১
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি তখন সবেমাত্র ঢাকা ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছি। হস্টেলে থাকি। হঠাৎ একদিন সকালে শুনলাম জেঠামশাই বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন। পরদিন ক্লাশে অনেক পড়া, কাজেই মনে মনে একটু বিরক্তই হলাম।
আগের দিন বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তায় কাদা জমেছে। আমি সেই কাদার ভিতর দিয়েই হেঁটে চলেছি। ফলে আমার শাড়ীর পাড় আর জুতোর রং দুয়েরই চেহারা একেবারে অন্য রকম। সেই অবস্থায় বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম।
মাথায় লম্বা বেণী, কোমরে আঁচল শক্ত করে জড়ান। পায়ে আর শাড়ীর পাড়ে কাদা। আমার দিদি তো (বেথুন কলেজে বি. এ. পড়ে। কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসেছে) আমাকে দেখে হেসেই অস্থির। আমি চটে গিয়ে বললাম, ‘হাসি থামিয়ে এখন দয়া করে কিছু খেতে দিয়ে বাধিত কর।’
এমন সময় জেঠামশাই দোতলা থেকে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘মা লাবণ, কয়েকখানা লুচি নিয়ে এস তো!’
দিদি লুচির পাত্রটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েই হাসি চাপতে দূরে সরে গেল। আমিও সেটা নিয়ে দুমদাম শব্দ করতে করতে উপরে চলে গেলাম।
জেঠামশাইকে ঝাঁঝের সঙ্গে কি একটা বলতে যাব, তাকিয়ে দেখি সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়েই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
জেঠামশাই আমাকে বললেন, ‘এই যে মা, এস আলাপ করিয়ে দি। এঁর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। দিল্লী থেকে এসেছেন।’
আমার তখন রাগের বদলে হাসির পালা। ছোটবেলা থেকে বেশ ভালভাবেই হাসিটি আয়ত্ত করেছিলাম। হাসি সামলাতে না পেরে ভদ্রলোকের দিকে পিছন ফিরেই একটা টুলের উপরে বসে পড়লাম।
জেঠামশাই বারবারই বলতে লাগলেন, ‘ওকি, পিছন ফিরে বসেছ কেন? ঠিক হয়ে বস। বাড়িতে অতিথি এলে ঠিকভাবে আপ্যায়ন না করাটা খুব অন্যায়। ইনি তোমাকে কি ভাবছেন?’
ইনি নামক ব্যক্তিটি আমাকে যাই-ই ভাবুন না কেন, ঠিক হযে বসব কি–আমি তখন আমার হাসি সামলাতেই ব্যস্ত। যাই হোক, কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আমি তাঁর দিকে ফিরে বসলাম। কিন্তু অসীম ধৈর্য ভদ্রলোকটির। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না ফিরলাম, তিনি চুপ করেই বসে রইলেন।
তাঁর দিকে ফেরার পরে তিনি আমাকে তিনটি প্রশ্ন করলেন। ‘আপনার নাম কি? আই এ-তে কি কি সাবজেক্ট নিয়েছেন এবং কোনটি আপনার বেশী পছন্দ।’
কোনও মতে প্রশ্ন তিনটির উত্তর দিয়ে ভদ্রলোককে কিছু না বলেই উঠে নীচে দৌড় দিলাম। রান্নাঘরে ঢুকেই দিদিকে গুম গুম শব্দে কিল মারতে আরম্ভ করলাম। দিদি আমার হাত দুখানা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, ‘তোর হ’ল কি?’
আমি আরও রেগে গেলাম। ‘আমার কেন হ’তে যাবে? হয়েছে তোমাদের। আজ তোমরা আরম্ভ করেছ কি? ঐ ভদ্রলোকটি কে, আর আমাকে সাত সকালে ডেকে পাঠাবারই বা কারণ কি?’ দিদি তখন ‘আমি কি জানি? ভদ্রলোকটির খবর তো তোরই রাখবার কথা।’ বলেই অন্য ঘরে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষণ পরে জেঠামশাই সেই ভদ্রলোকটিকে নিয়ে নিচে নেমে বাইরের দিকে চলে গেলেন। আমি তাঁদের দেখেই মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম।
দুপুরবেলা জেঠামশাই আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে এ-কথা সে- কথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, লাবণ মা, সকালের ভদ্রলোকটিকে তোমার কেমন লাগল?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘উনি এসেছিলেন কেন?’ উত্তরে জেঠামশাই বললেন, ‘তাহলে বলি শোন। উনি দিল্লীর রামযশ কলেজের একজন অধ্যাপক। তোমাকে দেখতে এসেছিলেন।’ আমি তখন পরিস্কার জানিয়ে দিলাম যে বি-এ পাশ না করে বিয়ের কথা ভাববই না।
ছেলেবেলায় মাত্র তিন মাসের তফাতে বাবা, মা দুজনকেই হারিয়েছিলাম বলে আমাদের অকৃতদার জেঠামশাই (অমৃতলাল গুপ্ত) তাঁর সবটুকু স্নেহ ঢেলে দুজনের জায়গাই পূর্ণ করতে চেষ্টা করতেন। তিনি আমাকে অনেক বোঝালেন, ‘তুমি যে বিয়ে করতে চাইছ না, আমি চোখ বুজলে তোমাকে কে দেখবে? তোমার দিদির বিয়ের কথা চলছে। হয়ত শিগগিরই, ঠিক হয়ে যাবে। তোমার ছোট বোনটি খুবই ছোট। তার বিয়ের কোন প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং তোমার জন্যই আমার এখন চিন্তা। তাছাড়া-উনি তো তোমাকে পড়াতে রাজী আছেন। তাহলে তোমার বিয়েতে আপত্তি করার কি আছে?’
সত্যিই তো, বাবা-মা নেই। দিদির বিয়েও ঠিক হচ্ছে। এখন আমার বিয়ে হয়ে গেলেই জেঠামশাই দায়মুক্ত হবেন। অতএব মত আমাকে দিতেই হবে। তবুও শেষবারের মত বললাম, ‘ভদ্রলোকের মত না জেনেই-আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’ তখন জেঠামশাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘তিনি সকালে তোমাকে দেখেই মত দিয়েছেন।’
আমার তখন অবাক হবার পালা। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি- কত রকম ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তবে মেয়েকে বরপক্ষীয় লোকের সামনে দাঁড় করাতে হয়; তাঁরা হাজার রকম প্রশ্ন করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে তবেই মতামত দেন। মেয়েদের সে এক ভীতিজনক অবস্থা। কিন্তু আমার বেলা!
.
সে যাই হোক, ২৬ শে বৈশাখ (৯ই মে) শুক্রবার (শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে) বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল। কবির কবিত্ব শক্তির কোন রকম পরিচয় তখনও আমরা পাইনি। আমাদের কাছে তিনি অধ্যাপক হিসেবেই পরিচিত হলেন।
বিয়ে ঠিক হবার পরে কেন জানি না মা-বাবার কথা খুব বেশী করে মনে হতে লাগল। কিন্তু তাঁদের স্মৃতি আর আমার মনে কতটুকু? বড় হয়ে আমার দিদিমার মুখে শুনেই যেটুকু ধারণা।
আমার বাবা, রোহিণীকুমার গুপ্ত ছিলেন খুলনার বৈদ্যপ্রধান অঞ্চল সেনহাটির কুলীন বৈদ্য সন্তান। আর আমার মা যশোহর জেলার ইতিনা গ্রামের তারাপ্রসন্ন সেনের একমাত্র মেয়ে সরযু গুপ্ত (সেন)।
সেন রাজাদের আমলে মহারাজ লক্ষ্মণ সেন যে আটজনকে কুলীন বলে চিহ্নিত করেন, তাঁদের মধ্যে বৈদ্য বংশের কাশ্যপ গোত্রীয় কায়ু একজন। তাঁর উপাধি ছিল গুপ্ত। কায়ু গুপ্তের ছেলে বনমালী সেনহাটিতে এসে বাস করতে আরম্ভ করেন। সেনহাটি সর্বপ্রধান কুলস্থান বলেই প্রসিদ্ধ, আমার বাবা রোহিণীকুমার গুপ্ত এই বংশেরই সন্তান। বাবার ঠাকুমায়ের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের শেষ রাজার দেওয়ান। রাজার কাছ থেকে তিনি প্রচুর ভূ-সম্পত্তি পেয়েছিলেন। বাবার মুখে শুনেছি, বাখরগঞ্জ জেলার সুবিখ্যাত ‘দুর্গা সরোবর’ নামে প্রকাণ্ড দীঘিটি তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন। এই সরোবরের কথা আজও সেখানকার প্রতিটি গ্রামের লোকের মুখে শুনতে পাওয়া যায়।
ভগবান আমার বাবা-মা দু’জনকে অকৃপণ হাতে সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আমার মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু পরিবারের মেয়ে। গল্প শুনেছি-তিনি মুরগীর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, বাড়িতে আনতেও দিতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং তাঁর স্বভাবটি ছিল কঠোর ও কোমলের অপূর্ব সমন্বয়।
আমার বাবা যেমনি ছিলেন স্ফূর্তিবাজ, তেমনি ছিল তার দরাজ মন। হিন্দু সন্তান, কোন রকম কুসংস্কারের ধার দিয়েও তিনি যেতেন না।
আমার বয়েস যখন সাত বছর কয়েক মাস, সেই সময় বাবা শ্রাবণে ও মা অগ্রহায়ণে বলতে গেলে একই সময়ে দু’জনে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। এর পরে পরে আমরা তিনটি বোন ও একটি ভাই আমাদের বড় জেঠামশাই-এর কাছে চলে আসি।
আমি গিরিডিতে উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখানকার বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশুনা আরম্ভ করলাম। আমার দিদি প্রমীলা গুপ্ত (কমিশনার বি দে-র মেজো ছেলে ও সরোজনলিনী দত্তের ভাই-বি এন রেলওয়ের প্রাক্তন কমার্শিয়াল ট্রাফিক ম্যানেজার বসন্তকুমার দে-র স্ত্রী। তিনি কয়েক বছর হল পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন) ব্ৰাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আমাদের একমাত্র ভাই শান্তিবিন্দু গুপ্ত (মাদ্রাজে একটি বৃটিশ ফার্মের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার) ও ছোট বোন নন্দিনী গুপ্তকে (দুর্গাপুরে বার্ন কোম্পানীর ওয়েলফেয়ার অফিসার নিশীথ ঘোষের স্ত্রী) গয়ায় মেজো জেঠামশাই বিহারীলাল গুপ্তের কাছে রাখা হল।
এইভাবেই শুরু হ’ল পিতৃমাতৃহীন আমাদের চারটি ভাই-বোনের জীবনযাত্রা। ভগবানই হয়ত হাল ধরেছিলেন-তাই তীরের দেখা পেলাম।
এবারে কবির পিতৃ ও মাতৃকুলের পরিচয় দিতে হলে আমাকে অতীতে ফিরে যেতে হয়।
কবির ঠাকুরদাদা সর্বানন্দ দাশের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে। গ্রামটি সর্বনাশী পদ্মার করাল গ্রাসে পড়ায় তিনি বরিশালের শান্ত সুন্দর পরিবেশে এসে ঘর বাঁধলেন।
তাঁর ছিল সাত ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলেরা হলেন-হরিচরণ, সত্যানন্দ, যোগানন্দ, অতুলানন্দ, প্রেমানন্দ, ব্রহ্মানন্দ ও জ্ঞানানন্দ। মেয়েদের মধ্যে একজন বাইশ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। পাঞ্জাবনিবাসী ব্রজেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে বড় (তাঁদের এক ছেলে হলেন এইচ.এম.ভি-এর প্রাক্তন রেকর্ড অধিকর্তা পি কে সেন) এবং কোটালীপাড়ার সুগায়ক মনমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে মেজো মেয়ের বিয়ে হয়। সকলের ছোট স্নেহলতা দাশ বরিশাল সদর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি আজীবন কুমারী থেকে দেশের ও দশের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেন।
সর্বানন্দের মেজো ছেলে সত্যানন্দই কবির বাবা। সৌম্যমূর্তি সত্যানন্দ একজন শিক্ষাব্রতী ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অপার-অসীম।
খ্যাতনামা মহিলা কবি কুসুমকুমারী দাশ হলেন জীবনানন্দের মা (গৈলার চন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বড় মেয়ে)।
বসন্তকালে ঋতুরাজের পায়ের ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মলয়পবন সবুজ বনানীর শ্যামলিমাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়। গাছের বুকে দেখা দেয় নতুন পাতা। নীলাকাশ থেকে ভেসে আসে পাখির আনন্দ লহরী ফাল্গুন মাসের এইরকম একটি দিনেই বরিশালে জন্ম নিলেন কবি জীবনানন্দ।
বাবার ধ্যানগম্ভীর ভাব ও মায়ের অপার সহনশীলতা এই দুয়ের মিশ্রণে গঠিত হ’ল তাঁর চরিত্র। আমাদের দেশের প্রতিটি সন্তান কম কথা বলে কাজের ভিতর দিয়েই তার মনুষ্যত্বকে ফুটিয়ে তুলুক-এই ছিল মায়ের ঐকান্তিক মনোবাসনা। তাঁর এই মনোভাব মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর বিখ্যাত কবিতায়।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’
কম কথা বলে, কাজে বড় হয়ে পৃথিবীতে তাঁর মায়ের কবিতাকে স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন কবি জীবনানন্দ।
কবির বাল্য ও কৈশোর কেটেছে বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। জগদীশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। বালকের শিক্ষানুরাগ সেই জ্ঞানী পুরুষকে মুগ্ধ করেছিল। তাই শিক্ষাব্যাপারে জীবনানন্দকে সব রকম সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি জীবনের উন্নতির অনেকগুলি সোপানই অনায়াসে পার হয়ে যেতে পেরেছিলেন।
প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি এসে ভর্তি হলেন ব্রজমোহন কলেজে। স্বনামধন্য দেশভক্ত অশ্বিনীকুমারের বাবার নামেই কলেজটি স্থাপন করা হয়েছে। এই কলেজ থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করে তিনি কলকাতায় এলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ পড়তে।
১৯২১ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে হাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে এম-এ পাশ করেন। কবির মুখে শুনেছি-পরীক্ষার কিছুদিন আগে তিনি দারুণ ব্যাসিলারী ডিসেন্ট্রি রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। ঐ বছর পরীক্ষা দিতে পারবেন না বলে তাঁর মাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নানা অসুবিধে থাকাতে মায়ের অনুমতি পেলেন না। বাধ্য হলেন পরীক্ষা দিতে- কিন্তু প্রথম শ্রেণীর সম্মান আর পেলেন না তিনি।
এম-এ পাশ করার পরে তিনি সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ করেন। ১৯৩০ সনে যখন তিনি দিল্লীর রামযশ কলেজে ছিলেন, সেই সময়েই আমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের ব্যাপারে তাঁর যে চারিত্রবৈশিষ্ট্য ছিল, তার কিছুটা পরিচয় এখানে দিচ্ছি।
আমাকে বিয়ে করার আগে এক ধনী ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব আসে। তিনি নিজেই মেয়ে দেখতে গেলেন–সঙ্গে ছিলেন তাঁর মেসোমশাই (বরিশাল বাণীপীঠ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) রসরঞ্জন সেন।
পাত্রীপক্ষের আদর আপ্যায়নের ত্রুটি ছিল না। মেসোমশাই ত’ তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ। কবি কিন্তু সব সময় চুপ করেই রইলেন। এমন কি সালঙ্কারা মেয়েটিকে দেখে ও তাঁকে বিলেতে পাঠাবার প্রস্তাব শুনেও কোন কথাই বললেন না। বাড়ি ফেরার পরে মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে কি না সে কথা বারবার জিগ্যেস করেও কবির কাছ থেকে কোন উত্তরই পাওয়া গেল না।
পরদিন দুপুরে আর একবার যাবার অনুরোধ জানিয়ে পাত্রীপক্ষ গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। কবি তখনও যেন চিন্তা করছেন। মেসোমশাই তাঁকে যাবার জন্য তৈরি হতে বললেন। কিন্তু তিনি বললেন, ‘তুমি যাও। আমি যাব না।’
‘সে কি কথা? বিয়ে করবি তুই, আর যাব আমি?’ মেসোমশাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কবি কিন্তু ধীরভাবেই উত্তর দিলেন, ‘যেখানে বিয়ে করব না বলেই ঠিক করেছি, সেখানে দ্বিতীয়বার যাওয়াটাও আমি অনুচিত বলেই মনে করি।’
সেদিন মেসোমশাই-এর শত অনুরোধও তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি।
আবার এ ব্যাপারে তিনি যে কতটা উদার ছিলেন, তার পরিচয় পেয়েছি আমার বিয়ের সময়। বিয়েতে একটিমাত্র আংটি ছাড়া-বোতাম, ঘড়ি অথবা আসবাব কিছুই তাঁকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেই আংটিটির জন্যই তিনি কত লজ্জিত কত কুণ্ঠিত। যেন মহা অপরাধে অপরাধী। বিয়ের পরে বরিশালে গিয়ে তাঁর বড় পিসীমাকে বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি বলে দিতে, তাহলে আমি নিজেই একটা আংটি কিনে নিয়ে যেতাম। আমার জন্য লাবণ্যর জেঠামশাইকে শুধু শুধু কতগুলো টাকা খরচ করতে হল। তাছাড়া বিয়ে করতে গেলে কিছু না কিছু পেতেই হবে- এ নিয়মই বা আছে কেন?’
কবির কথা শুনে বড়পিসীমা হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘সমাজের দোহাই দিচ্ছিস কেন? তোরা না নিলেই পারিস। কিন্তু আমি তো দেখি বিয়ের সময় বেশির ভাগ ছেলে বাপ-মায়ের অতি-বাধ্য হয়ে ‘বাবা মায়ের কথার উপরে আমি কি কিছু বলতে পারি’– এই কথাই বলে বসে।’
কবি তাঁর এই তেজস্বিনী পিসীমাকে ভাল করেই চিনতেন। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে সরে পড়াই শ্রেয় মনে করলেন।
ফুলশয্যার রাতে তাঁর সর্বপ্রথম কথা হ’ল- ‘আমি শুনেছি তুমি গাইতে পার। একটা গান শোনাবে?’
আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনটা?’
‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, গানটা যদি জান তবে সেটাই শোনাও।’
আমার এখনও মনে পড়ে, প্রথমবার গাইবার পরে তিনি আরও একবার গাইতে বললেন।
অনেকদিন পরে আমি একদিন হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, তুমি প্রথম দিনেই ‘জীবন মরণের সীমানা’ ছাড়াতে চেয়েছিলে কেন?’
তিনিও হেসেই উত্তর দিলেন, ‘এই লাইন দুটোর অর্থ বল ত?’
“আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া।”
আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি তখন আস্তে আস্তে বললেন, ‘জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।’
একজন কমলালেবু উপন্যাসে যে লাবণ্য দাশকে পেয়েছি তাতে তিনি একজন যথার্থ অভাবী লোকের স্ত্রীর মতোই জীবনানন্দকে ট্রিট করেছেন।