মানুষ জীবনানন্দ – ৪

শিশুকাল থেকেই কবির অন্তরঙ্গতা ছিল তাঁর মায়ের সঙ্গেই সব চাইতে বেশী। কাজেই আদর আবদার যা কিছু সবই ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের বউ হিসেবে তাঁর বেশীর ভাগ সময় কাটত রান্নাঘরের নানা কাজে। তাই কবিকে বেশ খানিকটা সময় তাঁর ঠাকুমার কাছেই থাকতে হ’ত। সেই সময় তিনি কবিকে অনেক গল্প শোনাতেন। ঠাকুমার কাছেই তিনি শুনেছেন কীর্তিনাশার কীর্তিকথা। শুনেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের বহু কাহিনী। 

বরিশালে বগুড়া রোডে ৫/৬ বিঘা জমির উপরে কবির ঠাকুরদাদা বাড়ি করেছিলেন। সেই জমির কোথায় আনারসের রং হলুদ হয়েছে, গাছে ক’টা আম ক’টা কাঁঠাল পেকেছে, কোন্ গাছটার জাম বেশী সুস্বাদু সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে। 

গ্রীষ্মের দুপুরে ঠাকুমা যখন তাঁর অতিপ্রিয় আচারের শিশি, বোতল অথবা আমসত্ব রোদে দিয়ে কবিকে পাহারা দিতে ডাকতেন, তিনি সানন্দে রাজী হয়ে যেতেন। ফলে আচার এবং আমসত্বের পরিমাণ রোজই কিছুটা কমে যেত। এ কাজ অবিশ্যি তিনি নির্বিকার চিত্তেই ক’রে যেতেন। 

ঠাকুমার একজন ভাই ছিলেন। তিনি, কবি ও কবির ছোট ভাই অশোকানন্দ একই ঘরে শুতেন। কবির মুখেই গল্প শুনেছি–শীতের রাতে সেই ভদ্রলোকের লেপের কোণে মোটা সুতো অথবা সরু দড়ি বেঁধে তার মুখটা দু-ভাই নিজেদের হাতের ভিতরে রেখে দিতেন। তিনি যখন আরাম ক’রে লেপখানা গায়ে জড়িয়ে ঘুমোতে আরম্ভ করতেন, তখনই দেখা যেত সেখানা তাঁর গা থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আরামে ঘুমানো আর তাঁর হ’ত না। কিন্তু কিছু বোঝারও উপায় ছিল না। কারণ দু ভাই তো লেপমুড়ি দিয়েই ঘুমুচ্ছে। 

সকালে এই ঘটনা শুনে কবির মা কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলতেন–এ কাজ কাদের। এ জন্যে কিছু স্নেহমাখা শাসনও ভোগ করতেন অপরাধীরা।

বাবার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল অতি সম্ভ্রমের। তাঁর মনের মণিকোঠাটি ভরা ছিল বাবার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায়। সে শ্রদ্ধা পরিমাপের ক্ষমতা বাইরের জগতের ছিল বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাঁর সামনে যেতে অথবা নিজে থেকে কথা বলতে তাঁকে আমি কোনদিনই দেখিনি। একদিনের একটি ঘটনা মনে পড়ে। 

বরিশালে আমাদের কাপড় কেনার জন্য একটি দোকান ঠিক করা ছিল। আমার শ্বশুরমশাই চিঠি লিখে দিলেই সেই দোকান থেকে কাপড় আনা হ’ত। 

শ্বশুরবাড়ি গিয়ে প্রথম থেকেই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে সংসারের প্রত্যেকটি লোকের জন্য আমার শাশুড়ী হাসিমুখে এবং অক্লান্ত ভাবেই তাঁর কর্তব্য করে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর কি দরকার বা কোনটা নেই সে কথা ভাববার দায়িত্ব কেউই নিতেন না। অথচ ছোটবড় সকলেই তাকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন তেমনি ভালবাসতেন। 

বরিশালের বাড়িতে প্রত্যেকেরই জন্মদিন পালন করা হত। শাশুড়ীর জন্মদিনে আমি দেখলাম, তিনি অতি আনন্দের সঙ্গে সকলকে খেতে দিচ্ছেন, সকলের সঙ্গে হাসি গল্প করছেন, কিন্তু পরে আছেন একখানি আধময়লা শাড়ি। লোকে কি মনে করবে এই লজ্জায় তিনি ধবধবে ফরসা শাড়ি কিছুতেই পরতে চাইতেন না। 

আমার কিন্তু খুবই খারাপ লাগল। আমি একবার কবিকে বললাম, ‘তোমরা দুই উপযুক্ত ছেলে থাকতে আজকের দিনে মায়ের একখানা ভাল শাড়ি জুটল না?’ 

কবি অম্লানবদনে উত্তরে দিলেন, ‘কাপড় কেনার ভার বাবার হাতে। আমি ওসবের মধ্যে নেই। মায়ের শাড়ির দরকার থাকলে তিনি নিজেই বাবাকে বলবেন।’ 

একেবারে নতুন বউ বলেই কবির এ মন্তব্য শুনেও আমাকে চুপ করেই থাকতে হ’ল। 

তার পরের বারে এই দিনটিতে সকাল-বেলাই কবিকে বললাম, ‘আমি কাপড় কিনব। তুমি বাবাকে বল দোকানে একখানা চিঠি দিতে।’ 

আমার কথা শুনে তিনি রীতিমত আঁতকে উঠলেন ‘ওরে বাবা! তোমার আবদার তো কম নয়। তোমার কাপড়ের শখ মেটাবার জন্য আমি বাবাকে বলতে যাব? পৃথিবী উল্টে গেলেও এ-কাজ আমার দ্বারা হবে না। তুমি মাকে গিয়ে বল।’ 

আমি তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা আমি নিজেই যদি বলি, তিনি কি রাগ করবেন?’ 

কবি তখন আমার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য উত্তর দিলেন, ‘তা একবার চেষ্টা করে দেখতে পার। কিন্তু এ বাড়িতে তুমি নতুন এসেছ। সেটা কি ভাল দেখাবে?’ 

আমি ‘দেখা যাক’ বলে সেখান থেকে উঠে সোজা আমার শ্বশুরমশাই- এর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি তখন বিছানায় শুয়ে একখানা বই পড়ছিলেন। আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসে কোনরকম ভূমিকা না করেই বললাম, ‘বাবা আমি কাপড় কিনব। দোকানে একখানা চিঠি লিখে দিন।’ 

দেবতা কাকে বলে জানি না। কিন্তু তাঁকে বোধ হয় আমি দেবতার চাইতেও বড় বলে মনে করতাম। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল অতি প্রখর। আমার কথা শুনে আস্তে আস্তে বইখানি বন্ধ করে রেখে আমার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘বেশ তো, বল, ক’খানা আনতে হবে? তুমি যে ক’খানা বলবে আমি তা-ই লিখে দেব।’ 

মনের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে আমি অনেকগুলো শাড়ির ফরমাস দিয়ে ফেললাম। কেন যে শাড়ি কিনতে চাইছি সেটা কবি না বুঝলেও তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। 

শ্বশুরমশাই-এর চিঠি পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই দোকানের একজন কর্মচারী দশ বারোখানা ভাল শাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। কাপড় দেখে কবির তো চোখ কপালে উঠবার যোগাড়। ‘সর্বনাশ! এ তুমি কি করলে? সত্যি সত্যিই বাবার কাছে কাপড়ের কথা বলতে পারলে? তোমার তো অনেক শাড়ি আছে, আবার না কিনলেই চলছিল না? না, তুমি আমাকে বরিশালে আর থাকতেই দেবে না দেখছি।’ 

আমি তখন শাড়ি বাছতে ভীষণ ব্যস্ত। মাথা না তুলেই উত্তর দিলাম, ‘সেই রকমই তো মনে হচ্ছে।’ 

আমার কথা শুনে কবি খুব বিরক্ত হয়েই সেখান থেকে চলে গেলেন। আমি সাদা একখানা ভাল ঢাকাই শাড়ি বেছে নিয়ে বাকি সব কাপড় ফেরৎ দিলাম। 

বিকেলে শাশুড়ী সকলকে খেতে দিতে যাবার আগে আমি তাঁর কাপড়ের আঁচল ধরে টেনে রেখে বললাম, ‘আপনি এ বেশে যেতে পারবেন না। একটু বসুন।’ বলেই আমি তাঁর হাতে একখানি চিরুণী দিয়ে বললাম, ‘নিন, আগে চুলটা আঁচড়ে ফেলুন তো।’ চুল আঁচড়ান হয়ে গেল আমি সেই শাড়িখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। 

তিনি তো হতভম্ব। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, ‘এসব তোমার কি পাগলামি? আমার কি সাজবার বয়েস আছে? তাছাড়া এ শাড়ি পরে আমি লোকের সামনে বের হব কি করে?’ 

‘তা কি করবেন? না হয় বেশি করে ঘোমটা দিয়েই যাবেন। কিন্তু এ খানা না পরলে আমি আজ আপনাকে কোন কাজই করতে দেব না।’–হাসিমুখেই আমি উত্তর দিলাম। 

তিনি আমাকে খুব ভালই চিনতেন। তাই আর ঘাঁটাতে সাহস না করে শাড়িখানা শেষ পর্যন্ত বাধ্য মেয়ের মত পরেই ফেললেন। তারপর আমি প্রথমেই কবিকে ডাকলাম। তিনি এসে তাঁর মায়ের দিকে তাকিয়েই বলে ফেললেন, ‘বাঃ! কুসুমকুমারীকে তো বেশ দেখাচ্ছে।’ 

মা চলে যেতেই তিনি আমার দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন আশীর্বাদই করলেন ‘বাবাকে বলে কোন কাজ করাবার সাহস আমার কোনদিন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। কিন্তু তুমি পারবে। সব অবস্থায় এগিয়ে যাবার মত সাহস এবং শক্তি তোমার আছে। এই শক্তিই তোমাকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারবে।’ 

কিন্তু মায়ের বেলা ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটতে দেখেছি। অথচ তিনি ছিলেন মা অন্ত প্রাণ। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে মায়ের স্নেহকোমল স্পর্শ না পেলে কোন কিছুই তাঁর পরিপূর্ণ হয়ে উঠত না। 

আমার শাশুড়ী চিরদিন পরের দরকারটাই বড় করে দেখেছেন। নিজের কথা ভাববার সময় তাঁর কখনই হত না। কতদিন দেখেছি-তাঁর প্রায় নতুন শাড়িখানা নিঃস্ব কোন পরিবারের বউ অথবা মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছেন। যদি কখনও বলেছি—‘মা, আপনার শাড়িখানা দিয়ে দিলেন?’ তিনি হাসিমুখে উত্তর দিতেন, ‘এই মেয়েটিকে সাহায্য চাইতে অনেক জায়গায় যেতে হবে। কাজেই একখানা আস্ত কাপড়ের যে এর একান্ত দরকার। তা ছাড়া আমাকে দেবার জন্য তো তোমরাই আছ। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেবার যে কেউ-ই নেই মা।’ 

তাঁকে যদি হাত-খরচের জন্য দশটা টাকাও দেওয়া হত, তার আট টাকাই তিনি পরের জন্য খরচ করে ফেলতেন। তাঁর যে থাকল না, এ নিয়ে কোনদিন সামান্য একটু দুঃখ প্রকাশ করতেও আমি শুনিনি। 

এসব ব্যাপারে কবি তাঁর মাকে ভালই চিনতেন। মা যখন ল্যান্সডাউন রোডে আমাদের বাড়িতে ছিলেন, তখনকার সময়ের একটা ঘটনা বলছি। 

গ্রীষ্মের এক দুপুরে আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম, নিদ্রা-দেবীর বহু আরাধনা করে সবে ঘুমটা একটু এসেছে, এমন সময় কানে গেল, ‘মিলু (কবির ডাক নাম) আমাকে একটা খাম দিবি?’ কথাটা বার দুই শুনলাম। বুঝলাম, মা কবির কাছে খাম চাইছেন। কিন্তু যাঁকে বলা, তাঁর কানে আদৌ ঢুকেছে বলে মনে হল না। 

বেশ কিছুক্ষণ পরে কবির গলা শোনা গেল। ‘আমাকে অনেকগুলো চিঠি লিখতে হবে। আমি পয়সা দিচ্ছি। তোমার যে কটা দরকার কাউকে দিয়ে আনিয়ে নাও। আর কাল হলে যদি চলে, তবে আমি নিজেই এনে দিতে পারি।’ 

কবির কথা শুনে মা চুপ করেই রইলেন। কিন্তু আমার আর সহ্য হল না। আমি কোনও কথা না বলে সোজা কবির ঘরে ঢুকে তাঁর টেবিল থেকে তিনটে খাম তুলে নিলাম। কবি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘কর কি? কর কি? সব কটা খামই আমার লাগবে।’ 

আমি খাম নিয়ে চলে আসতে আসতে বললাম, ‘পোস্ট-অফিস সামনেই। সোজা গিয়ে নিয়ে এস।’ 

কিন্তু মজা হল এই-মা খাম তো নিলেনই না, উল্টে আমাকে বললেন, ‘তুমি আবার ওর দরকারী খাম আনতে গেলে কেন? আমি তো আর নিজের জন্য চাইছি না। যাকে দেব, তাকে কাল দিলেও চলবে।’ 

আমি তখন রাগ করে খাম তিনটে কবির টেবিলেই ফেলে দিয়ে এলাম, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন, ‘এতদিনেও তুমি মাকে চিনলে না? আমি তো শোনা মাত্রই বুঝেছি যে, তিনি নিজের জন্য চাইছেন না।’ 

কবি অবিশ্যি তবে পরদিনই মাকে খাম এনে দিলেন। 

এইরকম বাবা মায়ের সন্তান হয়ে পৃথিবীতে আসতে পারায় কবি চিরদিন নিজেকে সৌভাগ্যবান বলেই মনে করেছেন। ঝড়, ঝঞ্ঝা, দুর্যোগের ঘনঘটা কালো আবরণে বহুবার তাঁর জীবনকে ঢেকে ফেলেছে–ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পথ হারিয়ে দিশেহারা তাঁকে হতে হয়েছে বৈকি। কিন্তু তাঁর মা বাবার আশীর্বাদই আলো হয়ে তাঁকে পথের সন্ধান দিয়েছে। শত বাধা অতিক্রম করে সোজা হয়ে হেঁটে যাবার শক্তি যুগিয়েছে। 

কবির কথা বলতে গিয়ে আজ মনে পড়ে কবির পরলোকগতা জেঠিমার কথা। মনে পড়ে তাঁর ছোট পিসিমার কথা। কাকা ব্রহ্মানন্দ দাশের সঙ্গে কবির সম্পর্কের কথা। 

আমাদের জেঠিমা অতি অল্প বয়সে সর্বানন্দ পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন। সেকালের মেয়ে তিনি। বিয়ের আগে লেখাপড়ার কোন সুযোগই তাঁর হয়নি। কিন্তু পরে নিজের চেষ্টায় বাংলা ছেড়ে ইংরেজীও তিনি ভালই শিখেছিলেন। কারণ আমি বরিশালে গিয়ে তাঁকে বহু ইংরেজী গল্পের বই পড়তে দেখেছি। 

এই জেঠিমা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবার পরে কবি আমাকে বলেছেন, ‘স্বামী এবং ছোট মেয়েটিকে (তিনটি মেয়ের মধ্যে) হারাবার পর তিনি যেন দ্বিধাহীনভাবেই নিজেকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। যেখানে অসুস্থ অসহায় মানুষ–সেখানেই আমাদের মমতাময়ী জেঠিমা রাত দুপুরেও যদি তিনি শুনতে পেতেন যে, পাড়ার কেউ খুবই বিপদে পড়েছে, অথবা অসুস্থ হয়ে কষ্ট পাচ্ছে; তাকে দেখবার কেউ-ই নেই, তিনি তখুনি ছুটে চলে গিয়েছেন তার কাছে। জাতের সংস্কার কোনদিনই তাঁকে এইসব অসহায় দুর্বল মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এই সেবাপরায়ণা মহিমাময়ী নারীর সান্নিধ্যে যিনিই এসেছেন, তিনিই নিজেকে ধন্য বলে মনে করেছেন-সান্ত্বনা পেয়েছেন মৃত্যুপথযাত্রী।’ 

মাতৃসমা জেঠিমা সম্বন্ধে কথাগুলি বলবার সময় কবির মনের দরদ এবং গভীর শ্রদ্ধা যেন প্রতিটি অক্ষরের ভিতর দিয়েই ঝরে পড়ছিল। 

কবির কাকা ব্রহ্মানন্দ দাশের কোন ছেলে না থাকায় তিনি তাঁর দাদার এই প্রথম সন্তানটিকে মনে মনে হয়ত গভীরভাবেই স্নেহ করতেন। তাই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাপাশে দেখেছি তাঁর অস্থির মনের ব্যাকুলতা। মুখে তিনি কিছুই প্রকাশ করেননি। শুধু দুটি হাত পিছনে মুষ্টিবদ্ধ করে অনবরত পায়চারি করেছেন। কি এক অব্যক্ত বেদনাভরে মাথা তাঁর নুয়ে নুয়ে পড়েছে। আমি নির্বাক হয়ে সবই লক্ষ্য করেছি। তাঁর তখনকার অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছে–তিনি শুধু যে কবির কথাই ভাবছেন, তা নয়, তাঁর দাদা এবং মেজো বৌঠানের (কবির বাবা, মা) কথা হয়তো স্মরণে আসছে তাঁর। কবির অবর্তমানে আমাদের কি হবে-এ কথাও হয়তো তিনি ভাবছেন। 

এই কাকা সম্বন্ধে কবিকে বহুবার বলতে শুনেছি, ‘আমাদের কাকাকে সহজে বোঝা যাবে না। মুখে তাঁর রুক্ষ ভাষা, কিন্তু অন্তরে তাঁর ফল্গুর ধারা। তাঁর কর্তব্যবোধ অসীম-পরিবারে তাঁর দানেরও সীমা নেই। কিন্তু সবই নীরবে। কোন প্রকার অভিব্যক্তিই তাঁর নেই।’ 

কবির ছোট পিসিমা চিরকুমারী স্বর্গীয়া স্নেহলতা দাশ যতদিন বেঁচে ছিলেন, পরিবারের সকলকে অন্তর দিয়েই আঁকড়ে ধরেছিলেন। মায়ের পরে এই ছোট পিসিমার সঙ্গে কবিকে মন খুলে কথা বলতে এমন কি হাসি ঠাট্টা করতেও দেখেছি। আবার মাকে হারিয়ে এই পিসিমার মধ্যেই মায়ের অস্তিত্বকে আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াতেও দেখেছি। 

ছোট পিসিমা আমাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে পণ্ডিতিয়া প্লেসে কাকার (শ্রীব্রহ্মানন্দ দাশ) বাড়িতে যাবার সময় যে মুহূর্তে বলেছেন, ‘মিলু এবারে যাই’, অমনি কবি তাঁর কবিতার খাতাপত্র ফেলে রেখে পিসিমার ডান হাতখানি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘এখনি কি যাবে? আর দু-একটা দিন থেকে যাও না। ভাইয়ের বাড়ি যাবার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? থাক, থাক। আরো যে কদিন পার, থাক না।’ তারপর ছেলেকে ডেকে বলতেন, ‘খোকন, দেখ তোর তিপীমা (আমার ছেলে ও মেয়ে পিসীমাকে এই নামেই ডাকত) চলে যাচ্ছেন।’ 

খোকন তখন দৌড়ে এসে পিসীমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গিয়ে বলত, ‘ইস্। গেলেই হল? ঠাকুরমার বদলে এখন তোমাকেই আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে।’ 

ছোট পিসীমা বহুদিন রোগশয্যায় পড়েছিলেন। শেষের দিকে একটু খেয়ালীও হয়েছিলেন। কারো কথাই শুনতে চাইতেন না। কিন্তু আমি যখনি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘পিসীমা, আমাকে চিনতে পারেন?’ তিনি এক গাল হেসে উত্তর দিয়েছেন, ‘ওমা, তুমি মিলুর বউ, তোমাকে চিনতে পারব না?’ তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন, ‘কাঁচা ছেলে মিলু চলে গেল। আর আমি পড়ে রইলাম’, বলতেন, আর দু চোখ বেয়ে টপ্ টপ্ করে জল পড়ত। পিসীমার মুখের এ কথা থেকেই বোঝা যায় যে কবির স্মৃতি তাঁর অবচেতন মনের অনেকখানিই অধিকার করে ছিল। 

কবি ছিলেন তাঁর বড় মামা প্রিয়নাথ দাশগুপ্তের অতি প্রিয়। তিনিই তাঁকে দীঘির জলে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিলেন–শিখিয়েছিলেন নানা গল্পের ভিতর দিয়ে আকাশের তারার সঙ্গে পরিচিত হতে। 

বড় মামা যখন নৌকা করে কোথাও যেতেন, কবিকেও সঙ্গে নিতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই বরিশালের গ্রাম্য প্রকৃতি, নদী, খাল এবং সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আন্তরিক পরিচয়ের সুযোগ তাঁর হয়েছিল। কবির কবিত্বে অভিষেক হয়তো সেই তখন থেকেই। 

আপাতদৃষ্টিতে কবি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু সেই গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকত তাঁর কৌতুক-প্রিয়তা। উপরে গাম্ভীর্যের একটা আবরণ থাকাতে তাঁর ঠাট্টা-তামাশা লোকে চট করে ধরতে পারত না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *