৩
কবিকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে আমি খুব কমই দেখেছি। কিন্তু যদি কখনও সামান্য একটু জ্বরও হত, তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। শুধু তাই-ই নয়—চাইতেন যে সবাই এসে তাঁর কাছে বসে থাকুক। সেজন্যে বিছানায় শুয়েই বলতে আরম্ভ করতেন- ‘ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস-আমার কাছে আয়। আমার শরীর যেন কেমন করছে-অবস্থা মোটেই ভাল বোধ হচ্ছে না-কতক্ষণ আছি কে জানে?’
তাঁর কথা শুনে সবাই (সবাই অর্থে আমি এবং আমার ছেলে সমর) যদি ছুটে তাঁর কাছে না যেতাম, তাহলেই তাঁর রাগ হয়ে যেত।
তখন আমি শিশু বিদ্যাপীঠ নামে একটি সেকেন্ডারী স্কুলে সবে ঢুকেছি। একদিন রাত প্রায় ৯টার সময় বাইরে থেকে বেড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকতে যাব, এমন সময় কবিকে বলতে শুনলাম, ‘হ্যাঁরে খোকন, তোর মা কি বাড়ি ফিরেছেন?’
‘খোকন’ আমার ছেলের ডাক নাম। সে উত্তর দিল—’না।’
তিনি তখন বলতে শুরু করলেন—‘তা ফিরবে কেন? এদিকে আমি যে জ্বরে পড়ে আছি-সেটা কে দেখে-কেই বা মুখে একটু জল দেয়?’ বলেই মনে হল যেন সারাদিন রোদ-খাওয়া লেপখানাকে বেশ আরামের সঙ্গেই গায়ে জড়িয়ে পাশ ফিরলেন।
কবির কথা শোনার পরে আমি আর ঘরে ঢুকলাম না। নিঃশব্দে বেরিয়ে সোজা একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। কারণ আমি জানি যে কবির জ্বর হলেও সেটা অতি সামান্য। অ্যানাসিন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। একে তো শীতকাল, তাতে আবার বেশী রাত জেগে লেখাপড়ার কাজ করেছেন—তাতেই হয়ত শরীরটা বেশী খারাপ লাগছে।
শেষ পর্যন্ত দুটো অ্যানাসিন ট্যাবলেট নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। ট্যাবলেট ও জলের গ্লাস টেবিলে রেখে বললাম, ‘ওষুধ রইল। ডাক্তার আজ বার্লি খেতে বলেছেন।’
কবি এতটার জন্য তৈরী ছিলেন না। আমি যে তাঁর কথা শুনে ফেলব সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কাজেই চুপ করেই রইলেন।
আমি অন্য ঘরে বসেই শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম যে তিনি উঠে অ্যানাসিন খাচ্ছেন। খানিক বাদে আমি খোকনকে খেতে দেবার জন্য রান্নাঘরে গেলাম। তাকে থালায় ভাত দিয়েছি, এমন সময় বারান্দা থেকে কবির স্বগতোক্তি শুনতে পেলাম।–‘এখন তো মনে হচ্ছে জ্বর আর নেই। গরম ভাত একটু ডিমের ঝোল দিয়ে খেলেও খাওয়া যেতে পারে। তখন কেন যে বেশী জ্বর বলে মনে হ’ল? না–অন্যায়টা তো আমারই। একটা মানুষ সারাদিন স্কুলে কাজ করে এসে সন্ধ্যেবেলা যদি একটু বেড়াতে না যায়, তবে তার শরীর টিকবে কি ক’রে?’
