মৃত্যুদ্বীপ – ১০

দশ

পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তরদিকের দ্বিতীয় দ্বীপের লোডিং ডক।

সকাল নয়টা চল্লিশ মিনিট।

মাত্র একঘণ্টা বিশ মিনিট পর দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠবে গোটা পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থলভূমি, পুড়ে মরবে কোটি কোটি মানুষ।

ভালুক দ্বীপের কালো কংক্রিট লোডিং ডকে মৃত মেরু ভালুকটাকে পরীক্ষা করছে ফারিয়া ও পবন।

ওদের পাশেই অপেক্ষা করছে রোবট বন্ধু।

‘কখনও এ ধরনের পোলার বেয়ার দেখিনি,’ বলল ফারিয়া। ‘রোম খেয়াল করুন। জট পাকানো, নোংরা। সাধারণত খাটো হয় পোলার বেয়ারের রোম, আর সেসব খুব পরিষ্কার রাখে তারা।’

মৃত ভালুকের দিকে চেয়ে নাক কুঁচকে ফেলল পবন।

এই ভালুক সত্যিই খুব নোংরা।

সারা দেহে রক্ত।

ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে লাশটা।

‘আজ পর্যন্ত যেসব ভালুক দেখেছি, এটা সেগুলোর তুলনায় ছোট,’ বলল পবন।

‘হ্যাঁ, তাই,’ মৃতদেহের আরেক পাশে থামল ফারিয়া। সতর্ক চোখে দেখছে। দক্ষ বিজ্ঞানীর মত করেই বলল, ‘তরুণ ভালুক সর্বক্ষণ খেপেই থাকে। হামলা করে সবসময়। কখন কী করবে কেউ জানে না।’

রিইনফোর্সড কাঁচের দরজার দিকে চাইল ফারিয়া। ওপাশে দ্বীপের ল্যাবোরেটরির দালান। দেখা যাচ্ছে সামনের কক্ষ। মাঝে আট কোনা এক জায়গা নেমে গেছে গভীরে। ওই অংশের চারপাশে উঁচু ওয়াকওয়ে। ওখানে ঘোরাফেরা করছে চারটে প্রকাণ্ড পোলার বেয়ার। তাদের একটা এসে থামল কাঁচের দরজার ওপাশে।

‘ফারিয়া, আপনার কি ধারণা ডকে একা বাস করত এই ভালুকটা?’ জানতে চাইল পবন।

আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল ফারিয়া। ‘পোলার ভালুকের জন্যে এটাকে আদর্শ বাড়ি বলতে পারেন। চারপাশ গুহার মত, আর বেরোবার একমাত্র পথ পানির নীচ দিয়ে।’

‘কিন্তু দলের অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে বাস করছিল কেন?’

‘তরুণ সব ভালুকই— ধরুন না গ্রিজলি, কোডিয়াক, পোলার- এরা বড়দেরকে মানতে চায় না। …আমার ধারণা জানতে চান? এই তরুণ ভালুক বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল বলে ওকে ভাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর পর থেকেই ভিন দেশে বাস করছিল ওটা।’

‘কিন্তু এদিকে এল কী করে বলুন তো…’

ধুপ! ধুপ!

দরজার ওপাশের দানবীয় ভালুক থাবা মারছে কাঁচের দরজার উপর।

থরথর করে কেঁপে উঠছে দরজা।

কিন্তু এখনও আস্ত আছে।

আওয়াজ পেয়ে ঘুরে চাইল রানা। তারপর ফিরল পরনদের দিকে। বলল, ‘তোমাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না তো?’

না-সূচক মাথা নাড়ল পবন ও ফারিয়া।

‘চ্যাণ্ডোপল?’ জানতে চাইল রানা।

চুপ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে তরুণ সহকারী। বুকের কাছে ঝুলছে মাথা। রানার গলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে চাইল। ওকে ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে একটু আগের আতঙ্কজনক ঘটনাগুলো। আস্তে করে মাথা দোলাল।

কাঁচের দরজার ওপাশে ভালুক, ওটার দিকে চাইল রানা। পরক্ষণে ঘুরে চাইল। ‘ঠিক আছে, মিস্টার তারাসভ, এবার জানান পোলার আইল্যাণ্ড এবং চারপাশের এসব ছোট দ্বীপ আসলে কী!’

রানার দিকে চাইলেন রাশান বিজ্ঞানী।

তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল সবাই। কিন্তু কিছুই বলছেন না তারাসভ।

‘আপনাকে মিস্টার তারাসভ বলব, না ডক্টর, না কর্নেল?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমি ডক্টর,’ সামান্য দ্বিধা নিয়ে বললেন তারাসভ।

‘ঠিক আছে, ডক্টর তারাসভ, আমরা পোলার আইল্যাণ্ডের বিষয়ে সামান্য তথ্য পেয়েছি। কিন্তু এখন চাইছি এমন কাউকে, যে চারপাশ ভাল করেই চেনে। এসব দ্বীপ সম্পর্কে আরও জানতে চাই। লেআউট থেকে শুরু করে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন- সবই বলবেন। আগামী আশি মিনিটের ভেতর ওই অস্ত্র ঠেকাতে না পারলে নরক হয়ে উঠবে পৃথিবী।’

মাথা দোলালেন রাশান বিজ্ঞানী। ‘মেরু দ্বীপ বা পোলার আইল্যাণ্ড আসলে প্রকাণ্ড একটা পাথরখণ্ড, মস্ত দুর্গ। একদল লোক ওয়াচ টাওয়ার পাহারা দিলে, কারও সাধ্য নেই গায়ের জোরে ওই দ্বীপ দখল করে।’

‘যদি অতই দুর্গম হবে, তো অনায়াসে ওটা দখল করল কী করে একদল লোক?’ জানতে চাইল নিশাত।

ক্লান্ত স্বরে বললেন বিজ্ঞানী, ‘আমার ধারণা ওই দ্বীপের স্কেলিটন ক্রুদের কেউ ঘুষ খেয়েছে। আমি যখন ওখানে গেলাম, তার আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। বিশেষ করে বলতে পারি এক লোকের কথা। তার নাম ডক্টর সেমেন ইগোরভ। বর্তমান রাশায় আমাদের মত বিজ্ঞানীদেরকে যথেষ্ট বেতন দেয়া হয় না। আর আমি জানি, ধারের কূপে ডুবে আছে ইগোরভ। ওকে অনায়াসেই কিনে নেয়া যেতে পারে। বিপুল টাকা পেলে হয়তো আমিও দল বদলাতাম। যখন পোলার আইল্যাণ্ডের এয়ারস্ট্রিপে নামলাম, হ্যাঙার থেকে হাত নাড়ছিল ইগোরভ। চিৎকার করে ডাকছিল… যাতে আমরা হ্যাঙারের দিকে গিয়ে গুলি খেয়ে মরি!’

‘এবার বলুন ওই অস্ত্র সম্বন্ধে,’ বলল রানা। ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে, লাল ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার চুরি বা ছিনিয়ে নিতে পারলে ওটাকে ঠেকাতে পারব। অথবা গ্যাসের মেঘের দিকে রওনা হওয়ার আগেই নষ্ট করতে হবে মিসাইল। এতে কোনও ভুল নেই তো?’

‘না, নেই,’ বললেন তারাসভ। ‘থিয়োরি অনুযায়ী, প্রথমেই বাধা দিলে তৈরি হতো না গ্যাসের মেঘ। অবশ্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরেকটা কাজ করা যেত, ভেণ্ট ধ্বংস করলে গ্যাসের মেঘের মাঝে তৈরি হতো একটা ফাঁক বা শূন্যতা। কিন্তু সেটা করার জন্যেও দেরি হয়ে গেছে। একবার পরিবেশে আগুন জ্বলে উঠলে কিছুতেই নেভানো যাবে না। মাঝে কোনও শূন্যতা থাকলে মুহূর্তে সেটুকু পেরিয়ে যাবে। অন্তত নব্বুই মিনিট গ্যাস বন্ধ রাখলে, তখন মাঝে তৈরি হবে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা।’

‘তার মানে ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার সরিয়ে ফেলতে হবে, অথবা মিসাইল নষ্ট করতে হবে— এই তো? এই দুটোই এখন উপায়?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় রাখা হয় ওসব স্ফেয়ার?’

‘মেইন টাওয়ারের উপর ছোটবড় দুটো পিরিচের মত স্থাপনা আছে না? ছোটটায় সিল করা ল্যাবোরেটরিতে রাখা হয় ওগুলো। ওই লাল বলগুলোর কারণেই দেরি করতে হচ্ছে ওদেরকে। যথেষ্ট উত্তপ্ত করতে হবে আগে। ওগুলো রাখতে হয় জিরো কেলভিনে, কিন্তু কাজে লাগানোর আগে তাপ হতে হবে ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুব নিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়াতে হবে তাপমাত্রা, নইলে ভেঙে পড়বে মলিকিউলার স্ট্রাকচার। সেক্ষেত্রে আর গ্যাসের ভেতর আগুন জ্বালতে পারবে না।’

‘কয়টা স্ফেয়ার আছে?’ জানতে চাইল শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।

‘ল্যাবে সবমিলে ছয়টি…’ সামান্য ইতস্তত করলেন তারাসভ। ওই দ্বিধা লক্ষ্য করে জানতে চাইল রানা, ‘পোলার আইল্যাণ্ডে আরও স্ফেয়ার আছে?’

তিক্ত হয়ে গেল বিজ্ঞানীর চেহারা। ‘বিশাল পিলারের মত ওই মেইন টাওয়ারের নীচে আছে আরেকটা গোপন ল্যাবোরেটরি। ওখানে নামতে চাইলে লাগবে সিকিউরিটি কোড ব্যবহার করা এলিভেটার। ওই ল্যাবে আছে রি-হিটিং ইউনিট ও আরেকটা ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার। নিউক্লিয়ার যুদ্ধ হলে শেষ ভরসা হিসেবে ওটা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ….

‘কিন্তু কী, ডক্টর?’

‘কিন্তু ওটার কথা জানে না সেমেন ইগোরভ। সে যে লেভেলের কর্মকর্তা, তাতে তাকে ওই ল্যাবে ঢুকবার ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়নি। সে যদি ওটার বিষয়ে না জেনে থাকে, ওই ডাকাত আর্মিও জানে না।’

‘আচ্ছা,’ বলল রানা, ‘তার মানে, আমরা যদি টাওয়ারের ওপরের ল্যাব থেকে প্রাইম হওয়ার আগেই স্ফেয়ার সরাতে পারি, কাজ করবে না ইউরেনিয়ামের বল।’

‘যদি সঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারেন,’ বললেন তারাসভ।

শ্যারন জানতে চাইল, ‘আমরা কি গ্রেনেড মেরে স্ফেয়ার ধ্বংস করতে পারব?’

‘না। গ্রেনেড বিস্ফোরণের তুলনায় অনেক কঠিন। কিছুই হবে না ওই জিনিসের। সামান্যতম ফাটলও ধরবে না লাল ইউরেনিয়ামের বলে। লাগবে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ বা নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ক্যালিব্রেট করা ইমপ্লোসিভ ব্লাস্ট, নইলে ভাঙবে না ওই জিনিস।’

‘একেকটা ওজনে কেমন?’ জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকালেন তারাসভ। ‘আকারের তুলনায় অনেক ভারী। বুঝতেই পারছেন, সেমি-নিউক্লিয়ার পদার্থ। একেকটার ওজন কমপক্ষে তিন কেজি। …হঠাৎ এ বিষয়ে জানতে চাইছেন যে?’

‘কারণ গলফ বলের আকৃতির তিন কিলোগ্রামের স্ফেয়ার পাথরের মত তলিয়ে যাবে সাগরে,’ বলল রানা। ‘আর আমরা যদি দখল করি ওগুলো, ক্লিফের উপর থেকে সাগরে ফেলে দিতে পারব।’

‘সেক্ষেত্রে আর কখনোই খুঁজে পাবে না কেউ,’ বলল শ্যারন। ‘কথাটা ঠিক,’ বললেন তারাসভ।

‘এক সেকেণ্ড,’ বলল নিশাত, ‘ওগুলো না রেডিয়োঅ্যাকটিভ মেটারিয়াল? খপ্ করে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলাম, তা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না?’

‘লাল ইউরেনিয়ামের এটাই এক সুবিধা,’ বললেন তারাসভ। ‘ভয়ঙ্কর শক্তিশালী বিস্ফোরক, কিন্তু প্যাসিভ রেডিয়োঅ্যাকটিভ প্রতিক্রিয়া খুবই কম। সরিয়ে নেয়া যায় সুটকেসে ভরে। আর কোনও গ্রেনেডে বিস্ফোরক হিসেবে ওই জিনিস ব্যবহার করলে…

‘একমিনিট,’ চমকে গেছে নিশাত। ‘ডক্টর, ওই জিনিস অন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়?’

‘তা করা হয়। আমাদের অস্ত্র বিজ্ঞানীরা নানাভাবেই ব্যবহার করেছেন লাল ইউরেনিয়াম। ওটার বিস্ফোরণ হয় প্রায় থারমো-বেরিক। ছোট ডিভাইসে ব্যবহার করা যায়। আমরা রেড ইউরেনিয়াম কোর ব্যবহার করে হ্যাণ্ড গ্রেনেড তৈরি করেছি। বল- বেয়ারিঙের সমান সব গ্রেনেড অনায়াসেই উড়িয়ে দেবে টি-৭২ ট্যাঙ্ক।’

‘নিউক্লিয়ার হ্যাণ্ড গ্রেনেড তৈরির মাধ্যমে শুয়োরের বাচ্চার মতই কীর্তি করেছে বিজ্ঞানীরা,’ মন্তব্য করল নিশাত।

আস্তে করে মাথা নিচু করে নিলেন তারাসভ। ‘ওই দ্বীপে আছে অন্য এক সময়ে তৈরি সব ডিভাইস। আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল, বিজ্ঞান পারে এমন যে-কোনও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক তৈরি করতে হবে। আমরা তা-ই করেছি। আসলে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি আমরা…’

‘সন্দেহ কী,’ বিরক্ত স্বরে বলল নিশাত।

‘আপনি আমাদের কথা ভাবছেন না,’ আপত্তির সুরে বললেন তারাসভ। ‘আমাদেরও পরিবার আছে। আমার কথাই ধরুন, আমার দুই ছেলে। ছয় নাতি। মস্কো শহরে থাকে ওরা। যদি ওই ভয়ঙ্কর অস্ত্র জ্বেলে দেয় পরিবেশে আগুন, ওরাও তো সবাই মারা যাবে। আপনারা যেমন সব হারাবেন, আমিও তেমনি সব হারাব। আমি হয়তো ওই ভয়াবহ অস্ত্র তৈরি করতে সাহায্য করেছি, কিন্তু নিশ্চিত থাকুন, কখনও চাই না ওটা ব্যবহার করা হোক।’

‘মাথা ঠাণ্ডা রাখুন সবাই,’ আগের প্রসঙ্গে ফিরতে চাইল রানা, ‘যেসব মিসাইল জ্বেলে দেবে গ্যাসের মেঘ, ওগুলো কোথায় রাখা হয়?’

আস্তে করে মাথা দোলালেন ডক্টর তারাসভ। ‘আমাদের শত্রুরা মেইন টাওয়ার থেকে দক্ষিণের লঞ্চ প্যাডে রাখবে এক ব্যাটারি ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল। হয়তো স্যাবোটাজ করা যাবে। কিন্তু ওরা কঠোরভাবে পাহারা দেবে জায়গাটা। উঁচু এক সরু সেতু পেরিয়ে ওখানে পৌছতে হয়। কিন্তু মিসাইল সাইট পাহারা দিলে ওই সেতু পর্যন্ত যাওয়াই কঠিন

চুপ করে কী যেন ভাবছে রানা।

চারপাশে নেমে এসেছে নীরবতা।

কিছুক্ষণ পর বলল রানা, ‘আমরা আরেকটা কাজ করতে পারি। বিষয়টা আগেও মনে হয়েছে, কিন্তু সেটা করাও কঠিন।’

‘খুলে বলুন, স্যর,’ বলল নিশাত।

‘আমরা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি, কারণ অনেক আগেই মিসাইল বা বোমারু বিমানের আগমন জেনে যাচ্ছে রাফিয়ান আর্মি। এমনকী ফিরিয়ে দিয়েছে রাশান আইসিবিএম। ওটা গিয়ে আঘাত হেনেছে রাশানদেরই লঞ্চ সাইটে।’

‘নিচু স্বরে বলল নিশাত, ‘এদের টেকনোলজি শক্তিশালী, এটা আমরা জানি।’

‘ওরা আগেই সব টের পাচ্ছে, শত শত মাইল দূর থেকেও দেখে ফেলছে মিসাইল বা বিমান,’ বলল রানা। ‘তার মানে, ওদের কাছে আর্লি-ওয়ার্নিং স্যাটালাইট আছে। ওই দ্বীপে আছে আপলিঙ্ক কানেকশন। স্যাটালাইটের সঙ্গে সংযোগ রাখছে ওটা।’

‘এবার বুঝতে পেরেছি…’ আস্তে করে মাথা দোলাল শ্যারন। ‘কিন্তু তুমি যা বলতে চাইছ, তাতে জটিলতার মুখে পড়তে হবে।’

‘একমিনিট, আমি বুঝতে পারিনি,’ বলল নিশাত।

‘যদি রাফিয়ান আর্মির স্যাটালাইট আপলিঙ্ক উড়িয়ে দিই— মানে, কোনওভাবে ধ্বংস, বা বিকল করা যায়— সেক্ষেত্রে চোখ হারাবে ওরা। তখন দ্বীপের উপর ফেলা যাবে নিউক্লিয়ার মিসাইল।’

রানা থামতেই বলল শ্যারন, ‘একবার আপলিঙ্ক নষ্ট করলে আলাস্কা বা সেন্ট্রাল রাশা থেকে পাঠানো যাবে নিউক্লিয়ার মিসাইল। ওই দ্বীপে পৌছতে ওগুলোর লাগবে বড়জোর বিশ মিনিট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে….

‘সমস্যা আমরাই,’ খেই ধরল রানা, ‘নিউক্লিয়ার মিসাইল আঘাত হানলে সরতে পারব না। যদি নষ্ট করি আপলিঙ্ক, পৃথিবী হয়তো রক্ষা পাবে… কিন্তু নিজেরা বাঁচব না।’

‘ও, বলল নিশাত। ‘বুঝতে পেরেছি।’

সংক্ষিপ্ত নীরবতা নামল ডকে।

‘বাধ্য হলে ওই অপশন নিয়ে ভাবব,’ গম্ভীর মুখে বলল রানা। ‘ওটা প্রথম অপশন নয়। আর সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে, ওই পথই বেছে নিতে হবে।’

সবাই আবারও চুপ হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর রানা বলল, ‘ঠিক আছে, এবার শুনুন আমরা কী করব। একবার দ্বীপে উঠলে দুটো উপদলে ভাগ হয়ে যাব। একদল যাবে ইউরেনিয়াম স্ফেয়ার দখল করতে। এবং ওই একই সময়ে ছোট আরেকটা দল বিকল করবে মিসাইল ব্যাটারি। প্রথম দলের নেতৃত্বে থাকব আমি। যদি সকাল এগারোটার আগেই ইউরেনিয়াম বলের উত্তপ্ত হওয়া থামাতে পারি, স্ফেয়ারগুলো নিয়ে উপকূলে গিয়ে ফেলে দেব সাগরে। আর যদি ব্যর্থ হই, দ্বিতীয় দল মিসাইল নষ্ট করলেও চলবে। তাতেও গ্যাসের মেঘে স্ফেয়ার ফাটাতে পারবে না তারা।’

‘চেষ্টা তো করবই, ব্যর্থ হওয়া বা সফল হওয়া পরের কথা,’ বলল নিশাত।

‘শুধু এগারোটার আগে ওখানে পৌছনোই কঠিন হবে,’ মন্তব্য করল শ্যারন।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘আমরা যখন এসব কাজে ব্যস্ত, ডক্টর তারাসভের কাজ হবে দ্বীপে নতুন বসানো স্যাটালাইট আপলিঙ্ক ডিশ খুঁজে বের করা। আমাদের দুই দল যদি ব্যর্থ হয়, শেষ উপায় হিসেবে উড়িয়ে দিতে হবে আপলিঙ্ক। সেক্ষেত্রে নিজেরাই রাশা বা আমেরিকার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেব নিউক্লিয়ার মিসাইলের আঘাত হানা যায়। …কারও কোনও প্রশ্ন?’

টু শব্দ করল না কেউ।

রানার শেষ কথাটা নিয়ে ভাবছে সবাই।

‘আমার একটা প্রশ্ন আছে,’ একটু পর বলল নিশাত। ডক্টর তারাসভের দিকে চাইল। ‘কোন্ শালা তৈরি করেছে এমন অস্ত্র? কেনই বা সুযোগ রাখল পৃথিবী ধ্বংস করার?’

আড়ষ্ট মুখে হাসতে চাইলেন বিজ্ঞানী। ‘উত্তরটা আপনাদেরকে চমকে দেবে। অ্যাটমোসফেরিক ডিভাইসের নকশা চুরি করেছিলাম আমরা আমেরিকানদের কাছ থেকে। আসলে ওই গোটা কমপ্লেক্সের নকশা তাদের। সব রাখা ছিল নেলিস এয়ার ফোর্স বেসে। সুযোগ থাকলে আমেরিকানরাই তৈরি করত, কিন্তু নানা সমস্যার কারণে পারেনি। পোলার আইল্যাণ্ড আমাদের, কাজেই আমরা এখানে তৈরি করেছি অস্ত্রটা।’

রিইনফোর্ড কাঁচের দরজার দিকে ইশারা করল রানা।

ওপাশে ঘোরাফেরা করছে মেরু ভালুক।

‘এরা এখানে কেন? কী কারণে এদেরকে রাখা হয়েছিল?’

‘একটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল ওদের নিয়ে,’ বললেন ডক্টর তারাসভ। ‘সফল হয়নি সেটা।’

‘ভালুকগুলোর কী করেছিলেন আপনারা, ডক্টর?’ জানতে চাইল কর্পোরাল বব।

‘ওটা আমার প্রজেক্ট ছিল না,’ বললেন তারাসভ। ‘আপত্তি ও তুলেছিলাম। ইউএসএ-র কুখ্যাত ডলফিন টেস্ট যেমন ছিল, তেমনই ছিল ওই প্রজেক্ট। রাশান সরকার চেয়েছিল ভালুক দিয়ে মিলিটারির কাজ চালিয়ে নেবে। মাইন পেতে দেয়া, সাবমেরিনে বিস্ফোরক আটকে দেয়া… ইত্যাদি কাজ করবে ভালুক। একদল ভালুককে মুড অল্টারিং ড্রাগ দেয়া হয়েছিল, যাতে ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। চাওয়া হয়েছিল, যেন তারা যুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিকের মত লড়াই করে।’

চমকে গেছে ফারিয়া আহমেদ। ‘আপনারা পোলার বেয়ারকে আরও আক্রমণাত্মক করতে চেয়েছিলেন? … বাধ্য থাকবে ওরা? …আপনারা কি পাগল?’

কাঁধ ঝাঁকালেন তারাসভ। ‘কয়েক বছর আগে এমনই একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিল আমেরিকান আর্মি প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে। ওটাতে ব্যবহার করা হয়েছিল গরিলা।’

চট্ করে রানার দিকে চাইল নিশাত।

রানা শুধু বলল, ‘সন্দেহ কী, সফল হয়নি এক্সপেরিমেন্ট।’

‘না। ভালুকের আদিম মগজে প্রতিক্রিয়া করেছিল ড্রাগ। স্রেফ উন্মাদ হয়ে গেল ওরা। খেপে গিয়ে সর্বক্ষণ হামলা করল। মেরে ফেলতে লাগল প্রশিক্ষকদেরকে। অন্য কোনও ভালুক দেখলেই খুন করল। একই সময়ে হয়ে গেল খুবই বুদ্ধিমান, যখন তখন বেরিয়ে পড়ত খাঁচা ভেঙে।’

‘অন্য ভালুক দেখলেই আক্রমণ করত,’’ মন্তব্যের সুরে বলল রানা। ওর মনে পড়েছে ভোরে দেখা বরফের মাঠে মৃত ভালুক। ওটাকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ‘খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে? ডক্টর, আপনি কি বলতে চান ল্যাবোরেটরির ওরা সম্পূর্ণ মুক্ত?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলালেন ডক্টর তারাসভ। ‘ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আরও পথ আছে। ছাতের ফাটল ধরা গম্বুজ, ফায়ার একটি… এসব পথে…’ আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। ‘তারপর উনিশ শ’ একানব্বুই সালে পোলার আইল্যাণ্ড ডিকমিশন করা হলো, তখন থেকে এখানে আছে স্কেলিটন ক্রু। আমরা এসব ভালুককে ছেড়ে দিয়েছি ভাগ্যের হাতে। খুশিমত আসা-যাওয়া করে। তবে জায়গাটা পছন্দ করে বলে এরা এখানে রয়ে গেছে।’

ওদের ছেড়ে রেখেছেন আপনারা,’ অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল ফারিয়া আহমেদ। ‘আশ্চর্য!’

রিইনফোর্সড কাঁচের দরজার দিকে আবারও চাইল রানা। ওপাশে পায়চারি করছে মস্ত এক ভালুক।

‘উন্মাদ ভালুক এড়িয়ে…

‘মেজর রানা…’ ডাক দিল পবন। চেয়ে আছে ডকের পানির দিকে। ওর পাশেই বন্ধু। ‘ওটা কী?’

ঘুরে চাইল রানা। চোখে পড়ল আলোটা।

পানির গভীর থেকে আসছে ভুতুড়ে সবুজ আভা।

নড়ছে।

এগিয়ে আসছে!

ডকে দাঁড়িয়ে পানিতে চোখ রাখল রানা। পরক্ষণে বন্ধুকে তুলে নিয়ে উল্টো করে নামিয়ে দিল নীচে। ওটার লেন্স পানির ভিতরও কাজ করে। ডিসপ্লে স্ক্রিন রয়ে গেছে উপরে।

স্ক্রিনে চোখ রাখল রানা।

ঘোলাটে পানির ভিতর দিয়ে উঠে আসছে ছয়টা সি স্লেভ! ওগুলোর প্রতিটির উপর স্কুবা গিয়ার পরা দু’জন করে ডাইভার!

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে উঠে আসছে ডকের দিকে!

স্পেন্ডের সামনের উজ্জ্বল সবুজ বাতি পরিষ্কার দেখা গেল।

‘আমাদের পেছনে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা’ বলল রানা।

বন্ধুকে পানি থেকে তুলেই ঘুরে দাঁড়াল ও, চট্ করে দেখে নিল চারপাশ। বদ্ধ কংক্রিটের ডক থেকে পালাবার পথ মাত্র দুটো। হয় নিমজ্জিত টানেল দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে সাগরে, অথবা বেরিয়ে যেতে হবে ওই রিইনফোর্সড কাঁচের দরজা দিয়ে ল্যাবোরেটরিতে। যেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটা খ্যাপা ভালুক।

‘তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলার ভেতর পড়ছি,’ মন্তব্য করল নিশাত।

ঝট্ করে মেরিনদের কাছ থেকে পাওয়া ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল বের করল রানা, পরক্ষণে তাক করল রিইনফোর্সড কাঁচের উপর। ‘আপা, বব, পাওলো… অস্ত্র তৈরি রাখুন!’

পর পর কয়েকটা গুলির আঘাতে ফাটল ধরা কাঁচের দরজা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল।

আর তখনই নরক হয়ে উঠল চারপাশ।

এগারো

আর একঘণ্টা পর পৃথিবী জুড়ে শুরু হবে ভয়ঙ্কর প্রলয়।

দলের সবাইকে নিয়ে উদ্যত পিস্তল হাতে ঝড়ের গতিতে পোলার বেয়ারের রাজ্যে ঢুকে পড়েছে রানা।

প্রকাণ্ড ল্যাবোরেটরি। দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে সত্তর মিটার। মাঝে বিশফুট গভীর কূপ। উপর দিয়ে গেছে সরু সেতু। কূপের দেয়ালে কমপক্ষে দশটা খাঁচা, সবই খোলা। ওখানে থাকার কথা ভালুকগুলোর। মস্ত ল্যাবের উপরে কাঁচের গম্বুজ। কোথাও পিলার নেই, গম্বুজটাকে ধরে রেখেছে ত্রিকোণ প্যানেল ও গার্ডার।

কূপের মাঝে বৃত্তাকার উঁচু প্ল্যাটফর্ম, ওটা থেকে দু’দিকে গেছে দুই সরু রিট্র্যাক্টেবল সেতু। প্ল্যাটফর্মের উপর কোমর সমান কন্সোল। পাশের মেঝেতে হ্যাচ। রানা খেয়াল করল, প্ল্যাটফর্মের গোল পুরু দেয়াল রিইনফোর্সড কাঁচের। ভিতর দিয়ে কূপের মেঝেতে গেছে মই। ওটা ব্যবহার করে নিরাপদে নামত সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।

বাঘ-সিংহের খাঁচায় যেমন কাঁচা মল, মূত্র ও পচে যাওয়া মাংসের দুর্গন্ধ থাকে, ভালুকের এই কূপেও সেই গন্ধ।

ল্যাবের গম্বুজ থেকে খসে পড়েছে কিছু প্যানেল। ওই পথে ঢুকেছে তুষার, উঁচু স্তূপ তৈরি করেছে কূপের চারপাশে। ছাতের গর্ত দিয়ে দেখা গেল ধূসর আকাশ।

এককালের ঝাঁ-চকচকে স্টেট-অভ-দ্য-আর্ট ল্যাবোরেটরি আজ পরিত্যক্ত, চারপাশে অবহেলার চিহ্ন। কনকনে ঠাণ্ডা, পাতলা বরফ সবকিছুর উপর। জং ধরেছে যন্ত্রগুলোয়।

ল্যাবের দক্ষিণে একমাত্র একটি ডোর। কিন্তু কূপের পুব ও পশ্চিমে তুষারের ঢিবির কারণে সবাইকে নিয়ে দক্ষিণে যেতে পারবে না রানা। ওই দরজার কাছে পৌঁছুতে হলে একমাত্র উপায় কূপের উপরের সরু রিট্র্যাক্টেবল সেতু।

রানার গুলিবর্ষণে ঝরঝর করে ভেঙে পড়েছে দরজা, আর তখনই চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়েছে চারটে পাহাড়সমান, নোংরা মেরু ভালুক। তারা আছে কূপের পশ্চিমে, তুষার ঢিবির কাছে। আগ্রহ নিয়ে দেখছে এইমাত্র ছুটে এসে ল্যাবে ঢোকা একদল মানুষকে।

বিকট এক গর্জন ছেড়ে পিছনের দু’পায়ে ভর করে উঠে দাঁড়াল আলফা মেল, পরক্ষণে তেড়ে এল মেইল ট্রেনের মত। তাকে অনুকরণ করল এক তরুণ পোলার বেয়ার, মুখ খিঁচিয়ে বের করে ফেলেছে হলদে, বড় বড় দাঁত

‘সবাই সেতুর ওপর! যেতে হবে ওদিকের দরজার কাছে!’ থমকে দাঁড়িয়ে সবাইকে তাড়া দিল রানা, নিজে চোখ রেখেছে অগ্রসরমাণ দুই ভালুকের উপর। ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল তুলে দুই জন্তুর মাথার উপর দিয়ে দু’বার গুলি করল।

প্রকাণ্ড ঘরে বুম! বুম! আওয়াজ তুলল বড় পিস্তল।

তেড়ে আসবার গতি কমল দুই ভালুকের, কিন্তু এখনও আসছে।

দলের সবাই সেতুতে উঠতেই নিজেও ওদিকে পা বাড়াল রানা। চট করে পিছন দিক দেখে নিল। তখনই চোখে পড়ল ডকের জিনিসটা। খুদে সিলিণ্ডার যেন। ছিটকে উঠেছে পানি থেকে। কয়েক মুহূর্ত ভেসে রইল বাতাসে।

পরিষ্কার দেখল রানা, ওর মনে হলো, ওটা সাধারণ এম৬৭ ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড, কিন্তু গায়ে অদ্ভূত রুপালি ব্যাণ্ড।

ওই গ্রেনেড যা-ই হোক, ওটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে শত্রুপক্ষ।

‘গ্রেনেড!’ চেঁচিয়ে জানিয়ে দিল রানা। ‘সবাই কাভার নিন!‘ শুনেছে প্রত্যেকে, ঝাঁপিয়ে পড়ল আড়াল নিতে। কেউ লুকিয়ে পড়ল ক্রেটের ওপাশে, কেউ ব্যারেলের ওদিকে। বরের পাশে ডোরওয়ের পিছনে বসে পড়ল রানা।

কোনও ধরনের কাভার নেয়নি শুধু তরুণ ভালুক।

ভাঙা দরজা পেরিয়ে মেঝেতে পড়েই বিকট আওয়াজে ফাটল গ্রেনেড। ওটার পেট থেকে চারপাশে ছিটকে গেল অতি উত্তপ্ত রুপালি তরন।

সরাসরি লাগল তরুণ ভালুকের পেট, বুক আর মুখে। ভয়ঙ্করভাবে কাতরে উঠল ভালুকটা, দু’হাতে চেপে ধরেছে দুই চোখ। থামছে না করুণ আর্তনাদ। খসে পড়ছে দেহের রোম, রুপালি তরল পুড়িয়ে দিচ্ছে বুক-পেট।

ভালুকের ভয়াবহ করুণ আর্তনাদের উপর দিয়ে ভস্-ভস্ আওয়াজ শুনল রানা।

ওর নিজের মাথার পাশে গলছে ডোরফ্রেম। স্টিল থেকে পিছলে নীচে রওনা হয়েছে এক ফোঁটা রুপালি অ্যাসিড। নামবার সময় খেয়ে ফেলছে স্টিল।

‘অ্যাসিড গ্রেনেড’ ববকে বলল রানা, ‘ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেডের মতই, কিন্তু তখন তখনই খুন করবে না শত্রুকে। আহত করবে। যাতে দলের লোকগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠি আমরা।’

তখনই বিকট স্বরে কাঁদতে লাগল তরুণ ভালুক। ওই অসহায় আহাজারি এমনই করুণ, গলা শুকিয়ে গেল রানার। আগে কখনও এমন হাহাকার শোনেনি কারও।

ঝলসানো চামড়া ছিলে নিয়ে মাংস পোড়াচ্ছে অ্যাসিড মাংসের উপর থেকে খসে পড়ছে চামড়া। চোখের সামনে রানা দেখল, অ্যাসিড ফুটো করে দিল ভালুকের পেট। পিছলে বেরিয়ে এল নাড়ি-ভুঁড়ি, অসুস্থকর থপ্ আওয়াজ তুলে পড়ল মেঝেতে।

ভীষণ ভীত-দ্বিধান্বিত ভালুক চেঁচিয়ে চলেছে, দু’হাতে খামচে ধরেছে মুখ— কপাল, গাল ও চিবুক থেকে খসে পড়ছে ঝলসানো চামড়া। বেরিয়ে এল কাঁচা মাংস, নীল-রক্তিম শিরা ও সাদা হাড়।

দৃশ্যটা অসুস্থকর।

দু’হাঁটুর উপর ভর করে বসে পড়ল ভালুকটা

বুম্‌!

মগজে গুলি খেয়ে ধুপ্ করে পড়ল তরুণ ভালুক।

দয়া করেছে রানা।

‘রওনা হও! জলদি!’ গলা ফাটিয়ে বলল রানা, ‘তিন সেকেণ্ডে পৌঁছে যাবে ওরা!

তিন সেকেণ্ড নয়, দশ সেকেণ্ড পর ল্যাবোরেটরির দরজার মুখে পৌঁছুল রাফিয়ান আর্মির চার যোদ্ধা। ভয়ঙ্কর আক্রোশ নিয়ে পুল থেকে যেন উঠে এসেছে সাক্ষাৎ সব শয়তান।

পরনে ধূসর-সাদা ওয়ায়ার-হিটেড ওয়েটসুট, কাঁধে এমপি- ৫এন মেশিন পিস্তলের বাঁট। সামনে চেয়ে আছে নলের উপর দিয়ে। এক্সপার্ট ফায়ারিং পজিশনে অস্ত্র।

রানা জানে না শত্রুদলে ক’জন লোক। হতে পারে দশ, বারো বা চোদ্দজন। যেভাবে অ্যাসিড গ্রেনেড মেরে ডকে উঠে এসেছে, দক্ষতার অভাব নেই। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে ওদের দিকেই।

চারপাশের দেয়াল খুবলে তুলছে একরাশ বুলেট।

পাল্টা জবাব দিল রানা ও বব। ছুটবার ফাঁকে পিছনে গুলি করছে। দলের অন্যরা উঠে পড়েছে সরু সেতুর উপর। তাদের পিছু নিল ওরা দু’জন।

‘আমাদের কাভার দিন, আপা! জানাল ‘রানা।

দলের নেতৃত্বে নিশাত সুলতানা, পৌঁছে গেছে কূপের মাঝের প্ল্যাটফর্মে। ঘুরেই জি৩৬ তুলে শত্রুদল লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করতে চাইল।

‘ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন, ওঁকে সাহায্য করুন!’ জরুরি স্বরে জানাল শ্যারন।

নিশাতের পাশে দাঁড়িয়ে গেল বিশালদেহী ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, মস্ত কর্ড তাক করল ভাঙা রিইনফোর্সড দরজার দিকে।

তখনই ডোরওয়ে পেরিয়ে এল প্রথম শত্ৰু।

কর্কশ আওয়াজে গর্জে উঠল কর্ড।

নিশাত ও বুনোর টানা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল লোকটা। ওয়েটসুট পরনে ছুটছিল একপলক আগে, পরক্ষণে ছিটকে গিয়ে পড়ল পিছনের ডকে- ছেঁড়া কাপড়ের পুতুল যেন!

নিশাত, বুনো ও শ্যারনকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় সেতুর উপর দিয়ে ছুটছে সিভিলিয়ানরা। সামনে ফারিয়া, কয়েক মুহূর্তে পৌঁছে গেল ওদিকের দরজার কাছে। কিন্তু ওখানে উঁচু হয়ে আছে রাশানদের ফেলে যাওয়া ক্রেট ও ব্যারেল। আর তখনই গর্জে উঠল হামলাকারী দলের মেশিনগান।

বিপক্ষের ভারী মেশিনগানের তোড়ের কাছে বুনো ও নিশাতের অস্ত্র কিছুই নয়।

গুলি আসছে ডকের ডোরওয়ের ওদিক থেকে।

পর পর কয়েকটা বুলেট শেষে আসছে জ্বলজ্বলে ট্রেসার গুলি।

বাধ্য হয়ে কাভার নিল নিশাত, বুনো, শ্যারন, রানা ও বব।

প্ল্যাটফর্মের কন্সোলের পিছনে আড়াল নিয়েছে নিশাত ও বুনো। মেঝেতে ভুল জায়গায় পা ফেলে হ্যাচের ভিতর দিয়ে নীচে পড়ে গেল শ্যারন। ওকে আড়াল দিল বৃত্তাকার রিইনফোর্সড কাঁচের দেয়াল। একরাশ গুলি আঁচড় কাটল ওপাশে। ফাটল ধরে গেল কাঁচে।

ধুপ করে বেকায়দাভাবে মেঝের উপর পড়েছে শ্যারন। তারই ফাঁকে দেখল, গর্জন ছেড়ে অন্ধকার এক কোনা থেকে ছুটে আসছে এক উস্কোখুস্কো রোমওয়ালা মস্ত ভালুক! বিকট হাঁ করতেই দেখা গেল হলদে, বড় বড় দাঁত। কাঁচের দেয়ালের খোলা দরজার দিকেই আসছে ওটা!

হাঁচড়ে-পাছড়ে সামনে বাড়ল শ্যারন, লাথি দিয়ে বন্ধ করে দিল কাঁচের দরজা। এক সেকেণ্ড পর ধুপ্ করে কবাটে বাড়ি খেয়ে থামল ভালুক। থরথর করে কেঁপে উঠেছে দরজা। আকস্মিক বাধা পেয়ে বোকা হয়ে গেছে ভালুক, ভারসাম্য রাখতে না পেরে ধপ্ করে বসে পড়ল, গুঙিয়ে উঠল ব্যথা পেয়ে।

প্রথম সেতুর মাঝে পৌঁছে গেছে রানা ও বব, এমন সময় শুরু হলো ট্রেসার বুলেট। একইসঙ্গে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা, কন্সোল ডিঙিয়ে পড়ল নিশাত ও বুনোর পাশে।

দক্ষিণের দরজার কাছ থেকে চিৎকার করল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো, ‘সান! ওপরে তাকাও! মাথার ওপর!’

মুখ তুলল বব…

দেখল গম্বুজের গার্ডারের এক জায়গায় সাদা কী যেন!

পরক্ষণে খসে পড়ল আবছা ওটা।

ধুপ্ করে নামল ওদের সামনে, দ্বিতীয় সেতুর উপর।

মহাক্ষিপ্ত এক ভালুক!

গোলমালের ভিতর গার্ডার বেয়ে গম্বুজের কাছে চলে গিয়েছিল, এখন নেমে এসেই আটকে দিয়েছে রানাদের পথ।

বিকট এক গর্জন ছেড়ে সামনে বাড়ল ভালুকটা। আর তখনই আছাড় খাওয়া তরমুজের মত ফেটে গেল ওটার মাথা।

ঝট্ করে ঘুরে চাইল রানা ও বব।

বুনোর মস্ত থাবার ভিতর .৪৪ ম্যাগনাম পিস্তল।

সেতুর উপর থেকে ঝপ্ করে কূপের মেঝেতে পড়ল মৃত ভালুক। মেঝে ভেসে গেল রক্তে।

‘বাপরে… হাঁ করে ভালুকটাকে দেখল বব।

ঘুরেই দাড়িওয়ালা ক্যাপ্টেনকে দেখল নিশাত। প্রশংসা না করে পারল না, ‘লক্ষ্যভেদ একেই বলে!

‘এ আর এমন কী,’ লজ্জা পেয়ে হাসল দানব ফ্রেঞ্চ।

দেরি না করে চারপাশ দেখে নিল রানা।

নীচে মই বেয়ে উঠে আসছে শ্যারন।

দক্ষিণ দরজার কাছে পৌঁছে গেছে মেরিন ক্যাপ্টেন পাওলো, সিভিলিয়ান চ্যাণ্ড্রোপল, ফারিয়া, পবন, বিজ্ঞানী তারাসভ ও ফ্রেঞ্চ এজেণ্ট সার্জেন্ট লেটিনিয়া— কয়েকটা ব্যারেল ও ক্রেটের আড়াল নিয়েছে সবাই।

এদিকে ডকের ডোরওয়ের কাছে ওয়েটসুট পরা আট হামলাকারীকে দেখল রানা।

জড় হয়েছে তারা, তারপর চারজন চারজন করে ছড়িয়ে গিয়ে সামনে বাড়ল। ঠাণ্ডা মাথায় ফাঁদে ফেলবে ওদেরকে। ডোরওয়ের একটু দূরে তাদের পায়ের কাছে শুয়ে পড়েছে আরও দু’জন। সামনের বাইপডে হেভি মেশিনগান।

এরা চোর-ছ্যাঁচ্চর নয়, ভাবল রানা, প্রত্যেকে রীতিমত প্রশিক্ষিত। কোনও পরিকল্পনা নিয়েই…

এমন সময় কোমরের কাছে একে-৪৭ বাগিয়ে ডক পেরিয়ে ল্যাবোরেটরিতে ঢুকল আরও দু’জন। পিছনে ফেলে দিল আট সশস্ত্র সৈনিককে। ব্রাশ ফায়ার করতে করতে পাগলের মত এল তারা। নানাদিকে ছুটছে বুলেট।

এতটা দূর থেকেও রানা স্পষ্ট দেখল, আফ্রিকান লোকদুটোর চোখ হলদে-লাল— গাঁজা বা এরকম কোনও ড্রাগ নিয়েছে। মনে সামান্যতম দ্বিধা নেই, এই হিম শীতে পরনে ছেঁড়া ওয়েটসুট। ঘাড়ে অসংখ্য উল্কি। করোটির ডানদিকে চুল আছে, আরেকদিক পুরো ন্যাড়া। কপাল, মুখ ও ঠোঁটে ভারী সব দুল। বিকট চিৎকার ছাড়ছে। হঠাৎ করে থামছে; লাফিয়ে সরছে, আসছে এঁকেবেঁকে।

বিস্মিত হয়েছে রানা।

লোকদুটো বিনা দ্বিধায় আত্মহত্যা করতে চাইছে, যেন মৃত্যুর আগে খতম করবে যত বেশি সম্ভব শত্রু।

এদের ঠিক উল্টো অন্য লোকগুলো।

ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব কষছে।

আসলে দু’ধরনের হামলা শুরু হয়েছে।

হতবাক করে দেবে শত্রুদেরকে।

চমকে যাবে ওরা, দ্বিধান্বিত হবে।

এবং সে সুযোগে শেষ করে দেয়া হবে ওদেরকে।

একে-৪৭-এর গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে দুই আফ্রিকান। প্রায় পৌঁছে গেছে প্রথম সেতুর কাছে। জুড়েছে বিকট চিৎকার।

পিস্তল তুলেই ডানদিকের লোকটার বুকে গুলি করল রানা। গুলি লেগেছে, তবুও ছুটতে ছুটতে এল সে। চিৎকারের ফাঁকে গুলি করছে। আরও চারবার গুলি করল রানা। তারপর ছিটকে পিছনের মেঝেতে গিয়ে পড়ল উন্মাদটা। তখনও টিপে ধরে রেখেছে ট্রিগার। নানাদিকে গেল একরাশ গুলি। দ্বিতীয় লোকটাকে পাঁচটা গুলি করে ফেলে দিল নিশাত।

‘শালারা পুরো পাগল!’ বিড়বিড় করে বলল।

‘এক নম্বর সেতু গুটিয়ে নিন!’ গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে চেঁচাল রানা।

কন্সোলে চোখ বোলাল প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ। টিপে দিল সঠিক সুইচ।

বৃত্তাকার কূপের ওদিকের দেয়ালে ঢুকতে লাগল সরু সেতু। কয়েক সেকেণ্ডে তৈরি হলো পঞ্চাশ ফুট ফাঁকা জায়গা। কূপের মাঝের প্ল্যাটফর্মে পজিশন নিয়েছে রানা। চোখ রেখেছে ডকের ডোরওয়ের উপর।

‘বব আর ফ্রেঞ্চ বন্ধুদেরকে নিয়ে রওনা হন, আপা!’ নীচে চাইল রানা। মই বেয়ে প্রায় উঠে এসেছে শ্যারন ফ্যেনুয়্যা। ‘আমি আপনাদের কাভার ফায়ার দেব! দক্ষিণের দরজার কাছে যান! পরে মিস শ্যারন আর আমি রওনা হলে কাভার ফায়ার দেবেন!’

কথাগুলো শেষে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল রানা, মৃত দুই আফ্রিকান উন্মাদের মতই কিচ্ছু পাত্তা না দিয়ে গুলি শুরু করল হামলাকারীদের উপর।

চমকে গেল লোকগুলো, ঝাঁপিয়ে পড়ে আড়াল নিল।

এদিকে দ্বিতীয় সেতু ধরে ছুটছে নিশাত, বব ও পিয়েখে ডিফেখন। দৌড়ের ফাঁকে গুলি করছে। দেখতে না দেখতে পৌঁছে গেল দূরের দরজায়। আড়াল নিল অন্যদের পাশে।

আবারও প্রায় সেন্ট্রাল প্ল্যাটফর্মে উঠে এসেছে শ্যারন। মাথা বের করল হ্যাচ দিয়ে।

‘আপা! কাভার দিন!’ নিচু স্বরে বলল রানা।

‘নিশ্চয়ই, স্যর!’ ইয়ারপিসে শুনল নিশাতের কণ্ঠ।

‘ঠিক আছে, দৌড়াও, শ্যারন!’ কাভার থেকে বেরিয়েই ছুটতে লাগল রানা।

কিন্তু ঠিক তখনই একইসঙ্গে ঘটল তিনটে ঘটনা:

এক, রানার শত্রুদের দুই মেশিনগানার নতুন উদ্যমে কাজে নামল। ট্রেসার গুলি এসে লাগছে দ্বিতীয় সেতুর গায়ে। রানা ও শ্যারনের পায়ের চারপাশে ছিটাতে শুরু করেছে লাল-কমলা-হলুদ ফুলকি।

দুই, হিসহিস আওয়াজ তুলে রানা ও শ্যারনের মাঝ দিয়ে গেল একরাশ গুলি। দু’জন আলাদা হয়ে যেতেই আবারও পিছনের প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হলো শ্যারন।

তিন, ছুটন্ত রানার পায়ের নীচে রওনা হয়ে গেল সরু সেতু। চলে যাচ্ছে ওদিকের মেঝের দিকে। প্রতি পদক্ষেপে রানা টের পেল, একটু একটু করে পিছিয়ে পড়ছে ও। কয়েক ফুট পিছনে সেতুর এদিকের মাথা। একবার ওই অংশ পেরিয়ে গেলে নীচে গিয়ে পড়বে ও।

ওর প্রতিপক্ষের কেউ পেয়েছে ডকের ডোরওয়ের পাশের কন্ট্রোল প্যানেল। সরিয়ে নিচ্ছে সেতু। এবার নির্জন হয়ে উঠবে সেন্ট্রাল প্ল্যাটফর্ম। ওখানে থাকবে অসহায় শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।

তুমুল গুলি করছে নিশাত।

প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে রানা। শেষপর্যায়ে ওকে সাহায্য করল সেতুর গতি। মেঝেতে নেমেই দরজার কাছে একটা ব্যারেলের ওপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা।

‘ফ্রেঞ্চ সুন্দরী যে ওদিকে রয়ে গেল!’ গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে বলল নিশাত।

উঠে বসেই ঘুরে চাইল রানা। দ্বীপের মত প্ল্যাটফর্মে একাকী শ্যারন। আড়াল নিয়েছে কন্সোলের। সম্পূর্ণ অসহায়। ওদিক থেকে আসছে পশলা পশলা বুলেট।

‘ওকে ফেলে চলুন!’ চেঁচিয়ে উঠল পাওলো। ‘ও আপনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!’

‘আমরা কাউকে ফেলে যাব না,’ বলল রানা। ‘ডক্টর তারাসভ, এই দরজার ওদিকে কী?’

‘সিঁড়ি,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘ওটা গেছে স্টেডিয়ামের মত এক জায়গায়।

‘ওদিকে গেলে পোলার আইল্যাণ্ডে ওঠা যায়?’

হ্যাঁ। স্টেডিয়ামের শেষমাথায় পন্টুন ব্রিজ। ওটা দিয়ে পৌঁছতে পারব পোলার আইল্যাণ্ডে।’

‘তা হলে ওদিকেই যাব,’ বলল রানা, ‘বব, ক্যাপ্টেন পাওলো! সামনের দিক কাভার করে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যান! সোজা যাবেন ওই স্টেডিয়ামে! ….আপা! আমার সঙ্গে থাকুন!’

বব ও পাওলোর পিছনে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল সিভিলিয়ান সবাই। অবশ্য রয়ে গেছে পিয়েখে ডিফেখন ও সার্জেন্ট লেটিনিয়া। পালিয়ে যেতে আপত্তি আছে তাদের।

‘মেজর ফ্যেনুয়্যাকে বিপদের মুখে রেখে কোথাও যাচ্ছি না, ‘ বলল প্রকাণ্ড ফ্রেঞ্চ।

মাথা দোলাল সার্জেন্ট।

‘আমিও সে কারণেই থাকছি,’ বলল রানা, ‘ওকে সরিয়ে আনব ওখান থেকে।’

ক্রেটের আড়ালে রানা ও নিশাতের পিছনে বসে আছে দুই ফ্রেঞ্চ।

ওরা দেখছে মাঝের প্ল্যাটফর্ম লক্ষ্য করে ঝাঁক ঝাঁক গুলি পাঠাচ্ছে শত্রুরা।

যেন নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডে আটকা পড়েছে শ্যারন।

‘ক্যাপ্টেন পাওলো কিন্তু একটা ঠিক কথাই বলেছিল,’ নিচু স্বরে রানাকে বলল নিশাত। ‘সত্যিই আপনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ওই মেয়ে।’

নিচু স্বরে নিশাতের কানে বলল রানা, ‘এখন এই দলের প্রত্যেকে কাজে আসবে।’ হোলস্টার থেকে ম্যাগহুক বের করে নিল ও।

‘আবারও ওই কচুর যন্ত্র, কবে যে সত্যি ওটার কারণে…. বিড়বিড় করল নিশাত।

‘আমাকে কাভার দিন, আপা!’

ঝট করে ঘুরেই জি৩৬ দিয়ে গুলি শুরু করল নিশাত।

একই সময়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রানা, ম্যাগহুক তাক করল প্রকাণ্ড গম্বুজের গার্ডারের দিকে। ট্রিগার টিপে দিতে গিয়েও থমকে গেল।

একই কাজ করেছে শ্যারন ফ্যেনুয়্যা, ম্যাগহুকের মত একটা ডিভাইস তাক করেছে উপরের গার্ডারের দিকে।

আবছাভাবে যন্ত্রটা দেখল রানা।

মেয়েটার হাতের জিনিসটা ম্যাগহুকের চেয়ে বড়, পেটমোটা। ওটার গ্র্যাপলিং হুক আরও তীক্ষ্ণ, যেন তীরের ডগা।

বাতাস চিরে উপরে ছিটকে গেল ডগাটা, পিছনে লেজের মত ছুটল কেবল। জোরালো ঠক্ আওয়াজ তুলল তীক্ষ্ণ হুক। ধাতব গার্ডারে গেঁথে গেল পুরো তিন ইঞ্চি!

খুলে এল না হুক।

রানার চোখের সামনে কন্সোলের পিছন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল শ্যারন, শক্ত হাতে ধরেছে লঞ্চারের দুই হাতল। লাফিয়ে পড়ল কূপের গহ্বরে, দুলতে দুলতে এল রানার দিকে।

প্রয়োজন পড়লে ওই একই কাজ করত ও নিজে, জানে রানা। ভালুকের কূপের উপর দিয়ে দুলতে দুলতে ভেসে গেল শ্যারন। পাক্কা ষাট ফুট পেরোল দেখতে না দেখতে। তুমুল গুলি করে ওকে কাভার দিল নিশাত।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ওদিকের দরজার কাছে রানার সামনে নামল শ্যারন।

‘চমৎকার মুভ,’ অন্তর থেকে প্রশংসা করল রানা। .

‘ধন্যবাদ,’ মৃদু হাসল শ্যারন। ওর ম্যাগহুকের বাঁটে অন করে দিল নির্দিষ্ট সুইচ, ফলে তিন সেকেণ্ডে সড়াৎ করে ফিরল কেবল।

রানা ইশারা করতেই দরজা পেরিয়ে স্টেডিয়াম লক্ষ্য করে ছুট দিল শ্যারন।

পাশাপাশি দৌড়ে চলেছে রানা, কিন্তু জানে না ল্যাবের ছাত থেকে চোখ রেখেছে ক্লোড়-সার্কিট টিভি ক্যামেরা। ওটা ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেখিয়ে দিচ্ছে শত্রুপক্ষকে।

ওদের চেহারা চিনে নিয়েছে রাফিয়ান আর্মির জেনারেল। লোডিং ডকের পযিশন থেকে রানাদের প্রতিটি মুভ লক্ষ করছে শত্রুবাহিনীর কমাণ্ডার।

এইমাত্র ওদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল তার দুই শিকার।

কমাণ্ডারের নাম ক্যাম্পেন ফন নেইটরিচ, কিন্তু দলের সবার কাছে সে পচা নেইটরিচ। সে জার্মান নাগরিক, কোনও এক সময়ে জার্মান আর্মির সার্জেণ্ট ছিল। আফ্রিকায় শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তখন একের পর এক তরুণী মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। ফলে তাকে অসম্মানের সঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ কারণে তার দলের সবাই তাকে পচা নেইটরিচ নামেই ডাকে।

স্ক্রিনে চোখ রেখে হাসল কমাণ্ডার।

‘নেইটরিচ টিম, পচা বলছি,’ বলল থ্রোট মাইকে। ‘এইমাত্র ওদেরকে ভাগিয়ে দিয়েছি বেয়ার ল্যাব থেকে। এখন সোজা যাচ্ছে আপনাদের দিকে।’

‘ঠিক আছে, পচা। আমরা তৈরি। স্টেডিয়ামে অপেক্ষা করছি।’

বারো

‘সবাই সুস্থ তো?’ জানতে চাইল রানা। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে পৌছে গেছে ওর ছোট্ট দলের পাশে।

মাথা দোলাল সবাই।

‘এবার কী করব আমরা?’ অসহায় সুরে জানতে চাইল বব।

‘বিশেষ কিছু করার নেই,’ বলল রানা। ‘হয় সামনে এগোতে হবে, নইলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। কাজেই…..

তুমুল গুলির আওয়াজে থেমে গেল রানা। নীচে সিঁড়ির শেষে প্যাসেজওয়েতে লেগেছে অসংখ্য বুলেট।

‘সবাই এগুতে শুরু করো।’

দলের সবাইকে নিয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরোল রানা, ঢুকল চারকোনা এক দালানে। জায়গাটা গেঁথে আছে ভালুক দ্বীপের পাহাড়ি বুকে। দু’পাশে দুয়েকটা অফিস-ঘর, তারপর চওড়া ফাঁকা একটা হলরুম। অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে।

‘এই দ্বীপের এসব অফিসে কাজ করত বিজ্ঞানীরা,’ বললেন ডক্টর তারাসভ।

মনোযোগ দিয়ে চারদিক দেখছে রানা।

দ্বীপের সরু কোমরের মত এক জায়গায় এই দালান। দক্ষিণে দূরের জানালা দিয়ে আসছে ধূসর আলো। ওদিকের একটা দরজা দিয়েই যেতে হবে, এ ছাড়া পথ নেই।

‘আপা, সানকে নিয়ে যতক্ষণ পারেন সিঁড়ি পাহারা দেবেন। আমরা যাব দক্ষিণে।’

‘জী, স্যর,’ বলল নিশাত।

দক্ষিণ লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করেছে রানা। পৌছে গেল সারি সারি জানালার পাশে। ওদিকে চোখ যেতেই আটকে ফেলল শ্বাস। বিড়বিড় করে বলল, ‘সর্বনাশ…..

ওর পাশে থমকে গেছে শ্যারন ফ্যেনুয়্যাও। নিচু স্বরে বলল, ‘জায়গাটা আসলে কী?’

ডিম্বাকৃতি মস্ত গহ্বর সামনে। কমপক্ষে এক শ’ ফুট উঁচু পাথুরে দেয়ালে চারপাশ ঘেরা। এদিকের অর্ধেক জায়গায় একের পর এক ট্রেঞ্চ। স্টেডিয়ামের মাঝে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। ওদিকের পরের অর্ধেক জায়গায় প্রায় জমাট এক লেক। মাটিতে গেঁথে দেয়া এক ওয়াকওয়ে গেছে দূরে। ছাতওয়ালা ওই প্যাসেজওয়ে নেমেছে লেকে, তলা দিয়ে গিয়ে আবারও উঠেছে ওদিকের এক চৌকো দালানে। রানারা এখন যে দালানে, ওটা ঠিক তেমনই দেখতে। ওই দালানের ছাতে দ্বিতীয় ওয়াচ টাওয়ার। ওখান থেকে চোখ রাখা যাবে গোটা স্টেডিয়ামের উপর।

প্রকাণ্ড স্টেডিয়ামের আকাশে উঠেছে চারটে উঁচু গার্ডার। প্রথম ওয়াচ টাওয়ারের ভিত্তি থেকে দেড় শ’ ফুট উপরে মিলিত হয়েছে টি আকৃতির জাংশন। ওসব গার্ডার থেকে ঝুলছে ফ্লাডলাইট, রাতে উজ্জ্বল আলো ফেলত গহ্বরের বুকে। জায়গাটা প্রায় ফুটবল স্টেডিয়ামের মতই, অথবা গ্ল্যাডিয়েটোরিয়াল এরিনা যেন।

‘ওটাই স্টেডিয়াম,’ রানার পাশ থেকে বললেন তারাসভ। ‘আমার কলিগরা ভালুকদের টেস্ট করতেন ওখানেই। ট্রেনিং দিতেন যুদ্ধের কৌশল।’

‘স্যর!’ ভালুক ল্যাবের সিঁড়ির উপর থেকে ডাকল নিশাত। ‘ওদের অস্ত্রের জোর আমাদের অস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি! এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে, স্যর!’

সামনে ঝকঝকে সাদা কাঁচের ছাতওয়ালা খাড়া সিঁড়ি নেমেছে সোজা গিয়ে স্টেডিয়ামের মেঝেতে। ওখান থেকেই শুরু হয়েছে মাটিতে আধাআধি ডেবে যাওয়া ওয়াকওয়ে। ওটা গেছে প্রকাণ্ড গহ্বরের বুক চিরে। কয়েক জায়গায় ভেঙে পড়েছে ওয়াকওয়ের উপরের কাঁচের ছাত। ওখানে আকাশ থেকে ঝরঝর করে তুষার পড়ে জমেছে উঁচু স্তূপ।

চারপাশ দেখে দমে গেল রানা। কেন জানে না, কু ডাকছে মন। কিন্তু আপাতত কিছু করবারও নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এগোতে হবে ওদেরকে।

‘সবাই সিঁড়ি বেয়ে নামুন! উঠে পড়ুন ওয়াকওয়েতে!’

দালানের দরজা পেরিয়ে ছাতওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত গতিতে নামতে লাগল ওরা। সবার শেষে পিছনদিক কাভার করে আসছে নিশাত ও সান। বারবার ঘুরে চাইছে ওদিকের উঁচু সিঁড়িতে, ওয়েটসুট পরনে কাউকে দেখলেই গুলি ছুঁড়ছে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে স্টেডিয়াম লক্ষ্য করে ছুটছে রানা এবং ওর দল। সামনে কাঁচ ভাঙা ছাতের একাংশ। ওখানে পরিষ্কার দেখা গেল ধূসর আকাশ।

হঠাৎ শ্মশ্ আওয়াজে ওদের আশপাশ দিয়ে চলে গেল একরাশ বুলেট, বিধল উপরের সিঁড়ির ধাপে।

ডাইভ দিয়ে একপাশে পড়ল জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল, দু’হাতে ঢেকে ফেলেছে মাথা। ওর পাশে ছুটন্ত ফ্রেঞ্চ সৈনিক সার্জেন্ট লেটিনিয়া হঠাৎ থমকে গেল, দেহে লেগেছে বেশ কয়েকটা গুলি। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল সে। এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু ভয়ঙ্করভাবে আহত। পাশে থেমে তাকে দু’হাতে তুলল শ্যারন, সরিয়ে নিল লাইন অভ ফায়ার থেকে।

হঠাৎ কাতরে উঠল ফারিয়া আহমেদ, ওর বাম পায়ে লেগেছে ‘বুলেট। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেয়েটা। ওর পাশে ডাইভ দিল পবন,

পরক্ষণে সঙ্গিনীকে তুলে নিয়ে হুড়মুড় করে উঠে গেল উপরের নিরাপদ সিঁড়ির ধাপে।

অন্যরাও পিছিয়ে এসেছে।

শিলাবৃষ্টির মত সিঁড়ির উপর নামছে বুলেট। কয়েকটা লাগল কাঁচের ছাতে। রিইনফোর্সড কাঁচ ভাঙল না, পিছলে আরেক দিকে গেল লং-রেঞ্জ গুলি। সামনের সিঁড়িতে উঠছে আগুনের লাল-হলুদ ফুলকি।

‘মরুক, শালা ঈশ্বরের বাচ্চা!’ চিৎকার করল মেরিন ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো, দু’হাতে মুখ ঢাকল।

নিজের দেহ দিয়ে ফারিয়াকে আড়াল করল পবন। ওই একই সময়ে স্টেডিয়ামে চোখ রেখেছে রানা ও শ্যারন। খুঁজছে কোথা থেকে আসছে গুলি। যা ভেবেছিল, দূরের ওই দালানের ছাতের উপরের ওয়াচ টাওয়ারে আছে মার্কস্ম্যান। নীচের ওয়াকওয়েতে ওদেরকে পেয়ে গেছে লাইন-অভ-সাইটে।

অপেক্ষা করছিল, জানত রানার দলের সবাইকে এদিকে আসতেই হবে।

বিড়বিড় করে কপালকে দোষ দিল শ্যারন।

কিছুই না বুঝে সবাইকে নিয়ে ফাঁদে পা দিয়েছি, ভাবল রানা। পাল্টা গুলি করল এমপি-৭ দিয়ে। যদিও জানে, ওর অস্ত্র অত দূরে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। আততায়ীরা আছে গহ্বরের শেষমাথায়। রানার মত করেই গুলি ছুঁড়ল পাওলো, শ্যারন ও বুনো। জবাবে থেমে গেল শত্রুপক্ষের বুলেট।

‘এখানে থামা চলবে না!’ উঁচু গলায় জানাল রানা। ‘যাদের মিলিটারি ট্রেনিং আছে, রোলিং কাভার ফায়ার দিন! গুলি থামালে খুন হব সবাই!’

আহত সার্জেণ্ট লেটিনিয়ার ডান বগল নিজের কাঁধে তুলে নিল রানা, বামহাতে জড়িয়ে ধরল কোমর, তারপর ছুটল নীচের সিঁড়ি লক্ষ্য করে। যাদের মিলিটারি ট্রেনিং আছে, তারা কাভার ফায়ার দিল।

ফারিয়া আহমেদকে উঠতে সাহায্য করল পবন হায়দার। মেয়েটিকে নিয়ে নামতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ডে ঢুকে পড়ল ছাতওয়ালা ওয়াকওয়েতে। ছুটছে স্টেডিয়ামের মাঝের পথে। গুলি করছে শত্রুরা, কিন্তু রিইনফোর্সড্ কাঁচে লেগে ছিটকে যাচ্ছে তাদের বুলেট।

সার্জেন্ট লেটিনিয়াকে প্রায় কাঁধে তুলে নিয়েছে রানা, তারই ফাঁকে বলল, ‘কিছুই বুঝিনি! আসলে আমাদেরকে খুন করতে চায়নি ল্যাবে! স্রেফ তাড়িয়ে এনেছে এখানে! যাতে ডালে বসা পাখির মত খুন হই!’ দোষ দিয়ে চলেছে নিজেকে।

‘স্যর, কারও সাধ্যি নেই আগেই বুঝে ফেলবে ফাঁদ পাতা হয়েছে,’ আপত্তির সুরে বলল নিশাত। ‘খামোকা নিজেকে দোষ দিচ্ছেন।’

‘এবার কোনদিকে?’ রানার অনুকরণে ফারিয়াকে কাঁধে তুলে নিয়েছে পবন। অন্য হাতে বহন করছে রোবট বন্ধুকে।

এরিনায় চোখ বোলাল রানা। ভোরে রওনা হয়ে পৌঁছেছে ক্র্যাশ করা বেরিভ বিমানের কাছে। এল রাফিয়ান আর্মির এয়ারক্রাফট, তারপর এল ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন। এবং এর পর থেকে বারবার ধাওয়া খেয়ে লিডের ভিতর দিয়ে এসে হাজির হয়েছে, বেয়ার আইল্যাণ্ডে চারপাশ দেখবার সামান্যতম সুযোগও হয়নি।

‘আপাতত জানি না কী করা উচিত,’ সত্য কথাই বলল রানা। ‘শুধু জানি, গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোতে হবে। পরে মাথায় কিছু এলে জানার।’

কোনও বিরতি না দিয়েই কাঁচ ভাঙা ছাতের ওয়াকওয়ে ধরে ছুটছে ওরা, গুলি করছে পিছনের শত্রুদের লক্ষ্য করে।

আড়াল দেয়া রিইনফোর্সড কাঁচের ছাত আবারও শুরু হলো। কিন্তু সামান্য দূরে আবারও শুরু হয়েছে কাঁচ ভাঙা অংশ। ওখানে বড় একটা অংশে মিলবে না কোনও কাভার। আকাশ ওখানে খোলা। ডেবে যাওয়া পথে জমেছে তুষারের উঁচু স্তূপ। আটকে দিয়েছে সামনে যাওয়ার পথ।

চট করে পিছনের ওয়াকওয়ে দেখল রানা।

ওদিকে আছে প্রথম হামলাকারী দল।

যে-কোনও সময়ে পিছন থেকে আসবে গুলি।

মন শান্ত রাখতে চাইল রানা।

বড়জোর কয়েক সেকেণ্ড পাবে, এবং এরই ভিতর পরিষ্কার করতে হবে মগজ— নইলে বেরোতে পারবে না এই মৃত্যু-ফাঁদ থেকে।

এখন চাই সঠিক সিদ্ধান্ত।

ঠিক আছে, মনে মনে বলল রানা। এবার ভাবো, তোমাকে কী করতে হবে?

একঘণ্টার ভিতর পৌঁছুতে হবে পোলার আইল্যাণ্ডে, নইলে ঠেকাতে পারবে না অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপনের হামলা।

কিন্তু আমার প্রতিটি পদক্ষেপ আগেই বুঝে ফেলছে শত্রুরা। ওদের আছে কো-অর্ডিনেট করা পরিকল্পনা। আর আমি তাড়া খাওয়ার ফাঁকে তৈরি করতে চাইছি ওদেরকে টেক্কা দেবার প্ল্যান।

ওরা এ এলাকা ভাল করে চেনে। আমি চিনি না। দৌড়ের ওপর দেখছি চারপাশ। জানি না সামনে কী আছে।

এখন সামনে ও পিছনে শত্ৰু।

প্রথম সুযোগেই দু’দিক থেকে গুলি করে শেষ করে দেবে আমাদের।

এই লড়াইয়ে হারতে চলেছি…

যদি তা ঠেকাতে হয়, কী করতে হবে?

…হ্যাঁ, লড়াইয়ের পরিস্থিতি বদলে দিতে হবে।

বেশ, কীভাবে বদলে দেব পরিস্থিতি?

আগে বারোটা বাজাতে হবে শত্রুদের প্ল্যানের। প্রথমেই উচিত এই ওয়াকওয়ে থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এবং শুরু করতে হবে এমন কোনও খেলা, যেটা আমার তৈরি। শত্রুরা যেন আমার খেলা অনুযায়ী খেলতে বাধ্য হয়।

চারপাশে নতুন করে চোখ বোলাল রানা।

গহ্বরের উঁচু পাথুরে দেয়ালে চোখ গেল।

গোটা এলাকার অনেক উপরে টি আকৃতির গার্ডার। স্টেডিয়ামের মাঝে ওয়াচ টাওয়ার…

হ্যাঁ, ওয়াচ টাওয়ার …

ওটাই ওর খেলায় প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত।

ওটার মাধ্যমেই বদলাতে হবে লড়াইয়ের বর্তমান পরিস্থিতি।

যদি কিছুটা সময় আদায় করা যায়…

নীচের এরিনায় মিলিটারি ট্রেঞ্চ।

ওসব ট্রেঞ্চে পোলার বেয়ারগুলোকে ট্রেনিং দিত সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।

হতেও পারে কাজ…

‘শুনুন!’ জরুরি সুরে বলল রানা, ‘আমরা এই ওয়াকওয়েতে রয়ে যেতে পারব না! সামনে ছাতহীন অংশে গিয়েই সবাই তুষারের স্তূপ বেয়ে উঠব! গিয়ে ঢুকব বামের ট্রেঞ্চে! ওগুলো বেশ খানিকটা কাভার দেবে!’

ওর কানের পাশ দিয়ে ভোমরার মত ম্‌ম্‌ম্ আওয়াজ তুলে চলে গেল একটা বুলেট।

ওটা এসেছে পিছন থেকে।

ওয়াকওয়ের শুরুতে হাজির হয়ে গেছে আততায়ীরা।

কাঁধে রাখা আহত সার্জেন্ট লেটিনিয়াকে নিয়ে চরকির মত ঘুরল রানা, অন্য হাতে গর্জে উঠল এমপি-৭। একই কাজ করেছে সান, পাওলো ও নিশাত। চারজনের গুলির মুখে আবারও উপরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল হামলাকারীরা।

দলের অন্যদের আগে ফারিয়াকে কাঁধে নিয়ে ওয়াকওয়ের খোলা অংশে পৌছে গেল পবন হায়দার— সামনে তুষারের উঁচু ঢিবি। ওখানে গুলি পাঠাতে পারবে না স্নাইপাররা। কিন্তু ওই ঢিবি পেরিয়ে আবারও নিচু প্যাসেজওয়েতেও নামতে পারবে না পবন।

হঠাৎ হিস্ হিস্ আওয়াজ তুলে একরাশ গুলি গেল ওদের মাথার উপর দিয়ে, লাগল গিয়ে ওয়াকওয়ের দু’পাশের দেয়ালে। পাশ থেকে এসেছে এসব গুলি। গহ্বরের পুব ও পশ্চিমের খাড়া দেয়ালে উঠেছে কয়েকজন স্নাইপার। নিশ্চিন্তে বসে আছে স্টিলের ভিত্তির পাশে। ওসব ভিত্তি ঝুলিয়ে রেখেছে স্টেডিয়ামের উপর প্রকাণ্ড গার্ডারের জাল।

পবন ও ফারিয়ার পাশে পৌছে গেল প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ বুনো ও শ্যারন। পাল্টা গুলি করল ওরা।

‘যান!’ তাড়া দিল শ্যারন। ‘ঢুকে পড়ুন ট্রেঞ্চে!’

একহাতে রোবট বন্ধুকে সুটকেসের মত ধরেছে পবন, অন্যহাতে ঠেলে তুলল ফারিয়াকে তুষারের স্তূপে। মেয়েটি সমতলে উঠতেই নিজেও উঠে গেল পবন। সামনে পড়ল নরম, কাদাময় জায়গা। হামাগুড়ি দিয়ে পেরিয়ে গেল ওরা। চারপাশে এসে বিঁধছে বুলেট। অবশ্য নিরাপদেই পৌছে গেল ট্রেঞ্চের কাছে।

ট্রেঞ্চ ছয় ফুট গভীর, ধুপ্ করে নীচে পড়ল ওরা। দু’পাশের মাটির দেয়াল ও মেঝে ঢেকে গেছে পাতলা সাদা বরফে। সোজা সামনে গেছে সরু ট্রেঞ্চ, মিশেছে গিয়ে আরও কিছু ট্রেঞ্চে— যেন ছোট কোনও গোলকধাঁধা। ডানদিকে গেছে প্রতিটি বাঁক।

ওদিকের কোনও ট্রেঞ্চে নিচু গর্জন শুনল পবন। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার মনে হয় না এসব ট্রেঞ্চ খালি….

.

পিছনের ওয়াকওয়েতে শত্রুদল লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করছে রানা, কাঁধে প্রায় ঝুলছে মারাত্মক আহত সার্জেণ্ট লেটিনিয়া।

ঝট্ করে দক্ষিণে ঘুরে চাইল রানা। ‘আপা! ওই ওয়াচ টাওয়ার দখল করতে চাই! ট্রেঞ্চের ভেতর দিয়ে ওটার কাছে চলে যান। …সান, ক্যাপ্টেন পাওলো, সরিয়ে নিন ডক্টর তারাসভ আর চ্যাণ্ড্রোপলকে! সোজা যাবেন পবন ও ফারিয়ার কাছে।’

‘জী, স্যর,’ ওয়াকওয়ে থেকে সমতলে উঠে গেল নিশাত, চারপাশে এক পশলা গুলি করে কাভার দিতে চাইল সবাইকে। ওর পিছন পিছন উঠল পাওলো ও চ্যাণ্ড্রোপল। তাদের পর সান, ঘুরেই হাত বাড়িয়ে দিল ডক্টর তারাসভকে তুলে নেয়ার জন্য।

থেমে থেমে গুলি করছে রানা। ওর পাশে চলে গেল শ্যারন। ‘মেজর!’ গুলির শব্দের উপর দিয়ে ডাকল, ‘এভাবে বাঁচব না কেউ! আগে পাল্টে দিতে হবে শত্রুর যুদ্ধের প্ল্যান!’

‘জানি!’

‘তোমার কোনও প্ল্যান আছে?’

‘হ্যাঁ! ট্রেঞ্চে নামব! তারপর যাব ওই ওয়াচ টাওয়ারে!’

‘তারপর?’

‘তারপর ওখান থেকে…’ গুলির আওয়াজে থেমে গেল রানা। একহাতে আহত সার্জেন্টকে স্থির রাখল ও।

‘ঠিক আছে! আপাতত এতেই চলবে!’ সার্জেন্ট লেটিনিয়ার আরেক কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাকে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করল শ্যারন।

গুলি করে ওদেরকে কাভার দিচ্ছে বুনো।

তুষারের ঢিবি বেয়ে উঠতে লাগল রানা ও শ্যারন।

ওরা প্রায় উঠে এসেছে ঢিবির উপর, এমন সময় হঠাৎ করেই রানা টের পেল, পিছনে থেমে গেছে গোলাগুলি।

ভুরু কুঁচকে গেল ওর। ঘুরে চাইল পিছনের ওয়াকওয়ের দিকে।

এখন আর সিঁড়িতে কেউ নেই।

পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হলো ওর।

শত্রুরা নেই মানেই অন্য কোনও প্ল্যান আছে তাদের।

ঠং! ঠং! ঠনাৎ!

ওদিকের সিঁড়ি থেকে ওয়াকওয়েতে এসে থেমেছে ছোট একটা ধাতব সিলিণ্ডার।

জিনিসটা দেখে রানার মনে হলো স্মোক গ্রেনেড। কিন্তু আকারে আরও ছোট। প্রথমে ভেবেছিল ওটা আরেকটা অ্যাসিড গ্রেনেড। কিন্তু ওই সিলিণ্ডার রুপালি নয়। দু’পাশে লাল ও হলুদ ব্যাণ্ড।

সমতলে উঠে ঘুরে চেয়েছেন ডক্টর তারাসভ।

তিনিও দেখেছেন ওই গ্রেনেড।

বিস্ফারিত হলো তাঁর দু’চোখ।

‘মেজর রানা! ওয়াকওয়ে থেকে উঠুন! ওটা লাল ইউরেনিয়াম গ্রেনেড!’

এরই ভিতর ওয়াকওয়ে থেকে সমতলে উঠেছে শ্যারন ও বুনো।

ঘুরে দাঁড়িয়ে রানাকে তুলতে হাত বাড়িয়ে দিল শ্যারন।

সার্জেন্ট লেটিনিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে তুষারের স্তূপে উঠছে রানা, কিন্তু পিছলে গেল প্রায় অচেতন সৈনিকের দুই বুট। খপ করে কিছু ধরতে চাইল সে, ফলে অসম্ভব হয়ে উঠল পতন ঠেকানো। হাত ফস্কে গেল রানারও। কয়েক ডিগবাজি খেয়ে নীচে গিয়ে পড়ল সার্জেন্ট লেটিনিয়া।

ঘুরেই ডাইভ দিতে তৈরি হলো রানা, কিন্তু তখনই শুনল ডক্টর তারাসভের চিৎকার। শ্যারনকে বলছে: ‘না! দেরি হয়ে গেছে, মিস! মেজর রানাকে তুলে আনুন!’

কোমরে টান পড়তেই রানা টের পেল, ওকে জড়িয়ে ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে কে যেন!

কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়েই হুড়মুড় করে প্রায় শক্ত কাদার উপর উপুড় হয়ে পড়ল রানা। ওর কোমরের পাশেই শ্যারন ফ্যেনুয়্যা। পরের সেকেণ্ডে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো লাল- হলুদ ব্যাণ্ডে মোড়া গ্রেনেড।

রানা ও শ্যারনের সামনের ওয়াকওয়ে ধরে ছিটকে গেল পাঁচ ফুট উঁচু লাল-হলুদ আগুনের হলকা।

সার্জেন্ট লেটিনিয়ার বাঁচবার কোন সম্ভাবনাই রইল না।

লাল-হলুদ আগুনের প্রচণ্ড তাপে মুহূর্তে ভুস্ করে মিলিয়ে গেছে বেচারা।

হতবাক হয়ে ওদিকে চেয়ে রইল রানা।

যেন মস্ত ফ্লেমথ্রোয়ার ব্যবহার করে ছিটকে দেয়া হয়েছে হলুদ-লাল আগুনের লকলকে জিভ।

পাঁচ ফুট উঁচু, নয় ফুট চওড়া গলি ভরে গেছে গনগনে শিখায়।

সার্জেন্ট লেটিনিয়াকে শেষ করবার আগে ওয়াকওয়ের উপরের রিইনফোর্সড কাঁচের ছাতে লেগেছে শিখা। ফেটে গেছে কঠিন কাঁচ; পরক্ষণে বিস্ফোরিত হয়েছে আকাশের দিকে।

ফ্রেঞ্চ সৈনিককে হাওয়ায় মিশিয়ে দিয়ে তুষারের স্তূপে লেগেছে হলদে আগুনের নদী। যেন মাখনে লেগেছে অতি তপ্ত ছোরা। ফোঁস আওয়াজে বাষ্পায়িত হয়েছে বরফের মস্ত ঢিবি। সোজা দেড় শ’ ফুট উপরে উঠেছে বাষ্প। প্যাসেজওয়ের দু’পাশে তৈরি হয়েছে ঘন কুয়াশার মেঘ।

কী করবে ভাবছে রানা, এমন সময় নতুন উদ্যমে হামলা করল শত্রুরা। আশপাশে মাথা খুঁড়ছে বুলেট।

ওয়াকওয়েতে চোখ পড়ল রানার। ভয়ঙ্কর উত্তাপে জায়গায় জায়গায় কাদার মত গলে গেছে কংক্রিটের কঠিন মেঝে। হাওয়া হয়েছে তুষারের মস্ত স্তূপ, প্রচণ্ড তাপে মেঝে হয়ে উঠেছে কমলা রঙের।

ঘন কুয়াশার আড়াল নিয়ে ঘুরেই ক্রল শুরু করল রানা। তার আগে টোকা দিয়েছে শ্যারনের কাঁধে। একইসঙ্গে কাছের ট্রেঞ্চে নামল ওরা। অপেক্ষা করছে নিশাত, বব, প্রকাণ্ডদেহী বুনো এবং ডক্টর তারাসভ। সামান্য দূরে ক্যাপ্টেন পাওলো ও জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল— ওদের দু’জনকে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হলো।

‘ওটা কী ছিল, ডক্টর?’ জানতে চাইল বিস্মিত রানা।

‘গ্রেনেড,’ বললেন তারাসভ। ‘অবশ্য ওটার কোর ছিল থারমোবেরিক।

‘সিলিণ্ডারটা কিন্তু খুবই ছোট ছিল…’ ঢোক গিলল ক্যাপ্টেন পাওলো।

‘ওটার লাল ইউরেনিয়ামের কোর এক দানা চালের সমান, ‘ বললেন তারাসভ। ‘ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত হয়নি, কারণ খোলা বাতাসের তাজা অক্সিজেন পায়নি। নইলে…’

‘বলতে চাইছেন আরও ভয়ঙ্করভাবে ফাটত ওটা?’ পদার্থ বিজ্ঞানীকে থামিয়ে দিল নিশাত, ‘আপনারা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী বলেন? আপনারা তো দেখছি আসলে আস্ত পশু সব! কসাই, পাষণ্ড সব…

‘এখন এসব থাক্, আপা,’ উঠে দাঁড়াল রানা। কুয়াশা মোড়া ট্রেঞ্চের দূরে দেখল উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। ‘এবার এই স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে অ্যাটমোসফেরিক ওয়েপন ঠেকাতে না পারলে কারও কোনও উপকারে আসব না আমরা। এখন প্রথম কাজ হবে ওই টাওয়ারে ওঠা।’

রানা রওনা হয়ে যেতেই পিছনে চলল অন্যরা।

রানার পাশে পৌছে গেল বব। বলল, ‘স্যর, আমরা মিস্টার পবন আর মিস ফারিয়াকে খুঁজে পাইনি। তাদের কাছে হেডসেট নেই।’

ভুরু কুঁচকে গেল রানার, এক সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে থ্রোট মাইকে টোকা দিল, ‘বন্ধু? …শুনছ?’

‘শুনছি, বন্ধু রানা,’ নিস্পৃহ সুরে জবাব দিল কুয়াশার রোবট।

‘তোমার স্পিকার চালু করো, যেন আমার কথা অন্যরাও শোনে।’

‘স্পিকার অন করে দিয়েছি, প্রিয় বন্ধু।’

আমি আবার কখন তোর প্রিয় হলাম, ভাবল রানা। কুয়াশার রোবট ব্যাটা বোধহয় ভাবছে একই শব্দ ব্যবহার করবে না!

‘পবন? …শুনছ?’

কুয়াশার সহকারীর কণ্ঠ শুনল রানা, মনে হলো স্পিকারফোনে কথা বলছে। ‘শুনছি, মিস্টার রানা।’

‘তুমি কোথায়? … তোমার সঙ্গে ফারিয়া আছে?’

কুয়াশাময় এক ট্রেঞ্চে হাঁটছে পবন হায়দার, ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে খুঁড়িয়ে চলেছে ফারিয়া আহমেদ। পিছনে রোবট বন্ধু।

‘আমরা ট্রেঞ্চের গোলকধাঁধায়। কোনও ভুল মোড় নিয়েছি, তাই হারিয়ে গেছি!’

‘তুমি কি স্টেডিয়ামের মাঝে ওয়াচ টাওয়ার দেখছ?’

বন্ধুর স্পিকারে পরিষ্কার শুনেছে পবন। ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে আশপাশ দেখল। প্রথমে মস্ত ওই গহ্বরের উঁচু পাথুরে দেয়াল ও পিছনে ফেলে আসা দালান ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না।

‘না… মিস্টার রানা…’ ঘুরে চেয়েই চমকে গেল পবন। ‘ও, হ্যাঁ! দেখতে পেয়েছি! ধূর! ভুল দিকে যাচ্ছি! আবারও যাচ্ছিলাম

এই গর্তের উত্তরদিকে!’

ঠিক আছে, খুব ভুল করোনি। এবার সোজা ওই ওয়াচ টাওয়ারের দিকে যাও। ওখানে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।’

‘জী।’

এবার ফারিয়াকে নিয়ে ঠিক দিকে চলল পবন। কিন্তু খেয়াল করল না, ওর নাইকি বুটের স্পষ্ট ছাপ পড়ছে ভেজা কাদায়।

.

হনহন করে হাঁটছে রানা ট্রেঞ্চের গোলকধাঁধায়, নিচু করে রেখেছে মাথা। প্রতিটা বাঁক নিচ্ছে হিসাব কষে। কুয়াশার চাদরের ওদিকে ওয়াচ টাওয়ার, প্রতি পদক্ষেপে কাছে চলে আসছে।

‘আসলে তোমার প্ল্যান কী, মেজর?’ জানতে চাইল শ্যারন ফ্যেনুয়্যা।

হাঁটবার গতি না কমিয়েই বলল রানা, ‘আমরা এই ফাঁদে ইঁদুরের মত বন্দি, চারপাশে শত্রু। দক্ষিণ, পুব ও পশ্চিমে দক্ষ স্নাইপার। এ ছাড়া, পিছনে উত্তরে আরেকদল, তাড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমাদের ধরা পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাজেই হাতে চাই নতুন তাস। প্রথমেই উঁচু কোথাও উঠব, নইলে বাগে পাব না ওদেরকে। আর ওদের শেষ করতে পারলেই দেরি না করে যাব পোলার আইল্যাণ্ডে। এখন জরুরি হয়ে উঠেছে ওই ওয়াচ টাওয়ার দখল করা।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে রানার মাথার পাশে কাদাটে দেয়ালে থ্যাপ্ শব্দে লাগল একটা লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট। ওদিকে দ্বিতীয়বার চাইল না ও, ব্যস্ত হয়ে হাঁটছে।

‘ওরা তোমাকে ওয়াচ টাওয়ারে দেখলে তিরিশ সেকেণ্ডে ওটা উড়িয়ে দেবে আরপিজি দিয়ে,’ জানাল শ্যারন।

‘জানি,’ বলল রানা, ‘কিন্তু যা করতে চাই, তার জন্য তিরিশ সেকেণ্ড লাগবে না।’

তেরো

‘ঠিক আছে, সবাই শুনুন,’ এমপি-৭ হাতে চারপাশ দেখে নিল রানা। ‘আমার এই প্ল্যান ভাগ করেছি দু’ভাগে। প্রথম কাজ হচ্ছে: আমি হব টোপ। ছুটব ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। পুব ও পশ্চিমের দেয়ালের ওপর থেকে গুলি করবে স্নাইপার। তখন আপনারা গুলি করে ফেলে দেবেন তাদেরকে। …বুঝতে পেরেছেন?’

ট্রেঞ্চের গোলকধাঁধার একধারে পৌঁছে থেমেছে রানা এবং ওর দলের প্রায় সবাই। এদিকটা ওয়াচ টাওয়ারের সবচেয়ে কাছে।

‘বুঝতে পেরেছি,’ বলল প্রকাণ্ডদেহী প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল।

‘কিন্তু, স্যর, আপনি কেন, আমিই না হয় টোপ হই,’ বলল স্নেহপরায়ণা নিশাত।

‘না, আপা, কাজটা আমার,’ সিধে মানা করে দিল রানা।

‘আপা মানে কী?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল শ্যারন।

‘ওল্ডার সিস্টার। বড় বোন।’

বড় হয়ে গেল শ্যারনের দুই চোখ। নিশাতকে একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার তোমার প্ল্যানের শেষাংশটা কী?’

আমি একবার পযিশন নিতে পারলেই ফেলে দেব দক্ষিণের ওয়াচ টাওয়ারের স্নাইপারদেরকে।’

‘ততক্ষণ তুমি বাঁচলে তো!’ শুকনো স্বরে বলল শ্যারন।

‘হ্যাঁ, বাঁচলে তবে,’ মৃদু হাসল রানা। ‘ঠিক আছে, এবার শুরু হচ্ছে খেলা!’

কথাটা মাটিতে পড়বার আগেই ট্রেঞ্চ থেকে উঠেই ওয়াচ টাওয়ারের ভিত্তি লক্ষ্য করে ঝেড়ে দৌড় দিল রানা।

মাত্র এক সেকেণ্ড পর পুব ও পশ্চিমের দেয়ালের মাথায় জ্বলজ্বল করে উঠল মাল্‌ ফ্ল্যাশ।

পশলা পশলা বুলেট এল রানার আশপাশের বাতাস চিরে। ওর কান-গলা ও বুকের খুব কাছ দিয়ে স্ আওয়াজে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট।

‘ওরে, ভাগরে, রানা!’ মনে মনে নিজেকে তাড়া দিল রানা, ছুটছে পাঁই-পাঁই করে। পাখির মত লেজ ও ডানা থাকলে উড়াল দিত।

পরের তিন সেকেণ্ডে রানাকে গেঁথে ফেলবার মত লক্ষ্যস্থির করতে পারল স্নাইপাররা।

কিন্তু তার আগেই কাজে নেমেছে ক্যাপ্টেন নিশাত, ক্যাপ্টেন পাওলো, সান, শ্যারন ও ফ্রেঞ্চ ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখন।

প্রথম তিনজন গুলি করছে পুব দেয়ালের স্নাইপারদের উদ্দেশে।

পশ্চিম দেয়ালের স্নাইপারদের ফেলতে চাইছে দুই ফ্ৰেঞ্চ।

দু’দলের টানা গুলিবর্ষণে ছিঁড়েখুঁড়ে গেল স্নাইপারদের দুই আস্তানা। ওসব পযিশন থেকে ছিটকে পিছনে গিয়ে পড়ল তিনজন করে মার্কসম্যান। থেমে গেল উপরের মাযল ফ্ল্যাশ।

ওই একই সময়ে ওয়াচ টাওয়ারের ভিত্তির সামনে পৌঁছে গেল রানা। কিন্তু নতুন উদ্যমে এল কয়েক পশলা বুলেট, তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল স্ট্রাটগুলোর মাঝ দিয়ে।

এবারের গুলি এসেছে দূরের ওয়াচ টাওয়ার থেকে।

ওই ওয়াচ টাওয়ার স্টেডিয়ামের দক্ষিণের দালানের উপর।

বেদমভাবে ধক্-ধক্ করে লাফাচ্ছে রানার হৃৎপিণ্ড। ঝড়ের গতিতে উঠতে লাগল ওয়াচ টাওয়ারের ভিতরের মই বেয়ে।

‘আপা! ওদিকের ওয়াচ টাওয়ার!’

বানরের মত ক্ষিপ্র অথচ সাবলীল ভঙ্গিতে মই বেয়ে উঠছে রানা। কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গুলি, জোরালো ঠং-ঠাং আওয়াজে লাগছে স্ট্রাটে।

রানার সানগ্লাসের কাঁচে আঁচড় কেটে গেল একটা বুলেট, রয়ে গেল দাগ। কে যেন হ্যাঁচকা টান দিল ওর ঘাড় ধরে। পড়তে পড়তে সামলে নিল রানা। মই বেয়ে উঠবার ফাঁকে একপলক পিছনে চেয়ে বুঝল, কেউ না, ওর পার্কার পুরু কলার ভেদ করে গেছে বুলেট।

রানার দলের সবাই কাভার ফায়ার দিতে চাইছে।

কিন্তু পুব ও পশ্চিমের আস্তানার মত নয় দক্ষিণের পযিশন। ওদিকের ছাউনির নীচে আছে বড়জোর এক বা দু’জন, লুকিয়ে আছে ভালভাবেই।

কয়েক সেকেণ্ড পর ওয়াচ টাওয়ারের ছাতির মত কিউপোলায় পৌঁছে গেল রানা। চারপাশে ছড়িয়ে আছে তিন শ’ ষাট ডিগ্রি বিশাল গহ্বর।

দৃশ্যটা মুগ্ধ হওয়ার মতই।

দারুণ!

কিন্তু ওর বেঁধে দেয়া তিরিশ সেকেণ্ড পেরিয়ে যাচ্ছে।

তখনই দক্ষিণ ওয়াচ টাওয়ারে একজনকে দেখল রানা।

লোকটা কী যেন তুলেছে কাঁধে!

জিনিসটার ব্যারেল লম্বা!

সর্বনাশ!

আরপিজি লঞ্চার!

নড়ে উঠল রানা, খপ্ করে পিঠের হোলস্টার থেকে নিল ম্যাগহুক, পরক্ষণে জিনিসটা সামনে এনেই দু’হাতে ধরে আকাশে তাক করে টিপে দিল ট্রিগার।

ওই একই সময়ে দক্ষিণের ওয়াচ টাওয়ারের লোকটা টিপেছে ট্রিগার। ছিটকে রওনা হলো রকেট-প্রপেল্ড-গ্রেনেড।

লেজে কেব্‌ল্ নিয়ে আকাশ ফুটো করছে ম্যাগহুক— ওদিকে স্টেডিয়ামের আরেক প্রান্ত থেকে বিদ্যুদ্বেগে আসছে আরপিজি, পিছনে দীর্ঘ ধোঁয়ার লেজ!

প্রকাণ্ড গহ্বরের অনেক উপরে টি আকৃতির গার্ডার জংশনে ঠং আওয়াজে আটকে গেল ম্যাগহুকের ম্যাগনেটিক হেড। দেরি না করেই হ্যাণ্ডগ্রিপের স্পুল বাটন টিপল রানা। পরক্ষণে কেবলের হ্যাঁচকা টানে লঞ্চারসহ রওনা হয়ে গেল আকাশ পথে।

কয়েক সেকেণ্ড পর ওয়াচ টাওয়ারে লাগল আরপিজি, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো রকেট। ফুরিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের মত বাইরের দিকে ছিটকে গেল হাজারো ধাতব টুকরো ও ধোঁয়ার মেঘ। আকাশে উঠতে উঠতে রানা নীচে দেখল, প্রকাণ্ড এক গোলাপের মত প্রস্ফুটিত হয়েছে লাল-হলুদের এক আগুনের ফুল।

দু’সেকেণ্ড পর ম্যাগহুকের ইণ্টারনাল স্পুলারের কারণে গার্ডার জংশনের নীচে গিয়ে ঠেকল ও। ঝুলে রইল স্টেডিয়ামের এক শ’ পঞ্চাশ ফুট উপরে, তারপর সামান্য কসরত করে উঠে পড়ল চার গার্ডারের জংশনে। পিঠের হোলস্টারে রেখে দিল ম্যাগহুক। ব্যস্ত হয়ে উঠল যে কারণে এখানে এসেছে, সেটা করতে।

দেরি না করে দক্ষিণের ধাতব গার্ডারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল রানা। ওই গার্ডার দীর্ঘ এবং ঢালু, বহু দূরে চলে গেছে স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে। প্রায় জমাট লেকের ঢের উপর দিয়ে গিয়ে ওদিকের দালানের ওয়াচ টাওয়ার পেরিয়ে থেমেছে দূরের মাটিতে।

স্টেডিয়ামের চার প্রধান গার্ডার প্রতিটি তিনফুট চওড়া। ওর গার্ডারের দু’পাশ শক্ত হাতে ধরেছে রানা, ডানহাতে এমপি-৭, বামহাতে ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল।

এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল, পরক্ষণে হড়কে যেতে দিল নিজেকে। মাথা নীচে, পা উপরের দিকে— সাঁই-সাঁই করে বাড়তে লাগল নামবার গতি— যেন মাছের দিকে ছোঁ দেয়া ক্ষিপ্র, ক্ষুধার্ত মাছরাঙা!

দু’হাতের তালু ও দুই বুট ব্যবহার করে চেপে ধরেছে গার্ডারের দু’দিকের পাত। তুমুল বেগ পাত্তা না দিয়ে স্থির রাখছে নিজেকে। সঠিক সময়ে নিয়ন্ত্রণ করবে গতি। খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে চলেছে রকেটের মত।

গার্ডার থেকে নীচে উঁকি দিয়েছে একের পর এক ফ্লাডলাইট, বিদ্যুদ্বেগে পিছনে পড়ছে। মনে হলো মুহূর্তে পিছিয়ে গেল লেক, দ্রুত আসছে দক্ষিণের দালান— ওটার উপর মাথা তুলেছে খাড়া ওয়াচ টাওয়ার।

এবার দেরি না করে দু’হাতের দুই অস্ত্র কাজে লাগাল রানা।

গর্জে উঠেছে দুই অস্ত্র, মুখে ঝরছে কমলা আগুন।

অন্তত ত্রিশটা বুলেট ঝাঁঝরা করল ওয়াচ টাওয়ারের কিউপোলা।

তুমুল বেগে পিছলে নেমে যাওয়ার মাঝে রানা দেখল, বুলেটের আঘাতে বেদম ঝাঁকি খেয়েছে দুই স্নাইপার, লুটিয়ে পড়েছে ওয়াচ টাওয়ারের মেঝেতে।

আর উঠে দাঁড়াল না তারা।

ফাঁকা হয়ে গেছে ওয়াচ টাওয়ার।

দেখতে না দেখতে গহ্বরের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে গেল রানা, তার আগেই গার্ডারের পাশে বুট চেপে কমিয়ে এনেছে পতনের গতি, একটু পর থেমে গেল ঝাঁকি খেয়ে। এখান থেকে শুরুই হয়েছে নিচু কংক্রিটের দেয়াল।

দুই অস্ত্রে নতুন ম্যাগাযিন ভরে নেয়ার ফাঁকেই দেখেছে, ওয়াচ টাওয়ারের ভিত্তির কাছে জড় হয়েছে পার্কা পরা আরও কয়েকজন শত্রু সৈনিক। গহ্বরের দেয়ালের দু’দিকে দু’পা ঝুলিয়ে গুলি শুরু করল রানা। সরসর করে নেমে চলেছে, তারই ফাঁকে দেখল গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ছে শত্রুরা।

দেয়ালের শেষে গিয়ে থেমে গেল রানা। বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না তিন ফুট উপর থেকে নামতে। দুই অস্ত্রের মুখ থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। আবারও খালি হয়ে গেছে অস্ত্র। থমথম করছে শত্রুদের পযিশন, ওদিকে নড়ছে না কেউ।

ব্যস্ত হাতে দুই অস্ত্রে নতুন ম্যাগাযিন ভরল রানা, সতর্ক।

এখনও কেউ রয়ে গেলে কাজে আসবে না ওর প্ল্যান।

আরও পাঁচ সেকেণ্ড পর নিশ্চিত হলো, বেঁচে নেই কেউ।

পরবর্তী আড়াই মিনিটে দ্বিতীয় ওয়াচ টাওয়ারের কিউপোলায় উঠল রানা, মৃত দুই স্নাইপারের একজনের রাইফেল তুলে নিয়ে ওটার সাইটের ভিতর দিয়ে দূরে চাইল।

কোথাও নড়ছে না কিছু।

‘আপা,’ থ্রোট মাইকে বলল, ‘এবার সবাইকে নিয়ে লেকের নীচের ওয়াকওয়ে ধরে চলে আসুন। এখান থেকে কাভার দিচ্ছি।’

রানা জানে না, কিন্তু অবিশ্বাস নিয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে শ্যারন ফ্যেনুয়্যা ও ক্যাপ্টেন ডিফেখন— হাঁ হয়ে গেছে মুখ। রানার অবিশ্বাস্য স্টান্ট এখনও হজম করতে পারেনি, এত দুর্দান্ত সাহসী হতে পারে মানুষ!

একটা কথাও বলল না শ্যারন, শুধু আস্তে করে দোলাল মাথা।

বুনো বলল, ‘আমি ওই লোককে ভালবেসে ফেলেছি, মেজর!’

‘জলদি রওনা হন,’ তাড়া দিল নিশাত।

দৌড় শুরু করল দলের সবাই। ফিরে চলেছে ওয়াকওয়ের দিকে। ট্রেঞ্চের ভিতর দিয়ে তিন মিনিটের ভিতর পৌছে গেল ওরা প্যাসেজওয়েতে। তার আগেই নিশাত জানিয়েছে কী করতে হবে।

ওয়াকওয়েতে নেমে রওনা হলো সান, পাওলো, চ্যাণ্ড্রোপল, তারাসভ, শ্যারন ও বুনো।

এবার দূরের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আর গুলি এল না, বরং ওখান থেকেই কাভার দেয়া হলো ওদেরকে।

পচা নেইটরিচের দল ভালুক ল্যাবোরেটরি থেকে ওদেরকে তাড়া করে এনেছিল এদিকে, কিন্তু উল্টো এখন তারাই আটকা পড়েছে উত্তরদিকের সিঁড়িতে। স্টেডিয়ামের দক্ষিণ ওয়াচ টাওয়ার থেকে রানার স্নাইপিং রাইফেলের গুলি আসছে তাদের দিকে। থ্রোট মাইকে ডাকল রানা, ‘তুমি কোথায়, পবন?’

কুয়াশার সহকারী জানাল, ‘এখনও ট্রেঞ্চে, ওয়াচ টাওয়ারের কাছে যেতে পারিনি।’

‘ওয়াচ টাওয়ারে যেতে হবে না আর। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে ওয়াকওয়ে ধরে চলে এসো। আমি কাভার দেব।’

‘ঠিক আছে, আমরা আসছি,’ জানাল পবন।

ট্রেঞ্চের জটিল গলির ভিতর দিয়ে চলেছে। ওর কাঁধ ধরে হাঁটছে ফারিয়া, পিছনে চাকা গড়িয়ে আসছে রোবট বন্ধু।

জোরে হাঁটতে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করেছে পবন।

জানে না কেন ভয় লাগছে ওর।

কাদাটে ট্রেঞ্চের তুষার ছাওয়া এক মোড় ঘুরল পবন, সামনে কাদা ভরা আরেকটা ট্রেঞ্চ।

অস্বস্তি লাগছে পবনের। একেবারেই হারিয়ে গেছে।

‘আপনার কী অবস্থা?’ জানতে চাইল সঙ্গিনীর কাছে।

‘ভাল না, পায়ে খুব ব্যথা,’ বলল ফারিয়া। অসহায় চোখে পবনের দিকে চাইল। ‘দয়া করে আমাকে ফেলে যাবেন না।’

থমকে দাঁড়িয়ে গেল পবন। চোখ রাখল অপরূপা মেয়েটির সজল চোখে। ‘ফারিয়া, আমার চোখে তাকান। আরও খারাপ কিছু হলেও কিছুতেই আপনাকে ফেলে যাব না। হয় একসঙ্গে বাঁচব, নইলে মরব- আলাদা হব না।’

লজ্জা পেল ফারিয়া, আস্তে করে চোখ নামিয়ে নিল। ‘ধন্যবাদ, পবন।

ট্রেঞ্চের উপরের পারের দিকে চাইল কুয়াশার সহকারী। ‘ওপরে উঠতে হবে। নইলে বুঝব না কোথায় আছি। শুনুন…’

কাছেই বলে উঠল কর্কশ কণ্ঠ, ‘বাহ্-বাহ্, প্রেম চলছে দেখি!’

ঘন কুয়াশার ভিতর আওয়াজটা খুব কাছে মনে হলো ওদের।

‘কী বলছিলে বীর পুরুষ— সুন্দরী, তোমাকে ছেড়ে যাব না?’

চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল পবন। ওই লোক বাংলা ভাষা জানে না, কিন্তু আন্দাজ করে নিয়েছে ও কী বলেছে।

দূরে গেছে ট্রেঞ্চ।

ওদিকে ঘন কুয়াশা।

কেউ নেই।

বিস্ফারিত চোখে পবনের দিকে চাইল ফারিয়া। ‘ওরা… ওরা ট্রেঞ্চে!’

‘আমার নাম ক্যাম্পেন ফন নেইটরিচ, হাসি-হাসি সুরে বলল কণ্ঠস্বর, ‘পচা নেইটরিচও ডাকতে পারো। খুবই বদনাম আছে আমার। আমি নাকি মেয়েদের পেলেই বারবার ইচ্ছেমত রেপ করি। …তার চেয়েও বড় কথা, তোমার গলার আওয়াজটা আমার পছন্দ হয়েছে, ডার্লিং ফারিয়া!’

আতঙ্কিত চোখে পরস্পরকে দেখল পবন ও ফারিয়া।

‘সোনা… ডার্লিং ফারিয়া,’ গুনগুন করল পচা নেইটরিচ।

কাছ থেকেই এসেছে কণ্ঠ। চারপাশে চোখ বোলাল পবন। ধাতব ‘ক্লিক!’ শব্দে এইমাত্র অফ হলো অস্ত্রের সেফটি ক্যাচ!

হ্যাণ্ডেল ধরে বন্ধুকে তুলে নিল পবন।

থমথম করছে চারপাশ।

ভয় করছে পবনের।

যে-কোনও সময়ে বন্ধুর ইলেকট্রিক মোটরের শব্দ শুনে ওদেরকে ধরে ফেলবে ওই লোক।

‘এদিকে চলুন!’ ফিসফিস করে বলল পবন ফারিয়াকে।

ট্রেঞ্চে আরেকটা বাঁক নিল দু’জন। আর তখনই বাতাস চিরে দিল ভয়ঙ্কর এক গর্জন। সামনের কাদাটে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রোমশ এক মস্ত পোলার বেয়ার!

পিছনের দুই পায়ে ভর করেছে, উচ্চতা কমপক্ষে দশফুট! মস্ত হাঁ করতেই বেরোল চারটে হলদে তীক্ষ্ণধার শ্বদন্ত। ভয়ঙ্কর খেপেছে, দুলতে দুলতে এগিয়ে এল দু’পা।

ল্যাবোরেটরির অন্য সব ভালুকের মতই, উস্কোখুস্কো রোম, তাতে শুকনো রক্ত। ভীষণ নোংরা। জ্বলজ্বল করছে লাল দুই চোখ। বিকট আরেকটা হুঙ্কার ছেড়ে সামনে বাড়ল।

ধাক্কা দিয়ে ফারিয়াকে নিজের পিছনে ঠেলে দিল পবন। বুঝে গেছে, এবার মরতে হবে ওদেরকে।

পবনের ওই নড়াচড়া দেখে আরও খেপল মেরু ভালুক, তেড়ে এল বিদ্যুদ্বেগে!

ওদের দিকে ছুটে আসছে শ্বেত দানব!

শেষ মুহূর্তে চার হাত-পায়ে ভর দিল।

তার আগেই চোখ বুজে ফেলেছে পবন। জানে, এবার শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা!

কিন্তু মৃত্যু এল না।

চোখ মেলল পবন। নাকের কাছে দেখল ভালুকের বিরাট মুখ।

ভীষণ পচা গন্ধ ওটার মুখে!

নাক থেকেও বেরোচ্ছে পচা মাংসের দুর্গন্ধ!

কী যেন শুঁকছে মস্ত নাক কুঁচকে!

ওর গায়ের গন্ধই, টের পেল পবন।

ঘোঁৎ করে উঠল মেরু ভালুক, পরক্ষণে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে গেল।

‘কী হয়েছে ওটার…’ ফিসফিস করে জানতে চাইল ফারিয়া।

‘জানি না…’ চাপা স্বরে বলল পবন। পরক্ষণে মনে পড়ল, ওরা রওনা হওয়ার আগে সবার গায়ে স্প্রে করেছিল বিজ্ঞানী কুয়াশার এনিমেল রিপেলেন্ট।

কয়েক ধরনের জন্তু ঠেকাতে তৈরি করেছে ওটা কুয়াশা।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্যই ওই রেপেলেন্ট ব্যবহার করেছিল পবন। আগে কোনও পোলার বেয়ারের উপর পরীক্ষা করা হয়নি।

‘এক শ’তে এক শ’ পেয়েছেন আমার বস,’ নিচু স্বরে বলল পবন।

কিন্তু তখনই আবারও ভয়ঙ্কর গর্জন ছাড়ল মেরু ভালুক, এবার আগের চেয়েও ক্ষিপ্ত। আবারও উঠে দাঁড়াল দু’পায়ে ভর করে, পরক্ষণে লাফিয়ে সামনে বাড়ল!

পবন বুঝল, ধারণা ভুল ছিল।

কাজ করেনি রেপেলেন্ট!

এবার আর চোখ বুজতে পারল না পবন, তার আগেই মস্ত এক লাফ দিয়ে ওদের দু’জনকে পেরিয়ে গেল দানব ভালুক। ছিটকে গিয়ে পড়ল সশস্ত্র চারজন লোকের উপর। তারা এইমাত্র এসেছে পিছনের বাঁক ঘুরে।

পচা নেইটরিচ ও তার তিন সঙ্গী।

ভয়ঙ্কর এক থাবা খেয়ে ধুপ্ করে মাটিতে পড়ল নেইটরিচের সামনের লোকটা। তার আগেই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে তার গলা।

ততক্ষণে হুঁশ ফিরেছে হতচকিত নেইটরিচের, গুলি চালাল।

অন্তত পনেরোটা বুলেট হজম করে ছিটকে পিছনে গিয়ে কাদার ভিতর পড়ল দানবীয় ভালুক। আওয়াজ হলো ধড়াস!

পচা নেইটরিচকে দেখতে পেয়েছে পবন ও ফারিয়া।

সে বেঁটে লোক, তারের মত টানটান শরীর। চকচক করছে মাথা ভরা টাক। শেয়ালের মত সরু দুই গাল। বাম ভুরু থেকে নাকের বাম পাটা পর্যন্ত ঝুলছে রুপালি সরু চেইন।

মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো পবন ও নেইটরিচের।

বরফের মূর্তি হয়ে গেল পবন।

চওড়া হাসি দিল পচা।

পবনের বুকের দিকে তুলল অস্ত্র।

‘বন্ধু! গুলি!’ বলে উঠল পবন। এখনও সুটকেসের মত ঝুলিয়ে রেখেছে কুয়াশার রোবটকে।

খুদে রোবট চালু করল মেশিনগান।

কারও দিকে তাকই করেনি পবন।

সামনের চারপাশে ছিটিয়ে গেল বুলেট।

কাভার নেয়ার জন্য ডাইভ দিয়েছে পচার লোক, অবশ্য তার আগেই বন্ধুর অস্ত্রের তোড়ে পিছনে ছিটকে গেল পচার পাশের ক্ষত-বিক্ষত সঙ্গী, মৃত।

বন্ধুর বুলেটের পরের তোড় গেল নেইটরিচের পাশ দিয়ে। অবশ্য লক্ষ্যভেদ করল মাত্র একটা বুলেট। পচার করোটির ডানদিক থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। বিকট এক আর্তনাদ ছাড়ল লোকটা, পরক্ষণে খসে পড়ল ট্রেঞ্চের মেঝেতে। রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে লোকটার মাথার পাশে তুষারে।

ওই দৃশ্য দেখে বিস্ফারিত হলো পবনের দুই চোখ। অবিশ্বাস নিয়ে দেখছে, ওর কারণেই মারা গেছে লোকটা

‘বন্ধু! সিয ফায়ার!’ কাঁপা স্বরে বলল পবন। ফারিয়াকে নিয়ে ঘুরেই রওনা হয়ে গেল, প্রায় দৌড়াতে শুরু করেছে।

পরের বাঁকে পৌঁছে ওরা দেখল ট্রেঞ্চের পারে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা। কাছে যেতেই হাতের ইশারা করল সে। হাত বাড়িয়ে দিল ওদেরকে তুলে নেয়ার জন্য।

কয়েক সেকেণ্ডে ওদের দু’জনকে টেনে তুলে নিল নিশাত। আর তখনই পরিচিত নাকি কণ্ঠ শুনল পবন।

‘পবন! শালা ইঁদুরের বাচ্চা, তুই উড়িয়ে দিয়েছিস আমার কান! আমি তোকে খুঁজে বের করব, তারপর পাছা দিয়ে ভরে দেব আমার ললিপপ! … আর তোর ফারিয়ার কী করব জানিস? তোকে বেঁধে রেখে তোর চোখের সামনে ওকে রেপ করে মেরে ফেলব! আমি আসছি, কুকুরের বাচ্চা!’

কুয়াশা ভরা ট্রেঞ্চ থেকে ভেসে এল নিষ্ঠুর হাসি।

‘পবন, যেখানেই যাচ্ছ, নতুন বন্ধু জোগাড় করছ— কী বলো?’ বলল নিশাত, ‘এবার এসো সরে যাই!’

রানার কাভার ব্যবহার করে একমিনিট পেরোবার আগেই ওয়াকওয়েতে পৌঁছে গেল ওরা, লেকের তলা দিয়ে গিয়ে ওদিকে উঠল। স্টেডিয়ামের দক্ষিণের চৌকো দালানে অন্যদের সঙ্গে দেখা হলো ওদের।

উত্তরদিকের দালানের মতই, এদিকের এই দালানও দ্বীপের আগ্নেয়-শিলার উপর তৈরি। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে উত্তরের দালান। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখা গেল ছোট একটা দ্বীপ ওটা পেরোলে সামনেই পড়বে পোলার আইল্যাণ্ড।

নিশাত, পবন ও ফারিয়া পৌছে যেতেই দক্ষিণের ছোট দ্বীপের দিকে মনোযোগ দিয়েছে রানা।

এই প্রকাণ্ড ঘরের দরজা পেরোলে পুরনো পন্টুন সেতু। ভালুক দ্বীপ থেকে সোজা গেছে পরের দ্বীপে। ওখানে পিছনদিকে ওয়্যারহাউসের মত বড় দালান। পিছনে উঁচু জমি, সেখানে একটা কেবল কার স্টেশন দেখল রানা। ঝুলন্ত কেবল গেছে পোলার আইল্যাণ্ডের বহু উপরের জমিতে।

ওই কেবল স্টেশন মৃত্যুদ্বীপে পৌছবার অন্যতম পথ। আরেকটা উপায় কাছেই। পন্টুন সেতুর মাঝে রয়েছে দ্বিতীয় একটা পন্টুন সেতু। সোজা গেছে পোলার আইল্যাণ্ডে। শেষ সেতু পুবদিকে গিয়ে মিশেছে জং ধরা করাগেটেড আয়ার্ন ছাউনিতে। ওখানে ক্লিফের পায়ে চুমু দিচ্ছে উপসাগরের ঢেউ। একটু দূরের ছাউনিতে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সাইযের দুই গ্যান্ট্রি এলিভেটার, উপরে- নীচে চলে ক্লিফের গা ছুঁয়ে।

‘ডক্টর তারাসভ,’ বলল রানা। ‘পন্টুন সেতু না কেবল কার, কোনটা ব্যবহার করা উচিত?’

‘পোলার আইল্যাণ্ডের আগের শেষ ওই দ্বীপটাকে আমরা বলি অ্যাসিড দ্বীপ,’ বললেন ডক্টর, ‘ওখানে অ্যাসিড রিসার্চ ল্যাবোরেটরি আছে। যাকগে, ওই পুরনো কেবল কার স্টেশন এখন ব্যবহার করা হয় না। উনিশ শ’ পঁচাশি সালে এদিকের ফ্যাসিলিটি তৈরির সময় ওটাই ছিল একমাত্র যোগাযোগের পথ। এখনও কাজ করে কেবল কার, কিন্তু ভীষণ শীতের সময় বিকল হয়ে যায়। পন্টুন সেতু উনিশ শ’ নব্বুই সালের। ওটার মাধ্যমে গিয়ে এলিভেটারে ওঠাই ভাল। তাতে জলদি পৌঁছুনো যাবে।’

‘সময় কম লাগলেই হলো,’ বলল রানা। পন্টুন সেতুর শেষে এলিভেটার, ওদিকে চাইল। চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি:

১০:২৬

চমকে গেছে রানা।

মাত্র ছাব্বিশ মিনিট আগে এসেছিল এখানে!

পায়ের দিকে চাইল রানা।

পড়ে আছে পাঁচটা লাশ।

এরা রাফিয়ান আর্মির সৈনিক।

পরনে মেরিনদের পার্কা।

একটা লাশের পাশে বসে হেলমেট ও গগলস নিল রানা।

লাশের গলা-ঘাড়ে একের পর এক উল্কি।

সেগুলোর ভিতর রয়েছে রাশান জাহাজ ও একটা দালান।

রানা খেয়াল করল, প্রতিটি লাশের গলা-ঘাড়ে এসব উল্কি আছে।

‘ওগুলো দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে?’ জানতে চাইল জর্জ চ্যাণ্ডোপল।

চুপ করে আছে রানা, তারপর বলল, ‘ওগুলো ওদের পুরস্কার। নির্দিষ্ট মিলিটারি অপারেশনের স্বীকৃতি।’

‘ভগবান, কোন্ পিশাচ এরা?’ বিড়বিড় করল চ্যাণ্ড্রোপল।

উঠে দাঁড়িয়ে দলের সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিল রানা।

সবাই ক্লান্ত, পরনে নোংরা পোশাক, পার্কায় রক্তের দাগ।

বিশেষ করে জর্জ চ্যাণ্ডোপলকে অত্যন্ত ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে।

এই শীতের ভিতর দরদর করে ঘামছেন ডক্টর তারাসভ।

সবার ভিতর শুধু প্রকাণ্ডদেহী ফ্রেঞ্চ লোকটাকে শান্ত মনে হচ্ছে, যেন পিকনিক করতে এসেছে।

ফ্রেঞ্চ সার্জেন্ট মারা যাওয়ায় ওরা দলে এখন দশজন।

রানার মনের কোণে চিন্তা এল: এ মিশনে কতজন মরবে?

‘এবার আমাদের প্ল্যান কী হবে, স্যর?’ জানতে চাইল ক্যাপ্টেন নিশাত। এসে দাঁড়িয়েছে রানার পাশে। চেয়ে আছে তৃতীয় দ্বীপের দিকে।

‘এবার গ্যান্ট্রি এলিভেটার ব্যবহার করব।’

‘সেটা করব কীভাবে?’ জানতে চাইল শ্যারন।

পন্টুন সেতুর যে অংশ গেছে সাপ্লাই ছাউনিতে, ওদিকে চাইল রানা। ওখানে গ্যান্ট্রি এলিভেটার।

‘পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে পিছন ফিরে যাব আমরা,’ বলল রানা।

চোদ্দ

পোলার আইল্যাণ্ডের পিরিচ আকৃতির দালান ছাড়িয়ে আরও উপরে কমাণ্ড সেন্টারে একদৃষ্টে মাসুদ রানার স্থির চিত্র দেখছে রাফিয়ান আর্মির সর্বোচ্চ নেতা – জেনারেল এবং বিশৃঙ্খলার সম্রাট।

রানার ওই ছবি এসেছে ভালুক দ্বীপের ল্যাবের এক সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা থেকে।

‘তো কে এই লোক?’ জানতে চাইল জেনারেল।

‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর একজন এজেন্ট, স্যর, কোড নেম এমআরনাইন,’ বলল কর্নেল সাইক্লোন। ‘আগে বাংলাদেশ আর্মির মেজর ছিল। ওই লোকের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। হেন দেশ নেই যেখানে মিশনে যায়নি। বহুবার রাশা ও আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, কিন্তু কী করে যেন বারবার বেঁচে গেছে। এখন ফ্রান্স তার উপর জারি করেছে মৃত্যু-পরোয়ানা।’

রানার মুখ ভাসছে মস্ত স্ক্রিনে।

আবারও সেদিকে চাইল জেনারেল।

কর্নেল সাইক্লোনের জোগাড় করা তথ্য পড়েছে।

নিষ্ঠুর হাসল ছবিটার দিকে চেয়ে।

‘ভাল, ভাল, আগ্রহ বাড়ছে আমার।‘

বিশ্বস্ত কর্নেলের দিকে ঘুরে চাইল।

‘অন্যদের ব্যাপারে বলো।’

‘আমরা ওই দ্বীপে ডক্টর তারাসভসহ মোটমাট এগারোজনকে দেখেছি,’ বলল কর্নেল। ‘অবশ্য পরে স্টেডিয়ামে তাদের একজন মারা পড়েছে। মাসুদ রানাসহ তারা এখন দশজন। তাদের ভেতর পাঁচজনকে শনাক্ত করেছি মিলিটারি ডেটাবেস থেকে।

‘এবং?’

দুই মেরিন, এক বাংলাদেশি ক্যাপ্টেন এবং দুই ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপার। তাদের একজন এখন আছে ডিজিএসই-এর সঙ্গে।’

‘আচ্ছা? দেখি তারা কারা,’ কন্সোলের সামনে গিয়ে নিজের সিটে বসল জেনারেল। বাটন টিপতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা, ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো, সৈনিক বব বউলিং, মেজর শ্যাখন ফ্যেনুয়্যা ও ক্যাপ্টেন পিয়েখে ডিফেখনের তথ্য।

পড়ছে জেনারেল।

পড়া শেষ হলে হেলান দিল সিটে, ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি।

.

পোলার আইল্যাণ্ডের উত্তরের উপসাগর।

সকাল দশটা ছাব্বিশ মিনিট।

চৌত্রিশ মিনিট পর শুরু হবে পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব কাণ্ড।

প্রকাণ্ড একটা ইউ-এর মত মৃত্যুদ্বীপের উত্তর উপকূল। মাঝে শেষ খুদে দ্বীপ।

ডক্টর ম্যাকসিম তারাসভ ওটার নাম বলেছেন: ‘অ্যাসিড আইল্যাণ্ড’।

ওখানে ছিল অ্যাসিড রিসার্চ ল্যাবোরেটরি। ওটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। তিনদিক দিয়ে ওই দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে পোলার আইল্যাণ্ডের তিন শ’ ফুট উঁচু ক্লিফ। ওখান থেকে নীচে চাইলে মনে হবে ওই ল্যাবোরেটরি খুবই ছোট।

অ্যাসিড দ্বীপের উত্তরে ভালুক দ্বীপ— দুটোর মাঝে সংযোগ রাখছে পন্টুন সেতু। ওটা থেকে আরেকটা শাখা সেতু পুবে গেছে গ্যান্ট্রি এলিভেটারের ছাউনির কাছে। পায়ের কাছে ছল-ছলাৎ শব্দে হাসছে উপসাগরের ঢেউ।

পোলার আইল্যাণ্ডের পুব ক্লিফের উপর বাতিঘর, ওটা আবার কাজ করছে ওয়াচ টাওয়ার হিসাবে।

ওই বাতিঘরে দস্যু আর্মির দুই সদস্য চোখ রেখেছে ভালুক দ্বীপের স্টেডিয়ামে। তাদের জানা আছে, আগত লোকগুলোকে পিছন থেকে তাড়া দিয়ে হাঙরের দলের কাছে পৌঁছে দেবে পচা নেইটরিচের দল। বেশিক্ষণ হয়নি হাঙরের দল অবস্থান নিয়েছে, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে ছিটকে পন্টুন সেতুতে বেরিয়ে এল হাঙরের দলের চারজন!

প্রাণের ভয়ে ছাউনির দিকে পালিয়ে আসছে তারা!

তৃতীয় এবং চতুর্থজন অন্যদের কাভার দিচ্ছে। পালিয়ে আসবার ফাঁকে বেয়ার আইল্যাণ্ড লক্ষ্য করে প্রাণপণে গুলি করছে।

হঠাৎ গুলি বন্ধ করল তারা। স্টেডিয়ামের দালান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে দস্যু আর্মির আরও চার সদস্য। প্রাণের ভয়ে ছুটছে প্রাণপণে।

গুলি করছে বেয়ার আইল্যাণ্ডের দালান লক্ষ্য করে।

তাদের চারপাশে সেতুর খুঁটি ও তক্তায় লাগছে হেভি ক্যালিবারের অসংখ্য বুলেট। নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে কাঠের কুচি।

বাতিঘরের দুই সেন্ট্রি দেখল, ভালুক দ্বীপের দালানের প্রকাণ্ড দরজা দিয়ে সেতুর দিকে গুলি পাঠাচ্ছে কয়েকজন।

তারাই আগত শত্রু।

হাঙরের দলকে তাড়া করছে।

পলায়নরত দলের লোক পৌঁছে গেছে সেতুর মাঝামাঝি, ওখানেই রয়েছে দীর্ঘ শাখা সেতু— ওটাই হাঙরের দুলের সবাইকে পৌঁছে দেবে গ্যান্ট্রি এলিভেটারের কাছে।

হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল হাঙরের এক লোক। গুলি লেগেছে নিশ্চয়ই। পাশের একজন তাকে টেনে তুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।

বিষয়টি খেয়াল করেছে দুই সেন্ট্রির একজন।

তরুণ সেন্ট্রি দেরি না করে রেডিয়ো করল: ‘বেস, লাইট হাউস বলছি! যা বুঝছি, শত্রুরা বেয়ার আইলেটের দক্ষিণে পৌঁছে গেছে! তারাই তাড়া করছে হাঙরের দলের সবাইকে! আমাদের দল ছুটছে সাপ্লাই শেড আর এলিভেটারের দিকে!’

‘শুনলাম, লাইট হাউস,’ জবাব এল বেস থেকে।

‘একমিনিট!’ হঠাৎ করেই বলল বাতিঘরের বয়স্ক সেন্ট্রি। সে দক্ষ যোদ্ধা। চিলির সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট ছিল। রাফিয়ান আর্মিতে তার নাম: স্যান্টা ক্লয।

তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে পন্টুন সেতুর উপর লোকগুলোকে।

‘ওরা হাঙরের দলের কেউ নয়…’ ধীর ভঙ্গিতে বলল সে। ‘রাফিয়ান আর্মির সবাইকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কারও গুলি লাগলে বা পড়ে গেলে ফেলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু এইমাত্র একজনকে তুলে নিয়েছে আরেকজন। এরাই আসলে হামলাকারী, পরনে হাঙরের দলের ইউনিফর্ম। …..ক্লিফ টিম! এক্ষুনি আরপিজি দেগে উড়িয়ে দাও পন্টুন ব্রিজ!’

.

ছাউনির ষাট গজ দূরে পন্টুন সেতু ধরে পালিয়ে আসছে একদল যোদ্ধা। পরনে দস্যু আর্মির মৃত সদস্যদের ভারী মেরিন পার্কা।

এ দলের নেতৃত্বে রয়েছে মাসুদ রানা। দীর্ঘ শাখা সেতু ধরে এলিভেটার লক্ষ্য করে ছুটছে।

রানার কানে হাই-টেক রেডিয়ো ইয়ারপিস/মাইক। ওটা নিয়েছে রাফিয়ান আর্মির এক মৃত সৈনিকের কাছ থেকে। জিনিসটা ইয়ারবাডের মতই ছোট, ফিলামেন্ট মাইক্রোফোন দৈর্ঘ্যে মাত্র দশ মিলিমিটার। আপাতত বন্ধ করে রেখেছে। অবশ্য শুনছে শত্রুপক্ষের কথা। এইমাত্র বাতিঘরের এক সেন্ট্রি বার্তা পাঠিয়েছে বেসে।

ভাল!

লোকটা বুঝতে পারেনি ওরা রাফিয়ান আর্মির লোক নয়।

আশা করা যায় অনায়াসেই দল নিয়ে মূল দ্বীপে উঠতে পারবে রানা।

মনোযোগ দিয়ে রেডিয়োর কথা শুনছে ও। গুলি করছে ভালুক দ্বীপ লক্ষ্য করে। প্রতিটি বুলেট যাচ্ছে দালানের অনেক উপর দিয়ে। ‘আহত’ বরকে নিয়ে পিছিয়ে চলেছে। একই কাজ করছে ক্যাপ্টেন ডিফেখন, তার সঙ্গে ‘আহত’ শ্যারন। ভঙ্গি করছে আহত সৈনিকদের নিয়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে ওরা। ফারিয়া, পবন, চ্যাণ্ড্রোপল ও তারাসভের পরনে চোরাই মেরিন পার্কা, রানাদের সঙ্গেই পালিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুদ্বীপের দিকে।

ভালুক দ্বীপের সেতুর মুখে দরজার আড়াল থেকে গুলি করছে নিশাত, পাওলো এবং রোবট বন্ধু। অসংখ্য বুলেট যাচ্ছে ‘শত্রু’ দলের দিকে। অবশ্য লাগছে না একটা গুলিও। নানাদিকে ছিটকে উঠছে সেতুর মেঝের তক্তা ও খুঁটির কাঠের কুঁচি। ওদের অভিনয়ে কোনও ত্রুটি নেই।

কিন্তু তখনই রেডিয়োতে তিক্ত বক্তব্য রাখল এক লোক।

সে বুঝে গেছে রানার পরিকল্পনা।

ধীর ভঙ্গিতে বলল, ‘ওরা হাঙরের দলের কেউ নয়। রাফিয়ান আর্মির সবাইকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কেউ গুলি খেয়ে পড়ে গেলে ফেলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু এইমাত্র একজনকে তুলে নিয়েছে আরেকজন। এরাই আসলে হামলাকারী, পরনে হাঙরের দলের ইউনিফর্ম। …ক্লিফ টিম! এক্ষুনি আরপিজি দেগে উড়িয়ে দাও পন্টুন ব্রিজ!’

দুই সেকেণ্ড পর ক্লিফের মাথা থেকে এল ঝাঁক ঝাঁক গুলি। তার তিন সেকেণ্ড পর নীচে রওনা হলো আরপিজি। রানার বিশ ফুট পিছনে সেতুর উপর পড়ল ওটা। লাফিয়ে আকাশে উঠল সেতুর ওই অংশ। চারপাশে ছিটকে গেল বিপুল পানি। ওই ফোয়ারা মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘুরে রানা দেখল, গায়েব হয়ে গেছে সামনের পন্টুন সেতুর বিরাট এক অংশ। ওই পথে আর পোলার আইল্যাণ্ডে যেতে পারবে না ওরা।

ঝট্ করে ঘুরেই জরুরি সুরে বলল রানা, ‘থামো সবাই! সেতুর অন্যদিকে! অ্যাসিড দ্বীপে উঠতে হবে! আপা-পাওলো! জলদি আসুন!’

ধরা পড়ে গেছে ওদের ছদ্মবেশ।

ক্লিফের মাথা লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা, শ্যারন ও ডিফেখন। কাভার দিচ্ছে অন্যদেরকে।

এবার সত্যিই জানের ভয়ে পালাতে শুরু করেছে ওদের দল।

নাতিদীর্ঘ পন্টুন সেতু ধরে ছুটছে অ্যাসিড দ্বীপের দিকে।

রোবট বন্ধুকে তুলে নিয়েই ঝড়ের গতিতে ছুট দিল ক্যাপ্টেন নিশাত ও পাওলো। বেরিয়ে এসেছে খোলা জায়গায়। গুলি করছে খাড়া ক্লিফের মাথার দিকে।

রানার কাভার ফায়ার যথেষ্ট নয়।

ওরা ঘুরে আরেকদিকে রওনা হতেই কমপক্ষে ছয়টা গুলি লাগল জর্জ চ্যাণ্ড্রোপলের পিঠে। বিস্ফোরিত হলো বুকের খাঁচা, ছিটকে বেরোল রক্তের ফোয়ারা। বেচারা পৌছে গিয়েছিল দুই সেতুর সঙ্গমে, গুলির ধাক্কা খেয়ে গিয়ে পড়ল নীল সাগরে। বরফ- খণ্ড ভরা পানিতে পড়বার আগেই মারা গেছে।

থমকে গিয়ে ভাসমান মৃতদেহের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল পবন ও ফারিয়া। পিছন থেকে ওদের ধাক্কা দিয়ে সচেতন করল শ্যারন। ‘ও মারা গেছে! ওকে আর সাহায্য করতে পারবে না! নিজেকে সাহায্য করো! দৌড়াও! দৌড়াও!’

ছুটবার ফাঁকে একবার পানিতে প্রায় নিমজ্জিত দেহটা দেখল রানা, থমথম করছে মুখ।

ওর পাশে চলে এল নিশাত। ‘এরা গাধা না, স্যর!’

‘না, তা নয়, আপা।’

ঝড়ের গতিতে নাতিদীর্ঘ সেতু পেরিয়ে গেল ওরা, পা রাখল ছোট্ট দ্বীপে। হুড়মুড় করে গিয়ে ঢুকল পরিত্যক্ত গার্ডহাউসে। ওখানে পা রাখবার আগে পন্টুন সেতুর উপর একটা গ্রেনেড ফেলেছে রানা। বিস্ফোরিত হলো ওটা। উড়িয়ে দিল সেতুর বিশ ফুট জায়গা। এখন আর ওদিক দিয়ে দ্বীপে উঠতে পারবে না কেউ।

পোলার আইল্যাণ্ডে পা-ও রাখতে পারেনি রানার দলের কেউ।

অথচ, রাফিয়ান আর্মি এখন ভাল করেই জানে ওরা কোথায়।

‘এবার পরের কাজ কী হবে, স্যর?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশাত।

ওর পাশে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে ফারিয়া আহমেদ।

হতবাক মনে হচ্ছে পবন হায়দারকে।

‘ফারিয়া, পবন,’ কড়া সুরেই ডাকল রানা। চট্ করে মুখ তুলে চাইল ওরা। ‘বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এখন মন খারাপ করার সময় নেই। আগেই জেনেছ, পরিস্থিতি খুবই খারাপ হতে পারে। গুলি লাগতে পারে। আমরা মারাও যেতে পারি। তবে মনে রেখো, জগতের দুঃখ-কষ্ট থেকে বিদায় নিয়েছে জর্জ চ্যাণ্ড্রোপল। আমাদেরকেও যেতে হবে। এমন কেউ নেই যে এখানে রয়ে যাবে।’

দক্ষিণে পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে চাইল রানা। চোখ স্থির হলো এই দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে। ওখানে কেবল কার স্টেশন।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছে কেবল, মিশেছে গিয়ে বহু উপরের আরেকটি বড় স্টেশনে। ওটা পোলার আইল্যাণ্ডের ক্লিফের মাথায়। দেখলে মনে হয়, যে-কোনও সময়ে পিছলে নেমে আসবে সাগরের বুকে। টার্মিনাল ধূসর কংক্রিটের— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গান এমপ্লেসমেন্টের মতই ভয়ঙ্কর দুর্গম লাগছে।

কিন্তু ওই পথেই যেতে হবে ওদের।

এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

‘চমকে দেয়ার সুযোগ হারিয়েছি,’ গম্ভীর সুরে বলল রানা। ‘দলে অনেক লোক, তা-ও নয়। এখন বাঁচার একমাত্র উপায় ঝটপট কাজ করা। ঝড়ের মতই যাব আমরা, হামলা করব বাঘের মত— ওরা ঠেকিয়ে দেয়ার আগেই সফল হতে হবে।’

.

জলদি হাঁটো!’ তাড়া দিল রানা।

চলেছে ওরা পিচ-ঢালা পথ ধরে। সামনেই অ্যাসিড দ্বীপের মাঝে ওয়্যারহাউসের মত পরিত্যক্ত, বড় দালান।

ওয়্যারহাউসের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে থমকে গেল ওরা। চারপাশে ফুটবল মাঠের সমান প্রকাণ্ড এক হলরুম। ছাত থেকে নেমেছে ঝুলন্ত, মস্ত এক ক্যাটওয়াক। ওটার মাধ্যমে যাওয়া যায় ঘরের যে-কোনও জায়গায়। এই বিশাল ঘরে তেইশটি অশুভ চেহারার ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যাট। প্রধান ক্যাটওয়াক থেকে সরু সব শাখা ক্যাটওয়াক গেছে বৃত্তাকার ভ্যাটগুলোর পাশে। এ ছাড়া মেঝেতে নামবার জন্য রয়েছে নানাদিকে মই।

স্টিলের দেয়াল ঘিরেছে প্রতিটি ভ্যাট। একেকটা ভ্যাট মাঝারি আকারের সুইমিং পুলের সমান। কোনও কোনোটার উপর প্রেশারাইড্ ঢাকনি। অন্যগুলো খোলা। দেখা যাচ্ছে নানা রঙের তরল— কোনোটা হলদে, কোনোটা বাদামি, কোনোটা সবুজ। জমাট বেঁধে গেছে কোনও কোনও ভ্যাটের তরল। অন্যগুলো বলকে উঠছে। কিছু ভ্যাটের সঙ্গে রয়েছে জটিল পাইপের জঙ্গল ও বড় সব ভাল্‌ভ্। একটা ভ্যাটের উপর ঝুলছে মানুষকে বন্দি করে রাখবার এক খাঁচা, খানিকটা ক্ষয়ে গেছে ইস্পাতের শিক।

রানা হাঁটতে শুরু করতেই সঙ্গে চলল অন্যরা।

‘অ্যাসিড ল্যাবোরেটরি,’ বললেন ডক্টর তারাসভ। ‘এখানে অ্যাসিড নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতাম আমরা। যাতে ব্যবহার করা যায় কেমিকেল ওয়েপনে। তৈরি হতো অ্যাসিড গ্রেনেড। এ ছাড়া বন্দিদের নির্যাতন করতেও ব্যবহার করা হতো অ্যাসিড।’

‘বন্দিদের ওপর নির্যাতন?’ পাশ থেকে জানতে চাইল নিশাত।

‘হ্যাঁ,’ বললেন ডক্টর। ‘ধরুন, অ্যাসিডের ভেতর নামিয়ে দেয়া হলো কাউকে। চোখের সামনে সে দেখল চড়-চড় করে উঠে আসছে সারাদেহের ত্বক। তখন তাকে জিজ্ঞেসাবাদ করলে কে আছে যে মুখ বুজে রাখবে?’

‘আপনারা রাশানরা… আর আমেরিকানরা… আপনারা আর মানুষ নেই— একেবারে পশু!’ থমকে দাঁড়িয়ে গেছে নিশাত।

‘হাঁটতে থাকুন সবাই,’ বলল গম্ভীর রানা।

নীচে চোখ রেখেছে, দেখল প্রথমতলায় সীসার পুরু একটা দরজা। ওটাকে খানিক আড়াল দিয়েছে সরু এক ক্যাটওয়াক। দরজাটা ব্যাঙ্কের ভল্টের মতই, কিন্তু তার উপর আঁকা নিউক্লিয়ার সিম্বল। রাশান ভাষায় কী যেন লেখা। রানা আঁচ করল, ওখানে রাখা হতো রেডিয়োঅ্যাকটিভ মেটারিয়াল।

রানার হাঁটবার গতি কমে আসতেই থেমে গেছে ফারিয়া।

‘আমরা এখানে থামব না,’ তাড়া দিল রানা। ‘সোজা যাব কেবল কারের কাছে।’

কয়েক মিনিট পর অ্যাসিড ওয়্যারহাউস পিছনে ফেলল ওরা, পৌছে গেল শর্ট কাট পথে কেবল কার স্টেশনে।

সামনেই দেখা গেল পোলার আইল্যাণ্ড— প্রকাণ্ড, দুর্গম, আকাশ ছুঁয়ে মাথা তুলেছে পাথুরে সব ক্লিফ। দ্বীপে উঠতে চাইলে একমাত্র উপায় দীর্ঘ ওই কেবলে ঝুলে যাওয়া। কেবল কার স্টেশন থেকে অনেক উপরে ক্লিফের মাথায় দ্বিতীয় টার্মিনাল।

কেবল কার স্টেশনে ঢুকে রানা দেখল, প্ল্যাটফর্মের পাশে কেবল থেকে ঝুলছে একটি মাত্র কেবল কার- আকারে বড়সড় একটা বাসের মতই।

‘কেবলের অন্যপ্রান্তে অপেক্ষা করবে শত্রুরা,’ বলল শ্যারন। ‘এ পথে গেলে বাঁচব না কেউ।’

‘ওই টার্মিনালে ঢুকলেই গুলি শুরু করবে,’ সায় দিল নিশাত।

‘জানি,’ আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। ‘কাজেই গুলি করতে করতে ঢুকতে হবে।’

কয়েকবার চালু করবার চেষ্টা হলো কেবল কার।

প্রতিবার ব্যর্থ হলেন ডক্টর তারাসভ।

অবশ্য, কয়েক মিনিট ইঞ্জিন ঘাঁটাঘাঁটি করবার পর কেবল কার চালু করল ক্যাপ্টেন ম্যাক পাওলো।

এক মিনিট পর ভীষণ গোঙাতে গোঙাতে রওনা হলো কেবল কার। স্টেশন থেকে বেরিয়ে উঠতে লাগল পোলার আইল্যাণ্ডের দিকে।

পাক্কা তিন শ’ মিটার উঠতে হবে।

তাতে লাগবে পুরো দু’মিনিট।

দীর্ঘ যাত্রা। অনেক নীচে সাগর।

নির্ধারিত গতি নিয়ে মৃত্যুদ্বীপের দিকে উঠছে কেবল কার।

সর্বক্ষণ ওটাকে চোখে চোখে রাখা হলো।

উপরের টার্মিনালে অপেক্ষা করছে রাফিয়ান আর্মির দশজন

যোদ্ধা, হাতে কক করা অস্ত্র।

‘থারমাল স্ক্যান চালু করা হয়েছে, তাদের একজন বলল। টার্মিনাল প্ল্যাটফর্মের শুরুতে দাঁড়িয়েছে সে। আর মাত্র দুই পা গেলে তিন শ’ ফুট উঁচু ক্লিফ থেকে পড়বে গিয়ে সাগরে। উঠে আসা কেবল কারের দিকে তাক করল সে ইনফ্রা-রেড স্ক্যানার। ‘না, কেউ নেই কারে…’

ভয়ানকভাবে ভুরু কুঁচকে ফেলল কমাণ্ডিং অফিসার। দলের সবাই তাকে আড়ালে ডাকে: কসাই।

‘গায়ের তাপ লুকাতে থারমাল ব্ল্যাঙ্কেট ব্যবহার করছে বোধহয়। অস্ত্র তৈরি রাখো। ওটা এলেই গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেবে।’

কেবল কার আসবে, সেজন্য অপেক্ষা করছে কসাই এবং তার দলের সবাই। বাগিয়ে ধরেছে অস্ত্র। আগেই অফ করে দেয়া হয়েছে সেফটি ক্যাচ।

একজনের বুকের হার্নেসে ফ্লেমথ্রোয়ার ইউনিট। ওটার মুখে ধিকি-ধিকি জ্বলছে নীল আগুন।

ধপ্!

প্ল্যাটফর্মের পাশে এসে থামল কেবল কার। সরসর করে খুলে যেতে শুরু করেছে স্লাইডিং ডোর…

দলের সবাইকে নিয়ে তৈরি কসাই…

পুরো খুলে গেল দরজা…

এবং কসাইয়ের দলের সবাই দেখল কেউ নেই কারে।

ওদের ভুল হয়েছে।

ওরা উপরের দিকে চেয়েছে।

যতক্ষণে চোখ নামাল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

মেশিনগান চালু করেছে রোবট বন্ধু।

ষাট ডিগ্রি ঘুরে এল মেশিনগানের ব্যারেল।

কমপক্ষে দুই শ’ গুলি গেল শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে।

বাঁচবার সুযোগই ছিল না কসাইয়ের দলের কারও।

যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই পড়ে রইল ক্ষত-বিক্ষত লাশ হয়ে।

এবার চাকা গড়িয়ে কে কার থেকে নামল বন্ধু। পযিশন নিল টার্মিনালের দরজার দিকে ঘুরে। যেন অতন্দ্র প্রহরী।

এবার অ্যাসিড দ্বীপের স্টেশনে দাঁড়িয়ে কেবল কার ডেকে নিল রানা।

নীচের দিকে রওনা হয়ে গেল ঝুলন্ত বাস।

রানা জানে, ওদের হাতে মাত্র চার মিনিট আছে।

কেবল কার অ্যাসিড দ্বীপে নামতে দু’মিনিট লাগবে এবং আবারও পোলার আইল্যাণ্ডের টার্মিনালে পৌঁছবার জন্য দু’মিনিট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *