মানুষ জীবনানন্দ – ২

কবিতার খাতা ছিল কবির প্রাণ। সে-সব খাতা তিনি কাউকে ছুঁতেও দিতেন না। এমন কি তাঁর টেবিলের সামনে গেলেও তটস্থ হয়ে উঠতেন। কিন্তু প্রয়োজন বোধে-আমার জন্য সেসব খাতার চরম দুর্গতিও তাঁকে হাসিমুখে সহ্য করতে দেখেছি। 

আমার বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। যে যুগে স্বাধীনতা-সংগ্রামের বীজ দিকে-দিকে, দেশে-দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, নিজেকে সেই যজ্ঞে আহুতি দেবার জন্য বিনয়, বাদল, দিনেশ, প্রীতি হাসিমুখে এগিয়ে এসেছিলেন— আমি সেই যুগেরই মেয়ে। কাজেই ইংরেজের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হইনি। 

একদিন সকালে হঠাৎ আমার নামে ওয়ারেন্ট ও বেশ কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আই বি ডিপার্টমেন্টের তিনজন অফিসার আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। কবি তখন সামনের দিকের ঘরেই ছিলেন। একজন অফিসার তাঁকে জিগ্যেস করলেন, ‘লাবণ্য দাশগুপ্ত কার নাম?’ 

কবি উত্তর দিলেন, ‘আমার স্ত্রীর নাম?’ 

অফিসারটি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘তাঁর নামে ওয়ারেন্ট আছে। আপনি কয়েকজন ভদ্রলোক ডাকুন। আমরা ঘর সার্চ করব।’ 

কবি নিঃশব্দে তাঁর ঘর দেখিয়ে দিলেন। দুটি ঘণ্টা ধরে পুলিশের তাণ্ডব নৃত্যের ফলে তাঁর অতিপ্রিয় কবিতার খাতাগুলির যা অবস্থা হয়েছিল তা দেখে আমার মত কাব্যরস-বঞ্চিত মানুষের চোখেও জল এসে গিয়েছিল। 

শুধু সার্চ করেই অফিসাররা থামলেন না। জেরার জন্য আমাকেও তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হ’ল। তাঁরা একটা নাম জানবার জন্য অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন। 

এতসব গোলমালের মধ্যেও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। যিনি পদস্থ অফিসার, তিনি আমার পড়ার টেবিলের উপরে বসে কবির ‘ঝরাপালক’ নামে কবিতার বইখানি পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছেন- মাঝে মাঝে কবির দিকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেনও। যিনি প্রশ্ন করছিলেন, তিনি আমার খাটের উপরে বসেছিলেন। 

সার্চ ক’রতে ক’রতে হঠাৎ আয়র্ল্যান্ড বিপ্লবের একখানা ইতিহাস পাওয়া গেল। বইখানা দেখে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। সেখানা তো আমার নয়-ই-এমন কি কে এনেছে তাও জানি না। বই পেয়ে খাটের উপরের জন কবির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখুন, আপনার স্ত্রী রীতিমত বিপ্লববাদীদের দলে যোগ দিয়েছেন।’ কথাটা শুনে কবি কিছুক্ষণ হতবাক হয়েই রইলেন। পরে, আস্তে আস্তে বললেন- ‘আমার স্ত্রীর বিপ্লবের সঙ্গে কোনই যোগাযোগ নেই।’ 

‘মশাই, এরা ঢাকার মেয়ে। এদের কতটুকু আপনি চেনেন?’ মাথা উঁচু করে গর্বভরে অফিসার উত্তর দিলেন।

এ-কথায় কবির সমস্ত মুখে একটা ম্লান আভা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি ব্যথাভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নীরবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। টেবিলের উপরের জনও আমার দিকেই তাকিয়েছিলেন। খাটের আরোহী তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ বই কি আপনার?’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘এরপর আপনার কি আর কিছু বলার আছে?’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এক হাতে ওয়ারেন্ট ও অন্য হাতে কলম ধরলেন। 

কবি তখনও নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি এবারে গম্ভীর হয়েই উত্তর দিলাম, ‘বলবার আমার এইটুকুই আছে যে ওখানা বি এ ক্লাসে ইতিহাসের রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইচ্ছে হলে বি এম কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বেশ রাগের সঙ্গেই অফিসারটি বললেন, ‘বি এ ক্লাসের বই আপনার ক্লাসে কেন? তাছাড়া এতরকম গল্পের বই থাকতে বিদ্রোহের ইতিহাসই বা পড়েন কেন?’ 

আমি তখন হেসে ফেলেছি। হাসতে হাসতেই উত্তর দিলাম, ‘আই এ- তে আমার ইতিহাস আছে। তাছাড়া ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসও বাংলার ছেলেমেয়েকে পড়তে হয় বলেই জানি। তবে আপনি যদি সঠিক খবর জানতে চান, তাহলে অবিশ্যি ইতিহাসের অধ্যাপককেই ডেকে আনতে হয়।’ 

আমার কথা শুনে অফিসারটি সম্ভবত অপমানিত বোধ করলেন। তাঁর মুখে বেশ একটা থমথমে ভাব দেখা গেল। কিন্তু টেবিলের উপরের জন হো-হো শব্দে হেসে উঠলেন। হাসি থামলে বললেন, ‘ওহে, আর কেন? অনেকভাবেই তো পরীক্ষা করলে। এবারে nil লিখে দিয়ে উঠে পড়।’ 

কবির মুখের ম্লান আভা সরে গিয়ে ততক্ষণে সেখানেও হাসি ফুটে উঠেছে। 

চলে যাবার সময় পদস্থ অফিসারটি পরমাগ্রহে কবির বইখানি চেয়ে নিলেন এবং সস্নেহে আমার দিকে তাকিয়ে বলে গেলেন, ‘আমাদের জন্য অনেক কষ্টই আজ আপনাকে ভোগ করতে হ’ল।’ 

পুলিশের হাঙ্গামার জন্য অনেকেই আমার উপর বিরক্ত হলেন। কিন্তু কবিকে দেখে সত্যিই আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিরক্ত তো তিনি হলেনই না, বরং আমি যে দেশের কথা চিন্তা করি সেজন্য তিনি গর্বই বোধ করলেন। কারো স্বাধীনতা খর্ব করতে অথবা ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কাজ করাতে আমি তাঁকে কোনদিনও দেখিনি। তিনি সব সময়েই বলতেন, ‘বড় হয়ে যে যেটা উচিত বলে মনে করবে সে সেটাই করবে। কারো তাতে বাধা দেওয়া ঠিক নয়।’ 

এ বিষয়ে একটি মজার ঘটনা বলি। 

আমি যেবারে বি.এ পরীক্ষা দিলাম, সেবারে কবি সেই কলেজেই (বরিশালে-ব্রজমোহন কলেজ) ইংরেজীর অধ্যাপকের পদে ছিলেন। ইতিহাস পরীক্ষার দিন শরীর খুব খারাপ বোধ হওয়াতে আমি পরীক্ষা দেব না স্থির করে বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একজন অধ্যাপক আমাকে বাধা দেন। এমন কি আমাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করাবার জন্য কবিকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁর সামনেই আমি বললাম, ‘আমি পরীক্ষা দেব না, বাড়ি যাব।’ তিনি আমার মুখের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ইচ্ছে না থাকলে পরীক্ষা দিও না। শরীর বেশি খারাপ লাগলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত।’ কথাটা বলেই মুহূর্ত মাত্র সেখানে অপেক্ষা না করে নিজের কাজে চলে গেলেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হেমচন্দ্র ঘোষ কবির উপর ভীষণ চটে গিয়ে বলেই ফেললেন, ‘বাড়ি যাবার অনুমতি তুমি দিতে পার, কিন্তু আমি কিছুতেই দেব না।’ তাঁরই ব্যবস্থায় আমি পরীক্ষা দিতে বাধ্য হলাম। তিনি যদি সেদিন আমার জন্য অতখানি কষ্ট স্বীকার করতে এগিয়ে না আসতেন, তাহলে হয়ত নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ আর পেতামই না। 

আমরা যে সময়ে বরিশালে ছিলাম, তখন সেখানে স্ত্রী-স্বাধীনতা তো ছিলই না বরং পর্দাপ্রথার প্রচলনই বেশি ছিল। আমাকে কলেজে যেতে হ’ত ঘোড়ার গাড়ির দরজা বন্ধ করে। বাড়িতে কোনও ভদ্রলোক এলে তাঁর সামনে যাওয়া বা কথা বলার অধিকার আমার ছিল না। কারণ, এসব ব্যাপারে সমাজে খুবই সমালোচনা হত। কিন্তু কবি উৎসাহ যুগিয়ে লেখাপড়া শেখার সুযোগ করে দিতেন বলেই আমি অনেক কাজেই এগিয়ে যেতে পেরেছি। 

একবার আমাদের বাড়িতে চুরি হয়ে গেল। খবর পেয়ে তো দারোগা এসে হাজির। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলবে কে-সেটাই হল সমস্যা। আমার শ্বশুরমশাই বুড়ো মানুষ, কাজেই তিনি এ সব কথা-বার্তায় থাকবেন না। কবি তাঁর লেখা নিয়ে ব্যস্ত। তিনি তার অমূল্য সময়ের একটুখানিও নষ্ট করতে রাজী নন। তবুও আমার শাশুড়ী কবিকেই গিয়ে বললেন, ‘দারোগা এসে বসে আছেন। তুই একবার যা। বাড়িতে আর কোন ছেলে নেই। তুই না গেলে কথাবার্তা বলবে কে?’ 

‘কেন? লাবণ্য কোথায়?’-লিখতে লিখতেই কবি উত্তর দিলেন। 

উত্তর শুনে আমার শাশুড়ী বিস্ময়ে আঁতকে উঠলেন। ‘ওমা, সে কি কথা! বাড়ির বউ দারোগার সঙ্গে কথা বলবে? কেন, তুই কি এদেশের রীতি-নীতির খবর রাখিস না?’ 

‘দেখছি লেখাপড়া জানা মেয়ে বিয়ে করা ঠিক হয়নি। তাদের কোন সাহায্যই তোমাদের দেশে পাবার উপায় নেই। তা বেশ তো, সে না পারলে, তুমি নিজেই যাও, আমাকে আর বিরক্ত ক’র না।’- কথাগুলো শেষ করেই তিনি আবার নিজের কাজে মন দিলেন। 

শাশুড়ী তখন বাধ্য হলেন আমাকে পাঠাতে। শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে খবরাখবর দেওয়া, যা কিছু আলোচনা করা সবই আমি করলাম। 

আগেই বলেছি, আমি শৈশব কাটিয়েছি ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চল গিরিডিতে। শালবনের আলো-আঁধারি ছায়াঘেরা পথে ঘুরে বেড়িয়ে বর্ষায় উচ্ছ্বল-যৌবনা পাহাড়ী নদী উশ্রীর রূপোলী ধারায় পা ডুবিয়ে এবং ছোট ছোট পাহাড়ের উপর দৌড়ঝাঁপ করেই আমার দিন কেটেছে। বন্ধন কাকে বলে জানতাম না। তাই বরিশালে প্রতিপদে পরাধীনতার শিকল ফাঁস হয়েই আমার গলা আটকে ধরল। টানাটানি করে সে ফাঁস আলগা করতে গিয়ে চোখের জলেই ভেসেছি, কিন্তু তাকে তার জায়গা থেকে একটুও নড়াতে পারিনি। 

আমার সে পরাজয়ের গ্লানি কবির চোখে ধরা পড়েছে বইকি। তিনি তখন এই কথা বলেই আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন-‘তুমি চোখের জল ফেলো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যেদিন বরিশালের এই আবহাওয়ার বাইরে যেতে পারব, আমার প্রথম কর্তব্য হবে তোমাকে স্বাধীন হবার সুযোগ দেওয়া। আজ তুমি যতটা কষ্ট সহ্য করছ, ভবিষ্যতে ঠিক সেই পরিমাণেই স্বাধীনভাবে তুমি চলতে পারবে। তখন যদি কেউ বাধা দিতে আসে, বোঝাপড়া হবে আমার সঙ্গে।’ তাঁর সে কথা তিনি সত্যিই রেখেছিলেন। 

১৯৫৪ সনের ১২ই মার্চ আমি যখন ‘চলোর্মি’ ক্লাব থেকে রঙমহলে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ বইতে মেজো বউরানীর পার্ট করলাম, তখন বিরুদ্ধ সমালোচনা হয়েছিল বৈকি। কেউ কেউ এ মন্তব্যও করেছিলেন, ‘তুমি কি শেষে তোমার বউকে স্টেজে নামাবে নাকি?’ উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘আমি এখনও মরিনি। আমার স্ত্রী কি করবেন না করবেন সে দায়িত্ব আমার উপরে ছেড়ে দিলেই সুখী হব। আর, এ তো সামান্য একটা ক্লাব থেকে থিয়েটার। যদি তাঁর ইচ্ছে থাকে-সিনেমাতে অ্যাকটিং ক’রতে দিতেও আমার আপত্তি হবে না।’ 

কবির সেই বজ্রগম্ভীর স্বর শুনে আমি নিজেও সেদিন কম অবাক হইনি। তাঁর সে চেহারা চোখ বন্ধ করলে আজও আমার সামনে ভেসে ওঠে। 

একটি জায়গায় শুধু তাঁর ভীষণ আপত্তি ছিল। সেটি হচ্ছে-অসুস্থ শরীরে আমার পড়াশুনো করা। 

বঙ্গ বিভাগের পরে যখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করলাম, তখন পড়াশুনো অথবা চাকরী-দুটোর একটা করব বলেই ঠিক করলাম। কিন্তু কোনটাতেই কবির মত পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে আমাকে কিছুদিন চুপ করে ঘরে বসেই কাটাতে হ’ল। শেষে আর বসে থাকতে না পেরে আমি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে বি টি পড়তে গেলাম। 

কিছুদিন আগেই ‘অ্যানজাইনা’ রোগটি আমার শরীরের উপর দিয়ে তার প্রথম আক্রমণপর্ব চালিয়ে গিয়েছে। জের তখনও ভালভাবে কাটেনি। কাজেই, কবির বাধা ঠেলে ভর্তি হবার কাজটা খুব সহজ হয়নি। 

অসুখটা হবার ফলে তাঁর একটা ধারণা হয়েছিল যে, আমার পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎই একদিন সকলকে ফাঁকি দিয়ে আমি চলে যাব। সেজন্য সর্বদাই বলতেন, ‘তুমি রাস্তাঘাটে যত খুশী দৌড়ে বেড়াও-আপত্তি করব না। শুধু গলায় একটা চাকতি ঝুলিয়ে রেখো।’ 

আমি যখন চটে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতাম, তিনি তখন আর একদিকে ফিরে আস্তে আস্তে বলতেন- ‘না, চাকতিটা থাকলে মর্গ থেকে চিনে বে’র করতে অসুবিধে হবে না। এই আর কি।’ 

কথাটা শুনে আমি আর কিছুই বলতে পারতাম না- শুধু তাঁর দিকে তাকিয়েই থাকতাম। আজ কেবলই মনে হয় আমাকে মর্গ থেকে আনবার ভয়েই তিনি তাড়াতাড়ি আমার চোখের আড়ালে চলে গেলেন? 

যাই হোক—বি টি কলেজে ভর্তি তো হলাম। কোর্সটা হ’ল ন’ মাসের। কিন্তু চার মাসেরও বেশি আমি দুর্বলতার জন্য বিছানাতেই শুয়ে রইলাম। সুস্থ হয়ে যেদিন কলেজে রওনা হচ্ছি–কবি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘শোন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? যদি কলেজ যাও, তবে আমি এখুনি প্রিন্সিপালের কাছে চিঠি পাঠাব কলেজের খাতা থেকে তোমার নামটা বাদ দেবার জন্য। তিনি যদি আমার কথা না শোনেন, তবে আমি তাঁর নামে কেস করব।’ 

আমার তখন মনে দারুন চিন্তা-এত ক্ষতি হল, কী করে পাস ক’রব। কাজেই তাঁর কথা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রেগে গিয়ে বললাম—‘বেশ তো চেষ্টা করে দেখতে পার। কিন্তু তার আগে তোমার কবিতার খাতা সামলিও। আমার নাম কাটার সঙ্গে সঙ্গে তোমার কবিতার খাতাও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’ কথা শেষ করেই আমি কলেজে চলে গেলাম। যতক্ষণ দেখা গেল—দেখলাম, তিনি আমার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। 

কবিকে নিয়ে মুশকিল বাধল রেজাল্ট বের হবার দিন। সেদিন কোথায় গেল তাঁর কবিতা লেখা আর কোথায়ই বা কাজকর্ম। সকাল থেকে কেবলই বারান্দায় অস্থিরভাবে ঘুরছেন আর বলছেন—‘দেখ, তুমি কিন্তু বেশী কান্নাকাটি করতে পারবে না। একে তো তোমার দুর্বল শরীর, তার উপরে যদি কাঁদতে শুরু কর- তবে তোমাকে বাঁচানই যাবে না।’

আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছি- ‘কাঁদব কেন? কি এমন কারণ ঘটল, যার জন্য আমাকে কাঁদতে হবে?’ 

তিনি আমতা আমতা করে বললেন- ‘এই, বলছিলাম আর কি, আজ তো রেজাল্ট বের হবে। তাছাড়া এত অসুখে ভুগে তুমি তো আর পড়াশুনা করবার সময় পাওনি- পাস করাটা কি তোমার পক্ষে সম্ভবপর?’ 

‘এ তো আচ্ছা লোকের পাল্লায় পড়লাম। স্ত্রীর যাতে নাম হয়, লোকে তার জন্য কত কিছু করে। তোমাকে দিয়ে তো সে সব কিছু হলই না। উল্টো পরীক্ষা দেবার পর থেকেই শুরু করেছ যে আমি ফেল করবই। পাস করতে পারি-এ কথাটা ভুলেও একবার মনে করতে পার না?’ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই কথাগুলি কবিকে শুনিয়ে দিলাম। 

আমার কথা শুনে তিনি খুব দুঃখের সঙ্গেই বললেন, ‘শুধু সান্ত্বনা দেবার জন্যেই এতবড় মিথ্যে কথাটা তোমাকে বলি কি করে? যদি কলেজটাও পুরোপুরি অ্যাটেন্ড করতে পারতে, তাহলেও না হয় পাসের কথা ভাবা যেত। সবকিছু জেনেও আমি কেমন করে ভাবব যে, তুমি পাস করবে?’ 

সমস্তটা দিন তিনি নিজেও কোন কাজ করলেন না, আমাকেও রেহাই দিলেন না। পাস করব না ভেবে আমি নিজে যে একটু মন খারাপ করব সে সুযোগই পেলাম না। 

সেই সময়ে আমার ছোট-জা শ্রীমতী নলিনী দাশ (এখন বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল) ডেভিড হেয়ারে অধ্যাপিকার পদে ছিলেন। বিকেলের দিকে তিনি আমার নামে একখানি চিঠি দিয়ে একটি লোককে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। 

তখনকার অবস্থা অবর্ণনীয়। কবি দৌড়ে এসে চিঠিখানা ছোঁ মেরে নিয়েই লোকটিকে বিদায় করে দিলেন। তারপরে–নিজেও চিঠি খুলবেন না–আমার হাতেও দেবেন না। কবির অবস্থা দেখে আমি হাসব কি কাঁদব কিছুই বুঝতে পারছি না। 

অনেকক্ষণ পরে তিনি চিঠিটা একটুখানি খুলে দেখেই হাসিমুখে আমার হাতে দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল যেন পরীক্ষাটা আগে দিইনি, এতক্ষণ ধরে কবির সামনে বসেই দিলাম। 

তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম চিঠিতে আর যা-ই থাক না কেন, ফেলের সংবাদ নেই। থাকলে কবিকে সামলানোই দায় হত। চিঠি পড়ার পরে আবার তাঁর উল্টো কথা শুরু হল। ‘হ্যাঁ, তুমি কি যাদু জান? তা না হলে-’ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কবি যে অদ্ভুত মনোবল, অপরিসীম ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন-তা সত্যিই অতুলনীয়। আমার দেওর (কবির খুড়তুতো ভাই) ডাক্তার অমল দাশ আমাকে কতবার বলেছে, ‘বৌদি, দাদা যে কি সাংঘাতিক যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করছেন সেটা মানুষের কল্পনাতীত।’ কিন্তু এই মানুষই আমাদের ব্যথা বেদনায় কতটা ব্যাকুল হয়ে পড়তেন–আমাদের সামান্য অসুখে কতখানি বিচলিত হতেন, তারই দু-একটি ঘটনা বলছি। 

তখন আমরা বরিশালে ছিলাম। আমার ছেলে সমর (খোকন) সবে দু’বছরের শিশু। একদিন আমাদের পাশের বাড়িতে তারই সমবয়েসী এক খুড়তুতো ভাই-এর সঙ্গে খেলা করবার সময় পড়ে গিয়ে তার মাথার অনেকটা জায়গাই কেটে যায়। সে বাড়ির ঝি এসে আমাকে খবরটা দিতেই আমি ছুটে সেখানে চলে গেলাম। 

গিয়ে দেখি সমর বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মাথার রক্তে তার মুখ ভেসে যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে কান্নার সঙ্গে ছোট্ট দু’খানি হাত দিয়ে রক্ত ঠেকাতে গিয়ে সে হাঁফিয়ে উঠছে। আমি তাকে কোলে তুলে নিয়েই এক ছুটে সোজা আমাদের স্নানের ঘরে ঢুকে তার মাথাটা নীচু করে ধরে অনবরত জল ঢালতে লাগলাম। মাথা নিচের দিকে করাতে ছেলেও তার স্বরে চীৎকার শুরু করল। হঠাৎ পিছন থেকে কবির আর্তস্বর শুনতে পেলাম, ‘মরে যাবে, ছেলেটা এখুনি মরে যাবে। শিগির ওর মাথা সোজা কর। তোমাকে এ ডাক্তারি কে শেখাল।’ 

আমি মাথা না তুলেই উত্তর দিলাম–আমার ডাক্তারি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি আসল ডাক্তারকে ডাকার ব্যবস্থা কর। 

আমার কথা শুনতে পেয়ে বাড়ির চাকরটি দৌড়ে গিয়ে কবির বাল্যবন্ধু ডাক্তার অমল ঘোষকে ডেকে নিয়ে এল। ইঁটের আঘাতে মাথা কেটেছে শুনে প্রথমেই তিনি ইঁটের কুঁচি আছে কিনা সেটা ভালভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপরে কবিকে বললেন, ‘সেলাই করতে হবে। তুই খোকনকে কোলে নিয়ে বোস।’

ব্যাস-কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কবি ঘর থেকে উধাও। তাঁকে কোথাও দেখতেই পাওয়া গেল না। তখন আমিই ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলাম। ডাক্তার সেলাই করলেন। প্রায় দশ মিনিট পরে দেখলাম–কবি জানালা দিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে ডাক্তারকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করছেন,-–’কখন সেলাই করবি?’ ডাক্তারও হেসে উত্তর দিলেন, ‘সূচসুতো নিয়ে তোর অপেক্ষাতেই বসে আছি। তুই এলেই সেলাই করে ফেলব।’ ছেলের মাথায় ব্যাণ্ডেজ দেখে তবে কবি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর এই দুর্বলতার জন্য অবিশ্যি তাঁকে অনেক কথাই শুনতে হল, কিন্তু ছেলের দিকে তাকিয়ে সব কিছুই তিনি হাসিমুখে মেনে নিলেন। 

আমার মেয়ে মঞ্জুশ্রী যখন খুব ছোট, তখন তার একবার আমাশা হয়েছিল। কিছুতেই সারে না। এদিকে মেয়ে তো দারুন দুর্বল হয়ে পড়ল। শেষে এমন হল যে কিছুতেই আর বিছানায় শুতে চায় না। কেবলই বলত- ‘কোলে শুয়ে ঘুরব।’ সে কাজ আমার দ্বারা হত না। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি কবির ধৈর্য দেখে। মেয়েকে কাঁধের উপরে শুইয়ে রাতের পর রাত তিনি ঘরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতেন। একটু ক্লান্তি বোধ করতেও কোনদিন দেখিনি। 

এসব কথা লিখতে গিয়ে আজ কেবলি মনে হচ্ছে–আমাদের সামান্য অসুখেও যাঁর এত চিন্তা ছিল, আমাদের ব্যথা বেদনায় যিনি এতটা অধীর হয়ে পড়তেন–তিনি আজ কোথায়? সত্যিই কি তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমাদের একেবারেই ভুলে যেতে পেরেছেন? না-কি অন্য কোথাও জন্ম নিয়েছেন? 

কিন্তু তাঁর আবার জন্মাবার কথা চিন্তা করতে যাওয়াটাও আমার পক্ষে অসহ্য। কিছুদিন আগে কবির এক ছাত্র আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা প্ল্যানচেটের সাহায্যে স্যারের আত্মা এনেছিলাম। পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছে তিনি প্রকাশ করেছেন।’ 

একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা সত্যিই বড় বেশী স্বার্থপর। আমাদের প্রিয়জন পরলোকে চলে গেলেও আমরা তাঁদের মন থেকে বিদায় দিতে পারি না। কল্পনার ভিতরেও যতক্ষণ পারা যায় আঁকড়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করি। তাঁরা অন্যরূপে আবার পৃথিবীতে আসবেন–কথাটা ভাবতে গেলেই যে আমাদের সে কল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটে, তাইতো আমরা সে চিন্তা মনেও আনতে পারি না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *