ওপার হতে এপার পানে খেয়া-নৌকো বেয়ে ভাগ্য নেয়ে দলে দলে আনছে ছেলে মেয়ে । সবাই সমান তারা এক সাজিতে ভরে-আনা চাঁপা ফুলের পারা । তাহার পরে অন্ধকারে কোন্ ঘরে সে পৌঁছিয়ে দেয় কারে! তখন তাদের আরম্ভ হয় নব নব কাহিনী-জাল বোনা — দুঃখে সুখে দিনমুহূর্ত গোনা । একে একে তিনটি মেয়ের পরে শৈল যখন জন্মাল তার বাপের ঘরে , জননী তার লজ্জা পেল ; ভাবল কোথা থেকে অবাঞ্ছিত কাঙালটারে আনল ঘরে ডেকে । বৃষ্টিধারা চাইছে যখন চাষি নামল যেন শিলাবৃষ্টিরাশি । বিনা-দোষের অপরাধে শৈলবালার জীবন হল শুরু , পদে পদে অপরাধের বোঝা হল গুরু । কারণ বিনা যে-অনাদর আপনি ওঠে জেগে বেড়েই চলে সে যে আপন বেগে । মা তারে কয় ‘ পোড়ারমুখী ' , শাসন করে বাপ — এ কোন্ অভিশাপ হতভাগী আনলি বয়ে — শুধু কেবল বেঁচে-থাকার পাপ । যতই তারা দিত ওরে গালি নির্মলারে দেখত মলিন মাখিয়ে তারে আপন কথার কালি । নিজের মনের বিকারটিরেই শৈল ওরা কয় , ওদের শৈল বিধির শৈল নয় । আমি বৃদ্ধ ছিনু ওদের প্রতিবেশী । পাড়ায় কেবল আমার সঙ্গে দুষ্টু মেয়ের ছিল মেশামেশি । ‘ দাদা ' বলে গলা আমার জড়িয়ে ধরে বসত আমার কোলে । নাম শুধালে শৈল আমায় বলত হাসি হাসি — ‘ আমার নাম যে দুষ্টু , সর্বনাশী! ' যখন তারে শুধাতেম তার মুখটি তুলে ধরে ‘ আমি কে তোর বল দেখি ভাই মোরে ? ' বলত ‘ দাদা , তুই যে আমার বর! ' — এমনি করে হাসাহাসি হত পরস্পর । বিয়ের বয়স হল তবু কোনোমতে হয় না বিয়ে তার — তাহে বাড়ায় অপরাধের ভার । অবশেষে বর্মা থেকে পাত্র গেল জুটি । অল্পদিনের ছুটি ; শুভকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি মেয়েটিরে সঙ্গে নিয়ে রেঙ্গুনে তার দিতে হবে পাড়ি । শৈলকে যেই বলতে গেলেম হেসে — ‘ বুড়ো বরকে হেলা করে নবীনকে , ভাই , বরণ করলি শেষে ? ' অমনি যে তার দু-চোখ গেল ভেসে ঝরঝরিয়ে চোখের জলে । আমি বলি , ‘ ছি ছি , কেন , শৈল , কাঁদিস মিছিমিছি , করিস অমঙ্গল । ' বলতে গিয়ে চক্ষে আমার রাখতে নারি জল । বাজল বিয়ের বাঁশি , অনাদরের ঘর ছেড়ে হায় বিদায় হল দুষ্টু সর্বনাশী । যাবার বেলা বলে গেল , ‘ দাদা , তোমার রইল নিমন্ত্রণ , তিন-সত্যি — যেয়ো যেয়ো । ' ‘ যাব , যাব , যাব বই কি বোন । ' আর কিছু না বলে আশীর্বাদের মোতির মালা পরিয়ে দিলেম গলে । চতুর্থ দিন প্রাতে খবর এল , ইরাবতীর সাগর-মোহানাতে ওদের জাহাজ ডুবে গেছে কিসের ধাক্কা খেয়ে । আবার ভাগ্য নেয়ে শৈলরে তার সঙ্গে নিয়ে কোন্ পারে হায় গেল নৌকো বেয়ে কেন এল কেনই গেল কেই বা তাহা জানে । নিমন্ত্রণটি রেখে গেল শুধু আমার প্রাণে । যাব যাব যাব , দিদি , অধিক দেরি নাই , তিন-সত্যি আছে তোমার , সে-কথা কি ভুলতে পারি ভাই । আরো একটি চিহ্ন তাহার রেখে গেছে ঘরে খবর পেলেম পরে । গালিয়ে বুকের ব্যথা লিখে রাখি এইখানে সেই কথা — দিনের পরে দিন চলে যায় ওদের বাড়ি যাই নে আমি আর । নিয়ে আপন একলা প্রাণের ভার আপন মনে থাকি আপন কোণে । হেনকালে একদা মোর ঘরে সন্ধ্যাবেলায় বাপ এল তার কিসের তরে । বললে , “ খুড়ো একটা কথা আছে , বলি তোমার কাছে । শৈল যখন ছোটো ছিল , একদা মোর বাক্স খুলে দেখি হিসাব-লেখা খাতার ‘ পরে এ কী হিজিবিজি কালির আঁচড় । মাথায় যেন পড়ল ক্রোধের বাজ । বোঝা গেল শৈলরি ই এ কাজ । মারা-ধরা গালিমন্দ কিছুতে তার হয় না কোনো ফল — হঠাৎ তখন মনে এল শাস্তির কৌশল । মানা করে দিলেম তারে তোমার বাড়ি যাওয়া একেবারে । সবার চেয়ে কঠিন দন্ড! চুপ করে সে রইল বাক্যহীন বিদ্রোহিণী বিষম ক্রোধে । অবশেষে বারো দিনের দিন গরবিনী গর্ব ভেঙে বললে এসে , ‘ আমি আর কখনো করব না দুষ্টামি । ' আঁচড়-কাটা সেই হিসাবের খাতা , সেই কখানা পাতা , আজকে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে তারি চোখের মতো । হিসাবের সেই অঙ্কগুলার সময় হল গত সে শাস্তি নেই , সে দুষ্টু নেই ; রইল শুধু এই চিরদিনের দাগা শিশু-হাতের আঁচড় কটি আমার বুকে লাগা । ”