ষাট
গুলি হতেই আর সবার মতই প্রাণভয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে বিলিয়নেয়ার লো হুয়াং লিটন। তার উদ্দেশ্য আলাদা। ছুটছে অন্যদিকে। প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি বেয়ে নেমে ক’জন পুলিশ অফিসারকে পাশ কাটিয়ে পৌছে গেল নিচতলায়।
এ ঘরের দরজা পাহারা দেয়ার কথা নকল হিমুরার, কিন্তু কোথাও নেই ওটা। খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করল না হুয়াং, বাইরে যাওয়ার দরজা খুলে ঢুকল পার্কিং লটে।
ভিআইপি লট-এ রয়েছে লিমাযিন। ওদিকে পা বাড়িয়েও থমকে গেল সে। ওই গাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ অফিসাররা। খোলা হলো ড্রাইভিং দরজা। সিট থেকে টান দিয়ে মেঝেতে ড্রাইভারকে ফেলল এক অফিসার। দু’হাতে আটকে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফ।
ঘুরে অন্যদিকে চলল লো হুয়াং। বুঝে গেছে, যে-কোনও সময়ে ধরা পড়বে সে। সহজ হবে না পালিয়ে যাওয়া। তখনই মনে পড়ল, বাইরে গাড়িতে রানা রোবটের জন্যে অপেক্ষা করবে হিমুরা আর সোহেল আহমেদের রোবট। ওগুলোর নির্দেশ ওভাররাইড করতে পারবে সে ভয়েস কমাণ্ড ব্যবহার করে।
প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে পুলিশের গাড়িটা খুঁজতে লাগল বিলিয়নেয়ার। ওটা আছে বেরোবার পথের কাছেই। মাথার ওপর দপ-দপ করে জ্বলছে পুলিশের নীল বাতি। খুশি হলো হুয়াং। ওই গাড়িতে চেপে চলে যেতে পারবে।
ধীর পায়ে গাড়ির দিকে চলল সে। কাড়তে চাইছে না কারও মনোযোগ। সেডানের পেছন দরজা খুলে উঁকি দিল ভেতরে। আগের নির্দেশ মতই ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সোহেল আহমেদের নকল। তবে কোথাও নেই পুলিশ অফিসার হিমুরা। তাতে কোনও ক্ষতি হয়ে যায়নি।
পেছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করল লো হুয়াং লিটন। ‘পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে যাও। সোজা যাবে ফ্যাক্টরিতে।’
একবার কপ্টারে উঠতে পারলে একঘণ্টায় পেরোতে পারবে জাপানি আকাশ সীমা। তারপর কে ধরে তাকে!
গাড়ির গিয়ার ফেলল নকল সোহেল। এগোতে শুরু করেও থেমে গেল। ‘ভাড়া কি নগদে দেবেন না বাকি?’
‘কী?’
‘ট্র্যান্সপোর্টেশন প্রোগ্রাম অনুযায়ী নগদ দিতে হবে।’
ভুল শুনছে, ভাবছে হুয়াং। রোবটের কণ্ঠস্বর আড়ষ্ট। ভাল কাজ দেখাতে পারেনি সাবেলা। কড়া সুরে বলল সে,
ওভাররাইড করো সব প্রোগ্রাম। আমাকে পৌঁছে দাও এনসিআর ফ্যাক্টরিতে। দেরি করবে না!’
পুরনো টিভির মত আওয়াজ বেরোল রোবটের স্পিকার থেকে: ‘ইন্সট্রাকশন এরর… এরর… কমপিউট করতে… পারছি না… পারছি না… এরর…
‘আমি লো হুয়াং লিটন,’ ধমকে উঠল বিলিয়নেয়ার। ‘সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছি তোমাকে!’
সামনের সিটের রোবট ঘুরল তার দিকে। হাতে পিস্তল! চওড়া হাসি দিল সোহেল। এবার স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘তুমি আমার বস নও, হুয়াং। আমি সোহেল আহমেদ।’
কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ল বিলিয়নেয়ার। খপ্ করে ধরল দরজার হ্যাণ্ডেল। কিন্তু তখনই গাড়িটা ঘিরে ফেলল একদল পুলিশ অফিসার। নেতৃত্বে সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরা। সঙ্গে মাসুদ রানা।
বাইরে থেকে হ্যাণ্ডেল খুলে কলার চেপে ধরে হুয়াংকে হ্যাঁচকা টানে বের করল রানা। নরম সুরে বলল, ‘বুঝলে, হুয়াং, কাজের নয় তোমার রোবট। একদম বাজে জিনিস।’
.
শাংহাই-এ যেইন নিং-এর অফিসের টিভিতে জাপানি ওই দুর্ঘটনার লাইভ দেখেছে লিউ ফু-চুং। বারবার দেখানো হচ্ছে একই দৃশ্য। শ্বাসরুদ্ধ স্বরে তথ্য দিচ্ছে ধারাভাষ্যকাররা। বিলিয়নেয়ার হুয়াঙের যন্ত্র-মানবের মুখোশ মাসুদ রানা টেনে খুলে দিতেই চমকে গেছে দুনিয়ার মানুষ।
যথেষ্ট দেখেছে ফু-চুং। ‘লাও-শি, ক্ষমতার লোভে বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন আপনি,’ বলল ও।
হেলিকপ্টার থেকে তোলা ভিডিয়োতে দেখা গেল ঘিরে ফেলা হয়েছে প্যাভিলিয়ন ভবন। চারপাশে গিজগিজ করছে পুলিশ অফিসার ও মিলিটারির সদস্যরা। উপায় নেই যে পালিয়ে যেতে পারবে লো হুয়াং লিটন।
‘আর উপায় ছিল না,’ আনমনে বলল বৃদ্ধ রাজনীতিক, ‘নইলে আমেরিকার খপ্পর থেকে বের করা যেত না জাপানকে।’
‘একবার ভেবেছেন, এসব করে কোথায় নামিয়েছেন মহাচিনকে?
‘ওসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, ছোকরা!’ কড়া গলায় বলল নিং। ‘সব দায় আমি আর লো হুয়াং মাথা পেতে নিলেই মিটে যাবে সব। এবার যাও তো, কয়েক মিনিট শান্তিতে থাকতে দাও।’
‘সাগরতলের খনিতে আপনারা কী ধরনের অপারেশন করেছেন, আর কী করেছে লো হুয়াং লিটন— প্রতিটি ফাইল বুঝিয়ে দেবেন আমাকে,’ উঠতে উঠতে বলল ফু-চুং।
‘পাবে সবই,’ বলল বৃদ্ধ। ঘুরে তাকাল টিভি স্ক্রিনের দিকে। হারিয়ে গেছে উঠে দাঁড়াবার শারীরিক ও মানসিক শক্তি। বিড়বিড় করল, ‘অনেক বয়স। এবার বিদায় নেয়াই ভাল।’ পাশের ড্রয়ার থেকে কালো একটা কৌটা নিল সে।
লোকটা কী করবে বুঝে গেছে ফু-চুং। বাধা না দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে এল বাইরের ঘরে। যে যা করে, তার দায় তাকেই নিতে হয়। করিডোরে পা রাখার আগে গার্ডদের উদ্দেশে বলল ফু-চুং, ‘বিরক্ত করবে না লাও-শিকে। দীর্ঘ বিশ্রামে যাচ্ছেন তিনি।’
মাথা দুলিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল দুই গার্ড।
ছয়টি লাল বড়ি গিলে চেয়ারে হেলান দিল নিং। মাত্র নয় সেকেণ্ডে ঘুমিয়ে পড়ল চিরকালের জন্যে।
নিজেদের অফিস লক্ষ্য করে হেঁটে চলেছে ফু-চুং। আজকের ঘটনায় চেপে গেছে ওর কাঁধে নানান ধরনের জরুরি কাজ।