আমি কিন্তু চুপ করেই রইলাম। কিছুক্ষণ আর কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। বোধহয় খাবার ঘরে ঢুকতে একটু ইতস্ততঃ করছিলেন। তারপরেই দেখি খোকনকে ডাকতে ডাকতে খাবার জায়গায় এসে হাজির। ছেলেকে ডিম খেতে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তাড়াতাড়ি থালা নিয়ে বসে পড়লেন। ডিম ছিল তাঁর অতি প্রিয় খাদ্য। ছেলেকে ডিম খেতে দেখলে তিনিও তখন নিতান্তই ছেলেমানুষ হয়ে যেতেন এবং তার ভাগ থেকে কিছুটা ভেঙে মুখে দিতে তিলমাত্রও দ্বিধা বোধ করতেন না। সুতরাং তখন আর কি করি-ভাত তাঁকে দিতেই হল। আর তিনিও গরম ভাত ডিমের ঝোল দিয়ে খেয়ে তবে উঠলেন।
পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আমার ছেলে-মেয়ে অথবা আমি কেউই কোনদিন পেন্সিল কেটে নিয়েছি অথবা কলমে কালি ভরেছি বলে তো মনে পড়ে না। এসব কাজ কবি নিজেই করতেন। তাঁর কাজ ছিল নিখুঁত। চিহ্নস্বরূপ এখনও তাঁর হাতের কাটা একটি পেন্সিল আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। পেন্সিলটি দেখলে স্মৃতির আলোড়নে কত কথাই ভেসে আসে। জগতে জড় পদার্থের মূল্য কতটুকু! কিন্তু যার জন্য সেই জড় পদার্থ অমূল্য সম্পদ হয়ে ওঠে—যাকে নিয়েই স্মৃতির আলোড়ন-থাকে না সেই মানুষ। ভাঙা-গড়ার কাজে বিধাতাপুরুষ মানুষের মন নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলছেন। যে মনে চেতনা দিয়েছেন বলেই মানুষ আজ শ্রেষ্ঠ জীব–আবার সেই মনকেই ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে প্রিয়জনকে টেনে নিয়ে যেতে একটুও বাধছে না! বিধাতার এ কী খেলা!
কারো উপরে রাগ করে তিনি পাঁচ মিনিটও থাকতে পারতেন না। তাঁর ব্যবহারে অন্যে কষ্ট পাবে একথা বোধহয় তিনি ভাবতেই পারতেন না। কাজেই সে রাতের সেই মন্তব্যের জন্য তার পরদিন তিনি কিছুতেই স্থির হয়ে কাজে মন দিতে পারছিলেন না। আমিও গম্ভীর হয়েই রইলাম। এমন কি সন্ধ্যেবেলা বাইরেও বের হলাম না। একখানা বই হাতে নিয়ে খোকন যেখানে বসে পড়ছিল, সেখানেই বসে রইলাম। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমি বাইরে না বেরনোতে কবি কিছুতেই সোয়াস্তি পাচ্ছিলেন না। অথচ আমাকে কিন্তু বলতে সাহসও পাচ্ছেন না। হঠাৎ শুনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছেন— ‘খোকন, কলকাতার সব সিনেমাই আজ বন্ধ নাকি রে?’
খোকনের বয়স তখন কম—নিতান্তই ছেলেমানুষ। সে তার বাবার অর্থ ধরতে না পেরেই উত্তর দিল—’না বাবা, সিনেমা তো চলছে। বন্ধ থাকবে কেন?’
কবি হেসে বললেন, ‘তুই জানিস না। তোর মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, আজ সব সিনেমা হলের দরজাই বন্ধ।’
তখন আর কি করি। আমিও হেসে ফেলেছি। আমার মুখে হাসি দেখে তবেই তিনি নিশ্চিন্ত মনে লেখার টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন।
কবি যখন লেখার কাজ নিয়ে বসতেন, সে সময় কতদিন কতভাবে যে তাঁকে বিরক্ত করেছি, সে কথা বলে শেষ করা যায় না। এজন্য কিন্তু তাঁকে রাগ করতে কোনদিনই দেখিনি।
আমার একটা খারাপ অভ্যাস ছিল যে পরীক্ষার খাতা দেখার সময় বানান সম্বন্ধে সন্দেহ হলে কষ্ট করে অভিধানের পাতা না উল্টিয়ে সোজা কবিকেই জিজ্ঞেস করতাম। স্বভাবে আমি চিরকাল কবির একেবারে উল্টো। তিনি ছিলেন ধীর, শান্ত। আর আমি ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার ধার দিয়েও যাই না। প্রায় সময়ই তিনি আমার অভিধানের কাজ করে দিতেন ফলে তাঁর নিজের কাজে বাধা পড়ত। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘দেখ, তোমার যেসব শব্দ অথবা অর্থের দরকার সেগুলো একটা কাগজে লিখে আমার টেবিলে রেখে দিও। তাহলে তোমাকেও চেঁচিয়ে গলাব্যথা করতে হয় না আর আমারও সময় নষ্ট হবে না।’
মঞ্জুশ্রী ও সমরের কাছে কবি শুধু বাবাই ছিলেন না–তাদের বন্ধুও ছিলেন তিনি। তাই তাদের যত কথা যত গল্প সবই ছিল তাঁর সঙ্গে। লেখক শ্রীসুবোধ রায় আমাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন। তিনি প্রায় রোজই আমাদের বাড়িতে এসে কবির সঙ্গে নানারকম গল্প করতেন। সে গল্পে বাবার সঙ্গী হিসেবে সমরও নিয়মিতভাবেই যোগ দিতো। খেয়ে দেয়ে তাঁরা গল্প করতে বসতেন। সুবোধবাবুও সে পাট চুকিয়েই আসতেন। কোন কোন দিন রাত প্রায় একটা বেজে যেত–তবুও তাঁদের গল্প শেষ হ’ত না। আমি এক ঘুম দিয়ে উঠে ছেলেকে তাড়া দিয়ে শুতে পাঠাবার চেষ্টা করলে সে দু-হাতে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকত। আমি রাগ করলে সুবোধবাবু ও কবি দুজনেই হাসতেন।
তাঁদের আসরে শুধু যে মজার মজার গল্পই হত, তা নয়। সাহিত্যের আলোচনাও হত। ছোট ছেলে হয়েও সমর মন দিয়ে সেসব কথা শুনত। এমন কি মাঝে মাঝে সাধ্যমত নানারকম প্রশ্নও করত। কবি ও সুবোধবাবু দুজনেই যতটা পারতেন, তাকে বুঝিয়ে দিতেন। ছেলে যে সেসব কথায় কি স্বাদ পেত জানি না-মন দিয়ে বসে বসে শুনত। কোন কারণে যেদিন সুবোধবাবু না আসতে পারতেন, সেদিন সমরের মন খারাপ হয়ে যেত! সে তার বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কেবলি জিজ্ঞাসা করত—‘বাবা, সুবোধ কাকা কখন আসবেন— কখন আমাদের গল্প হবে?’
ছেলের ম্লান মুখ দেখলে কবিও কোন কাজে মন দিতে পারতেন না। সবকিছু ফেলে ছেলের সঙ্গে গল্প করতে বসতেন। বাবার রোজকার সঙ্গী হিসেবে ছেলেও ক্রমে সাহিত্যকে ভালবাসতে শিখল।
কোথাও যেতে হলে অথবা কোন কাজ শুরু করবার আগে তিনি প্রথমেই ছেলের মতামত জিগ্যেস করতেন। ‘তুই কি বলিস?’ ছেলে মত দিলে তিনি খুশী হয়ে সে কাজ করতেন। আমি হাসলে বলতেন—‘বুড়ো হয়ে তো এই ছেলের উপরেই নির্ভর করতে হবে। এখন থেকেই তার তালিম নিচ্ছি’–কথাটা বলেই দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরতেন।
ছোট ছেলের সিনেমা দেখা পছন্দ করতাম না বলে আমি সমরকে বিশেষ সিনেমায় যেতে দিতাম না। তবে, তার যেদিন যেতে ইচ্ছে হত, বাবাকে দিয়েই ব্যবস্থা করিয়ে নিত। বাবা ও ছেলে বুঝুক আর নাই বুঝুক–ব্যাপারটা কিন্তু আমার নজর এড়িয়ে যেতে পারত না। কোন এক রবিবারের দুপুর হঠাৎ আমার চোখে পড়ল সমর তার বাবার কানে কানে ফিসফিস করে কি যেন বলছে। তিনি মাথা নাড়ছেন আর আমি যে ঘরে ছিলাম, সেদিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। পর মুহূর্তে সমর বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে আমি যেন কিছুই জানি না-এইরকম ভাব দেখিয়ে কবিকে জিজ্ঞাসা করলাম–‘খোকন কোথায়, তাকে দেখছি না যে?’
তিনি আর একদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন–‘যাবে আবার কোথায়, কেন, তোমার কি দরকার? চাকরকে পাঠাও না।’
তাঁর কথার ধরনে আমি হেসে বললাম, ‘তাকে তো কোথাও পাঠাতে চাইছি না। শুধু জানতে চাইছি সে কোথায় গেল।’
তখন তিনিও হেসে ফেলেছেন। হাসতে হাসতেই বললেন ‘বাবা, তোমাকে কি ফাঁকি দেবার যো আছে? সে যেখানেই যাক আমাকে বলেই গেছে। তুমি আবার তাকে বকাবকি করতে যেও না।’
সন্ধ্যেবেলা দেখি কবি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাকে যেন ইশারায় কি বলছেন। বুঝতে পারলাম ছেলে এসেছে। যাতে আমার চোখে না পড়ে তাই এই সতর্কতা। তখন আমি ঘর থেকে বেরিয়ে খোকনকে জিগ্যেস করলাম, ‘কি বই দেখলি?’ ছেলে বুঝল যে আমি রাগ করিনি। তখন হাসিমুখে আমার কাছে এসে দাঁড়াল।
‘আচ্ছা মা, তুমি কি করে জানলে যে আমি সিনেমা দেখেছি?’
আমি হেসে উত্তর দিলাম–‘আমার মন বলেছে।’
কবি তখন ছেলের কাঁধের উপরে একখানা হাত রেখে বললেন, ‘তোর মাকে ফাঁকি দিয়ে কোন কাজ করার ক্ষমতা তোর কেন, তোর বাবারও নেই।’
মঞ্জুশ্রী স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত তমলুকে তার পিসিমা শ্রীমতী সুচরিতা দাশের কাছেই ছিল। আমাদের কাছে এসে আই এ-তে ভর্তি হল। কবির কবিত্ব-শক্তির কিছুটা অংশ নিয়েই সে জন্মেছে, আট বছর বয়েস থেকেই সে কবিতা লিখতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ভাল না হলেও সে হতাশ হয়নি। দশ বছর বয়েসে ভালই লিখতে শিখল। মঞ্জুর সেই সময়কার একটি কবিতা তার পিসেমশাই শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্ত কোন একটি পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। মেয়ে যত না পড়াশুনা করেছে-কবিতা লিখেছে তার চাইতে অনেক বেশী। এ বিষয়ে সে তার বাবার কাছ থেকে যথেষ্ট উৎসাহ পেত।
বহুবার কবিকে বলতে শুনেছি—’লেখ, তুই লেখ। তোর মাকে দিয়ে ত’ আর এসব কাজ হবে না। তুই-ই আমার নাম রাখবি।’
মেয়েও হাসত আর বলত, ‘আচ্ছা বাবা, মা কেন কবিতা লেখেন না?’
‘কাব্যলক্ষ্মী তোর মাকে ভীষণ ভয় পান যে, তাই তো তিনি তোর মায়ের ধারে, কাছেও ঘেঁষেন না।’ হেসে কবি উত্তর দিতেন।
মঞ্জু তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করত- ‘সত্যি নাকি মা?’
‘সেটা আমার চাইতে তোর বাবাই ভাল জানেন।’ আমি গম্ভীর হয়েই উত্তর দিতাম।
কবি এবং তাঁর মেয়ের এই মনোভাবের ছোট্ট একটি ঘটনা বলছি।
এক ছুটির দুপুরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ মেঘের শব্দে জেগে দেখি ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে–আর বাইরে যত কাপড় মেলা ছিল সব ভিজছে। বাবা ও মেয়ের দৃষ্টিপাতও নেই। তারা দুজনে কবিতার আলোচনায় গভীরভাবেই মগ্ন।
আমি মেয়েকে বললাম–‘কাপড়গুলো সব ভিজে গেল, তুই একটু কষ্ট করে তুলতেও পারিস নি!’
‘ওমা, কাপড়গুলো বাইরে ছিল বুঝি?’ মেয়ে হাসি মুখেই উত্তর দিল।
কিন্তু কবি বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বললেন, ‘তোমার কেবল সংসার আর সংসার। তুমি কি কিছুতেই তার উপরে উঠতে পার না? কোনদিনও দেখলাম না যে তুমি কবিতার আলোচনায়, মুহূর্তের জন্যও যোগ দিয়েছ।’
আমি কাপড় তুলতে তুলতেই বললাম, ‘আমি কাব্য-জগতের ধার ধারি না। কবিতার চাইতে সংসারকেই বেশী ভালোবাসি।’
কবিবন্ধু বুদ্ধদেববাবু একদিন কবিকে বলেছিলেন—’আপনার ঘরখানি দেখলে কবিতা আপনা থেকেই আসতে চাইবে। কিন্তু এ কৃতিত্ব কার? নিশ্চয়ই আপনার না।’
তাঁর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে কবি মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। মঞ্জুকে আমি প্রায়ই বলতাম, ‘বড় হয়েছিস, কিন্তু রান্নাবান্না তো কিছুই শিখলি না।’
আমার কথায় মেয়ে সত্যি সত্যিই একদিন রান্নাঘরে এল। রান্নার কোন কিছু ধরেওনি–এমন সময় কবি কোথা থেকে দৌড়ে এসে বলতে শুরু করলেন, ‘পুড়ে মরবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি? শিগ্গির বেরো। তোর মায়ের যেমন কাণ্ড, তোকে শেষ না করে ছাড়বে না।’
মঞ্জু রান্নাঘর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কবি সেখান থেকে এক পাও নড়লেন না।
তিনি নিজে ত’ স্টাইলের ধার দিয়েও যেতেন না, কিন্তু মেয়ের বেলায় কতখানি যে চিন্তা করতেন তার প্রমাণ পেয়েছি ছোট্ট একটি ঘটনায়।
মঞ্জু তখন আই এ পড়ে। কবির অমত থাকা সত্ত্বেও আমি মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করছিলাম। অবিশ্যি মেয়েকে না জানিয়েই। একবার একটি ছেলে মঞ্জুকে দেখতে এল। ছেলেটি ভাল ঘরের এবং বেশ ভাল চাকরি করে। তবে অতি সাদাসিধে। কবিকে যখন ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম, দেখলাম ছেলের চাইতে তার বেশভূষা–বিশেষ করে কোঁচার দিকেই তাঁর ব্যগ্র দৃষ্টি। আমি ব্যাপারটা তখুনি আঁচ করে নিলাম।
কবির তো এই ভাব–ওদিকে মেয়ের কাণ্ড দেখে তো আমি হতভম্ব। সে তো আর জানে না যে তাকে দেখতে এসেছে। যেন অদ্ভুত কিছু একটা দেখছে এমন ভাবেই দেখতে লাগল ছেলেটিকে।
ছেলেটি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কবি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি একে যোগাড় করলে কোথা থেকে?’
‘কেন, ওর দোষটা কি হল?’
‘না, দোষের কিছু হয়নি। তবে এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে একে ধুতি পরানো শেখাতে শেখাতেই মেয়ের জীবন কেটে যাবে।’ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,-–‘কি বলিস রে?’
মেয়েও ত’ তেমনি–তখুনি উত্তর দিল-‘ও বাবা, এই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে নাকি? যেভাবে উঁচু করে কোঁচা ঝুলিয়েছে–আমি বাঙালী বলে বুঝতেই পারিনি—’
‘ঠিকই বলেছিস। একটু সাবধানে থাকিস। এরপরে তোর মা আবার কি এনে হাজির করবেন কে জানে?’
আমি তখন বেশ রাগের সঙ্গে বলতাম–‘খুব হয়েছে। আর বলতে হবে না। কিন্তু মেয়ের বাবা যখন রোহিনী গুপ্তের মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর কোঁচাটা কত লম্বা ছিল শুনি?’
কবি তাঁর ঘরে যেতে যেতে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে গেলেন–
“সে যুগ হয়েছে বাসী,
সে যুগেতে আর এ যুগেতে এবে
তফাৎ অনেক বেশি।”
হায়রে! অসময়ে এবং অতর্কিতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সময় তাঁর এত আদরের মঞ্জু ও সমরকে দেখতে পাবেন না–তাদের কোলে টেনে নিয়ে বুকভরা শান্তি আর মনভরা তৃপ্তি কোনদিনই অনুভব করতে পাবেন না–একথা ভেবে না জানি কত দুঃখ, কত ব্যথা নিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছে–তার নীরব সাক্ষী রইলেন শুধু অন্তর্যামী ভগবান।