

ককপিটের দরজার ফাঁকা জায়গার দিকে পিস্তল ঘোরাল রানা। অন্যহাতে টেনে তুলল শ্যারনকে, বসিয়ে দিল পাশের সিটে। নিজের সিটে বসে বেঁধে নিল দুই সিটের নিরাপত্তা বেল্ট।

ককপিটের দিকে আবারও চাইল। পিস্তল তাক করেনি আততায়ীদের উদ্দেশে। ওর লক্ষ্য পাইলট সিটের ছাতে ঝুলন্ত ল্যাণ্ডিং গিয়ার রিট্র্যাক্টার লিভার।

বুম্! করে উঠল ওর পিস্তল।

ঠং করে লাগল বুলেট ল্যাণ্ডিং গিয়ার লিভারে, ঝটকা দিয়ে সামনে গেল ওটা।

ফলাফল পাওয়া গেল এক সেকেণ্ড পর।

লাফ দিয়ে নদীর মেঝে থেকে উঠে এল ল্যাণ্ডিং গিয়ার, এবং সঙ্গে সঙ্গে উঁচু প্রপাত থেকে সাগরের দিকে সাঁই করে রওনা হয়ে গেল অ্যান্টোনভ বিমান!

দৃশ্যটা বিস্ময়কর!

রাজহংসীর মতই নাক নিচু করে ডাইভ দিয়েছে বিমান। প্রপাতের পানি এবং ওটার গতি ঠিক সমান। বাইরে থেকে কেউ দেখলে ভাববে, এবার ঠিকই সিনেমার দৃশ্যের মত উড়বে বিমান। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।

প্রকাণ্ড জলপ্রপাতের নীচে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে বিপুল শুভ্র ফেনা, ভয়ঙ্কর জোর এক ঝপাস্ আওয়াজ তুলে সেখানে গিয়ে নামল বিমান। চারপাশে প্রচুর বুদ্বুদ তৈরি করে সাগরে ডুব দিল কাঁচের নাক, যেন অলিম্পিকের স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত সাঁতারু।

সাগরের অনেক গভীরে চলে যেত বিমান, কিন্তু ওটার পতন ঠেকিয়ে দিল দুই ডানা ও তিন ইঞ্জিন। হাড়ভাঙা ভয়ঙ্কর এক ঝাঁকি খেল অ্যান্টোনভ, ওখানেই থমকে গেল। ককপিট চলে গেছে বিশফুট পানির তলে। আপাতত থেমে গেছে পতন।

ককপিটে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে দুই ফ্যানাটিকের।

বিমান নামতেই ভাঙা জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকেছে হাজার হাজার লিটার পানি। সেসব ভেদ করে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে সোজা ককপিট থেকে বেরিয়ে গেছে তারা সাগরে।

এদিকে ষাট-সত্তর ফুট উপর থেকে পড়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে রানা ও শ্যারন। অবশ্য বেশিরভাগ ঝাঁকি সহ্য করেছে সিটবেল্ট।

গুলির ক্ষতের কারণে ব্যথায় গুঙিয়ে চলেছে শ্যারন। আপাতত হোল্ডে ওরা দু’জন ছাড়া কেউ নেই।

কিন্তু রানা জানে, এখনও শেষ হয়নি ওদের কাজ।

আরেকটা ব্যাপার: মাত্র শুরু হয়েছে সত্যিকারের বিপদ।

এতক্ষণ কর্কের মত ভেসেছে বিমান, কিন্তু এবার খাড়াভাবে সাগরতলের দিকে রওনা হবে ওটা!

কথাটা মাত্র ভেবেছে রানা, তখনই নীচে রওনা হয়ে গেল বিমান। ভাঙা ককপিট জানালা দিয়ে ঢুকছে বিপুল পানি, খলখল করে উঠে আসছে হোল্ডে। ওই রাক্ষুসে পানি এবার গিলে নেবে রানা ও শ্যারনকে।

নীচের দিকে নাক তাক করে নামছে বিমান। হোল্ডের সামনে আছে রানা ও শ্যারন। ককপিট থেকে ওদের দিকে উঠে আসছে বরফ-ঠাণ্ডা পানি।

ঝট্ করে শ্যারনের সিটবেল্ট খুলল রানা, নিজেরটা খুলতেই উপরে দেখল দু’পাশের দরজা দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছে পানি। যেন ছোট জলপ্রপাত।

হোল্ডের রিয়ার র‍্যাম্প দিয়ে আসছে ধূসর দিনের আলো। চট্ করে চারপাশ দেখে নিল রানা। দু’ডানার কারণে আপাতত বিমানে তৈরি হয়েছে একটা ভারসাম্য। পতনের গতিও কমেছে। কিন্তু স্থির হয়ে গেছে বিমানের নিশ্চিত পরিণতি।

কিছুক্ষণ পর রিয়ার র‍্যাম্পের চৌকো জায়গাটা দিয়ে হুড়মুড় করে নামবে আস্ত সাগর। সাধারণ ধাতব টিউব হয়ে উঠবে এই বিমান, পাথরের মত নেমে যাবে নীচে।

এখনও অনেক কাজ, নিজেকে বলল রানা। সাগরের গভীরে ফেলতে হবে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার।

কাঁধে শ্যারনকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, ছলাৎ-ছলাৎ আওয়াজ তুলে চলে গেল বিমানের পোর্টসাইডের নেটিঙের কাছে। ওটা বেয়ে উঠতে লাগল। আট ফুট উপরে দরজা।

একফুট একফুট করে উঠছে রানা। আর ওর বুটের নীচে খলবল করে উঠে আসছে সাগর। পানি উঠে আসবার গতি রানার উঠবার গতির চেয়ে বেশি।

এক সেকেণ্ড পর তলিয়ে গেল রানার বুট। পরের কয়েক সেকেণ্ডে হাঁটু পেরিয়ে উঠে এল পানি ওর কোমরে।

দরজার পাশে পৌছে গেল রানা। ওকে ভিজিয়ে দিয়ে নীচে পড়ছে ছোট জলপ্রপাত। শ্যারনের বামহাতে নেটিং পেঁচিয়ে দিল ও, এবার পড়বে না মেয়েটি। নিজেও দু’হাত ব্যবহার করতে পারবে। ছোট একটা স্যামসোনাইট কেস খুলল রানা, দেখা গেল চকচকে লাল ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার। কেস সাগরে ফেললেই হবে না, বেশিরভাগ কন্টেইনারের মতই ওটাও বোধহয় ভাসবে।

একটা লাল বল তুলে নিল রানা। জিনিসটা ছোট, মসৃণ এবং ভারী। দরজার ওপাশে ওটা ফেলে দিল। নেমে গেল জিনিসটা।

একই পরিণতি হলো দ্বিতীয় স্ফেয়ারের। চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল সাগরতলে।

দুটো গেছে।

আরও দুটো রয়ে গেছে।

প্রথম স্যামসোনাইট কেস ফেলে দিল রানা, এবার ব্যাটল নেটিং থেকে খুলে নিল দ্বিতীয় কেস। ওর পাশে গুঙিয়ে কী যেন বলল শ্যারন।

কোনও ব্যাপারে সতর্ক করছে?

ঘুরে চাইল রানা, চমকে গেল।

ওর নাকের কাছে উঠে এসেছে এক কালো ফ্যানাটিক!

ফেনিল পানি পেরিয়ে ককপিট থেকে আবারও হাজির হয়েছে এসে হোল্ডে, রাগে কিড়মিড় করছে দাঁত। দু’হাতে খপ্ করে চেপে ধরল রানার গলা।

গায়ের জোরে দ্বিতীয় কেস দিয়ে বাড়ি মারল রানা। একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে গেল লোকটার নাক, দুই ফুটো দিয়ে ছিটকে বেরোল রক্তের ধারা। ঝপাৎ করে নীচের পানিতে গিয়ে পড়ল খুনি।

দরজার পাশের নেটিং ধরে ভারসাম্য রাখল রানা, তৈরি হয়ে নিচ্ছে পরের হামলার জন্য। কিন্তু আর এল না লোকটা, কারণ তখনই হোল্ডের পিছনের খোলা অংশটা তলিয়ে গেল সাগরে।

পাগল হয়ে উঠল সময়।

উপর থেকে হুড়মুড় করে নামল লাখখানেক লিটার পানি।

হোল্ডের পাশের নেটিং ধরে নিজেকে সামলে নিতে চাইল রানা। বুক দিয়ে চেপে ধরেছে শ্যারনকে, নইলে পড়ে যাবে মেয়েটি। আগ্রাসী ফ্যানাটিকের কপাল অতটা ভাল নয়, সে রয়েছে হোল্ডের ঠিক মাঝে— বিপুল পানি নেমেছে তার উপর।

পানিতে ভরে গেল হোল্ড। পুরো তলিয়ে গেছে বিমান।

রানার কথাই ঠিক হয়েছে, অ্যান্টোনভ সত্যিই হয়ে উঠেছে ধাতব টিউব।

ঘোলাটে হয়ে গেছে চারপাশের পানি, তার ভিতর দিয়ে দেখা গেল দুই বিস্তৃত ডানা নিয়ে হাজার হাজার ফুট নীচের উদ্দেশে রওনা হয়েছে বিমান।

হোল্ডের ভিতর বৃত্তাকার দেয়ালগুলো জোর মড়মড় আওয়াজে গুঙিয়ে উঠল। অসম্ভব হয়ে উঠছে চারপাশের পানির চাপ’। বেশিক্ষণ লাগবে না সাগরতলে বিমান নামতে। তার আগেই মুচড়ে যাওয়া বিয়ার ক্যানের মত হবে ফিউজেলাজ। তখন ভিতরে কেউ থাকলে জানে বাঁচবে না।

দম আটকে রেখে শ্যারনের ওয়েপন্স বেল্ট থেকে তুলে নিল রানা কমপ্যাক্ট স্কুবা রিব্রিদার। ওটা পাঁচ মিনিট বাতাস দেবে। মুখে আটকে নিল নাযল। বাতাসে ফুসফুস ভরে যেতেই দ্বিতীয় আরেকটা মিনি রিব্রিদার নিল রানা, গুঁজে দিল শ্যারনের মুখে। কিছুক্ষণের জন্য পানির নীচে বাতাস পাবে ওরা।

এবার যে কাজে এসেছে দরজার পাশে, সেটা সারল রানা। হোল্ডে ভাসছে ও। খুলে ফেলল দ্বিতীয় স্যামসোনাইট কেস, ওটা থেকে বের করে খোলা দরজা দিয়ে ফেলে দিল দুই ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার। চিরকালের জন্য বহু নীচের সাগরে চলে গেল ওগুলো।

কাজ শেষে শ্যারনের মাথার পাশের কী যেন ধরল রানা। খুলতে শুরু করেছে গিঁঠ। আরেকহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে শ্যারনকে। জিনিসটার রিপ কর্ড ধরেছে রানা, তখনই খপ্ করে ওর বুট চেপে ধরল কে যেন!

সেই লোকটা! যেন পণ করেছে কিছুতেই মরবে না!

বিমানের ভিতর থেকে বেরোতেও দেবে না রানাকে।

মড়মড় আওয়াজ তুলল বৃত্তাকার দেয়াল। গুঙিয়ে উঠছে বিমান। আর কয়েক সেকেণ্ড, তারপর সাগরের ভয়ঙ্কর চাপে চ্যাপ্টা হবে দেয়াল। ভিতরে কেউ থাকলে…

কিন্তু উন্মাদ লোকটা ছাড়ছে না রানার বুট!

বেরোতে দেবে না বিমান থেকে!

কষে লাথি মারল রানা তার মুখে। বুট ছাড়ছে না লোকটা! বাধ্য হয়ে সামনের জিনিসটার রিপকর্ড টেনে দিল রানা। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা খেল লাইফ রাফট। বুলেটের মত উপরে রওনা হলো। একই সময়ে মুচড়ে পা ছাড়িয়ে নিয়েছে রানা। একহাতে ধরেছে আহত শ্যারনকে। বাতাস ভরা রাফটের টান খেয়ে রিয়ার র‍্যাম্প দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল ওরা।

বিমান চলেছে সাগরতলে।

ঝড়ের গতিতে উঠছে রাফট, পিছু নিয়েছে অসংখ্য বুদ্বুদ। শক্ত হাতে রাফট ধরেছে রানা, অন্যহাতে জড়িয়ে ধরেছে শ্যারনকে। চোখ নীচের দিকে।

কিছুক্ষণ পরেই গভীর সাগরের প্রচণ্ড চাপে অ্যালিউমিনিয়ামের ক্যানের মত দুমড়ে গেল অ্যান্টোনভ বিমান। চেপ্টে যাওয়ার কথা নেশাখোর ফ্যানাটিকের। তাকে পেটে নিয়ে সাগরের আঁধারে হারিয়ে গেল বিমান।

বড় দ্রুত উঠবার ফল কী হতে পারে, ভাল করেই জানে রানা ও শ্যারন। বারবার শ্বাস ফেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সাগরের উপর ভেসে উঠল ওরা।

পোলার আইল্যাণ্ডের উঁচু ক্লিফ ও মস্ত জলপ্রপাত পিছনে। দ্বীপের এদিকটা যেন বরফ মোড়া খাড়া দেয়াল, কোনওভাবে বেয়ে ওঠা অসম্ভব। পশ্চিমে বিস্তৃত সাগর জুড়ে বরফ। তার ভিতর দিয়ে গেছে দশফুট গভীর সব লিড।

শ্যারনকে ঠেলে রাফটে তুলল রানা।

কাজে সাহায্য করতে চাইল শ্যারন, কিন্তু কোমর ও পেটের ক্ষত ভয়ঙ্কর ব্যথা দিচ্ছে ওকে।

শ্যারনকে রাফটে তুলে দেয়ার পর নিজেও রানা উঠল। বৈঠা তুলে নিয়ে বাইতে লাগল। চলেছে নিরাপদ জায়গা লক্ষ্য করে। ক্লিফের মাথায় শত্রুরা হাজির হওয়ার আগেই ঢুকে পড়তে চায় কাছের লিডে।

একমিনিট যাওয়ার আগেই ওরা পেয়ে গেল লিডের আড়াল। চুপ করে বসে ছিল শ্যারন, এবার শুয়ে পড়ল। বুজে গেছে চোখ। চেতনা এবং জ্ঞান হারাবার মাঝে ভাসছে ও।

বৈঠা বেয়ে চলেছে রানা। ভাবছে: একদম বরবাদ হয়ে গেল ওর দুঃসাহসী সঙ্গীদের জীবন বিসর্জন, ওর নিজের এত পরিশ্রম।

ডক্টর তারাসভ নেই।

ডিফেখনও শেষ।

এখনও বেঁচে আছে তরুণ মেরিন কর্পোরাল বব বউলিং ও ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো, কিন্তু কোথায় আছে, কে জানে!

শেষ দুই স্ফেয়ার নিয়ে পালাচ্ছে নিশাত সুলতানা, পবন ও ফারিয়া।

নিশ্চয়ই এরই ভিতর পিছু নিয়েছে রাফিয়ান আর্মির লোক।

ধরতে পারলেই সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলবে।

আর আছে শ্যারন আর ও নিজে।

শ্যারন আহত, যদি মারা না-ও যায়, আপাতত নড়তে পারবে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। আমিও বিধ্বস্ত, সত্যিই ক্লান্ত, জানি না আবারও কীভাবে ফিরব যুদ্ধে, ফিরতে পারব কি না!

একুশ

আর্কটিকের পোলার আইল্যাণ্ড।

সকাল সাড়ে এগারোটা।

ইউএসএ-র ভার্জিনিয়া, ক্রিস্টাল সিটিতে তিন এপ্রিল।

রাত সাড়ে এগারোটা।

অ্যানালিস্ট রিনা গর্ডনকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই দড়াম করে পিছনে দরজা বন্ধ করে দিল কেভিন কনলন, হাপরের মত হাঁপিয়ে চলেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে।

একটু আগে একদল সশস্ত্র লোক রিনাকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ভঙ্গি করছিল তারা ভিআইপি ট্র্যান্সপোর্ট টিম।

কেভিন ও রিনা গর্ডন পালাতে শুরু করে সোজা নেমেছে পেন্টাগনের রেল স্টেশনে। ওখান থেকে ট্রেনে উঠে হাজির হয়েছে ক্রিস্টাল সিটিতে। এখানেই কেভিনের বাসা। অফিস থেকে বেশ কাছেই।

‘বুঝলেন, রিনা, সত্যিই অফিশিয়ালি ভিআইপি হয়ে গেছেন আপনি,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কেভিন। ‘আরেকটু হলে গেছিলাম! ভাবা যায়! পেন্টাগনের নাকের ডগা দিয়ে কিডন্যাপ করবে!’

‘এরা কারা?’ জানতে চাইল রিনা গর্ডন।

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল কেভিন। কিন্তু ওরা জানত আপনি কে বা কোথায় যাচ্ছেন। আর তাই কিডন্যাপ করতে চাইছিল। বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক হবে না। একবার যদি জেনে যায় আমি কে, খুঁজে বের করবে এই অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু আমরাও বসে থাকব না। তদন্ত করব কী কারণে পিছু নিয়েছে। এখন প্রথম দরকার কমপিউটার। ওটাতে কিছু জরুরি সট্ওয়্যার থাকতে হবে। …দাঁড়ান!’

সামনে বেড়ে টেবিলের কাছে থামল কেভিন, ড্রয়ার টেনে বের করল ল্যাপটপ। দেরি না করেই চালু করল কমপিউটার। কানে পরে নিল ইয়ারপিস, টাইপ করতে লাগল কি-বোর্ডে।

‘বিদেশি মনে হয়নি ওদের,’ আনমনে বলল রিনা গর্ডন। কণ্ঠ এমন, যেন অতি সাধারণ কোনও বিষয়ে অ্যানালিসিস করছে। ‘অন্য দেশের সুরে কথা বলেনি। নিশ্চয়ই আমাদের দেশিই। এমন ধরনের ভুল করেছে, যেটা বেশিরভাগ মানুষ দেখবেই না। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে ওটা হয়েছে। আইডি ট্যাগ বা গাড়ি— সবই ঠিক ছিল। কিন্তু গাড়ির রিম যে ঠিক নেই, তা খেয়াল করেনি। এ থেকে বোঝা যায় হঠাৎ করেই কিডন্যাপ করতে বলা হয়েছে। আর…’

‘একমিনিট,’ হাত তুলে বাধা দিল কেভিন। আঙুল তাক করে দেখাল ইয়ারপিস। ‘আমি ডি.সি.-র রেডিয়ো এয়ারস্পেসে ট্যাপ করছি। মিলিটারি, ইন্টেলিজেন্স ও পুলিশ চ্যানেল। কি-ওঅর্ড হিসাবে ব্যবহার করছি আমাদের নাম। লোকগুলো কিডন্যাপ করতে পারেনি, কাজেই তাদের উপরওয়ালার কাছে সেল ফোন বা রেডিয়ো করবে…

কমপিউটারের স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে উঠেছে একের পর এক বাক্য।

‘সর্বনাশ…’ বিড়বিড় করে বলল কেভিন।

‘কী হলো? কী পেলে?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল রিনা।

মনিটরের দিকে ইশারা করল কেভিন। নিজেই দেখুন।’ স্ক্রিনে একের পর এক বাক্য আসছে:

ট্র্যাক

ভি-ডেটা সিস্টেম

অ্যাশেলন সাবসিস্টেম রিজিয়ন:

ই-৪ ওয়াশিংটন, ডি.সি. এবং চারপাশের ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ : ৪৬১.৭৩১-৪৬৩.৮৪ মেগাহার্টয কিওঅর্ডস্: গর্ডন, রিনা, কনলন, কেভিন কি-ওঅর্ডস্ ফাউণ্ড।

ফ্রম ইউযার: এ৬ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) প্রথম কণ্ঠ: পেন্টাগন থেকে রিনা গর্ডনকে তুলে নেয়া যায়নি। কারণ কী?

দ্বিতীয় কণ্ঠ: আগেই আমাদের চিনে ফেলে। আরেকজন ছিল। তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।

তৃতীয় কণ্ঠ: আমরা তার নাম জানি। কেভিন কনলন। ডিআইএ-র কর্মচারী। বাস করে ক্রিস্টাল সিটিতে।

প্রথম কণ্ঠ: দেরি না করে ওখানে যাও।

‘কাজেই বুঝতে পারছেন, একটু আগে আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে সিআইএ,’ রিনার দিকে চাইল কেভিন, ‘এবার সোজা এখানে আসবে। তার আগেই চলুন জানটা নিয়ে বেরিয়ে যাই।’

দেরি না করেই অ্যাপার্টমেন্ট তালা মেরে বেরিয়ে এল ওরা। সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়েছে কেভিন। প্রায় দৌড়াতে শুরু করে পৌঁছে গেল কাছের শপিং মলে। ওটা মাঝরাত পর্যন্ত খোলা থাকে। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকল দু’জন, থামল ম্যাগাযিনের র‍্যাকের পাশে। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় দোকানের দরজা।

‘আমাদের বোধহয় খোলাখুলি আলাপ করা দরকার,’ বলল কনলন। ‘আমি অনেক কিছুই জানি না। আবার আপনিও অনেক কিছুই জানেন না। তাই দু’জনের উচিত তথ্য বিনিময় করা।’

‘কেন তোমাকে বিশ্বাস করব,’ প্রায় প্রশ্ন আবার আনমনে বলা কথার মত শোনাল রিনা গর্ডনের কণ্ঠ

‘আমি কিন্তু নেভি ক্রস পেয়েছি…’ নরম স্বরে বলল কেভিন। ‘আর আরেকটা কথা, দু’জনই তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছি।’

‘তা ঠিক।’ মাথা দোলাল রিনা। ‘ঠিক আছে, আলাপ করব আমরা।’

ম্যাগাযিনের র‍্যাকের মাথায় ল্যাপটপ রাখল কেভিন, কি-বোর্ডে টাইপ করতে শুরু করে মুখ খুলল: ‘ঠিক আছে, আগে আমি বলছি। যা জানি বলব। আমার কন্ট্যাক্ট আর্কটিকে আছেন। বাংলাদেশ আর্মিতে ছিলেন। এখন বিসিআই-এ কর্মরত। আজ আমাকে বলেছেন যুদ্ধে যাচ্ছেন। রাফিয়ান আর্মি এবং পোলার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। ওই দ্বীপ পুরনো এক সোভিয়েত বেস। ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র আছে ওখানে।

‘আর রাফিয়ান আর্মি? তাদের ব্যাপারে জানতেই আপনার কাছে গিয়েছিলাম। পোলার আইল্যাণ্ড এবং ওই আর্মির বিষয়ে যা জানব, তা আমার কন্ট্যাক্টের কাজে আসবে।’ ল্যাপটপের স্ক্রিনে নতুন তথ্য এনেছে কেভিন। আঙুল তুলে দেখাল। ‘আর এই যে আমেরিকার মিলিটারি ও ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইযেশনের সব তথ্য। এরা গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে পোলার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে যা জোগাড় করেছে, সবই এখানে আছে।’

মনিটরে চোখ রেখে ভুরু কপালে উঠল রিনা গর্ডনের। ‘আরে! এই ডকুমেণ্ট তো জেসিআইডিডির! শুধু দেখবেন জয়েন্ট চি আর সবচেয়ে উপরের……

‘আমি কোড-ক্র্যাকার, ভুলে গেছেন?’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক!’

‘এখানে কারও নাম চিনছেন?’ জানতে চাইল কেভিন। কনলনের কমপিউটার স্ক্রিনের লিস্টে চোখ বোলাতে শুরু করেছে রিনা গর্ডন।

এজেন্সিডক টাইপসামারিঅথোরইয়ার
ইউএসএনসোভিয়েত সাব রিপেয়ার বেসেসলিস্ট অভ সোভিয়েত নেভি ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন রিপেয়ার ফ্যাসিলিটিড্র্যাপার, এ.১৯৮০-প্রেয়েন্ট
এনডাব্লিউ- এসম্যাক্রো ওয়েদার সিস্টেম অ্যানালিসিসঅ্যানালিসিস অভ জেটস্ট্রিম উইণ্ড প্যাটার্নহিউবার্ট এন.১৯৮২
সিআইএপসিবল লোকেশন্সজিয়োলজিকাল অপশন্স ফর অপারেশন ‘কিল-ড্রাগন’উইলিয়াম টি.১৯৮৫
সিআইএসোভিয়েত কেম অ্যাণ্ড বায়ো ওয়েপন্স ডেভলপিং সাইট্স্লিস্ট অভ নোউন সোভিয়েত কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স ডেভেলপমেন্ট সাইট্স্ অ্যাণ্ড ফ্যাসিলিটিয়ডেভিড, এম.১৯৮৬
ইউএস- এএফহাই-ভ্যালু টার্গেট লিস্ট(ইউএস- এসআর)লিস্ট অভ ফার্স্ট টার্গেট্স্ ইন দ্য ইউএসএস- আর ইন দ্য ইভেণ্ট অভ আ মেজর কনফ্লিক্টজন ডাব্লিউ.১৯৮৫- ১৯৯১
এনআরও/ ইউএস- এএফস্যাটালাইট লোকেশন লিস্টইন্টার এজেন্সি সোয়েপ অভ জিপিএস ডেটা কনসার্নিং রাশান বেসেসকর্পেট এন.২০০৯- ১৪
আর্মিসোভিয়েত কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স সার্ভে  লিস্ট অভ নোউন কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স কেপ্টবাই ইউএসএসআর/রাশান স্পেশাল ওয়েপন্স ডিরেক্টোরেটরন এফ.এল.১৯৮২- প্রেযেন্ট

লিস্টের দিকে চেয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে রিনা গর্ডন।

‘আর্মি, এয়ার ফোর্স, নেভি, সিআইএ, এমনকী ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসও অ্যানালাইয করেছে জেটস্ট্রিম। কিন্তু যদি মনোযোগ দিয়ে দেখো, বুঝবে পোলার আইল্যাণ্ড নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছে তারা।’

‘একটু খুলে বলুন,’ বলল কেভিন।

‘ধরো, প্রথমে পোলার আইল্যাণ্ডের উপর চোখ পড়েছিল ইউএস নেভির। তখন উনিশ শ’ ঊনআশি। ওখানে গড়তে লাগল সোভিয়েতরা ব্যালেস্টিক মিসাইল রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি। তখনই ওয়েদার সার্ভিস টের পেল, ওই দ্বীপের উপর দিয়ে গেছে জেটস্ট্রিম। কাজেই সতর্ক হয়ে উঠল সবাই।

—তুমি আগেই বলেছ, পোলার আইল্যাণ্ডের ওই ওয়েপন্স বেস তৈরি হয়েছে উনিশ শ’ পঁচাশি সালে। কিন্তু এই ডকুমেন্টে দেখো উনিশ শ’ ছিয়াশি সালে সিআইএ-র লিস্টে উঠেছে ওই দ্বীপ। সোভিয়েত কেমিকেল অ্যাণ্ড বায়োলজিকাল ওয়েপন্স বেস। এয়ার ফোর্সের লিস্টে হাই-ভ্যালু সোভিয়েত টার্গেটের ভিতর ওটা অন্যতম। পরের লিস্টেও পোলার আইল্যাণ্ড আছে। উনিশ শ‍ একানব্বই সালে ইউএসএসআর-এর পতন হওয়া পর্যন্ত ওটার তাৎপর্য ছিল। তারপর সরে গেল হাই-ভ্যালু সাইট লিস্ট থেকে। শুনেছি উনিশ শ’ পঁচাশি সালের সিআইএ-র রিপোর্টের কাছে অন্য রিপোর্ট কিছুই নয়। ফাইলের টাইটেল ছিল: পসিবল লোকেশন্স। ওটা তৈরি করে… আরেহ্… সর্বনাশ! এ তো সেই উইলিয়াম টি.!’

‘উইলিয়াম টি.? তো কী?’ অবাক হয়েছে কেভিন। ‘কে সে?’

‘উইলিয়াম টি. মানে উইলিয়াম থ্রাশার,’ চিন্তিত স্বরে বলল রিনা। ‘কিন্তু… কী করে… তা হলে এটা তার প্রজেক্ট? …আশ্চর্য! …কনলন, যেটা জানতে চাইছ, হয়তো এখানেই পাবে সে লিঙ্ক!’

‘কীসের লিঙ্ক? …আপনি চেনেন ওই লোককে?

‘চিনি মানে? ভাল করেই! রাফিয়ান আর্মির ওপর রিসার্চ করার সময় নামটা জেনেছি। আর এ থেকে অনেক কিছুই বুঝবে তুমি।’

আগ্রহী হয়ে উঠল কেভিন। ‘আসলে কে সে? উনিশ শ’ পঁচাশি সালে পোলার আইল্যাণ্ডের ওপর রিপোর্ট লিখেছিল? ওই বেস তো চালুই হয়েছে তার পরের বছর!’

দোকানের বাইরে আর্তচিৎকার ছাড়ল সাইরেন। ঝট্ করে ঘুরে চাইল কেভিন ও রিনা। না, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। পাশ কাটিয়ে গেছে অ্যাম্বুলেন্স। বড় করে দম নিল ওরা।

‘উইলিয়াম থ্রাশার,’ বলল রিনা, ‘সিআইএ-র সত্যিকারের উজ্জ্বল তারকাদের একজন। আর্মি রেঞ্জার ট্রেনিঙের সময় উনিশ শ’ আশি সালে তাকে রিক্রুট করা হয়। উনিশ শ’ আটাত্তর সালে চিন তার অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয় সব প্রকল্প চালু করার পর, ওই দেশের ওপর গবেষণা করে। পরে সিআইএ-র প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ অবদান রেখেছে। তা স্পেশাল অপারেশন্স ডিভিশন হোক বা অন্যসব কর্মকাণ্ড— সে আজও রয়ে গেছে ওই সংগঠনের হিরো। উনিশ শত আশির দশকের শেষে তাকে আমেরিকার মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্কুলে ট্রেনিং দেয়ার জন্য ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ করা হয়। আগেও বলেছি, ইউএস আর্মির ট্রেনিং হতো ফোর্ট বেনিনে। তখন চিলির বেশ কয়েকজন অফিসার ও সৈনিককে ট্রেনিং দেয় সে…

‘আর তার কাছ থেকেই ছাত্ররা শিখেছে কীভাবে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা যায়? পরে কেউ কেউ যোগ দিয়েছে রাফিয়ান আর্মিতে,’ বলল কেভিন।

হতে পারে। আগে কিছুই জানতাম না, কিন্তু যখন খেয়াল করলাম চিলির ভ্যালপারাইসো প্রিযন ভেঙে বেরিয়েছে বারোজন সেনা অফিসার, তখনই চোখ পড়ল থ্রাশারের ওপর। আমেরিকার সেই কালো সময়ে আর্মি প্রশিক্ষক ছিল ওই লোক। সেই পলাতক বারোজন অফিসার ছিল তারই ছাত্র।’

‘ভয়ঙ্কর লোক বলেই…’

‘কাজেই উইলিয়াম থ্রাশারের রেকর্ড ঘাঁটলাম,’ বলল রিনা গর্ডন। ‘তার মূল দায়িত্ব ছিল এজেন্সির সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার ডিভিশনে। সত্যিকারের এক্সপার্ট। তার ফাইলের শিরোনাম থেকে কোট করছি, নিজেই বুঝবে সে কী: ‘শত্রুপক্ষের কেউ বন্দি হলে, তার কাছ থেকে সহজেই তথ্য পেতে কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত, তার বর্ণনা দেয়া হলো।’‘

‘কীভাবে নির্যাতন করবে, তা বলেছে?’ বলল কেভিন।

‘হ্যাঁ। গত তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে উইলিয়াম থ্রাশার সিআইএ-র সাইকো-অপারেশন বা মানসিক নির্যাতন বিষয়ে সেরা এক্সপার্ট। গত কয়েক বছর ধরে আবারও চল শুরু হয়েছে মানসিক নির্যাতনের। গিটমো বা অন্যান্য সাইটে থ্রাশারের মেথডই ব্যবহার করা হয়। সে-ই আসল মাস্টার।

‘তার থিয়োরি অনুযায়ী, চাইলে যে-কোনও মানুষকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেয়া যায়, বা তার পেট থেকে বের করে নেয়া যায় সবই। সেজন্য বেশিকিছু করতে হবে না, শুধু আক্রমণ করতে হবে তার মনটাকে। শুনেছি, দুই হাজার পাঁচ সালে আফগানিস্তানে তিন তালেবানকে পাল্টে দেয় সে। স্ট্যাপল করে তাদের দুই চোখ খুলে রাখতে বাধ্য করেছিল। প্রতিদিন আটবার নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হতো জ্বলন্ত সিগারেট। ছয়দিন ভয়ঙ্কর সব ডিভিডি দেখিয়েছে। তার ভেতর ছিল ধর্ষণ, গর্দান কেটে নেয়া, ভয়াবহভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা— ইত্যাদি। ওই ছয়দিন সর্বক্ষণ বিকট সব আর্তনাদ, চিৎকার, কান্না শোনানো হয়েছে। এরপর ওই তালেবানদেরকে ছেড়ে দিতেই সোজা নিজ গ্রামে ফিরল তারা। ততদিনে হয়ে উঠেছে সাইকোলজিকাল টাইম বোমা; যে-কোনও সময়ে বিস্ফোরিত হবে। তারপর তাদের কাছে পৌছে গেল থ্রাশারের নির্দেশ। সিআইএ নির্দিষ্ট রেডিয়ো মেসেজ পাঠাতেই ।উন্মাদ হয়ে গেল তারা। হামলা করল নিজ গ্রামে, খুন করল নিজেদের পঁয়ষট্টিজন লোককে। তারপর আত্মহত্যা করল।’

‘যিশু!’

‘উনিশ শ’ আশির দশকে উইলিয়াম থ্রাশার ছিল সিআইএ-র সেরা জিনিয়াস। উনিশ শ’ তিরাশি সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ‘টার্গেট ৯৯৯’ এক্সারসাইযে অংশ নিল প্রশিক্ষক হিসেবে। খুব কম মানুষই জানে ওই ট্রেনিঙের কথা। ওই ট্রেনিঙে ন্যাটোর প্রতিটি দেশের প্রেসিডেন্ট অংশ নেন। মনে গেঁথে দেয়া হয়, প্রয়োজন পড়লে কীভাবে নিউক্লিয়ার হামলা করতে হবে ইউএসএসআর-এর ওপর। থ্রাশার ধরেই নিয়েছিল প্রয়োজন পড়লে রাশানরাও ওভাবেই হামলা করবে। কাজেই আমাদের সবার উচিত নিউক্লিয়ার আর্সেনাল তৈরি রাখা। আমেরিকার প্রতিটি ইন্টেলিজেন্স ও মিলিটারি ওই ট্রেনিঙের ওপর চোখ রেখেছিল। আর উনিশ শত আশির দশকের মাঝ থেকে শুরু করে একানব্বই সাল পর্যন্ত আমরা কী করে যেন জেনে গেছি সোভিয়েতরা এরপর কী করবে। ওই ট্রেনিং ভালবেসে ফেলেন প্রেসিডেন্ট রেগ্যান। তিনিই উইলিয়াম থ্রাশারকে পুরস্কার হিসেবে ইন্টেলিজেন্স মেডাল দেন।

‘থ্রাশারের ‘টার্গেট ৯৯৯’ ট্রেনিং দেখার পর সিআইএ তাকে নানান জিয়োপলিটিকাল অ্যানালিসিসের কাজে লাগাল। রাশা, চিন, দক্ষিণ আমেরিকা— থ্রাশার গবেষণা করতে লাগল। আসলে থ্রাশারকে শিকারী হিসেবে কাজে লাগাল সিআইএ। এমন এক অ্যানালিস্ট, যে আগেই বলে দিচ্ছে এরপর কী করবে শত্রু। নানান পরিস্থিতির কথা লিখে ভবিষ্যৎ দেখিয়ে দিয়েছে সে।

‘মানুষের মন ও মগজের সত্যিকারের পাঠক থ্রাশার, আগেই বোঝে এরপর কী করবে কেউ। ব্যাপারটা প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর মতই হয়ে উঠেছিল। ধরা যাক মিখাইল গর্বাচেভের ব্যাপারটাই। তিনি উনিশ শ’ পঁচাশি সালে যেসব অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা করেছেন, সেসব আগেই জানত আমেরিকা। গ্ল্যাসনস্ট বা পেরেস্ত্রোইকা আমেরিকার কাছে পুরনো জিনিস। প্রতিবার গর্বাচেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে ব্যক্তিগতভাবে থ্রাশারের সঙ্গে বসে সব জেনে নিতেন প্রেসিডেন্ট রেগ্যান। পরে বলেছেন: থ্রাশারের কারণে তাঁর মনে হতো, আসলে পোকার খেলার আগেই গর্বাচেভের সব তাস জেনে ফেলতেন।’

বড় করে দম নিল রিনা গর্ডন, তারপর বলল, ‘খুঁজতে শুরু করে চিনের উপর লেখা একটা পুরনো রিপোর্ট পেয়েছিলাম। ওটা লেখা হয়েছিল উনিশ শ’ বিরাশি সালে। বেশকিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল সে।’

এখনও রিনার হাতে ব্রিফকেস, ভিতরে রয়েছে জরুরি ফাইল ও নোটস্। ওগুলো নিয়ে যাওয়ার কথা হোয়াইট হাউসে। ডালা খুলে একটা ছাপা ডকুমেন্ট বের করল সে, কেভিনের হাতে ধরিয়ে দিল।

ডকুমেন্টের উপর পাতায় লেখা:

মহাচিনের অবিশ্বাস্য উত্থান এবং আমেরিকার পতন।
উইলিয়াম থ্রাশারের
অ্যানালিসিস
অগাস্ট ১, ১৯৮২।

‘ভাল টাইটেল দিয়েছে,’ বলল কেভিন। ‘ভয় লাগিয়ে দেয়ার মত।

‘কমিউনিস্ট পার্টি চিনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নাম দিয়েছিল: ‘সোশালিযম উইথ চাইনি ক্যারাকটারিস্টিক্স।’ বাস্তবে ওটাকে আমরা বলতে পারি আগ্রাসী সরকারের ফ্রি মার্কেট ক্যাপিটালিয়ম। পরিবর্তন শুরু হয়েছিল উনিশ শ’ আটাত্তর সালেই। কিন্তু প্রথমে কাজ হচ্ছিল ধীরে। অবশ্য উনিশ শ’ নব্বুই সালের মাঝ থেকে দুই হাজার সালের ভেতর চিন হয়ে উঠল সত্যিকারের অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু উনিশ শ’ বিরাশি সালে প্রায়-বিধ্বস্ত অর্থনীতির সাধারণ খামার ও রাষ্ট্রীয় কারখানা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল চিন। কেউ ভাবতে পারেনি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে ওই দেশ। কিন্তু ঠিকই বুঝেছিল উইলিয়াম থ্রাশার। ডকুমেন্টের হাইলাইট করা প্যারাগ্রাফ একবার দেখো, কনলন। মনে রেখো, ওগুলো লেখা হয়েছে উনিশ শ’ বিরাশি সালে।

হলুদ কালি দিয়ে চিহ্নিত প্যারাগ্রাফে চোখ বোলাতে শুরু করল কেভিন।

ডকুমেন্টের প্রথম পাতায় লেখা:

একুশ শতাব্দীর সুপারপাওয়ার: মহাচিন

মনে কোনও সন্দেহ রাখবার কারণ নেই, কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমানের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টার ফলে সৃষ্টি হবে নতুন এক মহাচিন। ওই দেশ দুই হাজার দশ সালের ভিতর হুমকি হয়ে উঠবে আমেরিকার সামনে। তারাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি।

মস্ত হয়ে উঠবে চিনের অর্থনীতি, এবং ওই দেশই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবে বিশ্বের লোহার আকর ও অ্যালিউমিনিয়াম। ধনী হয়ে উঠবে চিনের মধ্যবিত্তরা। এক বিলিয়ন চিনা ক্রেতা চাইবে টিভি, গাড়ি, রেফ্রিজারেটার এবং অন্য সব সাধারণ সামগ্রী। আমেরিকার নাগরিক এসব সাধারণভাবেই ভোগ করত উনিশ শ’ পঞ্চাশ সাল থেকে।

কিন্তু পতন শুরু হয়েছে আমেরিকার। আমরা এখন আর নতুন কিছুই তৈরি করছি না। উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশ থেকে উনিশ শ’ সত্তর আমেরিকার জন্য স্বপ্নিল সময়। সে সময়ে আমাদের ইণ্ডাস্ট্রির কোনও প্রতিযোগী ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরাজিত জার্মানি ও জাপানের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল দুর্বল। কিন্তু সে সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখন আশির দশকে এসে দেখা যাচ্ছে জার্মানি ও জাপান আমাদের চেয়ে ভাল তৈরি করছে গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যসব সামগ্রী। জাপান ও তাইওয়ানের মত দেশের সস্তা শ্রমের কারণে মার খাচ্ছে আমাদের কর্মীরা।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ভয়ঙ্কর এক দানব আসছে সামনের দশকে— মহাচিন! অবিশ্বাস্য উন্নয়নের দিকে চলেছে ওই দেশ।

আমেরিকার সিভিল ওঅরে উত্তরের সব রাজ্য জিতেছিল শুধু তাদের কারখানার শক্তির কারণে। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা টিকে থেকেছে শুধু তার শক্তিশালী ইণ্ডাস্ট্রির জন্য। এবং মহাচিন এবার যে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল• ক্ষমতা দেখাবে, সেটা আগে কখনও এই পৃথিবীতে দেখা যায়নি। ওই দেশের অর্থনীতি মেরামত করা হয়েছে শুধু একটি কাজের জন্য। তা হচ্ছে: ঘুমন্ত ড্রাগনকে জাগিয়ে দেয়া। জেগে উঠছে তাদের কারখানাগুলো।

সত্যি যদি ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় তাদের শক্তি, কিছুদিনের ভিতর প্রতি বছর দশ সূচকের চেয়েও বেশি উন্নয়ন করবে ওই দেশ। এবং উনিশ শ’ নব্বই সাল থেকে দুই হাজার সালের ভিতর…

.

‘যিশু, এ লোক তো আশ্চর্য মানুষ!’ বলল কেভিন। ‘চিনের বর্তমান উন্নতি দেখেছে সে উনিশ শ’ বিরাশি সালে!’

‘পড়তে থাকো,’ বলল রিনা গর্ডন।।

পরের হাইলাইটেড প্যারাগ্রাফে চোখ নামাল কেভিন। ওখানে লেখা:

মহাচিনের কারণে যা হতে চলেছে:

চিনের উন্নয়নের ফলে প্রথমেই ধস্ নামবে সাধারণ আমেরিকান মধ্যবিত্তের জীবনে। চিনের ইউয়ানের কাছে মূল্যহীন হয়ে উঠবে আমেরিকার ডলার। আর যখন যে দেশে খুশি যেতে পারবে না আমেরিকানরা। যাবে চাইনিজরা। দুই দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনে দেখা দেবে বিপুল ঘাটতি। এবং বাধ্য হয়ে আমাদের সরকার ধার নেবে চাইনিজ সরকারের কাছ থেকে।

লাখে লাখে মানুষ বেকার হয়ে যাবে আমেরিকায়। অল্প দক্ষ কর্মীরা কম বেতনে কাজ পাবে চিনে। এবং অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত হতেই চিনের রাজনৈতিক ক্ষমতাও বাড়বে। ধনী হতে থাকবে চিন। তারাই সাহায্য দেবে গরীব দেশগুলোকে। ফলে চিন কিছুদিনের ভিতর গোটা পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করবে নিজ ক্ষমতাবলয়। অর্থাৎ, ক্ষমতা কমবে আমেরিকার। এর কারণে…

.

ডকুমেণ্ট থেকে চোখ তুলে চাইল কেভিন। ‘দূরদর্শী লোক!’

‘যা পড়লে তার এক শ’ গুণ কঠিন সমস্যা নিয়ে লিখেছে সে,’ বলল রিনা গর্ডন। ‘তার বক্তব্য অনুযায়ী, একুশ শতকের শুরুর দিকেই চিন রাজি করিয়ে ফেলবে অলিম্পিক গেমস যেন তাদের দেশে করা হয়। আর নানা খেলার মাধ্যমে তারা গোটা পৃথিবীকে দেখাবে তাদের দেশ ও সংস্কৃতি।’

‘হতে পারে,’ বলল কেভিন। এক সেকেণ্ড পর জিজ্ঞেস করল, ‘এই লোক এখন কোথায়?’

কাঁধ ঝাঁকাল রিনা গর্ডন। ‘ডিআইএ বা সিআইএ-র কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। কেউ জানে না সে কোথায়, অথবা বলতে রাজি নয়। এটা জানি, এখনও এজেন্সির সঙ্গেই আছে। দশ সাল পর্যন্ত প্যারামিলিটারি স্পেশাল ফোর্স নিয়ে কী যেন করছিল। … কেভিন, তুমি কি জানো এজেন্সির তিনটা স্টারজিয়ন-ক্লাস সাবমেরিন আছে? সেসবের মাধ্যমে নানাদেশে গোপন সব মিশন করা হয়। এগারো সালে ইজিপ্ট ও টার্কিতে রেনডিশন স্টেশনে ছিল থ্রাশার। কী করছিল কেউ জানে না। বা বলবে না।’

আপনার কি মনে হয় রাফিয়ান আর্মির সঙ্গে সে জড়িত?’ জানতে চাইল কেভিন।

ব্যক্তিগতভাবে ওই বারো চিলিয়ান অফিসারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সে। তারা ভাল করেই চেনে তাকে। তার পদ্ধতিও জানে। দস্যু আর্মির অফিসার হওয়ার সব যোগ্যতা তাদের আছে। আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করার মত: সিআইএ-র রেনডিশন স্টেশন ছিল ইজিপ্ট ও টার্কিতে। ওই দুই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আফগানিস্তান ও ইরাকের বন্দিদের নির্যাতন করা হয়। আর ইজিপ্টের রেনডিশন সেন্টারে আফ্রিকার কয়েকটি সরকারের বন্দি শত্রুদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করে দেয় সিআইএ। আমাদের অন্যতম কাস্টমার ছিল সুদানের বিগত সরকার। পরে তাদের পতন হয়।’

‘দ্বিতীয় জেলখানা ছিল ইউএন-এর,’ বলল কেভিন। ‘সুদান থেকেই পালিয়ে গেছে এক শ’ সৈনিক। …এক মিনিট! আপনি কি বলতে চাইছেন সিআইএ এজেন্ট থ্রাশারই গড়ে তুলেছে রাফিয়ান আর্মি? অফিসার ও সৈনিক জোগাড় করেছে চিলি থেকে, তারপর দল বড় করতে নিয়েছে সুদানের সৈনিকদের?

‘তা-ই বলতে চাইছি। আরেকটা থিয়োরি আছে আমার। কিন্তু বললে তুমি আমাকে পাগল ভাববে।’

‘বলুন শুনি?’

দ্বিধা করল রিনা গর্ডন। ‘আমি অবশ্য প্রমাণ দেখাতে পারব না…’ বড় করে শ্বাস নিল সে। ‘রাফিয়ান আর্মির সর্বোচ্চ নেতা অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক, কঠোর, হৃদয়হীন— অথচ সবসময় নিজ মুখ ঢেকে রাখে। সত্যিই যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তা হলে স্বাভাবিক না তার নিজেকে জাহির করা, বড়াই করা? মুখ ঢেকে রাখবে কেন? সর্বক্ষণ চাইছে তার মুখ যেন কেউ দেখতে না পায়।

তার মানে, নিজের পরিচয় আড়াল করতে চাইছে। এমন হতেই পারে, সেরা সিআইএ এজেণ্ট উইলিয়াম থ্রাশারই আসলে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল।’

‘কিন্তু কী কারণে ওই ডাকাতের মত আর্মি তৈরি করতে হলো?’ জানতে চাইল কেভিন।

‘ওটা মূল কথা নয়, কেভিন। থ্রাশার সিআইএ-র বড় অফিসারদের অন্তরের লোক। আসলে মূল কথা হচ্ছে: হঠাৎ কী কারণে সিআইএ ওরকম একটা আর্মি তৈরি করল।’

‘আপনি এ কথা তুলবেন, হয়তো সেকারণেই আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে,’ বলল কেভিন।

‘হতে পারে,’ আস্তে করে মাথা দোলাল রিনা। স্ক্রিনের দিক দেখাল। ‘তোমার উনিশ শ’ পঁচাশির ওই ডকুমেন্টে কী আছে? পোলার আইল্যাণ্ড সম্পর্কে কী লিখেছে থ্রাশার? নাম দিয়েছে দেখছি: ‘কিল-ড্রাগন’। জিয়োলজিকাল অপশন্স ফর অপারেশন ‘কিল-ড্রাগন’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে? এই ডকুমেন্ট আমি হাতে পাইনি। কী ধরনের অপারেশন ছিল ওটা?’

‘আসুন একসঙ্গে পড়ি,’ কি-বোর্ডে টোকা দিল কেভিন। টাইপ করল নিষিদ্ধ পাসওঅর্ড।

মনিটরে ভেসে উঠল সতর্কবাণী:

‘দ্য ডকুমেন্ট ইউ আর অ্যাবাউট টু ওপেন ই লোকেশন প্রোটেকটেড।’

‘এর মানে কী?’ জানতে চাইল রিনা গর্ডন।

‘কারণ বোঝা সহজ, একবার ওই ফাইল খুললেই এই কমপিউটার ডিজিটালি জানিয়ে দেবে আমরা কোথায় আছি। ফাইলের মালিকের জানা হয়ে যাবে ফাইল খুলেছি। রিনা, এই ফাইল যদি সত্যিই পড়তে হয়, ঝড়ের মত পড়তে হবে। তারপর দৌড়ের ওপর থাকতে হবে। …তবুও দেখতে চান?’

‘হ্যাঁ, চাই। …তুমি?’

‘আমিও,’ বলল কেভিন। চলুন পাশের ক্যাফেতে গিয়ে টেবিলে পাশাপাশি বসি।’

‘চলো।’

বইয়ের দোকানের ভিতরেই ছোট ক্যাফে আছে। ওখানে মোটেও ভিড় নেই এখন। একটা টেবিল দখল করল ওরা।

‘কমপিউটার সামনে রেখে ‘ওপেন ডকুমেন্ট’-এর উপর ক্লিক করল কেভিন।

খুলে গেল নতুন উইণ্ডো।

সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনের ডানদিকের উপরে টিপটিপ করতে লাগল টাইম কোডেড বক্স। সতর্ক করছে:

‘ডকুমেন্ট ওপেনিং রেকর্ডেড।
সেণ্ডিং ইউযার আইডেন্টিফিকেশন।’

পাত্তা দিল না কেভিন, ঝটপট ডকুমেন্ট স্ক্যান করল।

পিডিএফ।

টাইপ রাইটারে ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল।

ডেট স্ট্যাম্প বলছে অগাস্ট ১, ১৯৮৫।

অপারেশন: ‘কিল-ড্রাগন’
অ্যানালিসিস অ্যাণ্ড
অপারেশন কনসেপ্ট বাই
উইলিয়াম থ্রাশার
অগাস্ট ১, ১৯৮৫

মাত্র তিন পৃষ্ঠার রচনা।

দ্রুত পড়তে লাগল কেভিন ও রিনা। জানা নেই কমপিউটার থেকে কার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ডিজিটাল তথ্য।

সে জানবে ওরা আছে ভার্জিনিয়ার এ শহরের কোথায়।

প্রায় একই সময়ে পড়া শেষ হলো ওদের।

পরস্পরের দিকে চাইল, চোখে আতঙ্ক।

‘হায় ঈশ্বর!’ বিড়বিড় করল কেভিন। ‘ওই লোক খোদ শয়তান! সন্দেহ কী আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে সিআইএ! মস্ত বিপদে পড়েছি আমরা!’

ল্যাপটপের ওয়াই-ফাই অফ করতে চাইল কেভিন। এই কমপিউটার ফেলে যেতে হবে তা নয়, তবে বিপদ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত ইণ্টারনেটে যেতে পারবে না। গেলেই হাজির হবে একদল খুনি।

থমকে গেল কেভিন, ওয়াই-ফাই অফ করবার আগে আরেকটা কাজ আছে।

এবার সাইবার স্পেসে পাঠিয়ে দিল ওই ডকুমেণ্ট।

‘কানেকশন বন্ধ করো, বাছা,’ তাড়া দিল রিনা। ‘পালাতে হবে।’

কমপিউটার শাটডাউন করল কেভিন। পরক্ষণে প্রায় দৌড়াতে শুরু করে দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

বাইশ

পোলার আইল্যাণ্ড।

সকাল এগারোটা পঁয়ত্রিশ।

রাফিয়ান আর্মির জেনারেল বা বিশৃঙ্খলার সম্রাট— যাকে কেউ কেউ চেনে উইলিয়াম থ্রাশার হিসাবে- এইমাত্র রানওয়ের শেষে এসে পৌঁছেছে। একটু আগে কর্নেল সাইক্লোন ও স্যান্টা ক্ল্যকে এখানে পাঠিয়েছে।

রাফিয়ান আর্মির সৈনিক ও অফিসারদের মাঝে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। ক্লিফের উপর থেকে দেখছে অ্যান্টোনভের পতনের জায়গাটা।

ওখানে সাগর অত্যন্ত গভীর।

‘আমাদের চারটে স্ফেয়ার নিয়ে জলপ্রপাত থেকে সাগরে পড়েছে মাসুদ রানা,’ রিপোর্ট দিল কর্নেল সাইক্লোন। ‘কিন্তু বিমান পড়ে যাওয়ার আগে তার দলের তিনজন সদস্য অ্যান্টোনভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তাদের কাছে একটা স্ফেয়ারের কেস ছিল। ওটার ভেতর দুটো স্ফেয়ার থাকার কথা। তারা চলে গেছে নদীর দক্ষিণ তীরে। কিন্তু ক্লিফ পর্যন্ত যেতে পারেনি। ওদিকে পাহারা দিচ্ছিল একটা স্ট্রেলা।’

‘হাঁটছে?’

‘জী, স্যর।’

‘তুমি নিশ্চিত তাদের কাছে স্ফেয়ার আছে?’

‘যতটুকু জানি, আছে, স্যর। এইমাত্র কয়েকটা স্ট্রেলায় করে দলবলসহ পচা নেইটরিচকে পাঠিয়ে দিয়েছি। নদীর ওপারে গেছে ওরা।’

নদীর দিকে চাইল বিশৃঙ্খলার সম্রাট। অনেক উপরের পাহাড় থেকে সাপের মত এঁকেবেঁকে নেমেছে নদী। পোলার আইল্যাণ্ডের দক্ষিণে একের পর এক পাহাড়। ওখানে ছোট খনিও আছে। কাঁচা রাস্তাও আছে কিছু। কিন্তু লুকাবার জায়গা নেই কোথাও।

‘ওদের খুঁজে বের করে খতম করবে,’ বলল থ্রাশার। ‘আর ওই স্কেয়ার দুটো আনবে আমার কাছে। আমাদের হাতে এখনও সময় আছে, কিন্তু চিরকাল থাকবে না।’

‘আমরা আরও কিছু পেয়েছি,’ বলল স্যান্টা ক্ল্য। সরে দাঁড়াল। সামনে এসে দাঁড়াল দুই সৈনিক। মাঝে ধরে রেখেছে শিথিল এক দেহ। হাত সরিয়ে নিতেই ধুপ্ করে থ্রাশারের সামনে পড়ল সে।

গালভরা দাড়ি। চুপচুপে ভেজা। প্রকাণ্ডদেহী।

থ্রাশারের পায়ের কাছেই পড়ে আছে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন।

লোকগুলো জানে না, যখন সাঁই করে ডিফেখনের দিকে ছুটে এল সিমেন্ট মিক্সার, লাফিয়ে অ্যান্টোনভ বিমানের পাশের দরজা দিয়ে ছিটকে পড়েছে সে নদীতে। পরক্ষণে বিমানের দেয়ালে দড়াম করে লেগেছে সিমেণ্ট মিক্সার।

‘মিনিটখানেক আগে তীরে উঠেছে,’ বলল স্যান্টা ক্ল্য। ‘ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো। মাসুদ রানার দলের লোক।’

হতক্লান্ত ডিফেখনের দিকে চাইল উইলিয়াম থ্রাশার।

‘মন্দ নয়,’ বলল, ‘ওকে কাজে লাগিয়ে দলের অন্যদেরকে ধরব। ওর ওপর নির্যাতন করলেই বুকফাটা আর্তচিৎকার শুনে ভড়কে যাবে তারা। স্যান্টা ক্ল্য, তুমি তো জানো, খুব কম মানুষই সহ্য করতে পারে করুণ চিৎকার। আমি প্রায় ভুলেই গেছি কীভাবে সত্যিকার মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে হয়। … ঠিক আছে, চেষ্টা করতে দোষ কী! ওকে নিয়ে যাও গ্যাসওঅর্কে।’

.

পাহাড়ের গোড়ায় ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে ছুটছে নিশাত। সরিয়ে দিচ্ছে সামনের বরফ জমা সব সরু ডাল। খাড়াই বেয়ে উপরে উঠছে ওরা। নিশাতের পিছনেই পবন ও ফারিয়া। পবনের হাতে স্ফেয়ারের কমপ্যাক্ট স্যামসোনাইট কেস।

‘আপা!’ প্রায় দৌড়ে উঠছে পবন। ‘এবার কী করব আমরা?’

কিছুক্ষণ হলো ভাবছে নিশাত কী করবে।

‘এখনও জানি না,’ হাঁপাতে শুরু করেছে নিশাত। ‘বেশিরভাগ সময় চিন্তার দায়িত্ব থাকে স্যরের, আমার কিছুই ভাবতে হয় না। জং ধরে গেছে মগজে। স্যর চিন্তা করেন, আর আমি গুলি করি। এখন ভাবতে গিয়ে নিজেকে পাথর-যুগের মানুষ মনে হচ্ছে!’

নিশাত ভাবতে চাইছে। বারবার মাসুদ রানার শেষ কথাগুলো ঘুরে আসছে মনে: ‘সরে যান ওখান থেকে! লুকিয়ে পড়বেন! পরিস্থিতি বুঝে…’

নিজেকে জিজ্ঞেস করল নিশাত, এই পরিস্থিতিতে কী করতেন স্যর?

‘প্রথম কাজ হওয়া উচিত যে-কোনও রাস্তা থেকে দূরে থাকা,‘ বলল নিশাত। ‘ঝোপঝাড়ের ভেতর ট্রাক নিয়ে ঢুকতে পারবে না ওরা। দ্বিতীয় কাজ: উপকূলে পৌছতে হবে। কিন্তু এদিকে গেলে সাগরের কাছে যেতে পারব না। তার মানেই অন্য কোনও উপায় চাই। লুকিয়ে ফেলতে হবে স্ফেয়ারগুলো।’

‘দ্বীপে লুকাতে পারবেন না, আপা,’ বলল পবন। ‘যত ছোটই হোক, রেডিয়োঅ্যাকটিভ জিনিস। মাটি-ধুলো বা বরফের নীচে রাখলেও গাইগার কাউন্টার দিয়ে খুঁজে বের করে ফেলবে।’

‘স্ফেয়ারসহ লুকিয়ে পড়ব আমরা,’ বলল নিশাত। ‘সম্ভব হলে চলার ওপর থাকব। যদি কয়েক ঘণ্টা সরে থাকতে পারি, হয়তো কোনও দেশের সেনাবাহিনী পৌঁছে যাবে।’

‘ম্যাপে দেখেছি, এই দ্বীপে একটা খনি আছে,’ বলল ফারিয়া।‘দুর্লভ গ্র্যানিটের খনি ওটা।’

এইমাত্র নিচু এক টিলার চূড়ায় উঠেছে ওরা।

নীচে দেখা গেল পাথুরে খনি। প্রবেশপথ চৌকো, দেয়াল পাথরের। সুড়ঙ্গ গেছে ছোট এক পাহাড়ের বুকে।

শক্ত মাটির র‍্যাম্প নেমেছে বিশাল এক গহ্বরে। এক র‍্যাম্প থেকে আরেক র‍্যাম্পে গেছে একের পর এক লোহার মই। একটু দূরে পড়ে আছে রাশানদের পুরনো জং ধরা মাইনিং ট্রাক। একেকটা যেন যান্ত্রিক মূর্তি। খনির পাশে দুটো দালান, পাশেই মস্ত সুড়ঙ্গ— গেছে পাহাড়ের গভীরে।

টিলার মাথায় থমকে গেল নিশাত, সরু হয়ে গেছে দু’চোখ। ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল, ‘ঠিক আছে, চিন্তা করো, বোকা মেয়ে! স্যর হলে কী করতেন?’

তখনই বুদ্ধি খেলল। পবন ও ফারিয়াকে বলল, ‘জানি কী করব। মন দিয়ে শোনো। কোনও ভুল যেন না হয়…

কয়েক মিনিট পর ওই টিলার উপর উঠে এল রাফিয়ান আর্মির স্ট্রেলা, থেমে গেল ওখানে। নীচে পাথুরে খনি। তখনই দেখা গেল সুড়ঙ্গ-মুখে নিশাত সুলতানাকে। অস্ত্র তাক করে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল খনির ভিতর।

ধাওয়াকারী দলের নেতা জল্লাদ রেডিয়ো করল। ‘ওরা খনিতে ঢুকেছে।’

জবাব এল সাইক্লোনের তরফ থেকে: ‘ওই খনিতে মাত্র দুটোই প্রবেশপথ। ওগুলো পাহারা দাও। নিজে খনির ভেতর ঢুকবে, একজনও যেন বাঁচতে না পারে।’

‘ঠিক আছে,’ বলল জল্লাদ। ‘বেশিক্ষণ লাগবে না।’

সত্যিই সময় লাগল না নিশাতকে খুঁজে নিতে।

ঝড়ের মত খনিতে ঢুকল জল্লাদ-বাহিনী। নানা সুড়ঙ্গে পাহারা বসাল। বন্ধ করে দেয়া হলো খনি থেকে বেরোবার সব পথ। লিপফ্রগ করে একে অপরকে কাভার দিচ্ছে। কোঅর্ডিনেশন নিখুঁত।

জটিল নয় খনির সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা। ফ্যাসিলিটি তৈরি করবার সময় কেটে নিয়ে যাওয়া হতো গ্র্যানিট। মাত্র পাঁচ মিনিট পর খনির এক কোনা থেকে এক ছায়ামূর্তি গুলি পাঠাল জল্লাদের লোকের উদ্দেশে।

নিশাত সুলতানা।

বেশিক্ষণ টিকল না তার প্রতিরোধ। পনেরো মিনিটের ভিতর হারতে হলো। বিপুল সাহস নিয়ে লড়ল, কিন্তু এতজনের বিরুদ্ধে কী করবে। শেষে তো গুলিই ফুরিয়ে গেল। গুলি থেমে যেতেই দু’পাশ থেকে চেপে এল জল্লাদবাহিনী। বাধ্য হয়ে মাথার উপর দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণ করতে চাইল নিশাত।

ওর উপর দুধের মাছির মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কমপক্ষে পাঁচজন সৈনিক।

আর তখনই তারা বুঝল, আসলে নিশাত সুলতানা একা।

খনির ভিতর পবন হায়দার ও ফারিয়া আহমেদ নেই।

আরও বড় কথা, খনিতে গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার কেস নেই।

মাসুদ রানা যা করত, ঠিক তা-ই করেছে নিশাত সুলতানা। খনিতে ঢুকে নিজের দিকে প্রলুব্ধ করেছে শত্রুদেরকে। যতটা পেরেছে সময় দিয়েছে পবন ও ফারিয়াকে। ওরা এখন স্ফেয়ার কেস নিয়ে সরে গেছে।

কোণের পযিশন থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হলো নিশাতকে। মাথার উপর তোলা ওর হাত। মুখের উপর পড়েছে কমপক্ষে আধডজন রাইফেল ব্যারেলের ফ্লাশলাইট।

রেডিয়ো করল জল্লাদ: ‘স্যর, জল্লাদ বলছি। এক মেয়েলোক সৈনিক পেয়েছি। কিন্তু বেটি ঠকিয়েছে আমাদেরকে। অন্য দু’জন পালিয়ে গেছে কেস নিয়ে। তবে নিশ্চয়ই দ্বীপেই কোথাও আছে।’

বিশৃঙ্খলার সম্রাট উইলিয়াম থ্রাশার বলল, ‘কে ওই মহিলা?’

‘ওই বাঙালি বেটি, স্যর। বিরাট শরীর।’

‘নিশাত সুলতানা?’ নিশ্চিত হতে চাইল থ্রাশার।

নিশাতের পাঁজরে রাইফেলের কুঁদোর গুঁতো দিল জল্লাদ। ‘অ্যাই বেটি, তোর নাম কি নিশাত সুলতানা?’

‘হ্যাঁ।’

‘জী, স্যর। এ সে-ই।’

‘জীবিত রাখো, নিয়ে এসো আমার কাছে,’ বলল থ্রাশার। ‘মারধর করতে যেয়ো না। আমি নিজেই ওই আনন্দ পেতে চাই।’

.

বরফভরা ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলেছে পবন ও ফারিয়া। বারবার মুখে ও দেহে লাগছে ডালপালা। পিছনের ওই পরিত্যক্ত খনি থেকে সরে যেতে হবে ওদেরকে অনেক দূরে।

ওরা ভাল করেই জানে, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হবে নিশাত সুলতানাকে। কিন্তু অনেকটা সময় পাইয়ে দিয়েছে সে ওদেরকে। এর ফলাফল নিশাতের জন্য মারাত্মক খারাপ হওয়ারই কথা। হয়তো অসহ্য কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হবে ওকে। নিশাতের যে আত্মত্যাগ, তা বৃথা যেতে দেবে না পবন ও ফারিয়া।

অবশ্য, দ্বীপের এই দক্ষিণে থাকা চলবে না ওদের। ধবধবে সাদা পাহাড়ে কোনও আড়াল নেই। লুকাবে কোথায়? কারও সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও নেই। উপায় নেই কাউকে জানানো যে ওরা বাগড়া দিয়েছে রাফিয়ান আর্মির পরিকল্পনায়।

পবন ও ফারিয়া আলাপ করে দেখেছে, আসলে টিকে থাকতে হলে আবারও ওদেরকে যেতে হবে উত্তরদিকে। লুকিয়ে পড়তে হবে মস্ত মেইন কমপ্লেক্সে। আর যদি পেয়ে যায় কোনও কমিউনিকেশন গিয়ার, চেষ্টা করবে ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো ও বব বউলিঙের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

ছুটছে পবন ও ফারিয়া। পেরিয়ে গেল ছোট একটা ঝর্না। আবারও উত্তর দিকে চলেছে মেইন কমপ্লেক্স লক্ষ্য করে।

.

ওদের একমাইল পিছনে খনির কাছে থমকে গেল রাফিয়ান আর্মির দুই স্ট্রেলা। উল্কিঅলা লোকগুলো হিংস্রভাবে দেখছে নিশাতকে। কুৎসিত সব গালি দিচ্ছে। জল্লাদ এবং তার দল ফিরছে মেইন কমপ্লেক্সের দিকে।

মূল দল থেকে সরে গেছে একজন, হাঁটু গেড়ে বসেছে কাদাটে জমির পাশে। সে পচা নেইটরিচ। ব্যাণ্ডেজ করে দেয়া হয়েছে বাম কান। বিশ্রীভাবে চুইয়ে রক্ত পড়েছে গজ কাপড়ে, ভয়ানক লাগছে লোকটাকে দেখতে।

কঠোর চোখে কী যেন দেখছে কাদাটে জমিতে।

ওখানে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে জুতোর ছাপ।

গোপন সোভিয়েত বেসে এ ধরনের জুতো কেউ ব্যবহার করে না।

ছাপগুলো নাইকি হাইকিং-বুটের।

‘শালা পবনের বাচ্চা…’ বিড়বিড় করল পচা নেইটরিচ। ‘আমি না শালা বলেছি ঠিকই তোকে খুঁজে বের করব!’

নিজের দলের লোক ডাকল সে। রওনা হয়ে গেল পায়ে হেঁটে। গাড়ি চাই না তার, নীরবে শিকার করবে।

রক্ষা নেই পবন হায়দার ও ফারিয়া আহমেদের!

তেইশ

পোলার আইল্যাণ্ডের পশ্চিমে আইস ফিল্ড।

সকাল এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিট।

হঠাৎ চমকে ঘুম ভাঙল ডিজিএসই এজেন্ট শ্যারন ফ্যেনুয়ার।

বারকয়েক কাশল। চোখ পিটপিট করে সচেতন হতে চাইছে। চারপাশ দেখল, ও আছে কমলা এক ইনফ্লেটেবল লাইফ রাফটে। শান্ত আর্কটিক সাগরের লিড দিয়ে ধীরে চলেছে ওটা। বৈঠা বাইছে মাসুদ রানা। ব্যথা সহ্য করে শ্যারন ভাবল, মানুষটা এবার কী করবে? ওদের তো কোথাও যাওয়ার নেই!

লিডের দু’পাশের বরফ-দেয়াল কমপক্ষে দশফুট উঁচু।

নিজের দিকে চাইল শ্যারন। রানা পুরু ওয়াটারপ্রুফ ফিল্ড ড্রেসিং বেঁধে দিয়েছে ওর কোমর ও পেটে।

আপাতত থেমে গেছে রক্ত পড়া।

কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল শ্যারন, তারপর কষ্ট করে উঠে বসল। ‘আচ্ছা, আমরা এখানে এলাম কী করে? শেষ যা মনে পড়ে…’ থেমে গেল শ্যারন। ওর চোখ পড়েছে পোলার আইল্যাণ্ডের উপর।

লিডের দেয়ালের উপর দিয়েও দেখা গেল দ্বীপের দক্ষিণে উঁচু পর্বতমালা।

গম্ভীর রানা বলল, ‘তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে। ড্রেস করে দিয়েছি ক্ষত। এপি-৭ ইনজেক্টও করেছি। ফিল্ড ড্রাগ। বাংলাদেশ আর্মির জন্য তৈরি করেছেন আমাদের এক মহৎ মনের বাঙালি বিজ্ঞানী। ওটা ব্যথানাশক, আবার একইসঙ্গে মন ও দেহ স্থির রাখে। যাতে সৈনিক ফিল্ড হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছুতে পারে।’

‘তোমাদের দেশ বেশ দ্রুত উন্নতি করছে,’ মন্তব্য করল শ্যারন।

‘আপাতত দৌড়াতে পারবে না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু হাঁটতে পারবে। সাগরে ফেলে দিয়েছি চারটে স্ফেয়ার। কিন্তু আরও দুটো রয়ে গেছে। ওগুলো আছে আমার দলের নিশাত সুলতানা, পরন হায়দার ও ফারিয়া আহমেদের কাছে। ওরা আটকা পড়েছে দ্বীপে। আবারও ওখানে ফিরব আমরা।’

‘ফিরবে? কী করে?’

‘এসব লিডের ভেতর দিয়ে যাব পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তরে। ওখানে ওয়েইলিং ভিলেজ আছে। এখন রাফিয়ান আর্মি কঠোরভাবে পাহারা দেবে, কেবল কার, বা গ্যান্ট্রি এলিভেটার। দ্বীপের আরেকপাশে সাবমেরিন স্টেশন, ওটাও ব্যবহার করতে পারব না। বাধ্য হয়েই ওই গ্রামের দিকে চলেছি।’

‘তাতে সময় লাগবে,’ বলল শ্যারন। নড়ে উঠতেই ব্যথা পেয়েছে।

ওর দিকে চাইল রানা। ‘আজ আর তুমি লড়তে পারবে না। আরেকটু হলে মারাই পড়তে। প্লিনের তিন মিলিমিটার দূর দিয়ে গেছে বুলেট।’

গুঙিয়ে উঠল শ্যারন, চোখ পিটপিট করে সহ্য করতে চাইল ব্যথা। আবারও শুয়ে পড়ল। বাতাস নেই, ঢেউ নেই, পরিবেশটা খুবই শান্ত। দু’পাশে শুভ্র বরফ-দেয়াল, গেছে বহু দূরে। শ্যারন যেন ভাসছে কোনও মেঘে

‘ভুল না হয়ে থাকলে দশ মিনিটের ভেতর গ্রামে পৌঁছব,’ বলল রানা। ধীরে ধীরে বৈঠা বাইছে।

—তুমি তলিয়ে যাওয়া বিমান থেকে আমাকে তুলে এনেছ,’ আস্তে করে বলল শ্যারন।

চুপ করে থাকল রানা।

‘কিন্তু কেন?’ প্রশ্ন ছুঁড়ল শ্যারন। ‘কেন এ কাজ করলে? আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাকে খুন করতে। আগেও এ কথা বলেছি: সব শেষ হলে যে কাজে এসেছি সেটা করব। মূল মিশন থেকে সরে যাওয়ার কোনও কারণ নেই আমার।

কয়েক সেকেণ্ড বৈঠা স্থির রাখল রানা। শান্ত পানিতে ধীরে এগিয়ে চলেছে রাফট। শ্যারনের দিকে চেয়ে রইল ও।

‘আমি তোমাকে সরিয়ে এনেছি, কারণ আপাতত তুমি আমার লোক। তোমাকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল, তাই করেছি।’

রানার চোখে চাইল শ্যারন। ‘সত্যি… বিশ্বাস করো আমাকে? …কেন?’

‘আমার ওপর তোমার দেশের প্রতিশোধ-স্পৃহার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে একসঙ্গে কাজ করছি আমরা।’

‘সে তো নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে।’

‘আরও একটা কথা আছে: আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি শুধু কর্তৃপক্ষের হুকুমে আমাকে খুন করতে আসোনি,’ বলল রানা। ‘তুমি এসেছ ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। তোমার ধারণা অন্যায় করা হয়েছে তার ওপর। নিরপরাধ এক বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে ভয়ঙ্কর এক খুনি। তোমাকে ধারণা দেয়া হয়েছে, আমিই সেই খুনি। কাজেই… তবে সত্যি কথা হচ্ছে, আমি তাকে খুন করিনি। আর এটাও সত্যি, নিরপরাধ সে ছিল না, একটা রিসার্চ সেন্টার আক্রমণে সাহায্য করেছিল নিষ্ঠুর একদল খুনিকে। তারা নির্বিচারে খুন করছিল সিভিলিয়ানদের। আমি তাকে বেঁধে রেখেছিলাম খুঁটির সঙ্গে। ভেবেছিলাম সে হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওই অন্যায়টা করতে বাধ্য হয়েছে। খুন করতে চাইলে হাত-পা বাঁধার দরকার ছিল না। তুমি যা জেনেছ, সবই ভুল।

‘তবে আরও একটা সত্য কথা জেনে রাখো, শ্যারন। তুমি যখন আমার বা আমার কোনও বন্ধুর দিকে অস্ত্র তুলবে, সেই মুহূর্তে বিনা দ্বিধায় তোমার বুকে গুলি করব আমি। এত কথা ভেঙেচুরে বলার কারণ: আমি জানি বিচারবুদ্ধি আছে তোমার, তোমার বিচারে আমি জঘন্য এক অপরাধী।’

‘কিন্তু আসলে তা নও? আমার প্রতিশোধ নেয়া উচিত নয়?’

‘শোধ নেয়ার ইচ্ছেতে আমি কোনও দোষ দেখি না।’

‘তুমি আমার দেশের মস্ত ক্ষতি করেছ।’

‘করেছি। বাধ্য হয়ে। সেজন্য আমি মোটেই দুঃখিত নই। ওরাই আগ্রাসী ছিল, আমি যা করেছি, নিজের প্রাণ বাঁচাতে। …জানো, আসলে তোমার সমস্যা হচ্ছে, তুমি ন্যায্য বিচার করতে চাও। যারা এটা করতে চায়, আমার বিশ্বাস তারা আসলে ভাল মানুষ।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ। আসলে সুন্দর একটা নরম মনের মেয়ে তুমি। কোমল হৃদয়ের যে-কারও সঙ্গে যুক্তি দিয়ে কথা বলা যায়। তুমি পৃথিবীর বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছ, তাই আমি তোমার বিপদে সাহায্য করেছি।’

চোখ নামিয়ে নিল শ্যারন। নিজের মনে ভাবছে কথাগুলো।

একটু পর আবারও চোখ তুলল রানার চোখে। দৃষ্টি কঠিন। তুমি ভুল জানো। একসময় ন্যায় বিচারের ভক্ত ছিলাম। তখন বোকা ছিলাম। এখন আমি শুধুই খুনি। এই মিশন শেষে আহত থাকি বা সুস্থ— অক্ষরে অক্ষরে ওপরঅলার নির্দেশ পালন করব। আমাকে নিশ্চিত হতে হবে তুমি আর নেই।’

রানার মুখে চিন্তার সামান্যতম ছাপ পড়ল না।

‘সে যা হয়, দেখা যাবে,’ মৃদু হাসল রানা। কিন্তু একসময় আততায়ী ছিলে না, তাই না?’ সহজ স্বরে বলল।

‘না, তা ছিলাম না।’

‘আর সত্যিকারের খুনিও হতে পারোনি। তুমি বোধহয় বেশ চিন্তাশীল মেয়ে।’

‘কী কারণে এটা মনে হচ্ছে?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল শ্যারন।

‘কারণ ঠাণ্ডা মাথার খুনির মনের মৃত্যু হয় প্রথম। ওরা বোকাও হয়। গাধাও ট্রিগার টিপতে পারে। যে কারও মনে হতে পারে, কাউকে খুন করলে সত্যিই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে সে। কিন্তু তুমি অমন নও। অন্যকিছু হয়েছিল তোমার জীবনে।’

‘তুমি কি আমার সাইকো অ্যানালিসিস করছ?’ একটু রেগে গিয়ে জানতে চাইল শ্যারন।

‘আর কোনও কাজও তো নেই,’ মৃদু হাসল রানা।

‘ঠিক আছে। আকাশে চোখ রাখল শ্যারন। ‘নিজের কথা বলব তোমাকে। কিন্তু তোমাকেও বলতে হবে নিজের ব্যাপারে। বিশেষ করে জানতে চাই সুলতা রায় থেকে শুরু করে তিশা করিমের সঙ্গে কেমন ছিল তোমার সম্পর্ক।

চোখ সরিয়ে নিল রানা, পরক্ষণে শ্যারনের চোখে চাইল। ‘বেশ, বলব। তোমাকে দিয়েই শুরু হোক।’

‘অ্যাকশন ডিভিশনে কাজ নেয়ার আগে, ছিলাম ডিজিএসই ডিরেক্টোরেট অভ ইন্টেলিজেন্স-এ,’ বলল শ্যারন। ‘আমার কাজ ছিল আলজেরিয়া, মরোক্কো ও ইয়েমেনের ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপের ওপর চোখ রাখা। বিশেষ করে খেয়াল করতাম, তারা মহিলাদেরকে দলে টানছে আত্মঘাতী বোমাবাজ তৈরি করার জন্য। এক ইয়েমেনি মহিলার সঙ্গে গড়ে উঠল বন্ধুত্ব। তার পাঁচটা ছেলেমেয়ে। বয়স ওর পঁয়ত্রিশ। নাম লিলি রহিম। তিনবছর ধরে প্রচুর তথ্য দিয়েছে। তার তথ্য পেয়েই প্যারিসের ওপর দুটো হামলা ঠেকিয়ে দিই। প্রথম হামলা ছিল আইফেল টাওয়ারে। অন্যটা চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে।

‘তারপর একদিন, লিলি বলল যেন ওকে নিরাপত্তা দিই। তখন আবারও প্রেগন্যান্ট ও। ভয় পাচ্ছিল ওর নেতারা জেনে ফেলেছে, আসলে মুখ খুলেছে। আমি মার্সেইল্স্ ডিজিএসই অফিসে নিয়ে গেলাম লিলিকে। ডিব্রিফিং রুমে নেয়ার পর দায়িত্ব নিল আমার বস। সে আমার বাগদত্তও ছিল। টু ওয়ে কাঁচের ওপাশ থেকে সব দেখছিল। কিন্তু এর আগের বাচ্চা প্রসবের সময় লিলির ইউটেরাসে অপারেশন করে সেমটেক্সের দলা রেখে দেয়া হয়।

‘একবারও ভাবিনি এমন হবে। লিলি জানত সবই। আমাদের এক্স-রে বা ক্যাথোড রে স্ক্যানার দেখল ব্যাণ্ডেজের মত ওই জিনিসটা আসলে তারই দেহের অংশ বা ফিটাস। লিলি আমাদের চারটে সিকিউরিটি স্ক্যানার পেরিয়ে ওই ঘরে ঢোকে। সেসময় ওখানে ছিল ডিজিএসই-র দু’জন সিনিয়ার এজেন্ট। এ ছাড়া ঘরে ছিল আরও চার কলিগ। সবাই ছিটকে গেল বোমার বিস্ফোরণে। শুধু বেঁচে গেলাম আমি। বছরের পর বছর লিলি রহিম অপেক্ষা করেছে আত্মঘাতী হামলার জন্যে।’

চুপ করে আছে রানা।

‘লিলির প্রতি দয়া দেখাতে গেলাম বলে মরতে হলো আমার বাগ্দত্ত এবং আরও কয়েকজনকে,’ বলল শ্যারন। ‘তখনই ঠিক করলাম, আর কখনও কারও প্রতি মনে সহানুভূতি জাগতে দেব না। শীতল এক মানুষ হয়ে গেলাম। ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলাম অ্যাকশন ডিভিশনে। প্রথম মাসেই খুন করলাম এক ধর্ষক-খুনিকে। আর তারপর থেকে এই কাজই করছি।’

থেমে গেল শ্যারন, তারপর বলল, ‘অবাক কাণ্ড কী, জানো? তোমার বিষয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি। সত্যিই বুঝতে পারিনি কীভাবে এত দক্ষ অপারেটর হলে তুমি।’

‘রিসার্চ করেছ?’

‘স্বাভাবিক। কাউকে খুন করতে চাইলে প্রথমে তার সম্পর্কে সবই জেনে নেয়া উচিত। আগে বুঝতে হবে প্রেশার পয়েন্ট, কাকে ভালবাসে, দুর্বলতা— ইত্যাদি। নইলে তাকে ফাঁদে ফেলব কী করে?’

‘তা-ও ঠিক।’

তুমি কি তোমার জীবনের ব্যর্থতা বা সাফল্য নিয়ে বলবে না?’

তুমি রিসার্চার, তুমিই না হয় বলো,’ হাসল রানা। ‘কোথাও ভুল হলে ধরিয়ে দেব। এতে বুঝেও যাব কতটা জানো।’

‘আমার আপত্তি নেই,’ বলল শ্যারন। মনে গুছিয়ে নিল কথা, তারপর বলতে লাগল।

চুপ করে শুনছে রানা। চলে গেছে অতীতে। শ্যারন একের পর এক ওর মিশন ও ব্যর্থ প্রেমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছে।

একটু পর চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ধীরে ধীরে রাফট নিয়ে চলেছে দ্বীপের দিকে। উদাস হয়ে গেছে মন। বুকে কোথায় যেন চাপা কষ্ট।

‘….আর শেষে বুঝে গেলে সংসারের মায়াজাল তোমার জন্যে নয়। পরেও সোহানা বা তিশা তোমাকে বাঁধতে চায়নি।’

মাত্র সাত মিনিটে বক্তব্য সেরেছে শ্যারন।

নিজের মানসপটে তৈরি করেছে রানার নিখুঁত চিত্র।

হঠাৎ করেই বলল, ‘আমি হলে হয়তো বাঁধতেই চাইতাম…. .সত্যি, রানা… ‘ চুপ হয়ে গেল শ্যারন।

‘থামলে কেন?’ মেয়েটির দিকে চাইল রানা।

ঢোক গিলল সুন্দরী শ্যারন। ‘মিথ্যা বলব না… এমন কাউকে আমি জীবনে দেখিনি। অথচ দেখো, আমরা দুই মেরুর মানুষ- আমার ওপর নির্দেশ: যেন শেষ করে দিই তোমাকে।’

শুভ্র বরফের মাঠের মাঝ দিয়ে লিডে বৈঠা বাইছে রানা, একদম চুপ।

‘কিন্তু এখন…’ আবারও মুখ খুলল শ্যারন, ‘সত্যি জানি না কী করব। পাগল হতে চাই না, রানা। জানা নেই আর একঘণ্টা বাঁচব কি না। কিন্তু এটা জানি: যদি বলা হয় তোমাকে শেষ করতে, সেটা আমি পারব না। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, সেজন্যেও নয়। কেন যেন আমার অস্তিত্বের ভেতর অনুভব করছি, জেনে-শুনে-বুঝে কোনও পাপ করোনি তুমি। করতে পার না।’

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রানা। এইমাত্র থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে রিস্টগার্ড।

মেসেজ এসেছে কেভিন কনলনের কাছ থেকে।

‘পরে আবারও আলাপ করব,’ বলল রানা। পড়তে শুরু করেছে মেসেজ।

অদ্ভুত চোখে চুপ করে ওকে দেখছে অপরূপা, আহত শ্যারন। মনোযোগ দিয়েছে রানা রিস্টগার্ডের স্ক্রিনে :

কেভিন কনলন: ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, রানা! লেজ তুলে সিআইএ-র একদল খুনির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি! নীচে যা পাঠালাম, সেসব ভাল করে পড়লে অনেক কিছুই বুঝবেন। আমার ধারণা আপনার রাফিয়ান আর্মির মাথায় আছে উইলিয়াম থ্রাশার নামের এক লোক। আবারও পালাতে হচ্ছে। পরে যোগাযোগ করব। … বাঁচলে!’

সিআইএ? ভুরু কুঁচকে গেল রানার।

মেসেজে অ্যাটাচ করা পিডিএফ ডকুমেন্ট।

টাইটেলে লেখা: ‘কিল-ড্রাগন’।

ফাইল ওপেন করল রানা। সরে বসল শ্যারনের পাশে। এবার

দু’জনই পড়তে পারবে।

চোখ বোলাতে লাগল রানা প্রথম পাতায়:

অপারেশন ‘কিল-ড্রাগন’
অ্যানালিসিস অ্যাণ্ড
অপারেশন কনসেপ্ট বাই
উইলিয়াম থ্রাশার
আগস্ট ১, ১৯৮৫

উনিশ শ’ বিরাশি সালে লিখিত ‘মহাচিনের অবিশ্বাস্য উত্থান এবং আমেরিকার পতন’ সূচক লেখার পর এজেন্সির ডিরেক্টর (অপারেশন্স) আমার একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহী হন। তার ফলে হয়তো ইউনাইটেড স্টেট্স্ অভ আমেরিকার পতন ঠেকানো যেতে পারে। যে পরিকল্পনা আমি তৈরি করি, তা নীচে লিখিত হলো:

আমরা রাশাকে ব্যবহার করে শেষ করব মহাচিনকে।

চট করে শ্যারনের দিকে চাইল রানা। ‘লোকটা লিখেছে রাশাকে কাজে লাগিয়ে চিনকে শেষ করে দেবে।

‘তা হলে কি এই মিশন আসলে চিনের বিরুদ্ধে?’ আনমনে বলল শ্যারন।

দু’জন মিলে পড়তে লাগল:

এক্সিকিউটিভ সামারি

আমাদের নতুন কিছু অস্ত্রের বিষয়ে আগ্রহী হই, এবং সেগুলোর ভিতর একটি প্রোটোটাইপ ওয়েপন প্রোগ্রাম আমাদের অত্যন্ত কাজে আসতে পারে। অস্ত্রটা অ্যাটমোসফেরিক বা টেসলা ডিভাইস। পৃথিবীর জেটস্ট্রিম বা তুমুল বায়ুপ্রবাহ ব্যবহার করবে ওটা। ওই বায়ুর সঙ্গে নর্দান হেমিস্ফেয়ারে ছড়িয়ে পড়বে বিপুল দাহ্য গ্যাস। ওয়েদার মডেলের মাধ্যমে দেখা গেছে, আর্কটিকের নির্দিষ্ট এলাকা বা সোভিয়েত ফ্লিট মেইনটেন্যান্স স্টেশন পোলার আইল্যাণ্ডে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন তৈরি করলে, ওটা প্রয়োগে বাস্তবে ক্ষতি রাশার হবে না, বরং চায়নার হবে।

সোভিয়েত গুপ্তচর সংগঠনগুলো ব্যস্ত হয়ে আমাদের গোপন তথ্য চুরি করছে। এসবের মাধ্যমেই ক্ষমতা পেয়েছে ওই দেশ। তারা খুবই খুশি হবে আমেরিকার মিলিটারির গোপন তথ্য সরাতে পারলে। এবং সন্দেহ নেই আমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে দেরি করবে না। অর্থাৎ তৈরি করবে আমাদেরই আবিষ্কার সুপারওয়েপন।

আমার প্রস্তাব হচ্ছে: টেসলা ডিভাইসের প্ল্যান চুরি করবার সুযোগ করে দেয়া হোক কেজিবিকে। ডিভাইসের প্ল্যানের সঙ্গে অপটিমাল লোকেশন বিষয়ে দেয়া হবে আমাদের নিজস্ব ভুল তথ্য। সেসব ডেটার ভিতর নোট দেয়া হবে: পোলার আইল্যাণ্ডে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন তৈরি করলে ধ্বংস করা যাবে প্রায় গোটা আমেরিকা।

.

পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে চাইল রানা। অসংখ্য লিডের উপর যেন ঝুঁকে আছে উঁচু, প্রকাণ্ড, পাথুরে দ্বীপ।

‘এরা মানুষ না…’ বিড়বিড় করল শ্যারন।

সোভিয়েতরা যদি সত্যিই তৈরি করে ওই ডিভাইস— এবং আমি নিশ্চিত তাই করবে— তা হলে আমাদের পরের কাজ হবে সঠিক সময়ে মহাচিনের হুমকি দূর করে দেয়া। সেক্ষেত্রে তারা পৃথিবীর মাথায় ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। এবং এই প্ল্যানের সবচে’ ভাল দিক হচ্ছে: কেউ জানবে না আসলে কলকাঠি নেড়েছে আমেরিকা।

কাজেই নানাদিক বিবেচনা করে…

‘সিআইএ-র এরা সত্যিকারের পশু,’ রানার দিকে চাইল শ্যারন।

কোনও মন্তব্য করল না রানা। পড়ছে:

ঠিক হয়েছে, তৈরি করা হবে দেশহীন একটি সামরিক বাহিনী। সবমিলে দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ লোক থাকবে ওটাতে। রাফিয়ান আর্মি বা অন্য যে- কোনও নাম দেয়া হবে ওই সেনাবাহিনীর। ওই দলের কাজ হবে সঠিক সময়ে পোলার আইল্যাণ্ড দখল করে টেসলা ডিভাইস চালু করা।

জরুরি একটি নোট: ওই দলের কেউ যেন জানতে না পারে তাদের আর্মি শেষে থাকবেই না।

সত্যিকারের সৈনিক কখনোই ভাল অভিনেতা হয় না। মার্সেনারিদেরকে কখনও বিশ্বাস করা যায় না। আর প্রাইভেট কন্ট্রাক্টাররা মার্সেনারিদের চেয়েও বদ। এই মিশন সফল করতে হলে চাই সত্যিকারের বিশ্বাসী অফিসার ও সৈনিক। ধরে নেয়া যেতে পারে, তাদের কেউ কেউ বন্দি হবে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করবে আমাদেরই কোনও বন্ধু রাষ্ট্র। (তারাও জানবে না আমরা তৈরি করেছি নকল আর্মি, এবং আমাদের দু’চারজন বন্দি হলে আমেরিকারই উপকার হবে।)

সব শেষে আমার প্রস্তাব হচ্ছে: আমাদের উচিত মিলিটারি ট্রেনিং পাওয়া লোক নিয়োগ করা। আমরা সহজেই তাদেরকে ভুল পথে নিতে পারব। জানিয়ে দেয়া হবে পৃথিবীতে নানা বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য তাদেরকে জড় করা হয়েছে। ওই আর্মির উপরমহলের ছোট বৃত্তের কয়েকজন বিশ্বাসী লোক এবং আমি নিজে মিলে একের পর এক টেরোরিস্ট হামলা করব নানা দেশে। এর ফলে ওই আর্মির নাম ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না। এরপর সঠিক সময়ে দখল করা হবে পোলার আইল্যাণ্ড, এবং কাজে লাগানো হবে রাশান ডিভাইস।

আরেকটি জরুরি বিষয়: আমাদের কাজ সমাপ্ত হলে শেষ করে দিতে হবে ওই আর্মির প্রত্যেককে।

চোখ বোলাতে লাগল রানা ডকুমেন্টে:

জরুরি এই মিশনের কারণে কী ঘটতে পারে:

লেলিহান গ্যাসীয় আগুনে মহাচিন, তার সব শহর, বেশিরভাগ মানুষ এবং সমস্ত সম্পদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় জনবিরল হয়ে যাবে ওই বিশাল ভূমি। ছাই হবে পাক-ভারত-বাংলাদেশের নব্বুই ভাগ মানুষ। স্বল্প খরচে শ্রমিক মেলে, তাই ওই কয়েকটি দেশের কনফেডারেশনই ভবিষ্যতে হয়ে উঠত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। এই একই মিশনে শেষ হবে দুই এলাকার দুই শত্রু প্রতিযোগী। ইউনাইটেড স্টেট্স অভ আমেরিকার সামান্য এলাকা পুড়বে। (এ ক্ষতি মেনে নিতে হবে, নইলে হয়তো সন্দেহ এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ে।) দোষ গিয়ে পড়বে রাশার ওপর। উন্নত দেশের সরকার ভাল করেই জানে, দুর্বল সেফটি প্রোটোকলের জন্য বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাশা। এবারও তা-ই হবে, ঝাড়ে বংশে শেষ হবে চিনারা। শেষপর্যন্ত অবশ্য দোষ পড়বে এক টেরোরিস্ট দলের ওপর। এবং আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমেরিকা। সাধারণ মধ্যবিত্ত নতুন করে বাঁচবে। নিশ্চিত হবে তাদের ভবিষ্যৎ।

শেষে আমেরিকার সাধারণ মানুষই ভোগ করবে এই বসুন্ধরা।

.

চুপ করে রিস্টগার্ডের স্ক্রিনে চেয়ে আছে রানা। মনে মনে বলল, ‘নরকে যাক আমেরিকানদের উন্নতি।’

ওর মনে পড়েছে, অতি দেশ-প্রেমিক আমেরিকান এক এজেন্সির কথা। ওই সংগঠনের নাম ছিল: আইসিজি। মানুষ খুন করতে দ্বিধা করত না। কিন্তু এবার আমেরিকার সিআইএ যা করছে, এর কোনও তুলনা হয় না। রিস্টগার্ডের পরের পৃষ্ঠায় গেল রানা। ওখানে পৃথিবী দেখানো হয়েছে। সেই মানচিত্রে বিপুল গ্যাসের মেঘ। ওটা বিষাক্ত নয়, কিন্তু দাহ্য বলে আগুন জ্বেলে দেবে দেশে দেশে।

ঢেকে ফেলেছে পুরো চিন।

ভারতের পশ্চিমাংশ ছাড়া উপমহাদেশের অন্যসব এলাকা ছাই হবে।

নিজের সবুজ দেশটির কথা মনে এল রানার, মুচড়ে উঠল বুকের ভিতরটা। বাঙালি শান্তিপ্রিয়, গরীব- তাই হাজার বছর ধরে মানতে হয়েছে অনেক অত্যাচার, অবহেলা ও অপমান। একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মাথার উপর চাপিয়ে দিয়েছিল অন্যায় যুদ্ধ। তারা খুন করেছিল লাখ লাখ বাঙালি। ধনী সব রাষ্ট্রের নানা দাবীর চাপ সহ্য করেও মাত্র কোমর সিধা করছে বাংলাদেশ। আর এখন বিশ্বের সম্রাট, যুদ্ধবাজ, অস্ত্রধারী, মহাধনী আমেরিকার একদল নিষ্ঠুর পশু চাইছে ওদেরকে বিনা অপরাধে শেষ করে দিতে!

বুকের ভিতর আগুন জ্বলছে রানার। আবারও ম্যাপ দেখল।

অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপনের ফলে এশিয়া বা ইউরোপের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকা।

ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল শ্যারন। নিচু স্বরে বলল, ‘সত্যি তা হলে রাফিয়ান আর্মির জন্ম দিয়েছে সিআইএ।’

‘এক শ’ ভাগ আমেরিকার জিনিস,’ তিক্ত স্বরে বলল রানা।

আবারও কিল-ড্রাগন ডকুমেন্টে মন দিল ওরা।

ডকুমেন্টে জরুরি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছে উইলিয়াম থ্রাশার:

মুখ থুবড়ে পড়বে সোভিয়েত ইউনিয়ন

সিআইএ কর্তৃপক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে আমাদের পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এবং আমারও ধারণা: এই দশকের শেষের দিকে ওই দেশই থাকবে না। আর তার ফলে কঠিন হবে আমাদের কাজ। কিন্তু এ-ও ঠিক, আরও জরুরি হয়ে উঠবে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।

সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ হয়ে যাওয়ায় যে কনফেডারেশন তৈরি হবে, তাদের জন্য কষ্টকর হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিধ্বংসী হাজার হাজার নিউক্লিয়ার আর্সেনাল নিয়ন্ত্রণ করা। এবং টেসলা ডিভাইসের মত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখা কঠিন হবে রাশার জন্য। পোলার আইল্যাণ্ডের ভয়ঙ্কর ওই অস্ত্র পাহারা দেয়ার জন্য হয়তো থাকবে আর্মির কয়েকজন স্টাফ ও সৈনিক। তারা হবে স্কেলিটন ক্রু। কাজেই সহজে তাদেরকে কিনেও নেয়া যাবে।

.

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ‘মেনে নেয়া কঠিন, ওই লোক এসব লিখেছে উনিশ শ’ পঁচাশি সালে। সত্যিই মস্ত অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে চিন। কিন্তু দুটো ব্যাপারে ভুল করেছে থ্রাশার। প্রথম কথা: পালিয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর ম্যাকসিম তারাসভ, ডিসট্রেস সিগনালও দিতে…’

‘আর দ্বিতীয় ভুল?’ প্রশ্ন ছুঁড়ল শ্যারন।

‘তার জানা ছিল না আমাদের ছোট্ট টেস্টিং টিম ছিল কাছেই।’

চুপ হয়ে গেছে রানা, এইমাত্র থামল রাফট।

কয়েক শ’ ফুট সামনে লিড শেষে উঁচু পোলার আইল্যাণ্ড।

ওই তীরেই বরফ-ছাওয়া শত বছর পুরনো পরিত্যক্ত তিমি শিকারীদের গ্রাম।

ওদিকে চোখ গেল রানার। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আরেকটা বিষয় মোটেও আঁচ করেনি থ্রাশার। তার জানা নেই, তাকে রুখতে আমরা কতটা দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ।’

চব্বিশ

মেইন ভেণ্টের কাছেই নিচু এক দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো ও কর্পোরাল বব বউলিং। পরিষ্কার চোখে পড়ছে পোলার আইল্যাণ্ডের মিসাইল ব্যাটারি। টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে ওরা, সম্পূর্ণ সতর্ক। শত্রুপক্ষ জানে না ওরা এখানে আছে। বিস্ময় এখনও দূর হয়নি ওদের।

একটু আগে দেখেছে, রাশান কমপ্লেক্সে ঢুকে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিয়ে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ারসহ তার দলবল নিয়ে রানওয়ের দিকে পালিয়ে গেছে মাসুদ রানা।

অবশ্য তার ফলে কিছুই বদলে যায়নি। মাসুদ রানা ও তার মিশন ব্যর্থ হয়েছে। এবার ওদেরকে কিছু করতে হবে। কঠিন কাজ।

ধ্বংস করতে হবে রাফিয়ান আর্মির মিসাইল ব্যাটারি।

শুধু তা-ই নয়, ওই আর্মিকে ঠেকাতে হবে, নইলে আবারও গ্যাসভরা আকাশে ইউরেনিয়ামের স্ফেয়ার ছুঁড়বে তারা।

একটা চিন্তা ঢুকেছে বব বউলিঙের মনে। বাধ্য হলে খুঁজে বের করবে রাফিয়ান আর্মির আপলিঙ্ক। ওটা যোগাযোগ রাখছে মিসাইল-স্পর্টিং স্যাটালাইটের সঙ্গে। ওই আপলিঙ্ক উড়িয়ে দিলে ওরা নিজেরাও বাঁচবে না। রাশান বা আমেরিকান মিসাইল উড়িয়ে দেবে এই দ্বীপ।

বব জানে, প্রয়োজনে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না ও।

কিন্তু আপলিঙ্ক খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ওই ডিশ খুব বড় হতে হবে, তা নয়। বাসনের সমান জিনিসটা আকাশে তাক করলেই হলো। সত্যি যদি খুব চালাক হয় রাফিয়ান আর্মির অফিসাররা— এবং তার উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে— সেক্ষেত্রে এমন কোথাও আপলিঙ্ক রেখেছে, যেখানে কারও চোখে পড়বে না ওটা। দ্বীপে উঠবার পর ডিশের মত কিছুই দেখেনি বব বা পাওলো।

মাসুদ রানা চলে যাওয়ার পর গ্যাস ভেন্টের দক্ষিণে মিসাইল ব্যাটারির কাছে অবস্থান নিয়েছে ওরা। পরনে এখনও মৃত রাফিয়ান আর্মির পার্কা।

এখন যেখানে আছে, সেটা ভাল জায়গা।

নীচেই মিসাইল ব্যাটারি।

অবশ্য ওদের চোখের সামনেই লঞ্চ করা হয়েছে মিসাইল।

ধবধবে সাদা হয়ে জ্বলে উঠেছিল দক্ষিণের আকাশ।

ওদের মনে হয়েছিল পুরো ব্যর্থ হয়েছে ওরা।

সফল হয়েছে রাফিয়ান আর্মি।

কিন্তু এর একটু পরেই শুনল হৈ-চৈ।

ছিটকে গিয়ে নানাদিকে ছুটল অফিসার ও সৈনিকরা।

ওই হুলুস্থুলের ভিতর এক সৈনিক দেখে ফেলেছিল ওদেরকে, কিন্তু সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের গুলিতে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো।

দেরি না করে লাশটা সরিয়েও ফেলেছে ওরা। তখন লোকটার ইয়ারপিস নিয়েছে ক্যাপ্টেন।

সিঙ্গল ইয়ারপিসে কান পেতেছে দু’জনই। শুনেছে রাফিয়ান আর্মির কথাবার্তা।

নদীপথে পালাতে শুরু করেছিল দুঃসাহসী মাসুদ রানা।

‘এইমাত্র বিমান নিয়ে নদীতে নেমেছে হারামজাদা…’

‘ধরতে স্ট্রেলা পাঠাও!’

‘…শালার ধচা বিমানের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে কারা যেন!’

‘তিনজন! সিমেণ্ট মিক্সারে!’

‘ধর শালাদের! ওই যে দুই স্ফেয়ারের কেস!’

‘কেড়ে আন্ ওই স্ফেয়ার!’

এর একটু পর অ্যান্টোনভ বিমান পড়ে গেল জলপ্রপাত থেকে নীচের সাগরে। আরও একটু পর আবারও শোনা গেল ট্র্যান্সমিশন। কোথায় যেন আছে একটা খনি, সেখানে কী যেন ঘটছে। শেষে নীরব হয়ে গেল রেডিয়ো।

এখন চুপচাপ অপেক্ষা করছে বউলিং ও পাওলো। চোখ রেখেছে পোলার আইল্যাণ্ডের মিসাইল ব্যাটারির উপর। প্রথম মিসাইল লঞ্চ ঠেকাতে পারেনি, কিন্তু এরপর আর ভুল করবে না।

ওই ব্যাটারি আসলে সমতল উঁচু এক জায়গা, ওই জমিকে বেসের সঙ্গে যুক্ত করেছে সরু একটা দীর্ঘ সেতু।

গহ্বর পেরিয়ে মেইন টাওয়ারে গেছে সেতু।

পাথরের সমতল জায়গাটা চেঁছে সমান করা, তার উপর দাঁড়িয়ে আছে সেমি-ট্রেইলারের মত দেখতে ছয়টা ট্র্যান্সপোর্টার ইরেকটর লঞ্চার। প্রতিটার পিঠে একটা করে মিসাইল।

মিসাইল ব্যাটারির দিকে চেয়ে আছে বব বউলিং। ‘আমরা যদি সেতুর পাশে দড়ি ঝুলিয়ে নেমে যাই? কারও চোখ না এড়িয়েই নামতে পারব কূপের ভেতর। তারপর ম্যাগহুক ব্যবহার করে আবারও উঠে যাব মিসাইল ব্যাটারিতে।’

মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন পাওলো। ‘যিশু! তুমি পাগল নাকি! আমরা শেষ! মাসুদ রানা খতম! অন্যরাও একটু পর মরবে!’

‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ— লড়ব আমরা,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল বব। ‘এ ছাড়া উপায়ও নেই। চলুন, স্যর, ব্যাটারি উড়িয়ে দিই!’

সাবধানে এগোতে শুরু করেছে তরুণ।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল ক্যাপ্টেন পাওলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘সব শালা হিরো হয় না, বাছা!’

বব বউলিঙের কথামতই কাজ করল পাওলো। নেমে গেল গভীর কূপে, তারপর ম্যাগহুক ব্যবহার করে আবারও উঠল ব্যাটারিতে। দেরি না করেই চট্ করে লুকিয়ে পড়ল একটা ট্র্যান্সপোর্টার ইরেকটর লঞ্চারের তলে।

প্রায় কেউ খেয়াল করেনি ওরা কোথায় গেছে।

কিন্তু ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করছে সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা।

কমাণ্ড সেন্টারে নীরবে সবই দেখছে বিশৃঙ্খলার সম্রাট উইলিয়াম থ্রাশার। এইমাত্র ব্যাটারি বেয়ে ট্রাকের নীচে ঢুকেছে দুই মেরিন।

মাইক্রোফোন তুলে নিল থ্রাশার।

ওদিকে লঞ্চারের নীচে সতর্ক হয়ে উঠেছে বব বউলিং। হাঁপাচ্ছে দৌড়ে আসা কুকুরের মত।

‘ঠিক আছে, স্যর, এবার গ্রেনেড দিন,’ পাওলোকে বলল।

খুব উৎসাহী হতে পারল না ক্যাপ্টেন পাওলো। হাত বাড়াল ওয়েবিঙে রাখা গ্রেনেড পাউচের দিকে। আর তখনই শুনল একটা কণ্ঠ: ‘ক্যাপ্টেন পাওলো, তুমি এসেছ আমেরিকার টেক্সাস থেকে। পরিষ্কার দেখছি মিসাইল ব্যাটারিতে শুয়ে আছ আমার একটা লঞ্চারের নীচে।’

চমকে গেল পাওলো। চট করে দেখে নিল বব বউলিংকে। ছোকরা কিছুই শোনেনি। ক্যাপ্টেন এবার বুঝল, ওই কণ্ঠ এসেছে রাফিয়ান আর্মির ইয়ারপিসে।

‘আমার কোনও কথা শুনবে না ও। শুনবে শুধু তুমি। এ-ই তো ভাল। তোমাকে চমৎকার একটা প্রস্তাব দিচ্ছি।’

বরফের মূর্তি হয়ে গেল পাওলো।

‘স্যর, গ্রেনেড দিন,’ তাড়া দিল বব বউলিং।

হাত তুলে দেরি করতে ইশারা করল পাওলো। ভঙ্গি করছে কাছের সেন্ট্রির কারণে দ্বিধা করছে। আসলে শুনছে ইয়ারপিসের কণ্ঠ: ‘আমি বিশৃঙ্খলার সম্রাট, রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। আমি তোমার শত্রু। কিন্তু শত্রুই থাকতে হবে, এমন তো নয়।’

‘স্যর…’ ডাক দিল বব।

চারটে গ্রেনেড দিল পাওলো।

চুপচাপ কথা শুনছে। ‘ঠিক আছে,’ মুখে বলল।

‘কিছু বললেন, স্যর?’ অবাক হয়েছে বব, কিন্তু আর কিছু বলল না।

‘পরিষ্কার দেখছি নির্দেশ পালন করছ, পাওলো। ধ্বংস করে দেবে আমার মিসাইল। ফলে গ্যাসের মেঘে স্ফেয়ার ছুঁড়তে পারব না। আগের মতই চলবে অন্যায় ভরা এই পৃথিবী। কিন্তু তুমি কি বোকা মনে করো আমাকে? ভেবেছ আরও মিসাইল ও লঞ্চার আমার নেই? আরও ভাবো, পাওলো। এরপর তোমার কী হবে? তোমাকে রক্ষা করবে কে?’

ভুরু কুঁচকে ফেলন ক্যাপ্টেন পাওলো।

ওই লোকের মত, ওর মনেও একই চিন্তা এসেছে।

যেইমাত্র ওরা ব্যাটারি উড়িয়ে দেবে, বোলতার ঝাঁকের মত আসবে রাফিয়ান আর্মির লোক।

রক্ষা নেই ওদের।

ভয়ঙ্করভাবে মরতে হবে ওকে।

অন্য কোথাও আছে আরও লঞ্চার।

‘পাওলো, বুঝতে চেষ্টা করো, যদি এসব লঞ্চার ধ্বংস করো, তোমাকে স্রেফ খালি হাতে ছিঁড়ে ফেলবে আমার লোক।’

ক্যাপ্টেনের দিকে ভুরু কুঁচকে দেখছে তরুণ বব বউলিং। জানে না, কোথায় হারিয়ে গেছে স্যরের মন। কিছু শুনছে বোধহয়। ‘স্যর, চুপচাপ কী করছেন?’

হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল পাওলো।

‘নিশ্চিত থাকো, আরও লঞ্চার আছে আমার। পাওলো, তোমার মৃত্যু হবে খামোকা। করুণ মৃত্যু। পাওলো, এ মুহূর্তে আমার সামনে তোমার ফাইল। তুমি বোকা নও। তোমার মামা ভিট্টোরিয়ো হলে বলত, ‘ভাগ্নে, এ সুযোগে নিজের পিঠ বাঁচা!’

‘আপনার কথা মানলে কী পাব?’ জানতে চাইল পাওলো।

আপনি কী করছেন, স্যর,’ কাছে চলে এসেছে বউলিং।

তুমি যদি ওই ছোকরাকে শেষ করো, ধ্বংস না করো আমার ব্যাটারি বা লঞ্চার— কথা দিচ্ছি, তোমাকে প্রাণে বাঁচতে দেব। নিরাপদে যেতে পারবে এই দ্বীপ ছেড়ে। আর এসব শেষ হওয়ার পর তোমাকে চিলিতে দেয়া হবে একটা ম্যানশন। যত খুশি মেয়েলোক ভোগ করতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, আরও দেয়া হবে পঞ্চাশ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। আয়াস করে পার করবে বাকি জীবন।’

অনেক কাছে চলে এসেছে বব বউলিং। বুঝে গেছে ক্যাপ্টেন কী করছে। বিস্ময় নিয়ে তার দিকে চাইল তরুণ।

‘স্যর, আসলে কী করতে চাইছেন আপ…’

জবাবে ঝট করে মেরিনদের এম৯ পিস্তল বের করল পাওলো, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করল বব বউলিঙের কপালে।

‘বুম!’ করে উঠেছে পিস্তল।

ছিটকে পিছনের মাটিতে গিয়ে পড়ল তরুণ।

উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো, রওনা হয়ে গেল। এখন লুকিয়ে নেই। ওকে দেখুক রাফিয়ান আর্মির লোক, ওকে খুন করবে না তারা।

.

পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তর-পশ্চিমে গভীর এক ত্রিকোণ ক্যানিয়নে পুরনো, পরিত্যক্ত রাশান তিমি-ধরা গ্রাম। ওই ক্যানিয়ন গেছে ক্লিফের বুক চিরে দূরে। গ্রাম থেকে দ্বীপের মেইন কমপ্লেক্সে যেতে হলে ব্যবহার করতে হবে ক্যানিয়নের দেয়ালের উপর তৈরি সরু এক রাস্তা।

উনিশ শতকের গ্রামে আজও রয়ে গেছে ছোট সব কুটির, বড় কসাইখানা, গোলাকার পানির ট্যাঙ্ক ও একের পর এক গ্যাংওয়ে ও জেটি। প্রতিটি বাড়ির সামনে ঝুলছে শিকল, হুক ও পুলি। আর্কটিকের শুকনো, হিমশীতল পরিবেশে সবই আগের মত রয়েছে। অবশ্য জ্বলে গেছে সব কাঠের তক্তার রং। তার উপর জমেছে শক্ত বরফের পাতলা স্তর।

বাংলাদেশের গ্রামের দক্ষ সাঁতারুদের মতই পানি কাটছে রানা ও শ্যারন। বরফের মাঠের কাছ থেকে রওনা হয়ে এক শ’ গজ খোলা সাগর পেরিয়ে উঠতে হবে দ্বীপের ক্লিফে। সামান্যতম ঢেউ তৈরি করছে না ওরা। তীরে কোনও প্রহরী থাকলেও সে বা তারা বুঝবে না ওদিকে চলেছে দু’জন মানুষ। আহত শ্যারনকে সাহায্য করছে রানা। ওর কমব্যাট ওয়েবিঙে আটকে নিয়েছে মেয়েটির ওয়েপন্স বেল্ট।

কিছুক্ষণ পর পৌছল তীরের ক্লিফের কাছে।

মাত্র এক শ’ গজ পশ্চিমে জনমানবহীন গ্রাম।

ক্লিফ ঘেঁষে পৌঁছল ওরা প্রথম জেটির পাশে।

মাত্র দু’চার জায়গায় বরফভরা সাগর থেকে ওঠা যায় পোলার আইল্যাণ্ডে।

কাজেই ওরা ধরে নিয়েছে, এ জায়গা পাহারা দেবে সেন্ট্রিরা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: আছে কোথায় তারা-!

কোথাও কোনও সেন্ট্রি দেখল না রানা বা শ্যারন।

নিঃশব্দে জেটিতে উঠল ওরা, ওখান থেকে বরফে ঢাকা বোট র‍্যাম্প। ভাবছে, কারও চোখে না পড়েই উঠতে পেরেছে দ্বীপে।

বাস্তবে তা নয়।

ক্লিফের গোড়ায় উঠতেই চোখে চোখে রাখা হয়েছে ওদের।

অবশ্য ওই চোখ সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরার।

বরফে ছাওয়া গ্রামে পৌছে কুটিরগুলোর আড়াল নিল ওরা। সামনে বাড়ছে সতর্কভাবে।

গ্রামের আরেকপ্রান্তে এসে দেখতে পেল সেন্ট্রিদল।

খুবই সহজ হয়ে উঠেছে তাদের কাজ।

রাস্তার মুখে পাহারা দিলেই চলবে।

তাদের রোডব্লকের পর শুরু হয়েছে এক লেনের রাস্তা, ঢালু হয়ে উঠে গেছে মেইন কমপ্লেক্সের দিকে।

সাগর থেকে গ্রামে উঠতে পারবে যে কেউ, লুকিয়ে পড়তে পারবে গ্রামের কুটিরে বা কসাইখানায়- কিন্তু মূল দ্বীপের রাশান স্থাপনায় যেতে হলে ব্যবহার করতে হবে ওই সরু রাস্তা।

পথের উপর আড়াআড়িভাবে রাখা দুটো জিপ ও একটা সাইডকারসহ মোটরসাইকেল, আটকে দিয়েছে রাস্তা। যানগুলোর উপর বসে আছে ছয়জন রাফিয়ান আর্মির সৈনিক। পরনে ভারী মেরিন পার্কা। ধূমপান চলছে অলস সময়ে। কাঁধ থেকে ঝুলছে স্লিঙে একে-৪৭ রাইফেল।

‘এবার ওদেরকে পেরোবে কী করে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল শ্যারন।

‘তোমার কাছে স্মোক গ্রেনেড ছিল— এখনও কি আছে?’

আস্তে করে মাথা দোলাল শ্যারন।

‘দুটো দাও।’

ওয়েপন্স বেল্ট থেকে দুটো গ্রেনেড নিয়ে রানার হাতে দিল শ্যারন।

‘এবার শোনো আমার প্ল্যান,’ বলল রানা, ‘আমি যাব ওই রোডব্লকের খুব কাছে। লোকগুলোর ওপর গ্রেনেড ফেলব। আর ধোঁয়া বেরোতে শুরু করতেই ডানদিকের সৈনিকদেরকে শেষ করবে তুমি। বামদিকের লোক আমার।’

‘ব্যস? এ-ই তোমার প্ল্যান?’ হতাশ হয়েছে শ্যারন।

‘ভাল আর কোনও প্ল্যান আছে তোমার?’

‘না, ঠিক তা না,’ স্বীকার করল শ্যারন। ‘একমিনিট, দাঁড়াও! তুমি রোডব্লক পর্যন্ত কীভাবে যাবে? সামনে পড়বে কমপক্ষে পঞ্চাশ গজ ফাঁকা জায়গা। এত দূর থেকে কোনও কাজ করবে না গ্রেনেড।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ‘সেজন্য আমার আলাদা প্ল্যান আছে।

‘সেটা কী?’

‘আত্মসমর্পণ করব।’

একমিনিট পর আড়াল থেকে বেরোল রানা। ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে চলেছে রোডব্লকের দিকে। হেরে যাওয়া হতাশ এক লোক, দু’হাত মাথার উপর।

এদিকে চোখ পড়েই চমকে গেছে রাফিয়ান আর্মির লোক। ঝট করে অস্ত্র তাক করল রানার দিকে।

ধুপধাপ শব্দে লাফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড, টের পেল রানা। ওকে যেতে হবে লোকগুলোর খুব কাছে।

আন্দাজ দশ গজ?

তারপর ছুঁড়ে মারবে দুই স্মোক গ্রেনেড।

ও-দুটো আছে কাঁধের পিছনের ক্লিপে, সামনের দিক থেকে চোখে পড়বে না।

পেরোতে হবে আরও তিরিশ গজ।

‘আমি সারেণ্ডার করছি,’ হাঁটতে হাঁটতে চেঁচাল রানা।

গুলি করা হলো না।

‘খবরদার! মাথার ওপর হাত রাখো!’ তর্জন ছাড়ল এক সৈনিক।

গুনগুন করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে হাঁটছে রানা। মনের চোখে দেখল বিসিআই চিফকে। ভয়ঙ্কর ভুরু কুঁচকে ওকে দেখছেন। হতাশ মুখে মাথা নাড়লেন, তারপর কঠোর কণ্ঠে ধমকের সুরে বললেন, ‘গানের কিচ্ছু হচ্ছে না, গাধা!’

গম্ভীর চেহারা করে হাঁটতে লাগল রানা।

আর বিশ গজ…

পনেরো…

দশ…

শক্ত হয়ে উঠল রানার দু’হাতের পেশি। এবার খপ্ করে ধরবে গ্রেনেড, তারপরই…

‘নড়বে না, মাসুদ রানা! শালার ওই দুই হাত গ্রেনেড থেকে দূরে রাখো!’ ডানদিক থেকে বলা হয়েছে কথাটা। কর্কশ স্বর।

বরফের মূর্তি হয়ে গেল রানা। বিড়বিড় করে গালি দিল ভাগ্যকে। আগেই রাস্তার পাশের ওই করাগেটেড ছাউনির দিকে খেয়াল দেয়া উচিত ছিল। ভিতরে যে লুকিয়ে আছে একলোক, তা কে জানত!

ব্যাটা তালগাছের সমান লম্বা, দু’হাতে বাগিয়ে ধরেছে আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল। গায়ের পার্কায় স্টেনসিলে লেখা: কর্নেল সাইক্লোন।

ছাউনি থেকে রাস্তায় নামল লম্বা খুঁটি।

রানার মাথা লক্ষ্য করে চেয়ে আছে তার অস্ত্রের মাযল।

পিছন থেকে হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নেয়া হলো রানার দুই গ্রেনেড, ফেলে দেয়া হলো রাস্তার বরফে।

‘ছিহ্, এসব হাতের কাছে রাখতে হয়?’ বলল সাইক্লোন।

রোডব্লকের লোকগুলো ঘিরে ফেলল রানাকে। অস্ত্রগুলোও কেড়ে নিল কর্নেল। ‘মাথার উপর হাত, মেজর রানা।’

মাথার পিছনে গেল রানার দু’হাত। ভাবল, এ বিপদে সাহায্য করতে পারবে শ্যারন? নাহ্! সাঁতার কাটতেই কষ্ট হচ্ছিল ওর। হামলা তো দূরের কথা! তা ছাড়া, ওর কাছে অস্ত্র বলতে আছে শুধু শ্টায়ার টিএমপি ও দুই পিস্তল— শেষের দুটো সিগ সাওয়ার পি২২৬ ও ছোট্ট রুগার। এসব অস্ত্র দিয়ে এতজনের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না শ্যারন।

নাকে প্রায় নাক ঠেকিয়ে রানার সামনে দাঁড়াল সাইক্লোন। চারপাশ দেখতে দিচ্ছে না।

ভয় লাগিয়ে দেয়ার মত লোকটার দুই চোখ।

কঠোর দৃষ্টি। মরা মাছের চোখের মত অস্বচ্ছ।

এ ধরনের চোখের লোক আগেও দেখেছে রানা।

এরা সত্যিকারের সাইকোপ্যাথ।

‘আমার বস্ ধারণা করেছিলেন তুমি আবারও ফিরবে,’ বলল সাইক্লোন। ‘তুমি কাঁঠালের আঠার মত লোক, মিস্টার।’

‘খুন যদি করতে চাও, করে ফেলো,’ বিরক্ত হয়ে বলল রানা। ‘অত বক্তৃতা শুনতে পারব না।’

‘নিশ্চয়ই খুন হবে, মেজর। এতে কোনও সন্দেহ রেখো না মনে। কিন্তু আপাতত তোমার দাম আছে আমাদের কাছে। বস্ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

রানা দেখল, মাথা সামান্য কাত করল সাইক্লোন।

ওর পিছনে নড়ে উঠেছে কেউ।

ঝট্ করে ঘুরল রানা, দেখল ওর মুখের উপর নেমে আসছে এক লোকের রাইফেলের কুঁদো।

আঁধার নামল দুই চোখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *