ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো , রাখো রাখো খুলে রাখো , শিয়রের ওই জানলা দুটো — গায়ে লাগুক হাওয়া । ওষুধ ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া । তিতো কড়া কত ওষুধ খেলেম এ জীবনে , দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে । বেঁচে থাকা , সেই যেন এক রোগ ; কত রকম কবিরাজি , কতই মুষ্টিযোগ , একটুমাত্র অসাবধানেই , বিষম কর্মভোগ । এইটে ভালো , ওই টে মন্দ , যে যা বলে সবার কথা মেনে , নামিয়ে চক্ষু , মাথায় ঘোমটা টেনে , বাইশ বছর কাটিয়ে দিলেম এই তোমাদের ঘরে । তাই তো ঘরে পরে , সবাই আমায় বললে লক্ষ্মী , সতী , ভালোমানুষ অতি! এ সংসারে এসেছিলেম ন-বছরের মেয়ে , তার পরে এই পরিবারের দীর্ঘ গলি বেয়ে দশের ইচ্ছা বোঝাই-করা এই জীবনটা টেনে টেনে শেষে পৌঁছিনু আজ পথের প্রান্তে এসে । সুখের দুখের কথা একটুখানি ভাবব এমন সময় ছিল কোথা । এই জীবনটা ভালো , কিংবা মন্দ , কিংবা যা-হ ো ক একটা-কিছু সে-কথাটা বুঝব কখন , দেখব কখন ভেবে আগুপিছু । একটানা এক ক্লান্ত সুরে কাজের চাকা চলছে ঘুরে ঘুরে । বাইশ বছর রয়েছি সেই এক-চাকাতেই বাঁধা পাকের ঘোরে আঁধা । জানি নাই তো আমি যে কী , জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা কী অর্থে যে ভরা । শুনি নাই তো মানুষের কী বাণী মহাকালের বীণায় বাজে । আমি কেবল জানি , রাঁধার পরে খাওয়া , আবার খাওয়ার পরে রাঁধা , বাইশ বছর এক-চাকাতেই বাঁধা । মনে হচ্ছে সেই চাকাটা — ঐ যে থামল যেন ; থামুক তবে । আবার ওষুধ কেন । বসন্তকাল বাইশ বছর এসেছিল বনের আঙিনায় । গন্ধে বিভোল দক্ষিণ বায় দিয়েছিল জলস্থলের মর্ম-দোলায় দোল ; হেঁকেছিল , “ খোল্ রে দুয়ার খোল্ । ” সে যে কখন আসত যেত জানতে পেতেম না যে । হয়তো মনের মাঝে সংগোপনে দিত নাড়া ; হয়তো ঘরের কাজে আচম্বিতে ভুল ঘটাত ; হয়তো বাজত বুকে জন্মান্তরের ব্যথা ; কারণ-ভোলা দুঃখে সুখে হয়তো পরান রইত চেয়ে যেন রে কার পায়ের শব্দ শুনে , বিহ্বল ফাল্গুনে । তুমি আসতে আপিস থেকে , যেতে সন্ধ্যাবেলায় পাড়ায় কোথা শতরঞ্জ খেলায় । থাক্ সে-কথা । আজকে কেন মনে আসে প্রাণের যত ক্ষণিক ব্যাকুলতা । প্রথম আমার জীবনে এই বাইশ বছর পরে বসন্তকাল এসেছে মোর ঘরে । জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে আনন্দে আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে — আমি নারী , আমি মহীয়সী , আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না-বীণায় নিদ্রাবিহীন শশী । আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা , মিথ্যা হত কাননে ফুল-ফোটা । বাইশ বছর ধরে মনে ছিল বন্দী আমি অনন্তকাল তোমাদের এই ঘরে । দুঃখ তবু ছিল না তার তরে , অসাড় মনে দিন কেটেছে , আরো কাটত আরো বাঁচলে পরে । যেথায় যত জ্ঞাতি লক্ষ্মী ব ' লে করে আমার খ্যাতি ; এই জীবনে সেই যেন মোর পরম সার্থকতা — ঘরের কোণে পাঁচের মুখের কথা! আজকে কখন মোর কাটল বাঁধন-ডোর । জনম মরণ এক হয়েছে ওই যে অকূল বিরাট মোহানায় , ঐ অতলে কোথায় মিলে যায় ভাঁড়ার-ঘরের দেয়াল যত একটু ফেনার মতো । এতদিনে প্রথম যেন বাজে বিয়ের বাঁশি বিশ্ব-আকাশ মাঝে । তুচ্ছ বাইশ বছর আমার ঘরের কোণের ধুলায় পড়ে থাক । মরণ-বাসর ঘরে আমায় যে দিয়েছে ডাক দ্বারে আমার প্রার্থী সে যে , নয় সে কেবল প্রভু , হেলা আমায় করবে না সে কভু । চায় সে আমার কাছে আমার মাঝে গভীর গোপন যে সুধারস আছে গ্রহতারার সভার মাঝখানে সে ঐ যে আমার মুখে চেয়ে দাঁড়িয়ে হোথায় রইল নির্নিমেষে । মধুর ভুবন , মধুর আমি নারী , মধুর মরণ , ওগো আমার অনন্ত ভিখারি । দাও , খুলে দাও দ্বার , ব্যর্থ বাইশ বছর হতে পার করে দাও কালের পারাবার ।