ছিন্ন পত্র

কর্ম যখন দেবতা হয়ে জুড়ে বসে পূজার বেদী , 
               মন্দিরে তার পাষাণ-প্রাচীর অভ্রভেদী 
                   চতুর্দিকেই থাকে ঘিরে ; 
          তারই মধ্যে জীবন যখন শুকিয়ে আসে ধীরে ধীরে 
পায় না আলো , পায় না বাতাস , পায় না ফাঁকা , পায় না কোনো রস , 
                   কেবল টাকা , কেবল সে পায় যশ , 
                   তখন সে কোন্‌ মোহের পাকে 
          মরণ - দশা ঘটেছে তার , সেই কথাটাই ভুলে থাকে । 
  
  
          আমি ছিলেম জড়িয়ে পড়ে সেই বিপাকের ফাঁসে ; 
                             বৃহৎ সর্বনাশে 
                    হারিয়েছিলেম বিশ্বজগৎখানি । 
                   নীল আকাশের সোনার বাণী 
           সকাল-সাঁঝের বীণার তারে 
           পৌঁছত না মোর বাতায়ন-দ্বারে । 
ঋতুর পরে আসত ঋতু শুধু কেবল পঞ্জিকারই পাতে , 
                   আমার আঙিনাতে 
     আনত না তার রঙিন পাতার ফুলের নিমন্ত্রণ । 
     অন্তরে মোর লুকিয়ে ছিল কী যে সে ক্রন্দন 
          জানব এমন পাই নি অবকাশ । 
               প্রাণের উপবাস 
          সংগোপনে বহন করে কর্মরথে 
     সমারোহে চলতেছিলেম নিষ্ফলতার মরুপথে । 
     তিনটে চারটে সভা ছিল জুড়ে আমার কাঁধ ; 
দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে ছাড়তে হত নকল সিংহনাদ ; 
     বীডন কুঞ্জে মীটিং হলে আমি হতেম বক্তা ; 
          রিপোর্ট লিখতে হত তক্তা তক্তা ; 
               যুদ্ধ হত সেনেট-সিন্ডিকেটে , 
তার উপরে আপিস আছে , এমনি করে কেবল খেটে খেটে 
               দিনরাত্রি যেত কোথায় দিয়ে । 
               বন্ধুরা সব বলত , “ করছ কী এ । 
                   মারা যাবে শেষে! ” 
                   আমি বলতেম হেসে , 
               “ কী করি ভাই , খাটতে কি হয় সাধে । 
               একটু যদি ঢিল দিয়েছি অমনি গলদ বাধে , 
                   কাজ বেড়ে যায় আরো — 
               কী করি তার উপায় বলতে পার ো ?” 
বিশ্বকর্মার সদর আপিস ছিল যেন আমার ‘ পরেই ন্যস্ত , 
          অহোরাত্রি এমনি আমার ভাবটা ব্যতিব্যস্ত । 
  
  
               সেদিন তখন দু-তিন রাত্রি ধরে 
          গত সনের রিপোর্টখানা লিখেছি খুব জোরে । 
               বাছাই হবে নতুন সনের সেক্রেটারি , 
           হপ্তা তিনেক মরতে হবে ভোট কুড়োতে তার ই । 
               শীতের দিনে যেমন পত্রভার 
          খসিয়ে ফেলে গাছগুলো সব কেবল শাখা-সার , 
               আমার হল তেমনি দশা ; 
          সকাল হতে সন্ধ্যা-নাগাদ এক টেবিলেই বসা ; 
               কেবল পত্র রওনা করা , 
                কেবল শুকিয়ে মরা । 
          খবর আসে “ খাবার তৈরি ”, নিই নে কথা কানে , 
                     আবার যদি খবর আনে , 
                        বলি ক্রোধের ভরে 
          “ মরি এমন নেই অবসর , খাওয়া তো থাক ্ পরে । ” 
  
  
               বেলা যখন আড়াইটে প্রায় , নিঝুম হল পাড়া , 
           আর-সকলে স্তব্ধ কেবল গোটাপাঁচেক চড়ুই পাখি ছাড়া ; 
                   এমন সময় বেহারাটা ডাকের পত্র নিয়ে 
                        হাতে গেল   দিয়ে । 
               জরুরি কোন্‌ কাজের চিঠি ভেবে 
          খুলে দিখি বাঁকা লাইন , কাঁচা আখর চলছে উঠে নেবে , 
                    নাইকো দাঁড়ি-কমা , 
   শেষ লাইনে নাম লেখা তার মনোরমা । 
          আর হল না পড়া , 
মনে হল কোন্‌ বিধবার ভিক্ষাপত্র মিথ্যা কথায় গড়া , 
     চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে আবার লাগি কাজে । 
          এমনি করে কোন্‌ অতলের মাঝে 
             হপ্তা তিনেক গেল ডুবে । 
               সূর্য ওঠে পশ্চিমে কি পুবে , 
     সেই কথাটাই ভুলে গেছি , চলছি এমন চোটে । 
এমন সময় ভোটে 
                    আমার হল হার , 
                শত্রুদলে আসন আমার করলে অধিকার ; 
                             তাহার পরে খালি 
                                কাগজপত্রে চলল গালাগালি । 
  
  
               কাজের মাঝে অনেকটা ফাঁক হঠাৎ পড়ল হাতে , 
          সেটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছি বসে আরাম - কেদারাতে ; 
                   এমন সময় হঠাৎ দখিন-পবনভরে 
          ছেঁড়া চিঠির টুকরো এসে পড়ল আমার কোলের ' পরে । 
               অন্যমনে হাতে তুলে 
এই কথাটা পড়ল চোখে , “ মনুরে কি গেছ এখন ভুলে । ” 
মনু ? আমার মনোরমা ? ছেলেবেলার সেই মনু কি এই । 
          অমনি হঠাৎ এক নিমেষেই 
              সকল শূন্য ভরে , 
হারিয়ে-যাওয়া বসন্ত মোর বন্যা হয়ে ডুবিয়ে দিল মোরে । 
     সেই তো আমার অনেক কালের পড়োশিনী , 
          পায়ে পায়ে বাজাত মল রিনিঝিনি । 
     সেই তো আমার এই জনমের ভোর-গগনের তারা 
          অসীম হতে এসেছে পথহারা ; 
     সেই তো আমার শিশুকালের শিউলিফুলের কোলে 
                   শুভ্র শিশির দোলে ; 
          সেই তো আমার মুগ্ধ চোখের প্রথম আলো , 
          এই ভুবনের সকল ভালোর প্রথম ভালো । 
     মনে পড়ে , ঘুমের থেকে যেমনি জেগে ওঠা 
          অমনি ওদের বাড়ির পানে ছোটা । 
     ওর ই সঙ্গে শুরু হত দিনের প্রথম খেলা ; 
          মনে পড়ে , পিঠের ' পরে চুলটি মেলা 
     সেই আনন্দমূর্তিখানি , স্নিগ্ধ ডাগর আঁখি , 
          কণ্ঠ তাহার সুধায় মাখামাখি । 
অসীম ধৈর্যে সইত সে মোর হাজার অত্যাচার 
          সকল কথায় মানত মনু হার । 
     উঠে গাছের আগডালেতে দোলা খেতেম জোরে , 
           ভয় দেখাতেম পড়ি-পড়ি ক ' রে , 
       কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে তাহার করুণ মিনতি সে , 
               ভুলতে পারি কি সে । 
          মনে পড়ে , নীরব ব্যথা তার , 
          বাবার কাছে যখন খেতেম মার ; 
          ফেলেছে সে কত চোখের   জল , 
       মোর অপরাধ ঢাকা দিতে খুঁজত কত ছল । 
               আরো কিছু বড়ো হলে 
       আমার কাছে নিত সে তার বাংলা পড়া বলে । 
          নামতাটা তার কেবল যেত বেধে , 
তাই নিয়ে মোর একটু হাসি সইত না সে , উঠত লাজে কেঁদে । 
           আমার হাতে মোটা মোটা ইংরেজি বই দেখে 
          ভাবত মনে , গেছে যেন কোন্‌ আকাশে ঠেকে 
               রাশীকৃত মোর বিদ্যার বোঝা । 
যা-কিছু সব বিষম কঠিন , আমার কাছে যেন নেহাত সোজা । 
                   হেনকালে হঠাৎ সেবার , 
               দশমীতে দ্বারিগ্রামে ঠাকুর ভাসান দেবার 
               রাস্তা নিয়ে দুই পক্ষের চাকর-দরোয়ানে 
             বকাবকি লাঠালাঠি বেধে গেল গলির মধ্যখানে । 
     তাই নিয়ে শেষ বাবার সঙ্গে মনুর বাবার বাধল মকদ্দমা , 
          কেউ কাহারে করলে না আর ক্ষমা । 
               দুয়ার মোদের বন্ধ হল , 
          আকাশ যেন কালো মেঘে অন্ধ হল , 
       হঠাৎ এল কোন্‌ দশমী সঙ্গে নিয়ে ঝঞ্ঝার গর্জন , 
               মোর প্রতিমার   হল বিসর্জন । 
                দেখাশোনা ঘুচল যখন এলেম যখন দূরে , 
     তখন প্রথম শুনতে পেলেম কোন্‌ প্রভাতী সুরে 
           প্রাণের বীণা বেজেছিল কাহার হাতে । 
                      নিবিড় বেদনাতে 
মুখখানি তার উঠল ফুটে আঁধার পটে সন্ধ্যাতারার মতো ; 
          একই সঙ্গে জানিয়ে দিলে সে যে আমার কত , 
                 সে যে আমার কতখানিই নয়! 
প্রেমের শিখা জ্বলল তখন , নিবল যখন চোখের পরিচয় । 
  
  
                   কত বছর গেল চলে , 
       আবার গ্রামে গিয়েছিলেম পরীক্ষা পাস হলে । 
গিয়ে দেখি , ওদের বাড়ি কিনেছে কোন্‌ পাটের কুঠিয়াল , 
                   হল অনেক কাল । 
                   বিয়ে করে মনুর স্বামী 
কোন্‌ দেশে যে নিয়ে গেছে , ঠিকানা তার খুঁজে না পাই আমি । 
          সেই মনু আজ এতকালের অজ্ঞাতবাস টুটে 
             কোন্‌ কথাটি পাঠাল তার পত্রপুটে । 
             কোন্‌ বেদনা দিল তারে নিষ্ঠুর সংসার —     
      মৃত্যু সে কি । ক্ষতি সে কি । সে কি অত্যাচার । 
           কেবল কি তার বাল্যসখার কাছে 
           হৃদয়ব্যথার সান্ত্বনা তার আছে । 
                   ছিন্ন চিঠির বাকি 
     বিশ্বমাঝে কোথায় আছে খুঁজে পাব না কি । 
               “ মনুরে কি গেছ ভুলে । ” 
     এ প্রশ্ন কি অনন্ত কাল রইবে দুলে 
       মোর জগতের চোখের পাতায় একটি ফোঁটা চোখের জলের মতো । 
             কত চিঠির জবাব লিখব কত , 
এই কথাটির জবাব শুধু নিত্য বুকে জ্বলবে বহ্নিশিখা , 
          অক্ষরেতে হবে না আর লিখা । 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *